উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

তিন । আগন্তুকের স্বরূপ

তিন । আগন্তুকের স্বরূপ

উপযোগী বাতাস পেয়ে জাহাজ বন্দর ছেড়ে ভেসে চলল আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। দু-দিন পরেই কাপ্তেন হর্নিগোল্ডের বুঝতে বাকি রইল না যে, সহকারীরূপে যাকে তিনি নিযুক্ত করেছেন, দুর্বৃত্ততায় সে শয়তানেরই জুড়িদার বটে! কাপ্তেনের ঘরের আওতাতেই দাঁড়িয়ে সে নোংরা, অশ্রাব্য ভাষায় চেঁচিয়ে শপথ করে এবং টুপি থেকে ঝুলন্ত পলিতাগুলোকে আগুন লাগিয়ে যথেচ্ছভাবে যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই ছোড়ে ছয়-ছয়টা পিস্তল—কেউ হত বা আহত হল কি না তা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামায় না! একে তো সেই বিপুলবপু, নরদানবের চেহারা দেখলেই পেটের পিলে চমকে যায়, তার উপরে তার পাশবিক গর্জন শুনে এবং পিস্তলগুলো নিয়ে মারাত্মক খেলা দেখে মহাপাষণ্ড বোম্বেটেগুলো পর্যন্ত আতঙ্কে থরহরি কম্পমান দেহে জাহাজের আনাচেকানাচে গা ঢাকা দেয় এবং তাদের মুখের ভাব যেন জাহির করতে চায়—ছেড়ে দে বাবা, কেঁদে বাঁচি!

কালোদেড়ের সামনে গেলে সকলেরই অবস্থা হয় ভীরু ভেড়ার মতো।

একদিন সে হাঁক ছেড়ে ডাক দিলে, ‘এই রাবিশের দল, আজ আমরা এক নিজস্ব নরক তৈরি করব! দেখব কতক্ষণ আমরা নরকযন্ত্রণা সহ্য করতে পারি! চল সবাই জাহাজের নীচের তলায়!’

ধ্রুম, ধ্রুম, ধ্রুম! পিস্তলের পর পিস্তলের ধমক! ভয়ে কেঁচোর মতো বোম্বেটের দল নীচের তলায় গিয়ে হাজির হতে দেরি করলে না। তারপর দুমদাম করে বন্ধ করে দেওয়া হল সব দরজা। অগ্নিসংযোগ করা হল বড়ো বড়ো গন্ধকের কুণ্ডে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলল না বটে, কিন্তু হু হু করে গন্ধকের ধোঁয়া বেরিয়ে ক্রমেই কুণ্ডলিত ও পুঞ্জীভূত হয়ে সেই রন্ধ্রহীন বদ্ধ জায়গাটাকে করে তুললে ভয়ংকর দুঃসহ! দৃষ্টি হয়ে যায় অন্ধ, শ্বাসপ্রশ্বাস হয়ে আসে রুদ্ধ, অন্তিমকাল মনে হয় আসন্ন! অমন যে বেপরোয়া, নিষ্ঠুর, হিংস্র ও নরঘাতক বোম্বেটের দল, তারাও হাঁচতে হাঁচতে, কাশতে কাশতে, হাঁপাতে হাঁপাতে ও মৃত্যুভয়ে কাঁপতে কাঁপতে হাঁটু গেড়ে কালোদেড়ের সামনে বসে পড়ে আর্তস্বরে চ্যাঁচাতে লাগল—’প্রাণ যায়, বাঁচাও! দরজা খুলে দাও, দরজা খুলে দাও, দরজা খুলে দাও!’

দুই হাতে দুটো করে পিস্তল ছুড়তে ছুড়তে কালোদেড় বিকট স্বরে অট্টহাস্য করে নেচে নেচে বলে উঠল, ‘একবার নরকে ভরতি হলে আমার শয়তানদাদা আর তোদের ছুটি দেবে না—এই বেলা সময় থাকতে থাকতে নরকবাসের অভ্যাসটা করে নে রে!’

‘গেলুম, গেলুম,—আর নয়! বাবা রে, দম বন্ধ হয়ে এল!’

তখন দরজা খুলে দিয়ে কালোদেড়ে গর্জন করে বললে, ‘কেমন, এখন বুঝলি তো, এ জাহাজের আসল কর্তা কে?’

জাহাজের উপর থেকে কালোদেড়ের আস্ফালন শুনতে শুনতে কাপ্তেন হর্নিগোল্ডের বুকটা কেঁপে উঠল। তিনি বুঝলেন, এমন সাংঘাতিক সহকারীর সঙ্গে সমুদ্রযাত্রা করা অতিশয় বিপজ্জনক। ভাবতে লাগলেন, এখন কোন উপায়ে এই নারকীয় পাল্লা থেকে ভালোয় ভালোয় ছাড়ানো পাওয়া যায়?