ড্রেস-রিহার্সালের কাঁটা – ১

এক

বাসুসাহেব জানতে চাইলেন, ঐ যে ভদ্রলোক কাউন্টারে বসে আছেন, উনি কি দোকানের মালিক না ম্যানেজার?

সেলসম্যানটি বিনয়ে বিগলিত হয়ে হাত কচলে বললে, আইজ্ঞা হ।

বাসু বিরক্ত হলেন। বললেন, ‘আইজ্ঞা হ’ মানেটা কী? আইদার মালিক, অর ম্যানেজার—দুটোই তো ‘আইজ্ঞা হ’ হতে পারে না।

তাড়াতাড়ি ওপাশ থেকে এগিয়ে আসেন আর একজন বয়স্ক সেলসম্যান। তিনি বুঝতে পারেন মূল সমস্যাটা কোথায়। প্রশ্নকর্তা ঐ স্যুট পরা বৃদ্ধটি হয়তো শুধু বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি জানেন, আর উত্তরদানকারী ছোকরা ওড়িয়া ছাড়া আর কিছু জানে না। সিনিয়র সেলসম্যান এগিয়ে এসে আধা ওড়িয়া আধা হিন্দিতে যে দার্শনিক উক্তিটি করলেন তার বিশুদ্ধ বঙ্গানুবাদ, ছার, এই ঁজগন্নাথধামে যা-কিছু দেখিছেন সব কিছুরই তো মালিক ঐ প্রভু ‘কালিয়া’। উনি ম্যানেজার বটেন।

বাসু বললেন, আপনি সত্য কথাই বলেছেন, তবে ‘হোল-টুথ’ নয়। প্রভু ‘কালিয়া’ শুধু জগন্নাথধামেরই মালিক নন, বিশ্বপ্রপঞ্চের মালিক! তা সে যাই হোক, আমাদের পছন্দ করা শাড়ি পাঁচখানা নিয়ে ঐ ম্যানেজারের কাছে চলুন। এস সুজাতা-

কাউন্টারের ম্যানেজার ভদ্রলোক এতক্ষণ উৎকর্ণ হয়ে শুনছিলেন, এবার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, নমস্কার, আইজ্ঞা।

বাসু প্রতিনমস্কার করে বললেন, এই পাঁচখানা শাড়ি আমাদের পছন্দ হয়েছে। তবে পাঁচখানাই কিনব না। চারখানা রাখব, একটা ফেরত দেব। ফাইনাল নির্বাচন করবেন আমার স্ত্রী। কিন্তু তিনি অসুস্থ। দোকানে আসতে পারবেন না। আপনি এই কার্ডখানা রাখুন, আমার ঠিকানা এতে লেখা আছে। আর এই পাঁচশো টাকার নোটখানা রাখুন, অ্যাডভান্স হিসাবে। সন্ধেবেলা আপনার লোক যেন শাড়িগুলো নিয়ে আমার বাড়িতে আসে। তার যাতায়াতের রিক্শা ভাড়াও আমি দিয়ে দেব!

—না, স্যার। রিশ্বাভাড়া লাগবেক নেই! সুবল সাইকেলে চাপ্যে যিব, আইজ্ঞা।

—ঠিক আছে, সেটা সুবলের সঙ্গে আমি ফয়সালা করে নেব। তবে ওর হাতে ক্যাশমেমো বইটাও পাঠিয়ে দেবেন, যাতে বাকি টাকা দিয়ে আমি রসিদ নিতে পারি।

ম্যানেজার স্বীকৃত হলেন। বাসুসাহেব সুজাতাকে নিয়ে রওনা দিলেন নির্গমন দ্বারের দিকে। দোকানটা স্বর্গারের কাছাকাছি। ভারত সেবাশ্রম আশ্রমের বিপরীতে, বড় রাস্তার উপরেই। কোল্যাপসি দরজা পাড়ি দিয়ে বড় রাস্তায় নামবার মুখেই কে যেন পাশ থেকে ডেকে উঠল, ব্যারিস্টারসাহেব না?

বাসু দাঁড়িয়ে পড়লেন পাপোসের উপর। মুখ তুলে দেখলেন। সুজাতা তার লেডিজ ছাতাটা সবে খোলবার উপক্রম করছিল। ক্ষান্ত দিল সে প্রচেষ্টায়।

বক্তা মধ্যবয়সী—না, বৃদ্ধই। পঞ্চাশের ওপারে। শৌখিন ব্যক্তি, তা তাঁর পোশাক- আশাকেই বোঝা যায়। পরিধানে ধাক্কা পাড় ধুতি, গায়ে গিলে করা পাঞ্জাবি, পায়ে শুঁড়তোলা নাগরা, হাতে হাতির দাঁতের মুঠওয়ালা ছড়ি এবং বাঁ হাতে গ্রহবারণ গোটা-চারেক আংটি—বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটা একাই বেকসুর খালাস পেয়েছে।

বাসু তাঁর নিজের পরিচয়টা স্বীকার করে বললেন, আপনাকে তো ঠিক….

ভদ্রলোক সে কথার জবাব না দিয়ে বলে ওঠেন, ওফ্। কী সৌভাগ্য আমার! পুরীতে এসে এমন বেমক্কা আপনাকে অ্যারেস্ট করে ফেলব ভাবতেই পারিনি।

তারপর পাশে ফিরে বললেন, এ কী মা সুজাতা! দোকান থেকে খালি হাতে বেরিয়ে আসছ যে? কিছুই পছন্দ হলো না?

সুজাতাও সরাসরি ওঁর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললে, মাপ করবেন, আমিও কিন্তু আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না।

ভদ্রলোক এত জোরে অট্টহাস্য করে উঠলেন যে, রাস্তার লোকজন এদিকে ফিরে তাকালো। পথচলতি একটি ওড়িয়া মেয়ের কোলের বাচ্চাটা বেমক্কা চিক্কুড় পেড়ে কাঁদতে শুরু করলো। ঠিক সেই সময়ই নামলো গুড়ি-গুড়ি বৃষ্টি।

বাসু সুজাতাকে ডাকলেন, দোকানের ভিতরে চলে এস সুজাতা, নাহলে ভিজে যাবে।

ম্যানেজারের ব্যবস্থাপনায় খানতিনেক ফোল্ডিং চেয়ার এসে গেল। ম্যানেজার বিশুদ্ধ ওড়িয়াতে নবাগতকে বললেন, রায়মশাই কবে এসেছেন? থাকবেন তো কিছুদিন?

রায়মশাই শুদ্ধ ওড়িয়াতেই উত্তরে জানালেন, এসেছি গতকাল। কদ্দিন থাকব বলতে পারছি না।

এদিকে ফিরতেই বাসু বললেন, আপনার পূর্ণ পরিচয়টা কিন্তু এখনো পাইনি, রায়মশাই।

রায় পকেট থেকে স্টেট এক্সপ্রেসের একটা প্যাকেট বার করে বাসুসাহেবের দিকে বাড়িয়ে ধরলেন। বাসু অস্বীকার করে পকেট থেকে পাইপ-পাউচ বার করলেন। বৃষ্টিটা না ধরা পর্যন্ত পথে নামা যাবে না। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ চলছে। উল্টোরথ শেষ হয়েছে, দুর্গাপূজার হিড়িক শুরু হয়নি। ম্যানেজার দুই ধূমপায়ীর মাঝখানে নিশ্চুপ বসে থাকা সুজাতার দিকে একটি সুদৃশ্য পানের ডিবা বাড়িয়ে ধরে মাতৃভাষায় বললেন, আসুন মা, জর্দা দেওয়া নেই। নির্ভয়ে খেতে পারেন।

ড্রেস-রিহার্সালের কাঁটা রায় বললেন, পুরো নামটা আমি বলব না, ব্যারিস্টারসাহেব, আপনাকে মনে করতে হবে। কিছু ক্লু অবশ্য আমি দিচ্ছি। আপনার জেরার সম্মুখীন হতে হয়েছিল আমাকে। একটা ‘এম্বেমেন্ট’ মামলায়, বছর আষ্টেক আগে। সাক্ষী হিসাবে।

পাইপে আগুন দিতে দিতে বাসু বলেন, উইটনেস্ ফর দ্য ডিফেন্স?

—নো, স্যার! উইটনেস্ ফর দ্য প্রসিকিউশন। আমি ‘বার’ নিয়ে গুলিয়ে ফেলেছিলাম। মানে বারবার আপনি কথার প্যাঁচে বারটা গুলিয়ে দিয়েছিলেন….

—’বার’ মানে? আদালতের বার অ্যাসোসিয়েশন, না জিমন্যাসিয়ামের প্যারালাল বার? নাকি ক্যাডবেরি চকোলেটের প্যাকেট?

রায়সাহেব মৃদু-মৃদু হাসছিলেন। গ্র্যান্ডফাদার ক্লকের পেন্ডুলামের মতো মাথা দোলাচ্ছিলেন।

—তবে কি শুঁড়িখানার ‘বার’? অথবা এক্কেরে শেষ নিদান ‘Let there be no moaning at the bar’?

—আজ্ঞে না! এখনো বুলস্ আই হিট করতে পারেননি!

পানের বোঁটা থেকে একটু চুন আঙুলে করে নিয়ে দাঁতে কেটে সুজাতা বললে, মামু ফেল করলে কি হবে, তাঁর ভাগ্নী পাস করেছে। আমি ধরে ফেলেছি। আপনি সোম-মঙ্গল-বুধ বেস্পতির কথা বলছেন!

—এজ্যাক্টলি!—রায় উৎসাহিত হয়ে ওঠেন।

তৎক্ষণাৎ বাসু বলেন, ভুল বললে সুজাতা! মামু ফেল করেনি। আজকাল গ্রে-সেলগুলোয় মাঝে মাঝে জট পাকিয়ে যায়। শুনুন রায়মশাই! য়ু আর স্পটেড: ব্রজদুলাল রায়। শ্যামবাজারের মোড়ে সেই ‘নটরঙ্গ’ হাউসের মালিক—অবশ্য মালিক তো প্রভু জগন্নাথ, আপনি তাঁর অছিমাত্র। পুলিস একটা নিরীহ বোকাসোকা লোককে চালান দিয়েছিল। সে নাকি আপনার ক্যাশ ভেঙে এক লাখ ছত্রিশ হাজার টাকা তছরুপ করে।

—ইয়েস, স্যার! ওয়ান পয়েন্ট থ্রি সিক্স! কারেক্ট! হান্ড্রেড পার্সেন্ট কারেক্ট! সেই বোকাসোকা ছোকরাকে আপনি বেকসুর খালাস করেন। অপরাধীও ধরা পড়েছিল, জেলে গিয়েছিল। তবে গোটা টাকাটা উদ্ধার হয়নি।

—আপনার তো পুরীতেও একটা বাড়ি ছিল, তাই না?

—’ছিল’ বলছেন কেন, স্যার? আছে। ঘটমান বর্তমানেও সেটা আছে। ‘দ্য রিট্রিট’। সমুদ্রের উপরেই। আর সেখানেই আপনাদের নিমন্ত্রণ করতে চাইছি। পরশু রাত্রে ডিনারে। আপনাদের চারজনকেই—স্যাটার্ডে ইভনিং…

বাসু বললেন, একটু রয়ে সয়ে রায়মশাই। বদ অভ্যাসটা আপনার এখনো যায়নি মনে হচ্ছে। প্রথম কথা : আজ বুধবার, চৌঠা অক্টোবর। ফলে পরশু হচ্ছে শুক্রবার, ছয় তারিখ। শনিবার, সাত তারিখ হচ্ছে তার পরদিন, পরশু নয় সেটা। পরশুর পর : তরশু!

রায়মশাই মর্মাহত হলেন : ওফ্! আবার সেই বার নিয়ে বাড়াবাড়ি, বিড়ম্বনা। আজ্ঞে না, পরশু নয়, আমি শনিবার সাত তারিখ সন্ধ্যার কথাই বলছি…

—বুঝলাম। উপলক্ষটা?

রায়মশাই বুঝিয়ে বললেন সব কথা। ওঁর এক বিশেষ বঙ্কুর জন্মদিন হচ্ছে উপলক্ষ। বঙ্কুও বটে, আবার এমপ্লয়িও বটে। ‘নটরঙ্গ’-এ একাদিক্রমে আঠারো বছর নায়কের চরিত্রে অভিনয় করে চলেছে। না, একাদিক্রমে নয়। মাঝে বছর দুই যাত্রায় যায়। আরও বছর দুই সিনেমার এত কন্ট্রাক্ট পায় যে, সপ্তাহে তিন দিন কমার্শিয়াল পাবলিক বোর্ডে হাজিরা দেওয়া শক্ত হয়ে পড়েছিল। তারপর বাংলা চিত্রজগতে এল মন্দা। সিরিয়ালে ও ঠিক পাত্তা পেল না। বয়সটাও গেছে বেড়ে। হিরোর চরিত্রে ওকে মানায় না আর। অধিকাংশ নটের জীবনেই আসে এমন একটা ক্রান্তিকাল। প্রাকৃতিক নিয়মকে মেনে নিয়ে বাবা-কাকার চরিত্রে অভিনয় করবে, না স্বেচ্ছা অবসর নেবে! রায়-মশাই ওকে উদ্ধার করে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন ‘নটরঙ্গ’-এ। থিয়েটারে B.C.U.-এর বালাই নেই—মানে, ‘বিগ-ক্লোজ-আপ’! ফলে এখানে আরও বছর পাঁচেক ওকে হিরোর রোলে চালানো যাবে।

যে কথাটা রায়মশাই স্পষ্টাক্ষরে স্বীকার করলেন না, অথচ বুঝতে অসুবিধা হলো না বাসু- সাহেবের, সেটা এই : প্রৌঢ় নট বাধ্য হয়ে হয়তো হাফ-প্রাইসে চুক্তি করেছে।

সুজাতা বললে, আপনি কি ‘ইন্দ্রকুমার’-এর কথা বলছেন?

—ওফ্! তোমার তো দারুণ বুদ্ধি মা-সুজাতা! ঠিক ধরেছ।

বাসু বললেন, এর সঙ্গে বুদ্ধির কোনো সম্পর্ক নেই। সুজাতা আর কৌশিক সুযোগ পেলেই থিয়েটার দেখতে যায়। অবশ্য ওরা গ্রুপ-থিয়েটারই বেশি দেখে; তবে শ্যামবাজারের ঐ থিয়েটার রোডেও যায় মাঝে মাঝে।

—শ্যামবাজারের ‘থিয়েটার রোড’! সেটা আবার কোনটা?

—ঐ মধ্য কলকাতার ‘থিয়েটার রোডটা ‘শেক্ষপীয়র সরণি’ হয়ে যাবার পর শ্যামবাজার সাতমাথার কাছাকাছি যে রাস্তাটার নাম ‘থিয়েটার রোড’ হওয়া উচিত ছিল। ভবানীপুরে যেমন পর পর লক্ষ্মীবাবুর ‘আসলি’ সোনা-চাঁদির দোকান, ওখানেও তেমনি প্রতিটি হলেই দেখানো হয় সর্বসময়ে ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক’।

রায়সাহেব বলেন, ওফ্! এ না হলে ব্যারিস্টার! কিন্তু একটা কথা ব্যারিস্টারসাহেব, শ্যামবাজারের ঐ মোড়টা সাতমাথার নয়, পাঁচমাথার

বাসু বলেন, না সাত। আমি নেতাজী আর তাঁর ঘোড়ার মাথাদুটো ধরে বলেছি। সে যা হোক। শুনুন মশাই। শনিবার সাত তারিখে আমরা দুজন যাব-

—দুজন কেন স্যার? মিসেস বাসু বা মিস্টার কৌশিক মিত্র আসেননি?

—এসেছেন। কিন্তু আমার স্ত্রী…

রায় বাধা দিয়ে বলেন, আই নো! আই নো! ঠিক আছে। তাঁকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই। তা পুরীতে এলেন কী করে? আছেনই বা কোথায়?

বাসু ওঁকেও একটি কার্ড বার করে দিলেন, যার পিছনে ওঁর পুরীর অস্থায়ী আস্তানার ঠিকানা ও টেলিফোন নাম্বারটা লেখা আছে। বললেন, এসেছি প্লেনে, মানে আমরা দুজন। সুজাতা-কৌশিক ট্রেনে করে এসেছে আগেই। হুইল-চেয়ার আর গাড়ি নিয়ে ভুবনেশ্বরের এয়ারোড্রোমে অ্যাটেন্ড করেছিল।

—তা হোটেলে থাকার কী দরকার? আমার ‘দ্য রিট্রিট’-এ আটখানা ডবল-বেড রুম আছে। কোন অসুবিধা হবে না।

বাসু বুঝিয়ে বললেন, যেখানে আছেন সেটা হোটেল নয়। ওঁর এক ক্লায়েন্টের বাড়ি। ফাঁকাই পড়ে থাকে। মাঝেমধ্যে কর্তারা এসে ওঠেন।

বৃষ্টিটা এতক্ষণে ছেড়েছে। বাসু জানতে চাইলেন, তা ইন্দ্রকুমারের জন্মদিন কলকাতায় না হয়ে পুরীতে প্রতিপালিত হচ্ছে কেন?

রায় বলেন, ওফ্! আপনার জেরার জ্বালায় জেরবার! শুনুন মশাই! জোয়ারের সময় প্রতিটি জন্মদিনকে মনে হয় ‘হ্যাপি বার্থ-ডে’; কিন্তু ভাঁটার টান এলে মরা গাঙ ভাবে : জীবনের বরাদ্দ করা বার্থ-ডের একটা খসল! ইন্দ্রের বয়স পঞ্চাশ…

বাধা দিয়ে সুজাতা বলে, কী বলছেন! পঞ্চাশ?

ড্রেস-রিহার্সালের কাঁটা

—হ্যাঁ, মা! ম্যাট্রিক সার্টিফিকেট অনুযায়ী। যদ্দূর জানি, দুই বছর হাতে রেখে ওকে ইস্কুলে ভর্তি করানো হয়েছিল। সেটা ধরলে—জগন্নাথধামে দাঁড়িয়ে মিছে কথা বলব না—ওর এটা ‘দু-কুড়ি-একডজন-মার্কা’ জন্মদিন। কিন্তু আমরা অফিসিয়ালি এটাকে ওর ফর্টি থার্ড বার্থ ডে বলছি। বেয়াল্লিশ পার হয়ে এই সবে তেতাল্লিশে পা দিচ্ছে ইন্দ্ৰ!

বাসু বলেন, কেন? বয়স নিয়ে এভাবে এম্বেমেন্ট করার কারণটা কী?

—ওফ্! আপনাকে কী করে বোঝাই! হিরোর একটা পাবলিক-ইমেজ তো চাই! দেখলেন না, ওর বয়স পঞ্চাশ শুনে সুজাতা-মা কী ভীষণ আঁৎকে উঠেছিল!

সুজাতা বললে, তা সত্যি! আমি ভাবতেই পারিনি এতটা বয়স হয়েছে ইন্দ্রকুমারের!

—হ্যাঁ! দারুণ মেকআপ নিতে পারে ইন্দ্রটা! ও আমাকে বলেছিল শরৎবাবুর শুধু তিনটি বইয়ে ও নামভূমিকায় নামতে পারবে না—এক, ‘রামের সুমতি’-র রাম, দুই, ‘মহেশ’-র মহেশ, আর তিন, ‘গৃহদাহ’-র আগুনে-পোড়া মহিমের বাড়িটা।

সুজাতা হেসে ফেলে। বলে, সত্যি, ওঁর মেকআপ নেবার ক্ষমতা দারুণ। আমি ওঁকে লেনিন থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ—বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করতে দেখেছি। চেনাই যায় না!

রায় বলেন, কী জান, মা? একবার পেলেকে ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন কলকাতায় নিয়ে এসে ইডেনে খেলায়। পেলে তার সুনাম অনুযায়ী খেলতে পারেনি। লোকে বলাবলি করেছিল : আসলে বহু টাকার টিকিট বেচে ওরা ইন্দ্রকুমারকে পেলে সাজিয়ে মাঠে নামায়!

সুজাতা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে

বাসু বলেন, চল এবার ওঠা যাক। বৃষ্টিটা ধরেছে।

—তাহলে আসছেন তো স্যার?

—শিওর। তবে চারজন নয়। দুজন।

দুই

পরদিন সকালে সবাই বসেছেন ব্রেকফাস্ট টেবিলে। রানীদেবী অনুযোগ করছিলেন, কলকাতার সোস্যাল-লাইফ থেকে অব্যাহতি পাবার জন্যেই কদিন পুরীতে পালিয়ে এলাম, আর তুমি এখানে এসেই ডিনারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বসলে! দারুণ নোলা বাপু তোমার!

বাসু বলেন, কী করব বল, রানু? আমি কি ইচ্ছে করে নিলাম? ইন্দ্রকুমারের নাম শুনেই সুজাতা এমন ছোঁকছোঁক করতে শুরু করলো যে, ভদ্রলোক তো প্রায় বাধ্য হয়েই নিমন্ত্রণ করে বসলেন।

সুজাতা কাপে কাপে কফি ঢালছিল। বললো, বাজে কথা একদম বলবেন না, মামু! সেই বাহান্ন বছরের বুড়োর জন্যে আমার তো রাতে ঘুম হচ্ছিলো না…

বাসু বললেন, উল্টোপাল্টা কথা বল না, সুজাতা। অফিসিয়ালি ওর বয়স বেয়াল্লিশ! বাহান্ন বছর কী বলছ?

কৌশিক টোস্টে একটা কামড় দিয়ে বললে, বয়সটা বাড়তি না কমতি? আই মিন, বেয়াল্লিশের পর কি তেতাল্লিশ-চুয়াল্লিশ হবে, না উদো-বুধোর আইনে একচল্লিশ, চল্লিশের দিকে নামতে থাকবে?

বাসু কিছু বলার আগেই টেলিফোনটা বেজে উঠল। বিশু—সে যথারীতি এসেছে দলের সঙ্গে—আগ বাড়িয়ে ধরল টেলিফোনটা। তারপর শুনে নিয়ে ‘কথামুখে’ হাত চাপা দিয়ে বললে, সাহেবের ফোন।

—তাহলে নিয়ে আয় যন্ত্রটা।

যে ক্লায়েন্টের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন সে একজন ধনী ব্যবসায়ী। পুরীর বাড়িতে কুক সার্ভেন্ট-মালী সব কিছুই পৃথক রাখা আছে। ফোনটাও কর্ডলেস। বিশ্বনাথ ফোনটা নিয়ে এসে বাসু-সাহেবের হাতে ধরিয়ে দিল।

—বাসু বলছি!

ও প্রান্ত থেকে প্রশ্ন হলো, বেরুচ্ছেন নাকি? আমি ব্রজদুলাল বলছি।

—না, এই তো বেড়িয়ে ফিরলাম। ব্রেকফাস্টে বসেছি। কেন বলুন তো?

—আপনার যদি অসুবিধা না হয় তাহলে আধঘণ্টা-খানেক পরে আমরা কজন আসছি। আপনার সঙ্গে আলাপ করার জন্য আমার অতিথিরা সবাই উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠেছেন। অবশ্য আপনাদের যদি অন্য কোনো প্রোগ্রাম থাকে….

বাসু বললেন, সুজাতা-কৌশিক বেরুবে। আমরা দুজন বাড়িতেই আছি। আসুন, গল্পগুজব করা যাবে। এসে ব্রেকফাস্ট সারবেন তো?

—না না, ওফ্! সে কি! আমাদের ব্রেকফাস্ট অনেকক্ষণ সারা হয়েছে।

—আমাদের বাড়িতে আসার পথের ডিরেকশনটা দেব?

—কোনো দরকার নেই। আপনার মক্কেল জওহরলাল আগরওয়াল একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি। তাঁর বাড়িটা আমি চিনি। আমরা তাহলে আধঘণ্টা-খানেকের মধ্যেই আসছি। আমরা ছয়জন।

—অল রাইট। ওয়েলকাম।—বলে টেলিফোনটা বিশের হাতে দিয়ে গৃহিণীর দিকে ফিরে বললেন, ওঁরা ছয়জন আসছেন। এত সকালে বীয়র বা জিন অফার করাটা কি ভালো দেখাবে?

রানী বললেন, না। দেখাবে না। পাঁড় মাতাল না হলে কেউ সকাল সাড়ে আটটায় মদ খেতে চায় না। সেকেন্ড-কাপ চা-বিস্কুট খেতে চায় তো ভাল, না হলে ডাব খাওয়াব।

.

একটু পরেই দুখানা গাড়ি বোঝাই হয়ে ওঁরা এলেন। একটা মারুতি ভ্যান, একটা ফিয়াট। প্রথমটি রায়মশায়ের, দ্বিতীয়টি শোনা গেল মিসেস্ মোহান্তির।

সুজাতা-কৌশিকের একটু মার্কেটিং-এ যাবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ওঁদের আগমন পর্যন্ত প্রতীক্ষা করে গেল তারা। ব্রজদুলাল ব্যতিরেকে আরও যে পাঁচজন এলেন, তাঁদের পরিচয় এই রকম :

এক : ইন্দ্রকুমার চৌধুরী। বয়স 42/(52)। মাঝারি গঠন। গোঁফ-দাড়ি কামানো। মেকআপ ছাড়া(?) এখন দেখলে মনে হচ্ছে মধ্য-চল্লিশ। ব্যাকব্রাশ চুল। কুচকুচে কালো। কলপ রঙের। গায়ে একটি চক্রা-বক্ত্ররা কলার-ওয়ালা স্পোর্টিং শার্ট—যা বিশ থেকে পঁচিশের পক্ষেই শোভন হতো। নিম্নাঙ্গে জিন্‌স-এর প্যান্ট। হাঁটুর কাছে পকেট।

দুই : ডক্টর শিবশঙ্কর ঘোষাল, এম. ডি। বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। তিনি যে ইন্দ্রকুমারের স্কুলজীবনের সহপাঠী এ-কথাটা গোপন রাখতে ভালোবাসেন। কারণ তাঁর চেহারা দেখলেই বোঝা যায় যে, তিনি অর্ধশতাব্দী পাড়ি দিয়ে এসেছেন। ইন্দ্রকুমারের কলপ-কাম-জিন্‌স-কাম- চক্রা-বক্রা স্পোটিং শার্ট-এর সঙ্গে তাঁর ইন্দ্রলুপ্ত পাকা গোঁফ এতই বে-মানান যে, কথাটা উনি ইন্দ্রের ইমেজের খাতিরে চেপে যেতেই ভালোবাসেন। উনি একজন পশারওয়ালা ড্রেস-রিহার্সালের কাঁটা সাইকিয়াটিস্ট ডাক্তার। চুঁচুড়ায় নিজস্ব একটি নার্সিংহোম আছে। পাঁচতলা বাড়ি। লিফট্ আছে। সবসমেত তেরটি বেড। সাতটি ফিমেল বেড এবং ছয়টি পুরুষের। উনি নিজে থাকেন পৃথক বাড়িতে। কাছেই। একতলায় আউট-ডোর, চেম্বার, ও. টি. প্রভৃতি। ঘোষালসাহেব অকৃতদার। শোনা যায়—নিতান্ত বাল্যকালে তাঁর সঙ্গে কার বুঝি ‘কাফ-ল্যভ’ হয়। মেয়েটির অন্যত্র বিয়ে হয়ে যাওয়ায় উনি সারাজীবন বিবাহই করেননি। এ রটনা সত্য কি মিথ্যা তা হয়তো বলতে পারতেন ইন্দ্রকুমার। বলতেন না। স্বাভাবিক কারণে। তাহলে তাঁকে স্বীকার করতে হয় পঞ্চাশোর্ধ্ব বৃদ্ধ শিবুডাক্তার ওঁর বাল্যবঙ্কু। এটা চাপা দেবার জন্য ইন্দ্রকুমার ঘোষালকে বারবার দাদা ডাকেন–হয় ‘শিবুদা’ নয় ‘ঘোষালদা’, অথবা ‘ডাক্তারদা’।

তিন এবং চার : মা-মেয়ে। মিসেস্ আর মিস্ মোহান্তি। মিসেস্ মোহান্তি সাদা-ঘেঁষা একটা শিফন পরে এসেছেন। চুল বব্‌কাট, নখ ম্যানিকিওর করা। মুখে প্রচুর মেক-আপ, অরিজিনাল গাত্রবর্ণ কর্পূর! ঠোঁটে ভার্মিলিয়ান লিপস্টিক। তিনি প্রাক্তন রাষ্ট্রমন্ত্রী মোহান্তি সাহেবের বিধবা এবং বলে না দিলে বোঝা মুশকিল তাঁর বয়স চল্লিশোর্ধ্বে। মোহান্তি ছিলেন পট্টনায়কসাহেবের প্রিয়পাত্র। এককালে মোহান্তি সপাটে দোহাত্তা কামিয়েছেন। নির্বাচনে ওঁদের পার্টির মুখ্যমন্ত্রীর পরাজয়ের পরেই তাঁর বিরুদ্ধে সি. বি. আই. তদন্তে নেমেছিল। করুণাময় যমরাজের বদান্যতায় অব্যাহতি পেয়েছেন। ফলে গুণবতী মোহান্তি স্বামীর উপার্জিত কুবেরিষিত অতুল বৈভবের মালকিন হয়েছেন। জনশ্রুতি, কন্যাটিকে পাত্রস্থ করার পূর্বে তিনি পুনর্বিবাহ করবেন না।

কন্যা সুভদ্রা মোহান্তি পিতার জীবিতকালে পাস কোর্সে বি. এ. পাস করেছিল। স্কুলে- কলেজে তাকে অন্তত ‘পাস-মার্ক’টুকু না দেবার ঔদ্ধত্য দেখানোর হিম্মৎ কারও হয়নি। হেতুটা সহজবোধ্য : পরীক্ষকদের, ট্যাবুলেটার এবং পর্ষদ ডিরেক্টরের ঘাড়ে ছিল যথারীতি এক-একটা করেই মাথা। কিন্তু রাষ্ট্রমন্ত্রী মোহান্তিসাহেবের ‘পটলোৎপাদন’-এর পর সুভদ্রার পক্ষে এম. এ- তে সিট পাওয়াই অসম্ভব হয়ে পড়ে। পড়া বা পাস করা তো পরের কথা। গুণবতীর চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। কিন্তু জমানা বদলে গেছে। স্বয়ং ‘পট্টনায়ক-সাহেব’ নির্বাচনে হেরে ভূত হলেন। প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রমন্ত্রীর বিধবার কথা কে শুনবে? ফলে সুভদ্রা ঝুঁকল ফিল্ম-লাইনে। যৌবনের চটক এখনো আছে—ছাব্বিশ-এর কাছাকাছি। মুখটা ভাগ্যক্রমে ফটোজিনিক। কণ্ঠস্বরও মাইক ফিটিং। গাত্রবর্ণ কোনও ফ্যাক্টরই নয়, আজকালকার রূপসজ্জার দৌলতে। গুণবতী একমাত্র মেয়েকে কুচিপুড়ি নাচটা শিখিয়েছিলেন। সেটা সত্যিই ভালো করে শিখেছিল সুভদ্রা। দ্বিতীয়ত শিখেছে বাংলা ভাষাটা। অন্তত কথ্য ভাষাটা। ফলে ‘ডবল-ভার্শান’ ছবি হলে সুভদ্রার চান্সটা বেশি। খান-তিনেক বই করে সুভদ্রা এখন উদীয়মানা ওড়িয়া শিল্পী। ব্রজদুলাল তাকে নটরঙ্গ-এ পাকাপাকিভাবে নিতে চান।

দলের পঞ্চম ব্যক্তিটি জয়ন্ত মহাপাত্র। সুভদ্রার প্রায় সমবয়সী, হয়তো দু-চার বছরের বড়। অত্যন্ত সুদর্শন। বাংলা, হিন্দি, ওড়িয়া তিনটি ভাষাতেই নির্ভুল কথা বলতে পারে। তার অ্যাম্বিশন— ছবিতে নামা, কিন্তু আজও সুযোগ পায়নি। সুভদ্রাকে সে ভালোবাসে, হয়তো সুভদ্রাও বাসে; কিন্তু গুণবতী ছোকরাকে বরদাস্ত করেন না। স্বাভাবিক হেতুতে। জয়ন্ত কলকাতায় ক্যানিং স্ট্রিটে একটা অফিসে কী একটা অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সিতে কাজ করে। মাস মাহিনা, না কমিশন বেসিসে তা জানা যায় না। ইন্দ্রদার জন্মদিন উপলক্ষে পুরীতে পার্টি হবে শুনে সেও দলে ভিড়ে গেছে। সে অবশ্য ব্রজদুলালের অতিথি নয়। তার এক মাসতুতো দাদার বাড়িতে উঠেছে।

বাসু জানতে চাইলেন, আপনারা তো ব্রেকফাস্ট সেরে এসেছেন বললেন, তাহলে এখন কী হবে? সেকেন্ড রাউন্ড চা-কফি, না ঠাণ্ডাই?

ব্রজদুলাল বললেন, ওফ্! তা নিয়ে এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? সেসব তো একটু পরেও হতে পারে। প্রথমে কিছুটা খোশগল্প চলুক!

ইন্দ্রকুমার বললেন, কৌশিকবাবুর কল্যাণে আপনার কাঁটা-সিরিজের বেশ কিছু কীর্তি- কাহিনী আমরা জেনেছি, বাসুসাহেব। আজ চাক্ষুষ দেখা-সাক্ষাৎ হয়ে গেল। এরপর কোনো খুন-জখমের মামলায় জড়িয়ে পড়লে সরাসরি আপনার দ্বারস্থ হতে পারব। নতুন করে পরিচয় দিতে হবে না।

ব্রজদুলাল বলেন, একটা কথা ইন্দ্র, শুধু জড়িয়ে পড়লেই যেও। খুন হলে যেও না যেন!

ইন্দ্ৰ জানতে চায়, তার মানে?

—ওফ্! সহজ কথাটা বোঝ না। ‘খুন’ হয়ে গেলে তো এক ঝুড়ি চন্দ্রবিন্দু লাগবে কথা বলতে; ‘ব্যারিস্টার সাঁহেব! আমার খুঁনের কিনারা কাঁইন্ডলি করে দেঁবেন?’

সবাই হো-হো করে হেসে ওঠে। ব্রজদুলাল আরও বলেন, মিসেস্ বাসু পৃথক শয়নকক্ষে রাত্রিযাপন করেন কি না তা জানি না—জানতে চাওয়াও সৌজন্যে বাধবে—তবে তা যদি করেন তাহলে তাঁর জন্যেই আমার চিন্তাটা বেশি হচ্ছে! তিনি না হার্টফেল করে বসেন অত- অত চন্দ্ৰবিন্দুতে!

রানী খিখিল করে হেসে ওঠেন। জবাবে বলেন, আমার কিন্তু সৌজন্যে বাধছে না। আমার সরাসরি প্রশ্ন : আপনি একা পুরীতে এলেন কেন? মিসেস্ রায়কে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন না কেন?

—ওফ্! যে-বেদনার কথাটা ভুলে থাকতে চাই, আপনি সেই প্রসঙ্গটাই টেনে আনছেন! কলকাতায় আমার শয়নকক্ষে এভরিনাইট স্ত্রী ভূমিকা-বর্জিত নাটকের আয়োজন। অর্থাৎ কলকাতাতেও আমার শূন্যপুরী, এখানে তো ডবল শূন্যপুরী! আই মিন পুরীও শূন্যপুরী!

রানী বললেন, আয়াম সরি।

ডঃ ঘোষাল বলেন, না, না, ব্রজ উইডোয়ার নয়, কনফার্মড ব্যাচিলার!

বাসু বলেন, বাঃ! আপনারা তিন বঙ্কুই তাহলে কনফার্মড ব্যাচিলার? ব্রজদুলাল, ডঃ ঘোষাল আর ই কুমার?

ব্রজদুলাল বললেন, আজ্ঞে না! একটু ভুল হলো আপনার। ইন্দ্রকুমার ব্যাচিলার, কিন্তু কনফার্মড ব্যাচিলার নয়। ওর বিয়ে করার বয়স এখনো যায়নি।

কৌশিক বলে, তা তো বটেই, পরশুই তো ওঁর উনচল্লিশ বছর শেষ হবে। চল্লিশে পা দেবেন। তাই না?

ইন্দ্র গম্ভীর হয়ে বলে, না। তেতাল্লিশে পড়ব।

ব্রজদুলাল যুক্তকরে বলেন, ব্যারিস্টারসাহেব যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে একটা কথা নিবেদন করি?

—বলুন না, কী এমন কথা?

—গাড়িতে আমার ক-একটা ‘কেরুস্-জিন’-এর বোতল আছে। সিট্রা আর বরফের যোগানের ব্যবস্থাটা আপনি যদি করেন…

বাসু বলেন, ঠিক আছে; কিন্তু আমাকে বাদ দিয়ে। জিনটা আমার সহ্য হয় না। গলা শুকিয়ে ওঠে।

ডঃ ঘোষাল বললেন, আমারও তাই। আমিও জিন খাই না আদপে। তবে কোল্ডড্রিঙ্কস্ নেব।

ড্রেস-রিহার্সালের কাঁটা সুজাতা উঠে গেল স্ন্যাকস্-এর ব্যবস্থা করতে। ফ্রিজ থেকে সিট্রা আর বরফ নিয়ে আসতে।

এক রাউন্ড জিন পান করার পর ইন্দ্র বললো, আমি সুইমিং ট্রাঙ্ক সঙ্গে করেই এনেছি। গাড়িতে আছে। এবার আমি সমুদ্রস্নানে যাব। এরপর রোদ চড়ে যাবে। কে কে আমার সঙ্গে যাচ্ছেন?

সুভদ্রা সবার আগে হাতটা তুলে বললো : আমি।

গুণবতী বললেন, এক্সট্রা শাড়ি-টাড়ি এনেছ?

সুভদ্রা অম্লানবদনে বললো, না। কিন্তু সুজাতাদি আমাকে নিশ্চয় একসেট পোশাক দিয়ে সাহায্য করবেন। সেটা পরেই আমি স্নান করব। আবার এই পোশাকে বাড়ি ফিরে যাব।

গুণবতী বলেন, তোমার সবেতেই বাড়াবাড়ি।

বাসু বললেন, এটাই যে ওর বয়সের ধর্ম, মিসেস্ মোহান্তি।

আর কেউ উৎসাহ দেখাচ্ছে না লক্ষ্য করে জয়ন্ত জিন-এর গ্লাসটা নামিয়ে দিয়ে বললো, চলুন। আমিও সীবাথ নেব!

ইন্দ্রকুমার প্রশ্ন করে, বাড়তি পোশাক সঙ্গে এনেছ?

দরকার হবে না এক বেলা ভিজে প্যান্টে থাকলে, কী হবে? গায়েই ওটা শুকিয়ে গেলে আমার অসুখ করবে না।

কৌশিক আগ বাড়িয়ে বলে, তার কি দরকার? তোমাকে আমার একটা হাফপ্যান্ট দিচ্ছি, এস।

ওরা তিনজন স্নানে চলে গেল।

বাসু ডক্টর ঘোষালের কাছে জানতে চাইলেন, আপনার একটি নার্সিংহোম আছে শুনেছি চুঁচুড়ায়? তাই নয়?

—হ্যাঁ এবং না। অর্থাৎ ওটা নার্সিংহোম নয়। ওটা একটা মেন্টাল স্যানাটোরিয়াম। আমার নার্সিংহোমে যে কজন রোগী আছে তারা সবাই মানসিকভাবে অসুস্থ। আউট-ডোরেও শুধু মানসিক-রোগেরই চিকিৎসা করা হয়।

গুণবতী জানতে চাইলেন, শুধু মানসিক রোগের চিকিৎসা-ব্যবস্থা কেন?

—যেহেতু আমি মানসিক রোগের ডাক্তার। আমার সহকারীরাও সবাই তাই। আপনারা একটা কথা ভেবে দেখেছেন কখনো? আদমসুমারী মতে ভারতীয় জনসংখ্যার তিন শতাংশ ‘মেন্টালি রিটার্ডেড’; মানে কমবেশি মানসিক রোগাক্রান্ত। ছিটগ্রস্ত থেকে বদ্ধ উন্মাদ। কিন্তু হিসাব করে দেখুন—মানসিক রোগের জন্য ‘বেড’-এর সংখ্যা শারীরিক অসুখের বেডের তুলনায় 0.003 পার্সেন্টও নয়। যেকটি আছে—সরকারি বা বেসরকারি—তা হচ্ছে বন্দিশালা! আপনি কিছু টাকা খরচ করতে রাজি থাকলে আপনার উন্মাদ আত্মীয়কে—বাবা-মা-সন্তান- স্ত্রীকে—ওরা চেন দিয়ে বেঁধে রাখতে রাজি আছে! ব্যস্!

রানী বলেন, এ রকম করে বলবেন না প্লিজ! আত্মীয়রা আর কী করতে পারে? ডঃ ঘোষাল বলেন, শুনবেন? আমার হোমে পাঁচটি বদ্ধ উন্মাদ পেশেন্ট আছে— —দুটি মহিলা, তিনটি পুরুষ—যাদের দেখতে কোনো ভিজিটার আজ পাঁচ বছরের ভিতর আসেনি!

সুজাতা জানতে চায়, কেন?

—কেন আসবে বলুন? হাসপাতালে দর্শনার্থীর ভিড় হয় স্বাভাবিক কারণে। কিন্তু আমার এখানে তারা কেন আসবে? রোগী/রোগিণী তো তাদের চিনতেই পারবে না।

বাসু বলেন, তাহলে ঐসব পেশেন্টের খরচ দেয় কে?

ঘোষাল বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে চেক বা ড্রাফটে খরচ আসে।

বাসু আবার প্রশ্ন করেন, একজন আত্মীয়কে আপনার হাসপাতালে রাখতে হলে মাসিক খরচ কত পড়ে?

—জেনারেল বেড-এ এখন মাসিক তিনশ টাকা লাগে। আগে দুশ টাকা চার্জ ছিল—একেবারে প্রথমদিকে তো দেড়শ টাকাতেই কুলিয়ে যেত। এখন সব জিনিসপত্রের দাম এত বেড়ে গেছে …

রানু জানতে চান, মাত্র তিনশ টাকায় সব খরচ কুলিয়ে যায়?

—না যায় না। কিন্তু এর বেশি দেবার ক্ষমতা কজনের থাকে? তাই ডোনেশন থেকে সাবসিডি দিয়ে পুষিয়ে নিতে হয়। শুধু কি তাই? দু-একটি ক্ষেত্রে সে-টাকাও পাই না। আমার নিজের পকেট থেকেই খরচ করতে হয়।

কৌশিক বলে, কেন? আপনার কী দায়?

—মানবিকতার। পোঁটলায় বন্দী করে বেড়াল-ছানাকে যেভাবে দূরে গিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়, সেভাবে ওদের কোনো ফাঁকা রাস্তায় বসিয়ে দিয়ে পালিয়ে আসতে পারি না বলে!

রানী বলেন, হাউ সিক্‌নিংলি স্যাড!

—না, মিসেস্ বাসু, আমি এখনো ‘স্যাডেস্ট পার্ট অব দ্য স্টোরিতে’ আসিনি। শুনুন বলি। এজন্য আমি একবার খুন হতে হতে প্রাণে বেঁচে যাই।

কৌশিক ঝুঁকে পড়ে বলে, খুন! কেন? খুনের কথা উঠছে কি করে?

—শুনুন তাহলে।

কেস-হিস্ট্রিটা উনি বিস্তারিত জানালেন :

ওঁর একজন পেশেন্টের নাম কুন্তী। প্যারামনেশিয়ার রোগী। অতীতকে সে ভুলে গেছে। আরও নানান কমপ্লিকেশন। তাকে খাইয়ে দিতে হয়। বাথরুমে নিয়ে যেতে হয়। মেয়েটি অত্যন্ত সুন্দরী, বিহারী, হিন্দুস্তানি। এখন বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ। বছর বিশেক সে আছে ঐ উন্মাদাগারে। বিয়ের কয়েক মাস পরেই একটা বাস-অ্যাক্সিডেন্টে স্বামী মারা যায়। ওর মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লাগে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেল বটে তবে বদ্ধ উন্মাদ। ওর শ্বশুর বড়লোক। শ্বশুর ও দেওর ওকে ভর্তি করে দিয়ে যায়। তারপর প্রথম দিকে মাস-মাস টাকা আসত। হঠাৎ সেটা বন্ধ হয়ে গেল। ডঃ ঘোষাল রেজিস্ট্রি চিঠি লিখে জানতে পারলেন ঠিকানাটা ভুয়ো। অর্থাৎ ঐ বিধবা পাগলিকে ডাক্তারবাবুর জিম্মায় নামিয়ে দিয়ে তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা মুক্তি পেয়েছে। বিশ বছর আগে মেয়েটির বয়স ছিল পঁচিশ-ছাব্বিশ। ভরা যৌবন তার। প্রতি মাসে প্রাকৃতিক নিয়মে চার-পাঁচ দিন সে অসুস্থ হয়ে পড়ত। ফিমেল ওয়ার্ড-অ্যাটেন্ডেন্ট ব্যবস্থাদি করত। তারপর তিন-চার দিন সে ভায়োলেন্ট হয়ে উঠত! সেক্স- ম্যানিয়াক্! তখন তাকে বেড-এর সঙ্গে বেঁধে রাখা ছাড়া উপায় থাকত না।

শেষে একদিন ওঁর একজন ওয়ার্ড-বয়, শম্ভু বসাক, এসে বললো, ডাক্তারবাবু! আপনি যদি আপত্তি না করেন তাহলে কুন্তীকে আমি ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারি। কী ওষুধ ও চাইছে তা তো আপনিও বুঝছেন, আমিও বুঝছি!

ডাক্তারবাবু প্রথমটা চমকে উঠেছিলেন। তারপর জানতে চাইলেন, ঘরে তোমার কে আছে শম্ভু? বিয়ে করেছ?

—করেছিলাম, স্যার। বাচ্চা হতে গিয়ে বৌটা মরে গেল।

—ঠিক আছে। আমি ভেবে দেখি।

ডক্টর ঘোষাল চিফ মেট্রনের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। তিনি রাজি হলেন রুদ্ধদ্বারের বাইরে দাঁড়িয়ে পাহারা দিতে। স্থির হলো, হাসপাতালের আর কেউ জানবে না ব্যাপারটা। কুন্তীকে ওষুধ ইন্জেকশনও দেওয়া হলো—যাতে সে গর্ভবতী না হয়ে পড়ে।

যা প্রত্যাশা করা গিয়েছিল, তাই ঘটল। ডাক্তারবাবুর এম. ডি. ডিগ্রি যে রোগ সারাতে পারেনি, শম্ভু বসাকের এক দাগ ওষুধেই সেই রোগিণী শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

কাজটা ঠিক হলো কি না ডক্টর ঘোষাল স্থির করে উঠতে পারেন না। মেডিকেল সায়েন্স কী বলে? মেডিকেল জুরিসপ্রুডেন্স? বিচার-বিবেচনা করতে করতেই একমাস কেটে গেল।

কুন্তী আবার উন্মাদিনী হয়ে ওঠে! ওয়ার্ড-বয় আবার এসে দাঁড়ায়। হাত কচলে বলে, কী স্যার? আপনার ওষুধে তো কুন্তীর কিচ্ছু হচ্ছে না! খাটের সঙ্গে অহেতুক ওকে বেঁধে রেখেছেন। আমি দেব এক পুরিয়া? এবার আমাকে ‘ফি’ দিতে হবে কিন্তু—বিশ টাকা!

ডঃ ঘোষালের ইচ্ছে হলো হতভাগার গালে ঠাশ করে একটা চড় কষিয়ে দেন। তা দিলেন না কিন্তু। পরিবর্তে বললেন, ঠিক আছে। রাত দশটার সময় এস। টাকা-ফাকা দেব না!

আবার কথাটা বলতে হলো চিফ মেট্রনকে। ভদ্রমহিলা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। মধ্যবয়সী। ডিভোর্সি। এবার তিনি বললেন, কাজটা ঠিক হচ্ছে না, ডক্টর ঘোষাল।

—সে তো আমিও বুঝছি। কিন্তু কী করি বল? আমি তো ওকে রাত দশটায় আসতে বলেছি।

মেট্রন বললেন, ঠিক আছে। তবে এটাই শেষবার। না হলে কথাটা ভিন্নরূপ নিয়ে পাঁচকান হবে। আমাদের মেন্টাল-হোমের বদনাম হয়ে যাবে।

রাত দশটায় হাসপাতাল প্রায় নিশুতি। ডাক্তারবাবু সচরাচর সাড়ে আটটায় বাড়ি চলে যান। আজ যাননি। অফিসে বসে কাজ করছিলেন। এমন সময় একটা জিপ এসে দাঁড়াল হাসপাতালের সামনে। নেমে এল তিনজন গুণ্ডাপ্রকৃতির লোক আর শম্ভু বসাক। পর্দা সরিয়ে চারজনে সরাসরি ঘরে ঢুকে পড়ল। অনুমতি চাওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না। মেট্রন ছিলেন ডাক্তারের ঘরে। উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, কে আপনারা? কী চান? এভাবে ঘরে ঢুকলেন কেন?

সামনের ঝাঁকড়া-চুল চোঙা প্যান্ট লোকটা বললে, ডাগদারবাবুর সঙ্গে আমাদের বাতচিৎ আছে, আপনি ফুটুন!

ডাক্তারবাবু বললেন, ঠিক আছে সিস্টার, তুমি যাও। আমি দেখছি কেসটা।

মেট্রন ঘর ছেড়ে চলে যাবার পর ঐ লোকটা বলল, হমার নাম কাল্লু শেখ আছে! হামাকে চিনেন স্যার? না চিনেন তো স্ট্যান্ডিং এস্লেসাবকে টেলিফোন করে জেনে নিন, বাৎ ঠিক আছে কি না।

ডক্টক ঘোষাল বলেন, কী চাইছ তোমরা? কেন এসেছ?

—শম্ভু-শালার কাছে সব শুনছি হামরা। ঐ ছুকরির কী নাম বে—? প্রশ্নটা করলো সে শম্ভুর দিকে ফিরে।

শম্ভু পাদপূরণ করে : কুন্তী দোসাদ!

—জী হাঁ। কুম্ভী দোসাদ। এই রামভগত দোসাদ শালা আছে কুন্তীর দেবর। ভাবিজীকে ও শালা নিতে এসেছে। জিপ নিয়েই এসেছে। তিন দিন পরে আবার ওয়াপস দিয়ে যাবে। হর-মাহিনা আমরা এই তারিখে আসব। আপনার কোনো অসুবিস্তা হোবে না। তিন দিন কুন্তীকে ওষুধ দিয়ে ঠাণ্ডা করে রাখব। শম্ভু-শালা আপনার কাছে বিশ রূপেয়া ফিজ মাঙিয়েছিল? হারামজাদা…

সে মারতে ওঠে শম্ভুকে। শম্ভু দূরে সরে যায়। বলে, ট্যাকা তো নিইনি বাবা! ডাক্তারসাব দেব না বললেন, ব্যস! আমি তো মেনে নিলাম।

ডক্টর ঘোষাল কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। কাল্লু হাত দুটি জোড় করে বললে, অগর আপ বুরা না মানে তো ঔর এক বাত বাতাই, ডাগডরসাব?

কী? কী কথা!

—ও ছুরি তো বেওয়ারিশ! শালীর ঘরওয়ালা আদমিরা তো কুছু দেয় না। আগর আপ্ চাহে তো ওয়াপস দিতে আসবই না। আপনি খাতায় ‘ডেড’ লিখে রাখবেন। একটা বেড ফাঁকা হইয়ে যাবে।

অনেক কষ্টে মেজাজ ঠিক রেখে ঘোষাল শান্তকণ্ঠে বলেছিলেন, দেখ কাল্লু! রাত দশটায় কোনও পেশেন্টকে রিলিজ করা যাবে না। কাল সকাল দশটার সময় এস, কথা হবে।

—কাল সুবে? দশ বাজে? আজ রাতে একঠো ইনজেকশন লাগবে তো হুকুম করুন।

দাঁতে দাঁত দিয়ে ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, ওকে কড়া ঘুমের ওষুধ দিয়েছি। কুন্তী এখন অঘোরে ঘুমাচ্ছে।

এই পর্যন্ত বলে ডাক্তারবাবু থামলেন। বরফ দেওয়া সেভেন-আপ-এর গ্লাসটা টেনে নিলেন।

ব্রজদুলাল জানতে চান, তারপর? এ কেসটার কথা তো তুমি কোনোদিন বলনি, ঘোষাল!

-–না, বলিনি। কখনো কাউকে বলতামও না। আজ বলছি নিতান্ত ঘটনাচক্রে। বাসুসাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যাওয়ায়।

কৌশিক জানতে চায়, কেন? মামুর সঙ্গে কেসটার কী সম্পর্ক?

ডাক্তার ঘোষাল বলেন, ঘটনাটা আজ থেকে চোদ্দ বছর আগেকার। আমি সে রাত্রেই এস. পি. সাহেবের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করি। সমস্ত কথাই খোলাখুলি জানাই। ওনার কাছে জানতে পারি কাল্লু শেখ লোকটা জেল পালানো আসামি। পোলিটিক্যাল শেলটার পাওয়ায় পার্টির তরফে গুণ্ডামি করে বেড়াচ্ছিল। সংক্ষেপে বলি : পরদিন ওরা চারজনই ধরা পড়ল আমার নার্সিংহোমে। তিনজনের দীর্ঘ মেয়াদী সাজা হয়ে গেল। একধিক কেস ঝুলছিল ফেরারী গুণ্ডাগুলোর মাথায়—রেপ, ডাকাতি, খুন। কাল্লু মিঞার খুনের দায়ে যাবজ্জীবন হয়ে গেল। যাবার সময় সে আমাকে শাসিয়ে গেছিল—ফিরে এসে বদলা নেবে।

বাসু জানতে চান: তারপর?

—দিন সাতেক আগে খবর পেয়েছি—পুলিসসূত্র থেকে—মেয়াদ খেটে কাল্লু শেখ ছাড়া পেয়েছে। একটু আগে ইন্দ্ৰ-ভায়া বলছিল না যে, বেমক্কা খুন-জখম হয়ে গেলে—অবশ্য ব্রজর ঐ কথাটা আমার মনে থাকবে। জখম হলেই বাসুসাহেবের দ্বারস্থ হব। খুন হলে একঝুড়ি চন্দ্রবিন্দু নিয়ে দেখা করতে আসব না।

এবার আর কথাটায় কেউ হাসল না।

ব্রজদুলাল থার্ড পেগে জিন-এ সিট্রা মেশাতে মেশাতে বললেন, কুন্তী কি বেঁচে আছে?

—আছে। তবে তার আর সেই রূপযৌবনের জৌলুস নেই। স্মৃতিশক্তি ফিরে আসেনি, আসবেও না কোনোদিন। হরমোন চিকিৎসায় ওর ঐ সেক্সুয়াল টেন্ডেন্সিটা এখন অবশ্য সম্পূর্ণ সেরে গেছে।

রানী জানতে চান, এই পনের বছরে কেউ এর খোঁজ নিতে আসেনি? বাপের বাড়ি বা শ্বশুর বাড়ি থেকে?

—না, আসেনি। কিন্তু আমি আশা ছাড়িনি। আমি নিশ্চিত। দুনিয়া কুন্তীকে ভুলে গেলেও একজন ভুলবেন না। তিনি আসবেন। যথাসময়ে! ওর আঁচলে পাড়ানির কড়ি থাক বা না থাক!

কোথাও কিছু নেই রানীদেধী ইমোশনাল হয়ে পড়েন। বেমক্কা প্রশ্ন করে বসেন, ঐ হতভাগিনীকে আপনি ভালোবাসেন, তাই না ডক্টর ঘোষাল?

ঘোষাল একটু চমকে ওঠেন। বরফের একটা কিউব মাটিতে পড়ে যায়। হাসেন তিনি। বলেন, সেটাই তো স্বাভাবিক মিসেস্ বাসু! পেশেন্টকে যদি ডাক্তার ভালোই না বাসতে পারল তা হলে প্রাণ দিয়ে তার চিকিৎসা করবে কী করে?

তিন

শনিবার সকালেই ফোন করলেন ব্রজদুলাল। বলুন স্যার, কটা নাগাদ গাড়ি পাঠিয়ে দেব?

বাসু বললেন, না, না, গাড়ি পাঠানোর দরকার নেই। যাচ্ছি ডিনার খেতে, একটু হাঁটাহাঁটি না করলে খিদে হবে কেন? রাত আটটায় তো ডিনার টাইম?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু সবাই জমায়েত হবেন সন্ধে সাতটায়। একটু গল্পগাছা করে রাত আটটায় সবাই ডিনারে বসব।

—দলে আমরা কজন?

—ওফ্! আপনি একেবারে বুল্স-আই হিট করে বসে আছেন!

—তার মানে?

—দলে আমরা তেরো জন। ইন্দ্র, ডাক্তার ঘোষাল আর আমি—এই তিনজন, আপনারা দুজন, হলো পাঁচ। পালিত আর মিসেস্ পালিত, একুনে সাত। মিস্ অ্যান্ড মিসেস্ মোহান্তি, ইজুক্যালটু: নয়। এ ছাড়া জয়ন্ত আর অনুরাধা—হলো এগারো। সর্বশেষে অ্যাবে শবরিয়া আর তাঁর মিসেস্ মারিয়া : তেরো!

বাসু বললেন, সবাইকে ঠিক চিনলাম না। অ্যাব্রাহাম শবরিয়াটি কে?

—ওফ্! আপনিও সেই ভুল করলেন! শবরিয়ার নাম অ্যাব্রাহাম নয়। ও হচ্ছে গুনপুর গির্জার একজন Abbey—এ-বি-বি-ই-ওয়াই–গ্রাম্য ধর্মযাজক। অ্যাব্রাহামের ডাকনাম ‘অ্যাবে’ নয়। আমার সঙ্গে দীর্ঘদিনের জানাশোনা। থাকেন গুনপুরে। আমি পুরীতে বেড়াতে এলেই ওঁকে সস্ত্রীক ডেকে পাঠাই। মুশকিল হয়েছে তাঁকে নিয়েই। এক টেবিলে তেরো জনে নৈশাহারে বসতে তিনি ইতস্তত করছেন। ইন্দ্ৰ তাই বলছে, জয়ন্তকে বাদ দিতে। সেটা আবার আমার ঠিক পছন্দ নয়। জয়ন্ত বেচারি কলকাতা থেকে এতদূর এসেছে এই উৎসবে যোগ দিতে, তাকে কি বাদ দেওয়া যায়?

বাসু বললে, বুঝলাম। এ সমস্যার সমাধান তো সহজেই হতে পারে।

—কী রকম?

—আকাশ আজ পরিষ্কার। আপনি গার্ডেন-পার্টির ব্যবস্থা করুন। আপনার বাগানটা তো শুনেছি প্রকাণ্ড। চারখানা টেবিল পাতার ব্যবস্থা করুন। চার-চারে ষোল জন বসিবেক। যেহেতু আমরা কুল্লে তের জন, ফলে তিনটি চেয়ার ভেকেন্ট পড়িয়া থাকিবেক। অথবা অতিরিক্ত ‘ইয়ে’ পান করার ফলে বে-এক্তিয়ার হইলে চেয়ার জোড়া দিয়া তাঁহার শয়নের ব্যবস্থা করা যাইবেক!

—ওফ্! দারুণ ব্যবস্থা করেছেন, স্যার।

—শুনুন, রায়মশাই। গাছে গাছে টুনি বাল্ব জ্বালানোর ব্যবস্থা করুন। একটা বড় কেক কিনে তার ওপর ‘43’ এবং ‘হ্যাপি বার্থডে’ লেখানোর ব্যবস্থা করুন। যাতে প্রচারটা ঠিকমতো হয়। কেউ না ভুল করে ভাবে এটা ইন্দ্রকুমারের ‘সিলভার জুবিলি জন্মদিন! ও. কে.?

—এ না হলে ব্যারিস্টার!

—এক টেবিলে তের জন বসাতেই না অ্যাবে শবরিয়ার আপত্তি! এতে শাপটাও মরল, লাঠিটাও ভাঙল না! তাই না?

রায়মশাই এবার শুধু বললেন, ওফ্!

কাঁটায়-কাঁটায় সন্ধে সাতটায় বাসুসাহেব সুজাতাকে নিয়ে ব্রজদুলালের প্রকাণ্ড বাগান – ওয়ালা বাড়িতে প্রবেশ করলেন। পাড়া আর অবস্থানটা মোটামুটি জানা ছিল; চিনতে কোন অসুবিধা হলো না। দুশ’ মিটার দূর থেকেই গাছে গাছে টুনি বাল্‌ব্‌-শোভিত উৎসবগৃহটি নজরে পড়ছে সকলের।

বাগানের মাঝখানে একটি কংক্রিটের ব্যাডমিন্টন কোর্ট। জোরালো আলো জ্বলছে তাতে। একদিকে অনুরাধা আর জয়ন্ত, অপর দিকে ইন্দ্র আর সুভদ্রা। অ্যাবে শবরিয়া কাউন্ট করছেন উঁচু টুলে বসে।

ওঁদের আসতে দেখেই ব্রজদুলালের সেক্রেটারি অশোক চ্যাটার্জি এগিয়ে এসে সম্বর্ধনা করলো। কেতাদুরস্ত থ্রি-পিস স্যুট, কণ্ঠে কালো বো। হাতে নোটবই। বাগানের ও-প্রান্ত থেকে ব্রজদুলাল হাঁক পাড়েন, আসুন, আসুন স্যার! ওয়েলকাম সুজাতা-মা।

পানীয় সরবরাহ সবে শুরু হয়েছে। ব্রজদুলাল বাসুসাহেবের সঙ্গে ক্যাপ্টেন আর মিসেস্ পালিতের আলাপ করিয়ে দিলেন। ক্যাপ্টেন জে. পালিত আর্মিতে ছিলেন না, ছিলেন পাইলট। বর্তমানে অবসর নিয়েছেন। সচরাচর টি. ভি. দেখেই সময় কাটান। বয়স বেশি হয়ে গেছে বলে অবসর নেননি, নিতে বাধ্য হয়েছেন মাত্রাতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি পাওয়ায়। অ্যাভিয়েশন- আইন মোতাবেক ‘ওজন-বয়স-উচ্চতা’র একটি সূত্র আছে। বয়স ও উচ্চতা হাতের বাইরে! ফলে সংযমের মাধ্যমে ওজনটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। পালিত সেখানে ব্যর্থ হয়েছেন। বাসুসাহেবের মনে হয় ভোজনরসিক হিসাবে এ ব্যর্থতা নয়, পানাসক্ততার পরিণাম এটি। ওঁর মধ্যদেশের স্ফীতিটা ‘অ্যালকহলিক ফ্যাট’।

সুজাতার পরিধানে আজ একটি বিচিত্র বালুচরী। কোনো একটি কেস-এ কণ্টকোৎপাটনে সুজাতার সাফল্যের এটি পুরস্কার–বাসুসাহেবই কিনে দিয়েছিলেন। অনেকেই আঁচলটা হাতে তুলে নিয়ে পরীক্ষা করছে। শাড়িটার প্রশংসা করছে।

একটু পরেই ব্যাডমিন্টন খেলা শেষ হলো। অনুরাধা আর জয়ন্ত বিপক্ষকে ‘লাভ সেট’ দিয়েছে। সুভদ্রা মর্মাহত! ইন্দ্রকুমারের জন্মদিন উপলক্ষেই এই আনন্দ-উৎসব। আর তাকেই এভাবে গো-বেড়েন দেওয়াটা কি উচিত হলো? জয়ন্ত বললে, তা তুমি আগে বললে না কেন যে, ‘গড়াপেটা’ খেলতে হবে?

অনুরাধা জানতে চায়, ‘গড়াপেটা’ খেলা কাকে বলে?

জয়ন্ত বলে, ঐ দেখ সুভদ্রা! অনুরাধাদি কথাটার মানেই জানে না—কেমন করে তোমাদের জিতিয়ে দেব?

সুভদ্রা প্রতিবাদ করে, জিতিয়ে দিতে তো বলিনি। তুমি কলেজে ব্যাডমিন্টন চাম্পিয়ান ছিলে, জানি। তা—বেশ তো! জেত! কিন্তু দু-একটা পয়েন্ট তো ছেড়ে দিতে পারতে! লোকটার আজ জন্মদিন! একেবারে লাভ সেট! তোমার কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই।

অনুরাধা মুখ টিপে হাসে। ‘গড়াপেটা’ খেলা কাকে বলে তা সে বিলক্ষণ জানে। ন্যাকা সাজছিল। বাসু অন্যদিকে তাকিয়ে পাইপ টানতে টানতে এদের কথোপকথন শুনছিলেন। তাঁর মনে হয় ব্যাডমিন্টন কোর্টে এখন যে খেলাটা চলছিল, রাজশেখরের ভাষায় সেটা : ‘হারিত- জারিত-অমিতা-জমিতার প্রেমচক্র’! অনুরাধা ভালোবাসে ইন্দ্রকুমারকে। ইন্দ্রকুমার ভালোবাসে সুভদ্রাকে। জয়ন্তও ভালোবাসে সুভদ্রাকে! ঠিক ‘হিডিয়াস হেক্সাগন’ নয়, তবে জটিল কোনো জ্যামিতিক ফিগার!

উঁচু টুল থেকে নেমে এসে অ্যাবে শবরিয়া বাসুসাহেবের সঙ্গে করমর্দন করে বললেন, আমার নাম উইলিয়ম শবরিয়া। আপনার নাম ও কীর্তিকাহিনী বেশ ভালোই জানা আছে; আজ সাক্ষাৎ পরিচয় হলো। ধন্য হলাম।

বাসু বললেন, বিলক্ষণ! আসুন আমরা মিসেস্ শবরিয়ার কাছে গিয়ে বসি। উনি একা-একা বসে আছেন।

অ্যাবে শবরিয়া বলেন, চলুন। উনি কিন্তু শবর ছাড়া আর কোন ভাষা বোঝেন না।

—তা হোক। সঙ্গ তো দিতে পারবেন।

খিদমদারেরা টেবিল-চেয়ার সাজাচ্ছে অশোকের নির্দেশে। আবার অন্য একদল ট্রেতে করে পানীয় নিয়ে আসছে। স্ন্যাস্ত্ত।

সুজাতা ব্রজদুলালকে জিজ্ঞাসা করে, ইন্দ্রকুমার ভিতরে চলে গেলেন কেন? একা একা কী করছেন উনি ওখানে?

ব্রজদুলাল প্রতিপ্রশ্ন করেন, তুমি দিল্লিবাসী আধারকারকে চেন?

—’দৃষ্টিপাত’-এর ড্রিংস-বিশারদ আধারকার?

—একজ্যাক্টলি! ইন্দ্রের ধারণা, ও নিজেও ঐ রকম একজন ড্রিংস-মিশ্রণের কনৌসার। আমার সেলারে বসে নানান ড্রিংস মেশাচ্ছে। ভালো কথা, মিসেস্ পালিত অথবা অনুরাধার সঙ্গে তোমার আলাপ হয়েছে? হয়নি? চল, আলাপ করিয়ে দিই।

সুজাতা দুজনের সঙ্গে পরিচিত হলো।

মিসেস্ ছায়া পালিত একজন নামকরা ‘ড্রেস-ডিজাইনার’। সুশিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী। ব্রজদুলালের সঙ্গে তাই নিকট সম্পর্ক। নতুন নাটক মহড়া দেবার সঙ্গে সঙ্গে এক কপি পাণ্ডুলিপির জেরক্স পাঠিয়ে দেন মিসেস্ পালিতকে। পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক—যাই হোক। কোন্ কুশীলবের কী পোশাক হবে—কোন দৃশ্যে সে পোশাকটা বদলে কোন পোশাক পরবে তার ডিজাইন করে ছায়া। প্রতিটি পোশাকে ট্যাগ দিয়ে দু-খানি চার্ট টাঙিয়ে দিয় দুটি গ্রীনরুমে। পুরুষ ও স্ত্রীলোকের। ড্রেস-বিষয়ে ছায়া পালিত একজন কনৌসার। চৌকস, তীক্ষ্ণদৃষ্টিসম্পন্না মহিলা।

ব্রজদুলাল বলেন, তোমার সেই সেকেন্দার শাহ্র মুকুটের গল্পটা ওকে শুনিয়ে দাও, ছায়া। ছায়া লজ্জা পায়। বলে, বাদ দিন রায় কাকা!

—না, না, বাদ দেব কেন? তুমি তো আমাদের টিমের লোক গো। তোমার কৃতিত্বে আমাদেরও গর্ব!

সুজাতাও উৎসাহ দেখায়, বলুন রায়কাকা! কী ব্যাপার!

বছর পাঁচ-সাত আগেকার কথা। কোনো একটি কলেজের ছাত্রছাত্রী ‘নটরঙ্গ’ স্টেজটা ভাড়া করেছে তাদের বার্ষিক সমাবর্তন উৎসবের জন্য। ওরা ডি. এল. রায়ের ‘চন্দ্রগুপ্ত’ মঞ্চস্থ করবে। ড্রেস এবং রূপসজ্জার দায়িত্বও গ্রহণ করেছেন ব্রজদুলাল। ড্রেস-রিহার্সালে আলেকজান্ডারের মুকুটটা দেখে খেপে উঠেছিলেন ওদের পরিচালক। তিনিই সেকেন্দার শাহ্র চরিত্রটা করবেন। কলেজের ইকনমিক্সের অধ্যাপক। তিনি ব্রজদুলালের ম্যানেজারকে ধমকে ওঠেন, এটা কি মুকুট হয়েছে? এ তো গণেশের মাথা! গ্রিক হেলমেট কেমন হয় জানেন না আপনারা? ম্যানেজার মিসেস্ পালিতের দিকে তাকায়। ছায়া পালিত এগিয়ে এসে বলে, আপনিই তো পরিচালক, তাই নয়?

একটি ছেলে—সেলুকাস সেজেছে—বললে, উনি আমাদের ইকনমিক্সের স্যার! হ্যাঁ, উনিই পরিচালনা করছেন।

ছায়া পালিত বলে, আপনাদের কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক অথবা হিস্ট্রি-অনার্স পড়েন এমন কোনো ছাত্র কি এখানে আছেন?

সেলুকাস থতমত খেয়ে যায়। ও-পাশ থেকে চাণক্য—মানে চাণক্য চরিত্রের অভিনেতা বলে ওঠে, কেন বলুন তো? আমার হিস্ট্রি-অনার্স।

—তাহলে আপনি বুঝবেন। এই রাজমুকুটটা একটা গ্রিক হেলমেটের অনুকরণে গড়া। কার্থেজে আবিষ্কৃত একটা মেডেলিয়ানে পাওয়া গেছে একটি স্বর্ণমুদ্রা—বর্তমানে সেটি প্যারীতে ল্যুভ সংগ্রহশালায় রক্ষিত। ঐতিহাসিকদের অনুমান এই বিশেষ রাজমুকুটটি আলেকজান্ডার তৈরি করিয়েছিলেন পুরুকে পরাজিত করার পর। হস্তী হচ্ছে পুরুরাজের প্রতীক। আপনাদের পরিচালক এসব বুঝবেন না। উনি ইকনমিক্স পড়ান তো? ওঁকে কাইন্ডলি বলে দেবেন, ল্যুভ সংগ্রহশালায় যে মুদ্রাটা রাখা আছে তার মূল্য না হোক মিলিয়ান ডলার্স। যা হোক সেই ট্র্যাডিশনাল আলেকজান্ডারের মামুলি হেলমেটটা পাঠিয়ে দিচ্ছি। সব গোলামার্কা ডিরেক্টর যেটা অনুমোদন করেন। গণেশের মাথাটা এদিকে বাড়িয়ে দিন!

অনুরাধা বসু ‘নটরঙ্গে’-এ আছে আজ টানা দশ বছর। বরাবর হিরোইনের চরিত্র করে চলেছে। চিত্রশিল্পের হিসেব অনুযায়ী ওর বয়স ত্রিশের নিচে। সাজলে-গুজলে সে-রকমই লাগে। কিন্তু হিসাবে যে কিছুটা গোঁজামিল আছে সেটা সবাই বোঝে। অনুরাধা বছরের পর বছর ইন্দ্রকুমারের বিপরীতে নায়িকার চরিত্র করে গেছে। এক্ষেত্রে নায়িকার একটা দাবি জন্মেই যায়। কেউ বলে অনুরাধা বিধবা, কেউ বলে ডিভোর্সি, আবার কারও মতে সে কুমারী ব্রজদুলাল হয়তো ভিতরের কথা জানেন, প্রকাশ করেন না। তবে ‘নটরঙ্গ’-এ সবাই জানে, ইন্দ্রকুমার প্রস্তাব দিলেই অনুরাধা নীড় বাঁধতে রাজি। ইন্দ্রকুমারই ইদানীং অনুরাধার প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছে। ভাবখানা : “ঘরের কোণে ভরা পাত্র দুই বেলা তা পাই /ঝরনাতলার উছল পাত্র নাই।” রাতের পর রাত মঞ্চের উপর অনুরাধার সঙ্গে প্রেমাভিনয় করতে করতে বোধকরি ইন্দ্রকুমার ক্লান্ত। বীতশ্রদ্ধ। বিরক্ত।

ওদিকে শিউলি গাছতলায় খানতিনেক চেয়ার টেনে নিয়ে অ্যাবে শবরিয়া বাসুসাহেবকে বোঝাতে শুরু করেছেন—কী সূত্রে ব্রজদুলালের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়।

শবরিয়া আসলে আদিবাসী সমাজের লোক। ওঁদের গোষ্ঠীটার নাম ‘শবর’। এরা আদিযুগে মুণ্ডাজাতীয় একটি অস্টো-এশিয়াটিক কথ্য ভাষার অধিকারী ছিল। এদের বাস ওড়িশার কোরাট আর গঞ্জাম জেলার সীমান্তে। গুনপুরের আশেপাশে। আজকের দণ্ডকারণ্যের বাইরে বটে, কিন্তু প্রাচীনকালে এদের দণ্ডকবনের বাসিন্দা বলেই ধরা হতো। এদের কিছু থাকে পাহাড়ী অঞ্চলে, যেখানে ওড়িশার কোরাপুট জেলা গিয়ে মিশেছে গঞ্জাম জেলায়। কিছু থাকে সমতল অঞ্চলে। সমতলবাসীদের কথ্য ভাষায় অসংখ্য তেলেগু আর ওড়িয়া শব্দ অনুপ্রবেশ করেছে। তুলনায় পাহাড়িয়া শবরেরা তাদের ভাষায় বৈশিষ্ট্য শুধু নয়, তাদের আদিম চরিত্র- বৈশিষ্ট্যও অবিকৃত রাখতে পেরেছে।

অ্যাবে শবরিয়া বোঝাতে চাইলেন ‘শবর’ শব্দটার একটা প্রাচীন ঐতিহ্য আছে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণের মতে শবরেরা বিশ্বামিত্রের বংশধর। সোমদেবের কথাসরিৎসাগরেই শুধু নয়, গ্রিক পণ্ডিত টলেমির জবানীতেও জানা যায় ভারতবর্ষের গাঙ্গেয় উপত্যকায় শবর জাতির বাস। উচ্চবর্ণের হিন্দু জমিদার-জোতদারেরা শবরদের ‘বন্ডেড-লেবার’ করে রেখেছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী— ‘ক্রীতদাস’ বলতে যা বোঝায়। আমেরিকার প্লান্টার্সদের মতোই সে অত্যাচারের সীমা-পরিসীমা ছিল না।

এই নিপীড়িত সমাজের সেবা করতে এগিয়ে এসেছিলেন একদল খ্রিস্টান ধর্মযাজক। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি জেসুইট সোসাইটির তরফে ধর্মপ্রচার করতে ভারতে আসেন সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার। গোয়া বন্দরে তিনি পদার্পণ করেন 1534 খ্রিস্টাব্দে। সময়টা চিহ্নিত করতে বলা যায় যে, মুঘল সম্রাট হুমায়ুন তখন ভারতেশ্বর। কিন্তু গোয়া বন্দরে বোধকরি কেউ তাঁর নামই জানত না। বন্দর এবং সংলগ্ন ভূখণ্ডের মালিক ছিল পর্তুগিজ বোম্বেটের দল, যারা নাবিকবৃত্তি-তথা-বোম্বেটেগিরি ছেড়ে ভূসম্পত্তির মালিক হতে শুরু করেছে। জেসুইট সোসাইটির ধর্মযাজকেরা ক্রমে ছড়িয়ে পড়েন কেরালায়, ওড়িশায়, অন্ধ্রে। তারই একটি শাখা এসে গুনপুরে একটি ছোট্ট গির্জা বানায়। মূল গির্জাটা দু-তিনবার ধূলিসাৎ হয়েছে বটে কিন্তু জেসুইট সোসাইটির অর্থসাহায্যে পুনর্নির্মিত হয়েছে। উইলিয়ম শবরিয়া সেই প্যারিশ-চার্চের একজন অ্যাবে।

ওঁর গ্রামে দেড়শ’ ঘর মানুষের বাস। সবাই শবর নয়, তবে সবাই খ্রিস্টান। কারণ খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলে আদিবাসীরা অনেক সুযোগ-সুবিধা পেত এবং পায়, যা বর্ণহিন্দু সমাজপতিরা ওদের দিতে চাইত না।

বাসুসাহেব বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নটার জবাব এখনো দেননি। ব্রজদুলালবাবুর সঙ্গে আপনার আলাপ হলো কী করে?

অ্যাবে বিল হাসলেন। বললেন, শবর জাতির কথা শোনাবার মতো পণ্ডিত তো পাই না। আমি একজন পিতৃপরিচয়হীন অনাথ। মানুষ হয়েছি খ্রিস্টান পাদরীদের দয়ায়। আমার স্ত্রীও তাই। আমার কোন গোত্র নেই—’ফ্যামিলি-নেম’ নেই। তাই নাম নিয়েছি : “শবরিয়া” অর্থাৎ শবর-জাতের লোক। এসব কথা তো সবাইকে বলার নয়, বলিও না। আপনি পণ্ডিত, তাই সব কথা আপনাকে বললাম। ব্রজদুলালবাবু এবং তাঁর এক বঙ্কু—তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের নৃতত্ত্বের অধ্যাপক, শবরদের সংস্কৃতির বিষয়ে সন্ধান করতে গুনপুরে এসেছিলেন। ওখানে না আছে হোটেল, না ডাকবাংলো। আমি গির্জার অ্যাবটকে বলে ওঁদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম আমাদের চার্চে। অতিথি হিসাবে। ওঁর বঙ্কুর তরফে আদিবাসী শবরদের মধ্যে দিন সাত-দশ দোভাষীর কাজও করেছিলাম। এ থেকেই বঙ্কুত্ব গড়ে ওঠে। মিস্টার রায় বোর্ডিং-লজিং এবং দোভাষীর কাজ করার জন্য আমাকে কিছু পারিশ্রমিক দিতে চান। আমি তা গ্রহণ করিনি। উনি বেশ কিছু টাকা আমাদের অনাথ আশ্রমে দান করে আসেন। – তাই থেকেই বঙ্কুত্ব। উনি যখনই ওঁর এই পুরীর প্রাসাদে এসে ওঠেন, তখন সময় থাকতে আমাকে জানান। আমরা দুই বুড়ো-বুড়ি কদিন পুরীতে এসে ভালোমন্দ খেয়ে যাই। এই আর কি!

বাসু জানতে চান, আপনি কি প্রোটেস্টান্ট?

—আজ্ঞে না। আমি রোমান ক্যাথলিক। সোসাইটি অফ যীসাস-এর এক দীন সেবক! জয়ন্ত পাশে দাঁড়িয়ে শুনছিল। হঠাৎ বলে বসে, সব খ্রিস্টানই তো যীসাস-সেবক, সোসাইটি অব যীসাস-এর সদস্য।

—নো মাই পুওর চাইল্ড। ‘সোসাইটি অব বীসাস’ একটি সেবাদল প্রতিষ্ঠানের নাম। তার প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন সেন্ট ইগনেশাস লয়লা। তিনি স্পেন দেশের মানুষ। জার্মানির মার্টিন লুথার—যাঁকে বলা হয় প্রোটেস্টান্ট ধর্মের প্রধান উদগাতা, তাঁর চেয়ে সেন্ট লয়লা ছিলেন মাত্র আট বছরের ছোট। প্রথম যৌবনে তিনি সৈনিক ছিলেন। যুদ্ধে তাঁর একটি পা কাটা যায়। তারপর তিনি ধর্মজীবনে প্রবেশ করেন। দুটি ক্রাচ সম্বল করে পদব্রজে মাদ্রিদ থেকে রোমে উপস্থিত হন। পোপের আশীর্বাদ নিয়ে তিনি এই ‘সোসাইটি অব যীসাস’ গঠন করেন। আমাদের মূলমন্ত্র : নিঃস্বার্থভাবে দীন-দরিদ্রের সেবা করা। তাদের ঈশ্বরমুখী করে তোলা।

বাসু জানতে চান, আপনাদের সংসারে আর কে কে আছে?

বৃদ্ধ অমায়িক হেসে বললেন, ওলি ব্রাদার্স অ্যান্ড সিস্টার্স! সারা বিশ্বে ছড়ানো।

কথাটা ভালো লাগল বাসুসাহেবের। জানতে চাইলেন, সন্তানাদি নেই আপনাদের?

অ্যাবে জবাব দিলেন না। ধর্মপত্নীর দিকে ফিরে শবর ভাষায় কী যেন প্রশ্ন করলেন। মিসেস্ শবরিয়াও জবাবে কী যেন বললেন। অ্যাবে বিল ভাষান্তর করে বললেন, একশ’ তিন!

জয়ন্ত অবাক হয়ে বলে, তার মানে?

বিল শবরিয়া বললেন, আমাদের অনাথ আশ্রমে বর্তমানে একশ’ তিনজন আছে। তাই বলছেন উনি।

বাসু বুঝলেন : উনি সামাজিক অর্থে নিঃসন্তান।

গার্ডেন-পার্টিতে সচরাচর যেমন হয়। কিছু দূরে দূরে এক-একটি জমায়েত। তিন-চার-পাঁচ জনের। প্রত্যেকের হাতেই এক একটা গ্লাস। কেউ ভদ্‌কা, কেউ জিন, কেউ বীয়ার, অধিকাংশই স্কচ। মেয়েরা কেউ কেউ কোকোকোলা, সেভেন-অপ্ বা লিকাও পান করছে। খিদ্‌মদগারেরা ট্রে হাতে ঘুরছে। ব্রজদুলাল যদিও নিমন্ত্রণকর্তা, তবু বয়সের ভারে তিনি একটি সোফায় বসে পড়েছেন। তাঁর পাশে ডঃ ঘোষাল। ইন্দ্রকুমার হিসেবমতো ওঁদের চেয়ে পনের- বিশ বছরের ছোট, তাই ঘুরে ঘুরে আপ্যায়ন করছে। অশোকও সাহায্য করছে তাকে। সুভদ্রা যদিচ হোস্টেস নয়, তবু ভাবখানা যেন তারই বাড়িতে সবাই নিমন্ত্রণ রাখতে এসেছেন। তার পরনে একটি ময়ূরকণ্ঠী রঙের বেনারসী। কানে এক জোড়া জড়োয়া দুল—দৈর্ঘ্যে ইঞ্চি চারেক। ভা-রি খুশি-খুশি ভাব তার। ‘লাভ সেট’ খাওয়ার কথাটা এতক্ষণে মনে হয় ভুলে গেছে। ‘ল্যভ’ এমনই জিনিস!

ক্যাপ্টেন পালিত সম্ভবত চার নম্বর ভদ্‌কা গ্লাসের প্রভাবে একখানি চেয়ার টেনে বসে পড়েছেন।

একমাত্র জয়ন্ত কিছু পান করছিল না। মাঝে মাঝে বেয়ারাদের ট্রে থেকে তুলে দু-চার টুকরো ফিশ-ফিঙ্গার অথবা কাবাব মুখগহ্বরে ফেলে দিচ্ছে। উপায় নেই। সুভদ্রার অনুরোধে এই আনন্দ-উৎসবের নানান রঙিন ফটো তোলার দায়িত্ব সে নিয়েছে। ক্যামেরাটা সুভদ্রার—ক্যানন। রিলটাও সে কিনে দিয়েছে। ফলে জয়ন্ত সুরাপানের সুযোগই পাচ্ছে না। মাঝে মাঝেই তার হাতে ক্যামেরা ঝিলিক দিয়ে উঠছে।

একজন খিদ্‌মদগার এগিয়ে এল একটি বড় ট্রেনে সাত-আটটি গ্লাস নিয়ে। ইন্দ্রকুমার একটা গ্লাস উঠিয়ে দিল সুভদ্রার হাতে। সুভদ্রা বললে, আমার কিন্তু এটা সেকেন্ড পেগ্‌! নেশা-টেশা হয়ে যাবে না তো, ইন্দ্রদা?

ইন্দ্রকুমার বললে, খালি পেটে খেও না। তাহলে কিস্তু হবে না।

আর একটি গ্লাস তুলে দিতে গেল মিসেস্ মোহান্তির হাতে। উনি বললেন, কী ওটা?

—’জিন’ উইথ সেভেন-আপ্।

—না, না, আমাকে কোক্‌ দিন।

ইন্দ্র পীড়াপীড়ি করে, সে কিছুতেই হবে না, মাসিমা। আজকের রাতটা একটা স্পেশাল অকেশন। আগেকার গ্লাসটা কী ছিল?

—সিট্রা!

—দেন ইট মাস্ট বি জিন, দিস্ টাইম—নিন বলছি।

মিসেস্ মোহান্তি কচি খুকির মতো সলজ্জে উঠিয়ে নিলেন গ্লাসটা।

ইন্দ্র এবার অনুরাধার দিকে ফিরল, তুমি কী নেবে?

—নো থ্যাংক্‌স্‌! আই হ্যাভ হ্যাড এনাফ!

—তা বললে আমরা শুনব কেন?

—শুনবে। যেহেতু আমি কোন পার্টিতে কখখনো থার্ড পেগ্ নিইনি। সরি! সেকেন্ড ইজ মাই লিমিট!

ইন্দ্রকুমার পীড়াপীড়ি করলো না। এগিয়ে গেল খিদমদারের পিছন-পিছন। ট্রেতে তখনো পাঁচ-সাতটা গ্লাস।

ডঃ ঘোষাল উঠিয়ে নিলেন স্কচ। একটু সোডা মিশিয়ে নিলেন। বাসুও নিলেন হুইস্কি অন- রস্! খিদ্‌মদগার এগিয়ে এল খ্রিস্টান যাজকটির কাছে।

—নিন, ফাদার, যেটা ইচ্ছে উঠিয়ে নিন।

অ্যাবে বিল গোটা ছয়েক চিকেন কাবাবের টুকরো তুলে নিলেন। তিনটে দিলেন ধর্মপত্নীকে, তিনটে বাঁ হাতের মুঠোয় রেখে বললেন, থ্যাংক্‌স্!

—ও কী? ড্রিংকস্ নিন। যেটা ইচ্ছে।

অ্যাবে বিল বললেন, কী জান ভাই? ড্রিংসের স্বাদ সব ভুলেই গেছি। আমাদের ওখানে তো শুধু ধেনো, পচাই আর মহুয়া। ওসব আমার সহ্যই হয় না।

ব্রজদুলাল বললেন, এক পেগ্‌ নিন। চাঙ্গা লাগবে।

অ্যাবে বিল প্রশ্ন করেন, এটা কী?

ব্রজদুলাল বলেন, হোয়াইট হর্স!

অ্যাবে ঠাট্টা করে বলেন, আপনি আর খাবেন না রায়সাহেব। আপনার দিব্যি নেশা হয়েছে। স্পষ্ট দেখছি হলুদ রঙ—আপনি বলছেন হোয়াইট। আর যেটা হোয়াইট কালার?

ইন্দ্রকুমার বলে, ভদ্‌কা-উইথ-লাইম!

অ্যাবে বিল সেটাই উঠিয়ে নিলেন।

জয়ন্তর ক্যামেরা ক্রমাগত ঝিলিক মেরে চলেছে।

ইন্দ্রকুমার বলে, তুমি এবার ক্যামেরাটা বন্ধ কর তো জয়ন্ত। টেক অ্যা ড্রিংক। কী নেবে?

জয়ন্ত ক্যামেরাটা খাপে ভরে। এতক্ষণে প্রথম গ্লাসটা তুলে নিয়ে বলে, মেনি হ্যাপি রিটার্নস্, ইন্দ্রদা!

ইন্দ্রকুমার প্রত্যুত্তরে কিছু একটা কথা বলতে যাচ্ছিল। বলা হলো না। তার আগেই হঠাৎ বিষম খেলেন অ্যাবে শবরিয়া। কিন্তু শব্দটা ‘খক্‌খক্’ জাতীয় নয়। কেমন যেন অস্বস্তিকর, অশ্রাব্য। সকলেই অ্যাবে বিল-এর দিকে ফিরে তাকায়। সবাই লক্ষ্য করে তিনি বাঁ হাতে প্রায় নিঃশেষিত গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। ডান হাতটা গলায়। একটা বিবমিষার বেগ যেন—না, বমি হলো না। অ্যাবে শবরিয়া হঠাৎ বাঁ হাতটা আকাশের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। কিছু যেন একটা হাত বাড়িয়ে ধরতে চাইছেন তিনি। বিদ্যুৎচমকে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে ওঠেন মিসেস্ শবরিয়া। দুর্বোধ্য মাতৃভাষায় তিনি কী একটা কথা বললেন। অ্যাবে বিল তা শুনতে বা বুঝতে পারলেন কি না বোঝা গেল না। স্ত্রীর আলিঙ্গনে লুটিয়ে পড়লেন।

সুভদ্রা চিৎকার করে ওঠে, কী? কী হয়েছে!

সকলের দৃষ্টি সেদিকে। ডাক্তার ঘোষাল এক লাফে উঠে পড়েন। বৃদ্ধ খ্রিস্টান যাজককে স্ত্রীর আলিঙ্গনমুক্ত করে একটা কাউচে শুইয়ে দেন। গলার ‘বো’-টা খুলে নেন। কোটের বোতামগুলোও। এবার নাড়ি দেখেন তিনি।

ব্রজদুলালের আর ধৈর্য মানছে না। বলেন, কী? কী বুঝছ?

ধমক দিয়ে ওঠেন ডাক্তার ঘোষাল : স্টপ হাউলিং!

প্রায় মিনিট দুয়েক পর ঘোষাল উঠে দাঁড়ালেন।

ব্রজদুলাল আবার একই প্রশ্ন করেন, কী হলো?

—হি ইজ ডেড! আয়াম সরি।

শেষ দুটো শব্দ ওঁর ওষ্ঠাধর উচ্চারণ করলো না। যেন কণ্ঠস্বর হারিয়ে ফেলেছেন ডাক্তার ঘোষাল।

—ডেড! ইম্পসিব্‌ল্‌!

মিসেস্ মারিয়া শবরিয়া—যিনি মাতৃভাষা ছাড়া বস্তুত আর কোন ভাষাই জানেন না, তিনি আর্তনাদ করে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন আকাশের দিকে। তীব্র, তীক্ষ্ণ, জান্তব প্রশ্ন! যে ভাষা বুঝতে কারও অসুবিধা হলো না। জবাব দিলেন ডাক্তার ঘোষাল—তাঁর মাথাটা দুদিকে আন্দোলিত করে।

মিসেস্ শবরিয়া—সেই নিঃসন্তান ধর্মযাজকের ধর্মপত্নী—যাঁর সন্তানসংখ্যা মাতা গান্ধারীকেও লজ্জা দেবে—তিনি লুটিয়ে পড়লেন তাঁর স্বামীর বুকের উপর সমুদ্র-গর্জনকে ছাপিয়ে তাঁর জান্তর আর্তনাদ আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।

চার

মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর ঘণ্টা-তিনেক কেটে গেছে। রাত এখন দশটা। নিমন্ত্রিতেরা প্রায় সবাই চলে গেছেন। জন্মদিনের কেকটা পড়ে আছে প্যান্ট্রিতে। কাটার কথা কারও মনেও পড়েনি। খাবারের প্লেটে নিমন্ত্রিতরা কিছু তুলে নিলেন কিনা তা কেউ লক্ষ্য করে দেখেনি। সে মেজাজই ছিল না কারও। ব্রজদুলালের সেক্রেটারিটি করিতকর্মা। যাবতীয় ব্যবস্থা সে সুনিপুণভাবে সম্পন্ন করেছে। ডক্টর ঘোষালের পরামর্শে প্রথমেই গাড়ি বার করে ধরে নিয়ে এসেছে একজন স্থানীয় চিকিৎসককে—ডঃ গোবিন্দলাল পণ্ডা। ব্রজদুলাল পুরীতে এসে অসুস্থবোধ করলে এঁকেই ডাকেন। পণ্ডা সব কিছু শুনে, মৃতদেহ পরীক্ষা করে সরকারিভাবে ডেথ সর্টিফিকেট দিয়ে গেছেন। তারপর স্থানীয় ভাইকারেজে সংবাদ দেওয়া হয়। তারা ভ্যানে করে মৃতদেহ আপাতত অপসারিত করেছে। পুরী-গির্জার ভূগর্ভস্থ মৃত্যুকক্ষে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত শান্তিরাজ্যে অ্যাবেকে রাখা হবে, যতদিন না সমাধির আয়োজন সম্পূর্ণ হয়। মিসেস্ মোহান্তি মূর্ছাতুর বিধবাকে নিজের গাড়িতে করে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেছেন। ডক্টর পণ্ডার ব্যবস্থাপনায় একটি নাইট-নার্স যোগাড় করা গেছে, যে-মেয়েটি ‘গোণ্ডী’ এবং ‘শবরী’ ভাষা জানে! ঐ ভাষাজ্ঞানটাই ছিল সবচেয়ে জরুরী। কারণ পুরী শহরে ‘শবরী’ ভাষা জানা লোক পাওয়া কঠিন—যদিও শবরদের আস্তানা মাত্র দু- তিনশ কি.মি. দূরে। ব্রজদুলালের সেক্রেটারি প্রত্যেকটি অতিথিকে এক-একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়েছে। বলেছে, জানি, এ-অবস্থায় খাওয়ার কথা মনে থাকে না। এখানে বসে খেতে পারবেনও না। নিয়ে যান। খেতে ইচ্ছে না করে কাউকে দিয়ে দেবেন। আমরাও তো তাই করব! কাল সকালে!

কথাটা সত্যি। মৃত্যু যেমন নিষ্ঠুর সত্য, তেমনি অবধারিত সত্য : মৃত্যুকে অতিক্রম করে জীবনের দাবি!

প্রথমেই বিদায় নিয়েছেন ক্যাপ্টেন ও মিসেস্ পালিত, দ্বিতলে। তারপর নিজের ডেরায় চলে গেছে জয়ন্ত মহাপাত্র। অনুরাধার প্রচণ্ড মাথা ধরেছিল। সে একটা স্যারিডন ট্যাবলেট খেয়ে ত্রিতলে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছে। বাসু বাড়িতে ফোন করে কৌশিককে জানিয়েছেন তাঁদের ফিরতে দেরি হতে পারে। রানু যেন চিন্তা না করেন।

যে টেবিলে পানীয় গ্লাসটা রেখে লুটিয়ে পড়েছিলেন অ্যাবে শবরিয়া, ঠিক তার পাশের টেবিলেই এখন বসে কথা বলছিলেন ওঁরা পাঁচজন। ব্রজদুলাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন ঐ একই কথা : কী করবেন ব্যারিস্টারসাহেব? যা হোক দুটি খেয়ে নেবেন এখানে বসে? জাস্ট পিত্তিরক্ষা করা?

বাসু কিছু বলার আগে সুজাতা বলে ওঠে, মাপ করবেন রায়কাকু! আমি কিছু খেতে পারব না।

—বুঝেছি! অশোক! তুমি খাবারের প্যাকেটগুলো রেডি রেখো। এত রাত্রে বাসুসাহেব রিক্শা করে ফিরবেন না। ওঁদের পৌঁছে দিতে হবে। প্যাকেটগুলোও তুলে দিও।

তারপর সুজাতার দিকে ফিরে বলেন, তোমার অবস্থাটা বুঝতে পারছি, সুজাতা-মা! রাত্রে যদি কিছু মুখে দিতে ইচ্ছে না করে তো ফ্রিজে রেখে দিও। কাল সকালেও যদি রুচি না হয় তো কুকুরের মুখে ধরে দিও! ফেলেই তো দিতে হবে সব!

ইন্দ্রকুমার অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল বাগানে। আলোগুলো অধিকাংশই নিবিয়ে দেওয়া হয়েছে। টুনি বাল্বগুলোও। আকাশে শুক্লা দশমীর চাঁদ। হঠাৎ থমকে থেমে পড়ে ইন্দ্রকুমার। বলে, ঘোষালদা, এভাবে চোখের সামনে কোনো জলজ্যান্ত মানুষকে হার্টফেল করে মরে যেতে দেখেছ?

ম্লান হাসলেন ডক্টর ঘোষাল। বললেন, তুমি একটা কথা ভুলে বসে আছ, ইন্দ্র। তুমি অভিনেতা! মৃত্যুর অভিনয় করতেই শুধু শিখেছ! আমি ডাক্তার! মৃত্যু নিয়েই আমার কারবার। জীবন আর মৃত্যু। সারা জীবন ধরে মৃত্যুকে নানাভাবে দেখছি!

ব্রজদুলাল জিজ্ঞাসা করলেন, ডক্টর পা মৃত্যুর কারণ হিসাবে কী লিখেছেন?

—‘ফেলিওর অব হার্ট কজড বাই আ সাডেন সীজার!’ জবাব দিলেন ঘোষাল।

—অর্থাৎ I don’t know, নাহং বেদ! আমি জানি না। তবে হ্যাঁ, তোমরা আমাকে ‘ফিজ’ দিয়ে ডেকে এনেছ সার্টিফিকেট দিতে, তাই জানিয়ে যাচ্ছি : লোকটা মরে গেছে। ব্যস্! এবার তোমরা যা ইচ্ছে করতে পার—করব দিতে পার, পুড়িয়ে ফেলতে পার, টাওয়ার অফ সাইলেন্সে রেখে আসতে পার।

সুজাতা ডক্টর ঘোষালকে বলে, আপনি যা বললেন তাকেই কি আমরা সাদা বাংলায় বলি ‘হার্টফেল’ করে মারা গেছেন?

ডাঃ ঘোষাল বললে, হ্যাঁ, তাই।

বাসু এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিলেন। পাইপ পর্যন্ত ধরাননি। বসে বসে ভাবছিলেন—ঐ সদ্যমৃত লোকটার কথাই। কী অম্লানবদনে ভদ্রলোক চলে গেলেন—আর বলে গেছেন মৃত্যুর পাঁচ মিনিট আগে যে, তিনি ‘জারজ’। কোন অজ্ঞাত পুরুষ-রমণীর কামনার গরলসমুদ্রে অবগাহন করে তিনি দুনিয়াদারী করতে এসেছিলেন এক অবাঞ্ছিত পুরুষ হিসাবে। নিতান্ত ঘটনাচক্রে অথবা যীসাস্-এর কৃপায় জীবনসঙ্গিনী করেছিলেন অনুরূপ এক অবাঞ্ছিতাকে। এবার ডঃ ঘোষালের কথা শুনে কথোপকথনে যোগদান করেন তিনি : মাপ করবেন ডক্টর ঘোষাল। ‘সীজার অব হার্ট’—ফেনামেনানটাকে আপনি কী বলবেন? মৃত্যুর ‘কজ’, না ‘এফেক্ট’?

ইন্দ্রকুমার বিরক্ত হয়ে বললো, বাদ দিন এসব অ্যাকাডেমিক তর্কের কচকচি : তালটা ধপ্ করে পড়লো, না পড়ে ধপ্ করল!

বাসু তৎক্ষণাৎ বলেন, একজ্যাক্টলি! ইন্দ্রকুমার! একটা লোককে গুলি করে মারলেও এক সময় তার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়। দ্যাট অলসো ইজ ডেথ ডিউ টু সীজার অব হার্ট! তাই নয়?

ডক্টর কুঞ্চিত-ভ্রূভঙ্গে প্রশ্ন করেন, হঠাৎ এ প্রসঙ্গ কেন?

বাসু চাপা গলায় প্রতিপ্রশ্ন করেন, ডাক্তার হিসাবে আপনি নিশ্চিত—নটউইথস্ট্যান্ডিং পণ্ডা’জ ডেথ-সার্টিফিকেট—মৃত্যুটা স্বাভাবিক?

পুরো দশ সেকেন্ড কেউ কোনো কথা বললো না। যে-যার অন্তরের তলায় তলিয়ে গেছে। মৃত্যুদৃশ্যটা মনে মনে আবার দেখছে!

শেষ পর্যন্ত ব্রজদুলাল বলে ওঠেন, না তো কী? খুন? আত্মহত্যা?

ডাঃ ঘোষাল বলেন, দুটোই ইম্পসিব্‌ল্‌! কেই বা ওঁকে খুন করতে চাইবে? আর এভাবে উনি আত্মহত্যাই বা করবেন কেন?

ইন্দ্রকুমার বলে, আত্মহত্যা নয়। হতে পারে না। এভাবে জন্মদিনের নেমন্তন্ন খেতে এসে কেউ সবার সামনে বিষপান করে আত্মহত্যা করে না। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে উনি রসিকতা করেছিলেন ‘হোয়াইট হর্স’ হুইস্কি নিয়ে। কিন্তু কেসটা খুন কিনা এখনই বলা যায় না।

—কেন? অমন নির্বিরোধী, পরোপকারী, নিঃসম্বল মানুষটাকে কে কেন খুন করবে?—জানতে চায় সুজাতা।

ইন্দ্রকুমার শ্রাগ করে। বলে, এখনই বলা যাচ্ছে না। আমরা জানি না। কিন্তু খুঁজলে হয়তো ওঁর শত্রুকে পাওয়া যাবে।

ব্রজদুলাল বললেন, কথাটা তুমি ঠিকই বলেছ ইন্দ্ৰ। দুদিন আগে আমি নিজেও কল্পনাই করতে পারতাম না যে, ডক্টর শিবশঙ্কর ঘোষালের মতো বিশ্ববঙ্কু, পরোপকারী মানুষকে একজন খুন করতে চায়।

ইন্দ্রকুমার রীতিমতো চমকে ওঠে। বলে, মানে? কী বলছ ব্ৰজদা?

—আস্ক ঘোষাল!

ডক্টর ঘোষাল বললেন, তুমি জান কেসটা। ভুলে গেছ। বহু বছর আগেকার কেস তো! সেই কাল্লু শেখ! মনে নেই?

—তার তো ফাঁসি হয়েছিল!

—ফাঁসি নয়, যাবজ্জীবন।

—সে তো একই কথা!

—না, ইন্দ্র! যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আসামি বেঁচে থাকলে একদিন ছাড়া পায়।

ইন্দ্রকুমার একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে। বলে, সে কি ছাড়া পেয়েছে? তুমি জান?

ঘোষাল মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, এখন ও আলোচনা থাক, ইন্দ্র। পরে বলব। যে-কথা হচ্ছিল—বাসুসাহেব, আপনি কি আশঙ্কা করেন বিল শবরিয়ার মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়?

বাসু পকেট থেকে পাইপ-পাউট বার করেন এতক্ষণে। বলেন, আমি রায়মশায়ের কথাটা রিপিট করব : ‘নাহং বেদ! I don’t know! আমি জানি না!

ইন্দ্রকুমার আবার উঠে দাঁড়ায়। গম্ভীর স্বরে বলে, কথাটা যখন উঠেই পড়ল তখন মন খুলে আমার নিজের কথাটা বলে ফেলি। ওঁর মৃত্যুর হেতু যদি বিষক্রিয়ায় হয়ে থাকে তাহলে আমার একটা দায়িত্ব থেকে যায়। কারণ, ড্রিংসগুলো আমি নিজেই মিশিয়েছিলাম।

ব্রজদুলাল বলেন, বুলশিট! পাগলের মতো কথা বল না, ইন্দ্র। আমরা সবাই দেখেছি বিল নিজে হাতে ট্রে থেকে গ্লাসটা তুলে নিয়েছিল। তুমি তুলে দাওনি। সে হুইস্কি বা রমও নিতে পারত।

ঘোষাল বলেন, যদি বিষপানেই ওঁর মৃত্যু হয়ে থাকে তাহলে আমার ধারণা : এটা আত্মহত্যা! সুইসাইড!

সুজাতা জানতে চায়, কী যুক্তিতে?

—উনি যখন চুমুক দিচ্ছিলেন তখন আমি ওঁর দিকেই তাকিয়েছিলাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে, প্রথম চুমুক দিয়েই ওঁর মুখটা বিকৃত হয়ে উঠেছিল। তা সত্ত্বেও উনি গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রাখেননি। দ্বিতীয়বার চুমুক দিয়েছিলেন।

ব্রজদুলাল মাথা নেড়ে বললেন, তার অন্য একটা হেতু হতে পারে, ঘোবাল। আমার বঙ্কু বিল ছিল খুবই গরিব। তাড়ি, মহুয়া, পচাই হয়তো আগে কখনো খেয়েছে। এখন কিছুই খেত না। হয়তো ও ভদ্‌কা জীবনে কখনো পান করেনি। তাই প্রথম চুমুকে বুঝতে পারেনি—ওর দেহে যেটা হচ্ছে সেটা মাদকতার প্রভাবে নয়, মৃত্যুর সঙ্কেত!

বাসু ইতিমধ্যে পাইপটা ধরিয়েছেন। চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলেন সকলের কথা। এবার নড়ে- চড়ে বসে বললেন, ‘ধপ্ করে তাল পড়লো’, না, ‘পড়ে ধপ্ করলো’ তা জানার একটা বৈজ্ঞানিক রাস্তা কিন্তু এখনো খোলা আছে।

ইন্দ্রকুমার ঝুঁকে পড়ে বললো, পোস্ট-মর্টেম?

—না! মিসেস্ মারিয়া শবরিয়া তাতে রাজি হবেন না। অন্তত খুশি মনে। ওঁরা রোমান ক্যাথলিক। আমি বলছিলাম ঐ গ্লাসটার কথা—

পাশের টেবিলে একটি শূন্য কাচের গ্লাসের দিকে পাইপটা নির্দেশ করলেন উনি।

ব্রজদুলাল বলে ওঠেন, ঠিক কথা! ওতে তো এখনো কিছু তলানি পড়ে আছে দেখা যাচ্ছে। ঘোষাল, তুমি ওটার ফরেনসিক টেস্ট করাও। বিল-এর দেহ তো মৃত্যুকক্ষে রাখা আছে। ইতিমধ্যে ওটা টেস্ট করে পজেটিভ রিপোর্ট পেলে অন্যরকম ব্যবস্থাও করা যেতে পারে।

ডঃ ঘোষাল নিঃশব্দে উঠে গেলেন। হাতে রুমাল জড়িয়ে গ্লাসটা তুলে দেখলেন। বললেন, এনাফ! এক টেম্পুন হবেই। তবে এ-কাজে আমার চেয়ে বাসুসাহেব যোগ্যতর ব্যক্তি। আপনিই এ দায়িত্বটা নিন।

বাসু বললেন, অলরাইট। অশোককে ডাকুন তাহলে।

অশোক অবিলম্বে এসে দাঁড়ালো। বাসু বললেন, রাত সাড়ে দশটা। তা হোক, হস্পিটাল এমার্জেন্সি বিভাগে পাবে। একটা স্টেরিলাইজড শিশি যোগাড় করে নিয়ে এস। ইউরিন – টেস্টের জন্য সব ‘মেডিকেয়ার স্টোরেই’ থাকে। তাতে এই অবশিষ্ট তরল বস্তুটাকে আমাদের সকলের সম্মুখে ঢালতে হবে। তারপর সীল করে আমাকে দিতে হবে। উপরে একটা কাগজ আঠা দিয়ে আটকাতে হবে। তাতে আমাদের ছয়জনের সই থাকবে।

অশোক তৎক্ষণাৎ আবার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। ইন্দ্রকুমার বললে, আপনি কি আশঙ্কা করছেন এতে বিষ পাওয়া যাবে?

বাসু বললেন, বারবার পরের কথা রিপিট করতে ভালো লাগে না। আয়াম সরি; আমি জানি না – I don’t know! কিন্তু ঐ সঙ্গে আরও একটা কোটেশন না দিলে আমার বক্তব্যটা শেষ হবে না। তুমি মৃত্যুর অভিনয় করতেই শিখেছ! আমি কাউন্সেলার। মৃত্যুর তদন্তেই আমার জীবন কেটেছে! মৃত্যুর ইতিহাস আমি নানান দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জেনেছি।