ড্রেস-রিহার্সালের কাঁটা – ১৬

ষোলো

সাত তারিখে, মঙ্গলবার। অর্থাৎ কৌশিক-সুজাতা যে রাত্রে ঘাটশিলা থেকে ফিরে আসে তার দু-দিন পরের কথা। সকালের দিকেই একটা টেলিফোন এল। ধরলেন রানু। ওপ্রান্ত থেকে কথা বলছে অনুরাধা বসু : বাসুসাহেব আছেন?

রানু লাইনটা চেম্বারের এক্সটেনশনে দিয়ে দিলেন। বাসু বললেন, হ্যাঁ বল, অনুরাধা? তুমি আমাকে খুঁজছ? বিষয়টা কি ঘোষালের মৃত্যু- সংক্রান্ত?

—আজ্ঞে না। সমস্যাটা আমার নিজের। একটু আইন বিষয়ে পরামর্শের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কিন্তু আমার সামান্য উপার্জনে

বাসু ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলেন, এসব কী বলছ, অনু? মেসোমশায়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে পয়সা খরচ করতে হয় নাকি? তুমি কোথা থেকে ফোন করছ? তোমার বাড়িতে টেলিফোন আছে?

—আজ্ঞে না, নেই। আমি ফোন করছি আমার বাসাবাড়ির কাছাকাছি একটা টেলিফোন বুথ থেকে।

—কলকাতার কোন অঞ্চলে থাক তুমি?

—মদন বড়াল লেনে। বউবাজার অঞ্চলে।

—ঠিক আছে। তুমি চলে এস। আমি ফ্রি আছি। বাসে আসবে তো? নিউ আলিপুরে আসার সরাসরি বাস আছে?

সেসব আপনাকে ভাবতে হবে না, মেসোমশাই। আপনার বাড়ি আমি চিনি। মিনিট দশ-পনের সময় আপনার নষ্ট করব। আমি এক ঘণ্টার মধ্যে আসছি।

—এস।—লাইনটা কেটে দিলেন বাসুসাহেব।

আটাশে অক্টোবর, শনিবার, ঘোষাল ডাক্তারের বাড়ির পার্টিতে অনুরাধা উপস্থিত ছিল। জয়ন্ত মহাপাত্রের সঙ্গে সে এক ট্রেনে যায়। ফিরে আসে পরদিন ছায়া পালিতের গাড়িতে। বাসুসাহেব তার জবানবন্দি পড়েছেন। তার সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজন বোধ করেননি। এখন সে নিজে থেকেই ফোন করছে।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সে হাজির। সরাসরি তার সমস্যার কথায় এল অনুরাধা :

সে ‘নটরঙ্গ’ ছেড়ে দিচ্ছে। ওর সঙ্গে ব্রজদুলালের যে কন্ট্রাক্ট ছিল তাতে কোনও নাটক চলাকালে—যে নাটকে ওর পার্ট করছে—ও নটরঙ্গ ত্যাগ করতে পারে না। সেক্ষেত্রে ওকে মোটা খেসারত দিতে হবে। কিন্তু এখন যেহেতু কোনও নাটক চালু নেই—দু-পক্ষই পনের দিনের নোটিশে কন্ট্রাক্টে সমাপ্তিরেখা টানতে পারে। অনুরাধা এই সপ্তাহেই নটরঙ্গকে নোটিশ দিয়েছে—সে আর ঐ পাবলিক-বোর্ডে অভিনয় করবে না। হেতুটাও সে অকপটে স্বীকার করলো : ব্রজদুলাল আগামী নাটক ‘প্রবঞ্চক’-এ অনুরাধাকে দিয়েছেন সহনায়িকার ছোট চরিত্র এবং সুভদ্রাকে নায়িকার। অনুরাধা সেটা মেনে নিতে পারছে না। সুভদ্রা নভিস, অনুরাধা দীর্ঘদিনের মঞ্চসফল নায়িকা! সে অপমানিত বোধ করেছে।

বাসু জানতে চান : তাহলে কী করবে এবার?

—যাত্রায় যাব। তিন-চারটি যাত্রা-পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছি। যার অফার সবচেয়ে ভালো মনে হবে সেখানেই যাব। না—মেসোমশাই, সেসব নিয়ে আপনাকে বিরক্ত করতে আসিনি। এসব ব্যাপার আমাদের জলভাত! যাত্রা-থিয়েটার-সিনেমার চুক্তিগুলো।

—তাহলে কিসের পরামর্শ চাইতে এসেছ আমার কাছে?

অনুরাধা সঙ্কোচ করে না। জানে, ডাক্তার আর উকিলের কাছে সত্যগোপন করলে নিজেরই ক্ষতি। তাই অকপটে সে সব কথা স্বীকার করে। অনুরাধার বয়স বর্তমানে ছেচল্লিশ। মদন বড়াল লেনের ঐ বাড়িটায় সে ভাড়া আছে ত্রিশ বছর ধরে। পঁয়ষট্টি সালে ঐ দু-কামরার বাড়িটা ইন্দ্রকুমার ভাড়া নিয়েছিল আশি টাকা ভাড়ায়। বাড়িওয়ালাকে বলেছিল, বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে সে ভালোবেসে বিয়ে করেছে, মাথা গোঁজার ঠাঁই পাচ্ছে না। বাড়িওয়ালা প্রথমে রাজি হয়নি; কিন্তু পরে ইন্দ্রকুমারের সদ্যোবিবাহিতা বধূকে দেখে রাজি হয়ে যায়! স্বামী-স্ত্রী পরিচয়েই ওরা থাকত, ঐ বাড়িতে। বাড়িঅলা একাত্তর সালে মারা যান। তিনি এই বিশ্বাস নিয়েই প্রয়াত হয়েছিলেন যে, ইন্দ্র আর অনু স্বামী-স্ত্রী। তারপর ইন্দ্র বোধকরি মোহমুক্ত হয়—শ্যামপুকুরে বাসা ভাড়া করে উঠে যায়। বাড়িওয়ালার বিধবা অনুকে মেয়ের মতো ভালোবাসতেন যদিও ভাড়াটের নাম ইন্দ্রকুমার চৌধুরী তবু ইন্দ্রকুমার ও বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর থেকে তিনি অনুরাধাদেবীর নামেই বরাবর রসিদ কেটে গেছেন। সম্প্রতি সেই ভদ্রমহিলাও গত হয়েছেন। তাঁর দুই ছেলে—তারা জানে যে, অনুরাধা ইন্দ্রকুমারের বৈধ স্ত্রী নয়—এখন ভাড়াটে উচ্ছেদের জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে। অনু জানতে চায়—তার কী করণীয়? কতটা তার অধিকার?

বাসু বলেন—তুমি কি মাস-মাস ভাড়া দিয়ে রসিদ নিচ্ছ?

—হ্যাঁ। মাসিমা মারা যাবার পর ওরা ভাড়া নিতে অস্বীকার করায়, রেন্ট-কন্ট্রোলে জমা দিচ্ছি। মাসিক আশি টাকা। ওরা আমার ইলেকট্রিক লাইন কেটে দিয়েছে। রাস্তার মাঝখানে জামাকাপড় খুলে নেবে বলে ক্রমাগত শাসাচ্ছে।

—ইন্দ্ৰ কী বলছে?

—সে আবার কী বলবে? নতুন ‘গুড়িয়া’ পেয়ে সে তো আপনমনে পুতুলখেলায় মেতেছে। সে তো একা থাকে, শ্যামপুকুরে।

—বুঝলাম। তুমি নির্ভাবনায় থাক, অনু। আমি পুলিসের এক বড়কর্তাকে বলে দেব। পুলিস বাড়িওয়ালার দুই ছেলেকে থানায় ডেকে পাঠাবে। আচ্ছা করে কড়কে দেবে। তুমি একটা কাগজে ওদের নাম, বয়স, বাপের নাম, ঠিকানা সব লিখে দিয়ে যাও। ওরা কোনোরকম চ্যাংড়ামো করলেই আমাকে টেলিফোন করবে। তবে, ঐ আশি টাকা ভাড়াটা বাড়িয়ে নিজে থেকেই তুমি ওটা একশ টাকা করে দিও। যাত্রায় গেলে সেটা তোমার পক্ষে অসম্ভব হবে না নিশ্চয়।

—আজ্ঞে না। একশ তো হওয়াই উচিত। ও পাড়ায় এখন ঐ রকম একটা ফ্ল্যাট সাত- আটশ টাকাতেও পাওয়া যাবে না।

বাসু বলেন, একটা কথা অনুরাধা। ইন্দ্রের সঙ্গে তোমার কতদিনের পরিচয়?

—ঐ ত্রিশ-বত্রিশ বছরই হবে। আমার বয়স তখন পনের-ষোলো। ওই আমাকে এ লাইনে নিয়ে আসে।

—ইন্দ্র কতদূর লেখাপড়া জানে? কদ্দূর পড়েছে ও?

—থার্ড ডিভিশনের ম্যাট্রিক। তারপর আর পড়েনি। কলেজে ফার্স্ট-ইয়ারে ভর্তিও হয়েছিল—কিন্তু পড়াশোনা চালাতে পারেনি। স্কুলে থাকতেই একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে বিয়ে করে। বাড়ি ছেড়ে পালায়।

—বিয়ে করে? বল কী! তুমি কী করে জানলে?

–ইন্দ্র নিজেই গল্প করেছিল। ওর বিবাহিত জীবন মাত্র দু বছরের। সন্তান হতে গিয়ে ওর বউ মারা যায়। সন্তানটাও বাঁচেনি। তার পরেই আমার সঙ্গে আলাপ। আমরা থিয়েটারে নামি। বাসু বলেন, ওর সেই বউকে তুমি নিশ্চয় দেখনি, কিন্তু তার কোনও ফটোগ্রাফ দেখেছ?

—দেখেছি। তবে আমার কাছে নেই। ইন্দ্রর অ্যালবামে আছে।

—তুমি ওর ম্যাট্রিক সার্টিফিকেটটা দেখেছ, অনু?

—না! কেন বলুন তো?

—তবে কেমন করে জানলে যে, সে ম্যাট্রিক পাস?

–ও নিজেই বলেছিল। অনেকদিন আগে। কেন বলুন তো?

—ঠিক আছে। তুমি বরং এই কাগজখানায় আমাকে একটা চিঠি লেখ, তোমার সমস্যার কথা জানিয়ে। মানে, বাড়িওয়ালার দুই ছেলে তোমাকে কীভাবে শাসিয়েছে তা জানিয়ে। ঐ সঙ্গে ওদের নাম, বাবার নাম উল্লেখ কর।

অনুরাধা ইতস্তত করে বললো, তার চেয়ে এক কাজ করুন, মেসোমশাই। আপনি ধীরে দীরে ডিকটেশন দিন। আমি শুনে শুনে লিখে ফেলি। গুছিয়ে চিঠি লেখার অভ্যাস তো নেই!

—অলরাইট! লেখ তাহলে—

.

এরপর এলেন ব্রজদুলাল আর ইন্দ্রকুমার। নিজেদের গাড়িতে। অশোক ড্রাইভ করে আসেনি। নিয়ে এসেছে নটরঙ্গের পেশাদার ড্রাইভার। বাসু ওদের দুজনকেই আপ্যায়ন করে বসালেন। বললেন, বলুন কী খবর?

ব্রজদুলাল বলেন, সে কি, স্যার! লেটেস্ট খবর আপনি জানেন না?

–কী লেটেস্ট খবর? বিল শবরিয়া সংক্রান্ত, না পঞ্চাননের ধরা পড়ার খবর?

ইন্দ্র বলে, ওসব কিছু নয়। লেটেস্ট খবর হচ্ছে আজ ভোর রাতে আমাদের চারজনের বাড়িতে পুলিসের রেইড হলো যে। অবশ্য ঘণ্টা-দুয়েকের মধ্যেই রেহাই দিয়েছে।

বাসু জানতে চান, ‘চারজন’ মানে?

ইন্দ্রকুমার বলে, আমার, ব্রজদার, ওদিকে অ্যানেসের আর ডক্টর দাশের।

বাসু বলেন, ওঁদের দুজনের বাড়ি যে রেইড হয়েছে তা জানা গেল কীভাবে?

—কী করে আবার? টেলিফোন করে!

বাসু জানতে চাইলেন, পুলিস সার্চ-ওয়ারেন্ট নিয়ে এসেছিল তো?

ব্রজদুলাল বললেন, অফকোর্স! ইন্দ্র করেছে কি না জানি না, আমি আমার সাংবিধানিক অধিকার পুরোপুরি আদায় করে নিয়েছি। সার্চের আগে পুলিসদের সার্চ করে নিয়েছে।

মিসেস্ বাসু বলেন, কী খাবেন বলুন, চা না কফি?

ব্রজ বলেন, যা ঘোল খেয়েছি, আজ আর কিছু খাব না। তবে বাসুসাহেব অনুমতি করলে গাড়িতে আমার ভদ্‌কার একটা বোতল আছে–

বাসু কথাটা চাপা দিয়ে বললেন, পুলিসে কিছু ‘সিজ’ করেছে নাকি?

ব্রজ বলেন, করেছে। কিছু খাতাপত্র, ডায়েরি, নটরঙ্গের ফটো অ্যালবাম, আর আমার পাসপোর্টখানা।

বাসু জানতে চান, আপনি কি বছর দশকের মধ্যে জাকার্তা গিয়েছিলেন ব্রজবাবু?

—হ্যাঁ গিয়েছিলাম। বরবুদারের মন্দির দেখতে। কেন বলুন তো?

বাসু সেকথার জবাব না দিয়ে ইন্দ্রকুমারের দিকে ফিরে বললেন, তোমার কি কিছু ‘সিজ’ করেছে?

—হ্যাঁ, দু-একটা ডায়েরি। ফটো অ্যালবাম।

—পাসপোর্ট?

—না, সেটা দেখেছে। সিজ করেনি। দেখে, ফেরত দিয়েছে।

বাসু দুঃখপ্রকাশ করলেন : পুলিসের ‘নেই কাজ তো খই ভাজ!’

ব্রজদুলাল বললেন, কিন্তু ‘ভদ্‌কা’র ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত হলো?

বাসু বললেন, আমি খাব না। আপনারা দুজনে খেতে চান তো বলুন। আমি স্ন্যাকস্, বরফ ইত্যাদি আনিয়ে দিচ্ছি।

ইন্দ্র বলে, না, না, তাহলে আজ বরং থাক। দাদার যখন মুড নেই।

—সত্যিই মুড নেই, ইন্দ্র। নিশ্চয় তোমরা বুঝতে পারছ—পুলিস এত লোক থাকতে কেন বেছে বেছে তোমাদের চারজনকে সার্চ করলো?

ব্রজদুলাল ইন্দ্রের হয়ে জবাবটা দাখিল করেন, পুলিসের ধারণা ‘হারাধন’কে যে রেকমেন্ড করেছে, সে ঘোষালের খুব কাছের লোক ছিল—খুব বিশ্বাসী লোক।

ইন্দ্রকুমার বলে, অবভিয়াসলি। কিন্তু ঐ লোকটা—কী যেন নাম?—পচাই। সে এখনো ধরা পড়েনি?

বাসু বললেন, এখনো কোনো খবর নেই।

হঠাৎ টেলিফোনটা বেজে উঠলো। বাসু তুলে নিয়ে শুনলেন। বললেন, এখন ব্যস্ত আছি। একটু পরে রিং-ব্যাক করব। টেলিফোনের কাছাকাছিই থেক।

ব্রজ আর ইন্দ্রের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় হলো। শেষে ব্রজদুলাল বললেন, আজ তাহলে আমরা উঠি বাসুসাহেব। ঐ সার্চের খবরটা আপনাকে জানাতে এসেছিলাম। আর পাণ্ডেসাহেবের ‘এথি’র ব্যাপারে আপনার পরামর্শটা জানতে চাই।

বাসু বললেন, সরি, ব্রজবাবু। ঐ ‘এথি’ বা ‘পান-খাওয়ানোর ব্যাপারটা আমি ভালো বুঝি না। সুকৌশলীর সঙ্গে কথা বলুন। ওরা বোধহয় ওদিকের উইং-এ ঘরেই আছে।

ওঁরা চলে যাবার পর বাসু ফোন করলেন চুঁচুড়ায়। অ্যাগিকে বললেন, ঐ সময় আমার ঘরে লোক ছিল বলে কথা বলতে পারিনি।

অ্যাগি বলেন, সেটা আন্দাজ করেছি। তা লেটেস্ট খবর শুনেছেন?

—হ্যাঁ, তোমার আর ডাক্তার দাশের বাড়ি সার্চ হওয়া তো? পুলিসে কি কিছু ‘সিজ’ করেছে?

—না। আমি আপত্তি করেছিলাম। বলেছিলাম, সার্চ ওয়ারেন্টের কাগজে ‘সিজ’ করার কথা কিছু নেই। পুলিস জোর করে তা করলে একটা ‘আন্ডারটেকিং’ দিতে হবে যে, এই হাসপাতালের সমস্ত রোগীর জিম্মাদারী পুলিস নিচ্ছে। কারণ বিভিন্ন রেজিস্ট্রি ও ডায়েরিতে বিভিন্ন রোগীর কেস হিস্ট্রি লেখা আছে। তা শুনে ওরা কিছু সিজ করেনি।

—ভেরি গুড। তোমার পাসপোর্ট?

—হ্যাঁ, দেখতে চেয়েছিল। দেখে ফেরত দিয়ে গেছে। আচ্ছা পাসপোর্ট দেখতে চাইল কেন?

—ঠিক জানি না। আন্দাজ করছি, পুলিস জানতে চায় তোমাদের চারজনের মধ্যে কেউ কখনো ইন্দোনেশিয়া গেছ কি না। তুমি গিয়েছিলে?

—না। আমি ক্রমশ হাল ছেড়ে দিচ্ছি, মিস্টার বাসু!

বাসু বললেন, আমি তোমার সঙ্গে একমত নই। আমার তো মনে হচ্ছে, আমরা ক্রমশ জাল গুটিয়ে আনতে পারছি। আমার বিশ্বাস, আর এক সপ্তাহের মধ্যেই মার্ডারার ধরা পড়বে।

—য়ু মিন পঞ্চানন ঘড়াই?

—নিশ্চয় নয়। পঞ্চানন তো একটা সীসের বল! যে লোকটা দূর থেকে ট্রিগারটা টেনেছে, আমি তার কথা বলছি।

—আপনি কিছু আন্দাজ করতে পারছেন?

—তাই তো মনে হয়। কিন্তু টেলিফোনে এসব কথা আলোচনা করা ঠিক নয়। ডক্টর দাশের বাড়ি থেকে পুলিস কিছু সিজ করেছে?

—না। আপত্তিকর কিছু পায়নি। ‘সিজ’ও করেনি।

—হতাশ হয়ো না, অ্যাগি। জাল ক্রমশ গুটিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

.

পরের সপ্তাহের কথা। ষোলো তারিখ, বৃহস্পতিবার। ইতিমধ্যে চিনসুরা থেকে যুগলকিশোরের একটা জরুরি কল এসেছিল। গুরুত্ব বুঝে রানু কলটা বাসুসাহেবের ঘরে ট্রান্সফার করে দিলেন। ইচ্ছে করলে তিনি এক্সটেনশনে ওদের কথোপকথন শুনতে পারতেন, কিন্তু শুনলেন না।

তার কিছুক্ষণ পরে বাসুসাহেব সবাইকে ওঁর চেম্বারে ডেকে পাঠালেন। সুজাতা-কৌশিক বাড়ির অপর অংশ থেকে এসে বসলো বাসুসাহেবের প্রাইভেট চেম্বারে। বিশ্বনাথ রইলো দ্বারপালের ভূমিকায়।

বাসু বললেন, পরিস্থিতি কিছুটা বদলে গেছে। মনে হচ্ছে আমরা যেভাবে অগ্রসর হচ্ছিলাম সে-ভাবে সমস্যার সমাধানে পৌঁছনো যাবে না। ইন্দ্রকুমারের অ্যালেবাঈটা যাচাই করা গেছে। তবু আমি তাকে সন্দেহ-তালিকার বাইরে রাখতে পারছি না। কারণ স্বহস্তে খুনটা তো করেছে পঞ্চানন। ফলে রিমোট কন্ট্রোলে কে কী করেছে বলা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে দু-দুটি মারাত্মক ডেভেলপমেন্ট হয়েছে। তা তোমরা জান না, আমি জানি। যুগল আমাকে টেলিফোনে জানিয়েছে। আমি সবার আগে তথ্যগুলো তোমাদের সামনে প্লেস করতে চাই। তারপর যুক্তি করে ঐ চারজনের বিরুদ্ধেই অপক্ষপাতে আমাদের সন্ধান করতে হবে। প্রথম খবর : ওড়িশা স্বরাষ্ট্র বিভাগ থেকে টেলেক্স করে পশ্চিমবঙ্গ স্বরাষ্ট্র বিভাগকে জানানো হয়েছে যে, অ্যাবে উইলিয়াম শবরিয়ার মৃত্যু হার্টফেল করে হয়নি। হয়েছে একটি তীব্র বিষের ক্রিয়ায়। সেই একই নিকোটিন-ডেরিভেটিভের অস্তিত্ব তার দেহে পাওয়া গেছে। সুতরাং মিলিয়ান-টু-ওয়ান চান্সও আর থাকল না যে, এ দুটি হত্যাকাণ্ড বিক্ষিপ্ত ঘটনা। দুজন পৃথক অপরাধীর সম্পর্ক- বিরহিত কাজ। কারণ ঐ নিকোটিন-ডেরিভেটিভ ভারতে দুষ্প্রাপ্য। সামান্য আমদানি করা হয় ইন্দোনেশিয়া থেকে, গবেষণামূলক কাজে।

সুজাতা বলে, তার অর্থ : আপনি যে চারজনকে প্রাথমিকভাবে সন্দেহ করেছিলেন তা থেকে দুজনকে বাদ দিতে হয়। মিস্ অ্যাগনেস ডুরান্ট আর ডক্টর দাশ। তাঁরা অ্যাবে শবরিয়াকে চিনতেনই না।

কৌশিক বললে, সে বিচার করলে ইন্দ্রকুমারকেও বাদ দিতে হয়। তিনিও প্র্যাকটিক্যালি অ্যাবে শবরিয়াকে চিনতেন না। ঐ বারই পুরী গিয়ে প্রথম চিনলেন। বরং গুণবতী দেবীকে ইনক্লুড করতে হয়। কারণ তিনি দুজনকেই ভালোভাবে চিনতে

রানু বলেন, দুজনকে তো ব্রজবাবুও ভালোভাবে চিনতেন।

সুজাতা বলে, তা ঠিক। প্রথম কথা : পাসপোর্টে দেখা গেছে ব্রজবাবুই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ইন্দোনেশিয়ায় গেছেন। দ্বিতীয় কথা : এটা চিন্তাই করা যায় না যে, গুণবতী মোহান্তি পঞ্চানন ঘড়াইকে রেকমেন্ড করেছিলেন, আর ডাক্তারবাবু সেটা বিনা বিচারে মেনে নিয়েছিলেন।

রানু বাসুসাহেবকে বলেন, তুমি দুটো মারাত্মক ডেভেলপমেন্টের কথা বলেছ। একটা তো হলো। দ্বিতীয়টা কী?

—দ্বিতীয় খবরটাও যুগলকিশোরের সরবরাহ করা। পঞ্চানন ঘড়াই ধরা পড়েছে। বেগুসরাই স্টেশনে। বিহার সরকার তাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিচ্ছে।

কৌশিক বলে, কিন্তু আমরা তো পাণ্ডেসাহেবকে দশ হাজার টাকার ‘ইয়ে টা—

—না! ইন্দ্রকুমারের বাল্যবঙ্কু পাণ্ডেসাহেব ছাড়াও বিহার পুলিসে কিছু সৎলোক যে আছেন এটা তার প্রমাণ। পঞ্চানন আগামীকাল এসে যাবে। যুগল গাড়ি নিয়ে কাল বিকালে আসবে। আমাকে জেল হাজতে নিয়ে যাবে, পঞ্চাননকে জেরা করায় সাহায্য করতে।

রানু বলেন, মোটমাট পরিস্থিতিটা কী দাঁড়ালো?

বাসু বলেন, খুব ঘোরালো। আমাদের হাতে যথেষ্ট ‘ডাটা’ নেই, অথচ অনেকগুলো তথ্য আছে যার যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা নেই। ঐসব আপাত-অসঙ্গত ‘ফ্যাক্ট’গুলোর বিষয়ে প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করার আগে এ রহস্যের জট ছাড়ানো যাবে না।

সুজাতা বলে, কী কী অসঙ্গতি আপনি একে এক বলুন। আমরা নোট করি!

—এক নম্বর : গুণবতী মোহান্তি একটি ঘাঘু মহিলা। তিনি সবিশেষ অবগত আছেন যে, বিল শবরিয়ার দেহে বিষের অস্তিত্ব প্রমাণিত হলে তাঁর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হবে না। সে-ক্ষেত্রে তিনি এমন মরিয়া হয়ে ঐ মৃতদেহটা কবর থেকে ওঠানোতে আপত্তি করছেন কেন? কেন তাঁর মেয়ে বলে গেল এজন্য গুণবতী পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ করতে প্রস্তুত? কেঁচো খুঁড়তে কী সাপ বের হয়ে পড়ার ভয় করছেন মিসেস্ মোহান্তি?

—দু নম্বর : ঘোষাল পুরীতে আমাদের বলেছিল—ইন্দ্রকুমার তার সহপাঠী। দুজনে একই বছরে ম্যাট্রিক পাস করে এবং ইন্দ্র পাস করেছিল থার্ড ডিভিশনে। একথাটা অনুরাধা বোসের কাছেও ইন্দ্র স্বীকার করেছিল—আমি জানি। অথচ ইন্দ্র নিজে বলছে, সে নন্-ম্যাট্রিক। কেন? হোয়াই?

—তিন নম্বর : ডক্টর ঘোষাল অমন তাড়াহুড়া করে একটা পার্টি থ্রো করলো কার পরামর্শে? কী উদ্দেশ্যে? কেন সে বেছে বেছে পুরী-পার্টির সব কয়টি লোককে যোগাড় করার চেষ্টা করেছিল? তার আস্তিনের তলায় একটা ‘মজারু’ লুকনো ছিল—এ কথা সে টেলিফোনে ছায়া পালিতকে বলে। সেই ‘মজারুটা কী?

—চার নম্বর : অত্যন্ত দামী বিষের প্রয়োগে দু-দুটো মানুষ খুন হলো, কিন্তু কেউ কোনোভাবে লাভবান হলো না। তাহলে হত্যাকারীর মূল উদ্দেশ্যটা কী? ‘মোটিভ টা কী?

কৌশিক বলে, আচ্ছা মামু, এমন কি হতে পারে না যে, হত্যাকারী পুরীর পার্টিতে আসলে ডক্টর ঘোষালকেই হত্যা করতে চেয়েছিল। অ্যাবে শবরিয়া ভুল করে ঐ বিষের গ্লাসটা তুলে নেন?

বাসু বলেন, না কৌশিক, এমনটা ঘটতে পারে না। তুমি সেদিন ঘটনাস্থলে ছিলে না। আমি ছিলাম। সুজাতাও ছিল। তার নিশ্চয় মনে আছে, কী ভাবে ড্রিংসগুলো পরিবেশিত হচ্ছিলো। আমরা তেরজনে মিলে নাহোক ত্রিশ-চল্লিশ পেগ পান করেছি। তার ভিতর মাত্র একটিতে ছিল তরল মৃত্যু! কিন্তু পরিবেশকেরা ট্রেতে করে পাঁচ-সাতটি গ্লাস নিয়ে ঘুরছিল। ফলে এই ব্যবস্থাপনায় আততায়ী কিছুতেই নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট গ্লাস ধরিয়ে দিতে পারে না। আমাদের অনেকের স্পষ্ট মনে আছে যে, অ্যাবে শবরিয়া যখন ট্রে থেকে গ্লাসটা তুলে নেন তখন ট্রের ওপর চার-পাঁচটি গ্লাস ছিল। তিনি তা থেকে ইচ্ছা মতো একটা গ্লাস তুলে নেন। কেউ এখানে ‘ফোর্সিং কার্ড’-এর ম্যাজিক দেখায়নি। আততায়ী যদি নিজেও আমাদের সঙ্গে পান করে থাকে, তাহলে তার নিজের পক্ষে বিষপানে মৃত্যুর সম্ভাবনা ছিল সমান—যতটা ছিল শবরিয়ার, ইন্দ্রের, ব্রজবাবুর, আমার, বা ঘোষালের।

কৌশিক বলে, তাহলে তো খোঁজ নিয়ে জানতে হয়—কে কে সেদিন ড্রিংক করেনি।

—না, কৌশিক। ওভাবে হবে না। আততায়ী কীভাবে নিজেকে রক্ষা করেছে সেটাই শেষ কথা নয়। আমাদের বুঝে নিতে হবে, কে কোন উদ্দেশ্যে ত্রিশ-চল্লিশটা পানপাত্রের মধ্যে একটা তীব্র বিষের গ্লাস মিশিয়ে দিয়েছিল! কেন? হয়তো বিল শবরিয়াকে সে মারতে চায়নি—কিন্তু কোনো একজন তো মারা যাবেই! এটা কেন? নিজে সে মদ্যপান করে থাকতেও পারে। ট্রে থেকে গ্লাস না উঠিয়ে সরাসরি বোতল থেকে ঢেলে। অনেকেই সেভাবে সার্ভার্স টেবিলে গিয়ে পছন্দমতো কক্‌টেল বানিয়ে নিচ্ছিলেন। অন্তত হুইস্কির সঙ্গে সোডা ইচ্ছামতো মিশিয়ে নিয়ে এসে পান করছিলেন। সেভাবে সে মদ্যপান করেও বিষের গ্লাসটা এড়িয়ে যেতে পারে।

সুজাতা বলে, তাহলে আপনি কী করতে চান?

বাসু বলেন, ‘সুকৌশলী’র মাধ্যমে দুটো তদন্ত আমাকে করাতে হবে। একটা হচ্ছে : বিল শবরিয়া সংক্রান্ত। কেন গুণবতী কেঁচো খুঁড়তে দিতে রাজি নয়? বস্তুত সাপটা কী? সেটা সরেজমিন তদন্ত করতে হলে তোমাদের দুজনকে যেতে হবে—পুরী, ভুবনেশ্বর, গুনপুর। কিন্তু সেটা হপ্তাখানেক পরে করাই বিধেয়। কারণ আমাদের দেখা দরকার বিল শবরিয়ার বিষপ্রয়োগে মৃত্যুর কথা জেনে ওড়িশার পুলিস কী করে। দ্বিতীয় তদন্তটা করতে হবে ধানবাদে : সমঝে নিতে হবে, কেন ডাক্তার ঘোষালের সঙ্গে ইন্দ্রকুমারের কথার মিল হলো না। ওরা কি সহপাঠী? বয়স ভাঁড়ানোর প্রয়োজনে সেটা ইন্দ্রকুমার অস্বীকার করতে পারে; কিন্তু সে কেন আমাকে বললো যে, সে নন্-ম্যাট্রিক? অথচ বহুদিন পূর্বে অনুরাধাকে সে বলেছিল যে, সে ম্যাট্রিক পাস।

কৌশিক বলে, তার সঙ্গে এ হত্যারহস্যের কী সম্পর্ক?

—জানি না। তবে মনে হয়, এভাবে অসঙ্গতিগুলোর জট ছাড়াতে ছাড়াতেই আমরা সমাধানে পৌঁছব। সুতরাং সম্ভব হলে তোমরা দুজন আজই ধানবাদ রওনা হয়ে যাও। চিরাগোড়া বয়েজ স্কুলের রেকর্ড খতিয়ে দেখ। দেখ, ইন্দ্রকুমার অথবা শিবশঙ্করের বাল্য- কৈশোরের কোনও অনুদঘাটিত তথ্য সংগ্রহ করতে পার কিনা। প্রথম কথা, সঠিক জেনে এস : ইন্দ্রকুমার কি একষট্টি সালে থার্ড ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাস করেছিল?

.

ধানবাদ স্টেশনে রিটায়ারিং রুমেই ওরা জায়গা পেয়ে গেল। যে-তথ্য সংগ্রহ করতে এসেছে তাতে একটা দিনই যথেষ্ট। এতদিন পরে ঘোষাল বা ইন্দ্রকুমারের বাল্য-কৈশোরের কোনও তথ্য সংগ্রহ করা অসম্ভব! দুনিয়া অত্যন্ত দ্রুতগতিতে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। চিরাগোড়া বয়েজ স্কুলটা টিকে আছে কিনা সেটাই তো অজানা।

এরা ধানবাদে পৌঁছেছিল ভোরবেলা। রিটায়ারিং রুমে প্রাতঃকৃত্যাদি এবং স্নান সেরে সারাদিন মতো তৈরি হয়ে নিল। প্রথমেই পরদিন ফেরার জন্য কোনও মেল ট্রেনের দুটি বার্থ রিজার্ভ করলো। ঘটনাচক্রে ওয়েটিং লিস্টে থাকতে হলো না। একটা মিডল্, একটা আপার বার্থ পাওয়া গেল। এবার দুজনে রিকশা নিয়ে চললো চিরাগোড়া বয়েজ স্কুলে।

সৌভাগ্য ওদের। স্কুলটা জিন্দা। তার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবও সম্প্রতি হয়ে গেছে। ওরা যখন পৌঁছলো তখন বেলা প্রায় এগারোটা। হেডমাস্টারমশাই ঘরে একা বসে এক বাণ্ডিল পরীক্ষার খাতা দেখছিলেন। ওদের স্লিপ পেয়ে ডেকে পাঠালেন।

দুজন ঘরে ঢুকে হাত তুলে নমস্কার করলো। ভিজিটার্স চেয়ারে বসলো। হেডমাস্টারমশাই প্রৌঢ়। বললেন, কহিয়ে জী, হাউ ক্যানাই সার্ভ য়ু।

সুজাতা-কৌশিক স্থির করে এসেছিল যে, প্রথমেই তারা নিজেদের তাস বিছিয়ে দেবে। দিলও তাই। জানালো : ওরা একটি গোয়েন্দা সংস্থার দুই পার্টনার। বঙ্গাল মুলুকে একজন জবরদস্ত ডাক্তার-সাব খুন হয়েছেন। তিনি এই চিরাগোড়া বয়েজ স্কুল থেকে তিনটে লেটার এবং ডিস্ট্রিক্ট স্কলারশিপ নিয়ে ম্যাট্রিক পাস করেন। উনিশশো একষট্টি সালে। অর্থাৎ চৌত্রিশ বছর আগে। ঘটনাচক্রে তাঁর এক বঙ্কু—ইন্দ্রকুমার চৌধুরী—তিনিও এই স্কুলের ছাত্র—পুলিসের বিষনজরে পড়েছেন। পুলিস তাঁকে হত্যাকারী বলে চিহ্নিত করে যে কোনো সময়ে গ্রেপ্তার করতে পারে। ওরা দুজন তাই কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে এসেছে। …না, না, হেডমাস্টারমশাইকে কোনো আদালতে সমন ধরানোর প্রশ্নই নেই। তবে স্কুল-রেজিস্টার ঘেঁটে ওরা জানতে চায় ঐ শিবশঙ্কর ঘোষাল আর ইন্দ্রকুমার চৌধুরী সহপাঠী ছিল কিনা, কে কবে ম্যাট্রিক পাস করেন ইত্যাদি।

হেডমাস্টারমশাই রাষ্ট্রভাষায় জানালেন যে, তিনি এই স্কুলে দীর্ঘদিন আছেন বটে, তবে যোগদান করেছেন উনিশশো একষট্টির অনেক পরে। ‘খয়ের, ইস্মে কোই এতরাজ নেহি—আপনারা কাল সুবে আসুন, আমি খাতাপত্র দেখে রাখব।’

সুজাতা হাত দুটি জোড় করে হিন্দিতে বললো, মাস্টারসাব, আমরা জানতাম, আপনি এই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রকে বাঁচাতে এটুকু নিশ্চয় করবেন। কিন্তু মুশকিল-কি-বাৎ ইয়ে হ্যায় কি আজই রাতের ট্রেনে আমরা বার্থ রিজার্ভ করেছি। কাইন্ডলি যদি মেহেরবানি করে…

প্রাক্তন ছাত্রকে ফাঁসির দাড়ি থেকে বাঁচাতে মাস্টারজী রাজি হলেন : শুরু হলো অন্বেষণ দপ্তরি আর আর্দালি ধুলো-টুলো ঝেড়ে অনেক পুরাতন রেজিস্টার নিয়ে এসে জড়ো করলো হেডমাস্টারমশায়ের টেবিলের উপর। অনেক সন্ধান করে তিনি জানালেন : শিবশঙ্কর ঘোষাল একষট্টি সালে স্কুলের ভিতর ফার্স্ট হয়ে ডিস্ট্রিক্ট স্কলারশিপ পেয়েছিলেন। সচ্ বাত! লেকিন তার সঙ্গে ইন্দ্রকুমার চৌধুরী নামে কেউ থার্ড ডিভিশনে পাস করেনি। সুজাতার সনির্বন্ধ অনুরোধে তিনি বাষট্টি থেকে সাতষট্টি পর্যন্ত পুরাতন রেজিস্টার ঘেঁটে দেখলেন কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা : ইন্দ্রকুমার চৌধুরী না-পাত্তা! ও নামে কোনো ছাত্র একষট্টি থেকে সাতষট্টির মধ্যে এই স্কুল থেকে পাস করেনি। তথ্যটা ওরা দুজন মেনে নিতে পারলো না—কারণ ঐ কয় বছরে ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস টেন-এর ক্লাস-রেজিস্টারের ভিতরেও কোনও ছাত্রের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেল না, যার নাম: ইন্দ্রকুমার চৌধুরী।

এটা কেমন করে হয়? দুজনেই মিথ্যা বলেছে? ঘোষাল যে সত্য বলেনি তার প্রমাণ তো হাতে-হাতে। উনিশশো একষট্টি সালে ঐ স্কুল থেকে বেয়াল্লিশজন ছাত্র পাস করেছিল। সাতজন প্রথম বিভাগে, নয় জন দ্বিতীয় এবং বাকি ছাব্বিশ জন তৃতীয় বিভাগে—ইন্দ্রকুমার চৌধুরীর নাম তার ভিতর নেই। ফেল-করা ছাত্রদলেও নেই। সিদ্ধান্ত : শিবশঙ্কর ঘোষাল সত্য কথা বলেনি। কিন্তু সেখানেই তদন্তটা শেষ হচ্ছে না—ইন্দ্রকুমার যদি তার চেয়ে পাঁচ বছর নিচের ক্লাসের ছাত্র হয় তাহলে তার নাম সেই ক্লাস-রেজিস্টারে নেই কেন?

কৌশিক বলে, সে আমলের কোনও শিক্ষক কি আছেন?

হেডমাস্টারমশাই হাসলেন, এ কী পাগলের মতো কথা! চৌত্রিশ বছর পরে তেমন লোক কি পাওয়া সম্ভব? লেকিন

—লেকিন?

—অগর রামজী আপকো কিরপা করে তো পতা মিল যায়ে গা!

—বহ্‌ কৈসে?

মাস্টারসাব বললেন, এই স্কুলের এক অতিবৃদ্ধ হেডমাস্টারমশাই আজও জিন্দা আছেন। তিনি পঁচিশ বছর আগে রিটায়ার করেছেন। এখন বয়স আশির উপর। কিন্তু অসাধারণ তাঁর স্মৃতিশক্তি। আপনারা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে একটা শেষ চেষ্টা করতে পারেন। আমি ঠিকানা লিখে দিচ্ছি। কিন্তু মধ্যাহ্নে-বেলা দুটো থেকে চারটে—তিনি বিশ্রাম করেন। নিদ্রা দেন, আর কি। আপনারা চারটের পর তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। হয়তো নাম শুনেই—খাতাপত্র না দেখেই তিনি ইন্দ্রকুমার চৌধুরীকে চিনে ফেলবেন।

ওরা দুজনে ফিরে এল স্টেশনে। রেলওয়ে ক্যান্টিনে আহারাদি সেরে রিটায়ারিং রুমে বিশ্রাম নিল। বিকাল চারটে নাগাদ একটা অটো ধরে চললো শহরের অপর প্রান্তে—রিটায়ার্ড হেডমাস্টার পণ্ডিত রামনন্দন ত্রিবেদীজীর ডেরায়।

কড়া নাড়তে দ্বার খুলে দিল একটি তরুণী। বৃদ্ধের নাতনি। সে ওদের দুজনকে আপ্যায়ন করে বৈঠকখানায় বসালো। জানালো যে দাদাজীর দিবানিদ্রা ভেঙেছে। তিনি ইজিচেয়ারে শুয়ে অখবর পাঠ করছেন। তাঁকে সংবাদ দেবার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

ত্রিবেদীজী বরাভন। এরা দুজন পাদস্পর্শ করে প্রণাম করলো। বৃদ্ধ হিন্দিতে জানতে চাইলেন: কী চান আপনারা?

সুজাতা দীর্ঘসময় ধরে তাদের আগমনের হেতুটা জানালো। ওরা এসেছে শিবশঙ্কর ঘোষাল আর ইন্দ্রকুমার চৌধুরীর সম্বন্দে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহে। স্কুলের রেজিস্টারে তারা কোনও সন্ধান পায়নি। তবে বর্তমান হেডমাস্টারমশায়ের কাছ থেকে ঠিকানা সংগ্রহ করে ওরা ওঁকে বিরক্ত করতে এসেছে।

বৃদ্ধ বিশুদ্ধ হিন্দিতে বললেন, না, না। বিরক্ত কিসের? এ তো আমার কর্তব্য! ওয়ার্না শিবুটা বেমক্কা খুন হয়ে গেল?

কৌশিক বলে, আপনার স্যার মনে আছে শিবশঙ্করের কথা?

—থাকবে না? রোল ইলেভেন। সে তো তিনটে লেটার পেয়েছিল। ডিস্ট্রিক্ট স্কলারশিপ ভি পায়! তারপর ডগডর বন গয়ে। বঙ্গাল মুলুকমে সে পাগলদের একটা হাসপাতাল ভি বনাইয়েসে। স্কুলের গোল্ডেন-জুবিলিতে সে আসতে পারেনি, লেকিন টু হান্ড্রেড রুপিজ ডোনেশন ভেজিয়েছিল! তাকে ভুলে যাব? ক্যা আপসোস্ কি বাত! শিবুটা খুন হইয়ে গেল! কৌশিক বললে, জী হ্যাঁ। বহুৎ আপসোস কি বাৎ! লেকিন স্যার, ইন্দ্রকুমার চৌধুরীর কথা আপনার য়্যাদ নেই!

—কৌন?

—ইন্দ্রকুমার চৌধুরী। বংগালী! শিবশঙ্করের চেয়ে কিছু নিচু ক্লাসে পড়ত! অথবা প্রায় একই সঙ্গে—

—ইন্দ্রকুমার?

—জী হাঁ?

—চৌধুরী?

—জী হাঁ!

—নেহী জী! নো ওয়ান অফ দ্যাট নেম ওয়াজ আ স্টুডেন্ট অফ আওয়ার স্কুল ফ্রম ফিফটি ওয়ান টু সিক্টটি ওয়ান, বোথ ইয়ার্স ইনক্লুসিভ!–-

যেন সুপ্রীম কোর্টের রায়!

—আর য়ু শ্যিয়োর স্যার?

—হোয়াট! অগর রেজিস্টারমে কুছ কনট্রাডিক্‌টরি এন্ট্রি আপ কো মিল যায় তো হেডমাস্টার-সাবকে কনা কী রেজিস্টার কারেক্ট কর রাখা ঠিক হ্যায়। মাই মেমারি ইজ দ্য ফাইনাল ওয়ার্ড!

.

দিন পাঁচেক পরের কথা। বাসুসাহেব আবার সবাইকে ডেকে পাঠালেন। আবার চারজন এসে বসলেন বাসুর চেম্বারে। উনি বললেন, আবার তোমাদের পরামর্শ চাইছি। বল, আমাদের কীভাবে অগ্রসর হওয়া উচিত?

কৌশিক জানতে চায়, কী বিষয়ে? আপনি এর আগের দিন বলেছিলেন, চারটি মৌল সমস্যার সমাধান না হলে আমরা কোনোদিকে অগ্রসর হতে পারছি না। তার কী একটারও সমাধান হয়েছে?

বাসু বললেন, না, হয়নি। কিন্তু এই কয়দিন আমি আরও কিছু কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছি। অধিকাংশই যুগলকিশোরের মাধ্যমে। সেগুলি আমি তোমাদের জানাতে চাই। আবার আমার নিজের ডিডাকশনে আমি কিছু আন্দাজ করেছি যা যুগলকিশোর বা পুলিস জানে না। এখন আমার মনে হচ্ছে, হয়তো এভাবে সবকিছু নিজের আস্তিনের তলায় লুকিয়ে রাখাটা আমার উচিত হচ্ছে না। তাই তোমাদের পরামর্শ চাইছি।

সুজাতা বলে, মামু, আপনি ইতিমধ্যে কী জেনেছেন, কী আপনার আস্তিনের তলায় লুকোনো আছে, তা আমরা কেউ কিছুই জানি না। ফলে আমরা কী পরামর্শ দেব?

বাসু বলেন, কারেক্ট। তাই প্রথমেই আমি আমার তাসগুলি টেবিলে বিছিয়ে দিই। রঙের টেক্কাটা ছাড়া। প্রথম কথা : তোমরা যেদিন ধানবাদ চলে গেলে তার পরদিনই যুগলকিশোর আমাকে প্রেসিডেন্সি জেলের হাজতে নিয়ে যায়। সেখানে ছিল পঞ্চানন ঘড়াই। দেখেই চিনতে পারলাম, ঐ লোকটার ফটো নিঃসন্দেহে উঠেছিল ছায়া পালিতের ক্যামেরায়। যুগলকে সরিয়ে আমি একা লোকটার সঙ্গে জনান্তিকে কথা বললাম। লোকটা কেমন যেন ঘোরের মধ্যে ছিল। ভালো করে আমার চোখে-চোখে তাকাতেই পারছিল না।

রানু জানতে চান, নেশা করে বসেছিল?

—কী বলছ? জেল হাজতে বসে? নিশ্চয় নয়। সম্ভবত এটা থার্ড-ডিগ্রির প্রভাব। সে যা হোক, তার কথায় পারম্পর্য ছিল। ও আমার নাম জানে, তা স্বীকার করলো। অর্থাৎ ক্রিমিনাল ল-ইয়ার হিসাবে আমার সুখ্যাতি শুনেছে বললো। আমি তাকে সরাসরি অফার দিলাম : কে তোমাকে চিনসুরায় ডাক্তার ঘোষালের বাড়িতে চাকরি করতে পাঠিয়েছিল তা যদি সত্যি করে আমাকে গোপনে বলে দাও পঞ্চানন, তাহলে আমি বিনা ‘ফি’তে তোমায় ডিফেন্স দেব, যতদিন মামলা চলবে! রাজি আছ?

বাসু থামলেন। সুজাতা তাগাদা দেয়, তারপর? ও কী বললো?

লোকটা আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললে, আজ দু-দিন ধরে ঐ একই প্রশ্ন নিয়ে ‘কচুয়া-ধোলাই’ চলছে, হুজুর! কী বলব বলুন? চুঁচুড়ার সেই খুন-হয়ে- যাওয়া ডাক্তারবাবুকে আমি চিনিই না।

বাসুসাহেব তখন ওঁর পকেট থেকে ছায়া পালিতের তোলা একটা ফটো বার করে পচাইকে দেখান। প্রশ্ন করেন, এই লোকটা কে? চিনতে পার?

পচাই অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বললে, কবুল খাচ্ছি হুজুর, এটা আমারই ফটো। কেউ আমার অজান্তে তুলেছে। কোথায়, তা বলতে পারব না।

—তাহলে তো বাকিটুকুও তোমাকে কবুল খেতে হবে, পচাই। ডাক্তার ঘোষালের বাড়িতে তুমি ছিলে। গতমাসের শেষাশেষি। কারণ এ ছবি তোলা হয়েছে আটাশে অক্টোবর অন্তত দশ-পনেরজন সাক্ষীর সম্মুখে—ঐ ডাক্তার ঘোষালের বাড়িতে!

লোকটা চুপ করে রইলো এ-কথা শুনে। বাসু তাগাদা দেন, কী হলো? কিছু তো বলবে?

—কী বলব, হুজুর! চুঁচুড়ায় জীবনে একবারই গেছিলাম সাত বছর বয়সে, আমার কাকার বিয়েতে, বরযাত্রীদের সঙ্গে—’নিতবর’ হয়ে। তারপর আর জীবনে কখনো চুঁচুড়ায় যাইনি!

—তাহলে তোমার ফটো কি করে উঠলো চুঁচুড়ার ডাক্তারবাবুর বাড়িতে? মাত্র গতমাসে?

–এ ফটোতে কারসাজি আছে, হুজুর। আমার ছবি কেটে এনে ঐ ছবিতে বসিয়ে কেউ ফটো তুলেছে!

—সেটা তুমি প্রমাণ করতে পারবে না, পচাই। আমি কিন্তু প্রমাণ করতে পারব যে, এ ফটো গতমাসে দশজন সাক্ষীর সম্মুখে তোলা হয়েছিল। ত্রিশটা ফিল্মের গোটা নেগেটিভটাই আছে আমার কাছে। ঐ দশজনই বলবে যে, তুমি উপস্থিত ছিলে ওখানে, তোমাকে তারা চেনে।

পচাই হাত জোড় করে বলেছিলে, ঠিক আছে হুজুর। তাই সই। মেনে নিলাম। তিনটে খুনের বিচার হবে—একটা-না-একটার জন্যে ফাঁসিতে তো ঝুলতে হবেই। এটাও না হয় মেনে নেব। তিনের বদলে চার!

—তাহলে বল, কে তোমাকে এ-কাজে বহাল করেছিল? কত টাকায়?

—আজ্ঞে আমি বলব না। না হয়, আমার আপনারা তিনের বদলে চারবার ফাঁসি দেবেন।

বাসুসাহেব থামলেন। রানু বললেন, লোকটার দুর্জয় সাহস কিন্তু।

বাসু পাইপটা ধরাতে ধরাতে বললেন, ওর সাহসটাই শুধু দেখলে, রানু? ঐ সমাজবিরোধী লোকটার প্রভুভক্তিটা দেখলে না? ট্রাস্টওয়ার্দিনেস? জান দেবে তবু জবান দেবে না!

সুজাতা বলে, তার মানে বোঝা গেল পচাই ধরা পড়ায় আমাদের কোনও লাভ হলো না। সে কোনো মতেই স্বীকার করবে না, কে তাকে নিয়োগ করেছিল।

রানু বললেন, এবং তার মানে, তোমার মামার মতে, ঐ পাঁচটি সমস্যার সমাধান না হওয়াতক্ আমরা আন্দাজ করতে পারব না : কে ঘোষাল-ডাক্তারকে হত্যা করিয়েছে, অথবা অ্যাবে শবরিয়াকে।

বাসুসাহেব স্নান হাসলেন। বললেন, না রানু! সে-কথা কিন্তু আমি বলিনি। আমি বলেছি : ঐ পাঁচটি আপাত-অসঙ্গতির ব্যাখ্যা না পেলে এই হত্যারহস্যের সামগ্রিক রূপটা আমরা প্রণিধান করতে পারব না। আততায়ীকে চিহ্নিত করার কথা আমি বলিনি।

—বাঃ! সেটাই তো মূল সমস্যা?

—না, রানু, না। মূল সমস্যা হচ্ছে সামগ্রিক চিত্রটার রূপায়ণ। শুধু ‘কে’ নয়, ‘কেন’-সমেত কে!

কৌশিক তার মামিমার পক্ষ নিয়ে বলে, মামীও তো তাই বলছেন—’কে’ এবং ‘কেন’?

বাসু পাইপটার ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, আয়াম সরি, কৌশিক। আমি কিন্তু তা বলিনি। ‘কে?’—প্রশ্নটা আমি আদৌ তুলিনি, আমার কাছে একমাত্র সমস্যা : ‘কেন’? ‘why? কেন স্কাউড্রেলটা এভাবে পর পর দু-দুজন মানুষকে হত্যা করলো। ‘কে’ করেছে এ-প্রশ্নটা তো আমার জানা।

তিনজনেই যেন বজ্রাহত হয়ে গেলেন।

রানুই প্রথম বাঙ্ময় হলেন : তুমি জান? সঠিক আন্দাজ করেছ?

—হ্যাঁ, জানি। আন্দাজ নয়, ঘোষালের হত্যাকারী কে, তা আমি নিশ্চিতভাবে জানি। কক্লুসিভ প্রমাণ আছে আমার এক্তিয়ারে। কিন্তু সে কেন একাজ করেছে তা জানি না।

কৌশিক বলে, তাহলে সে লোকটা কে—তা আপনি আমাদের বলছেন না কেন? এই চার-দেওয়ালের ভিতর খবরটা গোপন রাখার কোনো বিশেষ হেতু আছে কি?

আবার হাসলেন উনি। বললেন, বিশেষ হেতু না থাকলে তোমাদের তিনজনের কাছ থেকে অহেতুক সেটা গোপনই বা করব কেন, বল?

আবার তিনজন কথা খুঁজে পান না। রানুই আবার বলে ওঠেন, বেশ! লোকটার নাম তুমি আমাদের না জানাতে চাও জানিও না, কিন্তু কী কারণে তা জানাচ্ছ না সেটাও কি জানাতে পার না?

—না, তা পারি! লোকটা অত্যন্ত ধূর্ত! জানে, তার পালাবার আর কোনো পথ নেই। তবে আমি যেমন তাকে চিনতে পেরেছি, মনে হয়, সেও তেমনি বুঝে ফেলেছে যে, তার মৃত্যুবাণ আমি ইতিমধ্যেই সংগ্রহ করেছি। সে মরিয়া হয়ে শেষ চেষ্টা করতে পারে। সে চেষ্টা তৃতীয় একটা হত্যা। এবার আমাকে। আর সেজন্যই নামটা তোমাদের কাছে গোপন রাখছি, যাতে তোমাদের জীবনও একই ভাবে বিপন্ন না হয়ে পড়ে।

পুনরায় নীরবতা ঘনিয়ে আসে। রানুই আবার নীরবতা ভঙ্গ করে বললেন, সেই জন্যেই কি কাল রাত্রে আলমারি থেকে রিভলভারটা বের করে পকেটে রাখলে?

—হ্যাঁ, তাই। কিন্তু তোমরা তো রিভলভার পকেটে নিয়ে ঘুরতে পারবে না, তাই আপাতত খবরটা আমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকুক। কিন্তু আমাকে হত্যা করলেও যে তার নিষ্কৃতি নেই এটা তাকে পাকেচক্রে জানিয়ে দেব—

—’নিষ্কৃতি নেই’ মানে?

—তোমাদের তিনজনকে দেখিয়ে এই সীলবন্ধ খামটা আমার সেফভল্টে তুলে রাখছি। আমার যাবতীয় যুক্তি সমেত ঐ লোকটার নিশ্চিত গিটি-ভার্ডিক্ট হবার তথ্য এই খামে রইল। আমার অবর্তমানে খামটা যুগলকিশোরকে দিও। আমি কায়দা করে আততায়ীকে জানিয়ে রাখব আমাকে হত্যা করলেও তার মুক্তি নেই।

রানুর মুখটা ধীরে ধীরে সাদা হয়ে গেল।

বাসু ধীরপদে উঠে গিয়ে একটা সীলমোহর করা বড় ম্যানিলা খাম ওঁর চেম্বারের সেটি ভল্টে তুলে রাখলেন। ফিরে এসে নিজের আসনে বসতেই সুজাতা, বললে, আচ্ছা, এমনটা কী করে হয়, মামু? আপনি যেসব তথ্য জানেন, আমরাও তো তাই-তাই জানি। তাহলে আমরা কেন লোকটাকে চিহ্নিত করতে পারছি না, অথচ আপনি পারছেন?

বাসু বললেন, না, সুজাতা, কথাটা তোমার ঠিক হলো না। আমি যা-যা জানি, তোমরা তার সবটা জান না। আবার তোমরা দুজন যা জানো তার সবটা আমিও জানি না।

—যেমন? দু-একটা উদাহরণ দিন?

—যেমন ধর, তোমার দুজন ধানবাদ যাওয়ার পথে ট্রেনে মুড়ি-মশলা কিনে খেয়েছে কিনা তা আমি জানি না। যে প্রফেসর ভদ্রলোক কৌশিককে ইন্দ্রকুমারের টেলিফোন রেকনারটা দিয়েছিলেন তাঁর গোঁফ আছে কি না, পণ্ডিত ত্রিবেদী দাড়ি রেখেছেন কিনা—এসব জানো। আমি জানি না।

কৌশিক বলে, এসব তো ইংরেলিভেন্ট কথা, অপ্রাসঙ্গিক।

—না কৌশিক, কোন কোন সূত্রটা প্রাসঙ্গিক, কোনটা নয়, তা দেখবার সূক্ষ্ম বিশ্লেষণী নজর থাকা চাই। ইন্দ্রকুমারের ক্যামেরাটা ট্রেনে হারানোর মধ্যে একটা সূক্ষ্ম কিন্তু স্পষ্ট সূত্র আছে, তা কি তোমরা খেয়াল করেছ? করনি। ডক্টর দাশ আমাকে যে ডোনার্স লিস্টা দিয়েছিলেন—দশ বছরের দানের হিসাব, তার ভিতর একটা অতি সূক্ষ্ম কিন্তু সুস্পষ্ট আঙ্কিক সূত্র আছে, তা কি তোমাদের নজরে পড়েছে? পড়েনি। কেন গুণবতী সাপের ভয়ে কেঁচো খুঁড়ছেন না, অথবা ঘোষাল কেন একজন নন-ম্যাট্রিককে ম্যাট্রিক বলে চালাতে চেয়েছিল তা তোমরা বিশ্লেষণ করে দেখেছ? দেখনি। ব্লু কিন্তু এই সব সূত্রেই ছড়ানো। তা থেকেই আমি অপরাধীকে শনাক্ত করেছি। তুমি, কৌশিক, যুগলকিশোরের স্ত্রীর কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে—

বাধা দিয়ে সুজাতা বলে, কী প্রতিশ্রুতি?

—এই দ্যাখ, সেটা আমি জানি, কৌশিক জানে, কিন্তু সুজাতা অথবা রানু জানে না। সুতরাং আমরা সবাই সবকিছু জানি না। কৌশিক যুগলের স্ত্রীকে বলেছিল সে এই হত্যারহস্য নিয়ে একটা গোয়েন্দা গল্প লিখবে। তা যদি লেখ কৌশিক, তাহলে কাহিনীর এই পর্যায়ে থেমে গিয়ে তুমি পাঠক-পাঠিকাকে জানিয়ে দিতে পার যে, তারা যে-যে তথ্য জানে, তোমার বাসুমামু তার চেয়ে একতিলও বেশি জানেন না। এইখানে গল্পের বইটা বন্ধ করে পাঠকের চেষ্টা করা উচিত আততায়ীকে চিহ্নিত করতে—কে প্রকৃত খুনি; এবং বাসুসাহেব একই তথ্যের বেসিসে কেমন করে তাকে চিহ্নিত করলেন। কী জান কৌশিক—তুমি গোয়েন্দা গল্প লেখ তো, তাই বলছি : ঈশপের গল্পে আর পঞ্চতন্ত্রের গল্পে মর‍্যালটা থাকে কাহিনীর শেষে, আর সার্থক গোয়েন্দা কাহিনীতে সেটা থাকে গল্পের মাঝামাঝি একটি বিশেষ মুহূর্তে। ঠিক যে মুহূর্তে গোয়েন্দা উপনিষদের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষির মতো ঘোষণা করেন : বেদাহমেতম্! আমি জানি!

কৌশিক বলে, সেক্ষেত্রে আপনি যতটুকু জানেন তা পুলিসকে জানিয়ে দিচ্ছেন না কেন? যুগলকিশোরকে সব কথা বলছেন না কেন?

—যুগলকে আমার সন্দেহের কথা বলামাত্র সে লোকটাকে অ্যারেস্ট করবে। কেস আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আদালতে উঠবে। কিন্তু আমি যে এখনো জানি না—লোকটা কেন জোড়া খুন করল! এক্ষেত্রে আসামীপক্ষের কাউন্সেলার একটা অ্যাডভান্টেজিয়াস পজিশনে থাকবে। একটা জোরালো যুক্তি। সে বলবে : হুজুর! বাদীপক্ষের ওই প্রমাণের কোনও বনিয়াদ নেই! কোনো অর্থ নেই। একটা মানুষ ঠাণ্ডা মাথায় দু-দুটো খুন করবে কেন? যদি তার নিজের কিছুমাত্র লাভ না হয়? এর জবাব আমার এখনো জানা নেই। ফলে বিচারক হয়তো সব জেনে বুঝেও ‘বেনিফিট অব ডাউটে’ আসামীকে ছেড়ে দিতে পারেন। কারণ ভারতীয় আইন বলছে “একশোটা অপরাধীকেও বিচারক ‘নট-গিলটি’ বলতে পারেন, কিন্তু একটিও নির্দোষীকে সাজা দিতে পারেন না।” সেজন্য পুরোপুরি তৈরি না হয়ে আমি যুগলকে আমার সমাধানটা জানাতে পারছি না। ঘোষালের হত্যা কে করেছে, আমি জানি, নিশ্চিত জানি। কেন করেছে তা আন্দাজ করেছি, আমার আশা বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে সেই ‘কেন’র জবাব আমার হাতে এসে যাবে—মোটিভ সংক্রান্ত কনক্লুসিভ প্রুফ। কিন্তু বিল শবরিয়াকে লোকটা কেন হত্যা করল? নাহং বেদ! না, তা আমি জানি না।

কথা বলতে বলতে টেলিফোনটা বেজে উঠল। সুজাতা সেটা নিয়ে শুনলো। তারপর যন্ত্রটা বাসুসাহেবের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললে, আপনার ফোন। ব্রজদুলালবাবু—

বাসু ওর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বললেন, সুপ্রভাত ব্রজবাবু, বলুন?

—সুপ্রভাত স্যার। আগামী শনিবার সন্ধেয় কি আপনি ফ্রি আছেন?

—আগামী শনিবার? দাঁড়ান, ডায়েরি দেখে বলছি। কিন্তু কেন বলুন তো? আপনি আসবেন?

—আজ্ঞে না। আপনারা আসবেন। ম্যাডামও আসবেন। আমি বড় গাড়িটা পাঠিয়ে দেব।

—কেন? কী ব্যাপার?

—আগামী শনিবার সন্ধে ছয়টায় আমাদের ‘সসজ্জা শেষ মহড়া’।

—’সসজ্জা শেষ মহড়া’! তার অর্থ?

—ওফ! আপনি সোজা কথা বোঝেন না, ব্যারিস্টারসাহেব? ওর সাদা বাংলা হচ্ছে : ড্রেস রিহার্সাল!

—ড্রেস রিহার্সাল! গুড গড! ড্রেস রিহার্সাল!!

—কী আশ্চর্য! কথাটা আগে শোনেননি? কোনো নতুন নাটক মঞ্চস্থ করার আগে একটা পরীক্ষামূলক …

বাসুসাহেব বাকিটা শুনতে পেলেন না। অন্যমনস্কের মতো টেলিফোনটাকে ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখলেন। ক্র্যাডলে নয়, টেবিলে। পাইপে অগ্নি সংযোগ করে স্বগতোক্তি করলেন : মাই গড!

টেবিলে নামিয়ে রাখা টেলিফোন যন্ত্রটা লেগহর্ন মোরগের মতো ক্রমাগত ‘কক্‌-কক্’ করে চলেছে। সবাই স্তব্ধ হয়ে অপেক্ষা করছে। এসব বাসুসাহেবের চেতন মনে ছায়াপাত করছে না। তিনি জানালা দিয়ে বাইরের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ঠোঁট থেকে পাইপটা ঝুলছে। ড্রেসিং গাউনের দু-পকেটে দুই হাত। উনি যেন অন্য জগতে চলে গেছেন।

সুজাতা রানুর দিকে তাকায়। দেখে, তিনি নিঃশব্দে অধরোষ্ঠের উপর তর্জনীটা রেখে চুপ করে থাকতে বলছেন।

বাসু যেন ধ্যানস্থ!

রানু টেলিফোনযন্ত্রটা টেবিল থেকে নিঃশব্দে তুলে নিলেন। কানে চেপে ধরে শুনলেন। ব্রজদুলাল একটানা বলে চলেছেন, হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো…

আস্তে, কিন্তু স্পষ্ট উচ্চারণে রানু টেলিফোনের কথামুখে বললেন, মিস্টার রায়, টেলিফোন ক্র্যাডল-এ রেখে দিন। আমি মিসেস বাসু বলছি। উনি কথা বলতে বলতে এদিকে একটা বিচিত্র ঘটনা ঘটেছে। ডোন্ট বি প্যানিকী। উনি একটু পরে আপনাকে রিং-ব্যাক করবেন।

এসব কোনো কথাই বোধহয় কর্ণগোচর হয়নি বাসুসাহেবের। তিনি যেন হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেলেন। এদিকে ফিরে সহাস্যে বললেন : গট ইট!

রানু জানতে চান : কী?

—ফুল সলুশন অব দ্য কেস! সব সমস্যার নিষ্কণ্টক সমাধান। ইটস : ড্রেস রিহার্সালের কাঁটা। অ্যান্ড দ্যাটস্ দ্য : ‘মজারু’!