ঢাকা রহস্য উন্মোচিত – পরিচ্ছেদ ৫ (শেষ)

পাঁচ

আজ সকাল থেকে একেনবাবু আবার বারান্দার গাছগুলো নিয়ে লেগেছেন। আমাকে অনেকক্ষণ বোঝাবার চেষ্টা করেছেন একটা বড় আয়না কিনে সেটা যদি বারান্দার রেলিং-এর সঙ্গে একটা ব্র্যাকেট আটকে তার অন্য প্রান্তে লাগানো যায়, তাহলে সূর্যের আলো তাতে রিফ্লেক্ট হয়ে ওঁর দুটো টবে অন্তত: পড়বে। ওঁর দুটো টবই হচ্ছে সবচেয়ে ক্রিটিক্যাল। অন্যগুলোতে যেসব গাছ আছে তারা ছায়াতেও বাঁচবে, যদিও ফুল ভালো হবে না।
আমি ঠাট্টা করে বললাম, “আপনি ঠিক চেক করে দেখেছেন দুটো টব আলো পাবে কিনা।”
“হ্যাঁ স্যার, থিওরি অফ ফিফ্লেকশনতো সহজ অঙ্ক। কঠিন ব্যাপার হল আপনাদের সম্মতি পাওয়া।”
“সেটা পাবেনও না, প্রমথ বলল, আয়না ভেঙ্গে নিচে কারোর মাথায় পড়লে খুনের দায়ে জেলে যাবে কে, আপনি না আমরা?”
“পড়ে যাবে কেন স্যার ব্র্যাকেটে নাটবোল্ট দিয়ে টাইট করে লাগানো থাকলে।”
“আপনি এক কাজ করুন, প্রমথ বলল, সবকটা টব মামুদকে দিয়ে দিন। ওদের কম্পিটেণ্ট মালী আছে, বিদেশী গাছ বাঁচিয়ে অভ্যস্ত। ওরা আপনার গাছকে অনেক ভালো দেখভাল করবে।”
“আপনি স্যার, সত্যি!” একেনবাবু ওঁর এই ব্রিলিয়াণ্ট আইডিয়াটা এভাবে উড়িয়ে দেওয়া হল বলে একটু ক্ষুণ্ণই হলেন।
আমার খারাপ লাগলো। বললাম, “দোকানেতো গ্রো লাইট বিক্রি করে দেখেছি। তার একটা কিনে লাগান না।”
“ওগুলো খুব এফেক্টিভ নয় স্যার। কোথায় সূর্যের আলো আর কোথায় গ্রো ল্যাম্প।”
“আরে মশাই নেই মামার থেকেতো কানা মামা ভালো।”
“তা ঠিক।”
“ঠিক আছে আপনি যখন এতো ঘ্যানঘ্যান কাছেন, ইলেকট্রিসিটি না হয় আমরা শেয়ার করবো। তবে এও আপনাকে বলছি, এর থেকে অনেক সস্তা হত যদি আপনি সপ্তাহ অন্তর কিছু ফুল বাড়িতে কিনে আনতেন। এই মাটি জলে বারান্দা কাদা করতেন না, ফুলও বাড়িতে থাকতো এবং তার ভ্যারাইটিও অনেক বেশি হত।”
“কিন্তু নিজের হাতে বাগান করার আনন্দটাতো থাকতো না।”
“সেটাতো শুধু আপনি উপভোগ করছেন। আমরা সাফার করছি। এক্ষেত্রে সবাই উপভোগ করতাম। আপনার ম্যাডাম ফ্র্যান্সিস্কাও।”

একেনবাবুর ভাগ্য অতি সুপ্রসন্ন। ঠিক এই সময়ে ফ্র্যান্সিস্কা এসে হাজির। একেনবাবুর কীর্তিকলাপ দেখে সে মুগ্ধ।
“মাই গড, কি চমৎকার গাছগুলো হয়েছে ডিটেকটিভ। আমি শিওর কদিন বাদেই বড় বড় ফুল হবে।”
“আই অ্যাম ট্রাইং ম্যাডাম,” একেনবাবু পরম উৎসাহিত হয়ে বললেন।
“আমাদের অনেক নেগেটিভ ফিডব্যাক সত্যেও,” প্রমথ গম্ভীর ভাবে বলল।
“তোমরা এতো নেগেটিভ কেন, নেচারকে নার্চার করছেন মাই ডিয়ার ডিটেকটিভ।” ফ্র্যান্সিস্কা একেনবাবুকে খুব পছন্দ করে। স্নেহভরে ‘মাই ডিটেকটিভ’ বলে ডাকে। একেনবাবুও ফ্র্যান্সিস্কাকে দেখলে মনে বেশ বল পান। এবং আমাদের বিরুদ্ধে যা যা কম্প্লেইন আছে সব নির্ভয়ে ব্যক্ত করেন। তারজন্য ফ্র্যান্সিস্কার মিষ্টি তিরস্কার আমাদের সহ্য করতে হয়। এটাই রুটিন।
“একটু সূর্যের আলো জোগাড় করার চেষ্টা করছিলাম ম্যাডাম, কিন্তু ওঁরা আপত্তি করছেন।”
“কেন?” ফ্রান্সিস্কা অনুযোগভরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকালো।
“তুমিই জিজ্ঞেস করো না আইডিয়াটা কি?”
একেনবাবু বিশদ করে আয়নার কথাটা বললেন।
“দ্যাট্‌স ব্রিলিয়াণ্ট,” সস্নেহে ফ্র্যান্সিস্কা বলল। “সিটি কোডে না আটকালে নিশ্চয় করা যেতো।”
এইখানেই আমাদের সঙ্গে ফ্র্যান্সিস্কার তফাৎ। বারণ করবে, কিন্তু এমন ভাবে করবে যে মনে হয় বারণ করছে না।
“কিন্তু ডিটেকটিভ আমাকে তোমার বলতে হবে তুমি কি ফার্টিলাইজার দিচ্ছ। ইমপেশেণ্ট গাছগুলো সত্যি কি হেল্‌দি লাগছে!”
“মিরাকল গ্রো-র একটা স্পেশাল ব্র্যান্ড কিনেছি ম্যাডাম। দেখলাম ওটাই বলছে এই গাছের পক্ষে সবচেয়ে ভালো।”
“তুমি এক কাজ করো ডিটেকটিভ, আমার অ্যাপার্টমেণ্টের বারান্দায় আলো আসে। তোমার যে গাছগুলোতে আলো দরকার সেগুলো ওখানে রাখতে পারো। আমার শুধু দুয়েকটা ছোট পট আছে। তোমার কয়েকটা পট ওখানে রাখতে কোনও অসুবিধাই নেই।”
“থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ। প্রমথবাবুতো এগুলোকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিতে বলছিলেন।”
“ঢাকা, ইউ মিন বাংলাদেশের ঢাকা?”
“হ্যাঁ, ম্যাডাম।”
ফ্রান্সিস্কা প্রমথর দিকে ভর্ৎসনার দৃষ্টি দিয়ে বলল, “ইউ আর রিয়েলি সো নটি!”
প্রমথ কাঁধ ঝাঁকালো।
“আজকে মেনু কি স্যার ?”
ফ্র্যান্সিস্কা এলেই এই টেকনিকটা একেনবাবু ব্যবহার করেন। ফ্র্যান্সিস্কা রান্না করতে ভালোবাসে। আরও ভালোবাসে খাওয়াতে। কিন্তু ফ্র্যান্সিস্কার রান্না করার ব্যাপারটা খুব ইলাবোরেট। আমাদের সমস্ত পট্‌স আর প্যান্‌স তাতে লেগে যায়। তারপর সেগুলো ধুতে ধুতে আমার আর প্রমথর প্রাণান্ত।। একেনবাবু অবশ্য ওঁর সার্ভিস ভলেণ্টিয়ার করেন। কিন্তু সেটা নেওয়া মানে আরও বাড়তি কাজ। এখানে ওখানে নোংরা লেগে থাকবে। সেগুলো স্পট করে করে আবার ধোয়া। ফ্র্যান্সেস্কা রান্না করলে খাওয়াটাও যেমন তেমন ভাবে করা যাবে না। সুন্দর করে টেবিল সাজিয়ে, প্লেসম্যাটের উপর প্লেট, গ্লাস, ন্যাপকিন কাঁটাচামচ ইত্যাদি রেখে মোমবাতি জ্বালিয়ে স্যালাড, ব্রেড ও ওয়াইন সহযোগে সেই রান্না খেতে হবে। সমস্ত ব্যাপারটা একটা প্রডাকশন। সেটা শর্ট কাট করা মানে ওকে কষ্ট দেওয়া। কে চায় কোনো সুন্দরীর কষ্টের কারণ হতে। তাছাড়া মেয়েটা রান্না করে চমৎকার, আর তারচেয়েও চমৎকার ওর হৃদয়টা। প্রমথর ভাগ্যি যে এরকম একটা মেয়ে ওর প্রেমে পড়েছে। কিন্তু কাপ-ডিশ পট্‌স প্যান ধোয়ার রূঢ় বাস্তবটাও উপেক্ষা করা যায় না। তাই আবার খাবার ধুয়ো তুলেছেন দেখে প্রমথ ধমকে বলল, “আপনি এতো হ্যাংলা কেন মশাই, আবার পোঁ ধরলেন।”
ফ্র্যান্সিস্কা এখন বাংলা বেশ শিখে গেছে। সহজ সহজ কথাগুলো ধরতে পারে। তাছাড়া যে রেটে আমরা ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি, তাতে বাংলা না জানলেও মূল বক্তব্য মোটামুটি ভালোই বোঝে। কিন্তু ‘হ্যাংলা’ আর ‘পোঁ’ শব্দটা ও ধরতে পারলো না। জিজ্ঞেস করল, “‘হ্যাংলা’ কি?”
“ওটা ট্র্যানস্লেট করা যায় না,” আমি বললাম।
“আর ‘পোঁ’?
“ওটাও কঠিন,” প্রমথ বলল।
একেনবাবু বললেন, “আসলে ম্যাডাম, আমি খাবারের কথা তুলেছিলাম বলে, ওঁরা রাগ করছেন, আপনাকে আবার রান্না করতে হবে বলে।”
“ওমা, এতে রাগের কি আছে। আমারতো ভালো লাগে রান্না করে সবাইকে খাওয়াতে।”
“আর আপনার রান্নাও একেবারে এক্সেলেণ্ট ম্যাডাম।”
“আচ্ছা নেমকহারামতো আপনি মশাই। প্রতিদিনতো বেশ ভালোই সাঁটান আমার রান্না।”
“কিযে বলেন স্যার। একজনকে ভালো বলা মানে কি আরেকজন খারাপ বলা। আপনার রান্নার প্রশংসা আমি সবজায়গাতেই করি।”
“ইউ আর সো কম্পিটিটিভ,” বলে প্রমথর মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে ফ্র্যান্সিস্কা রান্নাঘরের দিকে গেল। একেনবাবুও গেলেন ওর পেছন পেছন।
“মাঝে মাঝে একেনবাবুকে আমার খুন করতে ইচ্ছে করে,” আমার কানে কানে সেটা জানিয়ে প্রমথও গেল কিচেনটাকে একেনবাবু আর ফ্রান্সিস্কার যুগ্ম আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে।
তবে ভগবান আছেন। একেনবাবুর একটা ফোন – ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের কাছ থেকে।
“মাই গড —- আপনি শিওর স্যার —- গ্রেট নিউজ। থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ।”

ফোনটা নামাতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কি ব্যাপার ?”
“মামুদ সাহেবের বাবার ব্যাপারটা নিয়ে।”
“ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট এর মধ্যে জড়ালেন কি করে?”
“উনি বাংলাদেশের কনসাল জেনারেলকে খুব ভালো চেনেন স্যার। আমি কতগুলো জিনিস জানতে চেয়েছিলাম। উনি বাংলাদেশ কনসালের থ্রু-তে ঢাকা পুলিশকে দিয়ে কাজটা করিয়েছেন।”
“কি কাজ?” প্রমথর প্রশ্ন। কখন প্রমথ আর ফ্র্যান্সেস্কা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে দেখি নি।
“বলছি স্যার।”
ফ্র্যান্সিস্কা জিজ্ঞেস করল, “কি ব্যাপার ডিটেকটিভ, আমাকেতো কিছুই বল নি?”
“বলছি ম্যাডাম, বলছি। কিন্তু তার আগে, মামুদকে একটু খবর দেওয়া দরকার।”
“আমি ফোন করছি,” প্রমথ বলল, “আর সেই সঙ্গে পিৎজারও অর্ডার করি। ফ্র্যান্সিস্কা তাহলে রান্না করতে গিয়ে গল্পটা মিস করবে না।”
এক ঢিলে চমৎকার দুটো পাখি মারলো প্রমথ।
কয়েকমিনিটের মধ্যেই নিচ থেকে তারেক এলো। মামুদকে কোম্পানির কাজে দুদিনের জন্য শিকাগো যেতে হয়েছে। প্রমথ বলল, মামুদের জন্য অপেক্ষা না করে যা জানলেন আমাদের বলুন। ওকে না হয় আবার বলবেন।
এরমধ্যেই প্রমথ সংক্ষেপে ফ্র্যান্সিস্কাকে মামুদের বাবার মৃত্যুর ব্যাপারটা বলে দিয়েছে। সেও একেনবাবুকে বলল, “ডিটেকটিভ, সবকিছু না শুনে তোমাকে ছাড়বো না।”

ছয়

আমরা সবাই ভালোভাবে বসার পর একেনবাবু তারেককে বললেন, “একটু আগে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট ফোন করেছিলেন।”
“ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট?”
“উনি নিউ ইয়র্ক পুলিশের ক্রিমিনাল ডিভিশনের হেড। আমাকে খুব স্নেহ করেন স্যার”।
“না, না, ওঁর কথা আমি বাপীবাবুর কাছে শুনেছি, কিন্তু প্রসঙ্গটা বুঝতে পারছি না,” তারেক বলল।
“মামুদ সাহেবের কেসের ব্যাপারটা নিয়ে স্যার – ওঁর কাছে একটু সাহায্য চেয়েছিলাম। তা উনি ফোনে যে খবরটা দিলেন সেটা শুনে আমি মোটামুটি নিঃসন্দেহ যে মামুদ সাহেবের বাবার মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়।”
কথাটা শুনে শুধু তারেক নয় আমি আর প্রমথও অবাক! ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট ওঁকে এমন কি খবর দিতে পারেন যার থেকে এতদূরে বসে উনি এরকম একটা জোরদার কনক্লুশান করে ফেললেন।
“কি সর্বনাশ,” তারেক বলল, “তারমানে মামুদ যা আশঙ্কা করছিল সেটাইতো ঠিক! কিন্তু আপনি কি করে নিশ্চিত হলেন?”
“বলছি স্যার, সেইজন্যেই আপনাদের ডেকেছিলাম, কিন্তু মামুদ সাহেবকেতো পাওয়া গেল না।”
“ওর শিকাগো হোটেলের নম্বরটা আমার কাছে আছে।”
“কিন্তু ফোনে এটা না জানানোই ভালো স্যার।”
“তা ঠিক। তবে ফিরে এসে খবরটা যখন শুনবে – একেবারে ভেঙ্গে পড়বে। কিন্তু আপনি এ ব্যাপারে একেবারে নিঃসন্দেহ?”
“মোটামুটি নিঃসন্দেহ স্যার, পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হতে গেলে ঢাকা পুলিশের আরও অনেক কিছু করণীয় আছে।”
“খুনী কে?” তারেক প্রশ্ন করল।
“স্যার, মামুদ সাহেব জানতে চেয়েছিলেন, মৃত্যুটা অস্বাভাবিক কিনা – সেটার উত্তর পাওয়াটা স্যার কঠিন হলেও দারুণ শক্ত নয়। কিন্তু খুনী কে সেটা এখানে বসে জোর দিয়ে বলাটা স্যার ফ্র্যাঙ্কলি অসম্ভব।”
“একটু কম জোর দিয়েই না হয় বলুন,” প্রমথ বলল।
“স্যার আমার একটা থিওরি আছে – সেটাই ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে বলেছি ঢাকার পুলিশকে জানাতে।”
“সেই থিওরিটা কী বলবেন?” তারেক জিজ্ঞেস করল।
“থিওরিটা পিওর থিওরি স্যার – ঠিক নাও হতে পারে।”
“আঃ এতো ভনিতা না করে শুরু করুন না,” প্রমথ এবার অধৈর্য হয়ে উঠেছে।
“করছি স্যার, করছি। কিন্তু যা আমি বলছি, সেটা একটু সাফাই না গেয়ে বলাটা অনুচিত হবে।”
“সাফাইতো হল, এবার বলুন।”
একেনবাবু শুরু করলেন, “মামুদ সাহেবের বাবাকে খুন করা হয়েছিল ওঁর অরেঞ্জ জুসে পটাশিয়াম সায়ানাইড মিশিয়ে।”
“আপনি একেবারে বিষের নাম জেনে বসে আছেন!” প্রমথ অবিশ্বাসভরে কথাটা বলল।
“সেই তথ্যটাই আমাকে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট দিলেন স্যার।”
“কি যাতা বলছেন মশাই। জুসটাতো পুলিশ পরীক্ষা করেছিল, কিছুই পায় নি !”
“সেটা জানি স্যার।”
“তাহলে?”
“আঃ,” আমি প্রমথকে ধমক দিলাম, “তুই চুপ করবি? একেনবাবুকে বলতে দে।”
“এত সাসপেন্স না দিয়ে সোজাসুজি বললেইতো চুকে যায়।”
“বলছি স্যার, সোজাসুজিই বলছি। কিন্তু জিনিসটাতে এতো প্যাঁচ রয়েছে যে, গুছিয়ে বলাটা কঠিন।”
“ডিটেকটিভ, তুমি আস্তে আস্তে বলো আমরা শুনছি।” ফ্র্যান্সিস্কা এবার প্রমথকে চুপ করানোর ভার নিল।
“থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম। আমি আলো নেভার ব্যাপারটা দিয়েই শুরু করি। আমার বিশ্বাস, আলোটা ওভারলোড বা ডিফেক্টিভ ব্রেকারের জন্য নেভে নি। ওটা সার্কিট ব্রেকার অফ করেই নেভানো হয়েছিল যাতে খুনী মাসুদ সাহেবের অরেঞ্জ জুসের গেলাসটা সরিয়ে সেই জায়গায় পটাশিয়াম সায়ানাইড মেশানো বিষাক্ত একটা গ্লাস রেখার সুযোগ পান। তারপরে আলো জলে উঠলো। জামালসাহেব আর মামুদ সাহেবের পিশেমশাই যখন টোস্ট দিলেন তখন সেই বিষাক্ত জুসটা মাসুদ সাহেব খেলেন। এখন খুনীর চিন্তা ছিল যে জুস খেয়ে মৃত্যু হলে সেই জুসটা সম্ভবত: পরীক্ষা করা হবে। সুতরাং এই বিষাক্ত জুসটাকে সরাতে হবে। সেইজন্য আবার বাতি নেভাতে হল। দ্বিতীয়বার আলো নেভা মাত্র খুনী মাসুদ সাহেবের বিষাক্ত গ্লাসটা পাল্টে ওঁর পুরনো গ্লাসটা সামনে রেখে দেন।”
“দাঁড়ান, দাঁড়ান,” প্রমথ আর চুপ করে থাকতে পারল না। “আপনি একটা অবাস্তব কথা বলছেন! খুনী অরেঞ্জ জুসে বিষ মিশিয়েছিল, সেটা যদিও বা সম্ভব হয়। কিন্তু দৌড়ে গিয়ে আবার আলো নিভিয়ে এসে সেই গ্লাসটা সরিয়ে অন্য একটা গ্লাস মাসুদ সাহেবের সামনে রাখাটা ইম্পসিবল।”
“আমারও তাই বিশ্বাস স্যার।”
“তাহলে?”
“আপনি যে যুক্তি দিলেন, সেটা ভেবেই আমারও তাই মনে হয়েছে স্যার, খুনীর একজন সাহায্যকারী ছিল।”
“আপনি বলতে চান যে সাহায্যকারী এমন ভাবে দু’বার বাতি নিভিয়েছিল যাতে খুনী তার কাজগুলো করতে পারে আশেপাশের লোকদের সন্দেহ না জাগিয়ে – তাইতো?” এবার তারেক প্রশ্ন করল।
“দুবারই যে সাহায্যকারী বাতি নিভিয়েছিল, তা আমি বলছি না স্যার, কিন্তু টাইমিংটা খুবই ইম্পর্টেণ্ট। শুধু তাই নয় স্যার, যাঁরা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত তাঁরা মামুদ সাহেবদের বাড়িটা ভালো করে জানেন – তাঁদের বাড়ির ভেতরে দেখলে, বাড়ির কারো কোনও সন্দেহ হবে না।”
“তারমানে বাড়ির কাজের লোক এর মধ্যে জড়িত?” এবার আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“তাতো বলিনি স্যার। তবে সেটা নিশ্চয় একটা পসিবিলিটি, কিন্তু প্রবাবিলিটি নয়।”
“আচ্ছা, তোমরা ওঁকে বলতে দেবে?” ফ্র্যান্সিস্কা আমাদের সবাইকে একটু বকুনি দিল। তারপর একেনবাবুকে বলল, “এবার বল ডিটেকটিভ।”
“থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম, আমার নিজের বিশ্বাস খুনী প্রথমবার নিজেই একটা অরেঞ্জ জুসের গ্লাস নিয়ে সার্কিট ব্রেকারটা অফ করেছিলেন। সেই সময়েই তিনি সবার আড়ালে সেই জুসে বিষটা মেশান। মামুদ সাহেব যখন গেলেন কি হয়েছে দেখতে, তাতে যে সময়টুকু লাগলো, সেই সময়ের মধ্যে তিনি ফিরে এসে অন্ধকারে মাসুদ সাহেবের গেলাসটা সরিয়ে বিষের গেলাসটা সামনে রেখে দেন। তারপর মাসুদ সাহেব যখন সেটা খান, তার অল্পক্ষণের মধ্যেই আলো আবার নিভে যায়। এবার আলোটা নেভে ওঁর এক সাহায্যকারী ব্রেকারটি অফ করেন বলে। মামুদ সাহেব আবার ছোটেন সার্কিট ব্রেকার বক্সের দিকে। কিন্তু যাবার পথে মিস্টার খান আর সিঁড়ির ঘরে মালী রহিমকে ছাড়া কাউকে দেখতে পান না। আর আগেই বলেছি সেই সময়ে খুনী মাসুদ সাহেবের গেলাসটা আবার পাল্টে দেন। মামুদ সাহেবের বিষক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। তিনি যখন ঢলে পড়ে যাচ্ছেন, তখন খুনী চট করে সেই বিষাক্ত জুসটা পাশে একটা ফুলের টবে ফেলে দেন, যাতে কোনও মতেই সেটা ভুলে আর কেউ না খান, বা পুলিশের হাতে পরীক্ষার জন্য না যায়।”
“কিন্তু এটাই যে ঘটেছিল, সেটা আপনি বুঝলেন কি করে?” প্রমথ একটু বিরক্ত হয়েই বলল।
“কারণ স্যার খুনী অরেঞ্জ জুসটা হাইড্রেঞ্জিয়ার টবে ফেলেছিলেন।”
“সো হোয়াট?”
“ফলে হাইড্রেঞ্জিয়া ফুলের রঙটা পাল্টে গেল।”
“কি বলছেন মশাই যাতা!” এবার প্রমথ বলল।
“ঠিক কথাই বলছি যার। আপনি খেয়াল করেছেন কিনা জানি না, কিন্তু বাপীবাবু দেখেছেন, সমস্ত সাদা আর আবছা পিঙ্ক রঙের হাইড্রেঞ্জিয়া ফুলের মধ্য শুধু একটার রঙ শুধু নীল। আর সেই নীল রঙের হাইড্রেঞ্জিয়াটা স্যার পার্টির দিন ছিল না। আমি খুব ভালো করে পার্টির সময়ের ছবিগুলো দেখেছি, আপনারাও দেখেছেন। ছিল কি? আমি মামুদ সাহেবকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কোনো নতুন ফুলগাছ আনা হয়েছে কিনা। উত্তর স্যার, না। টবের মাটিগুলো আসে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল থেকে, যেখানে মাটিতে অ্যালুমিনিয়াম প্রচুর আছে। আমি জানি স্যার, আমার এই গাছপালার খ্যাপামি নিয়ে আপনারা হাসাহাসি করেন। কিন্তু জানেন স্যার, হাইড্রেনজিয়া গাছ যদি অ্যালুমিনিয়াম কম্পাউণ্ড শরীরে টেনে নিতে পারে, তাহলে তার ফুলের রঙ হয়ে যায় নীল। কিন্তু সেটা তখনই পারে যখন মাটি অম্লযুক্ত বা অ্যাসিডিক হয়। যেই মুহূর্তে অরেঞ্জ জুস টবের মধ্যে পড়ল, সেই টবের মাটি হয়ে গেল অ্যাসিডিক, আর হাইড্রেঞ্জিয়াও তার রঙ পাল্টালো – হয়ে গেল নীল। সমস্ত পিঙ্ক হাইড্রেঞ্জিয়ার মধ্যে হঠাৎ স্যার ঐ নীল রঙ দেখে আমি ভাবছিলাম, কেন একটা টবের মাটি অ্যাসিডিক। টবগুলো সব টেনিস কোর্টের পাশে, সুতরাং সেখানে জুসটা ফেলার সম্ভাবনা প্রচুর।”
“কিন্তু অন্য কেউওতো তাঁদের জুস কোনও কারণে টবে ফেলতে পারে?” প্রমথ প্রশ্ন তুলল।
“তা পারে স্যার, সেইটে জানতেই আমি ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের সাহায্য নিয়েছিলাম। তিনি বাংলাদেশের কনসুলেট জেনারেলের বলে বাংলাদেশের পুলিশকে দিয়ে নীল রঙের হাইড্রেঞ্জিয়ার টবটা পরীক্ষা করতে বলেন।
সেইখানে পটাশিয়াম সায়ানাইড ট্রেস পাওয়া গেছে। সেটাই হল ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের খবর।”
“মাই গড্ !” আমি বললাম।
“কিন্তু কে এই কাজটা করলেন?” তারেক প্রশ্ন করল।
“এবারতো আমার থিওরির কথা এসে গেল স্যার।”
“পসিবিলিটিতো তিনজন, আমি বললাম, মামুদের জামালচাচা, মিস্টার খান আর কবীর – আজিজুল সাহেবকে আমি বাদ দিচ্ছি।”
“চমৎকার স্যার। আর সহকারী কে?”
“গোয়েন্দাতো আপনি মশাই।” প্রমথ বলল।
“আমার ধারণা স্যার খুনী হলেন, মামুদসাহেবের জামালচাচা। তিনিই প্রথমে গিয়ে সার্কিট ব্রেকার অফ করেছিলেন। মামুদসাহেব যখন বাড়িতে ঢোকেন, তখন বাথরুমের সামনে জামালচাচার সঙ্গে ওঁর দেখাও হয়। মামুদ সাহেব সার্কিট ব্রেকার যেদিকে আছে সেদিকে হাঁটা দিতেই জামালচাচা বিষাক্ত জুসটা হাতে নিয়ে পার্টির দিকে চলে আসেন। সেখানে এসে গ্লাসটা মাসুদ সাহেবের সামনে রেখে আলো জলতেই মাসুদসাহেবকে একটা টোস্ট দেন। টাইমিংটা এমন ভাবে করা হয় যে, টোস্টের পরপরই আবার আলো নিভে যাবে। জামালচাচার সাহায্যকারীর দৌলতে স্যার, সেটা যায়ও। সেই সুযোগে জামালচাচা বিষাক্ত গেলাসটা সরিয়ে মাসুদ সাহেবের প্রথম গেলাসটা ওঁর সামনে রেখে দেন।”
“সাহায্যকারীটি কে?” তারেক জিজ্ঞেস করল।
“মিস্টার খান,” প্রমথ বলল।
“না স্যার। দ্বিতীয়বার আলো নেভার আগে মিস্টার খান বাড়িতে ঢুকেছিলেন ঠিকই এবং খুব দ্রুত হেঁটে বেরিয়ে আসছিলেন। কিন্তু তিনি যত দ্রুতই হাঁটুন, এমনকি তিনি দৌড়লেও সার্কিট ব্রেকার অফ করে বাড়ির বাইরে এসে মামুদ সাহেবের মুখোমুখি হওয়া সম্ভব ছিল না স্যার। তিনি সার্কিট ব্রেকারটা অফ করেন নি। যিনি সার্কিট করেছিলেন, তিনি সাইডের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পার্টিতে চলে আসেন।”
“তাতো বুঝলাম কিন্তু লোকটি কে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“আপনাদের মনে আছে কিনা জানি না স্যার, জামলচাচা মামুদসাহেবকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ওঁর আম্মা কোথায়? সেটা কিন্তু একটা সাধারণ প্রশ্ন নয়, জামালচাচা সিওর হতে চাচ্ছিলেন যে, ওঁর অ্যাসিস্টেণ্ট ঠিকমত জায়গায় রয়েছেন কিনা। যেই মুহূর্তে তিনি জানলেন যে, আম্মা বাড়িতে এসে গেছেন উনি দ্রুত পার্টির দিকে গেলেন। আসলে পুরো ব্যাপারটাই ভালো ভাবে প্ল্যান করা ছিল।”
প্রমথ বলল, “অফ অল দ্য পিপ্‌ল আম্মা? হোয়াই?”
আমিও বললাম, “যাই বলুন আপনি, আমার কাছে কিন্তু ব্যাপারটা ক্লিয়ার হচ্ছে না। কোথাও একটা ফাঁক আছে। খুনের মোটিভতা কি? সুখ বা অর্থ কোনোটাই নয়। মামুদের কাছেই শুনেছি যে ওর বাবার মৃত্যু জামলচাচাকে বিধ্বস্ত করেছে – আর্থিক ও মানসিক দুভাবেই। আম্মারও আর্থিক দিক থেকে বিরাট লাভের কোনও সম্ভাবনা দেখছি না।”
“ইউ আর রাইট স্যার। এটা আমাকেও বদার করেছে স্যার, বদারড্ মি এ লট। তারপর আমার মনে হল, এর একটা ব্যাখ্যা আছে স্যার। সেইটেই এখন ঢাকার পুলিশকে অনুসন্ধান করে দেখতে দেখতে হবে – ঠিক কিনা।”
“ব্যাখ্যাটা বলুন।”
“প্রথমত: স্যার হত্যাকাণ্ডটা, অর্থের জন্য নয় স্যার, আমার ধারণা প্রেমের জন্য।”
“হোয়াট ?”
“হ্যাঁ স্যার, আমার মনে হয় মামুদ সাহেবের আম্মা আর জামলচাচার মধ্যে প্রেম ছিল। মামুদসাহেবের আম্মা মাসুদ সাহেবের কাছে তালাক চেয়েছিলেন। কিন্তু মাসুদ সাহেব দিতে রাজি হন নি। ইসলামিক আইনে স্যার স্বামীর তালাক দেবার অধিকার আছে, কিন্তু স্ত্রীর অত সহজে স্বামীর কাছ থেকে ডিভোর্স পাওয়াটা সহজ নয়। মাসুদসাহেব নিশ্চয় সন্দেহ করতে শুরু করেছিলেন যে, জামালসাহেবের সঙ্গে স্ত্রীর প্রেম আছে, ফলে মানসিক ভাবে কষ্টও পাচ্ছিলেন। জামলসাহেব আর আম্মা যখন বুঝলেন কোনওমতেই মাসুদ সাহেব আম্মাকে ছাড়তে রাজি হবেন না, তখন এই মার্ডারের প্ল্যানটা করেন। কাম একটা আদিম রিপু স্যার, মানুষ অনেক রকম অদ্ভুত কাজ এর তাড়নায় করে ফেলতে পারে স্যার।”
“এটা নিশ্চয় একটা ব্যাখ্যা – যদিও ধোপে নাও টিঁকতে পারে, আমি বললাম, কিন্তু এরজন্য জামালচাচার মানসিক অশান্তি বা অর্থকষ্টের ব্যাখ্যাটাতো পেলাম না।”
“ইয়েস স্যার। এইবার বলি, কেন সেটা হয়েছে বলে আমার সন্দেহ। এইটে যদি পারফেক্ট ক্রাইম হত, তাহলে কোনও সমস্যাই ছিল না। কিন্তু একজন যিনি মাসুদ সাহেবের টেবিলে বসে ছিলেন, তিনি জামালচাচচার এই গেলাস সরানোটা অন্ধকারেও দেখে ফেলেন এবং যেই মুহূর্তে মাসুদ সাহেব মুখ বিকৃত করেছেন, সেই মুহূর্তে তিনি অনুমান করতে পারেন – একটু পরে কি ঘটবে। অর্থাৎ আবার আলো নিভবে। তখন তিনি দ্রুত ছোটেন বাড়ির দিকে। হলঘরে ঢুকে তিনি দেখতে পান আম্মা ঢুকছেন সার্কিট ব্রেকার যে ঘরে আছে সেখানে। তিনি দ্রুত ফিরে আসেন পার্টিতে। তখন আলো আবার নিভে গেছে। কিন্তু এই ভদ্রলোক অতি ধুরন্ধর। তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারেন দ্বিতীয় আলো নেভার সময়ে কি ঘটেছে। এরপর ওঁর ব্ল্যাকমেল করা শুরু হয় জামালচচাচাকে। এঁর অর্থের প্রয়োজন মেটাতে জামালচাচা তাঁর সর্বস্ব খোয়ান। এবার আর ফ্যাক্টরি ওয়ার্কারদের সমস্যা নয়, এটা হল মার্ডার চার্জ। সুতরাং মিস্টার খান এর জন্য কয়েক কোটি টাকাই দাবি অবশ্যই করতে পারেন।”
আমরা সবাই চুপ।
একেনবাবু বললেন, “ঢাকা পুলিশ এখন জামালচাচার সমস্ত কাগজপত্র সিল করে দেখছে কোথায় ওঁর টাকা গেছে, আর খান সাহেবের টাকাকড়ির হিসেব নিকেশ করছে। দুটো মিলে গেলেই আমার মনে হয় এই হত্যাকাণ্ডের সুরাহা হবে।”
ফ্র্যান্সিস্কা হাততালি দিয়ে বলল, “ডিটেকটিভ ইউ আর ব্রিলিয়াণ্ট!”

(গল্পের নামকরণ দেখে পাঠকরা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে, একেনবাবুর থিওরিতে কোনও ভুল ছিল না। শেষ খবর: ঢাকার পুলিশ আম্মা, জামালচাচা আর মিস্টার খান তিনজনেকেই গ্রেফতার করেছে।)