তিন । ফ্রান্সের সন্তান
কেবল ইংরেজ ও স্পানিয়ার্ডদের সঙ্গে নয়, জার্মান ও অস্ট্রিয়ানদেরও সঙ্গে ফ্রান্সের বিবাদ চলছে।
কিছুকাল কর্মচ্যুত হয়ে অলস জীবনযাপন করবার পর নেপোলিয়ন হঠাৎ একদিন শাসনসভা থেকে আহ্বান-পত্র পেলেন।
ব্যাপারটা হচ্ছে এই। একবার রক্তের স্বাদ পেলে বাঘ তা কখনও ভোলে না। জনসাধারণ আবার খেপে উঠেছে—তারা রক্ত চায়! শাসনসভার মাতব্বররা ভীত হয়ে ডাক দিলেন নেপোলিয়নকে।
নেপোলিয়ন বললেন, ‘আমি রাজি। কিন্তু আমাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে।’
মাতব্বররা বললেন, ‘তুমি যা খুশি করো।’
আজ সাত বছর ধরে ফ্রান্সের জনসাধারণ যখনই বিদ্রোহী হয়েছে, কর্তৃপক্ষ তাদের উচিতমতো বাধা দিতে পারেননি। বরং তাদের মন রাখবার চেষ্টা করেছেন। আস্কারা পেয়ে পেয়ে তাদের সাহস বেড়ে উঠেছে।
নেপোলিয়ন তাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্যে ব্যবস্থা করতে লাগলেন। রাতারাতি শাসনসভা হয়ে উঠল রীতিমতো কেল্লার মতো। ভীত সভ্যরা তার ভিতরে এসে আশ্রয় নিলেন—নেপোলিয়ন তাঁদেরও হাতে দিলেন অস্ত্র।
তিনি বললেন, ‘এইবারে কয়েকটা কামান চাই।’
সভ্যরা চমকে অধিকতর ভীত হয়ে ভাবলেন—ওরে বাবা, কামান? ব্যাপারটা কি এতই সাংঘাতিক হয়ে উঠবে?
মুরাট হচ্ছেন একজন যুবক, গোলন্দাজ সেনানী। তিনি নগর-প্রান্ত থেকে চল্লিশটা বড় বড় কামান টেনে নিয়ে এলেন। আজ থেকে নেপোলিয়নের ভাগ্যসূত্রের সঙ্গে তাঁরও ভাগ্য গ্রথিত হল।
জনসাধারণ হরেকরকম অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বিকট চিৎকার করতে করতে এগিয়ে আসছে। তাদের গর্জন-রব ভেসে এল শাসনসভার মধ্যে। সভ্যরা ঠকঠক করে কেঁপে সারা!
অনেকেই বললেন, দরকার নেই বাপু এত দাঙ্গা-হাঙ্গামায়! কী হতে কী হয় বলা তো যায় না। ওদের সঙ্গে একটা মিটমাট করে ফেলাই ভালো!
নেপোলিয়ন কিন্তু অটল। জনসাধারণকে তিনি আজ এমন শিক্ষা দিতে চান, যেন তারা ভবিষ্যতে আর কোনও দিন আবদার করতে না আসে!
ব্যূহবদ্ধ শিক্ষিত সৈনিকদের আক্রমণ করা যে কতখানি মারাত্মক ব্যাপার, নির্বোধ জনতা তা বুঝলে না। তারা বন্দুক ছুড়তে আরম্ভ করলে।
নেপোলিয়ন হুকুম দিলেন, ‘কামান দাগো!’
দেখতে দেখতে প্যারিসের রাজপথ দিয়ে বইতে লাগল রক্তের ঢেউ! দুই ঘণ্টার মধ্যে পথ সাফ! বিপুল জনতা দারুণ ভয়ে অদৃশ্য হল, পিছনে হতাহতকে ফেলে। সৈনিকদের মধ্যে মারা পড়ল তিরিশজন, আহত হল ষাটজন।
শাসনসভার সদস্যরা ‘রক্ষাকর্তা’ বলে নেপোলিয়নকে দুই হাত বাড়িয়ে অভ্যর্থনা করলেন।
জনসাধারণের কাছে তিনি এখন ঘৃণ্য। কিন্তু তাদের ঘৃণা তিনি গ্রাহ্যও করেন না। তিনি আজ ফ্রান্সের মধ্যে প্রধান সেনাপতিরূপে নির্বাচিত হয়েছেন। যশ, মান, অর্থ, শক্তি—সবই আজ তাঁর! দুর্বলের ঘৃণা নগণ্য!
তাঁর ভাইরা ও আত্মীয়রা বড় বড় কাজে নিযুক্ত হলেন। এতদিন পরে মা লেটিজিয়ার আর কোনও অভাব রইল না।
দাদা জোসেফ ইতিমধ্যে বিয়ে করে সংসারী হয়েছেন। নেপোলিয়নও তাঁর দাদার শ্যালি দেসিরিকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর প্রার্থনা নামঞ্জুর হয়। দেসিরি তখন বুঝতে পারেনি, নেপোলিয়নকে প্রত্যাখ্যান করে সে অর্ধইউরোপের সিংহাসন থেকে বঞ্চিত হল! যদিও পরে নেপোলিয়নেরই অনুগ্রহে সে হয়েছিল সুইডেনের মহারানি। কিন্তু তারপরেও সে স্বামীর সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল নেপোলিয়নেরই বিরুদ্ধে।
ভাই কাউন্ট বাহার্নেস এখন মৃত, তাঁর বিধবা জোসেফাইন এক ছেলে, এক মেয়ের মা। তিনি খেতাবওয়ালা বড় ঘরের বউ, শাসনসভার বড় কর্তারাও তাঁকে খাতির করে চলেন।
নিজের সৌভাগ্য সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়ে নেপোলিয়ন স্থির করলেন, এইবারে সংসার পাতবেন।
কিন্তু মনের মতন বউ কই? দেসিরি? হ্যাঁ, সে হয়তো এখন জেনারেল নেপোলিয়ন বোনাপার্টকে বিয়ে করতে রাজি হবে, কিন্তু এখন তাঁর যে পদমর্যাদা হয়েছে, অমন সাধারণ গৃহস্থ ঘরের মেয়ে আনলে তো চলবে না!
তখন নেপোলিয়নের দৃষ্টি পড়ল জোসেফাইনের দিকে। যদিও তিনি বয়সে নেপোলিয়নের চেয়ে বড়, তবু তাঁর উপাধি আছে এবং রূপেরও অভাব নেই।
নেপোলিয়নের সঙ্গে জোসেফাইনের বিবাহ হয়ে গেল (১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দ)। বিয়ের আংটির উপরে এই কথাটি খোদাই ছিল—’অদৃষ্ট-পথে’। তাঁদের অদৃষ্ট-পথ কোথায় গিয়ে শেষ হবে, সেদিন কেউ তাঁরা দেখতে পাননি!
বিবাহের দুই দিন পরে নেপোলিয়ন ইতালির দিকে যাত্রা করলেন।
ইতালির উপরে তখন অস্ট্রিয়ানদের প্রভুত্ব এবং অস্ট্রিয়ানদের সঙ্গে বেধেছে ফরাসিদের লড়াই। নেপোলিয়ন গেলেন প্রধান সেনাপতিরূপে।
তখন সেনাপতি মোরো ও জোর্দান যথাক্রমে সত্তর ও আশি হাজার সৈন্য নিয়ে জার্মানিকে আক্রমণ করতে গিয়েছেন। নেপোলিয়ন পেলেন মাত্র আটত্রিশ হাজার সৈন্যের ভার।
নেপোলিয়নের বয়স তখন সাতাশ বৎসর। এবং আজ থেকে তিনি নিজেকে ফ্রান্সের সন্তান বলে মনে করতে লাগলেন।