পনের
ইস্পাত ঠিক সময়মতোই পৌঁছেছিল ঘাটশিলায়। বেলা দশটায়। স্যুটকেস হাতে ট্যাক্সি-স্ট্যান্ডে দরাদরি করছিল কৌশিক আর পিছন- পিছন ঘুরছে ব্যাগ কাঁধে সুজাতা; এমন সময়ে একটি অল্পবয়সী বাঙালী ছেলে এগিয়ে এসে বললে, আপনারা কি ‘সুবর্ণরেখা’ হোটেলে যেতে চাইছেন, স্যার? গালুডিতে?
—হ্যাঁ, তুমি কি করে আন্দাজ করলে, ভাই?
—আজ্ঞে না, আন্দাজ নয়, ঐ ট্যাক্সি-ড্রাইভারটি বললে। আমি ঐ হোটেলের অ্যাম্বাসাডারটা চালাই। একজন বোর্ডারকে ইস্পাত ধরাতে নিয়ে এসেছিলাম। ওঁরা এই ট্রেনেই সম্বলপুর চলে গেলেন। এখন খালি ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে ফিরে যাব। উঠুন, স্যার। আপনার দুজন তো?
কৌশিক বললে, হ্যাঁ, দুজন। তুমি কি মিটারে যাবে?
—মিটার কোথায় স্যার? এ তো হোটেলের গাড়ি। প্রাইভেট। ভাড়া আমাকে দিতে হবে না। হোটের বিলের সঙ্গে ন্যায্য ভাড়া টাইপ করে উঠে যাবে। আমার লগবুকে একটা সই দিয়ে দেবেন শুধু।
কৌশিক আর সুজাতা উঠে বসলো। ছেলেটি বললো, মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে যাই, কি বলেন স্যার? যদি হোটেলের আর কোনও শেয়ার-প্যাসেঞ্জার পেয়ে যাই।
কৌশিক বললে, ঠিক আছে। তবে পাঁচ মিনিটের চেয়ে বেশি দেরি কর না যেন। ছেলেটি তৎক্ষণাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বললে, আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন, স্যার। অপেক্ষা করছি আমার নিজের স্বার্থে নয়—আপনার স্বার্থে।
—মানে?
—’সুবর্ণরেখা’ হোটেলের আর কোনও বোর্ডার যদি ইস্পাতে এসে থাকেন, আর আমি তাঁকে পাকড়াও করতে পারি, তাহলে আমার কোনো লাভ নেই, হোটেলেরও কোনো লাভ নেই—কিন্তু আপনার গাড়ি ভাড়া ‘হাফাহাফি’ হয়ে যাবে।
কৌশিক বললে, বুঝলাম। সিগ্রেট চলে?
প্যাকেটটা বাড়িয়ে ধরে।
ড্রাইভার—বছর বিশ-বাইশ বয়স হবে তার, লাজুক-লাজুকভাবে একটা স্টিক নিয়ে পিছন ফিরলো। নিজেই ধরালো। এদিক-ওদিক খদ্দের খুঁজে দেখতে থাকে কিছুক্ষণ। স্টেশন ক্ৰমশ ফাঁকা হয়ে আসছে। অর্থাৎ ইস্পাতে যাঁরা এসেছেন তাঁরা সবাই গেট পার হয়ে ঘাটশিলায় জনারণ্যে মিশে গেছেন। ছেলেটি সুখটান দিয়ে সিগ্রেটটা ফেলে দিয়ে ড্রাইভারের সিটে এসে বসলো। বললে, আপনার ‘ব্যাড লাক’, স্যার। ‘সুবর্ণরেখা’র বোর্ডার আজ আপনারা শুধু দুজনই।
স্টার্ট দিল সে গাড়িতে।
কৌশিক জানতে চায়, তোমার নামটা কী ভাই?
—কাত্তিক। কাত্তিক দাশ।
–কতদিন কাজ করছ এই হোটেলে?
—হোটেল খোলা ইস্তক। হোটেলের ম্যানেজারবাবু—প্রসূন ঘোষ, আমার ভগ্নিপতি। সুজাতা কথোপকথনে যোগ দেয়: ‘ঘোষ’ তো কায়স্থ উপাধি। তোমরা কি কায়স্থ? কার্তিক গাড়ি চালাতে-চালাতেই বললে, আজকাল কি আর জাত-পাত দেখে কেউ বিয়ে করে দিদিভাই? ওসব সেকালে হতো। তবে ম্যানেজারবাবুকে যেন বলবেন না, আমি বলেছি যে, উনি আমার জামাইবাবু।
সুজাতা জানতে চায়, সেকি! কেন গো?
ম্লান হেসে কার্তিক বললে, দেবসেনাপতি যে রথী নন, সারথী!
সুজাতা জবাব দিল না। বোঝে, এটা কার্তিকের বেদনার স্থান। হীনম্মন্যতা। হয়তো লেখাপড়া শেখেনি। ভগিনীপতির কৃপায় করে খাচ্ছে। একটু পরে কার্তিক নিজে থেকেই জানতে চায় : কদ্দিন থাকবেন?
সুজাতা বললে, মাত্র দু’দিনের ছুটি। কাল রোব্বারেই সন্ধ্যার ইস্পাত ধরে ফিরে যাব সোমবারে ওঁকে জয়েন করতে হবে অফিসে।
—তা আজ বিকালে যদি শেয়ারের প্যাসেঞ্জার পাই তাহলে বের হবেন? লোকাল ট্রিপে?
—কী কী দেখা যাবে?
—ফুলডুংরি পাহাড়, সুবর্ণরেখা নদী, বিভূতিসদন লাইব্রেরি, বিভূতিবাবু যে বাড়িতে থাকতেন, যেখানে দেহ রেখেছিলেন—
কৌশিক জানতে চায়—আমাদের দুজনের মাথাপিছু কত করে খরচ পড়বে?
—সেটা স্যার নির্ভর করছে আপনারা কতজন যাচ্ছেন তার উপর। ঠিক আছে, আমি লাঞ্চের মধ্যেই আপনাকে জানাব। দেখি, আর কোনও বোর্ডার পাই কিনা।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা এসে পৌঁছল হোটেলে। রিসেপশনে এসে কৌশিক রসিদটা দেখাল। খাতায় নাম-ঠিকানা লিখে দিল। প্রসূনবাবু জানতে চাইলেন, কদ্দিন থাকবেন, স্যার?
—উইকেন্ডের ছুটি। সোমবার জয়েন করতে হবে। কাল সন্ধ্যায় ইস্পাতে ফিরব।
—টিকিট কাটা আছে? না কাটতে দেব?
—না। আপ-ডাউন টিকিট কেটেই এসেছি। আর ফিরবার সময় ঐ কার্তিকের গাড়িতেই ঘাটশিলায় যাব ট্রেন ধরতে। কার্তিককেও বলে রেখেছি।
ম্যানেজারবাবু একটি বেলবয়কে ডেকে একটা চাবি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, বীরু, এঁদের দোতলার তিন নম্বরে নিয়ে যা। ঘরটা রেডি আছে।
বীরু স্যুটকেস আর কাঁধের ঝোলাটা তুলে নিয়ে বললে, আসুন!
বেশ ছিমছাম ডবল-বেড রুম। পিছনের জানলা খুলে দিলে সুবর্ণরেখার উপত্যকার অনেকটা আরণ্যক ভূমি দেখা যায়। জল দেখা যায় না অবশ্য। শীতের শুরু হচ্ছে। কলকাতায় এ সময় বেশ গরম—এখানে খোলামেলায় উত্তাপ কিছু কম। বীরু দেখিয়ে দিল বাথরুমে অব্যবহৃত সাবান ও তোয়ালে রাখা আছে। বিছানার চাদর পাটভাঙা। সুজাতা জানতে চাইলো, বেলবয়কে ডাকতে হলে কোনটা সুইচ?
বীরু বললে, আজ্ঞে না। সুইচ নেই। ঘরে ঘরে ফোন আছে। সার্ভিস চাইলে ‘17’ ডায়াল করবেন। রেস্টুরেন্ট—’11’ আর রিসেপশন ‘21’।
কৌশিক বললো, দু-পেয়ালা কপি নিয়ে এস তো হে।
—এখনি নিয়ে আসছি স্যার। তৈরি কফি, না পটে? সঙ্গে আর কিছু? স্ন্যাক্স্ জাতীয়?
সুজাতা বলে, পটেই নিয়ে এস। না। সাড়ে এগারোটা বাজতে যাচ্ছে। এখন কিছু খেলে দুপুরের লাঞ্চটা মাটি হয়ে যাবে।
বীরু নিজে থেকেই বললো, দুপুরে কী কী পাওয়া যাবে তা ঐ ‘ডব্ল্ ওয়ান’-এ ফোন রে জেনে নিন। এখনো তো সিজন ঠিকমতো শুরু হয়নি। সব সময় সবকিছু পাওয়া যায় না।
সুজাতা বলে, চাইনিজ পাব?
রাত্রে ডিনারে পাবেন, দিদি। এ বেলা এখন অর্ডার দিলে সার্ভ করতে অনেক বেলা হয়ে যাবে।
—তাহলে লাঞ্চের সময় অর্ডার দিয়ে দেব। ইন্দ্রদা বলেছিল, চাইনিজই নাকি তোমাদের স্পেশালিটি। কথাটা সত্যি?
বীরু প্রতিপ্রশ্ন করে, ইন্দ্রদা কে? বোর্ডার?
—ইন্দ্রকুমার। ফিল্ম স্টার। গত সপ্তাহেই তো এসে এ হোটেলে সাতদিন ছিলেন। তুমি দেখনি তাঁকে?
বীরু বললে, না দিদি। দেখিনি। তিনি তিনতলায় দু’নম্বরে ছিলেন। গত সোমবার ফিরে গেছেন। উনি ফিরে যাবার পর জানতে পারলাম। তাই অটোগ্রাফটা নেওয়ার সুযোগ হয়নি। তা আপনি ইন্দ্রকুমারকে চেনেন?
—ওমা, চিনব না কেন? ইন্দ্রদা তো আমার মাস্তুতো দাদা হয়। আমার মায়ের খুড়তুতো বোনের ছেলে। ঠিক আছে, আমি তোমাকে ইন্দ্রদার অটোগ্রাফ যোগাড় করে ডাকে পাঠিয়ে দেব।
—থ্যাঙ্কু দিদি। বসুন। আগে কফিটা নিয়ে আসি।
বীরু চলে যায় দু-কাপ কফি আনতে।
কৌশিক জামা-জুতো খুলতে খুলতে বললে, ফার্স্ট ওভারেই দু-দুটো উইকেট নেমে গেল!
—তার মানে?
ক্রিকেটী-ভাষা সুজাতা বোঝে না। অথচ কৌশিক বি.ই. কলেজ ক্রিকেট টিমে এককালে খেলত।
কৌশিক বুঝিয়ে বলে, মামু আমাকে দু-দুটো দিন সময় দিয়েছেন, কিন্তু ভগবান দিয়েছেন আরও বড় দান: সুন্দরী শুধু নয়, বুদ্ধিমতী বউ। দারুণ কায়দা করে জেনে নিয়েছ: ইন্দ্রকুমার এসেছিলেন, এ হোটেলেই উঠেছিলেন। এটা আমাদের ফার্স্ট উইকেট। আর সেকেন্ড উইকেটটা আরও মারাত্মক: তিনি সোমবার ফিরে গেছেন। অর্থাৎ শনিবার ঘটনার রাত্রি, আটাশে অক্টোবরের পরের পরের দিন। সুতরাং ইন্দ্রকুমার সন্দেহ তালিকার বাইরে!
সুজাতা তার চুলের কাঁটাগুলো খুলে-খুলে ড্রেসিং টেবিলে সাজিয়ে রাখছিল—বিন্দি টিপটা খুলে আয়নার কাচে আটকে দিতে দিতে বললে : হিসাবটা বুঝলাম না। কীভাবে ইন্দ্রকুমার হিসাবের বাইরে যাচ্ছেন?
—বুঝলে না? ইন্দ্ৰকুমার কলকাতা ত্যাগ করেছেন সোমবার তেইশে অক্টোবর। তখনো ডক্টর ঘোষাল পার্টি দেবার ব্যাপারে মনস্থির করেননি। কারণ, করলে ইন্দ্রকুমারের নিমন্ত্রণ হতো সবার আগে। তা হয়নি। ইন্দ্রকুমারই তাঁর নিকটতম বাল্যবঙ্কু। দ্বিতীয় কথা, হারাধন চিনসুরায় জয়েন করে মঙ্গলবার। তারপর ঐ পার্টির ব্যবস্থা হয়। তৃতীয় কথা : ঘাটশিলা থেকে ইন্দ্রকুমার কলকাতা ফিরে আসেন সোমবার-ঘটনার পরে। ফলে ঘোষালের মৃত্যুর সঙ্গে ইন্দ্রকুমারকে কিছুতেই জড়ানো যাচ্ছে না।
সুজাতা ততক্ষণে স্যুটকেস খুলে শাড়ি-ব্লাউজ বার করতে শুরু করেছে। স্নানের পরে যা পড়বে। বললে, আজ্ঞে না, স্যার। এখনো কিছুই প্রমাণিত হয়নি। ইন্দ্রকুমার যে তেইশে অক্টোবর এখানে আসেন, তা বীরু বলেনি। শুধু বলেছে যে তিনি গত সোমবার ফিরে গেছেন-
—দ্যাটস এনাফ! কবে এসেছেন সেটা তো রিসেপশনে খাতা দেখেই জানা যাবে।
—তা যদি যায় তাহলে তিনি কবে চেক-আউট করেছেন তাও খাতা দেখে বলে দেওয়া যায়। কিন্তু লোকটা যে ন্যায্যত ইন্দ্রকুমারই তা প্রমাণ হয় না। বিশেষ বীরু তো চেখেই দেখেনি ইন্দ্রকুমারকে। সে শোনা কথা আউড়ে গিয়েছে। আইনের ভাষায় যাকে বলে: হেয়ার- সে রিপোর্ট!
—আই নো! আই নো! বীরু বলেছে “উনি ফিরে যাবার পর জানতে পারলাম…” সুতরাং এখন আমাদের জেনে নিতে হবে ও কার কাছে শুনেছে। নাইন্টি-পার্সেন্ট চান্স: তিনতলার বেলবয়। ইন্দ্রকুমার একজন সিনেমা আর্টিস্ট। তাকে কেউনা কেউ নিশ্চয় নোটিস্ করেছে। হয়তো অটোগ্রাফ খাতায় স্বাক্ষরও নিয়েছে। তাহলে ওর ডেটেড সিগনেচার পাব। তা স্নানে আগে কে যাবে। তুমি না আমি?
সুজাতা বলে, কফিটা তো আসুক।
বলতে বলতেই দরজায় নক করে বীরু এসে হাজির। কফির ট্রেটা নামিয়ে দিয়ে, খাবার জলের স্টেনলেস স্টিলের জলপাত্রটা তুলে নিয়ে বললে, আজকে পারশে মাছ এসেছে, দিদি। পারশে মাছ ভালো লাগে? তাহলে ডবল-ওয়ানে দু-প্লেট পারশে মাছের সর্ষেবাটা অর্ডার এখনি করে দিন।
সুজাতা বললে, দিচ্ছি। একটা কথা, বীরু। ইন্দ্রদা আমাদের টেলিফোন করে বলেছেন যে, এখান থেকে ফিরে যাবার পর ওঁর একটা পকেট-বুক খুঁজে পাচ্ছেন না। পকেট-বুক মানে, ছোট্ট কালো রঙের একটা খাতা। তাতে নানান লোকের টেলিফোন নাম্বার লেখা। তুমি ভাই একটু খোঁজ নিয়ে দেখবে, ইন্দ্রদা যে ঘরে ছিলেন তার বেলবয়কে জিজ্ঞেস করে?
—কাশীদাকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। ইন্দ্রকুমারবাবু ফিরে যাবার পর ওঁর ঘরে যদি কেউ কোনো ঐ রকম খাতা খুঁজে পায়—তা সে কাশীদাই হোক, ঝাড়ুদারই হোক অথবা জমাদার—সে জমা দেবে অফিস-কাউন্টারে। ঠিক আছে, দিদি। আমি খোঁজ নিয়ে দেখব।
সুজাতা পট থেকে কাপে কফি ঢালতে বলে, কাশীনাথ কে? তিনতলার বেলবয়?
বীরু চলতে শুরু করেছিল। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ। ইন্দ্রকুমার যে ঘরে ছিলেন—তিনশ দুই –কাশীদা ঐ ঘরটা অ্যাটেন্ড করে।
—ঐ কাশীদাই বুঝি তোমাকে বলে, ইন্দ্রকুমার এসেছিলেন, সোমবারে ফিরে গেছেন?
—না দিদি! খবরটা আমাকে দিয়েছিল কার্তিকদা।
—কার্তিক? ঐ অ্যাম্বাসাডার গাড়িটা যে চালায়?
—হ্যাঁ। কার্তিকদাকেও আপনি চেনেন?
-–বাঃ! ওর গাড়িতেই এলাম তো।
.
লাঞ্চ-আওয়ার্স বারোটা থেকে আড়াইটা। কৌশিক পারশে মাছের সর্ষেবাটা দু-প্লেট অর্ডার করে দিয়েছিল আগেভাগেই। প্রায় দেড়টা নাগাদ ওরা নেমে এল ডাইনিং-হলে। খানা- কামরায় তখন যথেষ্ট ভিড়। কৌশিক সুজাতাকে বললে, আমাদের তো কোনো তাড়া নেই। চল, এই মওকায় একবার রিসেপশনটা ঘুরে আসি। দেখা যাক, ম্যানেজারের কাছ থেকে জেনে নেওয়া যায় কি না—ইন্দ্রকুমার কবে চেক-ইন করেন আর কবেই বা চেক-আউট করেন।
সুজাতা রাজি হয়।
ওরা দুজনে এগিয়ে যায় রিসেপশন কাউন্টারের দিকে। সেখানে এখন লোকজন বিশেষ নেই। ম্যানেজার প্রসূনবাবু একখণ্ড খবরের কাগজ নিয়ে একাগ্র মনে পড়ছিলেন। ওরা এগিয়ে আসতেই কাগজটা সরিয়ে রেখে বললেন, আসুন। লাঞ্চ হয়েছে?
সুজাতা বলে, আজ্ঞে না। ডাইনিং-হলটা এখন ভর্তি। তাই এই সুযোগে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলাম, একটা ব্যাপারে।
—বলুন?
—আপনাদের হোটেলটার কথা প্রথম শুনি ইন্দ্রদার কাছে—মানে ফিল্ম-স্টার ইন্দ্রকুমার—উনি আমার দাদা হন সম্পর্কে। ইন্দ্রদা হোটেলের খুব সুখ্যাতি করলো, আপনার কথাও বললো।
হাসলেন প্রসূনবাবু। বললেন, ওঁরা তো নটরঙ্গে নতুন বই নামাচ্ছেন কালীপূজার পর। আমাকে নিমন্ত্রণ করে গেছেন। খুব অমায়িক লোক।
—ইন্দ্রদার দিলটা চিরকালই দরাজ। ও! ভালো কথা! ইন্দ্রদা এখান থেকে ফিরে যাবার পরে একটা পকেট নোটবুক খুঁজে পাচ্ছে না। তাতে শুধু টেলিফোন নাম্বার লেখা আছে। আমাদের বলেছে, আপনাকে জিজ্ঞেস করতে—সে কি খাতাটা হোটেলের ঘরে ফেলে গেছে?
—হ্যাঁ, বীরু, মানে আপনার রুমের বেলবয় সে-কথা আমাকে একটু আগেই জানিয়েছে। কিন্তু সরি, কেউ তো তা আমার কাছে জমা দেয়নি। ওটা যদি ঘড়ি, ফ্লাস্ক, ক্যামেরা, বা মানিব্যাগ হতো তাহলে না হয় অন্যরকম সম্ভাবনার প্রশ্ন উঠত। কিন্তু নোটবইটা তো আর কারও কোনও কাজে লাগবে না। ফলে, বেলবয়-ঝাড়ুদার-জমাদার যে কেউ পেলে নিশ্চয় আমাকে দিয়ে যেত। খুব সম্ভবত উনি সেটা অন্য কোথাও হারিয়েছেন।
সুজাতা খুব ক্যাজুয়ালি বললো, তা হবে। তা উনি তো গত সোমবার, মানে ত্রিশ তারিখে ফিরে গেছেন। তাই না?
—হ্যাঁ! তাই হবে বোধহয়!
কৌশিক বলে, আবার ‘বোধহয়’ কেন মিস্টার ঘোষ? হাতে পাঁজি মঙ্গলবার। আপনি তো
রেজিস্টার দেখে নিশ্চিতভাবে সেটা বলে দিতে পারেন। তাই না?
একগাল হেসে প্রসূন বলেন, আজ্ঞে হ্যাঁ। তা অবশ্য পারি।
কৌশিক বলে, কাইন্ডলি খাতাখানা দেখে সেটা বলবেন?
প্রসূনবাবু তখনো সহাস্যবদন। বলেন, কেন বলুন তো?
—ইন্দ্রদাই আমাকে বলেছিলেন, খবরটা জেনে যেতে। উনি রবিবারে কলকাতা ফিরেছেন, না সোমবার?
প্রসূনবাবুর হাসিমুখ একই রকম রইলো। বললেন, আই সি! সেক্ষেত্রে তাঁকে বলবেন, আমাকে চিঠি লিখতে অথবা টেলিফোন করতে!
কৌশিককের ভ্রূকুঞ্চন হলো। একটু অন্যসুরে বলে, কিন্তু কেন বলুন তো? এটা এমন কি গোপন ব্যাপার যে, আমাদের জানাতে পারেন না?
—না, না, গোপন ব্যাপার-স্যাপার কিছু নেই। তবে আমরা ইন্ডিভিজুয়ালি প্রতিটি বোর্ডারের স্বার্থ দেখে থাকি। একজনের কথা অপরজনকে জানাই না। এটা আমাদের হোটেল বিজনেস্-এর এস্থেটিক্যাল এটিকেট!
কৌশিক পকেট থেকে তার আইডেন্টিটি-কার্ড বার করে প্রসূনবাবুর দিকে বাড়িয়ে ধরল। বললো, ইন্দ্রকুমার চৌধুরী শুধু সম্পর্কে আমার স্ত্রীর দাদাই নন, তিনি সুকৌশলীর ক্লায়েন্ট। তাঁর স্বার্থেই আমরা প্রশ্নটা করেছি।
এতক্ষণে প্রসূনবাবুর মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল। গম্ভীরভাবে তিনি বললেন, “সুকৌশলী”? আই সি! একটি গোয়েন্দা-সংস্থা! তা ইন্দ্রকুমারের কাছ থেকে কোনও চিঠিপত্র আপনারা এনেছেন কি?
—না হলে আপনি কোনও রেজিস্টার্ড গোয়েন্দা এজেন্সিকে ঐ ফর্মাল খবরটুকু দেবেন না? তিনি কবে এসেছিলেন এবং কবে চেক-আউট করে ফিরে যান?
—আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিক তাই। আপনি যদি পুলিস হতেন, সরকারি গোয়েন্দা হতেন, অথবা ইন্দ্রকুমারের চিঠি দেখাতে পারতেন, তাহলে নিশ্চয়ই আমি সব কিছু আপনাকে জানিয়ে দিতাম। কিন্তু এখন—যখন দেখছি, আপনি প্রাইভেট গোয়েন্দা এবং যখন আপনি ইন্দ্রকুমারের কোনও চিঠি দেখাতে পারছেন না—তখন তো আমি বুঝতে পারছি না যে, আপনি ইন্দ্রকুমারের স্বার্থে ও প্রশ্ন করছেন অথবা ইন্দ্রকুমারের শত্রুর স্বার্থে ও কাজ করছেন! আইদার অব দিস্ মে বি টু! তাই নয় কি? সরি স্যার! আমার জবাব: নো কমেন্টস্!
কৌশিক বললে, হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। ইন্দ্রদার কাছ থেকে একটা চিঠি নিয়ে আসা উচিত ছিল আমাদের।
—থ্যাঙ্কু স্যার। আপনি বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ। তাই আমার সমস্যাটা বুঝতে পেরেছেন। আমাদের কাছে সবার আগে দেখতে হবে বোর্ডারের ইন্টারেস্ট। যদি না ‘স্টেট’ হস্তক্ষেপ করে। তাই নয়? প্রাইভেট গোয়েন্দা এজেন্সিকে ওব্লাইজ করা আমাদের কর্তব্য নয়। যেমন ধরুন, এই ভদ্রমহিলা—আপনার স্ত্রী। আপনি বলেছেন, আমি মেনে নিয়েছি। কিন্তু কোনো গোয়েন্দা এজেন্সি যদি ভবিষ্যতে এসে খোঁজ করে আপনি একা ছিলেন, না সস্ত্রীক, তাহলে আমি কি তার জবাব দিতে পারি? আমি কি জানি যে আপনি বিবাহিত না ব্যাচিলার?
—থ্যাঙ্কু অল দ্য সেম, মিস্টার ঘোষ। আমি আপনার সমস্যাটা বুঝতে পেরেছি!
.
ডাইনিং রুমে ফিরে এসে কৌশিক বললো, ম্যানেজারটি একটি বাস্তুঘুঘু! তোমার কী মনে হলো?
হোটেলের পরিবেশনকারী দুটি প্লেট, ছুরি-কাঁটা-ফর্ক আর জলের গ্লাস দিয়ে গেল। সে শ্রুতিসীমার বাইরে যেতেই সুজাতা বললো, আমার তা আদৌ মনে হলো না। উনি যা বলেছেন, তা যুক্তিপূর্ণ এবং এথিক্যাল। তুমি যদি ঝপ করে ‘সুকৌশলী’-র কার্ডখানা ভদ্রলোকের নাকের ডগায় মেলে না ধরতে তাহলে আমি হয়তো সুকৌশলে খবরটা জেনে নিতাম। তুমি তাড়াহুড়া করায় তা হলো না।
কৌশিক ঢোক গিলল।
পারশে মাছের সর্ষেবাটা কিন্তু ভালোই হয়েছিল।
আহারান্তে কৌশিক মুখটুক ধুয়ে যখন ক্যাশ কাউন্টারে এসেছে তখন দেখা দিল কার্তিক। কৌশিক জিজ্ঞেস করলো, কী ব্যাপার?
—আপনি পেমেন্টটা সেরে নিন, তারপর বলছি।
কৌশিক বিল মিটিয়ে এসে দেখে খানা-কামরার বাইরে কার্তিক আর সুজাতা কথা বলছে। কৌশিক এগিয়ে আসতেই সুজাতা বললো, কার্তিক বলছে, বিকালে লোকাল-ট্রিপের একটি পার্টি ও যোগাড় করেছে। প্রফেসর অ্যান্ড মিসেস্ সেনগুপ্তা, আর তাঁদের নাতনি। তার মানে, ন্যায্য যা ভাড়া হবে তার টু-ফিফ্থ্ আমাদের দিতে হবে। বিকাল সাড়ে চারটের সময় বের হতে হবে। তুমি কী বল?
—বাই অল মিস্। আমরা নিশ্চয় যাব। তার আগে একটু ওঁদের সঙ্গে প্রাথমিক আলাপ সেরে নিলে ভালো হয়। ওঁরা কত নম্বর ঘরে আছেন?
সুজাতা কার্তিকের দিকে তাকায়। সে বলে, ওঁরা আছেন তো তিনতলার একটি ঘরে; কিন্তু আপাতত তিনজনেই লাঞ্চ সেরে বসে আছেন লাউঞ্জে—টি.ভি. দেখছেন। আসুন না.?
ওরা তিনজনে এগিয়ে যায়। কার্তিক প্রফেসর সেনগুপ্তকে বলে, এই এঁদের দুজনের কথাই বলছিলাম, স্যার।
বৃদ্ধ প্রফেসর সেনগুপ্ত একেবারে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ান। যুক্তকরে এদের দুজনকে নমস্কার করে বলেন, আমরা এসেছি প্রায় দিন-সাতেক। রোজই পায়ে হেঁটে বেড়াই। আজ ভাবছি, হোটেলের গাড়িটা নিয়ে ঘাটশিলায় বিভূতিবাবুর বাড়িটা দেখে আসব। তা আপনারা দুজন…?
কৌশিক বললে, আমার নাম কৌশিক মিত্র, এ আমার স্ত্রী, সুজাতা। আপনার নাম তো জেনেছি প্রফেসরসাহেব, এবং মিসেস্ সেনগুপ্তার পরিচয়টাও পেয়েছি…
ওপাশ থেকে একটি কুড়ি-বাইশ বছরের সালোয়ার-কামিজ পরা মেয়ে কৌশিকের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললে, বাকি যে রইল তার নামটা হচ্ছে টুকাই। সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী!
সুজাতা বললে, টুকাই তো ডাকনাম, ভালো নামটা?
টুকাই বললে, দিদা যদি মিসেস্ সেনগুপ্তার পরিচয়ে একটি সন্ধে পাড়ি দিতে পারেন—ভালোমন্দ নাম ছাড়াই—তাহলে আমিই বা ছাড় পাব না কেন?
কৌশিকের লক্ষ্য হলো, টুকাই-এর বামচক্ষুটি অদৃশ্য। সে বলে, কিন্তু একটি সন্ধেতেই আমাদের যোগাযোগটা শেষ হয়ে যাবে এমন কথা কেন মনে করছ, টুকাই? কাল সকালে….
—পাখি উড়ে যাবে—ফুরুৎ! কাল সক্কালেই আমরা চেক-আউট করব।
প্রফেসরসাহেব তাঁর মানিব্যাগ খুলে একটি কার্ড বাড়িয়ে ধরে বলেন, কিন্তু পাখি তো শেষমেশ তার সাবেক দাঁড়ে গিয়ে বসবে? সুতরাং যোগাযোগটা শেষ না হবার সম্ভাবনাই বেশি।
মিসেস্ বলেন, তাছাড়া তুই নিশ্চয়ই আজ সন্ধেয় কিছু ছবি তুলবি—সেগুলোও তো সুজাতাদের পাঠাতে হবে? না কী?
সুজাতা তার লেডিজ ব্যাগ খুলে ওদের যৌথ-নামাঙ্কিত একটি বিজনেস্ কার্ড বার করে দেয়।
দেখে নিয়ে প্রফেসর বলেন, ‘সুকৌশলী’? নামটা যেন চেনা-চেনা লাগছে!
টুকাই জানতে চায়, কাঁটা-সিরিজের সুকৌশলী নাকি? হ্যাঁ তাই তো হবে। আপনারা ‘মেড-ফর-ইচ আদার’—কৌশিক আর সুজাতা।
সবাই হেসে ওঠে।
টুকাই বলে, আমি তাহলে আপনাকে এখনি একটা প্রবলেম দেব, কৌশিকদা। আপনি সল্যুশন করে দিন।
কৌশিক বলে, কিন্তু আমাকে তাহলে প্রফেশনাল ফি দিতে হবে। তোমার পুরো নামটা জানাতে হবে।
—অল রাইট! যদি সল্যুশনটা সভ্ করে দিতে পারেন।
বলতে বলতেই টুকাই তার ভ্যানিটি ব্যাগটা খোলে। এক গোছা পোস্টকার্ড সাইজ রঙিন ফটোগ্রাফ থেকে বেছে নিয়ে, একখানা বাড়িয়ে ধরে বলে, বলুন দেখি, দাদুর পাশে ঐ যে ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর নামটা কী?
কৌশিক ফটোগ্রাফখানা নিয়ে দেখল। সে যে চূড়ান্ত বিস্মিত হয়েছে তা তার মুখভঙ্গি দেখে বোঝা গেল না। নির্লিপ্তের মতো বললে, এটা আবার একটা সমস্যা নাকি? তোমার দাদুকে জিজ্ঞেস করলেই তো তিনি বলে দেবেন।
—না! দাদু গাড়ু মেরেছেন। জানেন না। আমি জানি; দাদু-দিদাকে বলেওছি কিন্তু ওঁরা বিশ্বাস করছেন না।
কৌশিক প্রফেসরের দিকে ফিরে বলে, কী স্যার? আপনি এঁকে চিনতে পারছেন না? ইনি তো নামকরা অভিনেতা : ইন্দ্রকুমার চৌধুরী।
টুকাই তার দাদুকে বললে, দেখলে?
কৌশিক বলে, টুকাই! এবার আমার প্রফেশনাল ‘ফিটা?
—অফ কোর্স! আমার পিতৃদত্ত নাম : সুচরিতা সেনগুপ্তা।
প্রফেসর বলেন, তাহলে আরও একটা সমস্যার পূরণ করে দিতে হবে আপনাকে—
—উঁ হুঁ হুঁ! ‘আপনি’ নয়, স্যার, ‘তুমি’।
—অলরাইট। তুমি আর একটা সমস্যার সমাধান করে দাও। আমি না হয়, তোমার প্রফেশনাল ফি-টা অগ্রিম মিটিয়ে দিচ্ছি। দেবদুলাল সেনগুপ্ত ছাড়াও আমার আর একটা নাম আছে—পিতৃদত্ত নয়, ছাত্রদলদত্ত : ডি. ডি. এস!
সবাই হেসে ওঠে! কৌশিক জানতে চায়, বলুন স্যার, সমস্যাটা কী?
—ঐ ইন্দ্রকুমারের পার্মানেন্ট অ্যাড্রেসটা কী?
–এটা কি একটা সমস্যা? রিসেপশনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেই তো তা জানতে পারবেন!
—না ভাই, কৌশিক। সে চেষ্টা করা হয়েছে। সেখানেও টুকাইয়ের দাদু গাড্ডু মেরেছেন। হোটেলের ম্যানেজার সবিনয়ে এবং সুদৃঢ়ভাবে জানিয়েছেন : হোটেল-এথিক্সে মানা আছে এক বোর্ডারের কথা অপর একজনকে বলা।
কৌশিকের সঙ্গে সুজাতার দৃষ্টি বিনিময় হলো। সুজাতা জানতে চায়, কিন্তু আপনিই বা ওঁর ঠিকানা জানবার জন্য এত উদ্গ্রীব কেন? মানছি, ইন্দ্রকুমার ব্যাচিলার, কিন্তু যতই লালটু- মার্কা চেহারা হোক, তিনি পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই। আপনার নাতজামাই হিসাবে তাকে মানাবে না।
টুকাই তার হাতে-ধরা ম্যাগাজিনটা দিয়ে সুজাতার হাঁটুতে একটা ছদ্মতাড়না করে।
দেবদুলাল বললেন, তাহলে গল্পটা খুলে বলতে হয়।
কার্তিক হঠাৎ বলে ওঠে, আমি চলি, স্যার। তাহলে ঐ কথাই রইলো। আমি সাড়ে- চারটের সময়ে গাড়ি লাগাব।
এতক্ষণে সকলের খেয়াল হলো—কার্তিক ওঁদের সম্মতির অপেক্ষায় অদূরে দাঁড়িয়েছিল এতক্ষণ। প্রফেসার বললেন, হ্যাঁ, ঠিক আছে কার্তিক। বিকাল সাড়ে-চারটে।
দেবদুলাল বিস্তারিত জানালেন তাঁর ইন্দ্রকুমার সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা। সাত দিনের জন্য ‘সুবর্ণরেখা হোটেল’ বুক করে উনি এসেছেন গত সোমবার, ত্রিশে অক্টোবর সকালে। ইস্পাতে। ট্রেন ঠিক সময়েই এসেছিল। সকাল দশটায়। উনি কলকাতা থেকেই হোটেলের গাড়িটা বুক করেছিলেন। কার্তিক স্টেশনে ছিল। একই ট্রেনে হোটেলে আগমনেচ্ছু আর একটি দম্পতি ছিলেন—অবাঙালী। পাঁচজনকে নিয়ে কার্তিক হোটেলের প্রবেশদ্বারের সামনে গাড়িটা পার্ক করা মাত্র ঐ ভদ্রলোক বারান্দা থেকে ছুটে এসে কার্তিককে ধমকে উঠলেন : তোমার কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই! আমি তোমাকে কটার সময় বুক করেছিলাম?
কার্তিক বলেছিল, কার্লা-হাওড়া এক্সপ্রেস ধরবেন তো, স্যার? মাসে পঁচিশ দিন সেটা লেটে আসে। ধরা যাক আজ তা এল না। তাতেই বা কী? আপনার ট্রেন ছাড়বে—রাইট- টাইম এগারোটা সাতাশ। এখনো পাক্কা এক ঘণ্টা সময় আছে। রিজার্ভেশন তো করানোই আছে। ঘাবড়াচ্ছেন কেন? এখান থেকে ঘাটশিলা স্টেশন তো বাইশ মিনিটের জার্নি। আসুন স্যার, উঠে বসুন।
ভদ্রলোক তবু গোঁজ-গোঁজ করতে থাকেন। ডিকি থেকে এঁদের মালপত্র নামাবার সময়টা পর্যন্ত যেন দিতে চান না। এর মধ্যে টুকাই বেমক্কা ওঁকে প্রশ্ন করে বসল, আপনাকে আগে কোথাও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে! কোথায় বলুন তো?
ভদ্রলোক হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, সেটা আমার দুর্ভাগ্য! আমি সর্বত্র বিরাজমান। আমার নাম হরিদাস পাল!
গল্পটা থামিয়ে সুজাতা টুকাইকে বললে, এর জবাবে তুমি ওঁকে কিচ্ছু বললে না?
-–না, সুজাতাদি! আমি চাইনি, ইন্দ্রকুমার তার বদমেজাজের জন্য ট্রেনটা মিস্ করুক আমি ওকে ঠিকই চিনতে পেরেছিলাম। তাই ক্লিক করে এই ছবিটা তুলে নিলাম।
ইন্দ্রকুমার খেপে আগুন : এ কি! আপনি পার্মিশন না নিয়ে, আমার ছবি তুললেন কেন?
টুকাই জবাবে বলেছিল, আপনি ভুল করছেন মিস্টার হরিদাস পালমশাই! আমি দাদুর ফটো নিয়েছি—তিনিই আমার এ শটের হিরো; আপনি ইন্সিডেন্টালি ফ্রেমে আছেন, এই যা—অ্যাজ একস্ট্রা! ফিল্মি-লব্জ্ বোঝেন তো মিস্টার হরিদাস পাল?
—তারপর, তারপর?—সুজাতা সোৎসাহে জানতে চায়।
—ওর ট্রেন ধরার তাড়া ছিল। ঝগড়া করার টাইম নেই। নিক্কথায় গাড়িতে উঠে বসল মালপত্র সমেত, আর কার্তিক হুম্ করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। দাদু আমাকে বললেন, তুই বেমক্কা হরিদাসবাবুর ফটো নিলি কেন? তখন আমি দাদুকে বুঝিয়ে বললাম, ও ‘হরিদাস পাল ‘ থোড়াই। ও একজন অভিনেতা–ইন্দ্রকুমার চৌধুরী। তাই ধরাকে সরা জ্ঞান করে। তা দাদু বিশ্বাস করলো না।
কৌশিক জানতে চায়, কিন্তু সে ক্ষেত্রে ইন্দ্ৰকুমারের ঠিকানা জানার কী প্রয়োজন হলো?
দিদা এবার কথোপকথনে যোগ দেন, সে আর এক গল্প। ঘটনাচক্রে ঐ ইন্দ্রকুমারের সদ্য ছেড়ে যাওয়া ঘরখানাই আমাদের অ্যালট করা হয়েছিল। তিনতলায় দু-নম্বর ঘর। আমি বেতো রুগী, দোতলায় চেয়েছিলাম—কিন্তু দোতলায় কোনো ঘর খালি ছিল না। সে যাহোক, ঘরটা সাফা করার পর আমরা সেটা দখল করলাম। উনি হাতঘড়িটা খুলে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে রাখতে গিয়ে দেখেন সেখানে একটা ছোট্ট নোটবই!
প্রফেসার স্ত্রীর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, না, নোটবই ঠিক নয়—মিনি-টেলিফোন রেকনার। এ-বি-সি-ডি করে পৃষ্ঠা সাজানো। তাতে দশ-বিশটি টেলিফোন নাম্বার লেখা। মনে হলো অধিকাংশ কলকাতার নম্বর। প্রথম পৃষ্ঠায় মালিকের নাম লেখা আছে— স্বাক্ষরের মতো হস্তাক্ষরে: “ইন্দ্রকুমার”। এমনকি “চৌধুরী”ও লেখা নেই। কোনও ঠিকানার বালাই নেই। ইন্দ্রকুমারের এন্ট্রি নেই। হয় ভদ্রলোকের নিজস্ব টেলিফোন নেই, অথবা ইচ্ছে করেই সেটা লেখেননি। টুকাই বলছে যে, ভদ্রলোক অভিনেতা—নাম ইন্দ্রকুমার চৌধুরী। টেলিফোন নোটবইটা দেখার পর তা বিশ্বাস হলো। কিন্তু তাহলে তিনি কেন টুকাইকে বললেন যে, ওঁর নাম হরিদাস পাল?
টুকাই বাধা দিয়ে বলে ওঠে, বুঝলে না? স্রেফ ভেনগ্লোরিয়াসনেস্! চালবাজি! কেওকেটা ভাব!
প্রফেসর বললেন, হয়তো তাই। তা আমি সরলভাবে খাতাটা কাউন্টারে জমা দিতে চাইলাম। বাধা দিলেন টুকাইয়ের দিদা!
বাধা দিয়ে মিসেস্ সেনগুপ্তা বলেন, না! আমি না। টুকাই।
—তোমরা দুজনেই!
—তা বলতে পার। আমি টুকাইয়ের পক্ষ নিয়েছিলাম।
তারপর সুজাতার দিকে ফিরে বলেন, তুমিই বল, সুজাতা, কেন আমি টুকাইয়ের পক্ষ নেব না? ভদ্রলোক যেরকম অভদ্রতা করে গেলেন…
কৌশিক বলে, আপনার বক্তব্য স্ববিরোধী হয়ে যাচ্ছে দিদা! ভদ্রলোকেরা অভদ্রতা করে না। টুকাই, তুমিই বুঝিয়ে বল–
টুকাইয়ের বাঁ-দিকে একটা চুলের গোছা (সেটা, – হোক আমার রচনা ‘স্ববিরোধী’—অতি সুবিন্যস্তভাবে অবিন্যস্ত। অর্থাৎ মাথা নাড়লেই চুলের গোছা বাঁ-চোখের উপর অসোয়াস্তিকর ভাবে ঝুলতে থাকে, চোখটা অদৃশ্য হয়ে যায়। আর টুকাই সেটা ক্রমাগত সরিয়ে দেয়) চোখের উপর থেকে সরিয়ে দিয়ে বললে, আমিই দাদুকে বললাম, খাতাখানা আমাকে দিতে। আমি চেয়েছিলাম রিসেপশন-কাউন্টার থেকে ইন্দ্রকুমারের ঠিকানাটা সংগ্রহ করে তাঁকে রেজিস্ট্রি-ডাকে ঐ ছোট্ট খাতাখানা ফেরত পাঠাতে। খামের উপর লেখা থাকবে ইন্দ্রকুমার চৌধুরীর নাম—পোস্টাল ডিপার্টমেন্টের খাতিরে; আর ভিতরে থাকবে আর একখানা খাম ‘শ্রীল শ্রীযুক্তবাবু হরিদাস পাল’-কে সম্বোধন করে। মিনি-টেলিফোন বুকের সঙ্গে থাকবে ঐ ফটোটা এবং কিছু উপদেশ : মঞ্চ থেকে নেমে আসার পর অভিনেতাদের কাছ থেকে কী জাতীয় ভদ্র ব্যবহার প্রত্যাশা করে সাধারণ দর্শক।
সুজাতা জানতে চায়, তার সঙ্গে তোমার নাম-ঠিকানা থাকবে না?
চুলের গোছা আবার সরিয়ে দিয়ে টুকাই বললো, না! অ্যান এম্ফাটিক : নো! আমি নাম- ঠিকানা জানালেই ঐ অভদ্র লোকটা ভাবত আমি এভাবে ওর সঙ্গে পত্রবঙ্কুত্ব করতে লালায়িত। সে ইচ্ছা আমার আদৌ নেই
কৌশিক জানতে চায়, তা রিসেপশন-কাউন্টারে ইন্দ্রকুমারের নাম-ঠিকানা পেলে না?
—না! পেলে আর কেন দাদু আপনাকে বলবেন সেটা যোগাড় করে দিতে? বলুন?
—তা ঠিক। তা রিসেপশনের ঐ ভদ্রলোক-প্রসূনবাবু কী বললেন?
—প্রসূনবাবু কি না জানি না—উনিই বোধহয় ম্যানেজার—টাক মাথা, বছর পঞ্চাশ বয়স, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা—তিনি বললেন, হোটেলের নিয়ম নেই এক বোর্ডারের নাম-ধাম-ঠিকানা তাঁর বিনা অনুমতিতে অন্য বোর্ডারকে জানানো
সুজাতা জানতে চায়, সে-ক্ষেত্রে খাতাটা অফিসে জমা দিলে না কেন?
–কেন দেব? অত সহজে আমি হার মানবার পাত্রী নই। আমি জানি, ইন্দ্রকুমার এখন ‘নটরঙ্গ’ পাবলিক স্টেজে অভিনয় করে। সেখানে গিয়ে ওরা ঠিকানা সংগ্রহ করা কঠিন হবে না। সবাই তো আর প্রসূনবাবুর মতো নয়।
সুজাতা এবার বলে, তোমাকে এতক্ষণ বলিনি টুকাই—ইন্দ্রকুমার সম্পর্কে আমার দাদা হয়। ও কনফার্মড ব্যাচিলার! শ্যামপুকুরে থাকে। ওর বাড়িতে টেলিফোন নেই। তবে ওর ঠিকানা আমার অ্যাড্রেস-বইতে লেখা আছে।
টুকাই তার বামচক্ষু আবরিত-করা অলকগুচ্ছকে শাসন করে কৌশিকের দিকে ফিরে জানতে চায়, সত্যি?
কৌশিক বলে, ট্রুথ। বাট নট দ্য হোল টুথ!
সুজাতা রুখে ওঠে, কী মিথ্যা বলেছি আমি?
—মিথ্যা বলনি। তবে অজ্ঞানে অসত্য বলেছ। ইন্দ্রকুমারের বয়স পঞ্চাশ ছুঁই-ছুঁই, ইফ নট্ অন দ্য সিনিয়ার হাফ অব দ্য সেঞ্চুরি—কিন্তু সে ‘কনফার্মড’ ব্যাচিলার নয়। দু-দুজন মহিলা—আমার জ্ঞানমতে মাত্র দুইজনই—ইন্দ্রকুমারের সঙ্গে নীড় বাঁধায় উৎসাহী!
টুকাই বলে, তাহলে কলকাতায় ফিরে অ্যাড্রেস-বই দেখে ইন্দ্রকুমারের শ্যামপুকুরের পোস্টাল অ্যাড্রেসটা জানাবেন?
সুজাতা বললো, কলকাতা যেতে হবে না। ‘পত্তা-কেতাব’ আমার সঙ্গেই আছে। বিকালেই তোমাকে ইন্দ্রকুমারের ঠিকানাটা দিয়ে দেব…
কৌশিক পাদপূরণ করে,…একটি শর্তে।
—কী শর্ত?
—আমাদের প্রফেশনাল ফি দিতে হবে।
–এবার সেটা কী?
কৌশিক বললো, ঐ যে ফটোগ্রাফটা দেখালে—যাতে দেখা যাচ্ছে ইন্দ্রকুমার ডিকিতে মার্ল তুলছেন আর তোমার দাদু মাল নামাচ্ছেন—ঐ ফটোখানা আমাদের দিয়ে দিতে হবে। নেগেটিভ তো তোমার কাছে রইলই, তুমি আর এক কপি বানিয়ে নেবে।
—এ আর কী এমন শক্ত ব্যাপার, নিন্—
কুন্তলগুচ্ছ শাসনে এনে সে ফটোগ্রাফখানা বাড়িয়ে ধরে।
কৌশিক বলে, আরও একটু কৃত্য আছে টুকাই। ঐ ফটোর পিছনে লিখে দাও যে, ‘এই ফটোখানা আমি সোমবার, 30.10.95-এ বেলা প্রায় সাড়ে দশটার সময় গালুডির ‘সুবর্ণরেখা’ হোটেলের সামনে তুলেছিলাম। ছবিতে আমার দাদু প্রঃ ডি. ডি. সেনগুপ্ত এবং একজন বোর্ডারকে দেখা যাচ্ছে, যিনি বলেছিলেন তাঁর নাম হরিদাস পাল।’—এইটুকু লিখে সই করে দিতে হবে। ডেটেড সিগনেচার।
টুকাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। প্রফেসর সেনগুপ্ত বলেন, কেন বল তো? সেটা নিয়ে তুমি কী করবে?
কৌশিক বলে, আমি তো অন্যায় কিছু দাবি করিনি প্রফেসর সেনগুপ্ত। টুকাই তার জ্ঞানমতে যা সত্য বলে জানে তাই তো জানাচ্ছে।
প্রফেসর বলেন, বাট হোয়াই?
কৌশিক বললে, সচরাচর আমরা হাতের তাস দেখাই না। কিন্তু আপনাকে দেখাব। কথাটা গোপন রাখবেন। আমারা এখানে ঠিক বেড়াতে আসিনি। এসেছি একটা ইনভেস্টিগেশনে। আটাশে অক্টোবর হুগলিতে এক ভদ্রলোক খুন হয়েছেন। সে ভদ্রলোক ইন্দ্রকুমারের ঘনিষ্ঠ বঙ্কু ছিলেন। পুলিস হয়তো চাইবে ইন্দ্রকুমারকে আসামী হিসাবে খাড়া করতে। আমরা ‘সুকৌশলী’র তরফে প্রমাণ সংগ্রহ করতে এসেছি যে, শনিবার আটাশে অক্টোবর ইন্দ্রকুমার ঘটনাস্থলের অনেক দূরে ছিলেন। তাঁর ব্যবহার ভদ্রজনোচিত হোক বা না হোক—এই বিশেষ ক্ষেত্রে তিনি খুনী হতে পারেন না।
প্রফেসর শুধু বললেন, গুড গড! য়ু মিন ঐ ফটোগ্রাফটাই প্রমাণ দেবে ইন্দ্রকুমারের অ্যালেবাঈ?
—আমি তাই আশা করছি।
মিসেস্ সেনগুপ্তা বলেন, তার মানে টুকাইকে তোমরা সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাইছ?
টুকাই দৃঢ় প্রতিবাদ করে, তাতে দোষ কী দিদা? একজন নির্দোষী মানুষকে বাঁচানোর দায়িত্ব তো প্রত্যেকেরই সামাজিক কর্তব্য। সেক্ষেত্রে ঐ টেলিফোনের মিনি বইটাও আপনি নিয়ে যেতে পারেন। দাদুকেও কাঠগড়ায় তুলে ব্যারিস্টার বাসুসাহেব প্রশ্ন করে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন যে, দাদু এটা সুবর্ণরেখা হোটেল 3/2 নম্বর ঘরে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে খুঁজে পায়। সেটাও ঐ সোমবার এগারোটা নাগাদ।
মিসেস্ সেনগুপ্তা মন খুলে বলেই ফেলেন, আমার বাপু এসব ভালো লাগছে না। এলাম বেড়াতে, তার মধ্যে ঢুকে পড়লো খুনখারাপি, আদালতের সমন
প্রফেসর তাঁকে বললেন, দিস্ ইস্ লাইফ, রমা! ঠিকই বলেছে টুকাই—নিরপরাধীকে রক্ষা করা আমাদের সামাজিক দায়িত্ব! সকালবেলা একগ্লাস নিমপাতার রস যে তুমি আমাকে দাও—সেটা কি স্বাদের আকর্ষণে পান করি আমি? শারীরধর্ম রক্ষার জন্য খাই। সমাজের শারীরধর্ম রক্ষার জন্য এইটুকু আমাদের করণীয়। ইয়েস ইয়ং ম্যান! আই এগ্রি! প্রয়োজনে আমরা দাদু-নাতনি সাক্ষী দেব যে, হুগলিতে যখন হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয় তার দেড়-দু’দিন পরে ইন্দ্রকুমার গালুডি ছেড়ে কলকাতা-মুখো রওনা হন।
.
রাত্রে শুতে যাবার আগে ভালো পোশাকটা ছেড়ে সুজাতা একটা নাইটি পরেছে। নৈশ মুখপ্রক্ষালনও শেষ হয়েছে। মুখে কী-একটা ক্রিম মাখতে মাখতে বললো, বাব্বা! এতক্ষণে সব সমস্যার সমাধান হলো। মানে, যে মিশন নিয়ে এসেছি। নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে ইন্দ্রকুমার টুকাইয়ের সঙ্গে যতই দুর্ব্যবহার করে থাক, চুঁচুড়ার হত্যাকাণ্ড থেকে সে শতহস্ত দূরে।
কৌশিক বললে, একটা কথা সুজাতা! তুমি ঐ কথাটা বরাবর আমার কাছ থেকে গোপন রেখেছিলে কেন বলত?
—কোন কথাটা?
ইন্দ্রকুমার টেলিফোন করে তোমাকে জানিয়েছিল যে, সে এই হোটেলে একটা ছোট্ট নোটবই—টেলিফোন-রেকনার—ফেলে গেছিল?
সুজাতা এদিকে ঘুরে কৌশিকের মুখোমুখি বসে। এক গাল হেসে বলে, এটা এত শক্ত প্রবলেম যে, সুকৌশলীর সিনিয়র পার্টনারের মাথায় ঢুকবে না। …এই না, না, রাগ কর না–শোন বুঝিয়ে বলি। এককথায় : গালুডিতে এসে আমি না ‘অলীকবিবি’ হয়ে গেছি!
—কী হয়ে গেছ? ‘অলীকবিবি’? তার মানে?
—জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘অলীকবাবু’কে মনে আছে? গুলসম্রাট অলীকবাবু? সে ইচ্ছামতো একের পর এক গুল মারত, আর চোখের সামনে দেখত, তার গুলগুলো সত্যি হয়ে গেছে। অলীকবাবু এক লক্ষপতি মারোয়াড়ির নামে গুল ঝাড়ল, তৎক্ষণাৎ স্টেজে এক মারোয়াড়ি হাজির: “আগে কাম, পিছে সেলাম—উঁ উঁ উঁ!’ অলীকবাবু চীনেম্যানের কথা বললো : তৎক্ষণাৎ চ্যাঙ-চুঙ চীনেম্যান স্টেজে হাজির!
—তার সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক?
–বেলবয়ের সঙ্গে আর ম্যানেজারের সঙ্গে খেজুরে আলাপ জমাতে হবে বলে আমি একটা নির্ভেজাল খাঁটি গুল ঝাড়লাম : ইন্দ্রদা আমাকে বলেছে, সে একটা ছোট পকেট- রেকনার এই হোটেলে ফেলে রেখে গেছে। স্রেফ মিথ্যে কথা। গুল! আর এই ‘অলীকবিবি’র গালে একটা থাপ্পড় মেরে প্রফেসর ডি. ডি. এস. বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, জানি। এইতো সেটা!’ কী অদ্ভুত কাকতালীয় কাণ্ড বল তো?
—তার মানে, ইন্দ্রকুমার যে সত্যিই একটা নোটবই ফেলে গেছেন তা তুমি জানতে না? গুল মেরেছিলে?
—না তো বলছি কি? খবরটা জানা থাকলে কি আমি তোমার কাছেও গোপন করব?
—তা বটে!
.
পরদিন ওরা হাওড়া থেকে ট্যাক্সি নিয়ে যখন নিউ আলিপুর এসে পৌঁছলো তখন রাত সাড়ে দশ। বেল বাজাতে, ম্যাজিক আই দিয়ে ভালো করে দেখে নিয়ে বিশে সদর খুলে দিল।
কৌশিক বলে, কি রে বিশে? মামা-মামী শুয়ে পড়েছেন?
–না তো! ঘরে বসে গপ্পোসপ্পো করছেন আর কি। সাহেব আজ সেইটা বার করেছেন— হাতের মুদ্রায় শ্যিভাস-রিগ্যালের বোতলটা দেখায়।
সুজাতা বলে, তুই খেয়ে নিয়েছিস্?
—না। এইবার খাব। আপনারা?
—আমার রাতে খেয়ে এসেছি। মামিমাকে বলে দিস…
করিডোরের ও-প্রান্তে একটা সুইচ জ্বলে ওঠে। হুইল-চেয়ারে পাক মেরে রানু এগিয়ে আসেন। বলেন, এই তো! এসে গেছ তোমরা। রাতের খাবার ফ্রিজে রাখা আছে। বিশে শুধু গরম করে দেবে।
কৌশিক বলে, না মামিমা, আমরা রাতের খাবার ট্রেনেই খেয়ে এসেছি। হোটেল থেকে প্যাকেট দিয়েছিল। ফ্রিজে যা আছে তা কাল সকালে সদ্ব্যবহার করা যাবে। মামু কি শুয়ে পড়েছেন?
—না। তাঁর থার্ড পেগ চলছে। তোমরা গিয়ে প্রাথমিক রিপোর্টটা দাখিল কর, দেখি সেই মওকায় হাতসাফাই করে বোতলটা সরিয়ে ফেলতে পারি কি না। এস তোমরা।
তিনজনে এগিয়ে আসেন বাসুসাহেবের ঘরে। উনি একটা ইজিচেয়ারে লম্ববান। পাশে টি- পয়তে গ্লাস-বোতল-জল-আইস কিউব
সুজাতা-কৌশিক এদিক থেকে প্রাচীন ভারতীয় শালীনতা মেনে চলে। মাত্র দু-দিনের জন্যে কলকাতার বাইরে গিয়েছিল। কিন্তু এগিয়ে এসে দুজনেই বাসুসাহেবকে প্রণাম করলো। মামীকেও।
বাসু বললেন, এই যে মিস্টার অ্যান্ড মিসেস্ সুকৌশলী! আপনারা দুজন যে নিরাপদে ফিরে আসতে পেরেছেন এতেই আমরা ধন্য।
বোঝা গেল, তিন পেগেই বাসুমামুর নেশাটা জমজমাট!
রানু ইতিমধ্যে কায়দা করে হুইল-চেয়ারটা টি-পায়ের ওপাশে ভিড়িয়ে বড় বোতলটা ।দখল করেছেন। বলেন, ওদের কাছ থেকে প্রাথমিক রিপোর্টটা শুনে নিয়ে ‘লেটস্ কল ইট এ ডে’! বিস্তারিত রিপোর্ট কাল শুনো!
—তা না হয় শুনব। কিন্তু তুমি… মানে, ইয়ে…ওটা নিয়ে যাচ্ছ কেন?
বোতলটা সুজাতাকে হস্তান্তরিত করে রানু বলেন, তোমার বরাদ্দ মতো দু-পেগ শেষ করে একটা এক্সট্রা পেগও হয়ে গেছে। আর নয়।
প্রসঙ্গটা চাপা দিতে কৌশিক বলে, আমাদের মিশন সাকসেসফুল। বুঝলেন মামু?
–রিয়েলি! কী মিশন নিয়ে তোমরা ঘাটশিলা গেলে মিস্টার অ্যান্ড মিসেস্ সুকৌশলী?
-–বাঃ! আপনার মনে নেই? ঘোষাল-হত্যা মামলায় চার-চারজন সম্ভাব্য অপরাধীর কথা আপনি ভাবছিলেন—ব্রজবাবু, ইন্দ্রকুমার, অ্যাগি আর ডঃ দাশ। তাই ইন্দ্রকুমারের অ্যালেবাঈটা যাচাই করে দেখতে আমাদের দুজনকে গালুডি পাঠিয়েছিলেন। দ্যাট চ্যাপটার ইজ ক্লোজড। ইন্দ্রকুমার ঐ চারটি সম্ভাব্য কাঁটার ভিতর থেকে সমূলে উৎপাটিত—
–কী? কী বললে? কিসের থেকে?
—সম্ভাব্য কণ্টক। কাঁটা—
কোথাও কিছু নেই, ব্যারিস্টারসাহেব একেবারে দুর্বাসা মুনি: তোমরা কি আমাকে একটুক্ষণও শান্তিতে থাকতে দেবে না, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস্ সুকৌশলী! মধ্যরাত্রে একা একা বসে মৌজ করছি, এখানেও সেই কাঁটা? কী পেয়েছ তোমরা? অ্যাঁ? ডাইনে কাঁটা, বাঁয়ে কাঁটা, হেঁটোয় কাঁটা, মুড়োয় কাঁটা! শুধু কাঁটা আর কাঁটা! একটা শেষ হতে না হতেই আর একটা! তাহলে সকল কাঁটা ধন্য করে জোলাপটা কখন ফুটবে? অ্যাঁ? আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবেন মিস্টার অ্যান্ড মিসেস্ সুকৌশলী?
রানু কৌশিককে আস্তিন ধরে টানলেন। ওদের ইঙ্গিত করলেন কেটে পড়তে।
তাই পড়লো ওরা। নিঃশব্দে। পা টিপে টিপে। বাসু ক্লান্ত হয়ে আবার ইজিচেয়ারে শুয়ে পড়েছেন। তাঁর চোখ দুটি বোজা।
সুজাতা ফিফিস্ করে রানুকে বলে, মামা কি আজ একেবারে আউট? জোলাপের কথা কী যেন বললেন, মামু?
রানু হাসলেন। বললেন, উনি না হয় তিন পেগের পর কথাটা মুখ ফস্কে বলে ফেলেছেন। কিন্তু তোমরা দুজন তো মদ্যপান করনি। বুঝতে পার না—উনি ‘জোলাপের’র কথা বলছেন না? বলছেন : ‘গোলাপ’-এর কথা!
সুজাতা অবাক হয়ে বলে, গোলাপ! মানে?
রানু বললেন, গোলাপ একটা ফুলের নাম, সুজাতা। তুমি ভুলে গেছ। একটু চেষ্টা করে দেখ, মনে পড়ে যাবে। এখন যাও, শুয়ে পড়।
—কিন্তু মামু যে—
—ভবের ভ্রূকুটির ভাবনাটা ভবানীকেই ভাবতে দাও, সুজাতা! তোমরা দুজন বরং ভেবে দেখ গোলাপের কথা আজ এতদিন পরে হঠাৎ কেন বললেন উনি। কাঁটা নয়— গোলাপ!