তিমি শিকারির বুকে হারপুন
[ দি অ্যাডভেঞ্চার অব ব্ল্যাক পিটার ]
১৮৯৫ সালের জুলাইয়ের প্রথম হপ্তায় বন্ধুবরকে ঘন ঘন এবং দীর্ঘ সময়ের জন্যে আমাদের আচ্ছা থেকে উধাও হতে দেখে অনুমান করেছিলাম একটা কিছু নিয়ে আবার মাথা ঘামাতে শুরু করেছে ও। এই সময় আবার রুক্ষ চেহারার কয়েকজন লোক এসে ক্যাপ্টেন বেসিল সম্বন্ধে খোঁজখবর নেওয়ায় আমি বুঝেছিলাম আবার ছদ্মবেশে কোথাও-না-কোথাও তৎপর হয়ে উঠেছে হোমস। অপরাধী মহলে ও ছিল মূর্তিমান বিভীষিকা। তাই অসংখ্যবার ওকে ভোল পালটাতে দেখছি অগণিত নামের আর রূপের খোলসে। লন্ডনের বিভিন্ন স্থানে ছড়ানো আছে ওর অন্তত পক্ষে গোটা পাঁচেক খুদে আস্তানা –সংক্ষেপে যাদের বলা যায় বহুরূপী হোমসের মেক-আপ রুম। কিন্তু কী কাজ নিয়ে যে তার এত ব্যস্ততা, সে-সম্বন্ধে আমার কাছে কোনোরকম উল্লেখ না-করায় আমিও তার গোপন কথা জানবার চেষ্টা করিনি। সে-রকম স্বভাবই নয় আমার। ওর তদন্তধারার প্রকৃতি সম্বন্ধে ছোট্ট একটু ইঙ্গিত প্রথম যেদিন পেলাম, সেইদিন বুঝলাম, কাজটা অসাধারণ। প্রাতরাশের আগেই বেরিয়েছিল ও। আমি টেবিলে একলা। এমন সময়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে হঠাৎ ঘরে ঢুকল হোমস। মাথায় টুপি, ছাতার বাঁটের মতো মুখের দিকে বেঁকানো মস্ত একটা হারপুন হাতে ঝুলছে।
কী সর্বনাশ! চেঁচিয়ে উঠি আমি। লন্ডনের রাস্তাঘাটে এই জিনিসটা নিয়ে তুমি হাওয়া খেয়ে এলে নাকি হে?
কসাইয়ের কাছ থেকে আসছি। গেছি গাড়িতে, এসেছি গাড়িতে।
কসাই?
খিদেয় পেট জ্বলছে মাই ডিয়ার ওয়াটসন, ব্রেকফাস্টের আগে ব্যায়ামের উপকারিতা সম্বন্ধে আমার আর কোনোরকম সন্দেহ নেই। কিন্তু বাজি ফেলে বলতে পারি যে কী ধরনের ব্যায়াম করে এখন ফিরছি, তা তুমি অনুমান করতে পারবে না কোনোমতেই।
সে-চেষ্টাও আমি করব না।
কফি ঢালতে ঢালতে নিঃশব্দে এক চোট হেসে নিলে ও। তারপর বলতে আরম্ভ করলে, অ্যাল্লারডাইসের দোকানের পেছনের ঘরে হাজির থাকলে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হত তোমার। কড়িকাঠে আংটা থেকে ঝুলছিল একটা মরা শুয়োর। আর, শার্টের হাতা গুটিয়ে এক ভদ্রলোক এই হাতিয়ারটা দিয়ে বীরবিক্রমে প্রাণপণ শক্তিতে আঘাতের পর আঘাত হানছিল বেচারির গতায়ু দেহটার ওপর। জানো, এই শৰ্মাই সেই উৎসাহী ভদ্রলোক! হাজার কায়দা করেও গোটা শুয়োরটাকে এক ঘায়ে এফেঁড়-ওফোড় করা যে আমার পক্ষে সম্ভব নয়, এ-বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। তুমি একবার চেষ্টা করে দেখবে নাকি?
হাজার টাকা দিলেও না। কিন্তু হঠাৎ এ-খেয়াল হল কেন তোমার?
আমার ধারণা, উডম্যানস লীর কেসের সঙ্গে এ-ব্যাপারের একটা পরোক্ষ সম্পর্ক আছে, –তাই। এই যে হপকিনস, তোমার টেলিগ্রাম কাল রাত্রে পেয়েছি। এতক্ষণ তোমারই অপেক্ষা করছিলাম।
হপকিনসের বয়স তিরিশ হবে। অত্যন্ত সজাগ সতর্ক পুরুষ। পরনে সাদাসিধে একটা টুইডের সুট! কিন্তু খাপখোলা তলোয়ারের মতো সিধে চেহারাটি দেখলেই বোঝা যায় অফিশিয়াল ইউনিফর্ম পরাই তার বারোমাসের অভ্যাস। ভদ্রলোকের পুরো নাম স্ট্যানলি হপকিনস। এই তরুণ ইনস্পেকটরটির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অনেক উচ্চাশা পোষণ করে হোমস। হপকিনসও গুণমুগ্ধ শিষ্যের মতো প্রখ্যাত শখের গোয়েন্দা শার্লক হোমসের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিগুলো একবার প্রশংসা করতে শুরু করলে আর থামতে চায় না। আমার বন্ধুটির ওপর তার শ্রদ্ধা অসীম। হপকিনসের কুঞ্চিত ললাটে আজ কিন্তু চিন্তার আবিলতা। চোখে-মুখে অপরিসীম তিক্ততা। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল সে।
ধন্যবাদ, স্যার। বেরোবার আগেই প্রাতরাশ সেরে নিয়েছি আমি। গতকাল রিপোর্ট দিতে এসেছিলাম। শহরেই কাটিয়েছি রাতটা।
কীসের রিপোর্ট?
ব্যর্থতার, স্যার–চরম ব্যর্থতার।
সেকী, তাহলে এক পা-ও এগোতে পারোনি বল?
একদম না। সর্বনাশ! তাহলে তো দেখছি আমাকেই দেখতে হয় কী ব্যাপার।
মি. হোমস, আমারও তাই একান্ত ইচ্ছা। এত বড়ো সুযোগ হাতের মুঠোতে পেয়েও কিছু করতে পারছি না আমি–সমস্ত বুদ্ধিশুদ্ধি গুলিয়ে গেছে আমার। দয়া করে আপনি একবার গা ঝাড়া দিন–একটু সাহায্য করুন আমাকে।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। তদন্তের রিপোর্ট এবং কেস সম্পর্কে যা কিছু আজ পর্যন্ত পাওয়া গেছে, সবই পড়ার সুযোগ আমার হয়েছে। মন দিয়েই পড়েছি। ভালো কথা, তামাক রাখার যেথলিটা পাওয়া গেছে, সে-বিষয়ে তোমার মতামত কী শুনি? কিছু আন্দাজ করতে পেরেছ?
অবাক হয়ে যায় হপকিনস।
থলিটা লোকটারই, স্যার। ভেতরে তার নামের আদ্যক্ষর পাওয়া গেছে। সীল মাছের চামড়া দিয়ে তৈরি–লোকটা নিজেও এককালে সীল শিকারি ছিল।
কিন্তু তার নিজের কাছে তো কোনো পাইপ নেই।
না স্যার, পাইপ আমরা পাইনি। লোকটা খুব বেশি ধূমপান করত বলে মনে হয় না। বন্ধুবান্ধবদের আপ্যায়ন করার জন্যেই হয়তো খানিকটা তামাক রেখে দিয়েছিল।
কোনো সন্দেহই নেই তাতে! এ-প্রসঙ্গের উল্লেখ করলাম না এইজন্যে যে, আমি যদি এ কেসটা হাতে নিতাম, তাহলে হয়তো এই পয়েন্ট থেকেই তদন্ত শুরু হত। সে-কথা এখন থাকুক। ড. ওয়াটসন এ-ব্যাপারের বিন্দুবিসর্গও শোনেনি! আমিও সমস্ত ব্যাপারটা তাগাগোড়া শুনতে পেলে খুশি হতাম। যেসব পয়েন্টগুলো নিতান্তই প্রয়োজন, সেইগুলে দিয়ে সংক্ষেপে কেসটা শুনিয়ে দাও দিকি।
পকেট থেকে এক তাড়া কাগজ বার করে শুরু করল স্ট্যানলি হপকিনস। নিহত ক্যাপ্টেন পিটার ক্যারির কর্মজীবন সংক্রান্ত কয়েকটা তারিখ লেখা আছে এই কাগজটায়। পঞ্চাশ বছর আগে ১৮৪৫ সালে তাঁর জন্ম। সীল আর তিমি মাছ শিকারে তার মতো দুর্দান্ত অথচ পাকা শিকারি সচরাচর দেখা যায় না। ১৮৮৩ সালে ডানভীর সীল শিকারের জাহাজ সী ইউনিকর্ন-এর কম্যান্ডার ছিলেন তিনি। এর পর থেকেই কয়েকবার সমুদ্রযাত্রায় বেরোন। প্রতিবারেই সফল হন। পরের বছর অর্থাৎ ১৮৮৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন ক্যাপ্টেন পিটার ক্যারি। অবসর নিয়ে কয়েক বছর শুধু দেশে দেশে ঘুরে বেড়ান। কিন্তু শেষে, সাসেক্স ফরেস্ট রো-র কাছে উডম্যানস লী নামে একটা জায়গা কিনে শুরু করেন বসবাস। বছর কয়েক এইখানেই কেটে যায়। তারপর আজ থেকে মাত্র সাত দিন আগে উডম্যানস লীতেই তিনি শেষ নিশ্বাস ফেলেছেন।
বিচিত্র চরিত্র ক্যাপ্টেন পিটার ক্যারির। দু-একটা নমুনা শুনলেই বুঝবেন কেন এ-কথা বললাম।
সাধারণ জীবনে উনি ছিলেন কড়া পিউরিটান। ধর্ম আর আচার সম্বন্ধে তার অতি-নিষ্ঠা লক্ষ করার মতো। স্বল্পভাষী, সদাই বিষণ্ণ তার প্রকৃতি। সংসারে থাকবার মধ্যে আছেন স্ত্রী, বছর বিশ বয়সের এক মেয়ে আর দুজন পরিচারিকা। পরিচারিকারা কেউই বেশিদিন টিকতে পারত না। নতুন নতুন মুখ দেখা যেত এ-সংসারে। বেচারিদের চাকরিতে সুখ ছিল না কোনোদিনই। মাঝে মাঝে অবস্থা এতদূরে গড়াত যে ওদের সহ্যশক্তি হার মানত। ক্যাপ্টেন লোকটা কিছুদিন অন্তর মদে চুর হয়ে বাড়ি ফিরতেন। এবং যতক্ষণ সুরার রং থাকত তার চোখে, ততক্ষণ তাঁকে একটা আস্ত পিশাচ ছাড়া আর কিছু বলা যেত না। একবার নাকি বউ আর মেয়েকে মাঝরাতে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে বার করে পার্কের মধ্যে দিয়ে চাবকাতে চাবকাতে নিয়ে চলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাদের আর্ত চিৎকারে গ্রামসুদ্ধ লোক উঠে এসে বাঁচায়।
একবার তার নামে আদলতের শমনও এসেছিল গ্রামের বুড়ো পাদরির ওপর বর্বরের মতো হামলা করার জন্যে। ভদ্রলোক ক্যাপ্টেনের বাড়িতে গিয়েছিলেন তার আচরণের প্রতিবাদ জানাতে। মি. হোমস, সংক্ষেপে, পিটার ক্যারির কীর্তিকলাপকে ম্লান করার মতো বিপজ্জনক লোক আপনি আর দুটি দেখতে পাবেন কি না সন্দেহ। শুনেছি জাহাজের কম্যান্ডার থাকার সময়েও নাকি তার চরিত্র ছিল এইরকম। ও-মহলে লোকে তাকে ব্ল্যাক পিটার বলে ডাকত। শুধু ষণ্ডামার্কা ক্রূর চেহারার সঙ্গে মানানসই কুচকুচে কালো প্রকাণ্ড দাড়ি থাকায় তার এমনতরো নামকরণ হয়নি, হয়েছে উত্তট রঙ্গপরিহাসের জন্যে যা তার সাঙ্গোপাঙ্গদের কাছে নিছক আতঙ্ক ছাড়া আর কিছুই ছিল না। প্রতিবেশীদের কেউই তাকে দু-চক্ষে দেখতে পারত না। তার ছায়া মাড়াতেও যেন সবাইয়ের ঘৃণা। সেই কারণেই, এমন কোনো লোক পাইনি যে তার এহেন নিষ্করুণ ভয়ংকর মৃত্যুতে শোক পেয়েছে, অন্তত সহানুভূতির একটি শব্দও উচ্চারণ করেছে।
মি. হোমস, লোকটার কেবিনসম্পর্কে তদন্তের বিবরণ নিশ্চয় পড়েছেন আপনি। আপনার বন্ধু হয়তো শোনেননি, তাই বলছি। বাড়ি থেকে কয়েকশো গজ দূরে একটা কাঠের আউট হাউস তৈরি করেছিলেন ক্যাপ্টেন।নাম দিয়েছিলেন কেবিন। এই কেবিনেই প্রতি রাতে ঘুমোতে আসতেন তিনি। কেবিনটা আসলে ছোট্ট এক কামরার একটা কুঁড়ে, লম্বায় ষোলো ফুট, চওড়ায় দশ ফুট। কেবিনের চাবি থাকত তারই পকেটে। নিজের বিছানা নিজেই পাততেন। ধুলোময়লা সাফ করতেন নিজেই। দ্বিতীয় কোনো প্রাণীকে চৌকাঠ পেরোতে দিতেন না। চারদিক পর্দায় ঢাকা ছোটো চারটে জানলা আছে কেবিনে, কিন্তু তিনশো পঁয়ষট্টি দিনেও সে-জানলা কেউ খোলে না। একটা জানলা আছে বড়োরাস্তার দিকে। রাতের অন্ধকারে ঘরের মধ্যে আলো জ্বললে পথচারীরা পরস্পরকে তা দেখিয়ে নিজেদের মধ্যেই বলাবলি করত–না-জানি কী কাণ্ডই করছে ব্ল্যাক পিটার। মি. হোমস, তদন্তের ফলে আমরা যে ক-টা অকাট্য প্রমাণ পেয়েছি তাদের মধ্যে অন্যতম এই জানলাটা।
আপনাদের হয়তো মনে থাকতে পারে হত্যার দু-দিন আগে রাত একটার সময়ে ফরেস্ট রোর দিক থেকে একজন পাথরের কারিগর আসতে আসতে থমকে দাঁড়িয়ে যায় গাছপালার মধ্যে দিয়ে চৌকোনা আলোর ঝিকিমিকি দেখে। আলোকিত পর্দার ওপর ফুটে উঠেছিল একটা মুখের কালো ছায়া। পাশের দিকে মুখ ফিরিয়ে ছিল লোকটা। ক্যাপ্টেন ক্যারির সঙ্গে তার অনেকদিনের পরিচয় এবং এ-মুখ যে তার মুখ নয়, এ-কথা হলফ করে বলতে রাজি আছে। সে। ছায়া-মুখের দাড়ি ছিল বটে কিন্তু সে-দাড়ি আকারেও ছোটো এবং সামনের দিকে ঠেলে বার করা–ক্যাপ্টেনের মতো মোটেই নয়। এ-দৃশ্য দেখবার আগে ঘণ্টা দুয়েক ভাটিখানায় কাটিয়ে এসেছিল সে, পথ থেকে জানলার দূরত্বও ছিল অনেকখানি। আর কি জানেন, এ-দৃশ্য সে দেখেছে সোমবার, কিন্তু খুন হয়েছে বুধবার।
মঙ্গলবার পিটার ক্যারিকে তার জঘন্যতম মেজাজে দেখা গিয়েছে। মদ্যপানের ফলে আরক্ত মুখ আর বুনো জন্তুর মতো দুর্দান্ত হাবভাব দেখে ভয় পেয়েছে সবাই। বাড়িময় দুমদাম করে বেড়িয়েছেন তিনি। যতবার তার পায়ের শব্দ পাওয়া গেছে ততবারই অন্যদিকে দৌড়ে গা-ঢাকা দিয়েছে বাড়ির মেয়েরা। রাত গভীর হয়ে এলে নিজের কেবিনে গেছেন পিটার ক্যারি।
রাত দুটোর সময়ে বিকট একটা আর্ত চিৎকার ভেসে আসে কেবিনের দিক থেকে। শব্দটা শোনে ক্যাপ্টেনের মেয়ে প্রতিরাত্রে জানলা খুলে ঘুমোনোর অভ্যাস তার। মদের নেশায় এ ধরনের চিৎকার বা অনর্থক হট্টগোল করা ক্যাপ্টেনের চিরকালের স্বভাব–তাই এ-বিষয়ে কেউ আর মাথা ঘামায়নি। সকাল সাতটায় উঠে একজন ঝি লক্ষ করে কেবিনের দরজা খোলা। কিন্তু ক্যাপ্টেনকে ওরা এমনই যমের মতো ভয় করত যে দুপুর বারোটার আগে কারোরই সাহসে কুলোয়নি একবার উঁকি মেরে দেখে ব্যাপারটা কী। ভরদুপুরে ওরা খোলা দরজা দিয়ে ভেতরকার দৃশ্য একবার উঁকি মেরে দেখেই রক্তশূন্য সাদা মুখে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটে গাঁয়ের দিকে। আর এক ঘণ্টার মধ্যেই ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে কেসটা হাতে নিই আমি।
মি. হোমস, আপনি তো জানেন আমার স্নায়ু দুর্বল নয়। কিন্তু সেদিন সত্যি কথা বলতে কী ওই ছোট্ট আউট হাউসের ভেতরে মাথা গলানোর পরে আমার মতো লোকেরও আপাদমস্তক। কেঁপে উঠেছিল। ছোটো বড়ো হরেকরকম মাছির ভনভনানিতে যেন হারমোনিয়ামের বাজনা বাজছিল ঘরের মধ্যে। মেঝে আর দেওয়াল দেখে মনে হল যেন কসাইখানায় এসে পড়েছি। ব্ল্যাক পিটার ঘরটার নাম দিয়েছিলেন কেবিন এবং নামটা অযৌক্তিক নয় মোটেই। বাস্তবিকই একটা কেবিনের মতো সাজানো ঘর। ঢুকলেই মনে হবে যেন জাহাজের মধ্যে এসে পড়েছেন আপনি। এক প্রান্তে একটি বাঙ্ক, জাহাজি সিন্দুক, অনেকগুলো ম্যাপ আর চার্ট, সী ইউনিকর্ন-এর একটা ছবি, তাকের ওপর জাহাজের গতি হিসেব রাখার একসারি কেতাব। যেকোনো ক্যাপ্টেনের কেবিনে ঢুকে পড়লে ঠিক যেমনটি আশা করা যায়, তেমনিভাবে সাজানো ঘরটা। এসবের মাঝখানে পড়ে ছিলেন ক্যাপ্টেন পিটার ক্যারি স্বয়ং। অনেক অত্যাচারে বীভৎসভাবে যেন দুমড়ে মুচড়ে গেছে তার মুখ। মস্তবড়ো কালো দাড়িটা যেন অসীম যন্ত্রণায় ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। সামনের দিকে। ইস্পাতের একটা হারপুন চওড়া বুক ভেদ করে গভীরভাবে গেঁথে গেছে পেছন দিককার দেওয়ালে। কার্ডের ওপর গুবরে-পোকাকে পিন দিয়ে যেভাবে লাগিয়ে রাখা হয়, ঠিক তেমনিভাবে হারপুন দিয়ে তাকে গেঁথে রাখা হয়েছিল কাঠের দেওয়ালে। ভদ্রলোকের প্রাণবায়ু যে অনেক আগেই শূন্যে মিলিয়েছে, তা আর না-বললেও চলে। অপরিসীম যন্ত্রণায় শেষ মরণ-চিৎকার দেওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই সাঙ্গ হয়েছে তাঁর ইহলীলা।
আপনার পদ্ধতি আমি জানি, স্যার। কাজ শুরু করলাম সেইমতো। কোনো কিছু স্থানচ্যুত হওয়ার আগে ঘরের মেঝে এবং বাইরের জমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলাম। আশ্চর্য, ঘরে বাইরে কোথাও কোনোরকম পায়ের ছাপ নেই।
তার মানে তুমি বলতে চাইছ যে তুমি দেখতে পাওনি?
বিশ্বাস করুন, স্যার, কোনোরকম ছাপ নেই।
হপকিনস, বহু রহস্য গ্রন্থি মোচন করেছি আমি। কিন্তু ডানা মেলে উড়ে এসে কেউ অপরাধ করে সরে পড়েছে, এমন দৃষ্টান্ত আজ পর্যন্ত শুনিনি বা দেখিনি। অপরাধী যতক্ষণ দু-পায়ে হাঁটছে, ততক্ষণ কিছু ছাপ, কিছু ঘষা, কিছু অতি তুচ্ছ নাড়াচাড়ার চিহ্ন সন্ধানীর বৈজ্ঞানিক চোখে ধরা পড়বেই। রক্ত ছড়ানো এ-রকম একটা ঘরে আমাদের পথ দেখানোর মতো কোনো নিশানা যে নেই, তা হতেই পারে না। যাক, তোমার রিপোর্ট শুনে মনে হচ্ছে ঘরের মধ্যে অন্তত কতকগুলো
জিনিস তোমার নজর এড়াতে পারেনি, তাই তো?
শ্লেষের সূক্ষ্ম খোঁচাটুকু গায়ে না-মেখে চোখ মিটমিট করে হপকিনস বলে, সে সময়ে আপনাকে না-ডেকে খুবই বোকামো করেছি মি. হোমস। যাক, যা হবার হয়ে গেছে, এখন বর্তমান নিয়ে পড়া যাক। আপনার অনুমানই ঠিক, ঘরের মধ্যে এমন কয়েকটা জিনিস আমি পেয়েছি যা উপেক্ষা করা চলে না কোনোমতেই। একটা হচ্ছে খুনির হাতিয়ার—হারপুন। অস্ত্রটা হ্যাচকা টানে নামিয়ে আনা হয়েছে দেওয়ালের তাক থেকে। পাশাপাশি রাখা দুটি হারপুনের পাশে তৃতীয়টির স্থান শূন্য।এস. এস. সী ইউনিকর্ন, ডানডী–এই শব্দ ক-টা প্রত্যেকটার হাতলেই খোদাই করা। দেখে শুনে মনে হয়, খুনটা হয়েছে নিছক রাগের ঝোঁকে। হত্যাকারী প্রচণ্ড রাগে উন্মাদ হয়ে আচম্বিতে হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই টেনে নিয়ে বসিয়ে দিয়েছে ব্ল্যাক পিটারের বুকে। খুনটা হয়েছে রাত দুটোর সময়ে। অথচ ব্ল্যাক পিটারের পরনে দেখা গেছে বাইরে বেরোনোর জন্যে সম্পূর্ণ সাজসজ্জা। এসব দেখে মনে হয় আগে থেকেই কারো সঙ্গে সাক্ষাতের সময় স্থির হয়ে ছিল তার। এ ধারণার আর একটা কারণ হচ্ছে টেবিলের ওপর রাখা দুটো নোংরা গেলাসের পাশে এক বোতল র্যম।
হোমস বললে, মন্দ বলনি, তোমার দুটো সিদ্ধান্তই দেখছি বরদাস্ত করা চলে। র্যম ছাড়া ঘরের মধ্যে আর কোনো মদ ছিল কি?
ছিল। জাহাজি সিন্দুকের মধ্যে মদ রাখার উপযুক্ত তালা লাগানো একটা আধারে পেয়েছি হুইস্কি আর ব্র্যান্ডি। এ-পয়েন্টটা কিন্তু আমাদের বিশেষ কোনো কাজে আসবে না। কেননা, মদ রাখার পাত্রগুলো ভরতি থাকায় সিন্দুকের বোতলে কেউই হাত দেয়নি।
কাজে লাগবে কি না বলতে পারি না, তবে ঘরের মধ্যে হুইস্কি আর ব্র্যান্ডির উপস্থিতিটাই ভাববার বিষয়। সে-কথা এখন থাকুক, কেসটা সম্পর্কে আর কিছু দরকারি তথ্য যদি জানা থাকে তো বলে ফেল।
টেবিলের ওপর তামাক রাখার থলিটা পাওয়া গেছে।
টেবিলের কোন দিকে?
ঠিক মাঝখানে। সীলমাছের খসখসে পুরু চামড়ার ব্যাগ–মুখ চামড়ার ফিতে দিয়ে বাঁধা। P.C.অক্ষর দুটো ভেতর দিকে লেখা। প্রায় আধ আউন্সের মতো কড়া জাহাজি তামাক পাওয়া গেছে ভেতরে।
চমৎকার! আর কিছু?
পকেট থেকে ছাইরঙের পুরু পশমি কাপড়ে ঢাকা একটা নোটবই বার করল স্ট্যানলি হপকিনস। বাইরের দিকটা কর্কশ, বহু ব্যবহারে ক্ষয়ে গেছে কোনাগুলো, বিবর্ণ হয়ে উঠেছে পাতাগুলো। প্রথম পাতায় লেখা আছেJ.H.N.আর ১৮৩। টেবিলের ওপর নোটবইটা রেখে তন্ময় হয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল হোমস আর চোখে অসীম প্রত্যাশা নিয়ে তার দু-কাঁধের ওপর ঝুঁকে পড়লাম আমি আর হপকিনস। দ্বিতীয় পাতায় C.P.R., এই ছাপা অক্ষর তিনটের পর কয়েক পাতা জুড়ে লেখা অজস্র সংখ্যা। এ-রকম শিরোনামা আরও তিনটে দেখলাম। আর্জেন্টিনা, কোস্টারিকা আর স্যান পাওলো। প্রত্যেকটা শিরোনামার পর কয়েক পাতা জুড়ে কেবল দুর্বোধ্য চিহ্ন আর সংখ্যার সারি।
হোমস জিজ্ঞেস করলে, এ-সম্বন্ধে তোমার কী মনে হয়, তাই আগে শুনি।
আমার তো মনে হয় স্টক এক্সচেঞ্জের সিকিউরিটির ফিরিস্তি ছাড়া আর কিছুই নয় ওগুলো। দালালটার নাম বোধ হয় J.H.N.।C.P.R. তারই মক্কেলের নামের আদ্যক্ষর।
হোমস বললে, আমি যদি বলি ক্যানাডিয়ান প্যাসিফিক রেলওয়ে?
ঊরুর ওপর একটা ঘুসি মেরে দাঁতে দাঁত পিষে চেঁচিয়ে ওঠে হপকিনস, ওঃ, কী বোকা আমি। আপনার ধারণাই সত্য, মি. হোমস। বাকি রইল তাহলে J.H.N.-এর রহস্য মোচন। ১৮৮৩ সালের পুরোনো স্টক এক্সচেঞ্জ খুলে দালালদের লিস্ট আমি দেখেছি। কিন্তু হাউস-এর ভেতরে অথবা বাইরের এমন কোনো নাম আমি পাইনি J.H.N. যার আদ্যক্ষর। না-পেলেও আমার বিশ্বাস, এই মুহূর্ত পর্যন্ত যত সূত্র আমার হাতে এসেছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে দরকারি হচ্ছে এই নোটবইটা। একটা বিষয়ে আপনিও নিশ্চয় আমার সঙ্গে একমত হবেন, মি. হোমস। নামের আদ্যক্ষরগুলো ব্ল্যাক পিটারের সংগ্রহ নয়, দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির এবং দ্বিতীয় কোনো
ব্যক্তি বলতে এখানে হত্যাকারীকেই বোঝাচ্ছে। আরও বলব এ-কেসে রাশি রাশি মূল্যবান সিকিউরিটি সংক্রান্ত একটা দলিলের আবির্ভাব ঘটায় এই প্রথম খুনের একটা যুক্তিযুক্ত উদ্দেশ্য আমরা পাচ্ছি।
খবরটা শার্লক হোমসের কাছে একেবারেই নতুন, তা তার দারুণভাবে চমকে ওঠা দেখেই বুঝলাম।
তোমার দুটো পয়েন্টই মেনে না-নিয়ে পারছি না। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, তদন্ত চলার সময়ে নোটবইটা রঙ্গমঞ্চে না-পৌঁছোনোয়, আমার মতামতেও একটু আধটু রদবদল করা দরকার হয়ে পড়েছে। এই খুন সম্বন্ধে আমি একটা থিয়োরি খাড়া করেছিলাম। সে-থিয়োরিতে নোটবইয়ের কোনোরকম স্থান তো আমি দেখতে পাচ্ছি না। সিকিউরিটি সম্বন্ধে এইমাত্র যা বলছিলে, তা বাস্তবিকই কৌতূহল জাগায়। এ-রকম এক-আধটা সিকিউরিটি হাতে এসেছে নাকি?
অফিসগুলোর তদন্ত শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু আমার ভয় কী জানেন, দক্ষিণ আমেরিকার এই কোম্পানিগুলোর স্টকহোল্ডারদের নামধামের রেজিস্টার দক্ষিণ আমেরিকায় থাকায় কয়েক হপ্তার আগে শেয়ারগুলোর কোনো হদিশ পাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
আতশকাচ দিয়ে নোটবইয়ের মলাটটা পরীক্ষা করছিল হোমস। এই জায়গার রংটা দেখছি অন্যরকম হয়ে গেছে।
হ্যাঁ স্যার, ওটা রক্তের দাগ। আপনাকে তো বললাম মেঝে থেকে নোটবইটা কুড়িয়ে পেয়েছি আমি।
রক্তের দাগলাগা মলাটটা নীচে ছিল, না ওপরে ছিল?
নীচে ছিল।
তার মানে এই বোঝাচ্ছে, ব্ল্যাক পিটার খুন হয়ে যাওয়ার পর নোটবইটা পড়েছে মাটিতে।
এগজ্যাক্টলি, মি. হোমস। বড়ো সুন্দর পয়েন্ট বলেছেন। আমার অনুমান, তাড়াহুড়ো করে পালাবার সময়ে নোটবইটা ফেলে যায় হত্যাকারী। দরজার কাছেই কুড়িয়ে পেয়েছিলাম বইটা।
নিহত ব্ল্যাক পিটারের সম্পত্তির মধ্যে কোনো সিকিউরিটির হদিশ নিশ্চয় পাওয়া যায়নি?
না, স্যার।
চুরি গেছে বলে মনে হয়?
না, স্যার। কোনো কিছুতেই হাত দেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না।
বেশ ইন্টারেস্টিং কেস তো! ছুরিও তো পাওয়া গেছে, তাই না?
খাপওলা একটা ছুরি। খাপসমেত পড়ে ছিল ব্ল্যাক পিটারের পায়ের কাছে। মিসেস ক্যারি শনাক্ত করেছেন ছুরিটা তার স্বামীরই।
মুহূর্তের জন্যে চিন্তার অতলে তলিয়ে যায় হোমস। তারপর শুধোয়, হপকিনস, নিজের চোখে জায়গাটা একবার আমার না-দেখলেই নয়!
আনন্দে চিৎকার করে ওঠে হপকিনস।
ধন্যবাদ, স্যার। মনের ওপর থেকে আমার একটা মস্ত বোঝা নেমে যাবে আপনার পায়ের ধুলো পড়লে।
আঙুল নাড়তে নাড়তে হোমস বলে, হপ্তাখানেক আগে হলে কাজটা আরও সহজ হয়ে উঠত, ইনস্পেকটর। এখনও এক চক্কর ঘুরে এলে খুব বিফল হবে বলে মনে হয় না। ওয়াটসন, হাতে যদি সময় থাকে, আমার জন্যে একটু নষ্ট করো। তোমার সঙ্গ আমায় আনন্দ দেবে প্রচুর। হপকিনস, একটা ঘোড়ার গাড়ি ডাকো তো। মিনিট পনেরোর মধ্যেই ফরেস্ট রোর দিকে রওনা হওয়ার জন্যে তৈরি হয়ে নিচ্ছি।
ছোট্ট স্টেশনটায় নেমে একটা গাড়ি নিয়ে কয়েক মাইল পেরিয়ে এলাম বহুদূর বিস্তৃত বনভূমির মধ্য দিয়ে, কোনো এক সময়ে এ-বনভূমি ছিল এক বিরাট অরণ্যের অংশ যার সুকঠিন বর্মে সুদীর্ঘকালের জন্যে বারে বারে মাথা খুঁড়ে ফিরে গেছে স্যাক্সন যোদ্ধারা। বনভূমির ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ উঠে গেছে অনতিউচ্চ বাড়িটার দিকে। রাস্তার তিন দিকে ঝোপে ঢাকা ছোট্ট একটা আউট হাউস। রাস্তা থেকেই চোখে পড়ে তার দরজা এবং জানলা। ব্ল্যাক পিটার খুন হয়েছে এখানেই।
হপকিনস প্রথমেই আমাদের বাড়ির মধ্যে নিয়ে গিয়ে আলাপ করিয়ে দিলে নিহত ক্যাপ্টেনের বিধবা স্ত্রীর সঙ্গে। আলুথালু অবস্থা ভদ্রমহিলার। চুলগুলো ধবধবে সাদা। চওড়া, ভারী মুখে অজস্র বলিরেখা আর দু-চোখের লালাল আভার আড়ালে আতঙ্কের উদ্ভান্ত দৃষ্টির মধ্যে ফুটে উঠেছিল বহু বছরের দুর্ব্যবহার আর হাড়ভাঙা পরিশ্রমের স্বাক্ষর। ভদ্রমহিলার সঙ্গে তার মেয়েও ছিলেন। ফ্যাকাশে ফর্সা রং মেয়েটির। বাবা মারা যাওয়াতে এতটুকু দুঃখ নেই, বরং বেশ খুশিই হয়েছে সে। বাপকে শেষ করে গেছে যে তার কাছে সে যেন সবিশেষ কৃতজ্ঞ। ব্ল্যাক পিটারের নিজের হাতে গড়া এই ভয়াবহ পৃথিবী থেকে সূর্যের আলোয় বেরিয়ে এসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচলাম আমি। নিহত ক্যাপ্টেনের যাতায়াতের ফলে ঘাসজমির ওপর একটা সরু পথ ফুটে উঠেছিল আউট হাউস পর্যন্ত। এই পথ ধরেই আমরা আবার এগিয়ে চললাম তার পরম প্রিয় কেবিনের দিকে।
খুবই সাদাসিধে গঠনের আউট হাউস। কাঠের দেওয়াল, কাঠের ছাদ, দরজার পাশে একটা মাত্র জানলা, আর একটা শেষ প্রান্তে। পকেট থেকে চাবি বার করে তালার ওপর ঝুঁকে পড়ল হপকিনস। সবিস্ময়ে বলে, তালাটা কেউ খোলার চেষ্টা করেছে।
কোনো সন্দেহই ছিল না এ-বিষয়ে। কাঠের নকশার জায়গায় জায়গায় আঁচড় পড়েছে। রঙের ওপরেও আঁচড় পড়ায় তলাকার সাদা অংশ বেরিয়ে পড়েছে। জানলাটা পরীক্ষা করতে থাকে হোমস।
বলে, জানলাটাও দেখছি কেউ খুলতে চেষ্টা করেছে। যাই হোক, ঢুকতে কিন্তু পারেনি। বেজায় আনাড়ি চোর।
ইনস্পেকটর বললে, ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই সামান্য নয়, মি. হোমস। আমি হলফ করে বলতে পারি কাল সন্ধ্যায় এ-রকম কোনো দাগ এখানে ছিল না।
আমি বললাম, কোনো অতি উৎসাহী গ্রামবাসীর কীর্তি নয় তো?
না-হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কেননা, ব্ল্যাক পিটারের এক্তিয়ারে পা দেওয়ার মতো সাহস কারোরই নেই। ঘরের ভেতরে মাথা গলানোর কথা তো ওঠেই না। আপনার কী মনে হয় মি. হোমস?
আমার মনে হয় ভাগ্য আমাদের ওপর খুবই সদয়।
আপনি বলতে চান, লোকটা আবার আসবে, এই তো?
ফিরে আসার সম্ভাবনাই বেশি। দরজা খোলা পাবে, এই আশাতেই এসেছিল লোকটা। দরজা বন্ধ দেখে পেনসিলকাটা ছোট্ট একটা ছুরির ফলা দিয়ে তালা খোলার চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। কাজেই ভেবে দেখ–এরপর তার কী করা উচিত?
পরের রাতেই উপযুক্ত যন্ত্র নিয়ে ফিরে আসা।
আমিও ঠিক তাই বলি। সে সময় তাকে আপ্যায়ন জানানোর জন্যে আমাদের হাজির–থাকাটা হবে চরম গাফিলতি। তার আগে চল কেবিনের ভেতরটা একবার চোখ বুলিয়ে আসি।
খুনের চিহ্ন সব মুছে ফেলা হলেও আসবাবপত্র সরানো হয়নি। খুনের রাতে যেটি যেখানে ছিল ঘরে ঢুকে সব কিছু তেমনিভাবেই সাজানো পেলাম। পুরো দুটি ঘণ্টা ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শিকারি কুকুরের মতো পরীক্ষা করল হোমস। ঘরের প্রতিটি তুচ্ছ জিনিসও উলটেপালটে দেখতে ছাড়ল না। তবু তার মুখ দেখে বুঝলাম সব পরিশ্রম বৃথাই গেল। রহস্যের কালো অন্ধকারে এতটুকু আলোর নিশানা দেখা গেল না। কিন্তু অসীম তার সহিষ্ণুতা। একবার শুধু থমকে গিয়ে প্রশ্ন করল হোমস, তাকের এইখানটা থেকে কিছু নিয়েছ নাকি হপকিনস?
না তো।
এই জায়গাটায় কিছু একটা সরানো হয়েছে। দেখছ না, অন্যান্য জায়গার চেয়ে এই কোণে ধুলো একটু কম জমেছে। বই হতে পারে বাক্সও হতে পারে। যাকগে, কল্পনায় এত দৌড়ে লাভ নেই–আপাতত এর বেশি আর কিছু ভাবা যাচ্ছে না। চলো হে ওয়াটসন, কুঞ্জবনের গন্ধবায়ু সেবন করতে করতে ফুল লতা পাতা আর পাখি দেখে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে আসা যাক। তোমার সঙ্গে এইখানেই পরে দেখা হবে হপকিনস। তারপর ধারেকাছে কোথাও নিশাচর ভদ্রলোকটির প্রতীক্ষায় বসে থাকা যাবেখন।
রাত এগারোটার সময় আবার আমরা জমা হই কেবিনের সামনে। হপকিনস চায় দরজা খোলা থাকুক, কিন্তু হোমসের যুক্তি–দরজা খোলা থাকলে আততায়ীর সন্দেহ জাগতে পারে। তা ছাড়া, তালাটা এমনই মামুলি যে একটা বড়ো সাইজের ছুরির মজবুত ফলা ঢুকিয়ে চাড় দিলেই তা খোলা যায় অনায়াসে। হোমসের প্রস্তাব অনুযায়ী ঘরের মধ্যে না-থেকে বাইরে ঝোপঝাড়ের মধ্যেই ওত পাতা স্থির করলাম। দূরের জানলাটা থেকেই ঝোঁপের শুরু। এখানে ওত পেতে থাকার সুবিধে হচ্ছে এই যে লোকটা যদি আলো জ্বালায়, তাহলে তার নৈশ অভিযানের উদ্দেশ্যটা খুব কাছ থেকে দেখা যাবে স্পষ্টভাবে।
শুরু হয় রাত জাগার পালা। সেই অসহ্য অস্বস্তিকর প্রতীক্ষার যেন আর শেষ নেই। সেকেন্ডে সেকেন্ডে মিনিটে মিনিটে পেরিয়ে গেল একটার পর একটা ঘণ্টা।
ছমছমে নীরবতা আবার সচকিত হয়ে ওঠে আড়াইটে বাজার মেঘমন্দ্র ঘন্টা সংকেতে। ঠিক এমনি সময়ে ফটকের দিক থেকে মৃদু অথচ তীক্ষ্ণ্ণ ক্লিক শব্দ শুনে চমকে উঠলাম সবাই। গেট পেরিয়ে কে যেন ভেতরে এসেছে। কিন্তু তারপর আর কোনো শব্দ নেই। কতক্ষণ রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে হাল ছেড়ে দিলাম। ভাবলাম, নিশ্চয় অন্য কোনো শব্দ শুনে ভুল করেছি। এবার শোনা গেল পা টিপে টিপে চলার শব্দ। শব্দটা এল ঘরের এক পাশ থেকে। পর মুহূর্তেই আবার পেলাম ধাতুতে ধাতু আঁচড়ানোর আওয়াজ এবং আরও খুটখাট শব্দ। শুরু হয়েছে তালাখোলার চেষ্টা। এবারে লোকটা নিশ্চয় ভালো রকমের যন্ত্রপাতি এনেছে। একটু পরেই কড়াৎ করে একটা তীক্ষ্ণ্ণ শব্দ ভেসে আসে। এর পরেই শুনি ক্যাঁচ ক্যাচ আওয়াজ। আর ঠিক তারপরেই জ্বলে ওঠে একটা দেশলাইয়ের কাঠি এবং পরক্ষণেই মোমবাতির স্থির আলোয় উদ্ভাসিত হয় সারাঘরখানা। জালি পর্দার মধ্যে দিয়ে আমাদের তিন জোড়া চোখের দৃষ্টি আঠার মতো লেগে থাকে ভেতরকার দৃশ্যে।
নিশাচর আগন্তুকের বয়স এমন কিছু বেশি নয়।
বিশ বছরও হবে কি না সন্দেহ। রুগণ, শীর্ণ চেহারা। মড়ার মতো ফ্যাকাশে মুখ আরও ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে কুচকুচে কালো গোঁফটার জন্যে। কোনো মানুষকে এ-রকম ভয় পেতে আমি দেখিনি। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম দাঁতে দাঁতে ঠোকাঠুকি লেগে যাচ্ছে তার। সারা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাঁপছে থর থর করে। বাস্তবিকই, তার অবস্থা দেখে অনুকম্পা জাগে। বেশবাস ভদ্রলোকের মতোই। কোমরের কাছে ফিতে লাগানো ঢিলেঢালা জ্যাকেট, হাঁটুর কাছে জড়ো করা ঢিলে ট্রাউজার, নিকারবোকার আর মাথার ওপর একটা কাপড়ের টুপি। ভয়ার্ত চোখে জুল জুল করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল সে। তারপর মোমবাতিটাকে টেবিলের ওপর বসিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেল। ফিরে এল জাহাজের গতির হিসেব রাখার মোটা একটা বই নিয়ে। ঘরের তাকের ওপর এ-রকম বইয়ের একটা সারি দেখেছিলাম প্রথমবার ঘরে ঢুকে। টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে দ্রুতহাতে পাতার পর পাতা উলটে চলল, তারপর হঠাৎ থেমে যেতেই বুঝলাম ইঙ্গিত হিসেব সে পেয়েছে। কিন্তু পরমুহূর্তে মুঠি পাকিয়ে শুন্যে হাত ছুঁড়তে বুঝতে পারি বেজায় রেগে গেছে সে। দুম করে বই বন্ধ করে রেখে দেয় ঘরের কোণে। এবার নিভে যায় মোমবাতিটা। ঘর ছেড়ে সবে সে বেরোতে যাচ্ছে এমন সময়ে হপকিনসের হাত তার কলারের ওপর পড়তেই দম আটকানো আর্ত চিৎকার বেরিয়ে আসে তার গলা দিয়ে। আবার জ্বলে ওঠে মোমবাতিটা। দেখি, ডিটেকটিভ বন্ধুর সাঁড়াশি মুষ্টিতে আটকা পড়ে বেচারা বলির পাঁঠার মতো কাঁপছে। হপকিনস মুঠি আলগা করতেই জাহাজি সিন্দুকের ওপর ধপ করে বসে পড়ে সে। অসহায়ভাবে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
হপকিনস বলে, কী হে ছোকরা, তোমার নাম কী? বলো তো, কী করতে এসেছিলে এখানে?
ছেলেটি নিজেকে সংযত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কোনোরকমে সোজা হয়ে বসে বলে, আপনাদের গোয়েন্দা বলেই মনে হচ্ছে, তাই না? আপনাদের ধারণা ক্যাপ্টেন পিটার ক্যারির মৃত্যুর পেছনে আমারও হাত আছে। কেমন? বিশ্বাস করুন, এ-বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ।
হপকিনস বলে, সেটা আমরা ভাববখন। আপাতত বলো, কী নাম তোমার?
জন হপলি নেলিগ্যান।
লক্ষ করলাম, চকিতে দৃষ্টি বিনিময় করলে হোমস আর হপকিনস।
এখানে কী করছিলে?
যা বলব তা কি কেবল আমাদের মধ্যেই সীমিত থাকবে?
নিশ্চয় না।
তবে আমি বলব কেন?
প্রশ্নের উত্তর না-দিলে মামলা চলার সময়ে মজা টের পাবে’খন।
চোখ মিটমিট করে উঠল তরুণটি।
বলল, ঠিক আছে, আমি বলছি। বলবই-বা না কেন? যদিও আমি চাই না পুরানো কেলেঙ্কারি নতুন করে ছড়িয়ে পড়ুক, তবুও কিছু গোপন করব না আপনাদের কাছে। ডসন। অ্যান্ড নেলিগ্যানের নাম শুনেছেন আপনারা?
হপকিনস যে কস্মিনকালেও শোনেনি, তা ওর মুখ দেখেই বুঝলাম। হোমস কিন্তু বেশ সচকিত হয়ে উঠেছে মনে হল।
সাগ্রহে শুধোল ও, পশ্চিম দেশের ব্যাঙ্কার ছিল ডসন অ্যান্ড নেলিগ্যান তাই না? প্রায় দশ লক্ষ পাউন্ড নিয়ে ফেল করল তাদের ব্যাঙ্ক। কর্নয়ালের অর্ধেক পরিবারকে পথে বসিয়ে উধাও হয়ে গেল নেলিগ্যান।
এগজ্যাক্টলি। নেলিগ্যান আমারই বাবা।
এতক্ষণে অকূলপাথারে একটা কুটোর সন্ধান পাওয়া গেল! যদিও পলাতক ব্যাঙ্কার আর দেওয়ালের সঙ্গে হারপুন দিয়ে গাঁথা ক্যাপ্টেন পিটার ক্যারির মধ্যেকার ব্যবধানটা এতই দীর্ঘ যে কোনো দিশে খুঁজে পেলাম না। তরুণ জন হপলি নেলিগ্যানের আশ্চর্য বর্ণনা কানখাড়া করে শুনতে বসলাম সবাই মিলে।
এ-ব্যাপারের মূল আমার বাবা। ডসন আগেই অবসর নিয়েছিলেন। সে সময় আমি মাত্র দশ বছরের হলেও এই ঘটনার বিভীষিকা উপলব্ধি করার মতো বয়স আমার হয়েছিল। ঢি ঢি পড়ে গেছিল চারিদিকে। লজ্জায় আমাদের মাথা কাটা যায় সকলের সামনে। প্রথম থেকেই সবাই জেনেছে, বলাবলি করেছে এবং বিশ্বাস করেছে যে আমার বাবাই সিকিউরিটিগুলো আত্মসাৎ করে গা-ঢাকা দেন। এ-কথা সত্য নয়। তার বিশ্বাস ছিল, যথেষ্ট সময় যদি তাকে দেওয়া হয়, তাহলে সিকিউরিটিগুলো পুনরুদ্ধার করে পাওনাদারদের পাওনাগণ্ডা, কড়ায় ক্রান্তিতে চুকিয়ে দিতে পারতেন তিনি। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বেরোনোর একটু আগেই ছোট্ট বজরাটা নিয়ে নরওয়ের দিকে রওনা হন তিনি। আগের রাতে মায়ের কাছে বিদায় নেওয়ার দৃশ্যটা এখনও মনে আছে আমার। সিকিউরিটিগুলোর একটা তালিকা রেখে যান বাবা। যাবার সময় বলে যান মানসম্মান উদ্ধার না-করে তিনি ফিরবেন না। যারা তাকে বিশ্বাস করেছেন, তাঁদের বিশ্বাস যাতে অটুট থাকে, সে-বন্দোবস্ত করে তবে ঘরমুখো হবেন তিনি। এরপর থেকে তার আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। বজরা সমেত উনি যেন কপূরের মতো উবে গেলেন কোনোরকম চিহ্ন না-রেখেই। মা আর আমি ভাবলাম নিশ্চয় বজরাড়ুবি হয়েছে। সিকিউরিটিগুলো নিয়েই সমুদ্রের তলায় শেষ ঘুম ঘুমিয়েছেন বাবা। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে গেলাম আমাদের অনুগত এক ব্যবসায়ী বন্ধু মারফত একটা খবর শোনার পর। যাবার সময়ে যে সিকিউরিটিগুলো বাবা নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের কয়েকটা কিছুদিন আগে আবার দেখা গেছে লন্ডনের বাজারে। খবরটা শোনার পর আমরা যে কী পরিমাণে হতবুদ্ধি হয়ে যাই, তা নিশ্চয় অনুমান করতে পারছেন আপনারা। মাসের পর মাস লেগে রইলাম সিকিউরিটিগুলোর অনুসন্ধানে। অনেক দুর্ভোগ, বিস্তর ঝামেলা কাটিয়ে ওঠার পর আবিষ্কার করলাম যে সিকিউরিটিগুলো বাজারে বিক্রি করেছেন এই বাড়ির মালিক ক্যাপ্টেন পিটার ক্যারি।
লোকটার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, যে সময়ে আমার বাবা নরওয়ে রওনা হয়েছিলেন ঠিক সেই সময়ে সুমেরু সাগর দিয়ে ফিরে আসছিলএকটা তিমি শিকারের জাহাজ। ক্যাপ্টেন পিটার ক্যারি এই জাহাজের কম্যান্ডার ছিলেন। সে বছরের শরৎকালে ঝড় হয়েছে প্রচুর। প্রবল দক্ষিণে ঝড়ের উৎপাত দেখেছি একনাগাড়ে অনেক দিন ধরে। বাবার বজরা হয়তো এই ঝড়ের মুখে পড়ে ভেসে গিয়েছিল উত্তর দিকে। ক্যাপ্টেন পিটার ক্যারির জাহাজের সঙ্গে দেখা হয় সেইখানেই। তাই যদি হয়, তাহলে বাবা গেলেন কোথায়? পিটার ক্যারিকে সাক্ষী মেনে যদি প্রমাণ করতে পারি সিকিউরিটিগুলো বাজারে এসেছে কীভাবে, তাহলেই প্রমাণ করা হবে যে বাবা ওগুলো বিক্রি করেননি এবং ওগুলো নেওয়ার পেছনেও তাঁর কোনো ব্যক্তিগত মুনাফার উদ্দেশ্য ছিল না।
ক্যাপ্টেনের সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যেই এসেছিলাম সাসেক্সে। কিন্তু ঠিক এই সময়ে নিষ্ঠুরভাবে খুন হলেন তিনি। তদন্তের বিবরণে তার এই কেবিনের বর্ণনাও পড়েছিলাম এবং জাহাজের হিসাব রাখার বইগুলো যে এইখানেই উনি রেখে দিয়েছেন তা জেনেছিলাম। মতলবটা মাথায় আসে তখনই। ১৮৮৩ সালের অগাস্ট মাসে সী ইউনিকর্ন জাহাজের দিনপঞ্জিতে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেই তো জানা যায় বাবার পরিণতি রহস্য। গতরাতে বইগুলো দেখবার মতলবে এসে ব্যর্থ হয়েছি দরজা বন্ধ থাকায়। আজকে এসে দরজা খুলেছি। তারপরেই বইটা নামিয়ে পাতা উলটোতে গিয়ে দেখি আমি যা চাইছি, তা নেই। বইটা রেখে সবে বেরোতে যাচ্ছি, এমন সময়ে আপনারা এসে পাকড়াও করলেন আমাকে।
আর কিছু বলার আছে, না, এই-ই সব? জিজ্ঞেস করে হপকিনস।
না, আর কিছু বলবার নেই, চোখ নামিয়ে নেয় তরুণটি।
তাহলে আর কিছু বলার নেই তোমার?
আমতা আমতা করতে থাকে নেলিগ্যান, না কিছুই আর বলার নেই।
গতরাতের আগে এখানে তুমি আসনি?
না।
তাহলে এ-জিনিসটা এল কোত্থেকে? চিৎকার করে উঠে হপকিনস বহু ব্যবহারে জীর্ণ নোটবইটা বাড়িয়ে ধরে। রক্তের দাগ লাগা মলাটটা ওলটাতেই প্রথম পাতায় জ্বলজ্বল করতে থাকে বন্দি হপলি নেলিগ্যানের প্রথম অক্ষর তিনটে।
আত্মসংযমের শেষ শক্তিটুকু ব্যর্থ হয়। একেবারে ভেঙে পড়ে ছেলেটি। দু-হাতের তালুতে মুখ ঢেকে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করল সে, কিন্তু মনে হল তার চুলের ডগা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সমস্ত দেহ ঘন ঘন কেঁপে উঠছে ভয়ে উত্তেজনায় শিহরনে।
গুঙিয়ে উঠল নেলিগ্যান, কোথায় পেলেন আপনি? আমি জানি না। আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমি তো ভেবেছিলাম হোটেলে হারিয়েছি নোটবইটা।
ইস্পাত কঠিন স্বরে হপকিনস বলে, যথেষ্ট হয়েছে। আর যা কিছু বক্তব্য তোমার আছে আদালতেই বলবে। আপাতত আমার সঙ্গে চলো পুলিশ-ড়ি পর্যন্ত। মি. হোমস, আপনাদের দুজনকেই আমার ধন্যবাদ জানাই এতদূর এসে আমায় সাহায্য করার জন্যে।
ওয়াটসন, গতিক বুঝছ কেমন? পরের দিন সকালে লন্ডনে ফেরার পথে হোমস জিজ্ঞাসা করে।
আমি তো দেখছি–মোটেই সন্তুষ্ট হওনি তুমি।
আরে না, না, খুবই সন্তুষ্ট হয়েছি আমি। তবে হপকিনসের পদ্ধতি-টদ্ধতিগুলো ঠিক মানতে পারছি না। হপকিনস আমায় হতাশ করেছে, ওয়াটসন। ওর কাছ থেকে আমি আরও ভালো জিনিস আশা করেছিলাম। অপরাধ সম্পর্কিত তদন্তের সর্বপ্রথম নিয়ম হচ্ছে–সবসময়ে বিকল্প সম্ভাবনার কথা চিন্তা করা এবং তাকে কাজে লাগানো।
সেই বিকল্প সম্ভাবনাটা কী শুনি?
যে তদন্ত ধারা আমি নিজেই প্রথম থেকে ভেবে এসেছি–এক্ষেত্রে বিকল্প সম্ভাবনা একমাত্র সেইটাই। আমারও ভুল হতে পারে এবং তদন্ত শেষে হয়তো বৃহৎ শূন্য ছাড়া আর কিছুই লাভ হবে না। কী হবে তা জানি না। তবু শেষ না-দেখে ছাড়ছি না আমি।
বেকার স্ট্রিটে হোমস নামে কয়েকটা চিঠি এসে পড়ে ছিল। একটা চিঠি তুলে খুলেই বিজয়োল্লাসে হোমস তার চিরকেলে নিঃশব্দ হাসি হাসতে শুরু করে দিলে।
চমৎকার, ওয়াটসন, চমৎকার।বিকল্প সম্ভাবনাই ঠিক হতে চলেছে। টেলিগ্রাম ফর্ম আছে নাকি? গোটা দুয়েক খবর বলছি, লিখে ফেল তো সামনার, শিপিং এজেন্ট ব্যাটক্লিফ হাইওয়ে। কাল সকাল দশটায় তিনজন লোককে পাঠিয়ে দিন বেসিল।ও-অঞ্চলে আমার নাম বেসিল। আরেকটা লেখ : ইনস্পেকটর স্ট্যানলি হপকিনস ৪৬ লর্ড স্ট্রিট, ব্রিক্সটন। কাল সকাল সাড়ে নটায় ব্রেকফাস্টের সময়ে এসো। দরকারি। আসা সম্ভব না হলে টেলিগ্রাম পাঠাও–শার্লক হোমস।
টেলিগ্রামের সময় অনুসারে কাঁটায় কাটায় সাড়ে নটায় ইনস্পেকটর হপকিনস এসে পৌঁছোল আমাদের টেবিলে। তোফা খানা বানিয়েছেন মিসেস হাডসন। খোশমেজাজে টেবিল সরগরম করে রাখল তরুণ গোয়েন্দা। বুঝলাম, সাফল্যের আনন্দে অধীর হয়ে উঠেছে ওর অন্তর।
হোমস জিজ্ঞেস করে, হপকিনস, সত্যিই কি তুমি মনে কর যে তোমার সিদ্ধান্তে কোনো ভুল নেই?
নিশ্চয় নেই, মি. হোমস। এর চাইতে নিখুঁত কেস আর দেখিনি।
আমার তা মনে হয় না। আসল সমাধানে এখনও তুমি পৌঁছোতে পারনি।
অবাক করলেন মি. হোমস। আর কী আশা করেন আপনি?
তোমার ব্যাখ্যা দিয়ে সবকটা জিজ্ঞাসার সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া কি সম্ভব?
আলবাত সম্ভব। যেদিন ব্ল্যাক পিটার খুন হন, ঠিক সেদিন হোটেলে এসে ওঠে এই নেলিগ্যান ছোকরা। আরও খবর পেয়েছি, গলফ খেলার অছিলায় এ-অঞ্চলে কার আগমন। তার ঘরটা ছিল একতলায়, কাজেই যখন খুশি বাইরে বেরোতে পারত সে। সেই রাতেই ও উডম্যানস লী-তে গিয়ে ব্ল্যাক পিটারের সঙ্গে দেখা করে আসে। তর্কাতর্কি থেকে হাতাহাতি। হারপুনটা টেনে নামিয়ে ক্যাপ্টেনকে খুন করে সে। রক্ত দেখেই কিন্তু মাথা ঘুরে যায় তার। ভয়ে দিশেহারা হয়ে ঘর ছেড়ে পালানোর সময়ে নোটবইটা ফেলে আসে ভেতরে। সিকিউরিটি তালিকা লেখা নোটবইটা সে এনেছিল পিটার ক্যারিকে জেরা করার জন্যে। আপনি হয়তো লক্ষ করে থাকবেন, সংখ্যার ওপর টিক চিহ্ন দেওয়া আছে, কিন্তু বেশিরভাগ সংখ্যার পাশে কোনো চিহ্ন নেই। টিক চিহ্ন দেওয়া সিকিউরিটিগুলোই লন্ডনের বাজারে পিটার ক্যারি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। বাকিগুলো নিশ্চয় তার দখলে এখনও আছে, এই আশাতেই নেলিগ্যান এসেছিল তার সঙ্গে একটা বোঝাঁপড়া করতে। তার উদ্দেশ্য ছিল সিকিউরিটি পুনরুদ্ধার করে নিয়ে গিয়ে বাবার পাওনাগণ্ডা যতদূর সম্ভব মিটিয়ে ফেলা। সেরাতে চম্পট দেওয়ার পর কয়েকদিন এমুখো হওয়ার সাহস তার হয়নি, তারপর ফিরে এসেছিল আরব্ধ কর্মের বাকিটুকু শেষ করতে। এর মধ্যে জটিলতাটা কোথায় বলুন, মি. হোমস? ঠিক এইরকম না হলেই বরং আশ্চর্য হতাম।
মৃদু হেসে মাথা নেড়ে হোমস বলে, হপকিনস, তোমার ব্যাখ্যায় কেবল একটা অসংগতি আমার চোখে লাগছে এবং তা হচ্ছে, তুমি যা বললে, তা অসম্ভব, একদম অসম্ভব। কোনোরকম সন্দেহের অবকাশ না-রেখে, বিলকুল অসম্ভব। হারপুন দিয়ে কোনো দেহ এফেঁড়-ওফেঁড় করার চেষ্টা কোনোদিন করেছ? করনি? ছিঃ ছিঃ এইসব খুঁটিনাটি জিনিসগুলো নিয়ে তোমার একটু মাথা ঘামানো উচিত। বন্ধুবর ওয়াটসনকেই জিজ্ঞেস কর না কেন পুরো একটা সকাল আমি ব্যয় করেছি হারপুন দিয়ে দেহ এফেঁড়-ওফেঁড় করার ব্যায়ামে। ব্যায়ামটা বড়ো সহজ নয় হে হপকিনস। খুব বলিষ্ঠ আর পাকা হাত ছাড়া এ-কাজ কারো পক্ষে সম্ভব? গভীর রাতে ব্ল্যাক পিটারের খুনি এমন জোরে হারপুন চালিয়েছে যে হাতিয়ারের মাথাটা দেওয়ালের মধ্যেও গেঁথে গেছে অনেকখানি। তোমার কি মনে হয় এই রক্তহীন ছেলেটার দেহে এ-রকম আসুরিক শক্তি থাকা সম্ভব? গভীর রাতে ব্ল্যাক পিটারের সাথে এক টেবিলে রাম আর জল খাওয়ার মতো সাহস কি তার আছে? তুমি বলতে চাও দুরাত আগে জানলার পর্দায় এরই মুখের ছায়া ফুটে উঠেছিল? না, হপকিনস, না, নেলিগ্যান নয়। আমাদের উচিত আরও ভয়ংকর কোনো লোকের সন্ধানে জাল ছড়ানো।
হোমসের বক্তৃতা শুনতে শুনতে ক্রমশ ভারী হয়ে ঝুলে পড়ছিল গোয়েন্দাপ্রবরের চোয়ালখানা। তার হাঁ করে তাকিয়ে থাকার ধরন দেখে বাস্তবিকই বড়ো অনুকম্পা হল আমার। বেশ বুঝলাম, একটু একটু করে ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে তার আশা-উচ্চাশার অনেক কষ্টে গড়ে তোলা স্বপ্নসৌধ। কিন্তু ভাঙবে, তবু মচকাবার পাত্র সে নয়। তাই আশ্রয় নেয় তর্কের।
কিন্তু সেরাতে নেলিগ্যান ছোকরা যে খুনের দৃশ্যে হাজির ছিল, তা তো আপনি অস্বীকার করতে পারেন না, পারেন কি মি. হোমস? নোটবইটাই তার প্রমাণ। আমার তো দৃঢ় বিশ্বাস আমার হাতে যেসব প্রমাণ এসেছে, তা জুরিদের সন্তুষ্ট করার পক্ষে যথেষ্ট। শেষ মুহূর্তে দু-একটা ছিদ্র আপনার চেষ্টায় বেরিয়ে গেলেও বিশেষ কিছু ক্ষতি হয় না তাতে। তা ছাড়া মি. হোমস, আমার থিয়োরি অনুযায়ী আসামিকে আমি পাকড়াও করেছি। কিন্তু আরও ভয়ংকর যার কথা বলছেন, সে কোথায়?
আমার তো মনে হচ্ছে সিঁড়ির ওপর তার পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কঠোর স্বরে বলল হোমস। ওয়াটসন, রিভলভারটা এমন জায়গায় রাখ যেন হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। বলে, উঠে গিয়ে কয়েক পঙক্তি লেখা এক টুকরো কাগজ একটা ছোট্ট টেবিলের ওপর রেখে ফিরে এল। সব ঠিক আছে, আমরা তৈরি।
দরজার বাইরে কর্কশ গলায় কিছুক্ষণ কথোপকথনের পর দরজা খুলে গেল। মিসেস হাডসন ঘরে ঢুকে জানালেন তিনজন লোক ক্যাপ্টেন বেসিলের সঙ্গে দেখা করতে চায়।
একে একে তাদের নিয়ে আসুন এ-ঘরে, বললে হোমস।
প্রথমে যে-লোকটা ঘরে ঢুকল, তাকে দেখলে আচারের আপেলের কথা মনে পড়ে। খর্বকায়। রক্ত ফেটে-পড়া লাল লাল গালের ওপর পেঁজা তুলোর মতো ধবধবে সাদা একজোড়া জুলপি।
পকেট থেকে একটা চিঠি বার করে হোমস শুধোল, কী নাম?
জেমস ল্যাঙ্কাস্টার।
ল্যাঙ্কাস্টার, আমি দুঃখিত। আর জায়গা নেই জাহাজে। মিছিমিছি কষ্ট দিলাম, তাই রইল এই আধ-গিনিটা। পাশের ঘরে মিনিট কয়েকের জন্যে অপেক্ষা করো।
দ্বিতীয় দর্শনপ্রার্থী একজন দীর্ঘকায় পুরুষ। শরীরের মধ্যে মেদ-মাংসের বালাই নেই। শুকনো চেহারা। মাথায় অল্প অল্প চুল। তোবড়ানো গাল। লোকটার নাম হিউ প্যাটিনস। তাকেও আধ গিনি দিয়ে বরখাস্ত করে অপেক্ষা করতে বলা হল পাশের ঘরে।
তৃতীয় জনের চেহারাখানা দেখার মতো। এক কথায়, অসাধারণ মূর্তি তার। রাশি রাশি চুল আর দাড়ির ফ্রেমে আঁটা বুল-ডগের মতো ভয়ংকর মুখ। ঝোঁপের মতো পুরু, কার্নিশের মতো বেরিয়ে আসা গুচ্ছ গুচ্ছ একজোড়া ভুরুর নীচে ঘন কালো গ্রানাইটের মতো কঠিন, জ্বলন্ত চোখের দীপ্তি। স্যালুট করে নাবিক-সুলভ কায়দায় দাঁড়িয়ে টুপিটা হাতের মধ্যে ঘোরাতে লাগল সে।
তোমার নাম? জিজ্ঞেস করে হোমস।
প্যাট্রিক কেয়ার্নস।
হারপুনওয়ালা?
ইয়েস, স্যার, ছাব্বিশবার পাড়ি দিয়েছি সাগরে।
ডানডি, তাই না?
ইয়েস, স্যার।
অভিযান দলের জাহাজের সঙ্গে যেতে প্রস্তুত আছ তো?
মাইনে কত?
মাসে আট পাউণ্ড।
আমি রাজি।
এই মুহূর্তে রওনা হতে পারবে?
আমার জিনিসপত্র পাওয়ামাত্র তৈরি হব আমি।
কাগজপত্র এনেছ?
ইয়েস, স্যার। পকেট থেকে তেলতেলে জীর্ণ কতকগুলো ফর্ম বার করলে সে। চোখ বুলিয়ে নিয়ে কাগজগুলো ফিরিয়ে দিল হোমস।
তোমার মতো লোককেই চাইছিলাম আমি। ছোট্ট টেবিলটার ওপর শর্তলেখা কাগজটা আছে। তোমার সইটা হয়ে গেলে এদিককার বন্দোবস্ত পাকা হয়ে যায়।
ভারী ভারী পা ফেলে ঘরের ওদিকে গিয়ে কলমটা তুলে নিলে হারপুনওয়ালা প্যাট্রিক কেয়ার্নস।
তারপর টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করলে, এইখানেই সই করব তো?
হোমস তার কাঁধের ওপর ঝুঁকে পড়ে ঘাড়ের দু-পাশ দিয়ে দু-হাত গলিয়ে বললে, এইতেই হবে।
কানে ভেসে এল ইস্পাতে ইস্পাতে ঠোকাঠুকির কড়াৎ শব্দ এবং সঙ্গেসঙ্গে বাড়ি কাঁপিয়ে গর্জন করে উঠল যেন এক খেপা ষাঁড়। পরমুহূর্তেই হোমস আর হারপুনওয়ালা দুজনে একসাথে গড়িয়ে পড়ল মেঝের উপর। দৈহিক ক্ষমতার দিক দিয়ে লোকটাকে দানব বললেও চলে। চোখের পলক ফেলার আগেই নিপুণ হাতে তার কবজিজোড়া হাতকড়ার মধ্যে বেঁধে ফেলেছিল হোমস। তবুও ওই অবস্থাতেই সে ঘায়েল করে ফেলত হোমসকে যদি-না আমি আর হপকিনস দুজনেই ছুটে যেতাম তার সাহায্যে। মাথার ওপর রিভলভারের ঠান্ডা নলচেটা ঠেসে ধরতেই লোকটা বুঝলে ধস্তাধস্তি করে কোনো লাভই হবে না। দড়ি দিয়ে তার গোড়ালি দুটো বেঁধে ফেলে হাঁফাতে হাঁফাতে দাঁড়ালাম তিনজন।
প্রসন্নস্বরে হোমস বলে, হপকিনস, আজকের অভিজ্ঞতা থেকে তুমিও একটা মস্ত জিনিস শিখলে। সেটা কী জানো? বিকল্প সিদ্ধান্তকে কখনো অবহেলা করবে না। তরুণ নেলিগ্যানকে নিয়ে তুমি এত মেতে উঠেছিলে পিটার ক্যারির আসল হত্যাকারী প্যাট্রিক কেয়ার্নস সম্পর্কে ভাববারও অবসর পাওনি।
কথার মাঝেই হঠাৎ গমগম করে ওঠে হারপুনওয়ালার কর্কশ কণ্ঠ, এই যে, মিস্টার! আমাকে এভাবে নাজেহাল করার জন্যে কোনো অভিযোগ আমি জানাচ্ছি না। কিন্তু আপনি উলটোপালটা কথা বলছেন বলে বাধা না-দিয়ে পারলাম না। আপনি বলছেন পিটার ক্যারিকে মেরে ফেলেছি। আমি। কিন্তু আমি বলি তাকে ইচ্ছা করেই বধ করেছি আমি। তফাত শুধু এইটুকু। বিশ্বাস হওয়া-না-হওয়া আপনার অভিরুচি। কিন্তু এটুকু জেনে রাখুন আপনারা, আমি ধোঁকা দিচ্ছি না।
নিশ্চয় না, নিশ্চয় না। বলে হোমস। বল না–এ-সম্পর্কে কী বলার আছে তোমার।
বলব তো বটেই এবং ঈশ্বরের দিব্যি–একটা অক্ষরও মিথ্যা বলব না। ব্ল্যাক পিটারকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। তাই যে-মুহূর্তে ছুরি বার করেছে সে, আমিও পলক ফেলার আগেই হারপুনটাকে নামিয়ে এনে চালিয়ে দিয়েছি ওর বুকের মধ্যে দিয়ে। কেননা, এক মুহূর্ত দেরি করলে আমার অবস্থা যে কী হত, তা শুধু আমিই জানি। আপনি একে এবার খুন বলতে চান তো বলুন! ব্ল্যাক পিটারের ছুরি বুকে নিয়ে মরতাম, আপনাদের পাল্লায় পড়ে না হয় গলায় ফাঁস দিয়েই মরতে হবে।
হোমস জিজ্ঞেস করে, এখানে কী করে এলে তুমি?
তাহলে প্রথম থেকেই শুনুন। একটু তুলে বসিয়ে দিন আমায় কথা বলতে অসুবিধে হচ্ছে। এ-ঘটনাটা ঘটে ১৮৮৩ সালে, –অগাস্ট মাসে। সী ইউনিক জাহাজের কর্তা ছিলেন পিটার ক্যারি, আর আমি ছিলাম হারপুনওয়ালা। বরফের এলাকা পেরিয়ে এসে প্রবল ঝড় ঠেলে দেশে ফিরছিলাম আমরা। এমন সময় চোখে পড়ল ছোটো একটা জাহাজ। ঝড়ের দাপটে জাহাজটা ভেসে এসেছিল উত্তর দিকে। লোকজন বলতে শুধু একজনই ছিল জাহাজে তাও সে নাবিক নয়। পাইলট নাকি জাহাজড়ুবি হওয়ার ভয়ে সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে ডিঙি করে নরওয়ে উপকূলের দিকে সটকান দিয়েছিল। সমুদ্রের যা অবস্থা তখন, আমার তো বিশ্বাস ডিঙিসমেত সবাই ড়ুবে মরেছে–নরওয়ে পৌঁছোননা আর হয়নি। যাই হোক, পরিত্যক্ত ক্যাপ্টেনকে আমরা সী ইউনিকর্ন-এ তুলে নিলাম। কেবিনের ভেতরে তার সঙ্গে ব্ল্যাক পিটারের অনেকক্ষণ ধরে কথাবার্তা হল। ক্যাপ্টেনের মালপত্রের মধ্যে একটা টিনের বাক্সও ছিল। ভদ্রলোকের কী নাম, তা আমরা জানতাম না অর্থাৎ জানানো হয়নি। তবে, পরের দিন তাকে সী ইউনিকর্ন-এ দেখা গেল না। ভোজবাজির মতো অদৃশ্য হয়ে গেল সে। শোনা গেল ভদ্রলোক হয়তো নিজেই সমুদ্রে ড়ুবে আত্মহত্যা করেছে, আর না হয় ঝড়ের ধাক্কা সামলাতে না-পেরে রেলিং টপকে ডেক থেকে পড়ে গেছে জলে। কিন্তু একজন জানত ক্যাপ্টেনের পরিণাম। সেই লোক আমি, নিজের চোখে দেখেছিলাম গভীর রাতে ক্যাপ্টেনের গোড়ালি বেঁধে রেলিংয়ের ওপর দিয়ে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল সমুদ্রের বুকে। এ-কাণ্ড ঘটেছিল শেটল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের আলো দেখতে পাওয়ার ঠিক দু-দিন আগে।
এ-খবর কিন্তু আমি কাউকেই জানালাম না। ধৈর্য ধরে রইলাম কোথাকার জল কোথায় দাঁড়ায় দেখার জন্যে। এ-ব্যাপার নিয়ে যা একটু কানাঘুসো হয়েছিল–স্কটল্যান্ডে এসে তাও ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হল অনায়াসেই। দুর্ঘটনায় যদি কোনো আগন্তুক মারা গিয়ে থাকে, তা নিয়ে খোঁজখবর করার কাজ আমাদের নয়। এর কিছুদিন পরেই সমুদ্রযাত্রা ছেড়ে দিল পিটার ক্যারি। তারও অনেক বছর পরে ঠিকানা পেলাম তার। আমার বিশ্বাস ওই টিনের বাক্সের মধ্যেকার জিনিসের জন্যই ক্যাপ্টেনকে খুন করেছিল পিটার ক্যারি। আর আমার মুখ বন্ধ রাখার মতো পয়সার তার অভাব হবে না বলেই হঠাৎ মনে হল আমার।
ব্ল্যাক পিটারের এখানকার ঠিকানা পেয়েছিলাম একজন খালাসির খাছে। লন্ডনে দেখা হয়েছিল দুজনের। ঠিকানা অনুযায়ী এলাম তার কাছ থেকে কিছু দুয়ে নিতে। প্রথম রাতে তার কথাবার্তা শুনে আশা হয়েছিল আমাকে বাকি জীবনের মতো সমুদ্রযাত্রা যাতে আর না-করতে হয় তার জন্যে সে উপযুক্ত টাকা আমায় দেবে। স্থির হল, দুরাত পর এ-বিষয়ে পাকাঁপাকি ব্যবস্থা করা হবে। এসে দেখি সে মদে চুর হয়ে আছে। মেজাজও তিরিক্ষে। টেবিলে দুজনে বসে একসঙ্গে মদ খেলাম। পুরাননা দিনের অনেক কথা হল। কিন্তু গেলাসের পর গেলাস খালি হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে ওর চোখের দৃষ্টিটা আমার ভালো লাগল না। দেওয়ালের তাকে হারপুনটাকে দেখে রাখলাম তখনই। লড়তেই যদি হয়, খালি হাতে লড়ব না। যা ভয় করেছিলাম, তাই হল। আচমকা থুতু ছিটিয়ে, অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে করতে মস্ত একটা ছুরি হাতে আমার দিকে তেড়ে এল ব্ল্যাক পিটার। কিন্তু খাপ থেকে ছুরিটা বার করারও সময় দিলাম না। হারপুন দিয়ে এফেঁড়-ওফোঁড় করে ফেললাম তাকে। উঃ সে কী বিকট চিৎকার। আজও ঘুমোলে লোকটার মুখ আমি ভুলতে পারি না। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে–তবুও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম চুপ করে। কিন্তু চারিদিক নিস্তব্ধ দেখে সাহস ফিরে পেলাম। এদিক-ওদিক তাকাতেই তাকের ওপর টিনের বাক্সটা চোখে পড়ল। বাক্সটার ওপর পিটার ক্যারির অধিকার যতটা, আমারও অধিকার ততখানি। কাজেই অন্ধকারে গা-ঢাকা দেওয়ার আগে তা নিতে ভুললাম না। কিন্তু আহাম্মক আমি, যাওয়ার সময়ে তামাকের থলিটা ফেলে গেলাম টেবিলের ওপর।
এবার বলি শুনুন একটা অদ্ভুত ব্যাপার। ঘর থেকে বেরোতে-না-বেরোতেই পায়ের শব্দ শুনে তাড়াতাড়ি ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়ে পড়লাম আমি। চোরের মতো পা টিপে টিপে ঘরের মধ্যে ঢুকল একটা লোক। তারপরেই ভূত দেখলে মানুষ যেমন চিৎকার করে, তেমনি বিকট চিৎকার ছেড়ে দৌড়ে নিমেষের মধ্যে আমার চোখের আড়াল হয়ে গেল সে। লোকটা কে এবং কীসের জন্যে চোরের মতো ও-রকমভাবে এল, তা আমি জানি না। সেই রাতেই দশ মাইল হেঁটে লন্ডনে পৌঁছেই আমি। পরে কী হয়েছে-না-হয়েছে, আর আমি জানি না।
বাক্সটা খুলে তাজ্জব বনে গেলাম। টাকাকড়ির চিহ্ন নেই। শুধু একখানা কাগজ এবং যেসব কাগজ বিক্রি করার মতো সাহস আমার নেই। ব্ল্যাক পিটার খতম, আমার পকেটও খালি। একটা শিলিং নেই যে লন্ডন ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি। এক সময়ে কাগজে বিজ্ঞাপন দেখলাম মোটা মাইনায় হারপুনার প্রয়োজন। তৎক্ষণাৎ শিপিং এজেন্টের সঙ্গে দেখা করতে তারা আমাকে পাঠিয়ে দিলে এখানে। এ ছাড়া আর আমি কিছু জানি না। কিন্তু আবার আমি বলছি, ব্ল্যাক পিটারকে যদি আমি বধ করে থাকি তবে আইনের কর্তাদের উচিত আমাকে ধন্যবাদ দেওয়া। কেননা ওর জন্যে তাদের শণের দডির খরচটা আমি বাঁচিয়ে দিয়েছি।
খাসা বিবৃতি, নিটোল রিপোর্ট উঠে দাঁড়িয়ে পাইপ ধরাতে ধরাতে বললে হোমস। হপকিনস, তোমার আসামিকে চটপট নিরাপদ জায়গায় সরানোর ব্যবস্থা কর। হাজত হওয়ার মতো যোগ্যতা নেই এ-ঘরের। তা ছাড়া কার্পেটের বেশ খানিকটা জায়গা দখল করে রয়েছেন মি. প্যাট্রিক কেয়ার্নস।
হপকিনস বলে, মি. হোমস, কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাব ভেবে পাচ্ছি না। আপনার ভেলকি দেখে হতভম্ব হয়ে গেছি আমি। বুঝতেই পারছি না কী কৌশলে এমন কাণ্ড করলেন!
শুরু থেকেই ঠিক সূত্রটি ধরে এগোনোর সৌভাগ্য হয়েছিল বলেই এত সহজে সমাধান করতে পারলাম এই রহস্যের। নোটবইটার সূত্র যদি আগে শুনতাম, তাহলে তোমার মতো বিপথে চালিত হত আমার চিন্তাধারা। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আমি যেটুকু শুনেছি, সেটুকু থেকেই নির্দেশ পেয়েছি শুধু একদিকেই এগোনোর। বিপুল শক্তি, হারপুন চালানোর নৈপুণ্য, রাম আর জল, সীলমাছের চামড়া দিয়ে তৈরি তামাকের থলি আর তার ভেতর কড়া তামাক–প্রত্যেকটা পয়েন্টই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এমন একজন লোককে যার পেশা হারপুন চালানো আর সমুদ্রে ঘুরে বেড়ানো। তামাকের থলির ভেতরে লেখা PCঅক্ষর দুটো যে পিটার ক্যারির নামের আদ্যক্ষরের সঙ্গে দৈবাৎ মিলে গেছে, সে-বিষয়ে আমার তিলমাত্র সন্দেহ ছিল না। কারণ, তার অভ্যাস ছিল না নিয়মিত ধূমপানের এবং তার কেবিনেও কোনো পাইপ পাওয়া যায়নি। তোমার মনে আছে কি একবার তোমায় জিজ্ঞেস করেছিলাম কেবিনের মধ্যে হুইস্কি আর ব্র্যান্ডি ছিল কি না? তুমি বলেছিলে–হ্যাঁ, ছিল। হুইস্কি ব্র্যান্ডি থাকা সত্ত্বেও তা স্পর্শ না-করে র্যম আর জল খাওয়ার মতো রুচি ক-জন ডাঙার অধিবাসীর আছে বলতে পার? সমুদ্রের ওপর যাদের ঘরবাড়ি, এমন নেশা থাকে শুধু তাদেরই। সেইজন্যেই লোকটা যে জাহাজি এ-বিষয়ে নিঃসন্দেহ ছিলাম আমি।
কিন্তু তাকে খুঁজে বার করলেন কেমন করে?
মাই ডিয়ার স্যার, এ ক-টি তথ্য পাওয়ার পর তো খুবই সরল হয়ে এসেছিল আসল রহস্যটা। লোকটা যদি জাহাজি হয় তাহলে সে সী ইউনিকর্ন-এর খালাসি না হয়ে যায় না। সী ইউনিকর্ন ছাড়া আর কোনো জাহাজে সে সমুদ্র যাত্রা করেনি, এ-বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়ার পর ডানডীতে গত তিনদিন ধরে সমানে টেলিগ্রাম পাঠাতে লাগলাম। তিনদিন পর জানতে পারলাম সী ইউনিকর্ন জাহাজে ১৮৮৩ সালে যেসব লোকলশকর ছিল তাদের প্রত্যেকের নামের লিস্ট। এই লিস্টে চোখ বুলোতে গিয়ে হারপুনওয়ালা প্যাট্রিক কেয়ার্নস-এর নাম দেখেই প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে এল আমার গবেষণা। নিজের মনের সঙ্গেই তর্কবিতর্ক করে দেখলাম, লোকটা নিশ্চয় এখন লন্ডনেই আছে এবং এদেশ ছেড়ে পালাবার সুযোগ পেলে সে ছাড়বে না। তাই কয়েকটা দিন ইস্ট এন্ড-এ কাটিয়ে উত্তর মেরু অভিযানের একটা গল্প ছড়িয়ে দিলাম ও-অঞ্চলে। তারপর ক্যাপ্টেন বেসিলের তত্ত্বাবধানে কাজ করার জন্যে লোভনীয় বেতনে হারপুনওয়ালার বিজ্ঞাপন দিলাম দৈনিকে। দেখতেই তো পাচ্ছ, তার ফলাফল।
ওয়ান্ডারফুল। সোল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠে হপকিনস, ওয়ান্ডারফুল!
হোমস বলে, যত তাড়াতাড়ি পার নেলিগ্যানকে খালাস করার ব্যবস্থা করো তুমি। ছেলেটার কাছে তোমার ক্ষমা চাওয়াও উচিত। টিনের বাক্সও তাকে ফিরিয়ে দেবে অবিলম্বে। অবশ্য যে সিকিউরিটিগুলো ব্ল্যাক পিটারের ভোগে লেগেছে, সেগুলো আর ফিরে পাওয়ার আশা না-করাই ভালো। গাড়ি এসে গেছে, হপকিনস। লোকটাকে এবার নামানোর ব্যবস্থা করো। মামলা চলার সময়ে আমাকে দরকার হলে নরওয়েতে চিঠি লিখো আমি আর ওয়াটসন দুজনেই থাকব সেখানে পুরো ঠিকানা পাঠাব ফিরে।
————-
টীকা
তিমি শিকারির বুকে হারপুন : দি অ্যাডভেঞ্চার অব ব্ল্যাক পিটার ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯০৪ সংখ্যার কলিয়ার্স উইকলি পত্রিকায় এবং মার্চ ১৯০৪ সংখ্যার স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনে প্রথম প্রকাশিত হয়।
ক্যাপ্টেন বেসিল : এই নাম ছাড়া শার্লক হোমসের আরও কয়েকটি ছদ্মনাম হল কল মিস্তিরি অ্যাসকট (চার্লস অগাস্টাস মিলভারটন), অ্যাকাউন্ট্যান্ট মিস্টার হ্যারিস (স্টক ব্রোকার্স ক্লার্ক), গুপ্তচর অ্যালামন্ট (হিজ লাস্ট বাও), নরউইজিয় পর্যটক সিগারসন (দ্য এম্পটি হাউস)। এ ছাড়া নামহীন বহু ছদ্মবেশ শার্লক হোমস ধারণ করেছেন অন্য অনেক কাহিনিতে।
গোটা পাঁচেক খুদে আস্তানা : কিছু গবেষক অনুমান করেন, এগুলির মধ্যে একটি হল শার্লকের দাদা মাইক্রফটের বাড়ি।
স্যান পাওলো : যেহেতু এই নামে বাস্তব কোনো দেশ বা শহর না-থাকায় আর্জেন্টিনা এবং কোস্টারিকার সঙ্গে উচ্চারিত এই নামটি ব্রেজিলের শহর সাও পাওলো হওয়া সম্ভব বলে মনে করেছেন কোনো কোনো গবেষক। ১৮৮০-তে কফি চাষের উন্নতির পর থেকে এই অঞ্চলে ইউরোপীয়দের আগমন বাড়তে শুরু করে।
ক্যানাডিয়ান প্যাসিফিক রেলওয়ে : আমেরিকার প্রথম আন্তমহাদেশীয় রেলপথ। মন্ট্রিল থেকে ভ্যাঙ্কুভারের পোর্ট মুডি পর্যন্ত বিস্তৃত এই রেলপথের মূল লাইন নির্মাণ শেষ হয়েছিল ১৮৮৫ সালে।
নিকারোকার : হাঁটু পর্যন্ত স্কুলের ব্রিচেস জাতীয় পাতলুন। ওয়াশিংটন আর্ভিং-এর গ্রন্থ আ হিস্ট্রি অব নিউইয়র্ক ফ্রম দ্য বিগিনিং অব দ্য ওয়ার্ল্ড টু দি এন্ড অব দ্য ডাচ ডাইনেস্টি গ্রন্থের কাল্পনিক চরিত্র ডিডরিশ নিকারবোকার-এর নাম থেকে এর উদ্ভব। ১৮০৯ সালে প্রথম প্রকাশিত এই গ্রন্থের ইলাসট্রেটর জর্জ কশ্যাঙ্ক-এর আঁকা ছবিতে ডাচদের দেখা গিয়েছিল এই ধরনের পোশাক পরিহিত অবস্থায়। এক সময়ে ওলন্দাজ বংশোদ্ভূত সকলকেই নিকারবোকার নামে অভিহিত করা হত।
র্যাটক্লিফ হাইওয়ে : লন্ডনে টেমস নদীর সমান্তরালে অবস্থিত, দোকানপাট, অফিস প্রভৃতিতে ভরতি ব্যস্ত রাস্তা র্যাটক্লিফ হাইওয়ের উল্লেখ শার্লক হোমস করেছিলেন আ স্টাডি ইন স্কারলেট উপন্যাসে।
সমানে টেলিগ্রাম পাঠাতে লাগলাম : হোমস টেলিফোন করলে সময় বাঁচত, মনে করেন অনেক গবেষক। হয়তো হোমসের নিজের ফোন ছিল না, কিন্তু দ্য সাইন অব ফোর উপন্যাসে জানা যায়, বেকার স্ট্রিটের বাড়ির উলটোদিকে একটি ব্যবহারযোগ্য টেলিফোন ছিল।
নরওয়েতে : এত জায়গা ছেড়ে হোমস হঠাৎ নরওয়েতে কেন গেলেন? নেলিগ্যানও নরওয়ে অভিমুখে রওনা হয়েছিল সেই বিষয়ে তদন্ত করতে?