ঢাকা রহস্য উন্মোচিত – পরিচ্ছেদ ৪

চার

এরমধ্যে একদিন বাড়ি ফিরে দেখি একেনবাবু কম্পিউটারের মনিটরে তন্ময় হয়ে মামুদের বাড়ি দেখছেন।
“কি দেখছেন এতো বিভোর হয়ে?”
“ফুলগুলো স্যার। হাইড্রেঞ্জিয়া ফুলগুলো দেখতে অপূর্ব।”
“তাতো বুঝলাম, কিন্তু শুধু সেগুলো দেখছেন বলেতো মনে হচ্ছে না।”
“কিযে বলেন স্যার, ফুলগুলোই দেখছি। দেখুন স্যার, কিরকম পিঙ্ক রঙের হাইড্রেঞ্জিয়ার মাঝখানে হঠাৎ চমৎকার একটা নীল রঙের হাইড্রেঞ্জিয়া।”
“দেখলাম, কিন্তু তাতে অবাক হবার কি কিছু আছে ? হাইড্রেঞ্জিয়া কি নীল রঙের হয় না?”
“হয় স্যার, নিশ্চয় হয়।”
“তাহলে?”
“আসলে আগে এটাকে এখানে দেখি নি।”
“হয়তো টবটা অন্য জায়গায় ছিল। তাছাড়া একই গাছে তো নানান রঙের ফুলও হতে পারে। মেণ্ডেলের সূত্র জানেন না – কি ছাই এতো গাছের বই পড়েন!”
“এটা মন্দ বলেন নি স্যার। চা খাবেন?”
“আপনি বানাবেন?” আমি মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলাম।
“বানাতে পারি স্যার, কিন্তু আপনি অনেক ভালো বানান।”
“তাহলে আর চা খাবেন কিনা জিজ্ঞেস করলেন কেন, বললেই পারতেন একটু চা করে খাওয়াবেন কিনা?”
“আপনিও স্যার প্রমথবাবুর মতো হয়ে যাচ্ছেন,” একেনবাবু অনুযোগের ভঙ্গীতে বললেন।
“ঠিক আছে বুঝেছি, আসুন,” বলে আমি কিচেনে গেলাম। স্টোভে জল চাপিয়ে আমি খুঁজতে শুরু করলাম চা-পাতা কিছু অবশিষ্ট আছে কিনা। পাওয়া গেল না। আমি টি-ব্যাগ একেবারেই পছন্দ করি না। তার থেকে ইনস্ট্যান্ট কফি ভালো।
“কফি চলুক, কি বলেন?”
“বেশতো স্যার, আমেরিকায় কফিই ভালো।”
জল গরম হতে কয়েক মিনিট, কফিও সঙ্গে সঙ্গেই হয়ে গেল। কফি নিয়ে বাইরের ঘরে বসতেই একেনবাবু বললেন, “আচ্ছা স্যার, শরিয়ত আইন সম্পর্কে আপনি কি জানেন?”
“সেটা আবার কি, ইসলামিক আইন?”
“হ্যাঁ।”
“শূন্য। কেন?”
“না স্যার, ওদের উত্তরাধিকার আইনটা বেশ গোলমেলে। আমি অনেকদিন আগে একটু দেখেছিলাম, তারপর মাথা এতো ঝিমঝিম করতে শুরু করল যে, হাল ছেড়ে দিলাম।”
“শরিয়ত আইন নিয়ে হঠাৎ মাথা ব্যথা কেন।”
“একটা অঙ্ক মিলছে না স্যার, তাই ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছি।”
মানিকজোড়দের জিজ্ঞেস করুন, ওরা নিশ্চয় জানবে। তারেক আর মামুদকে প্রমথ ইদানীং মানিকজোড় বলতে শুরু করেছে – ব্যাড ইনফ্লুয়েন্স, আমিও হঠাৎ হঠাৎ বলে ফেলি।
“কারা, তারেকসাহেব আর মামুদসাহেবের কথা বলছেন?”
“রাইট।”
“নাও জানতে পারেন স্যার, হিসেবটা বেশ গোলমেলে।”
“ভালোকথা ওদের খবর কি, কদিন ধরে বেপাত্তা !”
“কি একটা কাজে বাইরে গেছেন স্যার। আমিও খোঁজ করছিলাম।”
“আপনি কেন খোঁজ করছিলেন, প্রব্লেম সল্‌ভ হয়ে গেল নাকি?”
“কিযে বলেন স্যার। প্রব্লেম আছে কিনা তাই জানা নেই।”
“তাহলে কি জানতে চাইছিলেন?”
“হঠাৎ মনে হল স্যার বাইরের গাছ পরিবেশ পাল্টালে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন। আবহাওয়ার কথা ছেড়ে দিন, মাটি আলাদা, অন্যরকম পোকামাকড় – যেগুলোর বিরুদ্ধে কোনও প্রতিরোধ ক্ষমতাই গাছগুলোর নেই – এইসবের বিরুদ্ধে লড়াই করে গাছগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে – সোজা ব্যাপার নয়।”
“আপনি কি মামুদের বাড়ির হাইড্রেঞ্জিয়া, লাইলাক – ঐসব গাছগুলোর কথা ভাবছেন?”
“হ্যাঁ স্যার।”
“দেখুন আপনি এখন গাছ-বিশারদ হয়ে গেছেন, আপনাকে কিছু বলতে সাহস হয় না। তবে যদি পঞ্চাশ বছর ধরে গাছগুলো বাংলাদেশেই জন্মায় আর মরে থাকে, তাহলে প্রতিরোধশক্তিটা বোধহয় এতদিনে গড়ে উঠেছে।”
“এটা ভালো বলেছেন স্যার। সমস্যাটা প্রথম দিকেই হয়েছিল।”
“নিশ্চয় হয়েছিল, কিন্তু তার উত্তর মামুদ দিতে পারবে না। ওর ঠাকুরদা হয়তো পারতেন।”
“গুড পয়েন্ট স্যার,” একেনবাবু অন্যমনস্ক ভাবে বললেন। তবে আমার বক্তব্য উনি কতটা কানে দিলেন সেটা অবশ্য বুঝলাম না।

কোথাও নিশ্চয় একটা টেলিপ্যাথি কাজ করছিল। দরজায় বেল শুনে দেখি মামুদ আর তারেক।
“তোমাদের কথা হচ্ছিল,” আমি বললাম। “একেনবাবু ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন, তোমাদের এইসব বিদেশি গাছের মাটি, সার, ইনসেক্টিসাইড – এইসব সম্পর্কে।”
আমার কথাটা ধরতে না পেরে মামুদ একটু কনফিউসড মুখে তাকালো।
ব্যাপারটা ওকে বিশদ করে বলতেই বলল, “মাটির ব্যাপারটা জানি, কিন্তু সার আর ইনসেক্টিসাইড সম্পর্কে কিছুই জানি না।”
“মাটির ব্যাপার মানে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“প্রতি বছর বাবা বাংলাদেশের উত্তরের কোন একটা জায়গা থেকে মাটি আনাতেন। কেন, সে প্রশ্ন করবেন না। বাবা বিশ্বাস করতেন ঐ মাটি না পেলে গাছ বাঁচবে না। আমার ধারণা ওঁর আব্বা সেখান থেকে প্রথমে মাটি এনেছিলেন, তাই বাবা আর চান্স নেন নি।”
“তুমি না জানলে, সে মাটি এখন আসবে কোত্থেকে?”
“ধরে নিচ্ছি জামালচাচা জানেন। নইলে সমস্যা। তারওপর আমিতো এখানে।”
“এই যে একেনবাবু,” আমি ঠাট্টার সুরে বললাম, “কি ধরণের মাটি দরকার? অনেক বইপত্রতো লাইব্রেরি থেকে এনেছেন, ছেলেটাকে একটু হেল্প করুন।”
“আপনি স্যার সত্যিই প্রমথবাবুর মতো হয়ে যাচ্ছেন।” একেনবাবু অনুযোগ করলেন।
“সেটা কি কমপ্লিমেন্ট?”
“রান্নার ব্যাপারে নিশ্চয় স্যার। দুর্দান্ত কফি বানিয়েছেন আজ।”
“আরেক কাপ চান নাকি?”
“চাই স্যার, কিন্তু বলতে বাধো বাধো ঠেকছে।”
“আমি ওদের জন্য বানাচ্ছি। সুতরাং আরেক কাপ বানাতে অসুবিধা নেই।”
“বাঁচালেন স্যার। আসলে আজ মাথাটা বড্ড ধরেছে।”

আরেক প্রস্থ কফি বানানো হল। আমার চেয়ে তারেকই বেশি খাটলো। কাপডিশ ধুয়ে জল গরম করে; আমি শুধু আধ চামচ ইনস্ট্যাণ্ট কফির গুঁড়ো ঢেলে চামচ দিয়ে নাড়লাম।
কফি খেতে খেতে একেনবাবু হঠাৎ মামুদকে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা স্যার, আপনার আম্মাকে দেখে খুব বেশি বয়স কিন্তু মনে হল না।”
“খুব বেশি বয়স ওঁর হয় নি।”
একেনবাবু বোধহয় দ্বিতীয় প্রশ্নটা করবে কিনা ভবছিলেন। তার আগেই মামুদ বলল, “উনি আমার নিজের মা নন।”
“আপনার নিজের মা স্যার ?”
“তিনি অনেকদিন হল মারা গেছেন।”
একেনবাবু চোখে তখনও প্রশ্ন দেখে মামুদ বলল, “আমার এই আম্মাকে বাবা বিয়ে করেন বছর দশেক আগে।”
এটুকু বলার পর মামুদের স্বাভাবিক সংযম ভেঙ্গে গেল। অনেকগুলো কথা প্রায় অনাবশ্যক ভাবেই বলে ফেলল। “আমার সঙ্গে আমার আম্মার সম্পর্ক ভালো নয়। উনি আমার থেকে বছর কয়েকের মাত্র বড়। খুব গরীব ঘর থেকে এসেছেন। কেন এবং কীভাবে বাবার সঙ্গে ওঁর পরিচয় বা শাদী হল আমি বলতে পারবো না। আমি বোর্ডিং স্কুলে পড়তাম এসে দেখি উনি বাড়িতে এসে গেছেন। কিন্তু ওঁর সঙ্গে কোনোদিনই আমার বনে নি – দরকার মতো কথাবার্তা হত, এইটুকুই। বাইপাস হবার আগে যখন বাবার প্রাণ প্রায় যায় যায় হয়েছিল, তখন প্রথম আম্মা আমার সঙ্গে অত্যন্ত সুব্যবহার শুরু করেন। আসলে ওঁর বোধহয় ভয় হয়েছিল বাবার মৃত্যুর পর আমি যদি ওঁকে না দেখি। সে ব্যাপারে ওঁর কোনও চিন্তা নেই এটা আমি ওঁকে নিশ্চিত করেছিলাম। তাছাড়া জামালচাচাও তখন এগিয়ে এসে ওঁকে সাহস দিয়েছিলেন যে ওঁর কোনও অর্থকষ্ট বাবা হতে দেবেন না বলে।”
“কেন স্যার, আপনাদের শরিয়ত আইনে বিধবা স্ত্রীরা কিছু পান না?”
“কিছু পান। ধারদেনা সব বাদ দিয়ে যা থাকে তার ১/৮ অংশ উনি পেতেন, আমি বাকি অংশ। তবে বাবার ধারদেনা কি ছিল, সেটা আমরা জানতাম না। আর উনি যেরকম আরামের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হযেছিলেন, সেই ঠাট ওঁর পক্ষে বজায় রাখা সম্ভব ছিল না।”
“আপনার বাবার সঙ্গে ওঁর সম্পর্ক কিরকম ছিল?”
এর উত্তর সোজাসুজি মামুদ দিল না। শুধু বলল, “আম্মা কমবয়সী এবং সুন্দরী – বাবা পছন্দ করেই শাদী করেছিলেন।”
“আপনার আম্মার কোনও ছেলেপুলে হয় নি স্যার ?”
“একটি হয়েছিল, শাদীর কয়েক বছর পরে। কিন্তু বাচ্চাটা জন্মানোর সময়ে মারা যায়।”
“আপনি বলেছিলেন স্যার, আপনার বাবা মারা যাবার কিছুদিন আগে থেকে আপনার আম্মা আর বাবার মধ্যে একটা দূরত্ব লক্ষ করেছিলেন। তারমানে স্যার তার আগে নিশ্চয় ওঁদের সম্পর্কটা ভালো ছিল। আমি কি ভুল বলছিস স্যার ?”
মামুদ এবার লজ্জিত হল। “আপনি ভুল বলেন নি। আসলে আম্মাকে পছন্দ করি না বলেই ওর সম্পর্কে কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে আমার অসুবিধা হয়।”
“আই সি স্যার। আচ্ছা, আপনাদের সমাজে দেনমোহরের একটা ব্যাপার আছে না?”
“বুঝেছি, আপনি কি জানতে চাচ্ছেন। না, আমার মনে হয় না, বাবা ওঁকে বিয়ে করার সময়ে বিরাট কোনও দেনমোহরে রাজি হয়েছিলেন বলে। আমি জোর করে কিছু বলতে পারবো না। কিন্তু বাবার অসুখের সময়ে আম্মা সেই নিয়ে আমাকে ওঁর চিন্তার কথাটা বলেছিলেন।”
“দেনমোহর ব্যাপারটা কি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“ওটা খানিকটা আপনাদের স্ত্রীধনের মতো। মুসলমান স্বামীরা দেনমোহরের টাকাটা মৃত্যুর আগে স্ত্রীকে দিয়ে যেতে বাধ্য। অর্থাৎ কেউ মারা গেলে তাঁর সম্পত্তি থেকে দেনমোহরের টাকাটা প্রথমেই বিধবা স্ত্রীর কাছে চলে যায়, তারপর অন্যান্য ঋণ কর্জ ইত্যাদি মিটিয়ে যা বাকি থাকে সেটাই ওয়ারিশদের মধ্যে ভাগ করা হয়।”
“আপনার বাবার কোনও লাইফ ইন্সিওরেন্স ছিল?”
“না।”
“আপনি শিওর ?”
“হ্যাঁ, কারণ আনোয়ারচাচা বাবকে বেশ কয়েকবার বলেছিলেন লাইফ ইন্সিওরেন্সের কথা, বাবা আমল দেন নি। বলতেন, ঘরবাড়ি সম্পত্তি উনি যা রেখে যাচ্ছেন, সেটাই ওঁর সবচেয়ে বড় ইন্সিওরেন্স।”
“ভেরি ইন্টারেস্টিং,” একেনবাবু বললেন।
“কি ইণ্টারেস্টিং?”
“ঐ যা: স্যার, সাতটা বেজে গেছে, আজ আবার ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের সঙ্গে একটা অ্যাপয়েণ্টমেণ্ট আছে।” এই বলে তড়িঘড়ি জুটোটুতো পরে ‘চললাম স্যার’ বলে অদৃশ্য হলেন।
মামুদ আর তারেকের হতম্ভম্ব ভাবে বসে আছে দেখে আমি বললাম, “টিপিক্যাল একেনবাবু. মাথায় কি ঘুরছে, কারোর বোঝার সাধ্যি নেই।”