ড্রেস-রিহার্সালের কাঁটা – ৫

পাঁচ

পরদিন সকাল।

চক্রতীর্থ রোডে পান্থনিবাসের কাছাকাছি এসে বাসুসাহেব রিকশাওয়ালাকে থামতে বললেন। রিক্শা থেকে নেমে একটি দোকানের দিকে এগিয়ে গেলেন, যার সামনে বোর্ডে লেখা আছে : আই. এস. ডি. এস. টি. ডি., জেরক্স। দোকানে ঝাড়পৌঁছ করছিল একটি ছোকরা।

সে ওড়িয়া ভাষায় বললে, দোকান এখনো খোলেনি। বেলা দশটায় খুলবে। দোকানের মালিকবাবু দশটার সময় আসবেন। আধঘণ্টা পরে।

বাসু হাতঘড়িতে দেখলেন সওয়া-দশটা বাজে।

বাসু জানতে চান, আই. এস. ডি.?

—আইজ্ঞা?—সম্মার্জনীহস্ত ছোকরা চাকরটা ঘুরে দাঁড়ালো।

বাসু হাতঘড়িটা দেখিয়ে বললেন, অখন দশটা বাজিকিরি পন্দের মিনিট হই গেলা। আমর আধঘণ্টা পরে পৌনে এগারোটা বাজিবেক! বটে কি না?

ছোকরা বললে, তো মুই কী করিব? বাবু কহিল…

—কারেক্ট! য়ু আর হেল্পলেস! অ্যাজ আয়াম!

—আইজ্ঞা?

—টুল-ফুল কিছু আছে? তাহলে এই বারান্দায় একটা পেতে দাও। বসি। পৌনে এগারোটার সময়েই যে দশটা বাজবে তা তো আর নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।

ছোকরা নিক্কথায় একটা হাতলভাঙা চেয়ার বারান্দায় বার করে দিল। ঝাড়ন দিয়ে মুছেও দিল। বাসু জুত করে বসেই লক্ষ্য করলেন দোকানের সামনে, রাস্তার বাঁ দিকে একটি ফিয়াট গাড়ি থামল। নেমে এল সুভদ্রা : এখানে কী করছেন?

—শবরীর প্রতীক্ষা। একটা এস. টি. ডি. করব।

—আপনাদের বাড়িতেই তো ফোন আছে!

—তা আছে। কিন্ত এস. টি. ডি-র ব্যবস্থা নেই। তুমি কোথায় যাচ্ছ?

—সামনের ঐ ‘পুরী ফটোগ্রাফিক স্টোর্সে’। আপনি উঠে আসুন তো। আমাদের বাড়ি চলুন। সেখান থেকে এস. টি. ডি. করবেন।

—না, মা! ‘যেথায় চলেছ যাও তুমি ধনি/সময় যখন আসিবে আপনি/যাইব তোমার ডেরাতে।

—কেন? আমাদের বাড়ি থেকে এস. টি. ডি. করতে আপত্তি কিসের?

—একটা ভাউচার চাই। এভিডেন্স! তুমি যাও মা। আমি অপেক্ষা করি।

—ভাউচার চান, না আসলে ফোনটা গোপনে করতে চান?

—আমি কাকে, কেন ফোন করছি, তুমি জান?

—জানি না। আন্দাজ করছি। কলকাতায়। জানতে, গ্লাসের তলানিতে বিষের হদিস পাওয়া গেল কি না। তাই নয়?

—ওরে বাবা! তুমি যে মস্ত গোয়েন্দা হয়ে উঠেছ! কি করে আন্দাজ করলে? আমার তো ধারণা ছিল, ব্যাপারটা আমরা গোপনে করছি।

—তাই করছেন। আমাকে যিনি বলেছেন, তিনিও কথাটা গোপন রাখতেই বলেছেন।

—অহেতুক একটা করে দত্তের ‘ন’ লাগাচ্ছ কেন? ইন্দ্রকে তুমি তো ‘তুমি’ বলেই কথা বল!

—আপনি কি করে বুঝলেন, ইন্দ্রদা বলেছে?

—’গোয়েন্দা’ হিসাবে তোমার মতো আমার নামডাক নেই। কিন্তু তাই বলে ‘অন্ধ’ হিসাবে বদনামও তো নেই! শোন, আমি এই দোকানেই অপেক্ষা করছি। তুমি ফেরার পথে এখানে একবার দাঁড়িও। আমি ফটোগুলো দেখব। হয়তো দু-একদিনের জন্য নেগেটিভগুলো আমার দুরকার হবে।

—কোন্ ফটোর কথা বলছেন আপনি?

—বললাম না, আমি অন্ধ নই? তুমি এক কাজ কর বরং—দোকানদারকে এক কপি কন্ট্যাক্ট প্রিন্ট দিতে বল। যে সিকোয়েন্সে নেগেটিভগুলো আছে তাই বজায় রেখে

—আপনি আশা করছেন টেলিফোনে পজেটিভ রিপোর্ট পাবেন? হার্টফেল নয়? পয়েজনিং?

—‘আশা’ নয় সুভদ্রা। ‘আশঙ্কা’। না, করছি না। তবু ক্রিমিনাল-লইয়ার হিসাবে এটা আমার প্রায় অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে: ‘যেখানে দেখিবে ছাই/উড়াইয়া দেখ তাই/পাইলে পাইতে পার’ গোপন গরল!

—ঠিক আছে, স্যার। আপনি ‘গোপন গরল’ খুঁজুন। আমি ফেরার পথে খোঁজ করব! ঠিক তখনই এসে উপস্থিত হলো দোকানদার।

—নমোস্কার, আইজ্ঞা!

বাসু ফোন করলেন ওঁর বাল্যবঙ্কু ও সহপাঠী ফরেনসিক কেমিস্টকে। একবারেই কানেকশন পেলেন। প্রশ্ন করলেন, গুড-মনিং ভট্টাচার্যি। আমি পুরী থেকে পি. কে. বাসু বলছি। এখান থেকে অশোক চ্যাটার্জি নামে একজনের হাতে যে স্যাম্পলটা…

কথাটা উনি শেষ করতে পারলেন না। ডক্টর ভট্টাচার্যি বলে ওঠেন, জাস্ট অ্যা মিনিট, স্যার! আমার স্ত্রীর নামটা বলুন?

—কী? তোমার স্ত্রী? ও আই সি! আরে, হ্যাঁ রে জগু, আমি প্রসন্নই বলছি। তোর বউ- এর নাম জয়া, মেয়ের নাম রেখা, নাতির নাম বাবলু। হলো তো?

—হ্যাঁ ভাই, হলো। বুঝতেই তো পারছিস। এটা প্রফেশনাল এথিক্স। তোর হাতের লেখা চিঠি পেয়েছি। ব্যস! কে খুন হলো, কত লাখ টাকার সম্পত্তি, কী কেস, কিছুই জানি না। সিল করা বোতলে পেয়েছিলাম 4.5 ড্রাম তরল পদার্থ, অর্থাৎ প্রায় চারশ ফোঁটা!

—আই নো! তাতে ভদ্‌কা ছিল, লাইম ছিল। আর কি ছিল?

—এইচ-টু-ও!

—জল? কোনোরকম বিষের কিছু ট্রেস পাসনি?

—নিক্স!

—নিক্স? মানে নাথিং?

—আয়াম সরি। তাই। ‘ভদ্‌কা’ কিনা আদালতে হলপ নিয়ে বলতে পারব না, তবে কোনো ‘অ্যালকহল’, ভদ্‌কা বা জিন হতে পারে। ‘লাইম’ নিশ্চিত ছিল। বাকিটা জল।

—আই সি!

—খুব হতাশ হয়ে গেলি মনে হচ্ছে?

—না, নিশ্চিন্ত হলাম। যদিও এটা আমার অ্যাপ্রিহেনশনের বিরুদ্ধে। আমার আশঙ্কা ছিল এটা একটা কেস অব পয়েজনিং। ঠিক আছে! রাখলাম!

টেলিফোনের চার্জ মিটিয়ে বেরিয়ে এলেন রাস্তায়। মিনিটখানেক একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেন সমুদ্রের দিকে। রোদ চড়া হচ্ছে। ছাতা আনতে ভুলেছেন। টুপিও পরেননি। পুরী সমুদ্রতীরে টুপি পরা এক বিড়ম্বনা। সর্বদাই মনে হয় উড়ে যাবে। নজর হলো ফটোগ্রাফিক স্টোর্সের পাশে আকাশী-নীল ফিয়াট গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। বাসু পায়ে পায়ে সেদিকে এগিয়ে চললেন।

কাউন্টারে দাঁড়িয়ে সুভদ্রা ছবিগুলো দেখছিল। বাসুসাহেবকে দেখতে পেয়ে বললো, টেলিফোনে যোগাযোগ হলো?

—হ্যাঁ, হলো!

—গোপন গরল’ মিলল?

—তোমার কাজ মিটেছে?

—হ্যাঁ! তবে আপনি কি একসেট কন্ট্যাক্ট প্রিন্ট চান—নেগেটিভ যে-সিকোয়েন্সে আছে সেই পর্যায়ক্রমে?

—না, থাক। আর প্রয়োজন হবে না।

—নেগেটিভগুলো নেবেন?

—না, চাই না। চলো তোমাদের বাড়ি যাই।

—আসুন।

ভ্যানিটি ব্যাগে ছবিগুলো ভরে নিয়ে সুভদ্রা বাইরে বেরিয়ে এল। বাসুসাহেবকে বসালো বাঁয়ে। গাড়ি ঘুরিয়ে চক্রতীর্থ রোডে পড়ে বললো, আপনার ‘আশা’ বা ‘আশঙ্কা’ যে ‘সফল’ হয়নি—অর্থাৎ গ্লাসে যে বিষের ট্রেস পাওয়া যায়নি তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কারণ ছবিগুলো আপনি তাকিয়েও দেখলেন না!

বাসুসাহেব কোনো জবাব দিলেন না।

সুভদ্রা আবার বললে, আপনি কি করে ভাবতে পারলেন মেসোমশাই যে, অ্যাবে শবরিয়াকে কেউ বিষপ্রয়োগে হত্যা করতে পারে? ভদ্রলোকের কোনো সম্পত্তি নেই, কোনো শত্রু নেই। রাগের মাথায় হঠাৎ কেউ হয়তো ওঁকে ছুরি মেরে খুন করতে পারে; কিন্তু রায়কাকুর বাড়িতে পার্টিতে এসে ওঁর পানপাত্রে কে বিষ মেশাতে যাবে? ইটস অ্যাবসার্ড!

—ঠিক কথাই। কিন্তু কী জান,সুভদ্রা? আমি তো স্বচক্ষে ওঁকে মারা যেতে দেখেছি। খণ্ডমুহূর্তের জন্য আমার মনে হয়েছিল, এটা বিষক্রিয়ার যন্ত্রণা—হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়াতেই উনি লুটিয়ে পড়েছিলেন; কিন্তু তার পূর্বে একটা তীব্র বিষের প্রতিক্রিয়া আমি স্পষ্ট লক্ষ্য করেছিলাম!

—এখন তো বুঝছেন সেটা ভ্রান্ত ধারণা?

বাসু জবাব দিলেন না।

সুভদ্রা বললে, কৌশিকদার জন্যে আমার দুঃখ হচ্ছে।

—কৌশিকদা! কেন? কৌশিকের কথা উঠছে কোন সূত্রে?

—কৌশিকদার ‘কাঁটা-সিরিজ’-এর একটা দুর্দান্ত প্লট এলেবেলে হয়ে গেল। ধরুন, আপনি যদি পজেটিভ রিপোর্ট পেতেন, তাহলে জয়ন্তের তোলা ফটোগুলো এখন পরপর সাজিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন। কৌশিকদা কোনো মাসিক পত্রিকায় গল্পটা ছাপতে দিত। পাঠক-পাঠিকা ভাবতে বসত—এই এগারো জনের মধ্যে কে খুনটা করতে পারে? এগারো জনের ফুলটিম সাস্পেক্ট!

—এগারো জন?

—তাই হচ্ছে না হিসেব অনুসারে? আমরা ছিলাম তেরো জন। একজন তো খুন হলেন। মিসেস্ মারিয়া শবরিয়াকেও ছাড় দিতে হয়! বাকি রইলাম আমরা এগারো জন।

—অশোক চ্যাটার্জি বাদ?

—ও! হ্যাঁ! অশোকদার কথা আমার খেয়াল ছিল না। আসুন, মেসোমশাই, আমরা পৌঁছে গেছি।

.

মিসেস্ গুণবতী মোহান্তি বাইরের বারান্দাতেই একটা ডেকচেয়ারে বসেছিলেন। উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করে বললেন, আসুন, আসুন, স্যার! আপনার মতো মানুষের পায়ের ধুলো…

বাসু বাধা দিয়ে বললেন, পথে সুভদ্রার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ভাবলাম তোমাদের বাড়িটা ঘুরেই যাই।

—খুব ভালো করেছেন। আসুন।

ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। রাষ্ট্রমন্ত্রী মোহান্তি বেশ ভালো সম্পত্তিই রেখে গেছেন। প্রকাণ্ড বাড়ি। আসবাবপত্রও খুব দামী। গুণবতী বললেন, ইন্দ্রকুমারের জন্মদিনের পার্টিটা যে এমন করুণভাবে শেষ হবে তা কে ভেবেছিল বলুন?

বাসু জানতে চান, মিসেস্ মারিয়া শবরিয়া কোন ঘরে আছেন?

গুণবতী জানালেন, গুনপুর থেকে ওঁর স্বজনেরা এসে তাঁকে স্বগ্রামে নিয়ে গেছে।

সুভদ্রা জানতে চায়, বলুন মেসোমশাই, কী বানাবো? কফি না চা?

বাসু বললেন, দুটোর একটাও নয়। তুমি মা, আমার জন্যে বরং এক গ্লাস লেবুর সরবত বানিয়ে নিয়ে এস।

—শুধু সরবত?

—এবারের মতো।

সুভদ্রা সরবত বানাতে ভিতরে চলে গেল। বাসু বলেন, ভারি মিষ্টি স্বভাবের মেয়েটি তোমার।

—বাইরে থেকে আপনাদের তাই মনে হয়। আসলে বাপের আদরে সুভোর মাথাটি খাওয়া হয়ে গেছে।

—একথা কেন বলছ? বি. এ. পাস করেছে। শুনেছি, ভালো কুচিপুড়ি নাচ জানে। ড্রাইভিং-এর হাত যে ভালো তা তো স্বচক্ষে এখনি দেখলাম। সুপাত্রে বিয়ে না হবার জীবনে সুখী না হবার কোনো কারণ তো দেখছি না।

—সুপাত্রের দিকে ওর নজরই নেই। বঙ্কুগুলি তো সব বাঁদর। চাল নেই, চুলো নেই – র সঙ্গে ছোঁক-ছোঁক করে ঘোরে, শুধু ওর বাপের সম্পত্তির দিকে নজর

বাসু জানতে চান, জয়ন্ত ছেলেটিকে তোমার কেমন লাগে?

—কী আছে বলুন তার? কোন এক অ্যাডভার্টাইজিং কোম্পানিতে কাজ করে। কী পায়, মাইনে পায়, না কমিশন, তাও জানি না। নিজের বাড়িঘর নেই, গাড়ি নেই। চাল নেই, চুলো নেই।

—কিন্তু ওর রূপ আছে, যৌবন আছে, সুস্বাস্থ্য আছে। উচ্চাশা আছে। গাড়ি-বাড়ি তো সুভদ্রারই থাকবে।

কথাটা পছন্দ হলো না গুণবতীর। জবাব দিলেন না।

বাসু আন্দাজে একটা টোপ ফেললেন, ইন্দ্রকুমারকে তোমার কেমন লাগে?

—ইন্দ্রকুমার? সে তো সুভোর ডবল বয়সী। সুভোর ছাব্বিশ, ওর ছাপ্পান্ন! আপনারা তেতাল্লিশ বলে চালালেই হলো?

—না, অত হবে না। যা হোক, তোমাদের সমাজে কি ভালো ছেলে পাচ্ছ না?

—পাব না কেন? সুভদ্রার বাবার এক বঙ্কু পুরীর নামকরা পাণ্ডা। একটি মাত্র পুত্র তার, বলভদ্র রথ। অগাধ সম্পত্তির মালিক। এগারোটি উনান আছে, তার, বুঝলেন? এক-একটা উনানে যদি দৈনিক হাজার টাকার ভোগ বিক্রি হয় তবে কত হলো? দৈনিক এগারো হাজার মাসে খরচ-খরচা বাদে তিন লাখ! বুঝেছেন? মাসে তিন লাখ! নেট! ইনকাম ট্যাক্স নেই,

সেল্ ট্যাক্স নেই! বছরে নেট ছত্রিশ-লক্ষ তঙ্কা! তিন বৎসরেই কোটিপতি!

বাসু উনানের হিসাবটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না। এটুকু বুঝলেন মিসেস্ মোহান্তি হিসেবে খুব দড়। তবে এ বিষয়ে আর কোনো কথা হলো না। সুভদ্রা ফিরে এল ঘরে, সরবতের গ্লাসটা নিয়ে। উৎসব রজনীর রঙিন আলোকচিত্রের বান্ডিলটা বার করে মায়ের হাতে দিল। অগত্যা বাসুকেও দেখতে হলো। উনি বিশেষ করে লক্ষ্য করলেন সেই ছবিটি যখন অ্যাবে শবরিয়া গ্লাসটার দিকে হাত বাড়াচ্ছেন। না, কেউ বিশেষ কোনো একটা গ্লাস ‘ফোর্সিং-কার্ড ম্যাজিকে’র মতো ওঁর হাতে গছিয়ে দেয়নি।

একটু পরে রোদ বেড়ে উঠছে বলে উঠে পড়েন বাসু। সুভদ্রা বলে, আসুন মেসোমশাই, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে গাড়ি গ্যারেজ করি।

অগত্যা তাই।

বাড়ির দোরগোড়ায় নামিয়ে গিয়ে বিদায় নিল সুভদ্রা। বললো, সুজাতাদিকে বলবেন, আজ বেলা হয়ে গেছে। আর একদিন আসব। মাসিমাকেও প্রণাম দেবেন।

.

বাসু ঘরে ঢুকতেই রানী জিজ্ঞাসা করলেন, কী? আমার কথাই ফলল তো? গ্লাসে কিছু ছিল না নিশ্চয়—

বাসু শার্টটা খুলতে খুলতে বললেন, কী করে জানলেন, মিসেস্ শার্লক হোমস্?

—এলিমেন্টারি, মাই ডিয়ারেস্ট ওয়াটসন। গ্লাসে কিছু পাওয়া গেলে তোমার ফিরতে অনেক দেরি হতো। প্রথমে ইন্দ্রকুমার, ব্রজবাবু। তারপর পুলিস, ভাইকারেজ—নানান ঝক্কিঝামেলা সারতে হতো তোমাকে। তাছাড়া শার্টের পকেট থেকে একটা এস. টি. ডি. বুথের টিকিট তুমি ওয়েস্ট-পেপার বাস্কেটে ফেলে দিলে। এভিডেন্সটার কোনো দাম নেই।—অর্থাৎ ফোনটা তোমার করা হয়েছে। রেজাল্ট নেগেটিভ। তুমি স্বীকার কর আর নাই কর। শোন, এদিকে সকাল থেকে ছায়া পালিত তোমাকে তিনবার ফোন করেছে। তুমি বেরিয়ে যাবার পরেই একবার। ঘণ্টাখানেক বাদে একবার; এই তো আধঘণ্টা আগে একবার।

–কী বক্তব্য তার?

—আমাকে বলেনি। সে শুধু জানতে চেয়েছে তুমি আছ কিনা।

—ওরা স্বামী-স্ত্রী তো ব্রজদুলালের গেস্ট? একটা ফোন কর। দেখি ছায়া কী বলতে চায়।

রানী ডায়াল করলেন। ও-প্রান্তে বোধহয় কোনো ভৃত্যশ্রেণীর কেউ ধরল ফোনটা। রানী ছায়া পালিতকে চাইলেন। মিনিট তিনেক পরেই ছায়ার কণ্ঠস্বর শোনা গেল : হ্যালো?

—মিস্টার পি. কে. বাসু ফিরেছেন। নাও কথা বল।

বাসু স্ত্রীর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বললেন, বল ছায়া?

—আমরা আজ কলকাতা ফিরে যাচ্ছি; শ্রীজগন্নাথ এক্সপ্রেসে। সুজাতাকে আমার কার্ড দিয়েছি। আমার দোকানের ঠিকানাও। একদিন যদি সময় করে আসেন খুব খুশি হব।

—তা তো হবে; কিন্তু এই কথাটা জানাবার জন্য নিশ্চয় তুমি সকাল থেকে তিন-তিনবার ফোন করনি। আসল কথাটা কী?

—আসল কথাটা তো বলব না, মেসোমশাই। শুনব!

—তাই নাকি? কী বিষয়ে?

—গ্লাসের তলানিতে কী পাওয়া গেল সেই বিষয়ে!

বাসু একটু চমকে উঠলেন। ক্যাপ্টেন পালিত আর ছায়া যখন চলে যায় তখনো মদের গ্লাসের প্রসঙ্গই ওঠেনি। পণ্ডা ডেথ-সার্টিফিকেট দিয়ে গেছেন। ভাইকারেজ থেকে মৃতদেহ বহনের গাড়িটাও তখনো এসে পৌঁছয়নি। তার আগেই ক্যাপ্টেন পালিত রীতিমতো বে- এক্তিয়ার হয়ে গিয়েছিল। সে বোধহয় সে-রাত্রে জানতেই পারেনি যে, পার্টিতে একটা লোক মারা গেছে। ছায়া পালিত প্রথম সুযোগেই স্বামীকে সরিয়ে নিয়ে উপরের ঘরে উঠে যায়। তাহলে সে কেমন করে জানল এই গূঢ় সংবাদ?

বাসু বললেন, তুমি কেমন করে জানলে?

—সেটা কি টেলিফোনে বলা ঠিক হবে, স্যার?

—তা যদি না হয় তাহলে তোমার প্রশ্নের জবাবটাও কি আমার পক্ষে টেলিফোনে বলা ঠিক হবে, ছায়া?

—তা বটে! খুব কি বেলা হয়ে গেছে? আমি একবার আসতে পারি? জাস্ট আধঘণ্টার জন্য? কারণ আজই আমরা ফিরে যাচ্ছি তো। আমি যেটুকু জানতে পেরেছি তা আপনাকে জানিয়ে যাওয়া আমার কর্তব্য এবং আমি যেটা জানতে চাইছি—আপনার আপত্তি না থাকলে—সেটা জেনে যেতে চাই। আসব?

—এস! এমন কিছু বেলা হয়নি। এখন সাড়ে বারোটা।

—তাহলে খবরটা গোপন রাখবেন—আই মিন আমার আসার কথাটা। অবশ্য আপনার বাড়ির চারজন তো জানবেই।

–বাড়িতে আমার পাঁচজন।

—তাই নাকি? পঞ্চম ব্যক্তিটি কে?

—আমাদের কম্বাইন্ড হ্যান্ড, বিশ্বনাথ। বিশে। এস তুমি। আমরা অপেক্ষা করছি।

ফোনটা ক্র্যাডলে নামিয়ে রাখলেন। রানী বললেন, আবার নতুন করে কী রহস্য ঘনিয়ে তুলছ তোমরা?

—আমরা?

—হ্যাঁ! তুমি আর ছায়া পালিত!

—নতুন রহস্য কেন হবে? তুমি তো এখনো জানই না গ্লাসের তলানিতে কী-কী পাওয়া গেছে। নিজের আন্দাজমতো কল্পনা করে ভুল ধারণা নিয়ে খুশি হয়ে বসে আছ!

–ভুল ধারণা! তাহলে ফরেনসিক রিপোর্ট পজেটিভ? ঐ তলানিতে কিছু পাওয়া গেছে?

—অফ কোর্স! মিসেস্ হোমস্। পাওয়া গেছে! যার খবর ডক্টর ওয়াটসন জানে, মিসেস্ হোমস্ এখনো জানেন না।

—কী? কী ছিল তলানিতে?

—ট্রেসেস্ অব অ্যালকহল, লাইম কর্ডিয়াল আর…

—আর?

—তুমি বিশ্বাসই করতে পারবে না : এইচ-টু-ও!—জল!

—মানে?

—‘মানে’টা বোঝা ভা—রি শক্ত!

ছয়

বাসু বললেন, এঁর সঙ্গে তোমার আলাপ নেই…

বাধা দিয়ে ছায়া পালিত বললে, না আছে, মেসোমশাই। আজকেই তিন-তিনবার টেলিফোনে কথা বলেছি মাসিমার সঙ্গে। তাছাড়া কৌশিকবাবুর কাঁটা সিরিজের কল্যাণে মিসেস্ রানু বাসু একজন পরিচিত মহিলা—অন্তত গোয়েন্দা গল্পের পাঠক-পাঠিকার কাছে।

—তাহলে তো তুমি জানই যে, উনি আমার একান্ত সচিব। আমাকে যা বলতে পার, তা ওঁর সামনে বলায় কোনো অসুবিধা নেই।

মিসেস্ পালিত জানতে চায়, কৌশিকবাবু আর সুজাতা…

—তারা আজ টুরিস্ট বাসে কোনারক দেখতে গেছে। ফিরতে সন্ধে…তুমি বরং শুরু কর—কী যেন বলতে এসেছ?

ছায়া বললে, আমি জানি, আপনি খুব ‘মেথডিক্যাল’। তাই প্রথমেই বলি : আমি দুটি প্রসঙ্গে আলোচনা করতে এসেছি। একটা হচ্ছে আমার ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যা। সেটা বর্ণনা করে আপনার কাছে কিছু লিগ্যাল-অ্যাডভাইস্ নেব। দ্বিতীয়টা অ্যাবে শবরিয়ার মৃত্যু সংক্রান্ত। আমরা প্রথমে কোন প্রসঙ্গটা আলোচনা করব?

—দ্বিতীয়টা। তুমি প্রথমেই ব্যাখ্যা করে বোঝাও—টেলিফোনে তখন কেন জানতে চেয়েছিলে ‘গ্লাসের তলানিতে কিছু পাওয়া গেল?’ গ্লাসের তলানি নিয়ে যে একটা পরীক্ষা করা হচ্ছে এ-কথা তোমাকে কে বলেছে?

—কেউ বলেনি, মেসোমশাই। এটা আমার অনুমান। মানে ‘ডিডাকশন’! আপনি সম্ভবত সকালবেলা কলকাতায় একজন ফরেনসিক এক্সপার্টকে টেলিফোন করে এ বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। তিনি কী উত্তর দিয়েছেন তা জানি না।

—সেটাই বা কী করে জানলে?

—তাহলে প্রথম থেকে বলি। মেথডিক্যালি! অ্যাবে শবরিয়া ভদ্‌কা পান করে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়ার সময়ে আপনার মনে যে প্রশ্নটি জেগেছিল, আমার মনেও ঠিক একই কারণে, একই প্রশ্ন জেগেছিল।

—প্রশ্নটা কী? আর ‘একই কারণে’ বলতে?

—প্রশ্নটা তো ‘মৃত্যুর কারণ’—হার্ট-অ্যাটাক, না বিষপ্রয়োগ? প্রশ্নটা মনে উদয় হয়েছিল একাধিক হেতুতে। প্রথম কথা, অ্যাবে শবরিয়ার গলায় ঐ অদ্ভুত শব্দটা হতেই আমরা সবাই তাঁর দিকে তাকিয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল উনি যেটা পান করেছেন তার জন্যই ওঁর কষ্ট হচ্ছে। হার্ট-অ্যাটাক হলে রোগী অনিবার্যভাবে, প্রতিবর্তী প্রেরণায়, ডানহাতে তার বুকের বাঁ দিকটা চেপে ধরে—কারণ যন্ত্রণাটা হয় তার হৃদপিণ্ডে। অ্যাবে শবরিয়া তা করেননি। তিনি তাঁর গলায় হাত দিয়েছিলেন—অর্থাৎ কণ্ঠনালীটা তাঁর জ্বলে যাচ্ছিল।

বাসু বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, ওয়ান্ডারফুল! এদিকটা কিন্তু আমিও ভেবে দেখিনি। তারপর?

তৎক্ষণাৎ আমার মনে হলো : বিষক্রিয়ায় যদি মৃত্যু হয়ে থাকে তাহলে ওঁর গ্লাসটা একটা মারাত্মক এভিডেন্স! ততক্ষণে সবাই ওঁকে ঘিরে ধরেছে। আমি ওঁকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। একটু পরে—দশ থেকে পনের সেকেন্ড পরে—ডক্টর ঘোষাল সবাইকে সরিয়ে অ্যাবে শবরিয়ার দেহটার দায়িত্ব নিলেন। ভিড়টা ফাঁকা করে দিলেন। তখনই আমার নজরে পড়ল, অ্যাবে শবরিয়ার গ্লাসটা টেবিলে রাখা আছে। ঐ টেবিলে তখন একটাই কাচের গ্লাস ছিল। ফলে চিনতে কোন অসুবিধা হলো না। আমি নজর করে দেখলাম, গ্লাসের তলায় আধ-চামচ মতো তলানি আছে। অ্যাবাউট এ টেবিলস্পুনফুল।

—কনগ্র্যাচুলেসন্স, ছায়া, ফর য়োর প্লেনডিড অবজার্ভেশন। তোমাকে বলি, গ্লাসে 4.5 ড্রাম তরল পদার্থ ছিল—অর্থাৎ বড় চামচের এক চামচ। বলে যাও!

—আমি আপনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম। আমার মনে হলো, বিষপ্রয়োগের সম্ভাবনার কথাটা আপনিও নিশ্চয় ভাবছেন। তারপর ডক্টর পণ্ডা এলেন। তিনি যখন অ্যাবে শবরিয়ার দেহটা পরীক্ষা করছেন তখন লক্ষ্য করে দেখলাম, আপনি উঠে গিয়ে হেড-ওয়েটারকে কী যেন বললেন।

—কারেক্ট। কী বলেছিলাম আমি?

—তা হলপ নিয়ে আদালতে দাঁড়িয়ে বলতে পারব না; কিন্তু যুক্তিপরম্পরায় অনায়াসে ডিডিয়ুস করা যায়। কারণ আপনার কথা শুনে হেড়-বেয়ারা সম্মতিসূচক গ্রীবা সঞ্চালন করলো। আমি আরও লক্ষ্য করে দেখলাম—বেয়ারা তিনটি টেবিল থেকে ভুক্তাবশিষ্ট প্লেট ও গ্লাস উঠিয়ে নিয়ে গেল; কিন্তু যে টেবিলে আপনি, মিস্টার রায় আর অ্যাবে শবরিয়া বসেছিলেন সেই টেবিলটা সাফা করলো না। আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না—ঐ বিশেষ গ্লাসটার প্রতি শুধু আমার নয়, আপনারও নজর আছে। ইতিমধ্যে আমার স্বামী একেবারে বে- এক্তিয়ার হয়ে পড়েছিলেন। তাই আমি নিশ্চিন্ত হয়ে একজন বেয়ারার সাহায্যে তাঁকে নিয়ে দ্বিতলে উঠে গেলাম। আমি নিশ্চিত জানতাম যে, আপনি ঐ গ্লাসের তলানি সম্বন্ধে যথাকর্তব্য করবেন। পরদিন সকালে আমার কর্তার ঘুম ভাঙলো দশটার পর, কিন্তু সকালেই আমি খবর পেলাম মিস্টার অশোক চ্যাটার্জি কলকাতা চলে গেছেন—কী একটা জরুরি কাজে! পরের দিনটা আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি—নানা কারণে। সকলেই নানা কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আজ সকালে আপনাকে ফোন করেছিলাম। মাসিমা বললেন আপনি বেরিয়েছেন। বেলা দশটা নাগাদ আমি নিজেও বেরিয়ে পড়লাম। চক্রতীর্থ রোডে হঠাৎ নজর হলো, আপনি একটি এস. টি. ডি. বুথের সামনে একা বসে আছেন। আমি সেদিকে অগ্রসর হবার আগেই একটি ফিয়াট গাড়ি এসে দাঁড়াল। আমি সামনের একটা চায়ের দোকানে বসে সবকিছু নজর করতে থাকি। আপনি বেরিয়ে যাবার পর আমি ঐ দোকানে যাই। দোকানদারকে বলি, ‘বাবা একটু আগে ফোন করে চলে যাবার সময় পেমেন্টের টিকিটটা নিয়ে গেছেন, না এখানেই ফেলে রেখে গেছেন মনে করতে পারছেন না। কাইন্ডলি একটু খুঁজে দেখবেন?’ লোকটা বললো, ‘খুঁজে দেখার কিছু নেই। আমার স্পষ্ট মনে আছে প্যান্টের বাঁ-পকেটে সেটা নিয়েছিলেন উনি।’ আমি বললাম, ‘সেটা তাহলে পড়ে গেছে রাস্তায়। যে নম্বরে ফোন করেছিলেন সে নম্বরটাও ওঁর মনে পড়ছে না। কাইন্ডলি একটু দেখে বলবেন?’ লোকটা দশ সেকেন্ড আমার দিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকল। তারপর বললো, ‘আপনার বাবাকে দোকানে আসতে বলবেন। আপনাকে আমি তা জানাতে পারি না।’ আমি বললাম, ‘কেন? বাবাই তো আমাকে পাঠালেন!’ লোকটা বললো, ‘সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই, ম্যাডাম, কিন্তু এটার নিয়ম নেই।’

বাসু দম্পতি হেসে ওঠেন। মিসেস্ বাসু বলেন, তুমি খুবই চালাক। লোকটা কিন্তু তোমার উপর টেক্কা দিয়েছে।

বাসু বলেন, তা নাও হতে পারে। এটা হয়তো ওর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। তাই মিন প্রফেশনাল এথিক্সটা। সে যাই হোক, তাহলে তুমি কী করে জানলে কলকাতায় আমি কাকে ফোন করেছিলাম?

—আজ্ঞে না। সেটা জানি না। ডিডিয়ুস করেছি। আন্দাজ করছি। এক নম্বর : পরদিন ভোরেই অশোকবাবুর কলকাতা যাওয়ায়। দু নম্বর : পরদিনই আপনি কলকাতায় এস. টি. ডি. করায়।

বাসু এতক্ষণে স্বীকার করলেন, হ্যাঁ, ছায়া; তুমি ঠিকই ডিডিয়ুস করেছ। আমরা ঐ গ্লাসের তলানিটা কলকাতায় পাঠিয়ে ছিলাম ফরেনসিক টেস্ট করাতে। রেজাল্ট ইজ নেগেটিভ। বিষের কোনো ট্রেসই পাওয়া যায়নি।

ছায়া স্পষ্টতই হতাশ হলো।

বাসু বললেন, এবার কি আমরা প্রথম প্রসঙ্গটায় আসব? তোমার ব্যক্তিগত সমস্যাটায়?

—না, মেসোমশাই। আমার মনে হয়, যেটা আমি বলতে এসেছিলাম তা পুরোপুরি বলেই ফেলি—ঐ অ্যাবে শবরিয়ার মৃত্যু সংক্রান্ত ঘটনাটাকে ঘিরে। যদিও বিষের ট্রেস না পাওয়া যাওয়ায় এসব কথা বাহুল্য আলোচনা। তা হোক, আপনি যখন তদন্ত করছেন, তখন সব কিছুই আপনার জানা থাকা দরকার। কাজে লাগুক বা না লাগুক।

—বল তাহলে?

ছায়া জানালো আর একটি ঘটনার কথা। পার্টির আগের রাত্রের ঘটনা। ওরা দ্বিতলে পর- পর পাঁচখানি ঘরে আতিথ্য গ্রহণ করেছিল। প্রথমটায় ব্রজদুলাল একা, দ্বিতীয়ে ডাক্তার ঘোষাল, তিন নম্বরে ইন্দ্রকুমারও একা, চতুর্থে ক্যাপ্টেন ও মিসেস পালিত, পঞ্চমে অ্যাবে এবং মিসেস্ শবরিয়া। অনুরাধা ছিল ত্রিতলে। প্রতিটি ঘরেই আছে অ্যাটাচড বাথ। সে রাত্রেও, অর্থাৎ শুক্রবার রাত্রেও ক্যাপ্টেন পালিত মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান করে এবং মধ্যরাত্রে ঘরে বমি করে ফেলে। ঘরে কার্পেট নেই; কিন্তু ময়লাটা তো সাফা করতে হবে? ছায়া দেখল, বাথরুমে কোনো ঝাঁটা নেই। ওর মনে পড়ল তিনতলায় ওঠার বাঁকের মুখে একটি ল্যাট্রিন আছে—সাধারণ ব্যবহারের জন্য। ও দেখতে চাইল সেখানে কোনো ব্রাশ বা ঝাঁটা পাওয়া যায় কি না। তাহলে চুপিসাড়ে রাতারাতি ঘরটা সাফা করে দিতে পারবে। রাত তখন সাড়ে বারোটা। নিঃশব্দে দরজা খুলে ও করিডোরে বার হয়ে আসে। দু-পা চলতে গিয়েই নজরে পড়ে সামনে বারান্দার রেলিঙে ভর দিয়ে দুজন কথা বলছেন। আরও নজরে পড়ে পাশের ল্যাট্রিনটা বন্ধ, আলো জ্বলছে। ঐ ল্যাট্রিনের দরজায় একটা ছোট্ট কাচের নির্দেশক। ভিতরে কেউ থাকলে, আলো জ্বললে, সেখানে লেখা ফুটে ওঠে : এনগেজড।

ছায়া পিলাস্টারের আড়ালে অন্ধকারে অপেক্ষা করলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মধ্যরাত্রে আলাপরত ব্যক্তিদ্বয়ের দু-একটা ছুটকো কথা ও শুনতে পেল। চোখে না দেখলেও কণ্ঠস্বরে বুঝতে পারে, ডক্টর ঘোষাল আর ইন্দ্রকুমার। ও একটু অবাক হলো। এঁরা দুজনেই একক শয্যাবিশিষ্ট ঘরে আছেন। তাহলে বারান্দায় বার হয়ে এসে কথা বলছেন কেন? হঠাৎ একটা কথায় চমকে উঠল ছায়া। ইন্দ্রকুমার বলছে, ‘আমাকে আর নীতিকথা শোনাতে আসিস না রে, শিবু। তোর বৃন্দাবনলীলার কথা কি আমি জানি না মনে করিস?’

ছায়া সবচেয়ে বেশি অবাক হলো ভাষাটায়। ইন্দ্রকুমার সর্বসমক্ষে ডক্টর ঘোষালকে ‘ঘোষালদা’ বা ‘শিবুদা’ বলে কথা বলে। ‘তুই-তোকারি’ করে না।

বাসু বললেন, আমি শুনেছি ওরা বাল্যবঙ্কু। একই গ্রামের ছেলে। সহপাঠী। হয়তো আড়ালে দু-জনেই তুই তোকারি করে। সভ্যসমাজে করে না—ইন্দ্রকুমারের ঐ নায়কোচিত বয়সটার খাতিরে। যা হোক, তারপর কী হলো?

ছায়া বললে, ডক্টর ঘোষাল চাপা গলায় ধমক দিলেন। সম্ভবত বলেছিলেন ‘ডোন্ট বি ভালগার ইন্দ্র’ বা ঐ জাতীয় কিছু। যাহোক ঠিক সেই সময়েই ওদিককার ল্যাট্রিনের দরজাটা খুলে যায়, আর অ্যাবে শবরিয়া বার হয়ে আসেন। তিনি ওদের দুজনকে ওখানে দেখে যেন আঁৎকে ওঠেন! কিন্তু কিছু বলার আগেই ইন্দ্রকুমার তাঁকে ধমক দেয়, ‘একি! আপনি এখানে কী করছেন?’ অ্যাবে শবরিয়া বলেন, ‘কী বলছেন মশাই? দেখতেই তো পেলেন, আমি ল্যাট্রিনে গেছিলাম।’ ইন্দ্র আবার ধমক দেয়, ‘কেন? আপনার ঘরেই তো অ্যাটাচ্‌ড বাথ ডাবলু সি আছে! তাহলে?’ অ্যাবে ইংরেজিতে বলেন, ‘আপনি কি আমার কৈফিয়ৎ চাইছেন? কেন আমি ঐ টয়লেট গেছি?”

ইন্দ্র চাপা গর্জন করে ওঠে, ‘নো স্যার! আমি জানতে চাই কেন আপনি আড়ি পেতে আমাদের কথা শুনছিলেন!’ অ্যাবে শবরিয়া একথার জবার দেন না। ডাক্তার ঘোষালের দিকে ফিরে বলেন, ‘ওয়েল ডক্টর! আপনারা যদি মধ্যরাত্রে কোনো কিছু গোপন বিষয়ে আলোচনা করতে চান তো এই পাবলিক প্লেসে কেন? দু-দুটো ফাঁকা ঘর তো আপনাদের জন্য প্রতীক্ষা করছে।’ ডক্টর ঘোষাল বোধহয় বঙ্কুর হয়ে মাপ চাইতে এগিয়ে গেলেন। ছায়া নিঃশব্দে নিজের ঘরে ঢুকে যায়। মিনিট পনের পরে উঁকি মেরে দেখে করিডোর নির্জন। তখন সে দ্বিতীয়বার যায় সম্মার্জনী সন্ধানে।

বাসু বললেন, ঠিক আছে, ছায়া। তোমার মনে হয়েছে, তুমি যেটুকু জেনেছ তা আমাকে জানানো তোমার কর্তব্য। তুমি তা জানিয়েছ। গ্লাসের তলানিতে যদি বিষের হদিস পাওয়া যেত, তাহলে হয়তো তোমার ঐ কথাগুলোকে অন্যমাত্রায় বিচার করার প্রয়োজন হতো। আপাতত ঘটনাটা নিরর্থক। এবার তাহলে তোমার দ্বিতীয় প্রসঙ্গে আসা যায়। কী তোমার সমস্যা, যার জন্য তুমি আমার পরামর্শ চাইছ?

ছায়া একটু ইতস্তত করে বললো, কিছু মনে করবেন না, মেসোমশাই। প্রথমেই আমি জেনে নিতে চাই—এই লিগ্যাল অ্যাডভাইস নিতে আমার কী পরিমাণ খরচ হবে!

বাসু হাসলেন। বললেন, আমি এখানে বেড়াতে এসেছি, ছায়া। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার—আমার পরামর্শ নিতে তোমাকে কোনো খরচ করতে হবে না। তুমি কি তোমাদের ‘ডিভোর্স’ সম্বন্ধে আলোচনা করতে চাইছ? সেক্ষেত্রে প্রথমেই বলে রাখি, এসব কেস আমি সচরাচর করি না। তবে তোমার সঙ্গে ভালো আইনজ্ঞ ব্যক্তির যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারব। অথবা কেসটা জটিল মনে করলে হয়তো নিজেই কেসটা নিতে পারি। ইন্‌সিডেন্টাল খরচটুকুই লাগবে তোমার। মেসোমশাইকে ফিজ দিতে হবে না।

ছায়া বললে, আমি মুখ খোলার আগেই তো আপনি বুল্স-আই হিট্ করে বসে আছেন। আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আমি ‘নটরঙ্গে’ ড্রেস-ডিজাইন করে এবং বুটিকের দোকান থেকে যা রোজগার করি তাতে আমার স্বচ্ছন্দে চলে যাবার কথা। যায়ও। আমি ভাড়া বাড়িতে থাকি। সেল্ফ-ড্রিভন গাড়ি চালাই। আমাদের কোনো সন্তানাদি নেই। কিন্তু জগৎ এত বেশি মদ খায় যে, মাসের শেষে টানাটানি পড়ে যায়। সোশ্যালি আমি কারও সঙ্গে মিশতে পারি না। বঙ্কুবান্ধবকে সন্ধেবেলা নিমন্ত্রণ করতে পারি না। ওকে একলা রেখে সন্ধের পর কোথাও বের হতেও ভয় হয়!

বাসু জানতে চান, ক্যাপ্টেন পালিত কি কখনো ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠে? হাত চালায়!

—নো, নেভার! ও মদ খায় ফ্রাস্ট্রেশন থেকে। সেজন্য ওকে আমি করুণা করি। সেজন্যই বিবাহ-বিচ্ছেদের কথা এতদিন ভাবিনি। ওকে…ইয়েস, আমি ভালোবাসি…..যদিও সে ভালোবাসার উৎসমূলে নিছক করুণাই! কিন্তু ও এখন সংশোধনের বাইরে। অনিবার্যভাবে চলেছে ‘লিভার সিরোসিসের’ দিকে। আমি কী করব? আমি কী করতে পারি? ও কারও কথা শুনবে না। মদ্যপানের পরিমাণ কমাবে না। এভাবে যদি আরও দশ-পনের বছর বেঁচে থাকে তাহলে আমি তো নিঃশেষ…

হঠাৎ মুখে আঁচল চাপা দিল ছায়া।

বাসু ওকে কিছুটা সামলে নেবার সময় দিতে পকেট থেকে পাইপ-পাউচ বার করলেন। বাইরের বারান্দায় উঠে গেলেন। মিনিট-পাঁচেক পরে পাইপ টানতে টানতে ফিরে এসে বসলেন তাঁর সোফাটায়। বললেন, একটা কথা আগে বল ছায়া, তোমাদের কোনো সন্তানাদি হয়নি কেন? অনিচ্ছাটা কার? তোমার না ক্যাপ্টেনের?

—দুজনের একজনেরও নয়!

—আই সি। তা শারীরিক গণ্ডগোলটা কার?

—আমার নয়।

—ক্যাপ্টেন কি ডাক্তার দেখিয়েছে?

জবাব দিতে একটু দেরি হলো ছায়ার। কীভাবে এ প্রশ্নের জবাব দেবে যেন বুঝে উঠতে পারছে না। বাসু বললেন, ডাক্তার আর উকিলের কাছে কিছু গোপন করতে নেই, ছায়া। তুমি কি বলতে চাও ও চিকিৎসার বাইরে?

গ্রীবা সঞ্চালনে ছায়া স্বীকার করলো।

বাসু একবার রানু আর একবার ছায়ার দিকে তাকিয়ে দেখলেন। কী একটা কথা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। রানু স্বামীর দিকে ফিরে বললেন, তোমার অনুমতি পেলে আমি ওকে একটা প্রশ্ন করতাম—

—অফ কোর্স! বাই অল মিস্! আস্ক হার! আমরা একটা সত্য খুঁজে বেড়াচ্ছি। বাস্তব অবস্থাটা।

রানু বললেন, ছায়া, তুমি আমাকে এই কথাটার জবাব দাও শুধু—ক্যাপ্টেন পালিত কি শুধু পিতা হবার জন্যেই অনুপযুক্ত, নাকি স্বামী হবার পক্ষেও?

ছায়া রানুর দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল। বললো, আপনি ঠিকই আন্দাজ করেছেন মাসিমা। আমি ওকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম—অনাথ আশ্রম থেকে একটি শিশু নিয়ে এসে তাকে দত্তক নিই! জগৎ তাতে রাজি হয়নি।

বাসু ঝুঁকে পড়ে জানতে চাইলেন, কেন?

ছায়া শ্রাগ করলো।

রানু প্রশ্ন করেন, কিন্তু বিয়ের আগে কি ও বুঝতে পারেনি যে, ও স্বামী হবার অনুপযুক্ত? একটি পূর্ণযৌবনা রমণীকে ও তৃপ্তি দিতে পারবে না?

ছায়া ঝুঁকে পড়ে রানুর হাতটা তুলে নিয়ে নিম্নস্বরে বললো, আপনারা যাই বলুন, সেই জন্যেই ওকে অত ভালোবেসে ফেলেছি, মাসিমা। ও যখন আমাকে বিয়ে করতে আসে তখন ওর বয়স সাতাশ। এতটা বয়সেও ওর প্রাকবিবাহ জীবনে কোনো যৌন-অভিজ্ঞতা হয়নি। লোকটা এতই অবিশ্বাস্য রকমের সরল!

বাসু বলেন, দ্যাটস্ ইম্পসিবল! সাতাশ বছরের একজন শিক্ষিত ছেলে ‘বিয়ে’ শব্দটার জীববিজ্ঞানসম্মত অর্থ জানে না?

—তা তো বলিনি আমি! ও ছিল হান্ড্রেড পার্সেন্ট সৎ! প্রাকবিবাহ জীবনে ওর কোনো যৌন-অভিজ্ঞতা ঘটেনি। এটাই বলেছি। আই নো—এটা বাস্তবে অবিশ্বাস্য—তবু এটাই ঘটনা। আমাকে বিয়ে করার পর সে ঐ নিদারুণ সত্যটা বুঝতে পারে; স্বামী হিসাবে ও নিঃস্ব। শুধু সন্তান নয়, স্ত্রীর জৈবিক মর্যাদাটুকুও ও মিটিয়ে দিতে পারবে না। কী নিদারুণ ট্র্যাজেডি বুঝে দেখুন, মাসিমা! ওই নিষ্ঠুর বাস্তব সত্যটা সে প্রণিধান করলো সাতাশ বছর বয়সে—বিবাহ করার পর! সে কতখানি অবিশ্বাস্য রকমের সৎ যৌনজীবন যাপন করেছে প্ৰাকবিবাহ জীবনে, ভেবে আমি ওকে করুণা করতে শুরু করি। চিকিৎসা করাই—কিছু হয় না। আমি ওকে প্রস্তাব দিই : এস, মনে করা যাক আমরা সন্ন্যাস নিয়েছি। আমরা একটি অনাথকে দত্তক নিই। আগেই বলেছি, ও রাজি হয়নি। মদের মাত্রা বাড়িয়ে গেছে। চাকরি খুইয়েছে। আমি ওকে সান্ত্বনা দিই—ও শান্ত হতে পারে না। দত্তক ও নেবে না। মদ্যপানের মাত্রা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। বাস্তবে ও আত্মহত্যা করছে। বিষপানের বদলে মদ্যপানে। লোকটা শিশুর মতো সরল।

হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় ছায়া পালিত। একটু উত্তেজিত হয়ে চাপা গলায় বলে, আয়াম সরি। আয়াম এক্সট্রিমলি সরি, মেসোমশাই! প্লিজ এক্সকিউজ মি ফর ওয়েস্টিং য়োর ভ্যালুয়েবল টাইম। না! ভুল বলেছিলাম! আমি ডিভোর্স চাই না। যে-কটা দিন বাঁচবে ওর ইচ্ছামতো স্লো- পয়েজিনিং-এর যোগান আমি দিয়ে যাব। সরি স্যার। আমি চলি।

ঝড়ের বেগে ও এগিয়ে যায় নির্গমন দ্বারের দিকে।

বাসু রানুর দিকে ফিরে শুধু বললেন, ‘কত অজানারে জানাইলে তুমি…’

.

বিকেল চারটে নাগাদ টেলিফোন করলেন ব্রজদুলাল।

—গুড আফটারনুন, ব্যারিস্টারসাহেব! আমি ব্রজ বলছি। একটু আগে কলকাতা থেকে অশোক এস. টি. ডি. করেছিল। ও কাল সকালে ফিরে আসছে। আপনি যে ডাঃ ভট্টাচার্যির কেমিস্ট শপে ওকে পাঠিয়েছিলেন সেখান থেকে ও রিপোর্ট পেয়েছে। সেটা নিয়েই আসছে। আপনি বোধহয় রিপোর্ট ইতিমধ্যে পেয়ে গেছেন, তাই না?

বাসু বললেন, হ্যাঁ, সকালবেলা টেলিফোনে আমি জেনেছি। আশঙ্কাজনক কোনোকিছুই ঐ গ্লাসের তলানিতে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ অ্যাবে শবরিয়ার হার্টফেলই হয়েছে।

—আগামী রবিবার পনের তারিখ গুনপুরে বিলকে সমাধিস্থ করা হবে। আমি এখানকার ভাইকারেজের সঙ্গে কথা বলে সেই রকম ব্যবস্থাই করেছি। গুনপুর চার্চ-এর অ্যাবটও এসেছিলেন পুরীতে। আমরা ঐদিন একটা গাড়ি নিয়ে গুনপুর যাচ্ছি ফিউনারালে উপস্থিত থাকতে। আপনি কি আসতে পারবেন?

—আজ্ঞে না। বুঝতেই তো পারছেন আমার অবস্থা। মিসেস্ বাসুকে নিয়েও যাওয়া যাবে না, রেখেও যেতে পারব না। তবে গাড়িতে জায়গা হলে সুজাতা বা কৌশিক একজন কেউ যেতে পারে।

—গাড়িতে জায়গা হবে না কেন? আমি তো বড় ভ্যানটা নিয়ে যাব। ক্যাপ্টেন পালিত আর ছায়া তো আজ ফিরে যাচ্ছে, ডক্টর ঘোষালও আজই চলে যাচ্ছেন। রাত দশটার গাড়িতে। ইন্দ্রও অতদিন থাকবে না বলছে…

—ঠিক আছে। আমি সুজাতার সঙ্গে কথা বলে আপনাকে জানাব।

—অলরাইট, স্যার। একটু লাইনটা ধরুন, ঘোষাল আপনার সঙ্গে কথা বলবে।

ডক্টর ঘোষাল বললেন, রাত দশটার গাড়িতে উনি কলকাতামুখো রওনা দেবেন। তার আগে—বাসুসাহেব সময় দিতে পারলে—উনি এখানে এসে বিদায় নিয়ে যেতে পারেন।

বাসু বললেন, বাই আল মিনস্। য়ু আর ওয়েলকাম।

প্রায় আধঘণ্টা পরে ডক্টর ঘোষাল এলেন। একাই। নানান সৌজন্যমূলক কথাবার্তা হলো। বাসুকে উনি আমন্ত্রণ জানালেন ওঁর চুঁচুড়ার মানসিক হাসপাতাল পরিদর্শন করে যেতে।

রানু বললেন, এত তাড়াহুড়ো করে ফিরে যাচ্ছেন কেন? এসেই তো পড়লেন এক দুঃখজনক ঘটনার আবর্তে। সেটার জের মিটতে না মিটতেই….

বাধা দিয়ে ঘোষাল বললেন, তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে হচ্ছে দুটি বিশেষ জরুরি হেতুতে। বস্তুত প্রসঙ্গটা আমি নিজেই তুলতাম—বাসুসাহেবের অ্যাডভাইস নিতে

বাসু বলেন, কী ব্যাপার? বলুন শুনি।

—সকালবেলা আমাদের ওখানে দু-দুটো বাইরের কল আসে। প্রথমটা অশোকের, অশোক চ্যাটার্জির। ঐ ফরেনসিক রিপোর্ট—গ্লাসে ভদ্‌কা, লাইম কর্ডিয়াল আর জল ছাড়া কিছু পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ ন্যায়শাস্ত্রে যাকে ‘রজ্জুতে সর্পভ্রম’ বলে, আমাদের তাই হয়েছিল। দ্বিতীয় ফোনটা করে আমার স্যানাটোরিয়ামের সিনিয়ার মেট্রন অ্যাগি ডুরান্ট। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহিলা। এই নার্সটি আমার স্যানাটোরিয়ামে আছেন নাহোক বিশ বছর। যেমন সৎ, সাহসী তেমনি দৃঢ়চেতা, বিশ্বাসী…

বাসু বাধা দিয়ে বলেন, এক্সকিউজ মি ডক্টর, অ্যাগি বোধহয় ‘অ্যাগনেস্’ শব্দের ডাকনাম। ‘অ্যাগনেস্’ একটা গ্রিক শব্দ, অর্থ : পবিত্র। আর ‘ডুরান্ট’ সারনেমটা এসেছে প্রাচীন ফরাসী ভাষা থেকে। অর্থ : enduring. উনি সেদিক থেকে সার্থকনামা।

মিসেস্ বাসু চাপা ধমক দেন, অহেতুক কথার মধ্যে বাধা দাও কেন বল তো? বলুন, ডক্টর ঘোষাল।

—হ্যাঁ, যা বলছিলাম। অ্যাগি দু-দুটো খবর দিল। যে জন্য আমাকে তাড়াতাড়ি, আজই, ফিরে যেতে হচ্ছে। আমার একটি পেশেন্ট—ইন ফ্যাক্ট, তার কথা আপনাদের বিস্তারিত বলেছি, কুন্তী দোসাদ—তার অবস্থা হঠাৎ খারাপ হয়ে পড়েছে। সে বোধহয় আমাকে খুঁজছে।

কথা বলতে পারে না তো…

বাসু জানতে চান, দ্বিতীয় খবরটা কী?

মিসেস্ বাসু বোধহয় কুন্তী দোসাদ সম্বন্ধে আরও কিছু শুনতে চান ডক্টর ঘোষালের কাছ থেকে। কিন্তু এবার আর কর্তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন না।

ঘোষাল বললেন, দ্বিতীয় খবরটা অ্যালার্মিং। অন্তত চিফ মেট্রনের ধারণায়। একটা বেগানা লোক—তার ভাষা মস্তান টাইপের—টেলিফোন করে আমার খোঁজ করছে। জানতে চাইছে আমি কোথায়, ডাক্তার শালা কবে ফিরবে এসেট্রা। অ্যাগির ধারণা : লোকটা সেই কাল্লু শেখ, অথবা তার কোনো চ্যালা-চামুণ্ডা। অ্যাগি জানে, কাল্লু ছাড়া পেয়েছে।

রানু বলেন, সেজন্য আপনি তাড়াহুড়া করে ফিরে যাচ্ছেন?

—খালটা আমিই কেটেছি মিসেস্ বাসু! সেই খাল বেয়ে যদি কুমির উজিয়ে আসে আর আমার চিফ মেট্রন ভয় পায়, তাহলে আমাকে ছুটে যেতে হবে বইকি।

বাসু জানতে চান, ঐ লোকটা ক বার ফোন করেছিল?

—একবারই। অ্যাগির ধরণা সে ‘লোকাল কল’ করেনি। সম্ভবত চিনসুরার বাইরে থেকে কল করেছে। কিন্তু তার ভাষা আর ঔদ্ধত্য থেকে ওর মনে হয়েছে—

বাসু জানতে চান, আপনার কোনো ফায়ার আর্মস্ আছে? পিস্তল জাতীয়?

—না। কোনোদিন প্রয়োজন হবে বলে মনে করিনি।

—আপনার নার্সিংহোমে দারোয়ান নেই? তার কোনো ফায়ার-আর্মস্ নেই?

—দারোয়ান আছে। কিন্তু স্যানাটোরিয়ামে ‘ক্যাশ’ তো তেমন কিছু থাকে না। তাই বন্দুকধারী দারোয়ানের দরকার হবে ভাবিনি।

—আপনি কি দেহরক্ষী জাতীয় কোনো লোককে নিয়োগ করতে চান? আমার সঙ্গে আই. জি. ক্রাইম, বার্ডওয়ান রেঞ্জ-এর জানাশোনা আছে। আমি বিশ্বস্ত লোকের ব্যবস্থা করে দিতে পারি।

—সেই কথা আলোচনা করতেই আসা। অ্যাগির কথায় এখনি সেটা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। আগে নিজের জায়গায় ফিরে যাই। পরিস্থিতিটা নিজে সমঝে নিই। তারপর প্রয়োজন হলে আপনার সাহায্য নেব।

—শিওর! নির্দ্বিধায়। আমার ফোন নাম্বার তো জানেনই। আই মিন এই বাড়ির। আমি এখানে মাসখানেক থাকব। পূজার পর, ইনফ্যাক্ট কালীপুজার বোমা-পটকার বাৎসরিক আনন্দোৎসবের অত্যাচার শেষ হলে কলকাতা ফিরব। প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবেন। আমি এখান থেকেই আই. জি. ক্রাইমের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে ব্যবস্থাদি করে দেব।

—থ্যাঙ্কু স্যার!

বাসু জিজ্ঞাসা করেন, ব্রজদুলালের সঙ্গে আপনার কত দিনের আলাপ?

—তা বছর পাঁচেক হবে। ইন্দ্রর একটা নাটকের রজত জয়ন্তী হলো। সে সময় থিয়েটার দেখতে গিয়ে ব্রজদুলালের সঙ্গে প্রথম আলাপ। কেন বলুন তো?

বাসু সে কথার জবাব না দিয়ে বলেন, আর ইন্দ্রকুমারের সঙ্গে?

ঘোষাল বলেন, জনান্তিকে জানাই—আমরা একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়তাম। আমরা সহপাঠী। কিন্তু কথাটা জানাজানি হলে ‘তেতাল্লিশ বছরের’ নায়ক ইন্দ্রকুমার বিব্রত হবে। যেহেতু আমি পঞ্চাশোর্ধ্ব!

বাসু ও রানু হেসে ওঠেন। বাসু বলেন, কোন স্কুলে পড়তেন আপনারা দুজন? কলকাতায়?

—না। ধানবাদে। চিড়াগোড়া বয়েজ হাই স্কুলে। আমার বাবা ছিলেন ধানবাদের একজন ডাক্তার। আর ইন্দ্রের বাবা ওখানকার অ্যাসিস্টেন্ট স্টেশন মাস্টার। উনিশশো একষট্টিতে আমরা দুজনেই একসঙ্গে ম্যাট্রিক পাস করি। আমি ডিস্ট্রিক্ট স্কলারশিপ পাই। ও থার্ড ডিভিশনে পাস করে। ইন্দ্র ঐ বয়েসেই পাড়ার থিয়েটারে নাম করেছিল। একটা যাত্রাদলের সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে পালায়। প্রায় পাঁচ বছর পরে আমার সঙ্গে দেখা। আমি সে বছরই চুঁচুড়ায় স্যানাটোরিয়ামটা খুলে সবে বসেছি। কিন্তু এসব কথা প্রকাশ হলে ইন্দ্র লজ্জা পাবে। সর্বসমক্ষে সে আমাকে ‘শিবুদা’ কিংবা ‘ঘোষালদা’ বলে ডাকে।

—আর আড়ালে ‘তুই-তোকারি’ করে। তাই না?

ঘোষাল জবাব দিলেন না। হাসলেন।

বাসু হঠাৎ প্রশ্ন করে বসেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করি, ডক্টর ঘোষাল। গত শুক্রবার রাত একটার সময় আপনি আর ইন্দ্রকুমার যখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন তখন ল্যাট্রিন থেকে অ্যাবে শবরিয়া হঠাৎ বের হয়ে আসেন, তাই না? শবরিয়ার মৃত্যুর পূর্ব রাত্রির কথা বলছি আমি! ঘটনাটা নিশ্চয় মনে আছে আপনার? তখন ইন্দ্রকুমার অ্যাবে শবরিয়াকে হঠাৎ চার্জ করে : আপনি আড়ি পেতে আমাদের কথা শুনছিলেন কেন? মনে আছে নিশ্চয়? কী কথা আলোচনা করছিলেন আপনারা দুজন? কেন ইন্দ্রকুমারের মনে হলো, অ্যাবে শবরিয়া তা আড়ি পেতে শুনছিলেন! তার ঠিক আগেই ইন্দ্ৰ ‘বৃন্দাবনলীলা’ প্রসঙ্গে কিছু বলেছিল। অ্যাম আই কারেক্ট? আপনি যদি আমার সাহায্য চান, তাহলে আনুপূর্বিক ঘটনা আমাকে দয়া করে জানাবেন? আমার জানা থাকা দরকার।

ডক্টর ঘোষাল যেন বজ্রাহত হয়ে গেলেন। কোন অতীন্দ্রিয় ক্ষমতাবলে বাসুসাহেব সেই মধ্যরাত্রির জনান্তিক ঘটনাটা—যার দুজন সাক্ষীর একজন মৃত, দ্বিতীয় জন নিশ্চয় স্বীকার করবে না—তা ঐ বৃদ্ধ জেনেছেন, তা বুঝে উঠতে পারেন না। দীর্ঘ মিনিট খানেক তিনি নির্বাক তাকিয়ে থাকলেন বাসুসাহেবের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, আমাকে মার্জনা করবেন, বাসুসাহেব। আমি শুনেছি, আদালতে আপনি অনেকবার অনেক ভেলকি দেখিয়েছেন। আদালতের বাইরেও যে তা দেখাতে পারেন তা এইমাত্র জানতে পারলাম। কিন্তু আপনি যে প্রশ্নটা করেছেন তা আমার নিজের গোপন তথ্য নয়। অন্য কারও। তার কাছে আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে, কথাটা আমি গোপন রাখবো। আমাকে মার্জনা করবেন। এজন্য যদি আমাকে সাহায্য করতে অস্বীকৃত হন, তাহলে আমি নাচার!

বাসু বললেন, ভেলকির প্রসঙ্গ থাক। নিজেকে কোনো বিপদের সম্মুখীন মনে করলে আমার সাহায্য চাইবেন প্লিজ! আমি সাহায্য করতে প্রস্তুত!

.

রাত তখন সাড়ে নয়টা। বাসুসাহেব বসেছিলেন দক্ষিণের বারান্দায়। সস্ত্রীক। দুজনে দুটি ডেক-চেয়ার টেনে নিয়ে। আকাশে দ্বাদশীর চাঁদ। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে পুরীর সমুদ্রসৈকত। ঢেউয়ের মাথায়-মাথায় রূপালি হাতছানি। দু-একটা গাঙচিল সেই একপ্রহর রাতেও জলের কিনারে-কিনারে খাদ্যসন্ধান করে ফিরছে। রিক্শার সারি তখনো যাতায়াত করছে সামনের রাস্তা দিয়ে। বিশু ভিতর থেকে এসে জানতে চাইল, টেবিল লাগাবো কি?

বাসু বললেন, তোর দাদাবাবু-দিদিমণি তো এখনো ফেরেনি কোনারক দেখে।

বিশু নীরব রইল। রানু বললেন, আর আধঘণ্টা দেখি। রাত এমন কিছু বেশি হয়নি।

কথা বলতে বলতেই ওরা দুজন ফিরে এল। রিকশায় চেপে। যাত্রীবাহী বাস স্ট্যান্ডে এসে সব যাত্রীদের নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে যে-যার হোটেলে ফেরে।

বাসু জানতে চাইলেন, কেমন বেড়ালে?

কৌশিক বললে, ভালোয়-মন্দয়।

—কেন ‘মন্দটা’ আবার কী হলো?

কৌশিক জবাব দেবার আগেই রানু বলেন, আচ্ছা তুমি কেমন মানুষ গো? তুমি তো জানতে চাইতে পারতে ‘ভালো’টা কী হলো? সব সময়েই ‘মন্দ টা কী জানতে চাওয়া তোমার একটা বাতিকে দাঁড়িয়ে গেছে!

বাসু আত্মপক্ষ সমর্থন করেন, আহা-হা! তা কেন? স্বামী-স্ত্রীতে সারাদিন আউটিং করে ফিরল—এখানে তো আদ্যন্ত ভালোই হবার কথা। এর মধ্যে ‘মন্দ’ কী করে ঢুকল এটাই তো জানতে চাইব।

সুজাতা ওঁদের ঝগড়া থামিয়ে দিয়ে বলে, মাইনর একটা অ্যাক্সিডেন্ট। ‘বাঘ গুহা’ দেখে নামবার সময় পা-মচ্‌কে পড়ে গিয়ে—

—না, না, আমাদের দুজনের মধ্যে কারও নয়; আমাদের এক সহযাত্রিণীর—

কৌশিক বলে, ‘আমাদের এক সহযাত্রিণী’ না বলে বরং স্পষ্ট করে বল : ‘আপনাদের একজন পরিচিত মহিলা’।

—পরিচিত মহিলা! কে? কার কথা বলছ?

সুজাতা কৌশিককে বলে, তুমি ততক্ষণ গল্পটা বলতে থাক, আমি শাড়িটা পাল্টে গায়ে দু-ঘটি জল ঢেলে আসি। ঘামে গা প্যাঁচ প্যাঁচ করছে।

রানু বলেন, গিজারটা চালু করাই আছে। একেবারে ঠাণ্ডা জলে গা ধুয়ো না যেন—নতুন জায়গা, চেঞ্জ-অব-সিজনের সময়…

সুজাতা ঘাড় নেড়ে ভিতরে চলে যায়। কৌশিক জুতোর ফিতে খুলতে খুলতে ঘটনাটার বর্ণনা দেয়।

সকালবেলাঁ বাসটা ছেড়েছিল মেরিন ড্রাইভে, পুরী হোটেলের সামনে থেকে। কৌশিক আর সুজাতা বাসে উঠে দেখে সামনের একটি সিট দখল করে বসে আছে অনুরাধা। ওদের দেখেই সে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে : যাক বাবা! একেবারে একা-একা যেতে হবে না। কথা বলার লোক পাব!

কৌশিক-সুজাতা বসল ঠিক পিছনের সিটে। সুজাতা বললো, কেন? আর কেউ যেতে রাজি হলো না?

—সবাইকে অনুরোধ করিনি। দু-একজনকে বলেছিলাম, কিন্তু মনে হলো ঐ বৃদ্ধের—কী যেন নাম—আকস্মিক মৃত্যুতে ওঁরা এখনো আচ্ছন্ন। আমার বেড়াতে যাবার প্রস্তাবটা ওঁরা যেন ভালো চোখে দেখছেন না।

সুজাতা দেখে, অনুরাধা জানলার ধারে বসেছে। পাশের সিটটা ফাঁকা। ও জানতে চায় – নম্বর সিটটা কার?

অনুরাধা বললো, খোদায় মালুম! আমার জানার কী দরকার? প্রভু জগন্নাথের কৃপায় তার গায়ে ঘামের গন্ধ না থাকলেই হলো।

সুজাতা বললো, তেমন-তেমন বুঝলে আমি তোমার পাশের সিটে চলে যাব, বদ্-বু- ওয়ালা লোকটিকে আমার কর্তার পাশে বসিয়ে দেব।

অনুরাধা খিল খিল করে হেসে ওঠে।

বাসটা ছাড়ার সময়-সময় একটা চমক!

টাইট চোস্ত আর ঢিলে পাঞ্জাবি গায়ে সানগ্লাস চোখে আর ক্যামেরা কাঁধে আবির্ভূত হলেন নটকেশরী ইন্দ্রকুমার! সিটের নম্বর খুঁজতে খুঁজতে আসছিলেন তিনি। কী আশ্চর্য! দেখা গেল : অনুরাধার পাশের ফাঁকা সিটটাই অজান্তে বুক করেছেন তিনি।

কৌশিক সুজাতার কানে-কানে বলে, একেই ইংরেজিতে বলে ‘কোয়েন্সিডেন্স’; বাংলায় ‘কাকতালীয় ঘটনা’। ঘটনাচক্রে দুজনে আলাদা-আলাদা…

সুজাতা চাপা ধমক দেয় : থাম! যা বোঝ না, তা নিয়ে বক না। একে ইংরেজিতে বলে : ‘গিমিক’, আর সাদা বাংলায় : ন্যাকামি!

কৌশিক বলে, আই সি!

সুজাতার রাগ তখনো যায়নি। বলে, তা তো দেখবেই। গোয়েন্দা কিনা! চোকে খোঁচা দিয়ে কেউ যখন দেখাচ্ছে তখন তো দেখতেই হবে! অ্যাতো লুকোছাপার কী আছে তা ওরাই জানে!

বাসের দু-একজন যাত্রী-যাত্রিণী ঐ ফিল্মস্টার ইন্দ্রকুমার আর অনুরাধাকে চিনে ফেলল। তাদের কেউ-কেউ ওদের অটোগ্রাফও নিল। সুজাতা-কৌশিক নিজেদের গুটিয়ে নিল।

দুর্ঘটনাটা ঘটল উদয়গিরি-খণ্ডগিরিতে পৌঁছে। উদয়গিরি হস্তিগুম্ফা থেকে ব্যাঘ্রগুম্ফায় যেতে কয়েকটি পাথরের ধাপ পার হতে হয়। অনুরাধার পায়ে ছিল কিঞ্চিৎ হাইহিল জুতো—এমন ভ্রমণের সময় ঐ জাতীয় জুতো; কেন পরেছে তা সেই জানে—অনুরাধা পা মুচড়ে পড়ে যায়। প্রথমটা বোঝা যায়নি; কিন্তু পরে ওর পায়ে যন্ত্রণা হতে থাকে। ইন্দ্রকুমার ওকে নিয়ে একটা ফ্লাইং ট্যাক্সি ধরে ভুবনেশ্বরের দিকে ফিরে যায়। হাসপাতালে দেখাতে। তারপর আর তারা বাসে ফিরে আসেনি। কোনার্কে যায়নি।

বাসু বললেন, ব্রজদুলালের বাড়িতে একটা ফোন কর তো রানু।

ততক্ষণে জামা-কাপড় পাল্টে সুজাতা এসে গেছে। সে বসেছিল টেলিফোন যন্ত্রটার কাছাকাছি। তুলে ডায়াল করতে শুরু করে। কৌশিক বলে, বিশু, তুই টেবিল লাগা, আমি মুখ হাত ধুয়ে এখুনি এসে যাব।

ব্রজদুলালকে পাওয়া গেল। তিনি জানালেন, হ্যাঁ, ইন্দ্রকুমার ভুবনেশ্বর থেকে ফোন করেছিল। অনুরাধার পা-টা এক্সরে করা হয়েছে। হাড়-টাড় কিছু ভাঙেনি—লিগামেন্টে একটা টান ধরেছে। কাল বিকালের মধ্যেই ওকে ছেড়ে দেবে হাসপাতাল থেকে। ইন্দ্রকুমার বাধ্য হয়ে একটা হোটেলে উঠেছে। কাল বিকাল নাগাদ ওরা ফিরে আসবে।

খাবার টেবিলে সুজাতা বললে, অনুরাধা অ্যাকটিং করে জবর!

রানু বলেন, তুমি ওর অভিনয় দেখেছ? কোথায়? মানে কোন নাটকে?

—না, মামী, আমি স্টেজ-অ্যাকটিং-এর কথা বলছি না। ব্র্যাঘ্রগুম্ফায় ওর পতন ও মূর্ছার কথাটা বলছি।

—মূর্ছা?

—না, পুরোপুরি মূর্ছা নয়। তেতাল্লিশ বছরের নায়ক যদি ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিতে পারত, তাহলে অনু নির্ঘাৎ নিশ্চিন্ত হয়ে মূর্ছা যেত; কিন্তু বাহান্ন বছরের বৃদ্ধ ওর মাজা জড়িয়ে নিয়ে নামিয়ে নিয়ে এল কি না, তাই পুরোপুরি মূর্ছা যাবার সুযোগ অনু পেল না!

কৌশিক বলে, তোমরা…মেয়েরা না…

রানু বলেন, কী? বাক্যটা শেষ কর? মেয়েরা কী?

কৌশিক বাক্যটা শেষ করে : আয়াম সরি, মামী! আপনার দৃষ্টি দেখে বাক্যটা আমার হিরে গেছে’!

সাত

প্রায় তিন সপ্তাহ পরের কথা। ডক্টর ঘোষাল মারা গিয়েছিলেন অক্টোবরের আটাশ তারিখ। এই সংবাদটা ওঁরা পেলেন মাসের শেষদিকে—ত্রিশে অক্টোবর। সংবাদপত্রের পাঁচ নম্বর পৃষ্ঠায় মফঃস্বল- বার্তা বিভাগে। তা তো হতেই পারে। সংবাদপত্রের বৃকোদর ভাগ দখল করে বসে আছেন রাজনীতি ব্যবসায়ীরা। নির্বাচন জয় করে—তা সে যে- কোনো পদ্ধতির মাধ্যমেই হোক না কেন,—জনগণের মস্তকে পনস-বিদীর্ণ করে কীভাবে লুটেপুটে খাচ্ছেন তার বর্ণনা দিতেই কাগজের আধাআধি অবয়ব ঢাকা পড়ে যায়। তার উপর আছে খেলা, টি. ভি., সিনেমা, যাত্রা এবং বিজ্ঞাপন। মফঃস্বলে —কী ঘটল-না-ঘটল জানাবার অবকাশ কোথায়? সংবাদটা প্রথম নজরে পড়ে রানু দেবীর। তিনিই বাসুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আজ কাগজে দেখেছ? ডাক্তার ঘোষাল হার্টফেল করে মারা গেছেন!

রীতিমতো চমকে উঠেছিলেন বাসু : ডক্টর ঘোষাল? মানে চুঁচুড়ার শিবশঙ্কর ঘোষাল?

—হ্যাঁ, এই দেখ না, পাঁচ নম্বর পাতায়।

বাসু সংবাদপত্রটা ওঁর হাত থেকে গ্রহণ করে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিলেন। ডঃ ঘোষাল মারা গেছেন শনিবার আটাশে অক্টোবর। সেদিন তিনি কয়েকজন বঙ্কুবান্ধবকে নিজের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। নৈশভোজের টেবিলে নিমন্ত্রিতদের উপস্থিতিতেই তাঁর একটা ম্যাসিভ হার্ট-অ্যাটাক হয়। হাসপাতালে নিয়ে যাবার সময় পাওয়া যায়নি। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন একজন চিকিৎসক। তিনিই জানালেন—প্রবীণ চিকিৎসক ডঃ ঘোষাল নিঃশব্দে চলে গেছেন।

এর পর চার-পাঁচ পংক্তিতে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে এম. বি. বি. এস. ও পরে এম. ডি. পাস করেন। কিছুদিন পার্শীবাগান লেনে ‘ভারতীয় মনঃসমীক্ষা সমিতি’-তে গবেষণা করে ‘অ্যাবনর্মাল সাইকোলজি’ বিষয়ে পি. এইচ. ডিও করেন। পরে চুঁচুড়ায় একটি মানসিক নার্সিংহোম গঠনই তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি।

রানু বললেন, কার যে কখন ডাক আসবে কেউ জানে না।

বাসু বললেন, তা তো বটেই। কিন্তু কোয়েন্সিডেন্সটা লক্ষ্য করেছ? নৈশভোজের টেবিল, একাধিক নিমন্ত্রিতের উপস্থিতি, ‘ম্যাসিভ হার্ট-অ্যাটাক’। কোনো কিছু পান করতে করতে মারা যাননি তো?

রানু বলেন, তোমার সব উদ্ভট চিন্তা।

একটু দূরে বসে ইংরেজি সংবাদপত্র দেখছিল কৌশিক। সে বলে, না মামী! মামুর চিন্তা মধ্যে অসামঞ্জস্য কিছু নেই। ইংরেজি কাগজে লিখেছে, ‘While drinking from a glass of liquor..’ [মদের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে]

বাসুসাহেবের হাত ইতিমধ্যে পকেটে চলে গেছে—পাইপ-পাউচের সন্ধানে। বললেন, ব্রজদুলালকে ধর তো ফোনে।

ধরা গেল না। ব্রজদুলাল দিন সাতেক আগে সেই যে হাজারিবাগ চলে গেছেন, তারপর থেকে তাঁর আর কোনো খবর নেই। অ্যাবে শবরিয়াকে সমাধিস্থ করে ব্রজদুলাল তাঁর হাজারিবাগের বাড়িতে চলে যান। বাসুকে বলেছিলেন যে, শ্যামবাজারের ‘থিয়েটার হল টা বর্তমানে এয়ার-কন্ডিশনিং করা হচ্ছে। কাজটা শেষ হতে মাসখানেক লাগবে। ফলে পুরো মাসটাই ছুটি। সামনের মাস নাগাদ নতুন বই মঞ্চস্থ হবে।

ইন্দ্রকুমার কলকাতায় পৌঁছে একটা খবর দিয়েছিল। ফোনে বলেছিল যে, সে নাকি দিন পনেরর জন্য ঘাটশিলায় বেড়াতে যাচ্ছে। বাসু অতঃপর ফোন করলেন মিসেস্ মোহান্তির পুরীর ডেরায়। সেখানেও কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভবপর হলো না। মা-মেয়ে দিন সাতেক আগে কলকাতা গেছেন। কৌশিক বলে, মিসেস্ পালিতকে ফোন করব মামু, কলকাতায়?

বাসু বললেন, পণ্ডশ্রম! পালিত দম্পতির সঙ্গে ডক্টর ঘোষালের আলাপ এই পুরীতেই। খবরের কাগজে যদি নজরে না পড়ে থাকে তাহলে ছায়া এ খবরটা হয়তো জানেই না। আর ক্যাপ্টেন পালিত হয়তো মনেই করতে পারবে না যে, কোনো এক ডক্টর ঘোষালের সঙ্গে তার পুরীতে আলাপ হয়েছিল।

রানু বললেন, ঘাটশিলার উপর দিয়ে যে নদীটা বয়ে গেছে তার নামটা যেন কী? ঋত্বিক ঘটকের একটা ফিল্‌মও আছে ঐ নামে—

সুজাতা বলে, ‘সুবর্ণরেখা’!

রানু বলেন, ঠিক! ‘সুবর্ণরেখা!’ আমার বেশ মনে আছে ইন্দ্রকুমার ফোনে বলেছিল ঐ ‘সুবর্ণরেখা’ হোটেলেই সে উঠবে। নতুন হয়েছে হোটেলটা। শুনেছি সুখ্যাতিও হয়েছে। ফোন নিশ্চয় আছে—

কৌশিক উঠে দাঁড়াল। বললো, আমি একটু খোঁজ নিয়ে আসি টেলিফোন এক্সচেঞ্জ থেকে। ফোন নিশ্চয় আছে। আমার ফিরতে দেরি হলে আপনারা খেয়ে নেবেন।

সুজাতা বলে, এই ‘ওয়াইল্ড গুজ চেজ’-এর কোনো অর্থ হয়? এখানে আমাদের ক্লায়েন্ট কে? একগাদা এস. টি. ডি-র দাম মেটাবে কে?

বাসু এতক্ষণে পাইপটা ধরিয়েছেন। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন : আমি! আমিই বিল মেটাবো। আমিই সুকৌশলীর ক্লায়েন্ট! আই মাস্ট হ্যাভ এ স্যাটিসফ্যাকটরি এক্সপ্ল্যানেশন।

সুজাতা একটু থমকে যায়। তবু বলে, রাগ করবেন না মামু! কিন্তু কিসের ব্যাখ্যা চাইছেন আপনি? এরকম ঘটনা কি ঘটে না পৃথিবীতে? দুটি মানুষ—দুজনেই বৃদ্ধ—পাঁচজনের সঙ্গে ডিনার খেতে খেতে ‘ম্যাসিভ হার্ট-অ্যাটাক’-এ মারা যেতে পারে না? তিন সপ্তাহ আগে- পিছে। না হয় দুজনেই সেসময় মদ্যপান করছিল। এটা কি এতই বিরল ঘটনা?

—না! কিন্তু আমি কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি চাই—

—কী বিষয়ে?

—আমি জানতে চাই ম্যাসিভ হার্ট-অ্যাটাক যখন হয় তখন ডাক্তার ঘোষালের হাত দুটি কোথায় ছিল! বুকের বাঁ-দিকে, না গলায়? আমি জানতে চাই মৃত্যুসময়ে ওঁর মুখে যে অভিব্যক্তি…

কথাটা তাঁর শেষ হলো না। হঠাৎ ঝন্ ঝন্ করে বেজে উঠল টেলিফোন। বাসু যেন এটারই প্রতীক্ষায় বসেছিলেন এতক্ষণ। ব্যাঘ্রঝম্পনে টেলিফোনটা তুলে নিয়ে বললেন, পি. কে. বাসু! বলুন?

—আমি ব্রজ। ব্রজদুলাল!

—ইয়েস! আর একটু জোরে বলুন। কোথা থেকে বলছেন? হাজারিবাগ?

—না। কলকাতা! ডঃ ঘোষালের খবরটা পেয়েছেন?

—হ্যাঁ! স্যাড কেস!

—আজ্ঞে হ্যাঁ, স্যাড তো বটেই। তার চেয়েও বড় কথা মোস্ট মিস্টিরিয়াস! হার্ট-অ্যাটাক নয়, বাসুসাহেব! দিস্ টাইম ইট ইজ পয়েজনিং! বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে ঘোষালের

—কী করে জানলেন?

—পোস্টমর্টেম থেকে। আপনি কি আসতে পারবেন?

—অফ কোর্স! বাই টুমরো। কালকের সন্ধ্যার মধ্যে পৌঁছে ফোন করব আপনাকে। অবশ্য যদি প্লেনের টিকিট পাই, আর….

—শুনুন স্যার! আমার মারুতি-ভ্যনটা পুরীতেই আছে। আমি অশোককে টেলিফোনে ইন্সট্রাকসন্স দিয়ে দিচ্ছি। মিসেস্ বোস শুয়ে শুয়েই আসতে পারবেন। হুইল-চেয়ারটাও পিছনে নিয়ে নিতে পারবেন। কাম বাই রোড! অশোক সব ব্যবস্থা করবে।

বাসু বলেন, ইন্দ্রকে কি করে একটা খবর দেওয়া যায়? ও আছে ঘাটশিলায়, ‘সুবর্ণরেখা’ হোটেলে।

—না, স্যার! ইন্দ্র বসে আছে আমার সামনে। খবরের কাগজে নিউজটা দেখেই ও ঘাটশিলা থেকে চলে এসেছে।

—অল রাইট। আমি আসছি।

আট

পয়লা নভেম্বর। সন্ধে তখনো হয়নি, সূর্য পশ্চিমাকাশে। যদিও গাধূলিতে ঢাকা পড়েছেন দৈনন্দিন বিদায়কামী সূর্যদেব। আজ্ঞে না, পাঠক-পাঠিকা! —ওটা প্রেসের অনবধানতার বর্ণাশুদ্ধি নয়। লেখকের মূল রচনায় ‘গাধূলি’ই লেখা হয়েছে। এই বিংশ শতাব্দীর শেষপাদে প্রাক্তন সূতানুটি-গোবিন্দপুর গ্রামে প্রাকসন্ধ্যা-লগ্নে গোষ্ঠভূমি থেকে গাভীরা প্রত্যাবর্তন করে না। গোবেচারী কেরানির দল দিনগতর পাপস্খালনান্তে বাদুড়ের অনুকরণে ‘বাস’-এর হাতল ধরে ঝুলতে ঝুলতে নিজ-নিজ গোয়ালে ফিরে আসে। সেই বাসের টায়ার থেকে যে ধূলি পশ্চিমাকাশকে আবৃত করে—’গাড়ির ধূলি’—তাকেই বলে ‘গাধূলি’। এখনও কথাটা অভিধানে ওঠেনি; তবে মুখে মুখে চালু হচ্ছে। অভিধানে অচিরে এই নয়া শব্দটি সংযোজিত হবে।

সেই ‘গাধূলি’-লগ্নে গাড়িখানা এসে পৌঁছলো বাসুসাহেবের নিউ আলিপুরের ডেরায়। প্রথমেই নামানো হলো রানুদেবীকে হুইল-চেয়ারে বসিয়ে। রাস্তা থেকে পোতায় ওঠার জন্য ঢালু ‘র‍্যাম্প’ বানানোই আছে। হুইল-চেয়ার অনায়াসে উঠে এল বারান্দায়। অশোক, কৌশিক আর বিশু হাতে হাতে মালপত্র সব নামিয়ে ফেলল। বাসু তাঁর অ্যাটাচিকেসটা হাতে নিয়ে নেমে এসে একটা ডেক- চেয়ার দখল করে বসলেন।

অশোক হাত-পায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বললে, এবার তাহলে অনুমতি দিন, স্যার—আমি সল্টেলেকের দিকে রওনা দিই?

বাসুসাহেব কিছু বলার আগেই প্রতিবাদ করে ওঠেন রানু : তা কী হয়? ধুলোয় তোমার সর্বাঙ্গ ভরে গেছে। সেই খড়্গাপুর থেকে একটানা ড্রাইভ করে আসছ। তোমার সুটকেসটা নিয়ে এদিকে এস দিকিন। একটা শাওয়ার-বাথ নাও; জামা-প্যান্ট বদলে ফ্রেশ হয়ে নাও। এট্টু চা-টা খাও। তারপর সল্টলেকে ব্রজদুলালবাবুর বাড়িতে চলে যেও। আমরা ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি।

অশোককে নিয়ে গেল কৌশিক ওদের উইং-এ, বাথরুমের দিকে। বাসুসাহেব ঢুকলেন ড্রইংরুমে, ব্রজদুলালকে একটা দূরভাষণবার্তায় তাঁদের নিরাপদ যাত্রা-সমাপ্তির কথা জানাতে। রানু সুজাতাকে ডেকে বললেন, দেখ তো সুজাতা, সামনে ঐ অপর্ণার দোকানে এখন কী পাওয়া যাবে? স্ন্যাক্‌স্ জাতীয়। অশোক স্নান করে এলে, আমরাও সবাই হাতমুখ ধুয়ে নিয়ে একটু চা-কফি খাব। বিশু শুধু চা আর কফি বানাবে—খাবারটা সাপ্লাই করবে অপর্ণা।

বাসু বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, আবার চা-কফির হাঙ্গামা করার কী দরকার? অশোককে ভালো ব্রান্ডি খাওয়াব। এতটা ড্রাইভ করে এসেছে…

রানু ধমকে ওঠেন, না! সে তুমি একাই বসে বসে গিলো। ওকে আবার এতটা পথ ড্রাইভ করে সল্টলেক ফিরতে হবে—সে খেয়াল আছে?

বাসু কেশবিরল মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেন, আরে আমি কি ওকে তিন-চার পেগ খেতে দিতাম?

রানুর ধমকের ‘টোনটা অপরিবর্তিত : ক্রমাগত টিকটিক না করে ব্রজবাবুকে একটা টেলিফোন কর দিকিন।

বাসুসাহেব নিক্কথায় ফিরে যান ড্রইংরুমে।

সুজাতা রাস্তাটা পার হয়ে অপর্ণার দোকানে ঢোকে!

—আসুন সুজাতাদি। এইমাত্র পুরী থেকে ফিরলেন দেখলাম। সব ভালো তো?

—হ্যাঁ, আমরা ভালোই আছি, মুন্নার কী খবর?

—বাড়িতে মায়ের কাছে আছে। ভালোই।

অপর্ণা এ পাড়ারই মেয়ে। বাসুসাহেবের একমাত্র কন্যা—যে মোটর দুর্ঘটনায় মারা যায়—তার সহপাঠিনী ছিল। তাই বাসুসাহেব ও রানীদেবী ওকে খুব ভালোবাসেন। বেচারি অপর্ণা—মাত্র তিন বছর বিবাহিত-জীবনান্তে ঐ মুন্নাকে নিয়ে বিধবা হয়েছে। বাসুসাহেবের বাড়ির বিপরীতে একটি মণিহারী দোকান খুলেছিল—নাম দিয়েছে “রকমারী”। ইদানীং তার এক-কোণায় একটা ‘ফাস্ট-ফুডের’ কাউন্টার খুলেছে। ওরই মতো আর এক হতভাগিনী—কল্যাণী দত্ত—আসে সন্ধেবেলায় অথবা ছুটির দিনে। ‘ফাস্ট-ফুড’ -এর দোকানটা দুজনে মিলে চালায়—চাওমিঙ, মোগলাই পরোটা, ঘুগনি, কষা মাংস। ছুটির দিনে ফিশ ফ্রাই, ফ্রায়েড রাইস, চিলি-চিকেন। অপর্ণা সূর্যমুখীর রিফাইন্ড তেল কুকিং মিডিয়াম হিসাবে ব্যবহার করে। বিশুদ্ধতা আর পরিচ্ছন্নতার দিকে তার কড়া নজর। রানু প্রায়ই ওখান থেকে নৈশ আহার সংগ্রহ করেন—বিশেষ সুকৌশলীর কাজের চাপে যখন সুজাতাকে ছুটোছুটি করতে হয়। বিশের কাজের চাপ বাড়ে।

.

ব্রজদুলালকে টেলিফোনে ধরা গেল।

—আপনারা তাহলে নিরাপদে এসে পৌঁছেছেন দেখছি। কতক্ষণ হলো? -এই মিনিট দশেক!

—অশোককে ভ্যানটা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন?

—না। ও একটা ওয়াশ নিচ্ছে। চা-টা খেয়ে ফিরবে। আপনি বরং একটা ট্যাক্সি নিয়ে এখনি চলে আসুন। ব্যাপারটা বিস্তারিত শোনা যাক।

ব্রজ প্রতিবাদ করেন, আজ থাক না, স্যার? সমস্ত দিন জার্নি করে এসেছেন। আমরা বরং কাল সকালে যাব।

—না, তা হয় না। এখন প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। আমি রাত্রেই বিস্তারিত শুনতে চাই। ইন্দ্রকুমার তো শ্যামপুকুরে থাকে, ওকেও উঠিয়ে নিয়ে আসুন। ওকে একটা ফোন করুন প্রথমে।

ব্রজদুলাল বলেন, না স্যার, ইন্দ্র এখন আমার এখানেই আছে। ও ভীষণ মুষড়ে পড়েছে। দিনরাত চাদর মুড়ি দিয়ে পড়ে আছে। নাওয়া-খাওয়াও করতে চাইছে না। ঘোষাল তো আসলে ওর বাল্যবঙ্কু ছিল। দুজনে ছিল প্রাণের বঙ্কু।

বাসু প্রচণ্ড ধমকে ওঠেন, ও নিজেকে কী ভাবছে? অ্যাকিলিসের রোলে অভিনয় করছে? ‘পেট্রোক্লাস ইজ ডেড! অ্যাকিলিস্ শুড ডাই অ্যাজওয়েল?’

ধমকটা ব্রজদুলালের মাথার ছয় ইঞ্চি উপর দিয়ে বেরিয়ে গেল। তিনি শুধু বললেন, আজ্ঞে?

এ প্রান্তে বাসুর পাশেই বসেছিলেন রানী, তাঁর হুইল-চেয়ারে। জোর করে স্বামীর হাত থেকে টেলিফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে তার ‘কথামুখে’ বললেন, ব্রজদুলালবাবু, আমি মিসেস্ বাসু বলছি। উনি যা বললেন তাই করুন, প্লিজ। ইন্দ্রবাবুকে জোর করে তুলে সঙ্গে নিয়ে আসুন। একটা ট্যাক্সি নিয়ে। আজ রাত্রেই প্রাথমিক কথাবার্তাগুলো সেরে ফেলা দরকার। যাতে কাল সকাল থেকেই পরিকল্পনামাফিক কাজ শুরু করা যায়। ইতিমধ্যেই যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে।

—আজ্ঞে হ্যাঁ, তা তো বটেই। ঘোষাল মারা গেছে শনিবার আটাশে, আর আজ পয়লা বুধবার! চার-চারটে দিন! ঠিক আছে, আমরা ট্যাক্সি নিয়েই আসছি। অশোক ভ্যানটা চালিয়ে আমাদের ফেরত নিয়ে আসবে।

—আপনারা দুজন কি এখানেই যা হোক দুটি খেয়ে নিয়ে ফিরতে চান? তাহলে সেই মতো ব্যবস্থা করি। ফর্মালিটির কিছু নেই

—না, না মিসেস্ বাসু। আমার এখানে রান্নাবান্না করার লোক আছে। সে আমাদের নৈশাহার বানিয়েই রেখেছে বোধহয়। ওসব হাঙ্গামা করবেন না। তাহলে ঐ কথাই রইল; আমরা ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আসছি। বাইপাস দিয়ে গেলেও পাক্কা এক ঘণ্টা লাগবে!

—তা লাগবে। আসুন আপনারা।

টেলিফোনটা ক্র্যাডেলে নামিয়ে রেখে কর্তার দিকে ফিরে বললেন, আচ্ছা তোমার কি মাথা খারাপ? ব্রজবাবুকে হোমারের ‘ঈলিয়াড’ শোনাচ্ছ? হোমার তো আমাদের কাছেই গ্রিক, ব্রজবাবুর কাছে বোধহয় ‘মার্শিয়ান’ ভাষা!

বাসু সে কথার জবাব দিলেন না। বললেন, ঠিক আছে। ঠিক আছে। বস তোমরা, আমি মুখে-হাতে একটু জল দিয়ে আসি। বিশে কি চায়ের জল বসিয়েছে?…

কথা বলতে বলতে তিনি ভিতর দিকে চলে যান। বস্তুত পালিয়ে যান। বোধকরি তিনি প্রণিধান করেছেন টেলিফোনে যে ক্লাসিক্যাল ধমকটি দিয়েছেন, সাদা সংস্কৃতে তাকে বলে : ‘অরসিকেষু রসস্য নিবেদনম্’!

কৌশিক ইতিমধ্যে অশোককে বাথরুমটা দেখিয়ে দিয়ে ড্রইংরুমে ফিরে এসেছে। সুজাতাও এসে বসেছে বাইরের দিক থেকে অপর্ণার দোকানে খাবারের অর্ডার দেওয়া সেরে সুজাতাই বলে, বাসুমামু ওটা তখন কী বললেন মামিমা? তুমি বুঝতে পেরেছ?

—না বোঝার কী আছে? হোমারের ‘ঈলিয়াড’ যে পড়েছে, সেই বুঝবে!

কৌশিক বলে, আমাদের বি. ই. কলেজে হোমার পড়তে হয় না। ব্যাপারটা সংক্ষেপে বুঝিয়ে বলুন না মামী?

–সংক্ষেপে? মহাকাব্যের কি পকেট এডিশন হয়?

—গোটা ‘মহাভারত’ তো শুনতে চাইছি না। ঐ ‘পেট্রোক্লাস’টা কে? আর এক্ষেত্রে তার প্রসঙ্গ এলই বা কেন? আই মিন, বাসুমামু হঠাৎ ও-কথা বললেন কেন?

রানু হেসে ফেলেন। বলেন, তুমি তিনটে প্রশ্ন করেছ কৌশিক। ‘পেট্রোক্লাস’কে ও কেন, তৃতীয়ত তোমার মামু হঠাৎ ওকথা কেন বললেন। তাই না? আমি তোমার তিন নম্বর প্রশ্নের জবাবটা প্রথমে দেব। যেহেতু সেটা ‘ম্যাথমেটিকাল’—অঙ্কশাস্ত্র অনুসারে বোধগম্য তোমাদের শিবপুর বি. ই. কলেজে হোমার পড়ানো হোক না হোক, অঙ্ক নিশ্চয় শেখানো হয়। তোমাদের মামুর বর্তমান বয়সটা কত জান? ‘সেভেন্টিওয়ান + (প্লাস) & সেভেন্টি থ্রি (মাইনাস)’। ঐ বিশেষ বয়সে কিছু বায়ুবৃদ্ধি ঘটে থাকে। তা না হলে ব্রজদুলালকে উনি কিছুতেই হোমার শোনাতেন না।

কৌশিক বলে, বুঝলাম। এবার গল্পের ধরতাইটা?

রানু বুঝিয়ে বলতে থাকেন :

অ্যাকিলিস্ ছিলেন রাজপুত্র। মীরমিডনরাজ পেলিয়ুস-এর আদরের পুত্র। তার মা ছিলেন সামুদ্রিক দেবী থেটিস। জন্মমাত্র অ্যাকিলিসের মা তাকে স্টীক্স-নদীর পুণ্যোদকে গোড়ালি ধরে চুবিয়ে নেয়—ফলে অ্যাকিলিসের সর্বাঙ্গে (গোড়ালিটুকু বাদে, যেখানে মা তাকে ধরেছিল) অভেদ্য হয়ে গিয়েছিল—তীর বা বর্শার ফলায় তা বিদ্ধ করা যেত না। সে যাই হোক এই অ্যাকিলিসের প্রাণের বাল্যবঙ্কু ছিল পেট্রোক্লাস। অ্যাকিলিস্ মীরমিডনরাজের পঞ্চাশটি অর্ণবপোত নিয়ে বারে বারে ট্রয় অভিযানে গিয়ে প্রখ্যাত বীরের আখ্যা পেয়েছে। ট্রয়-যুদ্ধের সময় অনেক গ্রিক সামন্ত রাজন্যবর্গ একত্রে ট্রয় অবরোধ করতে যান। সেই সময় প্রতিপত্তিশালী সামন্তরাজ অ্যাগামেমনন অ্যাকিলিসের সুন্দরী প্রিয় ক্রীতদাসীটিকে প্রায় জোর করে তুলে নিয়ে যায়।

প্রতিবাদে অ্যাকিলিস্ যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে অস্বীকার করে। তার অনুপস্থিতিকালে ট্রোজান বীর হেক্টর পেট্রোক্লাসকে যুদ্ধে নিহত করে। সেই দুঃসংবাদ শুনে অ্যাকিলিস্ স্থির করে সে আত্মহত্যা করবে।

রানু হেসে বলেন, ব্রজদুলালকে ঐ উদ্ধৃতিটাই শোনাচ্ছিলেন তোমাদের মামু : “পেট্রোক্লাসহীন এই দুনিয়ায় অ্যাকিলিস বেঁচে থাকতে চায় না। মৃত্যুই তার কাম্য।”

সুজাতা জানতে চায়, তারপর কী হলো?

—বাকি মহাভারতটা? গ্রিক শিবিরের সবাই অ্যাকিলিকে বোঝাতে থাকে যে বঙ্কুর মৃত্যুতে হা-হুতাশ করা বীরের ধর্ম নয়। তার একমাত্র কর্তব্য বঙ্কুকে যে বধ করেছে সেই হেক্টরকে ছিন্নমুণ্ড করা। শেষ পর্যন্ত অ্যাকিলিস্ তার দুর্মনস্যতাকে কাটিয়ে বীরের মতো উঠে দাঁড়ায়। পরদিন দ্বৈরথ সমরে সে নিহত করলো বিপক্ষের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা হেক্টরকে।

বাসুসাহেব এই সময়ে ফিরে এলেন। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলেন, মহাকাব্য শেষ হলো?

রানু বলেন, তা তো হলো, কিন্তু তুমি কোন বুদ্ধিতে ব্রজদুলালকে হোমার শোনাতে গেলে?

বাসু বলেন : পেশেন্স ম্যাডাম, পেশেন্স! রহু ধৈর্যং! আর ছয়টা মাস!

—কেন? ছয় মাস পরে কী হবে?

—আমার ঐ ক্রিটিকাল এজটা পার হয়ে যাবে। আমি তিয়াত্তরে পৌঁছে যাব।

সবাই হেসে ওঠে।

.

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ওঁরা দুজন এসে গেলেন। ব্রজদুলালের সাজপোশাক, রকম-সকম একই ধরনের। কিন্তু ইন্দ্রকুমারকে যেন চেনাই যায় না। বেশবাসের পারিপাট্যই ছিল তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, এখন যেন সে ঝোড়ো-কাক! চোখের কোলে স্পষ্টতই কালির প্রলেপ। চুলে কলপ দেওয়া নেই—ফলে রাতারাতি সে পক্ককেশ বৃদ্ধ! ঘোষলের মৃত্যুতে সে যে এতবড় আঘাত পাবে তা যেন আন্দাজ করে উঠতে পারেননি বাসু। দুজনে আসন গ্রহণ করলে বাসুসাহেব ব্রজদুলালকে প্রশ্ন করেন, আপনি তখন টেলিফোনে বলেছিলেন ‘বিষক্রিয়া’! তথ্যটা কে জানিয়েছে?

—চিনসুরার অটোপ্সি-সার্জেন। শবব্যবচ্ছেদ করে।

—আহা, সে তো বটেই। আমি জানতে চাইছি—কেসটা যে হার্ট-ফেলিওর নয়, বিষক্রিয়ায় মৃত্যু—এটা মনে হলো কার?

—প্রথম সাজেস্ট করেছিল মিসেস্ পালিত। ফাইনাল ডিসিশন নেন ডক্টর দাশ—অমরেশ দাশ—ঐ নার্সিংহোমের সিনিয়ার-মোস্ট ডাক্তার—ঘোষালের ডান হাত।

বাসু জানতে চান, ছায়া পালিত ছিল নিমন্ত্রিতদের মধ্যে?

—তাই তো শুনছি।

।—আই সি। ডিনার-পার্টির উপলক্ষটা কী? আপনার নিমন্ত্রণ ছিল না?

—উপলক্ষ তেমন কিছু নয়। আর আমি তো ছিলাম হাজারিবাগে। আমার নিমন্ত্রণ হবে কেমন করে?

—খবরটা পেলেন কোথায়? কাগজে?

—না। দাঁড়ান, গুছিয়ে বলি :

অ্যাবে শবরিয়াকে কবরস্থ করার পরেই ব্রজদুলাল তাঁর হাজারিবাগের বাড়িতে চলে যান। তাঁর গাড়িটা পুরীতেই পড়ে থাকে। উনি ট্রেনে গিয়েছিলেন, দিন সাত-দশ কাটিয়ে আসতে। কথা ছিল পুরীতেই ফিরে আসবেন; আর তারপর সেখান থেকে বাই রোড কলকাতায়। হাজারিবাগে পৌঁছনোর পর একরাত্রে ব্রজদুলাল বিশ্রী একটা দুঃস্বপ্ন দেখলেন। ঘোষাল-বর্ণিত কাল্লু মিঞা ছুরি উঁচিয়ে তাঁকে মারতে আসছে। ব্রজদুলাল একটা উবড়ো-খাবড়া জমির আল ধরে ছুটতে ছুটতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। আর তৎক্ষণাৎ কাল্লু ওঁকে যেন ছুরি মারতে গেল। প্রাণভয়ে ব্রজদুলাল স্বপ্নের মধ্যেই চিৎকার করে উঠলেন, তাকিয়ে দ্যাখ, কাল্লু! আমি ডাক্তার ঘোষাল নই। কাল্লু বললো: বাঁচ গিয়া শালাহ্!

কাল্লুর মুখখানা তখন ঠিক আমজাদের মতো দেখাচ্ছিল। ‘শোলে’ ছায়াছবির আমজাদ। ঠিক তখনই ঘুমটা ভেঙে গেল ব্রজবাবুর। ওঁর মনটা খারাপ হয়ে গেল! যদিও স্বপ্ন, তবু ওঁর মনে হলো বঙ্কু ঘোষাল ডাক্তারের প্রতি উনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। বাকি রাত আর ঘুম হলো না। ভোরবেলা কালীপদ যখন বেড-টি দিতে এল তখন উনি টেলিফোন করলেন চুঁচুড়ায়। দুঃস্বপ্নের কথা খুলে বলে ক্ষমা চাইলেন। ঘোষাল তো হেসেই বাঁচেন না। বলেন, রাতে আর একটু ‘লাইট-ফুড’ খেও, বদহজম হচ্ছে তোমার।

ব্রজদুলাল তখন টেলিফোনে জানতে চান, ‘আর কোনো মিস্টিরিয়াস ফোন এসেছিল?’ ঘোষাল জানালেন, ‘না, আসেনি।’ আরও একটা ভালো খবর দিলেন : রিলায়ে সোর্স থেকে ঘোষাল একজন বডি-গার্ড পেয়েছেন। কম্বাইন্ড হ্যান্ডের ছদ্মবেশে, অর্থাৎ চাকর সেজে লোকটা ওঁর বাড়িতে আছে। সুতরাং ভয়ের আর কিছু নেই। ব্রজদুলাল বলেছিলেন, ‘তাহলে কদিন হাজারিবাগে কাটিয়ে যাও না কেন? ঐ দেহরক্ষীকে সঙ্গে নিয়েই এস।’ জবাবে ডক্টর ঘোষাল বলেন, ‘ভেবে দেখি। নার্সিংহোমের একটা ব্যবস্থা করে উঠতে পারলে যাব দুজনে। দেহরক্ষী ছোকরা বেশ চট্‌পটে। তোমার পছন্দ হবে।’

বাসু জানতে চান, এটা কত তারিখের কথা?

—শুক্রবার, সাতাশে। মানে ওর মৃত্যুর পূর্বদিন সকালে।

—তারপর? মৃত্যুর খবর পেলেন কী করে?

ঐ টেলিফোনেই। রবিবার সকালে। আমার এখানকার ফোন নাম্বার লেখা ছিল ওর টেলিফোন প্যাডে। ফোন করেছিলেন মিস্ অ্যাগি ডুরান্ট। ওর নার্সিংহোমের চিফ মেট্রন আমার সঙ্গে তাঁর আলাপ দীর্ঘদিনের। দুঃসংবাদটা উনিই জানালেন। পূর্বরাত্রে ডিনার – টেবিলে—ওঁর চোখের সামনেই—ডক্টর ঘোষালের দেহান্ত হয়েছে। আমি রবিবারেই রাত্রের ট্রেনে ফিরে এলাম কলকাতায়।

বাসু এবার ইন্দ্রকুমারের দিকে ফিরে জানতে চান, আর তুমি? তুমি কখন খবর পেলে? ইন্দ্রকুমার অন্যমনস্কভাবে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসেছিল। এঁদের কথাবার্তা শুনছিল বলে মনে হয় না। চমকে উঠে বললে, উঁ? আমাকে কিছু বললেন?

—হ্যাঁ! ডক্টর ঘোষালের মৃত্যু-সংবাদ তুমি কী করে পেলে? খবরের কাগজে?

—আজ্ঞে না। আমিও ঐ রবিবারে ঘোষালকে একটা ফোন করেছিলাম। ধরল অ্যাগি। ও আমাকে চিনতই। দীর্ঘদিনের আলাপ অ্যাগির সঙ্গে। কারণ শিবুর ঐ মেন্টাল-হোম প্রতিষ্ঠার প্রথম যুগ থেকেই ওখানে আমার যাতায়াত ছিল। অ্যাগিও আছে সেই প্রথম যুগ থেকেই। টেলিফোনটা অ্যাগিই তুলেছিল। আমি বললাম ঘোষালদাকে একটু দিন তো…ও…ও… কথাটা শেষ করতে পারল না ইন্দ্রকুমার। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরল।

বাসু বোধহয় একটু বিব্রত হলেন। বিরক্তও। বললেন, লুক হিয়ার ইন্দ্র! উই আর অল সরি ফর য়ু। ডক্টর ঘোষাল আমাদের পরিচিত একজন সজ্জন, তাঁর মৃত্যুতে আমরা সবাই কমবেশি আঘাত পেয়েছি। কিন্তু তিনি তোমার কাছে ছিলেন ‘শিবু’—সহপাঠী, বাল্যবঙ্কু! হি ওয়াজ য়োর পেট্রোক্লাস…

বলেই হকচকিয়ে থেমে যান। রানু কথার খেইটা তুলে নিয়ে বলেন, এভাবে ভেঙে পড়লে তো চলবে না। আপনি মনকে শক্ত করুন। যে সমাজবিরোধীটা বিষ দিয়ে আপনার বঙ্কুকে হত্যা করেছে… সেই যে, কী-যেন নাম লোকটার….

কৌশিক অধোবদনে অস্ফুটে বলে, হেক্টর!

বাসু প্রায় ধমকে ওঠেন, না! কাল্লু! কাল্লু মিঞা!

রানু কৌশিককে চোখ দিয়ে ইশারা করে বাক্যটা শেষ করেন, সেই কাল্লুকে ফাঁসিকাঠ থেকে না ঝোলানো পর্যন্ত তো শোকে বিহ্বল হবার অধিকার আপনার নেই।

ব্রজদুলাল বলেন, এই কথাটাই আমি দুদিন ধরে বোঝাবার চেষ্টা করছি।

বাসু প্রসঙ্গটা ঘোরাতে চান : ডিনারে কে কে ছিল?

ব্রজদুলাল বলেন, ঠিক জানি না। নার্সিংহোমের তিন-চার জন, যাঁদের নাম আমি জানি না। আর ডক্টর ঘোষালের কয়েকজন বঙ্কু-বান্ধবী এসেছিলেন যাঁদের অ্যাগি বা ডক্টর দাশ চেনেন না। তবে ক্যাপ্টেন পালিত আর ছায়া ছিল এ খবর পেয়েছি।

—আপনারা দুজনে চুঁচুড়া গিয়েছিলেন নিশ্চয়। কবে?

ব্রজদুলাল বলেন, না, ইন্দ্র যায়নি। ও তখনো সামলে উঠতে পারেনি। আমি গিয়েছিলাম আমাদের থিয়েটার কোম্পানির ম্যানেজারকে নিয়ে। একটা ‘রেন্ট-এ-কার’ ভাড়া নিয়ে। বিশেষ কিছুই জানতে পারিনি। হয় কেউ কিছু জানে না অথবা জেনেও না-জানার ভান করছে।

—সদর থানা কী বলছে?

ব্রজদুলাল বললেন, থানার ও. সি. লোকটা স্বভাবতই দুর্মুখ না পয়সা খেতে চায়, বুঝে উঠতেই পারলাম না। সে কোনো সাহায্যই করলো না।

—’বিষপ্রয়োগে হত্যা’ এটা তো স্বীকার করলো?

—আজ্ঞে না। তাহলে বলি, শুনুন

ব্রজদুলালের মতে সদর থানার ও. সি. গণেশচন্দ্র সাহা একটি পোড়-খাওয়া পাঁড় ঘুঘু। কার্ড পেয়েই, ডেকে পাঠালেন। অতি আপ্যায়ন করে বসালেন ভিজিটার্স চেয়ারে। বললেন, বলুন স্যার, কীভাবে আপনাদের সেবা করতে পারি? জনগণের সেবা করতেই তো আছি আমরা!

ব্রজদুলাল মুখ খোলার আগেই পুনরায় বলেন, আপনি তো স্যার ঐ ‘নটরঙ্গ’ থিয়েটার হলের মালিক? তাই না? কী নাটক হচ্ছে এখন? এখান থেকে গিয়ে থিয়েটার দেখে ফিরে আসা তো প্রায় অসম্ভব। তবে আমার শ্বশুরবাড়ি শ্যামবাজারেই। থিয়েটার দেখে রাতটা কলকাতায় থেকে আসা যায়।

ব্রজদুলাল সিগ্রেটের কার্টনটা বাড়িয়ে ধরে বললেন, কার্ডে আমার টেলিফোন নাম্বার লেখা আছে। ফোন করে দেবেন—টিকিট নিয়ে গেটে লোক থাকবে।

—গেলে একা যাব না কিন্তু। শ্বশুরবাড়ির ব্যাপার…

—তা তো বটেই। কখানা টিকিট চাই সেটাও বলে দেবেন। এবার কি কাজের কথায় আসব?

গণেশচন্দ্র ইতিমধ্যে সিগ্রেটটা ধরিয়েছেন। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, কাজ তো আছেই মশাই—চৌপর দিন শুধু কাজ আর কাজ…

হঠাৎ বেজে উঠলো টেলিফোনটা।

—আঃ!—একটা বিরক্তি প্রকাশ করে ফোনটা তুলে কানে লাগালেন। ও-প্রান্ত থেকে কে কী জানতে চাইলো বোঝা গেল না। গণেশ বললেন, সরি! রঙ নাম্বার। না, না, না! এটা সদর থানা নয়।

বলেই বাঁ-হাতে কানেকশনটা কেটে দিয়ে টেলিফোনটা টেবিলে নামিয়ে রেখে বললেন, এরা নিশ্বাস ফেলতে দেয় না মশাই। হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম… আপনার থ্যাটার হলে এখন কী পালা চলছে?

—রেনোভেশন।

—রেভেলিউশন? কিসের বিপ্লব?

—আজ্ঞে না, ভাঙা-চোরার কাজ। থিয়েটার এখন বন্ধ আছে। কাজের কথায় আসতে পারি?

—হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলুন না। কী ব্যাপার?

—মমতাময়ী মেন্টাল-হোমের ডক্টর শিবশঙ্কর ঘোষাল আমার বিশেষ বঙ্কু। গত শনিবার তিনি মারা গেছেন। পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা কি পাওয়া গেছে?

গণেশচন্দ্র বার দুই-তিন সিগ্রেটে টান দিয়ে জানতে চাইলেন, ডক্টর ঘোষালের ওয়ারিশ কে? কোনো ব্লাড-রিলেশন চুঁচুড়ায় নেই?

ব্রজদুলাল বললেন, যতদূর জানি ওঁর কোনো ব্লাড-রিলেশন চুঁচুড়ায় নেই। উনি কনফার্মড ব্যাচিলার। ভাই-ভাইপোরা কে-কে আছে জানি না। তবে এখানে নেই।

—আই সি!

নীরবে গণেশচন্দ্র সিগ্রেট টেনে চলেন। ব্রজদুলাল পুনরায় একই প্রশ্ন পেশ করতে যান : পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা?

—হ্যাঁ পাওয়া গেছে। যথাস্থানে সেটা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

—’বিষ’-এর কোনো ট্রেস কি পাওয়া গেছে?

—সরি, স্যার। সে-কথা তো আপনাকে বলা যাবে না। হয় ডাক্তার ঘোষালের কোনো ব্লাড-রিলেশন আসবেন। অথবা তাঁর ওয়ারিশের ওকালতনামা নিয়ে…

ব্রজদুলাল বাধা দিয়ে বলেন, আমরা তো স্যার লিখিত রিপোর্ট চাইছি না। জাস্ট আপনার মৌখিক কথা।

ঠিক সেই সময় শাসকদলের কোনো হোমড়া-চোমড়া এসে ঘরে ঢোকেন। গণেশ উঠে দাঁড়িয়ে পড়েন। আসুন, আসুন স্যার।

আগন্তুক ব্রজদুলাল ও তাঁর ম্যানেজারকে দেখিয়ে জানতে চান, এঁদের সঙ্গে আপনার কাজ মিটেছে?

ও. সি. ব্রজদুলালের দিকে ফিরে বললেন, আপনারা দুজন যদি কাইন্ডলি একটু ঐ বারান্দার বেঞ্চে গিয়ে বসেন, তাহলে স্যারের সঙ্গে জরুরি কথাটা সেরে নিতাম।

—অফ কোর্স!—উঠে দাঁড়ালেন ওঁরা দুজন।

গণেশচন্দ্র একজন সেপাইকে হুকুম দিলেন। এঁদের দু-কাপ চা-বিস্কুট দাও। কলকাতা থেকে অনেকটা পথ এসেছেন। শেষে যেন থানার বদনাম করে না যান!

ব্রজদুলাল অবশ্য চা-বিস্কুট না খেয়েই ফিরে এসেছিলেন।

বাসু বললেন, বুঝলাম। দ্য স্লেট ইজ ক্লিন ইয়েট! কাজের কাজ শুরুই হয়নি। আপনারা বোধহয় কোনো এফ. আই. আর.-ও লজ করে আসেননি?

–কী লিখব F.I.R. -এ? কেসটা যে ‘পয়েজনিং’ তাও তো জানি না!

বাসু পকেট থেকে পাইপ-পাউচ বার করলেন। ধরাতে ধরাতে সুজাতাকে বললেন, ডি. আই. জি. বার্ডওয়ান রেঞ্জকে ধর তো। প্রথমে অফিসে, না পেলে রেসিডেন্সে। নাম্বারটা আমার টেলিফোন বইতে আছে ‘পি’-তে, মানে ‘পুলিস’-এন্ট্রিতে।

এসব কাজ সচরাচর রানুদেবীর। তবে আজ তিনি সারাদিন জার্নি করেছেন, তাই সুজাতাকে বলা। সুজাতা বই ঘেঁটে দেখল ডি. আই. জি. বার্ডওয়ানের অফিসটা চুঁচুড়ায়। ফোন করে জানল : সাহেব বাড়িতে চলে গেছেন।

সুজাতা এবার রেসিডেন্স-নাম্বারটা ডায়াল করলো।

রিঙিং টোন…মহিলাকণ্ঠে : হ্যালো? দিস্ ইস্ রেসিডেন্স অব ডি. আই. জি. বার্ডওয়ান রেঞ্জ।

সুজাতা সাদা বাংলায় বললো, গুড ঈভনিং, ডি. আই. জিকে কাইন্ডলি লাইনটা দেবেন? পি. কে. বাসু বার-অ্যাট-ল একটু কথা বলতে চান….

ও-প্রান্ত থেকে মহিলাকণ্ঠে একটু রূঢ় জবাব শোনা গেল : সরি। উনি এখন রেস্ট নিচ্ছেন। কাল সকালে ফোন করবেন…

সুজাতা কিছু বলার আগেই লাইনটা কেটে দিল।

বাসু জানতে চান : কী হলো?

—মহিলাকণ্ঠ। মিসেস্ না রিসেপশনিস্ট বুঝতে পারলাম না। বললেন, ডি. আই. জি. রেস্ট নিচ্ছেন। কাল সকালে ফোন করতে বললো!

—ও! দাও ফোনটা আর নাম্বারটা।

রানু জানতে চান, আমি দেখব?

—না! আমিই দেখছি। তুমি আজ ক্লান্ত!

অনেকগুলি নাম্বার ডায়াল করার পর রিঙিং টোন শোনা গেল। একটু পরেই মহিলাকণ্ঠে : গুড ঈভনিং! দিস্ ইজ ডি. আই. জি. বার্ডওয়ানন্স রেসিডেন্স!

—বাচ্চু আছে? থাকলে তাকে দাও, না থাকলে একটা মেসেজ লিখে নাও!

মেয়েটি চোস্ত ইংরেজিতে বললে, আপনি বোধহয় ভুল নাম্বার ডায়াল করেছেন। সরি!

বাসু তৎক্ষণাৎ ইংরেজিতে বলেন—ও টেলিফোন নামিয়ে রাখার আগেই—বুঝতে পারছি তুমি সোমা রায়চৌধুরী নও—কারণ সে জানে তার কর্তা ডি. আই. জি. সাহেবের ডাক নাম ‘বাচ্চু’। তাহলে তুমি কে বট, মা? রিসেপশনিস্ট?

মেয়েটা থতমত খেয়ে বললে, আপনি কে?

—তুমি আমায় চিনবে না, মা, –বাচ্চু বা সোমা থাকলে ফোনটা তাদের দাও। বল, প্রসন্নকাকু ফোন করছে।

মেয়েটি জবাব দিল না। টেলিফোনে কিছু জলতরঙ্গের শব্দ। তারপর ভারী কণ্ঠে কে যেন বললে, ইয়াস? হুম ড্যু য়ু ওয়ান্ট?

—বাচ্চু? হ্যালো! দিস্ ইজ প্রসন্নকাকু। পি. কে. বাসু অব ক্যালকাটা বার।

—হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো! কাকু? বলুন, কী করতে পারি আমি আপনার জন্য? –কাল যে-কোনো সময় দশ মিনিট পেশেন্ট হিয়ারিং

—কাল? কাল তো আমি সারাদিনই… ওয়েল সকাল সাড়ে আটটা… উড্ দ্যাট বি ট্যু আর্লি?

–নট দ্য লিস্ট। সকাল সাড়ে আট, ঠিক হ্যায়, কিন্তু কোথায়?

—আমার সঙ্গে ব্রেকফাস্ট খাবেন। খেতে খেতে দশ মিনিট কেটে যাবে। কথা বলাও ফুরোবে।

—আমি রাজি। কিন্তু একটা শর্ত আছে।

—বলুন?

—টাইম আর ভেনু স্থির করেছ তুমি। মেনুটা স্থির করব আমি : নো এগ্, নো বাটার, নো বেকন! মায় নো টোস্ট!

—তাহলে আপনি খাবেন কী?

—পাকা পেঁপে, কলা, শশা, ফুটি, আঙুর, ডালিম—এর মধ্যে যে-কোনো তিনটে। একটা বিস্কুট—ক্রিমছাড়া—আর র-কফি এক্কাপ!

—অল রাইট, স্যার! অ্যাজ য় প্লিজ। আপ রুচি খানা!

—সোমা কি চিনসুরায়?

—হ্যাঁ! তবে এখন বাড়িতে নেই।

—তা না থাকুক। কাল সাড়ে আটটায় যেন সে বাড়িতে থাকে। টু অ্যাটেন্ড মাই ট্রোজান ব্রেকফাস্ট! ও. কে?

—শিওর!

নয়

পরদিন সকাল আটটা পঁচিশে ব্রজদুলালের ভ্যানটা প্রবেশ করলো চিনসুরায়, ডি. আই. জি. বার্ডওয়ান রেঞ্জ-এর বাংলোর হাতায়। বিনা প্রতিবাদে নয়। আর্মড গার্ড গেটেই রুখে দিল গাড়িটা। বাসুসাহেব নিজের আইডেন্টিটি-কার্ডটা দেখালেন। প্রহরী স্বীকার করলো—তার উপর নির্দেশ আছে, ঐ নামের আগন্তুককে ভিতরে যেতে দিতে।

সঙ্গে ব্রজদুলাল, অশোক ও ইন্দ্রকুমারও এসেছেন। ওঁরা রওনা হয়েছেন অতি প্রত্যূষে, যাতে সাড়ে আট-এর আগেই অকুস্থলে উপনীত হতে পারেন। প্রাতরাশ কারও হয়নি। ব্রজদুলাল বাসুসাহেবকে বললেন, আপনি স্যার, ভিতরে যান। আমরা ততক্ষণ সামনের ঐ মিষ্টির দোকানটায় বসে সকালবেলাকার ‘নাস্তাটা সেরে আসি। আমাদের উপস্থিতিতে ডি. আই. জি.-সাহেব হয়তো তাঁর প্রসন্নকাকুর সঙ্গে খোলামনে কথাবার্তা বলতে সঙ্কোচ করবেন।

বাসু বললেন, হ্যাঁ, প্রস্তাবটা ভালো! আপনারা নাস্তা সেরে ঐ ফাঁকা জায়গায় গাড়ি পার্ক করবেন, গাছের ছায়ার তলায়।

ব্রজদুলাল বললেন, আপনার নাস্তার নিমন্ত্রণ তো ডি. আই. জি. সাহেবের বাড়িতেই। দেখুন, আপনার বরাতে ছয়জন ফেরারী আসামীর মধ্যে চুঁচুড়ার বাজার থেকে ডি. আই. জি.- আর্দালি কোন তিনজনকে গ্রেপ্তার করে।

বাসু চলতে শুরু করেছিলেন। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেন, ঠিক বুঝলাম না তো! ছয়জন ফেরারী আসামী! কে তারা?

—পাকা পেঁপে, কলা, শশা, ফুটি, আঙুর, ডালিম—এদের মধ্যে মাত্র তিনজনই না হবে বিস্কুট আর র-কফির সঙ্গী!

বাসু স্মিত হেসে বললেন, ও আই সি! আচ্ছা, আসুন আপনারা। ‘বাই নাইন’ আমি বেরিয়ে আসব।

কলবেল বাজাতে হলো না। ডি. আই. জি.-র ঘরণী সোমা রায় বাগানে মালিকে দিয়ে গাছের ‘কলম’ বানাচ্ছিল। বাসুর গাড়ি কম্পাউন্ডের ভিতর ঢুকতে দেখেই সে এগিয়ে আসে। তার পরনে একটা হাউস-কোট। সে পদস্পর্শ করে বাসুসাহেবকে প্রণাম করে বললো, কাকিমা কেমন আছেন?

বাসু আশীর্বাদ করতে ওর খোঁপায় একটা হাত রাখলেন। বললেন, বাঃ! তুমি তো আচ্ছা ভাইঝি! আগে জিজ্ঞেস কর ‘কাকু, কেমন আছেন?’ তার পর না কাকিমার প্রসঙ্গ?

—না, কাকু! আপনি যে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ‘জনি-ওয়াকার’ থাকবেন তা আমরা সবাই জানি। ভয়টা কাকিমাকে নিয়েই।

বাসু হাসলেন। হাসিটা ম্লান। বললেন, তোমার জ্ঞানটা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল কেন, সোমা? তুমি জান না : তোমার কাকিমাও জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ‘জেনী-হুইলচেয়ারাসীনা ই থাকবেন?

সোমা লজ্জা পায়। বলে, উই আর আল সরি ফর হার, কাকু!

—য়ু অল আর রঙ দেয়ার! ‘ওয়াকার’ আর ‘হুইলচেয়ারার’ উই বোথ আর স্টিল গোয়িং স্ট্রং। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাই যাবও। বাচ্চু কোথায়?

—আসুন, ভিতরে আসুন।

বাচ্চু বা ডি. আই. জি. বার্ডওয়ান রেঞ্জ ধড়াচূড়া পরে তৈরি। নয়টার সময় ওঁর দেহরক্ষী আর গাড়ি এসে যাবে। ধড়াচূড়া-পরা অবস্থাতেই প্রসন্নকাকুকে প্রণাম করে বললেন, ওফ্ফ্‌ কদ্দিন পরে দেখা হলো, কাকু?

—তা তো হিসাব রাখিনি। বোধহয় তোমার বাবার শ্রাদ্ধবাসরে শেষ দেখা হয়েছে তোমার সঙ্গে। সেটা বছর পনের হবে; তাই না?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, প্রায় তাই। তা শুনুন, দুপুরে এখানে দুটি খেয়েই যান না। আমি বেলা দেড়টার মধ্যে ফিরে আসব। অ্যাদ্দিন পরে দেখা, একটু জিন-লাইম তো খাবেন, অথবা বিয়ার।

—লোভ দেখাচ্ছ?

—লোভ আর কাকে দেখাব, কাকু? আপনি তো একদম বদলে গেছেন। কলা-পেঁপে- আপেল সহযোগে ব্রেকফাস্ট করছেন বাসুকাকু। আমি তো ভাবতেই পারি না।

বাসু আঁৎকে ওঠেন : কলা-পেঁপে-আপেল? ব্রেকফাস্টে ভদ্রলোক খায়?

ততক্ষণে ডি. আই. জি. সাহেবের খিদ্‌মদ্‌গার টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে। একদিকে টোস্ট-মাখন, ডব্‌ল্ ডিমের পোচ, পরিজ, বিপরীত দিকে একটা বড় প্লেটে নানান কাটা ফল—পেঁপে-কলা-শশা-আঙুর-আপেল…

বাসু তড়িঘড়ি তাঁর ভাইপোকে গোঁত্তা মেরে সরিয়ে দিয়ে টোস্ট-মাখন-পাড়ার চেয়ারে বসে পড়েন। ড-ডিমের পোচের প্লেটটা টেনে নিয়ে সোমাকে প্রশ্ন করেন, বাচ্চু বুঝি আজকাল সকালবেলা ফল-টল খায়? ভালো, খুব ভালো! চল্লিশ বছর পার হলেই খাওয়া- দাওয়া বিষয়ে সংযম করা উচিত।

সানি-সাইড-আপ একটি পোচ টোস্টের উপর বসিয়ে বাঁ-হাতে সেটা তুলে নিয়ে বলেন, কি হলো বাচ্চু? বস। তোমার দেরি হয়ে যাবে যে।

সোমা আর তার স্বামী দুজনেই রীতিমতো বিব্রত। ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারে না। শেষে সোমাই প্রশ্নটা পেশ করে : মানে? আপনি ফল খাবেন না? কলা-শশা-পেঁপে…

বাসু টোস্টে কামড় দিয়ে বলেন, কেন? ফল খেতে যাব কোন দুঃখে? আমি কি বাচ্চুর মতো সদ্য-চল্লিশোর্ধ্ব?

ডি. আই. জি. ওঁর বিপরীতে বসে পড়েছেন। প্রশ্ন করেন, তাহলে কাল রাত্রে ও-কথা বললেন কেন?

—সে তো অতীতের কথা। গতকাল। স্থান-কাল-পাত্র সব বদলে গেল না?

সোমা বলে, ব্যাপারটা কিন্তু আমার বোধগম্য হলো না, কাকু

–এখনো তোমার সময় হয়নি/যেথায় চলেছ যাও তুমি ধনি/সময় যখন আসিবে তখনি/বুঝিবে গো সোমা, বুঝিবে। যাও। আপাতত আরও খান-দুই টোস্ট আর ডব্লু ডিমের পোচ বানিয়ে নিয়ে এস দিকিন—

সোমাকে এসব বানাতে হয় না। সে পাচিকাকে চোখের ইঙ্গিত করে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো। বললো, ওসব বাজে কথা বাদ দিন! বলুন, কাল কেন বলেছিলেন, নো এগ, নো বাটার, নো বেকন, নো টোস্ট? বলেননি একথা?

—আই কনফেস! বলেছিলাম! কারণটা বোঝবার মতো বয়স এখনো তোমার হয়নি। বাচ্চুর বয়স যখন বাহাত্তর হবে, আর তুমি পাকাচুলে সিঁদুর পরে টেলিফোনের পাশে ঠায় বসে পাহারায় থাকবে, তখন বাচ্চুও টেলিফোনে ঐ কথাই বলবে!

দুজনেই হো হো করে হেসে ওঠে।

সোমা বলে, ঠিক আছে। আমি এক্ষুণি কাকিমাকে টেলিফোন করে সব কথা বলে দিচ্ছি।

—ইটস য়োর প্রিভিলেজ। সদর দরজাটা তোমার বাড়ির। প্রসন্নকাকুর নাকের সামনে দরজাটা বন্ধ করে দিতে চাইলে আমি কী করতে পারি?

.

প্রাতরাশান্তে ওঁরা দুজনে গিয়ে বসলেন ডি. আই. জি.-সাহেবের খাশ কামরায়। ডি. আই. জি. বলেন, এবার বলুন, কাকু, প্রয়োজনটা কী?

বাসু আদ্যোপান্ত ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেন। পুরী ভ্রমণ, অ্যাবে বিল শবরিয়ার সন্দেহজনক মৃত্যু। তার মদের গ্লাসে পানাবিশিষ্ট তরল পদার্থে কোনো বিষের চিহ্নমাত্র না পাওয়া। পরে এটাকে ‘হার্ট-ফেল’ বলে ধরে নিয়ে অ্যাবে শবরিয়াকে ওড়িশায় সুদূর গুনপুর গ্রামে সমাধিস্থ করা। চিনসুরার প্রখ্যাত মনের ডাক্তার ঘোষালসাহেবের মৃত্যুর সঙ্গে সেই ঘটনাটির একটা বিচিত্র সাদৃশ্য আছে। দুজনেই বহু প্রত্যক্ষদর্শীর সম্মুখে নৈশ-ডিনারে মদ্যপান করতে করতে হার্ট-অ্যাটাকে মারা গেছেন।

বিকাশ রায়চৌধুরী, ওরফে ‘বাচ্চু’ বললেন, হ্যাঁ, কেসটার কথা আমি শুনেছি; মানে অ্যাবে শবরিয়ার কেস নয়, ডক্টর ঘোষালের রহস্যজনক মৃত্যুর কথা। ডক্টর ঘোষালের ডিনার পার্টিতে ঘটনাচক্রে উপস্থিত ছিলেন এক পালিত দম্পতি। তার ভিতর মিসেস্ পালিতই প্রথম ইঙ্গিত করেন যে, এটি হার্ট-ফেলের বদলে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হলেও হতে পারে। ওঁরা লোকাল থানায় ফোন করেন। ঐ মেন্টাল স্যানাটেরিয়ামের মেট্রন এবং ডাক্তার অমরেশ দাশের অনুরোধে আমরা ডক্টর ঘোষালের দেহটা পোস্টমর্টেম করাই।

বাসু বললেন, হ্যাঁ, এ পর্যন্ত শুনেছি। রেজাল্ট কী হয়েছে?

—মোস্ট মিস্টিরিয়াস্! ওঁর স্টম্যাকে একটা পয়জনাস কম্পাউন্ডের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে—নিকোটিনের একটা ডেরিভেটিভ—যে বিষ সাধারণ পরীক্ষায় ধরা না-ও পড়তে পারে; অথচ যার বিষক্রিয়া প্রায় পটাশিয়াম সায়ানাইডের মতো তীব্র। রসায়ন বিশেষজ্ঞকে জিজ্ঞেস করে তিনটি তথ্য আমি সংগ্রহ করেছি যা রীতিমতো রহস্যময়। প্রথম কথা, নিকোটিনের এই ডেরিভেটিভ জলে বা অ্যালকোহলে দ্রবণীয়; দ্বিতীয়ত, চার-পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যেই হৃদপিণ্ডের রক্ত জমাট বাঁধিয়ে মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করে; এবং তৃতীয়ত, এই কেমিক্যাল-কম্পাউন্ডটি ভারতে তৈরি বা বিক্রি হয় না। কারণ স্পেশালিস্ট ব্যতিরেকে কারও কোনো প্রয়োজনেও লাগে না। অর্থাৎ এটিকে বিদেশ থেকে স্মাগল্ করে আনা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এমন দুর্লভ বিষপ্রয়োগে কেন হত্যা করার চেষ্টা হবে এক্ষেত্রে? ডক্টর ঘোষাল কিছু ভাওয়ালের অথবা পাকুড়ের রাজকুমার নন যে বিষ সংগ্রহে কয়েক শত বা সহস্ৰ মুদ্রা ব্যয় করতে আততায়ী কুণ্ঠিত হবে না!

বাসু বললেন, তার চেয়েও বড় কথা অমন একটি দুর্মূল্য এবং দুর্লভ বিষ দিয়ে অ্যাবে শবরিয়ার মতো একটি অজাতশত্রু-তথা-কপর্দকহীনকে কেন হত্যা করা হবে?

বিকাশ বাধা দিয়ে বললেন, ওটা আপনার ‘ওয়াইল্ড গুজ চেজ’। অ্যাবে শবরিয়াকে যে আদৌ বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে এমন প্রমাণ নেই।

—না নেই। প্রমাণ নেই। কিন্তু বিচিত্র ঘটনা পরম্পরায় সম্ভাবনাটাকে উড়িয়ে দেওয়াও যাচ্ছে না। হ্যাঁ, ভালো কথা, যে গ্লাস থেকে ডক্টর ঘোষাল পান করেছিলেন তার তলানিটা কি পরীক্ষা করা হয়েছে?

ডি. আই. জি. বলে ওঠেন, সেটাই এ সমস্যার মোস্ট মিস্টিরিয়াস্ এপিসোড। তলানিতে কোনো বিষাক্ত ইনগ্রিডিয়েন্ট আদৌ পাওয়া যায়নি।

বাসু বলেন, এটা কেমন করে সম্ভব? নাম্বার ওয়ান : প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন ঐ পাত্র থেকে পান করতে করতে তিনি লুটিয়ে পড়েন—মারা যান। নাম্বার টু : অটোন্সি সার্জেন বলছেন তীব্র বিষক্রিয়ার মৃত্যু। নাম্বার থ্রি : পানপাত্রের তলানিতে বিষের চিহ্নমাত্র নেই!

ডি. আই. জি. বললেন, মৃত্যুটা অবিসংবাদিত সত্য, অটোন্সি সার্জেনের রিপোর্ট নির্ভুল, সুতরাং বুঝতে হবে : যে-গ্লাসের তলানি সংগ্রহ করা হয়েছিল সেটা ভুল করে সংগ্রহ করা! সেটা অন্য একটি গ্লাস।

—আর য়ু শিওর ‘ভুল করে সংগ্রহ করা’?

—তাছাড়া কী?

—মার্ডারার সেটা কায়দা করে বদলে দিয়েও থাকতে পারে।

—তা পারে। যদি সে অকুস্থলে উপস্থিত থেকে থাকে। সে যাই হোক, আপনি আমার কাছে ঠিক কী কী চাইছেন?

বাসু বললেন, নাম্বার ওয়ান : এই কেসটাতে আমাকে সাহায্য করবার জন্য পুলিসের একজন ইন্টেলিজেন্ট অফিসার-সার্জেন্ট র‍্যাঙ্কের হলেই চলবে। তবে তার আর কোনো কাজ থাকবে না। নাম্বার টু : অটোন্সি সার্জেনের রিপোর্টের একটা জেরক্স কপি।

বিকাশ বললেন, লুক হিয়ার, কাকু। এ-কাজটা এখন আর ঠিক আমার এক্তিয়ারে থাকছে না। ডি. সি. ডি. ডি.-র আন্ডারে চলে যাচ্ছে। মানে ডেপুটি কমিশনার, ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট। তাঁর অফিস কলকাতায়।

—জানি। কিন্তু বর্তমানে ডি. সি. ডি. ডি.-র পোস্টে কে আছেন?

—মিস্টার বকুল বিশ্বাস। চেনেন?

—বকুল বিশ্বাস! মানে সেই যিনি শিলিগুড়িতে জেলা-সর্বাধিকারী না কাকে যেন, সিমেন্ট চুরির দায়ে গ্রেপ্তার করেছিলেন?

—এ-কথায় কী জবাব দেব, কাকু? আপনি যদি জানতে চান ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর? মানে কি সেই দাড়িওয়ালা ভদ্রলোকটি যিনি বীরভূমের কী একটা স্কুলে পড়াতেন?” তাহলে তার জবাব কী হবে?

বাসু অট্টহাস্য করে ওঠেন! বলেন, দ্যাটস্ এ প্লেন্ডিড রেইলারি। অর্থাৎ বকুল বিশ্বাসের নানান কীর্তির তুলনায় ঐ ঘটনাটা অকিঞ্চিৎকর। না, বকুলবাবুর সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ আলাপ নেই। করে নেব। তুমি তাহলে আমার সঙ্গে এখানকার এস. পি.-র আলাপ করিয়ে দাও। তাঁর কাছ থেকে আমি পুলিস-ইনভেস্টিগেশনে কতটুকু জানা গেছে তা সংগ্রহ করে নিতে পারব।

—ঠিক আছে। কিন্তু এস. পি. নয়। ডি. এস. পি.। তিনটি হেতুতে। প্রথম কথা : এস. পি. বর্তমানে অন্য একটি কাজে প্রচণ্ড ব্যস্ত। দ্বিতীয় কথা : ডি. এস. পি. যুগলকিশোর সেনরায় ছিল ডক্টর ঘোষালের একজন গুণগ্রাহী। যুগলের স্ত্রী প্রায় উন্মাদ হতে বসেছিল; ডক্টর ঘোষালের চিকিৎসাতেই সে ভালো হয়ে গেছে। তৃতীয় কথা: আমি জানি, যুগল আর তার স্ত্রী গোয়েন্দা গল্পের পোকা। আপনার কাঁটা-সিরিজের সবকয়টা গল্প আছে ওদের সংকলনে। ওরা দুজনেই আপনার ফ্যান। ওকে ফোন করব?

—কর। বল, আমি আধঘণ্টার মধ্যেই ওঁর রেসিডেন্সে আসছি। ঐ সঙ্গে তোমাদের সদর থানার ও. সি.-কেও ধর—গণেশ সাহা। তাকে বল, যুগল সেনরায়ের বাড়িতে গিয়ে অপেক্ষা করতে। আমার নাম বা পরিচয় তাকে দেওয়ার দরকার নেই।

বিকাশ টেলিফোন রিসিভারটা তুলে নিলেন।

.

বিকাশচন্দ্র একটি সরকারি গাড়িতে তাঁর কাকুকে ডি. এস. পি. যুগল সেনরায়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। যুগল খুশি হলেন পি. কে. বাসু তাঁর বাড়িতে আসছেন শুনে। তিনি সস্ত্রীক বাসু-সাহেবের ফ্যান। বাসু ব্রজদুলালকে নির্দেশ দিলেন ভ্যান গাড়িটা নিয়ে মানসিক হাসপাতালে চলে যেতে এবং অ্যাগি বা অন্যান্য কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে সেই রাত্রের ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ সংগ্রহ করতে। ইন্দ্রকুমার এখন স্বাভাবিক হয়েছে। সেও বললো, ঠিক আছে, স্যার।

যুগলও স্বীকার করলেন যে, মদ্যপাত্রের তলানিতে যে তরল পদার্থ পাওয়া গেছে তাতে বিষের চিহ্নমাত্র না পাওয়া একটা রহস্যজন ঘটনা। তবে সর্বজনসমক্ষে আততায়ী বা তার এজেন্ট হাতসাফাই করে গ্লাসটা বদলে দিয়েছে এটা বিশ্বাস করতে চাইলেন না। যে পুলিস সাব-ইন্সপেক্টর মৃত্যুর খবর পেয়ে তদন্ত করতে যায়, তার উচিত ছিল সবকয়টি পানপাত্রই সংগ্রহ করে আনা। হয়তো যে গ্লাসটা ও তুলে এনেছে, ঠিক তার পাশেই ছিল ডক্টর ঘোষালের বিষাক্ত পানপাত্রটা।

বাসু জানতে চাইলেন, মৃত্যুসময়ে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের জবানবন্দি পুলিস নিশ্চয় সংগ্রহ করেছে। সেই জবানবন্দির এককপি জেরক্স আমার এখনি চাই। সম্ভবপর হলে দু- একজন প্রত্যক্ষদর্শীকে আমি আজই জেরা করতে চাই।

কথা হচ্ছিল ডি. এস. পি-সাহেবের বৈঠকখানায়। মিসেস্ পম্পা সেনরায় বসেছিল সেই আলোচনার আসরে। বাসুসাহেব ওর কর্তার উপরওয়ালার বাড়িতে ব্রেকফাস্ট সেরে এসেছেন, এখন এককাপ কফিও খাবেন না শুনে বেচারি মর্মাহত। বাসু তাকে আশ্বস্ত করেছেন—চুঁচুড়ায় তাঁকে সম্ভবত বার কয়েক আসতে হবে। এর পরের বার উনি পম্পার নিজের হাতে তৈরি রান্না পরখ করে যাবেন, বাজারের মিষ্টি নয়—আর ওর বুক-র‍্যাকে কৌশিকের লেখা সবগুলি কাঁটা-সিরিজের বইতে আশীর্বাদী-স্বাক্ষর দিয়ে যাবেন। তা, এই অবকাশে পম্পা বলে ওঠে, আমি একটা কথা বলব, মামু?

—মামু?

—বাঃ! সুজাতাদি তো আপনাকে ‘মামুই ডাকে।

—ও ইয়েস! তা কী বলবে বল?

—আপনি আমার জবানবন্দিও নিতে পারেন। কারণ সে রাত্রে আমাদের দুজনেরই নিমন্ত্রণ ছিল—ও যেতে পারল না, মস্তানপার্টির বোমাবাজিতে একজন খুন হয়ে যাওয়ায়। আমি গেছিলাম। ডাক্তার ঘোষাল আমার সামনেই মারা যান।

একজন প্রত্যক্ষদর্শীকে হাতের কাছে পেয়ে বাসু উৎসাহিত হয়ে ওঠেন। যথারীতি তাঁর হাত পকেটে প্রবেশ করে— পাইপ-পাউচের সন্ধানে। বলেন, তবে তো সুবিধেই হলো। তুমি গুছিয়ে সব কথা বল তো মা, কী উপলক্ষে ঐ ডিনার পার্টি, কে কে উপস্থিত ছিল—মানে তোমার পরিচিত। আর ঠিক কীভাবে মৃত্যুটা ঘনিয়ে এল। প্রথমে তুমি মনকে সংযত কর, একাগ্র কর, তারপর সেই অতীত মুহূর্তটিকে প্রত্যক্ষ করার চেষ্টা কর। আমাদের উপস্থিতির কথা ভুলে যাবার চেষ্টা কর—ধ্যান করার সময় সাধকেরা যেমন করে। তারপর তোমার স্মৃতিচারণকে বাঙ্ময় করে তোলো। সবটা শুনে আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করব। এখন তোমার স্মৃতিচারণে আমি বা যুগল বাধা দেব না।

তারপর যুগলকিশোরকে বললেন, তুমি তোমার কোনো খিদ্‌মদ্‌গারকে বলে দাও—এখন যেন কেউ ঘরে না আসে—কোনোভাবেই পম্পাকে ডিস্টার্ব না করে।

পম্পা বোধহয় কখনো কল্পনাই করেনি যে, ‘কাঁটা-সিরিজের’ একটি চরিত্রে তাকে, নিজেকে, অভিনয় করতে হবে, তার নাম কোনো বিখ্যাত মাসিক পত্রিকায় ছাপা হবে—হাজার হাজার পাঠক-পাঠিকা পম্পা সেনরায়ের নামটা জানতে পারবে। আচ্ছা, কৌশিকদা কি পম্পার বর্ণনা দিতে একটু যত্ন নেবে? লিখবে কি যে, তার বয়স পঁয়ত্রিশ হলেও তাকে দেখায় সাতাশ-আটাশের কাছাকাছি? সে তন্বী, হ্যাঁ শ্যামাই—তবে ‘মধ্যক্ষামা’; বোঝা যায় না যে, সে দু-দুটি সন্তানের জননী—ওর মাথার চুল…

–কী হলো, এবার শুরু কর?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, বলি :

কী উপলক্ষে নিমন্ত্রণ করেছিলেন ডাক্তারসাহেব তা পম্পা জানে না। ডাক্তার ঘোষালকে সে দশ-বারো বছর ধরে চেনে। বস্তুত সে ছিল ওঁর পেশেন্ট। সপ্তাহে দু-দিন ওঁর চেম্বারে পম্পাকে যেতে হতো—

হঠাৎ বর্ণনা থামিয়ে বাসুসাহেবকে প্রশ্ন করে, একটা কথা মামু! কৌশিকদা কি এই কাহিনীটা কোনো ‘কাঁটা-সিরিজে’ লিখবে?

বাসু ইতিমধ্যে পাইপ ধরিয়েছেন। বলেন, তা তো বলতে পারব না, মা। দু-দুটো ঘটনাই যদি ‘হার্ট-ফেলিওর’ কেস হয় তবে কৌশিক, নিশ্চয় পণ্ডশ্রম করবে না। কিন্তু যদি একটাও—মোস্ট প্রব্যাবলি ডক্টর ঘোষালের কেসটা—যদি খুন হয়, আর আমরা আততায়ীকে চিহ্নিত করতে পারি, তাহলে ও এ নিয়ে একটা গপ্পো লিখতে পারে। কিন্তু সে প্রশ্ন হঠাৎ তোমার মনে এখন জাগল কেন?

—না, মানে তাহলে কৌশিকদাকে বলবেন, হয় আমার নাম-পরিচয় বদলে দিতে, না হলে কী মেন্টাল-কেসে আমার সঙ্গে ডাক্তার ঘোষালের পরিচয় তার উল্লেখ না করতে। আমি যুগলের সামনেই আপনাকে সব কথা অকপটে বলে যেতে চাই।

—বেশ, তাই হবে। বল?

যুগল আর পম্পার বিয়ে হয়েছে প্রায় বিশ বছর আগে। তখন পম্পার বয়স পনের, যুগলের বাইশ। কিন্তু পাঁচ-সাত বছরের ভিতরেও ওদের সংসারে তৃতীয় ভাগীদার এল না। ওরা দুজনেই শিক্ষিত। গাইনো ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়। ডাক্তার দুজনকেই পরীক্ষা করে দেখলেন—আশ্চর্য! দৈহিক ত্রুটি কারও নেই। যে-কোনো মিলনই ফলপ্রসূ হতে পারে; কিন্তু হচ্ছে না। ওরা সাইকিয়াট্রিস্টের শরণাপন্ন হয় এবার—ডক্টর ঘোষালের সঙ্গে দেখা করে। ঘোষাল কিছুদিন পরীক্ষা করে বললেন : পম্পা ভুগছে ‘ফিয়ার-সাইকোসিস্’-এ। মিলন মুহূর্তে ওর মনে হয়—এবারের মিলনও বোধহয় সার্থক হবে না, ফলপ্রসূ হবে না। মানসিক দুশ্চিন্তা শরীরে প্রতিফলিত হয়—হরমোনের সাময়িক হেরফের হয়। মিলন সার্থক হয় না। ডাক্তারসাহেব এবং অ্যাগি ডুরান্ট ওকে নানান পরামর্শ দেন—সেসব বিস্তারিত বাসুসাহেবের না শুনলেও চলবে, আর বলতেও ওর ভীষণ লজ্জা করবে…

বাসু বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, থাম না, মা! প্রথম কথা : সে-সব কথা বর্তমান ‘কেস’-এ ইরেলিভ্যান্ট। দ্বিতীয় কথা : মানসিক-চিকিৎসার ঐসব ব্যাপার আমার মোটামুটি জানা। ফলে বুঝতে পারছি : ডাক্তার ঘোষাল বিজ্ঞানের আশীর্বাদে তোমাকে মাতৃত্বের অধিকারিণী করে তোলেন। তোমার কটি বাচ্চা? তারা কোথায়?

—দুটি। বড়টি ছেলে, ছোটটি মেয়ে। দুজনেই স্কুলে।

—ঠিক আছে। কী সূত্রে তুমি ডাক্তার ঘোষালের সঙ্গে পরিচিত তা বোঝা গেল। তাই তোমাদের দুজনের নিমন্ত্রণ হয়েছিল।

এই সময় যুগলকিশোর বাধা দিয়ে বলে ওঠে, এক্সকিউজ মি, স্যার, ফর মাই ইন্টারাপশন

আরও একটা ব্যাপারে ডক্টর ঘোষাল বহুদিন পরে আমাকে হঠাৎ সেদিন ফোন করেছিলেন।

বাসু বললেন, আই প্রিজম ‘কাল্লুর ব্যাপারে। তাই না?

—আশ্চর্য! আপনি কী করে জানলেন?

—জানি না তো! জানলে আর ‘আই প্রিজ্যুম’ বলব কেন? আন্দাজ করছি। তা কাল্লু মিঞার কিস্সা পরে শুনব। আগে পম্পার জবানবন্দিটা শেষ হোক।

.

ডাক্তার ঘোষালের নিজস্ব বাড়িটি দ্বিতল। তিনি একা মানুষ। একটি সর্বক্ষণের কম্বাইন্ড- হ্যান্ড আছে! নন্দু। সে ছোকরাই হাট-বাজার করে, রান্না করে, ফাই-ফরমাশ খাটে, ঝাঁট-পাট দেয়, বিছানা বানায়। এ-ছাড়া একজন স্থানীয়া পরিচারিকা আছে। সে সকালে আসে, ঘরগুলো মুছে দেয়, কাপড় কাচে, বাসন মাজে। ও-বেলায় সে আসে না। তৃতীয়ত আছে আরও একজন—ডাক্তারবাবুর ফিয়াট গাড়ির ড্রাইভার শৈলেশ মান্না। সে হাসপাতালের স্টাফ—কিন্তু প্রয়োজনে বাড়ির কাজও করে। ইলেকট্রিক বা টেলিফোনের বিল জমা দেওয়া, রেশন তোলা, পোস্টাপিসে যাওয়া, অথবা বাইরের ফাই-ফরমাশ খাটা। এই তো সংসারের তিনটি মানুষ। দ্বিতলে ডাক্তারবাবুর শয়নকক্ষ। একতলায় রান্না-খাবার ঘর, বৈঠকখানা আর মেজানাইন ঘরে থকে শৈলেশ। নন্দ শোয় সিঁড়ি-ঘরের চিলেকোঠায়।

ঘোষালসাহেবের বাড়ির পিছনে বেশ বড় একটি বাঁধানো চাতাল। তার চারপাশে কিছু অযত্নের ফুলের গাছ—গাঁদা, সন্ধ্যামণি, দণ্ডকলস। দু-একটি বড় গাছও—গন্ধরাজ, শিউলি, কলকে ফুল। একটি কলমের আমগাছও আছে। অগ্রহায়ণ মাস। আকাশ নির্মেঘ। ডাক্তারবাবু পিছনের ঐ উন্মুক্ত উদ্যানেই গার্ডেন-পার্টির ব্যবস্থা করেছিলেন। নিমন্ত্রিত মাত্র জনা দশ-বারো।

যুগল বাধা দিয়ে বললো, না। একজ্যাক্টলি নয় জন!

বাসু বললেন, তুমি ওকে বাধা দিও না, প্লিজ! এভাবে বাধা পেলে ও সেই চরম মুহূর্তটাকে স্মৃতি থেকে উদ্ধার করতে পারবে না। নিমন্ত্রিত নয় কি বারো সে সংশোধন তোমার মাধ্যমে পরে করে নেব। আপাতত ওটা জনা দশ-বারো থাক না!

এই সময়েই খিদ্‌মদ্‌গারটি এসে জানাল, মাফ কিজিয়ে সাব। থানা সে বড়বাবু আয়ে হেঁ। মিলনে চাহতে হেঁ।

যুগল কিছু বলার আগেই বাসু প্রশ্ন করেন, ও কি সদর থানার ও. সি. গণেশ সাহার কথা বলছে?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

—শোন। ভদ্রলোককে ডাক। কিন্তু আমি তাঁর সামনে এসব আলোচনা করতে চাই না। ভদ্রলোককে বাইরের রোয়াকে বসিয়ে রেখ। যেন চলে না যায়

যুগলকিশোর একটু অবাক হলেন। তাঁর সেপাইটিকে বললেন, ও. সি. সাব কো আনে বোল!

একটু পরেই ও. সি. এলেন। ধড়াচূড়া পরা। কায়দা মাফিক ডি. এস. পি.-কে স্যালুট করে বললেন, ডি. আই. জি.-সাব আমাকে টেলিফোনে নির্দেশ দিলেন আপনার সঙ্গে দেখা করতে। কী ব্যাপার, স্যার?

যুগল ইতস্তত করে বললেন, ডক্টর ঘোষালের কেসটার কোনো নতুন খবর আছে?

গণেশ একদৃষ্টে বাসুর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বাসু তাকিয়ে ছিলেন তাঁর পাইপটার দিকে। বাসুসাহেবকে যাচাই করতে করতেই গণেশ জবাব দিলেন, আজ্ঞে না। নতুন কোনো ডেভলপমেন্ট হয়নি।

যুগল পুনরায় জানতে চায় : বহরমপুর সেন্ট্রাল জেল কোনো মেসেজ পাঠায় নি?

—আজ্ঞে, আমি তো হাতে পাইনি। ঠিক জানি না।

—ও আচ্ছা। আপনি একটু বাইরে অপেক্ষা করুন। চলে যাবেন না। কথা আছে। এতক্ষণে গণেশের মুণ্ডটা দিক পরিবর্তন করে। তিনি জানতে চান, বাইরে অপেক্ষা করব? ‘বাইরে’ মানে? কোথায়? বাইরের রোয়াকে? ওখানে তো রোদ।

যুগল সামলে নেয় পরিস্থিতিটা। বলে, আপনি জিপে এসেছেন তো? তাতেই বসুন। এ ভদ্রলোকের কেসটা শেষ করেই আপনাকে ডাকব।

গণেশের মুণ্ডু আবার পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি ঘুরল। পুনরায় বাসুসাহেবকে দেখে নিয়ে প্রশ্ন করেন, উনি কি সেই ডাক্তার ঘোষালের ব্যাপারেই এসেছেন, স্যার?

যুগলকিশোরকে জবাব দেবার সুযোগ না দিয়ে বাসু চটজলদি বলে ওঠেন, আজ্ঞে হ্যাঁ, স্যার! সদর থানাতে লোক পাঠিয়েছিলাম জানতে-পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বিষের উল্লেখ আছে কি না। আনফরচুনেটলি তারা রিপোর্টটা সংগ্রহ করতে পারেনি। তাই আমি এসেছিলাম বাচ্চুর কাছ থেকে জানতে, কেসটা ‘পয়েজনিং’-এর কি না—

গণেশচন্দ্র অস্পুটে বললেন : বাচ্চু! বাচ্চু কে?

সমাধান দাখিল করলেন যুগলকিশোর : ডি. আই. জি.-সাহেবের ডাকনাম ‘বাচ্চু; জানেন না?

গণেশের গলকণ্ঠটা বার দুই ওঠানামা করলো।

বাসু যুগলকে বলেন, মার্ডার-কেস-এর এফ. আই. আর. লজ করতেই তিন-চার দিন দেরি হয়ে গেল। জাস্ট তোমার সদর থানার নন-কোয়াপারেটিভ অ্যাটিচ্যুডে! আসামী ধরা পড়লে আদালতে এ প্রশ্ন উঠবেই : কেন এত দেরি হলো এফ. আই. আর. লজ করতে। আই ডোন্ট নো, তোমার সদর থানার ও. সি. মার্ডারারের কাছ থেকে ঘুষ-ফুস্ খেয়ে বসে আছে কি না, নাহলে শুধু মৌখিক প্রশ্নের…

যুগল বাধা দিয়ে বাসুসাহেবকে বলে, ইনিই স্যার, আমাদের সদর থানার ও. সি. শ্রীগণেশচন্দ্র সাহা।

গণেশ থতমত খেয়ে একটা নমস্কার ঠুকে দিলেন। বাসুসাহেব তার প্রতি-সম্ভাষণে পাইপটাকে একটু উঁচু করে ধরলেন—তাকেই যদি তোমরা ‘নমস্কার’ বল, তবে ‘প্রতি-নমস্কার’ করলেন। গণেশ আমতা আমতা করে ডি. এস. পি. -র কাছে জানতে চান, ওঁকে তো ঠিক, স্যার…

—উনি কলকাতা হাইকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের এক্স-প্রেসিডেন্ট পি. কে. বাসু বার- অ্যাট-ল।

গণেশ পুনরায় যুক্তকরে—এবার বেশ একটু ঘাড় নিচু করে—নমস্কার করলেন। সেটা বাসু-সাহেব দেখতেই পেলেন না। কারণ তিনি ততক্ষণে পম্পার দিকে ফিরেছেন। পম্পাকে বলছেন, তুমি এক কাজ কর মা, তোমার কোনো চাকর-টাকরকে বল বাইরে এক-পেয়ালা চা আর বিস্কুট পাঠিয়ে দিতে। উনি অতদূর থানা থেকে এসেছেন, শেষে তোমার গৃহস্থলীর নিন্দে করে না যান।

পম্পা আর যুগল কিছুই বুঝল না। দুজনে অবাক হলো।

মাথা হেঁটে করে গণেশচন্দ্র বাইরে গিয়ে বসলেন।

যুগল এগিয়ে এসে বললো, ব্যাপার কী স্যার?

বাসু বললেন, পরে বুঝিয়ে বলব। থাক ও বাইরে জিপে বসে। আধঘণ্টাখানেক পরে আমি যখন চলে যাব, তখন ওকে ডেকে জানিয়ে দিও যে, গণেশকে আলোচনায় প্রয়োজন হয়নি। হ্যাঁ, যে কথা হচ্ছিলো….