তুমি পিশাচ – ১

এক

আমার চলার কোনও শেষ নেই৷ আমি সত্যিকারের পথিক—পথই যার জীবন৷ আমার চলার পথের যেমন কোনও শেষ নেই, তেমন আমারও কোনও শেষ নেই৷ এমনই আমার জীবন৷

মানুষের সঙ্গে আমার মিল অনেক—কিন্তু আবার গরমিলও প্রচুর৷ আমি মানুষের মনের কথা বুঝতে পারি৷ তাই বুঝতে পারি মানুষ কেমন হয়৷ অর্থাৎ, মানুষের মন আর চেহারা দুই-ই দেখতে পাই৷ কিন্তু আমাকে কেউ দেখতে পায় না—শুধু অনুভব করতে পারে৷

মানুষ আমার খুব পছন্দের, খুব প্রিয়৷ তাই মানুষ দেখলে আমি কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়ি৷ এক অদ্ভুত টানে দু, তিন, কিংবা চার টুকরো হয়ে নানান মানুষের ভেতরে আশ্রয় নিই৷ তাই আমার বাসা হল মানুষ—মানুষই আমার ঠিকানা৷ কারও মধ্যে আমি পঞ্চাশ, ষাট কি একশো বছর ধরে থাকি৷ আবার কারও শরীরে থাকি পাঁচ, সাত কি দশ দিন৷ কতদিন কোথায় থাকব সেটা নির্ভর করে আমার মরজির ওপরে৷

যে-যে মানুষের মধ্যে আমি আশ্রয় নিই তাদের মধ্যে অনেকগুলো নতুন-নতুন গুণ দেখা যায়৷ কিন্তু সেই গুণগুলো হয়তো মানুষের চোখে দোষ৷ তাই আমি খুব চেষ্টা করি গুণগুলো আড়াল করে রাখতে৷

কী আশ্চর্য আমার জীবন! মানুষের এত কাছাকাছি আমি বাস করি অথচ তা সত্ত্বেও মানুষ আমাকে ভাবে অমানুষ৷ আমাকে কিছুতেই আপন করে নিতে পারে না৷

আমি জানি, এক ঠান্ডা গভীর অন্ধকার থেকে আমার উৎপত্তি৷ তারপর পথ চলা৷ শুধু পথ চলা৷ আমার বিনাশ বলে কিছু নেই৷ মানুষ আমাকে কখনও-কখনও ধ্বংস করে বটে, কিন্তু তা নিতান্তই সাময়িক৷ তখন আমি ফিরে যাই সেই ঠান্ডা অন্ধকার গহ্বরে৷ শীতঘুমে সময় কাটিয়ে দিই৷ তারপর…

তারপর? তারপর যখন আবার খিদে টের পাই, তেষ্টা টের পাই, মানুষের টান টের পাই—তখন আমি জেগে উঠি৷ শীতঘুম ছেড়ে বেরিয়ে আসি বাইরের আলোর জগতে, লোকালয়ে৷ যেমন এখন৷

ওই তো চোখে পড়ছে একটা বিশাল পাঁচিল ঘেরা এলাকা৷ তার ভেতরে, অনেকটা দূরে, একটা বাড়ি৷ বাড়ি তো নয়, যেন প্রাসাদ৷ না, শুধু প্রাসাদও নয়—তার সঙ্গে রয়েছে ছোট-ছোট কয়েকটা বাড়ি আর ঘিরে থাকা বাগান৷ বাগানে কত বড়-বড় গাছ৷ গাছে কত পাতা৷ সেই পাতার ছায়ায় গাছের নীচটা দিনের আলোতেও অন্ধকার-অন্ধকার দেখাচ্ছে৷ আর সেই অন্ধকারে মাথাচাড়া দিয়েছে অজস্র আগাছা৷

প্রকাণ্ড এলাকাটা রং-চটে-যাওয়া পাঁচিল দিয়ে ঘেরা৷ তারই এক জায়গায় সিং-দরজা৷ সব কিছু দেখে মনে হয় রাজা-রাজড়াদের ফেলে যাওয়া বাগান আর প্রাসাদ৷ এককালে তাদের হাতিশালে হাতি ছিল, ঘোড়াশালে ঘোড়া৷ আজ সবই পুরোনো স্মৃতি৷ শুধু রাজবাড়িটা অতীতের সাক্ষী হয়ে চুপচাপ মনের দুঃখে দাঁড়িয়ে আছে৷ আর তাকে ঘিরে বিষণ্ণ গাছগুলো৷

কিন্তু তাই কী? এখানে এখন কেউ থাকে না তা তো নয়!

কারণ, আমি মানুষের ঘ্রাণ পাচ্ছি৷ একটা-আধটা নয়, অনেক মানুষের৷

শুধু তাই নয়, এত দূর থেকেও আমি কত মানুষের কথা শুনতে পাচ্ছি৷ শুনতে পাচ্ছি ছেলেদের গলা, মেয়েদের গলা৷

উঁহু, বাড়িটা পুরোনো জীর্ণ হলেও এখানে অনেক মানুষ থাকে৷ আমাকে ওরা কোনও অদৃশ্য টানে টানছে—কাছে টানছে৷

আমি আকাশের দিকে তাকালাম৷

আকাশে মেঘ জড়ো হচ্ছিল সকাল থেকেই৷ তার সঙ্গে দম আটকানো গুমোট৷ বৃষ্টি যে হবে তার গন্ধ আমি পাচ্ছিলাম৷ এও বুঝতে পারছিলাম, মেঘ আরও ঘন হবে, আরও কালো হবে৷ এখন দেখলাম আকাশটা একেবারে ছাই রঙের হয়ে গেছে৷ আর সেই রং-টা ক্রমশ কালোর দিকে ঢলে পড়ছে৷

বৃষ্টির জল আমার ভালো লাগে না৷ বৃষ্টির জল ওপর থেকে আসে৷ প্রাকৃতিক পবিত্র জল৷ ওই জল গায়ে লাগলে আমরা—মানে, আমি আর আমার মতো যারা—নিস্তেজ হয়ে পড়ি৷ তাই ঠিক করলাম, আপাতত এই বাড়িটায় আমি আশ্রয় নিই৷ অনেক মানুষে ভরা এই আস্তানাটা আমার মন্দ লাগবে না৷

সেদিকে এগোতে গিয়েই সিং-দরজার মাথায় বসানো হোর্ডিং-টা আমার চোখে পড়ল৷ তাতে বড়-বড় হরফে লেখা রয়েছে :

রাজা চন্দ্রভানু মালটিপারপাস গার্লস স্কুল

ও, এটা তা হলে স্কুল!

ওঃ, ক’শো বছর আগে যে আমি স্কুলে পড়তে গিয়েছিলাম তা মনে নেই৷ কিন্তু যুগে-যুগে আমি মানুষের কাছ থেকে শিখেছি৷ যখনই আমি কোনও মানুষের শরীর আর মন দখল করেছি তখনই তার সব অভিজ্ঞতা আর জ্ঞান আমার অস্তিত্বে মিশে গেছে৷ আমি বহু শতকের প্রাচীন হলেও সবসময় নবীনের কাছাকাছি থেকে শিখেছি৷ তাই প্রাচীন হলেও আমি সবসময় আধুনিক৷

এখনও চিনতে পারোনি আমাকে?

আমি একজন পিশাচ—যার মধ্যে রয়েছে অতি প্রাচীন এক অমানুষ প্রেতাত্মা৷

আমি একা৷ তবে ইচ্ছে হলেই অনেক হতে পারি—অ্যামিবার মতো৷

আর যদি আমি তোমার ওপরে ভর করি, তোমার মধ্যে বাসা বাঁধি, তা হলে তখন তুমি পিশাচ৷ হ্যাঁ, হ্যাঁ—তুমি৷

আকাশ থেকে বৃষ্টির দু-একটা ফোঁটা পড়ল৷

নাঃ, আর দেরি নয়৷ আমি সিং-দরজার দিকে এগোলাম৷ তালাবন্ধ দরজার জং ধরা লোহার রডের ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম৷ দারোয়ানরা কেউ আমাকে দেখতে পেল না—কারণ, আগেই বলেছি, আমাকে দেখা যায় না—শুধু টের পাওয়া যায়৷

সুন্দর পিচবাঁধানো রাস্তা আর ঘাসজমির ওপর দিয়ে প্রাচীন বাড়িটার দিকে যাওয়ার সময় আমি হঠাৎই একটা চেনা গন্ধ পেলাম৷ স্কুলবাড়ির দিক থেকেই আসছে গন্ধটা৷

চমকে উঠলাম আমি৷ এ তো আমার মতোই গন্ধ! আমার একজন বন্ধু তা হলে রয়েছে ওই স্কুলবাড়িতে! আমার আগেই আমার মতো কেউ এসে আশ্রয় নিয়েছে এখানে! অথবা আস্তানা গেড়েছে ওই বাড়ির মানুষজনের ভেতরে! আনন্দ আর খুশিতে মনটা নেচে উঠল৷

বৃষ্টির ফোঁটা হঠাৎই জোরে ঝরতে লাগল৷

আর আমিও দেরি না করে ঢুকে পড়লাম স্কুলবাড়ির ভেতরে৷

দুই

ইতিহাসের ক্লাস এমনভাবে চলছিল যেন টিভির নিউজ চ্যানেলে কোনও রোবট পরপর দুঃখের খবর পড়ে চলেছে৷

রনিতা ম্যাডাম এভাবেই ক্লাস নেন বরাবর৷ আর সেই জন্যই পড়ার দিকে ইলিনার মন ছিল না৷ ও অনুষ্কার কথা ভাবছিল৷ মাত্র সাতদিন হল অনুষ্কা ওদের ক্লাসে ভরতি হয়েছে৷

ইলিনার ডেস্কের ওপরে ইতিহাস বইয়ের পাতা খোলা ছিল৷ তার নীচে একটা রাফ খাতা৷ সেই খাতার শেষ পাতায় ইলিনা বারবার নিজের নাম লিখছিল৷ একবার ইংরেজিতে, আর-একবার বাংলায়৷ বেশ সুন্দর ডিজাইন করে অক্ষরগুলো তৈরি করছিল ও৷ সেগুলোর দিকে একবার তাকালেই বোঝা যায় ওর অলঙ্করণের হাত বেশ ভালো৷

ইলিনার খুব শখ ও ট্যাটু আর্টিস্ট হবে৷ এ পর্যন্ত ও প্রায় চল্লিশটা ট্যাটুর ডিজাইন এঁকেছে—লাল আর নীল কালি দিয়ে৷ সেগুলো একটা বাঁধানো ড্রইং খাতায় আঁকা আছে৷ সেটার ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে ওর নিত্য-নতুন নকশার আইডিয়া মাথায় আসে৷

মাঝে-মাঝে ও বন্ধুদের হাতে বা পায়ে বলপয়েন্ট পেন দিয়ে ছোট-ছোট ট্যাটু এঁকে দেয়৷ অবশ্য বন্ধুদের পারমিশান নিয়ে তবেই৷ একবার গীতাঞ্জলির কনুইয়ের ওপরদিকটায় একটা বাজপাখির ডিজাইন এঁকে দিয়েছিল৷ সেটা রনিতা ম্যাডামের চোখে পড়ে গিয়েছিল৷ গীতাঞ্জলিকে তিনি বেশ বকুনি দিয়েছিলেন৷ কিন্তু গীতাঞ্জলি ইলিনার নাম বলেনি৷ বরং ট্যাটু আঁকার দায়টা ওর এক কাল্পনিক ভাইয়ের ওপর দিয়ে চালিয়ে দিয়েছিল৷

ইলিনার নামের অক্ষরের ডিজাইনগুলো অনেকটা ট্যাটুর ডিজাইনের মতো দেখাচ্ছিল৷ সেদিকে তাকিয়ে ইলিনা সেগুলো বেশ খুঁটিয়ে বিচার করছিল৷ হঠাৎই ক্লাসরুমের খোলা জানলায় একটা শালিখ এসে বসায় ওর সেদিকে চোখ গেল৷

ক্লাসরুমের বাইরের দিকের দেওয়ালে দুটো বড়-বড় জানলা৷ তাতে ঝিলমিল লাগানো বিশাল পাল্লা৷ পাল্লার ওপরে ফুটদুয়েক চওড়া ঝিলমিল বসানো কাঠের পাটি৷ বহু পুরোনো আমলের রাজা-রাজড়াদের বাড়িতে যেমন থাকত৷ রাজা চন্দ্রভানুও বোধহয় সেরকম কেউকেটা কোনও রাজা কিংবা মহারাজা ছিলেন৷ তাঁর সেই রাজপ্রাসাদ প্রায় একশো বছর আগে স্কুল হয়ে গেছে৷

শালিখ দেখতে গিয়ে ইলিনার চোখ গেল অনুষ্কার দিকে৷ মনে হল, ইলিনার মতো ওরও ইতিহাসে মন নেই, আর ও-ও যেন আনমনাভাবে খাতায় আঁকিবুকি কেটে চলেছে৷

অনুষ্কাকে কেমন অদ্ভুত বলে মনে হয় ইলিনার৷ মাত্র সাতদিন আগে মেয়েটা ক্লাস টেন-এ ওদের সেকশানে এসে ভরতি হয়েছে৷ ওর বাবা সরকারি চাকরি করেন৷ ঝাড়খণ্ড থেকে ট্রান্সফার হয়ে কলকাতায় এসে পড়েছেন৷ তাই অনুষ্কা এই স্কুলে ভরতি হতে পেরেছে৷ নইলে ইলিনাদের স্কুলে ক্লাস টেন-এ কাউকে ভরতি নেওয়া হয় না৷

অনুষ্কাকে দেখতে খুব সুন্দর৷ এত সুন্দর যে, অন্য মেয়েরা যখন-তখন ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে৷ ইলিনার খুব বিশ্বাস, কোনও ফিল্ম ডিরেক্টর ওকে দেখামাত্র সিনেমা কি টিভি-তে চান্স দিয়ে দেবে৷

রনিতা ম্যাডাম আনমনা অনুষ্কাকে খেয়াল করেছিলেন৷ তাই ওকে ‘শিক্ষা’ দেওয়ার জন্য ওর দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘অনুষ্কা, তুমি বলো..৷’

অনুষ্কা শান্তভাবে উঠে দাঁড়াল৷ নিষ্পাপ ফুটফুটে মুখে তাকাল ম্যাডামের দিকে৷

রনিতা ম্যাডাম ক্লাস নাইন-এর কয়েকটা চ্যাপ্টার রিভাইজ করাচ্ছিলেন৷ তাই সম্রাট অশোকের ধর্মের বিষয়ে পড়াচ্ছিলেন৷

অনুষ্কাকে রনিতা ম্যাডাম জিগ্যেস করলেন, ‘সম্রাট অশোক যে ধর্ম প্রচার করেছিলেন, বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে তার সূক্ষ্ম তফাত কোথায় ছিল?’

রনিতা ম্যাডামের রোগা চেহারা৷ চশমার পিছনে চোখ দুটো বেশ রাগি৷ কপালে ভাঁজ৷ সবসময় ছাত্রীদের হেনস্থা করেন, শাস্তি দেওয়ার ফিকির খোঁজেন৷

ইলিনা বুঝল, আজ অনুষ্কার রেহাই নেই৷ কপালে চূড়ান্ত বকুনি আছে৷ তারপর, যদি কপাল আরও খারাপ হয়, তা হলে ক্লাস সিক্সের রুমের সামনে গিয়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে৷

ইলিনার বুকের ভেতরটা অকারণেই ঢিপঢিপ করতে লাগল৷ ও স্থির চোখে অনুষ্কার দিকে তাকিয়ে রইল৷ অপেক্ষা করতে লাগল৷

কিন্তু কী আশ্চর্য!

অনুষ্কা মিষ্টি গলায় ধীরে ধীরে উত্তর দিল, ‘ম্যাডাম, বৌদ্ধধর্মের তুলনায় অশোকের প্রচার করা ধর্ম অনেক বেশি উদার আর মানবতাবাদী ছিল৷ অশোক তাঁর ধর্মে ব্যক্তিগত জীবন আর সমাজজীবনকে পরিশুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন৷ সেই কারণেই তিনি দান, দয়া প্রভৃতি বারোটি গুণের অনুশীলন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন৷ তাঁর প্রচলিত ধর্মে নানা ধর্মের সার কথাগুলো জায়গা পেয়েছিল…৷’

রনিতা ম্যাডাম কেমন যেন হকচকিয়ে গেলেন৷ শিকার হাতছাড়া হওয়ার দুঃখের চেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটাই বেশি করে ফুটে উঠল ওঁর মুখে৷ তিনি স্পষ্ট দেখেছেন, মেয়েটা অন্যমনস্ক হয়ে খাতায় কী যেন করছিল৷ তা হলে কী করে ওঁর এইমাত্র পড়ানো লাইনগুলো হুবহু বলে দিল!

অনুষ্কা কি ওঁর বলা কথাগুলো খাতায় টুকছিল? তারপর প্রশ্নের উত্তরে সেই লেখাগুলোই রিডিং পড়ে দিল?

কিন্তু উত্তর দেওয়ার সময় মেয়েটা তো খাতার দিকে তাকায়নি!

মরিয়া হয়ে ডায়াস থেকে নেমে এলেন রনিতা ম্যাডাম৷ মেয়েটার খাতাটা একবার দেখা দরকার৷

‘দেখি, তোমার খাতাটা দেখি—৷’ চটপটে পায়ে জানলার পাশ দিয়ে হেঁটে অনুষ্কার কাছে চলে এলেন৷

অনুষ্কা কোনও কথা না বলে ডেস্কের ওপরে রাখা খোলা খাতাটা দিদিমণির দিকে এগিয়ে দিল৷

রনিতা ম্যাডাম দেখলেন৷ পাতা দুটোয় কিছু লেখা নেই৷ শুধু ডানদিকের পাতার নীচের কোনার দিকে কয়েকটা হিজিবিজি দাগ৷

খাতাটা ওকে ফেরত দিয়ে সামান্য ধমকের সুরে ‘বোসো’ বলে ডায়াসের দিকে ফিরে গেলেন৷ ওঁর ফিরে যাওয়ার ভঙ্গিতে কেমন যেন একটা ‘হেরে যাওয়া’ ভাব ছিল৷

ইলিনার খুব আনন্দ হচ্ছিল৷ ওর মনে হল অনুষ্কা যেন রনিতা ম্যাডামকে পালটা একটা ‘শিক্ষা’ দিল৷ অনুষ্কাকে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করল ওর৷ ওর সঙ্গে জমিয়ে গল্প করতেও ইচ্ছে করল৷

কিন্তু সেটা বোধহয় সম্ভব নয়৷ কারণ, প্রথম দিন থেকেই ইলিনা লক্ষ করেছে, অনুষ্কা ভীষণ একা-একা আর চুপচাপ থাকে—কারও সঙ্গে মিশতে চায় না৷ ইলিনা দু-একবার আলাপ জমানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু কথাবার্তা তেমন এগোয়নি৷

রনিতা ম্যাডাম মঞ্চে উঠে আবার পড়াতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু ওঁর যান্ত্রিক আত্মবিশ্বাসে কেমন যেন চিড় ধরে গিয়েছিল৷ তাই পড়ানোর তাল আর লয় বারবার গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল৷

ইলিনা ভাবছিল, পিরিয়ডটা শেষ হলে বাঁচি৷ কারণ, তারপরই টিফিন৷ তখন অন্তত আধঘণ্টা হাঁফ ছেড়ে বাঁচা যাবে৷

আজ ওর পড়াশোনার মুড নেই৷ শুধু গল্প করতে ইচ্ছে করছে আর গান শুনতে ইচ্ছে করছে৷ কে জানে কেন—হয়তো আকাশটা মেঘলা বলেই৷ আর তার সঙ্গে ঝিরঝিরে বৃষ্টি মনখারাপের ইন্ধন জোগাচ্ছে৷

হঠাৎই টিফিনের ঘণ্টা পড়ল৷ টিফিনের ঘণ্টার একটা বিশেষ ঢং আছে৷ ছুটির ঘণ্টারও তাই৷ ঠিক ফুটবল খেলায় হাফটাইম আর গোলের বাঁশি বাজানোয় যেমন তফাত থাকে৷

ওদের স্কুলের ঘণ্টাটা দারুণ৷ একতলার বারান্দায় সিলিং থেকে ঝোলানো বড় পিতলের ঘণ্টা—ঠিক পূর্ণিমার চাঁদের মতো৷ বৃদ্ধ বলাইদা কাঠের হাতুড়ি দিয়ে সেই ঘণ্টাটা টাইমে-টাইমে বাজিয়ে দেয়৷ টিফিন হতেই গোটা ক্লাসটা স্বাধীন এবং এলোমেলো হয়ে গেল৷ কেউ-কেউ জানলার কাছে চলে গেল৷ আকাশ, বৃষ্টি আর গাছপালা দেখতে লাগল৷ বেশ কয়েকজন মেয়ে স্কুলব্যাগ থেকে টিফিনবক্স বের করে টিফিন খেতে বসল৷

আজ বৃষ্টির মধ্যে অন্য দিনের মতো একতলার উঠোনে কিংবা বাগানে গিয়ে ছুটোছুটি করে খেলার উপায় নেই৷ তাই অনেকে ক্লাসরুমের লাগোয়া করিডরে গিয়ে হইহুল্লোড় করতে লাগল৷

ইলিনা টিফিনবক্সটা ব্যাগ থেকে বের করে নিল৷ তারপর তাকাল অনুষ্কার দিকে৷

অনুষ্কা একটা খাতা খুলে তাতে মনোযোগ দিয়ে কী যেন লিখছিল৷ ওর দু-পাশে পারমিতা আর সুচন্দ্রা বসে৷ এখন ওরা কেউ সিটে নেই৷ বোধহয় টিফিন খেতে বাইরের করিডরে কোথাও গেছে৷

ইলিনার কেমন একটা জেদ চেপে গেল৷ আজ ও অনুষ্কার সঙ্গে আলাপ করবেই৷ গায়ে পড়ে হলেও ওর সঙ্গে আজ আলাপ করতে ভীষণ ইচ্ছে করছে৷

তাই ইচ্ছে আর জেদ সঙ্গী করে ও সরাসরি অনুষ্কার কাছে চলে গেল৷ ওর ডানপাশের খালি চেয়ারটায় ধপ করে বসে পড়ে বলল, ‘কী করছ?’

অনুষ্কা চোখ তুলে তাকাল ইলিনার দিকে৷

কী সুন্দর গভীর দুটো চোখ! টানা-টানা, ঘন চোখের পাতার সীমানায় ঘেরা৷ হঠাৎ করে দেখলে মনে হয় কাজল পরে এসেছে৷ ওর চোখের মণির ভেতরে চক্রের মতো অনেকগুলো বৃত্ত৷ সেগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় বৃত্তগুলো কোন পাতালে চলে গেছে৷

‘একা-একা বসে কী করছ?’ ইলিনা আবার জিগ্যেস করল৷

‘কিছু না৷’ নীচু গলায় অনুষ্কা বলল৷

ওর খাতার দিকে চোখ গেল ইলিনার৷ সেখানে অদ্ভুত একটা ছবি বারবার আঁকা—ছোট-বড় নানান মাপে৷ একটা ফুলকে ঘিরে দুটো সাপ—তাদের লেজের কাছটা একে অপরের সঙ্গে জড়ানো৷

দেখে কোনও একটা প্রতীকচিহ্ন গোছের ছবি বলে মনে হয়৷ অথবা কোনও ট্যাটুর নকশা৷

‘এটা কীসের ছবি?’ ছবিটার দিকে আঙুল দেখিয়ে জানতে চাইল৷

‘ও কিছু না…৷’

‘দারুণ হয়েছে কিন্তু৷ অনেকটা ট্যাটুর ডিজাইনের মতো৷ তুমি তো জানো আমি ট্যাটুর ডিজাইন আঁকি৷ খাতাটা পরে আমাকে দিয়ো—আমি ডিজাইনটা তুলে নেব৷’

কথাটা শুনেই শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল অনুষ্কা৷ কেমন একটা ভয়ের চোখে তাকাল ইলিনার দিকে : ‘না, না—এটা বাজে ছবি৷ এটার কোনও মানে হয় না৷ ওয়ার্থলেস—৷’

এ-কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্কা ছবিগুলোর ওপরে এলোমেলো কাটা-কুটি দাগ আঁকতে লাগল৷ ছবিগুলো নিপুণভাবে নষ্ট করতে লাগল৷

‘কী করছ! কী করছ! সুন্দর ছবিগুলো নষ্ট করছ কেন?’

কিন্তু অনুষ্কা ইলিনার কথায় মোটেই কান দিল না৷ কাটাকুটি দাগ কাটতে-কাটতেই বিড়বিড় করে বলল, ‘সুন্দর নয়, বাজে ছবি…বাজে ছবি…৷’

ইলিনা কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেল৷ ওর আলাপের শুরুটা এভাবে ধাক্কা খাবে ও ভাবেনি৷

প্রসঙ্গ পালটাতে ও টিফিনবক্স খুলে ফেলল৷ সঙ্গে-সঙ্গে ফ্রেঞ্চ টোস্টের জিভে-জল-আনা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল৷ মা-মণি টিফিনবক্সে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে৷ একটা খোপে চার পিস ফ্রেঞ্চ টোস্ট৷ তার পাশের খোপে একটা মিষ্টি৷ আর একটা ছোট পলিপ্যাকে টমেটো সস৷

‘এসো, আমার টিফিন শেয়ার করো…৷’

‘টিফিন?’ খানিক যেন দিশেহারা হয়ে ইলিনার দিকে তাকাল অনুষ্কা : ‘টিফিন তো আমার খাওয়া হয়ে গেছে…৷’

ইলিনা বেশ অবাক হয়ে গেল৷ স্কুল বসেছে সকাল এগারোটায়৷ তারপর, চারটে পিরিয়ড শেষ হলে এই টিফিন ব্রেক৷ সুতরাং টিফিন ব্রেকের আগে টিফিন খাওয়ার কোনও সুযোগ নেই৷ তাহলে অনুষ্কা এসব কী বলছে? ওর টিফিন খাওয়া হয়ে গেছে!

‘কখন টিফিন খেলে তুমি! আমাকে এত বোকা পেয়েছ!’ বন্ধুত্বে ভরা মজার সুরে বলল ইলিনা, ‘নাও, ফ্রেঞ্চ টোস্ট খাও! আমার মা-মণি ভেজে দিয়েছে—৷’

‘না, মানে…আমার ঠিক খিদে নেই৷’ নরম গলায় বলল, ‘প্লিজ, তুমি কিছু মাইন্ড কোরো না…৷’

অনুষ্কার মিষ্টি মুখে কাতর এক অনুনয় ফুটে উঠেছিল৷ সেদিকে তাকিয়ে ইলিনা আর কিছু বলতে পারল না৷ তবে একইসঙ্গে ওর মনে পড়ল এই ছ’দিনে অনুষ্কাকে ও কোনওদিন টিফিন খেতে দেখেনি৷ অর্থাৎ, অনুষ্কা টিফিন খাচ্ছে এমন দৃশ্য ওর চোখে পড়েনি৷

মুহূর্তের মধ্যে খটকাটা ডিঙিয়ে ও ফ্রেঞ্চ টোস্ট টমেটো সস-এ ছুঁইয়ে কামড় বসাল৷ খেতে-খেতে প্রসঙ্গ পালটে চলে গেল রনিতা ম্যাডামের দিকে৷

‘রনিতা ম্যাডামকে তুমি আজ দারুণ টাইট দিয়েছ৷ আমি ভাবতেই পারিনি তুমি ওই সাডেন অ্যাটাকের মুখে ওরকম ঠিক-ঠিক আনসার দিতে পারবে…৷’

‘উঁ৷’ বলে ছোট্ট একটা শব্দ করল অনুষ্কা৷

‘কী করে পারলে বলো তো!’ ইলিনা বলেই চলল, ‘ফ্যানট্যাস্টিক! তুমি যে ক্লাসে এত মনোযোগ দিয়ে শোনো সেটা তোমাকে দেখে কিন্তু বোঝা যায় না…৷’

অনুষ্কা শান্ত চোখে তাকাল ইলিনার দিকে৷ বলল, ‘মনোযোগ দিতে হয় না৷ আমাদের এমনিতেই সব মনে থাকে…৷’

ইলিনা ফ্রেঞ্চ টোস্টে কামড় দিতে গিয়ে থমকে গেল৷

‘আমাদের এমনিতেই সব মনে থাকে’ মানে?

সে-কথাই ও জিগ্যেস করল, ‘ ‘‘আমাদের’’ বলছ কেন? আমাদের মানে?’

চমকে উঠল অনুষ্কা৷ তাড়াতাড়ি শুধরে নিয়ে বলল, ‘আমাদের মানে আমার৷ আমার এমনিতেই সব মনে থাকে…৷’ কথা শেষ করে হাসল৷

ইলিনা অবাক চোখে অনুষ্কার দিকে তাকিয়ে রইল৷ একে তো অপরূপ সুন্দরী, তার ওপর এত গুণ! বাব্বাঃ! এমনিতেই সব মনে থাকে!

ভগবানের ওপরে রাগ হল ইলিনার৷ একজনকে উজাড় করে সবকিছু দেওয়ার কী দরকার ছিল? মনে থাকার ব্যাপারটা তিনি যদি কাইন্ডলি ইলিনাকে দিতেন তা হলে পরীক্ষার রেজাল্টটা অনেক ভালো হতে পারত৷ বাপি আর মা-মণির কাছ থেকে রেগুলার বকাবকি শুনতে হত না৷

জানলার ফ্রেমে বাঁধানো আকাশটা আরও কালো হয়ে গিয়েছিল৷ বিদ্যুৎ সেই কালোর ওপরে মাঝে-মাঝেই সাদা তরোয়াল ঘোরাচ্ছিল৷

ইলিনা সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখবে, ছুটির সময় ঠিক বৃষ্টি হবে৷ তুমি ছাতা এনেছ তো? আমি এনেছি…৷’

অনুষ্কা হাসল : ‘হ্যাঁ, এনেছি৷ ছাতা ছাড়া আমি চলতেই পারি না৷ তা ছাড়া বৃষ্টি আমার একদম ভালো লাগে না…৷’

‘কেন?’

বৃষ্টি পড়ছিল—তবে তেমন জোরে নয়৷ সেদিকে অপছন্দের চোখে তাকাল অনুষ্কা৷ বলল, ‘পরিবেশবিদরা বলেন, বৃষ্টির জলে অ্যাসিড থাকে…৷’

‘যাঃ, সে তো রেয়ার! তোমার এটা ভুল ধারণা—৷’

‘ভুল ধারণা হোক আর যা-ই হোক, বৃষ্টি আমার ভাল্লাগে না…৷’

মেঘের গর্জন শোনা গেল আকাশে৷

তিন

স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশান আর বেশি দূরে নেই—মাত্র দু-মাস বাকি৷ নাচ, গান, আবৃত্তি আর নাটকের রিহার্সাল শুরু হয়ে গেছে৷ স্কুলের যে-কোনও কালচারাল প্রোগ্রামে শম্পা ম্যাডাম আর কাকলি ম্যাডাম সবসময় দায়িত্ব নেন৷

শম্পা ম্যাডাম বেশ লম্বা, খুব সুন্দর নাচতে পারেন৷ আর সবসময় মুখে হাসি৷

কাকলি ম্যাডাম মাথায় খাটো৷ মোটাসোটা৷ মাথায় ঘন কোঁকড়ানো চুল৷ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারেন ফাটাফাটি৷ কিন্তু ওঁর ভীষণ ভূতের ভয়৷

ইলিনাদের কালচারাল প্রোগ্রামের রিহার্সাল হয় ফেস্টিভ্যাল হলে৷ হলটা বিশাল বড়৷ ওলটানো ‘ভি’ অক্ষরের মতো টিনের চালে ঢাকা৷ অনেক সময় ছোটখাটো প্রোগ্রাম হলে এই হলঘরটাতেই সেরে নেওয়া হয়৷ কিন্তু স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশান মানে ঘ্যাম ব্যাপার৷ তখন খেলার মাঠে প্রকাণ্ড প্যান্ডেল বাঁধা হয়৷

গত বছর ইলিনারা ফেস্টিভ্যাল হলে সন্ধেবেলা গানের রিহার্সাল দিচ্ছিল৷ কাকলি ম্যাডাম ওদের ‘চিত্রাঙ্গদা’-র গানগুলো তোলাচ্ছিলেন৷ তখন পাশের বাস্কেটবল গ্রাউন্ড থেকে অদ্ভুত এক শব্দ ভেসে এসেছিল৷

স্কুলের বাস্কেটবল গ্রাউন্ডটা বড় মাপের, কংক্রিট দিয়ে বাঁধানো৷ তার চারপাশটা লোহার জালের উঁচু রেলিং-এ ঘেরা৷ যখন খেলা-টেলা থাকে না তখন গ্রাউন্ডে ঢোকার লোহার গেটটায় তালা দেওয়া থাকে৷ সেদিনও তাই ছিল৷ তবুও সেখান থেকে ভেসে আসছিল খটখট-খটখট শব্দ৷ যেন অনেকগুলো টগবগে ঘোড়া বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের কংক্রিটের মেঝেতে পাগলের মতো ছুটে বেড়াচ্ছে৷

এরপর ওদের গানের রিহার্সাল ভন্ডুল হয়ে গিয়েছিল৷

ইলিনা স্কুলের কাজের মাসি আশাদির কাছে শুনেছে, এই স্কুলটাতে নাকি সাহেবি আমলে সৈন্যদের ছাউনি ছিল৷ স্কুলের বিশাল এলাকার নানান সব বিল্ডিং-এ সৈন্যরা থাকত৷ আর মেইন স্কুল বিল্ডিংটা ছিল হেস্টিংস সাহেবের কোয়ার্টার৷ একসময় হেস্টিংস রাজা চন্দ্রভানুকে এই বিশাল সম্পত্তি নামমাত্র দামে বিক্রি করে দেন৷

এই স্কুল ক্যাম্পাসে যে সন্ধেবেলা কখনও-সখনও ভূতুড়ে কাণ্ড শুরু হয় এমন দুর্নাম বরাবরই ছিল৷

কখনও মাঠের বড়-বড় গাছপালার ফাঁকে আলোর ফুটকি দেখা যায়৷ সেগুলো খসে পড়া তারার মতো ছুটোছুটি করে বেড়ায়৷

কখনও বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা যায়৷

একবার ক্লাস টেন-এর একটা মেয়ে দোতলার বারান্দা থেকে আর-একটা মেয়েকে নীচে লাফিয়ে পড়তে দেখেছিল—কিন্তু মেয়েটির পড়ার কোনও শব্দ শোনা যায়নি বা একতলায় ছুটে গিয়ে কোনও বডি পড়ে থাকতে দেখা যায়নি৷

কিন্তু এতসব গুজব, রটনা কিংবা দুর্নাম থাকলেও স্কুলটা যে এখনও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে তার কারণ পড়াশোনা৷ মাধ্যমিক পরীক্ষায় রাজা চন্দ্রভানু মালটিপারপাস গার্লস স্কুলের রেজাল্ট বরাবরই ঈর্ষা করার মতো৷

আজ অ্যানুয়াল ফাংশানের গানের রিহার্সাল চলছিল৷ কাকলি ম্যাডাম ছ’জনকে একসঙ্গে বসিয়ে একটা গান তোলাচ্ছিলেন৷ পাশে বসেছিলেন শম্পা ম্যাডাম আর রবিনা ম্যাডাম৷ রবিনা ম্যাডাম খুব ভালো আবৃত্তি করতে পারেন৷ ইলিনাদের প্রোগ্রামে সঞ্চালনা আর আবৃত্তির ব্যাপারটা তিনিই দেখাশোনা করেন৷ ম্যাডামের বয়কাট চুল আর মুখে কয়েকটা বসন্তের দাগ আছে বলে ওঁকে একটু রুক্ষ দেখায়৷ তবে ওঁর ব্যবহার খুব মিষ্টি আর দারুণ সাহস৷ একবার নাকি হেডমিসট্রেসের ভূতের ভয় তাড়াতে সন্ধে সাতটার সময় টর্চ ছাড়াই অন্ধকারে গোটা ক্যাম্পাসটা চক্কর দিয়ে এসেছিলেন৷

রবিনা ম্যাডাম ইলিনাদের সবসময় বলেন, ‘শোন, ভূত বলে কিছু নেই৷ আসলে তোরাই এক-একটা ভূত৷’

তখন ক্লাসের আর-একটি মেয়ে, সজনী, ফোড়ন কেটে বলে উঠেছিল, ‘ভূত না, ম্যাডাম—পেতনি…৷’ তাতে ক্লাসের সবাই হেসে উঠেছিল৷ আর রবিনা ম্যাডামও হাসি চাপতে পারেননি৷

বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল৷ মেঘও ডাকছিল আপন খেয়ালে৷ হলের টিনের চালে বৃষ্টির আওয়াজ হচ্ছিল৷ খোলা জানলা দিয়ে বিদ্যুতের ঝিলিক চোখে পড়ছিল৷

হলের মেঝেতে বিশাল মাপের তিনটে শতরঞ্চি পাতা৷ তার ওপরে সবাই বসেছিল৷ কাকলি ম্যাডাম ছ’জনকে গান তোলাচ্ছিলেন আর ইলিনারা দশ-বারো জন একটু দূরে বসে নিজেদের মধ্যে চাপা গলায় গল্পগুজব করছিল৷

হঠাৎই ঘোড়ার খুরের শব্দ কানে এল ওদের৷ মনে হল, বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের কংক্রিট বাঁধানো চাতালে যেন অনেকগুলো ঘোড়া এলোমেলোভাবে ছুটে বেড়াচ্ছে৷

ইলিনা চমকে উঠল৷ ওর মনে পড়ল, প্রায় বছরখানেক এই শব্দটা শোনা যায়নি৷

শব্দটা যে কাকলি ম্যাডামও শুনতে পেয়েছেন সেটা বোঝা গেল৷ কারণ, তিনি গান থামিয়ে দিয়েছেন৷ আশা-আশঙ্কার চোখে রবিনা ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন৷ যেন ভূত তাড়াতে রবিনা ম্যাডামই একমাত্র ভরসা৷

ইলিনার পাশে বসে ছিল সমর্পিতা—সম্পি৷ ওর দশাসই মোটাসোটা চেহারা, আর ডাকাবুকো বলে স্কুলে বেশ খ্যাতি আছে৷

সমর্পিতা এমন লম্বা-চওড়া যে, স্কুল-ইউনিফর্ম পরে থাকলেও ওকে ইলিনাদের চেয়ে বয়েসে অনেক বড় বলে মনে হয়৷ লেখাপড়া ছাড়া অন্য যে-কোনও কাজে ওর উৎসাহ অনেক বেশি৷ স্কুলের সবরকম অ্যাক্টিভিটিতে সম্পি সবার আগে হাজির৷ দিদিমণিদের কোনও ব্যক্তিগত কাজের জন্যেও ওর ডাক পড়ে৷ দিদিরা সবাই ওকে ভালোবাসেন, স্নেহ করেন৷ আর বন্ধুদের মতোই ওর বড় মাপের নামটাকে ছোট করে ‘সম্পি’ বলে ডাকেন৷

ইলিনা সম্পির গায়ে ছোট্ট ঠেলা দিয়ে বলল, ‘কী রে, কীসের আওয়াজ?’

সম্পি বলল হাত নেড়ে, ‘ছাড় তো, ও কিছু নয়৷ ওই লাস্ট ইয়ারে যেমন শোনা গিয়েছিল৷ তারপর খোঁজ নিয়ে দেখবি হয়তো কাকু কিংবা মাসিদের কোয়ার্টারে কোনও ছেলেপিলে মেঝেতে নারকোলের মালা ঠুকে আওয়াজ করে খেলছে…৷’

এটা ঠিকই যে, স্কুলের অনেক কর্মী—বলাইদা কিংবা আশাদির মতো—ক্যাম্পাসের মধ্যেই সংসার নিয়ে কোয়ার্টারে থাকে৷ টিনের চালে ছাওয়া ছোট-ছোট পাকা ঘরগুলোই ওদের কোয়ার্টার৷ ওদের কোনও ছেলেমেয়ে এই ভূতুড়ে কাণ্ড করতেই পারে৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও ইলিনার তেমন ভরসা হচ্ছিল না৷

যেন ওকে সাহস দিতেই সমর্পিতা উঠে দাঁড়াল৷ তারপর গটগট করে পা ফেলে এগিয়ে গেল খোলা জানলার দিকে৷

কাকলি ম্যাডাম ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘সম্পি, কী করছ! যেয়ো না, যেয়ো না…৷’

ম্যাডামের কথা সমর্পিতা শুনল না৷ জানলার কাছে পৌঁছে গেল৷ এবং ওর পিছু-পিছু রওনা হল ইলিনা, সজনী আর অঙ্গনা৷

ভয় যে ওদের করছিল না তা নয়—কিন্তু কৌতূহলটাও কিছু কম ম্যাথাচাড়া দিচ্ছিল না৷

রবিনা ম্যাডামের ভয়-টয়ের কোনও বালাই নেই৷ তিনিও কখন যেন ইলিনাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন৷ অন্য মেয়েরা তখন শতরঞ্চিতে বসে ভয় আর কৌতূহলের চোখে ইলিনাদের দিকে দেখছে৷

জানলার বাইরে বৃষ্টি আর অন্ধকার৷ আকাশে মাঝে-মাঝে বিদ্যুতের ঝিলিক৷ তারই মধ্যে নজর চালিয়ে সম্পি ব্যাপারটা ভালো করে দেখতে চেষ্টা করল৷

বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের দিক থেকে ঘোড়ার খুরের শব্দ আসছে ঠিকই, কিন্তু সাদা আলোর দু-একটা বিন্দুও চোখে পড়ছে যেন৷ মাপে জোনাকি পোকার মতো, কিন্তু অনেক উজ্জ্বল৷ বিন্দুগুলো চঞ্চলভাবে এদিক-ওদিক ছিটকে বেড়াচ্ছে৷

আকাশে গুড়গুড় শব্দে মেঘ ডাকল৷ কিন্তু তাতে ঘোড়ার টগবগ শব্দ চাপা পড়ল না৷

অঙ্গনা জিগ্যেস করল, ‘ওই আলোগুলো কীসের? মনে হচ্ছে কারা যেন মিনি সার্চলাইট জ্বেলেছে৷’

একইসঙ্গে ইলিনা টের পেল অঙ্গনা ওর গায়ের কাছে সরে এসেছে৷

সমর্পিতা বলল, ‘কীসের আলো সেটা গিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে৷’

কাকলি ম্যাডাম হারমোনিয়ামের কাছে বসেছিলেন৷ সেখান থেকেই চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘না, না—যাওয়ার কোনও দরকার নেই৷ তা ছাড়া বৃষ্টি পড়ছে দেখছ না!’

রবিনা ম্যাডাম জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন৷ সেদিকে চোখ রেখেই বললেন, ‘এমন কিছু বৃষ্টি পড়ছে না—৷’

এ-কথা শেষ হতে-না-হতেই সম্পি দৌড়ল হলের দরজার দিকে৷

পিছন থেকে কাকলি ম্যাডাম, অঙ্গনা, ইলিনা সবাই ‘সম্পি! সম্পি!’ বলে ডাকতে লাগল৷

কিন্তু সেসব ডাক সম্পির কানে বোধহয় ঢুকল না৷ ও ততক্ষণে হলের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেছে৷

রবিনা ম্যাডাম আর দেরি করলেন না৷ সম্পির পিছন-পিছন দৌড়লেন৷ আর ওঁর সঙ্গে-সঙ্গে ছুট লাগাল ইলিনা আর সজনী৷

বাইরেটা অন্ধকার, জলে ভেজা৷ সামনে পিচের রাস্তা, তারপর ছোট্ট একটা পার্কের মতো৷ এই পার্কে পতাকা তোলার ফাংশান হয়৷

পার্কের চারপাশের রেলিং বেশ খাটো৷ ওরা দেখল, শর্টকাট করার জন্য সম্পি লাফিয়ে পার্কের রেলিং ডিঙিয়ে ওপারে পৌঁছে গেছে৷ ইলিনা আর রবিনা ম্যাডামরা পার্কটাকে পাশ কাটিয়ে সম্পিকে ধরার জন্য দৌড়ল৷

পার্ক পেরিয়ে একটা সবুজ মাঠ৷ তারপর বাস্কেটবল গ্রাউন্ড৷ সম্পি সেখানে পৌঁছে কয়েক লহমা দাঁড়াল৷ তারপর রেলিং ঘিরে দৌড়তে যাবে তখনই রবিনা ম্যাডাম ওকে ধরে ফেলল৷ একটু পরেই ইলিনা আর সজনী সেখানে পৌঁছে গেল৷

বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের রেলিং উঁচু, তাই সেটা ডিঙোনোর প্রশ্ন ওঠে না৷ সেইজন্যই সম্পি বোধহয় দাঁড়িয়ে পড়েছিল৷ ভাবছিল এরপর কী করবে৷ তা ছাড়া ঘোড়ার খুরের আওয়াজটা এখন আর শোনা যাচ্ছিল না৷

কিন্তু সাদা আলোর বিন্দুগুলো আরও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল৷

স্কুল-ক্যাম্পাসের নানা জায়গায় পিচের রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গেছে৷ রাস্তার একপাশে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে লাইটপোস্ট৷ তার ঝিমিয়ে পড়া আলো অন্ধকারের সঙ্গে অসম লড়াই করছে৷

ওরা সবাই দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ভিজছিল আর হাঁপাচ্ছিল৷ তাকিয়ে ছিল খাঁ-খাঁ বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের দিকে৷ রাস্তার আলো সেখানে ছিটকে এসে পড়েছে৷ কংক্রিটে বাঁধানো গ্রাউন্ড বৃষ্টির জল পড়ে চকচক করছে৷

রবিনা ম্যাডাম বললেন, ‘এবার ফিরে চল৷ ওই ঘোড়ার খুরের শব্দ…ওটা হয়তো ভুল শুনেছি৷ তা ছাড়া ওটা শুধু শব্দ…ভয়ের কিছু নেই৷ তোদের কাকলি ম্যাডাম একটুতেই ভয়-টয় পায়৷ চল…৷’

রবিনা ম্যাডামের কথার পিঠে সমর্পিতা বলল, ‘সে না হয় বুঝলাম, ম্যাডাম৷ কিন্তু ওই আলোগুলো কীসের? এখন দেখছেন, ওগুলো কেমন এদিক থেকে ওদিকে লাফাচ্ছে!’

সত্যিই তাই৷ আলোগুলো এখন লাফিয়ে উঁচু থেকে নীচে নামছে, আবার নীচ থেকে লাফিয়ে ওপরে উঠছে৷ কখনও ওগুলো আবার দপ করে নিভে যাচ্ছে৷

রবিনা ম্যাডাম একটু ইতস্তত করলেন৷ বোধহয় ভাবলেন, ছাত্রীর কাছে সাহসের পরীক্ষায় তিনি হেরে যেতে চান না৷ তাই বললেন, ‘চল তা হলে, একবার কাছ থেকে দেখে আসি…৷’

বাস্কেটবল গ্রাউন্ডকে পাশ কাটিয়ে ওরা এগিয়ে গেল৷ সামনে বড়-বড় গাছপালা, আর তার পরেই বিশাল খেলার মাঠ৷ এই মাঠে খেলাধুলো ছাড়াও স্কুলের অ্যানুয়াল স্পোর্টস হয়৷ সেই মাঠটার একপাশে প্রায় তিনতলা সমান উঁচু একটা প্রকাণ্ড গাছ আছে৷ ওই গাছটা দেখলেই ইলিনার ভয় করে৷ কারণ, অত বড় গাছটায় একটিও পাতা নেই৷ শুধু অসংখ্য শুকনো ডালপালা কঙ্কালের মতো আকাশের দিকে ছড়িয়ে গেছে৷ হঠাৎ করে মনে হয়, কেউ যেন একশো হাতের পাঁচশো আঙুল আকাশের দিকে তুলে ভগবানের কাছে মুক্তি চাইছে৷

বাস্কেটবল গ্রাউন্ড পেরিয়ে গাছপালার গাঢ় অন্ধকার এলাকায় ঢুকে পড়ল ওরা৷ ইলিনার এবার বেশ ভয় করছিল৷ মনে হচ্ছিল, রাতের অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে ওরা কোনও অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়েছে৷

গাছপালার পাতায় বৃষ্টি আটকালেও পাতা থেকে টপটপ করে জল ঝরে পড়ছিল৷ সজনী ইলিনার হাত চেপে ধরেছিল৷ মনে হচ্ছিল, এইভাবে ওদের শরীরে আর মনে ভরসার আদানপ্রদান হচ্ছিল৷

সমর্পিতা রবিনা ম্যাডামকে বলল, ‘ওই দেখুন ম্যাডাম, আলোগুলো আরও কতটা দূরে…৷’

‘মনে হয়, ওই মরা গাছটার কাছে…৷’ রবিনা ম্যাডাম বললেন৷

ওরা জলের ওপরে পায়ের ছপছপ শব্দ তুলে এগোতে লাগল৷

আরও অনেকটা এগোতেই ওরা দৃশ্যটা ঠিকঠাক দেখতে পেল৷ কারণ, সেই মুহূর্তেই আকাশে নীল বিদ্যুৎ ঝলসে উঠেছে, আর বাজ পড়ার শব্দ কানে আসার আগেই ওরা শুনতে পেল খিলখিল হাসির শব্দ৷

মরা গাছটা ইলিনাদের কাছ থেকে এখন অন্তত তিরিশ-চল্লিশ মিটার দূরে৷ কিন্তু তার জন্য দেখতে কোনও অসুবিধে হল না৷

তিনটে প্রাণী ওই মরা গাছটার ডালে নানান উচ্চতায় উবু হয়ে বসে আছে৷ তাদের প্রত্যেকের মাথায় ছাতা৷ আর ছাতার নীচের অন্ধকারে দুটো করে সাদা আলোর চোখ জ্বলছে৷

ওরা খিলখিল করে হাসছে আর বিদ্যুতের ঝিলিকের মতো এ-ডাল থেকে সে-ডাল লাফাচ্ছে৷ কখনও লাফিয়ে ভিজে মাঠে নেমে আসছে, কখনও-বা মাঠ থেকে সোঁ করে লাফিয়ে উঠে যাচ্ছে ডালে৷ ওদের হাতে ধরা ছাতাগুলো অনেকটা প্যারাশুটের মতো লাগছে৷

সজনী ভয়ে চাপা চিৎকার করে উঠতেই ইলিনা চট করে ওর মুখে হাত চাপা দিল৷

রবিনা ম্যাডাম মরা গাছটার দিকে চোখ রেখেই ভয়ের গলায় জিগ্যেস করলেন, ‘ওগুলো কী—মানুষ, না পশু?’

প্রশ্নটা কাকে লক্ষ্য করে সেটা বোঝা যায়নি বটে কিন্তু সমর্পিতা উত্তর দিল, ‘ওগুলো মানুষ নয়, ম্যাডাম৷ মনে হচ্ছে, খারাপ কিছু…৷’

সেই ‘খারাপ কিছু’-টা যে কী সেটা ওরা চারজন হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করল৷

এমন সময় আবার বিদ্যুৎ চমকে উঠল৷ ওদের হাসির শব্দ স্পষ্ট শোনা গেল৷ তারপরই বাজ পড়ার বিকট শব্দে সেটা কিছুক্ষণের জন্য চাপা পড়ে গেল৷

ইলিনারা অন্ধকারে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে রুদ্ধশ্বাসে সেই অলৌকিক সার্কাস দেখতে লাগল৷

সজনী কাঁপা গলায় বলল, ‘ম্যাডাম, ফিরে চলুন৷ আমার…আমার ভয় করছে…৷’

‘ফিরে যাব কেন?’ বকুনির সুরে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন রবিনা ম্যাডাম৷ আঁচলে জড়ানো হাতের মুঠোয় ধরা টর্চটা বের করে মাটির দিকে তাক করে জ্বেলে ধরলেন৷ টর্চের জোরালো সাদা আলোয় বৃষ্টি-ভেজা ঘাস আর পাতা চোখে পড়ল৷ রবিনা ম্যাডাম বললেন, ‘আমরা চারজন আছি—ভয় কীসের! আমরা সবাই মিলে তাড়া করলে ওরা…মানে, ওই অ্যানিম্যালগুলো পালাবে৷’

রবিনা ম্যাডামের কথা শেষ হওয়ামাত্রই একটা চমকে ওঠার মতো ঘটনা ঘটে গেল৷ সমর্পিতার ভেতরে কেউ যেন আচমকা সাহস এবং অ্যাকশনের সুইচ অন করে দিল৷ মেয়েটা ‘অ্যাই, তোরা কে রে?’ বলে কান-ফাটানো চিৎকার করে ভেজা মাঠের ওপর দিয়ে মরা গাছটা লক্ষ্য করে ছুটতে শুরু করল৷ আর একইসঙ্গে ‘চোর! চোর!’ বলে চেঁচাতে লাগল৷

রবিনা ম্যাডাম ‘সম্পি! সম্পি!’ বলে চিৎকার করে উঠলেন৷ তারপর টর্চ জ্বেলে সেটাকে সামনে পিস্তলের মতো বাগিয়ে ধরে সম্পির পিছন-পিছন ছুটতে শুরু করলেন৷ অবাক হয়ে ভাবলেন, মেয়েটা চেহারায় দশাসই হলেও বেশ জোরে ছুটতে পারে দেখছি!

রবিনা ম্যাডাম ‘চোর! চোর!’ বলে চিৎকার করছিলেন আর ইলিনাদের কাছ থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিলেন৷

ইলিনা আর সজনী ভয় পেয়ে গেল৷ কারণ, ওদের দুই সাহসী সদস্য এখন আর ওদের পাশে নেই৷ তাই ওরাও রবিনা ম্যাডামকে লক্ষ্য করে দৌড়তে শুরু করল৷ আর একইসঙ্গে ‘চোর! চোর!’ বলে চিৎকার করতে লাগল৷

ওদের চারজনের চিৎকারে সার্ভেন্টস কোয়ার্টার থেকে লোকজন বেরিয়ে এল৷ কিন্তু অন্ধকার আর বৃষ্টির জন্য ওরা ভালো করে কিছু ঠাহর করতে পারছিল না৷

সম্পিদের ‘চোর! চোর!’ চিৎকারে প্রাণীগুলো কিন্তু মোটেই ভয় পায়নি৷ বরং ওদের হাসাহাসি আর লাফালাফির খেলা চালিয়ে যাচ্ছিল৷ কিন্তু সম্পি খুব কাছাকাছি এসে পড়তেই ওরা লাফিয়ে মাটিতে নামল৷ তারপর হাসি বন্ধ করে মাথার ওপরে ছাতা ধরে স্থির হয়ে দাঁড়াল৷

রবিনা ম্যাডাম সম্পিকে প্রায় ধরে ফেলেছিলেন৷ শাড়ি পরে থাকলেও ওঁর অ্যাথলেটিক শরীর ওঁকে দ্রুত দৌড়তে সাহায্য করছিল৷

ঘোলাটে অন্ধকারে রবিনা প্রাণীগুলোকে ভালো করে দেখতে পাচ্ছিলেন না৷

সম্পি রবিনার তুলনায় খানিকটা এগিয়ে ছিল৷ কিন্তু ও-ও ঠিকঠাক দেখতে পাচ্ছিল না৷ শুধু গাঢ় কালচে তিনটে ছাতার নড়াচড়া বুঝতে পারছিল৷

যদি ওরা প্রাণীগুলোকে ঠিকমতো দেখতে পেত তাহলে আর এগোত না৷

এমন সময় আকাশে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল৷ পরপর দু-বার৷

সম্পিরা দেখতে পেল ওদের৷ সঙ্গে-সঙ্গে ডাকাবুকো সম্পি আর রবিনা ম্যাডাম থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন৷ ওঁদের চিৎকার থেমে গেল৷

ছাতার নীচে তিনটে ফ্যাকাসে সাদা বিকৃত মুখ৷ চোখগুলো পুরোটা কালো—তাতে সাদা অংশ বলে কিছু নেই৷ শুধু মাঝখানে দুটো উজ্জ্বল আলোর বিন্দু ধকধক করে জ্বলছে৷ ওদের ঠোঁট জোড়া টুকটুকে লাল—যেন লিপস্টিকে রাঙানো৷ তিনজনেরই ঠোঁটজোড়া ফাঁক হয়ে আছে৷ আর সেই ফাঁক দিয়ে ওদের দাঁত দেখা যাচ্ছে৷ এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসানো ঝকঝকে ইস্পাতের দাঁত৷ দাঁতগুলো মাপে ছোট, কিন্তু অসংখ্য৷

এরা কারা? কোথা থেকে এল এখানে?

বিদ্যুতের আলো নিভে গেল৷ চারপাশ আবার ছায়া-অন্ধকার৷

রবিনা ম্যাডামের হাত থরথর করে কাঁপছিল৷ সেই কাঁপা হাতে তিনি টর্চের আলো ছুড়ে দিলেন একজনের মুখে৷ তারপর আর-একজনের৷ তারপর…৷

আবার দেখা গেল সেই ভয়ংকর মুখ৷ আরও ভয়ংকর ওদের পোশাক৷

একজনের পরনে রঙিন শাড়ি৷ আর অন্য দুজনের গায়ে স্কুল-ড্রেস৷ সবুজ স্কার্ট আর সাদা টপ৷ মাথায় জোড়া বিনুনি করে ফিতে বাঁধা৷

টর্চের আলোয় সাদা টপে রক্তের দাগ চোখে পড়ল যেন৷

সঙ্গে সঙ্গে সম্পি ভয়ে চিৎকার করে উঠল৷

রবিনা ম্যাডামের গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরোচ্ছিল না৷ ওঁর হাতে ধরা টর্চের আলোটা ভীষণ কাঁপছিল৷ তখনই বিদ্যুৎ চমকে উঠল আবার৷ তারপর কড়কড় শব্দে বাজ পড়ল৷ বৃষ্টি আরও জোরে শুরু হল৷

তিনটে মানুষ—কিংবা অমানুষ—আচমকা শূন্যে লাফ দিল৷ হাউইবাজির মতো ছিটকে চলে গেল দূরে৷

তারপর আবার লাফ৷ আরও দূরে৷

শেষে মিশে গেল অন্ধকারে৷

এরকম লাফ মানুষ দিতে পারে না৷

একটা অদ্ভুত ‘গোঁ-গোঁ’ শব্দ করে রবিনা ম্যাডাম অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন৷ ওঁর হাতের টর্চ ছিটকে পড়ল দূরে৷

সম্পি ওঁর শরীরের ওপরে ঝুঁকে পড়ে ‘ম্যাডাম! ম্যাডাম!’ বলে ডাকতে লাগল৷ পিছনে তাকিয়ে দেখল অনেকে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে৷ ফেস্টিভ্যাল হলের আলো আর সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের আলোর পটভূমিতে মানুষগুলোর ছায়া দেখা যাচ্ছে৷

চার

পরদিন স্কুলে হইচই যেটা হল সেটার ধরনটা অনেকটা ভ্রমরের গুঞ্জনের মতো৷

মেয়েদের মধ্যে চাপা ফিসফাস, তর্কবিতর্ক চলতে লাগল৷ আর সমর্পিতাকে ঘিরে যত উত্তেজনা, যত আলোড়ন৷ ও যেন সাহসের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেছে৷ ওকে ঘিরে সবচেয়ে বেশি ভিড়৷ তারপর হালকাভাবে ঘেরাও হয়েছে ইলিনা, সজনী, আর রিহার্সালে হাজির থাকা বাকি মেয়েরা৷

ক্লাসের ফাঁকে-ফাঁকে কিংবা ক্লাসের মধ্যেই সম্পিকে একই কাহিনি বারবার বলতে হচ্ছে৷ অন্য মেয়েরা এক-একটা ক্লাসের পর পালা করে বসার জায়গা পালটে সম্পির পাশে গিয়ে বসছে৷ এইভাবে গতকাল রাতের ভয়ংকর কাহিনি ছড়িয়ে গেল প্রায় সব ক্লাসেই৷

স্কুলের হেডমিসট্রেস মিসেস প্রীতি দত্ত বেশ রাশভারী মানুষ৷ মাথায় কাঁচাপাকা চুল, চোখে সরু মেটাল ফ্রেমের চশমা৷ ওঁকে খুব কম সময়েই হাসতে দেখা যায়৷

তিনি সকাল থেকে প্রতিটি ক্লাসে ভিজিট করে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলেছেন, যাতে এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশি গুজব না ছড়ায়৷

ইলিনাদের ক্লাসে হেডমিসট্রেস এলেন৷ তখন কাকলি ম্যাডামের বাংলা ক্লাস চলছিল৷ ছাত্রীদের লক্ষ করে বড়দি বললেন, ‘শোনো, মেয়েরা৷ কাল রাতে যা হয়েছে, সেটা আমার কানে এসেছে৷ ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, সিম্পলি একটা…মানে…অ্যাক্সিডেন্ট৷ একে তো রাত, তার ওপরে মেঘ-বৃষ্টি৷ বুঝতেই পারছ ব্যাপারটা হ্যালুসিনেশান…মানে, দেখার ভুল হতে পারে৷ তা ছাড়া রবিনার তো শরীর ভালো নয়—লো প্রেশারে ভোগে৷ তাই ও হঠাৎ করে সেন্সলেস হয়ে গেছে…৷

‘যাই হোক, ব্যাপারটা নিয়ে তোমরা কারও সঙ্গে আর আলোচনা কোরো না৷ বরং বেস্ট হবে, যদি তোমরা সবাই এই ইনসিডেন্টটা ভুলে যাও৷ তা না হলে কথার পিঠে কথা ছড়াবে…তারপর কোন সময় দেখবে পুলিশ আর টিভি চ্যানেলের লোকজন স্কুলে এসে হাজির হবে, আর হাজারটা কোয়েশ্চেন করে আমাদের সবাইকে জ্বালিয়ে খাবে৷ তা ছাড়া আমাদের স্কুলের একটা নামডাক আছে৷ সম্মান আছে৷

‘তা হলে মনে থাকবে তো? ব্যাপারটা আর কিছুই নয়…রাতবিরেতে দেখার ভুল৷ বুঝলে?’

ক্লাসের সব মেয়ে একসঙ্গে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘মনে থাকবে, বড়দি৷’

কাকলি ম্যাডামও কাঁচুমাচু মুখে ঘাড় কাত করলেন৷

হঠাৎই সমর্পিতা উঠে দাঁড়াল : ‘বড়দি—৷’

প্রীতি দত্ত ভুরু কুঁচকে বড়সড় চেহারার ছাত্রীটির দিকে তাকালেন৷

ইলিনা আর সজনীর বুক দুরদুর করে উঠল৷ ওরা আঁচ করতে পারল সম্পি কী বলতে চলেছে৷ এই বোধহয় ও বড়দির বকুনি খেল!

‘বড়দি, আমি কাল রাতে রবিনা ম্যাডামের সঙ্গে ছিলাম৷’

‘হ্যাঁ৷ জানি৷ তো?’ ভুরুজোড়া আরও কাছাকাছি চলে এল৷

‘রবিনা ম্যাডাম…অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন৷ আমি হইনি৷ আমি…সবটা নিজের চোখে দেখেছি—৷’

‘হ্যাঁ, শুনেছি৷ রবিনা বলেছে৷ কিন্তু এখন আর কোনও কথা শুনতে চাই না৷ তুমি, ইলিনা আর সজনী বরং টিফিনের সময় আমার রুমে এসো—তখন সব শুনব, আর আমার যা বলার বলব৷’ চোখের চশমাটা ঠিকঠাক করে নাকের ওপরে বসালেন প্রীতি দত্ত : ‘মোট কথা, এ-ব্যাপারে যেন একটা শব্দও বাইরে না যায়৷ আমাদের স্কুলের সুনামই হচ্ছে প্রথম এবং শেষ কথা৷ বুঝেছ?’ শেষ শব্দটায় ধমকের সুর আরও স্পষ্ট শোনাল৷

সমর্পিতা বেশ দমে গেল৷ ওর মুখ দেখে সেটা বোঝা গেল৷ আর কোনও কথা না বলে ও গুম হয়ে বসে পড়ল৷ কিন্তু ওর ভেতরে-ভেতরে একটা রাগ তৈরি হল৷ সবকিছু ও নিজের চোখে দেখেছে৷ তা সত্ত্বেও ব্যাপারটা ওকে ‘দেখার ভুল’ বলে মানতে হবে!

এটা ঠিকই যে, আকাশে মেঘ ছিল, বৃষ্টি ছিল, অন্ধকার ছিল৷ কিন্তু বিদ্যুতের আলোও তো ছিল! তার সঙ্গে টর্চের আলো৷ তা ছাড়া ওদের চোখগুলো জ্বলছিল!

বড়দি ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সজনী আর ইলিনা ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে সম্পির দু-পাশে এসে বসে পড়ল৷ তারপর চাপা গলায় ফুসুর-ফুসুর শুরু করল৷ টিফিনের সময় বড়দির মুখোমুখি হওয়ার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল৷ কাকলি ম্যাডামের ক্লাসের দিকে ওদের আর মন রইল না৷

সম্পি চাপা গলায় ইলিনাকে বলল, ‘আমি স্পষ্ট দেখেছি, দুজনের গায়ে আমাদের মতো স্কুল-ড্রেস ছিল৷ আর-একজনের ছিল শাড়ি৷’

সম্পিদের কাছ থেকে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও স্কুল-ড্রেস-এর ব্যাপারটা ইলিনা আর সজনীরও নজরে পড়েছিল৷ তাই ‘হুঁ’ বলে ওরা দুজনে ঘাড় নাড়ল৷

সম্পি বলল, ‘তার মানে, দুজন আমাদের স্কুলেরই স্টুডেন্ট—নাইন অথবা টেন-এর…৷’

ওর এ-কথা বলার কারণ, সিনিয়ার স্কুলের ক্লাস নাইন আর টেন-এর স্টুডেন্টদের ড্রেস সাদা টপ আর সবুজ স্কার্ট৷ ফাইভ থেকে এইট পর্যন্ত স্কুল-ড্রেসটা অন্যরকম—সাদা ফ্রক, সবুজ টিউনিক৷ আর জুনিয়ার স্কুলের বিল্ডিংও আলাদা, ড্রেসও আলাদা : সবুজ পাড় আর পাইপিং লাগানো সাদা ফ্রক৷

সম্পি আবার বলল, ‘আর শাড়িটা দেখেছিলি? ওটার রং ঠিকঠাক বুঝতে পারিনি, তবে পাড়ের চওড়া ডিজাইনটা আমার মনে আছে…৷’

‘তাতে কী হয়েছে?’ ইলিনা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল৷

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সম্পি ফিসফিস করে বলল, ‘কাল ওই ডিজাইনের শাড়ি পরে আমাদের একজন ম্যাডাম স্কুলে এসেছিল…৷’

ইলিনা আর সজনীর শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল৷

কাল ওদের একজন ম্যাডাম সেই একই ডিজাইনের শাড়ি পরে স্কুলে এসেছিলেন? তারপর সেই ম্যাডাম অন্ধকার আর বৃষ্টির মধ্যে খেলার মাঠের ওই মরা গাছটার ডাল থেকে ডালে ছাতা মাথায় লাফিয়ে বেড়াচ্ছিলেন? এ কী সর্বনেশে ব্যাপার!

‘তুই জানিস কে সেই ম্যাডাম?’ উত্তেজনায় কেঁপে যাওয়া গলায় জানতে চাইল সজনী৷

‘হ্যাঁ, জানি৷’ দুষ্টুমির চোখে একে-একে ইলিনা আর সজনীকে দেখল সম্পি৷ তারপর : ‘কিন্তু নামটা তোদের এখন বলব না৷ আমি চুপচাপ থেকে ক’টা দিন ওই ম্যাডামের ওপরে নজর রেখে দেখি৷ তারপর…৷’

ইলিনা সম্পির দিকে তাকাল৷

সম্পির ফোলা-ফোলা গাল, অথচ তা সত্ত্বেও চোয়ালের শক্ত রেখা বেশ স্পষ্ট৷ ক্লাসরুমের পাখা বনবন করে ঘুরছে, কিন্তু সম্পির গালে, কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম৷

দেখে মনে হচ্ছিল, সম্পি ব্যাপারটা নিয়ে রীতিমতো ছানবিন করবে বলে শপথ নিয়েছে৷

ইলিনার ভয়-ভয় করে উঠল৷ কারণ, কাল রাতের তিনটে প্রেতিনীর মড়ার মতো মুখ ও অস্পষ্টভাবে হলেও দেখতে পেয়েছে৷ তা ছাড়া ওই খিলখিল হাসি!

ইলিনা আমতা-আমতা করে জিগ্যেস করল, ‘বড়দির কাছে গিয়ে কী বলবি?’

‘এসব কিচ্ছু বলব না৷ বলব আমি যা দেখেছি…৷’

কথাটা সম্পি আর শেষ করল না৷ কারণ, ঠিক তখনই বাংলার ক্লাস শেষ হওয়ার ঘণ্টা পড়ল৷

টিফিনের স্বতঃস্ফূর্ত হইচই আজ বেশ কম মনে হল৷ কারণ, গতকালের অদ্ভুত খবরটা ফিসফিসে প্রচারে অনেকটাই ছড়িয়ে গেছে৷

অনুষ্কার ডেস্কের দিকে চোখ গেল ইলিনার৷ ও আজ আসেনি৷ সকাল থেকেই ইলিনার চোখ বারবার অনুষ্কার ডেস্কের দিকে চলে যাচ্ছে৷ কেন কে জানে!

ইলিনা, সজনী আর সমর্পিতা তাড়াহুড়ো করে টিফিন খাওয়া শেষ করল৷ বড়দির ঘরে ডাক পড়েছে বলে তিনজনের বুক দুরদুর করছিল৷ ইলিনা ক্লাসরুমের বড় জানলা দিয়ে বাইরে একবার তাকাল৷ আকাশ মেঘলা৷ তার সঙ্গে সকাল থেকেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি৷

বড়দির কাছে গিয়ে কী বলবে সেটা সম্পি, ইলিনা আর সজনী বেশ কয়েকবার চাপা গলায় রিহার্সাল দিল৷ সম্পি বারবার বলছিল, ‘আমি যা দেখেছি সেটাই স্ট্রেটকাট বড়দিকে বলব৷ যা সত্যি, তাই৷ লুকোনোর কী আছে?’

ইলিনা আর সজনী ওকে বোঝাতে লাগল৷

এ নিয়ে অনেক সময় কেটে গেল৷ শেষ পর্যন্ত ওরা তিনজনে প্রায় হাতে হাত ধরে বড়দির ঘরের দিকে রওনা হল৷ সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল৷

একতলায় প্রীতি দত্তর বিশাল ঘর৷ ঘরের দু-পাশে দুটো করে জানলা৷ তাদের মাপ এত বড় যে, সাধারণ বাড়ির দরজাকেও হার মানায়৷ ডানদিকের খোলা জানলা দিয়ে স্কুলের লাগোয়া ফুলের বাগান দেখা যাচ্ছে৷ বাগান পেরোলেই চোখে পড়ছে খাটো পাঁচিল ঘেরা এলাকা—তার ভেতরে ছোট-ছোট সার্ভেন্টস কোয়ার্টার৷

সময়ের আঁচড়ে ময়লা হয়ে যাওয়া একটা প্রকাণ্ড মাপের সেক্রেটারিয়াট টেবিল৷ তার পিছনে বড়দি মুখ ভার করে বসে আছেন৷ টেবিলের ওপরে পেন স্ট্যান্ড, রাইটিং প্যাড, একটা মোবাইল ফোন, আর রাজ্যের খাতাপত্র ছড়ানো৷ টেবিলের একপাশে একটা পুরোনো মডেলের কম্পিউটার৷ আর বড়দির সামনে একটা গোলাপি রঙের কোঁচকানো রুমাল, তার পাশে একটা প্লাস্টিকের চাকতি দিয়ে ঢাকা দেওয়া কাচের গ্লাসে আধগ্লাস জল৷

বড়দির মুখোমুখি চারটে হাতল-ওয়ালা কাঠের চেয়ার৷ চারটেই খালি৷ চেয়ারের পিঠ ধরে ইলিনারা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ চুপচাপ দাঁড়িয়ে বড়দির কথার অপেক্ষা করতে লাগল৷

মাথার ওপরে কাঠের ব্লেডওয়ালা ঢাউস সিলিং ফ্যান ‘ক্যাঁচক্যাঁচ’ শব্দে ঘুরছিল৷ সেই বাতাসের ঝাপটায় ট্যালকাম পাউডারের হালকা গন্ধ ওদের নাকে আসছিল৷ আর বড়দির গলায় পাউডারের ছোপ চোখে পড়ছিল৷

প্রীতি দত্ত ঠান্ডা চোখে সম্পির দিকে তাকালেন৷ অন্তত দশ সেকেন্ড স্থিরভাবে চেয়ে রইলেন—যেন ওকে হিপনোটাইজ করার চেষ্টা করছেন৷

তারপর অতিরিক্ত মোলায়েম স্বরে বললেন, ‘সমর্পিতা…তাই তো নাম তোমার?’

সম্পি চুপচাপ মাথা নাড়ল৷ যার মানে, হ্যাঁ৷

‘…এবার বলো তো, কাল রাতে তুমি ঠিক কী দেখেছ?’

ইলিনা বড়দির শাড়িটা লক্ষ করছিল৷ আজ বড়দি একটা টাঙ্গাইল শাড়ি পরে এসেছেন৷ চওড়া পাড়ে গাঢ় সবুজ রঙের নকশা তোলা৷ হালকা সবুজ জমির ওপরে গাঢ় সবুজের কলকা বোনা৷

‘মনে হয়…মনে হয়…’ মেঝের দিকে তাকিয়ে আঙুল খুঁটতে লাগল সম্পি৷ বারকয়েক হোঁচট খেয়ে বলল, ‘মনে হয়…মনে হয় আমি…ভুল দেখেছি, বড়দি৷ ওই অন্ধকার, মেঘ, তার ওপরে বৃষ্টি…৷’

ইলিনা আর সজনী অবাক চোখে সমর্পিতার দিকে তাকাল৷

এসব কী বলছে সম্পি? একটু আগেই না বলছিল, একজনের শাড়ির পাড়ের ডিজাইনটা ও লক্ষ করেছে! গতকাল একজন ম্যাডাম ওইরকম শাড়ি পরে স্কুলে এসেছিলেন৷ সেই ম্যাডামের ওপরে ও নজর রাখছে৷ এবং যা সত্যি তাই বলবে বড়দিকে৷

তা হলে?

ইলিনা আর সজনীকে আরও অবাক করে দিয়ে সম্পি বড়দিকে বলল, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন, বড়দি৷ কাল রাতে আমার মাথাটা কেমন ঘুরে গিয়েছিল৷ মানে, ব্যাপারটা মনে হয় আমার দেখার ভুল৷ মানে…ওই যে আপনি বললেন না…হ্যালু…৷’

‘হ্যালুসিনেশান৷’ একগাল হেসে ওকে কথাটা ধরিয়ে দিলেন প্রীতি দত্ত, ‘এই তো ভালো মেয়ের মতো কথা৷ গুড গার্ল৷’ এবার তিনি ইলিনা আর সজনীর দিকে তাকালেন : ‘তোমরা কিছু বলবে?’

অবাক ভাবটা কাটিয়ে ইলিনা আর সজনী একইসঙ্গে মাথা নাড়ল : ‘না, বড়দি, আমরা কিছুই দেখতে পাইনি—৷’ ওরা তখনও আড়চোখে বারবার সম্পিকে দেখছিল৷

‘গুড৷’ খুশির গলায় বললেন প্রীতি৷ তারপর স্নেহমাখা মোলায়েম গলায় আরও বললেন, ‘তোমরা এখন বড় হয়েছ৷ স্কুলের ভালোমন্দ অনেকটাই বুঝবে৷ জানো, সুনাম তৈরি করতে বহু বছর লেগে যায়! কিন্তু দুর্নাম?’ একটু থামলেন৷ তারপর : ‘দুর্নাম হওয়ার জন্যে একটা দিনই যথেষ্ট৷ আসলে…৷’

বড়দির বক্তব্যের স্রোতে বাধা পড়ল৷ কারণ, মলিনাদি ঘরে এসে ঢুকল৷

মলিনাদি বড়দির খাসবেয়ারা৷ তা ছাড়া ক্লাসে-ক্লাসে নোটিস নিয়ে যায়৷

মলিনাদি বেশ মোটাসোটা৷ রং কালো, মাথায় কাঁচাপাকা চুল৷ চোখে কালো ফ্রেমের চশমা—তার একটা ডাঁটিতে তাপ্পি লাগানো৷

ইলিনারা লক্ষ করল মলিনাদি বেশ হাঁপাচ্ছে, আর চোখগুলো গোল-গোল৷

‘কী হয়েছে, মলি?’ কথা থামিয়ে প্রীতি দত্ত প্রশ্ন করলেন৷

বড়-বড় শ্বাস টেনে-টেনে মলিনা বলল, ‘বলাইদার ছেলে…বলাইদার ছেলে…পরান…পরান…৷’

‘কী হয়েছে পরানের? কী হয়েছে?’ বড়দি প্রশ্ন করতে-করতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছেন৷

‘পরান…পরান মারা গেছে গো, দিদি, মারা গেছে!’ এ-কথা বলেই মলিনা চাকরিজীবনে কখনও যা করেনি তাই করে বসল৷ বড়দির সামনেই ধপাস করে একটা খালি চেয়ারে বসে পড়ল এবং বুকে দু-হাত চেপে উত্তেজনাটাকে সামাল দিতে চেষ্টা করল৷

মলিনার অসংলগ্ন কথা থেকে প্রীতি দত্ত অনেক কষ্টে গোটা গল্পটা উদ্ধার করলেন৷

স্কুলের ঘণ্টা বাজায় যে-বলাইদা, সে সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে থাকে৷

তার বয়েস অনেক৷ মাথার মাঝখানে টাক৷ তার চারদিকে সাদা ঝালরের মতো চুল৷ মুখে খোঁচা-খোঁচা সাদা দাড়ি৷ খানিকটা কুঁজো হয়ে থাকা বৃদ্ধ শরীর৷ ধীরে-ধীরে হাঁটা-চলা করে৷ কিন্তু বলাইদার ঘণ্টা বাজানোর জোর অবাক করে দেওয়ার মতো৷

সেই বলাইদার জোয়ান ছেলে পরান কাছাকাছি একটা রেশন-দোকানে চাকরি করে৷ অনেক সময় হিসেবনিকেশের চাপে পরান রাতে সেই দোকানেই থেকে যায়৷ কাল রাতেও সেরকম কিছু একটা হয়েছে বলে বলাইদারা ভেবেছিল৷ কিন্তু আজ সকালে পরান না ফেরায় বলাইদারা অপেক্ষা করে-করে শেষ পর্যন্ত বেলায় পরানের খোঁজ করতে সেই দোকানে যায়৷ গিয়ে শোনে, গতকাল রাতে পরান বৃষ্টির মধ্যেই বাড়ি রওনা হয়ে গিয়েছিল৷ বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচানোর জন্য ও দোকান থেকে শুধু একটা পলিথিনের প্যাকেট নিয়েছিল৷

তখন বলাইদারা পাগলের মতো পরানের খোঁজ করতে থাকে৷ হাসপাতালে, থানায়, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে—সব জায়গায়৷

কিন্তু পরানকে পাওয়া যায়নি৷

তারপর, একটু আগে, কোয়ার্টারের একটা বাচ্চা ছেলে স্কুলের পিছনদিকের পাঁচিলের কাছে ‘ছোট বাইরে’ করতে গিয়ে পরানের ডেডবডি দেখতে পায়৷

চারটে বড়-বড় আমগাছ আর কৃষ্ণচূড়া গাছের মাঝে বৃষ্টির জলে ভেজা আগাছা আর ঘাস-পাতার ওপরে পরানের দেহটা পড়ে ছিল৷ ওর মাথাটা ছিল একটা পলিথিনের প্যাকেটে ঢাকা৷

বাচ্চা ছেলেটা বুঝতে না পেরে ‘পরানদা, পরানদা—’ বলে পলিথিনের প্যাকেটটা ধরে টান মারে৷ জলে ভেজা প্যাকেটটা খুলে আসতেই পরানের ফ্যাকাসে মুখটা দেখা যায়৷

পরানের গায়ের রং শ্যামলা হলেও দেখা গেল, ওর সারাটা শরীর সাদাটে, রক্তশূন্য৷ চোখ দুটো বড়-বড়, যেন ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসবে৷ আর ঘাড়ে-গলায় চার-পাঁচ জায়গায় গভীর ক্ষতের দাগ৷ সেখানে কালচে রক্ত জমাট বেঁধে আছে৷

এসব কথা শুনে প্রীতি দত্তের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল৷ তার ওপর মলিনাদি বলল, সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের কারা যেন বড়দির পারমিশান না নিয়ে এর মধ্যেই পুলিশে খবর দিয়ে দিয়েছে৷

ইলিনা, সম্পি আর সজনী ভয়ে রীতিমতো কাঁপছিল৷ পরানের মৃতদেহের যে-সংক্ষিপ্ত বর্ণনা মলিনাদি দিয়েছে তাতেই ওরা রক্তশূন্য ছাইরঙা ডেডবডিটা যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিল৷

প্রীতি দত্ত টেবিল থেকে গ্লাস তুলে নিয়ে দু-ঢোঁক জল খেলেন৷ কয়েকটা বড়-বড় শ্বাস নেওয়ার পর কিছুটা সামলে উঠলেন৷ তারপর তড়িঘড়ি সম্পিদের বিদায় দিলেন৷ আপনমনেই বললেন, ‘কী-সর্বনাশ! মনে হচ্ছে, স্কুল ক’দিন ছুটি দিতে হবে…৷’

মলিনা ভয় পাওয়া গলায় বলল, ‘আমি বডিটা স্বচক্ষে দেখে এলুম, দিদি৷ এ একেবারে অপঘাতে মিত্যু৷ নিঘঘাৎ ডাকিনি-পিশাচের কাজ৷ সারা শরীরটায় রক্ত নেই৷ একেবারে সাদা৷ এবারে কী হবে, দিদি?’

মলিনার আর্ত আবেদন বড়দির কানে পৌঁছল কি না বোঝা গেল না৷ তিনি তখন টেবিল থেকে মোবাইল ফোন হাতে তুলে নিয়েছেন৷ কপালে ভাঁজ ফেলে চোখ সরু করে মলিনার উচ্চারণ করা মারাত্মক দুটো শব্দ নিয়ে ভাবছেন৷

এই স্কুলে ডাকিনি আর পিশাচ এল কোথা থেকে?