গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

তুঙ্গভদ্রার তীরে – তৃতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব – এক

পরদিন অতি প্রত্যূষে উঠিয়া অর্জুন ধড়াচূড়া বাঁধিল, লাঠি হাতে লইয়া বলরামকে বলিল— ‘আমি চললাম। কোথায় যাচ্ছি, কবে ফিরব কিছুই জানি না।’

বলরাম বলিল— ‘দুর্গা দুর্গা। আমি সঙ্গে যেতে পারলে ভাল হতো। যা হোক, সাবধানে থেকো। দুর্গা দুর্গা।’

বাহিরে তখনো রাত্রির ঘোর কাটে নাই। সভাগৃহের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া অর্জুন দেখিল, সেখানে মানুষ কেহ উপস্থিত নাই, কেবল দু’টি ঘোড়া পাশাপাশি দাঁড়াইয়া আছে। রাজমন্দুরার তেজস্বী অশ্ব, পক্ক তিন্তিড়ী ফুলের ন্যায় বর্ণ, পিঠে কম্বলের আসন, মুখে বল্‌গা। ঘোড়া দু’টি নিশ্চল দাঁড়াইয়া আছে, কেবল তাহাদের কর্ণ সম্মুখে ও পিছনে নড়িতেছে। অর্জুনকে তাহারা চোখ বাঁকাইয়া দেখিল ও অল্প নাসাধ্বনি করিল।

অর্জুন দাঁড়াইয়া রহিল। সভাগৃহে সাড়াশব্দ নাই। কিছুক্ষণ পরে বাহিরের দিক হইতে এক মনুষ্যমূর্তি দেখা দিল। কৃশ খর্বাকৃতি মানুষটি, মাথায় বৃহৎ পাগড়ি, কোমরে তরবারি, বয়স অর্জুন অপেক্ষা ছয়-সাত বছরের জ্যেষ্ঠ। সে কাছে আসিয়া অর্জুনকে সন্দিগ্ধ অপাঙ্গদৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল।

তারপর সভাগৃহের দ্বিতল হইতে পিঙ্গলা আসিয়া জানাইল, মহারাজ দু’জনকেই আহ্বান করিয়াছেন।

মহারাজ দেবরায় ইতিমধ্যে প্রাতঃস্নানপূর্বক দেবপূজা সমাপন করিয়াছেন; সূর্যোদয়ের পূর্বেই রাজকার্য আরম্ভ হইয়া গিয়াছে।

অর্জুন ও দ্বিতীয় ব্যক্তি রাজার বিরামকক্ষে উপস্থিত হইয়া দেখিল, মহারাজ পালঙ্কের উপর উপবিষ্ট; তাঁহার সম্মুখে দুইটি কুণ্ডলিত জতুমুদ্রাঙ্কিত পত্র। দুইজনে যথারীতি প্রণাম করিয়া রাজার সম্মুখে দাঁড়াইল। বলা বাহুল্য, অর্জুনের লাঠি ও দ্বিতীয় ব্যক্তির তরবারি প্রতিহারিণীর নিকট গচ্ছিত রাখিতে হইয়াছিল।

রাজা বলিলেন— ‘স্বস্তি। তোমাদের দু’জনকে একসঙ্গে দূত করে পাঠাচ্ছি কুমার বিজয়রায়ের কাছে। অনিরুদ্ধ, তুমি পথ চেনো, তুমি অর্জুনকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। পথে চটিতে ঘোড়া বদল করবে। এই নাও দু’জনে দুই পত্র, স্কন্ধাবারে পৌঁছে পত্র কুমার বিজয়ের হাতে দেবে। দুই পত্রের মর্ম যদিচ একই, তবু দু’জনেই কুমার বিজয়কে পত্র দেবে। উত্তরে তিনি তোমাদের পৃথক পত্র দেবেন। সেই পত্র নিয়ে তোমরা ফিরে আসবে। একত্র আসার প্রয়োজন নেই, যে যত শীঘ্র পারবে ফিরে আসবে। আশু কর্মে তোমাদের পাঠাচ্ছি। মনে রেখো বিলম্বে কর্মহানির সম্ভাবনা।’

অনিরুদ্ধ রাজার হাত হইতে লিপি লইয়া নিজের পাগড়িতে বাঁধিয়া লইল; তাহার দেখাদেখি অর্জুনও লিপি পাগড়িতে বাঁধিল।

রাজা বলিলেন— ‘এই নাও, কিছু স্বর্ণমুদ্রা সঙ্গে রাখ, প্রয়োজন হতে পারে। দক্ষিণ দিকের তোরণ-রক্ষীদের বলা আছে, কেউ তোমাদের বাধা দেবে না। এখন যাত্রা কর। শুভমস্তু।’

রাজার নিকট বিদায় লইয়া দুইজনে অস্ত্রাদি উদ্ধার করিয়া নীচে নামিল। অশ্ব দু’টি পূর্ববৎ দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাদের পৃষ্ঠে আরোহণপূর্বক ঘোড়া ছুটাইয়া দিল।

তাহারা লক্ষ্য করিল না, এই সময়ে সভাগৃহের দ্বিতলের একটি গবাক্ষ দিয়া একজোড়া সদ্য-ঘুম-ভাঙ্গা রমণীচক্ষু নীচের দিকে চাহিয়া ছিল। চোখ দু’টি বড় সুন্দর, মুখখানির তুলনা নাই। অশ্বারোহীরা অন্তর্হিত হইলে কুমারী বিদ্যুন্মালার দুই ভ্রূর মাঝখানে একটু ভ্রূকুটির চিহ্ন দেখা দিল। তিনি অর্জুনবর্মাকে চিনিতে পারিয়াছিলেন। ভাবিলেন, অর্জুনবর্মা! কোথায় চলেছেন!

আজ ঘুম ভাঙ্গিয়া উঠিয়া বিদ্যুন্মালা অলস অর্ধ-প্রমীল মনে মহলের বাতায়নগুলির পার্শ্বে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলেন, সহসা একটি বাতায়ন দিয়া নীচের দৃশ্য চোখে পড়িল। তাঁহার সমগ্র চেতনা সজাগ ও উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল। কিন্তু তিনি কাহাকেও কোনো প্রশ্ন করিতে পারিলেন না, প্রশ্নগুলি মনের মধ্যেই রহিল। তারপর যথাসময় তিনি পম্পাপতির মন্দিরে গেলেন। সারা দিন মনটা উদাস বিভ্রান্ত হইয়া রহিল।

বেলা প্রথম প্রহর অতীতপ্রায়। নগরের সপ্ত প্রাকার পার হইয়া অর্জুন ও অনিরুদ্ধ উন্মুক্ত পথ দিয়া চলিয়াছে। অশ্ব দু’টি যুগ্ম শরের ন্যায় পাশাপাশি ছুটিতেছে, কেহ কাহাকেও অতিক্রম করিয়া যাইতে পারিতেছে না।

পথ অশ্মাচ্ছাদিত, শিলাবন্ধুর। নগর সীমানার বাহিরেও লোকালয় আছে, বিসর্পিল শৈলশ্রেণীর ফাঁকে ফাঁকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রাম দেখা যায়। পথের দুই পাশে তাপ-কৃশ ঝোপ-ঝাড় জঙ্গল; যেন পাথরের রাজ্যে উদ্ভিদ অনধিকার প্রবেশের চেষ্টা করিয়া হতাশ্বাস হইয়া পডিয়াছে।

আকাশে প্রখর সূর্য সত্ত্বেও অশ্বারোহীরা তাপে বিশেষ কষ্ট পাইতেছে না। মাথায় পাগড়ি আছে, উপরন্তু অশ্বের ধাবনজনিত বায়ুপ্রবাহ তাহাদের দেহ শীতল রাখিয়াছে।

দুইজনে পাশাপাশি চলিয়াছে বটে, কিন্তু বাক্যালাপ বেশি হইতেছে না। অনিরুদ্ধের মন খুব সরল নয়, তাহার সন্দেহ হইয়াছে রাজা তাহাকে সরাইয়া অর্জুনকে নিয়োগ করিতে চান; তাই অর্জুনের প্রতি তাহার মন বিরূপ হইয়া বসিয়াছে। অর্জুন তাহা বুঝিয়াছে, তাহাদের মাঝখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রচ্ছন্ন বিরোধ দেখা দিয়াছে।

এক সময় অনিরুদ্ধ বলিল— ‘তোমার নাম অর্জুন। তোমাকে আগে কখনো দেখিনি।’

অর্জুন আত্মপরিচয় দিয়া বলিল— ‘তোমাকেও আগে দেখিনি।’

অনিরুদ্ধ উদ্দীপ্ত কণ্ঠে বলিল— ‘তুমি নবাগত, তাই আমার নাম শোনোনি। আমি অনিরুদ্ধ, বিজয়নগরের প্রধান রাজদূত। দশ বছর এই কাজ করছি। আশু দৌত্যকার্যে আমার তুল্য আর কেউ নেই।’

বিরসভাবে অর্জুন বলিল— ‘ভাল। আমার সৌভাগ্য যে রাজা তোমাকে আমার সঙ্গে দিয়েছেন।’

কিন্তু বাক্যালাপে অর্জুনের মন নাই, তাহার মন ও চক্ষু পথের আশেপাশে চিহ্ন অনুসন্ধান করিয়া ফিরিতেছে। ওখানে ওই গিরিচূড়া বিচিত্র ভঙ্গিতে দাঁড়াইয়া আছে, এখানে পথের উপর দিয়া শীর্ণ জলধারা বহিয়া গিয়াছে। অদূরে ওই ভগ্নপ্রায় পাষাণমন্দিরের পাশ দিয়া পথ দ্বিধা বিভক্ত হইয়া গিয়াছে। অর্জুন মনে মনে স্থানগুলিকে চিহ্নিত করিয়া রাখিতে লাগিল। এই পথেই তাহাকে ফিরিতে হইবে।

‘তোমার হাতে লাঠি কেন?’

‘যার যেমন অস্ত্র, তোমার তলোয়ার আমার লাঠি।’

‘কিন্তু দু’টো লাঠির কী দরকার?’

অর্জুন একটু হাসিল— ‘একটা লাঠি দিয়ে লড়ব, সেটা ভেঙ্গে গেলে অন্য লাঠি দিয়ে লড়ব।’

অনিরুদ্ধের মন সন্তুষ্ট হইল না। তাহার সন্দেহ হইল, লাঠি দুইটির অন্য কোনো তাৎপর্য আছে।

দ্বিপ্রহরে তাহারা এক পান্থশালায় পৌঁছিল। পথের কিনারে ক্ষুদ্র প্রস্তরনির্মিত গৃহ, তাহার পাশে ছায়াশীতল একটি বৃহৎ বটবৃক্ষ। বৃক্ষতলে দুইটি অশ্ব বাঁধা রহিয়াছে।

একজন মধ্যবয়স্ক শিখাধারী লোক গৃহ হইতে বাহির হইয়া আসিল, বলিল— ‘অশ্ব প্রস্তুত, আহার প্রস্তুত। এস, বসে যাও।’ লোকটি অনিরুদ্ধকে চেনে।

দুইজনে অশ্ব হইতে নামিয়া গৃহে প্রবেশ করিল। ঘরে পীঠিকার সম্মুখে আহার্যের থালি, জলের ঘটি; ক্ষুধার্ত পিপাসার্ত দুইজনে বিনা বাক্যব্যয়ে বসিয়া গেল।

অর্ধ দণ্ডের মধ্যে আহার সমাপ্ত করিয়া তাহারা নূতন ঘোড়ার পিঠে চড়িয়া বসিল। প্রৌঢ় ব্যক্তি বলিল— ‘সেনাদলের ছাউনি আরো পূব দিকে সরে গেছে। সন্ধ্যার আগে পৌঁছুলে দূর থেকে ধোঁয়া দেখতে পাবে, রাত্রে পৌঁছুলে আগুন দেখতে পাবে। এখনো ত্রিশ ক্রোশ বাকি।’

আবার তাহারা বাহির হইয়া পড়িল।

দুই অশ্বারোহী যখন কুমার বিজয়ের স্কন্ধাবারে পৌঁছিল তখন সূর্যাস্ত হইয়া গিয়াছে। গোধূলির আলোয় সৈন্যাবাসটি দেখাইতেছে একটি বিরাট গো-গৃহের মত। অসংখ্য গরুর গাড়ি পাশাপাশি সাজাইয়া বিপুলায়তন একটি চক্র-ব্যূহ রচিত হইয়াছে; তাহার মধ্যে তালপত্রের ছত্রাকৃতি অগণিত ছাউনি। মধ্যস্থলে সেনাপতির জন্য বস্ত্রনির্মিত উচ্চ শিবির।

শকট-চক্রের একস্থানে একটু ফাঁক আছে; এই প্রবেশদ্বারের মুখে সশস্ত্র রক্ষী পাহারা দিতেছে, উপরস্তু একদল রক্ষী শকটবেষ্টনের বাহিরে পরিক্রমণ করিতেছে। পাছে শত্রুসৈন্য রাত্রিকালে আক্রমণ করে তাই সতর্কতা।

অনিরুদ্ধ ও অর্জুন স্কন্ধাবারে উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেনাপতির নিকট নীত হইল। বিজয়রায় তখন আহারে বসিয়াছিলেন। কিন্তু রাজদূত যখনই আসুক তৎক্ষণাৎ তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে হইবে, ইহাই রাজকীয় নিয়ম।

বস্ত্রাবাসের একটি বৃহৎ কক্ষে বিজয়রায় আহারে বসিয়াছিলেন। পীঠিকার সম্মুখে আট-দশটি থালিকা, থালিকাগুলিকে ঘিরিয়া দশ-বারোটি তৈলদীপ। ছয়জন পরিচারক পার্শ্বরক্ষী সম্মুখে ও পিছনে দাঁড়াইয়া পাহারা দিতেছে; তাহাদের কটিতে ছুরিকা।

বিজয়রায়ের আহার্যবস্তুর পরিমাণ যেমন প্রচুর, তেমনি অধিকাংশই আমিষ। সেই সঙ্গে কিছু ঘৃতপক্ক অন্ন ও এক ভৃঙ্গার দ্রাক্ষাসার। বিজয়রায় ম্লেচ্ছ রন্ধনপদ্ধতির পক্ষপাতী ছিলেন, তাই তাঁহার ভোজনপাত্রগুলিতে শোভা পাইতেছিল মেষমাংসের শূল্যপক্ক গুটিকা, কালিয়া সেক্‌চী দোল্‌মা সমোসা ইত্যাদি। একটি স্ফটিকের পাত্রে স্তূপীকৃত আঙ্গুর ফল।

বিজয়রায়ের আকৃতি মধ্যম পাণ্ডবের মত; ব্যূঢ়োরস্ক গজস্কন্ধ। জ্যেষ্ঠ দেবরায় ও কনিষ্ঠ কম্পনের সহিত তাঁহার আকৃতির সাদৃশ্য অতি অল্প। সঙ্গম বংশের প্রতিষ্ঠাতা হরিহর ও বৃকরায় সকল বিষয়ে অভেদাত্মা ছিলেন কিন্তু তাঁহাদের আকৃতি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। ভীমার্জুনের আকৃতির যে তফাত, হরিহর ও বৃকরায়ের আকৃতিতে সেইরূপ পার্থক্য ছিল; একজন সিংহ, অন্যজন হস্তী। তারপর পুরুষানুক্রমে এই দ্বিবিধ আকৃতি বার বার এই বংশে দেখা দিয়াছে। দেশের লোক হরিহররায় ও বৃকরায়কে স্নেহভরে হুক্ক-বুক্ক বলিয়া উল্লেখ করিত। দেবরায় ও বিজয়রায়কে দেখিয়া তাহারা নিজেদের মধ্যে সগর্বে বলাবলি করিত— হুক্ক-বুক্ক আবার ভ্রাতৃরূপে পুনর্জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন।

অনিরুদ্ধ ও অর্জুন বিজয়রায়ের সম্মুখে উপস্থিত হইলে তিনি বিশাল চক্ষু তুলিয়া তাহাদের পরিদর্শন করিলেন, তারপর বাঁ হাত বাড়াইয়া পত্র দু’টি গ্রহণ করিলেন, পত্রের জতুমুদ্রা অভগ্ন আছে কিনা পরীক্ষা করিয়া তিনি পত্র দু’টি মাথায় ঠেকাইলেন, তারপর একজন পরিচারকের দিকে চাহিলেন। পরিচারক আসিয়া একে একে পত্র দু’টির জতুমুদ্রা ভাঙ্গিয়া বিজয়রায়ের চোখের সম্মুখে মেলিয়া ধরিল। তিনি আহার করিতে করিতে পাঠ করিলেন।

পত্রে দূতদের সম্বন্ধে বোধহয় কিছু লেখা ছিল। পত্র পাঠান্তে বিজয়রায় উভয়ের প্রতি আবার নেত্রপাত করিলেন, বিশেষভাবে অর্জুনকে লক্ষ্য করিলেন। তারপর জীমূতমন্দ্র স্বরে বলিলেন— ‘তোমরা পানাহার কর গিয়ে, দু’দণ্ডের মধ্যে পত্রের উত্তর পাবে। মহারাজের আজ্ঞা, যত শীঘ্র সম্ভব বার্তা নিয়ে ফিরে যাবে।’

অনিরুদ্ধ বলিল— ‘আর্য, আমি আজ রাত্রেই ফিরে যেতে পারতাম, কিন্তু অন্ধকার রাত্রে ঘোড়া চলবে না। কাল প্রত্যূষে আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রা করব।’

বিজয়রায় একটি সমোসা মুখে পুরিয়া ঘাড় নাড়িলেন। অনিরুদ্ধ ও অর্জুন শিবিরের বাহিরে আসিল।

বাহিরে তখন মশাল জ্বলিয়াছে। কোথাও সঞ্চরমাণ আলোকপিণ্ড ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, কোথাও স্থির হইয়া আছে। প্রান্তরে যেন ভৌতিক দীপোৎসব চলিতেছে।

রাজদূতেরা ছাউনিতে উত্তম পানাহার পাইল। একটি স্বতন্ত্র ছত্রতলে শুষ্ক তৃণশয্যায় শয়ন করিল। ছত্রাবাসগুলি রাত্রিবাসের জন্য নয়, অধিকাংশ সৈনিক মুক্ত আকাশের তলে খড় পাতিয়া শয়ন করে। দিবাকালে প্রচণ্ড সূর্যের দহন হইতে আত্মরক্ষার জন্য ছত্রগুলির প্রয়োজন হয়।

দু’জনে শয্যাশ্রয় করিয়াছে, এমন সময় সেনাপতির এক পরিচারক আসিয়া দুইজনকে দুইটি পত্র দিয়া গেল। অর্জুন নিজের চিঠি কোমরে গুঁজিয়া লইল।

বাক্যালাপ বিশেষ হইল না। অনিরুদ্ধ একটি উদ্‌গার তুলিল, অর্জুন জৃম্ভণ ত্যাগ করিল। দু’জনের মাথায় একই চিন্তার ক্রিয়া চলিতেছে— কি করিয়া অন্যকে পিছনে ফেলিয়া আগে রাজার সমীপে পৌঁছিবে।

উভয়ের শরীর ক্লান্ত ছিল। অনিরুদ্ধ শয়ন করিয়া চিন্তা করিতে লাগিল। অর্জুন লাঠি দু’টিকে আলিঙ্গন করিয়া শুইয়া রহিল এবং অধিক চিন্তা করিবার পূর্বেই ঘুমাইয়া পড়িল।

ক্রমে স্কন্ধাবারে মশালগুলি একে একে নিভিয়া আসিতে লাগিল। তারপর রন্ধ্রহীন অন্ধকারে চরাচর ব্যাপ্ত হইল। এই অন্ধকারে ক্বচিৎ প্রহরীদের হাঁকডাক ও অস্ত্রের ঝনৎকার শুনা যাইতে লাগিল।

রাত্রির মধ্য যামে দূরাগত শৃগালের সমবেত ডাক শুনিয়া অর্জুনের ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। চক্ষু না খুলিয়াই সে অনুভব করিল তাহার দেহের ক্লান্তি দূর হইয়াছে। সে চক্ষু খুলিল।

ছত্রের বাহিরে তরল অস্ফুট আলো দেখিয়া সে চমকিয়া উঠিয়া বসিল। তবে কি সকাল হইয়া গিয়াছে! সে চকিতে ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল, অনিরুদ্ধ এখনো ঘুমাইতেছে।

কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইয়া সে আবার বাহিরের দিকে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি প্রেরণ করিল। না, এ ভোরের আলো নয়, চাঁদের আলো। মধ্যরাত্রে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠিয়াছে। ছাউনি সুষুপ্ত। অর্জুন নিঃশব্দে উঠিয়া ব্যূহমুখে উপস্থিত হইল।

প্রধান প্রহরী হাঁকিল— ‘কে যায়?’

অর্জুন তাহার কাছে গিয়া বলিল— ‘চুপ চুপ। আমি রাজদূত। এখনি আমাকে রাজধানীতে ফিরতে হবে।’

প্রহরী বলিল— ‘তা ভাল। কিন্তু ঘোড়া চাই তো। তোমার ঘোড়া কোথায়?’

‘ঘোড়ার দরকার নেই। এই আমার ঘোড়া—’ বলিয়া অর্জুন লাফাইয়া লাঠিতে আরোহণ করিল, তারপর দীর্ঘ পদক্ষেপে উত্তরাভিমুখে চলিল। হতবুদ্ধি প্রহরীরা মুখব্যাদান করিয়া রহিল।

স্কন্ধাবারের কাছে সুচিহ্নিত পথ নাই, মাঠের মাঝখানে অস্থায়ী ছাউনির নিকট পথ কিজন্য থাকিবে! অর্জুন কৃষ্ণপক্ষের অর্ধভুক্ত চাঁদকে ডান দিকে রাখিয়া চলিল। ক্রোশেক দূর চলিবার পর পথ মিলিল। চন্দ্রালোকে অস্ফুট রেখা, তবু পথ বলিয়া চেনা যায়।

চেনা গেলেও সাবধানতার প্রয়োজন। পথ সিধা নয়, ঘুরিয়া ফিরিয়া টিবি-ঢাবা বাঁচাইয়া চলিয়াছে, কোথাও দুই ভাগ হইয়া গিয়াছে; এইসব স্থানে আসল পথটি চিনিয়া লইতে হইবে। পথের দিকে দৃষ্টি রাখিয়া চলিতে চলিতে অর্জুনের মুখে একটু হাসি দেখা দিল। স্কন্ধাবার কখন পিছন দিকে অদৃশ্য হইয়া গিয়াছে, কোথাও জনপ্রাণী নাই; ভাগ্যে এই সময় কেহ তাহাকে দেখিতে পাইতেছে না, দেখিলে ভাবিত, একটা দীর্ঘ শীর্ণ প্রেতি চাঁদের আলোয় ছুটিয়া চলিয়াছে।

একটা শৈলখণ্ডের মোড় ঘুরিয়া অর্জুনের পথ হারাইবার আশঙ্কা সম্পূর্ণ দূর হইল। সম্মুখে বহু দূরে একটি রক্তাভ আলোর বিন্দু দেখা দিয়াছে। হেমকূট পর্বতের আগুন! আর পথভ্রষ্ট হইবার ভয় নাই, ওই আলোকবিন্দু সম্মুখে রাখিয়া চলিলেই বিজয়নগরে পৌঁছানো যাইবে। অর্জুন সহর্ষে দীর্ঘ পদদ্বয় ক্ষিপ্রতর বেগে চালিত করিয়া দিল।

ঊষার আলো ফুটিয়াছে কি ফোটে নাই, পশ্চিম আকাশে চাঁদ ফ্যাকাশে হইয়া গিয়াছে। রাজসভা-গৃহের অন্ধকার মূর্তি ধীরে ধীরে পরিস্ফুট হইয়া উঠিতেছে। দাসী পিঙ্গলা অভিসারে গিয়াছিল, বহির্দিক হইতে ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, সভাগৃহের অগ্রপ্রাঙ্গণে হাঁটুর উপর মাথা রাখিয়া একজন বসিয়া আছে। পিঙ্গলা কাছে গিয়া ঝুঁকিয়া দেখিল— অর্জুনবর্মা! বিস্ময়ে বিহ্বলভাবে ছুটিতে ছুটিতে সে রাজাকে সংবাদ দিতে গেল।

দুই

রাজা বলিলেন— ‘অর্জুনবর্মা, আজ থেকে তুমি আমার অতিথি নও, তুমি আমার ভৃত্য। তোমাকে আশুগতি দূতের কাজ দিলাম; এও সামরিক কাজ। তোমার গুপ্তবিদ্যা রাজনীতির ক্ষেত্রে অতি মূল্যবান বিদ্যা; এ বিদ্যা গুপ্ত রাখা প্রয়োজন। কেবল মুষ্টিমেয় লোককে তুমি এ বিদ্যা শেখাবে। কিন্তু সে পরের কথা। — আর্য লক্ষ্মণ, অর্জুনবর্মার বাসস্থান নির্দেশ করুন; রাজপুরীর কাছে হবে অথচ গোপন স্থান হওয়া চাই। অর্জুনবর্মা রাজকার্যে নিযুক্ত হয়েছে একথা অপ্রকাশ থাকাই বাঞ্ছনীয়।’

লক্ষ্মণ মল্লপ কেবল ঘাড় নাড়িলেন। অর্জুন যুক্তকরে বলিল— ‘ধন্য মহারাজ। যেখানে আমার বাসস্থান নির্দেশ করবেন সেখানেই থাকব। যদি অনুমতি করেন, আমার বন্ধু বলরামও আমার সঙ্গে থাকবে। বলরামের কথা কি আপনার স্মরণ আছে মহারাজ?’

রাজা বলিলেন— ‘আছে। আজ আমার সভারোহণের সময় হল, তুমি যাও। সারাদিন অতিথিশালায় বিশ্রাম করবে। সন্ধ্যার পর তোমার বন্ধুকে নিয়ে এস। দেখবো কেমন তার গূঢ়বিদ্যা।’

সূর্যোদয় হইয়াছে। মন্ত্রণাগৃহ হইতে বাহির হইয়া অর্জুন অতিথিশালার দিকে চলিল। দেহের স্নায়ুপেশী ক্লান্ত কিন্তু হৃদয়ের মধ্যে অপূর্ব উল্লাস উচ্ছলিত হইতেছে।

দাসী পিঙ্গলা এই কয়দিনে বিদ্যুন্মালা ও মণিকঙ্কণার প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছে; একটু অবকাশ পাইলেই তাঁহাদের কাছে আসিয়া বসে, রাজ্যের গল্প করে। রাজার ইঙ্গিতে রাজকুমারীদের মনোরঞ্জন করাও তাহার একটি কর্তব্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে। তাই সেদিন কুমারীরা পম্পাপতির মন্দির হইতে ফিরিবার পর সে তাঁহাদের মহলে আসিয়া মেঝের উপর পা ছড়াইয়া বসিল। প্রকাণ্ড একটা হাঁফ ছাড়িয়া বলিল— ‘বাবাঃ! অর্জুনবর্মা মানুষ নয়, বাজপাখি।’

দুই রাজকন্যা চকিতে মুখ ফিরাইলেন। মণিকঙ্কণা বলিল— ‘কে বাজপাখি— অর্জুনবর্মা!’

পিঙ্গলা বলিল— হ্যাঁ গো, রাজকুমারি, যিনি তোমাদের সঙ্গে এসেছেন।’

বিদ্যুন্মালার হৃৎপিণ্ড দুলিয়া উঠিল। মণিকঙ্কণা বলিল— ‘ও মা, তিনি উড়তেও জানেন! আমরা তো জানি তিনি মাছের মত সাঁতার কাটতে পারেন। তা তিনি কোথায় উড়ে বেড়াচ্ছেন?’

পিঙ্গলা গলা একটু হ্রস্ব করিয়া বলিল— ‘কি বলব রাজকুমারি, সে এক আশ্চর্য ব্যাপার! মহারাজ কাল সকালে তাঁকে দূতকর্মে পাঠিয়েছিলেন ষাট ক্রোশ দূরে। আজ সকালে তিনি কাজ সেরে ফিরে এসেছেন। বল দেখি রাজকন্যা, এ কি মানুষে পারে!’

মণিকঙ্কণা বলিল— ‘অমানুষিক কাজ বটে। তিনি কি একলা গিয়েছিলেন?’

পিঙ্গলা হাসিয়া উঠিল— ‘একলা কেন, সঙ্গে অনিরুদ্ধ ছিল, রাজ্যের চঙ্গ দূত! অনিরুদ্ধ এখনো ফেরেনি। হয়তো সন্ধ্যেবেলায় ধুঁকতে ধুঁকতে ফিরবে।’

বিদ্যুন্মালার হৃদ্‌যন্ত্র যে অস্বাভাবিকভাবে প্রসারিত ও সঙ্কুচিত হইতেছে, তিনি নিশ্বাস রোধ করিয়া আছেন তাহা কেহ জানিতে পারিল না। পিঙ্গলা আরো খানিকক্ষণ অর্জুনবর্মার পরাক্রমের কথা আলোচনা করিয়া চলিয়া গেল।

মণিকঙ্কণাও কিয়াৎকাল পরে উঠিয়া গেল, রাজার বিরামকক্ষে উঁকি মারিয়া দেখিতে গেল রাজা সভা হইতে ফিরিয়াছেন কিনা। সে সুযোগ পাইলেই রাজার বিরামকক্ষের দিকে গিয়া আড়াল হইতে উঁকিঝুঁকি মারে। বিদ্যুন্মালা একাকিনী বসিয়া রহিলেন; তাঁহার হৃদয়ে আশা ও আকাঙ্ক্ষার জটিল গ্রন্থিরচনা চলিতে লাগিল।

সন্ধ্যার পর রাজার বিরামকক্ষে দীপাবলী জ্বলিতেছিল। মহারাজ পালঙ্কে সমাসীন, সম্মুখে ভূমির উপর অর্জুন ও বলরাম। আজ লক্ষ্মণ মল্লপ উপস্থিত নাই, সম্ভবত অন্য কোনো কাজে ব্যাপৃত আছেন। পিঙ্গলা এতক্ষণ ঘরে ছিল, রাজার ইঙ্গিতে সরিয়া গিয়াছে।

রাজা বলিলেন— ‘বলরাম, তুমি বাঙ্গলা দেশের মানুষ?’

বলরাম করজোড়ে বলিল— ‘আজ্ঞা, রাঢ় বাঙ্গলা— বর্ধমান ভুক্তি, নগর বর্ধমান।’

রাজা কহিলেন— ‘বাঙ্গলা দেশে মুসলমান রাজা। তারা অত্যাচার করে?’

বলরাম বলিল— ‘করে মহারাজ। যারা দুষ্ট তারা স্বভাবের বশে অত্যাচার করে, আর যারা শিষ্ট তারা অত্যাচার করে ভয়ে।’

‘ভয়ে অত্যাচার করে!’

‘হ্যাঁ মহারাজ। মুসলমানেরা সংখ্যায় মুষ্টিমেয়, হিন্দুরা সংখ্যায় তাদের শতগুণ। তাই তারা মনে মনে ভয় পায় এবং সেই ভয় চাপা দেবার জন্য অত্যাচার করে।’

‘তুমি যথার্থ বলেছ। সকল অত্যাচারের মূলে আছে ষড়রিপু এবং ভয়। তুমি দেখছি বিচক্ষণ ব্যক্তি। তোমার গুপ্তবিদ্যা কিরূপ, আমাকে শোনাও।’

‘মহারাজ, আমি কর্মকার, লোহার কাজ করি। সকল রকম লোহার কাজ জানি, এমন কি কামান পর্যন্ত ঢালাই করতে পারি।’

‘সে আর নূতন কি! বিজয়নগরে শত শত কর্মকার কামান নির্মাণে নিযুক্ত আছে।’

‘যথার্থ মহারাজ। কামান সর্বত্র তৈরি হয়, তাতে নূতনত্ব কিছু নেই। কিন্তু এমন কামান যদি তৈরি করা যায় যা একজন মানুষ স্বচ্ছন্দে অবলীলাক্রমে বহন করে নিয়ে যেতে পারে?’

মহারাজ কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিলেন— ‘তা কি করে সম্ভব?’

বলরাম বলিল— ‘আর্য, যুদ্ধের জন্য যে কামান তৈরি হয় তা অতি গুরুভার, তাকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া মহা শ্রমসাধ্য ব্যাপার; পঞ্চাশজন লোক মিলে গো-শকটে তুলে তাকে নিয়ে যেতে হয়। বিজয়নগরের মত পার্বত্য দেশে কামান যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া আরো কষ্টসাধ্য কার্য। তাই এমন কামান দরকার যা প্রত্যেক সৈনিক ভল্লের মত হাতে করে নিয়ে যেতে পারে।’

রাজা বলিলেন— ‘কিন্তু সেরূপ কামান কি তৈরি করা যায়! বড় কামান ঢালাই করা যায়, মাঝারি পিতলের কামানও ঢালাই হয়, কিন্তু একজন মানুষ বহন করে নিয়ে যেতে পারে এমন কামানের কথা শুনিনি।’

বলরাম বলিল— ‘আর্য, কামানের রহস্য তার নালিকার মধ্যে। বড় নালিকা ঢালাই করা সহজ কিন্তু অতি ক্ষুদ্র এবং লঘু নালিকা তৈরি করা কঠিন। কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয় মহারাজ।’

‘যদি সম্ভব হয় তাহলে আধুনিক যুদ্ধের ধারা একেবারে পরিবর্তিত হয়ে যাবে, তীরন্দাজ সেনার আর প্রয়োজন হবে না। — তুমি দেখাতে পার?’

‘পারি মহারাজ। দ্বারের প্রহরিণী আমার থলি কেড়ে নিয়েছে, আজ্ঞা দিন থলিটা নিয়ে আসুক।’

রাজার আদেশে প্রহরিণী বলরামের থলি দিয়া গেল। বলরাম থলি হইতে একটি লৌহযষ্টি বাহির করিয়া রাজার হাতে দিল। রাজা অভিনিবেশ সহকারে সেটি নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখিলেন; এক বিতস্তি দীর্ঘ, বেণুবংশের ন্যায় গোলাকৃতি লৌহযষ্টি। কিন্তু দণ্ড নয়, নালিকা; তাহার অন্তর্ভাগ শূন্য এবং মসৃণ। রাজা বিস্মিত হইয়া বলিলেন— ‘এ তো দেখছি লৌহ নালিকা! এত সরু নালিকা তুমি নির্মাণ করলে কি করে?’

বলরাম স্মিতমুখে হাতজোড় করিয়া বলিল— ‘আর্য, ওইখানেই আমার গুপ্তবিদ্যা। আমি সরু নল তৈরি করার কৌশল উদ্ভাবন করেছি।’

রাজা নালিকাটিকে আরো খানিকক্ষণ দেখিলেন, বলিলেন— ‘তারপর বল।’

বলরাম বলিল— ‘শ্রীমন্‌, কামান নির্মাণের মূল রহস্য নালিকা নির্মাণ; নালিকা তৈরি হলে বাকি সব উপসর্গ অতি সহজ। দেখুন, এই নালিকা দিয়ে অতি সহজেই ক্ষুদ্র কামান রচনা করা যায়। প্রথমে নলের এক প্রান্ত লোহার আবরণ দিয়ে বন্ধ করে দেব, তাতে কেবল একটি সূচিপ্রমাণ ছিদ্র থাকবে। তারপর নলের মধ্যে বারুদ ভরব, পিছনের ছিদ্রপথে বারুদ একটু বেরিয়ে আসবে। তখন সেই ছিদ্রের বেরিয়ে-আসা বারুদে আগুন দিলেই কামান ফুটবে। প্রক্রিয়া বোঝাতে পেরেছি কি মহারাজ?’

রাজা আরো কিছুক্ষণ নলটি নাড়িয়া-চাড়িয়া বলিলেন— ‘বুঝেছি। কিন্তু পরিপূর্ণ যন্ত্রটি কেমন হবে এখনো ধারণা করতে পারছি না। তুমি তৈরি করে আমাকে দেখাতে পার?’

‘পারি মহারাজ। দু’চার দিন সময় লাগবে।’

‘তাতে ক্ষতি নেই। তুমি যন্ত্র প্রস্তুত কর। যদি সম্পূর্ণ যন্ত্রটি যুদ্ধে ব্যবহারের উপযোগী হয়—’

এই সময় ধন্নায়ক লক্ষ্মণ উপস্থিত হইলেন। রাজা তাঁহাকে বলিলেন— ‘আর্য লক্ষ্মণ, এদের বাসস্থান নির্দেশের কী ব্যবস্থা করলেন?’

লক্ষ্মণ মল্লপ বলিলেন— ‘পুরভূমির মধ্যে বাড়ি হল না, ওদের গুহায় থাকার ব্যবস্থা করেছি।’

‘গুহায়? কোন্‌ গুহায়?’

‘রাজ-অবরোধের দক্ষিণ প্রান্তে কমলা সরোবরের অদূরে সঙ্কেত-গুহা নামে যে গুহা আছে তাতেই ওদের বাসস্থান নির্দেশ করেছি। গুহাটি নির্জন, ওদিকে লোক-চলাচল নেই; ওরা আরামে থাকবে, রাজার হাতের কাছে থাকবে, অথচ বাইরের লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে না।’

রাজা বলিলেন— ‘ভাল, আজ থেকে ওরা গুহাবাসী হোক, কিন্তু গৃহের আরাম থেকে যেন বঞ্চিত না হয়। বলরামের বোধহয় কিছু যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হবে—’

বলরাম বলিল— ‘আর সব যন্ত্রপাতি আমার আছে মহারাজ, কেবল একটি ভস্ত্রা হলেই চলবে।’

লক্ষ্মণ মল্লপ সাম্প্রতিক ঘটনা জানেন না, তিনি বলরামের প্রতি কৌতূহলী দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিলেন— ‘ভস্ত্রা পাবে। — এখন অনুমতি করুন, মহারাজ, এদের গুহায় পৌঁছে দিই।’

রাজা লৌহ নালিকাটি বলরামকে প্রত্যর্পণ করিয়া বলিলেন— ‘আপনি বলরামকে নিয়ে যান, অর্জুনবর্মার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।’

বলরামকে লইয়া মন্ত্রী চলিয়া গেলেন। রাজা অর্জুনের দিকে গম্ভীর দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিলেন— ‘অর্জুনবর্মা, একটা দুঃসংবাদ আছে। তোমার পিতার মৃত্যু হয়েছে।’

অর্জুন দাঁড়াইয়া ছিল, ধীরে ধীরে বসিয়া পড়িল। সংবাদ কিছু অপ্রত্যাশিত নয়, এই আশঙ্কাই সে দিনের পর দিন মনের মধ্যে পোষণ করিতেছিল; তবু তাহার কণ্ঠের স্নায়ুপেশী সঙ্কুচিত হইয়া তাহার কণ্ঠরোধের উপক্রম করিল, হৃদ্‌যন্ত্র পঞ্জরের মধ্যে ধক্‌ধক্‌ করিতে লাগিল। চিন্তা করিবার শক্তি ক্ষণকালের জন্য লুপ্ত হইয়া গেল, কেবল মস্তিষ্কের মধ্যে একটা আর্ত চিৎকার ধ্বনিত হইতে লাগিল— পিতা! পিতা!

রাজা তাহার অবস্থা দেখিয়া সদয়কণ্ঠে বলিলেন— ‘অর্জুনবর্মা, তোমার পিতা ক্ষত্রিয় ছিলেন, তিনি গৌরবময় মৃত্যু বরণ করেছেন, ধর্মের জন্য প্রাণ দিয়েছেন।’

এইবার অর্জুনের দুই চক্ষু ভরিয়া অশ্রুর ধারা নামিল, সে রুদ্ধকণ্ঠে কেবল একটি শব্দ উচ্চারণ করিল— ‘কবে—?’

রাজা বলিলেন— ‘এগারো দিন আগে। ম্লেচ্ছরা তাঁকে গো-মাংস খাইয়ে ধর্মনাশের চেষ্টা করেছিল, তিনি অনশনে প্রাণত্যাগ করেছেন। — তুমি এখন যাও, আজ রাত্রিটা অতিথিশালাতেই থেকো, রাত্রে পিতাকে প্রাণ ভরে স্মরণ কোরো। কাল তোমার পিতৃশ্রাদ্ধের আয়োজন আমি করব। এস বৎস।’

অর্জুন যখন সভাগৃহের প্রাঙ্গণে আসিয়া দাঁড়াইল, তখন চারিদিকে অন্ধকার জমাট বাঁধিয়াছে, নগর প্রায় নিষ্প্রদীপ। বাষ্পাকুল চোখে আকাশের পানে চাহিয়া তাহার মনে হইল জগতে সে একা, নিঃসঙ্গ; তাহার হৃদয়ও শূন্য হইয়া গিয়াছে।

তিন

দুই দিন পরে মহারাজ দেবরায় সীমান্ত-সেনা পরিদর্শনে বাহির হইলেন। সঙ্গে পিঙ্গলা এবং পাঁচজন পাচক। দেহরক্ষীরূপে চলিল এক সহস্র তুরাণী ধনুর্ধর। রাজা রাজ্যের উত্তর সীমান্তের এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত পরিদর্শন করিবেন, ন্যূনাধিক এক পক্ষকাল সময় লাগিবে। ইতিমধ্যে ধন্নায়ক লক্ষ্মণ মল্লপ একান্ত অনাড়ম্বরভাবে রাজ্য পরিচালনার ভার নিজ হস্তে তুলিয়া লইয়াছেন।

কুমার কম্পনদেবের ইচ্ছা ছিল, রাজার অনুপস্থিতি কালে তিনিই রাজ-প্রতিভূ হইয়া রাজকার্য চালাইবেন। কিন্তু রাজা তাঁহাকে ডাকিলেন না; এত অল্প সময়ের জন্য শূন্যপাল নিয়োগের প্রয়োজন হয় না, মন্ত্রীই কাজ চালাইয়া লইতে পারেন। কুমার কম্পনের বিষয়-জর্জরিত মন আরো বিষাক্ত হইয়া উঠিল।

কুমার কম্পনের নূতন গৃহ সম্পূর্ণ হইয়াছে, তাহাতে নানা প্রকার মহার্ঘ সাজসজ্জা বসিয়াছে। কিন্তু এখনো তিনি গৃহপ্রবেশ করেন নাই। তাঁহার প্রকাশ্য অভিপ্রায়, রাজা প্রত্যাগমন করিলে রাজাকে এবং রাজ্যের গণ্যমান্য রাজপুরুষদের প্রকাণ্ড ভোজ দিয়া গৃহপ্রবেশ করিবেন। এই অভিপ্রায়ের পশ্চাতে যে কুটিল এবং দুঃসাহসিক অভিসন্ধি আছে তাহা তিনি হাস্যমুখে আবৃত করিয়া রাখিয়াছেন।

অর্জুন ও বলরাম গুহামধ্যে অধিষ্ঠিত হইয়াছে। অতিথিশালা হইতে গুহায় স্থানান্তরিত হইয়া কিন্তু তাঁহাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের তিলমাত্র হানি হয় নাই।

বিজয়নগরের সর্বত্র, তথা রাজ-পুরভূমির মধ্যে ছোট ছোট পাহাড় আছে; পাহাড় না বলিয়া তাহাদের শিলাস্তূপ বলিলেই ভাল হয়। সর্বত্র দেখা যায় বলিয়া কেহ এগুলিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করে না। অনেক শিলাস্তূপের অভ্যন্তরে নৈসর্গিক কন্দর আছে। অর্জুন ও বলরাম যে গুহাতে আশ্রয় পাইয়াছিল তাহাও এইরূপ গুহা। ইতস্তত বিকীর্ণ বড় বড় শিলাখণ্ডের মাঝখানে ক্রমোচ্চ স্তনইব ভুবঃ একটি স্তূপ, এই শিলায়তনের মধ্যে গুহা। গুহাটি বেশ বিস্তীর্ণ, কিন্তু অধিক উচ্চ নয়; এমন তাহার ত্রিভঙ্গ গঠন যে তাহাকে স্বচ্ছন্দে দুই ভাগ করিয়া দুইটি প্রকোষ্ঠে পরিণত করা যায়। পিছন দিকে ছাদের এক অংশে কিছু পাথর খসিয়া গিয়া একটি নাতিবৃহৎ ছিদ্র হইয়াছে, সেই পথে প্রচুর আলো ও বায়ুর প্রবাহ প্রবেশ করে।

মন্ত্রী মহাশয় যত্নের ত্রুটি রাখেন নাই। কোমল শয্যা, উপবেশনের জন্য পীঠিকা, জলের কুণ্ড, দীপদণ্ড ও অন্যান্য তৈজস দিয়া গুহার শ্রীবৃদ্ধি সাধন করিয়াছেন। রাজপুরীর রন্ধনশালা হইতে প্রত্যহ দুইবার একটি দাসী আসিয়া রাজভোগ্য খাদ্য পানীয় দিয়া যায়। বলরাম ও অর্জুন একদিন বহিত্রে গিয়া বলরামের লোহা-লক্কড় ও যন্ত্রপাতি লইয়া আসিয়াছে, তাহার মৃদঙ্গাদি বাদ্যও আনিতে ভোলে নাই। দুই বন্ধু নিভৃতে নিরালায় সংসার পাতিয়া বসিয়াছে।

পিতার শ্রাদ্ধশান্তির পর অর্জুন ধীরে ধীরে আবার সুস্থ হইয়া উঠিতেছে। তাহার অসহায় বিহ্বল ভাব কাটিয়া গিয়াছে; বর্তমানে যে বৈরাগ্য ও নিস্পৃহতার ভাব তাহার হৃদয়কে অধিকার করিয়াছে তাহাও ক্রমে কাটিয়া যাইবে। যৌবনের মনঃপীড়া বড় তীব্র হয়, কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হয় না। ক্ষত শীঘ্র শুকায় এবং অচিরাৎ নিশ্চিহ্ন হইয়া যায়।

বলরাম হৃদয়ের প্রীতি ও সহানুভূতি দিয়া অর্জুনকে ঘিরিয়া রাখিয়াছে। সে নিজে জীবনে অনেক দুঃখ পাইয়াছে, দুঃখের মূল্য বোঝে; তাই তাড়াতাড়ি করিয়া অর্জুনের শোক ভুলাইয়া দিবার চেষ্টা করে না; বরং শোকের ভাগ লইয়া শোক লাঘব করিবার চেষ্টা করে। কখনো নানা বিচিত্র কাহিনী বলে, কখনো সন্ধ্যার পর প্রদীপ জ্বলিলে মৃদঙ্গ লইয়া গান ধরে— শ্রিত-কমলাকুচ মণ্ডল ধৃতকুণ্ডল কলিতললিত বনমাল জয় জয় দেব হরে!

গুহার যে অংশে ছাদে ফুটা, আজ সেইখানে বলরাম হাপর বসাইয়াছে। সকালবেলা চুল্লীতে আগুন ধরাইয়া সে কাজ করিতে বসে; অর্জুন তাহার হাপরের দড়ি টানে। লৌহখণ্ড তপ্ত হইয়া তরুণার্করাগ ধারণ করিলে বলরাম তাহা হাতুড়ি দিয়া পিটিয়া অভীষ্ট রূপ দান করে। কাজের সঙ্গে সঙ্গে গল্প হয়; বলরামই বেশি কথা বলে, অর্জুন কখনো ঘাড় নাড়ে কখনো দু’একটা কথা বলে। বলরাম বলে— ‘এ গুহাটি বেশ, এর সঙ্কেত-গুহা নাম সার্থক। আমরা এখানে আসার ফলে কিন্তু অনেক অভিসারিকার প্রাণে ব্যথা লেগেছে।’

অর্জুনের সপ্রশ্ন দৃষ্টির উত্তরে বলরাম মৃদু মৃদু হাসিতে হাসিতে বলে— ‘এ গুহাটি রাজপুরীর যুবতী দাসী-কিঙ্করীদের গুপ্ত বিহারগৃহ; অভিসারিকার কুহুরাত্রে চুপি-চুপি আসত, নাগরেরাও আসত। গুহার অন্ধকারে ক্ষীণ দীপশিখা জ্বলত। আর জ্বলত মদনানল।’

অর্জুন বলে— ‘তুমি কি করে জানলে?’

বলরাম বলে— ‘তুমি দেখনি! গুহার গায়ে জোড়া জোড়া নাম লেখা আছে। কোথাও খড়ি দিয়ে লেখা— রত্নমালা-দেবদত্ত; কোথাও গিরিমাটি দিয়ে লেখা— চন্দ্রচূড়-বল্লভা। কতক নাম নূতন, কতক নাম অনেকদিনের পুরানো, প্রায় মিলিয়ে এসেছে, ভাল পড়া যায় না। এরা সব এখানে আসত। কিন্তু মন্ত্রী মহাশয় বাদ সাধলেন, আমাদের এনে এখানে বসিয়ে দিলেন। ওদের মনে কি দুঃখ বল দেখি! আবার নূতন গুহা খুঁজতে হবে।’ বলিয়া বলরাম অনেকক্ষণ ধরিয়া হো হো শব্দে হাসিতে থাকে। অর্জুনের অধরেও একটু হাসি খেলিয়া যায়।

আবার কখনো বলরাম বলে— ‘আজ আর কামান তৈরি করতে ভাল লাগছে না। এস, তোমার লাঠির জন্যে দুটো হুল তৈরি করে দিই। লাঠির ডগায় বসিয়ে দিলেই লাঠি বল্লমে পরিণত হবে।’

অর্জুন বলে— ‘তাতে কী লাভ?’

বলরাম বলে— ‘লাভ হবে না! একাধারে ঘোড়া এবং বল্লম পাবে। ভেবে দেখ, তুমি রাজদূত, তোমাকে যখন-তখন পাহাড় জঙ্গল ভেঙ্গে দূর-দূরান্তরে যেতে হবে। হঠাৎ যদি অস্ত্রধারী আততায়ী আক্রমণ করে! তুমি তখন কী করবে? লাঠি দিয়ে কত লড়বে! তখন এই অস্ত্রটি কাজে আসবে। তুমি টুক্‌ করে লাঠি থেকে নেমে বল্লম দিয়ে শত্রুর পেট ফুটো করে দেবে।’

‘তা বটে।’

বলরাম দুইটি লোহার হুল তৈয়ার করিয়া লাঠির মাথায় আঁট করিয়া বসাইয়া দেয়। দুই বন্ধু দু’টি ভল্ল লইয়া কিছুক্ষণ ক্রীড়াযুদ্ধ করে। রঙ্গ-কৌতুকে অর্জুনের মন লঘু হয়।

দ্বিপ্রহরের কিছু পূর্বে রাজপুরীর দাসী খাবার লইয়া আসে। দূর হইতে তাহাকে আসিতে দেখা যায়। মাথার উপর একটি প্রকাণ্ড থালা, তাহাতে অন্ন-ব্যঞ্জন। তার উপর আর একটি অন্ন-ব্যঞ্জনপূর্ণ থালা। সর্বোপরি একটি শূন্য থালা উপুড় করা। কোমরে ছোট একটি জলপূর্ণ কলসী। তাহার শাড়ির রঙ কোনো দিন চাঁপা ফুলের মত, কোনো দিন পলাশ ফুলের মত। গতিভঙ্গি রাজহংসীর মত। তাহাকে আসিতে দেখিলে মনে হয় মাথায় সোনার মুকুট পরা দিব্যাঙ্গনা আসিতেছে।

সে দৃষ্টিগোচর হইলেই বলরাম কাজ ফেলিয়া উঠিয়া পড়ে, বলে— ‘অর্জুন ভাই, চল চল, স্নান করে আসি। মধ্যাহ্ন ভোজন আসছে।’

গুহা হইতে চার-পাঁচ রজ্জু দূরে পৌরভূমির দক্ষিণ কিনারে বিপুলপ্রসার কমলা সরোবর; দৈর্ঘ্য প্রস্থে প্রায় ক্রোশেক স্থান জুড়িয়া স্ফটিকের ন্যায় জল টলমল করিতেছে। দূরে পূর্বদিকে কমলাপুরমের ঘাট দেখা যায়। কিন্তু অর্জুন ও বলরাম ঘাটে স্নান করিতে যায় না। নিকটেই আঘাটায় স্নান করিয়া ফিরিয়া আসে।

গুহায় ফিরিয়া দেখে, দাসী পীঠিকার সম্মুখে আহার্য সাজাইয়া বসিয়া আছে। তাহারা আহারে বসিয়া যায়। আহার শেষ হইলে দাসী উচ্ছিষ্ট পাত্রগুলি তুলিয়া লইয়া চলিয়া যায়।

প্রথম দুই-তিন দিন তাহারা দাসীকে ভাল করিয়া লক্ষ্য করে নাই। একদিন খাইতে বসিয়া বলরামের জিজ্ঞাসু চক্ষু তাহার উপর পড়িল। মেয়েটি পা মুড়িয়া অদূরে বসিয়া আছে। তাহার বয়স অনুমান কুড়ি-একুশ; কচি কলাপাতার মত স্নিগ্ধ দেহের বর্ণ। ঊর্ধ্বাঙ্গে কাঁচুলি ও উত্তরীয়, নিম্নাঙ্গে উজ্জ্বল পীতবসন; মধ্যে ডমরুর ন্যায় কটি উন্মুক্ত। মুখখানি কমনীয়, টানা-টানা চোখ, অধর ঈষৎ স্ফুরিত। মুখের ভাব শান্ত এবং সংযত; যেন দর্শকের দৃষ্টি হইতে নিজেকে সরাইয়া রাখিতে চায়। লাজুক নয়, কিন্তু অপ্রগল্‌ভা। বলরাম তাহার প্রতি কয়েকবার চকিত দৃষ্টিপাত করিয়া শেষে প্রশ্ন করিল— ‘তোমার নাম কি?’

যুবতীর চোখ দু’টি ভূমিসংলগ্ন হইল, সে সম্বৃত স্বরে বলিল— ‘মঞ্জিরা।’

কিছুক্ষণ নীরবে আহার করিয়া বলরাম বলিল— ‘তুমি রাজপুরীতেই থাকো?’

মঞ্জিরা বলিল— ‘হাঁ।’

‘কতদিন আছ?’

‘আট বছর।’

‘তোমার পিতা-মাতা নেই?’

‘আছেন। তাঁরা নগরে থাকেন।’

বলরাম আরো কিছুক্ষণ আহার করিয়া মুখ তুলিল; তাহার ‘অধরকোণে একটু হাসি। বলিল— ‘তুমি আগে কখনো এ গুহায় এসেছ? অর্থাৎ আমরা আসার আগে কখনো এসেছ?’

মঞ্জিরা চোখ তুলিয়া বলরামের মুখের পানে চাহিল। চোখে ছল-কপট নাই, ঋজু দৃষ্টি। বলিল— ‘না।’

বলরাম বলিল— ‘কিন্তু অপবাদ শুনেছি, রাজপুরীর দাসী-কিঙ্করীরা মাঝে মাঝে রাত্রিকালে এই গুহায় আসে।’

মঞ্জিরার মুখের ভাব দৃঢ় হইল, সে বলরামের চোখে চোখ রাখিয়া বলিল— ‘যারা দুষ্ট মেয়ে তারা আসে। সকলে আসে না।’

তিরুস্কৃত হইয়া বলরাম চুপ করিল। সেকালের কবিরা অভিসারিকাদের লইয়া যতই মাতামতি করুন, সমাজে অভিসারিকাদের প্রশংসা ছিল না। বিকীর্ণকামা নারী সকল যুগে সকল সমাজেই নিন্দিত। তবে এ কথাও সত্য, সেকালে অভিসারের প্রচলন একটু বেশি ছিল।

বলরাম ও অর্জুন আহার শেষ করিয়া আচমন করিতে উঠিল। মঞ্জিরা উচ্ছিষ্ট পত্রগুলি লইয়া চলিয়া গেল।

সেদিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে অর্জুন ও বলরাম ভ্রমণের জন্য বাহির হইল। রাজা রাজধানীতে নাই, সভা বসে না; তবু অর্জুন দিনে একবার রাজসভার দিকে যায়, শূন্য সভাঙ্গনে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করিয়া ফিরিয়া আসে। আজ বলরামও তাহার সঙ্গে চলিল।

গুহা হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া কিছু দূর যাইবার পর বলরাম দেখিল, একটা উঁচু পাথরের চ্যাঙড়ের পাশে একজন অস্ত্রধারী লোক দাঁড়াইয়া আছে। মুখে প্রচুর গোঁফদাড়ি, মাথায় পাগড়ি, হাতে ভল্ল, কোমরে তরবারি। তাহাদের আসিতে দেখিয়া লোকটা পাথরের আড়ালে অপসৃত হইল।

বলরাম বলিল— ‘এস তো, দেখি কে লোকটা।’

অর্জুনের হাতে হুল-শীর্ষ লাঠি দু’টি ছিল, সুতরাং অস্ত্রধারী অজ্ঞাত পুরুষের সম্মুখীন হইতে ভয় নাই। অর্জুন একটি লাঠি বলরামকে দিল, তারপর দুইজনে দুই দিক হইতে চ্যাঙড় ঘুরিয়া অন্তরালস্থিত লোকটির নিকটবর্তী হইল।

তাহাদের দেখিয়া লোকটি অপ্রস্তুত হইয়া পড়িল। বলরাম বলিল— ‘বাপু, কে তুমি? তোমার নাম কি? এখানে কি চাও?’

লোকটি বলিল— ‘আমি এখানে পাহারা দিচ্ছি। আমার নাম চতুর্ভুজ নায়ক।’

বলরাম বলিল— ‘কাকে পাহারা দিচ্ছ?’

চতুর্ভুজ নায়কের গোঁফ এবং দাড়ির সঙ্গমস্থলে একটু শ্বেতাভা দেখা দিল— ‘তোমাদের পাহারা দিচ্ছি।’

বিস্মিত হইয়া বলরাম বলিল— ‘আমাদের পাহারা দিচ্ছ! আমাদের অপরাধ?’

‘তোমরা গোপনীয় রাজকার্যে ব্যাপৃত আছ। পাছে বাইরের লোক কেউ আসে তাই মন্ত্রী মহাশয়ের হুকুমে পাহারা দিচ্ছি।’

‘বুঝলাম। রাত্রেও কি পাহারা থাকে?’

‘থাকে।’

‘তুমি একা পাহারা দাও, না তোমার মতন চতুর্ভুজ আরো আছে?’

‘আমরা তিনজন আছি, পালা করে পাহারা দিই।’

‘নিশ্চিন্ত হলাম। অভিসারক আর অভিসারিকাদের ঠেকিয়ে রেখো। আমরা একটু ঘুরে আসি।’

সূর্যাস্তের অল্পকাল পরে অর্জুন ও বলরাম ফিরিয়া আসিল, দেখিল গুহায় দীপ জ্বলিতেছে, মঞ্জিরা খাবার সাজাইয়া বসিয়া আছে। দুইজনে খাইতে বসিয়া গেল।

রাজবাটি হইতে রোজ নূতন নূতন অন্ন-ব্যঞ্জন আসে। আজ আসিয়াছে শর্করা-মধুর পিণ্ডক্ষীর, দুই প্রকার মৎস্য, শূল্য মাংস, উখ্য মাংস, দুগ্ধফেননিভ তণ্ডুল, ঘৃতলিপ্ত রোটিকা, সম্বর, অবদংশ ও পর্পট। দক্ষিণ দেশে আহারের নিয়ম মধুরেণ সমাপয়েৎ নয়, মধুর খাদ্য দিয়া আহার আরম্ভ। অর্জুন ও বলরাম পিণ্ডক্ষীর মুখে দিয়া পরম তৃপ্তিভরে ভোজন আরম্ভ করিল।

পিণ্ডক্ষীরের আস্বাদ গ্রহণ করিতে করিতে বলরাম অর্ধমুদিত নেত্রে মঞ্জিরাকে নিরীক্ষণ করিল। মঞ্জিরা বাম করতল ভূমিতে রাখিয়া একটু হেলিয়া বসিয়া আছে, স্নেহদীপিকার নম্র আলোকে তাহার মুখখানি বড় মধুর দেখাইতেছে। কিছুক্ষণ দেখিয়া বলরাম বলিল— ‘তোমার নাম মঞ্জিরা। মঞ্জিরা মানে বাঁশি। তুমি বাঁশি বাজাতে জান?’

অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে মঞ্জিরা আয়ত চক্ষু তুলিয়া চাহিল। একটু ঘাড় বাঁকাইল, বলিল— ‘জানি।’

বলরাম বলিল— ‘বাঃ বেশ। আমি গান গাইতে পারি, তোমাকে গান শোনাব। তুমি আমাকে বাঁশি শোনাবে?’

মঞ্জিরার অধরে চাপা কৌতুকের হাসি খেলিয়া গেল, সে একটু ঘাড় নাড়িল।

বলরাম উৎসাহভরে বলিল— ‘ভাল। কাল তাহলে তুমি তোমার বাঁশি এনো। কেমন?’

মঞ্জিরা আবার ঘাড় নাড়িল।

অর্জুন আড়চোখে বলরামের পানে চাহিল। গুহার ভিতর দুইটি নর-নারীর মধ্যে পূর্বরাগের অনুবন্ধ আরম্ভ হইয়া গিয়াছে দেখিয়া তাহার মন উৎসুক ও প্রসন্ন হইয়া উঠিল।

পরদিন দ্বিপ্রহরে মঞ্জিরা খাবার লইয়া আসিল। আজ বলরাম ও অর্জুন পূর্বাহ্ণেই স্নান করিয়া প্রস্তুত ছিল। আহারে বসিয়া বলরাম বলিল— ‘কই, বাঁশি আনোনি?’

মঞ্জিরা কোঁচড় হইতে বাঁশি বাহির করিয়া দেখাইল। বনবেতসের এড়ো বাঁশি। বলরাম হৃষ্ট হইয়া বলিল— ‘এই যে বাঁশি! তা— তুমি বাজাও, আমরা খেতে খেতে শুনি।’

মঞ্জিরা নতমুখে মাথা নাড়িয়া হাসিল। বলরাম বলিল— ‘ও— বুঝেছি, আমি গান না গাইলে তুমি বাঁশি বাজাবে না। ভাবছ, আমি গাইতে জানি না, ফাঁকি দিয়ে তোমার বাঁশি শুনে নিতে চাই। — আচ্ছা দাঁড়াও।’

আহারান্তে বলরাম মৃদঙ্গ কোলে লইয়া বসিল। বলিল— ‘জয়দেব গোস্বামীর পদ গাইছি— শ্রীরাধিকার বিরহ হয়েছে, তিনি চন্দন আর চন্দ্রকিরণের নিন্দা করছেন। কর্ণাট রাগ, যতি তাল। আমার সঙ্গে সঙ্গে বাজাতে পারবে?’

মঞ্জিরা উত্তর দিল না, বাঁশিটি হাতে লইয়া অপেক্ষা করিয়া রহিল। বলরাম কয়েকবার মৃদঙ্গে মৃদু আঘাত করিয়া কলিতকণ্ঠে গান ধরিল—

‘নিন্দতি চন্দনমিন্দুকিরণমনুবিন্দতি খেদমধীরম্‌। —’

মঞ্জিরা বাঁশিটি অধরে রাখিয়া ফুঁ দিল। বাঁশির ক্ষীণ-মধুর ধ্বনি বসন্তের প্রজাপতির মত জয়দেবের সুরের শীর্ষে শীর্ষে নাচিয়া বেড়াইতে লাগিল। বলরাম গান গাহিতে গাহিতে মঞ্জিরার চোখে চোখ রাখিয়া চমৎকৃত হাসি হাসিল।

‘সা বিরহে তব দীনা

মাধব মনসিজ-বিশিখভয়াদিব

ভাবনয়া ত্বয়ি লীনা।’

দু’জনের চক্ষু পরস্পর নিবদ্ধ, কিন্তু মন নিবদ্ধ সুরের জালে। মোহময় সুর, কুহকময় শব্দ; সঙ্গীতের স্রোতে আশ্লিষ্ট হইয়া দু’জনে একসঙ্গে ভাসিয়া চলিয়াছে।

দুই দণ্ড পরে গান শেষ হইল।

মৃদঙ্গ নামাইয়া রাখিয়া বলরাম গদ্গদ স্বরে বলিল— ‘ধন্য! তুমি এত ভাল বাঁশি বাজাও আমি ভাবতেই পারিনি। — আমার গান কেমন শুনলে?’

মঞ্জিরা সলজ্জ স্বরে বলিল— ‘ভাল।’

বলরাম হঠাৎ বলিল— ‘ভাল কথা, তোমার খাওয়া হয়েছে?’

মঞ্জিরা মাথা নাড়িয়া বলিল— ‘না।’

বলরাম বিব্রত হইয়া পড়িল— ‘অ্যাঁ— এখনো খাওনি! গান-বাজনা পেলে বুঝি খাওয়া-দাওয়ার কথা মনে থাকে না? এ কি অন্যায় কথা? যাও যাও, খাও গিয়ে। কাল যখন আসবে খাওয়া-দাওয়া সেরে আসবে। কেমন?’

মঞ্জিরা চলিয়া যাইবার পর বলরাম শয্যা পাতিয়া শয়ন করিল, অর্জুনও নিজের শয্যা পাতিল। বলরাম কিছুক্ষণ সুপারি চর্বণ করিয়া বলিল— ‘মঞ্জিরা মেয়েটা ভারি সুশীলা।’

অর্জুন হাসি দমন করিয়া বলিল— ‘তা তো বুঝতেই পারছি।’

বলরাম সন্দিগ্ধভাবে তাহার দিকে ঘাড় ফিরাইল, বলিল— ‘কি করে বুঝলে?’

অর্জুন বলিল— ‘বাঁশি বাজাতে পারে।’

বলরাম এবার হাসিয়া উঠিল— ‘সে জন্যে নয়। মেয়েটার শরীরে রাগ নেই, আর খুব কম কথা কয়। যে-মেয়ে কম কথা কয় সে তো রমণীরত্ন।’

অর্জুনের মনে পড়িল বলরামের পূর্বতন স্ত্রী মুখরা ও চণ্ডী ছিল। অর্জুন শয্যায় শয়ন করিয়া বলিল— ‘তা বটে।’

অতঃপর মঞ্জিরা আসে যায়। দ্বিপ্রহরে বলরামের সঙ্গে দু’দণ্ড বাঁশি বাজাইয়া তৃতীয় প্রহরে ফিরিয়া যায়। রাত্রে কিন্তু বেশিক্ষণ থাকে না, আহার শেষ হইলে পাত্রগুলি তুলিয়া লইয়া চলিয়া যায়। বলরামের সহিত তাহার আন্তরিক বন্ধন ঘনিষ্ঠ হইতেছে। সঙ্গীতের বন্ধন নাগপাশের বন্ধন, দু’জনকে পাকে পাকে জড়াইয়া ধরিয়াছে। তবু, বলরাম সাবধানী লোক, সে জানিয়া লইয়াছে যে মঞ্জিরা অনূঢ়া; পরকীয়া প্রীতি যে অতি গর্হিত কার্য তাহা তাহার অবিদিত নাই।

এইভাবে দিন কাটিতেছে। বলরাম কামানটি সম্পূর্ণ করিয়াছে, কিন্তু রাজা প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত কিছু করণীয় নাই। কৃষ্ণপক্ষ কাটিয়া শুক্লপক্ষ আরম্ভ হইয়াছে। সন্ধ্যার পর দুই বন্ধু গুহার বাহিরে দাঁড়াইয়া তরুণী চন্দ্রলেখার পানে চাহিয়া থাকে। চন্দ্রলেখা দিনে দিনে পরিবর্ধমানা।

একদিন এই নিস্তরঙ্গ জীবনযাত্রার মধ্যে এক বিচিত্র অপ্রাকৃত ব্যাপার ঘটিল। দিনটা ছিল শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী কি সপ্তমী তিথি। সন্ধ্যার পর যথারীতি আহার সমাপন করিয়া বলরাম ও অর্জুন শয্যায় শয়ন করিয়াছিল। মঞ্জিরা চলিয়া গিয়াছে; দীপের শিখাটি তৈলাভাবে ধীরে ধীরে ক্ষুদ্র হইয়া আসিতেছে।

বলরাম আলস্যভরে জৃম্ভণ ত্যাগ করিয়া বলিল— ‘কামানটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে ঠিক হল কিনা। কাল প্রত্যূষে বেরুব।’

অর্জুন বলিল— ‘বেশ তো! কোথায় যাবে?’

‘কোনো নির্জন স্থানে। যাতে শব্দ শোনা না যায়। আজ ঘুমিয়ে পড়। শয়নে পদ্মনাভঞ্চ।’

কিন্তু নিদ্রাকর্ষণের পূর্বেই বাধা পড়িল। গুহার মুখের কাছে ধাবমান পদশব্দ শুনিয়া দু’জনেই ত্বরিতে শয্যায় উঠিয়া বসিল।

গুহার রন্ধ্রমুখে ধূম্রাকার ছায়া পড়িল, একটি কম্পিত কণ্ঠস্বর শুনা গেল— ‘অর্জুন ভদ্র! বলরাম ভদ্র!’

অর্জুন গলা চড়াইয়া হাঁক দিল— ‘কে তুমি!’

‘আমি চতুর্ভুজ নায়ক।’

দু’জনে উঠিয়া দাঁড়াইল। বলরাম বলিল—’চতুর্ভুজ! ভিতরে এস। কী সমাচার?’

প্রহরী চতুর্ভুজ তখন গুহায় প্রবেশ করিয়া আলোকচক্রের মধ্যে দাঁড়াইল। দেখা গেল তাহার চক্ষু ভয়ে গোলাকৃতি হইয়াছে, দাড়িগোঁফ রোমাঞ্চিত। সে থরথর স্বরে বলিল— ‘হুক্ক-বুক্ক!’

‘হুক্ক-বুক্ক! সে কাকে বলে?’

চতুর্ভুজ তখন স্খলিত স্বরে যথাসাধ্য বুঝাইয়া বলিল। রাজবংশের প্রবর্তক হরিহর ও বুক্কের প্রেতাত্মা দেখা দিয়াছেন। তাঁহারা গুহার বাহিরে অনতিদূরে পদচারণ করিতেছেন। চতুর্ভুজ প্রথমে তাঁহাদের মানুষ মনে করিয়া সম্বোধন করিয়াছিল। কিন্তু তাঁহারা মানুষ নয়, প্রেত; চতুর্ভুজের সম্বোধন অগ্রাহ্য করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন।

শুনিয়া অর্জুন লাঠি দু’টি হাতে লইল, বলিল— ‘চল দেখি।’

চতুর্ভুজ মাটিতে বসিয়া পড়িয়া বলিল— ‘আমি আর যাব না। তোমরা যাও।’

দুই বন্ধু গুহা হইতে বাহির হইয়া এদিক-ওদিক চাহিল। চন্দ্র এখনো অস্ত যায় নাই, জ্যোৎস্না-বাষ্পে চারিদিক সমাচ্ছন্ন। কিন্তু মানুষ কোথাও দেখা গেল না। তাহারা তখন আরো কিছুদূর অগ্রসর হইয়া একটি বৃহৎ প্রস্তরখণ্ডের পাশে দাঁড়াইল।

হাঁ, সরোবরের দিক হইতে দুইজন লোক আসিতেছে। এখনো দর্শকদের নিকট হইতে প্রায় শত হস্ত দূরে আছে। একজন দীর্ঘকায় ও কৃশ, অন্য ব্যক্তি খর্ব ও গজস্কন্ধ; জ্যোৎস্নালোকে তাহাদের মুখাবয়ব দেখা যাইতেছে না। তাহারা যেন প্রগাঢ় মনোযোগের সহিত কোনো গোপনীয় কথা আলোচনা করিতেছে।

অর্জুন ও বলরামের মাথার উপর দিয়া একটা পেচক গম্ভীর শব্দ করিয়া উড়িয়া গেল। বলরাম নিঃশব্দে অর্জুনের হাত ধরিয়া প্রস্তরস্তূপের আড়ালে টানিয়া লইল।

দুই মূর্তি অগ্রসর হইতেছে। অর্জুন ও বলরাম পাথরের আড়াল হইতে উঁকি মারিয়া দেখিল, যুগলমূর্তি তাহাদের বিশ হাত দূর দিয়া রাজসভার দিকে চলিয়া যাইতেছে। এখনো তাঁহাদের অবয়ব অস্পষ্ট; মানুষ বলিয়া চেনা যায় কিন্তু মুখ-চোখ দেখা যায় না।

অর্জুন বলরামকে ইঙ্গিত করিল, দুইজনে আড়াল হইতে বাহির হইয়া সমস্বরে তর্জন করিল— ‘কে যায়? দাঁড়াও।’

মূর্তিযুগল দাঁড়াইল; তাহাদের দেহভঙ্গিতে বিস্ময় ও বিরক্তি প্রকাশ পাইল। তারপর, বুদ্ধুদ যেমন ফাটিয়া অদৃশ্য হইয়া যায়, তেমনি তাহারা শূন্যে মিলাইয়া গেল।

অর্জুন ও বলরাম দৃষ্টি বিনিময় করিল। বলরাম অধর লেহন করিয়া বলিল— ‘যা দেখবার দেখেছি। চল, গুহায় ফিরি।’

গুহার ভিতরে চতুর্ভুজ জড়সড়ভাবে বসিয়া ছিল; প্রদীপটি নিব-নিব হইয়াছিল। বলরাম প্রদীপে তৈল ঢালিল, প্রদীপ আবার উজ্জ্বল হইল।

চতুর্ভুজ বায়সের ন্যায় বিকৃত কণ্ঠে বলিল— ‘দেখলে?’

বলরাম শয্যায় উপবেশন করিয়া বলিল— ‘দেখলাম। চোখের সামনে মিলিয়ে গেল। — কিন্তু ওরা যে হুক্ক-বুক্কের প্রেতাত্মা তা তুমি জানলে কি করে?’

চতুর্ভুজ শয্যার পাশে আসিয়া বসিল, বলিল— ‘গল্প শুনেছি। হরিহর ছিলেন লম্বা রোগা, আর বুক্ক ছিলেন বেঁটে মোটা। ওঁরা মাঝে মাঝে দেখা দেন, অনেকে দেখেছে। রাজ্যের যখন কোনো গুরুতর বিপদ উপস্থিত হয় তখন ওঁরা দেখা দেন।’

দুই বন্ধু উদ্বিগ্ন চক্ষে চাহিয়া রহিল। গুরুতর বিপদ! কী বিপদ! তুঙ্গভদ্রার পরপারে মূর্তিমান বিপদ বুভুক্ষু শার্দূলের ন্যায় ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, সেই বিপদ! কিংবা অন্য কিছু?

চতুর্ভুজের কথায় তাহাদের চিন্তাজাল ছিন্ন হইল— ‘আজ রাত্রে আমি গুহার মধ্যে থেকেই পাহারা দেব। কি বল?’

বলরাম কহিল— ‘সেই ভাল। তুমি আমাদের পাহারা দেবে, আমরা তোমাকে পাহারা দেব।’

চার

মহারাজ দেবরায় সৈন্য পরিদর্শনে যাত্রা করিবার পর সভাগৃহের দ্বিতলের গৌরব-গরিমা অনেকটা কমিয়া গিয়াছিল। দুই রাজকন্যা পরিচারিকা পরিবেষ্টিত হইয়া বাস করিতেছিলেন। পিঙ্গলা নাই, রাজার সঙ্গে গিয়াছে। বিদ্যুন্মালা ও মণিকঙ্কণার মানসিক অবস্থা খুবই করুণ হইয়া পড়িয়াছিল।

দুই ভগিনীর মনঃকষ্টের কারণ সম্পূর্ণ বিভিন্ন। মণিকঙ্কণা কাতর হইয়াছে রাজার বিরহে; প্রভাতে উঠিয়া সে আর রাজার দর্শন পায় না, আড়াল হইতে তাঁহার কণ্ঠস্বর শুনিতে পায় না। সে ক্ষিণ্ণ মনে এক কক্ষ হইতে অন্য কক্ষে ঘুরিয়া বেড়ায়; কখনো চুপি চুপি রাজার বিরামকক্ষে যায়, পালঙ্কের পাশে বসিয়া গভীর দীর্ঘশ্বাস মোচন করে। তারপর যখন গৃহ অসহ্য হইয়া ওঠে তখন দেবী পদ্মালয়ার ভবনে যায়; সেখানে বালক মল্লিকার্জুনের সঙ্গে কিয়ৎকাল খেলা করিয়া ফিরিয়া আসে। সে লক্ষ্য করে রাজার অবর্তমানে পদ্মালয়ার অবিচল প্রসন্নতা তিলমাত্র ক্ষুণ্ণ হয় নাই। সে মনে মনে বিস্মিত হয়। এরা কেমন মানুষ!

বিদ্যুন্মালার সমস্যা অন্য প্রকার। বস্তুত তাঁহার সমস্যা একটা নয়, অনেকগুলা সমস্যার সূত্র একসঙ্গে জট পাকাইয়া গিয়াছে।

বিদ্যুন্মালা যাঁহাকে বিবাহ করিবার জন্য বিজয়নগরে আসিয়াছেন সেই দেবরায়ের প্রতি তিনি প্রীতিমতী নন; যাহার প্রতি তাঁহার মন আসক্ত হইয়াছে সে রাজা নয়, রাজপুত্র নয়, অতি সামান্য যুবক। তাহার সহিত রাজপুত্রীর বিবাহের কথা কেহ ভাবিতেই পারে না।

পূর্বে অর্জুনের সহিত বিদ্যুন্মালার প্রায় প্রত্যহ দেখা হইত। দশ দিন আগে দ্বিতলের বাতায়নে দাঁড়াইয়া বিদ্যুন্মালা চকিতের ন্যায় অর্জুনকে অশ্বারোহণে চলিয়া যাইতে দেখিয়াছিলেন। তারপর আর তিনি অর্জুনকে দেখেন নাই; শুনিয়াছিলেন অর্জুন দৌত্যকার্যে গিয়াছিল, ফিরিয়া আসিয়াছে। তারপর সে কোথায় গেল? বিদ্যুন্মালা প্রত্যহ অতিথিশালার সম্মুখ দিয়া পম্পাপতির মন্দিরে যান, কিন্তু অর্জুনের দেখা পান না। কি হইল তাহার? দাসীদের প্রশ্ন করিতে শঙ্কা হয়, পাছে তাহারা সন্দেহ করে। তিনি অন্তর্দাহে দগ্ধ হইতেছেন।

বিবাহ তিন মাস পিছাইয়া গিয়াছে বটে, কিন্তু তিন মাস কতটুকু সময়? একটি একটি করিয়া দিন যাইতেছে আর মেয়াদের কাল ফুরাইয়া আসিতেছে। সময় যে যুগপৎ এমন দ্রুত ও মন্থর হইতে পারে তাহা কে জানিত? ভাবিয়া ভাবিয়া রাজকুমারীর দেহ কৃশ হইয়াছে, চোখে একটা অস্বাভাবিক প্রখর দৃষ্টি। জলবদ্ধা কুরঙ্গী বাহির হইবার পথ খুঁজিয়া পাইতেছে না।

একদিন সূর্যাস্ত কালে বিদ্যুন্মালা নিজ শয্যায় অর্ধশয়ান হইয়া দুর্ভাবনার জালে জড়াইয়া পড়িয়াছিলেন। মণিকঙ্কণা কক্ষে নাই, বোধ করি নিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে রাজার বিরামকক্ষে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। একটি দাসী ভূমিতলে বসিয়া কুমারীদের পরিধেয় বস্ত্র ঊর্মি করিতেছিল, কুমারীরা সান্ধ্য-স্নান করিয়া পরিধান করিবেন।

সূর্যাস্ত হইলে কক্ষের অভ্যন্তর ছায়াচ্ছন্ন হইল। বিদ্যুন্মালার দেহ সহসা অসহ্য অধীরতায় ছটফট করিয়া উঠিল। তিনি শয্যায় উপবিষ্ট হইয়া ডাকিলেন— ‘ভদ্রা!’

দাসী কাপড় চুনট্‌ করিতে করিতে জিজ্ঞাসু মুখ তুলিল— ‘আজ্ঞা রাজকুমারি।’

বিদ্যুন্মালা বলিলেন— ‘ঘরে আর তিষ্ঠতে পারছি না। চল, নীচে খোলা জায়গায় বেড়িয়ে আসি।’

ভদ্রা উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল— ‘তাহলে প্রতিহারিণীদের বলি। আপনি সন্ধ্যাস্নান সেরে বেশ পরিবর্তন করুন।’

বিদ্যুন্মালা বলিলেন— ‘না না, প্রতিহারিণীদের প্রয়োজন নেই, কেবল তুমি সঙ্গে থাকবে। ফিরে এসে বেশ পরিবর্তন করব।’

‘যে আজ্ঞা রাজকুমারি।’

ভদ্রাকে লইয়া বিদ্যুন্মালা নীচে নামিলেন। সোপানের প্রতিহারিণীরা একবার সপ্রশ্ন ভ্রূ তুলিল, ভদ্রা দক্ষিণ হস্তের ঈষৎ ইঙ্গিত করিল। রাজকুমারীরা বন্দিনী নন, কেহ বাধা দিল না।

প্রাঙ্গণে নামিয়া বিদ্যুন্মালা এদিক-ওদিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। কেবল উত্তরদিকে পম্পাপতির মন্দিরের পথ তাঁহার পরিচিত। তিনি বিপরীত দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিলেন— ‘ওদিকে কী আছে?’

ভদ্রা বলিল— ‘ওদিকে কমলা সরোবর।’

‘চল।’— বিদ্যুন্মালা সেই দিকে চলিলেন।

চলিতে চলিতে ভদ্রা বলিল— ‘কমলা সরোবর এখান থেকে অনেকটা দূর, প্রায় অর্ধ ক্রোশ। অত দূর কি যেতে পারবেন রাজকুমারি!’

বিদ্যুন্মালা উত্তর দিলেন না, ইতস্তত দৃষ্টিপাত করিতে করিতে চলিলেন; কিন্তু তাঁহার মন অন্তর্নিহিত হইয়া রহিল। সন্ধ্যার সময় লোকজন বেশি নাই; যে দু’চারটি পৌরজন সম্মুখে পড়িল তাহারা কলিঙ্গ-কুমারীকে দেখিয়া সসম্ভ্রমে দূরে সরিয়া গেল।

খানিক দূর গিয়া রাজকুমারী অনুভব করিলেন, পথ কঙ্করময় হইয়াছে, অদূরে একটি নীচু পাহাড়। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘ওটা কি?’

ভদ্রা বলিল— ‘ওটা একটা পাহাড় রাজকুমারি। ওর মধ্যে গুহা আছে। লোকে বলে— সঙ্কেত-গুহা।’ ভদ্রার ঠোঁটের কোণে একটু চাপা হাসি দেখা দিল। সঙ্কেত-গুহার পরিচয় পুরস্ত্রীরা সকলেই জানে।

রাজকুমারী গুহা সম্বন্ধে আর কোনো ঔৎসুক্য দেখাইলেন না, আরো কিছুদূর অগ্রসর হইয়া দেখিলেন, কমলা সরোবর এখনও দূরে। তিনি ফিরিলেন। এই ভ্রমণের ফলে বিক্ষিপ্ত মন ঈষৎ শান্ত হইল।

পরদিন সায়ংকালে বিদ্যুন্মালা ভদ্রাকে বলিলেন— ‘আমি আজও একটু ঘুরে-ফিরে আসি। তোমাকে সঙ্গে যেতে হবে না।’ ভদ্রার মুখে অব্যক্ত আপত্তি দেখিয়া বলিলেন— ‘ভয় নেই, আমি হারিয়ে যাব না, পথ চিনে আসতে পারব।’

ভদ্রা আর কিছু বলিতে পারিল না। বিদ্যুন্মালা নীচে নামিয়া কাল যেদিকে গিয়াছিলেন সেইদিকে চলিলেন। পরিচিত পথে চলাই ভাল; অপরিচিত পথ কিরূপ কণ্টকাকীর্ণ তাহা রাজকন্যা বুঝিতে আরম্ভ করিয়াছেন।

আকাশে সূর্যাস্তের বর্ণলীলা শেষ হইয়াছে, চাঁদের কিরণ পরিস্ফুট হয় নাই। বিদ্যুন্মালা নীচু পাহাড়টা পাশে রাখিয়া কিছু দূর অগ্রসর হইয়া ফিরি-ফিরি করিতেছেন, এমন সময় পিছন দিক হইতে কে বলিল— ‘রাজকুমারি! আপনি এখানে!’

বিদ্যুন্মালা ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। দেখিলেন গুহার দিক হইতে দ্রুতপদে আসিতেছে— অর্জুন। তাহার মুখে বিস্ময়বিমূঢ় হাসি।

অর্জুন বিদ্যুন্মালার সম্মুখে যুক্তকরে দাঁড়াইল, বলিল— ‘আপনি একা এতদূর এসেছেন!’

বিদ্যুন্মালা ক্ষণকাল তাহার মুখের পানে চাহিয়া রহিলেন, তারপর কোনো কথা না বলিয়া ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন। উদ্বেগের সঞ্চিত বাষ্প অশ্রুর আকারে বাহির হইয়া আসিল।

অর্জুন হতবুদ্ধি হইয়া গেল, নির্বাক সশঙ্ক মুখে বিদ্যুন্মালার পানে চাহিয়া রহিল।

বিদ্যুন্মালা চোখ মুছিলেন না, গলদশ্রু নেত্রে ভাঙা ভাঙা গলায় বলিলেন— ‘আগে রোজ সকালে আপনাকে দেখতাম, আজকাল দেখতে পাই না কেন?’

অর্জুন হৃদয়ের মধ্যে একটা চমক অনুভব করিল। রাজকুমারী এ কী বলিতেছেন! কিন্তু না, ইহা সাধারণ কুশলপ্রশ্ন মাত্র। অশ্রুজলেরও হয়তো একটা কারণ আছে; রমণীর অশ্রুপাতের কারণ কে কবে নির্ণয় করিতে পারিয়াছে? অর্জুন আত্মসংবরণ করিয়া বলিল— ‘আমি এখন আর অতিথি-ভবনে থাকি না। রাজা আমাকে কাজ দিয়েছেন। আমি আমার বন্ধু বলরামের সঙ্গে ওই গুহায় থাকি।’

বিদ্যুন্মালা এবার চোখ মুছিলেন, ঘাড় ফিরাইয়া গুহার দিকে চাহিয়া বলিলেন— ‘গুহায় থাকেন! গুহায় থাকেন কেন?’

অর্জুন বলিল— ‘তা জানি না। রাজার আদেশ। — আপনি ভাল আছেন?’

বিদ্যুন্মালার অধরে একটু ম্লান হাসি খেলিয়া গেল— ‘ভাল! হাঁ, ভালই আছি। আপনি তো লাঠি চড়ে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।’

অর্জুন বিস্মিত হইয়া বলিল— ‘আপনি জানলেন কি করে? ও— আমি বোধহয় আপনাকে লাঠি চড়ার কথা বলেছিলাম। হাঁ, রাজা আমাকে দূতকার্যে পাঠিয়েছিলেন।’

কিছুক্ষণ দু’জনে নীরব, যেন উভয়েরই কথা ফুরাইয়া গিয়াছে। শেষে অর্জুন বলিল— ‘সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। চলুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।’

বিদ্যুন্মালা বলিলেন— ‘না, আমি একা যেতে পারব। কাল এই সময় আপনি এখানে থাকবেন, আমি আসব।’

বিদ্যুন্মালা চলিয়া গেলেন। যাইতে যাইতে কয়েকবার পিছু ফিরিয়া চাহিলেন। অর্জুন দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর রাজকন্যা দৃষ্টির বহির্ভূত হইয়া গেলে অশান্ত শঙ্কিত মনে গুহায় ফিরিল।

বিদ্যুন্মালার একটি রাত্রি এবং একটি দিন দুঃসহ অধীরতার মধ্যে কাটিল। কিন্তু তিনি মন স্থির করিয়া লইয়াছেন : বায়ুতাড়িত হালভাঙ্গা নৌকায় ইতস্তত ভাসিয়া বেড়াইলে কোনো ফল হইবে না; নৌকা ছাড়িয়া জলে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া তীরের দিকে যাইতে হইবে। এবার অগাধ জলে সাঁতার।

সন্ধ্যার কিছু পূর্বে বিদ্যুন্মালা গুহার অভিমুখে গেলেন। মণিবন্ধে একটি মল্লীফুলের মালা জড়ানো। আজ আর কান্নাকাটি নয়, প্রগল্ভ চটুলতা। অর্জুনের হৃদয় এখনো প্রেমহীন; নারীর তূণীরে যত বাণ আছে সমস্ত প্রয়োগ করিয়া অর্জুনের হৃদয় জয় করিয়া লইতে হইবে।

অর্জুন অপেক্ষা করিতেছিল, যে পাষাণস্তূপের পাশে দাঁড়াইয়া হুক্ক-বুক্কের প্রেতাত্মা দর্শন করিয়াছিল সেই পাষাণস্তূপে ঠেস দিয়া পথের দিকে চাহিয়া ছিল। বিদ্যুন্মালা আসিয়া তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইল। অর্জুন খাড়া হইয়া দুই কর যুক্ত করিল।

বিদ্যুন্মালা হাসিলেন। গোধূলির আলোকে এই হাসির বিদ্যুদ্দীপ্তি যেন অর্জুনের চোখে ধাঁধা লাগাইয়া দিল। সে দেখিতে পাইল না যে হাসির পিছনে অনেকখানি কান্না, অনেকখানি ভয় লাগিয়া আছে।

রাজকন্যা বলিলেন— ‘এদিকটা বেশ নিরিবিলি। তবু স্তম্ভের আড়ালে যাওয়াই ভাল।’

তিনি আগে আগে চলিলেন, অর্জুন নীরবে তাঁহার অনুগামী হইল। দু’জনে স্তম্ভপাষাণের অন্তরালে দাঁড়াইলেন। এখানে কাহারো চোখে পড়িবার আশঙ্কা নাই।

বিদ্যুন্মালা অর্জুনের একটু কাছে সরিয়া আসিলেন, একটু ভঙ্গুর হাসিয়া বলিলেন— ‘অর্জুন ভদ্র, আবার আপনার বিপদ উপস্থিত হয়েছে।’

বিদ্যুন্মালার মুখে এমন কিছু ছিল যাহা দেখিয়া অর্জুনের বুক দুরুদুরু করিয়া উঠিল, সে ক্ষীণকণ্ঠে বলিল— ‘বিপদ!’

বিদ্যুন্মালা বলিলেন— ‘হাঁ, গুরুতর বিপদ। একবার যাকে নদী থেকে উদ্ধার করেছিলেন, তাকে আবার উদ্ধার করতে হবে।’

অর্জুন মূঢ়ের ন্যায় পুনরাবৃত্তি করিল— ‘উদ্ধার!’

বিদ্যুন্মালা অর্জুনের মুখ পর্যন্ত চক্ষু তুলিয়া আবার বক্ষ পর্যন্ত নত করিলেন; অস্ফুট স্বরে বলিলেন— ‘হাঁ, উদ্ধার। আমাকে উদ্ধার করতে হবে। এখনো বুঝতে পারছেন না?’

অসহায়ভাবে মাথা নাড়িয়া অর্জুন বলিল— ‘না।’

‘তবে বুঝিয়ে দিচ্ছি।’

বিদ্যুন্মালা মল্লীমালিকাটি মণিবন্ধ হইতে পাকে পাকে খুলিয়া দুই হাতে ধরিলেন, তারপর অর্জুন কিছু বুঝিবার পূর্বেই মালিকাটি তাহার গলায় পরাইয়া দিলেন।

অর্জুন ক্ষণকাল স্তম্ভিত হইয়া রহিল, তারপর প্রায় চিৎকার করিয়া উঠিল— ‘রাজকুমারি, এ কি করলেন?’

থরথর কম্পিত অধরে হাসি আনিয়া বিদ্যুন্মালা বলিলেন— ‘স্বয়ংবরা হলাম।’

তিনি একটি পাষাণ-পট্টের উপর বসিয়া পড়িলেন। প্রগল্ভতা তাঁহার প্রকৃতিসিদ্ধ নয়, তাই এইটুকু অভিনয় করিয়া তাঁহার দেহমনের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হইয়া গিয়াছিল।

অর্জুন আসিয়া তাঁহার পায়ের কাছে বসিল; ব্যাকুল চক্ষে তাঁহার মুখের পানে চাহিয়া রহিল। অলক্ষিত আকাশে আলো মৃদু হইয়া আসিতেছে।

অর্জুন মিনতির স্বরে বলিল— ‘রাজকুমারি, আপনি ক্ষণিক বিভ্রমে ভুল করে ফেলেছেন। আপনার মালা ফিরিয়ে নিন। আমি প্রাণান্তেও কাউকে কিছু বলব না।’

বিদ্যুন্মালা আকাশের পানে চাহিলেন, মাথা নাড়িয়া বলিলেন— ‘আর তা হয় না। কিন্তু আজ আমি যাই, অন্ধকার হয়ে গেছে। কাল আবার আসব। কাল কিন্তু আর তোমাকে ‘আপনি’ বলতে পারব না; তুমিও আমাকে ‘তুমি’ বলবে।’

ছায়ার ন্যায় বিদ্যুন্মালা অন্তর্হিতা হইলেন।

অর্জুন গুহায় ফিরিল। মঞ্জিরা এখনো খাদ্য লইয়া আসে নাই। বলরাম প্রদীপ জ্বালিয়া মৃদঙ্গ লইয়া বসিয়াছে, আপন মনে গান ধরিয়াছে—

ন কুরু নিতম্বিনি গমনবিলম্বনমনুসর তং হৃদয়েশম্‌।

অর্জুন গলা হইতে মালা খুলিয়া হাতে ঝুলাইয়া লইয়াছিল; বলরাম মালা দেখিয়া গান থামাইল; বলিল— ‘মালা কোথায় পেলে? পান-সুপারি বাজারে গিয়েছিলে নাকি?’

অর্জুন একটু স্থির থাকিয়া বলিল— ‘না, একটি মেয়ে দিয়েছে।’

বলরাম উচ্চ হাস্য করিয়া উঠিল— ‘আরো বাঃ! তুমিও একটি মেয়ে জুটিয়ে ফেলেছ! বেশ বেশ। তা— কে মেয়েটি? রাজপুরীর পুরন্ধ্রী নিশ্চয়।’

অর্জুন বলিল— ‘হাঁ, রাজপুরীর পুরন্ধ্রী। কিন্তু নাম বলতে নিষেধ আছে।’

এই সময় নৈশাহারের পাত্র মাথায় লইয়া মঞ্জিরা উপস্থিত হইল। মালার প্রসঙ্গ স্থগিত হইল।

সে-রাতে অর্জুন শয্যায় শয়ন করিয়া অনেকক্ষণ জাগিয়া রহিল। গভীর দুঃখ ও বিজয়োল্লাস একসঙ্গে অনুভব করা সকলের ভাগ্যে ঘটে না। এরূপ অভাবনীয় ব্যাপার তাহার জীবনে কেন ঘটিল! বিদ্যুন্মালাকে সে দেখিয়াছে শ্রদ্ধার চোখে, সম্ভ্রমের চোখে। কিন্তু তিনি মনে মনে তাহাকে কামনা করিয়াছেন। তিনি রাজকন্যা, রাজার বাগ্‌দত্তা বধূ; আর অর্জুন অতি সামান্য মানুষ। কী করিয়া ইহা সম্ভব হইল! তারপর— এখন কী হইবে? ইহার পরিণাম কোথায়? যেভাবে বলরাম মঞ্জিরাকে ভালবাসে সেভাবে অর্জুন বিদ্যুন্মালাকে ভালবাসে না। সম্ভ্রম ও পদমর্যাদার বিপুল ব্যবধান তাহাদের মাঝখানে। তাহাদের মধ্যে যে কোনপ্রকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ঘটিতে পারে ইহা তাহার কল্পনার অতীত। উপরন্তু সে রাজার ভৃত্য, রাজার বাগ্‌দত্তা বধূর প্রতি দৃষ্টিপাত করিবে কোন্‌ স্পর্ধায়!

উত্তপ্ত মস্তিষ্কের অসংযত দিগ্‌ভ্রান্ত চিন্তা নিষ্পন্ন হইবার পূর্বেই অর্জুন ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। ঘুম ভাঙ্গিল শেষ রাত্রে। মল্লীমালার ম্রিয়মাণ গন্ধ তাহার ঘুম ভাঙ্গাইয়া দিল।

মালাটি তাহার বুকের কাছে ছিল। সে তাহা মুষ্টিতে লইয়া একবার সজোরে পেষণ করিল, তারপর দূরে সরাইয়া রাখিল। যাহাতে ওই গন্ধ নাকে না আসে।

কিন্তু ঘুম আর আসিল না। মস্তিষ্কের মধ্যে চিন্তা-ঊর্ণনাভ জাল বুনিতে আরম্ভ করিল।

সেদিন সন্ধ্যাকালে পাথরের আড়ালে অর্জুন ও বিদ্যুন্মালার নিম্নরূপ কথোপকথন হইল :

অর্জুন বলিল— ‘তুমি রাজকন্যা। আমি সামান্য মানুষ।’

বিদ্যুন্মালা বলিলেন— ‘তুমি সামান্য মানুষ নও। তুমি যদুকুলোদ্ভব, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তোমার পূর্বপুরুষ।’

বিদ্যুন্মালা বেদীর মত একটি প্রস্তরখণ্ডে রাজেন্দ্রাণীর ন্যায় বসিয়াছেন, অর্জুন তাঁহার সম্মুখে সমতল ভূমিতে পিছনে পা মুড়িয়া উপবিষ্ট। বিদ্যুন্মালার চক্ষু অর্জুনের মুখের উপর নিশ্চলভাবে নিবদ্ধ। তিনি যেন জীবন বাজি রাখিয়া পাশা খেলিতেছেন। অর্জুনের দৃষ্টি পিঞ্জরাবদ্ধ পাখির মত এদিক-ওদিক ছটফট করিয়া ফিরিতেছে।

অর্জুন বলিল— ‘তুমি মহারাজ দেবরায়ের বাগ্‌দত্তা।’

বিদ্যুন্মালা বলিলেন— ‘আমি কাউকে বাগ্‌দান করিনি। রাজায় রাজায় রাজনৈতিক চুক্তি হয়েছে, আমি কেন তার দ্বারা আবদ্ধ হব?’

‘তোমার পিতা তোমাকে দান করেছেন।’

‘আমি কি পিতার তৈজস? আমার কি স্বতন্ত্র সত্তা নেই!’

‘শাস্ত্রে বলে স্ত্রীজাতি কখনো স্বাতন্ত্র্য পায় না।’

‘ও শাস্ত্র আমি মানি না। আমার হৃদয় আমি যাকে ইচ্ছা দান করব।’

‘তুমি অপাত্রে হৃদয় দান করেছ।’

‘ও কথা আগে হয়ে গেছে। তুমি অপাত্র নও।’

অর্জুন কিছুক্ষণ নতমুখে রহিল, তারপর মুখ তুলিয়া বলিল— ‘আমার দিক থেকে কথাটা চিন্তা করে দেখেছ?’

বিদ্যুন্মালার মুখে আষাঢ়ের মেঘ নামিয়া আসিল, চক্ষু বর্ষণ-শঙ্কিত হইল। তিনি বিদীর্ণ কণ্ঠে বলিলেন— ‘তুমি কি আমাকে চাও না?’

অর্জুন ক্লান্ত মস্তক বিদ্যুন্মালার জানুর উপর রাখিল, বিধুর কণ্ঠে বলিল— ‘চাওয়া না-চাওয়ার অবস্থা পার হয়ে গেছে। তিন দিন আগে আমি সজ্জন ছিলাম, আজ আমি কৃতঘ্ন বিশ্বাসঘাতক। রাজা আমাকে ভালবাসেন, আমাকে পরম বিশ্বাসের কাজ দিয়েছেন; আর আমি মুহূর্তে তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছি। তুমি আমার এ কী সর্বনাশ করলে?’

বিদ্যুন্মালার মুখের মেঘ কাটিয়া গিয়া ভাস্বর আনন্দ ফুটিয়া উঠিল। বিজয়িনীর আনন্দ। তিনি অর্জুনের মাথায় হাত রাখিয়া কোমল স্বরে বলিলেন— ‘কেন তুমি মিছে কষ্ট পাচ্ছ! রাজা হৃদয়বান লোক, তিনি তোমায় স্নেহ করেন, সবই সত্যি। কিন্তু তাঁর অনেক ভৃত্য-পরিচর আছে, তুমি না থাকলেও তাঁর চলবে। এবং তিনি না থাকলেও তোমার চলবে। তুমি এ দেশের অধিবাসী নও। তুমি রাজার কাজ ছেড়ে দাও। চল, আমরা চুপি চুপি এদেশ ছেড়ে পালিয়ে যাই।’

অর্জুন চমকিয়া মুখ তুলিল, বিভ্রান্ত চক্ষে চাহিয়া বলিল— ‘এ দেশ ছেড়ে চলে যাব! এই অমরাবতী ছেড়ে পালিয়ে যাব! কোথায় যাব? ম্লেচ্ছের দেশে? না, আমি পারব না।’

সে উঠিয়া দাঁড়াইল। বিদ্যুন্মালাও সঙ্গে সঙ্গে উঠিয়া তাহার হাত ধরিলেন। তিনি কিছু বলিবার উপক্রম করিয়াছেন, এমন সময় প্রস্তরস্তম্ভের অন্তরাল হইতে শব্দ শুনিয়া থমকিয়া গেলেন। অর্জুন শরীর শক্ত করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

শব্দটা আর কিছু নয়, মঞ্জিরা আপন মনে গানের কলি গুঞ্জরন করিতে করিতে খাবার লইয়া গুহার দিকে যাইতেছে। দুইজনে রুদ্ধশ্বাসে দাঁড়াইয়া রহিলেন, মঞ্জিরা তাঁহাদের দেখিতে পাইল না, তাহার গানের গুঞ্জন দূরে মিলাইয়া গেল।

বিদ্যুন্মালা অর্জুনের কানে অধর স্পর্শ করিয়া চুপি চুপি বলিলেন— ‘আজ যাই। কাল আবার আসব।’

তিনি জ্যোৎস্না-কুহেলির মধ্যে অদৃশ্য হইয়া গেলেন। অর্জুন হর্ষ-বিষাদ ভরা অন্তরে গুহায় ফিরিতে ফিরিতে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিল, কাল আর সে বিদ্যুন্মালার সঙ্গে দেখা করিতে আসিবে না।

কিন্তু প্রতিজ্ঞা রহিল না। পরদিন সে যথাকলে যথাস্থানে আবার উপস্থিত হইল। যৌবন ও বিবেকবুদ্ধির দড়ি-টানাটানি চলিতে লাগিল।

এইভাবে কয়েকদিন কাটিল। কিন্তু সমস্যার নিষ্পত্তি হইল না।

পাঁচ

মহারাজ দেবরায় সৈন্য পরিদর্শনে যাত্রা করিয়াছিলেন কৃষ্ণ পক্ষের দশমী তিথিতে, শুক্ল পক্ষের নবমী তিথিতে অগ্রদূত আসিয়া সংবাদ দিল, আগামী কল্য পূর্বাহ্ণে মহারাজ রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করিবেন। রাজপুরী এই এক পক্ষকাল যেন ঝিমাইয়া পড়িয়াছিল, আবার চন্‌মনে হইয়া উঠিল।

মণিকঙ্কণার হৃদয় আনন্দের হিন্দোলায় দুলিতেছে। কাল মহারাজ আসিবেন, কতদিন পরে তাঁহার দর্শন পাইব! প্রতীক্ষার উত্তেজনায় সে আত্মহারা। দিন কাটে তো রাত কাটে না।

বিদ্যুন্মালার মানসিক অবস্থা সহজেই অনুমেয়। রাজার অনুপস্থিতি কালে তিনি প্রবল হৃদয়বৃত্তির স্রোতে অবাধে ভাসিয়া চলিয়াছিলেন, বাধাবিঘ্নগুলি ক্ষুদ্র হইয়া গিয়াছিল; এখন বাধাবিঘ্নগুলি পর্বতপ্রমাণ উচ্চ হইয়া দাঁড়াইল। ভয়ে তাঁহার বুক শুকাইয়া গেল। তাঁহার সঙ্কল্প তিলমাত্র বিচলিত হইল না, কিন্তু সঙ্কল্প সিদ্ধির সম্ভাবনা কঠিন নৈরাশ্যের আঘাতে ভূমিসাৎ হইল। কী হইবে! অর্জুন পলায়ন করিতে অসম্মত। তবে কি মৃত্যু ভিন্ন এ সঙ্কট হইতে উদ্ধারের অন্য পথ নাই? বিদ্যুন্মালা উপাধানে মুখ গুঁজিয়া নীরবে কাঁদিলেন, চোখের জলে উপাধান সিক্ত হইল। কিন্তু অন্ধকারে পথের দিশা মিলিল না।

অর্জুনের অবস্থা বিদ্যুন্মালার অনুরূপ হইলেও তাহার মনে অনেকখানি আত্মগ্লানি মিশ্রিত আছে। বিদ্যুন্মালাকে সে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভালবাসিয়াছে, কিন্তু সমস্ত প্রাণ উৎসর্গ করিয়া ভালবাসিয়াছে, মনের মধ্যে এমন নিবিড় প্রেমের অনুভূতি পূর্বে তাহার অজ্ঞাত ছিল। কিন্তু প্রেম যত গভীরই হোক, তাহার দ্বারা অপরাধ-বোধ তো দূর হয় না। প্রেম যখন সমস্ত হৃদয় অধিকার করিয়াছে তখনো মস্তিষ্কের মধ্যে চিন্তার ক্রিয়া চলিয়াছে— আমি রাজার সহিত কৃতঘ্নতা করিয়াছি; যিনি আমার অন্নদাতা, যিনি আমার প্রভু, তাঁহারই সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছি। কেন বিদ্যুন্মালার প্রেম প্রথমেই প্রত্যাখ্যান করি নাই, কেন বার বার তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছি? এখন কী হইবে? রাজার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইব কেমন করিয়া! তাঁহার চোখে চোখ রাখিয়া চাহিব কোন্‌ সাহসে? তিনি যদি মুখ দেখিয়া মনের কথা বুঝিতে পারেন!…এ কথা কাহাকেও বলিবার নয়। বলরামকেও সে মুখ ফুটিয়া কিছু বলিতে পারে নাই। বলরাম তাহার চিত্তবিক্ষোভ লক্ষ্য করিয়াছে, মাঝে মাঝে প্রশ্ন করিয়াছে, কিন্তু সত্য উত্তর পায় নাই। সে ভাবিয়াছে অর্জুনের হৃদয় এখনো পিতৃশোকে মুহ্যমান।

এদিকের এই অবস্থা। ওদিকে কুমার কম্পন রাজার আশু প্রত্যাবর্তনের সংবাদ পাইয়া সর্বাঙ্গে উত্তেজনায় শিহরণ অনুভব করিলেন। সময় উপস্থিত; আর বিলম্ব নয়। এবার গৃহপ্রবেশের নিমন্ত্রণ পাঠাইতে হইবে। যাহারা রাজার বিশ্বাসী প্রিয়পাত্র কেবল সেইসব মন্ত্রী সভাসদকে নিমন্ত্রণ করিতে হইবে। তারপর সকলে একত্রিত হইলে রাজার সঙ্গে সকলকে একসঙ্গে নির্মূল করিতে হইবে। কবে নিমন্ত্রণ করিলে ভাল হয়? কাল রাজা ফিরিবেন, হয়তো ক্লান্ত দেহে নিমন্ত্রণ রক্ষা না করিতে পারেন। সুতরাং পরশ্বই শুভদিন।

কুমার কম্পন বাছা বাছা রাজপুরুষদের নিমন্ত্রণ পাঠাইলেন এবং নবনির্মিত গৃহে অতিথিসৎকারের আয়োজন করিতে লাগিলেন।

পিতা বীরবিজয়ের কথাও কম্পন ভুলিলেন না। বুড়া তাঁহাকে দু’চক্ষে দেখিতে পারেন না। তাঁহার সদ্‌গতি করিতে হইবে।

পরদিন মধ্যাহ্নের দুই দণ্ড পূর্বে মহারাজ দেবরায় ডঙ্কা বাজাইয়া সদলবলে পুরীতে ফিরিয়া আসিলেন। সভাগৃহের বহিঃপ্রাঙ্গণে বৃহৎ জনতা অপেক্ষা করিতেছিল, তন্মধ্যে দুইজন প্রধান : কুমার কম্পন এবং ধন্নায়ক লক্ষ্মণ। সাত শত পুরপ্রহরিণী শঙ্খ বাজাইয়া তুমুল নির্ঘোষে রাজার সম্বর্ধনা করিল।

রাজা অশ্ব হইতে অবতরন করিতেই কুমার কম্পন ছুটিয়া আসিয়া তাঁহার জানু স্পর্শ করিয়া প্রণাম করিলেন, বলিলেন— ‘আর্য, আপনি ছিলেন না, রাজপুরী অন্ধকার ছিল, আজ এক পক্ষ পরে আবার সূর্যোদয় হল।’

কুমার কম্পন অতিশয় মিষ্টভাষী, কিন্তু তাঁহার মুখেও কথাগুলি চাটুবাক্যের মত শুনাইল। রাজা একটু হাসিলেন, ভ্রাতার স্কন্ধে হাত রাখিয়া বলিলেন— ‘তোমার সংবাদ শুভ? গৃহপ্রবেশের আর বিলম্ব কত?’

কম্পন বলিলেন— ‘গৃহ প্রস্তুত! কেবল আপনার জন্য গৃহপ্রবেশ স্থগিত রেখেছি। কাল সন্ধ্যার সময় আপনাকে আমার নূতন গৃহে পদার্পণ করতে হবে আর্য। কাল আমার গৃহপ্রবেশের শুভমুহূর্ত স্থির হয়েছে।’

রাজা বলিলেন— ‘তোমার নূতন গৃহে অবশ্য পদার্পণ করব।’

‘ধন্য।’ কম্পন আর দাঁড়াইলেন না, বেশি কথা বলিলে পাছে মনোগত অভিপ্রায় প্রকাশ হইয়া পড়ে তাই তাড়াতাড়ি প্রস্থান করিলেন।

রাজা তখন মন্ত্রী উপমন্ত্রী সভাসদ্‌ বিদেশীয় রাষ্ট্রদূত প্রভৃতি সমবেত প্রধানদের দিকে ফিরিলেন। প্রত্যেককে মিষ্ট সম্ভাষণ করিয়া কিছু সংবাদের আদান-প্রদান করিয়া বিরাম-ভবনে প্রবেশ করিলেন।

ইতিমধ্যে পিঙ্গলা আসিয়া দ্বিতলের বিশ্রামকক্ষের তত্ত্বাবধান করিয়াছিল, পাচকেরা রান্না চড়াইয়াছিল। রাজা অত্বরিতভাবে স্নান করিলেন, তারপর ধীরে সুস্থে আহারে বসিলেন। আহার শেষ হইতে বেলা দ্বিপ্রহর অতীত হইয়া গেল।

রাজা পালঙ্কে অঙ্গ প্রসারিত করিলেন। পিঙ্গলা ভূমিতলে বসিয়া পান সাজিতে প্রবৃত্ত হইল। রাজা অলসকণ্ঠে প্রশ্ন করিলেন— ‘কলিঙ্গ-রাজকুমারীদের সংবাদ নিয়েছ?’

পিঙ্গলা বলিল— ‘তাঁহারা কুশলে আছেন আর্য।’

এই সময় নব জলধরে বিজুরিরেখার ন্যায় মণিকঙ্কণা কক্ষে প্রবেশ করিল; ছায়াচ্ছন্ন কক্ষটি তাহার রূপের প্রভায় প্রভাময় হইয়া উঠিল।

তাহাকে দেখিয়া মহারাজ সহাস্যমুখে শয্যায় উঠিয়া বসিবার উপক্রম করিলেন; মণিকঙ্কণা তাঁহাকে প্রণাম করিয়া বলিল— ‘উঠবেন না মহারাজ, আপনি বিশ্রাম করুন। পিঙ্গলা, তুমি ওঠো, আজ আমি মহারাজকে পান সেজে দেব।’

পিঙ্গলা হাসিমুখে সরিয়া দাঁড়াইল। মণিকঙ্কণা তাহার স্থানে বসিয়া পান সাজিতে লাগিয়া গেল। রাজা পাশ ফিরিয়া অর্ধশয়ানভাবে তাহার তাম্বূল রচনা দেখিতে লাগিলেন। পিঙ্গলা স্মিতমুখে বলিল— ‘ধন্য রাজকুমারী! পান সাজতেও জানেন!’

মণিকঙ্কণা পর্ণপত্রে খদির লেপন করিতে করিতে বলিল— ‘কেন জানিব না! কতবার মাতাদের পান সেজে দিয়েছি। কলিঙ্গ দেশে পানের খুব প্রচলন। তবে উপকরণে বিশেষ আছে। পানের সঙ্গে গুয়া খদির কর্পূর দারুচিনি তো থাকেই, চুয়া কেয়া-খদির নারঙ্গফুলের ত্বক্‌, কেশর প্রভৃতিও থাকে। — এই নিন মহারাজ।’

মণিকঙ্কণা উঠিয়া পানের তবক রাজার সম্মুখে ধরিল; তিনি সেটি মুখে দিয়া কিছুক্ষণ চিবাইলেন, তারপর বলিলেন— ‘চমৎকার পান! তুমি এত ভাল পান সাজতে পার জানলে আগেই তোমার শরণ নিতাম। কাল থেকে তুমি নিত্য দ্বিপ্রহরে এসে আমার পান সেজে দেবে।’

মণিকঙ্কণা কৃতার্থ হইয়া বলিল— ‘তাই দেব মহারাজ। আমাদের সঙ্গে কিছু কলিঙ্গদেশীয় পানের উপকরণ আছে, তাই দিয়ে পান সেজে দেব।’

সে আবার পানের বাটা লইয়া বসিতে যাইতেছিল, এমন সময় নিঃশব্দপদে ধন্নায়ক লক্ষ্মণ মল্লপ প্রবেশ করিলেন। মণিকঙ্কণা বলিল— ‘ওমা, মন্ত্রীমশায় এলেন! এবার বুঝি রাজকার্য হবে। আমি তাহলে যাই।’ রাজার প্রতি দীর্ঘ বিলম্বিত দৃষ্টি সম্পাত করিয়া সে নিষ্ক্রান্ত হইল।

মন্ত্রী পালঙ্কের শিয়রের দিকে ভূমিতলে বসিলেন। পিঙ্গলা তাম্বূলকরঙ্ক তাঁহার দিকে আগাইয়া দিয়া ঘর হইতে চলিয়া গেল। রাজার সঙ্গে ভ্রমণ করিয়া ফিরিবার পর সে এখনো পলকের জন্য বিশ্রাম পায় নাই।

রাজা ও মন্ত্রীর মধ্যে বাক্যালাপ আরম্ভ হইল। মন্ত্রী মহাশয়ের নিবেদন করিবার বিশেষ কিছু ছিল না, তিনি সংক্ষেপে রাজ্য সম্বন্ধীয় বক্তব্য শেষ করিয়া বলিলেন— ‘একটা সংবাদ আছে; হুক্ক-বুক্কর প্রেতাত্মা দেখা দিয়েছে।’

রাজা শয্যায় উঠিয়া বসিলেন— ‘হুক্ক-বুক্ক দেখা দিয়েছেন? কে দেখেছে?’

মন্ত্রী বলিলেন— ‘অর্জুন ও বলরামের গুহা পাহারা দেবার জন্য যাদের নিয়োগ করেছিলাম, তাদের মধ্যে একজন দেখেছে। অর্জুন ও বলরামও দেখেছে।’

‘হুঁ।’ মহারাজ কর্ণের মণিকুণ্ডল অঙ্গুলিতে ধরিয়া একটু নাড়াচাড়া করিলেন— ‘অনেক দিন পরে হুক্ক-বুক্ক দেখা দিলেন। সেই আহমদ শা সুলতান হয়ে যখন বিজয়নগর আক্রমণ করেছিল তার আগে দেখা দিয়েছিলেন! আশঙ্কা হয়, দারুণ বিপদ আসন্ন। কিন্তু কোন্‌ দিক দিয়ে আসবে বুঝতে পারছি না।’

মন্ত্রী জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘সীমান্তের অবস্থা কেমন দেখলেন?’

রাজা বলিলেন— ‘শত্রুর তৎপরতার কোনো চিহ্ন পেলাম না। আমার সীমান্তরক্ষী সেনাদল একটু ঝিমিয়ে পড়েছিল, আমাকে দেখে আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।’

মন্ত্রী কিছুক্ষণ কুচকুচ করিয়া সুপারি কাটিলেন, তারপর নিজের জন্য গান সাজিতে সাজিতে বলিলেন— ‘কুমার কম্পন গৃহপ্রবেশ উপলক্ষে বাছা বাছা কয়েকজন সদস্যকে নিমন্ত্রণ করেছেন। আমিও নিমন্ত্রিত হয়েছি। আমার কিন্তু ভাল লাগছে না।’

‘কী ভাল লাগছে না?’

‘এই নিমন্ত্রণের ভাবভঙ্গি। সন্দেহ হচ্ছে কুমার কম্পনের কোনো প্রচ্ছন্ন অভিসন্ধি আছে। যে দ্বাদশ ব্যক্তিকে নিমন্ত্রণ করেছেন তাদের কারুর সঙ্গেই তাঁর ঘনিষ্ঠ হৃদ্যতা নেই।’

‘কিন্তু— প্রচ্ছন্ন অভিসন্ধি কী থাকতে পারে?’

‘তা জানি না। মহারাজ, আপনিও নিমন্ত্রিত, আমার মনে হয় আপনার না যাওয়াই ভাল।’

রাজার ললাট মেঘাচ্ছন্ন হইল, তিনি ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া বলিলেন— ‘কম্পন আমাকে ভালবাসে, সে আমার অনিষ্ট করবার চেষ্টা করবে, আমি ভাবতেও পারি না। তাছাড়া আমার অনিষ্ট করবার ক্ষমতা তার নেই। — আপনিও তো নিমন্ত্রিত হয়েছেন, আপনি কি যাবেন না?’

মন্ত্রী পান মুখে দিয়া বলিলেন— ‘না মহারাজ, আমি যাব না। হুক্ক-বুক্ক দেখা দিয়েছেন, এ সময় আমাদের সকলেরই সতর্ক থাকা প্রয়োজন।’

এ প্রসঙ্গ সমাপ্ত হইবার পূর্বেই দ্বাররক্ষিণী আসিয়া জানাইল, অর্জুনবর্মা ও বলরাম রাজার সাক্ষাৎপ্রার্থী।

রাজার অনুমতী পাইয়া দুইজনে আসিয়া পালঙ্কের পদপ্রান্তে বসিল। অর্জুন রাজার মুখের দিকে একবার চক্ষু তুলিয়াই চক্ষু নত করিল। বলরাম যুক্তকরে বলিল— ‘আর্য, কামান তৈরি হয়েছে। সঙ্গে এনেছিলাম, প্রহরিণীর কাছে গচ্ছিত আছে।’

রাজা প্রহারিণীকে ডাকিয়া কামান আনিতে বলিলেন। কামান আসিলে প্রহরিণীকে বলিলেন— ‘বলরাম বা অর্জুন যদি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমার কাছে আসতে চায়, তাদের বাধা দিও না।’

প্রহরিণী প্রস্থান করিলে বলরাম উঠিয়া কামান রাজার হাতে দিল। একহস্ত পরিমাণ যন্ত্রটি, দেখিতে অনেকটা বক-যন্ত্রের মত। রাজা সেটিকে উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া মন্ত্রীর হাতে দিলেন, বলিলেন— ‘যন্ত্রের প্রক্রিয়া বুঝেছি। যন্ত্র চালিয়ে দেখেছ?’

বলরাম বলিল— ‘আজ্ঞা দেখেছি, ঠিক চলে। অর্জুন আর আমি একদিন বনের মধ্যে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছি। পঞ্চাশ হাত দূর পর্যন্ত প্রাণঘাতী লক্ষ্যভেদ করতে পারে।’

রাজা বলিলেন— ‘ভাল, আমিও পরীক্ষা করে দেখতে চাই। কাল প্রত্যূষে তোমরা আসবে, দক্ষিণের জঙ্গলে পরীক্ষা হবে। পরীক্ষার জন্য কি কি বস্তু প্রয়োজন?’

বলরাম বলিল— ‘বেশি কিছু নয় আর্য, গোটা তিনেক মাটির কলসী হলেই চলবে। বাকি যা কিছু— গুলি বারুদ কার্পাসবস্ত্র, নারিকেল-রজ্জু— আমি নিয়ে আসব।’

রাজা প্রশ্ন করিলেন— ‘লৌহ-নালিকা প্রস্তুতের কৌশল প্রকাশ করতে চাও না?’

বলরাম আবার যুক্তপাণি হইল— ‘মহারাজ, এটি আমার নিজস্ব গুপ্তবিদ্যা। যদি উপযুক্ত শিষ্য পাই তাকে শেখাব।’

‘ভাল। তুমি একা এই লঘু কামান কত তৈয়ার করতে পার?’

‘মাসে তিনটা তৈয়ার করতে পারব।’

রাজা ঈষৎ চিন্তা করিয়া বলিলেন— ‘তবে তোমার গুপ্তবিদ্যা গুপ্তই থাক। অন্তত শত্রুপক্ষ জানতে পারবে না।’

পরদিন ঊষাকালে রাজা বলরাম ও অর্জুনকে সঙ্গে লইয়া দক্ষিণের জঙ্গলে উপস্থিত হইলেন। জঙ্গল নামমাত্র, রৌদ্রদগ্ধ শুষ্ক গাছপালার ফাঁকে শিলাকীর্ণ অসম ভূমি। তিনটি মৃৎকলস পাশাপাশি বসাইয়া বলরাম কলস হইতে পঞ্চাশ হাত দূরে সরিয়া আসিয়া লক্ষ্যভেদের জন্য প্রস্তুত হইল।

প্রথমে সে কামানটির নলের মুখ দিয়া অর্ধমুষ্টি বারুদ প্রবিষ্ট করাইয়া দিয়া ক্ষুদ্র একখণ্ড কার্পাস নলের মুখে ঠাসিয়া দিল; কামানের পশ্চাদ্ভাগে সূক্ষ্ম ছিদ্রপথে একটু বারুদের গুঁড়া দেখা গেল। তখন সে নলের মুখে মটরের মত কয়েকটি লৌহ-গুটিকা প্রবিষ্ট করাইয়া আবার কার্পাসখণ্ড দিয়া মুখ বন্ধ করিল। বলিল— ‘মহারাজ, কামান তৈরি। এখন আগুন দিলেই গুলি বেরুবে।’

রাজা বলিলেন— ‘দাও আগুন।’

বলরাম একটি অগ্নিমুখ নারিকেল-রজ্জু সঙ্গে আনিয়াছিল, সে কলসীর দিকে লক্ষ্য স্থির করিয়া কামানের পিছন দিকে অগ্নিস্পর্শ করিল। অমনি সশব্দে কামান হইতে গুলি বাহির হইয়া পঞ্চাশ হাত দূরের তিনটি কলস চুর্ণ করিয়া দিল।

রাজা সহর্ষে বলরামের স্কন্ধে হাত রাখিয়া বলিলেন— ‘ধন্য! আজ থেকে অর্জুনের মত তুমিও আমার ভৃত্য হলে। — এই লঘু কামান আমি নিলাম।’

ছয়

সন্ধ্যার পর কুমার কম্পনের নূতন প্রাসাদ দীপমালায় সজ্জিত হইয়াছিল। প্রাসাদের তোরণশীর্ষে একদল বাদ্যকর মধুর বাদ্যধ্বনি করিতেছিল। গৃহপ্রবেশের শুভমুহূর্ত সমাগত।

প্রাসাদে এখনো পুরস্ত্রীগণের শুভাগমন হয় নাই। কেবল কয়েকজন ষণ্ডামার্ক ভৃত্য আছে; আর আছে স্বয়ং কুমার কম্পন।

অতিথিরা একে একে আসিতে লাগিলেন। তাঁহারা সংখ্যায় বেশি নয়, মাত্র দ্বাদশ জন।

কুমার কম্পন পরম সমাদরের সহিত সকলকে গোষ্ঠাগারে বসাইলেন। তাঁহার মুখের অম্লান হাসির উপর মনের আরক্ত ছায়া পড়িল না।

দ্বাদশজন সমবেত হইলে কুমার কম্পন বলিলেন— ‘আমি মানস করেছি আমার গৃহের প্রত্যেকটি কক্ষে একটি করে অতিথিকে ভোজন করাব। তাহলে আমার সমস্ত গৃহ পবিত্র হবে।’

অতিথিরা হর্ষ জ্ঞাপন করিলেন। কুমার কম্পন একজনকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন— ‘জীমূতবাহন ভদ্র, আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ, আপনি আগে আসুন।’

বয়োজ্যেষ্ঠ জীমূতবাহন ভদ্র গাত্রোত্থান করিয়া কুমার কম্পনের অনুসরণ করিলেন। বাকি সকলে বসিয়া নিজ নিজ বয়সের তুলনামূলক আলোচনা করিতে লাগিলেন।

কুমার কম্পন অতিথিকে একটি কক্ষে লইয়া গেলেন। বহু দীপের আলোকে কক্ষটি প্রভান্বিত, শঙ্খশুভ্র কুট্টিমের উপর শ্বেতপ্রস্তরের পীঠিকা, পীঠিকার সম্মুখে নানাবিধ অন্নব্যঞ্জনপরিপূর্ণ থালি। দুইজন ভৃত্য অদূরে দাঁড়াইয়া আছে, একজনের হাতে ভৃঙ্গার ও পানপাত্র, অন্য ভৃত্য চামর লইয়া অপেক্ষা করিতেছে।

কুমার কম্পন অতিথিকে বলিলেন— ‘আসন গ্রহণ করুন ভদ্র।’

ভদ্র পীঠিকায় উপবিষ্ট হইলেন। কুমার কম্পন বলিলেন— ‘অগ্রে ফলাম্লরস পান করুন ভদ্র।’

ভৃত্য পানপাত্রে পানীয় ঢালিয়া ভদ্রের হাতে দিল, ভদ্র পানিপাত্র মুখে দিয়া এক নিশ্বাসে পান করিলেন। পাত্র ভৃত্যের হাতে প্রত্যার্পণ করিয়া তিনি ক্ষণকাল স্থির হইয়া রহিলেন, তারপর ধীরে ধীরে পাশের দিকে ঢলিয়া পড়িলেন।

কুমার কম্পন অপলক নেত্রে অতিথিকে নিরীক্ষণ করিতেছিলেন; তাঁহার মুখে চকিত হাসি ফুটিল। অব্যর্থ বিষ, বিষবৈদ্য যাহা বলিয়াছিল তাহা মিথ্যা নয়। তিনি ভৃত্যদের ইঙ্গিত করিলেন, ভৃত্যরা অতিথির মৃতদেহ ধরাধরি করিয়া পিছনের দ্বার দিয়া প্রস্থান করিল।

কুমার কম্পনের মস্তকে ধীরে ধীরে হত্যার মাদকতা চড়িতেছে, চোখের দৃষ্টি ঈষৎ অরুণাভ হইয়াছে। তিনি অন্য অতিথিদের কাছে ফিরিয়া গেলেন, মধুর হাসিয়া বলিলেন— ‘ভদ্র কুমারাপ্পা, এবার আপনি আসুন।’

কুমারাপ্পা মহাশয় গাত্রোত্থান করিলেন।

এইভাবে কুমার কম্পন একটির পর একটি করিয়া দ্বাদশটি অতিথির সৎকার করিলেন। এই কার্য সমাপ্ত করিতে একদণ্ড সময়ও লাগিল না।

কুমার কম্পনের মাথায় রক্তের নেশা পাক খাইতেছে, তিনি চারিদিক রক্তবর্ণ দেখিতেছেন, সমস্ত দেহ থাকিয়া থাকিয়া অসহ্য অধীরতায় ছট্‌ফট্‌ করিয়া উঠিতেছে। রাজা এখনো আসিতেছে না কেন! তবে কি আসিবে না! যদি না আসে?

গৃহে ভৃত্যেরা ছাড়া অন্য কেহ নাই। অন্য কেহ আসিবে না। যাহারা আসিয়াছিল তাহারা নিঃশেষিত হইয়াছে। বাকি শুধু রাজা। রাজা যদি কিছু সন্দেহ করিয়া থাকে সে আসিবে না। লক্ষ্মণ মল্লপও আসে নাই, হয়তো লক্ষ্মণ মল্লপই রাজাকে সতর্ক করিয়া দিয়াছে—!

কুমার কম্পনের মাথার মধ্যে রক্তস্রোত তোলপাড় করিতেছিল, অধিক সূক্ষ্ম চিন্তা করিবার শক্তি তাঁহার ছিল না। রাজা যদি না আসে আমিই তাহার কাছে যাইব। সে এই সময় একাকী বিরামকক্ষে থাকে। যদি বা লক্ষ্মণ মল্লপ সঙ্গে থাকে তবে একসঙ্গে দু’জনকেই বধ করিব।

ভৃত্যদের সাবধান করিয়া দিয়া কুমার কম্পন একটি ক্ষুদ্র ছুরিকা কটিবস্ত্রে বাঁধিয়া লইলেন; তারপর গৃহ হইতে বাহির হইলেন। তোরণশীর্ষে মধুর বাদ্যধ্বনি চলিতে লাগিল।

তোরণের বাহিরে আসিয়া একটা কথা কুমার কম্পনের মনে পড়িল, তিনি থমকিয়া দাঁড়াইলেন। বৃদ্ধ পিতা বিজয়রায়। সে কনিষ্ঠ পুত্রকে দেখিতে পারে না, সে যদি বাঁচিয়া থাকে তবে নানা অনর্থ ঘটাইবে। সুতরাং তাহাকেই সর্বাগ্রে বিনাশ করা প্রয়োজন।

রাজ-পিতা বিজয়রায়ের ভবন অধিক দূর নয়, কুমার কম্পন সেইদিকে চলিলেন।

বিজয়রায়ের ভবন পাহারার ব্যবস্থা নামমাত্র, ভবন-দাসীর সংখ্যাও বেশি নয়; বৃদ্ধ ঘটা-চটা ভালবাসেন না। তোরণদ্বারের কাছে দুইজন প্রহরী বসিয়া দুইজন ভবন-দাসীর সঙ্গে রসালাপ করিতেছিল; কুমার কম্পনকে দেখিয়া তাহারা সন্ত্রস্তভাবে উঠিয়া দাঁড়াইল। কুমার কম্পন পিতৃভবনে কখনো আসেন না।

তিনি কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ না করিয়া ভবনে প্রবেশ করিলেন। ভৃত্যেরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। পুত্র পিতার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছেন, ইহাতে আশঙ্কার কথা কিছু নাই, তাহারা ভাবিতে লাগিল শিষ্টাচারের কোনো ত্রুটি হইল কিনা।

ভবনের দ্বিতলে বসিয়া বিজয়রায় তখন এক নূতন মিষ্টান্ন প্রস্তুত করিতেছিলেন। যবচূর্ণ শক্তু তালের রসে মাখিয়া পিণ্ডক্ষীরের সহিত থাসিয়া পাক করিলে উত্তম নাড়ু হয় কিনা পরীক্ষা করিতেছিলেন। এমন সময় কম্পন গিয়া দাঁড়াইলেন।

বিজয়রায় মুখ তুলিয়া ভ্রূকুটি করিলেন, বলিলেন— ‘কম্পন! কী চাও?’

কুমার কম্পন উত্তর দিলেন না, ক্ষিপ্রহস্তে কটি হইতে ছুরিকা লইয়া পিতার বক্ষে আঘাত করিলেন। ছুরিকা পঞ্জরের অন্তর দিয়া হৃৎপিণ্ডে প্রবেশ করিল। বিজয়রায় চিৎ হইয়া পড়িয়া গেলেন, তাঁহার মুখ দিয়া কেবল একটি ত্রস্ত-বিস্মিত শব্দ বাহির হইল— ‘অধম—!’ তারপর তাঁহার অক্ষিপটল উল্টাইয়া গেল।

কম্পন তাঁহার বক্ষ হইতে ছুরিকা বাহির করিয়া আবার কটিতে রাখিলেন। পিতার মুখের পানে আর চাহিলেন না, দ্রুত নামিয়া চলিলেন।

সূর্যাস্তকালে অর্জুন অভ্যাসমত সভাগৃহের প্রাঙ্গণে আসিয়াছিল। অভ্যাসবশতই লাঠি দু’টি তাহার সঙ্গে ছিল। ক্রমে সন্ধ্যা হইল, মহারাজ সভাভঙ্গ করিয়া দ্বিতলে প্রস্থান করিলেন। তবু অর্জুন প্রাঙ্গণে ঘোরাঘুরি করিতে লাগিল। রাজার সহিত সাক্ষাৎ করিবার কোনো নিমিত্ত ছিল না, রাজা তাহাকে আহ্বান করেন নাই, কিন্তু তাহার মন তথাপি গুহায় ফিরিয়া যাইতে চাহিল না। এই গৃহে বিদ্যুন্মালা আছেন তাই কি সে নিজের অজ্ঞাতে এই গৃহের ছায়া ত্যাগ করিতে পারিতেছে না, অকারণে প্রাঙ্গণে ঘুরিয়া বেড়ায়? মানুষের মন দুর্জ্ঞেয়, মন কখন মানুষকে কোন দিকে টানিতেছে, কোন দিকে ঠেলিতেছে, কিছুই বোঝা যায় না।

চাঁদ উঠিয়াছে। প্রাঙ্গণ জনবিরল হইয়া গিয়াছে। সহসা অর্জুন দেখিল কুমার কম্পন আসিতেছেন। তাঁহার গতিভঙ্গিতে অস্বাভাবিক ব্যগ্রতা পরিদৃষ্ট হইতেছে। তিনি অর্জুনের দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করিলেন না, সভাগৃহের দ্বারের অভিমুখে চলিলেন। অর্জুন চকিত হইয়া লক্ষ্য করিল তাহার কটিতে একটি ছুরিকা আবদ্ধ রহিয়াছে। কম্পন অবশ্য রাজার সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইতেছেন, কিন্তু সঙ্গে ছুরি কেন? অস্ত্র লইয়া রাজার সম্মুখীন হওয়া নিষিদ্ধ। বিদ্যুদ্বেগে কয়েকটি চিন্তা তাহার মাথার মধ্যে খেলিয়া গেল।

কুমার কম্পন সোপান বাহিয়া দ্রুতপদে উঠিতে লাগিলেন। সোপানের প্রতিহারিণীরা বাধা দিল না, কারণ রাজসকাশে কম্পনের অবাধ গতি।

কম্পন রাজার বিরামকক্ষে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন দীপান্বিত কক্ষে অন্য কেহ নাই, রাজা পালঙ্কে শুইয়া চক্ষু মুদিয়া আছেন। বোধহয় নিদ্রিত। কম্পন ক্ষিপ্রচরণে সেইদিকে চলিলেন।

রাজা কিন্তু নিদ্রা যান নাই, চক্ষু মুদিয়া রাজ্য-চিন্তা করিতেছিলেন। পদশব্দে চক্ষু মেলিয়া তিনি উঠিয়া বসিলেন। কম্পনের ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক নয়। রাজা ঈষৎ বিস্মিত স্বরে বলিলেন— ‘কম্পন, কী চাও?’ তিনি গৃহপ্রবেশের কথা ভুলিয়া গিয়াছিলেন।

কম্পনের হিংস্র মুখে হাসি ফুটিল। তিনি ছুরিকা হাতে লইয়া বলিলেন— ‘রাজ্য চাই।’

তারপর যাহা ঘটিল। তাহা প্রায় নিঃশব্দে ঘটিল। রাজা নিরস্ত্র বসিয়া আছেন। কুমার কম্পন তাঁহার কণ্ঠ লক্ষ্য করিয়া ছুরি চালাইলেন। রাজা অবশে আত্মরক্ষার জন্য বাম বাহু তুলিলেন, ছুরি তাঁহার কফোণির নিম্নে বাহুর পশ্চাদ্দিকে বিদ্ধ হইল। প্রথমবার ব্যর্থ হইয়া কম্পন আবার ছুরি তুলিলেন। কিন্তু এবার আর তাঁহাকে ছুরি চালাইতে হইল না, অকস্মাৎ পিছন হইতে তীক্ষ্ণাগ্র বংশ-ভল্ল আসিয়া তাঁহার গ্রীবামূলে বিদ্ধ হইল। কম্পন বাঙ্‌নিষ্পত্তি না করিয়া পালঙ্কের সম্মুখে পড়িয়া গেলেন।

রাজাও বাঙ্‌নিষ্পত্তি করিলেন না, এক দৃষ্টে মৃত ভ্রাতার দিকে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার বাহু হইতে গলগল ধারায় রক্ত প্রবাহিত হইতে লাগিল।

‘মহারাজ, আপনি আহত!’

রাজা অর্জুনের পানে চক্ষু তুলিলেন। অর্জুন দেখিল, রাজার চক্ষু অশ্রুসিক্ত।

রাজা কণ্ঠস্বর সংযত করিতে করিতে বলিলেন— ‘অর্জুন, তুমি আমার জীবন রক্ষা করেছ।’

অর্জুন নীরব রহিল।

এই সময় পিঙ্গলা কক্ষে প্রবেশ করিল, রাজার রক্তাক্ত কলেবর দেখিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল— ‘এ কী, মহারাজ আহত! কে এ কাজ করল? ওরে তোরা কে কোথায় আছিস ছুটে আয়—’

বিভিন্ন দ্বার দিয়া কঞ্চুকী পাচক প্রহরিণী অনেকগুলি লোক কক্ষে প্রবেশ করিল এবং রাজার শোণিতলিপ্ত দেহ দেখিয়া স্থাণুবৎ দাঁড়াইয়া পড়িল।

রাজা সকলকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন— ‘কম্পন আমাকে হত্যা করতে এসেছিল, অর্জুন আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে। আমার আঘাত মারাত্মক নয়, তবে ছুরিকায় যদি বিষ থাকে—’

মণিকঙ্কণা পিঙ্গলার চিৎকার শুনিয়া কক্ষে প্রবেশ করিয়াছিল, এখন ছুটিয়া আসিয়া রাজাকে দুই বাহুতে জড়াইয়া লইল, তারপর ত্বরিতে উঠিয়া নিজের বস্ত্র হইতে পট্টিকা ছিঁড়িয়া রাজার বাহুর ঊর্ধ্বভাগে শক্ত করিয়া তাগা বাঁধিয়া দিল। গলদশ্রু নেত্রে অস্ফুটব্যাকুল কণ্ঠে বলিতে লাগিল— ‘দারুব্রহ্ম! এ কি হল— এ কি হল—’

ধন্নায়ক লক্ষ্মণ মল্লপ রাজার সহিত দেখা করিতে আসিতেছিলেন, কক্ষে ভিড় দেখিয়া তিনি ভিড় ঠেলিয়া সম্মুখে আসিলেন; রাজার অবস্থা এবং কুমার কম্পনের মৃতদেহ দেখিয়া সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপার বুঝিয়া লইলেন। রাজার সহিত তাঁহার একবার দৃষ্টি বিনিময় হইল; রাজা করুণ হাসিয়া যেন তাঁহাকে জানাইলেন— তোমার সন্দেহই সত্য।

মুহূর্তমধ্যে লক্ষ্মণ মল্লপ সারথির বল্‌গা নিজ হস্তে তুলিয়া লইলেন; তাঁহার আকৃতি ভিন্নমূর্তি ধারণ করিল। তিনি সকলের দিকে আদেশের কণ্ঠে বলিলেন— ‘তোমরা এখানে কি করছ? যাও, নিজ নিজ স্থানে ফিরে যাও। — পিঙ্গলা, তুমি ছুটে যাও, শীঘ্র বৈদ্যরাজকে ডেকে নিয়ে এস। — অর্জুন, তুমি যেও না, তোমাকে প্রয়োজন হবে।’

কক্ষ শূন্য হইয়া গেল। কেবল মণিকঙ্কণা ও অর্জুন রহিল। বিদ্যুন্মালাও একবার কক্ষে আসিয়াছিলেন, দৃশ্য দেখিয়া নিজ কক্ষে ফিরিয়া গিয়া দু’হাতে মুখ ঢাকিয়া শয্যাপার্শ্বে বসিয়া ছিলেন।

লক্ষ্মণ মল্লপ মণিকঙ্কণাকে বলিলেন— ‘দেবিকা, আপনি এখন নিজ কক্ষে ফিরে যান, আর কোনো শঙ্কা নেই।’

মণিকঙ্কণা উঠিল না, রাজার পৃষ্ঠ বাহুবেষ্টিত করিয়া দৃঢ়স্বরে বলিল— ‘আমি যাব না।’

ভয়ঙ্কর বার্তা মুখে মুখে পৌরভূমির সর্বত্র প্রচারিত হইয়াছিল। রানীদের কানে সংবাদ উঠিয়াছিল। তাঁহারা রাজাকে দেখিবার জন্য ব্যাকুল হইয়াছিলেন, কিন্তু রাজার অনুমতি ব্যতীত তাঁহাদের ভবন হইতে বাহিরে আসিবার অধিকার নাই। সকলে নিজ নিজ মহলে আবদ্ধ হইয়া রহিলেন। দেবী পদ্মালয়াম্বিকা দীপহীন কক্ষে পুত্র মল্লিকার্জুনকে কোলে লইয়া পাষাণমূর্তির ন্যায় বসিয়া রহিলেন।

বৈদ্যরাজ দামোদর স্বামীর গৃহ রাজ-পুরভূমির মধ্যেই। সেদিন সন্ধ্যার পর রসরাজ মহাশয় তাঁহার গৃহে উপস্থিত হইয়াছিলেন। দুই বৃদ্ধের মধ্যে ইত্যবসরে প্রণয় অতিশয় গাঢ় হইয়াছিল। দুইজনে মুখোমুখি বসিয়া দ্রাক্ষাসব পান করিতেছিলেন; মৃদুমন্দ বিশ্রাম্ভালাপ চলিতেছিল। এমন সময় পিঙ্গলা ঝটিকার ন্যায় আসিয়া দুঃসংবাদ দিল। দুই বৃদ্ধ পরস্পরের হাত ধরিয়া উঠি-পড়ি ভাবে রাজভবনের দিকে ছুটিলেন। পিঙ্গলা ঔষধের পেটরা লইয়া সঙ্গে ছুটিল।

রাজার বিরাম-ভবন হইতে তখন কম্পনের মৃতদেহ স্থানান্তরিত হইয়াছে। ইতিমধ্যে পিতার ও দ্বাদশজন সভাসদের মৃত্যুসংবাদও রাজা পাইয়াছেন। তিনি অবসন্ন দেহভার মণিকঙ্কণার দেহে অর্পণ করিয়া মুহ্যমানভাবে বসিয়া আছেন। ক্ষত হইতে অল্প রক্ত ক্ষরিত হইতেছে।

দামোদর ও হ্রস্বদৃষ্টি রসরাজ দ্রুত স্থলিত পদে প্রবেশ করিলেন। দামোদর হাত তুলিয়া বলিলেন— ‘জয় ধন্বন্তরি! কোনো ভয় নেই। স্বস্তি স্বস্তি।’

তিনি পালঙ্কে রাজার পাশে বসিয়া ক্ষতস্থান পরীক্ষা করিলেন, মুখে চট্‌কার শব্দ করিলেন, তারপর রাজার দক্ষিণ মণিবন্ধে অঙ্গুলি স্থাপন করিয়া নাড়ি পরীক্ষায় ধ্যানস্থ হইয়া পড়িলেন।

কিছুক্ষণ পরে তিনি মাথা নাড়িয়া চোখ খুলিলেন— ‘না, আশঙ্কার কোনো কারণ নেই। নাড়ি ঈষৎ দমিত, কিন্তু বিষক্রিয়ার কোনো লক্ষণ নেই। — রসরাজ মহাশয়, আপনি দেখুন।’

রসরাজ রাজার নাড়ি দেখিলেন, তারপর সহর্ষে বলিলেন— ‘বৈদ্যরাজ যথার্থ বলেছেন। রাজদেহে কণামাত্র বিষের প্রকোপ নেই। স্বস্তি স্বস্তি। এখন ক্ষতস্থানে প্রলেপাদির ব্যবস্থা করলেই রাজা অচিরাৎ নিরাময় হবেন।’

তখন ক্ষত চিকিৎসার উপযোগ হইল। তাগা খুলিয়া দিয়া ক্ষতস্থান পরিষ্কৃত হইল; দামোদর স্বামী তাহাতে শতধৌত ঘৃতের প্রলেপ লাগাইলেন, ক্ষত বন্ধন করিলেন না। তারপর রাজাকে অরিষ্ট পান করাইয়া পুনরায় নাড়ি পরীক্ষাপূর্বক নাড়ির উন্নতি লক্ষ্য করিয়া সানন্দে বহু আশীর্বাদ আবৃত্তি করিতে করিতে রাত্রির জন্য প্রস্থান করিলেন।

লক্ষ্মণ মল্লপ অর্জুনের সঙ্গে কক্ষের এক কোণে দাঁড়াইয়া ছিলেন, এখন রাজার পালঙ্কের পাশে আসিয়া দাঁড়াইলেন। লক্ষ্মণ মল্লপ বলিলেন— ‘অর্জুনকে মধ্যম কুমারের শিবিরে পাঠাচ্ছি। তিনি দূরে আছেন, হয়তো অন্যের মুখে বিকৃত সংবাদ শুনে বিচলিত হবেন।’

রাজা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন— ‘তাই করুন। — কী হয়ে গেল! কম্পন পিতাকে পর্যন্ত—। অর্জুন, তুমি কোথায় ছিলে? কেমন করে যথাসময়ে উপস্থিত হলে?’

অর্জুন বলিল— ‘আর্য, আমি প্রাঙ্গণে ছিলাম, কুমার কম্পনকে আসতে দেখলাম। তাঁর ভাবভঙ্গি ভাল লাগল না, তাঁর কটিতে ছুরিকা দেখে সন্দেহ হল। তাই তাঁর অনুসরণ করেছিলাম। তাঁর অভিসন্ধি সঠিক বুঝতে পারিনি, বুঝতে পারলে মহারাজ অক্ষত থাকতেন।’

রাজা ক্ষণেক নীরব থাকিয়া বলিলেন— ‘হুক্ক-বুক্কের আবির্ভাব মিথ্যা নয়, হয়তো এই জন্যই এসেছিলেন। — অর্জুন, তুমি আজ যে-কাজে যাচ্ছ যাও, এই মুদ্রাঙ্গুরীয় নাও, বিজয়কে দেখিও, তারপর তাকে সব কথা মুখে বোলো। — আর ফিরে এসে তুমি আমার দেহরক্ষীর কাজ করবে, প্রভাত থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমার প্রাণরক্ষার ভার তোমার।’

অর্জুন নত হইয়া যুক্তকরে রাজাকে প্রণাম করিল। অল্পকাল পরে মন্ত্রী তাহাকে লইয়া প্রস্থান করিলেন।

মণিকঙ্কণা রাজাকে ছাড়িয়া যাইতে সম্মত হইল না। রাত্রে সে ও পিঙ্গলা রাজার কাছে রাহিল।