সতের
বাসু জিজ্ঞেস করলেন, শেষ পর্যন্ত নিমন্ত্রিত কতজন হলো? তের নয় তো?
রানু লিস্টের নামগুলি পড়ে গেলেন, ব্রজদুলাল, ইন্দ্রকুমার, অশোক, ক্যাপ্টেন আর মিসেস ছায়া পালিত, গুণবতী আর সুভদ্রা, অনুরাধা, জয়ন্ত, ওদিকে চিনসুরার অ্যাগি ডুরান্ট, ডঃ দাশ, সস্ত্রীক ডি আই জি এবং সস্ত্রীক যুগলকিশোর; এছাড়া বিশুকে ধরে বাড়ির পাঁচজন—একুনে কুড়িজন।
—ওই সঙ্গে আর দুটো নাম যোগ হবে, প্রথমত যে-ছোকরা ঘোষালের মৃত্যুর পর তদন্ত করতে যায় : ইন্সপেক্টর চন্দন নন্দী। দ্বিতীয়ত অপর্ণা। ওর বাচ্চার জন্য একটা প্যাকেটও ওকে ধরিয়ে দিতে হবে। সর্বসমেত তাহলে বাইশ জন। রানু আর সুজাতা টেলিফোনে সবাইকে নিমন্ত্রণ করবে। শনিবার, আঠারই নভেম্বর, সন্ধে ছ’টায়। শুধু পাঁচজনকে নিমন্ত্রণ করার দায়িত্ব আমার—চিনসুরার ডি আই জি আর যুগলকিশোরকে সস্ত্রীক, আর ওই ইন্সপেক্টর ছোকরাকে, চন্দন নন্দীকে।
সুজাতা বলে, কিন্তু লোকে যখন জানতে চাইবে উপলক্ষটা কী, তখন কী বলব?
বাসু বলেন, এই মওকায় যদি কিছু প্রেজেন্টেশন পাওয়ার বাসনা থাকে তাহলে বল, তোমার জন্মদিন, অথবা তোমাদের বিবাহ-বার্ষিকী। না হলে বল, মামুর পাগলামি।
কৌশিক বলে, ব্রজদুলাবাবুকে কী বলব?
বাসু বলেন, নাঃ, ব্রজদুলাল আমার ক্লায়েন্ট। ওকে যা বলার তা আমাকেই বলতে হবে। ধর তো ফোনে।
রানু ফোনে ব্রজদুলালকে ধরলেন। শনিবার নিমন্ত্রণও করলেন। ব্রজদুলাল আকাশ থেকে পড়েন, ওফ! আপনাদের ব্যাপার-স্যাপার কিছুই বোঝা যায় না। আঠারই আমার ড্রেস- রিহার্সাল ছিল, সেটাকে কাঁচিয়ে দিয়ে…
কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে রানু বলেন, উনি আমার পাশেই বসে আছেন, সে কৈফিয়ৎ ওঁর কাছেই শুনুন—
বাসু টেলিফোনের জঙ্গমযন্ত্রটি গ্রহণ করে, তার কথামুখে বললেন, সরি ব্রজবাবু। আপনার ড্রেস-রিহার্সালটা সাতদিন পেছিয়ে দিতে হবে। আর ভালো কথা, আমার অনুমতি ছাড়া নতুন নাটকের কোনও বিজ্ঞাপন কোথাও ছাপতে পাঠাবেন না, টিকিট বিক্রি শুরু করবেন না, বুঝেছেন?
—কেন বলুন তো? ওফ্! আপনি কি আমাকে দ’য়ে মজাতে চান?
বাসু বলেন, শুনুন মশাই! আমি আপনার আইনত পরামর্শদাতা। আমি যা পরামর্শ দেব, আপনাকে সেই মতো চলতে হবে। কেন, কী বৃত্তান্ত সে পরে বলব। শনিবার ঠিক ছটার মধ্যে আমার বাড়িতে চলে আসবেন। আপনারা তিনজনই—অর্থাৎ ইন্দ্রকুমার এবং অশোককে নিয়ে। ওদের আমি অবশ্য পৃথকভাবে নিমন্ত্রণের ব্যবস্থা করেছি। ককটেল-ডিনার পার্টি!
অন্যান্য সকলেও নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। শুধু গুণবতী একটু আপত্তি করেছিলেন, তাঁর নাকি শুক্রবারের ফ্লাইটে ভুবনেশ্বরে ফিরে যাবার টিকিট কাটা আছে।
বাসু বললেন, সেটা ক্যানসেল করলেই ভালো করতে। শুনেছ বোধহয় : অ্যাবে শবরিয়ার শবদেহ ব্যবচ্ছেদের রিপোর্টটা পাওয়া গেছে?
—হ্যাঁ, শুনেছি। তার সঙ্গে আপনার এই পার্টির কী সম্পর্ক?
—ঠিক যতটা নিকট সম্পর্ক তোমার সম্পত্তির সঙ্গে। অবশ্য জরুরি কাজ থাকলে আমি আটকাবো না।
গুণবতী এককথায় রাজি হয়ে গেলেন, ফ্লাইটটা ক্যানসেল করে পরের সোমবারের নতুন টিকিট কাটার ব্যবস্থা করবেন তিনি।
ছায়া পালিতও কৌতূহলী হয়েছিল, কী ব্যপার বলুন তো মাসিমা? হঠাৎ” মেসোমশাই পার্টি দিচ্ছেন যে?
রানু বললেন, পাঁচ বাড়ি নেমন্তন্ন খেয়ে এসে একদিন তো পাঁচজনকে নেমন্তন্ন করে খাওয়াতে হয়?
ছায়া মানতে রাজি নয়। বলে, না মাসিমা, আপনি কিছু একটা কথা গোপন করে যাচ্ছেন।
রানু হেসে বললেন, তা যাচ্ছি!
—বাঃ! সেক্ষেত্রে আমাকে বলুন ভিতরের ব্যাপারটা আসলে কী?
—তোমার মেসোমশাই সেটা গোপন রাখতে চান। তবে আমাকে বলে রেখেছেন—শুধু ছায়াকে আসল কথাটা জানাতে পার : ওঁর আস্তিনের ভিতর একটা “মজারু’ লুকিয়ে রাখা আছে। উনি সেটা ওই নৈশাহারের টেবিলে বার করে দেখাবেন। ঘোষালের অসমাপ্ত খেলাটা। ছায়া বললে, আমিও সেটাই আন্দাজ করেছি। সেক্ষেত্রে আমি ক্যামেরা আবার লোড করি, কী বলেন?
রানু বলেন, কোনো উৎসব-রজনীর স্মৃতি ক্যামেরায় বন্দি করার বিরুদ্ধে ইন্ডিয়ান পিনাল কোডে যখন কোনো আপত্তিকর…
কথাটা তাঁর শেষ হয় না। ছায়া খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।
.
কৌশিক বিজলী গ্রিলকে অর্ডার দিয়ে এসেছে। ক্যাটারিং এজেন্টের পক্ষে এত অল্পসংখ্যক ভোজনার্থীর ক্ষেত্রে ঠিক পড়তা পোষায় না। তবে যেহেতু এটা লগনশার বাজার নয় এবং তদুপরি নিমন্ত্রণকর্তা একজন বিখ্যাত লোক তাই বিজলী গ্রিল রাজি হয়ে গিয়েছিল।
ড্রিংস-এর আয়োজন বাসুসাহেব সরাসরি করেছেন আবদুল মিঞার সঙ্গে যোগাযোগ করে। বিশ-ত্রিশ বছর আগে বার-লাইব্রেরিতে ‘তরল-নৈশাহারের’ আয়োজন হলে আবদুলের মাধ্যমেই পানীয় সংগ্রহ করা হতো।
সন্ধে থেকেই লোক সমাগম শুরু হয়েছে। ব্যবস্থাপনা একই রকম। বাগানের মধ্যে একদিকে বড় একটি টেবিলে বিজলী গ্রিলের সেবকেরা খাদ্যাদি সাজিয়ে ঢাকা দিয়ে রেখেছে। চার-পাঁচটি স্পিরিট ল্যাম্পও সাজানো আছে। অপর দিকে আর একটি টেবিলে আবদুলের সরবরাহ করা অমৃত! যেসব বোতল খোলা হবে না তা ও ফেরত নিয়ে যায়।
কিছু দূরে দূরে দু-চারজন করে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। ব্রজদুলাল একটি প্রকাণ্ড বড় ফুলের বোকে নিয়ে এসেছেন। তুলে দিলেন রানুর হাতে। সুজাতা সেটি সাজিয়ে রাখলো। ছায়া ঘুরছে-ফিরছে আর তার হাতে ফ্ল্যাশ বা ঝিলিক দিয়ে উঠছে। জয়ন্ত এগিয়ে এসে বলল, ক্যামেরাটা আমাকে দিন, না হলে কোনও ফটোতেই আমরা ছায়াদিকে দেখতে পাব না। এবার বরং আমি তুলি।
সুভদ্রা সুজাতাকে জনান্তিকে পাকড়াও করে বলল, একটা সুখবর আছে, সুজাতাদি। আপনাকে গোপনে জানাচ্ছি—নটরঙ্গের পরের নাটকে আমি হিরোইনের রোল করছি!
সুজাতা বলে, সেটা শুনেছি। আমরা কিন্তু তার চেয়েও বড় জাতের একটা সুখবরের প্রত্যাশায় আছি। সে অ্যানাউন্সমেন্টটা কবে হচ্ছে?
সুভদ্রা লজ্জা পেল, বলল, কথা ছিল ড্রেস-রিহার্সালের পরেই রেজিস্ট্রেশনটা হবে। মাকে না জানিয়ে। তারপর মাকে বলব। ফর্মাল বিবাহ-উৎসব কীভাবে হবে তা এখনো স্থির হয়নি। মা রাজি হলে একরকম, না রাজি হলে অন্যরকম।
সুজাতা সুযোগ বুঝে বলে, তুমি একটু এদিকে এসো তো সুভদ্রা, তোমার সঙ্গে কিছু গোপন কথা আছে।
সুভদ্রা একটু অবাক হলো; কিন্তু কথা শুনলো। সুজাতার পিছু পিছু সে বাগান ছেড়ে ওদের ফ্ল্যাটের দিকে চলতে থাকে। ইন্দ্রকুমার এগিয়ে এসে বলে, কী ব্যাপার? ‘প্রাইভেট টক্’ মনে হচ্ছে?
সুভদ্রা জবাব দেবার আগেই সুজাতা চটজলদি বলে, না, ওকে টয়লেটে নিয়ে যাচ্ছি। আমরা এখনি ফিরে আসব।
নিজের ঘরে ওকে নিয়ে এসে সুভদ্রা বলে, তুমি সব দিক ভালো করে ভেবেচিন্তে দেখেছ তো সুভদ্রা? তোমাদের দুজনের বয়সের পার্থক্যটা…
সুভদ্রা হাসতে হাসতে বলে, আমিও কিছু কচি খুকি নই সুজাতাদি। তাছাড়া হিন্দু কোড বিলের রক্ষাকবচ তো আছেই। সিনেমা-থিয়েটারের জগতে স্বামী-স্ত্রীর সাতপাকে বাঁধা সম্পর্কটা তো এখন পদ্মপত্রে পানি। না পোষালে কেটে পড়ব। ততদিনে আমি নিজেই অভিনয়-জগতে নাম করে ফেলব। ইন্দ্রকুমার তো মগডালে ওঠার একটা মই মাত্র।
সুজাতা রীতিমতো অবাক হলো। এভাবে যে নিজের জীবন নিয়ে কেউ ভাবতে পারে এটা ওর ধারণাই ছিল না। বললে, কিন্তু তোমাদের শিক্ষাদীক্ষায় যে আকাশ-পাতাল প্রভেদ। তুমি গ্র্যাজুয়েট আর শুনেছি, ইন্দ্রবাবু ম্যাট্রিকও পাস করেননি।
—না, ও ম্যাট্রিক পাস। আমাকে বলেছে।
—তুমি ওর ম্যাট্রিক সার্টিফিকেট দেখেছ?
সুভদ্রা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। বলে, আপনি কি ভাবছেন আমি ওকে চাকরি দিচ্ছি?
-–না, তা দিচ্ছ না; কিন্তু জীবনসঙ্গী করার আগে ওর ব্যাকগ্রাউন্ডটা ভালো করে জেনে নিয়েছ তো? অবশ্য আমার পক্ষে হয়তো এসব অনধিকারীর প্রশ্ন, তবু তোমাকে ভালোবাসি বলেই…তুমি কিছু মনে করছ না তো?
—না, সুজাতাদি। বরং খুশিই হচ্ছি। মায়ের সঙ্গে এসব কথা আলোচনা করা যায় না। মা অত্যন্ত কনজারভেটিভ। আর দুনিয়ায় একটি জিনিসই চেনে : টাকা! …তুমি যা বলছিলে, হ্যাঁ, ইন্দ্র তার সব কথাই আমাকে বলেছে। ওর বাবা রেলে কাজ করতেন। ওর ভাইবোন কেউ নেই। ম্যাট্রিক পাস করে বিহারের একটা স্কুল থেকে।
বাধা দিয়ে সুজাতা বলে, হ্যাঁ, শুনেছি। ডঃ ঘোষাল আর উনি একই স্কুল থেকে একই বছর ম্যাট্রিক পাস করেন।
সুভদ্রাও বাধা দিয়ে বললে, না! সেটা ঠিক নয়। ডঃ ঘোষাল ওর চেয়ে পাঁচ ক্লাস উপরে পড়তেন। ক্লাস-মেট নয়, স্কুলমেট। তা সে যাই হোক, কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়তে পড়তে ও একটি মেয়েকে বিয়ে করে। মাত্র দু বছরের মাথায় সন্তান হতে গিয়ে ওর সেই স্ত্রী মারা যায়।
—আর বাচ্চাটা?
—না, সেটাও বাঁচেনি। তারপর থেকে ও বিপত্নীক! যদিও অভিনয়-জগৎ জানে, ও কনফার্মড-ব্যাচিলার। ইন্দ্র তার জীবনের সব কথাই খুলে বলেছে আমাকে।
—কী বলেছে? এই ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর ওর জীবন ছিল স্ত্রীভূমিকাবর্জিত?
—তা কেন? সেকথাও ও অকপটে স্বীকার করেছে। সবাই তা জানেও। ও তো অনুরাধাদিকে নিয়ে থাকত, বউবাজারে একটা বাসা ভাড়া করে।
যেটুকু জানার ছিল সুজাতার, তা জানা হয়েছে। বলে, চল এবার বাগানে যাওয়া যাক ওঁরা বোধহয় আমাদের অভাবটা ফিল করছেন।
কৌশিক গুনতি করে দেখল সবাই এসেছেন, শুধু একজন বাদ—চিনসুরার সেই ইনভেস্টিগেটিং ইন্সপেক্টর, চন্দন। বাসুকে সে কথা বলতেই তিনি জনান্তিকে বললেন, না, চন্দন এসেছে। আড়ালে আছে। সময়মতো সে পজিশন নেবে—
–সেই নাটকীয় মুহূর্তটা কখন আসবে মামু? বিফোর না আফটার ডিনার?
—আফটার ডিনার! পুরীতে ডিনার খাওয়া যায়নি, চিনসুরাতেও কেউ খেতে পারেনি, এখানে তা আমি হতে দেব না।
—কিন্তু আফটার ডিনার কি ড্রিংক্স্ চলবে?
—চলবে! চালাতে জানলে সবই চলে!
.
বাসুসাহেবের পরিকল্পনা মতোই কাজ শুরু হলো। গল্পগুজব হাসি-হুল্লোড়ের মধ্যে নিরাপদে ড্রিংক্স্-পর্ব সমাধা হলো। তারপর আগের মতোই সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ব্যুফেডিনার সারলেন। অপর্ণাকে বাচ্চার জন্য একটা প্যাকেটও ধরিয়ে দেওয়া হলো. সে বেচারি কাউকেই চেনে না। বাচ্চা ঘুমিয়ে পড়বে এই অজুহাত দেখিয়ে অপর্ণা সবার আগে চলে গেল। খিদমদ্গারেরা প্লেট ও টেবিল সাফা করতে শুরু করেছে। পরিকল্পনামতো কৌশিক, সুজাতা আর বিশু চেয়ারগুলো একটু দূরে গোল করে সাজিয়ে দিল। রাত তখনো বেশি হয়নি। মাত্র সাড়ে আট।
বাসু বললেন, কিছু ভালো ওয়াইন রাখা আছে—ডেসার্ট-ওয়াইন, অর্থাৎ ডিনারের পর সেব্য; আর আছে ড্রাই-মার্টিনী; আসুন, সবাই বসা যাক আবার। বেশ গোল হয়ে।
রানু বলেন, আর আমরা? যাদের ওসব চলবে না? আমরা কি বুড়ো আঙুল চুষব?
—তা কেন? তাদের জন্যও ব্যবস্থা আছে। আইসক্রীম, কফি, মিল্কশেক—যার যা পছন্দ!
সবাই ঘনিয়ে আসে। ছায়া পালিত রানুর কানে-কানে বলে, এবার কি ‘মজারু’ পালাটা হবে?
রানু চাপা ধমক দেন, চোপ।
ডি আই জি বার্ডওয়ান বলেন, এবার কেউ একটা গান শোনান
ইন্দ্রকুমার বলে, আরে ছি ছি, আগে বলতে হয় যে, সান্ধ্য আসরে গানবাজনা হবে, তাহলে তৈরি হয়ে আসতাম।
ব্রজদুলাল সবিস্ময়ে বলেন, মানে? তুমি গান গাইতে জানো নাকি? আর তাছাড়া ‘তৈরি হয়ে আসতে’ মানে?
ইন্দ্ৰ বলে, দুটো প্রশ্নের একই জবাব। আমার প্লে-ব্যাক সিঙ্গারকে সঙ্গে নিয়ে আসতাম। আমার কাজ তো ঠোঁট নাড়ানো।
সবাই হেসে ওঠে।
ব্রজদুলাল বলেন, অনুরাধা গান জানে। অনু একটা ধর।
অনুরাধা বলে, আমিও ইন্দ্রদার মতো বলব, ‘আগে বলতে হতো’! ভরপেট খাওয়ার পর, আইসক্রীম খেতে খেতে গান হয় নাকি?
ডি আই জি বলেন, বুঝলাম! গান চলবে না। কিন্তু গল্প তো চলতে পারে? বাসু-কাকু একটা ছাড়ুন। পুরনো একটা কেস হিস্ট্রি। বেশ জমাটি একটা খুনের মামলা! কীভাবে অপরাধীকে স্পট করলেন সেই কিস্সা।
বাসু যথারীতি পাইপে টোব্যাকো ঠেসতে ঠেসতে বলেন, ঠিক আছে। তাই শোনাব। তবে ‘একটা’ নয়, জোড়া খুনের কেস। কিন্তু ব্রতকথা শোনার আগে প্রত্যেকের হাতে ফুল- বেলপাতা থাকা চাই। এক-একটা গ্লাস উঠিয়ে নিন আপনারা। মেয়েরাও নাও — জিন, ভারমুথ, নিদেন আইসক্রীম, মিল্কশেক বা কফি
খিদমদ্গারেরা ট্রে নিয়ে ঘুরছে। সবাই একটা করে পানপাত্র বা আইসক্রীম প্লেট তুলে নিলেন। কৌশিক একটা গ্লাস তুলে নিয়ে বললে, এটা কী?
বাসু নিজে নিয়েছেন তাঁর সাবেক ব্র্যান্ড—শিভাস রিগ্যাল অন-রকস্। বললেন, ওটা ড্রাই- মার্টিনী। নিশ্চিন্তে খেতে পার।
কৌশিক বলে, নেশা হবে না তো?
বাসু ধমক দেন, কী পাগলামি করছ? ওতে আছে জিন, আর ভারমুথ! মেয়েদের ড্রিংস্। আফটার ডিনার ডেলিকেসি।
কৌশিক গ্লাসটা উঠিয়ে নিয়ে বললে, এবার শুরু করুন মামু, আপনার জোড়া খুনের কিস্সা! সবার হাতেই ফুল-বেলপাতা পৌঁছে গেছে!
বাসু গল্পটা শুরু করেন, জোড়া খুনের আসামীর নাম … নাঃ! আমি বরং আসল নামটা গোপন রেখে একটা ছদ্মনাম ব্যবহার করি। ধরা যাক্, লোকটার নাম : বটুক চোংদার।
ছায়া তীব্র আপত্তি জানায় : এ ম্যা! কী বিশ্রী নাম! জোড়া খুনের মামলার আসামী : বটুক চোংদার! আমি ভাবতেই পারছি না।
বাসু বলেন, কেন? চোংদার উপাধি হয়, শোননি?
ছায়া মাথা নেড়ে বলে, কোনো জন্মে নয়।
জয়ন্ত বললে, আমাদের ক্লাসে একজন ‘চোংদার’ পড়ত। ওই টাইটেলটা শুনেছি। আপনি গল্পটা বলুন, স্যার।
বাসু বলেন, আর কেউ? চোংদার টাইটেল? অনুরাধা? সুভদ্রা? পম্পা? ইন্দ্রকুমার?
কেউ কোনো জবাব দেয় না। অনেকেই মাথা নাড়ে।
ব্রজদুলাল বলেন, ওফ্! গল্পটা কেন থেমে গেল? আমরা মেনে নিচ্ছি ‘চোংদার’ টাইটেল আছে; গল্পটা চলুক।
বাসু বলেন, বেচারির দোষ কী? পিতৃদত্ত নাম, বংশগত উপাধি। ওই বিশ্রী নামের বোঝা নিয়েই সে স্কুলে সহপাঠীদের উপদ্রব সহেছে। তবে দেখতে ছেলেটা সুন্দর ছিল। ক্রমে ম্যাট্রিক পাস করে মফস্বল থেকে কলকাতায় চলে এল। স্কুলে থাকতেই বটুক একজন : বিত্তশালী জোদ্দারের কিশোরী মেয়ের প্রেমে পড়ে। মেয়েটিও সুন্দরী, তবে নাবালিকা। বিশ্রী নাম সত্ত্বেও মেয়েটিও বটুক চোংদারের প্রেমে পড়লো। বলতে ভুলেছি, ঘটনাস্থল—বিহারের ধানবাদ শহর। বটুক ওইখানে চিরাগোড়া বয়েজ স্কুলে পড়ত। চোংদারের কিশোরী প্রেমিকার নাম—আচ্ছা, আবার একটা ছদ্মনামই নেওয়া যাক—ধর : কুন্তী দোসাদ।
ডঃ অমরেশ দাশের হাতে ওয়াইন-গ্লাসে তরল পদার্থটা একটু চলকে উঠলো। তিনি সামনের দিকে ঝুঁকে প্রশ্ন করেন, কী নাম বললেন? কুন্তী দোসাদ?
বাসু একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বলেন, কী ব্যাপার? এ নামটা কি তোমার কাছে বিশ্রী মনে হচ্ছে নাকি? কুন্তী তো মহাকাব্য থেকে নেওয়া নাম বাপু, পাণ্ডবজননী?
মিস্ ডুরান্টের দিকে তাকিয়ে ডঃ দাশ কেমন যেন থতমত খেয়ে থেমে যান। ব্রজদুলাল সোজা হয়ে উঠে বসেন। বলেন, জাস্ট এ মিনিট, ব্যারিস্টারসাব, নামটা বিশ্রী বলে নয়, কোথায় যেন শুনেছি মনে হচ্ছে। কোথায় বলুন তো?
যুগলকিশোর বলে, তাতে কী হলো? ধানবাদের ওই চিরাগোড়া স্কুলের নামটাও তো আমি শুনেছি। ডঃ ঘোষাল তো ওখান থেকেই ম্যাট্রিক পাস করেন। আর ইয়ে, আপনিও তো ওই স্কুলেই ডঃ ঘোষালের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়তেন, তাই নয়?
এবার যুগলকিশোর প্রশ্নটা করেছে ইন্দ্রকুমারের দিকে সরাসরি তাকিয়ে। ইন্দ্রকুমার এতক্ষণ মাথাটা নিচু করে শুনে যাচ্ছিলো। এবার সোজা হয়ে উঠে বসে। গলাটা ঝেড়ে স্পষ্টভাবে বলে, হ্যাঁ, আমিও ওই স্কুলেরই ছাত্র ছিলাম। তবে ঘোষালদার সঙ্গে এক ক্লাসে নয়, অনেক নিচুতে। আর ঘোষালদার ব্যাচে চোংদার উপাধিধারী কোনো ছাত্র ছিল কি না তা মনে নেই। অনেকদিনের কথা তো—
তারপর হঠাৎ ব্রজদুলালের দিকে ফিরে বললে, আমার বড্ড মাথা ধরেছে, ব্রজদা! তোমাদের যদি ফেরার দেরি থাকে তাহলে আমি বরং একটা ট্যাক্সি নিয়েই ফিরে যাই।
উঠে দাঁড়ায় ইন্দ্রকুমার। সুভদ্রাও তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ায়। বলে, ট্যাক্সি কেন? চল, আমি পৌঁছে দিচ্ছি। আমি গাড়ি নিয়েই এসেছি।
ওরা দুজনে যাবার জন্য প্রস্তুত। ঠিক তখনই উঠে দাঁড়ায় কৌশিক। তার হাতে ড্রাই- মার্টিনীর একটা গ্লাস। পূর্বমুহূর্তেই সে তাতে প্রথম চুমুকটা দিয়েছে। দিয়েই উঠে দাঁড়িয়েছে। বোধহয় তরল পদার্থটা থু-থু করে ফেলে দেবে বলে। কিন্তু তা সে পারল না। গ্লাসটা ঠক করে নামিয়ে রাখল টেবিলে। তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে উঠেছেন বাসুসাহেব। তিনিও গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রেখে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরলেন কৌশিককে : কী হয়েছে? অমন করছ কেন? কৌশিক! কৌশিক!!
বাসুসাহেব ওভাবে জড়িয়ে না ধরলে কৌশিকের সংজ্ঞাহীন দেহটা হয়তো মাটিতে লুটিয়ে পড়ত। ওর ডান হাতটা এলিয়ে পড়েছে। বাঁ হাতটা কণ্ঠনালীতে। একই খণ্ডমুহূর্তে জয়ন্তের হাতে ছায়া পালিতের ক্যামেরাটা ঝিলিক দিয়ে উঠল। আর ছায়া পালিত—কোথাও কিছু নেই—গোলকিপার যেভাবে ডাইভ মেরে পেনাল্টি বাঁচায়—সেইভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে দু-হাতে চেপে ধরল কৌশিকের টেবিলে নামিয়ে রাখা মার্টিনীর গ্লাসটা।
একটা বিশৃঙ্খলা! প্যান্ডিমোনিয়াম। ঠিখ পূর্বমুহূর্তে হয়ে গেছে লোডশেডিং! বাসু চিৎকার করে উঠলেন, ডোন্ট বি প্যানিকী! যে যেখানে আছ স্থির হয়ে থাক!
ধীরে ধীরে কৌশিকের সংজ্ঞাহীন দেহটা উনি শুইয়ে দিলেন ঘাসের উপর। এ-পাশ ফিরে বললেন, ডঃ দাশ! প্লিজ-
ডাঃ দাশ ছিলেন একটু দূরে। এগিয়ে এলেন তিনি। বসলেন হাঁটু গেড়ে ঘাসের উপর। না! গোটা এলাকাটায় লোডশেডিং হয়নি। ওঁর বাড়িতেই কোনো কারণে ফিউজ হয়ে গেছে নিশ্চয়। রাস্তায় আলো জ্বলছে। পাশের বাড়িতেও। বাগানটা অন্ধকার নয়, আলো-আঁধারি। ডঃ দাশ কৌশিকের মণিবন্ধটা তুলে নিয়ে পরীক্ষা করছেন। বাসু এ-পাশ ফিরে ডাকলেন, সুজাতা! সুজাতা কোথায়? সুজাতা-
সুজাতা নির্দেশমতো কুন্তী দোসাদের নাম ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পা টিপে-টিপে চলে গিয়েছিল সিঁড়ির নিচে ইলেকট্রিক মিটার-বক্সের কাছে, সময়মতো মেইন সুইচটা ‘অফ’ করতে।
সাড়া দেয় বিশ্বনাথ, দিদি ওদিকপানে গেল! বলেন, তাঁরে ডাকতিছেন কেন? আমিই তো খাড়া আছি।
দাশসাহেব বলেন, বাট হি ইজ অ্যালাইভ! অ্যাগি দেখ তো—যেন মৃত্যুই প্রত্যাশিত ছিল!
বাসু চিৎকার করে ডেকে ওঠেন : সুজাতা?
এইরকমই নির্দেশ ছিল। সুজাতা সুইচটা ‘অন’ করে দিল। বাগানে আবার জ্বলে উঠল আলোর মালা।
একসার মানুষ একটা শায়িত সংজ্ঞাহীন দেহকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। থিয়েটারের ভাষায় যাকে ‘স্টিল’ হয়ে যাওয়া বলে! আলো জ্বলে ওঠার পর দেখা যায় কৌশিকের মাথাটা ডাঃ দাশের বাম জানুতে; আর অ্যাগি কৌশিকের নাড়িটা ধরে দেখছেন। ব্রজদুলাল—শুধু ব্রজদুলাল কেন, সক্কলে তাকিয়ে আছে ওই সংজ্ঞাহীন যুবকটির দিকে। একটিমাত্র ব্যতিক্রম। ইন্দ্রকুমার।
সে স্থিরলক্ষ্যে তাকিয়ে আছে বাসুসাহেবের দিকে—ঈগলনেত্রদহনকারী জ্বলন্ত দৃষ্টিতে।
বাসুও তাকিয়েছিলেন তার দিকেই। ধীরে ধীরে এ-পাশ ফিরে ছায়াকে বললেন, তুমি দু হাতে ওই গ্লাসটা ধরে আছ কেন, মা?
ছায়া দৃঢ়স্বরে বললে, এবার আর ভুল হতে দেব না বলে। এই গ্লাসটাই কৌশিকদা নামিয়ে রেখেছিল টেবিলে। ইট কনটেইন্স পয়জনাস্ ড্রাগ।
বাসু হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা ওর হাত থেকে কেড়ে নিলেন। বললেন, সরি, ছায়া! এবারও মিস্ করেছ তুমি!
—নো স্যার! আয়াম পজেটিভ! হান্ড্রেড পার্সেন্ট—
—দেন লেট মি ড্রিংক ইট টু দ্য লী—
গলায় ঢেলে দিলেন গ্লাসের তলানিটা।
কৌশিকের গ্লাস নয়—এটা ছিল শিভাস রিগ্যালের তলানি। ওঁরই পানপাত্রটা। বাসু এদিকে ফিরে বললেন, তোমার অভিনয় শেষ হয়েছে, কৌশিক! এনকোর বলব না, বলব প্লেন্ডিড! ওঠ। উঠে বস।…সরি টু ট্রাবল য়ু ডঃ দাশ অ্যান্ড অ্যাগি—
ব্রজদুলালের গলকণ্ঠটা বার দুই ওঠা-নামা করল। এক ঢোক পানীয় সেই কণ্ঠনালীতে ঢেলে দিয়ে উনি বললেন, এর মানেটা কী হলো, ব্যারিস্টারসাহেব? মশ্করা?
ইন্দ্রকুমার বললে, চিপ গিমিক! এ ফিথি জোক! চলে এস, সুভদ্রা!
সে চলতে শুরু করে।
বজ্রগম্ভীর স্বরে পিছন থেকে ডি আই জি বার্ডওয়ান বলে ওঠেন, হোল্ড অন, প্লিজ! কেউ আসর ছেড়ে চলে যাবেন না।
রুখে ওঠে ইন্দ্রকুমার : মানে? কী বলতে চান আপনি? আমরা কি গ্লেপ্তার হওয়া আসামী?
ডি আই জি ওর চোখে চোখ রেখে বললেন, অন্য সকলের কথা থাক। কিন্তু আপনি চলে যাবেন না, মিস্টার চৌধুরী। ওই চেয়ারে বসে থাকুন। আমাকে জেনে দিতে দিন মিস্টার পি কে বাসু এই উৎকট রসিকতাটা কেন করলেন—ওই ‘ফিথি জোকটা।
ইন্দ্রকুমার এদিক-ওদিক তাকিয়ে আবার বসে পড়ে।
ডি আই জি এবার বাসুসাহেবের দিকে ফিরে বললেন, এটা আপনি কেন করলেন বাসুকাকু?
–এটা একটা ড্রেস-রিহার্সাল, বাচ্চু! আমি একটা পরীক্ষা করে দেখতে চাইছিলাম—দশ-বিশজন প্রত্যক্ষদর্শীর সামনে ওইভাবে হাতসাফাইটা করা চলে কিনা! অবশ্য পঞ্চানন করেছিল বিজলিবাতির আলোয়, আমাকে আলো-আঁধারির পরিবেশের সাহায্য নিতে হল। কারণ আমি প্রায় নিশ্চিত জানতাম—কৌশিক পড়ে গেলেই কেউ-না-কেউ ওর গ্লাসটাকে দখল করতে চাইবে। অ্যাবে শবরিয়ার বেলা আমরা বুঝতেই পারিনি ব্যাপারটা কী হতে যাচ্ছে। ঘোষালের বেলাতেও পঞ্চানন হাতসাফাইটা করতে পেরেছিল; কিন্তু আমার আশঙ্কা ছিল বার-বার তিনবার ম্যাজিকটা দেখানো চলবে না—যদি না একটু আলো-আঁধারির ব্যবস্থা করা যায়।
পকেট থেকে একটা কাচের গ্লাস বার করে বাসু সেটা টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। বললেন, কৌশিক এই গ্লাসে ড্রাই-মার্টিনী পান করছিল। ছায়া হুমড়ি খেয়ে পড়ার আগেই আমি ওটা সরিয়ে নিতে পেরেছিলাম। বাস্তবে, আমি পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিলাম—দু-দুবার পানপাত্রের তলানিতে বিষের হদিস পাওয়া গেল না কেন। আদালতে এ প্রশ্নটা উঠবেই। আমার মুখের কথায় হয়তো বিচারককে ‘কনভিন্স’ করানো যেত না। তাই দু-দুশজন সাক্ষীর ব্যবস্থা আমাকে করতে হল। প্রমাণ করতে : এটা সম্ভব!
ডি আই-জি বলেন, আপনি কি বলতে চান, পঞ্চানন ঘড়াই ওইভাবে হাতসাফাই করে গ্লাসটা সরিয়ে ফেলেছিল?
—আমি কেন বলব? তোমরা যে কেউ বল না—তা না করা হয়ে থাকলে গ্লাসের তলানিতে বিষের ইঙ্গিত পাওয়া গেল না কেন? আপনারা বিকল্প কোনো সমাধান দাখিল করতে পারেন?
ডি আই জি বলেন, না, পারি না। কিন্তু তাহলে অ্যাবে শবরিয়ার ক্ষেত্রে সমাধানটা কী হবে? সেখানে তো পঞ্চানন ঘড়াই ছিল না।
বাসু বলেন, তার একমাত্র কারণ পঞ্চানন ঘড়াই ঘোষালকে হত্যা করেনি। দু-দুটি ক্ষেত্রে ম্যাজিশিয়ান যদি একই ব্যক্তি হয়, তাহলে পঞ্চাননকে ঘোষালের মৃত্যুর জন্য দায়ী করা চলে না।
ব্রজদুলাল বলেন, সেটা কী করে সম্ভব? পঞ্চানন তাহলে ওভাবে পালিয়ে গেল কেন? পঞ্চাননকে দেহরক্ষী হিসাবে কে নিযুক্ত করেছিল?
—কেউ নয়, ব্রজদুলালবাবু, কেউ নয়! পুলিস যাকে ‘পঞ্চানন’ বলছে, সেই অ্যান্টিসোস্যালের অনেক দোষ, কিন্তু এক্ষেত্রে কেউ তাকে প্রফেশনাল খুনি হিসাবে নিযুক্ত করেনি। বাস্তবিকপক্ষে ডাক্তার ঘোষালকে বিষপ্রয়োগে যে হত্যা করেছে, সে পঞ্চানন ঘড়াই নয়, ঘোষালের সহপাঠী এবং বাল্যবঙ্কু, অর্থাৎ আমার ওই ‘জোড়াখুন কাহিনী’র নায়ক : বটুক চোংদার!
ব্রজদুলাল অবাক হয়ে বলেন, আপনি বলতে চান, বটুক চোংদার সেদিন সন্ধেয় ঘোষাল ডাক্তারের বাড়ির পার্টিতে ছিল?
— ছিল!
—অথচ এতগুলি মানুষের মধ্যে কেউ তাকে দেখতে পেল না?
—না, কেন জানেন? সবাই তাকে দেখেছে, তবে ছদ্মবেশে : পঞ্চানন ঘড়াই-এর ছদ্মবেশে। চোংদার ছদ্মবেশ ধারণে অসাধারণ দক্ষ। আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়, পঞ্চানন ঘড়াই যখন পুলিসের এক্তিয়ার থেকে পালায় তখন আরক্ষা বিভাগ থেকে একটি পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই ঘোষণাপত্রে পচাই-এর সামনে থেকে এবং পাশ থেকে দুটি ফটো ছাপা হয়েছিল। বটুক চোংদার সে দুটি যোগাড় করে। আপনি জানেন কি জানেন না, জানি না, ব্রজবাবু- একবার একটা মজাদার ঘটনা ঘটে। ফুটবল-সম্রাট পেলে কলকাতায় এসে যখন তাঁর নিজস্ব নৈপুণ্য দেখাতে পারলেন না, তখন লোকে কী বলাবলি করেছিল জানেন? বলেছিল : আই এফ এ পেলেকে আদপেই দক্ষিণ আমেরিকা থেকে উড়িয়ে আনেনি। পেলের ‘মেক-আপ’ নিয়ে মাঠে নেমেছিল, ছদ্মবেশ ধারণে অসাধারণ দক্ষ অভিনেতা ওই : বটুক চোংদার!
ব্রজদুলাল ধীরে ধীরে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাকিয়ে দেখলেন তাঁর বঙ্কু ইন্দ্রকুমারের দিকে। ইন্দ্র তখন তার জুতোর ফিতে বাঁধায় হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ব্রজদুলাল বলেন, এসব কী বলছেন আপনি? ইন্দ্র? তার কী স্বার্থ? সে কেন এমন জঘন্য কাজ করবে? আর তাছাড়া …ওরা…ওরা তো বাল্যবঙ্কু! ঘোষালের মৃত্যুতে ইন্দ্র কীভাবে ভেঙে পড়েছিল তা নিজে চোখে দেখেননি?
হঠাৎ আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে ইন্দ্রকুমার। ডি আই জি বার্ডওয়ান রেঞ্জের দিকে ফিরে বলে, সরি, স্যার! সহ্যের একটা সীমা আছে! এ পাগলের প্রলাপ এভাবে আর বসে বসে শুনতে পারছি না। আমাকে ওই আষাঢ়ে গল্পটা জোর করে শোনাতে হলে আমাকে অ্যারেস্ট করতে হবে গুড নাইট! এস সুভদ্রা-
ডি আই জি ধীরেসুস্থে বললেন, ইস্ য়োর প্রিভিলেজ, মিস্টার চৌধুরী। আই মিন, গল্পটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনাকে ওই চেয়ারে বসে থাকতেই হবে। তবে হ্যাঁ, আপনি চাইলে হ্যান্ডকাপ পরে বসে বসে শুনতে পারেন। …চন্দন!
যেন অন্তরীক্ষ থেকে আবির্ভূত হল ইন্সপেক্টর চন্দন নন্দী। তার বাঁ হাতে স্টেনলেস- স্টিলের হ্যান্ডকাপ। ডান হাত তুলে সে ডি আই জি-কে স্যালুট দিয়ে বললে, ইয়েস স্যার?
ডি আই জি কোনো আদেশ দেবার আগেই বাসুসাহেব বলে ওঠেন, ইস্ মাই পার্সোনাল অ্যাপিল, ডি আই জি বার্ডওয়ান রেঞ্জ, স্যার! ইন্দ্রকুমার চৌধুরী ওরফে বটুক চোংদার, ওরফে পঞ্চানন ঘড়াই আজ সন্ধ্যায় আমার আমন্ত্রিত অতিথি। এ বাড়ির ভিতরেই ওকে হাতকড়াটা না-ই বা পরালেন? আমি কথা দিচ্ছি—ও শান্ত হয়ে বসে সব কথা শুনবে। শোনাটা ওর দরকার—বিশেষ দরকার, ওর নিজের স্বার্থেই!
তারপর ইন্দ্রকুমারের দিকে ফিরে বললেন, শোন ইন্দ্র, তুমি আমার ক্লায়েন্ট নও, তবু তোমার সাংবিধানিক অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করে দিতে চাই। এই বাড়ি ছেড়ে বার হওয়ামাত্র পুলিস তোমাকে ফর্মালি গ্রেপ্তার করবে; বাস্তবে, তুমি এখনো ডি-ফ্যাক্টো আন্ডার- অ্যারেস্ট। তাই আমার পরামর্শ : তুমি এখন একটি কথাও বলবে না। শুধু শুনে যাবে। তোমার স্বরূপ বুঝে ফেলার পর তুমি আর আমার বঙ্কু নও—কিন্তু আজ রাত্রে—আগেই বলেছি—তুমি আমার আমন্ত্রিত অতিথি। চুপটি করে বসে থাক তুমি—বুঝে নেবার চেষ্টা কর
কীভাবে নাগপাশে জড়িয়ে পড়েছ। আত্মরক্ষা যদি আদৌ করতে পার, আমি খুশি হব।
যুগলকিশোর জানতে চায়, আপনার প্রথম সন্দেহটা কবে জাগে?
বাসু বলেন, পুরীতে। বিল শবরিয়ার মৃত্যুর আগের রাতের ঘটনাটায়। গভীর রাত্রে, একান্ত নির্জনে, বারান্দায় ইন্দ্রকুমার যখন ডক্টর ঘোষালকে বলেছিল, কোট ‘আমাকে আর নীতিকথা শোনাতে আসিস না রে শিবু! তোর বৃন্দাবনলীলার কথা কি আমি জানি না, মনে করিস?’ আনকোট।
ব্রজদুলাল অবাক হয়ে বলেন, সে-কথা আপনি কেমন করে জানলেন? আপনি নিজেই বলছেন : ‘গভীর রাত্রে’, ‘একান্ত নির্জনে…
—এ প্রশ্ন আদালতে যখন ইন্দ্রকুমারের উকিল আমার কাছে জানতে চাইবে তখন তার জবাব দেব। আপাতত শুধু বলি, তখনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম ইন্দ্র মিছে কথা বলেছে—ওরা দুজন বাল্যবঙ্কু, সহপাঠী। দুজনের সম্পর্ক ‘তুই-তোকারি’র। তবে ইন্দ্রকুমার যেহেতু অভিনয়-জগতে বয়সটা কমাতে চায় তাই ঘোষাল এই কথাটা গোপন রাখে। কিন্তু ওই ‘বৃন্দাবনলীলা’র ব্যাপারটা তখন বুঝতে পারিনি। সে বিষয়ে সন্দেহ জাগল যখন ডঃ অমরেশ দাশ গত দশ বছরের ডোনার্স-লিস্ট-এর হিসেবটা দেখালেন।
কৌশিক বলে, হ্যাঁ, আগেও আপনি অমন একটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই হিসাবে সন্দেহজনক কিছু তো দেখিনি।
—দেখা উচিত ছিল কৌশিক; তুমি পাস-করা এঞ্জিনিয়ার। অঙ্কশাস্ত্রটা তোমার দখলে। শোন, বুঝিয়ে বলি। প্রথম কথা : ইন্দ্রের রোজগার যখন কম ছিল, দশ বছর আগে, তখনও সে দান করে গেছে। কেন? সে তো ইনকামট্যাক্স দিত না তখন। তাই আর সবাইয়ের মতো ৪০ G ধারায় ইনকামট্যাক্সে ছাড়া পাওয়ার প্রশ্ন তো তখন ছিল না—
সুজাতা বলে, ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, বঙ্কুর সৎকাজে ইন্দ্রবাবু নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী সাহায্য করেছিলেন।
—সেটাই স্বাভাবিক সমাধান। কিন্তু অঙ্কের হিসাবে একটু অসঙ্গতি নজরে পড়ল আমার। অন্য সবাই যা বার্ষিক দান হিসাবে দিয়েছেন, তা হাজার অথবা পাঁচশত টাকার গুণিতকে। লক্ষ্য করে দেখ, সংখ্যাগুলি 500/-, 1,000/-, 1,500/-, 2000/-, 3,000/-, এবং 5,000/-। অথচ ইন্দ্রের ক্ষেত্রে এমনটা হয়নি। সে 1986 থেকে ‘৪৪ পর্যন্ত দিয়েছে 1800/- হারে; পরের তিন বছর 2,400/- টাকা করে, এবং তারপর অবশ্য হাজারের গুণিতকে 3,000/- করে। ইদানীং দিচ্ছে 3,600/- টাকা বার্ষিক। কেন? ঐ চারটি সংখ্যা – 1,800/- হারে; 2,400/-, 3,000/- এবং 3,600/- কেন হলো? কেন হলো না থওকা হিসাবে যথাক্রমে : 2,000/-, 2,500/-, 3,000/- 4 3,500/-?
সুজাতা বললো, এর কি কোনো কারণ থাকতে পারে?
—পারে। যদি ঐ সংখ্যাগুলিকে ‘12’ দিয়ে ভাগ কর। সেক্ষেত্রে মাসিক দেয় হয় : 150/-, 200/-, 250/-, 300/-, তাই না?
সুজাতা বলে, তাতেই বা কী প্রমাণ হয়?
—না, প্রমাণ কিছু হয় না, তবে একটা সম্ভাবনার সূত্র পাওয়া যায়। পুরীতেই ডাক্তার ঘোষাল কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন, ওঁর হাসপাতালে বর্তমানে কোনো রোগীকে রাখতে হলে মাসিক চার্জ হচ্ছে 300/- টাকা। আগে ছিল আড়াই শ’ করে। আরও আগে মাসিক দুইশত করে দিলেই চলত, যদিও প্রথম পর্যায়ে বেড-চার্জ ছিল মাত্র দেড় শ’; ফলে একটা সম্ভাবনার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে : ইন্দ্র হয়তো বার্ষিক দান করত না আদৌ। একটি রোগীকে পার্মানেন্টলি হাসপাতালে রাখার মাসিক খরচটা বছরে একবার মিটিয়ে দিত। প্রমাণ নয়, সম্ভাবনা।
কৌশিক বললো, এ-দিকটা আমরা খেয়াল করিনি।
বাসু বলেন, ঐ অজানা রোগীর পরিচয় আমাকে কেউ জানায়নি, কিন্তু দুজনের গোপনীয়তা থেকেই আমরা সন্দেহ হলো রোগী নয়, ইন্দ্র যার চার্জ মেটায় সে রোগিণী! আর ঐ বৃন্দাবনলীলার প্রসঙ্গ যখন উঠেছে, তখন মেয়েটি ‘কুন্তী দোসাদ’ হলেও হতে পারে। কিন্তু সেটা তো আমার আন্দাজ। প্রমাণ হবে কী ভাবে? কুন্তী দোসাদের পরিচয় জানত ঘোষাল, কিন্তু সে মৃত; আর জানে ইন্দ্র : সে বলবে না। অ্যাগিও তা জানে না। বঙ্কুর প্রতি বিশ্বস্ততায় ঘোষাল তা হয়তো অ্যাগির কাছ থেকেও গোপন করেছিল। তাহলে? আর একটা অসঙ্গতির কথা তখন বিশ্লেষণ করতে বসলাম। ঘোষাল সরল মনে গল্প করেছিল যে, ওরা সহপাঠী। ইন্দ্রকুমার তার সঙ্গে একই বছরে, 1961-তে, ম্যাট্রিক পাস করে। থার্ড ডিভিশনে। একথা ইদু স্বীকার করেছে অনুরাধার কাছে, এবং সুভদ্রার কাছেও। অথচ আমাকে বলেছে, সে নম্যাট্রিক। কেন? চিরাগোড়া বয়েজ স্কুলের খতিয়ানেও ইন্দ্রকুমার চৌধুরীর নাম পাওয়া গেল না। এ সমস্যার একমাত্র সমাধান হতে পারে : যদি ইন্দ্রকুমার পরবর্তী জীবনে এফিডেবিট করে তার পিতৃদত্ত নাম—যে-নাম আছে ম্যাট্রিক সটিফিকেটে—তা পরিবর্তন করে থাকে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমি বিচার করতে বসলাম। আমারই পরামর্শ অনুযায়ী যুগলকিশোর চারজন সাসপেক্ট-এর বাড়ি তল্লাশি করায়। চারজনকে করা হলো এজন্য, যাতে প্রকৃত অপরাধী সন্দিহান না হয়ে পড়ে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল দেখা, ইন্দ্রকুমারের কোনো পাসপোর্ট আছে কিনা, থাকলে তার নম্বর কত?
অনুরাধা জানতে চায়, কেন? পাসপোর্টের নম্বর পেলে কী লাভ হবে?
—তুমি জান না, অনু, পাসপোর্টের জন্য আবেদন করার সময় দরখাস্তকারীকে জানাতে হয়, তার কোনও ‘অ্যালায়াস’ আছে কি না, অর্থাৎ জীবনের কোনো পর্যায়ে সে অন্য কোনো নামে, অন্য কোনও পরিচয়ে পরিচিত ছিল কি না। ওর পাসপোর্টের নম্বর ধরে ব্রেবোর্ন রোডের পাসপোর্ট অফিসে তল্লাশি করে জানা গেল, ইন্দ্রকুমার দরখাস্তে জানিয়েছিল তার বাবার নাম ঁমোহিনীমোহন চোংদার এবং ওর পিতৃদত্ত নাম বটুকেশ্বর চোংদার। সেই আমি প্রথম জানলাম : ইন্দ্রকুমারের পিতৃদত্ত নাম ও উপাধি।
যুগলকিশোর এই সময়ে বলে ওঠে, স্বীকার করব, এই আবিষ্কারে আমি কিন্তু খুব কিছু উল্লসিত হইনি। আমার মনে হয়েছিল : সিনেমার জগতে ‘বটুক চোংদার’ নাম নিতান্ত অচল বলেই উনি এফিডেবিট করে নামটা বদলেছেন। কিন্তু ব্যারিস্টারসাহেব আমার দৃষ্টি অন্য একটা দিকে আকর্ষণ করলেন। ইন্দ্রকুমার সিনেমার নামার চার বছর আগে এফিডেবিট করে নামটা বদলেছেন। স্বতই প্রশ্ন জাগে : কেন? বাসুসাহেবের পরামর্শমতো আমি একজনকে ধানবাদে পাঠিয়েছিলাম। এবার স্কুলের নথিতে দেখা গেল বটুকেশ্বর চোংদার ঐ একষট্টি সালেই থার্ড ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাস করেছিল। স্কুলের এক প্রাক্তন অতিবৃদ্ধ হেডমাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে জানা গেল, ঐ বটুক চোংদার ধানবাদের একজন বর্ধিষ্ণু জোদ্দারের নাবালিকা মেয়েকে ইলোপ করেছিল। থানাতে চৌত্রিশ বছর আগেকার এফ. আই. আর. পাওয়া গেল। যিনি এফ. আই. আর. লজ করেছিলেন তিনি প্রয়াত; কিন্তু তাঁর পুত্র মহাবীর দোসাদের কাছ থেকে জানা গেল—তাঁর অপহৃতা দিদি কুন্তী দোসাদের কোনও হদিসই করতে পারেনি বিহার – পুলিস। এ থেকেই আমরা দুইয়ে-দুইয়ে চার করেছি—
ইন্দ্রকুমার আর স্থির থাকতে পারে না। হঠাৎ বলে ওঠে, বাট…বাট…মাই অ্যালেবাঈ…আটাশে অক্টোবর আমি তো গালুডিতে…’সুবর্ণরেখা’ হোটেলে।
বাসু ধমকে ওঠেন : শাট আপ্! তুমি কোনও কথা বলবে না, ইন্দ্ৰ! যতক্ষণ না তোমার সলিসিটার এসে উপস্থিত হন। তবে হ্যাঁ, প্রশ্নটা যখন বেমক্কা করে ফেলেছ তখন জবাবটা জেনে যাও। দেখ, কোনোভাবে জোড়াতালি দিয়ে নিজের ডিফেন্সটা দিতে পার কি না। আমি সব কখানা তাসই বিছিয়ে দেব। চিড়িতনের দুরি থেকে রঙের টেক্কা। দেখ আত্মরক্ষা করতে পার কি না। শোন : তুমি ঘটনার আগের শনিবার, একুশে গালুডি যাও। তিনতলার একখানা ডবেড রুম বুক কর। পুরো একটা দিন সকলের সঙ্গে হৈ-হৈ করেছ। একদিনেই গোটা ত্রিশেক ফটো তুলেছ। তারপর ঘরটা লক্ করে কলকাতায় ফিরে এসেছিলে। ঘরটা খাতাপত্রে তোমার নামেই বুক করা ছিল। চুঁচুড়ায় বঙ্কুকৃত্য সেরে তুমি উনত্রিশে, রবিবার আবার গালুডিতে ফিরে যাও। এবং পরদিন সোমবার চেক-আউট করে কলকাতায় ফিরে এসেছিলে। এই তো? হিসেব মিলছে?
ডি. আই. জি. বলেন, তার কোনো প্রমাণ আছে?
—রাশি, রাশি। বিষ সংগ্রহ করায় এবং হাতসাফাইয়ে ইন্দ্র যে প্রফেশানলিজম্ দেখিয়েছে তার তিলমাত্র দেখাতে পারেনি ওর ঐ ভুয়ো অ্যালেবাঈ-প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায়। একে একে বলি। যুগলকিশোর এজন্য চন্দন নন্দীকে ‘সুবর্ণরেখা’ হোটেলে পাঠায়। হোটেলের বিলে দেখা যাচ্ছে একুশে সে প্রথম খাবারের বিল মেটায় লাঞ্চে, দুপুরে। তারপর আফটার-নুন টি, ডিনার; পরদিন বাইশে বেড-টি থেকে ডিনার সব কিছুর বিলের কাউন্টার-ফয়েল পাওয়া যাচ্ছে। সোমবার, তেইশে বেড-টির পর : ব্ল্যাঙ্ক! তেইশ থেকে আটাশ পাক্কা ছয়দিন বোর্ডার রেস্তোরাঁর কোনও বিল মেটায়নি। সুবর্ণরেখার ধারে-কাছে কোনও খাবার দোকান নেই। ফলে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ইন্দ্রকে কৈফিয়ৎ দিতে হবে—কেন সে ছয়দিন রুদ্ধদ্বার কক্ষে প্রায়োপবেশনে কাটিয়েছে। আসলে ঘরটা বুক করে রেখে সে চুঁচুড়ায় ফিরে আসে। ছদ্মবেশে। ঘোষাল তাকে দেহরক্ষীরূপে বাড়িতে থাকতে দেয়। ঘোষাল স্বপ্নেও ভাবেনি, ইন্দ্ৰ কেন এভাবে ছদ্মবেশে এসেছে। ইন্দ্র যে একজন কুখ্যাত অ্যান্টিসোস্যালের ছদ্মবেশ ধারণ করেছে তা কেউ আন্দাজ করেনি। পঞ্চাননের অ্যাকটিভিটি ছিল মুর্শিদাবাদে। ইন্দ্র ঘোষালকে একটা পার্টি দেবার জন্য প্ররোচিত করে। হয়তো দুই বঙ্কুতে বাজি ধরেছিল—এই বাজি ধরার কথা ঘোষাল টেলিফোনে জানিয়েও ছিল ছায়াকে—কেউ ইন্দ্রকুমারের ছদ্মবেশ ধরতে পারে কিনা। এজন্যই বেছে বেছে পুরী-পার্টির লোকদের ডাকা হয়েছিল। আবার পার্টি হবে কিন্তু অ্যাগি, ডঃ দাশ বা যুগলকিশোরের নিমন্ত্রণ হবে না তা তো হয় না। আফটার-ডিনার ইন্দ্রকুমার ছদ্মবেশ খুলে ফেললে দারুণ একটা ‘ফান’ হবে—সেটাই ছিল সে রাত্রের : ‘মজারু’!
কৌশিক বলে, কিন্তু মিস্টার চৌধুরী যে ছবি তুলেছিলেন তাতে তো তারিখও ছাপা পড়ে গেছে। আটাশে—যেদিন ডক্টর ঘোষাল মারা যান সেই তারিখেরও তো খান-ছয়েক ফটো আছে।
বাসু পকেট থেকে ফটোর বান্ডিলটা বার করে বেছে বেছে একটি ফটো বাড়িয়ে ধরেন ডি আই. জি-র দিকে। বলেন, এই ফটোখানা দেখ বাচ্চু। গ্রুপ ফটোতে সাত-আটজন আছে। ডাইনিং-হলে ফ্ল্যাশ বালবে তোলা ছবি। পিছনের দেওয়ালে দেওয়াল ঘড়িতে সময়টা পড়া যাচ্ছে : রাত আটটা পঁয়তাল্লিশ। ছবিতে তারিখ আছে 28th। তাই না?
ডি. আই. জি. খুঁটিয়ে দেখে বললেন, হ্যাঁ তাই।
—ইন্দ্র দাবি করছে এ ছবি আটাশ তারিখ রাত পৌনে নয়টায় ‘সুবর্ণরেখা’ হোটেলের ডাইনিং-হলে তোলা। তাই তো?
যুগলকিশোর বলে, ছবির ঘড়ি এবং ক্যামেরার অটোমেটিক ছাপ তো তাই প্রমাণ দেয়। দেয় না?
—না, দেয় না। বাস্তবে আটাশ তারিখে রাত পৌনে নয়টায়, অর্থাৎ—ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড টাইম রাত আটটা পঁয়তাল্লিশে, ভারতবর্ষের যে কোনো ভূখণ্ডে ঐ ক্যামেরায় ফটো তোলা হলে অটোমেটিক জাপানী ক্যামেরায় তারিখটা উঠবে উনত্রিশে।
অনুরাধা বলে, সে কি! কেন?
—যেহেতু টোকিও-টাইম ভারতীয় সময়ের চেয়ে সাড়ে চার ঘণ্টা এগিয়ে। জাপানে ঐ সময় রাত একটা পনের—আটাশ নয়, উনত্রিশ তারিখের
অনুরাধা বলে, ব্যাপারটা বুঝলাম না।
—ইন্দ্র বলেছে, সে ঐ জাপানী ক্যামেরাটা ওসাকাতে কিনেছিল। দোকানদার যে দুটো ব্যাটারি ভরে দেয় তা আজও কার্যকরী। সে ভিতরের অ্যারেঞ্জমেন্টে কখনো হাত দেয়নি। সেক্ষেত্রে জাপানী ক্যামেরায় জাপানের সময়ই দেবে। ভারতীয় সময় নয়।
—তাহলে এ ছাপটা পড়ল কীভাবে?
—ফিল্মটা ডেভেলপ হয়ে যাবার পর কোনও দক্ষ চিত্রশিল্পীকে দিয়ে—ঐ যারা চালের উপর নাম লিখে দেয়—সেই জাতীয় শিল্পীকে দিয়ে ইচ্ছেমতো তারিখগুলো লেখানো হয়েছে। এজন্যই ওকে বলতে হয়েছে ক্যামেরাটা খোয়া গেছে—ওর কাছে নেই। কিন্তু যেহেতু বেচারি থার্ড ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাস করে—ভূগোলে বোধহয় খুব কম নম্বর পায়—তাই ও ঠিকমতো কারচুপি করতে পারেনি। জানে না যে, এখানে আটাশ তারিখ রাত পৌনে নয়টায় ফটো তুললে ঐ জাতীয় ক্যামেরায় ডেট পড়বে উনত্রিশ তারিখের। আরও একটা কথা—গোয়েন্দা বিভাগ যদি তদন্ত করে দেখে, তাহলে দেখা যাবে ঐ ফটোতে যাদের দেখা যাচ্ছে—আটাশ তারিখের আগেই ‘সুবর্ণরেখা’ হোটেল থেকে তাদের অনেকে চেক- আউট করে চলে গেছে!
পম্পা এই সময় আকুলভাবে প্রশ্ন করে ওঠে, কিন্তু একটা কথা! অমন দেবতুল্য মানুষকে ইন্দ্রকুমার খুন করলেন কেন? কী ক্ষতি করেছিলেন ডাক্তার সাহেব?
—আস্ক হিম! ঐ তো বসে আছে লোকটা। জিজ্ঞেস কর ওকে!
পম্পা কিন্তু তা পারলো না। ইন্দ্রের মাথাটা নেমে গেছে—মেদিনীনিবদ্ধ দৃষ্টি।
বাসুই পাদপূরণ করেন : ঘোষাল ডাক্তার যে ইন্দ্রর অনেক-অনেক উপকার করেছে। নাবালিকা অপহরণের অভিযোগে ওকে ধরিয়ে দেয়নি। ওর নাম, উপাধি, বয়স গোপন রেখেছে—এমনকি দীর্ঘ বিশ-পঁচিশ বছর ওর ‘উইনসাম-ম্যারো’ অ্যাগি ডুরান্টের কাছ থেকেও গোপন রেখেছে উন্মাদিনী কুন্তী দোসাদের প্রকৃত পরিচয়। এত এত উপকারের প্রতিদান দিতে হবে না?
যুগলকিশোর বলে, এটা তো সেন্টিমেন্টের কথা হলো, স্যার। হত্যার একটা জোরালো মোটিভ তো থাকবে?
—দেন, বেটার আস্ক সুভদ্রা মোহান্তি।
সুভদ্রাও মেদিনীনিবদ্ধ দৃষ্টি। জবাব দেয় না।
বাসুই আবার বলেন, মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সুভদ্রা ইন্দ্রকে রেজিস্ট্রি বিবাহ করতে যাচ্ছে—আগামী সপ্তাহেই। সুভদ্রা না হোক কোটি টাকার সম্পত্তি লাভ করেছে বাবার উইল মোতাবেক। তাই ইন্দ্র তার সাবেক সঙ্গিনী অনুরাধাকে ত্যাগ করে এখন সুভদ্রার সঙ্গে এনগেজমেন্ট করেছে। কিন্তু ডক্টর ঘোষাল জীবিত থাকলে তা হতো না। ঘোয়াল ওকে নাবালিকা-হরণের অপরাধে ধরিয়ে দেয়নি বটে, কিন্তু সে দিক থেকে শিবশঙ্কর অত্যন্ত কড়া মেজাজের লোক। দশ বছর ধরে ইন্দ্রর দেয় টাকা সে আদায় করে এসেছে কড়াক্রান্তি হিসাবে। কুন্তী ইন্দ্রের বিবাহিতা স্ত্রী। সাবালিকা হবার পর রীতিমতো রেজিস্ট্রি করে তাকে বিয়ে করেছিল ইন্দ্র। ফলে, ইন্দ্রকুমার বুঝে নিয়েছিল, সুভদ্রার ঐ কুবেরিষিত সম্পত্তি গ্রাস করতে হলে দুজনের একজনকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে। হয় কুন্তী দোসাদ, ওরফে কুন্তী চৌধুরী, অথবা শিবু ঘোষাল। কুন্তীকে হত্যা করা অত্যন্ত কঠিন। হাসপাতালে প্রহরী আছে, অ্যাগির সতর্ক ব্যবস্থাপনা আছে, সর্বোপরি আছে ঘোষাল ডাক্তারের সন্দিগ্ধ দৃষ্টি। কারণ ইন্দ্র জানে যে, ঘোষাল জানে—ইন্দ্ৰ কুন্তী নামক আপদটাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে উন্মুখ। তাই ইন্দ্রকুমার বেছে নিল ঘোষালকেই। সে জানত, ঘোষাল অতটা আশঙ্কা করবে না—ইন্দ্রকুমার হয়তো কুন্তীর ক্ষতি করতে পারে, বঙ্কুর কোনো ক্ষতি করবে না।
অনুরাধা বললে, তাই বলে খুন! ও তো এমন ছিল না।
—না, ছিল না; কিংবা কে জানে, হয়তো ছিল। পাপের পথে যাবার সুযোগটা এতদিন পায়নি। এখন হঠাৎ দেখলো, রাজকন্যা আর অর্ধেক রাজত্ব লাভের পথে দুটি পর্বতপ্রমাণ বাধা : হিন্দু কোড় বিল আর বাল্যবঙ্কু ঘোষাল! হয়তো বছরখানেকের মধ্যেই আমরা খবর পেতাম ভুল করে সুভদ্রা বেশি পরিমাণে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলেছে। ধর্মপত্নীর দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুতে নটসূর্য বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ত—ঠিক যেমন সে পাগলের মতো কেঁদেছিল বাল্যবঙ্কু ঘোষালের অকালমৃত্যুতে।
ডি. আই. জি. বললেন, একটা সমস্যার সমাধান কিন্তু এখনো হয়নি বাসুকাকু। অ্যাবে বিল শবরিয়ার মৃত্যুটা…?
—সেটা নেহাৎই একটা ড্রেস-রিহার্সাল। মহড়া দিতে দিতে যখন ডিরেক্টরের আত্মবিশ্বাস এসে যায় যে, সে সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত হয়েছে, তখন সে একটা ‘ড্রেস রিহার্সালের’ আয়োজন করে। সমঝে নিতে চায় দর্শকমণ্ডলী তার হাতসাফাইটা ধরতে পারে কি না।
—শুধু সেজন্য একটা মানুষকে কেউ খুন করে?
—করে। করেছে। তবে ইন্দ্র একটা চান্সও নিয়েছিল। ইন্দ্রকুমার খুব ভালোভাবে জানত যে, ডাক্তার ঘোষাল সবচেয়ে পছন্দ করে ‘ভদ্কা-উইথ-লাইম’। অ্যাগি ডুরান্টের জবানবন্দিটা আবার একবার পড়ে দেখ বাচ্চু, সেও ঐ কথা বলেছে। ঘোষালের বাড়িতে ফ্রিজে ঐ একটা পানীয়ই থাকত—ভদ্কা’। তাই পুরীতে ইন্দ্রর নির্দেশে খিদ্মদ্গার যখন ট্রে নিয়ে ঘোষালের সামনে এসে দাঁড়ায় তখন ট্রেতে ছিল ছয়টা গ্লাস—আমার স্পষ্ট মনে আছে। তিনটে ছিল স্কচ-হুইস্কি—বাসন্তী রঙের, দুটো রম, নীলচে-কালো, আর একটি মাত্র পাত্রে ভদ্কা-উইথ- লাইম, সাদা! আততায়ী আশা করেছিল রঙ দেখেই ঘোষাল বুঝে নেবে একটাই ভদ্কা আছে। বড়জোর সে জিজ্ঞেস করতে পারে, ‘এটা কী? জিন নাকি?’—ইন্দ্ৰ জানে, ঘোষাল জিনে স্ট্যান্ড করতে পারত না। তাই তার নব্বই পার্সেন্ট আশা ছিল ঘোষাল স্বেচ্ছায় ভদ্কার গ্লাসটা তুলে নেবে। কিন্তু ঐ! রাখে কেষ্ট মারে কে? ঘোষাল তুলে নিল স্কচ, একটু সোডা মিশিয়ে নিল। নেক্সট বসেছিলাম আমি। নিলাম স্কচ-অন-রস্! খিদ্মদ্গার যখন অ্যাবে শবরিয়ার সামনে এসে দাঁড়ালো তখন ট্রের উপর ছিল দুটো রম, একটা হুইস্কি আর একটা ভদ্কা। মারে কেষ্ট রাখে কে? অ্যাবে স্বেচ্ছায় তুলে নিল হলাহল পাত্রটা!
সুজাতা জানতে চায়, ‘সুবর্ণরেখা’ হোটেলে টেলিফোন রেকনারটা ফেলে আসার উদ্দেশ্যও কি তাই? আর একটা বাড়তি প্রমাণ সংগ্রহ করে রাখা যে, ঐ ঘরে উনি ছিলেন?
—তা তো বটেই। দেখ ওর ধূর্তবুদ্ধি। বইটাতে নাম সই করেছে, কিন্তু ঠিকানা লেখেনি। আশা করেছে, কেউ না কেউ ওটা কাউন্টারে জমা দেবে। সেখানে ওর বাড়ির ঠিকানা আছে। হোটেল ম্যানেজারের কাছে চিঠি লিখে এবং খরচ পাঠিয়ে ওটা ডাকে ফেরত নেবে। আর একটা এভিডেন্স থাকবে ওর স্বপক্ষে। টুকাইয়ের সঙ্গে অহেতুক গায়ে পড়ে ঝগড়া করার উদ্দেশ্যটাও তাই। যাতে টুকাই সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ওকে চিনতে পারে—হ্যাঁ, ঐ ভদ্রলোকই ছিলেন সুবর্ণরেখা হোটেলে
বাসুসাহেব থামলেন।
সকলেই নীরব। ইন্দ্রকুমারের মুখটা দেখা যাচ্ছে না। সে ঘাড় গুঁজে বসে আছে। অনুরাধা—কী আশ্চর্য! মেয়েটা কি সত্যিই ভালোবেসেছিল ইন্দ্ৰকুমারকে?—যে ওকে ভাঙা পেয়ালার মতো আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল? কী জানি। হয়তো দীর্ঘ দুই দশকের অনেক হাসি-কান্নার স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে ওর। অনুরাধার দুই চোখে দুটি জলের ধারা। ব্রজদুলাল এখনো আঘাতটা সামলে উঠতে পারেননি।
বাসু জানতে চান, আর কারও কোনও প্রশ্ন আছে? কোনও অসঙ্গতি কি নজরে পড়ছে?
কেউ কোনো কথা বলে না।
হঠাৎ ছায়া পালিত বলে ওঠে, না, অসঙ্গতি কোনো কিছু নজরে পড়েনি, তবে আমার মনে হচ্ছে আপনি রঙের টেক্কাখানা এখনো টেবিলে নামিয়ে দেননি, মেসোমশাই।
বাসু বলেন, ও ইয়েস। আয়াম সো সরি, ছায়া! সেটার কথা বলা হয়নি। এবার বলি—
ইন্দ্রকুমারের দিকে ফিরে বললেন, এ পর্যন্ত যা বলেছি তা কনক্লুসিভ প্রুফ নয়। তোমার ল-ইয়ার তার ছিদ্র খুঁজে বার করতে পারবেন; কিন্তু এই চূড়ান্ত প্রমাণের কোনও ‘মার’ নেই। ঘটনাটা আপনারা শুনুন : ঘটনার রাত্রে ছায়ার সামনে যখন হারাধন ড্রিংস্-এর ট্রেটা নিয়ে হাজির হয় তখন ছায়া তাকে বলে কোনো একটা সফ্ট্ ড্রিংক্স্ তুলে দিতে, যাতে অ্যালকোহল নেই—যেমন, গোল্ড স্পট, সিট্রা, কোকোকোলা। কারণ কোন গ্লাসে কী আছে ও বুঝতে পারছিল না। হারাধন তখন ওর হাতে একটা ‘পেসি’র গ্লাস তুলে দেয়। এরপর ট্রে-হাতে ডক্টর ঘোষালের সামনে হারাধন এসে দাঁড়ায়। ছায়া তার জবানবন্দিতে আমাকে বলেছিল যে, তার স্পষ্ট মনে আছে : ট্রের ওপর তখন ছিল চার-পাঁচটা গ্লাস—হুইস্কি, রম, রেড-ওয়াইন, ভদ্কা। লক্ষণীয় ভদ্কা ছাড়া কোনোটাই সাদা রঙের নয়। এই সময় ঘোষাল হারাধনকে কী-একটা প্রশ্ন করেন—ঠিক ‘কী’ তা ছায়া শুনতে পায়নি। খুব সম্ভবত ডাক্তার ঐ সাদা রঙের গ্লাসটা দেখিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, পানীয়টা ‘জিন’ না ‘ভদ্কা’। কারণ জিন খেলেই ওঁর হেঁচকি উঠত। সম্ভবত হারাধন জানায় যে, ওটা ভদ্কা। হারাধন জানত : ঘোষাল ভদ্কার স্বাদ পছন্দ করেন। তাই ট্রেতে ঐ একটাই সাদা রঙের পানীয় ছিল—বিষমিশ্রিত ভদ্কা! ….ঘটনা হচ্ছে এই যে, ঘোষাল যখন প্রথম সিপ গিলেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তখন ছায়ার মনে হয়েছিল যে, সে অভিনয় করছে। তারপর যখন ছায়া বুঝতে পারলো ওটা অভিনয় নয়, ডক্টর ঘোষাল মারা গেছেন, তখনই সে ঐ সন্দেহজনক মানুষটার খোঁজ করে—হারাধন দাশ! ও রীতিমতো অবাক হয়ে যায় : লোকটা ঐ মারাত্মক ঘটনার মধ্যেই সরে পড়েছে! ছায়ার দৃঢ় সন্দেহ হয়—ঐ হারাধন দাশই এ-ক্ষেত্রে বিষমিশ্রিত পানীয়টা ঘোষালকে গছিয়ে দিয়েছিল। সে তৎক্ষণাৎ একটা কাজ করে। ওর হাতের পানীয়টা মাটিতে ঢেলে ফেলে দিয়ে গ্লাসটা ন্যাপকিনে মুড়ে নিজের ব্যাগে ভরে ফেলে। গ্লাসটা ও নিয়ে এসে আমাকে দিয়েছিল…
ডি. আই. জি. বার্ডওয়ান জানতে চান, তারপর?
—আমি আমার পরিচিত একজন এক্সপার্টকে দিয়ে ঐ গ্লাসের লেটেস্ট ফিঙ্গারপ্রিন্ট উদ্ধার করি। দেখা যায়—ছায়া পালিতের আঙুলের ছাপ ছাড়া কোনো একজন পুরুষের তিনটি আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। আমি সেই তিনটি ফিঙ্গারপ্রিন্টের ফটোকপি যুগলকিশোরকে পাঠিয়ে দিই। পঞ্চানন ঘড়াইয়ের যে ফিঙ্গারপ্রিন্ট জেল হাজতে আছে তার সঙ্গে মিলিয়ে বুঝতে পারি যে, হারাধন দাশ লোকটা পঞ্চানন ঘড়াই-এর যমজ ভাই হতে পারে, পঞ্চানন নয়!
—তারপর?
—সন্দেহজনক যে কয়জন লোক আছে তাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহ করতে শুরু করি। ইন্দ্রকুমার একদিন আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে, মধ্যাহ্ন ভোজন করে। আমরা কিছু প্রাগাহার মদ্যপানও করেছিলাম। ও যে গ্লাস থেকে পান করে সেটি ভালো করে মুছে নিয়ে ছিলাম আগে থেকেই। ফলে ইন্দ্রকুমারের আঙুলের সুস্পষ্ট ছাপ সংগ্রহ করা গেল। আমার পরিচিত এক্সপার্ট-এর মাধ্যমে। সেদিন থেকেই আমি নিশ্চিতভাবে জানি যে, ডক্টর ঘোষালের বাড়িতে হারাধনের ছদ্মবেশে যে লোকটা দেহরক্ষীর চাকরি করছিল, বাস্তবে সে ইন্দ্রকুমার চৌধুরী।
যুগলকিশোর বলে, কিন্তু আপনি তো সেকথা আমাকে জানাননি।
—না, জানাইনি। কারণ তখনও আমি বুঝে উঠতে পারিনি এই খুনের মূল উদ্দেশ্যটা কী। তখনো কুন্তী দোসাদের প্রকৃত পরিচয় এবং সুভদ্রার এনগেজমেন্টটার কথা আমার জানা ছিল না। …সুতরাং বলা চলে এ খেলায় রঙের টেক্কাখানা—আই মিন কনক্লুসিভ প্রমাণটা আমরা আদালতে দাখিল করতে পারব শ্রীমতী ছায়া পালিতের উপস্থিত বুদ্ধির জন্য। আর কেউ কিছু বলবেন?
এবার আর কেউ কিছু বললো না।
বাসু নিজে থেকেই বলেন, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলমেন! আমরা সবাই এখানে সমবেত হয়েছিলাম একটি আনন্দসন্ধ্যা উদ্যাপন করতে। দুর্ভাগ্য আমাদের : আসরটা শেষ হলো একটা বেদনাদায়ক পরিবেশে। উপায় নেই। অ্যাবে বিল শবরিয়া এবং ডক্টর শিবশঙ্কর ঘোষাল দুজনকেই আমি বঙ্কু বলে স্বীকার করে নিয়েছিলাম। তাদের প্রতি আমার যেটুকু বঙ্কুকৃত্য ছিল তা আমি পালন করেছি। ইন্দ্রকুমারও আমার বঙ্কু ছিল এক সময়, স্নেহভাজন ছিল—এখন তা নয়। তবে আজ রাত্রে সে আমার নিমন্ত্রিত অতিথি। তাই আমি আমার সব কয়টা তাস তার সামনে মেলে ধরেছি। কীভাবে ধীরে ধীরে, ধাপে-ধাপে তাকে আমি চিহ্নিত করেছি, কী কারণে আজ তাকে পুলিসের হাতে তুলে দিচ্ছি তা খোলাখুলি জানিয়েছি। যাতে সে তার ডিফেন্স কাউন্সেলের সঙ্গে পরামর্শ করে আত্মরক্ষায় সচেষ্ট হতে পারে। আমি বিচারক নই। কিন্তু আইন কিছুটা বুঝি। এই পৈশাচিক অপরাধের—স্থিরমস্তিষ্কে যুগ্মহত্যার অপরাধের—একটিমাত্র শাস্তিই বিধেয়। তাই লোয়ার কোর্টে যদি আসামীর ‘যাবজ্জীবনের’ মেয়াদ হয়, তাহলে আমি থামতে পারব না। এ কোনো প্রতিশোধস্পৃহায় নয়, এ আমার বঙ্কুকৃত্য! উপরে, আরও উপরে সুপ্রীম কোর্ট পর্যন্ত বাদীপক্ষকে টেনে নিয়ে যাব—যতদিন না ন্যায়াধীশের কণ্ঠে এই অমানুষিক বিশ্বাসঘাতকতার জন্য নির্দিষ্ট চরম দণ্ডাদেশটা ধ্বনিত হয় : দ্যাট দ্য গিল্টি পার্সন শ্যাল বি হ্যাঙড্ বাই দ্য নেক, আনটিল…
বাসু থামলেন।
নিস্তব্ধতা ঘনিয়ে এল আবার।
দূরে বেতারে কেউ বাঁশী বাজাচ্ছে, আশাবরীতে। সম্ভবত আকাশবাণীতে। বাসু আবার শুরু করলেন—গুরুগম্ভীর কিন্তু নিচু গলায় : লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলমেন! আমি এবার আপনাদের অনুরোধ করব একটু উঠে দাঁড়াতে। আমাদের পরিচিত দুই প্রয়াত প্রিয় বঙ্কুর আত্মার সদগতি কামনায়… না, না, রানু! প্লিজ! তোমাকে বলিনি! পরম করুণাময় তোমার সে অধিকার কেড়ে নিয়েছেন। তুমি বসে বসেই ওঁদের আত্মার সদগতি কামনা করবে।
রানু দু হাতে মুখটা ঢাকলেন।
বাসুসাহেবের শেষ ভবিষ্যদ্বাণীটা কিন্তু সফল হলো না। সবাই উঠে দাঁড়াল; কিন্তু শুধু রানু দেবী নয়, আরও একজন দু পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারল না। পাপের ভারে বেচারি আচমকা প্রতিবন্ধীতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। মৃত্যুভীত মানুষটা দু হাতে মুখখানা ঢেকে শব্দহীন কান্নায় ভেঙে পড়ল চেয়ারে বসেই!
সবাই মুদিতনেত্র। তাই কেউ দেখতে পেল না দৃশ্যটা :
যৌবনোত্তীর্ণা এক উপেক্ষিতা নারীর শীতল হাত আস্তে আস্তে নেমে এল ঐ মৃত্যুপথযাত্রীর পিঠে—নিঃশব্দ সহানুভূতিতে।