ড্রেস-রিহার্সালের কাঁটা – ১০

দশ

ডি. এস. পি.-সাহেবের কাছ থেকে অনেক তথ্যই সংগ্রহ করা গেল। অটোপ্সি সার্জেন-এর রিপোর্ট এবং ঘটনার রাত্রে প্রত্যক্ষদর্শীদের কয়েকজনের জবানবন্দি। যুগল সব কিছুই জেরক্স করিয়ে এনে দিলেন। নিমন্ত্রিত ছিলেন নয়জন। এছাড়া ভৃত্য বা সেবকশ্রেণীর কয়েকজন ইনভেস্টিগেটিং অফিসার চন্দন নন্দী বেশ গুছিয়ে রিপোর্ট লিখেছে। প্রথমে নিমন্ত্রিত ও সেবকশ্রেণীর চোদ্দজনের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় :

1. মিস্ অ্যাগনেস্ ডুরান্ট, মানসিক চিকিৎসালয়ের প্রধানা মেট্রন

2. ডঃ অমরেশ দাশ, এম. ডি.―ডক্টর ঘোষালের দক্ষিণ হস্ত।

3. মিসেস্ ছায়া পালিত, ড্রেস-ডিজাইনার

4. ক্যাপ্টেন পালিত, ঐ স্বামী, প্রাক্তন পাইলট। এখন অবসরপ্রাপ্ত।

5. অনুরাধা বসু-অভিনেত্রী।

6. গুণবতী মোহান্তি, ওড়িয়া; জনৈক ওড়িশা-রাষ্ট্রমন্ত্রীর বিধবা।

7. সুভদ্রা মোহান্তি, ঐ কন্যা। চলচ্চিত্রে ও মঞ্চে অভিনয় করে

৪. জয়ন্ত মহাপাত্র—সুভদ্রার সহপাঠী ও বঙ্কু। সম্ভবত পাণিপ্রার্থী।

9. পম্পা সেনরায়, মিসেস্, ডি. এস. পি.

এই নয়জন নিমন্ত্রিত উপস্থিত ছিলেন। দুজন নিমন্ত্রিত আসেননি। এঁরা ছাড়া ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল আরও পাঁচজন সেবকশ্রেণীর নরনারী।

10. নন্দু দাস—গৃহভৃত্য। প্রায় সাত বছর চাকরি করছে।

11. শৈলেশ মান্না—ড্রাইভার। ডাক্তারবাবুর মেজানাইন ঘরে থাকে। সাত বছর চাকরি।

12. রুক্মিনী—ঠিকে ঝি। সচরাচর সন্ধের সময় চলে যায়। খাওয়া-দাওয়া ছিল বলে ডাক্তারবাবু যেতে দেননি। আহারাদি করে যাবার কথা।

13. শম্ভু শীল—স্থানীয় ক্যাটারার। সঙ্গে চার-পাঁচজন কর্মী, তাদের নাম লেখা হয়নি।

14. হারাধন দাশ—ডাক্তারবাবুর সদ্য-নিযুক্ত কম্বাইন্ড-হ্যান্ড। মাত্র ছয়-সাত দিন পূর্বে কাজে লেগেছে।

এই পর্যন্ত পাঠ করে বাসু থামলেন। বললেন, এই হারাধন দাশটিকে তুমিই সরবরাহ করেছিলেন নিশ্চয়?

যুগলকিশোর অবাক হয়ে বললেন, আমি! কী বলছেন? বরং ডি. আই. জি. যখন বললেন, আপনি এ কেসে ইন্টারেস্টেড, আমি তো তৎক্ষণাৎ ধরে নিয়েছি যে, হারাধন আপনার প্রেরিত দেহরক্ষী।

স্তম্ভিত হয়ে গেলেন বাসু। বলেন, এ রকম ধরণা করার মানে?

—সেকথা আগেই বলতে যাচ্ছিলাম, পম্পার জবানবন্দির মাঝখানে। আপনি বাধা দেওয়ায় বলা হয়নি। দিনকতক আগে, পুরী থেকে ফিরে এসেই ডাক্তার ঘোষাল আমার সঙ্গে বাড়িতে দেখা করেন। ‘কাল্লু’র কেসটা আমাকে সবিস্তারে বলেন। উনি যখন পুরীতে ছিলেন তখন কাল্লু নাকি মিস্ ডুরান্টের কাছে ওঁর তল্লাশ করে। ডাক্তারবাবু আমাকে অনুরোধ করেছিলেন পুলিস-বিভাগে তদন্ত করে খোঁজ নিয়ে দেখতে, কাল্লু কবে ছাড়া পেয়েছে। আমি বলেছিলাম, খোঁজ নিয়ে দেখব। উপরন্তু বলেছিলাম, উনি যদি ‘ইন্‌সিকিওর্ড ফিল’ করেন তাহলে একটি দেহরক্ষীর ব্যবস্থা করে দিতে পারি। উনি আমার উপকার করেছেন বলেই নয়—শহরের উনি একজন পরোপকারী মানী সজ্জন। সকালবেলা সপ্তাহে তিন দিন তিনি স্থানীয় মানসিক ভারসাম্যহীনদের দেখতেন, চিকিৎসা করতেন—বিনা দক্ষিণায়। কিন্তু উনি রাজি হলেন না।

বাসু জানতে চান, কেন রাজি হলেন না, তা কিছু বলেছিলেন?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। বলেছিলেন, ডাক্তারবাবু ইতিমধ্যেই একজন দেহরক্ষীকে পেয়ে গেছেন। অত্যন্ত কম্পিটেন্ট এবং যার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের অতীত। আমি জানতে চেয়েছিলাম, কে আপনাকে দিয়েছেন অমন একটি বিশ্বাসযোগ্য কর্মদক্ষ দেহরক্ষী? পুলিস-বিভাগের কেউ না মিলিটারি? উনি হেসে বলেছিলেন, ‘সে বিষয়ে তুমি চিন্তা কর না, যুগল! এ একেবারে ঈশ্বরদত্ত সম্পদ।’ তাই আপনি ঘোষালের কেস সম্বন্ধে খোঁজ নিচ্ছেন জেনেই আমি ধরে নিলাম যে, ঐ হারাধনকে আপনিই পাঠিয়েছেন।

বাসুর পাইপটা নিভে গিয়েছিল। ধরাতে ধরাতে বললেন, কী আশ্চর্য! কী অপরিসীম আশ্চর্য! কারণ আমি পুরীতে ঘোষালকে বলেছিলাম, সে যদি চায় তাহলে একজন বিশ্বাসী ও কর্মদক্ষ দেহরক্ষীর বন্দোবস্ত আমি করে দিতে পারি। সে চিনসুরায় এসে আমাকে ফোন করে জানিয়েছিল যে তেমন একজন লোক সে স্থানীয় আরক্ষা বিভাগ থেকেই পেয়ে গেছে। সে যাই হোক, কিন্তু সেই হারাধন দাশের জবানবন্দি তো এই বান্ডিলে নেই!

—না, নেই। কারণ আমরা তদন্ত করতে যাওয়ার আগেই সেই কর্মদক্ষ ও বিশ্বাসী দেহরক্ষীটি ফেরার হয়ে গেছে!

—ফেরার?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। ঘটনার রাত্রেই! মৃতদেহ অপসারিত হবার আগেই। বাসু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনলেন।

—হারাধন দ্বিতলে একটা খাটিয়া পেতে রাত্রে ঘুমতো, ডাক্তারসাহেবের শয়নকক্ষের সংলগ্ন বারান্দায়। ও এসেছিল একটা ছোট টিনের সুটকেস নিয়ে। সেটা নিয়ে যায়নি। দ্বিতলেই ডাক্তারবাবুর খাটের নিচে পড়ে আছে। তাতে কিছু শার্ট-প্যান্ট, একটা ডট-পেন, হাত-আয়না, চিরুনি, কিছু না-লেখা পোস্টকার্ড, টুথব্রাশ আর দাড়ি কামানোর সরঞ্জাম। আমাদের থানায় জমা আছে। যদি দেখতে চান, দেখতে পারেন।

—হ্যাঁ, তা তো দেখবই। কিন্তু এই বিশ্বস্ত ফেরারী দেহরক্ষীকে খুঁজে বার করার কী চেষ্টা তোমরা করেছ?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। ঘটনাচক্রে কিছু ভালো ‘ব্লু’ পাওয়া গেছে। নিতান্ত গডস্ গ্রেস। ব্যাপারটা হয়েছিল কি, মিসেস্ পালিত একটা ফ্ল্যাশ-গানওয়ালা ক্যামেরা নিয়ে এসেছিলেন। অনেকগুলি ছবি তোলেন। কেন যে তিনি ক্যামেরা নিয়ে আসেন তা তিনিই জানেন। মোট কথা, তার তিন-চারটি ‘শট’-এ ঐ হারাধনের সামনের দৃশ্য এবং ‘প্রোফাইল’ পাওয়া গেছে—গ্রুপের মধ্যে। তা থেকে আমরা পোস্টকার্ড-সাইজ এনলার্জ করেছি। এই দেখুন।

বাসুসাহেবের মনে হলো, লোকটার বয়স ত্রিশ থেকে চল্লিশ। মাথায় টাকা-টাকা ঘন কালো চুল। ঝোলা গোঁফ ছিল। উচ্চতা মাঝারি। রোগাও নয়, মোটাও নয়। খুব সাধারণ চেহারা। ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলে খুঁজে বার করা মুশকিল।

বাসু বললেন, লোকটার আইডেন্টিটি জানা যায়নি?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। জানা গেছে। ওর ডাক নাম ‘পচা’, ভালো নাম পঞ্চানন ঘড়াই। ও একজন কুখ্যাত অ্যান্টিসোস্যাল। বার তিন-চার জেল খেটেছে। একটা খুনের মামলায় পুলিস থেকে ওকে ধরবার জন্য ফটো ছাপিয়ে পুরস্কার ঘোষণাও করা হয়। পচা ধরা পড়ে। ওর নির্ঘাৎ ফাঁসি হয়ে যেত; কিন্তু ওর দলের লোক ওকে পুলিসের হেপাজত থেকে উদ্ধার করে। লোকটার অপারেশন-এরিয়া ছিল বহরমপুর। এ তল্লাটের কেউ তাকে চিনত না। সে যে কী করে ডাক্তারসাহেবের দেহরক্ষীর চাকরি পেল এটা এ কেসের সবচেয়ে বড় রহস্য।

বাসু বললেন, তুমি তখন ও. সি. সদরকে বহরমপুর জেলের কথা জিজ্ঞেস করছিলে। সেটা কি এই ‘পচা’র সন্ধানে?

—না, মামু। পচা বহরমপুর জেলে নেই। সে দীর্ঘদিন ফেরার। আমি খোঁজ নিচ্ছিলাম কাল্লুর। আপনি বোধহয় জানেন ‘কাল্লু’ ছিল চিনসুরার সমাজবিরোধী। বছর চোদ্দ আগে তার যাবজ্জীবন হয়। আমি তখন এখানে ছিলাম না। ওকে দেখিনি। ডাক্তারবাবু কাল্লুর খোঁজ করায় সন্ধান নিয়ে জেনেছি এই চোদ্দ বছরে সে বহুবার জেল থেকে জেলে বদলি হয়েছে। বছর দুই আগে ছিল খড়্গাপুরে। তারপর সেখানে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। কলকাতায় আনা হয়। টিউবারকুলেসিস্! ওকে বহরমপুরে পাঠানো হয়। তারপরের খবর এখনো পাইনি।

বাসু বললেন, জেলের ভিতর কোনো যাবজ্জীবন আসামীর যদি টিউবারকুলেসিস্ হয় তবে মুক্তি পাওয়ার চেয়ে তার মৃত্যু হওয়াই স্বাভাবিক। কোনোক্রমে মুক্তি পেলেও সে তৎক্ষণাৎ মস্তানগিরি শুরু করবে এটা প্রায় অপ্রত্যাশিত। আমার মনে হয়, কাল্লুর নাম নিয়ে কেউ ঘোষালকে ভয় দেখাচ্ছিল।

–কী উদ্দেশ্যে?

—অভিয়াসলি ব্ল্যাক-মেইলিং। ঠিক আছে, তুমি যে-পথে চলছ সে-পথেই চল। কাল্লু আর পচাইয়ের লেটেস্ট সংবাদ কিছু পেলে আমাকে জানিও। আপাতত তুমি আমাকে শ্ৰীমান হারাধন দাশের কিছু ফটো—যা মিসেস্ পালিত তুলেছে এবং শ্রীমান পচাই ঘড়াই, যে জেল থেকে পালিয়েছিল, তার ফটো দিতে পার?

—পারি। আপনি চার কপি নিয়ে যান। দুজনেরই ফ্রন্ট ভিয়ু এবং প্রোফাইল। যুগলকিশোর ছবিগুলো এনে দিলেন।

বাসুসাহেব পকেট থেকে ম্যাগানিফাইং গ্লাস বার করলেন। টেবিল-ল্যাম্পের আলো জ্বেলে পরীক্ষা করে দেখে বললেন, য়ু আর রাইট। হারাধন দাশ আর পচাই ঘড়াই অভিন্ন ব্যক্তি! আশ্চর্য! এমন একটা অ্যান্টিসোস্যালকে কে রেকমেন্ড করলো ঘোষাল ডাক্তারকে?

যুগলকিশোর বললেন, সেটা জানতে পারলে, বিষপ্রয়োগের আসামীকে ধরা কঠিন হবে না।

বাসু বললেন, আর একটা কাজ তোমাদের করতে হবে। আই. জি. ক্রাইমকে তোমরা ফর্মালি লেখ ওড়িশা গভর্নমেন্টকে অনুরোধ করতে : গুনপুর রোমান-ক্যাথলিক চার্চে অ্যাবে শবরিয়ার মৃতদেহটা ‘এক্সহিউম’ করতে। আমি কলকাতায় গিয়েই তাঁর সঙ্গে দেখা করব। অনুরোধও করব; কিন্তু ডিপার্টমেন্টাল অনুরোধটা থাকলে কেসটা জোরদার হবে।

বাসু এরপর জবানবন্দিগুলি পড়তে শুরু করলেন। চন্দন মাঝে মাঝে নিজস্ব মন্তব্য থার্ড- ব্র্যাকেটে লিখে গেছে। এগুলি আদালতে পেশ করার জন্য নয়, পুলিস-বিভাগের তদন্তের কাজে লাগবে। উনি শুরু করলেন মিস্ অ্যাগনেস ডুরান্টকে দিয়ে।

(1) মিস্ অ্যাগনেস্ ডুরান্ট [(42) : মানসিক হাসপাতালের মেট্রন। এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রায় চব্বিশ বছর। ডঃ ঘোষালের খুবই কাছের লোক। হাসপাতাল যে ট্রাস্ট বোর্ড- এর পরিচালনাধীন, তার সচিব। ট্রেইন্ড নার্স। ডিভোর্সি। তাঁর মতে : বাগানে চারটি টেবিল পাতা ছিল নিমন্ত্রিতের জন্য এবং একটা লম্বাটে টেবিলে ক্যাটারার প্যান্ট্রি বানিয়েছিল খাবার পরিবেশনের জন্য। পৃথক একটি টেবিলে ছিল ড্রিংস্‌-এর আয়োজন। সেখানে ছিল নানান জাতের মদের বোতল, গ্লাস, সোডা, সফ্‌ট্ ড্রিংস। গৃহস্বামী স্বয়ং ড্রিংক্স্‌ তৈরি করছিলেন। নন্দু, শৈলেশ ও হারাধন ট্রে-নিয়ে সরবরাহ করছিল। ক্যাটারিং এজেন্টের লোকজনদের ঐ টেবিলে যেতে বারণ করা ছিল। তারা শুধু খাবার সরবরাহই করছিল।

সন্ধে সাড়ে সাতটা থেকেই নিমন্ত্রিতেরা আসতে থাকেন। ড্রিংক্স্‌ তখনই শুরু হয়। ঠিক আটটায় ডিনার শুরু হয়। বাগানে চারটি টেবিলে ছিল ষোলোটি চেয়ার। নিমন্ত্রিত মাত্ৰ জনা- দশেক। ফলে, ঠিক পংক্তি ভোজনের নিয়মে সবাই বসে খাচ্ছিলেন না। প্লেটটা বাঁ-হাতে নিয়ে প্রায় সকলেই ঘুরে ঘুরে বুফে নিয়মে খাচ্ছিলেন। কেউ কেউ তখনো প্লেট হাতেই তোলেননি,—ড্রিংক্‌স্‌ নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন….

তদন্তকারী অফিসার : ‘তখনো’ বলতে কী মিন করছেন?

—সওয়া আটটা বা সাড়ে আটটা। যখন ডক্টর ঘোষাল তাঁর ভদ্‌কা-উইথ-সিট্রার পাত্রে প্রথম সিপ্ দেন।

—ওটা যে ভদ্‌কা-উইথ-সিট্রা তা আপনি জানলেন কী করে?

—না। আদালতে হলফ নিয়ে ও-কথা বলতে পারব না। এটা আমার অনুমান মাত্ৰ। ঘোষাল ‘জিন’ স্ট্যান্ড করতে পারতেন না, জিন খেলেই ওঁর হেঁচকি উঠত। আর হুইস্কি বা রম যে নয় তা পানীয়টার রঙ দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম। তাছাড়া আমি জানতাম, ঘোষাল ভদ্‌কা খুব পছন্দ করে। ওর ফ্রিজে সচরাচর ভাই থাকে। আমি জানি।

—আই সি। তরপর?

—ট্রে-টা ছিল হারাধনের হাতে। তাতে নানান পানীয় ছিল। অন্তত তিন-চারটি গ্লাস ছিল। হুইস্কি, রম, রেড-ওয়াইন, ভদ্‌কা। ঘোষাল তা-থেকে নিজেই ভদ্‌কাটা উঠিয়ে নেয়।

—আর য়ু শিওর? কেউ তাঁর হাতে গ্লাসটা তুলে দেয়নি?

—ইয়েস, আয়াম। কারণ সে-সময় আমি ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। ঘোষাল তিন-চারটি গ্লাসের ভিতর যে কোনো একটি তুলে নিতে পারত। কোনো ‘ফোর্সিং-কার্ড’-এর ম্যাজিক যে এর পিছনে ছিল না এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।

—আই সি। বলে যান।

অ্যাগির বর্ণনা মোতাবেক, ঐ টেবিলে তখন ছিলেন চারজন। ঘোষালের ডাইনে অনুরাধা, বাঁয়ে সুভদ্রা, বিপরীতে তিনি নিজে। ঠিক পাশের টেবিলে ছিলেন মিসেস্ ছায়া পালিত, ডক্টর অমরেশ দাশ, ক্যাপ্টেন পালিত আর মিসেস্ পম্পা সেনরায়। আর সকলে কে কোথায় বসেছিলেন ওঁর খেয়াল নেই। ডাক্তার ঘোষালের বাঁ-হাতে ধরা ছিল একটা আধখাওয়া ফিশ- ফিঙ্গার। উনি কথা বলতে বলতে হারাধনের হাতে-ধরা ট্রে থেকে একটা গ্লাস তুলে নিলেন—সাদা রঙ পানীয়টার। হারাধন পাশের টেবিলে চলে গেল। ঘোষাল ফিশ-ফিঙ্গারের বাকিটুকু মুখে পুরে দিলেন। এই সময় সুভদ্রা একটা জোক্‌স্‌ শোনাচ্ছিল। ঘোষাল অন্যমনস্কভাবে তাঁর ডান-হাতে ধরা গ্লাসে একটা চুমুক দিলেন। দিয়েই উঠে দাঁড়ালেন। মিস্ অ্যাগি তখনো বুঝে উঠতে পারেননি কেন উনি উঠে দাঁড়ালেন। ঘোষাল আরও এক সিপ্ মুখে টেনে নিলেন। মুখটা বিকৃত করলেন, তারপরেই হঠাৎ ঠক্ করে গ্লাসটা নামিয়ে রেখে বললেন, ‘এক্সকিউজ মি…’ উনি টেবিল ছেড়ে কোথাও যেন যেতে চাইছিলেন—কিন্তু পারলেন না। মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন!

স্বভাবত সবাই ছুটে এল। ডক্টর দাশ সবাইকে সরিয়ে দিয়ে ঘোষালের মাথাটা কোলে তুলে নিলেন। মিনিট দুই নাড়িটা দেখলেন। তারপর চিবুকের নিচে গলায় নাড়ির স্পন্দন পাওয়া যায় কিনা দেখলেন। বিহ্বলভাবে অ্যাগির দিকে ফিরে ইংরেজিতে বললেন, তুমি দেখ তো!

অ্যাগির কাছে ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। তবু ঘাসের উপর হাঁটু গেড়ে বসে তিনি ঘোষালের নাড়ি দেখলেন। ঘোষাল নয়, ডক্টর ঘোষালের মৃতদেহ! মুহূর্ত মধ্যে হার্টফেল করে ডক্টর ঘোষাল মারা গেছেন!

তদন্তকারী অফিসার : আর য়ু শিওর ম্যাডাম? ‘হার্টফেল’ করে?

–সে সময় আমার তাই মনে হয়েছিল।

—এখন কী মনে হয়?

—লুক হিয়ার, অফিসার। আমি প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে জবানবন্দি দিচ্ছি। আমার অনুমান সেই প্রত্যক্ষদর্শন অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পর্কবিযুক্ত!

–ইয়েস ম্যাডাম! আয়াম সরি! আপনি ঠিক বলেছেন। তারপর?

—তারপর যেমন হয়, একটা প্যান্ডিমোনিয়াম্! চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা। সকলেই মর্মাহত। খাওয়া-দাওয়া বস্তুত হলোই না। আমি ক্যাটারারকে বললাম, তার চিন্তার কিছু নেই, বিল আমি মেটাব। এই সময় হঠাৎ মিসেস্ ছায়া পালিত আমাকে বলে, তার আশঙ্কা কেসটা হার্ট- ফেলিওয়ের নয়—বিষক্রিয়ায় হবার সম্ভাবনা আছে। পুরীতে বিল শবরিয়ার মৃত্যুর কথাও সে সংক্ষেপে জানায়। ডক্টর দাশ সদর থানায় ফোন করেন। পুলিস আসে। মিসেস্ পম্পা সেনরায় তাঁর স্বামীকেও পৃথকভাবে ফোন করেন। ডি. এস. পি.-ও এসে যান। ডক্টর ঘোষালের মৃতদেহটি শবব্যবচ্ছেদের জন্য পুলিসের হাতে দেওয়া হয়।

তদন্তকারী অফিসার : যে গ্লাস থেকে ডক্টর ঘোষাল পান করছিলেন সেটা নির্বাচন করে দিলেন কে?

—মিসেস্ ছায়া পালিত।

[এ ছাড়া মিস্ অ্যাগি ডুরান্ট আরও কিছু বলেন, যা এই মৃত্যুর সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। আমার মনে হলো মিস্ ডুরান্ট-এর সঙ্গে ডক্টর ঘোষালের খুব নিকট সম্পর্ক ছিল। একজন অবিবাহিত, অপরজন ডিভোর্সি! জবানবন্দিতেও মিস্ অ্যাগি ঘোষাল প্রসঙ্গে কখনো ‘আপনি’ কখনো ‘তুমি’ বলেছেন। ‘ঘোষাল ভদ্‌কা খেতে ভালোবাসতো’—not ‘ডক্টর ঘোষাল ভদ্‌কা খেতে ভালোবাসতেন’। এ আমার অনুমান মাত্র। দ্বিতীয়ত পরে জানা গেছে, ডক্টর ঘোষাল তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি ঐ ট্রাস্টিকেই দিয়ে গেছেন, যার সেক্রেটারি এই অ্যাগি ডুরান্ট।]

(2) মিসেস্ ছায়া পালিত : [(?) কলকাতায় একটি ব্যুটিকের দোকান আছে, গোলপার্কের কাছাকাছি। এছাড়া একটি পেশাদারী রঙ্গমঞ্চে ড্রেস-ডিজাইনার। স্বামী প্রাক্তন পাইলট। নিঃসন্তানা। ডক্টর ঘোষালের সঙ্গে আলাপ ঐ রঙ্গমঞ্চের মাধ্যমে। ঐ পেশাদারী রঙ্গমঞ্চের মালিক এবং প্রধান অভিনেতা ডক্টর ঘোষালের বঙ্কুস্থানীয়। সেই সূত্রেই ঘনিষ্ঠতা।]

প্রশ্ন : ডাক্তার ঘোষালের বাড়িতে সেদিন সন্ধের নৈশ-পার্টির হেতুটা কী ছিল? আই মিন, কী উপলক্ষে নিমন্ত্ৰণ?

ছায়া পালিত : তা বলতে পারব না। উনি এখান থেকে কলকাতায় আমাকে ফোন করেছিলেন। আমাদের দুজনকে রাত্রে নিমন্ত্রণ করেছিলেন।

প্রশ্ন : আপনারা কি ট্রেনে এসেছিলেন?

ছায়া : না। গাড়ি ড্রাইভ করে। তবে সে রাত্রে ফিরতে পারিনি, অনেক রাত হয়ে যাওয়ায়। মিস্ অ্যাগি ডুরান্টের বাড়িতে রাতটা কাটিয়ে পরদিন ফিরে গিয়েছিলাম।

প্রশ্ন : আপনি ক্যামেরা এনেছিলেন কেন?

ছায়া : কোনো উৎসব-রজনীর স্মৃতি ক্যামেরায় বন্দী করার বিরুদ্ধে পিনাল কোডে কোনো নিষেধ আছে বলে শুনিনি। তাই।

প্রশ্ন : আপনি বাঁকা জবাব দিচ্ছেন কেন? আমার জিজ্ঞাস্য ক্যামেরা আনার কি বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য ছিল? কেউ কি সাজেস্ট করেছিল ক্যামেরায় স্পুল ভরে আনতে?

ছায়া : আপনার দুটি প্রশ্নের একই উত্তর : না!

প্রশ্ন : আপনিই কি প্রথম সাজেস্ট করেছিলেন যে, এটা হার্ট-ফেলিওরের কেস নয়, বিষপ্রয়োগে হত্যা?

ছায়া : লুক হিয়ার, অফিসার। আপনার প্রশ্নের ধরনে মনে হচ্ছে আপনি আমাকে এ কেসে জড়িয়ে ফেলতে চাইছেন। আমি আপনার কোনো প্রশ্নের জবাব দেব না, যতক্ষণ না আমার স্বার্থ দেখতে একজন সলিসিটারকে আনতে পারি।

প্রশ্ন : কী আশ্চর্য! আমি তো আপনাকে গ্রেপ্তার করতে চাইছি না। আমার প্রশ্নের ধরনে কী দোষ হলো?

ছায়া : প্রথমত আপনার প্রশ্নটিকে আইনের ভাষায় বলে ‘লিডিং কোশ্চেন’; দ্বিতীয়ত, আমিই প্রথম সাজেস্ট করেছিলাম কিংবা আমার আগেরও কেউ করেছিল তা আমার জানার কথা নয়। তৃতীয় কথা আমি বলিনি ‘এটা হর্ট-ফেলিওর নয়, বিষপ্রয়োগে হত্যা।’ আমি ডক্টর দাশকে বলেছিলাম, “ঠিক এই জাতীয় একটা অ্যাবনর্মাল মৃত্যু’ আমি একমাসের মধ্যে দু-বার দেখলাম।

প্রশ্ন : ‘বিষপ্রয়োগ হত্যা’র কথা আপনি বলেননি?

ছায়া : আমি আপনার কোনো প্রশ্নের জবাব দেব না।

[সাক্ষী হোস্টাইল। কিছু কথা উনি গোপন করতে চান তা স্পষ্টই বোঝা যায়।]

বাসুসাহেব জবানবন্দির বান্ডিলটা অ্যাটাচি কেসে তুলে রাখতে রাখতে বলেন, অহেতুক তোমার সময় নষ্ট করব না। বাড়ি গিয়ে এগুলো পড়ব। তুমি বরং সংক্ষেপে আমাকে বল, হারাধনের কথা কে, কী বলেছে! সে কবে প্রথম এল, একা না কেউ নিয়ে এল, কত মাইনে পেত, কী কাজ করত, ঘোষাল তার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করত, ইত্যাদি সংবাদ—কে কী বলেছে?

যুগলকিশোর বিভিন্ন সাক্ষীর কাছ থেকে সংগৃহীত তথ্যের চুম্বকসার দাখিল করলেন। এই তথ্যগুলি দিয়েছে নন্দু, ঠিকে ঝি এবং শৈলেশ মান্না। কিছুটা অ্যাগি ডুরান্ট।

হারাধন দিন পাঁচ-সাত কাজ করেছে। কে তাকে পাঠিয়েছে, কত মাহিনা, কী শর্ত তা কেউ কিছু জানে না। সে শৈলেশের সঙ্গে খেতে বসত না, আবার ঘোষালের সঙ্গেও নয়। একাই আহারে বসত। কাজ-কর্ম কিছুই করত না। তিন-চারদিন পরে নন্দু একদিন তার মালিককে আড়ালে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ঐ হারাধনবাবু আর কদ্দিন থাকবেন?’ ঘোষাল জবাবে বলেছিলেন, ‘ও তো তোর কোনো ক্ষতি করছে না। তোর সে খোঁজে কী দরকার?’

বস্তুত হারাধনকে যে ঘোষালসাহেব দেহরক্ষী হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন, এ তথ্যটা প্রকাশ করেননি। তবে শৈলেশ মান্নার পাশে একদিন যখন হারাধন গাড়িতে বসছে—ডাক্তারবাবু ছিলেন পিছনের সিটে—তখন মান্নার সঙ্গে হারাধনের একটা ধাক্কা লেগে যায়—অসাবধানে। শৈলেশ মান্নার মনে হয় : হারাধনের পাশ-পকেটে একটা রিভলভার আছে। এ সন্দেহের কথা সে ফিরে এসেই ডাক্তারবাবুকে গোপনে জানিয়েছিল। ডাক্তারবাবু বলেন, ‘জানি! তুমি কথাটা যেন আর কারও কাছে বল না।’ শৈলেশ কিন্তু সে আদেশ মানেনি। কাল্লু মিঞার ব্যাপারটা সে জানত। ডাক্তারবাবু যখন পুরীতে গিয়েছিলেন তখন কাল্লু যে হুমকি দেয়, তাও জানত। তাই গোপনে সে এ খবরটা জানিয়ে দেয় মিস্ ডুরান্টকে—নিশ্চিতভাবে জেনে যে, তিনি ডাক্তারবাবুর হিতাকাঙ্ক্ষিনী।

আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে বাসুসাহেব বেরিয়ে এলেন বাইরে। ও. সি. সদরের জিপটা দাঁড়িয়ে আছে। গণেশচন্দ্র বসে আছেন ড্রাইভারের পাশে। বাসু তাঁকে দেখেও দেখলেন না। গেট খুলে বেরিয়ে এসে একটা রিক্শা ধরলেন। রওনা দিলেন ‘মমতাময়ী মেন্টাল হোম’-এ।

গণেশচন্দ্র তাঁর ‘বস’-এর বৈঠকখানার দিকে এগিয়ে গেলেন।

এগারো

মধ্যাহ্ন-আহারের ব্যবস্থা করেছিলেন অ্যাগি ডুরান্ট। বলেছিলেন, আপনারা সঙ্কোচ করবেন না। ইট্স্ জাস্ট ‘ওয়ার্কিং লাঞ্চ’! ঘোষাল ছিল আমার ‘বস’ এবং নিকটতম বঙ্কু। প্রায় শতাব্দীর এক-চতুর্থাংশ কালের সহযোগী। তার এ জাতীয় মর্মান্তিক মৃত্যুতে আমি মর্মাহত। কিন্তু আপনারাও তার বঙ্কু,—এসেছেন ঘোষালের মৃত্যুরহস্যের তদন্ত করতে। ফলে, আমি কিছু খাবার আনাই। এখানেই সবাই খেতে খেতে কথাবার্তা বলা যাবে।

মধ্যাহ্ন-আহারের অবকাশে বাসুসাহেব জানতে পারলেন এই মানসিক চিকিৎসালয়টি পরিচালনায় দায়িত্বে আছে একটি ‘ট্রাস্ট বডি’। তার সচিব হচ্ছেন অ্যাগনেস্ আর প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডক্টর ঘোষাল। ভাইস প্রেসিডেন্ট-কাম-ট্রেজারার হচ্ছেন ডক্টর দাশ। এছাড়া শহরের আরও কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি আছেন সভ্য হিসাবে। এক্স-অফিশিও বা পদাধিকারবলে স্থানীয় কলেজের অধ্যক্ষ এবং ডি. এস. পি. বার্ডওয়ান রেঞ্জ ঐ সভার সদস্য। আরও জানা গেল, ডক্টর ঘোষালের একটি উইল উদ্ধার করা গেছে। উনি ওঁর স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি ঐ ট্রাস্ট বোর্ডকে দান করে গেছেন।

বাসু জিজ্ঞেস করলেন, ডক্টর ঘোষালের সঙ্গে হারাধন সংক্রান্ত কোনো কথা হয়নি তোমার?

—হয়েছিল। ও আমাকে বলেছিল, যতদিন না ‘কাল্লু’র কোনো হদিস পাওয়া যায় ততদিন ওকে সাবধানে থাকতে হবে। ও একজন দেহরক্ষীকে ‘কম্বাইন্ড-হ্যান্ড’ হিসাবে নিয়োগ করেছে। সে যে দেহরক্ষী এটা জানাজানি হয়ে গেলে ‘কাল্লু’ অথবা ‘কাল্লু’র পরিচয়ে যে হুমকি দিচ্ছে সে সাবধান হয়ে যাবে। তাই হারাধন দাশের প্রকৃত পরিচয়টা কাউকে জানানে হয়নি।

ইন্দ্রকুমার জানতে চায়, শুধু আপনি জানতেন?

—না, আমাদের ড্রাইভার মান্নাও জানত। তার সঙ্গে ঐ হারাধনের একবার একটা ধাক্কা লেগে যায়। মান্না বুঝতে পারে যে, হারাধনের পকেটে রিভলভার থাকে। সেটা সে তার মনিবকে জানায়।

ইন্দ্রকুমার পুনরায় প্রশ্ন করে, ঐ লোকটাকে কে রেকমেন্ড করেছিল তা ডাক্তার ঘোষাল বলেননি?

—না! অন্য সবাইকে সে কী বলেছিল তা জানি না। আমাকে বলেছিল,

‘দ্যাটস্ এ টপ সিক্রেট! তবে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার : লোকটা হান্ড্রেড পার্সেন্ট নির্ভরযোগ্য, সৎ এবং আমার হিতাকাঙ্ক্ষী!’

ইন্দ্রকুমার বলে, শিবুটা চিরকালই ছিল গোঁয়ারগোবিন্দ আর নিতান্ত গর্দভ!

মিস্ অ্যাগি প্রতিবাদ করে ওঠেন : প্লিজ, স্যার! আপনার জিহ্বাকে সংযত করুন। একজন পরলোকগত ব্যক্তির প্রতি ঐ সম্মান নাই বা দেখালেন! ঘোষাল যদি মূর্খামি করে থাকে, সেজন্য দামও দিয়ে গেছে। আপনি-আমি সেজন্য সেই মৃত-আত্মাকে খিস্তি করব কেন?

ইন্দ্র বলে, আয়াম সরি।

বাসু পাদপূরণ করেন : য়ু অট টু বি! যাহোক ও প্রসঙ্গ থাক। আমরা অন্য কিছু নিয়ে আলোচনা করি বরং।

বারো

চিনসুরা থেকে ফেরার পথে ওঁরা হাওড়া ব্রিজের জ্যাম এড়িয়ে বিদ্যাসাগর সেতু দিয়ে এলেন। গাড়ি চালাচ্ছিল অশোক। ব্রজদুলালের কাছে সে জানতে চাইল, প্রথমে বাসুসাহেবকে নামিয়ে দেব তো?

জবাব দিলেন বাসু। বললেন, না। তুমি একবার গোলপার্কের দিকে চল তো অশোক। এখনো ছায়া পালিতের বুটিকের দোকানটা খোলা আছে। দেখা যাক, তাকে ধরতে পারা যায় কি না।

ইন্দ্র বলে, কেন? বিশেষ করে ছায়ার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন কেন?

—মেয়েটা শার্প ইন্টেলিজেন্ট। তাছাড়া জবানবন্দিতে সে তো বস্তুত কিছুই স্বীকার করেনি।

ইন্দ্র আবার জানতে চায়, করেনি? কী বলেছে সে?

বাসু বললেন, পুলিস অফিসারের প্রশ্নের ধরন দেখে ছায়ার মনে হয়েছিল যে, তাকে খুনের মামলায় জড়াবার চেষ্টা হচ্ছে। তাই সে কোনোরকম জবানবন্দি দিতে অস্বীকার করে।

ব্রজদুলাল জানতে চান, আপনার কি মনে হয় ছায়া কিছু ক্লু দিতে পারবে?

—জানি না। চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি?

নির্দেশমতো অশোক গোলপার্কের দিকে চলল। বাসু তাঁর অ্যাচাটি-কেস খুলে দোকানের ঠিকানাটা জানালেন। ছায়া পালিত পুরীতেই তার দোকানের একটা কার্ড ওঁকে দিয়েছিল।

বুটিকের দোকানটা ছোট। কাউন্টারে বসেছিল একটি মেয়ে। ওঁরা তিনজনে দোকানে প্রবেশ করলে মেয়েটি বলে, বলুন স্যার? কী দেখাব?

বাসু বললেন, না মা। কিছু দেখাতে হবে না। আমরা ছায়াকে খুঁজছি। মিসেস্ ছায়া পালিত। সে কি দোকানে নেই?

মেয়েটি সরাসরি জবাব না দিয়ে বললে, আপনারা?

বাসু তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন : দর্শনার্থী। ছায়া পালিতের। সে যদি না থাকে তাহলে সে- কথাই বলে দাও, আমাদের নামঠিকুজি নিয়ে কী করবে?

মেয়েটির ভ্রূকুঞ্চন হলো। বললো, না, ছায়াদি দোকানে নেই। কাছেই আছেন। আপনাদের পরিচয় পেলে তাঁকে খবর পাঠাতে পারি। তাই জানতে চাইছি।

বাসু ওয়ালেট থেকে একটি কার্ড বার করে ওকে দিলেন।

মেয়েটি একজন ছোকরা কর্মচারীর হাতে কার্ডটা ধরিয়ে দিল। তাকিয়েও দেখলো না। বললো, বলাই, এই কার্ডটা দিদিকে দিয়ে আয়। বলিস, ওঁরা নিচে অপেক্ষা করছেন।

দোকানের পাশেই একটা সিঁড়ি। দশ-বারোটা ধাপ। মেজানাইন-ফ্লোরে যাবার রাস্তা। বলাই সেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।

অশোক গোলপার্কে জুৎসই জায়গায় গাড়িটা পার্ক করতে পারছিল না। তাই ওঁদের নামিয়ে দিয়ে সাদার্ন অ্যাভিন্যুর দিকে চলে যায়। সে গাড়িতেই বসে আছে। দোকানে এসেছিলেন ওঁরা তিনজন।

একটু পরে মেজানাইন-ফ্লোর থেকে ছায়া নেমে এল। সাদরে আহ্বান করলো, আসুন, আসুন, আসুন। উপরে উঠে আসুন।

ওঁরা তিনজনে সিঁড়ি বেয়ে দেড়-তলার ঘরটায় উঠে আসেন।

ছায়া জানতে চায়, সুজাতাদিকেও নিয়ে এলেন না কেন?

বাসু জবাবে বললেন, আমরা ঠিক সৌজন্য-সাক্ষাতে আসিনি ছায়া, খদ্দের হিসাবেও নয়। কয়েকটা কথা জানতে এসেছি।

—বেশ তো, আসুন। চা-কফি কিছু আনতে দেব?

বাসু বললেন, নো, থ্যাংকস্।

দোতলার ঐ ঘরটি ছায়ার ওয়ার্কিং-স্পেস্। ঘরে একটা টেবিলে বোর্ড-টি পাতা। ও সেখানে নকশা ছকে। নাটকের সেট ডিজাইন করে। ঘরে পিসবোর্ড, রঙ, আঠা, কাঁটি, ছুরি, ফেবিকল ইত্যাদি ছড়ানো। একটা বেঞ্চি পাতা আছে। ওঁরা তিনজনে ঠাসাঠাসি হয়ে বসলেন।

ছায়া জানতে চায়, কী ব্যাপার?

বাসু বললেন, আমরা চুঁচুড়া থেকে সোজা আসছি। ডক্টর ঘোষালের কেসটা সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞাস্য আছে।

—হ্যাঁ, বলুন। আমার চোখের সামনেই তো দুর্ঘটনাটা ঘটলো।

বাসু বললেন, জানি। পুলিস তোমার স্টেটমেন্ট নিয়েছে। তাও পড়েছি। দেখলাম, তুমি বিশেষ কিছুই বলনি, কারণ তোমার আশঙ্কা হয়েছিল পুলিস তোমাকে ফাঁসাতে চাইছে। তাই নয়?

—ইয়েস, স্যার! আই অ্যাডমিট

—তাহলে আমাদের কাছে খুলে বল, তুমি কতটুকু জানো? কী বুঝেছ? আমি বরং একে একে প্রশ্ন করি তুমি জবাব দিয়ে যাও। প্রথম প্রশ্ন : ডক্টর ঘোষাল পার্টি দিয়েছিল কেন? উপলক্ষটা কী?

—তা তো জানি না, মেসোমশাই। আমাকে উনি টেলিফোন করেছিলেন ঘটনার আগের দিন—শুক্রবার—সকালে। আমাদের দুজনকে পরদিন শনিবার রাত্রে ওর চিনসুরার বাড়িতে ডিনারে নিমন্ত্রণ করেন। কী উপলক্ষে তা জানাননি। আমি জানতে চেয়েছিলাম কিন্তু উনি কিছুতেই কারণটা বলেননি। আমি টেলিফোনেই ওঁর আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলাম। আমরা দুজন—স্বামী-স্ত্রী। আমার অনুমান, এটা জন্মদিনের পার্টি; কিন্তু ডক্টর ঘোষাল সেটা স্বীকার করতে চাইছিলেন না—কারণ উনি বোধহয় চাননি যে, ওঁর এই বৃদ্ধ বয়সে লোকে বার্থ-ডে প্রেজেন্টেশন নিয়ে যায়। সে যাই হোক, আমি একটা বড় ফুলের ব্যুকে নিয়ে গিয়েছিলাম। জন্মদিন না হলেও ফুলের তোড়া যেকোনো অকেশনেই উপহার দেওয়া চলে।

বাসু বললে, আই সি।

ইন্দ্রকুমার জানতে চায়, আপনারা দুজন কটা নাগাদ গিয়ে পৌঁছন?

—আমরা বের হয়েছিলাম যথেষ্ট সময় হাতে নিয়ে—ভায়া হাওড়া ব্রিজ। দুর্ভাগ্যবশত বারটা ছিল ‘শনি’। ফলে প্রচণ্ড জ্যামে পড়ে যাই। আমরা ট্রেনে যাইনি। গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম। যখন পৌঁছই তখন সন্ধে পার হয়ে গেছে। ওঁরা বাগানে বসে ড্রিংকস্ পান শুরু করেছেন। ডিনার তখনো সার্ভ করা শুরু হয়নি।

ব্রজদুলাল জানতে চান, তোমার পরিচিত কে কে ছিল?

ছায়া স্বীকার করে, অনেকেই ছিলেন। নিতান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে। যেমন মিসেস্ মোহান্তি, মিস্ মোহান্তি, জয়ন্ত, অনুরাধা। এঁরা যে আসছেন তা আমার জানাই ছিল না। আরও জনাতিনেক ছিলেন আমার অপরিচিত।

বাসু কী-একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই ইন্দ্রকুমার বলে, আপনি ফুলের তোড়াটা ডক্টর ঘোষালকে দেবার পর তিনি কী করলেন?

—কী আবার করবেন? আমাকে ‘থ্যাঙ্কু’ বলে ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখলেন।

—নিজেই?

—আমার ঠিক মনে পড়ছে না। বোধহয় তাঁর চাকর বা ড্রাইভারকে তোড়াটা দিলেন। সে একটা ফুলদানি নিয়ে এসে ফুলের ব্যুকেটা টেবিলে সাজিয়ে রাখল।

ইন্দ্রকুমার পুনরায় জানতে চায়, চাকর না ড্রাইভার?

ছায়া বলে, ঠিক মনে নেই। বাট ইজ দ্যাট রেলিভ্যান্ট? আই মিন, তার কি কোনো পারম্পর্য আছে?

বাসু ইন্দ্রকুমারকে ধমক দেন, তুমি থাম দিকিন। আমাকে জিজ্ঞেস করতে দাও। বল ছায়া, তোমার কি মনে আছে ডক্টর ঘোষাল ট্রে থেকে ড্রিংকস্‌টা নিজেই উঠিয়ে নেন, না কেউ তাঁর হাতে তুলে দেয়?

—নো স্যার। আমি জানি না। লক্ষ্য করিনি।

—সেদিন তুমি কি অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করেছিলে? এনিথিং আনুজুয়াল? কারও কোনো বিচিত্র ব্যবহার? কোনো রহস্যময় ঘটনা? বা সান্ধ্যপার্টিতে কোনো অপ্রত্যাশিত কিছু?

ছায়া অনেকক্ষণ ভেবে নিয়ে বললো, না স্যার। মনে করতে পারছি না।

হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে পড়লেন বাসু। বললেন, থ্যাংস! ধন্যবাদ! চলি।

—চা-কফি আজ কিছুই খাবেন না!

—আগেই বলেছি, আবার বলি : আমরা ঠিক সৌজন্য-সাক্ষাতে আসিনি! থ্যাঙ্কু অল দ্য সেম!

.

অশোক ওঁকে নিউ আলিপুরের বাড়িতে যখন নামিয়ে দিল, রাত তখন সাড়ে সাত। ইন্দ্রকুমার আর ব্রজদুলাল দুজনেই জানালেন যে, ওঁরা ক্লান্ত, চা-কফি বা ড্রিংস্‌ নেবেন না। বাড়ি ফিরতে চান। অগত্যা ওঁদের বিদায় দিয়ে বাসুসাহেব উঠে এলেন ওঁর বাইরের বারান্দায়

সেখানে প্রতীক্ষা করছিলেন মিসেস্ বাসু, তাঁর সাবেক হুইল-চেয়ারে। বাসুসাহেব প্রবেশ করা মাত্র বললেন, ইতিমধ্যে ছায়া দু-দুবার ফোন করেছে। ছায়া পালিত। বলেছে, তুমি বাড়িতে ফিরে এলেই যেন তাকে রিং ব্যাক কর।

বাসু জুতোর ফিতে খুলতে খুলতে বললেন, আমি সেটাই প্রত্যাশা করছিলাম। ধর দিকিন ছায়াকে।

রানু তাঁর অভ্যস্ত আঙুলে ছায়াকে ধরলেন, তার দোকানেই। ছায়া সাড়া দিতেই টেলিফোনটা বাসুসাহেবের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, কথা বল। ছায়া।

বাসুর একপায়ে জুতো। সেই অবস্থাতেই বললেন; বল ছায়া? তুমি নাকি দুবার আমাকে ফোনে খুঁজছিলে। কই, আমরা যখন তোমার সঙ্গে কথা বললাম তখন তো কিছু বলনি?

—আজ্ঞে না। আপনারা এখান থেকে চলে যাবার পরেই আমি দু-দুবার ফোন করেছি। মাসিমা বললেন, আপনি তখনো পৌঁছননি।

—বুঝলাম। ইন ফ্যাক্ট, আমি আন্দাজ করেছিলাম ওদের সামনে তুমি খোলা মনে কথা বলতে পারছিলে না। তাই না?

—একজ্যাক্টলি! আমি জনান্তিকে আপনাকে কিছু জরুরি কথা জানাতে চাই। আমার অনেক-অনেক কথা বলার আছে।

—বুঝলাম। কিন্তু, তুমি কি ওদের সম্বন্ধে কিছু আন্দাজ করছ? ওদের দুজনের মধ্যে কাউকে কি সন্দেহ করেছ?

—আই ডোন্ট নো, মেসোমশাই! কিন্তু এটা তো মানবেন যে, বাস্তব ঘটনাটা অত্যন্ত মিস্টিরিয়াস্। অ্যাবে বিল শবরিয়া—আমি জানি, তাঁর মৃত্যু যে বিষক্রিয়ায় হয়েছে তার কোনো প্রমাণ নেই—কিন্তু ঘোষালসাহেবের মৃত্যুর সঙ্গে তার একটা অদ্ভুত সাদৃশ্য আছে! সেবার আমরা ছিলাম তের জন, এবার নয় জন। দুটোই যদি হত্যাকাণ্ড হয়, দুটোই যদি একই হাতের কাজ হয়, তাহলে আমাদের একটা H. C. F-এর অঙ্ক কষতে হবে। হায়েস্ট-কমন- ফ্যাকটর! কে-কে দুবারই উপস্থিত ছিল!

—কিন্তু ব্রজদুলাল বা ইন্দ্রকুমার তো দ্বিতীয় ঘটনায় উপস্থিত ছিল না!

—আই নো। কিন্তু সাবধান হতে কী দোষ? ওঁদের এজেন্ট থাকতে পারে, ওঁরা দুজনেই দীর্ঘদিন ধরে ডক্টর ঘোষালকে চেনেন। সে যাই হোক, আমার যেটুকু বলার আছে, তা আপনাকে জনান্তিকে জানাতে চাই। এখুনি। আপনার কি এখন সময় হবে? তাহলে এখনি আমি আপনার নিউ আলিপুরের বাড়িতে যেতে চাই। আমার—অনেক অনেক কিছু বলার আছে।

বাই অল মিস্‌। য়ু আর ওয়েলকাম। এস। কিন্তু একটা কথা—ক্যাপ্টেন পালিত কেমন আছে? সন্ধের পর তুমি..আই মিন সে কার কাছে থাকবে?

—থ্যাঙ্কু মেসোমশাই—আপনি ওর অসহায়ত্বের কথাটা মনে রেখেছেন। সে ব্যবস্থা করেই যাব। আধঘণ্টার মধ্যেই আসছি আমি। আমি কিন্তু আপনার মতো শুধু মুখে ফিরে আসব না। কফি খাব, মাসিমাকে বলে রাখবেন।

তাই এল। আধঘণ্টা-খানেকের মধ্যেই। রাত আটটা। কৌশিক আর সুজাতা তখনো ফেরেনি। বিশুই গেল অপর্ণার দোকান থেকে ফিশ ফিঙ্গার অর্ডার দিতে।

বাসু ওকে চেম্বারে নিয়ে গিয়ে বসালেন। বললেন, এবার বল, কী তোমার বক্তব্য? কী লক্ষ্য করেছিলে তুমি? প্রথম থেকে গুছিয়ে নিয়ে বল। ডক্টর ঘোষালের টেলিফোন করা থেকে।

ছায়া জানালো দুর্ঘটনার পূর্বদিন, শুক্রবার সকালে, ডক্টর ঘোষাল ওকে টেলিফোনে বললেন, আগমীকাল সন্ধেয় আমার চুঁচুড়ার বাড়িতে, বাগানে আমি একটা পার্টি থ্রো করেছি। তোমার পরিচিত অনেকেই আসছেন। তোমাদের দুজনকে আসতে হবেই। এত দেরিতে জানাচ্ছি বলে রিফিউজ কর না, প্লিজ!

ছায়া বলেছিল, না, না, রিফিউজ করব কেন? কিন্তু অকেশনটা কী? মানে গার্ডেন পার্টির উপলক্ষটা কী?

—সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য। এলে বলব!

ছায়া রসিকতা করে বলেছিল, তাই কি হয়, ডাক্তারসাহেব? গিয়ে যদি শুনি : আপনি কাউকে বিয়ে করছেন! তখন অপ্রস্তুত হয়ে যাব না? বৌদির জন্য একটা ফুলের তোড়া অন্তত…

ডাক্তার ঘোষাল বলেছিলেন, ফাজলামো হচ্ছে?

—না স্যার। কারণটা না জানালে আমি কিন্তু নিমন্ত্রণ গ্রহণ করছি না।

—অলরাইট। অলরাইট! সেক্ষেত্রে কনফিডেনশিয়ালি তোমাকেই শুধু বলছি। আমি একটা ম্যাজিক দেখাব। ইন ফ্যাক্ট, আমি একজনের সঙ্গে বাজি ধরেছি—ম্যাজিকটা কেউ বুঝতে পারবে না। সে বলেছে, আমি ধরা পড়ে যাব। দেখা যাক কে হারে, কে জেতে!

—কার সঙ্গে বাজি ধরেছেন?

—সেটা এখনি বলা যাবে না। মোটকথা, পার্টিতে নৈশাহার আর ড্রিংস্‌ ছাড়াও থাকবে একটা ‘মজারু’।

ছায়া শেষ কথাটা টেলিফোনে শুনে বুঝে উঠতে পারেনি। জানতে চায়,—কী? কী থাকবে?

–কালকে ‘রাতে দেখবে একটা মজারু’। ‘হযবরল’ পড়নি?

বাসু ওকে মাঝপথে থামিয়ে বললেন, “কিউরিয়সার অ্যান্ড কিউরিয়সার!’ কার সঙ্গে বাজি ধরেছিল ডাক্তার? হোয়াট ওয়াজ দ্য ফান?

ছায়া বলে, তা জানি না, মেসোমশাই। কিন্তু ওঁর ঐ কথাটা আমি সারাক্ষণ ভুলতে পারিনি। আমি সর্বক্ষণ আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়কে সজাগ রেখেছিলাম—কারণ আমার মনে হয়েছিল, আগন্তুকদের বোকা বানানোর একটা ষড়যন্ত্র হয়েছে। ম্যাজিকটার কলাকৌশল আমাকে ধরতেই হবে। আমার আরও মনে হয়েছিল: ম্যাজিকটা আমাদের জানিয়ে-শুনিয়ে দেখানো হবে না—’এবার আমি একটা ম্যাজিক দেখাচ্ছি’ একথা ডাক্তারবাবু আদৌ বলবেন না। হঠাৎ বেমক্কা বিস্ময়কর কোনো একটা কিছু সবাই দেখতে পেয়ে বোকা হবে।

এই সময় হুইল চেয়ারে পাক মেরে রানু প্রবেশ করলেন ঘরে। মুখেও বললেন, ‘সরি ফর দ্য ইন্টারাপশন!’

ওঁর পিছন-পিছন এল বিশে। সঙ্গে দু-কাপ কফি আর ফিশ-ফিঙ্গারের প্লেট, টমেটো সস্ ইত্যাদি।

ছায়া বলে, দু-কাপ কেন, মাসিমা? আপনি কফি নেবেন না?

রানু বলেন, নেব। উনি নেবেন না। এ সময় কফি খেলে ওঁর ঘুম চড়ে যায়।

বাসু বললেন, ঠিক কথা। অ্যাই, অ্যাই বিশে! পালাচ্ছিস কেন? ফ্রিজ খুলে বরফের ট্রেটা নিয়ে আয়।

নিজে তিনি উঠে গেলেন ক্যাবিনেট থেকে শিভাস-রিগ্যাল, সোডার বোতল আর পানপাত্রটা নিয়ে আসতে।

রানু বললেন, বেশি গিলে মর না যেন?

—না, না মরব কেন? ষাট-বালাই! তুমি তো জানই—আমার মাপকরা মাত্রা—’দু-অ্যান্ড- আ মিনি হাফ’!

ছায়ার দিকে ফিরে বললেন, নাও, শুরু কর?

—আমরা যখন গিয়ে পৌঁছলাম তখন সবাই বাগানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসেছে। আমাদের দেখতে পেয়েই ডাক্তারসাহেব সানন্দে বলে ওঠেন : এই তো! ওরা দুজনও এসে গেছে!—ওয়েলকাম, ওয়েলকাম ক্যাপ্টেন পালিত।

ছায়া সেলোফেনে মোড়ানো বিরাট ফুলের তোড়াটা বাড়িয়ে ধরে বললে, কই? বৌদি কোথায়? কার হাতে দেব?

ডাক্তারসাহেব অট্টহাস্য করে ওঠেন। একজন মেমসাহেবকে বলেন, অ্যাগি! নাও এটা সাজিয়ে রাখ।

যাঁকে বললেন হয় তিনি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান অথবা মেমসাহেব—পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স—দেখতে খাঁটি মেম, উঠে এসে ছায়াকে সাদা বাংলায় বললেন, আমার নাম অ্যাগি ডুরান্ট, আমি এই মেন্টাল হসপিটালের ট্রাস্ট-বোর্ডের সেক্রেটারি। ফুলের তোড়াটার দায়িত্ব আমিই নিতাম; কিন্তু এটা তুমি মিসেস্ ঘোষালের জন্য এনেছে ভাই, ফলে আমি তো ওটা অ্যাকসেপ্ট করতে পারি না!

ডাক্তারসাহেব হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে বললেন, অলরাইট! ব্যবস্থা যা করার তা আমিই করছি। ইটস আ ব্যাচিলারস্ চোর (chore)।

এই কথা বলে ফুলের তোড়াটা তিনি ছায়ার হাত থেকে নিলেন; ও-পাশে ফিরে বললেন, হারু, আমার বেডরুমে টেবিলে একটা চীনামাটির বড় ফুলদানি আছে, নিয়ে আয় তো!

একটা মাঝবয়সী লোক, গায়ে ফতুয়া, উস্কোখুস্কো চুল, ঝোলা গোঁফ, ঘাড় নেড়ে বললে, আজ্ঞে আচ্ছা!

ছায়া তাকে এক নজর দেখেছিল মাত্র; কিন্তু তৎক্ষণাৎ তার মনে হয় : এ লোকটাকে সে কোথাও দেখেছে! হয় লোকটাকে, অথবা তার ফটো! যাইহোক লোকটা ফুলদানি নিয়ে আবার যখন ফিরে এল তখন ছায়া তাকে ভালো করে লক্ষ্য করলো। হ্যাঁ, এ লোকটাকে সে আগে কোথাও দেখেছে। ঐ টাকা-টাকা উস্কোখুস্কো চুল, ঐ ঝোলা-গোঁফ—এ মুখটা ওর চেনা।

লোকটা ফুলের তোড়াটা ফুলদানিতে সাজিয়ে টেবিলে রাখল। তারপর চলে গেল ড্রিংক্‌স্‌ টেবিলের দিকে। ট্রে-তে করে ড্রিংক্স্‌ সার্ভ করতে থাকে। ছায়া লক্ষ্য করলো–বাগানে অনেকগুলি চেয়ার ইতস্তত ছড়ানো। দু-প্রান্তে টেবিলক্লথে ঢাকা দুটি টেবিল। একটায় স্পিরিট ল্যাম্পে খাবার গরম রাখা হচ্ছে। তার ওপাশে তিন-চারজন য়ুনিফর্ম-পরা ক্যাটারারের লোক। ডিনার-সার্ভ করার অর্ডারের প্রতীক্ষা করছে। অবশ্য স্ন্যাপ্স্ তারাই সরবরাহ করছে। সচরাচর যেমন হয়। নিমন্ত্রিতেরা বাগানে ইতস্তত ঘোরাফেরা করছেন। ছোট-ছোট গ্রুপে আড্ডা জমাচ্ছেন। গুণবতী মোহান্তি আর তাঁর মেয়ে সুভদ্রা ঘটনাচক্রে ঐ সময় কলকাতার বাড়িতে ছিলেন। সল্টলেকের বাড়িতে। কীর্তিমান প্রাক্তন রাষ্ট্রমন্ত্রী শিঙে ফোঁকার আগেই ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কিছু মাথা গোঁজার সাত-আটতলা ভদ্রাসন নির্মাণ করে গেছেন। স্বনামে নয়—বোম্বাই আর দিল্লির মোকাম গুণবতী মোহান্তির। কলকতা, বাঙ্গালোর আর পুরীর প্রাসাদ তিনটি কন্যা সুভদ্রার নামে। রাষ্ট্রমন্ত্রী জীবিতকালে ছিলেন : অনিকেত। স্ত্রী-কন্যা তাদের বাড়িতে ঢুকতে না দিলে আক্ষরিক অর্থে পথে বসতে হতো তাঁকে। ওঁরা মা-মেয়ে কলকাতা থেকে মারুতি-সুজুকি ভ্যানটা নিয়ে এসেছেন। অনুরাধা আর জয়ন্ত এসেছে লোকাল ট্রেনে। তাদের ফেরার তাগাদা ছিল। তবে মিসেস্ মোহান্তি তাদের আশ্বাস দিয়ে রেখেছেন, ওরা ফেরার ট্রেন না পেলে ওদের কলকাতায় পৌঁছে দেবেন। ছায়াকে পেয়ে অনুরাধা জনান্তিকে জানালো—লাস্ট ট্রেন মিস্ করলে আমি কিন্তু আপনাদের গাড়িতে ফিরব মিসেস্ পালিত।

হেতুটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি ছায়ার। সেই হারিত-জাড়িত-লারিত/অমিতা-জমিতা- তমিতার হিডিয়াস্ হেক্সাগনের আধখানা। অনুরাধা চাইছে ইন্দ্রকুমারকে এবং ইন্দ্রকুমার চাইছে অর্ধেক রাজত্ব সমেত উৎকলী রাজকন্যাকে। ফলে অনুরাধা সুভদ্রার ওবলিগেশন নেবে না।

ঘোষাল সুযোগমতো ছায়াকে জনান্তিকে পকড়াও করলেন।—তুমি একটু ক্যাপ্টেনের দিকে নজর রেখ, ছায়া। বে-এক্তিয়ার হয়ে গেলে তুমিই অপ্রস্তুতে পড়বে। অবশ্য ইচ্ছে করলে রাতটা তোমরা দুজন আমার বাড়িতেও কাটিয়ে যেতে পার। কাল তো রোববার। দোকান বন্ধ।

ছায়া বলেছিল, আপনি ব্যস্ত হবেন না, ডক্টর ঘোষাল। জগৎ তিন পেগের বেশি ড্রিংক্‌স্‌ নেবে না। আর তিন পেগে ওর কি হয় না!

—তিন পেগ? মাত্র তিন পেগ! কেন গো?

-–ও আজকাল তিন পেগের বেশি খায় না।

এখানে ছায়ার জবানবন্দি থামিয়ে দিয়ে বাসুসাহেব বলে ওঠেন, বল কি হে ছায়া! ক্যাপ্টেনের এই হাল? অমৃতে অরুচি? কেন গো?

ছায়া জবাব দেবার আগেই রানু বলে ওঠেন, তোমার নিজের কিন্তু দু-পেগ অমৃত-সেবন শেষ হয়ে গেছে।

বাসুসাহেব সামলে নিয়ে বলেন, ইয়েস! আই রিমেম্বার। বাকি আছে বরাদ্দমতো জাস্ট ‘আ-মিনি-হাফ’!

বলতে বলতেই ঢাললেন পুরো এক পেগ!

ছায়া বললো, জগতের প্রসঙ্গে পরে আসব, মেসোমশাই। আপাতত শনিবার সন্ধের ঘটনাটা শেষ করি—

—কর!

ঐ জনান্তিকতার সুযোগে ছায়া ডক্টর ঘোষালকে প্রশ্ন করেছিল, ঐ হারু লোকটা কে?

—হারু? মানে?

—ঐ যাকে আপনি ‘হারু’ বলে তখন ডাকলেন। যে লোকটা ফুলদানি নিয়ে এল? ঐ তো ট্রে-তে করে ডিং সাজিয়ে সার্ভ করছে?

ডাক্তার ঘোষাল বললেন, ও! হারাধন? ও আমার কম্বাইন্ড-হ্যান্ড। কেন বল তো? ওর বিষয়ে হঠাৎ তোমার কৌতূহল হলো কেন?

ছায়া স্বীকার করলো না যে, লোকটাকে তার চেনা-চেনা লাগছে। কোথাও সে ওকে দেখেছে। ঐ লোকটাকে, অথবা তার ফটোগ্রাফ। খেলার এই পর্যায়ে, এই জিলে, সে রঙের গোলামটাকে পেড়ে লিড দিতে রাজি হলো না। দেখা যাক—’মজারু’ খেলাটা কোনদিকে মোড় নেয়। ছায়ার চিন্তাটা তখন ঐ রকম। ও এবার জানতে চাইল, ডাক্তারসাহেবের বাড়িতে টয়লেট টা কোথায়? ঘোষাল একটি চাকরকে ডেকে বললেন, নন্দু, এই দিদিমণিকে আমার দোতলার বেডরুমের সংলগ্ন বাথরুমটা দেখিয়ে দে।

নন্দু বললে, আসেন দিদি, আমার লগে লগে।

ওর পিছন-পিছন যেতে যেতে ছায়া জিজ্ঞেস করলো, তুমি বুঝি এবাড়িতেই কাজ-টাজ কর, নন্দু?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, দিদি। তা প্রায় সাত বছর। আমি রান্নাবান্না করি। ডাক্তারবাবুর বেবাক্ কাজ করে দি—

—আর ঐ হারাধন? সে কী করে?

নন্দু থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। বলে, জানি না তো, দিদি। ডাক্তারবাবুরে জিগাইবেন।

ছায়া রীতিমতো অবাক হয়ে যায়। এটাই কি তাহলে ‘মজারু’? ডাক্তারবাবু যার পরিচয় দিচ্ছেন ‘কম্বাইন্ড-হ্যান্ড’ বলে, তাঁর সত্যিকারের কম্বাইন্ড-হ্যান্ড বলছে—সে লোকটা কী করে তা ও জানে না। এর মানেটা কী? মজারু?

ছায়া আবার জানতে চায়, ঐ হারাধন কতদিন এখানে কাজ করছে?

—কাজ? আজ্ঞে না, কাজ তো ও কিছু করে না, দিদি। আছে গত মঙ্গলবার থিকা …ঐ…ঐটে বাথরুম। অ্যাইডে সুইজ। আপনে ভিৎরি যান, আমি বাতি জ্বেলে দেবনে।

ছায়া বাথরুম থেকে ফিরে এসে দেখল ভ্রাম্যমাণ আগন্তুকেরা বিভিন্ন টেবিলে ঘনিয়ে বসছেন। ছায়া তার ক্যামেরা বার করে তিন-চারটি শট নিল। ঐ ‘হারাধন’ লোকটার মধ্যে ‘মজারু’-র সন্ধান পেয়ে কায়দা করে ফ্ল্যাশবাবে এমন ফটো তুললো যাতে হারাধনের ফ্রন্ট ও সাইড ভিয়ু স্পষ্ট পাওয়া যায়।

ইতিমধ্যে সবাই বসেছেন। ডাক্তারসাহেব যে টেবিলে বসেছিলেন সেই টেবিলে ছিলেন আরও তিনজন নিমন্ত্রিত : ঘোষালের ডাইনে অনুরাধা বসু, বাঁয়ে সুভদ্রা মহান্তি। ঘোষালের বিপরীতে ঐ ভদ্রমহিলা, অ্যাগি ডুরান্ট। তাঁর পাশের টেবিলে বসেছিলেন ক্যাপ্টেন পালিত। তাঁর হাতে হুইস্কির গ্লাস—’হুইস্কি অন র’। ক্যাপ্টেনের পাশের চেয়ারে এখানকার মানসিক হাসপাতালের একজন ডাক্তার—তাঁর সঙ্গে ছায়ার আলাপ হয়নি। আরও একজন ভদ্রমহিলা বসেছিলেন—স্থানীয় একজন পুলিস অফিসারের স্ত্রী। টয়লেট থেকে ফিরে আসার পর তিনিই ছায়াকে ডাকলেন, আসুন, দিদি। এই চেয়ারটায় বসুন।

ছায়া তাঁর পাশের চেয়ারটায় বসল। উনি বললেন, আমার নাম পম্পা সেনরায়। আমি ডক্টর ঘোষালের একজন এক্স-পেশেন্ট।

তাঁর ওপাশ থেকে ডাক্তারবাবুটি বললেন, তা-ছাড়াও ওঁর আর একটি পরিচয় আছে। উনি প্রতীক্ষারতা নায়িকা

ছায়া চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বলে, মানে?

—কোনার্ক-খাজুরাহে দেখেননি? প্রতীক্ষারতা নায়িকামূর্তি?

—তা দেখেছি। কিন্তু উনি কেন তা হতে যাবেন?

ডাক্তারবাবু বললেন, ব্যাখ্যা দাখিল করব। তার আগে নিজের পরিচয়টা দিই। আমার নাম অমরেশ দাশ। ডক্টর ঘোষালের কোলিগ। এই মানসিক হাসপাতালেই আছি! …না, না, আপনাকে পরিচয় দিতে হবে না, মিসেস্ পালিত। আমরা আপনার পরিচয় জানি। … যে কথা বলছিলাম, মিসেস্ পম্পা সেনরায়ের আরও একটি পরিচয় আছে। উনি এখানকার ডি. এস. পি. মিস্টার যুগলকিশোর সেনরায়ের বেটার হাফ। ওঁদের দুজনেরই সায়মাশে নিমন্ত্রণ ছিল, কিন্তু স্থানীয় মস্তানদের মধ্যে দলাদলিতে বোমাবাজি হওয়ায় ডি. এস. পি-সাহেব আটকা পড়েছেন। তাই পম্পা দেবী সেই অজন্তা গুহার ‘প্রতীক্ষারতা কৃষ্ণা রাজকুমারী তে রূপান্তরিতা। কিন্তু আপনি তো কোনো ড্রিংক্‌স্‌ নেননি এখনো। অ্যাই… ব্যয়?

নেপথ্যের দিকে হাত বাড়িয়ে উনি যে ভঙ্গিতে ‘ব্যয়’ বলে হাঁকাড় পাড়লেন, তাতে ছায়ার মনে হলো ওঁর থার্ড পেগ ইতিমধ্যেই নিঃশেষিত।

এগিয়ে এল সেই লোকটি।

টাকা-টাকা চুল, ঝোলা গোঁফ, ফতুয়া গায়ে।

তার হাতে একটি ট্রে। তাতে নানান পানীয়

ছায়া যে কখনো পান করেনি তা নয়, কিন্তু ওর খেয়াল ছিল—গাড়ি ড্রাইভ করে কলকাতায় ফিরতে হবে। জগৎ এক সপ্তাহ হলো তিন পেগের বেশি পান করছে না; কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞা যে আজকের এই উৎসব রজনীতেও রক্ষিত হবে তার গ্যারান্টি নেই। সে, লোকটা—কী যেন নাম? –হ্যাঁ, হারাধনকে বললে, এর মধ্যে স-ড্রিংস্‌ কোনটা? গোল্ড স্পট, সিট্রা, কোকোকোলা জাতীয় যা হয় একটা দাও—যাতে অ্যালকহল নেই।

হারাধন একটা গ্লাস ওর হাতে তুলে দিল। বললো : পেপসি! ছায়ার মনে হলো, লোকটার টনসিলের দোষ আছে। কণ্ঠস্বর কেমন ফ্যাসফ্যাসে। মাত্র দুটি শব্দ সে উচ্চারিত হতে শুনেছে। ইতিপূর্বে ‘আজ্ঞে আচ্ছা’ আর এবার ‘পেসি’। মনে হলো হারাধন খুব মিতভাষী!

ডক্টর দাশ প্রতিবাদ করেন, এটা কেমন হলো মিসেস্ পালিত? হার্ড ড্রিংস না নিতে চান তো একটা জিন-উইথ-লাইম তো নেবেন?

ছায়া বললে, সরি, ডক্টর। আমাকে ড্রাইভ করে কলকাতা ফিরতে হবে। আমি দ্বিচারিণী হতে রাজি নই। আইদার ড্রিংক্স্‌ অর স্টিয়ারিং—নট বোথ!

সুভদ্রা পাশের টেবিলে তখন কী একটা জোক্‌স্‌ শোনাচ্ছিল। ঠিক পাশের সিটে বসেছিলেন ডক্টর ঘোষাল। তাঁর বাঁ-হাতে ধরা ছিল একটা আধখাওয়া ফিশ-ফিঙ্গার। এই সময় হারাধন ট্রে-হাতে তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ছায়ার স্পষ্ট মনে আছে তার হাতে যে ট্রে-টা ছিল, তাতে তখন চার-পাঁচটা গ্লাস—হুইস্কি, রম, রেড-ওয়াইন, ভদ্‌কা

বাধা দিয়ে বাসু প্রশ্ন করেন, তুমি দেখেই চিনতে পারলে? কোনটা কী?

ছায়া হাসল। বললো, মেসোমশাই! আমি অ্যালকহলিকের ঘরণী। আমার স্বামীর জীবনের লক্ষ্য : সিরোসিস্ অব্ লিভারের তীর্থে উপনীত হওয়া! আমি ড্রিংক্‌স্ চিনব না? রঙেই তো বোঝা যায়—হুইস্কি, রম, রেড-ওয়াইন আর ভদ্‌কার পার্থক্য। ওখানে জিন থাকলে ভদ্‌কার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতে পারতাম, অথবা ব্র্যান্ডি থাকলে হুইস্কির সঙ্গে…

বাসু বলেন, আয়াম সরি। ঠিক আছে। বলে যাও…

—হারাধন দুটো টেবিলের মাঝখানে দাঁড়ানোতে ওদিকটা আমারও দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল। তবে ডাক্তার ঘোষাল একটি গ্লাস তুলে নিতেই হারাধন তাঁর ওপাশে চলে গেল। ইতিমধ্যে সুভদ্রার জোটা শেষ হয়েছে। আমি তাকিয়েছিলাম ডাক্তারসাহেবের দিকে। দেখলাম, তাঁর হাতে-ধরা গ্লাসটার পানীয় সাদা রঙের। অর্থাৎ তিনি ভদ্‌কা উইথ লাইম কডিয়াল নিয়েছেন। সুভদ্রার জোকটা শেষ হতেই সবাই হেসে উঠলো। ঘোষাল ফিশ- ফিঙ্গারের বাকি টুকরোটা মুখে পুরে দিলেন। তারপর তাঁর ডান-হাতে ধরা পানীয়টায় একটা চুমুক দিলেন। আর তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে উঠলেন। মুখটা বিকৃত হয়ে গেল তাঁর। তারপরেই গ্লাসটা টেবিলে ঠক্ করে নামিয়ে রাখলেন। মুখে বললেন, ‘এক্সকিউজ মি…

ছায়ার মনে হলো ওঁর একটা বিবমিষার বেগ এসেছে। তাই দ্রুত টেবিল ছেড়ে আড়ালে আসতে চাইছিলেন। পারলেন না। প্রথম পদক্ষেপের পরেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন।

ন্যাচারালি একটা সোরগোল উঠল। সবাই এদিকে ছুটে এল। ছায়ার দৃষ্টির আড়ালে পড়ে গেলেন ডক্টর ঘোষাল।

বাসুসাহেব নিজের হাতের গ্লাসটা তুলে দেখিয়ে ছায়াকে প্রশ্ন করেন, আর গ্লাসটা? ঘোষালের হাতের গ্লাসটা?

ছায়া বললে, আয়াম সরি, মেসোমশাই, আমি জানি না। আমি চোখ মেলে দেখিনি….

–কী আশ্চর্য! প্রথমবার তো দেখেছিলে? বিল শবরিয়ার কেসে?

—তা দেখেছিলাম। কী জানেন, মেসোমশাই, সেবার আমার প্রথম প্রতিক্রিয়ায় মন বলেছিল—’এটা হার্ট-অ্যাটাক নয়, হত্যা—বিষপ্রয়োগে হত্যা!’ তাই আমি সজাগ দৃষ্টি মেলে সব কিছু লক্ষ্য করেছিলাম।

—আর এবার?

—আয়াম সরি টু অ্যাডমিট, স্যার! এবার আমার ভুল হয়ে গেল। হিমালয়ান্তিক ভ্রান্তি। আমার মনে হলো, এটা ডক্টর ঘোষালের একটা ‘ফিথি জোক’! উনি অ্যাবে শবরিয়ার মৃত্যু- অভিনয় করে আমাদের একটা ‘মজারু’ দেখাচ্ছেন। আমি মর্মান্তিকভাবে আহত হয়েছিলাম—এ কী চ্যাঙরামি! ডঃ ঘোষাল একজন বয়স্ক, প্রতিষ্ঠিত মানুষ! একজন আদিবাসী যাজকের মৃত্যু-মুহূর্তের যন্ত্রণার অভিনয় করে উনি আমাদের ‘মজারু’ দেখাচ্ছেন!!

—তারপর?

—মিনিট পাঁচেক আমি ঐ চিন্তাতেই বিভোর ছিলাম। প্রতি মুহূর্তেই আশা করছিলাম অভদ্ৰ অভিনয়ে ক্ষান্তি দিয়ে ঘোষাল হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াবেন। তা তিনি দাঁড়ালেন না। ইতিমধ্যে কী হয়েছে, কে কী করেছে আমি জানি না। তারপর জগৎ আমার হাতটা টেনে নিয়ে বললো, কী ভাবছ? আশ্চর্য কোয়েন্সিডেন্স! নয়?

–কী কোয়েন্সিডেন্স?

—দু-দুটো মৃত্যু! একই ভাবে।

তখনই আমি বুঝতে পারলাম—ঘোষালসাহেবের ঐ পতন ও মৃত্যুটা অভিনয় নয়, বাস্তব ঘটনা। আমি মর্মাহত হয়ে গেলাম। হয়তো তবু আমার বিশ্বাস হতো না, হলো অ্যাগি ডুরান্টের দিকে তাকিয়ে। তিনি ‘ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। আমার পাশের চেয়ারের সেই পম্পা—অজন্তার প্রথম গুহা-বিহারের প্রতীক্ষারতা কৃষ্ণা রাজকন্যা? সে হয়ে গেছে ষোড়শ বিহারের ‘মরণাহতা জনপদকল্যাণী The Dying Princess!’ এলিয়ে পড়েছে, চেয়ারেই।

সম্বিত ফিরে পেয়েই—বিশ্বাস করবেন না—আমার মনে প্রথম প্রশ্ন জাগল : ঐ লোকটা কোথায়? হারু? হারাধন? ডক্টর ঘোষালের দীর্ঘদিনের কম্বাইন্ড-হ্যান্ড?—যে গত সপ্তাহে কাজে বহাল হয়েছে? চারিদিকে তাকিয়ে আমি তাকে খুঁজে পেলাম না। এটা কেমন কথা? নন্দু আর ওঁর ড্রাইভার—কী যেন নাম, বাড়ির ঠিকে ঝি সবাই মৃতদেহ ঘিরে আছে। নিমন্ত্রিত সকলেই উপস্থিত। শুধু সে-লোকটা নেই! কেন? কেন? কেন?

একজন ক্যাটারারকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, হারুকে দেখেছ? লোকটা প্রতিপ্রশ্ন করে, হারু কে?

—হারু। হারাধন। ঐ যে লোকটা এতক্ষণ ড্রিংক্স্ সার্ভ করছিল। ফতুয়া পরা, বছর ত্রিশ- পঁয়ত্রিশ বয়স। মাথায় টাকা-টাকা চুল, ঝোলা গোঁফ…

ও-পাশ থেকে আর একজন ক্যাটারারের লোক বললে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, বুঝেছি, দিদি। হারাধনদা। সে তো ট্রেটা নামিয়ে রেখে কোথায় যেন চলে গেল!

ছায়া জানতে চাইল, কোথায়?

—তা কেমন করে জানব, দিদি?

ক্যাপ্টেন পালিত জানতে চায়, সে লোকটাকে তোমার কী দরকার?

—এ রকম মর্মান্তিক অবস্থায় বাড়ির লোক ওভাবে লুকিয়ে থাকবে কেন?

ক্যাপ্টেন পালিত বলে ওঠে : তাতে তোমার কী মাথাব্যথা?

ছায়ার এতক্ষণে খেয়াল হয় : তার বাঁ-হাতে দীর্ঘ সময় ধরে আছে একটা কাচের গ্লাস। তাতে একটা সফ্‌ট্ ড্রিংক : পেপ্‌সি বা ঐ জাতীয় কিছু। সে পরখ করে দেখেনি এখনো এবার সে সাবধানে পানীয়টা মাঠে ঢেলে ফেলে দেয়। ডিনার প্লেটের পাশে থাক-দেওয়া পেপার ন্যাপকিন খানকয় তুলে নেয়। সাবধানে মুড়িয়ে ওর হাতব্যাগে কাচের গ্লাসটা ভরে ফেলে।

বাসু বললেন, গুড! কোথায় সে গ্লাসটা?

হাতব্যাগ খুলে ছায়া টিসু-কাগজে মোড়া সেই কাচের গ্লাসটা বার করে টেবিলে নামিয়ে রাখল। ঐ সঙ্গে একটা হাফ-ফুলস্ক্যাপ মাপের কার্টিজ কাগজ। তাতে পাঁচ দু-গুনে দশটা আঙুলের টিপ ছাপ। রাবার স্ট্যাম্প-প্যাডের কালো কালিতে তোলা।

ছায়া বললে, এই দশটা হচ্ছে আমার দশ-আঙুলের ছাপ। গ্লাসটা কখন কোন হাতে ধরেছি মনে নেই। ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্টকে বলবেন, এই দশটা ফিঙ্গারপ্রিন্ট ছাড়া ঐ গ্লাসে যদি আর কোনো লেটেস্ট ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায়, তবে তা হারাধন দাশের। ও নিজে হাতে গ্লাসটা ধরে আমার হাতে তুলে দিয়েছিল। আমার যতদূর মনে আছে : ডান হাতে।

বাসু বললেন, তুমি খুব বুদ্ধিমতীর মতো কাজ করেছ, ছায়া। গ্লাসটা দাও, আমি খুব যত্ন করে তুলে রেখে দিচ্ছি। তবে ‘হারাধন দাস’ লোকটার আইডেন্টিটি গোপন নেই। আমরা জানি : সে কে!

—আপনারা জানেন? জানেন লোকটা কে?

বাসু নিঃশব্দে তাঁর অ্যাটাচি-কেস থেকে খান-চারেক পোস্টকার্ড সাইজ ফটোগ্রাফ বার করে তাঁর গ্লাসটপ টেবিলে রাখলেন—একই লোকের। দুখানি—দুখানি—সম্মুখ দৃশ্য; দুখানি পার্শ্বচিত্র বা প্রোফাইল।

বললেন, তুমি মিলিয়ে দেখে নাও, ছায়া।

ছায়া সাবধানী মেয়ে। তাড়াহুড়া করলো না। চারখানি ছবি টেবিল-ল্যাম্পের কাছে নিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলো। বাসুসাহেব নিঃশব্দে ওঁর অ্যাটাচি-কেস থেকে একটা বড় ম্যাগনিফাইং গ্লাস বার করে দিলেন। ছায়াও সেটা বিনা বাক্যব্যয়ে হাত বাড়িয়ে নিল। অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে দেখে বললে : হ্যাঁ, একই লোক, কিন্তু কে লোকটা?

—একটা অতি পরিচিত অ্যান্টিসোস্যাল। ওর অপারেশনের এলাকা ছিল মুর্শিদাবাদ জেলা। খুনের কেসে ধরা পড়ে। হয়তো ফাঁসিই হয়ে যেত; কিন্তু ওর দলের লোক পুলিস ভ্যান থেকে ওকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। সেই থেকে লোকটা ফেরার। ওর ছবি ছাপিয়ে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। হয়তো তুমি তা দেখেছ ঠিক মনে করতে পারছ না—তাই প্রথম দর্শনেই তোমার মনে হয়েছিল একে আগে কোথাও দেখেছ। ও একজন পাক্কা অ্যান্টিসোস্যাল—বর্তমানে ফেরার। ওর নাম : পঞ্চানন ঘড়াই। ডাক নাম: পচাই।

ছায়া অনেকক্ষণ ধরে হজম করলো তথ্যগুলো। তারপর জানতে চাইলো এমন একজন সামাজবিরোধীকে ডাক্তার ঘোষাল তাঁর বাড়িতে ঠাঁই দিয়েছিলেন কেন?

—সেটাই এ রহস্যের বুল্স্-আই–কেন্দ্রীয় সমস্যা!

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো ছায়ার। বললো, তাহলে এই গ্লাসটার, আই মিন ফিঙ্গারপ্রিন্টের কোনো প্রয়োজন নেই?

—তা তো আমি বলিনি, ছায়া। তুমি ওটা দাও। আমি সযত্নে প্রিজার্ভ করব।

—কিন্তু লোকটার আইডেন্টিটি তো জানা গেছে?

—তোমার-আমার কাছে। আদালতের কাছে নয়। পঞ্চানন যদি কোনোদিন ধরা পড়ে তাহলে সে তো স্বীকারই করবে না যে ‘হারাধন দাস’-এর ছদ্মবেশে সে চিনসুরায় কোনো ডাক্তারবাবুর বাড়িতে আদৌ চাকরি করেছে-

—কিন্তু এই ফটোগ্রাফগুলো?

—ওগুলো যে তুমি সেই শনিবারে ডিনার পার্টিতে তুলেছ তার কী প্রমাণ? ওর উকিল বলবে, ধর্মাবতার! এ চারখানাই পঞ্চাননের ফটোগ্রাফ। পুলিসের তোলা। যখন সে হাজতবাস করেছে।

—তাহলে তো কাচের গ্লাসের ফিঙ্গারপ্রিন্টের ক্ষেত্রেও সে বলতে পারে সেগুলো পঞ্চানন ঘড়াই-এর, হারাধনের নয়।

—না। পারে না। কাচের গ্লাসে দেখ, ক্যাটারারের নামের মনোগ্রাম এচিং করা আছে। ক্যাটারার আদালতে হলফ নিয়ে বলবে যে, এ গ্লাস তাদের। ঐ গ্লাসে হাজতবাসকালে পঞ্চানন ঘড়াই-এর আঙুলের ছাপ পড়তে পারে না। ডাক্তার ঘোষালের তথাকথিত কম্বাইন্ড-হ্যান্ড ‘হারাধন দাসে’র আঙুলের ছাপই পড়েছে। থ্যাংকস্ ছায়া, ফর য়োর কন্ট্রিব্যুশন।

ছায়া বলে, তাহলে উঠি?

—আর একটু বস। একটা ব্যাপারের ব্যাখ্যা দাওনি এখনো। ক্যাপ্টেন জগৎ পালিত কেন এখন তিন পেগের বেশি অমৃতপানে আগ্রহী নয়।

ছায়ার মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। বললো, ওর একটা বিরাট পরিবর্তন হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। আমার একজন সহপাঠিনী, কলেজের বান্ধবী একটা ‘অরফানেজ’-এ কাজ করে। পিতৃমাতৃহীন অনাথদের প্রতিষ্ঠান। ও আমাদের দুজনকে ওদের বার্ষিক অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করে। পথে কুড়িয়ে পাওয়া বা বাপ-মা পরিত্যক্ত বাচ্চাদের একটা নাচ-গান উৎসবের আয়োজন। সেখানে ঐ পরিত্যক্ত অবমানিত মানবশিশুগুলিকে দেখে জগতের মনে দারুণ একটা আঘাত লাগে। সে ফিরে এসে নিজে থেকেই আমাকে বলে, ‘কাম্ অন্ ছায়া! আমরা ঐ অনাথ আশ্রম থেকে একটি মেয়েকে নিয়ে এসে অ্যাডপ্ট করি। তাকে দত্তক নিই। তাকে কন্যাত্বে বরণ করে নিই।’

—আমি অবাক হয়ে বলি, সে-কথা তো অনেক আগেই আমি বলেছিলাম, তখন তুমিই তো রাজি হওনি—

ও বললে, আই অ্যাডমিট। আজ হচ্ছি! বাস্তব সমস্যাটা সেদিন ঠিক বুঝতে পারিনি, আজ পারছি। বিশ্বনিয়ন্তা বলে যদি কোনো ভদ্রলোক থাকেন, তাহলে তিনি আমাকে এক অস্ত্রে মেরেছেন—ঐ বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলিকে অন্য অস্ত্রে অন্যভাবে মেরেছেন। গড-অর- নো-গড—আমরা কি পরস্পরের সমস্যার পরিপূরক সমাধান দাখিল করে ঐ পরম করুণাময় গড-ভদ্রলোককে বলতে পারি না—উই কেয়ার টু হুটস্ ফর য়োর অ্যাপাথি?

—কী বলব, মেসোমশাই, আমি জগতের মধ্যে একটা নতুন মানুষকে আবিষ্কার করলাম। ও নাস্তিক ছিলই, এখনো তাই আছে। কিন্তু ও নিজের পথে জীবনের সমস্যাটার সমাধানটা খুঁজছে। আজ মনে হচ্ছে ও শচীশের জ্যেঠামশায়ের মতো আইডিয়াল নাস্তিক। চার অধ্যায়ের’ শচীশের কথা বলছি! তাই ও ঈশ্বরকে শত্রুভাবে ভজনা করতে চায়।

বাসুসাহেব বললেন, তুমি কি বললে?

—আমি বললুম, আমি রাজি! অনাথ আশ্রম থেকে অনাথা একটি মেয়েই নিয়ে আসব। অনাথ আশ্রমের ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা বেশি দুর্ভাগিনী। ছেলেরা বয়ঃপ্রাপ্ত হলে অধিকাংশই উপার্জনশীল হয়ে ওঠে। মেয়েরা যায় ‘রেড লাইট’ এলাকায়। তুমি-আমি যৌথ প্রচেষ্টায় যদি একটি মেয়েকেও সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, তাতে আমাদেরই সান্ত্বনা, আমাদেরই জীবনের সার্থকতা। কিন্তু জগৎ, তার আগে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। তোমাকে মদ্যপান ত্যাগ করতে হবে। পারবে?

জগৎ বললো, রাতারাতি? আমার শরীর প্রতিবাদ করবে না তো? ডাক্তারের সঙ্গে কনসাল্ট করব?

তাই করেছিলাম আমরা। ডাক্তারবাবু বলেন, প্রথম এক মাস ও তিন পেগের বেশি খাবে না। পরের মাসে দু পেগ। তার পরের মাসে এক পেগ। তারপর ছেড়ে দেবে। জগৎ রাজি হয়েছে। এখন তার তিন পেগের জমানা চলছে!

রানু জানতে চাইলেন, ডাক্তারবাবুর নাম-ঠিকানাটা আমাকে জানাবে ছায়া? আমি তাঁকে একটু কনসাল্ট…

বাসু বাধা দিয়ে বললেন, এ-সব ছেঁদো-কথার কোনো মানে হয়? শিভাস-রিগ্যালের বোতলটা টেনে নিলেন তিনি!

.

পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসেছেন চারজন। বাসুসাহেব আজকাল প্রাতরাশে টোস্ট-মাখন-ডিম ইত্যাদি আদৌ খান না। পেঁপে-কলা-শশা-আপেল-আঙুরের একটা হচপচ শেষ করে একপিস ক্রিমক্র্যাকার বিস্কুটের সঙ্গে র-কফি পান করেন। বাকি তিনজনে টোস্ট অমলেট-চা। রানু দেবীর কড়া ব্যবস্থাপনা।

রানু বললেন, আমার তো মনে হচ্ছে তোমার হাতে এবার যে কেসটা এসেছে সেটাই তোমার গোটা কেরিয়ারে মোস্ট মিস্টিরিয়াস কেস! আমরা তো ভেবেচিন্তে কোনো কিনারাই করতে পারছি না।

টোস্টে একটা কামড় দিয়ে সুজাতা বললে, তা ঠিক।

বাসু নির্বাক। পেঁপে চিবোচ্ছেন। কৌশিক বললো, মামু কিছু বলছেন না যে? আপনার কমেন্টস্?

–কী বলব? পাগলের প্রলাপের উপর কমেন্টস্ করা চলে?

রানু রুখে ওঠেন, পাগলের প্রলাপ! কেন? কী ভুল বলেছি আমি?

—প্রথম কথা, আমার হাতে কোনো ‘কেস’ নেই। আইনজীবীর কাছে ‘কেস’ শব্দটি ‘ক্লায়েন্ট’ শব্দের সঙ্গে বাগর্থের মতো সম্পৃক্ত! ক্লায়েন্ট আসবে, নাম-ঠিকানা বাৎলাবে, সমস্যাটার কথা বলবে, রিটেইনার দিয়ে রসিদ নেবে, তখনই না পয়দা হবে ‘কেস’! এখানে আমার মক্কেল কে?

সুজাতাও রুখে ওঠে: এই কথা? বেশ! দিন তো মামিমা, একটা একশো টাকার রসিদ। টাকাটা সুকৌশলী দেবে। আপনার ক্লায়েন্ট : ‘সুকৌশলী’। হলো তো? এবার?

বাসু বিনা বাক্যব্যয়ে পেঁপের পর্বতে ফর্কের কোদাল চালাতে থাকেন।

কৌশিক সহধর্মিণীকে মদত দিতে এগিয়ে আসে, আপনার বোধহয় মনে নেই, মামু—আমি একসময় এস.টি.ডি. ফোন করতে চাওয়ায় সুজাতা বলেছিল : ‘দিস্ ইজ ওয়াইল্ড গুজ চেজ! আমাদের ক্লায়েন্ট কই?’ তখন আপনিই তাকে এক ধমকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন—এ-কেসে সুকৌশলীর ক্লায়েন্ট ব্যারিস্টার পি. কে. বাসু! বলেননি?

বাসু ঢোক গিলে সামলে নেন নিজেকে। বলেন, অল রাইট! আমরা পরস্পরকে এনগেজ করেছি। সুকৌশলী আমাকে, আমি সুকৌশলীকে। আমরা মিউচুয়ালি পরস্পরের এজেন্ট। কিন্তু কী জান কৌশিক? সমাধানের আগে সব কেসকেই মনে হয় এটাই সবচেয়ে মিস্টিরিয়াস!

—আপনি এ কেসে কোনো সমাধানের সঙ্কেত পাচ্ছেন?

—পাচ্ছি। সঙ্কেত পাচ্ছি, ইঙ্গিত পাচ্ছি—কিন্তু চূড়ান্ত সমাধানে আসতে পাচ্ছি না। কারণ যথেষ্ট পরিমাণে ডাটা এখনো হাতে আসেনি।

—কী জাতীয় ‘ডাটা’?

—সবচেয়ে বড় ‘ডাটা’ হচ্ছে : অ্যাবে বিল শবরিয়ার মৃত্যুর প্রকৃত হেতুটা কী? হার্ট- ফেলিওর না বিষপ্রয়োগ? যদি সেটা ‘হার্ট-ফেলিওর’-এর কেস হয়, তাহলে আমার পক্ষে ঘোষালের মৃত্যু-রহস্য সমাধান অনেক সহজ হয়ে পড়ে। কিন্তু দুটো কেসই যদি পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়—দুটো যদি একই হাতের সূক্ষ্ম কাজ হয় তাহলে ছায়া পালিতের ভাষায় আমাদের সামনে প্রথমেই উপস্থাপিত হবে একটা গ.সা.গু.-র অঙ্ক।

—গ.সা.গু? তার মানে?—জানতে চায় সুজাতা।

—গরিষ্ঠ সাধারণ গুণনীয়ক! দুটি পার্টিতেই উপস্থিত ছিল কে, কে? তাদের মধ্যেই কেউ বিশেষ পানীয় পাত্রে বিষ মেশাচ্ছে! বাইরের লোকের পক্ষে তা সম্ভব নয়।

রানু বললেন, হ্যাঁ; সে-হিসাবটা আমি কষে রেখেছি। দু-দুটি ডিনার পার্টিতে শারীরিক উপস্থিতি একুশ জনের। প্রথম পার্টিতে ছিল তেরজন। তার’ভিতর একজন ভিকটিম। ফলে বারোজন। দ্বিতীয় পার্টিতে ছিল ভিক্‌টিম বাদে নয়জন। প্রথম পার্টির ঠাকুর চাকর-সার্ভারদের হিসাবের বাইরে রাখছি যেহেতু দ্বিতীয় পার্টিতে তারা কেউ ছিল না। দ্বিতীয় পার্টির ক্যাটারারদেরও একই কারণে বাদ দিচ্ছি। এই একুশ জনের মধ্যে কমন ফ্যাকটর—যাঁরা দুটো পার্টিতেই উপস্থিত ছিলেন তাঁদের সংখ্যা: ছয়! তাঁরা হলেন : ক্যাপ্টেন পালিত, মিসেস্ ছায়া পালিত, মিসেস্ মোহন্তি, মিস্ মোহান্তি, অনুরাধা আর জয়ন্ত। মাত্র দুজন পুরুষ, বাকি চারজন মহিলা!

বাসু বললেন, অঙ্কে ভুল হয়নি। কিন্তু সমাধান?

—সমাধান বালাবার দায় তো তোমার! কোনো মহিলার পক্ষে ড্রিংসের সঙ্গে বিষ মেশানো অসম্ভব! ছায়া, অনুরাধা, সুভদ্রা বা মিসেস্ মোহান্তি ড্রিংক্‌স্ টেবিলের ধারে-কাছে যাননি। আর পুরুষ দুজন? একজন তো ক্যাপ্টেন পালিত। সর্বদা অমৃতসেবনে বিভোর। দ্বিতীয় জন জয়ন্ত। প্রথম বার সে ছিল ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত। ড্রিংক্স্‌ টেবিলের ধার-কাছে আসেনি। এবারও নাকি তাই। তাহলে?

বাসু বললেন, সে কথাই তো বলছি আমি। দুটোই যদি বিষপ্রয়োগে হত্যার কেস হয় তাহলে আমরা বিশ বাঁও জলের নিচে। এ কেস সল্ভ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে। আর যদি ভুবনেশ্বর থেকে রিপোর্ট আসে যে, গুনপুরের সিমেটারিতে বিল শবরিয়ার দেহ ‘এক্সহিউয়ুম’ করে প্রমাণ করা গেছে যে, বিষপ্রয়োগে তাঁকে হত্যা করা হয়নি, তাহলে আমাদের সমস্যাটা আর ‘ক্যোঅড্রাটিক ইকোয়েশন’ থাকবে না। আই মিন দ্বিঘাতী সহ- সমীকরণ থাকবে না। x এবং y নয়, শুধু x-কে খুঁজব আমরা। সেক্ষেত্রে অঙ্কটা অনেক সরল হয়ে যাবে।

কৌশিক জানতে চায়, ধরুন তর্কের খাতিরে এক্ষুণি জানা গেল যে বিল শবরিয়ার মৃত্যুটা বিষক্রিয়ায় হয়নি, তাহলে আপনি কি আন্দাজ করতে পারছেন কে হতে পারে ডক্টর ঘোষালের হত্যাকারী?

বাসু র-কফিতে চুমুক দিলেন।

রানু বললেন, তখন কিন্তু সন্দেহের তালিকায় মাত্র ছয়জন নেই, আছেন নয়জন।

সুজাতা বলে, নয় কেন মামী? নয় প্লাস হারাধন—দশ।

রানু বললেন, হারাধন তো প্রফেশনাল কিলার! তাকে তো নিশ্চয় কেউ নিয়োগ করেছে। ঐ দুর্লভ এবং দুর্মূল্য নিকোটিন ডেরিভেটিভটা সরবরাহ করেছে। ভদ্‌কার পাত্রে মিশিয়ে ভিকটিমের হাতে তুলে ধরতে এনগেজ করেছে।

কৌশিক বলে, কিন্তু মিস্ অ্যাগি ডুরান্ট তাঁর স্টেটমেন্টে বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন—গ্লাসটা ডক্টর ঘোষাল নিজেই তুলে নেন। কেউ ‘ফোর্সিং-কার্ডের’ ম্যাজিক দেখায়নি।

সুজাতা যোগ দেয়, আই’ রিমেম্বার। উনি বলেছিলেন, ট্রেতে চারটি পানীয় ছিল তখন—রম, হুইস্কি, ভদ্‌কা আর রেড-ওয়াইন। ডক্টর ঘোষাল তা থেকে নিজেই একটা উঠিয়ে নেন। ভদ্‌কা। অ্যাকসিডেন্টালি সেটাই ছিল বিষমিশ্রিত।

বাসু এতক্ষণে কথা বলেন, তুমি কী করে জানলে?

–কী?

—হুইস্কি-রম-রেডওয়াইনেও একই বিষ, একই পরিমাণে ছিল, কি ছিল না? সে চারটি গ্লাসের পানীয়কে কি পরীক্ষা করানো হয়েছে?

কৌশিককে স্বীকার করতে হলো, তা বটে।

রানু বললেন, আরও একটা কাকতালীয় কোয়েন্সিডেন্সের দিকে তোমাদের নজর পড়েছে কি না জানি না।

সুজাতা প্রশ্ন করে, কী কোয়েন্সিডেন্সের কথা বলছেন মামিমা?

—পুরীতে বিল শবরিয়া যে ড্রিংক্‌টা পান করেছিলেন সেটাও ছিল ‘ভদ্‌কা’!

বাসু কোনো কথা বললেন না। তাঁর কফিপান শেষ হয়েছিল। হাত বাড়িয়ে টেলিফোন রিসিভারটা তুলে নিয়ে কী একটা নাম্বার ডায়াল করতে থাকেন। একটু পরেই টেলিফোনে জানতে চান, ব্রজদুলালবাবু?…হ্যাঁ, আমি বাসু বলছি। আজ আপনার কী প্রোগ্রাম? …

ইন্দ্ৰ কোথায়?…বুঝলাম! কী নাটক?…আচ্ছা। তা আপনি একবার আমার এখানে আসতে পারেন? ইন্দ্র যেমন রিহার্সাল দিচ্ছে দিক। আপনি একাই আসুন।…ইয়েস, আমি অপেক্ষা করব!

রানু জানতে চান, নটরঙ্গ নতুন নাটক নামাচ্ছে মনে হলো। কী নাটক?

বাসু বললেন, নতুন নাটক। একটা উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছেন ব্রজদুলাল নিজেই। উপন্যাসটার নাম—নাটকেরও ঐ নামই থাকবে—হচ্ছে : ‘প্রবঞ্চক’।

কৌশিক জানতে চায় : ডাচ শিল্পী ভাঁ মীগেরের জীবনী নিয়ে লেখা নাটক?

বাসু বলেন, কি জানি! তবে গল্পে নায়িকার চরিত্রটা খুব জুতের নয়, নায়কের কন্যার ইম্পর্টেন্ট রোল। তাই অনুরাধা এ নাটকে পার্ট করছে না। সুভদ্রা করবে ইন্দ্রকুমারের মেয়ের রোল। ওদের রিহার্সাল চলছে।

রানু জানতে চান, মনে হলো তুমি ব্রজদুলালবাবু চলে আসতে বললে?

—হ্যাঁ, উনি আসছেন। এখনি।

—তোমরা কি বিয়র বা জিন নিয়ে বসবে?

—পাগল! অ্যাত সকালে? আমরা কি পাঁড় মাতাল? রানু বললেন, না হলেই ভালো।

তেরো

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই এসে পড়লেন ব্রজদুলাল। অশোক ওঁকে নামিয়ে দিয়ে কী-একটা কাজ সেরে আসতে গেল। ব্রজদুলালকে ভিজিটার্স চেয়ারে বসিয়ে বাসু বললেন, আপনার নতুন নাটকের রিহার্সাল তো শুরু হয়ে গেল বললেন। ন্যাচারালি আপনারা সবাই ক্রমশ নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। তাই এবার খোলাখুলি আলোচনার সময় এসেছে। ঘোষাল ডাক্তারের মৃত্যুটার বিষয়ে আমরা কী অ্যাটিচ্যুড নেব!

ব্রজদুলাল দশ সেকেন্ড নির্বাক তাকিয়ে থাকলেন বাসুসাহেবের মুখের দিকে। তারপর বললেন, আপনি সাদা-বাংলাই বলেছেন, বাসুসাহেব, কিন্তু আমি ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি।

বাসু একটু ইতস্তত করে বললেন, বঙ্কুকৃত্য হিসাবে আমাদের যা করার ছিল তা আমরা করেছি। পুলিসকে জানিয়েছি, তারা আততায়ীকে খুঁজছে। এরপরেও কি আমাদের আর কোনো কর্তব্য বাকি রইল? ঘোষালের স্ত্রী-পুত্র-পরিজন কেউ আছে কিনা আমরা জানি না। দূরসম্পর্কের কোনো ওয়ারিশ থাকলেও সে খোঁজ নিতে আসবে না। কারণ ঘোষাল তার যাবতীয় পার্থিব সম্পত্তি–স্থাবর অস্থাবর —ঐ আরোগ্যনিকেতন ট্রাস্টকে দিয়ে গেছে। সুতরাং আমরা এক্ষেত্রে কি আরও অগ্রসর হব? খরচপাতি করব?

ব্রজদুলাল সোজা হয়ে উঠে বসলেন, ও! এই কথা! বুছেছি! দেখুন, বাসুসাহেব। আমিও ঘোষালের মতো কনফার্মড ব্যাচিলার। আমিও উইল করে থিয়েটার বোর্ডকে আমার সবকিছু দিয়ে রেখেছি। আমারও স্ত্রী-পুত্র-পরিজন নেই। এবং দূরসম্পর্কের কোনো ওয়ারিশ আমার খোঁজ নিতে আসবে না, বেমক্কা যদি আমি খুন হয়ে যাই। কিন্তু মানুষের আত্মা বলে যদি কিছু থাকে, তবে আমার আত্মা কিছুতেই বৈকুণ্ঠলোকে যেতে রাজি হবে না, যদি না আমার হত্যাকারী ফাঁসিতে ঝোলে। বুঝেছেন? আমি কি আপনাকে একটা অগ্রিম রিটেইনার দিয়ে রাখব? আমার নিজের খুনটার তদন্তের ব্যাপারে?

বাসু ও কথার জবাব দিলেন না। পকেট থেকে পাইপ ও পাউচ বার করে বলেন, আপনি চান যে, আমি এবং সুকৌশলী ইনভেস্টিগেশনটা চালিয়ে যাই? প্রয়োজনমতো খরচপাতি করি? এই তো?

—অফ কোর্স! ঘোষাল আমার বঙ্কু। হয়তো ইন্দ্রের সঙ্গে তার যেমন বাল্যবঙ্কুত্বের নিবিড় সম্পর্ক ছিল, আমার সঙ্গে তা ছিল না। তাকে বছর সাত-আট ধরে চিনি। কিন্তু তাই বলে ব্যস্ততার অজুহাতে অথবা অর্থ সঞ্চয়ের অজুহাতে আমি পিছু হটতেও রাজি নই বাসুসাহেব। পুলিস এসব কেস-এ কিছু করবে না। ব্রড ডে-লাইটে পুলিসের ডি.সি. বিনোদ মেহতা খুন হয়ে গেলেন, পূর্তমন্ত্রী হেমন্ত বসু খুন হয়ে গেলেন—পুলিস আততায়ীকে খুঁজে পেল? এক্ষেত্রে ঘোষাল ডাক্তারের মৃত্যুর কিনারা পুলিস কিছুতেই করতে পারবে না, আপনি যদি না ক্রমাগত খোঁচাতে থাকেন। বলুন স্যার, কী রিটেইনার দেব?

ইতিমধ্যে পকেট থেকে চেক বইটা বার করে ব্রজদুলাল টেবিলের উপর পেতেছেন। বাসু বলেন, তার আগে বলুন, আমি কতদূর খরচ করতে পারি? সুকৌশলীর এক্সপেন্স সমেত?

—আপাতত ধরুন : দশ হাজার।

—আপাতত মানে?

—খরচ তো আপনি করতে শুরুই করে দিয়েছেন। হাজার দশেক পর্যন্ত খরচ করার পর আমরা থামব। একবার পিছন ফিরে দেখব—কিছুটা অগ্রসর হওয়া গেছে, নাকি ঐ আমড়াতলার মোড়েই ক্রমাগত ঘুরপাক খেয়ে মরছি। তখন পরিস্থিতি বুঝে আরও দশ-পনের হাজার খরচ করতে আমি রাজি হতে পারি। যদি আমাদের মনে হয়, আততায়ী দুজনকে আমরা ফাঁসিকাঠ থেকে ঝোলাতে পারব।

বাসু বললেন, দুটো কথা বলব, ব্রজদুলালবাবু। ফাঁসিকাঠ থেকে ঝোলানোর দায়িত্ব আইনজীবীর নয়। সে অপরাধীকে চিহ্নিত করতে পারে, আসামীর অপরাধ প্রমাণ করে দিতে পারে, গিল্টি ভার্ডিক্ট-এর বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিতে পারি না। ফাঁসি দেবার মালিক মহামান্য আদালত। দ্বিতীয় কথা, আপনি আততায়ী ‘দুজন’ বলছেন। ঐ ধারণাটা একেবারে ভুলে যান। দু-দুটো সম্ভাবনা। এক: বিল শবরিয়া হার্ট-ফেল করে মারা গেছেন—সেক্ষেত্রে আততায়ী একজন, যে ঘোষালকে খুন করেছে। সম্ভাবনা নম্বর দুই : বিল শবরিয়াকে কেউ হত্যা করেছে। সেক্ষেত্রেও আততায়ী কিন্তু মাত্র একজন, যে জোড়া খুন করেছে। তাই নয়?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, তাই বটে। তা…ইয়ে…রিটেইনার কত দেব?

—আপাতত আমাকে হাজার, সুকৌশলীকে পাঁচশ। এক সপ্তাহ পরে আমরা রিপোর্ট দেব।

—এগ্রিড!

ব্রজদুলাল দুখানি চেক কেটে বাসুসাহেবের হাতে দিলেন। বাসু বেল বাজিয়ে চেক দুটি যথাস্থানে প্রেরণের ব্যবস্থা করলেন বিশের মারফৎ। বললেন, রসিদ দুটো নিয়ে আসিস। এখনি।

বাসু বললেন, প্রথমত তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া নেওয়া যাক যে, বিল শবরিয়াকে কেউ বিষপ্রয়োগে হত্যা করেনি। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে : ডক্টর ঘোষালকে কে মারতে চাইবে? এবং কোন লাভের আশায় মারতে চাইবে? কারণ এটা প্রমাণিত যে, ঘোষাল বিষপ্রয়োগে নিহত

—ধরুন কাল্লু। অথবা যে রাজনৈতিক দল কাল্লুকে পোষা গুণ্ডা হিসাবে রেখেছে সেই রাজনৈতিক দলের মস্তানরা।

বাসু বললেন, যুক্তিটা দাঁড়ায় না। যতদূর জানা যায়, কাল্লু বছরখানেক আগে বহরমপুর জেল হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায়। তখন সে ছিল মৃত্যুশয্যায়। টিউবারকুলেসিস্। সে দু- পায় খাড়া হয়ে উঠে প্রতিশোধ নিতে আসবে এটা ছেলেভুলনো গল্প। আর রাজনৈতিক দল? তাদের স্বার্থ কী? রাজনৈতিক দাদারা কাল্লুর মতো গুণ্ডাকে ততক্ষণই পাত্তা দেয় যতক্ষণ সে দু-পায়ে খাড়া! নির্জীব হয়ে শুয়ে পড়লে স্টাম্পে পরিণত সিগ্রেটের মতো অ্যাশট্রেতে গুঁজে দেয়।

—তাহলে কে?

—প্রশ্ন সেটাই। ওঁর মৃত্যুতে কে লাভবান হলো?

—হাসপাতালের ট্রাস্ট বডি। কিন্তু সে কারণে কেউ অমন একজন দেবতুল্য মানুষকে খুন করে না।

—ঠিক কথা। আপনি বলেছেন, ঘোষালকে বছর সাত-আট ধরে চেনেন। ওর ‘আরোগ্যনিকেতন’-এ আপনি ডোনেট করেন? বার্ষিক দান?

—হ্যাঁ, করি। প্রথম-প্রথম বছরে দু-হাজার করে দিতাম। লাস্ট ইয়ার থেকে পাঁচ হাজার করে দিচ্ছি।

—কেন? বাড়িয়ে দিলেন কেন?

—তিনটি কারণে। এক: বঙ্কুত্ব ও ভালোবাসা গাঢ়তর হওয়ায়। দুই: ওদের প্রতিষ্ঠানের কাজ দেখে মুগ্ধ হয়ে। তিন: আমার নিজের উপার্জন বৃদ্ধি পাওয়ায়। নিশ্চয় জানেন : ঘোষালের হাসপাতালে দান করলে ইনকামট্যাক্সে এইট্টি-এইট জি সেকশন থেকে ছাড় পাওয়া যায়।

—আই সি! ইন্দ্ৰও কি কিছু দিত?

—হ্যাঁ, দিত। ওর সঙ্গে ঘোষালের গভীর বঙ্কুত্ব তো বহুদিনের। ও প্রথম যুগ থেকেই বঙ্কুকে সাহায্য করত। বৎসরান্তে ফেব্রুয়ারি মাসে—রোজগার বুঝে নিয়ে, মানে ইনকামট্যাক্স ফর্ম তৈরি করার সময় একটা করে চেক পাঠাতো।

—কত টাকার?

—ঠিক জানি না। মনে হয় এক-এক বছর এক-এক রকম অ্যাকাউন্টের চেক। কারণ ওর উপার্জন তো খুব এদিক-ওদিক করে। যাত্রায় গেলে একরকম, না গেলে আর একরকম। সিনেমায় পার্ট পেলেও বেশি রোজগার। না পেলে বাৎসরিক উপার্জনটা কমে যায়।

এই সময় অশোক চ্যাটার্জি কাজ সেরে ফিরে এল। ব্রজদুলালকে বললো, আপনাদের কথাবার্তা শেষ হয়েছে? নাকি আমি আবার একটু ঘুরে আসব?

বাসু বললেন, না, আমার যেটুকু জানার ছিল জেনে নিয়েছি।

অশোক আর ব্রজদুলাল ফিরে গেলেন।

.

বাসু ঘড়িতে দেখলেন সাড়ে নয়টা বাজে। ফোন করলেন ও-পাশের উইং-এ। সুকৌশলীতে। ধরল কৌশিক। বাসু জানতে চাইলেন, ব্যস্ত?

—আজ্ঞে না। এই রি-ইনফোর্সড কংক্রিট ঢালাই ছাদের বাড়িতে কি মানুষ ব্যস্ত থাকার অবকাশ পায়? আপনাদের আমলে কেমন সুন্দর কড়ি-বরগার ছাদ ছিল—মানুষ সময় কাটানোর সুযোগ পেত।

—জাঠামো না করে গাড়িটা বার কর। এট্টু বেরুব।

—কদ্দুর?

—দুপুরে বাইরেই খাব। চিনসুরা অ্যান্ড ব্যাক্।

—সুজাতাকেও নিয়ে নেব?

—নিলে ভালোই হতো; কিন্তু তোমাদের মামী…

—আই নো, আই নো। সুজাতা বরং থাক। আমরা দুজনেই ঘুরে আসি।

প্রথমেই বাসুসাহেবের নির্দেশে গাড়ি চালিয়ে কৌশিক তাঁকে নিয়ে এল ওয়েলিংটন স্কোয়ারের কাছে—নির্মলচন্দ্র স্ট্রিটে। এখানে গালুডি টুরিস্ট কমপ্লেক্সে অবস্থিত ‘সুবর্ণরেখা’ হোটেলের রিজার্ভেশন করা যায়। গাড়িটা ফ্রি-পার্কিং জোনে পার্ক করে দুজনে গুটি গুটি উঠে এলেন অফিসে। একতলাতেই অফিসঘর। ছোট্ট অফিস। একজন কর্মচারী বসেছিল কাউন্টারে। বাসু জানতে চাইলেন : হ্যাঁগো, গিরিডির ‘সুবর্ণরেখা’ হোটেলের রিজার্ভেশন এখানে করা হয়?

ছেলেটি বৃদ্ধের মূর্খামিতে মুখ লুকিয়ে হাসল। তারপর কৌশিকের দিকে নজর পড়ায় সামলে নিয়ে বললো, গিরিডি নয় দাদু, গালুডি। ঘাটশিলার কাছাকাছি।

বাসু বললেন, তবে বাপু, আমরা ভুল জায়গায় এসেছি। চল হে কৌশিক। ছেলেটি আবার বলে, কিন্তু আপনি ‘সুবর্ণরেখা হোটেল’ বললেন না?

বাসু চলতে শুরু করেছিলেন। ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ‘সুবর্ণরেখা হোটেল’। গিরিডিতে। কাছেই ফুলডুংড়ি পাহাড়! ওখান থেকে টাটায় যাবার বাসও পাওয়া যায়—শুনেছি খুব ভালো হোটেল—

—তাহলে তো আপনি ঠিক জায়গাতেই এসেছেন, দাদু। এখান থেকেই ‘সুবর্ণরেখা হোটেল’-এ রিজার্ভেশন পাওয়া যাবে।

—সেটা গিরিডিতে নয়?

—আজ্ঞে না। গালুডিতে।

বৃদ্ধ বললেন, কী জানি, বাপু। তুমি সব গুলিয়ে দিলে। যাব গিরিডির সুবর্ণরেখায়, তুমি বলছ গালুডি।

ছেলেটি বৃদ্ধকে ছেড়ে এবার কৌশিককে পাকড়াও করলো। খানকতক ছাপানো লিটেরেচার ধরিয়ে দিল। কৌশিক তার উপর চোখ বুলিয়ে বললে, মামু। ও ঠিকই বলছে। গিরিডি নয়, গালুডি। ‘সুবর্ণরেখা হোটেল’ গালুডিতেই। বুঝলেন?

—এটাই সেই জায়গা যেখানে ইন্দ্ৰ গেছিল?—বৃদ্ধ জানতে চান, তাঁর ভাগ্নের কাছে।

ভাগ্নে বলে, তাই তো মনে হচ্ছে। ইন্দ্রদা ফুলডুংরির কথা বলেছিল, বিভূতিভূষণের বাড়ির কথা বলেছিল, বুরুডি-লেক-এর কথাও গল্প করেছিল। এই দেখুন, এদের বইতে সবকয়টা নাম ছাপা আছে।

ছেলেটি কৌশিককে বললে, মাপ করবেন স্যার, ‘ইন্দ্রদা’ বলতে কি আপনি ফিল্‌ম্-আর্টিস্ট ‘ইন্দ্রকুমার’-এর কথা বলছেন?

কৌশিক জবাবে বলে, হ্যাঁ, তুমি চেন তাঁকে?

—কী যে বলেন, স্যার! ইন্দ্রকুমারকে কে না চেনে? এই তো উনি ‘সুবর্ণরেখায়’ সাতদিন কাটিয়ে এলেন।

বাসু বললেন, হ্যাঁ, তার কাছে শুনেই তো এসেছি। তাহলে ঠিক জায়গাতেই পৌঁছেছি মনে হচ্ছে। তা তুমি খাতা দেখে বলতে পার, ইন্দ্র কত তারিখ থেকে কত তারিখ ‘সুবর্ণরেখা’য় ছিল?

ছেলেটি হাসল। বললো, যাচাই করে নিতে চান? ঠিক আছে। বসুন। আমি রেজিস্ট্রার দেখে বলছি।

ওঁদের অপেক্ষা করতে বলে ছেলেটি রেজিস্ট্রি খাতা খুলে দেখে নিয়ে বললো, ইন্দ্ৰকুমার সুবর্ণরেখায় ছিলেন টোয়েন্টিথার্ড অক্টোবর থেকে টোয়োন্টিনাইন্থ অক্টোবর, রবিবার পর্যন্ত। উনত্রিশ তারিখ সন্ধ্যায় চেক-আউট করে বেরিয়ে আসেন। বিশ্বাস না হয় তো ওঁকে টেলিফোন করে দেখতে পারেন।

বাসু বললেন, না, না। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন উঠছে না। তাছাড়া ইন্দ্র এখন কলকাতার বাইরে। তুমি বলছ এই যথেষ্ট। তা কালপরশুর মধ্যে একটা ড বেড ঘর পাওয়া যাবে?

—কোন ফ্লোরে?

–ইন্দ্র কোন ফ্লোরে ছিল?

—তা তো এখান থেকে বলা যাবে না, দাদু।

—ঠিক আছে। তুমি দোতলায় বা তিনতলায় একটা ঘর বুক করে দাও। সম্ভব হলে কাল থেকেই।

–কোন ট্রেনে যাবেন?

—ইস্পাতে।

ছেলেটি খাতাখানা বাড়িয়ে ধরে বললে, কার নামে ঘর বুক করা হবে?

—মিস্টার অ্যান্ড মিসেস্ কৌশিক মিত্র.

কৌশিক তার মামুর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, আপনি যাবেন না?

—পাগল! তোমরা দুজনে ঘুরে এস প্রথমে। যদি মনে কর আমার ভালো লাগবে তাহলে নাহয় আমিও পরে যাব।

অফিস থেকে বেরিয়ে এসে কৌশিক জানতে চাইল, এটা কী হলো, মামু? অহেতুক আমরা দুজন গালুডি যাব কেন?

—ইন্দ্রকুমারের অ্যালেবাঈটা চেক করতে!

—ইন্দ্রদা? সেই তো সবচেয়ে শক্ড!

—আই নো। সে দারুণ অভিনেতাও বটে!

—কিন্তু ছেলেটি তো বললো, ইন্দ্রকুমার রবিবার টোয়েন্টিনাইন্থ সন্ধ্যাবেলায় চেক-আউট করেছে। ঘটনা ঘটেছে শনিবার, সন্ধ্যায়।

—সত্যি তাই করেছে কি না, তা তুমিও জান না, আমিও জানি না। ও ছোকরাও জানে না। এটুকু এস্ট্যাবলিড্ হলো যে রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সে হোটেল চার্জ দিয়েছে।

—গালুডির ‘সুবর্ণরেখা হোটেল’-এ পৌঁছে আমরা কী করব?

—ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং! ইন্দ্রকুমার যদি ছদ্মবেশ ধারণ না করে থাকে তাহলে অনেকেই তাকে চিনবে। আই মিন, হোটেলের অফিস স্টাফ। তোমাদের প্রধান কাজ হবে পরীক্ষা করে দেখা—তেইশ থেকে উনত্রিশ—এই সাতদিনের মধ্যে সে গালুডির ঐ সুবর্ণরেখা হোটেল ছেড়ে কলকাতায় এসেছিল কিনা। ম্যানেজমেন্ট কী বলে, স্টাফ কী বলে, বেল-বয় কী বলে, ওয়াশারম্যান কী বলে! বোর্ডাররা নিশ্চয় বদলে গেছে।

—কিন্তু মামু, ইন্দ্রবাবুকে সন্দেহ করার বিশেষ কোনও কারণ আছে কি? ঘোষাল ডাক্তারের মৃত্যুতে তিনি তো কোনোভাবেই লাভবান হবেন না।

—আই নো, আই নো! কিন্তু ‘নেতি-নেতি’ করে তো অগ্রসর হতে হবে আমাকে। ঘোষালের মৃত্যুতে সবচেয়ে বড় আঘাত পেয়েছে ইন্দ্রকুমার—এটা আমরা সবাই দেখেছি। কিন্তু আমরা এখন নৈর্ব্যক্তিক উদাসীনতায় একটা সমাধান করতে বসেছি। অঙ্কের হিসেব। লজিকের অঙ্ক। সেখানে সেন্টিমেন্টের ঠাঁই নেই। ব্রজদুলাল যে হাজারিবাগে ছিল ঐ ঘটনার দিন—শনিবার আটাশে—তা ইতিমধ্যে যাচাই করে নিয়েছি। আমি ম্যাথমেটিকালি অগ্রসর হতে চাই কৌশিক। নৈর্ব্যক্তিকভাবে। ব্রজদুলাল ইজ নেগেটিভ। আমি চাই একইভাবে ইন্দ্রকুমারকে সন্দেহ তালিকার বাইরে রাখতে। মানে, একেবারে যুক্তিনির্ভর অঙ্কশাস্ত্র মতে তোমরা দুজন আটচল্লিশ ঘণ্টা ‘সুবর্ণরেখা’ হোটেলে স্বামীস্ত্রীতে কাটিয়ে এস। ফিরে এসে প্রমাণ দিও যে, ইন্দ্ৰকুমারের অ্যালেবাঈটা পাক্কা। ঘটনার দিন সে চিনসুরার অনেক দূরে ছিল—ঘাটশিলায়। আমি ব্রজদুলালের পর ইন্দ্রকুমারকে বাতিল করে ডাক্তার অমরেশ দাশ, অ্যাগি ডুরান্ট, বা অন্য সবাইকে যাচাই করতে শুরু করব।

কৌশিক বললো, বুঝলাম। ঠিক আছে। আপনি যা বলছেন তাই আমরা করব, দুজনে মিলে। কিন্তু তার আগেই বলে রাখছি—আপনি লিখে রাখতে পারেন—ইন্দ্রকুমার এ ষড়যন্ত্রের ত্রিসীমানায় নেই। কারণ তার কোনও মোটিভ আমরা কল্পনা করতে পারছি না। তাঁর কারণ—এ মৃত্যুতে সেই সবচেয়ে বেশি আহত। তার কারণ : এ দুনিয়ায় ডক্টর ঘোষালের দীর্ঘদিনের বাল্যবঙ্কু বলতে ঐ একজনই আছেন।

বাসু বললেন, ঠিক কথাই। আই এগ্রি। হান্ড্রেড পার্সেন্ট। তবে কী জান কৌশিক, একে বলে রুটিন চেক। ট্রেনের এয়ার-কন্ডিশন্ড কম্পার্টমেন্টে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে চিনতে পারলে টিকিট-চেকার যেমন নমস্কার করে বলে, ভালো আছেন, স্যার? আপনার টিকিটটা?—ইটস্ জাস্ট আ রুটিন চেক! এ পার্ট অব্ দি সিস্টেম। ডি. এম.-ও অফেন্স নেন না। টিকিটটা বাড়িয়ে ধরেন। টি. টি.সি. সেটা পাঞ্চ করে দেয়। সশ্রদ্ধ নমস্কার করে পরবর্তী প্যাসেঞ্জারের দিকে এগিয়ে যায়। আমি তেমনি চাইছি ইন্দ্রকুমারকে একটি নমস্কার করে পরবর্তী প্যাসেঞ্জারের অ্যালেবাঈটা চেক করতে।

.

চিনসুরাতে কোনো লাভ হলো না। সমাধানের দিকে এক চুলও অগ্রসর হওয়া গেল না। চুঁচুড়া যাবার পথের কোনও পরিবর্তন হয়নি—সেই লরি-অ্যাম্বাসাডার-গোগাড়ির ভিড়ে রাস্তা জ্যাম। শুধু দু-চাকার সওয়ার এ-ফাঁক ও-ফাঁক দিয়ে ক্রমাগত এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তাতে জটিল জ্যাম জটিলতর হচ্ছে। সেই ডেলি-প্যাসেঞ্জারদের মরণপণ ট্রেন ধরা, সেই ওভারব্রিজে ওঠার পরিশ্রম এড়িয়ে ভীরু পদাতিকের এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে রেললাইন পার হওয়ার চেষ্টা। আগেকার জমানায় ডেলি-পাষণ্ডদের দৌড়ঝাঁপ শেষ হুলে চুঁচুড়া শহরটা দুপুরে একটু ঝিমোতো—ঘুঘুর ডাকে, ফেরিওয়ালার হাঁকে, অথবা তৈলভূষিত গোযানের চাকার আর্তনাদে। সে জমানা অতিক্রান্ত। গো-গাড়ি শহরে ঢুকতে ভয় পায়। সারা দিন রাস্তায় শুধু মানুষ আর মানুষ। ঘুঘু হয়তো ডাকে; কিন্তু ঘুঘুনী তা আদৌ শুনতে পায় না—চোপর দিন এই মানুষজন্তুর হুহুঙ্কারে।

বাসুসাহেবকে নিয়ে কৌশিক তিন জায়গাতেই হানা দিল। ঘোষালসাহেবের আরোগ্যনিকেতনে, বাড়ি, আর যুগলকিশোরের ডেরায়। কাকস্য পরিবেদনা!

প্রথমেই ওঁরা এলেন মানসিক চিকিৎসালয়ে।

অ্যাগি ডুরান্ড সামলেছেন। কিন্তু এখনো বিষাদের প্রতিমা। ওঁদের আপ্যায়ন করে বসালেন। মেন্টাল হসপিট্যাল বাড়িটা দ্বিতল। অ্যাগি থাকেন তিনতলার একটি চিলেকোঠার ঘরে। একা মানুষ। ঐটুকু স্থানই যথেষ্ট। সঙ্গে অ্যাটাচড়-বাথ। ওঁর অফিসঘর নিচে। রান্না- বান্নার হাঙ্গামা নেই। পেশেন্টদের জন্য রান্না করতেই হয়। নার্সরাই ওঁর ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়।

অ্যাগি বললেন, আপনাদের দু-জনের জন্যও লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে দিই? কী খাবেন বলুন? ভাত, হাতে-গড়া রুটি, না লোফ?

বাসু বললেন, না। আমরা দুজন যুগলকিশোরের বাড়িতে মধ্যাহ্ন আহার করব। সেই মতো কথা দেওয়া আছে। অবশ্য পম্পার যদি না’ আজ কোনও অসুবিধা থাকে। প্রথমেই ওকে টেলিফোনে ধর তো।

অ্যাগি তাঁর ঘর থেকে যুগলকিশোরের বাড়িতে রিং করলেন। ধরল পম্পা। অ্যাগি রিসিভারটা বাড়িয়ে ধরলেন বাসু সাহেবের দিকে।

বাসু টেলিফোনের কথামুখে বললেন, পম্পামা, আমি মামু বলছি, মানে পি. কে. বাসু। তোমার বাড়িতে আমরা দুজন আজ মধ্যাহ্ন ভোজন করলে তোমার কি অসুবিধা হবে? আই মিন, আমার অল্টারনেটিভ নিমন্ত্রণ আছে। তোমাকে বিব্রত না করলে আমাকে অনাহারে থাকতে হবে না। তবে কালকেই তোমাকে কথা দিয়ে গিয়েছিলাম তো? তাই জানতে চাইছি।

পম্পা বললো, আজই হতে পারে। তবে খুবই সাদামাটা লাঞ্চ

—সেটাই আমার মন-পসন্দ। তোমার প্রাত্যহিক বাজার নিশ্চয় হয়ে গেছে। আজ কিসের আয়োজন? নিরামিষ, মাছ না মাংস?

—আজ আমাদের ইলিশ মাছ এসেছে।

—লা গ্র্যান্ডি! সর্ষেবাটা বানাতে পার? মাছ-পাতুরি?

—দুটো আলাদা বস্তু, মামু। কোনটা খাবেন বলুন? সর্ষেবাটা, না মাছ-পাতুরি?

–গুড গড। ও দুটো আলাদা নাকি?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। শুনুন! পাতুরি ভাপে রান্না হবে। প্রথমে তেল-সর্ষে দিয়ে…

—ঠিক আছে, ঠিক আছে। যা হয় কর। অ্যারাউন্ড দেড়টা। ঠিক আছে?

পম্পার সম্মতি নিয়ে টেলিফোনটা যথাস্থানে রেখে দিয়ে বললেন, ডাক্তার ঘোষালের বাড়িতেও নিশ্চয় ফোন আছে। তুমি নন্দু আর শৈলেশ মান্নাকে খবর দিয়ে দাও—আমরা দুজন সাড়ে বারোটা নাগাদ ঘোষালের বাড়িতে যাব। ওরা দুজন যেন বাড়িতে থাকে।

এরপর তিনি অ্যাগির কাছে ঘোষাল সম্বন্ধে পূর্ব ইতিহাস সংগ্রহ করতে বসলেন। কৌশিক মাঝে মাঝে—সাল, তারিখ ইত্যাদি নোট নিচ্ছিল। বাসু দু-চোখ বুজে পাইপ টানতে টানতে শুধু শুনেই গেলেন।

অ্যাগনেস এই মানসিক আরোগ্যালয়ে প্রথম যখন যোগদান করে তখনো তার বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি। সেটা সত্তর সাল। তার মাত্র একবছর আগে ডক্টর ঘোষাল একটা ছোট ভাড়া বাড়িতে মানসিক চিকিৎসালয়টা খুলেছেন। মাত্র তিনখানি ঘর। একটা ডাক্তারের চেম্বার, একটা ডাক্তারবাবুর শয়নকক্ষ। তৃতীয় একখানি ঘর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। ধীরে ধীরে তিল তিল করে এই আরোগ্যনিকেতনটি বর্ধিত হয়েছে। নতুন বাড়িতে উঠে এসেছে। শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি সাহায্য এসেছে। একটি বিদেশী সংস্থা একবার এককালীন মোটা দান দিয়েছিল। এখন ছেলেদের এবং মেয়েদের পৃথক ওয়ার্ড। আরোগ্যনিকেতেনের নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স আছে। নার্সদের জন্য পৃথক আবাসিক বন্দোবস্ত পর্যন্ত আছে।

বাসুসাহেব মাঝখানে কৌশিককে একবার থানায় পাঠিয়ে দিলেন। জেনে আসতে—কাল্লু অথবা পচাইয়ের বিষয়ে কোনও সংবাদ সদর থানা জেনেছে কিনা। বাস্তবে তিনি এই অছিলায় কৌশিককে সরিয়ে দিয়ে অ্যাগিকে কিছু অন্তরঙ্গ প্রশ্ন করতে চাইলেন। বললেন, তুমি বুদ্ধিমতী এবং সাইকিআট্রিস্ট! নিশ্চয় বুঝতে পারছ যে, এই রহস্যের কিনারা করতে হলে ডাক্তার ঘোষালের জীবনের সব কিছু ইতিহাসই আমার জানা থাকা দরকার। সে ছিল কনফার্মড্ ব্যাচিলার। তার যৌনজীবন বা মানসিক দুর্বলতার বিষয়ে তুমি কি আমাকে কিছু তথ্য সরবরাহ করে সাহায্য করতে পার?

অ্যাগনেস হাসল। ফাইলের কাগজপত্র নাড়াচাড়া করতে করতে নতনেত্রে বললো, যে প্রশ্নটা করতে আপনি সঙ্কোচবোধ করছেন, আমি তার সরাসরি জবাব দেব, মিস্টার বাসু!….ইয়েস, আমি তাকে ভালোবাসতাম। ইন ফ্যাক্ট… আমার ডিভোর্সের পর আমি প্রত্যাশা করেছিলাম যে, ও আমাকে প্রপোস করবে। …তা সে করিনি।

বাসুও মেদিনীনিবদ্ধ দৃষ্টিতে বললেন, থ্যাংকস্ অ্যাগি, ফর য়োর ক্যান্ডিড কন্তুফেশন! কিন্তু তার হেতুটা কী? আই মিন তোমার কী আন্দাজ? সে স্বভাবতই বিবাহিত জীবন এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল? নাকি, তার জীবনের একেবারে গোড়ার দিকে এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে যেজন্য সে বিবাহ করতে রাজি ছিল না? অথবা….

—না! তিনটের একটাও নয়!

—আমি তো তিনটি সম্ভাবনার কথা বলিনি?

—বলেছেন। তৃতীয়টার ইঙ্গিত দিয়ে থেমেছেন; কিন্তু বুঝতে আমার অসুবিধা হয়নি। আজ্ঞে না—এ-কথা সত্য নয় যে, ডাক্তার আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়নি, অথবা আমাকে ভালোবাসতে পারেনি, অথবা আমাকে বিয়ে করলে সে খুশি হতো না!

দেন হোয়াই? তাহলে তোমাদের বিবাহটা হয়নি কেন?

অ্যাগি তার ত্রিতলের ঘরের জানলার ভিতর দিয়ে সূর্যকরোজ্জ্বল আকাশের একটা চতুষ্কোণের দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখলো। ওখানে বহুদূর আকাশে একটা সূর্যসাক্ষী চিল ক্রমাগত পাক খাচ্ছে। ধীরে ধীরে ও বললে, ডাক্তার ‘অ্যাবনর্মাল সাইকলজি’র উপর গবেষণা করেছিল—ঐ বিষয়েই সে থিসিস্ দিয়ে ডক্টরেট করে। অথচ ঘোষাল নিজেই ছিল একজন অ্যাবনর্মাল সাইকলজিক্যাল পেশেন্ট।

–কী রকম? কী তার অ্যবনর্মালিটি?

–বলছি। কিন্তু তার আগেই কীভাবে এই অ্যাবনর্মালিটি ওর জীবনকে অধিকার করলো, সেই ঘটনাটা বলি। ডাক্তার নিজেই আমাকে বলেছিল। সমস্যাটা কী, তার মূল কোথায়, কীভাবে তাকে সমূলে উৎপাটিত করা সম্ভব তা ওর অজানা ছিল না; কিন্তু সব জেনে বুঝেও সে নিজেকে সারাতে পারেনি। সে অসুস্থতাটাকেই উপভোগ করে গেছে।

—ওর সেই অভিজ্ঞতাটা কী?

—শিবশঙ্কর ছিল মায়ের একমাত্র সন্তান। ছেলেবেলা থেকেই পড়াশুনায় চৌকস। বাপ- মায়ের নয়নের মণি। ওর জন্ম কিন্তু ওর বাবামায়ের বিবাহিত জীবনের শেষাশেষি। ও যখন জন্মায় তখন ওর মায়ের বয়স পঁয়তাল্লিশ। খুব সুন্দরী, আর খুব ফর্সা ছিলেন তিনি। বাবার বয়স তখন বাহান্ন। ওর জন্মের পর ওর মা দীর্ঘদিন সূতিকার জ্বরে ভুগেছিলেন। বছর তিনেক শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন। ঐ সময় মিস্টার ঘোষাল—শিবশঙ্করের বাবা, একটি দুগ্ধবতী অল্পবয়সী ধাত্রীকে নিয়োগ করতে বাধ্য হন। মেয়েটির শিশুসন্তান মারা গেছে। তার বুকে প্রচুর দুধ। অন্যদিকে ওর মায়ের বুকে দুধ ছিল না। এই দুগ্ধবতী অল্পবয়সী ধাত্রীকে নিয়ে আসা হয় ঐ নার্সিংহোম থেকে। যেখানে শিবশঙ্করের জন্ম হয়েছিল। মেয়েটি কালো, কুদর্শনা, স্বামীত্যক্তা, কিন্তু যৌবনবতী!…শিবশঙ্কর এসব প্রত্যক্ষজ্ঞানে জানতো না—জানার কথাও নয়। জেনেছে বড় হয়ে তার পিসির কাছে। ওর চার বছর বয়স হবার সময় ওর মা আত্মহত্যা করেন। হেতুটা সহজেই অনুমেয়।…ছেলেবেলায় ও বিমাতাকেই মা বলে জানত। তারপর বছর তিনেক বয়সে সে বুঝতে পারে ঐ অত্যন্ত ফর্সা, অত্যন্ত সুন্দরী এবং অত্যন্ত রুগ্না মহিলাটি ওর আসল মা! এরপর ওর মাতৃবিয়োগের পর যখন ওর বাবা সেই ধাত্রীটিকেই বিবাহ করলেন তখন ওর পিসিমা ওকে তাঁর নিজের সংসারে নিয়ে যান। ওর বাবার বয়স তখন সাতান্ন, বিমাতার ত্রিশ, আর ওর নিজের বয়স পাঁচ। ও পিসির কাছেই মানুষ। বাবার বিরুদ্ধে তার একটা হিমালয়ান্তিক অভিমান ছিল।

বাসু জানতে চান, এই ঘটনা ডাক্তার ঘোষালের জীবনে কীভাবে প্রভাব বিস্তার করে?

—ওর একটা অবসেশন হয়েছিল—দৃঢ়মূল প্রত্যয় গড়ে উঠেছিল যে, নরনারীর প্রেম তথা যৌনজীবন একমুখী না হলেই ঘৃণার্হ!

—য়ু মিন, যেহেতু তুমি ডিভোর্সি…

–ও নো, নো, নো! আমার দিক থেকে নয়। ঘোষাল বিংশ শতাব্দীর শিক্ষিত মানুষ। ডিভোর্সি স্ত্রীলোক নতুন কোনও পুরুষকে তো বিবাহ করতেই পারে। বাধাটা ছিল, তার নিজের দিক থেকে…

–আই ডোন্ট ফলো! ওর দিক থেকে মানে?

—আমাদের হাসপাতালে কুন্তী দোসাদ নামে একটি পেশেন্ট আছে, আপনি তার কথা জানেন। ঘোষাল পুরী থেকে ফিরে এসে আমাকে গল্প করেছিল যে, কুন্তীর কেসটা আপনাদের সে সবিস্তারে বর্ণনা করেছে, তাই নয়?

বাসু স্বীকার করলেন।

অ্যাগি বলেন, আপনার নিশ্চয় মনে আছে যে, কুন্তী মাঝে মাঝে ভায়োলেন্ট হয়ে উঠতো—জাস্ট ফর ‘সেক্‌স্যুয়াল আর্জেস্’ অ্যান্ড…

—হ্যাঁ, মনে আছে। তোমাদের হাসপাতালের একজন ওয়ার্ডবয়—কী যেন নাম? হ্যাঁ, শম্ভু বসাক—কুন্তী দোসাদের উন্মাদনাকে প্রশমিত করার দায়িত্ব নেয়। তুমি আর ডক্টর ঘোষাল ওর রুদ্ধদ্বার কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে…

—ও হেল! আপনি আমাদের দুজনের সে যন্ত্রণাটা কল্পনা করতে পারবেন না, মিস্টার বাসু। আমরা দুজন—মধ্যবয়সী পুরুষ ও রমণী—একজন ব্যাচিলার, একজন ডিভোর্সি—প্রায়ান্ধকার করিডোরে পাহারা দিচ্ছি! যাতে ঘরের ভিতর…ঐ স্কাউড্রেল শম্ভুটা… ওকটা উন্মাদিনীকে প্রশমিত করতে পারে।

—আই আন্ডারস্ট্যান্ড! তারপর?

—দু-মাস এভাবে কুম্ভীকে শান্ত করানো হলো। তারপর আমি বলতে বাধ্য হলাম—এ-কাজটা ঠিক হচ্ছে না, ডক্টর। শম্ভু একটা অশিক্ষিত লোফার! সে হয়তো পাঁচজনকে গল্প করে বেড়াবে। তাতে আমাদের এস্ট্যাবলিশমেন্টের বদনাম হয়ে যাবে! তুমি আর আমি এই ব্যভিচারটাকে মর‍্যালি, ফিজিক্যালি সাপোর্ট করছি…

আবার বাধা দিয়ে বাসুসাহেব বলেন, হ্যাঁ, সেসব কথা ঘোষাল আমাদের বলেছিল। আমাকে এবং আমার স্ত্রীকে। তারপরেই তো কাল্লু মিঞার আবির্ভাব। ডাক্তার বাধ্য হয়ে পুলিসে ধরিয়ে দিল কাল্লুকে।

—শুধু কাল্লু নয়, শম্ভুকেও পুলিসে চালান দিল। সেও ছিল কাল্লুর মস্তান পার্টিতে।

—তারপর?

—তারপরই দেখা দিল ঘোষালের জীবনের আসল সমস্যাটা। কাল্লু অ্যারেস্ট হবার মাসখানেক পরে। কুন্তীর পিরিয়ডিক্যাল সাইক্ল্ পার হবার পর, জৈবিক নিয়মে যখন তার উন্মাদনা বৃদ্ধি পেল। উই ওয়্যার হেলেস। অ্যাট লিস্ট, আই ওয়াজ।

—বুঝলাম! তখন শম্ভুর ভুমিকার অবতীর্ণ হতে হলো ঘোষালকে।

—ইয়েস! বাধ্য হয়েই। উপায়ান্তরবিহীন হয়েই। ঐ ওষুধটা চাই পাগলী মেয়েটির। কিন্তু নতুন কোনও পুরুষকে আমরা সাহস করে দায়িত্বটা দিতে পারিনি। আমি এ ব্যাপারটাকে খুব সাধারণভাবে—একটা মেডিকেল কম্প্রোমাইজ হিসাবে, বায়োলজিক্যাল সল্যুশন হিসাবে নিতে পেরেছিলাম। ঘোষাল পারেনি। একটা প্রচণ্ড অবসাদবোধে, অপরাধবোধে, সে নিজেকে জর্জরিত করতে থাকে।

—কী আশ্চর্য! ঘোষাল যদি এটাকে খোলামনে নিতে না পেরে থাকে তাহলে শম্ভু বসাক ছাড়া কি সারা দুনিয়ায় রিলায়ে লোক পাওয়া গেল না?

—আপনি সমস্যাটা ঠিক বুঝতে পারছেন না, মিস্টার বাসু। ঘোষালের ব্যক্তিসত্তা ঐ সময় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। ‘স্প্লিট পার্সোনালিটি’। ওর মনের একটা অংশ এটাকে পরিহার করতে চাইছে, ঘৃণার্হ মনে করছে, ন্যক্কারজনক ভাবছে—অথচ মনের আর একটা অংশ এতে আনন্দ পাচ্ছে! একটি উন্মাদিনী—প্রেমোন্মাদ নারীকে শান্ত করতে সক্ষম হওয়ায় পুরুষোচিত অহঙ্কারে তৃপ্ত হচ্ছে। সচেতন শিক্ষিত মনে নয়—আদিম স্যাভেজ সংস্কারবশে। নিজের পিতার বিরুদ্ধে ওর যে আশৈশব বৈরিতা ছিল তার যেন তির্যক বৈরী নির্যাতনের সান্ত্বনা পাচ্ছে। আদিম আরণ্যক মানুষ যেমন যৌবরাজ্যে উপনীত হবার পর পিতৃহন্তা হয়ে তৃপ্তি পেত। আবার এদিকে অদেখা-অচেনা মায়ের প্রতি আর অবচেতন মনে যে মমতা, যে ভালোবাসা, যে সহানুভূতি সঞ্চিত হয়েছিল সেটা সে আমার উপর আরোপ করতে চেয়েছিল। আমি তার কাছে মাতৃরূপা হয়ে উঠলাম ক্রমে। হয়তো আমার গায়ের রঙটা ওকে সেই অবসেশন এনে দেয়, জানি না। আমি বুঝতে পারছি না আপনাকে ঠিক বোঝাতে পারছি কি না। ও আমাকে যথেষ্ট ভালোবাসতো! ওর বাবাই কি বাসতেন না তাঁর সুন্দরী স্ত্রীকে? আবার ওর বাবা যেমন সেই কালো-কুরূপা-যৌবনবতী ধাত্রীটিকে ফিরিয়ে দিতে পারেননি- তার বুকের দুধ শিশুর আর প্রয়োজন ছিল না; ঠিক তেমনি…ও হেল্!

বাসু ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমি বুঝছি, অ্যাগি। তোমার এমনিতেই এখন মনটা খারাপ—দীর্ঘদিনের কম্পানিয়ন, বঙ্কু, তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে…

—ইয়েস স্যার! মাই ‘উইনসাম ম্যারো’ (‘Winsome Marrow’)। আর আমার মাথায় একটা জগদ্দল বোঝা চাপিয়ে দিয়ে গেছে। আজীবন একটা ক্যারিয়াটিড-এর (caryatid) মতো তা আমাকে বইতে হবে।

বাসু বললেন, এ প্রসঙ্গে আমরা এবং এখানেই থামি, অ্যাগি। আমার পূর্ণ সহানুভূতি আছে তোমার প্রতি, কিন্তু বেশ বুঝতে পারছি, ঘোষালের জীবনের এই গোপন অধ্যায়টার সঙ্গে আমার তদন্ত সম্পর্কবিমুক্ত। বাই-দ্য-ওয়ে—ঘোষালের যৌনজীবনের এই জটিলতার বিষয়ে তুমি ছাড়া এই আরোগ্যনিকেতনে আর কেউ কি কিছু জানত? ফর এক্‌জাম্পল্ ডক্টর দাশ?

–নো স্যার। আর কেউ কিছু জানত না। আন্দাজও করেনি। কুন্তী জানত, জানে—কিন্তু সে তো আমাদের হিসাবের বাইরে।

—ডাক্তার ঘোষালের মৃত্যুতে তার কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে?

—ইয়েস, মিস্টার বাসু! হয়েছে! বিস্ময়করভাবে হয়েছে। আমি সাইকলজি নিয়ে এম. এ. . করেছি—বিষয়টা ভালোভাবে জানি বলে এতদিন আমার একটা গর্ব ছিল। নিজের মুখেই বলছি—ডোন্ট থিংক আয়াম ব্র্যাগিং—বি. এ. অনার্স এবং এম. এ. দুবারই আমি ফার্স্ট-ক্লাস ফার্স্ট হই। কখনো কারও কাছে হারিনি। এই বুড়ি বয়সে হেরে গেলাম। ঐ একটা আনপড় গাঁয়ের মেয়ে, কুন্তী দোসাদের কাছে।

বাসু প্রশ্ন করলেন না। প্রশ্নবোধক দৃষ্টি মেলে শুধু তাকিয়ে রইলেন অ্যাগির মুখের দিকে। তাঁর পাইপে টোব্যাকো ফুরিয়েছে। আগুন নেই। ঠোঁট থেকে অহেতুক ঝুলছে পাইপটা। উনি নির্বাক শুধু তাকিয়েই রইলেন।

অ্যাগি বলে চলেন, আমি যখন কিশোরী তখন আমার বাবার একটা পোষা অ্যালসেশিয়ান ছিল। রোজ সকালে ড্যাডি তাকে নিয়ে বেড়াতে যেতেন। যদিও তাকে খেতে দিত বাড়ির চাকরটা, তবু বাবাকেই ‘মাস্টার’ বলে মানত। তারপর বাবার স্ট্রোক হলো। নার্সিংহোমে গেলেন। কুকুরটার প্রাতভ্রমণ দু-দিন বন্ধ রইলো; তৃতীয় দিনে—যে চাকরটা ওকে রোজ খাবার দিত তাকে মা বললেন স্যাগীকে বেড়িয়ে নিয়ে আসতে। কিন্তু স্যাগীই রাজি হোল না। এ পর্যন্ত বোঝা যায়। জীবমাত্রেই অভ্যাসের দাস। যার হাতে রোজ বিকালে মাংসভাত খাচ্ছে, তার সঙ্গে সে প্রাতভ্রমণে যেতে গররাজি! এটুকু বোধগম্য! কিন্তু পরের চ্যাপটারটার কোনও এক্সপ্ল্যানেশন নেই। তিন সপ্তাহ নার্সিংহোমে ভুগে বাবা মারা গেলেন। তাঁর ডেডবডি বাড়িতে আনা হলো। স্যাগী তাঁর মৃতদেহ দেখেনি। কফিনের ভিতর কী আছে তা তার জানার কথা নয়, কিন্তু কী অপরিসীম আশ্চর্য মিস্টার বাসু, পরদিন থেকে স্যাগী ঐ চাকরটার হাত থেকে খাবার খেতে রাজি হলো না। দু-দিন অনাহারে পড়ে থাকল। তখন আমাদের নিজেদের সংসারে যে অবস্থা চলছে—তাতে কুকুরকে খাদ্য নিয়ে পীড়াপীড়ি করার মতো মানসিকতা কারও ছিল না। আমার নয়, দিদির নয়, মায়ের নয়। চাকরটা নিজের বুদ্ধি খরচ করে বাবার এক বঙ্কু—পশুচিকিৎসক তিনি—তাঁকে ডেকে নিয়ে এল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। স্যাগী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ : অনশনে সে প্রাণ দেবে…

অ্যাগি থামলেন। বাসু পকেট থেকে পাউচ আর দেশলাই বার করলেন। জানতে চাইলেন: অ্যান্ড আল্টিমেটলি?

স্যাগী অনশন ভঙ্গ করলো। আমার মায়ের অনুরোধে। অথচ সে কিন্তু মায়ের খুব ‘পেট’ ছিল না। মা তাকে মাঝে মাঝে ডগ-বিস্কুট দিত, বা গলায় হাত বুলাতো। এই পর্যন্ত। অনশনের চতুর্থ দিনে সেই বিধবা ভদ্রমহিলাটি এসে যখন স্যাগীকে জড়িয়ে ধরলেন তখন অদ্ভুত একটা একটানা কাতর স্বরে স্যাগী তার মনোবেদনার কথা ব্যক্ত করলো। এই চার দিন সে ডাকেনি, খায়নি, ওর কেনেলের বাইরে আসেনি পর্যন্ত। অথচ মায়ের সহানুভূতিতে….

বাসু বললেন, কুন্তী দোসাদের ক্ষেত্রে ও ঘটনাটা একই রকম ঘটেছিল বলতে চাও?

—একজ্যাক্টলি! ওর বুঝতে পারার কথা নয় যে, ডাক্তার ঘোষাল মারা গেছেন। ও তাঁর মৃতদেহ দেখেনি। মৃতদেহ আরোগ্যনিকেতনে আনাই হয়নি। আমি বারণ করেছিলাম। ওসব ট্র্যাফিক-জ্যাম করা আড়ম্বর আমার ভালোই লাগেনি। আরোগ্যনিকেতনের কর্মীরা তো শ্মশানে যাবেই। আর এই পাগল-পাগলীগুলো তো এ বাড়ির জানলা-দরজা পিলার- পিলস্টারের মতো ফ্যালফ্যাল করে শুধু তাকিয়েই থাকবে। বাট…আ স্ট্রেঞ্জ থিং হ্যাপেন্ড! পরদিন থেকে কুন্তী দোসাদ তার খাবার খেতে অস্বীকার করলো। যে নার্সটি ওকে খাবার দেয়, যে প্লেট থেকে খাওয়ায়, যে সময়ে খাওয়ায়, কিছুই পরিবর্তন করা হয়নি…কিন্তু ও খেল না। রবি-সোম-মঙ্গল। তিন-তিনটি দিন! উড য়ু বিলিভ ব্যারিস্টার বাসু—আমাকে ওরা জানায়নি। ফোর্থ ডেতে—পরশুদিন আমি সব কথা শুনে ওকে দেখতে গেলাম। কুন্তী নির্জীব হয়ে গেছে! পাষাণ হয়ে গেছে। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে ফেললাম। ও কিন্তু কাঁদল না। ও কাঁদতে জানে না। বাট সে আমার অনুরোধে, আমার হাত থেকে চতুর্থ দিনে আহার্য গ্রহণ করলো। ওর যা ‘আই-কিউ’ তা ঐ অ্যলসেশিয়ান কুকুরটার চেয়ে বেশি না কম, তা আমি জানি না—আমার সঙ্গে ডাক্তার · ঘোষালের কী সম্পর্ক….ওয়েল। কিন্তু মনঃস্তত্ত্ববিজ্ঞানে যার ব্যাখ্যা নেই তাই বাস্তবে ঘটে গেল। ও বুঝে নিল, আমার দুঃখের পরিমাণটা—ঠিক যেমন স্যাগী বুঝতে পেরেছিল আমার মায়ের অপরিসীম ক্ষতির কথা। আরও অবাককরা কাণ্ড, ডাক্তার ঘোষাল দু-চার দিনের জন্য চিনসুরার বাইরে গেলে ও ছটফট করত, ওকে ট্র্যাঙ্কুলাইজার দিয়ে ঘুম পাড়াতে হতো। এবার হলো না। মৃত্যু কী—তা নিশ্চয় ও বুদ্ধি দিয়ে, বোধ দিয়ে, অনুভূতি দিয়ে বুঝতে পারে না—তবু মনোবিজ্ঞান যে তত্ত্ব জানে না, ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারে না, সেই না-পারার কোনও অজ্ঞাত রহস্যে ও শান্ত মনে ডাক্তার ঘোষালের অনুপস্থিতিটা মেনে নিল। এবার ইনজেকশন দিয়ে ওকে ঘুম পাড়াতে হয়নি। ও আচ্ছন্নের মতো শয্যায় শুয়ে আছে। কখনো জেগে কখনো নিদ্রিত!

এই সময় এসে উপস্থিত হলেন ডঃ দাশ। দরজায় নক করে ঘরে ঢুকে বসলেন। বললেন, এ কী কাণ্ড হয়ে গেল, স্যার?

বাসু বললেন, দিস্ ইজ লাইফ! উপায় কি?

—আমরা কী ভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?

বাসু বলেন, লুক হিয়ার ডক্‌টর দাশ! আমাদের কর্তব্য বিভিন্ন, আমাদের কর্মক্ষেত্র বিভিন্ন আমার কাজ: খুঁজে বার করা এই জঘন্য হত্যার পিছনে কী ষড়যন্ত্র ছিল। কে ঘোষালকে মেরেছে, কার প্ররোচনায় মেরেছে। আপনাদের ক্ষেত্র ভিন্নতর—আপনাদের কাজ : দেখা, ডক্টর ঘোষালের অবর্তমানে তাঁর গড়ে-তোলা মানবিকতার এই মহান প্রাসাদটা যেন ধূলায় না লুটিয়ে পড়ে। সারাটা জীবন দিয়ে সে একটা বৃহৎ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে—এ তল্লাটে একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যেখানে মানসিক ভারসাম্যহীনেরা মানুষের সহানুভূতি পায়। আপনাদের কাজ সেই প্রতিষ্ঠানটিকে বাঁচিয়ে রাখা, আরও শক্তিমান করে তোলা—ভবিষ্যতের দরদী মানুষের হাতে তুলে দেওয়া। অফ কোর্স, আমার প্রচেষ্টায় আপনারা সাহায্য করবেন, আপনাদের প্রচেষ্টাতে আমিও যথাসাধ্য সাহায্য করব। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য এবং কর্মক্ষেত্র বিভিন্ন।

ডক্টর দাশ বললেন, আই ফলো, স্যার!

—আপনি কি ডাক্তার ঘোষালের মৃত্যু সংক্রান্ত কোনও ঘটনা, কোনও ক্লু জানাতে পারেন—যা আমরা জানি না।

ডক্টর দাশ মাথাটা দুদিকে নেড়ে বললেন, আয়াম সরি। নো স্যার।

—ঐ হারাধন দাস লোকটার সম্বন্ধে আপনার কি ঘোষালের সঙ্গে কোনও কথা হয়েছিল?

—হ্যাঁ, হয়েছিল। কিন্তু তাতে আপনার সমস্যাটা সমাধানের দিকে এক পা-ও এগিয়ে যাবে না। লোকটাকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল—এ লোকটা কে? একে কেন চেনা-চেনা লাগছে? আমি শিবুদার কাছে জানতে চেয়েছিলাম। উনি বললেন, ‘কেন হে? ওকে তো আমাদের আরোগ্যনিকেতনে চাকরি দেওয়া হয়নি, যে, প্রশ্ন উঠবে কেন এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ থেকে লোক নেওয়া হলো না। ও হচ্ছে আমাদের পার্সোনাল স্টাফ—কম্বাইন্ড-হ্যান্ড!’ আমি আরও জানতে চেয়েছিলাম, ‘কেন? নন্দু কি ছুটি নিয়ে দেশে যেতে চাইছে?’ উনি আমাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেন। বলেন, ‘কাজের কথা বল ডক্টর দাশ। উই হ্যাভ এনাফ ওয়ার্ক টু ডু!

বাসু অ্যাগির দিকে ফিরে বললেন, তোমার অনেকটা সময় নষ্ট করেছি। ধন্যবাদ আমি জানাব না—কারণ উই আর অল ওয়ার্কিং ফর আওয়ার বিলাভেড ডিপার্টেড ফ্রেন্ড! আচ্ছা চলি। চল, ডাক্তার দাশ। আমরা তোমার অফিসে গিয়ে বসি।

.

অফিসে বসে বাসুসাহেব ট্রাস্টবডির আইনের বিষয় নানান প্রশ্নে জেনে নিলেন। ট্রাস্ট- ডীড়-এর একটি Xerox কপি পড়লেন। আসলটা ব্যাঙ্ক ভল্টে রাখা আছে। উনি গত বছরের আয়-ব্যয়ের ব্যালেন্স-শীটটাও দেখতে চাইলেন। অ্যাগি ডুরান্ট বোর্ড-এর সচিব, ডক্টর দাশ ট্রেজারার। দুজনের কারও আপত্তি হলো না। বাসু চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, আপনাদের ডোনার্স লেজারটা একটু দেখব।

অ্যাগি বললেন, একটা কথা ব্যারিস্টারসাহেব। ঘোষাল আপনার বঙ্কু ছিল। তাই খবর পেয়েই আপনি ছুটে এসেছিলেন। সেটা ছিল আপনার বঙ্কুকৃত্য। কিন্তু এখন আপনি যে খরচ করছেন—আপনার ক্যাশ ও সময়—তার দাম আমাদের, আই মিন এই ট্রাস্ট বোর্ডের, মিটিয়ে দেওয়া উচিত। এ বিষয়ে আপনি কী বলেন?

বাসু বললেন, ডক্টর ঘোষালের মৃত্যু-রহস্যের কিনারা করবার জন্য আমাকে ইতিমধ্যেই ব্রজদুলালবাবু এনগেজ করেছেন। আমি বেসিক্যালি ডিফেন্স ল-ইয়ার। খুনী পাকড়াও করা আমার কাজ নয়। সেটা গোয়েন্দাদের কাজ। ব্রজবাবু বাস্তবে ‘সুকৌশলী’ গোয়েন্দা সংস্থাকেই নিয়োগ করেছেন—আমি তাদের অ্যাডভাইসার মাত্র। সে যাই হোক, একই খুনের কেসে আমি তো দুজন ক্লায়েন্ট নিতে পারি না। ফলে ও প্রসঙ্গ থাক। আমাকে বরং তোমাদের ডোনার্স লেজারটা একটু দেখাও—কে কত টাকা, কোন বছরে দিয়েছেন।

ডক্টর দাশ বেল বাজিয়ে অ্যাকাউন্টেন্ট ভদ্রলোককে ডেকে পাঠালেন। তাঁকে ‘ডোনার্স লেজার টা নিয়ে আসতে বললেন।

ভদ্রলোক মধ্যবয়সী। টিপিক্যাল করণিক। জানতে চাইলেন, কোন বছরেরটা, স্যার?

জবাব দিলেন বাসু, আপনারা কি ওটা বছর-বছর বদলান? যাঁরা স্বেচ্ছায় দান করেন, বা প্রতিষ্ঠানগতভাবে অনুদান দেন? যাঁরা দান করেন, তাঁদের তো আপনারা I. T. Sec. 88G- মোতাবেক সার্টিফিকেটও দেন, তাই না?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, স্যার!

—তাহলে দানকারীদের নাম-ঠিকানা নিশ্চয় একটা খাতায় লেখা থাকে, তাকেই আমি ‘ডোনার্স লেজার’ বলছি। সেটা তো বছর বছর বদলাবার কথা নয়। এখানে বদলায় কি?

—আজ্ঞে না, স্যার। তবে আমাদের প্রতিষ্ঠান তো অনেক দিনের। প্রথমদিকের খাতাটা স্টোরে রাখা আছে। খুঁজে বার করতে অনেক সময় লাগবে। কারেন্ট-লেজারটা দশ-বারো বছরের পুরনো। 1984 থেকে 1996 পর্যন্ত। তাই জানতে চাইছি ‘কারেন্ট’ খাতাতেই কাজ হবে, না গুদামে পুরনো খাতা খুঁজতে লোক পাঠাব?

বাসুই জবাব দিলেন, না, না, পুরনো খাতার দরকার নেই। আপনি হাল-আমলের খাতাখানাই পাঠিয়ে দিন।

কেরানি ভদ্রলোক প্রস্থান করার পরে ডক্টর দাশ জানতে চাইলেন, ওটা দেখে কী লাভ হবে বাসুসাহেব?

বাসু বললেন, এ পর্যন্ত আমাদের হাতে যে পরিমাণ তথ্য এসেছে তাতে আশঙ্কা হচ্ছে ডক্টর ঘোষালের মৃত্যুর জন্য দায়ী একজন প্রফেশনাল কিলার : পঞ্চানন ঘড়াই। লোকটা ফেরার পুলিস তাকে খুঁজছে। হয়তো সুকৌশলীও তাকে খুঁজছে। কিন্তু একথা তো নিশ্চিত—কেউ একজন অর্থমূল্যে ঐ প্রফেশনাল কিলারকে নিয়োগ করেছিল! সে কিন্তু বাইরের লোক নয়, ঘরের লোক। ধরা পড়লে—যদি আদৌ ধরা পড়ে, তাহলে আমরা সবাই তাকে চিনতে পারব। এজন্য আমি জানতে চাই : ঘোষালের এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি কার কেমন সহানুভূতি ছিল। গত পাঁচ-দশ বছরের ভিতর কে কত টাকা দান করেছেন।

একটু পরেই করণিক ভদ্রলোক ফিরে এলেন।

বাসু পাতা উল্টে দেখলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, আমি অনেকগুলি পরিচিত নাম দেখতে পাচ্ছি—যাঁরা ডক্টর ঘোষালের মৃত্যুসময়ে উপস্থিত ছিলেন, অথবা তাঁর সম্প্রতিক পুরী ভ্রমণকালে যাঁরা তাঁর কাছে-পিঠে ছিলেন। গত আট-দশ বছরে এঁদের মধ্যে কে কত টাকা দিয়েছেন তার একটা তালিকা আমার চাই। ইয়ার ওয়াইজ। প্রোফর্মাটা এইরকম হবে। আমি প্রোফর্মা আর নামগুলো ছকে দিচ্ছি।

নাম… 1986..’87..’88..’89..’90..’91..’92..’93..’94..

নামগুলি পর্যায়ক্রমে: অ্যাগনেস্ ডুরান্ট, ডঃ অমরেশ দাশ, যুগলকিশোর সেনরায়, ব্রজদুলাল রায়, ইন্দ্রকুমার, মিসেস্ গুণবতী মোহান্তি, মিস্ সুভদ্রা মোহান্তি, মিসেস্ ছায়া পালিত—মোট আটজন।

ডক্টর দাশ বললেন, ঠিক আছে স্যার, এটা আমি তৈরি করে লোক দিয়ে যুগলকিশোরবাবুর বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছি। দুপুরের মধ্যেই।

এই সময়েই কৌশিক এসে জানালো যে, থানা এখনো পর্যন্ত কোনো খবর পায়নি—কাল্লু বা পচাই-সংক্রান্ত

বাসু নমস্কারান্তে বিদায় নিলেন হাসপাতাল থেকে। যাবার আগে জনান্তিকে মিস্ অ্যাগনেসকে বললেন, আজ নয়, এর পরের বার এসে তোমার স্যাগীর সঙ্গে দেখা করে যাব।

—স্যাগী?

—ইন সাবহিউমান ফর্ম : কুন্তী দোসাদ। আজ থাক।

.

নন্দু অথবা শৈলেশ মান্না হারাধনের বিষয়ে নতুন কোনও আলোকপাত করতে পারলো না। ওরা দুজন যা জানত তা আগেই পুলিশকে বলেছে—অথবা পুলিশের কাছে গোপন করে জনান্তিকে মিস্ অ্যাগনেস ডুরান্টকে। যেমন শৈলেশের সঙ্গে একবার হারুর ধাক্কা লেগে যায়, আর শৈলেশের ধারণা হয়, তার পকেটে একটা লোডেড রিভলভার থাকে। তখন সে প্রচণ্ড অবাক হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার ঘোষালকে সে জানায়, তিনি পাত্তা দেননি। অ্যাগিকেও জানায়—তিনি চেপে যেতে বলেছিলেন। তখনো শৈলেশ জানতো না যে, ডাক্তারসাহেব ঐ হারাধনকে অ্যাপয়েন্ট করেছেন দেহরক্ষী হিসাবে।

শৈলেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বললে, কিছু মনে করবেন না স্যার, হারুর কোনও দোষ আমি ধরি না–

—ধর না? বল কি! কেন গো? লোকটা দেবতুল্য ডাক্তারকে খুন করলো-

—আজ্ঞে হ্যাঁ, মানছি! কিন্তু পেটের দায়ে! যেমন পেটের দায়ে আমি শালা স্টিয়ারিং ঘোরাই, নন্দু ডাক্তরবাবুর জুতো সাফা করে, রুক্‌মিনি পরের এঁটো বাসন ধোয়! কী করব? শালা পেট যে মানে না! মাপ করবেন স্যার, রাগের মাথায় খিস্তি করে ফেলেছি। তা সে যাহোক, ঐ হারামজাদা হারুও তো তেমনি পেটের দায়ে মদের গ্লাসে বিষ মিশিয়েছিল। শালা কি নিজের ইচ্ছেয় মিশিয়েছে? বলুন, হক কতা কিনা। শালা যখন ধরা পড়বে, তখন দেখবেন ও হারামজাদার ঘরেও আছে মা-মরা চুন্নিমুন্নি—মাসির কোলে মানুষ হচ্ছে! যেমন হচ্ছে আমার মুনিয়া। দোষ কি ঐ হারামজাদা হারুর? দোষ তো সেই বাঞ্চোতের! যে ওকে টাকার টোপ দেখিয়ে এই কুকাজে লাগিয়েছে! অথচ ধরা পড়লে হারুশালার ঝোলা গোঁফ একটা- একটা করে টেনে উপড়ে ফেলবে গণেশ মামার সেপাইগুলো। আর সেই হাড়-হারামজাদ এমপ্লয়ার? যে ওকে দশ-বিশ হাজারের টোপ ঠেকিয়ে গেঁথে তুলেছিল? ধরতে পারলেও তার কী করবেন আপনারা? কিস্সুটি করতে পারবেন না, স্যার। তাকে তো আপনারা এম এল এ বানাবেন, মন্ত্রী মানাবেন? কী স্যার? ভুল বলছি?

শৈলেশ মান্নার দোষ নেই। সে বুঝেছে এ চাকরি তার খতম্। টেলিফোন আসার আগেই সাতসকালে পুরো একটি বোতল কালীমার্কা গিলে সে বুঁদ হয়ে বসেছিল এতক্ষণ।

বাসু বললেন, তা ঠিক। তুমি বিশ্রাম নাও গে যাও!

খ্যাক-খ্যাক করে হেসে ওঠে শৈলেশ—বিশ্রাম! কী বলছেন স্যার? ‘চাকরি-নট’-এর বিশ্রাম! চোপর দিনই তো এখন বিশ্রাম!

নন্দু রঙে ছিল না।

বাসু বলেন, তুমি তো সাত বছর ধরে এ বাড়িতে আছ নন্দু। এই সাত বছরের ভিতর ডাক্তারবাবুর কোনো আত্মীয়স্বজনকে কখনো আসতে দেখেছ? ভাই-ভাগ্নে-বোন-বোনাই?

নন্দু বললো, না, স্যার। একটা কালো-মতো মুশকো জোয়ান আগেকার দিনে আসত। বলত, সে নাকি ডাক্তারবাবুর ভাই হয়। তার মুখ দিয়ে সর্বক্ষণ ভক্ ভক্ করে মদের গন্ধ ডাক্তারসাব তারে পাত্তা দিতেন না। সে-ও ইদানীং আসেনি। অনেকদিন।

–কী রকম ভাই? খুড়তুতো, পিস্তুতো?

—আজ্ঞে না। সে তো বলতো ডাক্তারবাবুর সতাতো ভাই। সত্যি-মিথ্যা জানি না। কিন্তু এট্টা কতা জিগাই সাহেব? দুপুরে আপনে খাবেন কোই?

বাসু ওর পিঠে একটা থাপ্পড় মেরে বললেন, খুব খুশি হলাম নন্দু, তুমি এ-কথা জানতে চাওয়ায়। সে মানুষটা তো দুনিয়ার মায়া কাটালো, কিন্তু তুমি আজও তার আতিথেয়তার ধারা বজায় রেখে চলেছ। না, নন্দু, চিন্তা নেই। আজ আমার দুপুরে যুগলকিশোরবাবুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ আছে। এবার বরং বল, ঐ হারাধন লোকটা কি করে এখানে মাথা গলালো? সে যখন প্রথম আসে তখন তুমি বাড়ি ছিলে?

—আজ্ঞে না, হুজুর। বাজারে গেছিলাম। ফিরে এসে শুনলাম, হারুবাবু কাজে বহাল হইছেন। তা তাঁর কাজডা কী ছিল, তা তো আজও আমার মালুম হলনি। আপনমনে থাকতেন। সিগরেট ফুঁকতেন। ভালোমন্দ আহারে রুচি ছিল। ডাক্তারবাবুরে দুডো রসগোল্লা দিতি গেলি তিনি বলতেন—অ্যাড্ডা হারাধনেরে দিস! অরে আমার গুরুঠাউর!

—লোকটা কি লেখাপড়া জানত? খবরের কাগজ পড়ত? টেলিফোন করত? ডাক্তারবাবুর সঙ্গে গল্পটল্প করত?

—আজ্ঞে না। খগরের কাগজ তাঁরে ছুঁতি দেখিনি। টেলিফোনও নয়। তয়, বাড়ি ফাঁকা থাকলি’ দুজনে গুজগুজ-ফুসফুস্ করতেন। যান, নতুন বে-হওয়া বরবউ!

—বল কী নন্দু?

—আজ্ঞে হ্যাঁ ছার! হক্কথা! আমাদের দেখলি দু-জনে দু বাগে সরি যেতেন—যা একে অপররে চিনেনই না!

বাসু নন্দুকে বুঝিয়ে বলেন, আসল ব্যাপার কি জান, নন্দু? ঐ হারাধনকে ডাক্তারবাবু বহাল করেছিলেন দেহরক্ষী হিসাবে। দেহরক্ষী বোঝ তো? বডিগার্ড আর কি!

—হাঁ বুঝি! কিন্তু সেই বডিগার্ডই তো ডাকতারবাবুরে দংশন করলো : কালসাপ!

বাসু বলেন, দেখ নন্দু, আমার পরিচয় তুমি জানই। আমি এসেছি জানতে : কে ঐ কালসাপকে এ বাড়িতে ঢুকিয়েছিল। কেউ-না-কেউ ডাক্তারবাবুকে নিশ্চয় বলেছিল : ঐ হারাধন একজন বিশ্বস্ত বডিগার্ড! কারণ ডাক্তারবাবু তাকে চিনতেন না আগে। গত সাত বছর সে এ বাড়ি আসেনি—এলে তুমি তাকে চিনতে পারতে। তার উপর এখন শোনা যাচ্ছে, হারু একটা দাগী আসামী—খুন করে সে ফেরার ছিল। পুলিস এখনো তাকে খুঁজছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন তা নয়—আমি জানতে চাই: কে ঐ লোকটাকে ডাক্তারবাবুর কাছে সুপারিশ করে পাঠায়? আসলে সেই তো খুনী। হারু তো নগদ টাকা পেয়ে কুকাজ করে কেটে পড়েছে। তাই না? শৈলেশ মান্নাও তো তাই বললে। কী?

—তা তো বটেই।

—তা ঐ লোকটার সম্বন্ধে আর কিছু জান? ও কি নেশাভাঙ করত?

—আজ্ঞে তা জানি না। চোপর দিন দোর বন্ধ করি রাখত। তবে হ্যাঁ, মানুষডা জলে ডরাতো।

—জলকে ভয় পেত? কী করে বুঝলে?

—ছান করতি চাইতো না। কিন্তু এবার আমি এড্ডা কথা জিগাব কর্তা? ডাক্তারবাবু তো শুনিছি দারুণ বুদ্ধিমান আছিলেন। ইস্কুলে বরাবর কেলাসে ফাস্টো হতেন। এমন পণ্ডিত মানুষরে কোন হারামজাদা এমন বোকা বানাইল, কয়েন তো?

বাসু বললেন, হেইকতার জবাবটা আম্মো খুঁজে বেড়াচ্ছি নন্দু!

.

ভাত, নারকেল দিয়ে মুগডাল, বড়িভাজা, কুমড়োর পোড়েভাজা, আলুপোস্ত, ইলিশমাছের সর্ষেবাটা, আনারসের চাটনি আর দই।

রান্নার তারিফ করলেন বাসুসাহেব। প্রতিটি পদের। সবচেয়ে ভালো লেগেছে বললেন—ঐ ইলিশ মাছের পাতুরি।

পম্পা বললো, পাতুরি নয়, মামু। এটা সর্ষেবাটা। পাতুরি বানাতে হয় কলাপাতায় জড়িয়ে ভাপে সেদ্ধ করে—

বাসু বললেন, সে যাই হোক, খেতে যা হয়েছে : লা গ্র্যান্ডি!

যুগলকিশোর বাড়ি ছিল না। কোথায় বুঝি কোন মন্ত্রীর ভাষণ আছে। তাকে হাজিরা দিতে যেতে হয়েছে।

আহারান্তে বাসুসাহেব একটা ইজি-চেয়ারে লম্ববান হলেন। বললেন, তুমি এবার খেয়ে নাও পম্পা।

—ও আসুক। ও এখনি ফিরবে। একসঙ্গে খাব

কৌশিক জানতে চায় : বলুন পম্পাদেবী, এই ঘটনা নিয়ে যদি গোয়েন্দা গল্প লিখি তাহলে আপনার কী ছদ্মনাম দেব?

বাসু ধমকে ওঠেন, ওমা! ‘ছদ্মনাম’ দেবে কেন? ষাট-বালাই! এমন গ্র্যান্ড ইলিশ মাছের পাতুরি খাওয়ালো আর তুমি সে কৃতিত্বটা দিয়ে দেবে কোন খেঁদি-পেঁচী, আন্নাকালীকে?

পম্পা খিল্‌ খিল্‌ করে হেসে ওঠে। তারপর হাসির বেগ কমলে বলে, মামু! ওটা কিছু মাছ- পাতুরি নয়, সর্ষেবাটা।

বাসু বলেন, ঐ হলো। কিন্তু স্বাদ যা হয়েছিল…

কৌশিক পাদপূরণ করে: লা গ্র্যান্ডি!

এই সময় মিস্ অ্যাগি ডুরান্টের কাছ থেকে একজন পিয়ন একটি মুখবন্ধ খাম নিয়ে এসে হাজির। কৌশিক পিয়ন বইতে সই দিয়ে খামটা বাসু-সাহেবকে দিল। বাসু খুলে দেখলেন ওঁর চিহ্নিত আটজন দাতা গত নয় বছরের মধ্যে কে কত টাকা ঐ মানসিক আরোগ্যনিকেতনকে দিয়েছেন; ইনকামট্যাক্স থেকে কিছুটা রেহাই পেতে :

(সংখ্যা হাজারের গুণীতকে প্রকাশিত)

নাম — 86..’87..’88..’89..’90..’91..’92..’93..’94..

অ্যাগনেস ডুরান্ট — 2.0..2.0..3.0..3.0..3.0..5.0..5.0..5.0..5.0 ..1.0..

অমরেশ দাশ — 1.0..1.0..2.0..2.0..2.0..3.0..3.0..3.0

যুগল সেনরায় — …0.5..0.5..0.5..0.5..1.0..1.0..1.0..1.0..1.0

ব্রজদুলাল রায় — ..2.0..2.0..2.0..2.0..2.0..2.0

ইন্দ্রকুমার — 1.8.. 1.8.. 1.8..2.4..2.4..2.4..3.0..3.0..3.6

গুণবতী মোহান্তি — 5.0..5.0..5.0..5.0..5.0..5.0..4.0

সুভদ্রা মোহান্তি — 2.0..2.0..2.0..2.0..2.0..3.0..2.0

ছায়া পালিত — 1.0.. 1.0.. 1.0..1.0..1.5..1.5..1.5..1.5

বাসু কাগজখানা কৌশিকের দিকে বাড়িয়ে ধরলেন। সে তার উপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললো, এই কাক্কেশ্বর কুচকুচের ভগ্নাংশের হিসেবটা কোন গোস্টস্-ফাদারের শ্রাদ্ধে লাগবে, মামু?

—ঐ তো তোমাদের দোষ ছোকরা! ওতে কী আছে তা বুঝবার মতো চোখ যে ভগবান তোমাদের দেননি। বুঝবে কোত্থেকে?

—দু-একটা উদাহরণ যদি দিতেন, মামু?

—শোন। ও থেকে বোঝা যাচ্ছে :

এক : যুগল সেনরায়ের স্ত্রী—খেঁদি, পেঁচী, আন্নাকালী যেই হোক, 1986 থেকে ডাক্তারের চিকিৎসাধীন ছিল।

দুই : অমরেশ দাশের আরোগ্যনিকেতনে চাকরি দশ বছরের বেশি।

তিন : ব্রজদুলালের সঙ্গে ডাক্তার ঘোষালের আলাপ 1988 নাগাদ। তার আগে নয়।

চার : ইন্দ্রকুমার দশ বছর ধরে সাধ্যমতো ক্রমবর্ধমান হারে দান করে যাচ্ছে।

পাঁচ : সুভদ্রার পিতৃবিয়োগ হয়েছে 1988 সালের পরে নয়।

ছয় : সুভদ্রার বর্তমান বয়স অন্তত আটাশ।

পম্পা হঠাৎ বলে ওঠে : আটাশ! দেখলে তো তা মনে হয় না।

—না হতে পারে। এই ভগ্নাংশের অঙ্কের হিসাবটা বলছে ফিনানশিয়াল ইয়ার ‘86-87- এই সে অষ্টাদশী হয়ে পড়েছিল, না হলে তাকে ইনকামট্যাক্স দিতে হতো না। ‘87-এ যে আঠারো, ‘97-এ সে অনিবার্যভাবে আটাশ—মেক-আপের কল্যাণে তাকে যতই খুকি খুকি – মনে হোক।

পম্পা সোৎসাহে বলে ওঠে: ওফ! দারুণ ডিডাকশন! আপনাকে একটা প্রণাম করব, মামু? বাসুসাহেব ইজিচেয়ারের হাতলে ঠ্যাঙজোড়া তুলে দিয়ে বলেন, কর। এরা তো ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ ছাড়া আর কিছু চিনল না। তুমি শুধু ভালো রাঁধুনীই নও, বুদ্ধিমতী। অমন দারুণ ইলিশের মাছ-পাতুরি বানালে, আবার চট করে বুঝে নিলে…

পম্পা বলে, না মামু, ওটা মাছ-পাতুরি নয়…

কৌশিক বাধা দিয়ে বলে, ছেড়ে দিন পম্পা দেবী। এর পরের দিন আমি জোড়া ইলিশ নিয়ে আসব। পাশাপাশি দু-বাটিতে কব্জি ডুবিয়ে না খেলে আমাদের মাথায় ঢোকে না—কোনটা সর্ষেবাটার ভগ্নাংশ আর কোনটা মাছ-পাতুরিরই ত্রৈরাশিক!

বাসু তাঁর ভগ্নের দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকালেন যে, উনি দুর্বাসা মুনি হলে কৌশিক এতক্ষণে : ‘গো—ওয়েন্ট—গন’—স্রেফ অ্যাশেস্!

চৌদ্দ

শনিবার, চৌঠা নভেম্বর। অর্থাৎ পরদিনই। সকাল সাতটা নাগাদ বুড়োবুড়ি বসেছেন প্রাতরাশে। সংসারের বাকি দুজন—সুজাতা আর কৌশিক—ভোরবেলায় ট্যাক্সি নিয়ে রওনা দিয়েছে হাওড়া স্টেশন। ইস্পাত ধরে ঘাটশিলা যাবে। সেখানে থেকে ট্যাক্সি ধরে গালুডিতে। পরদিন, রবিবারের মধ্যে ওদের ফিরে আসার কথা। আজ বিশ্বনাথ টোস্ট বানায়নি। দুজনকেই দিয়েছে কাটা ফল।

রানু পাকা পেঁপের টুকরো কাঁটায় গাঁথতে-গাঁথতে বললেন, গালুডিতে ওদের দুজনকে অহেতুক পাঠালে তুমি। ইন্দ্রকুমারের অ্যালেবাঈটা যাচাই করার কোনও প্রয়োজন ছিল না। সে ছিল ঘোষাল-ডাক্তারের বাল্যবঙ্কু। সে-ই সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছে এ দুর্ঘটনায়। তাছাড়া ডাক্তারের মৃত্যুতে সে তো কোনোভাবেই লাভবান হচ্ছে না।

বাসু বললেন, জানি। কৌশিকও সে-কথা বলেছিল। কী জান? একে বলে রুটিন চেক। কাল বিকালে ফিরে এসে ওরা কনফার্ম করুক যে, ইন্দ্রকুমার তেইশ থেকে ত্রিশ তারিখ ঐ হোটেলে ছিল, ব্যস! আমি তখনি ইন্দ্রকে সন্দেহ-তালিকার বাইরে রাখব। কারণ ডাক্তার পার্টি দেবে বলে মনস্থির করেছে ইন্দ্রকুমার রওনা হবার পর—নাহলে তার নিমন্ত্রণই সবার আগে হতো।

রানু বলেন, কেন? তর্কের খাতিরে যদি ধরা যায় ইন্দ্রকুমার ঐ সময় তার শ্যামপুকুরের বাসায় ছিল, তাহলে তুমি তাকে সন্দেহ-তালিকায় রাখতে? সে যে গার্ডেন-পার্টিতে যায়নি এটা তো প্রমাণিত।

—সেটা কথা নয় রানু। ডাক্তারের গ্লাসে বিষটা কে মিশিয়েছে তা আমরা সহজেই আন্দাজ করতে পারছি। যেহেতু সে পরমুহূর্ত থেকেই ফেরার। যেহেতু সে একটা প্রফেশনাল কিলার। তাকে তো কেউ একজন দশ-বিশ হাজার টাকা খাইয়ে কাজটা করতে নিয়োগ করেছে! সেই লোকটা কে? পচাইকে পুলিস তন্নতন্ন করে খুঁজছে, যাতে জানা যায় –কে তাকে খুনী হিসাবে নিয়োগ করেছিল। নিঃসন্দেহে সে লোকটা ঘোষালের অত্যন্ত বিশ্বস্ত। খুবই কাছের মানুষ।

—কেন? সেটা কী করে বুঝলে?

—নাহলে সেই লোকটা পচাইকে কীভাবে হারাধনের পরিচয়ে ডাক্তারের বাড়িতে ঢুকিয়ে দিতে পারবে, বল? ভেবে দেখ, পুরীতে থাকতেই ডাক্তার আমাকে বলেছিল, অ্যাগির টেলিফোন পেয়ে সে কিছু রিচলিত। আমি তাকে সেদিনই একজন বিশ্বস্ত দেহরক্ষী দিতে চাইলাম। তখন সে রাজি হয়নি। বলেছিল, চিনসুরায় ফিরে গিয়ে পরিস্থিতি বুঝে সে আমাকে জানাবে। তা সে জানায়নি। কেন? দ্বিতীয়ত, যুগলকিশোরও ডাক্তারকে একজন বিশ্বস্ত দেহরক্ষী দিতে চেয়েছিল। ডাক্তার তাকে প্রত্যাখ্যান করে। সে যুগলকে জানিয়েছিল য়ে, অত্যন্ত বিশ্বস্ত সুত্র থেকে একজন ভালো দেহরক্ষী সে ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছে। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়—যে-লোকটা ঐ হারাধন দাসকে পাঠায় তাকে শিবশঙ্কর ঘোষাল খুব ভালোভাবে চিনত এবং সম্পূর্ণ বিশ্বাস করত। এই জন্যই আমার প্রথম সন্দেহ-তালিকায় আছে চারটি নাম : ব্রজদুলাল, ইন্দ্রকুমার, অ্যাগি এবং অমরেশ দাশ। মুশকিল হচ্ছে এই : এদের মধ্যে কেউই ডাক্তারের মৃত্যুতে তিলমাত্রর লাভবান হয়নি। এরা প্রত্যেকেই ডাক্তারকে ভালোবাসে, তার কাজকে শ্রদ্ধা করে, তার প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ সাত-আট বছর ধরে সাধ্যমতো দান করে গেছে।

রানু পট থেকে কাপে কফি ঢালতে ঢালতে বললেন, একদিক থেকে অবশ্য ওদের দুজনকে গালুডি পাঠানোটা ভালোই হয়েছে।

—কোন দিক থেকে?

—তোমার পাল্লায় পড়ে ওরা দুটিতে তো গোল্লায় গেছে। দিবারাত্র শুধু খুন-জখম নিয়ে মেতে আছে। রাতদিন চোর-পুলিস খেলছে। ওরা বোধহয় ভুলেই গেছে যে, ওদের পরিচয় শুধু ‘সুকৌশলী’-র পার্টনার হিসাবেই শেষ হয়ে যায় না : ওরা স্বামীস্ত্রী! যাক্ দুদিন ঘাটশিলায় ফূর্তি করে আসুক!

বাসু হাসলেন। বলেন : তা ঠিক!

—না, শুধু হাসলে হবে না। তুমি একটা জিনিস খেয়াল করেছ? ওদের এত বছর বিয়ে হয়েছে, অথচ বাচ্চা-টাচ্চা হয়নি। কেন? আপত্তিটা কার?

—কী আশ্চর্য! তা আমি কেমন করে জানব?

—তা তো বটেই! তুমি কেমন করে জানবে? সন্তান না হওয়ার অপরাধে ওদের যখন পুলিসে গ্রেপ্তার করছে না, তখন তুমি তো নির্লিপ্ত! তুমি জান না, আমি জানি!

—কী জান?

—ওঁদের দুজনের কারও শারীরিক কোনও ডিফেক্ট নেই। সুজাতা আমার কাছে স্বীকার করেছে। সন্তান হচ্ছে না—কারণ ওরা সেটা চাইছে না।

র-কফিতে একটা চুমুক দিয়ে বাসু সংক্ষেপে বললেন : আই সি!

না! কিছুই দেখতে পাও না তুমি। কারণ তুমি ছুঁচোর মতো অন্ধ। কী দেখবে তুমি? দেখার চোখ কি আছে তোমার? সুজাতার কত বয়স হয়েছে বল তো? এর পর ‘ফার্স্ট কনফাইনমেন্ট’ যে বিপদজনক তা তুমি জান? এ সংসারে একটা চুন্নিমুন্নি এলে সকলের জীবন—বিশেষ করে আমার এই বন্ধ্যা-জীবন—কেমন আনন্দঘন হয়ে উঠবে তা তুমি কোনোদিন ভেবে দেখেছ?

বাসু রীতিমতো বিব্রত হয়ে বলেন, কী আশ্চর্য! তা এ বিষয়ে আমি কী করতে পারি?

—তুমিই তো যত নষ্টের গোড়া! ওদের বিয়ের পর থেকে আপন মনে কাঁটার পাহাড় বানাচ্ছ! কাঁটার পরে কাঁটা! শেষ হতে-না-হতেই আবার কাঁটা! কোনো বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই, শুধু কাঁটা! ডাইনে কাঁটা, বাঁয়ে কাঁটা, হেঁটোয় কাঁটা, মুড়োয় কাঁটা! বলি, সকল কাঁটা ধন্য করে ফুলটা কি ফুটবার সুযোগ পাচ্ছে?

বাসু তাঁর পাকাচুলে আঙুল চালিয়ে কী একটা কথা জবাবে বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই বেজে উঠলো টেলিফোনটা।

রানু বলেন, ঐ শোন! স্বামীস্ত্রীতে দুটো সংসারের কথা বলার সুযোগ নেই। তার মাঝখানে শুরু হলো খোঁচানি : ‘টেলিফোনের কাঁটা’!

বিশে পাশের ঘর থেকে হান্ড্রেড-মিটার রেসের শেষ ক’মিটার পাড়ি দিয়ে এসে টেলিফোনটা তুলে নিল। তার ‘কথামুখে’ বললো, ব্যারিস্টার বাসুসাহেবের বাড়ি। বলুন? কারে চাইছেন?

বাসু প্রসঙ্গটা বদলের সুযোগ পেয়ে বলেন, বিশেটা এখন কেমন চালু হয়ে গেছে দেখেছ? রানু জবাব দিলেন না। শুনলেন, বিশে টেলিফোনে একনাগাড়ে বলে যাচ্ছে, আজ্ঞে না, বাড়ি নেই।..না, দুজনের কেউই নেই। কলকাতার বাইরে গেছেন, গিয়া…কী? তা আমি জানি না।…কী?…ও আচ্ছা ধরেন—

কর্ডলেস টেলিফোনটা এনে বাসু সাহেবের হাতে ধরিয়ে দেয়। তিনি টেলিফোনের ‘কথামুখে’ হাত চাপা দিয়ে বললেন, হ্যাঁরে, ওটা কী বললি? সুজাতা-কৌশিক কোথায় গেছে তা তুই জানিস না?

—কেন জানবনি? ঘাটশিলায় গেছেন তো। কিন্তু ঘরের কতা বাইরের লোকেরে বেহুদ্দো বতি,যাব কেনে?

বাসু রানুর দিকে ফিরে বললেন, বিশেকে আজ তোমার হাতখরচা থেকে দশটা টাকা বকশিস্ দিও। উই মাস্ট অ্যাপ্রিশিয়েট হিজ ইন্টেলিজেন্স!

তারপর টেলিফোনটা কানে লাগিয়ে বলেন : বাসু স্পিকিং।

–গুড মর্নিং স্যার! আমি গুণবতী বলছি, মানে মিসেস্ মোহান্তি।

—গুড মর্নিং। বল, গুণবতী? কী খবর?

—আমি, দাদা, ঐ কৌশিক-সুজাতাদের খুঁজছিলাম। তা যে টেলিফোন ধরেছিল- বোধহয় কাজের লোক—সে বললো, ওরা দুজনে কলকাতার বাইরে গেছে। কোথায় গেছে ওরা?

বাসু সে-প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন, ওদের খুঁজছ কেন গো? জরুরি কাজ? আগামীকাল রাত্রেই ওরা ফিরে আসবে। পরশু সকালে ফোন কর বরং।

—পরশু তো আমি নিজেই পুরীতে ফিরে যাব। তার আগে দেখা হলেই ভালো হতো। তা কোথায় গেছে ওরা দুজন?

বাসু অম্লানবদনে বললেন, ভুবনেশ্বর।

—ভুবনেশ্বর! কেন? ভুবনেশ্বর কেন?

—তা তো বলতে পারব না, মা। ‘সুকৌশলী’-র অফিসটা আমার বাড়িতে বটে, কিন্তু ওরা গোয়েন্দাগিরির কাজকর্ম করে পৃথকভাবে। আমার সঙ্গে যৌথভাবে নয়।

—আমি জানি দাদা। সে-ক্ষেত্রে আমি কি একবার আপনার কাছে আসতে পারি?

—কখন? কবে?

—আপনার অসুবিধা না হলে এখনই। ধরুন সল্টলেক থেকে নিউ আলিপুর যেতে যতটুকু সময় লাগে, তার পর।

–ব্যাপারটা জরুরি এবং প্রফেশনাল মনে হচ্ছে?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, দাদা। জরুরি তো নিশ্চয়ই। এবং প্রফেশনালও বটে।

—বেশ তো, এস। তুমি কি একা আসছ?

—আজ্ঞে না। খুকুও থাকবে আমার সঙ্গে। সে অবশ্য স্রেফ সৌজন্য সাক্ষাতে যাচ্ছে—কাটিসি-ভিজিট। আমি যাচ্ছি কাজে। প্রফেশনাল ভিজিট।

—এস। আমি অপেক্ষা করব।

—আর একটা কথা, দাদা। আমি যে আপনাকে প্রফেশনালি এনগেজ করেছি তা যেন জানাজানি না হয়ে যায়।

—দুটো কথা বলব, মিসেস্ মোহান্তি। এক : তুমি আমাকে আদৌ প্রফেশনালি এনগেজ করনি, করার একটা প্রস্তাব দিয়েছ। আমি তা এখনো গ্রহণ বা বর্জন করিনি। দ্বিতীয় কথা, তোমার কোনো গোপন কথা তোমার শত্রুকে অথবা তোমার শত্রুর কোনো গোপন কথা তোমাকে আমি জানাব না—ইফ্ আইদার অব য়ু বি মাই ক্লায়েন্ট।

—জানি দাদা, আয়াম সরি।

.

সকাল নটার মধ্যেই মা-মেয়ে এসে হাজির। ওদের বোধহয় নিজেদের ভিতর কথাবার্তা আগে থেকেই হয়েছিল। বাইরের ঘরে কিছুক্ষণ ‘খেজুরে-আলাপ’ শেষ করে সুভদ্রা রানুকে বললে, চলুন মাসিমা, আমরা দুজন বাইরের বারান্দায় গিয়ে বসি।

বাসু বললেন, না সুভদ্রা। তার দরকার হবে না। আমিই বরং তোমার মা-কে নিয়ে আমার চেম্বারে গিয়ে বসছি। তোমরা এখানেই গল্পগুজব, কথাবার্তা চালাতে পার।

শুণবতীকে নিয়ে বাসুসাহেব চেম্বারে ঢুকলেন। মিসেস্ মোহান্তি আসামাত্র রানুদেবীকে জানিয়ে রেখেছিলেন যে, ওঁরা এইমাত্র ব্রেকফাস্ট সেরে এসেছেন—রানু যেই চা-কফির হাঙ্গামা না করেন।

বাসু বলেন, এবার বল। ‘সুকৌশলী’কে খুঁজছিলে কেন?

গুণবতী প্রতিপ্রশ্ন করেন, ওরা কেন ভুবনেশ্বরে গেছে সত্যিই আপনি জানেন না, দাদা? বাসু পাইপটা এতক্ষণে ধরাবার প্রয়োজন অনুভব করলেন। বললেন, দেখ গুণবতী, আমাদের প্রফেশনটা এমন যে, একজনের কথা অপরজন বলি না। এই যে তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছ—তোমার প্রস্তাব গ্রহণ করি বা না করি—তা আমি তৃতীয় ব্যক্তিকে বলতে পারি না। সুতরাং সুজাতা-কৌশিক কেন ভুবনেশ্বরে গেছে তা জানলেও আমি তোমাকে জানাতে পারি না। ইস্‌ আওয়ার প্রফেশনাল এথিক্স।…এবার বল, তুমি আমাকে কী জানাতে এসেছ? তোমার প্রস্তাবটা কী?

—আমি শুনেছি, অ্যাবে বিল শবরিয়ার দেহটা কবর থেকে খুঁড়ে বার করার আয়োজন হচ্ছে। পরীক্ষা করে দেখতে, তার মৃত্যু কী কারণে হয়েছে—হার্ট-ফেল না বিষের ক্রিয়ায়। এ-কথাটা সত্যি?

বাসু একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, একই কথা বারে-বারে বলতে আমার ক্লান্তি লাগছে, গুণবতী। তুমি কি, বুঝতে পার না যে, সে-কাজটা আদৌ করা হলে তা করা হবে ওড়িশা সরকারের স্বরাষ্ট্র-বিভাগের নির্দেশে। তারা তা করছে কি করছে না, তা আমার জানার কথা নয়। জানলেও তা আমি তোমাকে জানাতে পারি না।

—এখন পারেন না। কিন্তু আমি যদি আপনার ক্লায়েন্ট হয়ে যাই? তখনো কি পারেন না?

—ক্লায়েন্ট! কী ‘কেস’-এর ক্লায়েন্ট?

ধরুন, আমি যদি বলি : জোড়া-খুনের। দুটোরই। বিল শবরিয়া এবং ডক্টর ঘোষাল?

—নো। আয়াম সরি। ঐ জোড়া-খুনের কেসটা আমি ইতিমধ্যেই গ্রহণ করেছি। ব্রজদুলাল রায় আমার মক্কেল।

—আমার ইন্টারেস্ট দেখতে আপনি আমাকে ক্লায়েন্ট বলে স্বীকার করতে পারেন না?

—সে-কথার জবাব পরে দেব। তোমার ইন্টারেস্টটা কী জানার পর। কিন্তু তুমি তো প্রাথমিকভাবে কোনো সলিসিটারের কাছে লিগ্যাল অ্যাডভাইস্ খুঁজছিলে না। তুমি তো এ- বাড়িতে ফোন করে প্রথমে ‘সুকৌশলী’কে খুঁজেছিলে। তাই না? শোন, মিসেস্ মোহান্তি! তোমার সমস্যাটা কী, তা আমি জানি না। তা যদি ‘সুকৌশলী’কে জানাতে চাও তাহলে পরশু সকালে তা জানাতে পার। তার আগে নয়। আর যদি আমার পরামর্শ চাও, তাহলে সর্বপ্রথমে আমাকে আদ্যোপান্ত মনের মধ্যে খুলে বলতে হবে। এভাবে আধো-খোলা, আধো-ঢাকা নয়। সবটা কেস শুনে আমি তোমার প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারি, প্রত্যাখ্যানও করতে পারি। কিন্তু আমাদের প্রফেশনটা এমন যে, সেই গোপন কথা আমি তৃতীয় ব্যক্তিকে বললে আমার বার লাইসেন্স খোয়াতে হবে। এমনি কেউ যদি স্বীকার করে যে, সে স্বহস্তে খুন করেছে—তাহলে আমি তার কেস নিতে পারি, নাও নিতে পারি—কিন্তু পুলিস ডেকে তাকে ধরিয়ে দিতে পারি না। অ্যাম আই ক্লিয়ার?…এখন তোমার ইচ্ছা। তুমি মন খুলে আমাকে সব কথা বলে আইনত পরামর্শ চাইতে পার। আমি তা দিতে পারি, না-ও দিতে পারি। বলতে পারি : তুমি অন্য কোনও ল-ইয়ারের কাছে যাও। কিন্তু তোমার গোপন কথা প্রকাশ করতে পারি না। বুঝতে পারলে?

গুণবতী বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ, দাদা। জলের মতো বুঝেছি। বেশ। আমি সব কথা আপনাকে খুলেই বলি। তারপর আপনি যদি কেস না নেন তাহলে আমি অন্য উকিল দেখব।

—বেশ কথা। বল।

সুভদ্রার বাবা যে কন্সটিটুয়েন্সি থেকে নির্বাচনে জয়লাভ করেন তার ভিতর পড়ে ঐ গুনপুরের শবরদের এলাকাটা। কয়েক হাজার বয়ঃপ্রাপ্ত শবর ঐ এলাকায় বাস করে। গুনপুর চার্চের অ্যাবট—অর্থাৎ অ্যাবে শবরিয়ার উপরে যিনি ঐ গির্জার প্রধান ধর্মযাজক, তিনি বুঝেছিলেন, শবরদের সঙ্ঘবদ্ধ করতে পারলে একটা ভালো ‘ভোট-পকেট’ তৈরি করা যায়। নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই তিনি প্রাপ্তবয়স্ক শবর নরনারীকে ভোটার তালিকাভুক্ত করে একটি দল গড়ে তোলেন। অ্যাবে শবরিয়াও প্রাণপাত করে এ-কাজ করেছেন। ওঁদের উদ্দেশ্য ছিল একটাই—যে প্রার্থী ঐ নিঃস্ব, রিক্ত, অদ্যভক্ষ্যধনুর্গুণ শবরদের মঙ্গলার্থী তাকেই ওঁরা ভোট দেবেন।

সুভদ্রার বাবা ভোটে জিতলেন শবরদের বিরাট ভোট পেয়ে।

অ্যাবে এবং অ্যাবটকে খুশি করে দিতে টাকা নিয়ে এগিয়েও এসেছিলেন। এঁরাই প্রত্যাখ্যান করেন। বলেন, দান যা দেবার তা চার্চকে দিতে হবে। ব্যক্তিকে নয়।

মুশকিল হচ্ছে এই যে, চার্চ-এর সঙ্গে এখানকার হিন্দু নেতাদের রেষারেষি ছিল—ভোটার কাড়াকাড়ির ব্যাপারে। ফলে সুভদ্রার বাবা প্রকাশ্যে চার্চকে টাকা দিতে পারেননি।

এ নিয়ে একটা বিশ্রী মন-কষাকষি হয়।

বাজারে এমন কথাও রটে যায় যে, সুভদ্রার বাবা অন্যায়ভাবে ঘুষ নিয়ে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ গোপনে রাখা আছে ঐ অ্যাবট এবং অ্যাবের কাছে। সময় মোটর দুর্ঘটনায় চার্চের অ্যাবট নিহত হন। দুষ্টলোক বলে—ওটা মোটেই দুর্ঘটনা ছিল না, ছিল রাজনৈতিক কারণে হত্যা।

বিরোধীপক্ষের চাপাচাপিতে সি. বি. আই তদন্ত বসে। দুর্ভাগ্যই বল, আর সৌভাগ্যই বল—হঠাৎ হার্ট-অ্যাটাকে মারা গেলেন সুভদ্রার বাবা!

মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত চালাতে ওঁর শত্রুরা উৎসাহিত হলো না। ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ল। মোহান্তিসাহেবের প্রয়াণে সিটটা খালি হলো। বাই-ইলেকশনেও মোহান্তির পার্টির লোকই জিতল।

গুণবতীর আশঙ্কা: এখন যদি অ্যাবে শবরিয়ার মৃতদেহ এক্সহিউম করে বিষের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায়, তাহলে লোকে বলবে : এটাও রাজনৈতিক হত্যা। অর্থাৎ প্রয়াত রাষ্ট্রমন্ত্রীর চ্যালা-চামুণ্ডারা এভাবে প্রতিশোধ নিয়েছে। গুণবতী আর সুভদ্রার উপস্থিতিতেই তিনি মারা যান। এই কারণে গুণবতীর ইচ্ছে নয় ওড়িশার স্বরাষ্ট্র দপ্তর গুনপুর চার্চে গিয়ে ঐ কেঁচো খোঁড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করে। আশঙ্কা : কে জানে কী সাপ বেরিয়ে আসবে!

বাসু সবটা শুনে বললেন, প্রথম কথা, মোহান্তিসাহেব প্রয়াত। ফলে বিল শবরিয়ার দেহে বিষের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও প্রয়াত রাষ্ট্রমন্ত্রী দায়ী হতে পারেন না। দ্বিতীয় কথা, ওড়িশা সরকার যদি এ-কাজ করতে চান তাহলে বাসুসাহেব বা সুকৌশলী সে বিষয়ে কী করতে পারে?

গুণবতী ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত দুটো প্রশ্নেরই জবাব দিলেন। প্রয়াত রাষ্ট্রমন্ত্রীকে নতুন করে ফাঁসি দেওয়া যাবে না এ-কথাও যেমন ঠিক, তেমনি রাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যেসব তদন্ত অনেক খরচপাতি করে চাপা দেওয়া গিয়েছিল, সেগুলো নিয়ে সি. বি. আই নতুন করে তদন্ত শুরু করতে পারে।

—সেগুলো কী জাতীয় অপরাধের তদন্ত?

—সুভদ্রার বাবার সম্পত্তির সঙ্গে তাঁর উপার্জনের অসামঞ্জস্য। এক্ষেত্রে অন্যায়ভাবে অর্জিত সম্পত্তি বলে কি ওয়ারিশদের কাছ থেকে সরকার সেসব সম্পত্তি কেড়ে নিতে পারেন?

বাসু জানতে চান, আমি শুনেছি মোহান্তিসাহেব মন্ত্রী থাকাকালে পাঁচখানি ভদ্রাসন কিনেছিলেন। তাই না? কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই, বাঙ্গালোর আর পুরী? আন্দাজ কত কোটি টাকা মূল্য হবে সব কয়টি মিলিয়ে?

গুণবতীর কণ্ঠস্বর নিচু হলো। হঠাৎ কি জানি কেন তিনি মাতৃভাষায় জবাব দিলেন, দ্বি- তিন কোটি হেবে। মুই না জানুছি।

বাসু খুব সাধারণভাবে বললেন, গড়ে পঞ্চাশ লাখ করে ধরা যাক, আড়াই কোটি? তা এই টাকাটা তিনি কত বছরের ভিতর উপার্জন করেছিলেন?

এবার মিসেস্ মোহান্তি সোজা হয়ে উঠে বসেন। আবার ফিরে আসেন বঙ্গভাষে, সে তো সারাজীবন ধরে। উনি চল্লিশ বছর ধরে কটকে প্র্যাকটিস করেছেন। টানা চল্লিশ বছর।

—কী প্র্যাকটিস করতেন?

—ডাক্তারী।

—উনি মেডিকেল প্র্যাকটিশনার? এম. বি. ডিগ্রি ছিল তাঁর?

—না, হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারী। ওড়িশা গরিব দেশ—তাই উনি হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস করতেন।

—বুঝেছি। আর রাষ্ট্রমন্ত্রী পদে ছিলেন কত বছর?

—আড়াই বছর!

—তার মানে হিসাবে দাঁড়ালো—বছরে কোটি। মানে মাসে গড়ে সওয়া আট লক্ষের উপর! হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ গুণবতী, কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে। আর আদালত রুলিং দিলে ঐ অন্যায়ভাবে উপার্জিত সম্পত্তি সরকারের খাস হয়েও যেতে পারে।

—কিন্তু উনি তো অন্যায়ভাবে উপার্জন করেননি।

—বটেই তো! সে তো তোমার-আমার বিচারে। আদালত সে-কথা নাও মানতে পারেন! –ঐ কথাটাই ভাবছি, দাদা। দেখুন না—আদালতের কী কাণ্ড! অমন দেবতুল্য মানুষ—জপ-তপ নিয়ে পড়ে আছেন—একরকম সন্ন্যাসীই! অতদিন প্রধানমন্ত্রীত্ব করলেন। তাঁকে পর্যন্ত চারশো বিশ ধারায় ফাঁসিয়ে হয়রানি করছে! কোনো মানে হয়?

—তা তুমি কী করতে চাইছ?

—ঐ কেঁচো-খোঁড়ার কাজটা চাপা দিতে! আমি শুনেছি, আপনি নিজেই এটা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে করছেন। ডক্টর ঘোষালের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আপনিই অ্যাবে শবরিয়ার ধামাচাপা পড়া মৃত্যুর কেসটাকে আবার খুঁচিয়ে তুলেছেন। আর সেজন্যই কৌশিক-সুজাতা ভুবনেশ্বরে গেছে। বাসু বিরক্ত হয়ে বলেন, আমার মনে হয় তোমার অন্য কোনও উকিলের কাছে পরামর্শ নেওয়া উচিত। আমি এজাতীয় কাজ হাতে নিই না।

— সুকৌশলী…?

—কাল বাদে পরশু! ওরা ভুবনেশ্বর থেকে ফিরে এলে কথা বল।

—তাহলে তাই সই! আপনি যখন আমার কেসটা নিতেই পারবেন না বলছেন। বিধবা, বোনটির প্রতি যখন আপনার কিছুতেই কৃপা হলো না, তখন ফিরেই যাই।

ওঁরা ফিরে এলেন বাইরের ঘরে।

সুভদ্রা বললো, তোমাদের আলোচনা হয়ে গেল?

মা বললে, হ্যাঁ, হয়ে গেল। চল, এবার ফেরা যাক।

মেয়ে বললে, সে কি! এবার তুমি মাসিমার সঙ্গে গল্পগাছা কর। আমি মেসোমশাইয়ের সঙ্গে একটু ‘প্রফেশনাল টক’ করে আসি। অতবড় ব্যারিস্টারকে হাতের কাছে পেয়েছি। আইনের কথা কিছু শোনাই, কিছু শুনি? চলুন মেসোমশাই। বেশি সময় আমি নেব না।

বাসু আবার গিয়ে বসলেন তাঁর স্টাফড্ রিভলভিং চেয়ারে। ওঁর চেম্বারের ডোর-ক্লোজার লাগানো কবাটটা নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেল। সুভদ্রা সামনের চেয়ারে বসে বললো, আমি বাজি রাখতে পারি : আপনি আমার মায়ের প্রস্তাবে রাজি হননি। কাজটা অ্যাকসেপ্ট করেননি।

—কাজটা কী, তা তুমি জান?

—মা বলেনি। আমি আন্দাজ করেছি। এটা যদি মায়ের একার প্রবলেম হতো, তাহলে আমি নাক গলাতাম না। কিন্তু আমার স্বার্থও একইভাবে জড়িত। তাই জেনে যেতে চাইছি।

–কী তোমার প্রশ্ন?

—বাপি আমাকে তিনখানা বাড়ি উইল করে দিয়ে গেছে। সল্টলেকে একটা দোতলা বাড়ি, পুরীতেও একটা দোতলা বাড়ি; আর বাঙ্গালোরে একটা সিক্স-স্টোরিড বিল্ডিং।

বাসু জানতে চাইলেন, তিনটের মিলিত ভ্যালুয়েশন কত হবে?

–কী ভ্যালুয়েশন? কর্পোরেশন ভ্যালুয়েশন, না বর্তমান বাজারদর?

—দ্বিতীয়টা তুমি আন্দাজ করতে পার? জান?

—ওমা! আন্দাজ করব কেন? সম্পত্তিটা যখন আমার, তখন বাজারদরটা জানব না? তিনটে মিলিয়ে ধরুন তিন কোটি।

—তা, তোমার প্রশ্নটা কী, সুভদ্রা?

—বিল শবরিয়ার বডি এক্সহিউম করে যদি দেখা যায় যে, তাঁকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে এবং তা নিয়ে যদি সরকার এনকোয়্যারি করায়—ডিপার্টমেন্টাল, অর সি.বি.আই-এর মাধ্যমে—আর যদি ঐ সূত্রে প্রমাণ হয় আমার পূজ্যপাদ স্বর্গত পিতৃদেব উৎকোচ গ্রহণ করে ঐ বাড়িগুলি বানিয়েছেন তাহলে সরকার সে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারেন?

–পারেন। আদালত সেই মর্মে নির্দেশ দিলে।

—আমরা মা-মেয়ে কি তখন পুরীর স্বর্গদ্বারে ভিক্ষা করতে বসব?

—আদালত সচরাচর অতটা নিষ্করুণ হয় না। উৎকোচের অর্থে অন্যায়ভাবে নির্মিত সম্পত্তি অধিগ্রহণ করলে সচরাচর সরকার থেকে ওয়ারিশদের একটা সামান্য কিছু অর্থমূল্য দেওয়া হয়; যা দিয়ে তারা আবার নতুন করে ভদ্রভাবে জীবন শুরু করতে পারে। সেসব নির্ভর করে কেস-এর মেরিটের উপর। বিচারকের মর্জির উপর।

—মেসোমশাই! এটা বন্ধ করা যায় না? বিল শবরিয়ার দেহটা কবর থেকে ওঠাতে চাইলে শবর সম্প্রদায় বিদ্রোহ করতে পারে। ওরা রোমান ক্যাথলিক।

–সে সমস্যা ওড়িশা সরকারের। তোমার-আমার নয়। তার আগে বল তো, তোমার এখন বয়স কত?

—ত্রিশ। কেন?

—তোমার মা কিছুদিন আগে বলেছিলেন ছাব্বিশ

—মা অলওয়েজ আমার বয়স চার বছর কমিয়ে বলেন। এটা ওঁর স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। অটোমেটিক রিফ্লেক্স অ্যাকশন। আমি সতের বছরে স্কুল ফাইনাল পাস করি। মা দুনিয়াভর লোককে বলেছে তের বছর বয়সে। আমার অন্নপ্রাশনের সময়ে—শোনা কথা অবশ্য—মায়ের বঙ্কুদের প্রশ্নের জবাবে মা নাকি বলেছিল আমার তখন বয়স ছিল মাইনাস তিন বছর দু-মাস।

—তার মানে?

—অঙ্কের হিসাব। আমার অন্নপ্রাশন হয়েছিল বাস্তবে দশ মাস বয়সে। মা যথারীতি তা থেকে চার বছর বাদ দিয়ে পেয়েছে ‘মাইনাস আটত্রিশ মাস’।

বাসু জানতে চাইলেন, আর ইন্দ্রকুমারের বয়স কত?

—ঠিক জানি না। আন্দাজ পঞ্চাশ-একান্ন। কারণ ও ছিল ডাক্তার ঘোষালের ক্লাসফ্রেন্ড। ডাক্তার ঘোষালের মৃত্যুসময়ে বয়স হয়েছিল একান্ন—অন্তত কাগজে তাই লিখেছে।

—তার মানে, তোমার থেকে ইন্দ্রকুমার অন্তত বিশ বছরের বড়?

—হিসেবে তাই তো দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু এ হিসাবটা কেন করছেন মেসোমশাই?

—তুমি বুদ্ধিমতী। নিশ্চয় বুঝতে পারছ।

—তা পারছি! তবে এটা আমার ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যা। আমি কচি খুকি নই। সব দিক বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত যা নেবার তা নেব। আমরা বরং যে-কথা আলোচনা করতে এসেছি, সেই প্রসঙ্গেই ফিরে যাই। বিল শবরিয়া। আমি জানি, আপনি মায়ের প্রস্তাবটা নিশ্চয় প্রত্যাখ্যান করেছেন; কিন্তু সুকৌশলী’ কি ‘কেসটা’ নিতে পারে? আপনার কী মনে হয়?

বাসু বিরক্ত হয়ে বলেন, তোমাদের কেসটা কী তাই তো বুঝছি- না আমি।

—বিল শবরিয়ার দেহ কবর থেকে তোলা ঠেকাতে মা—আমার যদ্দূর আন্দাজ—পঞ্চাশ হাজার পর্যন্ত খরচ করতে রাজি। দশ সে দেবে ‘সুকৌশলী’কে অ্যাজ এজেন্ট, বাকি চল্লিশ ভুবনেশ্বরে স্বরাষ্ট্রবিভাগে ইন্‌সিডেন্টাল এক্সপেন্সেস!

বাসুর ভ্রূকুঞ্চন হলো। বলেন, কেন বল তো? তোমার মা কি সে-কথা বলেছে তোমাকে? ফিফটি থাউজেন্ড!

—কেন? আপনাকে টাকার অঙ্কটা বলেনি?

—না। সে প্রসঙ্গই ওঠেনি।

—ও! -ও!

বাসু বললেন, তোমার মা-কে বলিনি, কিন্তু তোমাকে বলছি সুভদ্রা, অ্যাবে বিল শবরিয়ার মৃত্যু বিষক্রিয়ায় হয়েছে এটা প্রমাণ করার সঙ্গে তোমার বাবার ঐ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হবার সম্ভাবনা খুবই অল্প—ইন ফ্যাক্ট : নেই। রাজনৈতিক বৈরিতাবশত একই পার্টির লোক যদি এ- কাজ করেও থাকে—যা প্রমাণ করা অলমোস্ট ইম্পসিব্‌–তাহলেও তোমার বাবার উপার্জিত সম্পত্তির প্রসঙ্গ আদৌ আসে না। তাঁর ওয়ারিশদের ধরে এতদিন পরে টানাটানি করার সম্ভাবনা প্রায় নেই-ই। তা-ছাড়া তোমার বাবা যে রাজনৈতিক দলে ছিলেন, সেই দলই তো এখন ওড়িশার ক্ষমতাশীল।

—আই নো! আই নো!

—য়ু নো? তুমি তা বুঝতে পারছ? তাহলে আমাকে একটু বুঝিয়ে বল তো, মা,—আমি ঠিক বুঝতে পারছি না—তোমার মা কেন এই সহজবোধ্য জিনিসটা বুঝতে পারছে না? সে কেন মনে করছে : কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরুবে? সাপটা আসলে কী? তোমাদের সম্পত্তি? না আর কিছু?

সুভদ্রা অস্বস্তি বোধ করে। ইতস্তত করে বলে, তা আমি কী করে জানব? মায়ের কথা মা- ই বলবে। তাকে জিজ্ঞেস করুন।

—কিন্তু সে কি তোমাকে ঐ পঞ্চাশ হাজার টাকার অঙ্কটা শুনিয়েছে?

সুভদ্রা সামলে নেয় নিজেকে, নট ইন সো মেনি ওয়ার্ডস্। ওটা আমার আন্দাজ! ঠিক আছে, মেসোমশাই, আজ এই পর্যন্তই থাক

—তাই থাক। কিন্তু অ্যাবে বিল শবরিয়ারক দেহ এক্সহিউম করাতে তোমাদের কেন এত আপত্তি সেটা বাপু আমার এই মোটা মাথায় ঢুকলো না সুভদ্রা! ফিফটি থাউজেন্ড! গুড গড!

.

বেলা এগারোটা নাগাদ আবার একটা টেলিফোন এল। এবারও ‘সুকৌশলী’কে কেউ খুঁজছে। কর্ডলেস ফোনটা বিশে নিয়ে এসে ধরিয়ে দিল বাসুসাহেবের হাতে। বাসু বললেন, কৌশিক বা সুজাতা ক’দিনের জন্য কলকাতার বাইরে গেছে। পরশু সকালে তাদের পাওয়া যাবে। ও-প্রান্ত থেকে ভেসে এল, ব্যারিস্টারসাহেব, আমি ইন্দ্রকুমার বলছি।

—হ্যাঁ, বল ইন্দ্ৰ? তুমি কি কৌশিককে খুঁজছ?

—তাই খুঁজছিলাম। তা ওরা দুজন তো নেই, আপনার একটু নষ্ট করার মতো সময় হবে? একটা জরুরি বিষয়ে কিছু আলোচনার ছিল।

—ঘোষালের কেস সংক্রান্ত?

—অফকোর্স! আপনি কি ফ্রি আছেন? আমি আসতে পারি?

—তুমি কোথা থেকে টেলিফোন করছ, ইন্দ্র? ব্রজদুলালের বাড়ি থেকে?

—আজ্ঞে না। আমি শ্যামপুকুরে আমার নিজের ডেরায় ফিরে এসেছি। আমার ফোন নেই।

একটা টেলিফোন বুথ থেকে বলছি। আপনার অসুবিধা না হলে আমি এখনি ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসতে পারি। ধরুন ঘণ্টাখানেকের মধ্যে।

—তোমার মধ্যাহ্ন আহার হয়েছে?

—আজ্ঞে না। ফিরে এসে খাব।

—তার চেয়ে এক কাজ কর না ইন্দ্র। আমার বাড়িতেই লাঞ্চ কর। খেতে খেতে কথা হবে। না, না—তোমার সঙ্কোচ করার কিছু নেই। কৌশিক-সুজাতা নেই—আমরা আজ রান্নাবান্না করিনি। চাইনিজ আনিয়ে খাব। তুমি চাইনিজ ভালোবাস তো?

—শিওর। তবে একটা অনুরোধ! মিষ্টিটা আমি নিয়ে যাব। শ্যামপুকুরে একটা দোকান আছে, চিত্তরঞ্জন মিষ্টান্ন ভাণ্ডার –দারুণ কড়াপাক বানায়। আপনাদের নিউ আলিপুরে অমন সন্দেশ পাওয়াই যায় না।

—অলরাইট! কিন্তু লাঞ্চের আগে কী খাব? জীন না বিয়ার?

—ওটা আমার রেস্পনসিবিলিটি, স্যার! আমার কাছে ভালো জিন আছে। মিনিট পনের আপনার ডিপ-ফ্রিজে রাখলেই তৈরি হয়ে যাবে।

—অ্যাজ য়ু প্লিজ।

রানু বিরক্ত হলেন। মধ্যাহ্ন আহারে ইন্দ্রকুমারকে নিমন্ত্রণ করার জন্য নয়—ঐ সঙ্গে ‘জিন’-এর আমন্ত্রণ হওয়ায়।

.

বারোটা থেকে একটা পুরো একঘণ্টা গেল জিন-পানে।

বাসুসাহেবের চেম্বারে। রানু টু-ইন-ওয়ানে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনলেন। নিজের চেম্বারে জিনের গ্লাস নিয়ে বাসু বললেন, এবার বল, কী বলতে চাইছ?

ইন্দ্র জিন-এর সঙ্গে লাইম মেশাতে মেশাতে বলে, ব্যাপারটা আপনার সঙ্গে আলোচনা করে লাভ হবে না মনে হচ্ছে

—তাহলে এলে কেন?

—বলছি। সুকৌশলীর কেউ থাকলে সুবিধা হতো। কারণ আমার আশঙ্কা আপনি এসব অ্যান্ডারহ্যান্ড ডিস্‌-এ রাজি হবেন না।

—আন্ডারহ্যান্ড ডিল্স? মানে ঘুষ? না, তা হব না! ঠিকই বলেছ।

—আগে ব্যাপারটা শুনুন তো।

—বল?

ইন্দ্রকুমার সব কথা খুলে বলে:

ইন্দ্রকুমারের বাল্য ও কৈশোরকাল কেটেছে বিহারে। ধানবাদে। সেখানকার চিরাগোড়া বয়েজ হাইস্কুলে পড়ত। ওরা বাবা ছিলেন ধানবাদের অ্যাসিস্টেন্ট স্টেশনমাস্টার। ফলে, বিহারে ওর অনেক বঙ্কুবান্ধব, সহপাঠী ছড়িয়ে আছে। তেমনি একজন—সে এখন বৈশালী জেলার এস.পি.—ইন্দ্রকুমারকে জানিয়েছে যে, বঙ্গাল মুলুকের ফেরারী আসামী পচাই ঘড়াই এখন বিহারে। বৈশালী হচ্ছে পাটনার উত্তরে এবং মজঃফরপুরের দক্ষিণে একটি জেলা। ইন্দ্রের সেই বঙ্কু, পাণ্ডেসাহেব জানিয়েছেন যে, পঞ্চানন ঘড়াই, ওরফে পচাই, বর্তমানে বিহারের রেলডাকাতি গ্যাঙে নাম লিখিয়েছে। তার হাল-হকিকৎ পুলিসের জানা। তবে বিশেষ আর্থ-রাজনৈতিক হেতুতে পুলিস ওকে ধরতে চায় না। ওদের মূল আস্তানা গণ্ডক নদীর ধারে একটি জনপদ: হাজিপুর। পাণ্ডে-সাহেব পচ্ছিম-বঙ্গাল-কা পুলিসের হাতে ঐ ফেরারী আসামীটিকে তুলে দিতে পারেন। অনায়াসেই। তবে এ কাজে আন্দাজ দশ হাজার টাকা ‘এথি’-বাবদ খরচ হবে। সে টাকা কি কেউ দিতে রাজি আছে? তাহলে ইন্তাজাম হইয়ে যাবে। টাকাটা পঞ্চাশ টাকার বাণ্ডিলে দিলেই চলবে!

বাসু বললেন, দেশটা কোথায় যাচ্ছে ইন্দ্ৰ?

—সম্ভবত জাহান্নামে। সে-প্রসঙ্গ থাক। সেটা তো বাংলা-বিহারের জনগণের তরফে দেখছেন জ্যোতিবাবু আর লালুবাবু! আমার প্রশ্ন হচ্ছে: পচাইটাকে ধরতে না পারলে আমরা কিছুতেই বুঝতে পারব না—কে ঘোষালকে ওভাবে হত্যা করালো। পচাই তো একটা অ্যান্টিসোস্যাল, প্রফেশনাল খুনী। কিন্তু তাকে এমপ্লয় করলো কে? পচাইকে জেল-হাজতে রেখে থার্ড-ডিগ্রির মাধ্যমে ঐটুকু তথ্য আমাদের সংগ্রহ করতেই হবে। যদি না অবশ্য—ঐ যে কী-যেন নাম? –হ্যাঁ, সুজাত ভদ্রের চ্যালাচামুণ্ডা হাঁ-হাঁ করে বাধা দেয়।

বাসু জানতে চান: সুজাত ভদ্র কে?

—ঐ যে এ.পি.ডি.আর-এর বড়সাহেব। সে যাহোক, আমি ব্রজদুলালকে কনভিন্স করেছি। সে রাজি হয়েছে—আই মিন, দশ হাজার ইনভেস্ট করতে। কিন্তু আমি বলেছি যে, ও-টাকা আমি ছোঁব না। ট্র্যানজ্যাকশনটা হবে ‘সুকৌশলী’র মারফৎ। আমি শুধু উপস্থিত থাকব। সারা ভারতের এই সব ফ্রিলান্স গোয়েন্দাদের একটা সঙ্ঘবদ্ধ ফেডারেশন গড়ে উঠেছে। ক্রিমিনালরা এবং পলিটিক্যাল মস্তানরা যেমন দিন-দিন ফুলে-ফেঁপে উঠছে, ঠিক সেই হারে মানুষ পুলিসের উপর আস্থা হারাচ্ছে। ফলে এই সব ফ্রিলান্স গোয়েন্দার দল বাজার ক্যাপচার করছে। ওদের একটা অল-ইন্ডিয়া ফেডারেশন গড়ে উঠেছে। আমি জানি—’সুকৌশলী’ তার সদস্য। আমি চাই, ‘সুকৌশলী’ ওদের পাটনা-অফিসকে টেলিফোন করে প্রথমে জেনে নিক—বৈশালী জেলার এস. পি. পাণ্ডে-সাহেবের ঐ দশ হাজার টাকার অফারটা জেনুইন কিনা। যদি জেনুইন হয়, তবে পাটনার কোনও ব্যাঙ্কের উপর একটা ব্যাঙ্ক ড্রাফ্‌ট নিয়ে আমি আর কৌশিক চলে যাব পাণ্ডের কাছে।

ব্যাঙ্ক ড্রাফ্ট! মিস্টার পাণ্ডে নেবেন?

জিনের গ্লাসে একটা বড় চুমুক দিয়ে ইন্দ্রকুমার বললে, কী যে বলেন, স্যার! তাই কি নেয়? ব্যাঙ্ক ড্রাফ্‌টটা তো আমাদেরই ভাঙাতে হবে। তবে পাটনা যেতে যে পরিমাণ রেল- ডাকাতি হচ্ছে তাতে নগদে দশ হাজার টাকা কে নিয়ে যাবে বলুন? হয়তো ট্রেনের মধ্যেই পাইপগান দেখিয়ে ঐ পচাইই টাকাটা ছিনতাই করবে?

—তা ঠিক। তবে কী জান ইন্দ্র, এসব ব্যাপারে আমি একবারে নভিস। বাহাত্তর বছর বয়েস হলো—আজ পর্যন্ত ঘুষ কখনো দিইনি বা নিইনি। তুমি এ বিষয়ে কৌশিকের সঙ্গেই কথা বল বরং। সে পরশু সকালে বাড়িতে থাকবে।

—আমি এটাই আশঙ্কা করেছিলাম। আপনি এ ডিলে থাকতে রাজি হবেন না। -সেটা যদি জানাই থাকে তাহলে আমার কাছে অ্যাট অল এলে কেন, ইন্দ্ৰ?

—ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়াটা নির্বুদ্ধিতা হবে বলে। আমরা ‘সুকৌশলী’কেই নিয়োগ করছি—আমি আর ব্রজ; কিন্তু আপনার জ্ঞাতসারে।

বাসু বললেন, আর এক পেগ নেবে?

—দিন। তবে এটাই শেষ। মাসিমা অনেকক্ষণ একা একা গান শুনছেন। বেলাও প্রায় একটা বাজল।

বাসু নিজের জন্যও এক পেগ নিলেন। বললেন, তোমার একজ্যাক্ট বয়সটা কত ইন্দ্ৰ?

—ফর্টি সিক্স!

–ঘোষালের চেয়ে তুমি পাঁচ বছরের ছোট?

—হ্যাঁ। ওর এটা একান্ন চলছিল।

—অথচ তোমার সহপাঠী?

–কে? আমি? ঘোষালের? না তো! ও আমার চেয়ে পাঁচ ক্লাস উঁচুতে পড়ত।

—ঘোষাল তো একষট্টির ব্যাচ। ম্যাট্রিকের। তুমি কত সালে পাস কর?

—বিটুইন য়ু অ্যান্ড মি, স্যার। আমি ম্যাট্রিক পাস করিনি।

–তোমরা এক স্কুলে পড়তে না?

—পড়তাম। ও আমার চেয়ে পাঁচ ক্লাস ওপরে পড়ত।

বাসু বললেন: আই সি!

বাস্তবে কিন্তু সব কিছুই গুলিয়ে গেল তাঁর। তাহলে ঘোষাল কেন পুরীতে বলেছিল ওরা একই বছর, একই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেছিল?

বাসুসাহেবের মনে হলো—ঠিকই বলেছিলেন রানু: তিনি ছুঁচোর মতো অন্ধ।

বিশে এসে বললো, মা জানতে চাইলেন, খানা কি লাগানো হবে?

বাসু বললেন, লাগা।

.

চিকেন-অ্যাস্প্যারাগাস স্যুপ, মিক্সড-ফ্রায়েড-রাইস, চিলি-চিকেন, চাওমিঙ আর ফ্রায়েড প্রন। ঐ সঙ্গে শ্যামপুকুরের কড়াপাক। লাঞ্চটা জমল ভালোই। আহারের অবকাশে ইন্দ্রকুমার জানতে চাইলো, সুজাতা-কৌশিক হঠাৎ দু-দিনের জন্য কোথায় গেল?

অম্লানবদনে বাসুসাহেব বললেন, ভুবনেশ্বর।

—অ্যাবে শবরিয়ার দেহটা কবর থেকে তোলার ব্যাপারে?

বাসু ফ্রায়েড প্রন চিবোতে চিবোতে বললেন, ওরা কখন কোথায় যায়, কী করে, তা কি আমাকে জানায়? কে ওদের এমপ্লয় করেছে তাও তো জানি না।

—কেন? ব্রজদা তো বললো, সে-ই করেছে।

—তাহলে তাই।

ইন্দ্রকুমার এবার রানুর দিকে ফিরে বললে, আপনারা একবার গালুডি ঘুরে আসুন, মাসিমা। গ্র্যান্ড জায়গা। শীতকালেই ভালো। হোটেলটাও বেশ সুন্দর। খাওয়া-থাকার ব্যবস্থাপনাও ভালো।

রানুর মনে ছিল। তবু জানতে চান, কী যেন নাম হোটেলটার?

—’সুবর্ণরেখা’! কলকাতা থেকেই ঘর বুক করা যায়। গেলে আপনারা ব্রজদার বড় ভ্যানটা নিয়ে যাবেন—বাই রোড—তাহলে হুইল-চেয়ারটা নিয়ে যাওয়ার সুবিধা হবে।

বাসু নির্লিপ্তের মতো জানতে চান, তুমি কদ্দিন ছিলে ওখানে?

—হপ্তাখানেক। গিয়েছিলাম ও মাসের তেইশে, আর ফিরে এলাম সোমবার ত্রিশে।

—ওখানে থাকতেই ডাক্তারের মৃত্যুসংবাদ পেলে বুঝি?

—হ্যাঁ। উনত্রিশে, রবিবারে শিবুদাকে একটা এস.টি.ডি করেছিলাম, ঐ হোটেল থেকে। ধরল অ্যাগি। তার কাছেই শুনলাম মর্মান্তিক খবরটা—রবিবার রাত্রে। পরদিন সকালের ট্রেনে ফিরে এলাম কলকাতায়।

বাসু জানতে চান, হোটেল থেকে সুবর্ণরেখা নদী কতদূর?

—হাঁটাপথ। তাছাড়া ফুলডুংরি নামে ঘাটশিলাতে একটা পাহাড় আছে। গাড়ি নিয়ে তার মাথায় উঠে যেতে পারবেন মাসিমাকে সঙ্গে নিয়ে। ভা-রি সুন্দর দৃশ্য। বসুন, আপনাদের দেখাই।

কাঁটা-চামচ দিয়ে আহার করছিলেন ওঁরা, হাত ধুতে হলো না। ইন্দ্রকুমার ব্রিফকেস খুলে একতাড়া রঙিন ফটোগ্রাফ বার করে আনল। সুন্দর ফটো উঠেছে। সুবর্ণরেখার উপলবঙ্কুর জলোচ্ছ্বাস, অনাদ্যন্তকাল প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থাকা জলমগ্ন পাথর, মাছরাঙার শিকার ধরা, পাথুরে পথ, গাছ-গাছালি, সূর্যাস্তদৃশ্য, ফুলডুংরি, বিভূতিসদন, ‘ইস্‌মাইল প্লিজ’ গ্রুপ ফটো। সৰ্বসমেত ত্ৰিশটা। পোস্টকার্ড সাইজ।

বাসুসাহেবের সন্ধানী চোখে নজর হলো, ফটোর নিচে কোনায় তারিখটা ছাপা আছে প্রতিটি ক্ষেত্রে। ইলেকট্রনিক হরফে—চেকের নম্বর যে ভাষায় লেখা হয়। বাসু জানতে চাইলেন, এটা কী ক্যামেরা গো? তারিখও ছাপা পড়েছে দেখছি!

ইন্দ্র বললে, জাপানী ক্যামেরা। জোজো না গোজো কী যেন নাম। দারুণ ক্যামেরাটা। সব কিছু অটোমেটিক। অ্যাপারচার, টাইমিং কিছুই অ্যাডজাস্ট করতে হয় না। বিষয়বস্তুটা ভিয়ু- ফাইন্ডারের ভিতর আছে কিনা ঠিকমতো দেখে নিলেই হলো। আলো কম থাকলে আপনিই ফ্ল্যাশ বা জ্বলবে। অপ্রয়োজনে জ্বলবে না। তার উপর, যে-তারিখে ছবিটা তোলা হয়েছে তাও নেগেটিভে ছাপা হয়ে যাবে।

বাসু জানতে চান, কোথায় কিনেছিলে ক্যামেরাটা? দাম?

—কিনেছিলাম ওসাকাতে। পঁচাত্তর সালে। ইন্ডিয়ান কারেন্সিতে দাম পড়েছিল হাজার দেড়েক। কলকাতায় পাওয়া যায় কি না জানি না। কী আশ্চর্য ক্যামেরা দেখুন—ওরা দুটো ফি ব্যাটারি দিয়েছিল, কিন্তু আজ বিশ বছরের ভিতর ব্যাটারি বদলাতে হয়নি। কোনোরকম মেরামতি করতে হয়নি। ভিতরটা খুলেই দেখিনি কখনও। ক্যামেরাটা এখনো যেন ব্র্যান্ড নিউ।

বাসু বললেন, আমাকে একবার ক্যামেরাটা দেখিও তো, ইন্দ্র!

ইন্দ্রকুমার মাথা নেড়ে বললে, এক্সট্রীমলি সরি, স্যার! ওটা নেই। খোয়া গেছে।

রানী চমকে ওঠেন—সে কি! কবে? কী করে?

ইন্দ্রকুমার সে বেদনার কাহিনীটি সবিস্তারে পেশ করে। অ্যাগির কাছ থেকে দুঃসংবাদ পেয়ে সে যখন ত্রিশ তারিখ, সোমবার কলকাতার ফিরে আসে তখন ওর মাথার ঠিক ছিল না। ক্যামেরাটা জানলার হুক থেকে টাঙিয়ে রাখে। হাওড়ায় পৌঁছে সেটা নামাতে ভুলে যায়।

বাসু বলেন, তার আগেই রিলটা শেষ হয়েছিল নিশ্চয়।

—হয়েছিল। নতুন একটা রিল ভরাও হয়েছিল।

বাসু তারিখ অনুযায়ী ছবিগুলো সাজাতে থাকেন। বাইশ তারিখ, রবিবারে তোলা হয়েছে নয়টা ফটো, তেইশে তিনটে, চব্বিশে কোনো ছবি নেই, পঁচিশে একটা, ছাব্বিশে তিনটে, সাতাশে চারটে, আটাশে ছয়টা, উনত্রিশে চারটে, ত্রিশে কোনো ছবি তোলা হয়নি। একুনে ত্রিশটি ফটোগ্রাফ।

বাসু জানতে চান, এই ত্রিশটি ছবির নেগেটিভ তোমার কাছে আছে?

—আছে। কেন বলুন তো?

—তাহলে এই ত্রিশটা ছবি আপাতত আমার কাছে থাক।

—কেন? আপনি কী করবেন?

—টোপ হিসাবে ব্যবহার করব।

—মানে?

—ওরা দুজন ভুবনেশ্বর থেকে ফিরে এলে ওদের দেখাব। লোভে পড়ে যদি রাজি হয়, তাহলে ঘোষালের এই কেসটা মিটলে আমরা চারজন গালুডি যাব। সুবর্ণরেখা হোটেলে দিন সাতেক কাটিয়ে আসব।

ইন্দ্রকুমার খুশি মনেই ছবিগুলো রেখে গেল।

.

আহারান্তে ইন্দ্রকুমার বিদায় হলে রানু জানতে চাইলেন, তুমি ফটোগুলো রাখলে কেন, বল তো?

—ছবিগুলোই তো কনক্লুসিভ প্রমাণ যে, ডাক্তার ঘোষালের মৃত্যুর সঙ্গে ইন্দ্রকুমারের কোনও সম্পর্ক’ নেই। এর অনেকগুলিতেই ইন্দ্র সে এক্সপোজার দিয়েছে। প্রমাণ হচ্ছে, বাইশে অক্টোবর থেকে ত্রিশে অক্টোবর ইন্দ্রকুমার ছিল গালুডিতে।

রানু বললেন, আমি আগেই বলেছিলাম, ওদের গালুডি পাঠাচ্ছ অহেতুক।

—না, না, অহেতুক নয়! মাঝে মাঝে ওদের মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে, ওরা শুধু সুকৌশলীর পার্টনারই নয়—বিবাহিত জীবনেও পার্টনার। শুধু হেঁটোয় কাঁটা-মুড়ো কাঁটা, কাঁটা থামতে না থামতেই আবার কাঁটা—এ সব ভালো নয়।

রানু হাসতে হাসতে বলেন, তাই বুঝি?