গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

তুঙ্গভদ্রার তীরে – প্রথম পর্ব

প্রথম পর্ব – এক

কৃষ্ণা ও তুঙ্গভদ্রার সঙ্গমস্থল হইতে ক্রোশেক দূর ভাটির দিকে তিনটি বড় নৌকা পালের ভরে উজানে চলিয়াছে। তাহারা বিজয়নগর যাইতেছে, সঙ্গম পার হইয়া বামদিকে তুঙ্গভদ্রায় প্রবেশ করিবে। বিজয়নগর পৌঁছিতে তাহাদের এখনো কয়েকদিন বিলম্ব আছে, সঙ্গম হইতে বিজয়নগরের দূরত্ব প্রায় সত্তর ক্রোশ।

বৈশাখ মাসের অপরাহ্ণ। ১৩৫২ শকাব্দ সবে মাত্র আরম্ভ হইয়াছে।

তিনটি নৌকা আগে পিছে চলিয়াছে। প্রথম নৌকাটি আয়তনে বিশাল, সমুদ্রগামী বহিত্র। দ্বিতীয়টি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র হইলেও রণতরীর আকারে গঠিত, সঙ্কীর্ণ ও দ্রুতগামী; তাহাতে পঞ্চাশ জন যোদ্ধা স্বচ্ছন্দে থাকিতে পারে। তৃতীয় নৌকাটি ভারবাহী ভড়, তাহার গতি মন্থর। তাই তাহার সহিত তাল রাখিয়া অন্য বহিত্র দু’টিও মন্থর গতিতে চলিয়াছে।

নৌকা তিনটি বহুদূর হইতে আসিতেছে। পূর্ব সমুদ্রতীরে কলিঙ্গদেশের প্রধান বন্দর কলিঙ্গপত্তন, সেখান হইতে তিন মাস পূর্বে তাহাদের যাত্রা শুরু হইয়াছিল। এতদিনে তাহাদের যাত্রা শেষ হইয়া আসিতেছে; আর সপ্তাহকাল মধ্যেই তাহারা বিজয়নগরে পৌঁছিবে— যদি বায়ু অনুকূল থাকে।

যে-সময়ের কাহিনী সে-সময়ের সহস্রবর্ষ পূর্ব হইতেই ভারতের প্রাচ্য উপকূলে নৌবিদ্যার বিশেষ উৎকর্ষ হইয়াছিল। উত্তরে ‘নৌ-সাধনোদ্যত’ বঙ্গদেশ হইতে দক্ষিণে তৈলঙ্গ তামিল দেশ পর্যন্ত বন্দরে বন্দরে সমুদ্রযাত্রী বৃহৎ বহিত্র প্রস্তুত হইতেছিল, তাহাতে চড়িয়া ভারতের বণিকেরা ব্রহ্ম শ্যাম কম্বোজ ও সাগরিকার দ্বীপপুঞ্জে বাণিজ্য করিয়া ফিরিতেছিল; উপনিবেশ গড়িতেছিল, রাজ্যস্থাপন করিতেছিল। এইভাবে বহু শতাব্দী চলিবার পর একদা কালান্তক ঝড়ের মত দিক্‌প্রান্তে আরব জলদস্যু দেখা দিল, তাহার সংঘাতে ভারতের রতনভরা তরী লবণজলে ডুবিল। তবু ভারতের তটরেখা ধরিয়া সমুদ্রপোতের যাতায়াত একেবারে বন্ধ হইল না, তটভূমি ঘেঁষিয়া নৌ-যোদ্ধার দ্বারা সুরক্ষিত পোত এক বন্দর হইতে অন্য বন্দরে যাতায়াত করিতে লাগিল। নদীপথেও নৌ-বাণিজ্যের গমনাগমন অব্যাহত রহিল।

নৌকা তিনটির মধ্যে সর্বাগ্রগামী নৌকাটির প্রধান যাত্রী কলিঙ্গ দেশের রাজকন্যা কুমারী ভট্টারিকা বিদ্যুন্মালা। রাজকন্যা বিজয়নগরে যাইতেছেন বিজয়নগরের তরুণ রাজা দ্বিতীয় দেবরায়কে বিবাহ করিবার জন্য।

প্রথম নৌকাটি ময়ূরপঙ্খী। তাহার বহিরঙ্গ ময়ূরের ন্যায় গাঢ় নীল ও সবুজ রঙে চিত্রিত; পালেও নীল-সবুজের বিচিত্র চিত্রণ। দ্বিতীয় নৌকাটি মকরমুখী; তাহার দেহে বর্ণবৈচিত্র্য নাই, ধূসর বর্ণের নৌকা। তাহার ভিতরে আছে ত্রিশজন নৌ-যোদ্ধা; তাহারা এই নৌ-বহরের রক্ষী। এতদ্ব্যতীত নৌকায় আছে পাচক সূপকার নাপিত ও নানা শ্রেণীর ভৃত্য। সর্ব পশ্চাৎবর্তী ভড় বিবিধ তৈজস, আবশ্যক বস্তু ও খাদ্যসম্ভারে পূর্ণ। এতগুলা লোক দীর্ঘকাল ধরিয়া আহার করিবে, চাল দাল ঘৃত তৈল গম তিল গুড় শর্করা লবণ হরিদ্রা কাশমর্দ প্রভৃতি প্রচুর পরিমাণে সঙ্গে চলিয়াছে।

ভড়ের পিছনে একটি শূন্য ডিঙি দড়ি-বাঁধা অবস্থায় ল্যাজের মত ভড়ের অনুসরণ করিয়াছে। এক নৌকা হইতে অন্য নৌকায় যাতায়াত করিবার সময় ইহার প্রয়োজন।

এইভাবে রাজকীয় আড়ম্বরের দ্বারা পরিবেষ্টিত হইয়া রাজনন্দিনী বিদ্যুন্মালা বিবাহ করিতে চলিয়াছেন। কিন্তু তাঁহার মনে সুখ নাই।

সেদিন অপরাহ্ণে তিনি নৌকার ছাদে বসিয়া ক্লান্ত চক্ষে জলের পানে চাহিয়া ছিলেন। তাঁহার বৈমাত্রী ভগিনী মণিকঙ্কণা তাঁহার সঙ্গে ছিল। মণিকঙ্কণা শুধু তাঁহার ভগিনী নয়, সখীও। তাই বিদ্যুন্মালা যখন বিবাহে চলিলেন তখন মণিকঙ্কণাও স্বেচ্ছায় সঙ্গে চলিল। বিবাহের যিনি বর তিনি ইচ্ছা করিলে বধূর সহিত তাহার অনূঢ়া ভগিনীদেরও গ্রহণ করিতে পারিতেন। ইচ্ছা না করিলে পাত্রকুলের অন্য কেহ তাহাকে বিবাহ করিতেন। এই প্রথা আবহমানকাল প্রচলিত ছিল।

মণিকঙ্কণা বিদ্যুন্মালার বৈমাত্রী ভগিনী, কিন্তু সেই সঙ্গে আরো একটু প্রভেদ ছিল। বিদ্যুন্মালার মাতা পট্টমহিষী রুক্মিণী দেবী ছিলেন আর্যা, কিন্তু মণিকঙ্কণার মাতা চম্পাদেবী অনার্যা। আর্যগণ প্রথম দক্ষিণ ভারতে আসিয়া একটি সুন্দর রীতি প্রবর্তিত করিয়াছিলেন; আর্য পুরুষ বিবাহকালে আর্যা বধূর সঙ্গে সঙ্গে একটি অনার্যা বধূও গ্রহণ করিতেন। বংশবৃদ্ধিই প্রধান উদ্দেশ্য সন্দেহ নাই; কিন্তু প্রথাটি লোভনীয় বলিয়াই বোধকরি টিকিয়া ছিল। আর্যা পত্নীর মর্যাদা অবশ্য অধিক ছিল, কিন্তু অনার্যা পত্নীও মাননীয়া ছিলেন।

বিদ্যুন্মালা ও মণিকঙ্কণার বয়স প্রায় সমান, দু’এক মাসের ছোট বড়। কিন্তু আকৃতি ও প্রকৃতিতে অনেক তফাৎ। আঠারো বছর বয়সের বিদ্যুন্মালার আকৃতির বর্ণনা করিতে হইলে প্রাচীন উপমার শরণ লইতে হয়। তন্বী, তপ্তকাঞ্চনবর্ণা, পক্কবিম্বাধরোষ্ঠী, কিন্তু চকিত হরিণীর ন্যায় চঞ্চলনয়না নয়। নিবিড় কালো চোখ দু’টি শান্ত অপ্রগ্‌লভ; সর্বাঙ্গের উচ্ছলিত যৌবন যেন চোখ দু’টিতে আসিয়া স্থির নিস্তরঙ্গ হইয়া গিয়াছে। তাঁহার প্রকৃতিতেও একটি মধুর ভাবমন্থর গভীরতা আছে যাহা সহজে বিচলিত হয় না। অন্তঃসলিলা প্রকৃতি, বাহির হইতে অন্তরের পরিচয় অল্পই পাওয়া যায়।

মণিকঙ্কণা ঠিক ইহার বিপরীত। সে তন্বী নয়, দীর্ঘাঙ্গী নয়, তাহার সুবলিত দৃঢ়পিনদ্ধ দেহটি যেন যৌবনের উদ্বেল উচ্ছ্বাস ধরিয়া রাখিতে পারিতেছে না। চঞ্চল চক্ষু দু’টি খঞ্জনপাখির মত সঞ্চরণশীল, অধর নবকিশলয়ের ন্যায় রক্তিম। দেহের বর্ণ বিদ্যুন্মালার ন্যায় উজ্জ্বল গৌর নয়, একটু চাপা; যেন সোনার কলসে কচি দূর্বাঘাসের ছায়া পড়িয়াছে। কিন্তু দেখিতে বড় সুন্দর। তাহার প্রকৃতিও বড় মিষ্ট, মোটেই অন্তর্মুখী নয়; বাহিরের পৃথিবী তাহার চিত্ত হরণ করিয়া লইয়াছে। মনে ভাবনা-চিন্তা বেশি নাই, কিন্তু সকল কর্মে পটীয়সী; বিচিত্র এবং নূতন নূতন কর্মে লিপ্ত হইবার জন্য সে সর্বদাই উন্মুখ। পৃথিবীটা তাহার রঙ্গকৌতুক খেলাধূলার লীলাঙ্গন।

কিন্তু তিন মাস নিরবচ্ছিন্ন নৌকারোহণ করিয়া দুই ভগিনীই ক্লান্ত। প্রথম প্রথম সমুদ্রের ভীমকান্ত দৃশ্য তাঁহাদের মুগ্ধ করিয়াছিল, তারপর নদীর পথে দুই তীরের নিত্যপরিবর্তমান চলচ্ছবি কিছুদিন তাঁদের চিত্ত আকর্ষণ করিয়া রাখিয়াছিল। নদীর কিনারায় কখনো গ্রাম কখনো শস্যক্ষেত্র কখনো শিলাবন্ধুর তটপ্রপাত; কোথাও জলের মাঝখানে মকরাকৃতি বালুচর, বালুচরের উপর নানা জাতীয় জলচর পক্ষী— সবই অতি সুন্দর। কিন্তু ক্রমাগত একই দৃশ্যের পুনরাবর্তন দেখিতে আর ভাল লাগে না। নৌকার অল্প পরিসরে সীমাবদ্ধ জীবনযাত্রা অসহ্য মনে হয়, স্থলচর জীবের স্থলাকাঙ্ক্ষা দুর্বার হইয়া ওঠে।

সেদিন দুই ভগিনী পালের ছায়ায় গুণবৃক্ষের কাণ্ডে পৃষ্ঠ রাখিয়া পা ছাড়াইয়া বসিয়া ছিলেন। ছাদের উপর অন্য কেহ নাই; নৌকার পিছন দিকে হালী একাকী হাল ধরিয়া বসিয়া আছে। তাহাকে ছাদ হইতে দেখা যায় না। বিদ্যুন্মালার ক্লান্ত চক্ষু জলের উপর নিবদ্ধ, মণিকঙ্কণার চক্ষু দু’টি পিঞ্জরাবদ্ধ পাখির মত চারিদিকে ছটফট করিয়া বেড়াইতেছে। মণিকঙ্কণার মনে অনেক অসন্তোষ জমা হইয়া উঠিয়াছে। এ নৌকাযাত্রার কি শেষ নাই? আর তো পারা যায় না! সহসা তাহার অধীরতা বাঙ্‌মূর্তি ধরিয়া বাহির হইয়া আসিল, সে বিদ্যুন্মালার দিকে ঘাড় ফিরাইয়া বলিল— ‘একটা কথা বল্‌ দেখি মালা। চিরদিনই বিয়ের বর কনের বাড়িতে বিয়ে করতে যায়। কিন্তু তুই বরের বাড়িতে বিয়ে করতে যাচ্ছিস, এ কেমন কথা?’

সত্যই তো, এ কেমন কথা! এই বিপরীত আচরণের মূল অন্বেষণ করিতে হইলে কিছু ইতিহাসের চর্চা করিতে হইবে।

দুই

সঙ্গম বংশীয় দুই ভাই, হরিহর ও বুক্ক বিজয়নগর রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। তাঁহাদের জীবনকথা অতি বিচিত্র। দিল্লীর সুলতান মুহম্মদ তুঘ্‌লক দুই ভ্রাতার অসামান্য রাজনৈতিক প্রতিভা দেখিয়া তাঁহাদের জোর করিয়া মুসলমান করিয়াছিলেন। সে-সময়ে গুণী ও কর্মকুশল হিন্দু পাইলেই মুসলমান রাজারা তাঁহাদের বলপূর্বক মুসলমান করিয়া নিজেদের কাজে লাগাইতেন। কিন্তু হরিহর ও বুক্ক বেশি দিন মুসলমান রহিলেন না। তাঁহারা পলাইয়া আসিয়া শৃঙ্গেরি শঙ্করমঠের এক সন্ন্যাসীর শরণাপন্ন হইলেন। সন্ন্যাসীর নাম বিদ্যারণ্য, তিনি তাঁহাদের হিন্দুধর্মে পুনর্দীক্ষিত করিলেন। তারপর দুই ভাই মিলিয়া গুরুর সাহায্যে হিন্দুরাজ্য বিজয়নগরের প্রতিষ্ঠা করিলেন। বিজয়নগরের আদি নাম বিদ্যানগর, পরে উহা মুখে মুখে বিজয়নগরে পরিণত হয়।

কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণে যখন হিন্দু রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হইতেছিল, ঠিক সেই সময় কৃষ্ণার উত্তর তীরে একজন শক্তিশালী মুসলমান দিল্লীর নাগপাশ ছিন্ন করিয়া এক স্বাধীন মুসলমান রাজ্যের প্রবর্তন করিয়াছিলেন। এই রাজ্যের নাম বহমনী রাজ্য। উত্তরকালে বিজয়নগর ও বহমনী রাজ্যের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদ যুদ্ধ-বিগ্রহ প্রায় চিরস্থায়ী হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। বহমনী রাজ্যের চেষ্টা কৃষ্ণার দক্ষিণে মুসলমান অধিকার প্রসারিত করিবে, বিজয়নগরের প্রতিজ্ঞা কৃষ্ণার দক্ষিণে মুসলমানকে ঢুকিতে দিবে না।

রাজ্য প্রতিষ্ঠার অনুমান শত বর্ষ পরে বিজয়নগরের যিনি রাজা হইলেন তাঁহার নাম দেবরায়। ইতিহাসে ইনি প্রথম দেবরায় নামে পরিচিত। দেবরায় অসাধারণ রাজ্যশাসক ও রণপণ্ডিত ছিলেন। তিনি তুরস্ক হইতে ধানুকী সৈন্য আনাইয়া নিজ সৈন্যদল দৃঢ় করিয়াছিলেন এবং যুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার প্রচলিত করিয়াছিলেন। তাঁহার পঞ্চাশবর্ষব্যাপী শাসনকালে সমস্ত দাক্ষিণাত্য বিজয়নগরের পদানত হইয়াছিল, মুসলমান রাজশক্তি কৃষ্ণার দক্ষিণে পদার্পণ করিতে পারে নাই।

কিন্তু দেবরায়ের দুই পুত্র রামচন্দ্র ও বিজয়রায় ছিলেন কর্মশক্তিহীন অপদার্থ। ভাগ্যক্রমে বিজয়রায়ের পুত্র দ্বিতীয় দেবরায় পিতামহের মতই ধীমান ও রণদক্ষ। তাই প্রথম দেবরায় নিজের মৃত্যুকাল আসন্ন দেখিয়া দুই পুত্রের সহিত তরুণ পৌত্রকেও যৌবরাজ্যে অভিষেক করিলেন এবং কতকটা নিশ্চিন্ত মনে দেহরক্ষা করিলেন।

তরুণ দেবরায় পিতা ও পিতৃব্যকে ডিঙ্গাইয়া রাজ্যের শাসনভার নিজ হস্তে তুলিয়া লইলেন। অতঃপর আট বৎসর অতীত হইয়াছে। পিতৃব্য রামচন্দ্র বেশি দিন টিকিলেন না, কিন্তু পিতা বিজয়রায় অদ্যাপি জীবিত আছেন; রাজা হইবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাঁহার নাই, প্রৌঢ় বয়সে রাজপ্রাসাদে বসিয়া তিনি দুষ্ট শিশুর ন্যায় বিচিত্র খেলা খেলিতেছেন।

দেবরায়ের বয়স বর্তমানে পঁয়ত্রিশ বছর। তাঁহার দেহ যেমন দৃঢ় ও সুগঠিত, চরিত্রও তেমনি বজ্রকঠিন। গম্ভীর মিতবাক্‌, সংবৃতমন্ত্র পুরুষ। রাজ্যশাসন আরম্ভ করিয়া তিনি দেখিলেন, স্লেচ্ছ শত্রু তো আছেই, উপরন্তু হিন্দু রাজারাও নিরন্তর পরস্পরের সহিত বিবাদ করিতেছেন, তাঁহাদের মধ্যে একতা নাই, সহধর্মিতা নাই। অথচ ম্লেচ্ছ-শক্তির গতিরোধ করিতে হইলে সঙ্ঘবদ্ধ হওয়া একান্ত প্রয়োজন। দেবরায় একটি একটি করিয়া রাজকন্যা বিবাহ করিতে আরম্ভ করিলেন। ইষ্টবুদ্ধির দ্বারা যদি ঐক্যসাধন না হয় কুটুম্বিতার দ্বারা হইতে পারে। সেকালে রাজন্যবর্গের মধ্যে এই জাতীয় বিবাহ মোটেই বিরল ছিল না, বরং রাজনৈতিক কূটকৌশলরূপে প্রশংসার্হ কার্য বিবেচিত হইত।

সকল রাজা অবশ্য স্বেচ্ছায় কন্যাদান করিলেন না, কাহারও কাহারও উপর বলপ্রয়োগ করিতে হইল। সবচেয়ে কষ্ট দিলেন কলিঙ্গের রাজা গজপতি চতুর্থ ভানুদেব।

দাক্ষিণাত্যের পূর্ব প্রান্তে সমুদ্রতীরে কলিঙ্গ দেশ, বিজয়নগর হইতে বহু দূর। দেবরায়ের দূত বিবাহের প্রস্তাব লইয়া উপস্থিত হইল। কলিঙ্গরাজ ভানুদেব ভাবিলেন, এই বিবাহের প্রস্তাব প্রকারান্তরে তাঁহাকে বিজয়নগরের বশ্যতা স্বীকার করার আমন্ত্রণ। তিনি নিরতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া প্রতিবেশী অন্ধ্র রাজ্য সসৈন্যে আক্রমণ করিলেন, কারণ অন্ধ দেশ বিজয়নগরের মিত্র।

সংবাদ পাইয়া দেবরায় সৈন্য পাঠাইলেন। যুদ্ধ হইল। যুদ্ধে ভানুদেব পরাজিত হইয়া শান্তি ভিক্ষা করিলেন। শান্তির শর্তস্বরূপ তাঁহাকে দেবরায়ের হস্তে নিজ কন্যাকে সমর্পণ করার প্রস্তাব স্বীকার করিতে হইল। দেবরায় কিন্তু বিবাহ করিতে শ্বশুরগৃহে আসিতে পরিবেন না; কন্যাকে বিজয়নগর পাঠাইতে হইবে, সেখানে বিবাহক্রিয়া সম্পন্ন হইবে।

তৎকালে রাজাদের নিজ রাজ্য ছাড়িয়া বহু দূরে যাওয়া নিরাপদ ছিল না। চারিদিকে শত্রু ওত পাতিয়া আছে, সিংহাসন শূন্য দেখিলেই ঝাঁপাইয়া পড়িবে। তাছাড়া ঘরের শত্রু তো আছেই।

ভানুদেব কন্যাকে বিজয়নগরে পাঠাইবার ব্যবস্থা করিলেন। স্থলপথ অতি দুর্গম ও বিপজ্জনক; কন্যা জলপথে যাইবে। কলিঙ্গপত্তন বন্দরে তিনটি বহিত্র সজ্জিত হইল। খাদ্যসামগ্রী উপঢৌকন ও জলযোদ্ধার দল সঙ্গে থাকিবে। রাজদুহিতা বিদ্যুন্মালা সখী পরিজন লইয়া নৌকায় উঠিলেন। তিনটি নৌকা সমুদ্রপথে দক্ষিণদিকে চলিল। তারপর কৃষ্ণা নদীর মোহনায় পৌঁছিয়া নদীতে প্রবেশ করিল। তদবধি নৌকা তিনটি উজানে চলিয়াছে।

যাত্রা শেষ হইতে বেশি বিলম্ব নাই। ইতিমধ্যে দুই রাজকন্যা অধীর ও উত্ত্যক্ত হইয়া উঠিয়াছেন। সঙ্গে কন্যাকর্তারূপে আসিয়াছেন মাতুল চিপিটকমূর্তি এবং রাজকন্যাদের ধাত্রী মন্দোদরী। রাজবৈদ্য রসরাজও সঙ্গে আছেন। ইহাদের কথা ক্রমশ বক্তব্য।

তিন

মণিকঙ্কণার কথা শুনিয়া কুমারী বিদ্যুন্মালা তাহার দিকে ফিরিলেন না, সম্মুখে চাহিয়া থাকিয়া অলসকণ্ঠে বলিলেন— ‘কঙ্কণা, তুই হাসালি। এ নাকি বিয়ে! এ তে রাজনৈতিক দাবাখেলার চাল।’

মণিকঙ্কণা পা গুটাইয়া বিদ্যুন্মালার দিকে ফিরিয়া বসিল। বলিল— ‘হোক দাবাখেলার চাল। বর বিয়ে করতে আসবে না কেন?’

সম্মুখে অর্ধ ক্রোশ দূরে দুই নদী মিলিত হইয়া যেখানে বিক্ষুব্ধ জলভ্রমি রচনা করিয়া ছুটিয়াছে, সেইদিকে তাকাইয়া বিদ্যুন্মালার অধরপ্রান্তে একটু বাঁকা হাসি ফুটিয়া উঠিল। তিনি বলিলেন— ‘তিন-তিনটি বৌ ছেড়ে আসা কি সহজ? তাই বোধহয় আসতে পারেনি।’

মণিকঙ্কণা হাসি-হাসি মুখে কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিল, তারপর বিদ্যুন্মালার বাহুর উপর হাত রাখিয়া বলিল— ‘মহারাজ দেবরায়ের তিনটি রানী আছে, তুই হবি চতুর্থী। তাই বুঝি তোর ভাল লাগছে না?’

বিদ্যুন্মালা এবার মণিকঙ্কণার পানে চক্ষু ফিরাইলেন— ‘তোর বুঝি ভাল লাগছে?’

মণিকঙ্কণা বলিল— ‘আমার ভালও লাগছে না, মন্দও লাগছে না। রাজাদের অনেকগুলো রানী তো থাকেই। এক রাজার এক রানী কখনো শুনিনি।’

বিদ্যুন্মালা বলিলেন— ‘আমি শুনেছি। রামচন্দ্রের একটিই সীতা ছিল।’

মণিকঙ্কণা হাসিল— ‘সে তো ত্রেতাযুগের কথা। কলিকালে মেয়ে সস্তা, তাই পুরুষেরা যে যত পারে বিয়ে করে। যেমন অবস্থা তেমনি ব্যবস্থা।’

বিদ্যুন্মালার কণ্ঠস্বর একটু উদ্দীপ্ত হইল— ‘বিশ্রী ব্যবস্থা। স্ত্রী যদি স্বামীকে পুরোপুরি না পায়, তাহলে বিয়ের কোনো মানেই হয় না।’

মণিকঙ্কণা কিয়ৎকাল নীরবে চাহিয়া থাকিয়া বলিল— ‘পুরোপুরি পাওয়া কাকে বলে ভাই? স্বামী তো আর স্ত্রীর সম্পত্তি নয় যে, কাউকে ভাগ দেবে না। বরং স্ত্রীই স্বামীর সম্পত্তি।’

বিদ্যুন্মালার বিম্বাধর স্ফুরিত হইল, চোখে বিদ্রোহের বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল। তিনি বলিলেন— ‘আমি মানি না।’

মণিকঙ্কণা কলস্বরে হাসিয়া উঠিল— ‘না মানলে কী হবে, বিয়ে করতে তো যাচ্ছিস!’

বিদ্যুন্মালা বলিলেন— ‘যাচ্ছি। প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত নিরপরাধ মানুষ যেমন বধ্যভূমিতে যায়, আমিও তেমনি যাচ্ছি। যে-স্বামীর তিনটে বৌ আছে তাকে কোনোদিন ভালবাসতে পারব না।’

মণিকঙ্কণা বিদ্যুন্মালার গলা জড়াইয়া ধরিল— ‘কেন তুই মনে কষ্ট পাচ্ছিস ভাই! ভেবে দ্যাখ, তোর মা আর আমার মা কি মহারাজকে ভালবাসেন না? বিয়ে হোক, তুইও নিজের মহারাজটিকে ভালবাসবি। তখন আর সতীনের কথা মনে থাকবে না।’

বিদ্যুন্মালা কিছুক্ষণ বিরসমুখে চুপ করিয়া রহিলেন, তারপর বলিলেন— ‘মনে কর, মহারাজ দেবরায় আমার সঙ্গে সঙ্গে তোকেও গ্রহণ করলেন; তুই তাঁকে ভালবাসতে পারবি?’

মণিকঙ্কণা চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বলিল— ‘পারব না! বলিস কি তুই! তাঁকে অন্য বৌরা যতখানি ভালবাসে আমি তার চেয়ে ঢের বেশি ভালবাসব। আমার বুকে ভালবাসা ভরা আছে। যিনিই আমার স্বামী হবেন তাঁকেই আমি প্রাণভরে ভালবাসব।’

বিদ্যুন্মালা মণিকঙ্কণাকে কাছে টানিয়া লইয়া তাহার মুখখানি ভাল করিয়া দেখিলেন, একটি ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন— ‘আমি যদি তোর মতন হতে পারতুম! আমার মন বড় স্বার্থপর, যাকে চাই কাউকে তার ভাগ দিতে পারি না।’

মণিকঙ্কণা আবেগভরে বিদ্যুন্মালাকে দুই বাহুতে জড়াইয়া লইয়া বলিল— ‘না না, কখনো না। তুই বড় বেশি ভাবিস; অত ভাবলে মাথা গোলমাল হয়ে যায়। যা হবার তাই যখন হবে তখন ভেবে কি লাভ?’

বিদ্যুন্মীলা উত্তর দিলেন না; দুই ভগিনী ঘনীভূত হইয়া নীরবে বসিয়া রহিলেন। সূর্যের বর্ণ আরক্তিম হইয়া উঠিয়াছে, রৌদ্রের উত্তাপ নিম্নগামী; দক্ষিণ তীরের গন্ধ লইয়া মন্দ মধুর বাতাস বহিতে আরম্ভ করিয়াছে। নদীবক্ষে এই সময়টি পরম মনোরম।

ছাদের নীচে মড়্‌মড়্‌ মচ্‌মচ্‌ শব্দ শুনিয়া যুবতিদ্বয়ের চমক ভাঙিল। মণিকঙ্কণা চকিত হাসিয়া চুপিচুপি বলিল— ‘মন্দোদরীর ঘুম ভেঙেছে।’

অতঃপর ছাদের উপর এক বিপুলকায়া রমণীর আবির্ভাব ঘটিল। আলুথালু বেশ, হাতে একটি রূপার তাম্বূলকরঙ্ক; সে আসিয়া থপ্‌ করিয়া রাজকন্যাদের সম্মুখে বসিল, প্রকাণ্ড হাই তুলিয়া তুড়ি দিল, বলিল— ‘নমো দারুব্রহ্ম।’

মণিকঙ্কণা বিদ্যুন্মালাকে চোখের ইঙ্গিত করিল, মন্দোদরীকে ক্ষেপাইতে হইবে। সময় যখন কাটিতে চায় না। তখন মন্দোদরীকে লইয়া দু’দণ্ড রঙ্গ-পরিহাস করিতে মন্দ লাগে না।

কলিঙ্গের উত্তরে ওড্রদেশ, মন্দোদরী সেই ওড্রদেশের মেয়ে। বয়স অনুমান চল্লিশ, গায়ের রঙ গব্য ঘৃতের মত; নিটোল নিভাঁজ কলেবরটি দেখিয়া মনে হয় একটি মেদপূর্ণ অলিঞ্জর। গায়ে ভারী ভারী সোনার গহনা, মুখখানি পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় সদাই হাস্য-বিন্বিত। আঠারো বছর পূর্বে সে বিদ্যুন্মালার ধাত্রীরূপে কলিঙ্গের রাজসংসারে প্রবেশ করিয়াছিল, অদ্যাপি সগৌরবে: সেখানে বিরাজ করিতেছে। বর্তমানে সে দুই রাজকন্যার অভিভাবিকা হইয়া বিজয়নগরে চলিয়াছে। তাহার তিন কুলে কেহ নাই, রাজসংসারই তাহার সংসার।

মণিকঙ্কণা মুখ গম্ভীর করিয়া বলিল— ‘দারুব্রহ্ম তোমার মঙ্গল করুন। আজ দিবানিদ্রাটি কেমন হল?’

মন্দোদরী পানের ডাবা খুলিতে খুলিতে বলিল— ‘দিবানিদ্রা আর হল কই। খোলের মধ্যে যা গরম, তালের পাখা নাড়তে নাড়তেই দিন কেটে গেল। শেষ বরাবর একটু ঝিমিয়ে পড়েছিলুম।’

বিদ্যুন্মীলা উদ্বেগভরা চক্ষে মন্দোদরীকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন— ‘এমন করে না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ক’দিন বাঁচবি মন্দা! দিনের বেলা তোর চোখে ঘুম নেই, রাত্রে জলদস্যুর ভয়ে চোখে-পাতায় করতে পারিস না। শরীর যে দিন দিন শুকিয়ে কাঠি হয়ে যাচ্ছে।’

মন্দোদরী গদ্‌গদ হাস্য করিয়া বলিল— ‘যা যা, ঠাট্টা করতে হবে না। আমি তোদের মতন অকৃতজ্ঞ নই, খাই-দাই মোটা হই। তোরা খাস-দাস কিন্তু গায়ে গত্তি লাগে না।’

পানের বাটা খুলিয়া মন্দোদরী দেখিল তাহার মধ্যে ভিজা ন্যাকড়া জড়ানো দুই-তিনটি পানের পাতা রহিয়াছে। ইহা বিচিত্র নয়, কারণ দীর্ঘপথ আসিতে পানের অভাব ঘটিয়াছে। দুই-একটি নদীতীরস্থ গ্রামে ডিঙি পাঠাইয়া কিছু কিছু পান সংগ্রহ করা গিয়াছে বটে, কিন্তু তাহা যথেষ্ট নয়। অথচ পানের ভোক্তা অনেক। মন্দোদরী প্রচুর পান খায়, মাতুল চিপিটকমূর্তিও তাম্বূল-রসিক। বস্তুত যে পানের বাটাটি মন্দোদরীর সম্মুখে দেখা যাইতেছে, তাহা মাতুল মহাশয়ের। মন্দোদরী নিজের বরাদ্দ পান শেষ করিয়া মামার বাটায় হাত দিয়াছে।

বাটায় পান ছাড়াও চুন গুয়া কেয়াখয়ের মৌরী এলাচ দারুচিনি, নানাবিধ উপচার রহিয়াছে। মন্দোদরী পানগুলি লইয়া পরিপাটিভাবে পান সাজিতে প্রবৃত্ত হইল।

দুই ভগিনী দেখিলেন স্থূলতার প্রতি কটাক্ষপাতে মন্দোদরী ঘামিল না, তখন তাঁহারা অন্য পথ ধরিলেন। মণিকঙ্কণা বলিল— ‘আচ্ছা মন্দোদরি, তোকে তো আমরা জন্মে অবধি দেখছি, কিন্তু তোর রাবণকে তো কখনো দেখিনি। তোর রাবণের কি হল?’

মন্দোদরী বলিল— ‘আমার রাবণ কি আর আছে, অনেক দিন গেছে। আমি রাজসংসারে আসার আগেই তাকে যমে নিয়েছে।’

বিদ্যুন্মালা আশ্চর্য হইয়া বলিলেন— ‘সত্যিই তোর স্বামীর নাম রাবণ ছিল নাকি?’

মন্দোদরী মাথা নাড়িয়া বলিল— ‘না, তার নাম ছিল কুম্ভকর্ণ।’

মণিকঙ্কণা খিলখিল করিয়া হাসিয়া বলিল— ‘ও— তাই! তোর কুম্ভকর্ণ যাবার সময় ঘুমটি তোকে দিয়ে গেছে।’

বিদ্যুন্মালা বলিলেন— ‘তাহলে তোর এখন শুধু বিভীষণ বাকি!’

মন্দোদরী আর একটি নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল— ‘আর বিভীষণ! তোদের সামলাতে সামলাতেই বয়স কেটে গেল, এখন আর বিভীষণ কোত্থেকে পাব।’

মণিকঙ্কণা সান্ত্বনার স্বরে বলিল— ‘পাবি পাবি। কতই বা তোর বয়স হয়েছে। এই দ্যাখ না, বিজয়নগরে যাচ্ছিস, সেখানকার বিভীষণের তোকে দেখলে হাঁ করে ছুটে আসবে।’

বিদ্যুন্মালা বলিলেন— ‘কে বলতে পারে, ম্লেচ্ছ দেশের আমীর-ওমরা হয়তো তোকে ধরে নিয়ে গিয়ে বেগম করবে।’

মন্দোদরী বলিল— ‘ও মা গো, তারা যে গরু খায়।’

মণিকঙ্কণা বলিল— ‘তোকে পেলে তারা গরু খাওয়া ছেড়ে দেবে।’

মন্দোদরী জানিত ইহারা পরিহাস করিতেছে; কিন্তু তাহার অন্তরের এক কোণে একটি লুক্কায়িত আকাঙ্ক্ষা ছিল, তাহা এই ধরনের রসিকতায় তৃপ্তি পাইত। সে পান সাজিয়া মুখে দিল, চিবাইতে চিবাইতে বলিল— ‘তা যা বলিস। কার ভাগ্যে কি আছে কে বলতে পারে? নমো দারুব্রহ্ম।’

এই সময়ে নৌকার নিম্নতল হইতে তীক্ষ্ণ চিৎকারের শব্দ শোনা গেল। শব্দটি স্ত্রী-কণ্ঠোত্থিত মনে হইতে পারে, কিন্তু বস্তুত উহা মাতুল চিপিটকমূর্তির কণ্ঠস্বর। কোনো কারণে তিনি জাতক্রোধ হইয়াছেন।

পরক্ষণেই তিন চার লাফ দিয়া চিপিটকমূর্তি ছাদে উঠিয়া আসিলেন। মন্দোদরী কোলের কাছে পানের বাটা লইয়া বসিয়া আছে দেখিয়া তাঁহার চক্ষুদ্বয় ঘূর্ণিত হইল, তিনি অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া সূচীতীক্ষ্ণ কণ্ঠে তর্জন করিলেন— ‘এই মন্দোদরি! আমার ডাবা চুরি করেছিস!’ তিনি ছোঁ মারিয়া ডাবাটি তুলিয়া লইলেন।

মন্দোদরী গালে হাত দিয়া বলিল— ‘ও মা! ওটা নাকি তোমার ডাবা! আমি চিনতে পারিনি।’

চিপিটকমূর্তি ডাবা খুলিয়া দেখিলেন একটিও পান নাই, তিনি অগ্নিশর্মা হইয়া বলিলেন— ‘রাক্কুসী! সব পান খেয়ে ফেলেছিস! দাঁড়া, আজ তোকে যমালয়ে পাঠাব। ঠেলা মেরে জলে ফেলে দেব, হাঙরে কুমীরে তোকে চিবিয়ে খাবে।’

মন্দোদরী নির্বিকার রহিল; সে জানে তাহাকে ঠেলা দিয়া জলে ফেলিয়া দিবার সামর্থ্য চিপিটকমূর্তির নাই। তাছাড়া এইরূপ অজাযুদ্ধ তাহাদের মধ্যে নিত্যই ঘটিয়া থাকে। চিপিটকমূর্তি মহাশয়ের কণ্ঠস্বর যেমন সূক্ষ্ম তাঁহার চেহারাটিও তেমনি নিরতিশয় ক্ষীণ। তাঁহাকে দেখিলে গঙ্গাফড়িং-এর কথা মনে পড়িয়া যায়; সারা গায়ে কেবল লম্বা এক জোড়া ঠ্যাং, আর যাহা আছে তাহা নামমাত্র। কিন্তু মাতুল মহাশয়ের পূর্ণ পরিচয় যথাসময়ে দেওয়া যাইবে।

দুই রাজকন্যা বাহুতে বাহু শৃঙ্খলিত করিয়া মাতুল মহাশয়ের বাহ্বাস্ফোট পরম কৌতুকে উপভোগ করিতেছেন ও হাসি চাপিবার চেষ্টা করিতেছেন। সূর্য তুঙ্গভদ্রার স্রোতে রক্ত উদ্‌গিরণ করিয়া অস্ত যাইতেছে। নৌকা সঙ্গমের নিকটবর্তী হইতেছে, সম্মিলিত নদীর উতরোল তরঙ্গে অল্প অল্প দুলিতে আরম্ভ করিয়াছে। নৌকাগুলি দক্ষিণদিকের তটভূমির পাশ ঘেঁষিয়া যাইতেছে, এইভাবে সঙ্গমের তরঙ্গভঙ্গ যথাসম্ভব এড়াইয়া তুঙ্গভদ্রার স্রোতে প্রবেশ করিবে। উত্তরের তটভূমি বেশ দূরে। মণিকঙ্কণার চঞ্চল চক্ষু জলের উপর ইতস্তত ভ্রমণ করিতে করিতে সহসা এক স্থানে আসিয়া স্থির হইল; কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া থাকিয়া সে বিদ্যুন্মালাকে বলিল— ‘মালা, দ্যাখ তো— ঐ জলের ওপর— কিছু দেখতে পাচ্ছিস!’ বলিয়া উত্তরদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিল।

চার

দুই ভগিনী উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বিদ্যুন্মালা চোখের উপর করতলের আচ্ছাদন দিয়া দেখিলেন, তারপর বলিয়া উঠিলেন— ‘হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি। একটা মানুষ ভেসে যাচ্ছে— ঐ যে হাত তুলল— হাতে কি একটা রয়েছে—’

মণিকঙ্কণাও দেখিতেছিল, বলিল— ‘কৃষ্ণা নদী দিয়ে ভেসে এসেছে, বোধহয় অনেক দূর থেকে সাঁতার কেটে আসছে— আর ভেসে থাকতে পারছে না— সঙ্গমের তোড়ের মুখে পড়লেই ডুবে যাবে।’

হঠাৎ মণিকঙ্কণা দ্রুতপদে নীচে নামিয়া গেল। বিদ্যুন্মীলা উৎকণ্ঠিতভাবে চাহিয়া রহিলেন। মামাও যুদ্ধে ক্ষান্ত দিয়া ইতি-উতি ঘাড় ফিরাইতে লাগিলেন। অন্য নৌকা দু’টির বাহিরে লোকজন নাই। কেহ কিছু লক্ষ্যও করিল না।

তারপর শঙ্খধ্বনি করিতে করিতে মণিকঙ্কণা আবার ছাদে উঠিয়া আসিল, সে শঙ্খ আনিবার জন্য নীচে গিয়াছিল। শাঁখ বাজাইয়া এক নৌকা হইতে অন্য নৌকায় দৃষ্টি আকর্ষণ করা এই নৌ-বহরের সাধারণ রীতি; কেবল আশঙ্কাজনক কিছু ঘটিলে ডঙ্কা বাজিবে। মণিকঙ্কণা পুনঃ পুনঃ শাঁখ বাজাইয়া চলিল; বিদ্যুন্মালা উদ্বেগভরা চক্ষে ভাসমান মানুষটার দিকে চাহিতে লাগিলেন। মানুষটা স্রোতের প্রবল আকর্ষণের মধ্যে পড়িয়া গিয়াছে এবং প্রাণপণে ভাসিয়া থাকিবার চেষ্টা করিতেছে।

শঙ্খনাদ শুনিয়া দ্বিতীয় নৌকার খোলের ভিতর হইতে পিল্‌ পিল্‌ করিয়া লোক বাহির হইয়া পটপত্তনের উপর দাঁড়াইল। সকলের দৃষ্টি ময়ূরপঙ্খীর দিকে। বিদ্যুন্মালা বাহু প্রসারিত করিয়া ভাসমান মানুষটাকে দেখাইলেন। সকলের চক্ষু সেইদিকে ফিরিল।

ব্যাপার বুঝিতে কাহারও বিলম্ব হইল না; একটা মানুষ স্রোতে পড়িয়া অসহায়ভাবে নাকানি-চোবানি খাইতেছে, তলাইয়া যাইতে বেশি দেরি নাই। তখন দ্বিতীয় নৌকা হইতে একজন লোক জলের মধ্যে লাফাইয়া পড়িল, ক্ষিপ্র বাহু সঞ্চালনে সাঁতার কাটিয়া মজ্জমানের দিকে চলিল। তাহার দেখাদেখি আরো দুই-তিনজন জলে ঝাঁপ দিল।

ময়ূরপঙ্খীর ছাদে দাঁড়াইয়া দুই রাজকন্যা, মন্দোদরী ও মাতুল চিপিটকমূর্তি সাগ্রহ উত্তেজনাভরে দেখিতে লাগিলেন; কিছুক্ষণ পরে বৃদ্ধ রাজবৈদ্য রসরাজও তাঁহাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। তিনি চোখে ভাল দেখেন না, মণিকঙ্কণা তাঁহাকে পরিস্থিতি বুঝাইয়া দিল।

প্রথম সাঁতারুর নাম বলরাম; লোকটা বলিষ্ঠ ও দীর্ঘবাহু। সে প্রবল বাহু তাড়নায় তীরের মত জল কাটিয়া অগ্রসর হইল; নদীর মাঝখানে উতরোল জলপ্রবাহ তাহার গতি মন্থর করিতে পারিল না; যেখানে মজ্জমান ব্যক্তি স্রোতের মুখে হাবুডুবু খাইতে খাইতে কোনোক্রমে ভাসিয়া চলিয়াছিল তাহার সন্নিকটে উপস্থিত হইল। লোকটি চতুর, কি করিয়া মজ্জমানকে উদ্ধার করিতে হয় তাহা জানে। মজ্জমান লোকের হাতের কাছে যাইলে সে উন্মত্তের ন্যায় উদ্ধর্তাকে জড়াইয়া ধরিবে; তাই বলরাম তাহার হাতের নাগালে না গিয়া তাহার সঙ্গে সঙ্গে ভাসিয়া চলিল।

ময়ূরপঙ্খীর ছাদে যাঁহারা শতচক্ষু হইয়া চাহিয়া ছিলেন তাঁহারা দেখিলেন, বলরাম ফিরিয়া আসিতেছে এবং তাহার পাঁচ-ছয় হাত ব্যবধানে মজ্জমান লোকটি তাহার অনুসরণ করিতেছে; যেন কোনো অদৃশ্যসূত্রে দুইজন আবদ্ধ রহিয়াছে। তারপর দেখা গেল, অদৃশ্য সূত্রটি বংশদণ্ড। দুইজনে বংশদণ্ডের দুইপ্রান্ত ধরিয়াছে এবং বলরাম অন্য ব্যক্তিকে নৌকার দিকে টানিয়া আনিতেছে। অন্য সাঁতারুরাও আসিয়া পড়িল। তখন দেখা গেল, একটা নয়, দুইটা বংশদণ্ড। সকলে মিলিয়া বংশের এক প্রান্ত ধরিয়া লোকটিকে টানিয়া আনিতে লাগিল।

নৌকার উপর সকলে বিস্ময় অনুভব করিলেন। বংশদণ্ড দু’টা কোথা হইতে আসিল? তবে কি মজ্জমান ব্যক্তির হাতেই লাঠি ছিল? কিন্তু লাঠি কেন?

ইতিমধ্যে দুইজন নাবিক বুদ্ধি করিয়া ডিঙিতে চড়িয়া ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইয়াছিল। কিন্তু মজ্জমান ব্যক্তিকে ডিঙিতে তোলা সম্ভব হইল না; উদ্ধার্তরা ডিঙির কানা ধরিল, ডিঙির নাবিকেরা দাঁড় টানিয়া সকলকে নৌকার দিকে লইয়া চলিল।

নৌকা তিনটি পাল নামাইয়াছিল এবং স্রোতের টানে অল্প অল্প পিছু হটতে আরম্ভ করিয়াছিল। মণিকঙ্কণা দেখিল ডিঙাটি মাঝের নৌকার দিকে যাইতেছে, সে হাত তুলিয়া আহ্বান করিল। তখন ডিঙা আসিয়া ময়ূরপঙ্খীর গায়ে ভিড়িল। বলরাম ও সাঁতারুরা নৌকায় উঠিল, মজ্জমানকে নৌকায় টানিয়া তুলিয়া নৌকার গুড়ার উপর শোয়াইয়া দিল। লোকটিকে দেখিয়া মৃত বলিয়া মনে হয়, কিন্তু সে দুই হাতে দুইটি বংশদণ্ড দৃঢ়মুষ্টিতে ধরিয়া আছে।

নৌকার ছাদ হইতে সকলে দেখিলেন জল হইতে সদ্যোদ্ধৃত ব্যক্তি বয়সে যুবা; তাহার দেহ দীর্ঘ এবং দৃঢ়, কিন্তু বর্তমানে শিথিল হইয়া পড়িয়াছে। দেহের গৌর বর্ণ দীর্ঘকাল জলমজ্জনের ফলে মৃত্যুবৎ পাংশু বর্ণ ধারণ করিয়াছে। বিদ্যুন্মালার হৃদয় ব্যথাভরা করুণায় পূর্ণ হইয়া উঠিল; আহা, হতভাগ্য যুবক কোন্‌ দৈব দুর্বিপাকে এরূপ অবস্থায় উপনীত হইয়াছে— হয়তো বাঁচবে না—

মণিকঙ্কণা তাঁহার মনের কথার প্রতিধ্বনি করিয়া সংহত কণ্ঠে বলিল— ‘বেঁচে আছে তো?’

মাতুল চিপিটকমূর্তি গ্রীবা লম্বিত করিয়া দেখিতেছিলেন, শিরঃসঞ্চালন করিয়া বলিলেন— ‘মরে গিয়েছে, জল থেকে তোলবার আগেই মরে গিয়েছে।’

বলরাম সংজ্ঞাহীন যুবকের বুকে হাত রাখিয়া দেখিতেছিল, সে ফিরিয়া ছাদের দিকে চক্ষু তুলিল, সসম্ভ্রমে বলিল— ‘আজ্ঞা না, বেঁচে আছে; বুক ধুক্‌ধুক্‌ করছে। রসরাজ মহাশয় দয়া করে একবার নাড়িটা দেখবেন কি?’

ক্ষীণদৃষ্টি রসরাজ এতক্ষণ সবই শুনিতেছিলেন এবং অস্পষ্টভাবে দেখিতেছিলেন, কিন্তু কিছুই ভালভাবে ধারণা করিতে না পারিয়া আকুলি-বিকুলি করিতেছিলেন। তিনি বলিয়া উঠিলেন— ‘হাঁ হাঁ, অবশ্য অবশ্য। আমি যাচ্ছি— এই যে—’

মণিকঙ্কণা তাঁহার হাত ধরিয়া পাটাতনের উপর নামাইয়া দিল, তিনি সন্তর্পণে গিয়া প্রথমে যুবকের গায়ে হাত দিয়া দেখিলেন, তারপর নাড়ি টিপিয়া ধ্যানস্থ হইয়া পড়িলেন। মণিকঙ্কণা তাঁহার পিছনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল, চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করিল— ‘কেমন দেখছেন?’

রসরাজ সজাগ হইয়া বলিলেন— ‘নাড়ি আছে, কিন্তু বড় দুর্বল। দাঁড়াও, আমি ওষুধ দিচ্ছি।’ তিনি রইঘরের দিকে চলিলেন। মণিকঙ্কণা তাঁহার সঙ্গে চলিল।

ময়ূরপঙ্খী নৌকায় দুইটি রইঘর; একটিতে দুই রাজকন্যা থাকেন, অন্যটিতে মাতুল চিপিটকমূর্তি ও রসরাজ। নিজের রইঘরে গিয়া রসরাজ একটি পেটরা খুলিলেন। পেটরার মধ্যে নানাবিধ ঔষধ, খল-নুড়ি প্রভৃতি রহিয়াছে। রসরাজ একটি স্ফটিকের ফুকা তুলিয়া লইলেন; তাহাতে জলের ন্যায় বর্ণহীন তরল পদার্থ রহিয়াছে। এই তরল পদার্থ তীব্রশক্তির কোহল। রসরাজ একটি পানপাত্রে অল্প জল লইয়া তাঁহাতে পাঁচ বিন্দু কোহল ফেলিলেন, মণিকঙ্কণার হাতে পাত্র দিয়া বলিলেন— ‘এতেই কাজ হবে। খাইয়ে দাও গিয়ে।’

মণিকঙ্কণা দ্রুতপদে উপরে গিয়া পাত্রটি বলরামের হাতে দিল, বলিল— ‘ওষুধ খাইয়ে দাও।’

‘এই যে রাজকুমারি?’ বলরাম পাত্রটি লইয়া নিপুণভাবে সংজ্ঞাহীনের মুখে ঔষধ ঢালিয়া দিল। মণিকঙ্কণা সপ্রশংস নেত্রে তাহার কার্যকলাপ দেখিতে দেখিতে বলিল— ‘তুমিই প্রথমে গিয়ে ওকে ভাসিয়ে রেখেছিলে— না? তোমার নাম কি?’ মণিকঙ্কণা রাজকন্যা হইলেও সকল শ্রেণীর লোকের সঙ্গে সহজভাবে কথা বলিতে পারে।

বলরাম হাত জোড় করিয়া বলিল— ‘দাসের নাম বলরাম কর্মকার। আমি বঙ্গদেশের লোক, তাই ভাল সাঁতার জানি।’

মণিকঙ্কণা কৌতূহলী চক্ষে বলরামকে দেখিল, হাসিমুখে ঘাড় নাড়িয়া তাহার পরিচয় স্বীকার করিল, তারপর ছাদে উঠিয়া গিয়া বিদ্যুন্মালার পাশে বসিল। রসরাজ মহাশয়ও ইতিমধ্যে ছাদে ফিরিয়া গিয়াছেন। ছাদ পাটাতন হইতে বেশি উচ্চ নয়, মাত্র তিন হাত। ছাদে উঠিবার দুই ধাপ তক্তার সিঁড়ি আছে। রসরাজ মহাশয় সহজেই ছাদে উঠিতে পারেন, কেবল নামিবার সময় কষ্ট।

অতঃপর প্রতীক্ষা আরম্ভ হইল, ঔষধের ক্রিয়া কতক্ষণে আরম্ভ হইবে। মাতুল ও রসরাজ নিম্নকণ্ঠে বাক্যালাপ করিতে লাগিলেন, দুই রাজকন্যা ঘনিষ্ঠভাবে বসিয়া মৃতকল্প যুবকের পানে চাহিয়া রহিলেন, মন্দোদরী থুম হইয়া বসিয়া রহিল।

অর্ধ দণ্ড কাটিতে না কাটিতে যুবক ধীরে ধীরে চক্ষু মেলিল। কিছুক্ষণ শূন্যদৃষ্টিতে চাহিয়া থাকিয়া উঠিবার চেষ্টা করিল। বলরাম তাহাকে ধরিয়া বসাইয়া দিল, সহাস্য মুখে বলিল— ‘এখন কেমন মনে হচ্ছে?’

দর্শকদের সকলের মুখেই উৎফুল্ল হাসি ফুটিয়াছে। যুবক প্রশ্নের উত্তর দিল না, ধীর সঞ্চারে ঘাড় ফিরাইয়া চারিদিকে চাহিতে লাগিল। বলরাম বলিল— ‘তুমি কে? তোমার দেশ কোথা? নাম কি? নদীতে ভেসে যাচ্ছিলে কেন?’

এবারও যুবক উত্তর দিল না, দুই হাতে লাঠিতে ভর দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইবার চেষ্টা করিল। রসরাজ ছাদ হইতে বলিলেন— ‘আহা, ওকে এখন প্রশ্ন কোরো না। নিজেদের নৌকায় নিয়ে যাও, আগে এক পেট গরম ভাত খাওয়াও। নাড়ি সুস্থ হবে, তখন যত ইচ্ছা প্রশ্ন কোরো।’

‘যে আজ্ঞা।’

বলরাম ও নাবিকেরা ধরাধরি করিয়া যুবককে ডিঙিতে তুলিল। ডিঙি মকরমুখী নৌকার দিকে চলিয়া গেল।

পশ্চিম আকাশে দিনের চিতা ভস্মাচ্ছাদিত হইয়াছে সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিতেছে। নৌকা তিনটি পাল তুলিয়া আবার সম্মুখদিকে চলিতে আরম্ভ করিল। আজ শুক্ল ত্রয়োদশী, আকাশে চাঁদ আছে। নৌকা তিনটি সঙ্গম পার হইয়া তুঙ্গভদ্রায় প্রবেশ করিবে, তারপর তীর ঘেঁষিয়া কিংবা নদীমধ্যস্থ চরে নোঙ্গর ফেলিবে। নদীতে রাত্রিকালে নৌকা চালনা নিরাপদ নয়।

রসরাজ মহাশয় উৎফুল্ল স্বরে বলিলেন— ‘কোহলের মত তেজস্কর ওষুধ আর আছে! পরিস্রুত সুরাসার— সাক্ষাৎ অমৃত। এক ফোঁটা মুখে পড়লে তিন দিনের বাসি মড়া শয্যায় উঠে বসে।’

মন্দোদরী একটি গভীর নিশ্বাস মোচন করিয়া বলিল— ‘জয় দারুব্রহ্ম।’

মণিকঙ্কণা হাসিয়া উঠিল— ‘এতক্ষণে মন্দোদরীর দারুব্রহ্মকে মনে পড়েছে। — চল মালা, নীচে যাই। আজ আর চুল বাঁধা হল না।’

পাঁচ

শুক্ল ত্রয়োদশীর চাঁদ মাথার উপর উঠিয়াছে। নৌকা তিনটি সঙ্গম ছাড়াইয়া তুঙ্গভদ্রার খাতে প্রবেশ করিয়াছে এবং একটি চরের পাশে পরস্পর হইতে শতহস্ত ব্যবধানে নোঙ্গর ফেলিয়াছে। চারিদিক নিথর নিস্পন্দ, বহতা নদীর স্রোতেও চাঞ্চল্য নাই; চরাচর যেন জ্যোৎস্নার সূক্ষ্ম মল্লবস্ত্র সর্বাঙ্গে জড়াইয়া তন্দ্রাঘোরে অবাস্তবের স্বপ্ন দেখিতেছে।

ময়ূরপঙ্খী নৌকার একটি রইঘর স্নিগ্ধ দীপের প্রভায় উন্মেষিত। সন্ধ্যাকালে ঘরে অগুরু-চন্দনের ধূপ জ্বালা হইয়াছিল, তাহার গন্ধ এখনো মিলাইয়া যায় নাই। একটি সুপরিসর শয্যার উপর দুই রাজকন্যা পাশাপাশি শয়ন করিয়াছেন। মন্দোদরী দ্বারের সম্মুখে আড় হইয়া জলহস্তীর ন্যায় ঘুমাইতেছে।

রাজকুমারীদের চেতনা বারংবার তন্দ্রা ও জাগরণের মধ্যে যাতায়াত করিতেছে। বৈচিত্র্যহীন জলযাত্রার মাঝখানে আজ হঠাৎ একটি অতর্কিত ঘটনা ঘটিয়াছে; তাই তাঁহাদের উৎসুক মন নিদ্রার সীমান্তে পৌঁছিয়া আবার জাগ্রতে ফিরিয়া আসিতেছে। অপরাহ্ণের ঘটনাগুলি বিচ্ছিন্নভাবে তাঁহাদের চোখের সামনে ভাসিয়া উঠিতেছে।

দুই ভগিনী মুখোমুখি শুইয়াছিলেন। মণিকঙ্কণা এক সময় চক্ষু খুলিয়া দেখিল বিদ্যুন্মালার চক্ষু মুদিত, সেও চক্ষু মুদিত করিল। ক্ষণেক পরে বিদ্যুন্মালা চক্ষু মেলিলেন, দেখিলেন কঙ্কণার চক্ষু মুদিত, তিনি আবার চক্ষু নিমীলিত করিলেন। তারপর দুইজনে একসঙ্গে চক্ষু খুলিলেন।

দুইজনের মুখে হাসি উপচিয়া পড়িল। মণিকঙ্কণা বিদ্যুন্মালার মুখের আরো কাছে মুখ আনিয়া শুইল। বিদ্যুন্মালা ফিস্‌ফিস্ করিয়া বলিলেন— ‘ভাগ্যে তুই দেখতে পেয়েছিলি, নইলে লোকটাকে উদ্ধার করা যেত না।’

মণিকঙ্কণা ঘাড় নাড়িয়া বলিল— ‘মানুষটি উচ্চবর্ণের মনে হল। ব্রাহ্মণ কিংবা ক্ষত্রিয়।’

বিদ্যুন্মালা বলিলেন— ‘কিন্তু গলায় পৈতে ছিল না।’

মণিকঙ্কণা বলিল— ‘পৈতে হয়তো নদীর জলে ভেসে গিয়েছিল। কিন্তু হাতে লাঠি কেন ভাই? লাঠি নিয়ে কেউ কি জলে নামে?’

বিদ্যুন্মালা ভাবিতে ভাবিতে বলিলেন— ‘হয়তো ইচ্ছে করেই লাঠি নিয়ে জলে নেমেছিল, যাতে ভেসে থাকতে পারে। বাঁশের লাঠি তো, ভাসিয়ে রাখে।’

‘তাই হবে।’

তারপর আরো কিছুক্ষণ জল্পনা-কল্পনার পর তাঁহাদের চোখের পাতা ভারী হইয়া আসিল, তাঁহারা ধীরে ধীরে ঘুমাইয়া পড়িলেন।

ময়ূরপঙ্খীর যে কক্ষটিতে রসরাজ ও চিপিটকমূর্তি থাকেন তাহা নিষ্প্রদীপ। দুইজনে পৃথক শয্যায় শয়ন করিয়াছেন। রসরাজ মহাশয় সাত্ত্বিক প্রকৃতির মানুষ, তিনি নিদ্রা গিয়াছেন। চিপিটক অন্ধকারে জাগিয়া আছেন; তাঁহার মস্তিষ্কবিবরে নানা কুটিল চিন্তা উইপোকার ন্যায় বিচরণ করিয়া বেড়াইতেছে— যে লোকটিকে নদী হইতে তোলা হইয়াছে সে হিন্দু না মুসলমান? মুসলমান হইলে শত্রুর গুপ্তচর হইতে পারে; হিন্দু হইলেও হইতে পারে— আজকাল কে শত্রু কে মিত্র বোঝা কঠিন। ছুতা করিয়া নৌকায় উঠিয়াছে কী অভিসন্ধি লইয়া নৌকায় উঠিয়াছে কে বলিতে পারে—

চিপিটকমূর্তির গঙ্গাফড়িং-এর ন্যায় আকৃতির কথা পূর্বে বলা হইয়াছে, এবার তাঁহার প্রকৃতিগত পরিচয় দেওয়া যাইতে পারে। মাতুল মহোদয়ের যথার্থ নাম চিপিটক নয়, অবস্থাগতিকে চিপিটক হইয়া পড়িয়াছিল। বিংশ বৎসর পূর্বে কলিঙ্গের চতুর্থ ভানুদেব দক্ষিণ দেশের এক সামন্তরাজার কন্যাকে বিবাহ করিয়া যখন স্বদেশে ফিরিলেন, তখন তাঁহার অসংখ্য শ্যালকদিগের মধ্যে একটি শ্যালক সঙ্গে আসিলেন। কিছুকাল কাটিবার পর ভানুদেব দেখিলেন শ্যালকের স্বগৃহে ফিরিবার ইচ্ছা নাই; তিনি তখন তাঁহাকে রাজপরিবারের ভাণ্ডারীর পদে নিযুক্ত করিলেন। রাজ-ভাণ্ডারে বহুবিধ খাদ্যসামগ্রীর সঙ্গে রাশি রাশি চিপিটক স্তূপীকৃত থাকে, দধি ও গুড় সহযোগে ইহাই ভৃত্য-পরিজনের জলপান। শ্যালক মহাশয়ের আদি নাম বোধকরি হরিআপ্পা কৃষ্ণমূর্তি গোছের একটা কিছু ছিল, কিন্তু তিনি যখন ভাণ্ডারের ভার গ্রহণ করিয়া পরমানন্দে চিপিটক বিতরণ করিতে লাগিলেন তখন ভৃত্য-পরিজনের মধ্যে তাঁহার নাম অচিরাৎ চিপিটকমূর্তিতে পরিণত হইল। ক্রমে নামটি সাধারণের মধ্যেও প্রচারিত হইল। শুধু চিপিটক বিতরণের জন্যই নয়, শ্যালক মহাশয়ের নাকটিও ছিল চিপিটকের ন্যায় চ্যাপ্টা।

মনুষ্যচরিত্র লইয়া প্রকৃতির এক বিচিত্র পরিহাস দেখা যায়, যাহার বুদ্ধি যত কম সে নিজেকে তত বেশি বুদ্ধিমান মনে করে। চিপিটকমূর্তি মহাশয় পিতৃরাজ্যে অবস্থানকালে নিজের ভ্রাতাদের কাছে নির্বুদ্ধিতার জন্য প্রখ্যাত ছিলেন, তাই সুযোগ পাইবামাত্র তিনি অভিমানভারে ভগিনীপতির রাজ্যে চলিয়া আসিয়াছিলেন। তারপর রাজ-ভাণ্ডারের অধিকর্তার পদ পাইয়া তাঁহার ধারণা জন্মিয়াছিল যে ভানুদেব তাঁহার বুদ্ধির মর্যাদা বুঝিয়াছেন। কিন্তু তবু তাঁহার নিভৃত অন্তরে যে চরম আশাটি লুক্কায়িত ছিল তাহা অদ্যাপি পূর্ণ হয় নাই।

দক্ষিণাত্যে উপনিবিষ্ট আর্য জাতির মধ্যে— সম্ভবত দ্রাবিড় জাতির সহিত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ফলে— একটি বিশেষ সামাজিক নীতি প্রচলিত হইয়াছিল; তাহা এই যে, মাতুলের সহিত ভাগিনেয়ীর বিবাহ পরম স্পৃহনীয় ও বাঞ্ছিত বিবাহ। উত্তরাপথে যাঁহারা এই জাতীয় বিবাহকে ঘৃণার চক্ষে দেখিতেন তাঁহারাও দাক্ষিণাত্যে গিয়া দেশাচার ও লোকাচার বরণ করিয়া লইতেন। দীর্ঘকালের ব্যবহারে ইহা সহজ ও স্বাভাবিক বিধান বলিয়া গণ্য হইয়াছিল। তাই চিপিটকমূর্তি যখন ভগিনীপতির ভবনে আসিয়া অধিষ্ঠিত হইলেন তখন তাঁহার মনে দূর ভবিষ্যতের একটি আশা বীজরূপে বিরাজ করিতেছিল। যথাকলে তাঁহার একটি ভাগিনেয়ীর আবির্ভাব ঘটিল, চিপিটকের আশা অঙ্কুরিত হইল। তারপর বৎসরের পর বৎসর কাটিয়া যাইতে লাগিল, কিন্তু মাতুলের সহিত রাজকন্যার বিবাহের প্রসঙ্গ কেহ উত্থাপন করিল না; চিপিটকের আশার অঙ্কুর জলসিঞ্চনের অভাবে ম্রিয়মাণ হইয়া রহিল; শ্যালকরাপে রাজসংসারে প্রবেশ করিয়া রাজ-জামাতা পদে উন্নীত হইবার উচ্চাশা তাঁহার ফলবতী হইল না। চিপিটকমূর্তি একবার ভগিনীর কাছে কথাটা উত্থাপন করিয়াছিলেন, শুনিয়া রাজমহিষী হাসিয়া গড়াইয়া পড়িয়াছিলেন; বলিয়াছিলেন— ‘একথা অন্য কারুর কাছে বলো না।’

প্রকৃত কথা, কলিঙ্গের সমাজবিধি ঠিক আর্যাবর্তের মতও নয়, দক্ষিণাত্যের মতও নয়, মধ্যপথগামী। ভারতের মধ্যপ্রদেশীয় রাজ্যগুলির অবস্থা প্রায় একই প্রকার; তাহারা সুবিধামত একূল-ওকূল দুকূল রাখিয়া চলে। কলিঙ্গের লোকেরা মামা-ভাগিনেয়ীর বিবাহকে ঘৃণার চক্ষে দেখে না। আবার অতি উচ্চাঙ্গের সৎকার্য বলিয়াও মনে করে না। স্ত্রীলোকের কাছা দিয়া কাপড় পরার মত ইহা তাহাদের কাছে কৌতুকজনক ব্যাপার, তার বেশি নয়।

চিপিটক কিন্তু আশা ছাড়িলেন না, ধৈর্য ধরিয়া রহিলেন। ভাগিনেয়ী বিদ্যুন্মালা বড় হইয়া উঠিল। তারপর যুদ্ধ-বিগ্রহ নানা বিপর্যয়ের মধ্যে বিদ্যুন্মালার বিবাহ স্থির হইল বিজয়নগরের দেবরায়ের সঙ্গে। এবং এমনই ভাগ্যের পরিহাস যে, চিপিটকমূর্তি বধূর মাতুল বিধায় অভিভাবকরূপে তাঁহার সঙ্গে প্রেরিত হইলেন।

আশা আর বিশেষ ছিল না। কিন্তু চিপিটক হাল ছাড়িবার পাত্র নন, তিনি নৌকায় চড়িয়া চলিলেন। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ।

সে-রাত্রে নৌকার অন্ধকার রইঘরে শয়ন করিয়া চিপিটক চিন্তা করিতেছিলেন— নদী হইতে উদ্ধৃত লোকটা নিশ্চয় মুসলমান এবং শত্রুর গুপ্তচর। কাল সকালে তাহাকে নৌকায় ডাকিয়া কূট প্রশ্ন করিলেই গুপ্তচরের স্বরূপ বাহির হইয়া পড়িবে। গুপ্তচর যত ধূর্তই হোক চিপিটকের চক্ষে ধূলি দিতে পরিবে না।

ছয়

ওদিকে মকরমুখী নৌকায় সকলে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। কেবল দুইজন রাত-প্রহরী নৌকার সম্মুখে ও পিছনে জাগিয়া বসিয়া ছিল। আর জাগিয়া ছিল বলরাম কর্মকার ও জলোদ্ধৃত যুবক। চাঁদের আলোয় পাটাতনের উপর বসিয়া দুইজনে নিম্নস্বরে কথা বলিতেছিল। যুবক এক পেট গরম ভাত খাইয়া ও দুই দণ্ড ঘুমাইয়া লইয়া অনেকটা চাঙ্গা হইয়া উঠিয়াছে।

তাহাদের বাক্যালাপ অধিকাংশই প্রশ্নোত্তর; বলরাম প্রশ্ন করিতেছে, যুবক উত্তর দিতেছে। বলরাম যে যুবককে প্রশ্ন করিতেছে তাহা কেবল কৌতূহল প্রণোদিত নয়, অনাহূত অতিথির প্রকৃত পরিচয় সংগ্রহ করাই তাহার মূল উদ্দেশ্য। এ বিষয়ে বুদ্ধিহীন চিপিটকমূর্তি ও বুদ্ধিমান বলরামের মনোভাব একই প্রকার।

বলরাম বলিল— ‘তুমি যে মুসলমান নও তা আমি বুঝেছি। তোমার নাম কি?’

যুবক বলরামের দিকে চকিত দৃষ্টিপাত করিয়া চরের দিকে চক্ষু ফিরাইল, অস্পষ্ট স্বরে বলিল— ‘আমার নাম অর্জুনবর্মা।’

বলরাম মৃদুস্বরে হাসিল— ‘ভাল। আমি ভেবেছিলাম তোমার নাম বুঝি দণ্ডপাণি।’

অর্জুনবর্মার পাশে দণ্ড দু’টি রাখা ছিল, সে একবার সেই দিকে চক্ষু নামাইয়া বলিল— ‘তুমি আজ আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ। কিন্তু এই দণ্ড দু’টি না থাকলে এতদূর আসতে পারতাম না, তার আগেই ডুবে যেতম।’

বলরাম বলিল— ‘তুমি কোথা থেকে আসছ?’

অর্জুনবর্মা বলিল— ‘গুলবর্গা থেকে।’

বলরাম বলিল— ‘গুলবর্গা— নাম শুনেছি। দক্ষিণে যবনদের রাজধানী। ওরা বড় অত্যাচারী, বর্বর জাত। আমিও ওদের জন্যে দেশ ছেড়েছি। বাংলা দেশ যবনে ছেয়ে গেছে। তুমিও কি ওদের অত্যাচারে দেশ ছেড়েছ?’

‘হ্যাঁ।’ অর্জুনবর্মা থামিয়া থামিয়া বলিতে লাগিল— ‘গুলবর্গার কাছে ভীমা নদী— ওদের অত্যাচারে আজ সকালবেলা ভীমা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলাম— ভীমা এসে কৃষ্ণাতে মিশেছে— তার অনেক পরে কৃষ্ণা তুঙ্গভদ্রায় মিশেছে— এত দূর তা ভাবিনি— লাঠি দুটো ছিল তাই কোনোমতে ভেসে ছিলাম— তারপর তুমি বাঁচালে—’

বলরাম প্রশ্ন করিল— ‘কোথায় যাচ্ছিলে?’

‘বিজয়নগর। ভেবেছিলাম সাঁতার কাটে তুঙ্গভদ্রার দক্ষিণ তীরে উঠব, তারপর পায়ে হেঁটে বিজয়নগরে যাব।’

‘তা ভালই হল। আমরাও বিজয়নগরে যাচ্ছি। তোমার পায়ে হাঁটার পরিশ্রম বেঁচে গেল।’

কিছুক্ষণ উভয়ে নীরব রহিল, তারপর অর্জুনবর্মা প্রশ্ন করিল— ‘তোমরা কোথা থেকে আসছ?’

‘কলিঙ্গ থেকে। তিন মাসের পথ।’

‘সামনের বড় নৌকায় কারা যাচ্ছে?’

বলরাম একটু চিন্তা করিল। কিন্তু এখন তাহারা তুঙ্গভদ্রার স্রোতে প্রবেশ করিয়াছে, নদীর দুই কূলেই বিজয়নগরের অধিকার, যবন রাজ্যে অনেক দূরে কৃষ্ণার পরপারে, সুতরাং অধিক সাবধানতা নিষ্প্রয়োজন। সে বলিল— ‘কলিঙ্গের দুই রাজকন্যা যাচ্ছেন। বড় রাজকন্যার সঙ্গে বিজয়নগরের রাজা দেবরায়ের বিয়ে হবে।’

অর্জুনবর্মা আর কোনো ঔৎসুক্য প্রকাশ করিল না। বলরাম পাটাতনের উপর লম্বমান হইয়া বলিল— ‘রাত হয়েছে, শুয়ে পড়। এখনো তোমার শরীরের গ্লানি দূর হয়নি।’

অর্জুন লাঠি দু’টি পাশে লইয়া শয়ন করিল, বলিল— ‘তোমার নিজের কথা তো বললে না। তুমি কলিঙ্গ দেশের মানুষ, বাংলা দেশের কথা কী বলছিলে?’

বলরাম বলিল— ‘আমি কলিঙ্গ থেকে আসছি বটে, কিন্তু বাংলা দেশের লোক। আমার নাম বলরাম, জাতিতে কর্মকার।’

অর্জুন বলিল— ‘বাংলা দেশ তো অনেক দূর। তুমি দেশ ছেড়ে এতদূর এসেছ!’

বলরাম আক্ষেপভরে বলিল— ‘আরে ভাই, বাংলা দেশ কি আর বাংলা দেশ আছে, শ্মশান হয়ে গেছে; সেই শ্মশানে বিকট প্রেত-পিশাচ নেচে বেড়াচ্ছে। তাই দেশ ছেড়ে পালিয়ে এসেছি।’

‘বাংলা দেশে বুঝি যবন রাজা?’

‘হ্যাঁ। মাঝে কয়েক বছর রাজা গণেশ সিংহাসনে বসেছিলেন, বাঙ্গালী হিন্দুর বরাত ফিরেছিল। তারপর আবার যে-নরক সেই নরক।’

‘ওরা বড় অত্যাচারী, বড় নৃশংস—’ অর্জুনের কথাগুলি অসমাপ্ত রহিয়া গেল, যেন মনের মধ্যে অসংখ্য অত্যাচার ও নৃশংসতার কাহিনী অকথিত রহিয়া গেল।

বলরাম হঠাৎ বলিল— ‘ভাল কথা, তোমার বিয়ে হয়েছে?’

‘না।’ আকাশে অবরোহী চন্দ্রের পানে চাহিয়া অর্জুন ম্রিয়মাণ স্বরে বলিল— ‘যবনের রাজধানীতে বিয়ে করলে তার প্রাণসংশয়, বিশেষত যদি বৌ সুন্দরী হয়। যাদের ঘরে সুন্দরী মেয়ে জন্মেছে তারা মেয়ের বয়স সাত-আট হতে না হতেই বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়। অনেকে মেয়ের মুখে ছুরি দিয়ে দাগ কেটে মেয়েকে কুৎসিত করে দেয়, যাতে যবনদের নজর না পড়ে। তাতেও রক্ষে নেই, মুসলমান সিপাহীরা যুবতী মেয়ে দেখলেই ধরে নিয়ে যায়, আর স্বামীকে কেটে রেখে যায়; যাতে নালিশ করবার কেউ না থাকে। দক্ষিণ দেশে মেয়েদের পর্দা ছিল না; এখন তারা যবনের ভয়ে ঘর থেকে বেরোয় না।’

বলরাম উত্তেজিতভাবে উঠিয়া বসিয়া বলিল— ‘যেখানে যবন সেখানেই এই দশা। তবে আমার জীবনের কাহিনী বলি শোনো। বর্ধমানের নাম তুমি বোধহয় শোননি; দামোদর নদের তীরে মস্ত নগর। সেখানে আমার কামারশালা ছিল; বেশ বড় কামারশালা। কাস্তে কুড়ুল কাটারি তৈরি করতাম, ঘোড়ার ক্ষুরে নাল ঠুকতাম, গরুর গাড়ির চাকায় হাল বসাতাম। তলোয়ার, সড়কি, এমনকি কামান পর্যন্ত তৈরি করতে জানি, কিন্তু মুসলমান রাজারা তৈরি করতে দিত না; মাঝে মাঝে রাজার লোক এসে তদারক করে যেত। আমরা অবশ্য লুকিয়ে লুকিয়ে অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করতাম। কিন্তু সে যাক—

‘একবার লোহা কিনতে জংলীদের গাঁয়ে গিয়েছিলাম। ওরা পাহাড় জঙ্গল থেকে লোহা-নুড়ি সংগ্রহ করে এনে পুড়িয়ে লোহা তৈরি করে; আমরা কামারেরা গরুর গাড়ি নিয়ে যেতাম, তাদের কাছ থেকে লোহা কিনে আনতাম। সেবার গাঁ থেকে লোহা কিনে দু’দিন পরে ফিরে এসে দেখি, মুসলমান সেপাইরা আমার কামারশালা তছনছ করে দিয়েছে, আর আমার বৌটাকে ধরে নিয়ে গেছে—’ বলরাম আবার শয়ন করিল, কিছুক্ষণ আকাশের পানে চাহিয়া থাকিয়া গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলিল— ‘বৌটা মুখরা ছিল বটে, কিন্তু ভারি সুন্দর দেখতে ছিল। যাক গে, মরুক গে। যে যেমন কপাল নিয়ে এসেছে। আমার আর দেশে মন টিকল না। ভাবলাম যে-দেশে মুসলমান নেই সেই দেশে যাব। তারপর একদিন লোহার ডাণ্ডা দিয়ে একটা জঙ্গি জোয়ানের মাথা ফাটিয়ে দিয়ে কলিঙ্গ দেশে চলে এলাম।

‘কলিঙ্গ দেশে এখনও যবন ঢুকতে পারেনি। কিন্তু ঢুকতে কতক্ষণ? আমি একেবারে কলিঙ্গের দক্ষিণ কোণে কলিঙ্গপত্তনে এসে আবার নতুন করে কামারশালা ফেঁদে বসলাম। কলিঙ্গে তখন যুদ্ধ চলছে, কামারদের খুব পসার। আমি অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করতে লেগে গেলাম। রাজা থেকে পদাতি পর্যন্ত সবাই আমার নাম জেনে গেল। তারপর যুদ্ধ থামল, বিজয়নগরের রাজার সঙ্গে কলিঙ্গের রাজকন্যার বিয়ে ঠিক হল। নৌ-বহর সাজিয়ে রাজকন্যে বিয়ে করতে যাবেন। আমি ভাবলাম, দূর ছাই, দেশ ছেড়ে এতদূর যখন এসেছি তখন বিজয়নগরেই বা যাব না কেন? বিজয়নগরের রাজবংশ বীরের বংশ, একশো বছর ধরে যবনদের কৃষ্ণা নদী ডিঙোতে দেননি। বর্তমান রাজা শুধু বীর নয়, গুণের আদর জানেন; যদি তাঁর নজরে পড়ে যাই আমার বরাত ফিরে যাবে। গেলাম নৌ-নায়ক মশায়ের কাছে। নৌ-বহরে দূরযাত্রার সময় যেমন সঙ্গে ছুতোর দরকার, তেমনি কামারও দরকার। নৌ-নায়ক মশায় আমার নাম জানতেন, খুশি হয়ে নৌকোয় কাজ দিলেন। আর কি, যন্ত্রপাতি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সেই থেকে চলেছি।’

বলরামের কথা বলিবার ভঙ্গি হইতে মনে হয়, সে জীবনে অনেক দুঃখ পাইয়াছে, কিন্তু দুঃখ বস্তুটাকে সে বেশি আমল দেয় না। দুঃখ তো আছেই, দুঃখ তো জীবনের সঙ্গী; তাহার ফাঁকে ফাঁকে যতটুকু সুখ আহরণ করা যায় ততটুকুই লাভ।

বলরাম ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল, অর্জুনবর্মার চক্ষু মুদিত, সে বোধ হয় ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। তাহার ক্লান্তি-শিথিল মুখের পানে চাহিয়া বলরাম হৃদয়ের মধ্যে একটু স্নেহের ভাব অনুভব করিল। আহা, ছেলেটার কতই বা বয়স হইবে, বড় জোর একুশ-বাইশ, বলরামের চেয়ে অন্তত দশ বছরের ছোট। এই বয়সে অভাগা অনেক দুঃখ পাইয়াছে; অনেক দুঃখ না পাইলে কেহ দেশ ছাড়িয়া পলাইবার জন্য নদীতে ঝাঁপাইয়া পড়ে না।

সাত

পরদিন প্রত্যূষে নৌকা তিনটি নোঙ্গর তুলিয়া আবার উজানে যাত্রা করিল।

তুঙ্গভদ্রায় বড় নৌকা চালানো কিন্তু কৌশলীসাধ্য কর্ম, তজ্জন্য আড়কাঠির সাহায্য লইতে হয়। নদীগর্ভ পূর্বের ন্যায় গভীর নয়, নদীর তলদেশ শিলাপ্রস্তরে পূর্ণ কোথাও পাথুরে দ্বীপ জল হইতে মাথা ঠেলিয়া উঠিয়াছে; অতি সাবধানে লগি দিয়া জল মাপিতে মাপিতে অগ্রসর হইতে হয়। নদীর প্রসারও অধিক নয়, কোথাও পঞ্চদশ রজ্জু, কোথাও আরো কম; দুই তীরের উচ্চ পাষাণ-প্রাকার নদীকে সঙ্কীর্ণ খাতে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে। নৌকা নদীর মাঝখান দিয়া চলিলেও দুই তীর নিকটবর্তী।

সঙ্গে দেশজ্ঞ আড়কাঠি আছে, তাহার নির্দেশে হাঙ্গরমুখী নৌকাটি সবাগ্রে চলিল। তার পিছনে ময়ূরপঙ্খী, সর্বশেষে ভড়। হাঙ্গরমুখী নৌকা অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ও লঘু, তাই আড়কাঠি তাহাতে থাকিয়া পথ দেখাইয়া চলিল। কখনো দক্ষিণ তীর ঘেঁষিয়া, কখনো উত্তর তীর চুম্বন করিয়া; কখনো দাঁড় টানিয়া, কখনো পাল তুলিয়া নৌকা তিনটি ভুজঙ্গপ্রয়াত গতিতে স্রোতের বিপরীত মুখে অগ্রসর হইল।

মধ্যাহ্নে আহারাদি সম্পন্ন হইলে চিপিটকমূর্তি আজ্ঞা দিলেন— ‘যে লোকটাকে কাল নদী থেকে তোলা হয়েছে, আমার সন্দেহ সে শত্রুর গুপ্তচর; তাকে এই নৌকায় নিয়ে এস। সঙ্গে যেন দু’জন সশস্ত্র রক্ষী থাকে।’

চিপিটকমূর্তি যদিও সাক্ষিগোপাল, তবু তিনি নামত এই অভিযানের নায়ক, তাই তাঁহার ছোটখাটো আদেশ সকলে মানিয়া চলিত।

মকরমুখী নৌকায় আদেশ পৌঁছিলে অর্জুনবর্মা লাঠি দু’টি হাতে লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। বলরাম হাসিয়া বলিল— ‘লাঠি রেখে যাও। চিপিটক মামার কাছে লাঠি নিয়ে গেলে মামার নাভিশ্বাস উঠবে।’

অর্জুনবর্মা ক্ষণেক চিন্তা করিয়া বলরামকে বলিল— ‘তুমি লাঠি দু’টি রাখ, আমি ফিরে এসে নেব।’

অর্জুন দুইজন সশস্ত্র প্রহরীসহ ডিঙিতে চড়িয়া ময়ূরপঙ্খী নৌকায় চলিয়া গেল। বলরাম কৌতূহলের বশে লাঠি দু’টি ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিতে লাগিল। সে লাঠির দেশের লোক, যে-দেশে বাঁশের লাঠিই সাধারণ লোকের প্রধান অস্ত্র সেই দেশের মানুষ। সে দেখিল, বাঁশের লাঠি দু’টি বাংলা দেশের লাঠির মতই, বিশেষ পার্থক্য নাই; ছয় হাত লম্বা, গাঁটগুলি ঘনসন্নিবিষ্ট, দুই প্রান্তে পিতলের তারের শক্ত বন্ধন; যেমন দৃঢ় তেমনি লঘু। এরূপ একটি লাঠি হাতে থাকিলে পঞ্চাশজন শত্রুর মহড়া লওয়া যায়। কিন্তু দু’টি লাঠি কেন? বলরাম লাঠি দু’টি হাতে তৌল করিয়া দেখিল; তাহাদের গর্ভে সোনা-রূপা লুকানো থাকিলে এত লঘু হইত না, জলে পড়িলে ডুবিয়া যাইত। তবে অর্জুনবর্মা লাঠি দু’টি হাতছাড়া করিতে চায় না কেন? ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া ভাবিতে ভাবিতে হঠাৎ একটা কথা তাহার মনে হইল, সে আবার লাঠি দু’টিকে ভালভাবে পরীক্ষা করিল। ও— এই ব্যাপার। তাহার ধারণা ছিল বাংলা দেশের বাহিরে এ কৌশল আর কেহ জানে না, তা নয়। বলরামের মুখে হাসি ফুটিল; সে বুঝিল অর্জুনবর্মা বয়সে তরুণ হইলেও দূরদর্শী লোক।

ওদিকে অর্জুনবর্মা ময়ূরপঙ্খী নৌকায় পৌঁছিয়াছিল। কিন্তু বাহিরে পাটাতনের উপর বা রইঘরের ছাদে প্রখর রৌদ্র; চিপিটক তাহাকে নিজ কক্ষে ডাকিয়া পাঠাইলেন; কক্ষটি দিবা দ্বিপ্রহরেও ছায়াচ্ছন্ন। দারুনির্মিত দেওয়ালগুলিতে জানালা নাই, জানালার পরিবর্তে তঙ্কার ন্যায় ক্ষুদ্রাকৃতি অনেকগুলি ছিদ্র প্রাচীরগাত্রে জাল রচনা করিয়াছে; এইগুলি আলো এবং বাতাসের প্রবেশপথ। চিপিটক একটি মাদুরের উপর বালিশে হেলান দিয়া বসিয়া আছেন। এক কোণে বৃদ্ধ রসরাজ একখানি পুঁথি, বোধহয় সুশ্রুত-সংহিতা, চোখের নিকট ধরিয়া পাঠ করিবার চেষ্টা করিতেছেন। অর্জুনবর্মা ঘরে প্রবেশ করিয়া একবার দুই করতল যুক্ত করিয়া সম্ভাষণ জানাইল, তারপর আবার দ্বারের সন্নিকটে উপবিষ্ট হইল।

বলা বাহুল্য, অর্জুনবর্মাকে যখন নৌকায় ডাকা হইয়াছিল তখন রাজকন্যারা জানিতে পারিয়াছিলেন; স্বভাবতই তাঁহাদের কৌতূহল উদ্রিক্ত হইয়াছিল। অর্জুনবর্মা মামার কক্ষে প্রবেশ করিলে মণিকঙ্কণা চুপিচুপি বলিল— ‘মালা, চল্‌, ও-ঘরে কি কথাবার্তা হচ্ছে শুনি।’

বিদ্যুন্মালা ঈষৎ ভ্রূ তুলিয়া বলিলেন— ‘ও-ঘরে আমাদের যাওয়া উচিত হবে?’

মণিকঙ্কণা বলিল— ‘ও-ঘরে যাব কেন? দেওয়ালের ঘুলঘুলি দিয়ে উঁকি মারব। আয়।’

দুই ভগিনী নিজ কক্ষ হইতে বাহির হইয়া পাশের দিকে চলিলেন, সন্তর্পণে সচ্ছিদ্র গৃহ-প্রাচীরের কাছে গিয়া ছিদ্রপথে দৃষ্টি প্রেরণ করিলেন। কক্ষের অভ্যন্তরে তখন পরম উপভোগ্য প্রহসন আরম্ভ হইয়াছে।

চিপিটক বালিশ ছাড়িয়া চিড়িক মারিয়া উঠিয়া বসিলেন, অর্জুনবর্মার দিকে অভিযোগী অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া রমণীসুলভ কণ্ঠে তর্জন করিলেন— ‘তুমি স্নেচ্ছা! তুমি মুসলমান।’

অর্জুনবর্মার মেরুদণ্ড কঠিন ও ঋজু হইয়া উঠিল, চোখে বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল; সে মেঘমন্দ্র স্বরে বলিল— ‘না, আমি হিন্দু, ক্ষত্রিয়।’

চিপিটক তাহার কণ্ঠস্বর শুনিয়া চমকিয়া উঠিয়াছিলেন, সামলাইয়া লইয়া বলিলেন— ‘বটে! বটে! তুমি কেমন ক্ষত্রিয় এখনি বোঝা যাবে। — ওরে, ওর গা শুঁকে দেখ তো, হিঙ্গু-পলাণ্ডু-রসুনের গন্ধ বেরুচ্ছে কি না।’

রক্ষিদ্বয় আদেশ পাইয়া অর্জুনবর্মার গা শুঁকিল, বলিল— ‘আজ্ঞা না, পেঁয়াজ-রসুন-হিঙের গন্ধ নেই।’

ঘরের কোণে বসিয়া রসরাজ শুনিতেছিলেন, তিনি বিরক্তিসূচক চট্‌কার শব্দ করিলেন। চিপিটক কিন্তু দমিলেন না, বলিলেন— ‘হুঁ, গায়ের গন্ধ নদীর জলে ধুয়ে গেছে। — তোমার নাম কি?’

অর্জুনবর্মা নাম বলিল। শুনিয়া চিপিটক বলিলেন— ‘বটে— অর্জুনবর্মা। একেবারে পৌরাণিক নাম! ভাল, বল দেখি, অর্জুন কে ছিল?’

অর্জুনবর্মা এতক্ষণে চিপিটক মামার বিদ্যাবুদ্ধি বুঝিয়া লইয়াছে; কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে রঙ্গকৌতুকে তাহার রুচি নাই। সে গম্ভীর মুখে বলিল— ‘পাণ্ডব।’

‘হুঁ অর্জুনের বাবার নাম কি ছিল?’

‘শুনেছি দেবরাজ ইন্দ্র।’

চিপিটক আমনি কল-কোলাহল করিয়া উঠিলেন— ‘ধরেছি ধরেছি! আর যাবে কোথায়! যে অর্জুনের বাবার নাম জানে না সে কখনো হিন্দু হতে পারে না। নিশ্চয় যবনের গুপ্তচর। — রক্ষি, তোমরা ওকে বেঁধে নিয়ে যাও—’

রসরাজ রুক্ষস্বরে বাধা দিলেন, বলিলেন— ‘চিপিটক, তুমি থামো, চিৎকার করো না। অর্জুনের বাবার নাম ও ঠিক বলেছে। তুমিই অর্জুনের বাবার নাম জান না, সুতরাং বেঁধে রাখতে হলে তোমাকেই বেঁধে রাখতে হয়।’

চিপিটক থতমত খাইয়া গেলেন, ক্ষীণকণ্ঠে বলিলেন— ‘কিন্তু অর্জুনের বাবার নাম তো পাণ্ডু!’

রসরাজ বলিলেন— ‘পাণ্ডু নামমাত্র বাবা, আসল বাবা ইন্দ্র।’

চিপিটক অগত্যা নীরব রহিলেন। রসরাজ শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি, বেদ-পুরাণে পারঙ্গম; তাঁহার কথার বিরুদ্ধে কথা বলা চলে না।

রসরাজ অর্জুনকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন— ‘অর্জুনবর্মা, তোমার শরীর কেমন? গায়ে ব্যথা হয়েছে?’

অর্জুন বলিল— ‘সামান্য। আপনার ঔষধের গুণে দেহের সমস্ত গ্লানি দূর হয়েছে।’

রসরাজ বলিলেন— ‘ভাল ভাল। তুমি যদি আত্মপরিচয় দিতে চাও, দিতে পার, না দিতে চাও দিও না। তুমি অতিথি, আমরা প্রশ্ন করব না।’

অর্জুন বলিল— ‘আমার পরিচয় সামান্যই।’ সে বলরামকে যাহা বলিয়াছিল তাহাই সংক্ষেপে পুনরাবৃত্তি করিল।

রসরাজ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন— ‘যবনের রাজ্যে হিন্দুর ধর্ম কৃষ্টি স্বাধীনতা সবই নির্মূল হয়েছে। তুমি পালিয়ে এসেছ ভালই করেছ। দক্ষিণ দেশে এখনো স্বাধীনতা আছে, কিন্তু কতদিন থাকবে কে জানে। — আচ্ছা, আজ তোমরা এস, বৎস।’

অর্জুনবর্মা উঠিয়া দাঁড়াইল। চিপিটক চোখ পাকাইয়া বলিলেন— ‘আজ ছেড়ে দিলাম। কিন্তু পরে যদি জানতে পারি তুমি গুপ্তচর, তাহলে তোমার মুণ্ড কেটে নেব।’

রসরাজ বলিলেন— ‘চিপিটক, তোমার বায়ু বৃদ্ধি হয়েছে। এস, ঔষধ দিই।’

বাহিরে দাঁড়াইয়া দুই রাজকন্যা ছিদ্রপথে সবই প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন এবং অতি কষ্টে হাস্য সংবরণ করিয়া রাখিয়াছিলেন। পালা শেষ হইলে তাঁহারা পা টিপিয়া টিপিয়া ফিরিয়া আসিলেন এবং মুক্ত পটপত্তনে দাঁড়াইয়া অন্য নৌকার দিকে চাহিয়া রহিলেন। ক্ষণেক পরে অর্জুনবর্মা রক্ষীদের সঙ্গে বাহিরে আসিল, তাহার মুখে একটা চাপা হাসি। রাজকুমারীদের দেখিয়া সে সসম্ভ্রমে যুক্তপাণি হইয়া অভিবাদন করিল, তারপর ডিঙিতে নামিয়া বসিল। রক্ষী দুইজন দাঁড় টানিয়া সম্মুখে হাঙ্গরমুখী নৌকার দিকে চলিল।

মণিকঙ্কণা সেই দিকে কটাক্ষপাত করিয়া লঘুস্বরে বলিল— ‘অর্জুনবর্মা! হ্যাঁ ভাই, সত্যিই ছদ্মবেশে দ্বাপরযুগের অর্জুন নয় তো!’

বিদ্যুন্মালা ঈষৎ ভর্ৎসনা-ভরা চক্ষে মণিকঙ্কণার পানে চাহিয়া তাহার লঘুতাকে তিরস্কৃত করিলেন।

সেদিন সন্ধ্যাকালে নদীমধ্যস্থ একটি দ্বীপের প্রস্তরময় তীরে নৌকা বাঁধা হইল। দিনের গলদ্‌ঘর্ম প্রখরতার পর চন্দ্রমাশীতল রাত্রি পরম স্পৃহনীয়। নৈশাহারের পর দুই রাজকন্যা মাঝিদের আদেশ দিলেন, তাহারা পাটাতন দিয়া নৌকা হইতে দ্বীপ পর্যন্ত সেতু বাঁধিয়া দিল; রাজকন্যারা দ্বীপে অবতরণ করিলেন। জনশূন্য দ্বীপ, কঠিন কর্কশ ভূমি; তবু মাটি। অনেকদিন তাঁহারা মাটির স্পর্শ অনুভব করেন নাই; দুই ভগিনী হাত ধরাধরি করিয়া চন্দ্রালোকে পাদচারণা করিতে লাগিলেন।

নৌকা তিনটি পরস্পর শত হস্ত ব্যবধানে নিথর দাঁড়াইয়া আছে; যেন তিনটি অতিকায় চক্রবাক রাত্রিকালে দ্বীপপ্রান্তে আশ্রয় লইয়াছে, প্রভাত হইলে উড়িয়া যাইবে।

সহসা হাঙ্গরমুখী নৌকা হইতে মৃদঙ্গ মন্দিরার নিক্কণ ভাসিয়া আসিল। দুই রাজকন্যা চমকিয়া সেই দিকে দৃষ্টি ফিরাইলেন। শত হস্ত দূরে হাঙ্গরমুখী নৌকার পাটাতনের উপর কয়েকটি লোক গোল হইয়া বসিয়াছে, অস্পষ্ট আবছায়া কয়েকটি মূর্তি। তারপর মৃদঙ্গ মন্দিরার তালে তালে উদার পুরুষকণ্ঠে জয়দেব গোস্বামীর গান শোনা গেল—

মাধবে মা কুরু মানিনি মানময়ে!

বলরাম জাতিতে কর্মকার হইলেও সঙ্গীতজ্ঞ এবং সুকণ্ঠ। সে নৌকাযাত্রার সময় মৃদঙ্গ ও করতাল সঙ্গে আনিয়াছিল; তারপর নৌকায় আরো দু’চারজন সঙ্গীত-রসিক জুটিয়া গিয়াছিল। মন উচাটন হইলে তাহারা মৃদঙ্গ মন্দিরা লইয়া বসিত। পূর্ব ভারতে জয়দেব গোস্বামীর পদাবলী তখন সকলের মুখে মুখে ফিরিত; ভাষা সংস্কৃত হইলে কী হয়, এমন মধুর কোমলকান্ত পদাবলী আর নাই।

বলরামের দলের মধ্যে অর্জুনবর্মাও ছিল। সে গাহিতে বাজাইতে জানে না, কিন্তু সঙ্গীতরস উপভোগ করিতে পারে। তাই আজ বলরামের আহ্বানে সেও নৈশ কীর্তনে যোগ দিয়াছিল।

ধিক্‌ তান্‌ ধিক্‌ তান্‌ বলরামের মৃদঙ্গ বাজিতে লাগিল; ধ্রুবপদ আর একবার আবৃত্তি করিয়া সে অন্তরা ধরিল—

তালফলাদপি গুরুমতিসরসম্‌

কিমু বিফলীকুরুষে কুচকলসম্‌।

মাধবে মা কুরু মানিনি মানময়ে ॥

নিস্তরঙ্গ বাতাসে রসের লহর তুলিয়া অপূর্ব সঙ্গীত প্রবাহিত হইল; দূরে দাঁড়াইয়া দুই রাজকন্যা মুগ্ধভাবে শুনিতে লাগিলেন। তাঁহারা কলিঙ্গের কন্যা, জয়দেবের পদ তাঁহাদের অপরিচিত নয়; কিন্তু এমনি নিরাবিল পরিবেশের মধ্যে এমন গান তাঁহারা পূর্বে কখনো শোনেন নাই। শুনিতে শুনিতে তাঁহাদের দেহ রোমাঞ্চিত হইল, হৃদয় নিবিড় রসাবেশে আপ্লুত হইল।

মধ্যরাত্রে সঙ্গীত-সভা ভঙ্গ হইল। দুই রাজকন্যা নিঃশব্দে ময়ূরপঙ্খী নৌকায় উঠিয়া গেলেন, রইঘরে গিয়া শয্যায় পাশাপাশি শয়ন করিলেন। কথা হইল না, দুইজনে অর্ধনিমীলিত নেত্রে পরস্পর চাহিয়া একটু হাসিলেন; তারপর চক্ষু মুদিয়া সঙ্গীতের অনুরণন শুনিতে শুনিতে ঘুমাইয়া পড়িলেন।

হৃদয়ে রসাবেশ লইয়া নিদ্রা যাইলে কখনো কখনো স্বপ্ন দেখিতে হয়। সকলে দেখে না, কেহ কেহ দেখে। দুই রাজকন্যার মধ্যে একজন স্বপ্ন দেখিলেন—

স্বয়ংবর সভা। রাজকন্যা বীর্যশুল্কা হইবেন। তিনি মালা হাতে সভার মধ্যস্থলে দাঁড়াইয়া আছেন, চারিদিকে রাজন্যবর্গ। যিনি জলে ছায়া দেখিয়া শূন্যে মৎস্যচক্ষু বিদ্ধ করিতে পরিবেন। তাঁহার গলায় রাজকন্যা মালা দিবেন। একে একে রাজারা শরক্ষেপ করিলেন, কিন্তু কেহই লক্ষ্যভেদ করিতে পারিলেন না। রাজকন্যার মনে অভিমান জন্মিল। অর্জুন কেন আসিতেছেন না! অন্য কেহ যদি পূর্বেই লক্ষ্যভেদ করেন তখন কী হইবে। অবশেষে ছদ্মবেশী অর্জুন আসিয়া ধনুর্বাণ তুলিয়া লইলেন, জলে ছায়া দেখিয়া ঊর্ধ্বে মৎস্যচক্ষু বিদ্ধ করিলেন। অভিমানের সঙ্গে আনন্দ মিশিয়া রাজকুমারীর চক্ষে জল আসিল, তিনি অর্জুনের গলায় মালা দিলেন। অর্জুন ছদ্মবেশ ত্যাগ করিয়া রাজকন্যার সম্মুখে নতজানু হইলেন, বলিলেন—

মা কুরু মানিনি মানময়ে।

আট

নৌকা তিনটি চলিয়াছে।

ক্রমশ তীরে জনবসতি বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। শুষ্ক ঊষরতার ফাঁকে ফাঁকে একটু হরিদাভা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রাম। গ্রাম-শিশুরা বৃহৎ নৌকা দেখিয়া কলরব করিতে করিতে তীর ধরিয়া দৌড়ায়; যুবতীরা জল ভরিতে আসিয়া নৌকার পানে চাহিয়া থাকে, তাহাদের নিরাবরণ বক্ষের নির্লজ্জতা চোখের সলজ্জ সরল চাহনির দ্বারা নিরাকৃত হয়; গ্রাম-বৃদ্ধেরা দধি নবনী শাকপত্র ফলমূল লইয়া ডাকাডাকি করে, নৌকা হইতে ডিঙি গিয়া টাটকা খাদ্য ক্রয় করিয়া আনে।

নদীর উপর প্রভাত বেলাটি বেশ স্নিগ্ধ। কিন্তু যত বেলা বাড়িতে থাকে দুই তীরের পাথর তপ্ত হইয়া বায়ুমণ্ডলকে দুঃসহ করিয়া তোলে। দ্বিপ্রহরে নৌকাগুলির নাবিক ও সৈনিকেরা জলে লাফাইয়া পড়িয়া সাঁতার কাটে, হুড়াহুড়ি করে। তাঁহাদের দেখিয়া রাজকুমারীদেরও লোভ হয় জলে পড়িয়া খেলা করেন, কিন্তু অশোভন দেখাইবে বলিয়া তাহা পারেন না; তোলা জলে স্নান করেন।

অপরাহ্ণে সহসা বাতাস স্তব্ধ হইয়া যায়। মনে হয় বায়ুর অভাবে নিশ্বাস বন্ধ হইয়া আসিতেছে। আড়কাঠি উদ্বিগ্ন চক্ষে আকাশের পানে চাহিয়া থাকে; কিন্তু নির্মেঘ আকাশে আশঙ্কাজনক কোনো লক্ষণ দেখিতে পায় না। তারপর অগ্নিবর্ণ সূর্য অস্ত যায়, সন্ধ্যা নামিয়া আসে। ধীরে ধীরে আবার বাতাস বহিতে আরম্ভ করে।

এইভাবে কয়েকদিন কাটিয়াছে। পূর্ণিমা অতীত হইয়া কৃষ্ণপক্ষ চলিতেছে, আর দুই-এক দিনের মধ্যেই গন্তব্য স্থানে পৌঁছানো যাইবে। পথশ্রান্ত যাত্রীদের মনে আবার নূতন ঔৎসুক্য জাগিয়াছে।

এই কয়দিনে বলরাম ও অর্জুনবর্মার মধ্যে ঘনিষ্ঠতা আরো গাঢ় হইয়াছে। তাহারা ভিন্ন দেশের লোক, কিন্তু পরস্পরের মধ্যে মনের ঐক্য খুঁজিয়া পাইয়াছে; উপরন্তু অর্জুনবর্মার পক্ষে অনেকখানি কৃতজ্ঞতাও আছে। বিদেশ-বিভুঁই-এ মর্মজ্ঞ ও নির্ভরযোগ্য বন্ধু বড়ই বিরল, তাই তাহারা কেহ কাহারও সঙ্গ ছাড়ে না, একসঙ্গে খায়, একসঙ্গে ঘুমায়, একসঙ্গে উঠে বসে। ইতিমধ্যে মনের অনেক গোপন কথা তাহারা বিনিময় করিয়াছে। দেশত্যাগের দুঃখ এবং তাহার পশ্চাতে গভীরতর আঘাতের দুঃখ তাহাদের হৃদয়কে এক করিয়া দিয়াছে।

বিজয়নগর যত কাছে আসিতেছে, দুই রাজকন্যার মনেও অলক্ষিতে পরিবর্তন ঘটিতেছে। প্রথমে নৌকায় উঠিবার সময় তাঁহারা কাঁদিয়াছিলেন, শ্বশুরবাড়ি যাত্রাকালে সকল মেয়েই কাঁদে, তা রাজকন্যাই হোক আর সাধারণ গৃহস্থকন্যাই হোক। কিন্তু এখন তাঁহাদের মনে অজানিতের আতঙ্ক প্রবেশ করিয়াছে। বিজয়নগর রাজ্যে সমস্তই অপরিচিত; মানুষগুলা কি জানি কেমন, রাজা দেবরায় না জানি কেমন। মণিকঙ্কণার মুখে সদাস্ফুট হাসিটি ম্রিয়মাণ হইয়া আসিতেছে। বিদ্যুন্মালার ইন্দীবর নয়নে শুষ্ক উৎকণ্ঠা। জীবন এত জটিল কেন!

বিজয়নগরে পৌঁছিবার পূর্বরাত্রে দুই রাজকন্যা রইঘরে শয়ন করিয়াছিলেন, কিন্তু ঘুম সহজে আসিতেছিল না। কিছুক্ষণ শয্যায় ছট্‌ফট্‌ করিবার পর মণিকঙ্কণা উঠিয়া বসিল, বলিল— ‘চল্‌ মালা, ছাদে যাই। ঘরে গরম লাগছে।’

বিদ্যুন্মালাও উঠিয়া বসিলেন— ‘চল্‌।’

মন্দোদরী দ্বারের সম্মুখে আগড় হইয়া শুইয়া ছিল, তাহাকে ডিঙাইয়া দুই বোন রইঘরের ছাদে উঠিয়া গেলেন। নৌকার রক্ষী দুইজন রাজকন্যাদের বহিরাগমন জানিতে পারিলেও সাড়াশব্দ দিল না।

কৃষ্ণপক্ষের চন্দ্রহীন রাত্রি, মধ্যযামে চাঁদ উঠিবে। নৌকা বাঁধা আছে, তাই বায়ুর প্রবাহ কম। তবু উন্মুক্ত ছাদ বেশ ঠাণ্ডা, অল্প বায়ু বহিতেছে। আকাশের নক্ষত্রপুঞ্জ যেন সহস্র চক্ষু মেলিয়া ছায়াচ্ছন্ন পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করিতেছে। দুই ভগিনী দেহের অঞ্চল শিথিল করিয়া দিয়া ছাদের উপর বসিলেন।

নক্ষত্রখচিত ঝিকিমিকি অন্ধকারে দুইজনে নীরবে বসিয়া রহিলেন। একবার বিদ্যুন্মালার নিশ্বাস পড়িল। ক্লান্তি ও অবসাদের নিশ্বাস।

মণিকঙ্কণা জিজ্ঞাসা করিল— ‘কি ভাবছিস?’

বিদ্যুন্মালা বলিলেন— ‘ভাবছি শিরে সংক্রান্তি।’

‘ভয় করছে?’

‘হ্যাঁ। তোর ভয় করছে না?’

‘একটু একটু। কিন্তু মিথ্যে ভয়, একবার গিয়ে পৌঁছলেই ভয় কেটে যাবে।’

‘হয়তো ভয় আরো বাড়বে।’

‘তুই কেবল মন্দ দিকটাই দেখিস।’

‘মন্দকে যে বাদ দেওয়া যায় না।’

মণিকঙ্কণা বিদ্যুন্মালার ধরা-ধরা গলার আওয়াজ শুনিয়া মুখের কাছে মুখ আনিয়া দেখিল বিদ্যুন্মালার চোখে জল। সে হ্রস্বস্বরে বলিল— ‘তুই কাঁদছিস।’

বিদ্যুন্মালা তাহার কাঁধে মাথা রাখিলেন।

এখন, স্ত্রীজাতির স্বভাব এই যে, একজনকে কাঁদিতে দেখিলে অন্যজনেরও কান্না পায়। সুতরাং মণিকঙ্কণা বিদ্যুন্মালার কাঁধে মাথা রাখিয়া একটু কাঁদিল।

মন হালকা হইলে চক্ষু মুদিয়া আবার দুইজনে নীরবে বসিয়া রহিলেন। তারপর হঠাৎ মণিকঙ্কণা ঈষৎ উত্তেজিত কণ্ঠে বলিল— ‘মালা, পশ্চিম দিকে চেয়ে দেখ— কিছু দেখতে পাচ্ছিস?’

বিদ্যুন্মালা চকিতে পশ্চিম দিকে ঘাড় ফিরাইলেন। দূরে নদীর অন্ধকার যেখানে আকাশের অন্ধকারে মিশিয়াছে সেইখানে একটি অগ্নিপিণ্ড জ্বলিতেছে, হঠাৎ দেখিলে মনে হয় একটা রক্তবর্ণ গ্রহ অস্ত যাইতেছে। কিন্তু কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিলে দেখা যায়, আলোকপিণ্ডটি কখনো বাড়িতেছে কখনো কমিতেছে, কখনো ঊর্ধ্বে শিখা নিক্ষেপ করিতেছে। অনেকক্ষণ সেই দিকে চাহিয়া থাকিয়া বিদ্যুন্মালা বলিলেন— ‘আগুনের পিণ্ড! কোথায় আগুন জ্বলছে?’

মণিকঙ্কণা বলিল— ‘বিজয়নগর তো ওই দিকে। তাহলে নিশ্চয় বিজয়নগরের আলো। দাঁড়া, আমি খবর নিচ্ছি। — রক্ষি!’

দুইজনে বস্ত্র সংবরণ করিয়া বসিলেন; একজন রক্ষী ছায়ামূর্তির ন্যায় কাছে আসিয়া দাঁড়াইল— ‘আজ্ঞা করুন।’

মণিকঙ্কণা হস্ত প্রসারিত করিয়া বলিল— ‘ওই যে আলো দেখা যাচ্ছে, ওটা কোথাকার আলো তুমি জানো?’

রক্ষী বলিল— ‘জানি দেবী। আজই সন্ধ্যার পর আড়কাঠি মশায়ের মুখে শুনেছি। বিজয়নগরে হেমকূট নামে পাহাড়ের চূড়া আছে, সেই চূড়া পঞ্চাশ ক্রোশ দূর থেকে দেখা যায়। প্রত্যহ রাত্রে হেমকূট নামে পাহাড়ের চূড়ায় ধুনী জ্বালা হয়, সারা রাত্রি ধুনী জ্বলে। সারা দেশের লোক জানতে পারে বিজয়নগর জেগে আছে। — আমরা কাল অপরাহ্ণে বিজয়নগরে পৌঁছব।’

কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া মণিকঙ্কণা বলিল— ‘বুঝেছি। আচ্ছা, তুমি যাও।’

রক্ষী অপসৃত হইল। দুইজনে দূরাগত আলোকরশ্মির পানে চাহিয়া রহিলেন। উত্তর ভারতের দীপগুলি একে একে নিভিয়া গিয়াছে, নীরন্ধ্র অন্ধকারে অবসন্ন ভারতবাসী ঘুমাইতেছে; কেবল দক্ষিণাত্যের একটি হিন্দু রাজা ললাটে আগুন জ্বালিয়া জাগিয়া আছে।

নয়

পরদিন অপরাহ্ণে নৌকা তিনটি বিজয়নগরের নিকটবর্তী হইল। অর্ধক্রোশ দূর হইতে সূর্যের প্রখর আলোকে নগরের পরিদৃশ্যমান অংশ যেন পৌরুষ ও ঐশ্বর্যের প্রাচুর্যে ঝলমল করিতেছে।

নদীর উত্তর তীরে উগ্র তপস্বীর উৎক্ষিপ্ত ধূসর জটাজালের ন্যায় গিরিচক্রবেষ্টিত অনেগুন্দি দুর্গ। আদৌ এই দুর্গ বিজয়নগর রাজ্যের রাজধানী ছিল; পরে রাজধানী নদীর দক্ষিণ তীরে সরিয়া আসিয়াছে। অনেগুন্দি দুর্গ বর্তমানে একটি নগররক্ষক সৈন্যাবাস।

নদীর দক্ষিণ-কূলে শতবর্ষ ধরিয়া যে মহানগরী গড়িয়া উঠিয়াছে তাহা যেমন শোভাময়ী তেমনি দুষ্প্রধর্ষা। সমকালীন বিদেশী পর্যটকের পান্থলিপিতে তাহার গৌরব-গরিমার বিবরণ ধৃত আছে। নগরীর বহিঃপ্রকাশের বেড় ছিল ত্রিশ ক্রোশ। তাহার ভিতর বহু ক্রোশ অন্দরে দ্বিতীয় প্রাকার। তাহার ভিতর তৃতীয় প্রাকার। এইভাবে একের পর এক সাতটি প্রাকার নগরীকে বেষ্টন করিয়া আছে। প্রাকারগুলির ব্যবধান-স্থলে অসংখ্য জলপ্রণালী তুঙ্গভদ্রা হইতে নগরীর মধ্যে জলধারা প্রবাহিত করিয়া দিয়াছে। নগরীর ভূমি সর্বত্র সমতল নয়; কোথাও ছোট ছোট পাহাড়, কোথাও সংকীর্ণ উপত্যকা। উপত্যকাগুলিতে মানুষের বাস, শস্যক্ষেত্র, ফল ও ফুলের বাগান, ধনী ব্যক্তিদের উদ্যান-বাটিকা। নগরবৃত্তের নেমি হইতে যতই নাভির দিকে যাওয়া যায়, জনবসতি ততই ঘনসংবদ্ধ হয়। অবশেষে সপ্তমচক্রের মধ্যে পৌঁছিলে দেখা যায়, রাজপুরীর বিচিত্র সুন্দর হর্ম্যগুলি সহস্রার পদ্মের মধ্যবর্তী স্বর্ণকেশরের ন্যায় শোভা পাইতেছে।

নদীমধ্যস্থ নৌকা হইতে কিন্তু সমগ্র নগর দেখা যায় না, নগরের যে অংশ নদীর তটরেখা পর্যন্ত আসিয়া থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িয়াছে তাহাই দৃশ্যমান। অনুমান দুই ক্রোশ দীর্ঘ এই তটরেখা মণিমেখলার ন্যায় বঙ্কিম, তাহাতে সারি সারি সৌধ উদ্যান ঘাট মন্দির হীরা-মুক্তা-মাণিক্যের ন্যায় গ্রথিত রহিয়াছে।

নগর-সংলগ্ন এই তটরেখার পূর্ব সীমান্তে বিস্তীর্ণ ঘাট। বড় বড় চতুষ্কোণ পাথর নির্মিত এই ঘাটের নাম কিল্লাঘাট; শুধু স্নানের ঘাট নয়, খেয়া ঘাটও। এই ঘাট হইতে সিধা উত্তরে অনেগুন্দি দুর্গে পারাপার হওয়া যায়। এই ঘাটে আজ বিপুল সমারোহ।

কলিঙ্গের রাজকুমারীদের লইয়া নৌ-বহর দেখা দিয়াছে আজই অপরাহ্ণে আসিয়া পৌঁছিবে, এ সংবাদ মহারাজ দেবরায় প্রাতঃকালেই পাইয়াছিলেন। তিনি বহুসংখ্যক হস্তী অশ্ব দোলা ও পদাতি সৈন্য কিল্লাঘাটে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন অতিথিদের অভ্যর্থনার জন্য। কিল্লাঘাটে পাঠানোর কারণ, এই ঘাটের পর গ্রীষ্মের তুঙ্গভদ্রা আরো শীর্না হইয়াছে, বড় নৌকা চলে কি না চলে। কিল্লাঘাট রাজপ্রাসাদ হইতে মাত্র ক্রোশেক পথ দূরে, সুতরাং রাজকুমারীরা কিল্লাঘাটে অবতরণ করিয়া দোলায় বা হস্তিপৃষ্ঠে রাজভবনে যাইতে পরিবেন, কোনোই অসুবিধা নাই। উপরন্তু নগরবাসীরা বধূ-সমাগমের শোভাযাত্রা দেখিয়া আনন্দিত হইবে।

রাজা স্বয়ং কিল্লাঘাটে আসেন নাই, নিজ কনিষ্ঠ ভ্রাতা কুমার কম্পনদেবকে প্রতিভূস্বরূপ পাঠাইয়াছেন। কুমার কম্পন রাজা অপেক্ষা বয়সে অনেক ছোট, সবেমাত্র যৌবনপ্রাপ্ত হইয়াছেন, অতি সুন্দরকান্তি নবযুবক। রাজা এই ভ্রাতাটিকে অত্যধিক স্নেহ করেন, তাই তিনি বধূ-সম্ভাষণের জন্য নিজে না আসিয়া ভ্রাতাকে পাঠাইয়াছেন।

কিল্লাঘাটের উচ্চতম সোপানে কুমার কম্পন অশ্বপৃষ্ঠে বসিয়া নৌকার দিকে চাহিয়া আছেন। তাঁহার পিছনে পাঁচটি চিত্রিতাঙ্গ হস্তী, হস্তীদের দুই পাশে ভল্লধারী অশ্বারোহীর সারি। তাহাদের পশ্চাতে নববেশপরিহিত ধনুর্ধর পদাতি সৈন্যের দল। সর্বশেষ ঘাটের প্রবেশমুখে নানা বর্ণাঢ্য বস্ত্রনির্মিত দ্বিভূমক তোরণ, তোরণের দুই স্তম্ভাগ্রে বসিয়া দুই দল যন্ত্রবাদক পালা করিয়া মুরজমুরলী বাজাইতেছে। বড় মিঠা মন-গলানো আগমনীর সুর।

ওদিকে অগ্রসারী নৌকা তিনটিতেও প্রবল ঔৎসুক্য ও উত্তেজনার সৃষ্টি হইয়াছিল। আরোহীরা নৌকার কিনারায় কাতার দিয়া দাঁড়াইয়া ঘাটের দৃশ্য দেখিতেছিল। ময়ূরপঙ্খী নৌকার ছাদের উপর বিদ্যুন্মালা মণিকঙ্কণা মন্দোদরী ও মাতুল চিপিটকমূর্তি উপস্থিত ছিলেন। সকলের দৃষ্টি ঘাটের দিকে। তোরণশীর্ষে নানা বর্ণের কেতন উড়িতেছে; ঘাটের সম্মুখে জলের উপর কয়েকটি গোলাকৃতি ক্ষুদ্র নৌকা অকারণ আনন্দে ছুটাছুটি করিতেছে। ঘাটের অস্ত্রধারী মানুষগুলা দাঁড়াইয়া আছে চিত্রার্পিতের ন্যায়। সর্বাগ্রে অশ্বারূঢ় পুরুষটি কে? দূর হইতে মুখাবয়ব ভাল দেখা যায় না। উনিই কি মহারাজ দেবরায়?

নৌকাগুলি যত কাছে যাইতেছে মুরজমুরলীর সুর ততই স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে। দুই দলের দৃষ্টি পরস্পরের উপর। আকাশের দিকে কাহারও দৃষ্টি নাই।

নৌকা তিনটি ঘাটের দশ রজ্জুর মধ্যে আসিয়া পড়িল। তখন মণিকঙ্কণা বিদ্যুন্মালা ছাদ হইতে নামিয়া রইঘরে গেলেন। ঘাটে নামিবার পূর্বে বেশবাস পরিবর্তন, যথোপযুক্ত অলঙ্কার ধারণ ও প্রসাধন করিতে হইবে। মন্দোদরীকে ডাকিলে সে তাঁহাদের সাহায্য করিতে পারিত; কিন্তু মন্দোদরী ঘাটের দৃশ্য দেখিতে মগ্ন, রাজকন্যারা তাহাকে ডাকিলেন না।

দুই ভগিনী গভীর বিষণ্ণ মুখে মহার্ঘ স্বর্ণতন্তুরচিত শাড়ি ও কঞ্চুলী পরিধান করিলেন, পরস্পরকে রত্নদুতিখচিত অলঙ্কার পরাইয়া দিলেন। তারপর বিদ্যুন্মালা গমনোন্মুখী হইলেন। মণিকঙ্কণা জিজ্ঞাসা করিল— ‘আলতা কাজল পরবি না?’

বিদ্যুন্মালা বলিলেন— ‘না, থাক।’

তিনি উপরে চলিয়া গেলেন। মণিকঙ্কণা ক্ষণেক ইতস্তত করিল, তারপর কাজললতা লাক্ষারসের করঙ্ক ও সোনার দর্পণ লইয়া বসিল।

বিদ্যুন্মালা পটপত্তনের উপর আসিয়া চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিলেন। তাঁহার মনে হইল এই অল্পক্ষণের মধ্যে আকাশের আলো অনেক কমিয়া গিয়াছে। তিনি চকিতে ঊর্ধ্বে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। দক্ষিণ হইতে একটা ধূম্রবর্ণ রাক্ষস ছুটিয়া আসিতেছিল, বিদ্যুন্মালার নেত্রাঘাতে যেন উন্মত্ত ক্রোধে বিকট চিৎকার করিয়া নদীর বুকে ঝাঁপাইয়া পড়িল। নিমেষমধ্যে সমস্ত লণ্ডভণ্ড হইয়া গেল।

দক্ষিণাত্যের শৈলবন্ধুর মালভূমিতে গ্রীষ্মকালে মাঝে মাঝে এমনি অতর্কিত ঝড় আসে। দিনের পর দিন তাপ সঞ্চিত হইতে হইতে একদিন হঠাৎ বিস্ফোরকের ন্যায় ফাটিয়া পড়ে। ঝড় বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না, বড় জোর দুই-তিন দণ্ড; কিন্তু তাহার যাত্রাপথে যাহা কিছু পায় সমস্ত ছারখার করিয়া দিয়া চলিয়া যায়।

এই ঝড়ের আবির্ভাব এতই আকস্মিক যে চিন্তা করিবার অবকাশ থাকে না, সতর্ক হইবার শক্তিও লুপ্ত হইয়া যায়। নৌকা তিনটি পরস্পরের কাছাকাছি চলিতেছিল, ঘাট হইতে তাহাদের দূরত্ব পাঁচ-ছয় রজ্জুর বেশি নয়, হঠাৎ ঝড়ের ধাক্কা খাইয়া তাহারা কাত হইয়া পড়িল। ময়ূরপঙ্খী নৌকার ছাদে মন্দোদরী ও চিপিটকমূর্তি ছিলেন, ছিট্‌কাইয়া নদীতে পড়িলেন। পাটাতনের উপর বিদ্যুন্মালা শূন্যে উৎক্ষিপ্ত হইয়া মত্ত জলরাশির মধ্যে অদৃশ্য হইয়া গেলেন।

মকরমুখী নৌকা হইতেও কয়েকজন নাবিক ও সৈনিক জলে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল, তাহাদের মধ্যে অর্জুনবর্মা একজন। যখন ঝড়ের ধাক্কা নৌকায় লাগিল তখন সে মকরমুখী নৌকার কিনারায় দাঁড়াইয়া ময়ূরপঙ্খী নৌকার দিকে চাহিয়া ছিল; নিজে জলে পড়িতে পড়িতে দেখিল রাজকুমারী ডুবিয়া গেলেন। সে জলে পড়িবামাত্র তীরবেগে সাঁতার কাটিয়া চলিল।

আকাশের আলো নিভিয়া গিয়াছে, নৌকাগুলি ঝড়ের দাপটে কে কোথায় গিয়াছে কিছুই দেখা যায় না। কেবল নদীর উন্মত্ত তরঙ্গরাশি চারিদিকে উথল-পাথার হইতেছে। তারপর প্রচণ্ড বেগে বৃষ্টি নামিল। চরাচর আকাশ-পাতাল একাকার হইয়া গেল।

বিদ্যুন্মালা তলাইয়া গিয়াছিলেন, জলতলে তরঙ্গের আকর্ষণ-বিকর্ষণে আবার ভাসিয়া উঠিলেন। কিছুক্ষণ তরঙ্গশীর্ষে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হইবার পর তাঁহার অর্ধচেতন দেহ আবার ডুবিয়া যাইতে লাগিল।

নিকষ-কালো অন্ধকারের মধ্যে ঝড়ের মাতন চলিয়াছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলক, মেঘের হুঙ্কার; তারপর শোঁ শোঁ কল্‌কল্‌ শব্দ। জল ও বাতাসের মরণাত্মক সংগ্রাম।

বিদ্যুন্মালা জলতলে নামিয়া যাইতে যাইতে অস্পষ্টভাবে অনুভব করিলেন, কে যেন তাঁহাকে আকর্ষণ করিয়া আবার উপর দিকে টানিয়া লইয়া যাইতেছে। তিনি সম্পূর্ণ নিশ্চেষ্ট রহিলেন; শরীর অবশ, বাঁচিয়া থাকার যে দুরন্ত প্রয়াস জীবমাত্রেরই স্বাভাবিক তাহা আর নাই। জীবন ও মৃত্যুর ব্যবধান ঘুচিয়া গিয়াছে। ক্রমে তাঁহার যেটুকু সংজ্ঞা অবশিষ্ট ছিল তাহাও লুপ্ত হইয়া গেল।

দশ

ঝড় থামিয়াছে।

মেঘের অন্ধকার অপসারিত হইবার পূর্বেই রাত্রির অন্ধকার নামিয়াছে। বর্ষণধৌত আকাশে তারাগুলি উজ্জ্বল; তুঙ্গভদ্রার স্রোত আবার শান্ত হইয়াছে। তীরবর্তী প্রাসাদগুলির দীপরশ্মি নদীর জলে প্রতিফলিত হইয়া কাঁপিতেছে। কেবল হেমকূট শিখরে এখনও অগ্নিস্তম্ভ জ্বলে নাই।

এই অবকাশে ঝঞ্ঝাহত মানুষগুলির হিসাব লওয়া যাইতে পারে।

কিল্লাঘাটে যাহারা অতিথি সংবর্ধনার জন্য উপস্থিত ছিল তাহারাও ঝড়ের প্রকোপে বিপর্যন্ত হইয়াছিল। বস্ত্রতোরণ উড়িয়া গিয়া নদীর জলে পড়িয়াছিল; হাতিগুলা ভয় পাইয়া একটু দাপাদাপি করিয়াছিল, তাহার ফলে কয়েকজন সৈনিকের হাত-পা ভাঙ্গিয়াছিল; আর বিশেষ কোনো অনিষ্ট হয় নাই। ঝড় অপগত হইলে কুমার কম্পন নৌকা তিনটির নিরাপত্তা সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিবার চেষ্টা করিলেন; কিন্তু রাত্রি অন্ধকার, তীরস্থ গোলাকৃতি ছোট নৌকাগুলি কোথায় ভাসিয়া গিয়াছে। কুমার কম্পন কোনো সন্ধানই পাইলেন না। তখন তিনি সৈন্যদের ঘাটে রাখিয়া অশ্বপৃষ্ঠে রাজভবনে ফিরিয়া গেলেন। রাজাকে সংবাদ দিয়া কাল প্রত্যুষে তিনি আবার ফিরিয়া আসিবেন।

নৌকা তিনটি ঝড়ের আঘাতে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছিল, কিন্তু ডুবিয়া যায় নাই; অগভীর জলে বা নদীমধ্যস্থ দ্বীপের শিলাসৈকতে আটকাইয়া গিয়াছিল। নাবিক ও সৈন্যদের মধ্যে যাহারা ছিটকাইয়া জলে পড়িয়াছিল। তাহারাও কেহ ডুবিয়া মরে নাই, জল ও বাতাসের তাড়নে কোথাও না কোথাও ডাঙ্গার আশ্রয় পাইয়াছিল। ময়ূরপঙ্খী নৌকায় মণিকঙ্কণা ও বৃদ্ধ রসরাজ আটক পড়িয়াছিলেন। তাঁহাদের প্রাণের আশঙ্কা আর ছিল না বটে, কিন্তু বিদ্যুন্মালা, চিপিটক এবং মন্দোদরীর জন্য তাঁহাদের প্রাণে নিদারুণ ত্রাস উৎপন্ন হইয়াছিল। মণিকঙ্কণা ব্যাকুলভাবে কাঁদিতে কাঁদিতে ভাবিতেছিল— কোথায় গেল বিদ্যুন্মালা? মামা ও মন্দোদরীর কী হইল? তাহারা কি সকলেই ডুবিয়া গিয়াছে? রসরাজ মণিকঙ্কণাকে সত্ত্বনা দিবার ফাঁকে ফাঁকে প্রাণপণে ইষ্টমন্ত্র জপ করিতেছিলেন।

মামা ও মন্দোদরী ডুবিয়া যায় নাই। দুইজনে একসঙ্গে জলে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল। কেহই সাঁতার জানে না। মামার বকপক্ষীর ন্যায় শীর্ণ দেহটি ডুবিয়া যাইবার উপক্রম করিল; মন্দোদরীর কিন্তু ডুবিবার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না, তাহার বিপুল বপু তরঙ্গশীর্ষে শূন্য কলসের ন্যায় নাচিতে লাগিল। মামা ডুবিয়া যাইতে যাইতে মন্দোদরীর একটা পা নাগালের মধ্যে পাইলেন, তিনি মরীয়া হইয়া তাহা চাপিয়া ধরিলেন। ঝড়ের টানাটানি তাঁহার বজ্রমুষ্টিকে শিথিল করিতে পারিল না। কিন্তু চিপিটক ও মন্দোদরীর প্রসঙ্গ এখন থাক।

বিদ্যুন্মালা নদীমধ্যস্থ একটি দ্বীপের সিক্ত সৈকতে শুইয়া ছিলেন, চেতনা ফিরিয়া পাইয়া অনুভব করিলেন তাঁহার বসন আর্দ্র। মনে পড়িয়া গেল। তিনি নদীতে ডুবিয়া গিয়াছিলেন। তারপর বিদ্যুচ্চমকের ন্যায় পরিপূর্ণ স্মৃতি ফিরিয়া আসিল। তিনি ধীরে ধীরে চোখ খুলিলেন।

চোখ খুলিয়া তিনি প্রথমে কিছু দেখিতে পাইলেন না, ভিতরের অন্ধকার ও বাহিরের অন্ধকার প্রায় সমান। ক্রমে সূচির ন্যায় সূক্ষ্ম আলোকের রশ্মি তাঁহার চক্ষুকে বিদ্ধ করিল। আকাশের তারা কি? আশেপাশে আর কিছু দেখা যায় না। তখন তিনি গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া সন্তর্পণে উঠিয়া বসিবার উপক্রম করিলেন।

কে যেন শিয়রে বসিয়া তাঁহার মুখের পানে চাহিয়া ছিল, হ্রস্বকণ্ঠে বলিল— ‘এখন বেশ সুস্থ মনে হচ্ছে?’

বিদ্যুন্মালা চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া চাহিলেন, কিন্তু কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না; অন্ধকারের মধ্যে গাঢ়তর অন্ধকারের একটা পিণ্ড রহিয়াছে মনে হইল। তিনি স্থলিত স্বরে বলিলেন— ‘কে?’

শান্ত আশ্বাস ভরা উত্তর হইল— ‘আমি— অর্জুনবর্মা।’

ক্ষণকাল উভয়ে নীরব। তারপর বিদ্যুন্মালা ক্ষীণ বিস্ময়ের সুরে বলিলেন— ‘অর্জুনবর্মা— আমি ঝড়ের ধাক্কায় জলে পড়ে গিয়েছিলাম— কিছুক্ষণের জন্য নিশ্বাস রোধ হয়ে গিয়েছিল— তারপর কে যেন আমাকে টেনে নিয়ে চলল— আর কিছু মনে নেই। — এ কোন্‌ স্থান?’

অর্জুনবর্মা বলিল— ‘বোধহয় নদীর একটা দ্বীপ। আপনি শরীরে কোনো ব্যথা অনুভব করছেন কি?’

বিদ্যুন্মালা নড়িয়া চড়িয়া বসিলেন। বলিলেন— ‘না। কিন্তু আমি চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছি না।’

অর্জুনবর্মা বলিল— ‘অন্ধকার রাত্রি, তাই কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। আকাশের পানে চোখ তুলুন, তারা দেখতে পাবেন।’

বিদ্যুন্মালা ঊর্ধ্বে চাহিলেন। হাঁ, ওই তারার পুঞ্জ! প্রথম চক্ষু মেলিয়া তাহাদের দেখিয়াছিলেন, এখন যেন তাহারা আরো উজ্জ্বল হইয়াছে।

অর্জুনবর্মা বলিল— ‘পিছন দিকে ফিরে দেখুন, হেমকূট চুড়ার ধুনী জ্বলছে।’

হেমকূট চূড়ায় প্রত্যহ সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ধুনী জ্বলে; আজ বৃষ্টির জলে ইন্ধন সিক্ত হইয়াছিল তাই ধুনী জ্বলিতে বিলম্ব হইয়াছে। বিদ্যুন্মালা দেখিলেন, দূরে গিরিচূড়ায় ধূম্রজাল ভেদ করিয়া অগ্নির শিখা উত্থিত হইতেছে।

সেদিক হইতে দৃষ্টি ফিরাইয়া বিদ্যুন্মালা অর্জুনবর্মার দিকে চাহিলেন, মনে হইল যেন সুদূর ধুনীর আলোকে অর্জুনবর্মার আকৃতি ছায়ার ন্যায় দেখা যাইতেছে। এতক্ষণ বিদ্যুন্মালার অন্তরের সমস্ত আবেগ যেন মূর্ছিত হইয়া ছিল, এখন স্ফুলিঙ্গের ন্যায় একটু আনন্দ স্ফুরিত হইল— ‘অর্জুনবর্মা! আপনাকে আমি দেখতে পাচ্ছি।’ এই পর্যন্ত বলিয়াই তাঁহার আনন্দটুকু নিভিয়া গেল, তিনি উদ্বেগসংহত কণ্ঠে বলিলেন— ‘কিন্তু কঙ্কণা কোথায়? মন্দোদরী কোথায়?’

অর্জুন বলিল— ‘কে কোথায় আছে তা সূর্যোদয়ের আগে জানা যাবে না।’

‘আজ কি চাঁদও উঠবে না?’

‘উঠবে, মধ্যরাত্রির পর।’

‘এখন রাত্রি কত?’

‘বোধহয় প্রথম প্রহর শেষ হয়েছে। — রাজকুমারি, আপনার শরীর দুর্বল, আপনি শুয়ে থাকুন। বেশি চিন্তা করবেন না। দুর্বল শরীরে চিন্তা করলে দেহ আরো নিস্তেজ হয়ে পড়বে।’

‘আর আপনি?’

‘আমি পাহারায় থাকব।’

এই অসহায় অবস্থাতেও বিদ্যুন্মালা পরম আশ্বাস পাইলেন। দুই-চারিটি কথা বলিয়াই তাঁহার শরীরের অবশিষ্ট শক্তি নিঃশেষিত হইয়াছিল, তিনি আবার বালুশয্যায় শয়ন করিলেন। কিছুক্ষণ চক্ষু মুদিয়া শুইয়া থাকিবার পর তাঁহার ক্লান্ত চেতনা আবার সুপ্তির অতলে ডুবিয়া গেল।

বিদ্যুন্মালার চেতনা সুষুপ্তির পাতাল স্পর্শ করিয়া আবার ধীরে ধীরে স্বপ্নলোকের অচ্ছাভ স্তরে উঠিয়া আসিল। তিনি স্বপ্ন দেখিলেন, সেই স্বপ্ন যাহা পূর্বে একবার দেখিয়াছিলেন। স্বয়ংবর সভায় অর্জুন মৎস্যচক্ষু বিদ্ধ করিয়া রাজকুমারীর সম্মুখে নতজানু হইলেন। বলিলেন — ‘রাজকুমারি, দেখুন চাঁদ উঠেছে।’

বিদ্যুন্মালা চক্ষু মেলিয়া দেখিলেন অর্জুনবর্মা তাঁহার মুখের উপর ঝুঁকিয়া বলিতেছে— ‘রাজকুমারি, দেখুন চাঁদ উঠেছে।’ স্বপ্নের অর্জুন ও প্রত্যক্ষের অর্জুনবর্মায় আকৃতিগত কোনো প্রভেদ নাই।

চাঁদ অবশ্য অনেক আগেই উঠিয়াছিল, দিকচক্র হইতে প্রায় এক রাশি ঊর্ধ্বে আরোহণ করিয়াছিল। কৃষ্ণপক্ষের ক্ষীয়মাণ চন্দ্র, কিন্তু পরশু ফলকের ন্যায় উজ্জ্বল। তাহারই আলোকে বিদ্যুন্মালার ঘুমন্ত মুখখানি পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়ছিল। মুক্তবেণী চুলগুলি বিস্রস্ত হইয়া মুখখানিকে বেষ্টন করিয়া রাখিয়াছিল, মহার্ঘ বস্ত্রটি বালুকালিপ্ত অবস্থায় নিদ্রাশীতল দেহটিকে অযত্নভরে আবৃত করিয়াছিল। সব মিলিয়া যেন একটি শৈবালবিদ্ধ কুমুদিনী, ঝড়ের আক্রোশে উন্মূলিত হইয়া তটপ্রান্তে নিক্ষিপ্ত হইয়াছে।

অর্জুনবর্মা মোহাচ্ছন্ন চোখে ওই মুখখানির পানে চাহিয়া ছিল। তাহার দৃষ্টিতে লুব্ধতা ছিল না, মনে কোনো চিন্তা ছিল না; রম্যাণি বীক্ষ্য মানুষের মন যেমন অজ্ঞাতপূর্ব স্মৃতির জালে জড়াইয়া যায়, অর্জুনবর্মার মনও তেমনি নিগূঢ় স্বপ্নজালে আচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছিল। আলোড়িত জলরাশির মধ্য হইতে রাজকন্যার অচেতন দেহ টানিয়া তোলার স্মৃতিও অসংলগ্নভাবে মনের মধ্যে জাগিয়া ছিল।

অনেকক্ষণ বিদ্যুন্মালার মুখের পানে চাহিয়া থাকিবার পর তাহার চমক ভাঙ্গিল। ঘুমন্ত রাজকন্যার অনাবৃত মুখের পানে চাহিয়া থাকার রূঢ় ধৃষ্টতায় সন্ত্রস্ত হইয়া সে চকিতে উঠিয়া দাঁড়াইল। জ্যোৎস্না কুহেলির ভিতর নিমগ্ন প্রকৃতি বাষ্পাচ্ছন্ন চোখের দৃষ্টির ন্যায় অস্পষ্ট আবছা হইয়া আছে। অর্জুন চারিদিকে চক্ষু ফিরাইল, তারপর নিঃশব্দে সরিয়া গিয়া দ্বীপের কিনারা ধরিয়া পরিক্রমণ আরম্ভ করিল। চিরসঙ্গী লাঠি দু’টি আজ তাহার সঙ্গে নাই, নৌকা হইতে পতনকালে নৌকাতেই রহিয়া গিয়াছিল। বলরাম যদি বাঁচিয়া থাকে হয়তো লাঠি দু’টিকে যত্ন করিয়া রাখিয়াছে।

দ্বীপটি ক্ষুদ্র, প্রায় গোলাকৃতি; তীরে নুড়ি-ছড়ানো বালুবেলা, মধ্যস্থলে বড় বড় পাথরের চ্যাঙড় উঁচু হইয়া আছে। অর্জুনবর্মা তীর ধরিয়া পরিক্রমণ করিতে করিতে নানা অসংলগ্ন কথা চিন্তা করিতে লাগিল, কিন্তু তাহার উদ্বিগ্ন জল্পনার মধ্যে মনের নিভৃত একটা অংশ রাজকন্যার কাছে পড়িয়া রহিল। রাজকুমারী একাকিনী ঘুমাইতেছেন। যদি হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গিয়া তাহাকে দেখিতে না পাইয়া ভয় পান! যদি দ্বীপের মধ্যে শৃগাল বা বনবিড়াল জাতীয় হিংস্র জন্তু লুকাইয়া থাকে—!

দ্বীপে কিন্তু হিংস্র জন্তু ছিল না। অর্জুনবর্মা এক স্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিল কয়েকটি তীরচর ক্ষুদ্র পাখি জলের ধারে জড়সড় হইয়া দাঁড়াইয়া আছে, তাহার পদশব্দে টিটিহি টিটিহি শব্দ করিয়া উড়িয়া গেল। টিট্টিভ পাখি।

বিদ্যুন্মালার কাছে ফিরিয়া আসিয়া অর্জুনবর্মা দেখিল তিনি যেমন শুইয়া ছিলেন তেমনি শুইয়া আছেন, একটুও নড়েন নাই। অহেতুক উদ্বেগে অর্জুনের মন শঙ্কিত হইয়া উঠিল, সে তাঁহার শিয়রে নতজানু হইয়া মুখের কাছে মুখ আনিয়া দেখিল।

না, আশঙ্কার কোনো কারণ নাই। ক্লান্তির বিবশ জড়তা কাটিয়া গিয়াছে, রাজকুমারী স্বপ্ন দেখিতেছেন। স্বপ্নের ঘোরে তাঁহার ভ্রূ কখনো কুঞ্চিত হইতেছে, কখনো অধরে একটু হাসির আভাস দেখা দিয়াই মিলাইয়া যাইতেছে।

স্বপ্নলোকে কোন্‌ বিচিত্র দৃশ্যের অভিনয় হইতেছে কে জানে। অর্জুনবর্মা মনে মনে একটু ঔৎসুক্য অনুভব করিল; সে একবার চাঁদের দিকে চাহিল, একবার বিদ্যুন্মালার স্বপ্নমুগ্ধ মুখখানি দেখিল। তারপর মৃদুস্বরে বলিল— ‘রাজকুমারি, দেখুন চাঁদ উঠেছে।’

এগারো

বিদ্যুন্মালা জাগ্রতলোকে ফিরিয়া আসিয়া সিধা উঠিয়া বসিলেন, অর্জুনবর্মার পানে বিস্ফারিত চক্ষে চাহিয়া রহিলেন। স্বপ্ন ও জাগরের জট ছাড়াইতে একটু সময় লাগিল। তারপর তিনি ক্ষীণস্বরে বলিলেন— ‘আপনি কথা বললেন?’

অর্জুন অপ্রতিভ হইয়া পড়িল, বলিল— ‘আপনি বোধহয় খুব সুন্দর স্বপ্ন দেখছিলেন। আমি ভেঙে দিলাম।’

বিদ্যুন্মালা চাঁদের পানে চাহিলেন, মনে মনে ভাবিলেন, স্বপ্ন এখনও ভাঙে নাই।

অর্জুনবর্মা সঙ্কুচিতভাবে একটু দূরে বসিল, বলিল— ‘রাজকুমারি, আপনার শরীরের সব গ্লানি দূর হয়েছে?’

চাঁদের দিকে চাহিয়া থাকিয়া বিদ্যুন্মালা বলিলেন— ‘হাঁ, এখন বেশ স্বচ্ছন্দ মনে হচ্ছে। — রাত কত?’

হেমকূট শিখরে অগ্নিস্তম্ভ নির্ধূম শিখায় জ্বলিতেছে, নদীতীরস্থ গৃহগুলিতে দীপ নিভিয়া গিয়াছে। অর্জুন বলিল— ‘তৃতীয় প্রহর।’

এখনো রাত্রি শেষ হইতে বিলম্ব আছে। যতক্ষণ সূর্যোদয় না হয় ততক্ষণ স্বপ্নকে বিদায় দিবার প্রয়োজন নাই।

রাজকুমারী মনে মনে যেন কিছু জল্পনা করিতেছেন। তারপর মন স্থির করিয়া তিনি অর্জুনবর্মার পানে ফিরিলেন, বলিলেন— ‘ভদ্র, আজ আপনি আমার প্রাণ রক্ষা করেছেন।’

অর্জুন গলার মধ্যে একটু শব্দ করিল, উত্তর দিল না। বিদ্যুন্মালা বলিলেন— ‘আপনার পরিচয় আমি কিছুই জানি না, কিন্তু আমার প্রাণদাতার পরিচয় আমি জানতে চাই। আপনি সবিস্তারে আপনার জীবনকথা আমাকে বলুন, আমি শুনব।’

অর্জুন বিহ্বল হইয়া বলিল— ‘দেবি, আমি অতি সামান্য ব্যক্তি, আমার পরিচয় কিছু নেই।’

বিদ্যুন্মালা বলিলেন— ‘আছে বৈকি। আপনি নিজের কার্যের দ্বারা খানিকটা আত্মপরিচয় দিয়েছেন, কিন্তু তা সম্পূর্ণ নয়। আপনার সম্পূর্ণ পরিচয় আমি জানতে চাই।’

অর্জুন দ্বিধাগ্রস্ত নতমুখে চুপ করিয়া রহিল। উত্তর না পাইয়া বিদ্যুন্মালা একটু হাসিলেন, বলিলেন— ‘অবশ্য আপনি ক্লান্ত, ওই দুর্যোগের পর ক্ষণকালের জন্যও বিশ্রাম করেননি। আপনি যদি ক্লান্তিবশত কাহিনী বলতে না পারেন, তাহলে থাক, আপনি বরং নিদ্রা যান। আমি তো এখন সুস্থ হয়েছি, আমি জেগে থেকে পাহারা দেব।’

অর্জুন বলিল— ‘না না, আমার নিদ্রার প্রয়োজন নেই। আপনি যখন শুনতে চান, আমার জীবনকথা বলছি। রাত্রি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর তো কিছুই করবার নেই।’

বিদ্যুন্মালা বলিলেন— ‘তাহলে আরম্ভ করুন।’

অর্জুন কিছুক্ষণ হেঁট মুখে নীরব রহিল, তারপর ধীরে ধীরে বলিতে আরম্ভ করিল—

‘আমার পিতার নাম রামবর্মা। আমরা যাদববংশীয় ক্ষত্রিয়। আমার পূর্বপুরুষেরা বহু শতাব্দী আগে উত্তর দেশ থেকে এসে কৃষ্ণা নদীর তীরে বসতি করেছিলেন। উত্তর দেশে তখন যবনের আবির্ভাব হয়েছে, মানুষের প্রাণে সুখ-শান্তি নেই। দাক্ষিণাত্যে এসেও আমার পূর্বপুরুষেরা বেশি দিন সুখ-শান্তি ভোগ করতে পারলেন না, পিছন পিছন যবনেরা এসে উপস্থিত হল। উত্তরাপথের যে দুরবস্থা হয়েছিল দক্ষিণাপথেরও সেই দুরবস্থা হল। তারপর আজ থেকে শত বর্ষ পূর্বে বিজয়নগরে হিন্দুরাজ্য স্থাপিত হল, যবনেরা কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণ দিক থেকে বিতাড়িত হল। আমার পূর্বপুরুষেরা কৃষ্ণার উভয় তীরে বসতি স্থাপন করেছিলেন, তাঁরা যবনের অধীনেই রইলেন। দাক্ষিণাত্যের যবনেরা দিল্লীর শাসন ছিন্ন করে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল, তার নাম বহমনী রাজ্য; গুলবর্গা তার রাজধানী।

আমার পূর্বপুরুষেরা যোদ্ধা দিলেন, গুলবর্গার উপকণ্ঠে জমিজমা বাসগৃহ করেছিলেন। যখন যবন এসে গুলবর্গায় রাজধানী স্থাপন করল তখন তাঁরা যুদ্ধব্যবসায় ত্যাগ করলেন; কারণ যুদ্ধ করতে হলে যবনের পক্ষে স্বজাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়। তাঁরা অস্ত্র ত্যাগ করে শাস্ত্রচর্চায় নিযুক্ত হলেন।

এসব কথা আমি আমার পিতার মুখে শুনেছি।

সেই থেকে আমাদের বংশে বিদ্যার চর্চা প্রচলিত হয়েছে, কেবল আমি তার ব্যতিক্রম। কিন্তু নিজের কথা পরে বলব, আগে আমার পিতার কথা বলি।

আমার পিতা জীবিত আছেন, আমি দেখে এসেছি, কিন্তু এতদিনে তিনি বোধহয় আর জীবিত নেই। তিনি যুদ্ধবৃত্তি ত্যাগ করেছিলেন বটে, কিন্তু অন্তরে তিনি যোদ্ধা ছিলেন। কোনো দিন যবনের কাছে মাথা নত করেননি। গৃহে বসে তিনি বিদ্যাচর্চা করতেন, জ্যোতিষ ও গণিত বিদ্যায় তাঁর পারদর্শিতা ছিল। বিশেষত হিসাব-নিকাশের কাজের জন্য তিনি গুলবর্গায় খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আমি ছেলেবেলা থেকে দেখছি, গুলবর্গার বড় বড় ব্যবসায়ী তাঁর কাছে আসে নিজের ব্যবসায়ের হিসাবপত্র বুঝে নেবার জন্য। এ থেকে পিতার যথেষ্ট আয় ছিল।

আমার যখন দশ বছর বয়স তখন আমার মা মারা যান। পিতা আর বিবাহ করেননি। আমি এবং পিতা ছাড়া আমাদের গৃহে আর কেউ ছিল না।

আমার কিন্তু বিদ্যাশিক্ষার দিকে মন ছিল না। বংশের সহজাত সংস্কার আমার রক্তে বেশি আছে; ছেলেবেলা থেকে আমি খেলাধূলা অস্ত্রবিদ্যা সাঁতার মল্লযুদ্ধ এইসব নিয়ে মত্ত থাকতাম। একদল বেদিয়ার কাছে একটি গুপ্তবিদ্যা শিখেছিলাম, যার বলে এক দণ্ডে তিন ক্রোশ পথ অতিক্রম করতে পারি। পিতা আমার মনের প্রবণতা দেখে মাঝে মাঝে বলতেন— ‘অর্জুন, তোমার ধাতু-প্রকৃতিতে গোত্রপ্রভাব বড় প্রবল, তোমার কোষ্ঠীও যোদ্ধার কোষ্ঠী। তুমি বিজয়নগরে গিয়ে হিন্দু রাজার অধীনে সৈনিক বৃত্তি অবলম্বন কর।’ আমি বলতাম— ‘পিতা, আপনিও চলুন।’ তিনি বলতেন— ‘সাত পুরুষের ভিটে ছেড়ে আমি যাই কী করে? গৃহে দীপ জ্বলবে না, যবনেরা সব লুটেপুটে নিয়ে যাবে। তুমি যাও, হিন্দু রাজ্যে নিঃশঙ্কে বাস করতে পারবে।’ কিন্তু আমি যেতে পারতাম না, পিতাকে ছেড়ে একা চলে যেতে মন চাইত না।

এইভাবে জীবন কাটছিল; জীবনে নিবিড় সুখও ছিল না, গভীর দুঃখও ছিল না। তারপর আজ থেকে দশ-বারো দিন আগে রাত্রি দ্বিপ্রহরে পিতার এক বন্ধু এলেন। মহাধনী বণিক, সুলতান আহমদ শাহের সভায় যাতায়াত আছে, তিনি চুপি চুপি এসে বলে গেলেন— ‘আহমদ শাহ স্থির করেছে তোমাকে আর তোমার ছেলেকে গরু খাইয়ে মুসলমান করবে, তারপর তোমাকে নিজের দপ্তরে বসাবে। কাল সকালেই সুলতানের সিপাহীরা আসবে তোমাদের ধরে নিয়ে যেতে।’

পিতার মাথায় বজ্রাঘাত। সংবাদদাতা যেমন গোপনে এসেছিলেন তেমনি চলে গেলেন। আমরা দুই পিতা-পুত্র সারারাত পরস্পরের মুখের পানে চেয়ে বসে রইলাম।

মুসলমানেরা দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, তাদের প্রাণে ভয় নেই। কিন্তু তারা দস্যুরূপে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল, সেই দস্যুবৃত্তি এখনো ত্যাগ করতে পারেনি। তারা লুঠ করতে জানে, কিন্তু রাজ্য চালাতে জানে না; আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখতে জানে না। তাই তারা কর্মদক্ষ বুদ্ধিমান হিন্দু দেখলেই জোর করে তাদের মুসলমান বানিয়ে নিজেদের দলে টেনে নেয়। পিতাকেও তারা গরু খাইয়ে নিজের দলে টেনে নিতে চায়। সেই সঙ্গে আমাকেও।

রাত্রি যখন শেষ হয়ে আসছে তখন পিতা বললেন— ‘অর্জুন, আমার পঞ্চাশ বছর বয়স হয়েছে, কোষ্ঠী গণনা করে দেখেছি আমার আয়ু শেষ হয়ে আসছে। ম্লেচ্ছরা যদি জোর করে আমার ধর্মনাশ করে আমি অনশনে প্রাণত্যাগ করব। কিন্তু তুমি পালিয়ে যাও, তোমার জীবনে এখনো সবই বাকি। নদী পার হয়ে তুমি হিন্দু রাজ্যে চলে যাও।’

আমি পিতার পা ধরে কাঁদতে লাগলাম। পিতা বললেন— ‘কেঁদো না। আমরা যাদববংশীয় ক্ষত্রিয়, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ আমাদের পূর্বপুরুষ। তাঁকেও একদিন জরাসন্ধের অত্যাচারে মথুরা ছেড়ে দ্বারকায় চলে যেতে হয়েছিল। তুমি বিজয়নগরে যাও, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তোমাকে রক্ষা করবেন।’

বাইরে তখন কাক কোকিল ডাকতে আরম্ভ করেছে। আমি গৃহ ছেড়ে যাত্রা করলাম। আমার সঙ্গে শুধু এক জোড়া লাঠি। বেদিয়ারা আমাকে যে লাঠিতে চড়ে হাঁটতে শিখিয়েছিল। সেই লাঠি। এ লাঠি একাধারে অস্ত্র এবং যানবাহন।

বাড়ি থেকে বেরিয়েই শুনতে পেলাম-অশ্বক্ষুরধ্বনি। চারজন অশ্বারোহী আমাদের ধরে নিয়ে যেতে আসছে। আমি আর বিলম্ব করলাম না, লাঠিতে চড়ে নদীর দিকে ছুটলাম। সওয়ারেরা আমাকে দেখতে পেয়েছিল, তারা আমাকে তাড়া করল। কিন্তু ধরতে পারল না। আমাদের গৃহ থেকে নদী প্রায় অর্ধ ক্রোশ দূরে, আমি গিয়ে লাঠিসুদ্ধ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অশ্বারোহীরা আর আমাকে অনুসরণ করতে পারল না।

সারাদিন নদীর স্রোতে ভাসতে ভাসতে কৃষ্ণা ও তুঙ্গভদ্রার সঙ্গমে এসে পৌঁছুলাম। তারপর— তারপর যা হল সবই আপনি জানেন।’

অর্জুন নীরব হইল। বিদ্যুন্মালা নতমুখে শুনিতেছিলেন, চোখ তুলিয়া সম্মুখে চাহিলেন। চন্দ্রের প্রভা স্নান হইয়া গিয়াছে, পূর্বাকাশে শুকতারা দপদপ করিতেছে।