দ্বিতীয় পর্ব – এক
দিনের আলো ফুটিবার সঙ্গে সঙ্গেই কিল্লাঘাটে মহা হৈ-চৈ আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। কুমার কম্পন ফিরিয়া আসিয়াছেন। গোলাকৃতি খেয়ার তরীগুলি ঝড়ের তাড়নে ছত্রভঙ্গ হইয়া গিয়াছিল, কিন্তু ডুবিয়া যায় নাই; তাহারা ঘাটে ফিরিয়া আসিয়াছে। এই বিচিত্র গঠনের ডিঙাগুলি তুঙ্গভদ্রার নিজস্ব নৌকা, ভারতের অন্য কোথাও দেখা যাইত না। বেতের চ্যাঙ্গারির গায়ে চামড়ার আবরণ পরাইয়া এই ডিঙাগুলি নির্মিত; তবে আয়তনে চ্যাঙ্গারির তুলনায় অনেক বড়, দশ-বারো জন মানুষ তল্পিতল্পা লইয়া স্বচ্ছন্দে বসিতে পারে। এই জাতীয় জলযান প্রাচীন কাল হইতে আরব দেশে প্রচলিত ছিল, দক্ষিণ ভারতে কেমন করিয়া উপনীত হইল বলা সহজ নয়। হয়তো মোপলারা যখন আরব দেশ হইতে আসিয়া দক্ষিণাত্যে উপনিবেশ স্থাপন করে তখন তাহারাই এই জাতীয় নৌকার প্রবর্তন করিয়াছিল।
কুমার কম্পনদেব ঘাটে দাঁড়াইয়া দেখিতেছিলেন, কলিঙ্গের তিনটি বহিত্র নদীমধ্যস্থ বিভিন্ন চরে আটকাইয়া বেসামাল ভঙ্গিতে দাঁড়াইয়া আছে; যদিও মানুষগুলাকে দেখা যাইতেছে না, তবু আশা করা যায় তাহারা বাঁচিয়া আছে। বাঁচিয়া থাকিলে তাহাদের উদ্ধার করা প্রয়োজন; সর্বাগ্রে কলিঙ্গের দুই রাজকন্যার সন্ধান লওয়া কর্তব্য। কম্পনদেব আদেশ দিলেন; চক্রাকৃতি ডিঙাগুলি লইয়া মাঝিরা অর্ধমজ্জিত বহিত্রিগুলির দিকে চলিল। সর্বশেষ ডিঙাতে স্বয়ং কম্পনদেব উঠিলেন।
এখনও সূর্যোদয় হয় নাই, কিন্তু পূর্বদিগন্ত আসন্ন সূর্যের ছটায় স্বর্ণাভ হইয়া উঠিয়াছে। ডিঙাগুলি ভাটির দিকে চলিল, কারণ বানচাল বহিত্র তিনটি ঐদিকেই পরস্পর হইতে দুই-তিন রজ্জু দূরে আটকাইয়া আছে।
সকলের পশ্চাতে কম্পনদেবের ডিঙা যাইতেছিল। তিনি ডিঙার মধ্যস্থলে দাঁড়াইয়া এদিক-ওদিক চাহিতেছিলেন; সহসা তাঁহার চোখে পড়িল, পাশের দিকে দ্বীপাকৃতি একটি চরের উপর দুইটি মনুষ্যমূর্তি পড়িয়া আছে। তিনি আরো ভাল করিয়া দেখিলেনঃ হাঁ, সৈকতলীন মনুষ্যদেহই বটে। কিন্তু জীবিত কি মৃত বলা যায় না। একটির দেহে বালু-কর্দমাক্ত রক্তাংশুক দেখিয়া মনে হয় সে নারী। কম্পনদেব মাঝিকে সেইদিকে ডিঙা ফিরাইতে বলিলেন।
দ্বীপে নামিয়া কম্পনদেব নিঃশব্দে ভূমিশয়ান মূর্তি দুইটির নিকটবর্তী হইলেন। একটি নারী, অন্যটি পুরুষ; পরস্পর হইতে তিন-চারি হস্ত অন্তরে শুইয়া আছে। কিন্তু মৃত নয়, নিশ্বাস-প্রশ্বাসের ছন্দে দেহের সঞ্চালন লক্ষ্য করা যায়। হয় মূর্ছিত, নয় নিদ্রিত।
কম্পনদেবের চক্ষু যুবতীর মুখ হইতে পুরুষের মুখের দিকে কয়েকবার দ্রুত যাতায়াত করিল, তারপর যুবতীর মুখের উপর স্থির হইল। এই সময় সূর্যবিম্ব দিকচক্রের উপর মাথা তুলিয়া চারিদিকে অরুণচ্ছটা ছাড়াইয়া দিল। যুবতীর মুখে বালার্ক-কুঙ্কুমের স্পর্শ লাগিল।
কম্পনদেব নিস্পলক নেত্রে যুবতীর ঘুমন্ত মুখের পানে চাহিয়া রহিলেন। তিনি রাজপুত্র, সুন্দরী যুবতী তাঁহার কাছে নূতন নয়। কিন্তু এই ভূমিশয়ান যুবতীর মুখে এমন একটি দুর্নিবার চৌম্বকশক্তি আছে যে বিমূঢ় হইয়া চাহিয়া থাকিতে হয়। কম্পনদেব যুবতীর প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া মনে মনে বিচার করিলেন— এ নিশ্চয় কলিঙ্গের প্রধান রাজকন্যা, বিজয়নগরের ভাবী রাজবধূ। কম্পনদেব বোধকরি কলিঙ্গদেশীয়া বরাঙ্গনাদের কুহকভরা রূপলাবণ্যের সহিত ইতিপূর্বে পরিচিত ছিলেন না, তাঁহার সর্বাঙ্গ দিয়া ঈর্ষামিশ্রিত অভীপ্সার শিহরণ বহিয়া গেল।
আরো কিছুক্ষণ নিদ্রিতাকে পর্যবেক্ষণ করিয়া তিনি গলার মধ্যে শব্দ করিলেন, আমনি বিদ্যুন্মালার চক্ষু দু’টি খুলিয়া গেল; অপরিচিত পুরুষ দেখিয়া তিনি বসন সংবরণপূর্বক উঠিয়া বসিলেন। উষাকালে তিনি আবার তন্দ্রাচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছিলেন। অর্জুনও ঘুমাইয়াছিল। অর্জুনের ঘুম কিন্তু ভাঙ্গিল না, সারা রাত্রি জাগরণের পর সে গভীরভাবে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে।
বিদ্যুন্মালা একবার কুমার কম্পনদেবের দিকে চক্ষু তুলিয়াই আবার চক্ষু নত করিলেন। এই পরম কান্তিমান যুবকের চোখের দৃষ্টি ভাল নয়। বিদ্যুন্মালা ঈষৎ উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘আপনি কে?’
কম্পনদেব বলিলেন— ‘আমি রাজভ্রাতা কুমার কম্পনদেব। ঝঞ্জা-বিধ্বস্তদের খোঁজ নিতে বেরিয়েছি। আপনি—?’
‘আমি কলিঙ্গের রাজকন্যা বিদ্যুন্মালা।’
কম্পনদেব অর্জুনের দিকে কটাক্ষপাত করিয়া বলিলেন— ‘এ ব্যক্তি কে?’
বিদ্যুন্মালা বলিলেন— ‘আমি ঝড়ের আঘাতে নৌকা থেকে জলে পড়ে গিয়েছিলাম, ডুবে যাচ্ছিলাম। উনি আমাকে উদ্ধার করেছেন। ওঁর নাম অর্জুনবর্মা।’
নিদ্রার মধ্যেও নিজের নাম অর্জুনের কর্ণে প্রবেশ করিয়াছিল, সে এক লাফে উঠিয়া দাঁড়াইল; কম্পনদেবকে দেখিয়া বলিল— ‘কে?’
কম্পনদেব কুঞ্চিতচক্ষে তাহাকে নিরীক্ষণ করিলেন, উত্তর দিলেন না; তারপর বিদ্যুন্মালার দিকে ফিরিলেন— ‘সারা রাত্রি আপনি এবং এই ব্যক্তি দ্বীপেই ছিলেন?’
‘হাঁ।’
‘ভাল। চলুন, এবার ডিঙায় উঠন।’
বিদ্যুন্মালা উঠিয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহার চক্ষে সহসা ব্যাকুলতার ছায়া পড়িল, তিনি বলিলেন— ‘কিন্তু— কঙ্কণা? আমাদের নৌকা কি ডুবে গিয়েছে?’
কম্পনদেব বলিলেন— ‘না, একটি নৌকাও ডোবেনি। — কঙ্কণা কে?’
‘আমার ভগিনী— মাণিকঙ্কণা।’
‘তিনি নিশ্চয় ময়ূরপঙ্খী নৌকাতেই আছেন। আসুন, প্রথমে আপনাকে সেখানে নিয়ে যাই।’
বিদ্যুন্মালা ডিঙায় উঠিলেন। কুমার কম্পন একটু চিন্তা করিয়া অর্জুনের দিকে শিরঃসঞ্চালন করিলেন। অর্জুন ডিঙায় উঠিল। তখন কম্পনদেব স্বয়ং ডিঙায় আরোহণ করিয়া স্রোতের মুখে নৌকা চালাইবার আদেশ দিলেন।
সূর্য আরো উপরে উঠিয়াছে। নদীর বুকে যে সামান্য বাষ্পাবরণ জমিয়াছিল তাহা অন্তর্হিত হইয়াছে নৌকা তিনটি স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। প্রথমেই ময়ূরপঙ্খী নৌকা নিমজ্জিত চরে অবরুদ্ধ হইয়া উৎকণ্ঠ ময়ূরের ন্যায় দাঁড়াইয়া আছে; চারিদিকে জল। ইতিমধ্যে একটি ডিঙা তাহার নিকট পৌঁছিয়াছে, কিন্তু ময়ূরপঙ্খীর পাটাতনে মানুষ দেখা যাইতেছে না।
কুমার কম্পনের ডিঙা ময়ূরপঙ্খীর গায়ে গিয়া ভিড়িল। কুমারী বিদ্যুন্মালা শীর্ণ কণ্ঠে ডাকিলেন— ‘কঙ্কণা!’
খোলের ভিতর হইতে আলুথালু বেশে মণিকঙ্কণা বাহির হইয়া আসিল। বিদ্যুন্মালাকে দেখিয়া দুই বাহু প্রসারিত করিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল— ‘মালা! তুই বেঁচে আছিস।’
বিদ্যুন্মালা টলিতে টলিতে ময়ূরপঙ্খীর পাটাতনে উঠিলেন, দুই ভগিনী পরস্পর কণ্ঠালগ্না হইলেন। তারপর গলদশ্রু নেত্রে রইঘরে নামিয়া গেলেন। রাজপুরীতে যাইতে হইবে, আবার বেশবাস পরিবর্তন করিয়া রাজকন্যার উপযোগী সাজসজ্জা করা প্রয়োজন।
ডিঙাতে দাঁড়াইয়া কুমার কম্পন অঙ্গুলি দিয়া সূক্ষ্ম গুস্ফের প্রান্ত আমর্শন করিতে লাগিলেন। অর্জুন অপাঙ্গ দৃষ্টিতে তাঁহাকে দেখিতেছিল, তাঁহার মনের ভাব বুঝিতে কষ্ট হইল না। রাজপুত্র রূপ দেখিয়া মজিয়াছেন।
শোভাযাত্রা করিয়া রাজকন্যারা কিল্লাঘাট হইতে রাজভবন অভিমুখে যাত্রা করিলেন।
রাজকন্যাদের হাতির পিঠে উঠিবার অনুরোধ করা হইয়াছিল, তাঁহারা ওঠেন নাই। দুই বোন পাশাপাশি চতুর্দোলায় বসিয়াছেন। কুমার কম্পন অশ্বপৃষ্ঠে চতুর্দোলার পাশে চলিয়াছেন। তাঁহার দৃষ্টি মুহুর্মুহু রাজকন্যাদের দিকে ফিরিতেছে; রহস্যময় দৃষ্টি, তাঁহার অন্তর্গূঢ় জল্পনা কেহ অনুমান করিতে পারে না।
চতুর্দোলার পশ্চাতে একটি দোলায় রাজবৈদ্য বৃদ্ধ রসরাজ ঔষধের পেটরা লইয়া উঠিয়াছেন। ভাগ্যক্রমে তাঁহার দেহ অনাহত আছে, কিন্তু অবস্থাগতিকে তিনি যেন একটু দিশহারা হইয়া পড়িয়াছেন।
রসরাজের পিছনে নৌকার নাবিক ও সৈনিকের দল পদব্রজে চলিয়াছে। তাহাদের মধ্যে অর্জুনবর্মাও আছে। সে চলিতে চলিতে ঘাড় ফিরাইয়া এদিক-ওদিক দেখিতেছে, সবগুলি মুখই পরিচিত, কিন্তু বলরামকে দেখা যাইতেছে না। অর্জুনের পাশের লোকটি হাসিয়া বলিল— ‘বলরাম কর্মকারকে খুঁজছ? সে আসেনি। নৌকা জখম হয়েছে, তাই মেরামতির জন্য বলরাম আর কয়েকজন ছুতার নৌকাতেই আছে।’ অর্জুন নিশ্চিন্ত হইল, বিচিত্র নগরশোভা দেখিতে দেখিতে চলিল।
শোভাযাত্রার গতি দ্রুত নয়; সম্মুখে পাঁচটি হাতি ও পশ্চাতে অশ্বারোহীর দল তাহার বেগমর্যাদা সংযত করিয়া রাখিয়াছে। আজ আর মুরজমুরলী বাজিতেছে না, থাকিয়া থাকিয়া বিপুল শব্দে তূরী ও পটহ ধ্বনিত হইতেছে; যেন বিজয়ী সৈন্যদল ডঙ্কা বাজাইয়া গৃহে ফিরিতেছে।
এই বিশাল নগরের আকৃতি প্রকৃতি সত্যই বিচিত্র। সাতটি প্রাকারবেষ্টনীর মধ্যে ছয়টি পিছনে পড়িয়া আছে, তবু নগর এখনো তাদৃশ জনাকীর্ণ নয়। ভূমি কোথাও সমতল নয়, কঙ্কারাবৃত পথ কখনো উঠিতেছে কখনো নামিতেছে, কখনো মকরাকৃতি অনুচ্চ গিরিশ্রেণীকে পাশ কাটাইয়া যাইতেছে। কোথাও অগভীর সংকীর্ণ পয়োনালক পথকে খণ্ডিত করিয়া দিয়াছে, হাঁটু পর্যন্ত জল অতিক্রম করিয়া যাইতে হয়। যেখানে জমি একটু সমতল সেখানেই পথের পাশে পাথরের গৃহ, ফুলের বাগান, আম্রবাটিকা, ইক্ষুক্ষেত্র। শোভাযাত্রা দেখিবার জন্য বহু নরনারী পথের ধারে সারি দিয়া দাঁড়াইয়াছে, হাস্যমুখী যুবতীরা চতুর্দোলা লক্ষ্য করিয়া লাজাঞ্জলি নিক্ষেপ করিতেছে।
তারপর আবার অসমতল শিলাবন্ধুর ভূমি, স্বল্পসেচনতুষ্ট জোয়ার-বাজরার শূলকণ্টকিত ক্ষেত্র। ঊর্ধ্বে চাহিলে দেখা যায়, দূরে দূরে তিনটি স্তম্ভাকার গিরিশৃঙ্গ— হেমকূট মতঙ্গ ও মালয়বন্ত আকাশে মাথা তুলিয়া যেন দূরাগত শত্রুর দিকে লক্ষ্য রাখিয়াছে।
দিবা দ্বিতীয় প্রহরের আরম্ভে মিছিল এক উত্তুঙ্গ সিংহদ্বারের সম্মুখে উপস্থিত হইল। ইহাই শেষ তোরণ, তোরণের দুই পাশ হইতে উচ্চ পাষাণ-প্রাকার নির্গত হইয়া অন্তর্ভুক্ত ভূমিকে বেষ্টন করিয়া রাখিয়াছে। বিস্তীর্ণ নগরচক্রের ইহা কেন্দ্রস্থিত নাভি।
তোরণের প্রহরীরা পথ ছাড়িয়া দিল, মিছিল সপ্তম পুরীতে প্রবেশ করিল। সাত কৌটার মধ্যে এক কৌটা। ইহার ব্যাস চারি ক্রোশ; ইহার মধ্যে চৌত্রিশটি প্রশস্ত রাজপথ আছে, তন্মধ্যে প্রধান রাজপথের নাম পান-সুপারি রাস্তা। নাম পান-সুপারি রাস্ত হইলেও সোনা-রূপা হীরা-জহরতের বাজার। এই মণিমাণিক্যের হাটের মাঝখানে রাজভবনের অসংখ্য হর্ম্যরাজি।
মিছিল সেইদিকে চলিল। গভীর শব্দে ডঙ্কা ও তূরী বাজিতেছে। পথে লোকারণ্য; পথিপার্শ্বস্থ অট্টালিকাগুলির অলিন্দে বাতায়নে চাঁদের হাট; দুই সুন্দরী রাজকন্যাদের দেখিয়া সকলে জয়ধ্বনি করিতেছে। মণিকঙ্কণা ও বিদ্যুন্মালা চতুর্দোলায় পাশাপাশি বসিয়া আছেন। মণিকঙ্কণা সাহসিনী মেয়ে, কিন্তু তাহার বুকও মাঝে মাঝে দুরু দুরু করিয়া উঠিতেছে। বিদ্যুম্মালার আয়ত চক্ষু সম্মুখ দিকে প্রসারিত, কিন্তু তাঁহার মন আপন অতল গভীরতায় ডুবিয়া গিয়াছে। তিনি ভাবিতেছেন— জীবন এত জটিল কেন?
বেলা দ্বিপ্রহরে মধ্যদিনের সূর্যকে মাথায় লইয়া শোভাযাত্রা রাজভবনের সম্মুখে উপস্থিত হইল।
দুই
রাজপুরীর সাত শত প্রতিহারিণী ও পরিচারিকা সভাগৃহের সম্মুখে সারি দিয়া দাঁড়াইয়াছে। তাহাদের বাম হস্তে চর্ম, দক্ষিণ হস্তে মুক্ত তরবারি। সকলেই দৃঢ়াঙ্গী যুবতী, সুদর্শনা। তাহাদের মধ্যে অল্প সংখ্যক তাতারী যুবতী আছে, পিঙ্গল কেশ ও নীল চক্ষু দেখিয়া চেনা যায়। রাজপুরীতে, সভাগৃহ ব্যতীত অন্যত্র, পুরুষের প্রবেশ নিষেধ, এই নারীবাহিনী পুরী রক্ষণ করে ও পৌরজনের সেবা করে।
চতুর্দোলা রাজসভার স্তম্ভশোভিত দ্বারের সম্মুখে থামিয়াছিল। কুমার কম্পন অশ্বপৃষ্ঠ হইতে অবতরণ করিলেন। বাদ্যোদ্যম তুমুল হইয়া উঠিল। তারপর সভাগৃহ হইতে মহারাজ দেবরায় বাহির হইয়া আসিলেন। তপ্তকাঞ্চন দেহ, মুখে সৌম্য প্রশান্ত গাম্ভীর্য; পরিধানে পট্টবস্ত্র ও উত্তরীয়; কর্ণে মণিময় কুণ্ডল, বাহুতে অঙ্গদ। যৌবনের মধ্যাহ্নে মহারাজ দেবরায়ের দেহ যেন লাবণ্যচ্ছটা বিকীর্ণ করিতেছে।
তিনি একটি হস্ত ঊর্ধ্বে তুলিলেন, অমনি বাদ্যোদ্যম নীরব হইল। কুমার কম্পন বলিলেন— ‘মহারাজ, এই নিন, কলিঙ্গর দুই দেবীকে নদী থেকে উদ্ধার করে এনেছি।’
দুই রাজকন্যা চতুর্দোলা হইতে নামিয়া রাজার সম্মুখে যুক্তহস্তা হইলেন। রাজাকে দেখিয়া মণিকঙ্কণার সমস্ত ভয় দূর হইয়াছিল, সে হর্ষোৎফুল্ল নেত্রে চাহিল; বিদ্যুন্মালার মুখ দেখিয়া কিন্তু মনের কথা বোঝা গেল না। রাজা পূর্বে কলিঙ্গ-কন্যাদের দেখেন নাই, ভাটের মুখে বিবাহ স্থির হইয়াছিল। তিনি একে একে দুই কন্যাকে দেখিলেন। তাঁহার মুখের প্রসন্নতা আরো গভীর হইল। আশীর্বাদের ভঙ্গিতে করতল তুলিয়া তিনি বলিলেন— ‘স্বস্তি।’
রসরাজও নিজের দোলা হইতে নামিয়াছিলেন, এই সময় তিনি আসিয়া রাজার সম্মুখে দাঁড়াইলেন, বলিলেন— ‘জয়োস্ত মহারাজ। আমি কলিঙ্গের রাজবৈদ্য রসরাজ, কুমারীদের সঙ্গে এসেছি। কুমারীদের মাতুল অভিভাবকরূপে ওদের সঙ্গে এসেছিলেন, কিন্তু তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই আমিই আপনাকে কন্যাদের পরিচয় দিচ্ছি। ইনি কুমারী-ভট্টারিকা বিদ্যুন্মালা, ভাবী রাজবধূ; আর ইনি রাজকুমারী মণিকঙ্কণা, ভাবী রাজবধূর সঙ্গিনীরূপে এসেছেন।’
রাজা বলিলেন— ‘ধন্য। মাতুল মহাশয়কে নিশ্চয় খুঁজে পাওয়া যাবে। আপাতত—’
রাজা পাশের দিকে ঘাড় ফিরাইলেন। ইতিমধ্যে ধন্নায়ক লক্ষ্মণ মল্লপ রাজার পাশে একটু পিছনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। ইনি একাধারে রাজ্যের প্রধান সেনাপতি ও মহাসচিব। পঞ্চাশ বৎসর বয়স্ক দৃঢ়শারীর পুরুষ; অত্যন্ত সাদাসিধা বেশবাস, মুখ দেখিয়া বিদ্যাবুদ্ধি ও পদমর্যাদার কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না।
রাজা তাঁহাকে বলিলেন— ‘আর্য লক্ষ্মণ, মান্য অতিথিদের পরিচর্যার ব্যবস্থা করুন। এঁরা আমাদের কুটুম্ব, অতিথি-ভবনে নিয়ে গিয়ে এঁদের সমুচিত পানাহার বিশ্রামের আয়োজন করুন।’
‘যথা আজ্ঞা আর্য।’ লক্ষ্মণ মল্লপ করজোড়ে অতিথিদের সম্বোধন করিলেন— ‘আমার সঙ্গে আসতে আজ্ঞা হোক। অতিথি-ভবন নিকটেই, সেখানে আপনাদের স্নান পান আহার বিশ্রামের আয়োজন করে রেখেছি।’
লক্ষ্মণ মল্লপ লক্ষ্য করিয়াছিলেন যে রসরাজ চোখে ভাল দেখেন না, তিনি তাঁহার হাত ধরিয়া আগে লইয়া চলিলেন, অতিথিবর্গ তাঁহাদের পিছনে চলিল। রাজসভা হইতে শত হস্ত দূরে রাজকীয় টঙ্কশালের পাশে প্রকাণ্ড দ্বিভূমক অতিথি-ভবন। সেখানে পাঁচ শত অতিথি এককালে বাস করিতে পারে।
ইত্যবসরে রাজপুরী হইতে একটি শক্তসমর্থা দাসী স্বর্ণকলসে জল আনিয়া রাজকুমারীদের পায়ের কাছে ঢালিয়া দিয়াছিল। এই দাসী বিপুল রাজপরিবারের গৃহিণী, সাত শত প্রতিহারিণীর প্রধানা নায়িকা; নাম পিঙ্গলা। রাজা তাহাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন— ‘পিঙ্গলে, কলিঙ্গ-কুমারীদের জন্য নূতন প্রাসাদ প্রস্তুত হচ্ছে, এখনো বাসের উপযোগী হয়নি। তুমি আপাতত এঁদের রাজ-সভাগৃহের দ্বিতলে নিয়ে যাও, উপস্থিত সেখানেই এঁরা থাকবেন।’
পিঙ্গলা একটু হাসিয়া বলিল— ‘যথা আজ্ঞা আর্য।’
পিঙ্গলাকে নূতন করিয়া বলিবার প্রয়োজন ছিল না, কারণ ইতিপূর্বে রাজার আদেশে সে সভাগৃহের দ্বিতলে রাজকুমারীদের জন্য উপযুক্ত বাসস্থান সাজাইয়া গুছাইয়া রাখিয়াছিল; রাজা বোধ করি কুমারীদের শুনাইবার জন্য একথা বলিয়াছিলেন। রাজকীয় সভাগৃহটি দ্বিভূমক; নিম্নাতলে সভা বসে, দ্বিতীয় তলে তিনটি মহল। একটিতে মহারাজ দিবাকালে বিশ্রাম করেন, দ্বিতীয়টি রাজার পাকশালা, সেখানে দশটি পাচিকা রাজার জন্য রন্ধন করে, নপুংসক কঞ্চুকী পাকশালার দ্বারের পাশে বসিয়া পাহারা দেয়। তৃতীয় মহলটি এতদিন শূন্য পড়িয়া ছিল। এখন সাময়িকভাবে নবাগতাদের বাসস্থান নির্দিষ্ট হইয়াছে।
রাজা পুনশ্চ বলিলেন— ‘এঁদের নিয়ে যাও, যথোচিত সেবা কর। দেখো যেন সেবার ত্রুটি না হয়।’
পিঙ্গলা বলিল— ‘ক্রটি হবে না মহারাজ। আমি নিজে এঁদের সেবা করব।’
‘ভাল।’
পিঙ্গলা রাজকুমারীদের স্বাগত সম্ভাষণ করিয়া লইয়া গেল। মহারাজ ভ্রাতার দিকে ফিরিয়া সস্নেহে তাঁহার স্কন্ধে হস্ত রাখিলেন— ‘কম্পন, কাল থেকে তোমার অনেক পরিশ্রম হয়েছে। যাও, নিজ গৃহে বিশ্রাম কর গিয়ে।’
কম্পনদেব হ্রস্বকণ্ঠে বলিলেন— ‘আমার কিছু নিবেদন আছে আর্য।’
রাজা সপ্রশ্ন নেত্রে ভ্রাতার পানে চাহিলেন, তারপর বলিলেন— ‘এস।’
দুই ভ্রাতা সভাগৃহে প্রবেশ করিলেন।
বহু স্তম্ভযুক্ত রাজসভার আকৃতি নাট্যমণ্ডপের ন্যায়; তিন ভাগে সভাসদ্গণের আসন, চতুর্থ ভাগে অপেক্ষাকৃত উচ্চ মঞ্চের উপর সিংহাসন। পাথরে গঠিত হর্ম্য, কিন্তু পাথর দেখা যায় না; কুড্য ও স্তম্ভের গাত্র সোনার তবকে মোড়া। মণিমাণিক্যখচিত স্বর্ণ-সিংহাসনটি আয়তনে বৃহৎ, তিন চারি জন মানুষ স্বচ্ছন্দে পাশাপাশি বসিতে পারে। সিংহাসনের পাশে সোনার দীপদণ্ড, সোনার পর্ণসম্পুট, সোনার ভৃঙ্গার। চারিদিকে সোনার ছড়াছড়ি। সেকালে এত সোনা বোধ করি ভারতের অন্যত্র কোথাও ছিল না।
দ্বিপ্রহরে সভাগৃহ শূন্য, সভাসদেরা স্ব স্ব গৃহে প্রস্থান করিয়াছেন। রাজা দেবরায় আসিয়া সিংহাসনের উপর কিংখাবের আসনে বসিলেন; তাঁহার ইঙ্গিতে কুমার কম্পন তাঁহার পাশে বসিলেন। দুইজনে পাশাপাশি বসিলে দেখা গেল তাঁহাদের আকৃতি প্রায় সমান; দশ বছর বয়সের পার্থক্যে যতটুকু প্রভেদ থাকে ততটুকুই আছে। এই সাদৃশ্যের সুযোগ লইয়া মহারাজ দেবরায় একটু কৌতুক করিতেন; বিদেশ হইতে কোনো নবাগত রাষ্ট্রদূত আসিলে তিনি নিজে সভায় না আসিয়া ভ্রাতাকে পাঠাইয়া দিতেন। রাষ্ট্রদূতেরা চোখে না দেখিলেও রাজার কীর্তিকলাপের কথা জানিতেন। তাঁহারা কুমার কম্পনকে রাজা মনে করিয়া সবিস্ময়ে ভাবিতেন— এত অল্প বয়সে রাজা এমন কীর্তিমান! রাজা এই তুচ্ছ কাপট্যে আমোদ অনুভব করিতেন বটে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে অনিষ্ট হইতেছিল; কুমার কম্পনের মনে সিংহাসনের প্রতি লোভ জন্মিয়াছিল।
উভয়ে উপবিষ্ট হইলে রাজা ভ্রূ তুলিয়া ভ্রাতাকে প্রশ্ন করিলেন। কুমার কম্পন তখন ধীরে ধীরে বিদ্যুন্মালা ও অর্জুনবর্মার কথা বলিতে আরম্ভ করিলেন। অর্জুনবর্মা নদী হইতে বিদ্যুন্মালাকে উদ্ধার করিয়াছিল, দুইজনে নির্জন দ্বীপে রাত্রি কাটাইয়াছে, পাশাপাশি শুইয়া ঘুমাইয়াছে। কুমার কম্পন একটু শ্লেষ দিয়া একটু রঙ চড়াইয়া সব কথা বলিতে লাগিলেন; শুনিতে শুনিতে রাজার ললাট মেঘাচ্ছন্ন হইল।
বিবৃতির মাঝখানে লক্ষ্মণ মল্লপ এক সময় আসিয়া সিংহাসনের পাদমূলে পারসীক গালিচার উপর বসিলেন এবং কোনো কথা না বলিয়া নতমস্তকে কুমার কম্পনের কথা শুনিতে লাগিলেন। কুমার কম্পন তাঁহার আবির্ভাবে একটু ইতস্তত করিয়া আবার বলিয়া চলিলেন। লক্ষ্মণ মল্লপ ও কুমার কম্পনের মধ্যে ভালবাসা নাই, দু’জনেই দু’জনকে আড়-চক্ষে দেখেন। কিন্তু লক্ষ্মণ মল্লপ রাজ্যের মহাসচিব, তাঁহার কাছে রাজকীয় কোনো কথাই গোপনীয় নয়।
কুমার কম্পন বিবৃতি শেষ করিয়া বলিলেন— ‘মহারাজ, আমার বার্তা নিবেদন করলাম, এখন আপনার অভিরুচি।’ তারপর লক্ষ্মণ মল্লপের দিকে বক্র কটাক্ষপাত করিয়া বলিলেন— ‘আমার বিবেচনায় এ কন্যা বিজয়নগরের রাজবধূ হবার যোগ্য নয়।’
রাজা ক্ষণেক নীরব থাকিয়া বলিলেন— ‘তুমি যাও, বিশ্রাম কর গিয়ে।’
কুমার কম্পন অভিবাদন করিয়া প্রস্থান করিলেন। নিজের মনোগত অভিপ্রায় না জানাইয়া যতটা বলা যায় তাহা বলা হইয়াছে। আপাতত এই পর্যন্ত থাক।
রাজা ও মন্ত্রী পরস্পরের চোখে চোখ রাখিয়া কিছুক্ষণ বসিয়া রহিলেন। তারপর রাজা বলিলেন— ‘আপনি বোধহয় কম্পনের কথা সবটা শোনেননি—’
লক্ষ্মণ মল্লপ বলিলেন— ‘না শুনলেও অনুমান করতে পেরেছি।’
‘আপনার কি মনে হয়?’
লক্ষ্মণ মল্লপ বলিলেন— ‘ঘটনা সত্য বলেই মনে হয়, কিন্তু ইঙ্গিতটা অমূলক। আমি রাজকন্যাকে দেখেছি, আমার মনে কোনো সংশয় নেই।’
‘কিন্তু—’ রাজা থামিলেন।
লক্ষ্মণ মল্লপ বলিলেন— ‘অর্জুনবর্মার নিশ্চয় দলের সঙ্গে এসেছে। তাকে প্রশ্ন করা যেতে পারে।’
রাজা বলিলেন— ‘সেই ভাল। তাকে ডেকে পাঠান। আমি তাকে প্রশ্ন করব। আপনি তার মুখ লক্ষ্য করবেন।’
লক্ষ্মণ মল্লপ ঘাড় নাড়িয়া সায় দিলেন, তারপর বাম হস্ত দিয়া দক্ষিণ করতলে তালি বাজাইলেন। সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চের পাশের দিক হইতে একজন চোবাদার রক্ষী আসিয়া সিংহাসনের সম্মুখে রূপার ভল্ল নামাইয়া নতজানু হইল।
মন্ত্রী বলিলেন— ‘রাজকন্যাদের সঙ্গে যারা এসেছে তাদের মধ্যে একজনের নাম অর্জুনবর্মা। অতিথিশালা থেকে তাকে এখানে নিয়ে এস।’
রক্ষী ভল্ল হস্তে উঠিয়া দাঁড়াইল। মন্ত্রী পুনশ্চ বলিলেন— ‘বেঁধে আনতে হবে না। সমাদর করে নিয়ে আসবে।’
রক্ষী বলিল— ‘যথা অজ্ঞা আর্য।’
রাজা বলিলেন— ‘আমি বিরাম-গৃহে যাচ্ছি, সেখানে তাকে পাঠিয়ে দিও।’
রক্ষী বলিল— ‘যথা আজ্ঞা মহারাজ।’
তিন
অতিথি-ভবনে বহুসংখ্যক পরিচারক নবাগতদের সেবার ভার লইয়াছিল। প্রথমে অতিথিরা শীতল তক্র পান করিয়া পথশ্রম দূর করিলেন; তারপর স্নান ও আহার। অতিথিরা অধিকাংশই আমিশাষী, বহুবিধ মৎস্য ও মাংসাদি সহযোগে জবারের রোটিকা ও ঘূতপক্ক তণ্ডুল গ্রহণ করিলেন। রসরাজ নিরামিষ খাইলেন। তাঁহার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা, দধিমণ্ড ক্ষীর ফলমূল ও মিষ্টান্নের ভাগই অধিক।
প্রচুর আহার করিয়া সুবাসিত তাম্বূল চর্বণ করিতে করিতে সকলে অতিথি-ভবনের দ্বিতলে উপনীত হইলেন। দ্বিতলে সারি সারি অসংখ্য প্রকোষ্ঠ, প্রকোষ্ঠগুলিতে শুভ্র শয্যা বিস্তৃত। অতিথিগণ পরম আরামে সুকোমল শয্যায় লম্বমান হইলেন।
অর্জুনবর্মা একটি প্রকোষ্ঠে উপাধান মাথায় দিয়া শয়ন করিয়াছিল। উপাধান হইতে স্নিগ্ধ-শীতল উশীরের গন্ধ নাকে আসিতেছে। উদর তৃপ্তিদায়ক খাদ্যপানীয়ে পূর্ণ মস্তিষ্কে নূতন কোনো চিন্তা নাই; অর্জুনবর্মা চক্ষু মুদিত করিয়া রহিল। ক্রমে তাহার নিদ্রাকর্ষণ হইল।
সহসা তন্দ্রার মধ্যে নিজের নাম শুনিয়া অর্জুনবর্মার ঘুমের নেশা ছুটিয়া গেল। সে চক্ষু মেলিয়া দেখিল, প্রকোষ্ঠের দ্বারমুখে এক ভল্লধারী পুরুষ দাঁড়াইয়া আছে। অর্জুনবর্মা ত্বরিতে উঠিয়া বসিল।
রক্ষী দোপাট্টা দাড়ির মধ্যে হাসিয়া প্রশ্ন করিল— ‘মহাশয়ের নাম কি অর্জুনবর্মা?’
অর্জুন বলিল— ‘হাঁ, কী প্রয়োজন?’
রক্ষী বলিল— ‘শ্রীমন্মহারাজ আপনাকে স্মরণ করেছেন। আসতে আজ্ঞা হোক।’
অর্জুন বিস্মিত হইল; মহারাজ তাহার ন্যায় নগণ্য ব্যক্তিকে কেন স্মরণ করিলেন ভাবিয়া পাইল না। সে গাত্রোত্থান করিয়া বলিল— ‘চল।’
অতিথিশালা হইতে নামিয়া অর্জুন রক্ষীর সঙ্গে রাজসভার দিকে চলিল। আকাশে এখন সূর্য পশ্চিমে ঢলিয়াছে; কিন্তু এখনো বাতাস উত্তপ্ত, পৌরজন গৃহচ্ছায়া ছাড়িয়া বাহির হয় নাই। জনশূন্য পুরভূমি দিয়া যাইতে যাইতে রক্ষী জিজ্ঞাসা করিল— ‘রাজাকে কিভাবে অভিবাদন করিতে হয় আপনি জানেন তো?’
অর্জুন দাঁড়াইয়া পড়িল। সে কখনো রাজদরবারে যায় নাই, মাথা নাড়িয়া বলিল— ‘না, জানি না।’
রক্ষী বলিল— ‘চিন্তা নেই, আমি শিখিয়ে দিচ্ছি।’
সে মাটিতে ভল্ল রাখিয়া রাজ-বন্দনার প্রক্রিয়া দেখাইল। দুই হাত জোড় করিয়া মাথার ঊর্ধ্বে তুলিল, কটি হইতে ঊর্ধ্বাঙ্গ সম্মুখে অবনত করিল, তারপর খাড়া হইয়া হাত নামাইল। বলিল— ‘রাজাকে এইভাবে অভিবাদন করতে হয়। পারবেন?’
অর্জুন অনুরূপ প্রক্রিয়া করিয়া দেখাইল। নূতনত্ব থাকিলেও এমন কিছু শক্ত নয়। রক্ষী তুষ্ট হইয়া বলিল— ‘ওতেই হবে।’
সভাগৃহের দ্বিতলে উঠিবার সোপান-মুখে শস্ত্র-হস্তা দুইটি তরুণী প্রহরিণী দাঁড়াইয়া আছে। পুরুষ প্রহরীর অধিকার শেষ হইয়া এখান হইতে স্ত্রী-প্রহরীর এলাকা আরম্ভ হইয়াছে। প্রহরিণীদ্বয় অর্জুনবর্মাকে উত্তমরূপে নিরীক্ষণ করিল, রক্ষীকে প্রশ্ন করিল, তারপর পথ ছাড়িয়া দিল। রক্ষী নীচেই রহিল, অর্জুনবর্মা সঙ্কীর্ণ সোপান দিয়া উপরে উঠতে লাগিল। সোপান মধ্যপথে মোড় ঘুরিয়া গিয়াছে, মোড়ের কোণে অন্য একজন প্রহরিণী দাঁড়াইয়া আছে। তাহাকে অতিক্রম করিয়া অর্জুনবর্মা দ্বিতলে উঠিল। এখানে আরো দুইজন প্রহরিণী। তাহারা জানিত, অর্জুনবর্মা নামক এক ব্যক্তিকে রাজা আহ্বান করিয়াছেন; তাহাদের মধ্যে একজন অর্জুনকে রাজ-সমীপে উপনীত করিল।
রাজকক্ষটি আকারে যেমন বৃহৎ, উচ্চ দিকে তেমনি গোলাকৃতি ছাদযুক্ত; মুসলমান স্থাপত্যের প্রভাবে ভবনশীর্ষে গম্বুজ রচনার রীতি প্রচলিত হইয়াছিল। দেয়ালগুলি পুরু রেশমের কানাৎ দিয়া আবৃত; তাহার ফলে কক্ষটি দ্বিপ্রহরেও ঈষৎ ছায়াচ্ছন্ন ও নিরুত্তাপ হইয়া আছে। কক্ষের মধ্যস্থলে মণিমুক্তাজড়িত মর্মর-পালঙ্কে মহারাজ দেবরায় অর্ধশয়ান রহিয়াছেন। তাঁহার মাথার দিকে মসৃণ শিলাকুট্টিমের উপর বসিয়া মন্ত্রী লক্ষ্মণ মল্লপ কোনো দুরূহ চিন্তায় মগ্ন আছেন। পায়ের কাছে মেঝেয় বসিয়া পিঙ্গলা পান সাজিতেছে এবং মৃদুকণ্ঠে রাজাকে নবাগতা কলিঙ্গ-কুমারীদের কথা শুনাইতেছে। …রাজকুমারীরা স্নানাহার সম্পন্ন করিয়া বিশ্রাম করিতেছেন… কন্যা দু’টি যেমন সুন্দরী তেমনি শীলবতী… প্রথমটি একটু গম্ভীর প্রকৃতির, দ্বিতীয়টি সরলা হাস্যময়ী…
পিঙ্গলা সোনার তাম্বূলকরঙ্ক দুই হাতে রাজার সম্মুখে ধরিল। রাজা একটি পান তুলিয়া মুখে দিলেন, বলিলেন— ‘তুমি পান নাও, আর্য লক্ষ্মণকেও দাও।’
রাজার সম্মুখে তাম্বূল চর্বণ পুরুষের পক্ষে নিষিদ্ধ ছিল, তবে অনুমতি দিলে খাওয়া চলিত। স্ত্রীলোকের পক্ষে কোনো নিষেধ ছিল না, এমন কি নর্তকীরাও রাজার সম্মুখে পান খাইত।
লক্ষ্মণ মল্লপ পানের বাটা লইয়া নিজের সম্মুখে রাখিলেন, তারপর শঙ্কুলা লইয়া নিপুণ হস্তে সুপারি কাটিতে লাগিলেন। পিঙ্গলা বাটা হইতে একটি পান লইয়া মুখে পুরিল।
এই সময় অর্জুনবর্মা দ্বারের নিকট আসিয়া দাঁড়াইল এবং শিক্ষানুযায়ী যুগ্মবাহু তুলিয়া রাজাকে বন্দনা করিল। রাজা তাহাকে কক্ষের মধ্যে আহ্বান করিলেন, সে আসিয়া পালঙ্কের সমীপে ভূমির উপর পা মুড়িয়া বসিল। তাহার মেরুদণ্ড ঋজু হইয়া রহিল, দেহভঙ্গিতে দীনতা নাই, আবার ঔদ্ধত্যও নাই।
রাজা পিঙ্গলাকে ইঙ্গিত করিলেন, সে পাশের একটি কানাৎ-ঢাকা দ্বার দিয়া বাহিরে চলিয়া গেল। কক্ষে রহিলেন রাজা, লক্ষ্মণ মল্লপ এবং অর্জুনবর্মা।
লক্ষ্মণ মল্লপ শঙ্কুলায় কুচকুচ শব্দ করিয়া সুপারি কাটিতেছেন, যেন অন্য কিছুতেই তাঁহার মন নাই। রাজা নিবিষ্ট চক্ষে অর্জুনকে দেখিলেন, তারপর শান্ত কণ্ঠে বলিলেন— ‘তোমার নাম অর্জুনবর্মা?
অর্জুন ইতিপূর্বে দূর হইতে মহারাজ দেবরায়কে একবার দেখিয়াছিল, এখন মুখোমুখি বসিয়া সে তাঁহার পরিপূর্ণ অনুভব উপলব্ধি করিল। রাজা দেখিতে শান্তশিষ্ট, কিন্তু তাঁহার একটি বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্ব আছে যাহার সম্মুখীন হইলে অভিভূত হইতে হয়। অর্জুন যুক্তকরে বলিল— ‘আজ্ঞা, মহারাজ।’
রাজা বলিলেন— ‘তুমি ক্ষত্রিয়। রাজকন্যাদের নৌকায় যোদ্ধা রূপে এসেছ?’
অর্জুন বলিল— ‘আমি রাজকন্যাদের সঙ্গে কলিঙ্গ থেকে আসিনি মহারাজ।’
রাজা ঈষৎ বিস্ময়ে বলিলেন— ‘সে কি রকম?’
অর্জুন তখন গুলবর্গা ত্যাগের বিবরণ বলিল। রাজা শুনিলেন; লক্ষ্মণ মল্লপ শঙ্কুলা থামাইয়া অর্জুনের মুখের উপর সন্ধানী চক্ষু স্থাপন করিলেন। বিবৃতি শেষ হইলে রাজা বলিলেন— ‘চমকপ্রদ কাহিনী! তোমার পিতার নাম কি?’
অর্জুনবর্মা বলিল— ‘আমার পিতার নাম রামবর্মা।’
রাজা একবার মন্ত্রীর দিকে অলসভাবে চক্ষু ফিরাইলেন, লক্ষ্মণ মল্লপের শঙ্কুলা আবার সচল হইল।
রাজা বলিলেন— ‘ভাল। — সংবাদ পেয়েছি কাল ঝড়ের সময় তুমি রাজকন্যাকে নদী থেকে উদ্ধার করেছিলে। তুমি উত্তম সন্তরক, কিভাবে রাজকুমারীকে উদ্ধার করলে আমাকে শোনাও।’
রাজার এই জিজ্ঞাসার মধ্যে অর্জুন কোনো কুট উদ্দেশ্য দেখিতে পাইল না, সে সরলভাবে রাজকন্যা উদ্ধারের বৃত্তান্ত বলিল। তাহার মনে পাপ ছিল না, তাই কোনো কথা গোপন করিল না; নিজের কৃতিত্ব যথাসম্ভব লঘু করিয়া বলিল। রাজা ও মন্ত্রী তাহার মুখের উপর নিশ্চল চক্ষু স্থাপন করিয়া শুনিলেন।
বৃত্তান্ত শেষ হইলে রাজা কিছুক্ষণ প্রীতমুখে নিজ কর্ণের মণিকুণ্ডল লইয়া নাড়াচাড়া করিলেন, তারপর বলিলেন— ‘তোমার কাহিনী শুনে পরিতুষ্ট হয়েছি। তোমার সৎসাহস আছে, বিপদের সম্মুখীন হয়ে তোমার বুদ্ধি বিক্ষিপ্ত হয় না। তুমি বিজয়নগরে বাস করতে চাও, ভাল কথা। কোন্ কাজ করতে চাও?’
অর্জুন জোড়হস্তে বলিল— ‘মহারাজ, আমি ক্ষত্রিয়, আমাকে আপনার বিপুল বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করে নিন।’
রাজা বলিলেন— ‘সৈন্যদলে যোগ দিতে চাও? ভাল ভাল। — কিন্তু বর্তমানে তুমি কলিঙ্গ-সমাগত অতিথিদের অন্যতম। আপাতত বিজয়নগরের রাজ-আতিথ্যে থেকে আহার-বিহার কর। তারপর তোমার ব্যবস্থা হবে। এই স্বর্ণমুদ্রা নাও। তুমি রাজকুমারীর প্রাণরক্ষা করেছ, তোমার প্রতি আমি প্রসন্ন হয়েছি।’
রাজার পালঙ্কের উপর উপাধানের পাশে এক মুষ্টি স্বর্ণমুদ্রা রাখা ছিল; ছোট বড় অনেকগুলি স্বর্ণমুদ্রা। রাজা একটি বড় মুদ্রা লইয়া অর্জুনকে দিলেন, অর্জুন কপোতহস্তে গ্রহণ করিল।
রাজা বলিলেন— ‘আর্য লক্ষ্মণ, অর্জুনবর্মাকে পান দিন।’
লক্ষ্মণ মল্লপ বাটা হইতে অর্জুনকে পান দিলেন। অর্জুন জানে না যে পান দেওয়ার অর্থ বিদায় দেওয়া, সে পান মুখে দিয়া ইতস্তত করিতে লাগিল; স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া রাজসকাশ হইতে চলিয়া যাওয়া উচিত হইবে কিনা ভাবিতে লাগিল। লক্ষ্মণ মল্লপ তাহা বুঝিয়া হাতে তালি বাজাইলেন। প্রহরিণী দ্বারের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল।
মন্ত্রী বলিলেন— ‘অর্জুনবর্মাকে পথ দেখাও।’
অর্জুন তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইল, পূর্বের ন্যায় উদ্বাহু প্রণাম করিয়া প্রহরিণীর সঙ্গে বাহিরে চলিয়া গেল।
রাজা ও মন্ত্রী কিছুক্ষণ আত্মস্থ হইয়া বসিয়া রহিলেন; কেবল মন্ত্রীর হাতের যন্ত্রিকা কুচকুচ শব্দ করিয়া চলিল।
অবশেষে রাজা লক্ষ্মণ মল্লপের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিপাত করিলেন। লক্ষ্মণ মল্লপ মাথা নাড়িয়া বলিলেন— ‘কুমার কম্পন তিলকে তাল করেছেন। অর্জুনবর্মার মন নিষ্পাপ, সুতরাং রাজকন্যাও নিম্পাপ।’
রাজা কহিলেন— ‘আপনি যথার্থ বলেছেন, আমারও তাই মনে হয়। কম্পন ছেলেমানুষ, রজ্জুতে সর্পভ্রম করেছে। কিন্তু তবু— বিবাহোম্মুখী কন্যাকে পরপুরুষ স্পর্শ করেছে, এ বিষয়ে শাস্ত্রের বিধান যদি কিছু থাকে—’
মন্ত্রী বলিলেন— ‘উত্তম কথা। গুরুদেবের উপদেশ নেওয়া যাক।’
অতএব রাজগুরু আর্য কূর্মদেবকে রাজার প্রণাম পাঠানো হইল। কূর্মদেব একটি তৃণাসন হস্তে উপস্থিত হইলেন। শীর্ণকায় পালিতশীর্ষ ব্রাহ্মণ, রাজা তাঁহার সম্মুখে দণ্ডবৎ হইলেন। কূর্মদেব স্বস্তিবাচন উচ্চারণ করিয়া শিলাকুট্টিমের উপর তৃণাসন পাতিয়া উপবিষ্ট হইলেন। রাজাও ভূমিতে বসিলেন।
সমস্যার কথা শুনিয়া কূর্মদেব কিয়ৎকাল চক্ষু মুদিয়া মৌনভাবে রহিলেন। শাস্ত্রজ্ঞ প্রবীণ ব্যক্তি হইলেও তিনি শাস্ত্রকে শস্ত্রের ন্যায় ব্যবহার করেন না, লঘু পাপে গুরুদণ্ডের ব্যবস্থা করেন না। তিনি চক্ষু খুলিয়া বলিলেন— ‘দোষ হয়েছে, কিন্তু গুরুতর নয়। বিবাহোন্মুখী কন্যাকে সাধু উদ্দেশ্যে পরপুরুষ স্পর্শ করলে তাদৃশ দোষ হয় না। তবে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। বিবাহ তিন ঋতুকাল বন্ধ থাকবে। এই তিন মাস কন্যা প্রত্যহ প্রাতে অবগাহন স্নান করে পম্পাপতির মন্দিরে স্বহস্তে পূজা দেবেন। তাহলেই তাঁর পাপ-মুক্তি হবে। তখন বিবাহ হতে পারবে। শ্রাবণ মাসে আমি বিবাহের তিথি নক্ষত্র দেখে রাখব।’
গুরুর ব্যবস্থা রাজার মনঃপূত হইল। বিবাহ তিন মাস পরে হইলে ক্ষতি কি? বরং এই অবকাশে ভাবী বধূর সহিত মানসিক পরিচয়ের সুযোগ হইবে। ইতিমধ্যে কন্যার পিতা গজপতি ভানুদেবকে সংবাদটা জানাইয়া দিলেই চলিবে।
রাজা বলিলেন— ‘যথা আজ্ঞা গুরুদেব।’
দুই দণ্ড পরে গুরুদেব বিদায় লইলেন। তখন রাজা ও মন্ত্রী নিভৃতে মন্ত্রণা করিতে বসিলেন।
চার
অর্জুনবর্মা সভাগৃহ হইতে বাহির হইয়া অতিথি-ভবনে ফিরিয়া আসিল। রাজার প্রসন্নতা লাভ করিয়া তাহার হৃদয় আনন্দে পূর্ণ; সে নিজ কক্ষে ফিরিয়া আবার শয্যায় শয়ন করিল। রাজদত্ত পানটি মুখে মিলাইয়া গিয়াছে, কেবল একটি অপূর্ব স্বাদ মুখে রাখিয়া গিয়াছে। মন নিরুদ্বেগ, রাজা তাহাকে সৈন্যদলে গ্রহণ করিবেন; বিদেশে তাহার গ্রাসাচ্ছাদনের চিন্তা থাকিবে না। শুইয়া শুইয়া অর্জুনের দেহমন মধুর জড়িমায় আচ্ছন্ন হইয়া পড়িল।
দুই দণ্ড পরে তন্দ্রা-জড়িমা কাটিলে সে শয্যায় উঠিয়া বসিয়া আলস্য ত্যাগ করিল। দেখিল, পরিচারক কখন তাহার শয্যাপাশে এক প্রস্থ নূতন বস্ত্র ও উত্তরীয় রাখিয়া গিয়াছে। এদিকে দিনের তাপও অনেকটা কমিয়াছে, অপরাহ্ণ সমাগত। অর্জুন নববস্ত্র পরিধান করিয়া, রাজার উপহার স্বর্ণমুদ্রাটি উত্তরীয়প্রান্তে বাঁধিয়া উত্তরীয় স্কন্ধে নগর পরিভ্রমণে বাহির হইল।
রাজ-পুরভূমির উত্তর অংশে রাজকীয় টঙ্কশালার পাশ দিয়া পান-সুপারি রাস্তা আরম্ভ হইয়া সিধা পূর্বদিকে গিয়াছে; এই পথ প্রস্থে চল্লিশ হস্ত, দৈর্ঘ্যে দ্বাদশ শত হস্ত। ইহাই বিজয়নগরের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজপথ। পান-সুপারি রাস্তা নাম হইলেও পান-সুপারির দোকান এখানে অল্পই আছে। এই রাস্তার দুই পাশ জুড়িয়া আছে সোনা-রূপা হীরা-জহরতের দোকান। প্রধান রাজপুরুষদের অট্টালিকা, নগরবিলাসিনীদের রঙ্গ-ভবন। ছোটখাটোর মধ্যে আছে মিঠাই অঙ্গদি, ফুলের দোকান, শরবতের দোকান।
সায়ংকালে পান-সুপারি রাস্তায় উচ্চকোটির নাগরিক নাগরিকার সমাগম হইয়াছে। যানবাহন বেশি নাই, পদচারীই অধিক। সকলের পরিধানে বিচিত্র সুন্দর বস্ত্র ও অলঙ্কার। তাহাদের ত্বরা নাই, সকলে মন্থর চরণে চলিয়াছে। কেহ পানের দোকানে পান কিনিয়া খাইতেছে, কেহ পানশালায় শীতল শরবত পান করিতেছে; মেয়েরা ফুল কিনিয়া কণ্ঠে কবরীতে পরিতেছে। বিলাসিনীদের গৃহের সম্মুখে যুবকদের যাতায়াত একটু বেশি। বিলাসিনীরা গৃহসম্মুখে উচ্চ চত্বরের উপর কাষ্ঠাসনে বসিয়াছে, তাহাদের দেহের উচ্ছলিত যৌবন সূক্ষ্ম অচ্ছাভ মল্লবস্ত্রে ঈষদাবৃত। কাহারো কবরীতে দাসী চাঁপা ফুলের মালা জড়াইয়া দিতেছে; কেহ তাম্বূলরাগে অধর রঞ্জিত করিয়া পরিচারিকাদের সঙ্গে রঙ্গ-রসিকতা করিতেছে। তাহাদের বিদ্যুৎবিলাসের ন্যায় হাস্যকটাক্ষ মুগ্ধ পথিকজনের চক্ষু ধাঁধিয়া দিতেছে।
অর্জুনবর্মা অলসপদে চলিয়াছিল। চলিতে চলিতে সে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য করিল। বিজয়নগরের অধিবাসীদের মধ্যে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ মানুষ বড় কেহ নাই, সকলেরই গায়ের রঙ অরুণাভ গৌর হইতে কচি কলাপাতার মত কোমল হরিৎ পাণ্ডু, মেয়েরা সুগঠনা ও লাবণ্যবতী। এদেশের স্ত্রীপুরুষ কেহই পাদুকা পরিধান করে না; এমন কি রাজা যতক্ষণ রাজপুরীর মধ্যে থাকেন তিনিও পাদুকা ধারণ করেন না। গুলবর্গায় মুসলমানেরা চামড়ার শুঁড়-তোলা নাগরা পরে; দেখাদেখি উচ্চশ্রেণীর হিন্দুরাও নাগরা পরে। এদেশে কেবল তুরাণী তীরন্দাজেরা স্থূল বৃষচর্মের ফৌজী জুতা পরে। এখানে মাথায় টুপি বা পাগড়ি পরার রেওয়াজ নাই, তুরাণীরা ছাড়া সকলেই নগ্নশির। এখানে নারীদের পর্দা বা অবগুণ্ঠন নাই; তাহারা সহজ স্বচ্ছন্দতার সহিত পথে বাহির হয়, তাহাদের চোখের দৃষ্টি নম্র অথচ নিঃসঙ্কোচ; তাহারা পরপুরুষ দেখিয়া ভয় পায় না। অর্জুনের বড় ভাল লাগিল।
ফুলের মিশ্র সুগন্ধে আকৃষ্ট হইয়া অর্জুন এক ফুলের দোকানে উপস্থিত হইল। মালিনী একটি গৃহের সম্মুখভাগে প্রশস্ত বাতায়নের ন্যায় স্থানে বসিয়া ফুল বিক্রয় করিতেছে। গ্রীষ্মকালে রকমারি ফুলের অভাব। বিজয়নগর গোলাপ ফুলের জন্য বিখ্যাত; সেই গোলাপ ফুলের মরশুম শেষ হইয়াছে; তবু দুই-চারিটা রক্তবর্ণ গোলাপ দোকানে আছে। স্তূপীকৃত সোনার বরণ চাঁপা ফুল আছে; আর আছে জাতী যূথী কাঞ্চন অশোক। বাতায়নের তোরণ হইতে সারি সারি নবমল্লিকার মালা ঝুলিতেছে। মালিনী বসিয়া মাল্যরচনা করিতেছিল, অর্জুন বাতায়নের সামনে গিয়া দাঁড়াইতেই মালিনী চোখ তুলিয়া চাহিল। অর্জুন বলিল— ‘মালা চাই।’
মালিনী একটু প্রগল্ভা, মুচ্কি হাসিয়া বলিল— ‘কার জন্যে মালা চাই? নিজের জন্যে, না নাগরীর জন্যে।’
অর্জুনও হাসিল। বলিল— ‘আমি বিদেশী, নাগরী কোথায় পাব! নিজের জন্যে মালা।’
মালিনী ঘাড় কাৎ করিয়া অর্জুনকে দেখিল— ‘বিজয়নগরে নাগরীর অভাব নেই। তোমার কোমরে টঙ্কা আছে তো?’
উত্তরীয়ের খুঁট হইতে সোনার টঙ্কা খুলিয়া অর্জুন দেখাইল— ‘এই আছে।’
দেখিয়া মালিনীর চক্ষু একটু বিস্ফারিত হইল, সে বলিল— ‘তবে আর তোমার ভাবনা কি, ও দিয়ে সব কিনতে পার। কি চাই বল।’
অর্জুন বলিল— ‘আপাতত একটা মালা হলেই চলবে।’
মালিনী তখন দোদুল্যমান মাল্যশ্রেণী হইতে একটি মালা লইয়া অর্জুনকে দেখাইল। যূথী ও অশোক ফুলে গ্রথিত মালা; মালিনী বলিল— ‘এটা হলে চলবে? এর মূল্য তিন দ্রম্ম। এর চেয়ে ভাল মালা আমার দোকানে নেই।’
অর্জুন বলিল— ‘ওতেই হবে।’
মালিনী দীর্ঘ মালাটির দুই প্রান্ত হাতে ধরিয়া বলিল— ‘এস, গলায় পরিয়ে দিই।’
অর্জুন মালিনীর কাছে গিয়া গলা বাড়াইয়া দাঁড়াইল, মালিনী মালা গোল করিয়া তাহার গ্রীবার পিছনে বাঁধিয়া দিল। তারপর পিছনে সরিয়া গিয়া অর্জূনকে পরিদর্শনপূর্বক বলিল— ‘বেশ দেখাচ্ছে।’
অপরিচিত যুবতীর সহিত এরূপ লঘু হাস্যালাপ অর্জুনের জীবনে এই প্রথম। সে হাসিমুখে মালিনীকে স্বর্ণমুদ্রা দিল। মালিনী তাহার আসনের তলদেশ হইতে এক মুঠি রূপা ও তামার মুদ্রা লইয়া হিসাব করিয়া অর্জুনকে ফেরত দিল, বলিল— ‘গুনে নাও।’
অর্জুন মাথা নাড়িল। এ দেশের মুদ্রামান সম্বন্ধে তাহার কোনোই ধারণা নাই। সে ক্ষুদ্র মুদ্রাগুলি চাদরের খুঁটে বাঁধিল। মালিনী মিষ্ট হাসিয়া বলিল— ‘আবার এস।’
অর্জুন পিছু ফিরিতেই একটি লোকের সঙ্গে তাহার মুখোমুখি হইয়া গেল। শীর্ণ আকৃতি, বৈশিষ্ট্যহীন মুখ; বোধহয় ফুল কিনিতে আসিয়াছে। অর্জুন তাহাকে পাশ কাটাইয়া রাস্তায় উপনীত হইল এবং পূর্বমুখে চলিতে লাগিল।
কিছুদূর অগ্রসর হইয়া অর্জুন দেখিল, রাস্তার ধারে একদল লোক জমা হইয়াছে, তাহাদের মাঝখানে কিরাতবেশী একজন লোক। কিরাতের মাথায় কড়ির টুপি, বাঁ হাতের মণিবন্ধে একটি উগ্রমূর্তি বাজপাখি বসিয়া আছে, ডান হাতে খাঁচার মধ্যে একটি ধূম্রবর্ণ পারাবত। লোকটি সুর করিয়া বলিতেছে— ‘আমার বাজপাখি আমার পায়রাকে খুব ভালবাসে, পায়রা বাজপাখির বৌ। কিন্তু বৌ-এর স্বভাব ভাল নয়, সে মাঝে মাঝে ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। বাজপাখি তখন বৌকে খুঁজতে বেরোয়। দেখবে? দ্যাখো দ্যাখো, মজার খেলা দ্যাখো।’
ইতিমধ্যে আরো দু’চারজন দর্শক আসিয়া জুটিয়াছিল। কিরাত খাঁচা খুলিয়া পারাবতকে উড়াইয়া দিল, পারাবত ফট্ফট্ শব্দে আকাশে উঠিয়া পশ্চিমদিকে উড়িয়া যাইতে লাগিল। তখন কিরাত বাজপাখির পায়ের শিকল খুলিয়া তাহাকেও ছাড়িয়া দিল। বাজপাখি আতসবাজির ন্যায় সিধা শূন্যে উঠিয়া গেল, রক্তচক্ষু ঘুরাইয়া দূরে পলায়মান পারাবতকে দেখিল, তারপর ঝটিকার বেগে তাহার অনুসরণ করিল।
দর্শকেরা ঘাড় তুলিয়া এই আকাশ-যুদ্ধ দেখিতে লাগিল। পারাবত পলাইতেছে, কিন্তু বাজপাখির গতিবেগ তাহার চতুর্গুণ; অচিরাৎ বাজপাখি পারাবতের নিকট উপস্থিত হইল। পারাবত আঁকিয়া বাঁকিয়া নানাভাবে উড়িয়া পালাইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু পারিল না। বাজপাখি তাহার উপর দিয়া উড়িতে উড়িতে দুই পা বাড়াইয়া তাহাকে নখে চাপিয়া ধরিল, তারপর অপেক্ষাকৃত মন্থর গতিতে নির্জীব পারাবতকে কিরাতের কাছে ফিরাইয়া আনিল। কিরাত উত্তেজিত কণ্ঠে বলিতে লাগিল— ‘দেখলে? দেখলে? আমার বাজপাখি নষ্ট-দুষ্ট বৌকে কত ভালবাসে! দ্যাখো, বৌ-এর গায়ে নখের আঁচড় পর্যন্ত লাগেনি।’
সকলে হাসিয়া উঠিল। অর্জুন খেলা দেখিয়া প্রীত হইয়াছিল, সে কিরাতের সামনে একটি তাম্রমুদ্রা ফেলিয়া দিয়া পিছন ফিরিল।
এই সময় সেই শীর্ণ লোকটার সঙ্গে তাহার আবার মুখোমুখি হইয়া গেল। লোকটা অলক্ষিতে তাহার পশ্চাতে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। অর্জুন মনে মনে একটু বিস্মিত হইল। ফুলের দোকানে তাহার সহিত দেখা হইয়াছিল, আবার এখানে দেখা। লোকটা কি তাহার মতই নিরুদ্দেশ ঘুরিয়া বেড়াইতেছে।
অর্জুন আবার পূর্বদিকে চলিল। তাহার ইচ্ছা কিল্লাঘাটে গিয়া দেখিয়া আসে বলরাম কর্মকার ভাঙ্গা বহিত্র লইয়া কী করিতেছে। কিন্তু এদিকে দিন শেষ হইয়া আসিতেছে, কিল্লাঘাটে পৌঁছিতেই রাত্রি হইয়া যাইবে। তখন আর ফিরিবার উপায় থাকিবে না। আহা, যদি লাঠি দু’টি থাকিত। যা হোক, কাল প্রভাতেই সে বলরামকে দেখিতে যাইবে।
ক্রমে অর্জুন পান-সুপারি রাস্তার পূর্ব সীমানায় আসিয়া পৌঁছিল। এখান হইতে সাধারণ লোকালয়ের আরম্ভ; গৃহগুলি উত্তম বটে, কিন্তু পান-সুপারি রাস্তার মত নয়, পথও অপেক্ষাকৃত অপ্রসর। দক্ষিণদিক হইতে অন্য একটি পথ আসিয়া এইখানে তেমাথা রচনা করিয়াছে। তারপর কিল্লাঘাটের দিকে চলিয়া গিয়াছে।
অর্জুন এই পথে কিছুদূর অগ্রসর হইল। কিন্তু সন্ধ্যা ঘনীভূত হইতেছে, সে আর বেশি দূর না গিয়া সেখান হইতেই ফিরিল। অন্ধকার হইবার পূর্বেই অতিথি-ভবনে ফিরিতে হইবে।
এইখানে তৃতীয় বার সেই শীর্ণ লোকটির সঙ্গে তাহার দেখা হইল। লোকটি অর্জুনের পশ্চাতে কিয়দ্দূরে আসিতেছিল, অর্জুন ফিরিতেই সেও ফিরিয়া আগে আগে চলিতে আরম্ভ করিল। অর্জুন আশ্চর্য হইয়া ভাবিল, কী ব্যাপার! এই লোকটিকেই বার বার দেখিতেছি কেন! তবে কি লোকটি আমারই পিছনে লাগিয়াছে? কিন্তু কেন?
তেমাথার কাছাকাছি ফিরিয়া আসিয়া অর্জুন দেখিল, ইতিমধ্যে সেখানে প্রকাণ্ড একটা হাতিকে ঘিরিয়া ভিড় জমিয়াছে; হাতির কাঁধে মাহুত বসিয়া আছে। লোকটি ভিড়ের মধ্যে মিশিয়া গেল। অর্জুনও জনতার কিনারায় উপস্থিত হইয়াছে এমন সময় ভিতর হইতে চড়চড় শব্দে কাড়া বাজিয়া উঠিল। তারপর পুরুষ কণ্ঠস্বর শোনা গেল— ‘বিজয়নগরে শত্রুর গুপ্তচর ধরা পড়েছে— রাজাদেশে তার প্রাণদণ্ড হবে— বিজয়নগরে শত্রুর গুপ্তচরের কী দুর্দশা হয় তোমরা প্রত্যক্ষ কর।’
অর্জুন গলা বাড়াইয়া দেখিল। চক্রব্যূহের মাঝখানে হাত-পা বাঁধা একটা মানুষ চিৎ হইয়া পড়িয়া গোঁ গোঁ শব্দ করিতেছে। বাদ্যকর ঘোষক হাতির মাহুতকে ইশারা করিল, মাহুত হাতি চালাইল। হাতি আসিয়া ভূপতিত লোকটার বুকে পা চাপাইয়া দিল।
অর্জুন আর সেখানে দাঁড়াইল না, দ্রুতপদে স্থান ত্যাগ করিল। এরূপ দৃশ্য গুলবর্গায় সে অনেক দেখিয়াছে। বিজয়নগর ও বহমানী রাজ্যের মধ্যে বর্তমানে শান্তি চলিতেছে বটে, কিন্তু উভয় পক্ষই শত্রু সম্বন্ধে সংবাদ সংগ্রহে তৎপর। গুপ্তচর যখন ধরা পড়ে তখন এই বিকট শাস্তিই তাহার প্রাপ্য।
রাজপুরীর কাছাকাছি আসিয়া অর্জুন একটু পিপাসা অনুভব করিল। পাশেই একটি পানশালা। সে সত্রের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া পালিকাকে বলিল— ‘শীতল তাক্ দাও, ক্ষার তক্র।’
সত্রপালিকাটি যুবতী। এখানে পানের দোকানে, ফুলের দোকানে, পানশালা ইত্যাদি ছোট ছোট দোকানে যুবতীরাই বেসাতি করে। এই যুবতীটি অর্জুনকে একটু ভাল করিয়া দেখিল, তারপর মৃৎপাত্রে লবণাক্ত কপিত্থ-সুরভিত তক্র পান করিতে দিল।
তক্র পান করিয়া অর্জুনের শরীর ও মন দুই-ই স্নিগ্ধ হইল। সে নিঃশেষিত মৃৎপাত্র ফেলিয়া দিয়া যুবতীকে জিজ্ঞাসা করিল— ‘মূল্য কত?’
যুবতী অর্জুনকে লক্ষ্য করিতেছিল। বোধহয় তাহার বেশবাসে কিছু বিশেষত্ব দেখিয়া থাকিবে। সে বলিল— ‘তুমি বিদেশী, আজ কি তুমি কলিঙ্গ-রাজকন্যাদের সঙ্গে এসেছ?’
অর্জুন বলিল— ‘হ্যাঁ।’
যুবতী মাথা নাড়িয়া বলিল— ‘তাহলে দাম নেব না। তুমি আজ আমাদের অতিথি।’
অর্জুন কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিল, তারপর স্মিতমুখে ‘ধন্য’ বলিয়া বাহির হইল।
আকাশে রাত্রির পক্ষচ্ছায়া পড়িয়াছে। পথের দুই পাশে ভবনগুলিতে সন্ধ্যাদীপ জ্বলিতে আরম্ভ করিয়াছে। চলিতে চলিতে অর্জুন চক্ষু তুলিয়া দেখিল, দূরে পশ্চিমদিকে হেমকূট পর্বতের মাথায় অগ্নিস্তম্ভ জ্বলিয়া উঠিল।
আরো কিছুদূর গিয়া সে সহসা দাঁড়াইয়া পড়িল; তাহার দেহ রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। এমন অনুভূতি সে পূর্বে কখনো পায় নাই। তাহার মনে হইল, এতদিনে সে নিজের দেশ খুঁজিয়া পাইয়াছে। এই বিজয়নগরই তাহার স্বদেশ, তাহার স্বর্গাদপি গরিয়সী মাতৃভূমি। অগ্নিশীর্ষ হেমকূটের পানে চাহিয়া তাহার চক্ষু বাষ্পাকুল হইয়া উঠিল।
অর্জুন জানিত না যে, মাতৃভূমি বলিয়া কোনো বিশেষ ভূখণ্ড নাই। মানুষের সহজাত সংস্কৃতির কেন্দ্র যেখানে, মাতৃভূমিও সেইখানে।
পাঁচ
রাজপুরীতে বেলাশেষের প্রহর বাজিলে মহারাজ দেবরায় আপরাহ্নিক সভা ভঙ্গ করিয়া গাত্রোত্থান করিলেন। সভায় পাত্র অমাত্য সভাসদ্ ছাড়াও ইরাণ দেশের রাজদূত আবদর রজ্জাক ছিলেন। আরো কয়েকটি রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু কাজের কথা কিছু হইতেছিল না। রাজসভায় কেবল রাজনীতির আলোচনাই হয় না, হাস্য-পরিহাস গল্প-গুজবও হয়। সকলে রাজাকে অভিবাদন করিয়া বিদায় হইলেন।
দ্বিতলের বিরাম মন্দিরে গিয়া রাজা প্রথমে কেতকী-সুরভিত জলে স্নান করিলেন। তারপর আহারে বসিলেন। কিঙ্করীরা কক্ষে অসংখ্য ঘৃত-দীপ ও অগুরুবর্তি জ্বালিয়া দিল। দুই-হস্ত পরিমাণ চতুষ্কোণ একটি কাষ্ঠ-পীঠিকা তিনজন কিঙ্করী ধরাধরি করিয়া মহারাজের পালঙ্কের পাশে রাখিল। অনুচ্চ পীঠিকার উপর বৃহৎ সুবর্ণ থালি, থালির উপর অগণিত সোনার পাত্রে বিবিধ প্রকার অন্নব্যঞ্জন। মহারাজ আচমন করিয়া আহারে মন দিলেন। পিঙ্গলা ময়ূরপুচ্ছের পাখা দিয়া বাতাস করিতে লাগিল। কঞ্চুকী হেমবেত্র হস্তে দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া পরিদর্শন করিতে লাগিল।
আহার করিতে করিতে দেবরায় পিঙ্গলার দিকে চক্ষু তুলিলেন— ‘কলিঙ্গ-কুমারীদের খাওয়া হয়েছে?’
পিঙ্গলা বীজন করিতে করিতে বলিল— ‘না, আর্য। তারা অন্য রানীদের মত মহারাজের আহার শেষ হলে আহারে বসবেন।’
মহারাজ আর কিছু বলিলেন না।
আহারান্তে একটি দাসী জলের ভৃঙ্গার হইতে মহারাজের হাতে জল ঢালিয়া দিল, মহারাজ হস্তমুখ প্রক্ষালন করিলেন।
অতঃপর কঞ্চুকী ও দাসী কিঙ্করীরা রাজাকে প্রণাম করিয়া প্রস্থান করিল। কেবল পিঙ্গলা রহিল।
পিঙ্গলার হাত হইতে পান লইয়া দেবরায় শয্যায় অর্ধশয়ান হইলেন, বলিলেন— ‘পিঙ্গলে, তুমি দেবীদের সংবাদ পাঠিয়ে দাও যে, আমার নৈশাহার শেষ হয়েছে—’
‘আজ্ঞা মহারাজ।’
‘আর দেবী পদ্মালয়াকে জানিয়ে দিও যে, আজ রাত্রে আমি তাঁর অতিথি হব।’
পিঙ্গলা অস্ফুট কণ্ঠে স্বীকৃতি জানাইল, তারপর মহারাজকে পদস্পর্শ প্রণাম করিয়া রাত্রির মত বিদায় লইল।
রাজা কবে কোন্ রানীর মহলে রাত্রিবাস করিবেন তাহা অতিশয় গোপনীয় কথা, পূর্বাহ্ণে কেহ জানিতে পারে না। শেষ মুহূর্তে রাজা অন্তরঙ্গকে জানাইয়া দিতেন। রাজাদের জীবন সর্বদাই বিপদসঙ্কল, বিশেষত রাত্রিকালে গুপ্তঘাতকের আশঙ্কা অধিক, তাই রাজা কোথায় রাত্রি যাপন করিবেন তাহা যথাসম্ভব গোপন রাখিতে হয়।
রাজার মহল হইতে বাহির হইয়া পিঙ্গলা পাকশালা অতিক্রমপূর্বক কলিঙ্গ-কুমারীদের মহলে উপস্থিত হইল। এই মহলে গম্বুজশীর্ষ বৃহৎ একটি কক্ষ ঘিরিয়া অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র কয়েকটি প্রকোষ্ঠ। একটি প্রকোষ্ঠে রাজকন্যাদের নৈশাহারের আয়োজন হইয়াছে। কয়েকজন দাসী কাষ্ঠ-পীঠিকায় অন্নব্যঞ্জন সাজাইয়া অপেক্ষা করিতেছে। রাজকুমারীরা বড় ঘরে আছেন। পিঙ্গলা সেখানে গিয়া যুক্তকরে বলিল— ‘মহারাজের নৈশাহার সম্পন্ন হয়েছে, এবার আপনারা বসুন।’
দুই রাজকন্যা ভোজনকক্ষে গমন করিলেন। কাষ্ঠ-পীঠিকার দুই পাশে রেশমের আসন পাতা। রাজকন্যারা তাহাতে বসিলেন। চারজন পরিচারিকা তাঁহাদের পরিচর্যা করিতে লাগিল। পিঙ্গলা কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া দেখিল, তারপর বলিল— ‘অনুমতি করুন, আমি অন্য রানীদের সংবাদ দিতে যাই। সংবাদ না পাওয়া পর্যন্ত তাঁরা আহারে বসবেন না।’
বিদ্যুন্মালা উদাসমুখে নীরব রহিলেন, মণিকঙ্কণা মৃদু হাসিয়া বলিল— ‘এস।’
‘এই দাসীরা আপনাদের সেবা করবে; কাল প্রাতে আমি আবার আসব।’ পিঙ্গলা যুক্তকরে প্রণাম করিয়া চলিয়া গেল।
দুই ভগিনী নীরবে আহার করিতে লাগিলেন। বিদ্যুন্মালা নামমাত্র আহার করিলেন, মণিকঙ্কণা প্রত্যেকটি ব্যঞ্জনের স্বাদ লইয়া খাইল। দুইজনের মনের গতি ভিন্নমুখী। বিদ্যুন্মালার মনে সুখ নাই; মহারাজ দেবরায়ের সুন্দর কান্তি এবং সদয় ব্যবহার দেখিয়া তাঁহার মন আরো বিকল হইয়া গিয়াছে। ভাগ্যবিধাতা যেন এক হাতে সব দিয়া অন্য হাতে সব হরণ করিয়া লইতেছেন। মণিকঙ্কণার মনে কিন্তু বসন্তের বাতাস বহিতেছে। আশঙ্কার ঝড়-বাদল অপগত হইয়া হৃদয়াকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠিয়াছে।
দাসীদের সম্মুখে কোনো কথা হইল না, আহার সমাপন করিয়া রাজকন্যারা শয়নকক্ষে গেলেন। কক্ষের দুই পাশে প্রকাণ্ড দু’টি পালঙ্কের উপর শয্যা, শয্যার উপর জাতীপুষ্প বিকীর্ণ। মৃগমদ গন্ধে কক্ষ আমোদিত। মণিকঙ্কণা দাসীদের বলিল— ‘তোমরা যাও, আর তোমাদের প্রয়োজন হবে না।’
একটি দাসী বলিল— ‘যে আজ্ঞা, রাজকুমারী। দ্বারের বাইরে প্রতিহারিণীর প্রহরায় রহিল, যদি প্রয়োজন হয়, হাততালি দেবেন।’
দাসীরা প্রস্থান করিলে মণিকঙ্কণা বলিল— ‘মালা, তুই কোন্ পালঙ্কে শুবি?’
বিদ্যুন্মালা বলিলেন— ‘দুই পালঙ্কই সমান, যেটাতে হয় শুলেই হল। আয়, দু’জনে এক পালঙ্কে শুই।’
‘সেই ভাল। নৌকোতে একলা শোয়ার অভ্যাস ছেড়ে গেছে।’
দু’জনে একসঙ্গে শয়ন করিলেন। মণিকঙ্কণা ভগিনীর পানে চাহিয়া বলিল— ‘তোর কি এখানে কিছুই ভাল লাগছে না! অমন মনমরা হয়ে আছিস কেন?’
আসল কথা মণিকঙ্কণাকেও বলিবার নয়, বিদ্যুন্মালা বলিলেন— ‘মামা আর মন্দোদরীর কথা মনে হচ্ছে। কি জানি তারা বেঁচে আছে কিনা।’
চিপিটক ও মন্দোদরীর কথা মণিকঙ্কণা ভুলিয়া গিয়াছিল। হঠাৎ স্মরণ করাইয়া দিতে সে থতমত হইয়া চুপ করিল, তারপর ক্ষীণকণ্ঠে বলিল— ‘সত্যিই কি আর ডুবে গেছে! হয়তো বেঁচে আছে, কাল খবর পাওয়া যাবে।’
চিপিটক ও মন্দোদরী বাঁচিয়া ছিলেন। কিন্তু রাজভৃত্যেরা অনেক খোঁজাখুঁজি করিয়াও তাঁহাদের পায় নাই। পাইবার কথাও নয়।
ঝড়ের প্রারম্ভে নৌকা হইতে জলে নিক্ষিপ্ত হইয়া চিপিটক মন্দোদরীর পা চাপিয়া ধরিয়াছিলেন। তারপর ঝড়ের প্রমত্ত আস্ফালনে পৃথিবী লণ্ডভণ্ড হইয়া গেল, কিন্তু চিপিটক মন্দোদরীর পা ছাড়িলেন না। তিনি বুঝিয়াছিলেন, মন্দোদরীর চরণ ছাড়া তাঁহার গতি নাই। মন্দোদরী ডুবিল না, চিপিটকের নাকে মুখে জল ঢুকিলেও তিনি ভাসিয়া রহিলেন।
তারপর যুগান্ত কাটিয়া গেল, নিবিড় অন্ধকারে তাঁহারা কোথায় চলিয়াছেন কিছুই জ্ঞান নাই। ক্রমে ঝড়ের বেগ কমিতে লাগিল, বৃষ্টি থামিল। মেঘ কাটিয়া গেল। অবশেষে নদীর তরঙ্গভঙ্গও মন্দীভূত হইল, তুঙ্গভদ্রার স্রোত আবার স্বাভাবিক ধারায় বহিতে লাগিল। কিন্তু অন্ধকার দিগন্তব্যাপী; চিপিটক মন্দোদরীর চরণ ধারণ করিয়া ভাসিয়া চলিয়াছেন; একটা হাত অবশ হইলে অন্য হাত দিয়া পা ধরিতেছেন। মন্দোদরীর সাড়াশব্দ নাই, সে কেবল ভাসিয়া যাইতেছে।
অনেকক্ষণ কাটিবার পর চিপিটকের একটু সন্দেহ হইল, তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘মন্দোদরি, বেঁচে আছিস তো?’
মন্দোদরী এক ঢোক জল খাইয়া বলিল— ‘আছি। জয় দারুব্রহ্ম।’
আর কথা হইল না, কথা কহিবার সামর্থ্য বেশি ছিল না। খড়কুটার মত তাঁহারা স্রোতের মুখে নিরুপায় ভাসিয়া চলিলেন।
কিন্তু তাহাদের এই ভাসিয়া চলার কাহিনী দীর্ঘ করিয়া লাভ নাই। রাত্রি যখন শেষ হইয়া আসিতেছে তখন মন্দোদরীর দেহ মৃত্তিকা স্পর্শ করিল। সে হাঁচোড়-পাঁচোড় করিয়া কাদা ঘাঁটিয়া শুষ্ক ডাঙ্গায় উঠিল; চিপিটক তাহার পিছে পিছে উঠিলেন। চোখে কেহ কিছু দেখিল না, অনুভবে বুঝিল নুড়ি-ছড়ানো স্থান; নদীর তীরও হইতে পারে, আবার নদীমধ্যস্থ দ্বীপও হইতে পারে।
কিন্তু এসব কথা বিবেচনা করিবার শক্তি তাহাদের ছিল না, মাটি পাইয়াছে ইহাই তাঁহাদের পক্ষে যথেষ্ট। তাহারা যেমন ছিল সেই অবস্থায় নুড়ি বিছানো মাটির উপর শুইয়া অঘোরে ঘুমাইয়া পড়িল।
প্রথমে ঘুম ভাঙ্গিল মন্দোদরীর। সে চক্ষু মেলিয়া দেখিল প্রভাত হইয়াছে, একদল স্ত্রীলোক তাহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইয়া খিলখিল হাসিতেছে। মন্দোদরীর সর্বাঙ্গে সোনার গহনা, কিন্তু বস্ত্র নামমাত্র। ভাগ্যে পরিধেয় শাড়িটি কোমরে গ্রন্থি দিয়া বাঁধা ছিল তাই সেটি অবশিষ্ট আছে, স্তনপট্ট উত্তরীয় প্রভৃতি সবই তুঙ্গভদ্রা কাড়িয়া লইয়াছে। শাড়িটিও তাহার দেহে নাই, ছিন্ন পতাকার মত মাটিতে লুটাইতেছে।
মন্দোদরী কোনো মতে লজ্জা নিবারণ করিয়া উঠিয়া বসিল, বিহ্বলনেত্রে স্ত্রীলোকদের পানে চাহিয়া বলিল— ‘তোমরা কে গা?’
রমণীরা কলকণ্ঠে উত্তর দিল, কিন্তু মন্দোদরী কিছুই বুঝিল না। ইহাদের ভাষা গ্রাম্য; মন্দোদরী এদেশের নাগরিক ভাষাই বোঝে না গ্রাম্য ভাষা বুঝিবে কি করিয়া!
এদিকে চিপিটক মাতুলের অবস্থাও অনুরূপ। তিনিও প্রায় দিগম্বর, কেবল কটিসংলগ্ন অন্তবাস কৌপীনটুকু আছে। জাগিয়া উঠিয়া দেখিলেন, লাঠি হাতে একদল ষণ্ডামার্ক পুরুষ তাঁহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইয়া আছে। তাঁহার ধারণা জন্মিল তিনি ডুবিয়া মরিয়াছেন, যমদূতেরা তাঁহাকে লইতে আসিয়াছে। তিনি ফুকারিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন— ‘আমি কিছু জানি না রে বাবা!’
যা হোক, অল্পকাল পরে তিনি নিজের ভুল বুঝিতে পারিলেন। গ্রামীণ পুরুষদের সঙ্গে কথাবার্তা হইল। মামা দক্ষিণ দেশের মানুষ, ইহাদের ভাষা কোনোক্রমে বুঝিয়া লইলেন। —
নদী হইতে অনতিদূরে দক্ষিণে পাহাড়-ঘেরা একটিমাত্র গ্রাম আছে। আজ প্রাতে গ্রামের কয়েকটি মেয়ে নদীতে জল ভরিতে আসিয়াছিল। তাহারা দেখিল উপলবিকীর্ণ উপকূলে দুইটি নরনারী-মূর্তি পড়িয়া আছে। তাহারা ছুটিয়া গিয়া গ্রামে খবর দিল; তখন গ্রাম হইতে অনেক লোক আসিয়া মূর্তি দু’টিকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। তাহাদের বুঝিতে বাকি রহিল না যে, গত রাত্রির ঝঞ্ঝাবাতে নদীতে পড়িয়া ইহারা ভাসিয়া আসিয়াছে।
মামা কাতর স্বরে বলিলেন— ‘এখন কি হবে।’
গ্রামের পুরুষেরা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করিল। তাহাদের জীবন বহির্জগৎ হইতে প্রায় বিচ্ছিন্ন, নূতন মানুষ তাহারা দেখিতে পায় না, তাই এই দুইজনকে পাইয়া তাহারা পরম হৃষ্ট হইয়াছে। তাহাদের মধ্যে একজন বয়স্ক ব্যক্তি চিপিটককে বলিল— ‘চল, আমাদের গ্রামে থাকবে।’
তাহারা মেয়ে-পুরুষে দুইজনকে ধরাধরি করিয়া গ্রামে লইয়া চলিল।
নদীর প্রস্তরময় তট হইতে সঙ্কীর্ণ প্রণালীর মত পথ গিয়াছে, সেই পথে পাদক্রোশ যাইবার পর গ্রাম। হাজার হাজার বছর পূর্বে এই স্থানে বোধহয় একটি হ্রদ ছিল, ক্রমে হ্রদ শুকাইয়া পলিমাটির উপর গাছপালা গজাইয়াছিল, তারপর মানুষ আসিয়া এই পাহাড়ঘেরা স্থানটিকে ঘিরিয়া বসিয়াছে। ফল ফলাইয়াছে, ফসল তুলিয়াছে, গরু ছাগল পুষিয়া শান্তিতে বাস করিতেছে। ইহারা অধিকাংশ কুটিরে বাস করে, কিন্তু এখনো অল্পসংখ্যক লোক প্রাচীন অভ্যাস ছাড়িতে পারে নাই, তাহারা এখনো গুহাবাসী। এই পর্বতচক্রের বাহিরে বিস্তীর্ণ দেশের সহিত তাহাদের সম্পর্ক অতি অল্প; কদাচিৎ নগর হইতে নৌকাযোগে বণিক আসিয়া কাপড় এবং মেয়েদের তামা ও লোহার গহনা বিক্রয় করিয়া যায়, বিনিময়ে নারিকেল সুপারি ছাগচর্ম প্রভৃতি লইয়া যায়।
দেখা গেল গ্রামের মানুষগুলা অর্ধ-বন্য হইলেও অতিশয় অতিথিবৎসল। তাহারা অতিথিদের একটি বৃক্ষচ্ছায়ায় বসাইয়া দুগ্ধ পিণ্ডক্ষীর খাইতে দিল, পাকা আম ও কদলী দিল। দুই বুভুক্ষু অতিথি পেট ভরিয়া খাইল। আহারের পর গ্রামবাসীরা তাহাদের পান সুপারি খাইতে দিল। ইহারা জোয়ার বাজরির সঙ্গে পান সুপারির চাষও করে; জঙ্গলে খদির বৃক্ষ আছে, নদীর তীর হইতে শামুক ঝিনুক কুড়াইয়া তাহা পুড়াইয়া ইহারা চুন তৈয়ার করে। পান পাইয়া মন্দোদরী ও চিপিটক আহ্লাদে আটখানা হইলেন।
ইতিমধ্যে গ্রামের সমন্ত স্ত্রীলোক আসিয়া মন্দোদরীকে ঘিরিয়া ধরিয়াছিল; মন্দোদরীকে দেখিবার জন্য নয়, তাহার গহনা দেখিবার জন্য। মন্দোদরীর গলায় ছিল সোনার হাঁসুলী, হাতে অঙ্গদ ও কঙ্কণ, কোমরে চন্দ্রহার, পায়ের আঙ্গুলে রূপার চুট্কি। গ্রামের মেয়েরা আগে কখনো এমন অপরূপ গহনা দেখে নাই। তাহারা কলকণ্ঠে নিজেদের মধ্যে কথা বলিতে বলিতে মন্দোদরীর গা খাব্লাইতে লাগিল।
ওদিকে চিপিটক পান চিবাইতে চিবাইতে প্রবীণ মোড়লকে বলিলেন— ‘তোমাদের আতিথ্যে সন্তুষ্ট হয়েছি। এখন বিজয়নগরে ফেরবার উপায় কি?’
মোড়ল মাথা নাড়িয়া বলিল— ‘বিজয়নগরে যাবার রাস্তা নেই। চারিদিকে পাহাড়।’
‘অ্যাঁ! সে কী! আমাকে যে বিজয়নগরে ফিরতেই হবে।’
‘তুমি কি বিজয়নগরের মানুষ?’
‘না, আমি কলিঙ্গ রাজ্যের একজন অমাত্য, গুরুতর রাজকার্যে বিজয়নগরে যাচ্ছিলাম। — তা নদীপথে বিজয়নগরে যাওয়া তো সম্ভব।’
‘সম্ভব— কিন্তু আমাদের নৌকা নেই।’
চিপিটকের মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল— ‘তবে উপায়? আমরা যাব কি করে?’
মোড়ল হাসিয়া বলিল— ‘যাবার দরকার কি? আমাদের গ্রামে থাকো।’
কি সর্বনাশ! এই পাহাড়ের মাঝখানে জংলীদের মধ্যে সারা জীবন কাটাইতে হইবে। তাঁহার তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর উচ্চতর গ্রামে আরোহণ করিল— ‘অ্যাঁ! না না, আমরা নগরবাসী এই জঙ্গলে থাকতে পারব না। পাহাড়ে জঙ্গলে বাঘ ভালুক আছে— ওরে বাবারে, আমাকে খেয়ে ফেলবে।’
মোড়ল সাস্তনা দিয়া বলিল— ‘কোনো ভয় নেই। বাঘ ভালুক আমাদের গ্রামে আসে না। মাঝে মধ্যে দু’চারটে হনুমান আসে, তারা মানুষ খায় না। তোমরা নির্ভয়ে থাক, আমরা তোমাদের থাকার ভাল ব্যবস্থা করব, তোমরা পরম সুখে থাকবে।’
চিপিটক বিক্ষুব্ধ স্বরে বলিলেন— ‘কোথায় মনের সুখে থাকব? ঐ কুটিরে?’
মোড়ল মাথা নাড়িয়া বলিল— ‘কুটির একটিও খালি নেই। কিন্তু তোমরা যদি কুটিরে বাস করতে চাও, আমরা তোমাদের জন্যে কুটির তৈরি করে দেব। আপাতত একটি সুন্দর গুহা আছে, তাতেই তোমরা থাকবে।’
চিপিটকের চক্ষু কপালে উঠিল। শেষে গুহা! এও অদৃষ্ট ছিল! অতি কষ্টে জিহ্বার জড়ত্ব দূর করিয়া চিপিটক বলিলেন— ‘বণিকেরা আসে বলছিলে, তারা কি আসবে না?’
মোড়ল বলিল— ‘তারা দু’চার দিন আগে এসেছিল, আবার এক বছর পরে আসবে।’
চিপিটকের বাক্রোধ হইয়া গেল। ওদিকে গাঁয়ের মেয়েরা মন্দোদরীর সঙ্গে সদ্ভাব স্থাপন করিয়া ফেলিয়াছিল, ভাষা না বুঝিলেও ভাবের আদান-প্রদান চলিতেছিল। এই গ্রামের মেয়েরা কাছা দিয়া কটি হইতে হাঁটু পর্যন্ত কাপড় পরে, বক্ষ নিরাবরণ, তবু গহনার প্রতি তাঁহাদের যথেষ্ট আসক্তি আছে। মন্দোদরীর গহনা দেখিয়া তাহারা স্বভাবতই অতিশয় আকৃষ্ট হইয়াছিল। তাহারা মন্দোদরীকে দুই হাতে ধরিয়া টানিয়া তুলিল, বলিল— ‘চল। মোড়ল বলেছে তোমরা গুহায় থাকবে, তোমাকে গুহায় নিয়ে যাই। কী সুন্দর গুহা! তোমরা দু’জনে মনের আনন্দে থাকবে।’
মোড়ল চিপিটককে বলিল— ‘গুহা দেখবে এস। এত ভাল গুহা আর এখানে নেই। পুরনো মোড়ল এই গুহায় থাকত, তিরানব্বই বছর বয়সে মারা গেছে। তাই গুহাটা খালি হয়েছে। আমি এখন মোড়ল; ভেবেছিলাম আমি গিয়ে থাকব, কিন্তু আমার স্ত্রী-পুত্র-কন্যা অনেক, ও গুহায় আঁটবে না। তোমরা অতিথি এসেছ, তোমরাই থাক।’
সকলে গুহার নিকট উপস্থিত হইল। গ্রামের বাহিরে পর্বতচক্রের একস্থানে একটি গুহা। গুহার প্রবেশ-দ্বার অতি ক্ষুদ্র, হামাগুড়ি দিয়া প্রবেশ করিতে হয়। চিপিটকের পক্ষে প্রবেশ করা বিশেষ কষ্টকর নয়, কিন্তু মন্দোদরীকে টানা-হেঁচড়া করিয়া ঢুকিতে হয়। তবে গুহার অভ্যন্তর বেশ সুপরিসর। মন্দোদরীর গুহায় প্রবেশ করিতে কোনো আপত্তি দেখা গেল না। সে হামা দিয়া গুহায় প্রবেশ করিল। মোড়ল তখন চিপিটককে বলিল— ‘তুমি কিছুক্ষণ গুহায় গিয়ে বিশ্রাম কর। গুহায় বুড়ো মোড়লের বিছানা আছে, তাতেই তোমাদের দুই স্বামী-স্ত্রীর চলে যাবে।’
এতক্ষণে চিপিটকের হুঁশ হইল, ইহারা তাঁহাকে মন্দোদরীর স্বামী মনে করিয়াছে। তিনি ক্রোধে ছিটকাইয়া উঠিয়া প্রতিবাদ করিতে যাইতেছিলেন, হঠাৎ থামিয়া গেলেন। ইহারা বন্য বর্বর লোক, মন্দোদরী তাঁহার স্ত্রী নয় জানিতে পারিলে কি করিবে কিছুই বলা যায় না। হয়তো আবার টানিয়া লইয়া গিয়া নদীতে ফেলিয়া দিবে। উহাদের ঘাঁটাইয়া কাজ নাই।
আত্মগ্লানি গলাধঃকরণ করিয়া চিপিটক জানুর সাহায্যে গুহায় প্রবেশ করিলেন।
ছয়
পরদিন প্রভাতে বিজয়নগরের রাজপুরী জাগিয়া উঠিল। রাজা জাগিলেন, রানীরা জাগিলেন, পৌর-পরিজন জাগিল। বিদ্যুন্মালা ও মণিকঙ্কণার ঘুম ভাঙ্গিল।
সূর্যোদয় হইতে না হইতে পিঙ্গলা সভাগৃহের দ্বিতলে আসিয়া উপস্থিত হইল। সে রাত্রে রাজপুরীতেই কোথাও থাকে, তাহার স্বতন্ত্র গৃহ নাই। শুনা যায় তাহার একটি গুপ্ত নাগর আছে; মাসের মধ্যে দুই-তিন বার গভীর রাত্রে সে চুপিচুপি নাগরের কাছে যায়। সেখানে রাত কাটাইয়া ঊষাকালে রাজপুরীতে ফিরিয়া আসে। অন্যথা সে রাজপুরী ছাড়িয়া কোথাও যায় না। রাজপুরীতে তাহার অহোরাত্রের কাজ।
রাজকুমারীদের কাছে উপস্থিত হইয়া পিঙ্গলা বলিল— ‘রাজগুরু কূর্মদেব সংবাদ পাঠিয়েছেন, তিনি এখনি আপনাদের আশীর্বাদ জানাতে আসবেন।’
রাজকুমারীরা প্রস্তুত হইয়া রহিলেন। দুই দণ্ড পরে গুরুদেব আসিলেন, রাজকুমারীরা তাঁহার চরণে প্রণত হইলেন। পিঙ্গলা উপস্থিত ছিল, সে বিদ্যুন্মালার পরিচয় দিল।
কূর্মদেব ভাবী রাজবধূকে স্বচক্ষে দেখিতে আসিয়াছিলেন, দেখিয়া তৃপ্ত হইলেন; মনে মনে বলিলেন— ‘কন্যা সুলক্ষণা ও শুদ্ধচরিত্রা, অন্য কন্যাটিও তাই। দু’জনেই বিজয়নগরের রাজবধূ হইবার যোগ্য।’ তিনি বিদ্যুন্মালাকে বলিলেন— ‘কন্যা, শাস্ত্রীয় কারণে বিবাহ তিন মাস স্থগিত থাকবে। এই তিন মাস তোমাকে একটি ব্রত পালন করতে হবে। প্রত্যহ প্রভাতে তুমি পম্পাপতির মন্দিরে যাবে। পম্পাপতির মন্দির বেশি দূর নয়, তুমি পদব্রজে যাবে। সেখানে পম্পা সরোবরে অবগাহন স্নান করবে, সরোবরের পদ্ম তুলে পম্পাপতির পূজা করবে, তারপর ফিরে আসবে। তিন মাস এইভাবে কাটাবার পর বিবাহ হবে।’
বিদ্যুন্মালা মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস মোচন করিলেন। শিরে সংক্রান্তি আসিয়া পড়িয়াছিল, এখন অন্তত তিন মাসের জন্য পরিত্রাণ। তিনি মস্তক অবনত করিয়া স্বীকৃতি জানাইলেন। পিঙ্গলা বলিল— ‘গুরুদেব, কবে থেকে ব্রত আরম্ভ হবে?’
কূর্মদেব বলিলেন— ‘আজ থেকেই আরম্ভ হোক-না। শুভস্য শীঘ্রম্।’
রাজগুরু প্রস্থান করিলে পম্পাপতির মন্দিরে যাইবার জন্য সাজ-সাজ পড়িয়া গেল। পিঙ্গলা নিজে সঙ্গে যাইবে না, কিন্তু সে সমস্ত ব্যবস্থা করিল। রাজার কাছে সংবাদ গেল, পম্পাপতির মন্দিরে অগ্রদূত পাঠানো হইল। তারপর পট্টবস্ত্র পরিহিতা দুই রাজকন্যা বাহির হইলেন। সম্মুখে অসি হস্তে দুইজন প্রতিহারিণী, পিছনে আরো দশজন। পথ আলো করিয়া সুন্দরীর ঝাঁক চলিল।
পম্পাপতির মন্দির রাজপুরীর বায়ুকোণে অনুমান পাদক্রোশ দূরে অবস্থিত। মন্দিরের উত্তরে তুঙ্গভদ্রা, দক্ষিণে-বামে পম্পা সরোবর ও হেমকূট পর্বত। ত্রেতাযুগে এ পম্পা সরোবরে সীতা স্নান করিয়াছিলেন, রাম-লক্ষ্মণ তাহার তীরে পরমধার্মিক বকপক্ষী দেখিয়া হাস্য-পরিহাস করিয়াছিলেন।
রাজকন্যারা সভাগৃহ হইতে মাত্র কিয়দ্দূর গিয়াছেন, পথের পাশেই অতিথি-ভবন। একটি যুবক অতিথি-ভবন হইতে বাহির হইয়া সম্মুখে যুবতী-প্রবাহ দেখিয়া পথপার্শ্বে থামিয়া গেল। তারপর সে যুবতীদের মধ্যে রাজকন্যাদের দেখিতে পাইল।
রাজকন্যারা যুবককে দেখিয়াছিলেন এবং চিনিতে পারিয়াছিলেন। অর্জুনবর্মা। সে সসম্ভ্রমে দুই কর যুক্ত করিল। রাজকন্যাদের গতি স্থগিত হইল না, কিন্তু মণিকঙ্কণা চকিত হাস্যে দশনপ্রান্ত ঈষৎ উন্মোচিত করিল। বিদ্যুন্মালা হাসিলেন না, তাঁহার মুখখানি রক্ত সঞ্চারে একটু উত্তপ্ত হইল মাত্র। কেহ জানিল না যে তাঁহার হৃৎপিণ্ড ক্ষণিকের জন্য দুরু দুরু করিয়া উঠিয়াছে।
অর্জুন দাঁড়াইয়া রহিল, স্নানার্থিনীরা চলিয়া গেলেন। অর্জুন একটু ইতস্তত করিল; একবার তাহার ইচ্ছা হইল রাজকুমারীর অনুসরণ করে, তিনি প্রতিহারিণী পরিবৃতা হইয়া কোথায় যাইতেছেন দেখিয়া আসে। কিন্তু না, তাহা শোভন হইবে না। সে দৃঢ়পদে অন্য পথে চলিল।
আজ সকালে সে বলরামকে দেখিতে যাইবে বলিয়া বাহির হইয়াছিল। পথে নামিয়াই রাজকুমারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ। তাহার মন ক্ষণেকের জন্য বিক্ষিপ্ত হইয়াছিল, এখন সে আবার মন সংযত করিয়া কিল্লাঘাটের দিকে অগ্রসর হইল।
প্রভাতকালে নগরীর রূপ অন্য প্রকার; যেন সদ্য ঘুম-ভাঙা আলস্য-নিমীল রূপ। পান-সুপারি রাস্তায় লোক চলাচল বেশি নাই। দোকানপাট ধীরমন্থর চালে খুলিতেছে।
কিছুদূর চলিবার পর অর্জুন অকারণেই একবার পিছু ফিরিয়া চাহিল। সেই শীর্ণ লোকটা তাহার পিছনে আসিতেছে; নিজের মুখাবয়ব ঢাকা দিবার জন্যই বোধহয় মাথায় একটি পাগড়ি পরিয়াছে। কিন্তু তাহাতে তাহার স্বরূপ ঢাকা পড়ে নাই।
অর্জুনের একটু বিরক্তি বোধ হইল। কি চায় লোকটা? তাহার একটা উদ্দেশ্য আছে সন্দেহ নাই, কিন্তু কী সেই উদ্দেশ্য? একবার অর্জুনের ইচ্ছা হইল ফিরিয়া গিয়া লোকটাকে ধরিয়া জিজ্ঞাসা করে— কী চাও তুমি? কিন্তু তাহাতে শান্তিভঙ্গের সম্ভাবনা আছে; অর্জুন এ দেশে নবাগত, কাহারো সহিত কলহ করিতে চায় না। সে লোকটাকে মন হইতে ঝাড়িয়া ফেলিয়া অন্য কথা ভাবিতে ভাবিতে পথ চলিতে লাগিল।
ভাবনার বিষয়বস্তুর অভাব ছিল না। পিতা সুদূর গুলবর্গায় কি করিতেছেন; সত্যই কি সুলতান তাঁহাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে; পিতা কি অনশনে প্রাণত্যাগ করিয়াছেন?…এই দেশটা তাহার ভাল লাগিয়াছে; এই দেশকে নিজের দেশ ভাবিয়া সে সুখী হইয়াছে; সে কি দেশের সেবা করিতে পরিবে? রাজা কি তাহাকে সৈনিকের কার্য দিবেন?— এই সকল চিন্তার ফাঁকে ফাঁকে রাজকুমারী বিদ্যুন্মালার স্নিগ্ধগম্ভীর মুখখানি তাহার মানসপটে ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। রাজকুমারীর মনে গর্ব-অভিমান নাই, অর্জুনের ন্যায় সামান্য ব্যক্তির জীবনকথা শুনিতেও তাঁহার আগ্রহ। ঈশ্বর কৃপায় তিনি রাজেন্দ্রাণী হইয়া সুখে থাকুন—
অর্জুন যখন কিল্লাঘাটে পৌছিল তখন দ্বিপ্রহরের বিলম্ব নাই। ঘাটে দুই তিনটি গোলাকৃতি খেয়া-তরী ছিল, সে একটি ভাড়া লইয়া বানচাল বহিত্রগুলির দিকে চলিল। বহিত্র যেমন ছিল তেমনি দাঁড়াইয়া আছে। প্রথমটির নিকট গিয়া অর্জুন তাহার ভিতরে কোনো সাড়াশব্দ পাইল না। তখন সে দ্বিতীয়টির নিকটে গেল। এই বহিত্রটির খোলের ভিতর হইতে ঠুক্ঠাক্ শব্দ আসিতেছে। সে বহিত্রের গায়ে নৌকা ভিড়াইয়া উচ্চকণ্ঠে ডাকিল— ‘বলরাম!’
ঠুক্ঠাক্ বন্ধ হইল। মুহূর্ত পরে খোলের ভিতর হইতে বলরাম কর্মকার পাটাতনে উঠিয়া আসিল, অর্জুনকে দেখিয়া একগাল হাসিল— ‘এস এস, বন্ধু, এস। রাজভোগ ছেড়ে পালিয়ে এলে যে!’
‘তোমাকে দেখতে এলাম’ — অর্জুন বহিত্রের গলুইয়ে ডিঙা বাঁধিয়া পাটাতনে উঠিল— ‘আমার লাঠি দু’টো আছে তো?’
‘আছে। আমি যত্ন করে রেখেছি। চল, ছায়ায় যাই, এখানে বড় রৌদ্র।’
দুইজনে চিপিটক মামার রইঘরে গিয়া বসিল। মামার তৈজসপত্র পড়িয়া আছে কেবল মামা নাই। দু’জনে কিছুক্ষণ ঝড়ের সন্ধ্যার সংবাদ বিনিময় করিল, শেষে অর্জুন বলিল— ‘বহিত্র কি বেশি জখম হয়েছে?’
বলরাম বলিল— ‘জখম বেশি হয়নি, যেটুকু হয়েছে তা সূত্রধরেরা মেরামত করতে পারবে। কিন্তু তিনটি বহিত্রই চড়ায় আটকে গিয়েছে, যতদিন না বর্ষায় নদীর জল বাড়ছে ততদিন ওরা ভাসবে না।’
‘তোমার কাজ শেষ হয়েছে?’
‘আমার কাজ বেশি ছিল না। গোটা কয়েক লোহার কীলক তৈরি করে দিয়েছি, বাকি কাজ সূত্রধরেরা করবে।’
‘তাহলে তুমি আমার সঙ্গে বিজয়নগরে চল না।’
‘বেশ, চল। কিন্তু এখানে আহার তৈরি, খেয়ে নিয়ে বেরুনো যাবে। রান্না অবশ্য বেশি নয়, ভাত আর মাছের রাই-ঝোল।’
‘মাছ কোথায় পেলে?’
‘তুঙ্গভদ্রায় মাছের অভাব! বঁড়শি দিয়ে ধরেছি। মাছের স্বাদ কিন্তু ভাল নয়, বাংলা দেশের মত নয়। কাল খেয়েছিলাম।’
দু’জনে নৌকার খোলের মধ্যে গিয়া আহারে বসিল। খাইতে খাইতে কথা হইতে লাগিল— ‘রাজাকে দেখেছ? কেমন রাজা?’
‘রাজা আমাকে ডেকেছিলেন, আমি তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। রাজার মতন রাজা। আমাকে তাঁর সৈন্যদলে নেবেন বলেছেন।’
অর্জুন রাজদর্শনের আখ্যান বিস্তারিত করিয়া বলিল। শুনিয়া বলরাম বলিল— ‘তাই নাকি! তোমার কপাল ভাল। আমিও রাজার শ্রীচরণ দর্শন করতে চাই, বিশেষ প্রয়োজন আছে। তুমি ভাই একটু চেষ্টা করো।’
‘নিশ্চয় করব। আমার যথাসাধ্য করব।’
আহারান্তে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিয়া দুই বন্ধু গাত্রোত্থান করিল। বলরাম একটি পাটের থলিতে কিছু লোহা-লক্কড় লইয়া থলি কাঁধে ফেলিল। অর্জুন নিজের লাঠি দু’টি হাতে লইল।
গোল নৌকায় চড়িয়া তাহারা ঘাটে নামিল। অর্জুন দেখিল, নির্জন ঘাটের এক কোণে শীর্ণকায় লোকটি বসিয়া আছে। মাথায় পাগড়ি থাকা সত্ত্বেও রৌদ্রতাপে তাহার অবস্থা করুণ। অর্জুন ও বলরাম পথ চলিতে আরম্ভ করিলে সেও পিছে চলিল।
অর্জুন চলিতে চলিতে বলরামকে নিম্নস্বরে শীর্ণ লোকটির কথা বলিল। বলরাম একবার ঘাড় ফিরাইয়া পঞ্চাশ হস্ত দূরস্থ লোকটাকে দেখিল, তারপর কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিল— ‘রাজার গুপ্তচর হতে পারে।’
অর্জুন আশ্চর্য হইয়া বলিল— ‘রাজার গুপ্তচর—!’
বলরাম বলিল— ‘রাজারা কাউকে বিশ্বাস করেন না। বিশ্বাস করলে তাঁদের চলে না। তুমি নূতন লোক, গুলবর্গা থেকে এসেছ, তাই তোমার পিছনে গুপ্তচর লেগেছে। ভাল রাজা, বিচক্ষণ রাজা! কিন্তু তোমার মনে পাপ নেই, তোমার কিসের ভয়?’
অর্জুন অনেকক্ষণ হতবাক্ হইয়া রহিল। রাজনীতির সহিত তাহার পরিচয় নাই; যে-মানুষ প্রসন্ন মুখে তাহার সহিত বাক্যালাপ করিয়া প্রীতির নিদর্শন স্বরূপ স্বর্ণমুদ্রা দান করে, সে-ই আবার তাহার পিছনে গুপ্তচর লাগাইতে পারে। ইহা যেন বিশ্বাস হয় না। কিন্তু বলরামের কথাই সত্য, রাজাদের সর্বদা সতর্ক থাকিতে হয়।
পান-সুপারি রাস্তা দেখিয়া বলরামের চক্ষু গোল হইল। দীর্ঘ পথ হাঁটিয়া তাহারা পিপাসার্তা হইয়াছিল, তক্রবতীর দোকানে গিয়া আকণ্ঠ শীতল তক্র পান করিল। আজ আর তক্রবতী যুবতী মূল্য লইতে অস্বীকার করিল না।
সন্ধ্যার প্রাক্কালে দু’জনে অতিথি-ভবনে উপনীত হইল। বলরামের পরিচয় শুনিয়া পরিচারকেরা তাহাকে অর্জুনের পাশের একটি প্রকোষ্ঠে থাকিতে দিল।
সাত
পরদিন প্রভাতে দুই বন্ধু নগর পরিদর্শনে বাহির হইল। বলরাম ইতিপূর্বে এমন বিস্তীর্ণ শোভাময় নগর দেখে নাই, বর্ধমান ইহার তুলনায় গণ্ডগ্রাম। অর্জুনও বিজয়নগরের সামান্য অংশই দেখিয়াছে। তাই তাহারা সাগ্রহে নগর দর্শনে বাহির হইল। আজ তাহারা সারাদিন নগরের যত্রতত্র ঘুরিয়া বেড়াইবে, হ্রদে স্নান করিবে, মিঠাই-অঙ্গদি হইতে দ্বিপ্রহরে আহার্য সংগ্রহ করিয়া লইবে। তারপর সন্ধ্যাকালে ফিরিয়া আসিবে।
অতিথি-ভবন হইতে বাহির হইয়া আজও রাজকন্যাদের সঙ্গে দেখা হইয়া গেল। তাঁহারা প্রহরিণী পরিবৃত হইয়া পম্পাপতির মন্দিরে চলিয়াছেন। অর্জুন ও বলরাম পথের ধারে দাঁড়াইয়া পড়িল। মণিকঙ্কণা আজও মিষ্ট হাসিল, বিদ্যুন্মালার গণ্ডে কাঁচা সিঁদুর ছড়াইয়া পড়িল। তাঁহারা চলিয়া গেলে বলরাম অর্জুনকে জিজ্ঞাসা করিল— ‘এরা কোথায় যাচ্ছেন?’
অর্জুন বলিল— ‘জানি না। কালও গিয়েছিলেন।’
‘চল, খোঁজ নিই।’
বেশি খোঁজ করিতে হইল না, একটি পানের দোকানে তাহারা প্রকৃত তথ্য অবগত হইল। সংবাদ ইতিমধ্যে নগরে রাষ্ট্র হইয়াছে। রাজগুরুর আদেশে কলিঙ্গ-কুমারী তিন মাস ব্রত পালন করিবেন, প্রত্যহ পম্পা সরোবরে স্নান করিয়া মন্দিরে দেবার্চনা করিবেন। ব্রত উদ্যাপনের পর বিবাহ হইবে।
অতঃপর তাহারা নগরের চারিদিকে যথেচ্ছা ঘুরিয়া বেড়াইল। বলা বাহুল্য, শীর্ণ গুপ্তচরটি তাহাদের পিছনে রহিল।
নগরে অগণিত তুঙ্গশীর্ষ দেবমন্দির; কোনো মন্দির বীরভদ্রের, কোনো মন্দির রামস্বামীর, কোনো মন্দির মল্লিকার্জুনের। মন্দিরসংলগ্ন ভবনে বহুসংখ্যক দেবদাসীর বাস। চম্পকদামগৌরী এই সুন্দরীদের বিবাহ হয় না; ইহারা নৃত্য-গীত দ্বারা দেবতার সেবা করিয়া যৌবনকাল যাপন করে। দেবতাই তাহাদের স্বামী।
নগর পরিধির মধ্যে অনেক ছোট ছোট পাহাড় আছে; পাহাড়ে কোথাও কোথাও গুহা আছে। এই সকল গুহায় কেহ বাস করে না, কদাচিৎ মন্মথ-পীড়িত নায়ক-নায়িকা এই প্রাকৃতিক সঙ্কেতগৃহে নৈশ-অভিসার করে, প্রণয়ের অপরিণামদর্শিতায় নিজেদের নাম গুহাগাত্রে লিখিয়া রাখিয়া যায়। দ্বিপ্রহরে এই গুহার ছায়ায় রাখাল বালক নিদ্রা যায়। পাহাড় ছাড়াও চারিদিকে বহু পয়ঃপ্রণালী আছে, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সরোবর আছে। অর্জুন ও বলরাম সরোবরে স্নান করিল, সঙ্গে যে আহার্য আনিয়াছিল তাহা তরুচ্ছায়ায় বসিয়া ভোজন করিল, তারপর একটি গুহার স্নিগ্ধ অন্ধকার গর্ভে শুইয়া রহিল।
অপরাহ্ণে সূর্যের তেজ কমিলে দুইজনে গুহা হইতে বাহির হইল। গুপ্তচর গুহামুখ হইতে কিয়দূরে একটি বৃক্ষচ্ছায়ায় বসিয়া ছোলাভাজা খাইতেছিল। সেও গাত্রোত্থান করিল।
বলরাম তাহাকে দেখিয়া অর্জুনকে বলিল— ‘এস, লোকটাকে নিয়ে একটু রঙ্গ করা যাক।’
দু’জনে নিম্নকণ্ঠে পরামর্শ করিল, তারপর বলরাম পুনশ্চ গুহার মধ্যে প্রবেশ করিল, অর্জুন নির্জন পথ ধরিয়া রাজপুরীর অভিমুখে চলিল। রাজপুরী এখান হইতে অনুমান ক্রোশেক পথ দূরে।
গুপ্তচর বৃক্ষতলে দাঁড়াইয়া ক্ষণকাল ইতস্তত করিল, তারপর অর্জুনকে অনুসরণ করিল। স্পষ্টই বোঝা যায় অর্জুন তাহার প্রধান লক্ষ্য।
সে গুহার দিকে পিছন ফিরিলে বলরাম গুহা হইতে বাহির হইয়া তাহার পিছু লইল। ওদিকে অর্জুন কিছুদূর গিয়া হঠাৎ ফিরিয়া আসিতে লাগিল। দুইজনের মাঝখানে পড়িয়া গুপ্তচরের আর পালাইবার পথ রহিল না। সে ন যযৌ ন তস্থৌ ভাবে দাঁড়াইয়া পড়িল।
বলরাম আসিয়া গুপ্তচরের কাঁধে হাত রাখিল, বলিল— ‘বাপু, তোমার নাম কি?’
গুপ্তচর অন্যদিকে ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল, অর্জুন দাঁড়াইয়া আছে। তাহার মুখের ভাব পরিবর্তিত হইল, বোকাটে আধ-পাগলা গোছের মুখ করিয়া সে বলিল— ‘আমার নাম বেঙ্কটাপ্পা।’
বলরাম বলিল— ‘বাঃ! খাসা নাম! তুমি কী কাজ কর?’
‘কাজ!’ বেঙ্কটাপ্পা ফ্যাল ফ্যাল চাহিয়া বলিল— ‘আমি কাজ করি না, কেবল পথে পথে ঘুরে বেড়াই।’
‘বটে! কিন্তু পেট চলে কি করে?’
‘পেট! পেট তো চলে না, আমি চলি।’
‘বলি খাও কি?’
‘যা পাই তাই খাই।’
‘পথে পথে ঘুরে বেড়াও, রোজগার কর না, তোমার খাবার ব্যবস্থা করে কে?’
ক্ষণেক নীরব থাকিয়া বেঙ্কটাপ্পা আকাশের দিকে তর্জনী তুলিয়া বলিল— ‘ঐখানে ভগবান আছেন, তিনি খাবার ব্যবস্থা করেন।’
‘বৎস বেঙ্কটাপ্পা, তুমি তো ভারি চতুর লোক, ভগবানের ঘাড়ে খাবারের ভার তুলে দিয়েছ। কিন্তু আমাদের পিছনে লেগেছ কেন?’
বেঙ্কটাপ্পা হাঁ করিয়া চাহিয়া থাকিয়া বলিল— ‘পিছনে লাগা কাকে বলে?’
‘তাও জান না? ভারি নেকা তুমি!’ বলরাম তাহার বাহু ধরিয়া বলিল— ‘চল তুমি আমাদের সঙ্গে, পিছনে লাগা কাকে বলে বুঝিয়ে দেব।’
বেঙ্কটাপ্পা হাত ছাড়াইয়া লইয়া বলিল— ‘না, আমি তোমাদের সঙ্গে যাব না।’
বলরাম বলিল— ‘বেশ, পিছনে থাকো ক্ষতি নেই, কিন্তু বেশি কাছে এস না। আমার বন্ধুর হাতে লাঠি দেখতে পাচ্ছ?’
বেঙ্কটাপ্পা ইতিউতি চাহিয়া হঠাৎ পিছন দিকে ছুটি মারিল। বলরাম উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল, বলিল— ‘বেঙ্কটাপ্পাকে আজ আর দেখা যাবে না। চল, অতিথি-ভবনে ফেরা যাক।’
অর্জুন বলিল— ‘এখনো বেলা আছে। পম্পা সরোবর দেখতে যাবে?’
‘হাঁ হাঁ, তাই চল।’
সূর্যাস্তের সময় তাহারা পম্পার সন্নিধানে পৌঁছিল। স্থানটি শান্ত রসাস্পদ, পর্বত সরোবর ও মন্দির মিলিয়া তপোবনের পরিবেশ সৃজন করিয়াছে। মন্দিরের সম্মুখে বহুবিস্তৃত পাষাণ-চত্বর। পিছনে ও পাশে দেবদাসীদের বাসস্থান। চত্বরের উপর তিনজন প্রৌঢ় ব্রাহ্মণ বসিয়া আছেন। পূজার্থীর ভিড় নাই।
অর্জুন ও বলরাম দূর হইতে মন্দিরস্থ বিগ্রহকে প্রণাম করিল, তারপর সরোবরের দিকে চলিল।
মন্দির-সংলগ্ন ঘাট হইতে পম্পার দৃশ্য অতি মনোহর। দূরপ্রসারিত গোলাকৃতি হ্রদের তীর ঘন-সন্নিবিষ্ট তরুশ্রেণীর দ্বারা বেষ্টিত। তাহার ফাঁকে জলের উপর সন্ধ্যাভ্র বর্ণমালা প্রতিফলিত হইয়াছে। নীলাভ জলে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কমল ও কুমুদের গুচ্ছ। কমল মুদিত হইতেছে, কুমুদ ধীরে ধীরে উন্মীলিত হইতেছে। এমনিভাবে যুগযুগান্ত ধরিয়া তাহারা পালা করিয়া দিবারাত্র জনক-তনয়ার স্নানপুণ্য সরোবর পাহারা দিতেছে।
দুই বন্ধু ঘাটের পৈঠায় বসিয়া পম্পার জল মাথায় ছিটাইল, তারপর মুগ্ধনেত্রে চারিদিকে চাহিতে লাগিল। মৃদুমন্দ বায়ুভরে সরোবরের জল ঊর্মিল হইয়া উঠিতেছে, শুদ্ধ স্নিগ্ধ কমলগন্ধ বিকীর্ণ হইতেছে। তীরের জলরেখা ধরিয়া বকপক্ষীরা সঞ্চরণ করিতেছে; কয়েকটি বক উড়িয়া গিয়া রাত্রির জন্য বৃক্ষশাখায় বসিল। রামচন্দ্র যে বকপক্ষী দেখিয়াছিলেন ইহারা কি তাহারই বংশধর?
অর্জুন ও বলরাম শান্ত তৃপ্ত মন লইয়া বসিয়া রহিল। ক্রমে সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিল; তখন সহসা মন্দিরের চত্বরে মৃদঙ্গর রোল উত্থিত হইল। অর্জুন ও বলরাম তাড়াতাড়ি উঠিয়া মন্দিরের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল।
মন্দিরের ভিতরে ও বাহিরে বহু দীপ জ্বলিয়াছে। একদল দেবদাসী অপূর্ব বেশে সজ্জিত হইয়া যুক্তকরে মন্দিরদ্বার সম্মুখে দাঁড়াইয়াছে। তিনজন প্রৌঢ়ের মধ্যে একজন মন্দিরের পূজারী, তিনি মন্দিরের অভ্যন্তরে বিগ্রহের পুরোভাগে পঞ্চপ্রদীপ হস্তে দাঁড়াইয়াছেন। অন্য দুইজন প্রৌঢ় চত্বরে দাঁড়াইয়া মৃদঙ্গ ও মঞ্জীরা বাজাইতেছেন। দর্শকের সংখ্যা বেশি নয়; অর্জুন ও বলরাম তাঁহাদের মধ্যে গিয়া অঞ্জলিবদ্ধ হস্তে দণ্ডায়মান হইল।
আরতি আরম্ভ হইল। সঙ্গে সঙ্গে দেবদাসীগণের সুঠাম দেহ নৃত্যের তালে ছন্দিত হইয়া উঠিল। মৃদঙ্গ মঞ্জীরার ধ্বনির সহিত নূপুর ও কঙ্কণকিঙ্কিণীর নিক্কণ মিশিল। দশটি দেহ একসঙ্গে লীলায়িত হইতেছে, দশজোড়া নুপুর একসঙ্গে ঝংকৃত হইতেছে, বিলোল বাহু-মৃণাল একসঙ্গে বিসর্পিত হইতেছে। নর্তকীদের মুখের ভাব তদ্গত, চক্ষু অর্ধ-নিমীলিত; তাহাদের অন্তশ্চেতনা যেন ঊর্ধ্বলোকে সাক্ষাৎ নটরাজের সন্নিধানে উপনীত হইয়াছে।
তারপর নৃত্যের সহিত উদাত্ত কণ্ঠস্বর মিশিল। যিনি মঞ্জীরা বাজাইতেছিলেন, তিনি জয়মঙ্গল রাগে গান ধরিলেন। কণ্ঠস্বর গম্ভীর, কিন্তু তাল দ্রুত। এই গানের সুরে নর্তকীরা যেন মাতিয়া উঠিল। তাহাদের দেহ আলোড়িত করিয়া নৃত্যের ঘূর্ণাবর্ত উদ্বেলিত হইয়া উঠিতে লাগিল। দর্শকের ইন্দ্রিয়গ্রামের উপর দিয়া যেন হর্ষের একটা ঝড় বহিয়া গেল।
চিরদিনই দাক্ষিণাত্য দেশ নৃত্যগীতাদি কলায় পারদর্শী। সেকালে ছয় রাগ ছত্রিশ রাগিণীর সহিত কর্ণাট রাগ দেশ রাগ গুর্জর রাগ এবং জয়মঙ্গল রাগের বিশেষ সমাদর ছিল।
দুই দণ্ড পরে আরতি শেষ হইল। দেবদাসীরা মন্দির প্রদক্ষিণ করিয়া স্বপ্নদৃষ্টা অপ্সরার মত অদৃশ্য হইয়া গেল। পূজারী ভক্তবৃন্দকে প্রসাদ বিতরণ করিলেন।
রাত্রি হইয়াছে। অর্জুন ও বলরাম ফিরিয়া চলিল। কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি; তবু অদূরে হেমকূট চুড়ায় অগ্নিস্তম্ভ হইতে আলোকের প্রভা রাত্রির অন্ধকারকে ঈষৎ স্বচ্ছ করিয়া দিয়াছে। দুইজনে নীরবে পথ চলিয়াছে। তাহাদের মনে যে গভীর অনুভূতি জাগিয়াছে তাহা প্রকাশ করিবার ভাষা তাহাদের নাই। ইহা একদিকে যেমন নূতন, অন্যদিকে তেমনি চিরপুরাতন, তাহাদের রক্তের সহিত মিশিয়া আছে। তাহারা জানে না যে আজ তাহারা যাহা প্রত্যক্ষ করিল তাহা তাহাদের অপৌরুষেয় সংস্কৃতির স্বতঃস্ফুর্ত উচ্ছ্বাস।
আট
তারপর একটি একটি করিয়া গ্রীষ্মের অলস মন্থর দিনগুলি কাটিতে লাগিল। কলিঙ্গ-সমাগত অতিথিবৃন্দ মনের আনন্দে আছে, তাহারা খায়-দায়, নগরে ঘুরিয়া বেড়ায়, গলায় ফুলের মালা পরিয়া, গোঁফে আতর মাখিয়া নগরবাসিনী যুবতীদের সঙ্গে রঙ্গ-রসিকতা করে। কাহারো কোনো চিন্তা নাই, এইভাবে যতদিন চলে।
রাজবৈদ্য রসরাজ অতিথি-ভবনে অধিষ্ঠিত হইয়া প্রথমটা একটু সঙ্গিহীন হইয়া পড়িয়াছিলেন; তারপর দ্বিতীয়দিন সন্ধ্যাকালে বিজয়নগরের রাজবৈদ্য দামোদর স্বামী আসিলেন, প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিয়া সাদর সম্ভাষণের ভঙ্গিতে দুই বাহু তুলিয়া প্রচণ্ড একটি সংস্কৃত বচন ছাড়িলেন। রসরাজ নিঃঝুমভাবে একাকী বসিয়া ছিলেন, পুলকিত দেহে উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং ততোধিক প্রচণ্ড একটি শ্লোক ঝাড়িলেন। বয়সে এবং পাণ্ডিত্যে উভয়ে সমকক্ষ, সুতরাং অবিলম্বে ভাব হইয়া গেল। দুইজনে নিদান শাস্ত্রের আলোচনা করিয়া পরমানন্দে সন্ধ্যা অতিবাহিত করিলেন।
অতঃপর প্রত্যহ দুই রাজবৈদ্যের সভা বসিতে লাগিল। নানা প্রসঙ্গের অবতারণা হয়; রাজ পরিবারের বিচিত্র রোগ চুপি-চুপি আলোচনা হয়। একজন বলেন, রাজাদের আসল রোগ মাথায়; মাথাটা ঠাণ্ডা রাখিতে পারিলে আর কোনো গণ্ডগোল থাকে না। অন্যজন বলেন, রাজাদের সব রোগের উৎপত্তি উদরে, যদি পরিপাকযন্ত্র সুচারুরূপে সচল থাকে তাহা হইলে মস্তিষ্ক আপনি ঠাণ্ডা হইয়া যায়, কোনো গোলযোগের সম্ভাবনা থাকে না। পরন্তু রানীদের সমস্যা অন্য প্রকার—
একদিন কথা প্রসঙ্গে রসরাজ বলিলেন— ‘আমার কাছে যে কোহল আছে তার তুল্য কোহল ভু-ভারতে নেই।’
দামোদর স্বামী হটিবার পাত্র নন, তিনি বলিলেন— ‘আমার কাছে যে কোহল আছে তা এক চুম্ব পান করলে স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র ঐরাবতের পৃষ্ঠ থেকে গড়িয়ে মাটিতে পড়বেন।’
কিছুক্ষণ দুই পক্ষ নিজ নিজ কোহলের উচ্চ হইতে উচ্চতর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হইলেন। কিন্তু কেবল আত্মশ্লাঘায় তর্কের নিষ্পত্তি হয় না। রসরাজ বলিলেন— ‘আসুন, পরীক্ষা করে দেখা যাক। আপনি আমার কোহল দশ বিন্দু পান করুন, আমি আপনার কোহল দশ বিন্দু পান করি। ফলেন পরিচীয়তে।’
‘উত্তম কথা।’ দামোদর স্বামী গৃহে গিয়া নিজের কোহল লইয়া আসিলেন। দুই বৃদ্ধ পরস্পরের কোহল পান করিলেন। তারপর দণ্ডার্ধ অতীত হইতে না হইতে তাঁহারা শয্যার উপর হস্তপদ বিক্ষিপ্ত করিয়া নিদ্রিত হইয়া পড়িলেন।
গভীর রাত্রে দামোদর স্বামীর ঘুম ভাঙ্গিল, তিনি উঠিয়া টলিতে টলিতে গৃহে গেলেন। রসরাজের ঘুম সে রাত্রে ভাঙ্গিল না।
বিদ্যুন্মালা ও মণিকঙ্কণা সভাগৃহের দ্বিতলে আছেন। তাঁহাদের জীবনধারা আবার স্বাভাবিক ছন্দে প্রবাহিত হইতেছে। পিত্রালয়ে তাঁহারা যেমন ছিলেন, এখানকার জীবনযাত্রা তাহা হইতে বিশেষ পৃথক নয়।
কিন্তু একই সরোবরে বাস করিলে দুইটি মীনের মতিগতি এক প্রকার হয় না। দুই রাজকুমারীর প্রকৃতি মূলত ভিন্ন, নূতন সংস্থিতির সম্মুখীন হইয়া তাঁহাদের মন ভিন্ন পথে চলিয়াছে। কিন্তু সেজন্য তাঁহাদের স্নেহ-ভালবাসার সম্বন্ধ তিলমাত্র ক্ষুণ্ণ হয় নাই।
মণিকঙ্কণার মন স্ফটিকের ন্যায় স্বচ্ছ, সেখানে জটিলতা কুটিলতা নাই, সামাজিক বিধিব্যবস্থার প্রতি বিদ্বেষ নাই। সে মহারাজ দেবরায়কে দেখিয়া পলকের মধ্যে হৃদয় হারাইয়াছে এবং হৃদয় হারানোর আনন্দে মাতোয়ারা হইয়া আছে। মহারাজের কয়টি মহিষী, তিনি তাহাকে বিবাহ করিবেন কিনা, এই সকল প্রশ্ন তাহার কাছে নিতান্তই অবান্তর। মহারাজ যদি তাহাকে বিবাহ না করেন, সে চিরজীবন কুমারী থাকিয়া তাঁহার কাছে কাছে ঘুরিবে, তাঁহার সেবা করিবে; ইহার অধিক আর কিছু সে চাহে না। তাহার মনের এইরূপ আত্মভোলা অবস্থা।
বিদ্যুন্মালার মন কিন্তু শান্ত নয়, পাষাণ-বন্ধনে প্রতিহত জলপ্রবাহের ন্যায় সর্বদাই আলোড়িত হইতেছে। যাঁহার কাছে শ্রীরামচন্দ্রই একমাত্র আদর্শ স্বামী, বহুপত্নীক দেবরায়ের সহিত বিবাহ তাঁহার প্রীতিপদ হইতে পারে না। আদৌ তাঁহার মন এই বিবাহের প্রতি বিমুখ হইয়া ছিল। কিন্তু রাজকন্যাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর রাজনৈতিক কার্যকলাপ নির্ভর করে না; বিদ্যুন্মালা বিরূপ মন লইয়া বিবাহ করিতে চলিয়াছিলেন।
তারপর নদীগর্ভ হইতে উঠিয়া আসিল এক অজ্ঞাত অখ্যাতনামা যুবক। রাজকুমারীর মন স্বপ্নসন্ধুল হইয়া উঠিল। হয়তো স্বপ্ন একদিন অলীক কল্পনাবিলাসের মত মিলাইয়া যাইত, কিন্তু হঠাৎ ঝড় আসিয়া সব ওলট-পালট করিয়া দিল; নদী হইতে উদ্ধার এবং দ্বীপের উপর সেই নিভৃত রাত্রিটি চিরস্মরণীয় হইয়া রহিল। বিদ্যুন্মালা নিজ হৃদয়ের প্রচ্ছন্ন কথাটি জানিতে পারিলেন। রাজার মেয়ে এক অতি সামান্য যুবকের প্রতি আসক্ত হইয়াছেন।
মহারাজ দেবরায়কে দেখিয়া বিদ্যুন্মালার হৃদয় বিচলিত হইল না; কিন্তু তিনি বুদ্ধিমতী, বুঝিলেন রাজা নারীলোলুপ অগ্নিবর্ণ নয়, তিনি স্থিরবুদ্ধি অচলপ্রতিষ্ঠ রাজা। তাঁহার চিত্তলোকে নারীর স্থান অতি অল্প।
বিবাহ স্থগিত হইল, পম্পাপতিস্বামীর পূজা আরম্ভ হইল। প্রথম দিনই বিদ্যুন্মালা অর্জুনবর্মাকে পথের ধারে দেখিলেন, তারপর প্রায় প্রত্যহ দেখা হইতে লাগিল। মাঝে একদিন ফাঁক পড়িলে বিদ্যুন্মালা সারাদিন উৎকণ্ঠায় ছটফট করেন। ভুলিয়া যাইবার পথ রহিল না।
একদিন পূর্বাহ্ণে পম্পাপতির মন্দির হইতে ফিরিবার পর মণিকঙ্কণা বলিল— ‘চল মালা, অন্য রানীদের সঙ্গে ভাব করে আসি।’
বিদ্যুন্মালার মন আজ বিক্ষিপ্ত, তিনি পথের ধারে অর্জুনকে দেখিতে পান নাই। উদাসভাবে শয্যায় শয়ন করিয়া বলিলেন— ‘তুই যা কঙ্কা, আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। আমি একটু শুয়ে থাকি।’
মণিকঙ্কণা ইদানীং নিজের মন লইয়াই মাতিয়া ছিল, বিদ্যুন্মালার মনের গতি কোন্ দিকে তাহা লক্ষ্য করে নাই। সে বলিল— ‘তা বেশ। তোকে একটু ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আমি একাই যাই। মানুষগুলো কেমন, জানা দরকার।’
মণিকঙ্কণা পিঙ্গলাকে ডাকিয়া প্রয়োজন ব্যক্ত করিল। পিঙ্গলা বলিল— ‘যথা আজ্ঞা। মহারাজের আদেশ আছে, যেখানে যেতে চাইবেন সেখানে নিয়ে যাব। মধ্যমা দেবী শঙ্কটা কিন্তু কারুর সঙ্গে দেখা করেন না, তাঁর মহলে মহারাজ ছাড়া আর কারুর প্রবেশাধিকার নেই।’
মণিকঙ্কণা বলিল— ‘তাই নাকি! দেখতে কুৎসিত বুঝি?’
পিঙ্গলা মুখ টিপিয়া হাসিল, বলিল— ‘মধ্যমা দেবীকে আমরা কেউ দেখিনি। তাঁর পিত্রালয় থেকে যেসব দাসী এসেছিল তারাই তাঁকে অষ্টপ্রহর ঘিরে থাকে। চলুন, আগে কনিষ্ঠা রানী বিলোলা দেবীর কাছে নিয়ে যাই; তারপর পাটরানী পদ্মালয়াম্বিকার ভবনে নিয়ে যাব।’
মণিকঙ্কণা চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বলিল— ‘পাটরানীর কী নাম বললে? প-দ্মা-ল-য়া-ম্বি-কা!’
পিঙ্গলা বলিল— ‘তাঁর নাম পদ্মালয়া। কিন্তু তিনি যুবরাজ মল্লিকার্জুনকে গর্ভে ধারণ করেছেন। রাজবংশের নিয়ম, যে-রানী পুত্রবতী হবেন তাঁর নামের সঙ্গে’ ‘অম্বিকা’ শব্দ জুড়ে দেওয়া হবে।’
অতঃপর পিঙ্গলা ও আরো কয়েকজন রক্ষিণীকে সঙ্গে লইয়া মণিকঙ্কণা বাহির হইল।
সমুদ্রের বন্দরে যেমন অসংখ্য তরণী বাঁধা থাকে, রাজ পৌরভূমির বেষ্টনীর মধ্যে তেমনি অগণিত পৃথক প্রাসাদ। দ্বিভূমক ত্রিভূমক পঞ্চভূমক প্রাসাদ, অধিকাংশই আকারে বৃহৎ, দুই-একটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র প্রাসাদও আছে। দুইটি নূতন প্রাসাদ নির্মাণ হইতেছে; একটি বিদ্যুন্মালার জন্য, অন্যটি কুমার কম্পনদেব নিজের জন্য প্রস্তুত করাইতেছেন। তিনি বর্তমানে তাঁহার দুই ভার্যা লইয়া যে-প্রাসাদে আছেন তাহা অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র বলিয়া তিনি তাঁহার মর্যাদার উপযোগী মনে করেন না, তাই উচ্চতর ও বৃহত্তর প্রাসাদ নির্মাণ করাইতেছেন। রাজসভা হইতে অনতিদূরে একটি ক্ষুদ্র প্রাসাদে রাজ-পিতা বীরবিজয়দেব বাস করেন। তিনি অদ্যাপি জীবিত আছেন।
মণিকঙ্কণা কনিষ্ঠা রানীর তোরণ মুখে পৌঁছিবার পূর্বেই সেখানে সংবাদ গিয়াছিল। মণিকঙ্কণা দেহলিতে পদার্পণ করিয়া দেখিল, দ্বিতল হইতে সোপানশ্রেণী বাহিয়া জলপ্রপাতের মত এক ঝাঁক যুবতী নামিয়া আসিতেছে। সর্বাগ্রে দেবী বিলোলা, পিছনে সখিবৃন্দ।
ছোট রানী বিলোলাকে দেখিলে মনে হয় পনেরো বছরের কিশোরী মেয়ে। ছোটখাটো নিটোল পরিপুষ্ট গড়ন, সদ্য ফোটা মল্লীফুলের মত হাসিভরা মুখ; সে আসিয়া মণিকঙ্কণার সম্মুখে দাঁড়াইল, খিলখিল করিয়া হাসিয়া বলিল— ‘তুমি বুঝি নতুন ছোট রানী হবে?’
বিলোলাকে মণিকঙ্কণার ভাল লাগিল। সে বুঝিল, বিলোলা তাহাকে বিদ্যুন্মালা বলিয়া ভুল করিয়াছে। সে ভ্রম সংশোধন করিল না, একটু ঘাড় বাঁকাইয়া হাসিল, বলিল— ‘তা কি জানি!’
বিলোলা বলিল— ‘শুনেছি বিয়ের দেরি আছে। তা সে থাক। আজ আমার পুতুলের বিয়ে, তোমাকে নিমন্ত্রণ করলাম। চল, বিয়ে দেখবে।’
মণিকঙ্কণার হাত ধরিয়া বিলোলা উপরে লইয়া চলিল। ত্রিতলের বিশাল কক্ষে বিবাহ-বাসর। সোনার বর ও রূপার বধূ পাশাপাশি সিংহাসনে বসিয়াছে, দুইটি ক্ষুদ্রকায়া বালিকা চামর ঢুলাইতেছে। বর-বধূর সম্মুখে শত শত সুসজ্জিত পুত্তলিকা নানা প্রকার উপঢৌকন লইয়া দাঁড়াইয়া আছে। চারিদিকে বিচিত্র কর্মরত বিতস্তি-প্রমাণ পুতুলের ভিড়।
বিলোলা কক্ষে প্রবেশ করিয়া বলিল— ‘কই, বাজনা বাজছে না কেন?’
অমনি কক্ষের এক কোণ হইতে বেণু বীণা ও করতাল বাজিয়া উঠিল। কক্ষের মণ্ডপিত কোণে কয়েকটি যন্ত্র-বাদিকা বসিয়া ছিল, তাহাদের বাদ্যযন্ত্রের মধুর স্বনান কক্ষ পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল।
বিলোলা প্রশ্ন করিল— ‘কেমন বর-বধূ?’
মণিকঙ্কণা বলিল— ‘চমৎকার। যেমন বর তেমনি বধূ। কিন্তু আমি তো জানতাম না, ওদের জন্য যৌতুক আনিনি।’
বিলোলা বলিল— ‘পরে পাঠিয়ে দিও। এখন বোসো, মিষ্টিমুখ করতে হবে। — ওরে, অতিথির জন্যে মিষ্টান্ন নিয়ে আয়।’
দুই দণ্ড পরে মণিকঙ্কণা আনন্দিত মনে বিলোলার নিকট হইতে বিদায় লইল। বিলোলা বলিল— ‘আবার এস।’
অতঃপর মহাদেবী পদ্মালয়াম্বিকার ভবন।
ইনিই পট্টমহিষী, একমাত্র রাজপুত্র মল্লিকার্জুনের জননী। পদ্মালয়া প্রগাঢ়যৌবনা, বয়স পঁচিশ বছর; রূপ দেখিয়া কালসর্পও মাথা নীচু করে। তাঁহার প্রকৃতিতে কিন্তু চপলতা বা ছেলেমানুষী নাই; সকল অবস্থাতেই একটি অবিচল স্থৈর্য বিরাজ করিতেছে। চোখ দু’টিতে শান্ত মনস্বিতার প্রভা; গম্ভীর মুখমণ্ডলে সুদূর একটি প্রসন্নতার আভাস লাগিয়া আছে।
তাঁহাকে দেখিয়া মণিকঙ্কণার চক্ষু সম্ভ্রমে ভরিয়া উঠিল, সে নত হইয়া তাঁহাকে পদস্পর্শ প্রণাম করিল। পদ্মালয়া হাত ধরিয়া তাহাকে তুলিলেন, স্মিতমুখে বলিলেন— ‘এস ভগিনী।’
পালঙ্কের পাশে বসিয়া দুই-চারিটি কথা হইল; প্রীতি-কোমল প্রশ্ন, শ্রদ্ধাবিগলিত উত্তর। পদ্মালয়া মণিকঙ্কণার প্রকৃতি বুঝিয়া লইলেন, চেটীকে ডাকিয়া বলিলেন— ‘মধুরা, মল্লিকার্জুনকে নিয়ে আয়।’
অদূরে উন্মুক্ত অলিন্দে কয়েকটি চেটীর মাঝখানে চার বছরের একটি বালক তীর-ধনুক লইয়া খেলা করিতেছিল। বেত্রনির্মিত ক্ষুদ্র ধনু দিয়া হুলবিহীন তুক্ক বাণ এদিক-ওদিক নিক্ষেপ করিতেছিল। বনচারী রামচন্দ্রের ন্যায় বেশ, মাথার চুল চূড়া করিয়া বাঁধা। মাতার আহ্বান শুনিয়া মল্লিকার্জুন ধনুক স্কন্ধে লইল, তারপর সৈনিকের মত দৃঢ়পদে মাতার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল।
পদ্মালয়া বলিলেন— ‘ইনি আমার ভগিনী, এঁকে নমস্কার কর।’
মল্লিকার্জুন অমনি করতল যুক্ত করিয়া মস্তক অবনত করিল।
বালক মল্লিকার্জুনের শিরীষ-কোমল কান্তি ও মধুর ভাবভঙ্গি দেখিয়া মণিকঙ্কণা মুগ্ধ হইয়া গিয়াছিল, সে মল্লিকার্জুনের সম্মুখে নতজানু হইয়া তাহাকে দুই বাহু দিয়া আবেষ্টন করিয়া লইল, স্নেহ-গদ্গদ কণ্ঠে বলিল— ‘কী সুন্দর আমাদের পুত্র! দেবি, আমি যদি মাঝে মাঝে এসে ওকে দেখে যাই তাহলে আপনি রাগ করবেন কি?’
পদ্মালয়া দেখিলেন, মণিকঙ্কণার মন বাৎসল্য রসে আর্দ্র হইয়াছে। তিনি স্মিতমুখে বলিলেন— ‘যখন ইচ্ছা এস।’
মহারাজ দেবরায়ের হৃদয়ে প্রচুর স্নেহরস ছিল। তাঁহার কর্মবহুল ভাবনাবহুল জীবনের কেন্দ্রস্থলে অধিষ্ঠিত ছিল এই স্নেহবস্তুটি।
তাঁহার সর্বপ্রধান প্রেমাস্পদ ছিল বিজয়নগর রাজ্য। তিনি যুদ্ধ করিতেও ভালবাসিতেন; কিন্তু কেবল যুদ্ধের জন্যই যুদ্ধ ভালবাসিতেন না, রাজ্যের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের জন্য যুদ্ধবিদ্যা আয়ত্ত করিয়াছিলেন। প্রজাদের প্রতি আন্তরিক প্রীতি যাহার নাই সে কখনো আদর্শ রাজা হইতে পারে না। দেবরায় প্রজাদের প্রাণাধিক ভালবাসিতেন।
ব্যক্তিগত জীবনে তাঁহার স্নেহের পাত্র-পাত্রী ছিল অসংখ্য। যে সকল নরনারী তাঁহার সেবা করিত তাহাদের তিনি সর্বদা স্নেহরসে সিঞ্চিত করিয়া রাখিতেন। লক্ষ্মণ মল্লপ প্রমুখ মন্ত্রিগণ একবার তাঁহার বিশ্বাস লাভ করিতে পারিলে আর কখনো তাঁহার স্নেহাশ্রয় হইতে চ্যুত হইতেন না। এতদ্ব্যতীত তাঁহার নিকটতম পারিবারিক চক্রের মধ্যে ছিলেন তাঁহার পিতা বীরবিজয়রায়, দুই ভ্রাতা বিজয়রায় ও কম্পনরায়, তিনটি রানী এবং পুত্র মল্লিকার্জুন।
পিতার সহিত মহারাজ দেবরায়ের সম্বন্ধ ছিল বিচিত্র। বীরবিজয় নির্লিপ্ত স্বভাবের মানুষ ছিলেন; তিনি নানা প্রকার অন্নব্যঞ্জন রন্ধন করিতে ভালবাসিতেন। তিনি বিপত্নীক; ইহাই ছিল তাঁহার জীবনের একমাত্র বিলাস। ছয় মাস রাজত্ব করিবার পর তিনি দেখিলেন, রন্ধনকার্যে বিশেষ বিঘ্ন ঘটিতেছে; তিনি জ্যেষ্ঠ পুত্র দেবরায়কে সিংহাসনে বসাইয়া নিজে রন্ধনকর্মে মনোনিবেশ করিলেন। দেবরায়কে তিনি ভালবাসিতেন; দ্বিতীয় পুত্র বিজয়ের প্রতি তাঁহার মন ছিল নিরপেক্ষ, এবং কনিষ্ঠ পুত্র কম্পনকে তিনি গভীরভাবে বিদ্বেষ করিতেন। পৌরজন আড়ালে তাঁহাকে পাগলাপ্পা বা পাগলা-বাবা বলিত। মহারাজ দেবরায় পিতৃদেবকে বিশেষ ভক্তিশ্রদ্ধা করিতেন না বটে, কিন্তু ভালবাসিতেন। বীরবিজয় মাঝে মাঝে পুত্রের ভবনে আবির্ভূত হইয়া পুত্রকে স্বহস্তে প্রস্তুত মিষ্টান্ন খাওয়াইতেন, কিছু জ্ঞানগর্ভ উপদেশ দিতেন এবং কনিষ্ঠ ভ্রাতার নানা দূরভিসন্ধি সম্পর্কে সতর্ক করিয়া দিতেন। রাজা তদ্গতভাবে পিতৃবাক্য শ্রবণ করিতেন এবং মনে মনে হাসিতেন।
রাজার মধ্যম ভ্রাতা বিজয়রায় ছিলেন অবিমিশ্র যোদ্ধা। প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা যাইতে পারে যে বিজয়নগরের রাজপরিবারে নামের বৈচিত্র্য ছিল না; একই নাম— হরিহর বুক্ক কম্পন বিজয় দেবরায়— বার বার ফিরিয়া আসিত। প্রভেদ দেখাইবার জন্য ঐতিহাসিকেরা ‘প্রথম’ ‘দ্বিতীয়’ প্রভৃতি উপসর্গের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। রাজভ্রাতা বিজয় যুদ্ধ করিতে ভালবাসিতেন এবং নিপুণ সেনাপতি ছিলেন। তাঁহার অবশ্য একটি পত্নী ছিলেন, কিন্তু পত্নীকে রাজ অবরোধে রাখিয়া তিনি দেশ হইতে দেশান্তরে সৈন্যদল লইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেন; কদাচিৎ রাজধানীতে ফিরিয়া দু’চার দিন পত্নীর সহিত যাপন করিয়া আবার বাহির হইয়া পড়িতেন। মহারাজ দেবরায় এই ভ্রাতাটিকে কেবল ভালই বাসিতেন না, শ্রদ্ধাও করিতেন। এমন অনন্যমনা একনিষ্ঠ যোদ্ধাকে শ্রদ্ধা না করিয়া উপায় নাই।
বিজয়রায় বর্তমানে রাজ্যের দক্ষিণ প্রান্তে কয়েকজন বিদ্রোহী হিন্দু সামন্ত রাজাকে দমন করিতে ব্যস্ত আছেন। সপ্তাহের মধ্যে দুই-তিন বার অশ্বারোহী বার্তাবহ আসিয়া রাজাকে যুদ্ধের সংবাদ দিয়া যায়। রাজাও বার্তা প্রেরণ করেন। রাজধানী হইতে যুদ্ধক্ষেত্র অশ্বপুষ্ঠে দুই দিনের পথ। যাইতে একদিন ও ফিরিতে একদিন।
কনিষ্ঠ ভ্রাতা কম্পনদেবের প্রতি মহারাজের প্রীতি সর্বজনবিদিত। তাঁহার স্নেহ প্রায় বাৎসল্য পর্যায়ে গিয়া পড়িয়াছে। পিতার নিয়মিত সতর্কবাণী এবং মন্ত্রী লক্ষ্মণ মল্লপের নীরব অসমর্থন তাঁহার মোহভঙ্গ করিতে পারে নাই।
তিনটি রানীর প্রতি তাঁহার প্রেম সম্পূর্ণ পক্ষপাতশূন্য, হৃদয়াবেগের আধিক্য নাই। পুত্র মল্লিকার্জুন তাঁহার নয়নমণি।
এই স্নেহসর্বস্ব অপিচ বজ্রাদপি কঠোর রাজাটিকে প্রজারা যেমন ভালবাসিত, শত্রুরা তেমনি ভয় করিত।
বিজয়নগর রাজ্যে কেবল একজন মহারাজ দেবরায়কে ভালবাসিতেন না, তাঁহার নাম কুমার কম্পনদেব। ইহাতে বিস্মিত হইবার কিছু নাই। দেবরায় কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে ভালবাসিতেন বলিয়া কনিষ্ঠ ভ্রাতাও তাঁহাকে ভালবাসিবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নাই। বিশেষত স্নেহ স্বভাবতই নিম্নগামী, তাহাকে ঊর্ধ্বগামী হইতে বড় একটা দেখা যায় না।
কম্পনদেবের প্রকৃতি ছিল লোভী কুটিল উচ্চাকাঙ্ক্ষী; তদুপরি রাজার কাছে অত্যধিক আদর পাইয়া তিনি অতিমাত্রায় অহঙ্কারী হইয়া উঠিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার অহঙ্কার বাক্যে বা ব্যবহারে প্রকাশ পাইত না; রাজার প্রতি মিষ্ট ও সহৃদয় ব্যবহারে তিনি তাঁহাকে বশীভূত করিয়াছিলেন। মনে মনে সিংহাসনের প্রতি তাঁহার লোভ ছিল, কিন্তু সে লোভ তিনি ইঙ্গিতেও প্রকাশ করিতেন না; রাজ-সভাসদ্গণের মধ্যে তাঁহার অন্তরঙ্গ কেহ ছিল না। বয়সে তরুণ হইলে কি হয়, মনোগত অভীপ্সা গোপন করিবার দক্ষতা তাঁহার ছিল।
কম্পনদেবের দুইটি পত্নী— কৃষ্ণা দেবী ও গিরিজা দেবী; দু’টিই সুন্দরী ও রাজকুলোদ্ভবা। কম্পনদেব ইচ্ছা করিলে আরো দশটা বিবাহ করিতে পারেন, কেহ বাধা দিবে না। রাজার অজস্র প্রসাদ তাঁহার মাথায় সর্বদা বর্ষিত হইতেছে। তবু তাঁহার মনে তৃপ্তি নাই। তাঁহার উচ্চাশা কোনো দিকে পথ না পাইয়া শেষে তাঁহাকে এক নূতন কার্যে প্রবৃত্ত করিল; তিনি এমন এক গৃহ প্রস্তুত করিবেন যাহা দৈঘ্যে প্রস্থে উচ্চতায় রাজভবন অপেক্ষাও গরীয়ান হইবে। রাজার অনুমতি পাইয়া কুমার কম্পন নূতন অট্টালিকা নির্মাণে মনঃসংযোগ করিলেন।
নূতন অট্টালিকায় গৃহপ্রবেশের দিন আসন্ন হইয়াছে, এমন সময় একটি ব্যাপার ঘটিল। কম্পনদেব বিদ্যুন্মালাকে দেখিলেন। তারপর মণিকঙ্কণাকে দেখিলেন। কলিঙ্গের রাজকন্যা দু’টি শুধু অনিন্দ্য রূপসী নয়, তাঁহাদের আকৃতিতে অপূর্ব সম্মোহন, দুর্নিবার অনঙ্গশ্রী। লোভে কম্পনদেবের অন্তর লালায়িত হইয়া উঠিল। বাহিরে তাঁহার বিবেকহীন লালসা অল্পই প্রকাশ পাইল, কিন্তু তিনি মনে মনে সংস্কল্প করিলেন, যেমন করিয়া হোক ওই যুবতী দু’টিকে অঙ্কশায়িনী করিবেন। কিন্তু বলপ্রয়োগ চলিবে না, কূটকৌশল অবলম্বন আবশ্যক।
কম্পনদেবের কলাকৌশল কিন্তু সফল হইল না। বিদ্যুন্মালার চরিত্রে সন্দেহ আরোপের চেষ্টা ব্যর্থ হইল। কম্পনদেবের সহায়ক মিত্র কেহ ছিল না; কেবল ছিল কয়েকটি অনুগত ভৃত্য এবং মুষ্টিমেয় চাটুকার বয়স্য; তাই তাঁহার মাথায় বহু প্রকার কুবুদ্ধি খেলিলেও সেগুলিকে কার্যে পরিণত করিবার উপযোগী লোক কেহ ছিল না। তিনি সংবাদ পাইলেন রাজা বিদ্যুন্মালাকেই রাজবধূ করিবেন; সুতরাং সেদিকে কোনো আশা নাই। মণিকঙ্কণার জন্য রাজা উপযুক্ত পাত্রের চিন্তা করিতেছেন, মধ্যম ভ্রাতা বিজয়রায়ের কেবল একটি বধূ, মণিকঙ্কণা সম্ভবত তাঁহার ভাগেই পড়িবে। কম্পনদেবের অসন্তোষ এতদিন তুষানলের ন্যায় ধিকিধিকি জ্বলিতেছিল, এখন দাবানলের মত দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। রাজা হইয়া বসিতে না পারিলে জীবনে সুখ নাই।
নয়
একে একে দশ দিন কাটিয়া গেল। কিন্তু মহারাজের নিকট হইতে অর্জুনের আহ্বান আসিল না। যত দিন যাইতেছে অর্জুন ততই হতাশ হইয়া পড়িতেছে। রাজা কি তাহাকে মনে রাখিয়াছেন! রাজার সহস্র কাজ, সহস্র ভাবনা; তাহার মধ্যে সামান্য একজন সৈনিক পদপ্রার্থীর কথা তাঁহার মনে থাকিবে এরূপ আশা করাও অন্যায়। রাজাকে এই তুচ্ছ কথা স্মরণ করাইয়া দিতে যাওয়াও ধৃষ্টতা।
তবে এখন সে কী করিবে? এই দেশ, এই দেশের মানুষ তাহার চোখে ভাল লাগিয়াছে; এই দেশকে সে মাতৃভূমি রূপে হৃদয়ে বরণ করিয়া লইয়াছে। এখন সে কোথায় যাইবে? কোন্ বৃত্তি অবলম্বন করিয়া জীবনধারণ করিবে?
গত দশ দিন সে বলরামকে সঙ্গে লইয়া বিজয়নগরের সর্বত্র ঘুরিয়া বেড়াইয়াছে, এদেশের মানুষের স্বচ্ছন্দ নিরুদ্বেগ জীবনযাত্রার যে চিত্র দেখিয়াছে তাহাতে আনন্দ পাইয়াছে। কিন্তু যতই দিন কাটিতেছে, নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাবিয়া ততই সে উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিতেছে। স্বর্গে যদি স্থায়িভাবে থাকিতে না পারিলাম, তবে দু’দিনের অতিথি হইয়া লাভ কি!
সেদিন তাহারা নগর ভ্রমণে বাহির হয় নাই, অতিথি-ভবনেই বিরস মন লইয়া বসিয়া ছিল। বাক্যালাপের স্রোতে মন্দা পড়িয়াছে; বলরাম খুব কথা বলিতে পারে, কিন্তু আজ তাহার বাক্-যন্ত্র নিস্তেজ। মাঝে মাঝে দু’একটা অসংলগ্ন কথা বলিয়া সে চুপ করিয়া যাইতেছে।
আজ বিদ্যুন্মালা ও মণিকঙ্কণা কখন পম্পাপতির মন্দিরে গিয়াছেন, দেখা হয় নাই।
দ্বিপ্রহরে তাহারা স্নানাহার করিতে গেল। অন্য সহযাত্রী অতিথিদের মধ্যে বসিয়া আহার করিল। সকলেই নিজেদের মধ্যে নানা জল্পনা করিতে করিতে আহার করিতেছে, কেহ ঘোড়ার মত প্রকাণ্ড ছাগল দেখিয়াছে, তাহারই উত্তেজিত বর্ণনা দিতেছে; কেহ তুরাণী সৈনিকদের সঙ্গে আলাপ করিয়াছে, তাহাদের বিচিত্র ভাষা ও ভাবভঙ্গি অনুকরণ করিয়া দেখাইতেছে। সকলের মনই ভাবনাহীন, এদিকে রাজকীয় দাক্ষিণ্যের জোয়ার পূর্ণবেগে প্রবাহিত হইতেছে, ভাটার কোনো লক্ষণ নাই। অর্জুন ও বলরাম নীরবে আহার শেষ করিয়া উঠিয়া আসিল।
কক্ষে ফিরিয়া বলরাম শয্যায় অঙ্গ প্রসারিত করিল, অর্জুন দেওয়ালে ঠেস দিয়া বসিল। কিছুক্ষণ কাটিয়া গেল।
দণ্ড দুই এইভাবে কাটিবার পর বলরাম প্রকাণ্ড হাই তুলিয়া বলিল— ‘ঘুম পাচ্ছে। দিবানিদ্রা ভাল নয়। চল, নৌকাগুলা দেখে আসি।’
গত দশ দিনের মধ্যে তাহারা একবার কিল্লাঘাটে গিয়া নৌকাগুলিকে পরিদর্শন করিয়া আসিয়াছে। অর্জুন স্তিমিত স্বরে বলিল— ‘চল।’
বলরাম উঠিয়া বসিবার উপক্রম করিতেছে এমন সময় দ্বারের কাছে একটি মূর্তি আসিয়া দাঁড়াইল। তাহাকে দেখিয়া বলরাম ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিল— ‘একি, বেঙ্কটাপ্পা যে! তারপর, খবর কি? অনেকদিন তোমাকে দেখিনি!’
দ্বারের নিকট দাঁড়াইয়া বেঙ্কটাপ্পা সলজ্জ হাসিল। তাহার মুখের বোকাটে ভাব আর নাই, সে বলিল— ‘আমি আপনাদের পিছনেই ছিলাম, আপনারা দেখতে পাননি।’ তারপর অর্জুনকে লক্ষ্য করিয়া বলিল— ‘আপনাকে মহারাজ স্মরণ করেছেন।’
অর্জুন বিদ্যুদ্বেগে উঠিয়া দাঁড়াইল— ‘মহারাজ আমাকে স্মরণ করেছেন!’
বেঙ্কটাপ্পা বলিল— ‘হ্যাঁ, মহারাজ বিরামকক্ষে আপনাকে দর্শন দেবেন। আপনি আসুন আমার সঙ্গে।’
অতর্কিত পরিস্থিতিতে পড়িয়া অর্জুন হঠাৎ দিশহারা হইয়া পড়িয়াছিল, বলরাম বেঙ্কটাপ্পাকে বলিল— ‘ভাল ভাল। আমরা যা অনুমান করেছিলাম তা মিথ্যা নয়। ভাই বেঙ্কটাপ্পা, তুমি সত্যিই একজন রাজপুরুষ, ভবঘুরে নয়।’
বেঙ্কটাপ্পা আবার সলজ্জ হাসিল। অর্জুন বলিল— ‘তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি এখনি তৈরি হয়ে নিচ্ছি।’
বেঙ্কটাপ্পা দ্বারের পাশে সরিয়া গেল। অর্জুন ত্বরিতে বস্ত্র পরিবর্তন করিয়া উত্তরীয় স্কন্ধে লইল। ঘরের কোণে লাঠি দুটি দাঁড় করানো ছিল, সে-দু’টি হাতে লইয়া দ্বারের দিকে অগ্রসর হইলে বলরাম তাহার কাছে আসিয়া হ্রস্বকণ্ঠে বলিল— ‘লাঠি নিয়ে যাচ্ছ যাও, কিন্তু রাজার কাছে বোধহয় লাঠি নিয়ে যেতে দেবে না। — সে যা হোক, রাজার প্রসন্নতা যদি পাও, আমার কথা ভুলো না ভাই।’
অর্জুন বলিল— ‘ভুলব না। আগে দেখি রাজা কী জন্য ডেকেছেন।’
সভাগৃহের দ্বিতলে মহারাজ দেবরায় পালঙ্কে অর্ধশয়ান হইয়া মন্থরভাবে তাম্বূল চর্বণ করিতেছিলেন। পালঙ্কের পাশে ভূমিতলে আসন গতিয়া বসিয়া লক্ষ্মণ মল্লপ নির্বিকার মুখে সুপারি কাটিতেছিলেন এবং মাঝে মাঝে এক টুকরা সুপারি মুখে ফেলিয়া চিবাইতেছিলেন। কক্ষটি শীতল ও ছায়াচ্ছন্ন, অন্য কেহ উপস্থিত নাই। তবে দ্বারের বাহিরে প্রতিহারিণী আছে।
রাজা ও মন্ত্রীর মধ্যে বিশ্রম্ভালাপ হইতেছিল।
রাজা বলিলেন— ‘আহমদ শা অনেকদিন চুপ করে আছে। আমার মন বলছে তার মতলব ভাল নয়। এতদিন চুপ করে বসে থাকার ছেলে সে নয়।’
লক্ষ্মণ মল্লপ পানের বাটা হইতে এক খণ্ড হরীতকী বাছিয়া লইয়া মুখে দিলেন, বলিলেন— ‘তা বটে। কিন্তু বহমনী রাজ্যে আমাদের যে গুপ্তচর আছে তারা জানাচ্ছে, ওখানে যুদ্ধের কোনো আয়োজন নেই। সিপাহীরা ছাউনিতে বসে গোস্ত-রুটি খাচ্ছে আর হুল্লোড় করে বেড়াচ্ছে।’
দেবরায় বলিলেন— ‘ওরা ধূর্ত এবং শঠ; কপটতাই ওদের প্রধান অস্ত্র। ওদের বিরুদ্ধে লড়তে হলে আমাদেরও কপট এবং শঠ হতে হবে; ধর্মযুদ্ধ চলবে না। যুদ্ধে আবার ধর্ম কী? যুদ্ধ কর্মটাই তো অধর্ম। ধর্মযুদ্ধ করতে গিয়েই ভারতবর্ষ উৎসন্ন গেল।’
মন্ত্রী বলিলেন— ‘সত্য কথা। ছলে বলে কৌশলে বিজয় লাভ করাই যুদ্ধের ধর্ম, অন্য ধর্ম এখানে অচল। মুসলমানেরা এই মূল কথাটা জানে বলেই বার বার হিন্দুদের যুদ্ধে পরাজিত করেছে।’
রাজা বলিলেন— ‘আমার বিশ্বাস আহমদ শা আমাদের গুপ্তচরদের চোখে ধুলো দিয়ে চুপি চুপি গুপ্ত-আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।’
লক্ষ্মণ মল্লপ বলিলেন— ‘আমরা প্রস্তুত আছি। আমাদের এগারো লক্ষ সৈন্যের মধ্যে মাত্র ত্রিশ হাজার সৈন্য কুমার বিজয়ের সঙ্গে দক্ষিণে আছে, বাকি সব তুঙ্গভদ্রার শতক্রোশব্যাপী তীর সীমান্তে থানা দিয়ে বসে আছে। যবনের সাধ্য নেই তাদের ভেদ করে রাজ্য আক্রমণ করে।’
রাজা ঈষৎ হাসিলেন— ‘আমি জানি আমরা প্রস্তুত আছি। তবু সতর্কতা শিথিল করা চলবে না। প্রস্তুত থাকা অবস্থাতেও নিশ্চিন্ততা আসে। দু’এক দিনের মধ্যে আমি উত্তর সীমান্তে সেনা পরিদর্শনে যাব।’
এই সময় কক্ষদ্বারের প্রহরিণী দ্বারমুখে দাঁড়াইয়া জানাইল যে, অর্জুনবর্মা আসিয়াছে।
রাজা বলিলেন— ‘পাঠিয়ে দাও।’
অর্জুন প্রবেশ করিয়া যথারীতি ঊর্ধ্ববাহু হইয়া প্রণাম করিল। বলা বাহুল্য, লাঠি দু’টি তাহাকে বাহিরে রাখিয়া আসিতে হইয়াছিল। রাজার সকাশে অস্ত্র লইয়া গমন নিষিদ্ধ।
দেবরায় অর্জুনকে বসিতে ইঙ্গিত করিলেন, সে পালঙ্কের পায়ের দিকে ভূমিতে বসিল। রাজা স্নিগ্ধ হাসিয়া বলিলেন— ‘অতিথিশালায় সুখে আছ?’
অর্জুন বলিল— ‘আছি মহারাজ।’
রাজা বলিলেন— ‘নগর পরিভ্রমণ করেছ শুনলাম। কেমন দেখলে?’
অর্জুন উচ্ছ্বসিত হইয়া নগরের প্রশংসা করিতে চাহিল, কিন্তু উচ্ছ্বাস তাহার কণ্ঠ দিয়া বাহির হইল না। সে ক্ষীণস্বরে বলিল— ‘ভাল মহারাজ।’
‘যে লোকটি তোমার সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় সে কে?’
অর্জুন দেখিল বেঙ্কটাপ্পার কৃপায় তাহার গতিবিধি কিছুই রাজার অগোচর নয়, সে বলিল— ‘তার নাম বলরাম কর্মকার, বাংলা দেশের মানুষ। রাজকুমারীদের সঙ্গে নৌকায় এসেছে। আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে।’
রাজা তখন বলিলেন— ‘সে থাক। তুমি আমার সৈন্যদলে যোগ দিতে চাও। পূর্বে কখনো যুদ্ধ করেছ?’
‘না আর্য। কার পক্ষে যুদ্ধ করব?’
‘যবন সৈন্যদলে হিন্দু সৈনিকও আছে। — তুমি অবশ্য ভল্ল ও অসি চালনা জানো। আমার পদাতি এবং অশ্বারোহী দুই শ্রেণীর সৈন্যদল আছে। তুমি কোন্ দলে যোগ দিতে চাও?’
অর্জুন যুক্তকরে বলিল— ‘মহারাজের যেরূপ ইচ্ছা। আমি অশ্ব চালাতে জানি, কিন্তু আমি আর একটি বিদ্যা জানি মহারাজ, যার বলে ঘোড়ার চেয়েও শীঘ্র যেতে পারি।’
লক্ষ্মণ মল্লপ মুখ তুলিলেন। রাজা ঈষৎ ভ্রূভঙ্গি করিয়া বলিলেন— ‘সে কেমন?’
অর্জুন বলিল— ‘দু’টি লাঠির উপর ভর দিয়ে আমি দ্রুততম অশ্বকেও পিছনে ফেলে যেতে পারি।’
রাজা উঠিয়া বসিলেন— ‘লাঠির উপর ভর দিয়ে! এ কেমন বিদ্যা আমাকে দেখাতে পারো?’
অর্জুন বলিল— ‘আজ্ঞা এখনি দেখাতে পারি। আমার লাঠি দু’টি সঙ্গে এনেছিলাম। কিন্তু প্রতিহারিণী কেড়ে নিয়েছে।’
রাজা করতালি বাজাইলেন, প্রহরিণী দ্বার-সম্মুখে আবির্ভূতা হইল।
রাজা বলিলেন— ‘অর্জুনবর্মার লাঠি নিয়ে এস।’
অবিলম্বে লাঠি লইয়া প্রহরিণী ফিরিয়া আসিল, অর্জুনের হাতে দিয়া প্রস্থান করিল।
রাজা বলিলেন— ‘এবার দেখাও।’
অর্জুন উত্তরীয়টি স্কন্ধ হইতে লইয়া কোমরে জড়াইল; দৃঢ়বদ্ধ উন্নত বক্ষ অনাবৃত হইল। তারপর সে গ্রন্থিযুক্ত দীর্ঘ বংশযষ্টি দু’টি দুই হাতে ধরিয়া দুই পায়ের সম্মুখে দাঁড় করাইল। ডান পায়ের অঙ্গুষ্ঠ ও অঙ্গুলি দিয়া বংশদণ্ডের একটি গ্রন্থি চাপিয়া ধরিয়া ক্ষিপ্রভাবে বংশের উপর উঠিয়া পড়িল, সঙ্গে সঙ্গে অন্য বংশদণ্ডটি বাঁ পায়ে সংযুক্ত করিল। এইভাবে অর্জুন দুই বংশদণ্ড দ্বারা পদযুগলকে লম্বমান করিয়া দীর্ঘজঙ্ঘ সারস পক্ষীর ন্যায় বিশাল কক্ষে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল।
রাজা উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিলেন। লক্ষ্মণ মল্লপও হাসিলেন। ব্যাপারটি যুগপৎ হাস্য ও বিস্ময় উৎপাদক। অর্জুন যষ্টিদণ্ড হইতে অবতরণ করিয়া রাজার সম্মুখে দাঁড়াইল।
রাজা বলিলেন— ‘তুমি এই লাঠিতে চড়ে ঘোড়ার চেয়ে জোরে ছুটতে পারো?’
অর্জুন সবিনয়ে বলিল— ‘পারি মহারাজ।’
‘চমৎকার!’ মহারাজের চোখে চিন্তার ছায়া পড়িল; তিনি কিয়ৎকাল অর্জুনের মুখের উপর চক্ষু রাখিয়া চিন্তা করিলেন, শেষে বলিলেন— ‘পরীক্ষা করা প্রয়োজন। অর্জুনবর্মা, তুমি আজ যাও, কাল প্রাতঃকালে সূর্যোদয়ের পূর্বে এখানে এসে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। তোমাকে একটা বিশেষ কাজে পাঠাব।’
উল্লসিত মুখে অর্জুন বলিল— ‘যথা আজ্ঞা মহারাজ।’
দুই পা গিয়া আবার রাজার দিকে ফিরিল, কুন্ঠিত মুখে বলিল— ‘আর্য, ক্ষমা করবেন। আমাকে যখন অনুগ্রহ করেছেন তখন আমার বন্ধু বলরামের কথা বলতে সাহস পাচ্ছি। বলরামের কথা আগে বলেছি; সে লৌহকর্মে নিপুণ। তারও কিছু গুপ্তবিদ্যা আছে, মহারাজকে নিবেদন করতে চায়।’
রাজা বলিলেন— ‘ভাল ভাল, তোমার বন্ধুর নিবেদন পরে শুনব। তুমি কাল প্রত্যূষে লাঠি নিয়ে আসবে।’
‘আজ্ঞা আসব।’
অর্জুন প্রস্থান করিলে রাজা ও মন্ত্রী দৃষ্টি বিনিময় করিলেন। রাজা বলিলেন— ‘অর্জুনবর্মা যদি লাঠিতে চড়ে ঘোড়ার চেয়ে দ্রুত যেতে পারে তাহলে ওকে দিয়ে দৌত্যের কাজ আরো ভালো হবে। এমন কি ওর দেখাদেখি দণ্ডারোহী দূতের দল তৈরি করা যেতে পারে।’
‘আজ্ঞা আমিও তাই ভাবছিলাম!’ লক্ষ্মণ মল্লপ ক্ষণেক নীরব থাকিয়া বলিলেন— ‘গুলবর্গার সংবাদ অর্জুনবর্মাকে বলা হল না।’
দেবরায়ের মুখ গম্ভীর হইল, তিনি বলিলেন— ‘বলব স্থির করেই তাকে ডেকেছিলাম, কিন্তু বলতে পারলাম না, মায়া হল। কাল ওকে দক্ষিণে বিজয়ের কাছে পাঠাব। সেখান থেকে ফিরে আসুক, তারপর গুলবর্গার খবর বলব।’
বলা বাহুল্য, এই দশ দিন দেবরায় নিশ্চেষ্ট ছিলেন না, গুলবর্গায় গুপ্তচর পাঠাইয়া অর্জুন সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করিয়াছিলেন, তারপর তাহাকে ডাকিয়া পঠাইয়াছিলেন। অর্জুন যাহা বলিয়াছিল সমস্তই সত্য।
সেদিন সন্ধ্যাকালে দুই বন্ধু সাজসজ্জা করিয়া নগর পরিভ্রমণে বাহির হইল। একজন রাজ-অনুগ্রহ লাভ করিয়াছে, অন্যজন শীঘ্রই করিবে। আহ্লাদে দু’জনের হৃদয়ই ডগমগ।
পান-সুপারি রাস্তা ছাড়াইয়া তাহারা নগর পট্টনে উপস্থিত হইল। এখানে ফুলের দোকানে মালা কিনিয়া গলায় পরিল, কপিত্থগন্ধী তক্র পান করিল, পানের দোকানে গিয়া পান চাহিল।
পানের দোকানের সামনে দাঁড়াইয়া তিনটি তরুণ যুবক নিজেদের মধ্যে হাস্য-পরিহাস করিতেছিল। ইহারা বিলাসী নাগরিক নয়, মধ্যম শ্রেণীর গৃহস্থ পর্যায়ের লোক। অর্জুন ও বলরাম দোকানে উপস্থিত হইবার পর আর একটি যুবক আসিয়া পূর্বতন যুবকদের সঙ্গে যোগ দিল। উত্তেজিত স্বরে বলিল— ‘শীঘ্র পান খাওয়াও। বড় বিপদে পড়েছি।’
তিনজনে সমস্বরে বলিল— ‘কি হয়েছে?’
নবাগত যুবক বলিল— ‘বামনদেব দৈবজ্ঞের কাছে হাত দেখাতে গিয়েছিলাম। হাত দেখে কি বলল, জানো? বলল, আমার সাতটা বিয়ে হবে আর পঁয়ত্রিশটা মেয়ে হবে। ছেলে একটাও হবে না। আমি এখন কী করি?’
সকলে হাসিয়া উঠিল। তাম্বূল-পসারিণী বিপন্ন যুবককে পান দিয়া হাসিমুখে বলিল— ‘শিখিধ্বজের মন্দিরে পূজা দাও, তা হলেই ছেলে হবে।’
যুবক পান মুখে পুরিয়া বলিল— ‘বাজে কথা বোলো না। আমার এখনো একটাও বিয়ে হয়নি, ছেলে হবে কেত্থেকে!’
হাস্য-কৌতুকের মধ্যে বলরাম জিজ্ঞাসা করিল— ‘বামনদেব দৈবজ্ঞ কোথায় থাকেন?’
যুবক অঙ্গুলি দেখাইয়া বলিল— ‘ওই যে রামস্বামীর মন্দির, ওর পাশেই পণ্ডিতের বাসা। আপনিও কি জানতে চান ক’টা মেয়ে হবে?’
‘আগে দেখি কটা বিয়ে হয়।’ বলরাম পান লইয়া অর্জুনকে টানিয়া লইয়া চলিল।
অর্জুন বলিল— ‘সত্যিই কি হাত দেখাবে নাকি!’
বলরাম বলিল— ‘দোষ কি! একটা নতুন কিছু করা যাক।’
বামন পণ্ডিত নিজ গৃহের বহিঃচত্বরে অজিনাসন পাতিয়া বসিয়া ছিলেন। স্থূলকায় প্রৌঢ় ব্যক্তি, স্কন্ধে উপবীত, মুণ্ডিত মুখে তীক্ষ্ণায়ত চক্ষু, মাথার চারিপাশ ক্ষৌরিত, মাঝখানে সমস্তটাই শিখা।
বলরাম অর্জুন তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া যুক্তপাণি হইল। পণ্ডিত একে একে তাহাদের পরিদর্শন করিয়া বলিলেন— ‘তোমারা দেখছি ভাগ্যান্বেষী বিদেশী। করকোষ্ঠী দেখাতে চাও?’
‘আজ্ঞা।’
দৈবজ্ঞ প্রথমে অর্জুনের হাত টানিয়া লইয়া কররেখা পরীক্ষা করিলেন, বেশ কিছুক্ষণ দেখিলেন, বয়স জিজ্ঞাসা করিলেন। তারপর হাত ছাড়িয়া দিয়া বলিলেন— ‘জলমজ্জন যোগ ছিল, কেটে গেছে। তোমার জীবন এখন এক সঙ্কটময় দশার ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। পিছনে বিপদ, সামনে বিপদ, কি হয় বলা যায় না। তুমি আগামী শ্রাবণী অমাবস্যার পর আমার কাছে এস, তখন আবার হাত দেখব।’
অর্জুন বিমর্ষ মুখে বলরামের পানে চাহিল। বলরাম তাড়াতাড়ি দৈবজ্ঞের দিকে হাত বাড়াইয়া দিয়া বলিল— ‘আমার হাতটাও একবার দেখুন। আমরা দুই বন্ধু।’
বামনদেব হাত দেখিয়া বলিলেন— ‘তোমার হাত মন্দ নয়, দুঃখ কষ্ট অনেকটা কেটে এসেছে; তবে স্বদেশে আর কখনো ফিরতে পারবে না, বিদেশে সুখ-সম্পদ দারা-পুত্র লাভ করবে। তোমরা দু’জনে বন্ধু? তাহলে একটা কথা বলে রাখি। — তোমরা দু’জন যদি একসঙ্গে থাকো তাহলে তোমার বন্ধুর অনেক রিষ্টি কেটে যাবে। কিন্তু তোমার কিছু অনিষ্ট হতে পারে। এখন আর কিছু বলব না, শ্রাবণ মাসে আবার এস।’
বলরাম প্রণামী দিতে গেল, কিন্তু বামনদেব লইলেন না, বলিলেন— ‘শ্রাবণ মাসে প্রণামী দিও।’
দুই বন্ধু বিষণ্ণচিত্তে ফিরিয়া চলিল। বলরামের মনে অনুতাপ হইতে লাগিল, লঘুচিত্ত লইয়া দৈবজ্ঞের কাছে না যাইলেই ভাল হইত। কিন্তু তাই বা কেন? বিপদের কথা পূর্বাহ্ণে জানা থাকিলে সাবধান হওয়া যায়।
চলিতে চলিতে এক সময় অর্জুন বলিল— ‘আমার সঙ্গে থাকলে তোমার অনিষ্ট হতে পারে।’
বলরাম বলিল— ‘কিন্তু তোমার রিষ্টি কেটে যাবে। সুতরাং তোমার সঙ্গ ছাড়ছি না।’