তিনি এবং আমি
নে রবীন্দ্রনাথকে তুমি বুকে জড়িয়ে বসে আছো
জানলার ধারে
আমি কি কেউ না?
আমি গরিব ইস্কুল মাস্টারের ছেলে দাঁড়িয়ে আছি রাস্তায় হাঁ করে
জলকাচা ধুতির ওপর পেঁজা শার্ট পরে, পায়ে রবারের স্যান্ডেল
আমার কোনো জ্যোতিদাদা ছিল না, পিয়ানো-অর্গান শুনিনি
সাত জন্মে
আমার বাবা কোনো দিন সিলে পাহাড়ে যান নি আমাকে নিয়ে
জন্মদিনে রুপোর চামচে পায়সান্ন খাওয়া দূরে থাক, ফ্যানা ভাতে
কোনোদিন ঘি জোটেনি
তবু আমি কি কেউ না?
আমার নিজস্ব ঘর নেই, লেখার টেবিল নেই, যখন তখন আমার বিছানায়
উড়ে আসে
উনুনের ঠাণ্ডা ছাই
তিনবেলা টিউশানি করি, সর্বক্ষণ পেটে ধিকিধিকি করে খিদে
তবু আমি কবিতা লিখেছি, সবাইকে লুকিয়ে, মোম-জ্বলা মাঝ রাত্রে
আমার রক্ত, ঘাম, আত্মার টুকরো মিশে আছে তাতে।
আমার বাবা শিরোপা দেবার বদলে জুতো মারতে উঠেছিলেন
স্বর্ণকুমারী কিংবা প্রতিভা নয়, আমার ছোড়দির নাম চামেলী
আমার খাতার পাতা ছিঁড়ে সে বাতাসকে
উৎসাহ দেয়
বাড়ির দেয়াল থেকে পাড়ার মোড় পর্যন্ত ঝনঝন করে উপহাস
বড় জামাইবাবু মাথায় চাঁটি মেরে আমায় ‘কপি’ বলে
শ্যালিকাদের হাসিয়েছেন
তবু আমি লিখেছি, আমি লিখে গেছি
রবীন্দ্রনাথ আমার এই চৌহদ্দির মধ্যে জন্মালে লিখতে পারতেন
এক লাইনও?
বিহারীলালের মতন কোনো নামজাদার সঙ্গে আমার চেনা-জানা ছিল না
গলা থেকে মালা খুলে আর দেবে,
মালা পরাই উঠে গেছে
পত্রিকার সম্পাদকরা উত্তর দেন না, ডাক টিকিট মেরে দেন
তবু আমি লিখেছি, লিখে গেছি
আমার সমস্ত অস্তিত্বের নির্যাস নিয়ে এক একটি কবিতা
শুধু তোমাকে শোনাবার জন্যই নয়, তোমাকে রচনা করবার জন্য
তোমার পায়ের তলার ধুলো, চুলের মধ্যে ঘাম শুষে নেবার জন্য
তোমার ফ্যাকাসে হাসির চার পাশে একটা বৃত্ত এঁকে দেবার জন্য
এবং এক সময় তোমাকে ছাড়িয়ে আমি রক্ত নদীর তীরে দাঁড়িয়ে
গণ্ডূষ পান করেছি।
বন্ধুরা চাঁদা দিয়েছিল, তাই নিয়ে ছাপিয়েছি প্রথম কবিতার বই।
প্রেসে এখনও কিছু ধার রয়ে গেছে
দপ্তরী খানায় দয়া চেয়েছি
তারপর ছুটতে ছুটতে এসেছি তোমার কাছে, তোমার করকমলে
প্রথম কপিটি দেবার জন্য
পাপীয়সী, তুমি এই সময়ে রবীন্দ্রনাথকে বুকে জড়িয়ে আদর করছো
আমি কি কেউ না?
আমার ঈর্ষা লকলক করে উঠছে আকাশে, এখন এক প্রবল বজ্রপাতে
ধ্বংস হয়ে যাক
রবীন্দ্রনাথের মতো সব কিছু
তার ওপরে রেখে যাবো আমার দীন দুঃখী কাব্যগ্রন্থখানি!
রবীন্দ্রনাথের সব কিছু ধ্বংস হলেও কোনো ক্ষতি নেই
বাড়ি ফিরেও, সব কিছু মুছে দিয়ে, তোমাকেও
নির্মম একাকিত্বে
আমার হাহাকার, আমার সমস্ত গুপ্তকথার মতন অনর্গল মুখস্থ বলে যাবো
রবীন্দ্রনাথের কবিতা
একটাও কমা, হসন্ত ভুল হবে না
রবীন্দ্রনাথকে আমি ভাঙবো, ছিঁড়বো, যা খুশি করবো
সে সব আমার নিজস্ব ব্যাপার
রবীন্দ্রনাথও সে কথা জানতেন, মৃত্যুর আগে সেই জন্যই
তাঁর ঠোঁটে লেগে ছিল
ক্ষীণ কৌতুকের হাসি!