ডক্টর ট্রিপল-এ
নীলা তার বাবাকে বলল, আব্বু আমাকে একটা কুকুর ছানা কিনে দেবে?
নীলার বাবা আবিদ হাসান অন্যমনস্কভাবে বললেন, দেব।
উত্তরটি শুনে নীলার সন্দেহ হল যে তার বাবা আসলে তার কথাটি ভালো করে শোনেন নি–সাধারণত শোনেন না। তাই ব্যাপারটি পরীক্ষা করে দেখার জন্য বলল, আব্বু আমাকে একটা হাতির বাচ্চা কিনে দেবে?
আবিদ হাসান তার কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে আরো একটু ঝুঁকে পড়ে বললেন, দেব।
নীলা এবারে গাল ফুলিয়ে বলল, আব্বু, তুমি আমার কোনো কথা শোন না।
আবিদ হাসান নীলার গলায় উত্তাপ লক্ষ করে এবারে সত্যি সত্যি তার দিকে মনোযোগ দিলেন। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, কে বলেছে শুনি না? এই যে শুনছি!
বল দেখি আমি কী বলেছি?
তুই বলেছিস তোকে একটা ইয়ে কিনে দিতে হবে।
কী কিনে দিতে হবে?
এই তো কিছু একটা হবে — বারো বছরের একটি মেয়ে কী চাইতে পারে ভেবে দেখার চেষ্টা করলেন এবং হঠাৎ করে আবিষ্কার করলেন সে সম্পর্কে তার জ্ঞান খুব সীমিত। ইতস্তত করে বললেন, টেডি বিয়ার?
নীলা এবারে সত্যি সত্যি রাগ করল, সে এখন আর বাচ্চা খুকি নয়, টেডি বিয়ারের বয়স অনেকদিন আগে পার হয়ে এসেছে কিন্তু তার নিজের বাবা এখনো সেটা জানে না। বাবার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, টেডি বিয়ার না, কুকুর ছানা!।
আবিদ হাসান নীলার আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করে বললেন, কুকুর ছানা?
হ্যাঁ। এইটুকুন তুলতুলে কুকুর ছানা।
আবিদ হাসান পুরো ব্যাপারটুকু হেসে উড়িয়ে দিতে গিয়ে তার আদরের মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেলেন। ব্যাপারটা সরাসরি উড়িয়ে দেওয়া যাবে না–একটু গুরুত্ব দিয়ে কথা বলে নিতে হবে। তিনি মুখে খানিকটা গাম্ভীর্য টেনে এনে বললেন, একটা কুকুর ছানা কিন্তু একটা খেলনা নয়, জানিস তো?
জানি।
মজা ফুরিয়ে গেলে একটা খেলনা যেরকম সরিয়ে রাখা যায় একটা কুকুরের বেলায় কিন্তু সেটা করা যায় না।
নীলা চোখ বড় বড় করে বলল, জানি বাবা, সেজন্যই তো চাইছি।
বাসায় একটা কুকুর ছানা আনলে তাকে কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিতে হবে। খাওয়াতে হবে, পরিষ্কার রাখতে হবে, তার সাথে খেলতে হবে, তাকে বড় করতে হবে।
করব বাবা। নীলা উজ্জ্বল চোখে বলল, আমি যেখানেই যাব সেখানেই আমার পিছু পিছু ঘুরে বেড়াবে, কী মজা হবে!
আবিদ হাসান মুখ আরো গম্ভীর করে বললেন, এখন ভাবতে খুব মজা লাগছে, কিন্তু মনে রাখিস যখন তার পিছনে চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিতে হবে তখন কিন্তু মজা উবে যাবে।
যাবে না।
তোর কুকুর ছানা যখন বাথরুম করবে, সেগুলো পরিষ্কার করতে হবে। পারবি?
নীলাকে এবারে একটু বিভ্রান্ত দেখাল, কুকুর ছানা যে বাথরুম করতে পারে এই ব্যাপারটি সে আগে ভেবে দেখে নি। এক মুহূর্ত ইতস্তত করে মুখ শক্ত করে বলল, পারব আব্বু।
আবিদ হাসান একটু হাসলেন, বললেন, এখন বলা খুব সোজা, যখন সত্যি সত্যি করতে হবে তখন পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যাবি!
নীলা তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলল, যাব না বাবা–প্লিজ কিনে দাও!
আবিদ হাসান একটা নিশ্বাস ফেললেন। নীলা তার একমাত্র মেয়ে, খুব আদরের মেয়ে। ভারি লক্ষ্মী মেয়ে, কখনো বাবা–মাকে জ্বালাতন করেছে বলে মনে পড়ে না। কোনো কিছু চাইলে না বলেছেন মনে পড়ে না, কিন্তু বাসায় একটা পোষা কুকুর সেটি তো অনেক বড় ব্যাপার, তার অর্থ জীবন পদ্ধতির সবকিছু ওলটপালট হয়ে যাওয়া।
নীলা খুব আশা নিয়ে তার বাবার মুখের দিকে তাকাল, বলল, দেবে আব্বু?
আবিদ হাসান মেয়েকে নিজের কাছে টেনে এনে বললেন, দেখ, একটা পোষা কুকুর আসলে বাসার নতুন একটা মানুষের মতো। এত মায়া হয়ে যাবে যে যদি কিছু একটা হয়ে যায় তা হলে কেঁদে কূল পাবি না।
কী হবে আব্বু?
এই ধর যদি হারিয়ে যায় কিংবা মরে যায়
কেন হারিয়ে যাবে আব্বু? কেন মরে যাবে? আমি এত যত্ন করে রাখব যে তুমি অবাক হয়ে যাবে।
আবিদ হাসান মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, তুই আরো কয়টা দিন একটু চিন্তা করে দেখ। এখনই ঠিক করে ফেলতে হবে কে বলেছে?
কুকুরের বাচ্চার প্রস্তাবটা যখন নীলার মা মুনিরা হাসান শুনলেন তখন সেটা একেবারে এক কথায় নাকচ করে দিলেন। মুখ শক্ত করে বললেন, ফাজলেমি পেয়েছ? এমনিতেই জান বের হয়ে যাচ্ছে এখন বাসায় একটা কুকুর নিয়ে আসবে? ছিঃ!
নীলার মা মুনিরা হাসানের গলার স্বর সব সময় চড়া সুরে বাঁধা থাকে, তিনি নরম বা কোমল গলায় কথা বলেন না। কাজেই এক কথায় কুকুরের বাচ্চা পোষার শখটাকে বাতিল করে দেওয়ায় নীলার চোখে পানি টলটল করে উঠল এবং বলা যেতে পারে তখন আবিদ হাসান তার মেয়ের সাহায্যে এগিয়ে এলেন। বললেন, আহা, মুনিরা, ওরকম করে বলছ কেন? কুকুর–বেড়াল পোষা তো খারাপ কিছু না।
মুনিরা কোমরে হাত দিয়ে বললেন, এখন তুমিও মেয়ের সাথে তাল দিচ্ছ?
বেচারি একা একা থাকে, একটা সঙ্গী হলে খারাপ কী? পোষা পশুপাখি থাকলে একটা দায়িত্ব নেওয়া শিখবে।
বাসায় দায়িত্ব নেওয়ার জিনিসের অভাব আছে? ঘরদোর পরিষ্কার রাখতে পারে না? নিজের ঘরটা গুছিয়ে রাখতে পারে না? বাসার কাজকর্মে সাহায্য করতে পারে না?
কাজেই নীলার কুকুর পোর ব্যাপারটি আপাতত চাপা পড়ে গেল। বাবাকে নিজের পক্ষে পেয়ে নীলা অবশ্য এত সহজে হাল ছেড়ে দিল না, সে ধৈর্য ধরে লেগে রইল। আবিদ হাসান মেয়ের পক্ষ নেওয়ায় শেষ পর্যন্ত মুনিরা একটু নরম হলেন এবং শেষ পর্যন্ত একদিন নীলা কুকুর পোষার অনুমতি পেল। অনুমতিটি হল সাময়িক নীলার আম্মা খুব স্পষ্ট করে বলে রাখলেন যদি দেখা যায় নীলা ঠিক করে তার পোষা কুকুরের যত্ন নিতে পারছে না তা হলে সাথে সাথে কুকুর ছানাকে গৃহ ত্যাগ করতে হবে।
০২.
আবিদ হাসান একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করেন, বড় একটা প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে তাকে এত ব্যস্ত থাকতে হয় যে নীলাকে নিয়ে তার কুকুর ছানা কিনতে যাওয়ার সময় বের করতে বেশ বেগ পেতে হল। কুকুর ছানা কোথায় পাওয়া যায় সে সম্পর্কেও তার কোনো ধারণা নেই, আবিদ হাসান যখন ছোট ছিলেন তখন শীতের শুরুতে বেওয়ারিশ ছোট ছোট কুকুরের বাচ্চায় চারদিক ভরে উঠত। সেগুলো পোষা নিয়েও কোনো সমস্যা ছিল না। একবার তু তু করে ডাকলেই চিরদিনের জন্য ন্যাওটা হয়ে যেত। এখন দিনকাল পাল্টেছে, কুকুর ছানা কিনে আনতে হয়, ইনজেকশান দিতে হয়, ওষুধ খাওয়াতে হয়, মেজাজ–মর্জি বুঝে চলতে হয়। আবিদ হাসান অফিসে খোঁজ নিলেন এবং জানতে পারলেন কাটাবনের কাছে নাকি পোষা পশুপাখির দোকান রয়েছে। কাজেই একদিন সন্ধেবেলা নীলাকে নিয়ে তিনি কুকুরের বাচ্চা কিনতে গেলেন।
কাজটি যেরকম সহজ হবে বলে তিনি মনে করেছিলেন দেখা গেল সেটা মোটেও তত সহজ নয়। কাটাবনে সারি সারি দোকান রয়েছে সত্যি কিন্তু সেখানে কুকুর বলতে গেলে নেই। এক দুটি দোকানে কিছু ঘেয়ো কুকুর ছোট পঁচার মাঝে বেঁধে রাখা হয়েছে। দানাপানি না দিয়ে ছোট খাঁচার মাঝে বেঁধে রাখার ফলে তাদের মেজাজ হয়ে আছে তিরিক্ষে, কাছে যেতেই সবগুলো একসাথে ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠল। খুঁজে পেতে একটা দোকানে একটা বিদেশী কুকুরের বাচ্চা পাওয়া গেল, এক সময় তার গায়ের রং নিশ্চয়ই ধবধবে সাদা ছিল কিন্তু এখন অযত্নে ময়লা হয়ে আছে। কুকুর ছানাটা নির্জীব হয়ে শুয়ে ছিল। নীলা কাছে গিয়ে ডাকাডাকি করেও তাকে দাঁড়া করাতে পারল না।
নীলা এবং আবিদ হাসান যখন কী করবেন সেটা নিয়ে কথা বলছেন তখন দোকানের একজন কর্মচারী তাদের দিকে এগিয়ে এল, বলল, কুকুর কিনবেন?
হ্যাঁ। কুকুরের বাচ্চা!
মানুষটি আবিদ হাসানের চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারল চেষ্টা চরিত্র করে সে তার দোকানের কোনো কুকুর গুছিয়ে দিতে পারবে না, তাই সেদিকে আর চেষ্টা করল না। বলল, এভাবে তো ভালো কুকুর পাবেন না। সাপ্লাই তো কম। ঠিকানা–টেলিফোন রেখে যান ভালো বাচ্চা এলে ধোজ দেব।
কবে আসবে?
কোনো ঠিক নাই। আজকেও আসতে পারে, এক মাস পরেও আসতে পারে।
নীলার মুখের দিকে তাকিয়ে আবিদ হাসানের মন খারাপ হল, জিজ্ঞেস করলেন, আর কোনো কুকুরের দোকান নাই?
না। তবে
তবে?
শুনেছি টঙ্গীর কাছে নাকি একটা পোষা কুকুরের ফার্ম খুলছে।
কুকুরের ফার্ম? আবিদ হাসান খুব অবাক হলেন। কুকুরের আবার ফার্ম হয় নাকি?
তাই তো শুনেছি। সব নাকি বিদেশী কুকুর।
তাই নাকি?
জে।
সেই ফার্মে কী হবে?
মাছের যেরকম চাষ হয় সেরকম কুকুরের চাষ হবে। দোকানের কর্মচারী নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে ফেলল।
কী হবে কুকুরের চাষ করে?
জানি না। কেউ বলে কোরিয়ায় কুকুরের মাংস রপ্তানি করবে। কেউ বলে ল্যাবরেটরিতে গবেষণার জন্য পাঠাবে। কেউ বলে পুলিশের কাছে বিক্রি করবে।
আবিদ হাসান কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ফার্মটা কোথায়?
সেটা তো জানি না। শুনেছি টঙ্গীর কাছে আমেরিকান কোম্পানি।
নাম কী কোম্পানির?
মানুষটা মুখ সুচালো করে নামটা মনে করার চেষ্টা করে বেশি সুবিধে করতে পারল না, তখন ভিতরে ঢুকে কাগজ ঘাঁটাঘাঁটি করে একটা ময়লা কাগজে নাম লিখে আনল, পেট ওয়ার্ল্ড–পোষা প্রাণীর জগৎ।
আবিদ হাসান মেয়েকে কথা দিলেন পরের দিনই তিনি পেট ওয়ার্ল্ডের খোঁজ নেবেন।
.
আমেরিকান কোম্পানি হইচই করে বিদেশী কুকুরের একটা বিশাল ফার্ম বসালে সেটা খুঁজে পাওয়া সহজ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু পেট ওয়ার্ল্ড খুঁজে বের করতে আবিদ হাসানের কালো ঘাম ছুটে গেল। আজ সকাল সকাল অফিস থেকে বের হয়েছেন, নীলাকে নিয়ে টঙ্গী এসে পেট ওয়ার্ল্ড খোজা শুরু করেছেন, সন্ধে ঘনিয়ে যাবার পর যখন তিনি আশা ছেড়ে দিয়েছেন তখন পেট ওয়ার্ল্ডের খোঁজ পাওয়া গেল। বড় রাস্তার পাশে বেশ বড় একটা জায়গা উঁচু দেয়াল এবং কাটাতার দিয়ে ঘেরা। ভিতরে জেলখানার মতো বড় একটা দালান। সামনে শক্ত লোহার গেট এবং গেটের পাশে ছোট পেতলের একটা নামফলক, সেখানে আরো ছোট করে ইংরেজিতে লেখা পেট ওয়ার্ল্ড!
আবিদ হাসান গেটের সামনে দাঁড়িয়ে তার গাড়ির হর্ন বাজালেন। বার দুয়েক শব্দ করার পর প্রথমে গেটের উপরে ছোট চৌকোনা একটা জানালা খুলে গেল। সেখান থেকে একজন মানুষ উঁকি দিয়ে তাকে দেখল, তারপর গেটের পাশ থেকে নিরাপত্তারক্ষীর পোশাক পরা একজন মানুষ বের হয়ে এল, আবিদ হাসানের কাছে এসে দাঁড়িয়ে মানুষটি জিজ্ঞেস করল, কাকে চান?
আবিদ হাসান একটু বিপন্ন অনুভব করলেন, তার মনে হল তিনি বুঝি কোনো ভুল জায়গায় চলে এসেছেন। একটু ইতস্তত করে বললেন, আসলে আমি একটা কুকুর ছানা কিনতে এসেছি।
নিরাপত্তারক্ষীর পোশাক পরা মানুষটি কঠিন মুখে বলল, এখানে কুকুর ছানা বিক্রি হয় না।
আমাকে একজন বলল এখানে নাকি কুকুরের ফার্ম তৈরি হয়েছে।
মানুষটি নিস্পলক চোখে আবিদ হাসানের দিকে তাকিয়ে থেকে গলায় খানিকটা অনাবশ্যক রূঢ়তা ঢেলে বলল, আমি আপনাকে বলেছি, এখানে কুকুর বিক্রি হয় না।
মানুষটির ব্যবহারে আবিদ হাসান অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। তিনি রুষ্ট গলায় বললেন, তা হলে এখানে কী হয়?
নিরাপত্তারক্ষীর পোশাক পরা মানুষটি আবিদ হাসানের কথার উত্তর দেবার কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল না। সে পিছন ফিরে তার গেটের কাছে ফিরে যেতে থাকে, ঠিক তখন তার কোমরে ঝোলানো ওয়াকিটকিতে কেউ একজন তার সাথে যোগাযোগ করল। মানুষটি ওয়াকিটকিটি মুখের কাছে ধরে বাক্য বিনিময় শুরু করে, কী নিয়ে কথা বলছে সেটি শুনতে না পেলেও আবিদ হাসান বুঝতে পারলেন মানুষটি তাকে নিয়ে কথা বলছে। এক্সেলেটরে চাপ দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে গিয়ে তিনি থেমে গেলেন, কারণ তিনি দেখতে পেলেন নিরাপত্তারক্ষী মানুষটি তার দিকে এগিয়ে আসছে।
আপনি ভিতরে যান।
আবিদ হাসান ভুরু কুঁচকে বললেন, এখানে যদি কুকুর বিক্রি না হয় তা হলে আমি গিয়ে কী করব?।
নিরাপত্তারক্ষীর পোশাক পরা মানুষটি আবিদ হাসানের উত্মাটুকু হজম করে নিয়ে তার হাতের স্বয়ংক্রিয় একটা সুইচে চাপ দিতেই সামনের গেটটি ঘরঘর শব্দ করে খুলতে শুরু করে। তার গাড়িটা যাওয়ার মতো জায়গা করে গেটটা থেমে গেল। আবিদ হাসান গাড়ি ঘুরিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলেন।
গাড়ি ভিতরে ঢুকতেই নীলা বলল, কী সুন্দর! দেখেছ আব্বু?
আবিদ হাসান মাথা নাড়লেন, সত্যিই সুন্দর। বাইরে থেকে বোঝা যায় না ভিতরে এত জায়গা। সুবিস্তৃত লনে গাছগাছালি এবং ফুলের বাগান, পিছনে বিশাল আলোকোজ্জ্বল দালান। পুরো জায়গাটুকুতে এক ধরনের দীর্ঘ পরিকল্পনার ছাপ রয়েছে, আবিদ হাসানের। মনে হল তিনি বুঝি পাশ্চাত্যের কোনো একটি বড় করপোরেট অফিসে ঢুকে গেছেন।
গাড়ি পার্ক করার জন্য জায়গা নির্দিষ্ট করা হয়েছে, সেখানে গাড়ি রেখে আবিদ হাসান নীলার হাত ধরে খোয়া বাধানো হাঁটা পথে মূল দালানে পৌঁছলেন। বড় কাঁচের স্লাইডিং দরজার সামনে দাঁড়াতেই সেটা নিঃশব্দে খুলে গেল। আবিদ হাসান ভিতরে পা দিতেই কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের আরামদায়ক অনুভূতি তার সারা শরীর জুড়িয়ে দিল। দরজার অন্যপাশে একজন তরুণী দাঁড়িয়ে ছিল, আবিদ হাসান এবং নীলাকে দেখে সে তাদের দিকে এগিয়ে এল। মেয়েটির ফোলানো চুল এবং পরিমিত প্রসাধন চেহারায় এক ধরনের আকর্ষণীয়। এবং মাপা কমনীয়তা নিয়ে এসেছে। মেয়েটি মিষ্টি করে হেসে বলল, আসুন। আমি জেরিন। পেট ওয়ার্ডে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।
আমি আবিদ হাসান আর এ হচ্ছে আমার মেয়ে নীলা।
আসুন মি. হাসান। আপনার জন্য ডক্টর আজহার অপেক্ষা করছেন।
ডক্টর আজহার?
হ্যাঁ। আমাদের ম্যানেজিং ডিরেক্টর। এই পুরো প্রজেক্টটা ডক্টর আজহারের ব্রেইন চাইল্ড।
আবিদ হাসান বড় একটা হলঘরের ভিতর দিয়ে হেঁটে একটা লিফটের সামনে পঁড়ালেন। বোতাম স্পর্শ করামাত্র লিফটের দরজা নিঃশব্দে খুলে গেল। জেরিন আবিদ হাসান এবং নীলাকে নিয়ে লিফটে করে সাত তলায় এসে একটা দীর্ঘ করিডোর ধরে হেঁটে বড় একটা ঘরের সামনে দাঁড়াল। দরজার পাশে একটা সেক্রেটারিয়েট ডেস্ক, সেখানে ইন্টারকমে চাপ দিয়ে জেরিনা নিচু গলায় বলল, স্যার, আপনার গেস্টদের নিয়ে এসেছি।
আবিদ হাসান ইন্টারকমে একটা মোটা গলার আওয়াজ শুনতে পেলেন, ভিতরে নিয়ে এস।
জেরিন দরজা ঠেলে খুলে দিয়ে আবিদ হাসান এবং নীলাকে ভিতরে যেতে ইঙ্গিত করল। আবিদ হাসান নীলার হাত ধরে ভিতরে ঢুকলেন। বিশাল একটি অফিস ঘর, অন্যপাশে একটা বড় ডেস্কে পা তুলে একজন মানুষ তার রিভলবিং চেয়ারে আধশোয়া হয়ে বসে কিছু একটা পড়ছিল, আবিদ হাসান এবং নীলাকে ঢুকতে দেখে মানুষটি পা নামিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে এগিয়ে এল। এ রকম বিশাল একটি প্রতিষ্ঠান যার পরিকল্পনায় গড়ে উঠেছে সেই মানুষটিকে তুলনামূলকভাবে বেশ কম বয়স্ক মনে হল–আবিদ হাসান থেকে বড়জোর বছর পাঁচেকের বড় হবে। মানুষটি দীর্ঘদেহী এবং সুদর্শন, চোখে সূক্ষ্ম ধাতব রীমের চশমা। মাথায় এলোমেলো চুল, গায়ের রং অস্বাভাবিক ফর্সা–এই বয়সেও রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে যায় নি।
মানুষটি লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এসে আবিদ হাসানের সাথে করমর্দন করে বলল, আমি আসিফ আহমেদ আজহার। আমার বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলে ট্রিপল–এ।
আবিদ হাসান হাসলেন, ভাগ্যিস আপনি আমেরিকাতে নেই, তা হলে যত ভাঙা গাড়ি তাদের ড্রাইভারের ফোনের উত্তর দিতে দিতে আপনার জান বের হয়ে যেত।
যুক্তরাষ্ট্রের মোটর গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের প্রতিষ্ঠান আমেরিকান অটোমোবাইল এসোসিয়েশনের নামের আদ্যক্ষরের সাথে ডক্টর আজহারের নামের মিলটুকু আবিদ হাসান ঠিক ঠিক ধরতে পেরেছেন দেখে মানুষটি বেশ সন্তুষ্ট হল। সে আবিদ হাসান এবং নীলাকে তার ডেস্কের সামনে রাখা গদিসাঁটা চেয়ারে বসিয়ে নিজের জায়গায় বসে আবিদ হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি সিকিউরিটি গার্ডের ব্যবহারের জন্য আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি।
আবিদ হাসান ঠিক কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। ভদ্রতাসূচক কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন তার আগেই ডক্টর আজহার বলল, আমি অবশ্য সিকিউরিটি গার্ডের দোষও দিতে পারছি না। আমরা বেছে বেছে এমন মানুষকে সিকিউরিটি গার্ডের দায়িত্বে দেই যাদের আই. কিউ, খুব বেশি নয়। খানিকটা রোবটের মতো মানুষ! তাদের কাছে খুব ভদ্রতা আশা করাও অন্যায় হবে।
আবিদ হাসান মানুষটিকে তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করতে থাকলেন। মানুষটির সপ্রতিভ আন্তরিক কথাবার্তার পরেও তার ভিতরে কিছু একটা তাকে এক ধরনের অস্বস্তির মাঝে ফেলে দেয়। মানুষটি এবারে হঠাৎ করে নীলার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী খাবে বল? আইসক্রিম, কোল্ড ড্রিংকস, হট চকলেট?
নীলা আইসক্রিম খুব পছন্দ করে কিন্তু সেটা মুখ ফুটে বলল না, মাথা নেড়ে বলল, কিছু খাব না।।
কিছু একটা তো যেতে হবে। মানুষটি নীলার দিকে চোখ মটকে বলল, ঠিক আছে আইসক্রিমই হোক। আমার কাছে খুব ভালো আইসক্রিম আছে। স্ট্রবেরি উইথ হেজল নাট।
ইন্টারকমে চাপ দিয়ে এই সপ্রতিভ মানুষটি নীলার জন্য আইসক্রিম এবং তাদের দুজনের জন্য কফির কথা বলে আবার আবিদ হাসানের দিকে ঘুরে তাকাল। আবিদ হাসান একটু ইতস্তত করে বললেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না–আপনি কি শুধু সিকিউরিটি গার্ডের হয়ে ক্ষমা চাইবার জন্য আমাদের ডেকেছেন?
মানুষটি হা হা করে হেসে উঠে বলল, না। আমি সে জন্য আপনাদের কষ্ট দিই নি। আমাদের এই ফ্যামিলিটির সিকিউরিটি সিস্টেম একেবারে স্টেট অফ দি আর্ট। আমি এখানে বসে সবকিছু মনিটর করতে পারি। ঘটনাক্রমে আমি আপনার সাথে গার্ডের কথা শুনতে পেরেছি। আপনি আপনার মেয়ের জন্য একটা কুকুর ছানা খুঁজছেন।
হ্যাঁ। সারা ঢাকা শহর খুঁজে আমি একটা ভালো কুকুর ছানা পেলাম না।
পাবেন না। মানুষটি সোজা হয়ে বলল, যে দেশে মানুষ খেতে পায় না সে দেশে কুকুর আপনি কেমন করে পাবেন?
আবিদ হাসান একটু অবাক হয়ে বললেন, তা হলে আপনারা এত হইচই করে কুকুরের ফার্ম কেন খুলেছেন?
এক্সপোর্টের জন্য। ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ডে পোষা পশুপাখির বিশাল মার্কেট। মাল্টি বিলিয়ন ডলার ইন্ডাস্ট্রি। আমরা সেই মার্কেটটা ধরতে চাই।
আবিদ হাসানকে একটু বিভ্রান্ত দেখাল, তিনি মাথা নেড়ে বললেন, আমি বিজনেস বুঝি না। কিন্তু কমনসেন্স থেকে মনে হয় এখানে কুকুরের ফার্ম করে সেই কুকুরকে বিদেশে রপ্তানি করা কিছুতেই একটা লাভজনক ব্যবসা হতে পারে না।
ডক্টর আজহার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই জেরিন একটা সুন্দর ট্রে করে দুই মগ কফি এবং একটা গবলেটে আইসক্রিম নিয়ে এসে ঢুকল। টেবিলে তাদের সামনে সেগুলো সাজিয়ে রেখে চলে যাবার পর ডক্টর আজহার কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, আপনি বলছেন বিজনেস বোঝেন না, কমনসেন্স থেকে বলছেন কিন্তু বিজনেস মানেই হল কমনসেন্স। আপনি ঠিকই বলেছেন এখান থেকে সাধারণ কুকুর রপ্তানি করা লাভজনক ব্যবসা নয়।
তা হলে?
আমরা সাধারণ কুকুর রপ্তানি করব না। তা হলে কী ধরনের কুকুর?
জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে আমরা এমন একটি প্রজাতি দাঁড় করিয়েছি সারা পৃথিবীতে তার কোনো জুড়ি নেই।
আবিদ হাসান ভুরু কুঁচকে তাকালেন, কিসে জুড়ি নেই?
বুদ্ধিমত্তায়।
বুদ্ধিমত্তা?
হ্যাঁ। অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা।
আবিদ হাসান ডক্টর আজহারের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আমি বুঝতে পারছি না, জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে আপনি কুকুরের বুদ্ধিমত্তা কীভাবে বাড়াবেন?
আমার পিএইচডি থিসিসের নাম ছিল আইসোলেশান অফ জিন্স রেসপন্সিবল অফ ইনটেলিজেন্স ইন কেনাইন ফেমিলি। অর্থাৎ কুকুরের বুদ্ধিমত্তা জিন্সটি আলাদা করা।
কুকুরের বুদ্ধিমত্তায় একটি জিন্স আছে?
ডক্টর আজহার হাত নেড়ে বলল, এই আলোচনাগুলো আসলে কফি খেতে খেতে শেষ করা সম্ভব না, হ্যাঁ এবং না দিয়েও এর উত্তর হয় না। তবে আপনি যদি জানতে চান। আপনাকে বলতে পারি, বুদ্ধিমান কুকুরের জিন্স আলাদা করে অসাধারণ বুদ্ধিমান কুকুর তৈরি করায় আমার একটা পেটেন্ট রয়েছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। সেই পেটেন্ট দেখে আমেরিকায় একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি আমার সাথে যোগাযোগ করেছিল। পুরো দেড় বছর আলাপ–আলোচনা হয়েছে, শেষ পর্যন্ত এখানে পেট ওয়ার্ল্ড তৈরি হয়েছে।
চমৎকার। আবিদ হাসান বললেন, আপনাকে অভিনন্দন।
এখন অভিনন্দন দেবেন না। পুরোটুকু দাঁড়িয়ে যাক, স্টেটসে প্রথম শিপমেন্ট পাঠাই তারপর দেবেন।
প্রথম শিপমেন্টের কত বাকি?
অনেক। মাত্র প্রথম কয়েকটি টেস্ট কেস তৈরি হয়েছে। চমৎকার কয়েকটা কুকুর ছানার জন্ম হয়েছে।
নীলা এতক্ষণ চুপ করে তার আব্বুর সাথে ডক্টর আজহারের কথা শুনছিল, এবারে প্রথমবার কথা বলে উঠল, সত্যি?
ডক্টর আজহার নীলার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। বলল, হ্যাঁ, সত্যি। প্রথম কেসগুলো করেছি টেরিয়ার দিয়ে। আস্তে আস্তে শার্পে সিটজ করে ল্যাব্রাডার যাব। স্টেটসে ল্যাব্রাডার প্রজাতি খুব পপুলার।
নীলা একবার তার বাবার মুখের দিকে তাকাল, তারপর ডক্টর আজহারের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কুকুর ছানাগুলো বিক্রি করবেন?
ডক্টর আজহার চোখ বড় বড় করে লীলার দিকে তাকিয়ে বলল, কিনবে তুমি?
নীলা মাথা নাড়ল এবং সাথে সাথে ডক্টর আজহার হা হা করে হেসে উঠে বলল, আমাদের এই কুকুর ছানাগুলোর দাম কত জান?
নীলা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, কত?
রিটেল মার্কেট–অর্থাৎ খোলা বাজারে সাড়ে সাত হাজার ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশের টাকায় তিন লাখ থেকে বেশি!
নীলার মুখটি সাথে সাথে আশাভঙ্গের কারণে ম্লান হয়ে যায়। পুরো ব্যাপারটাকে তার কাছে এক ধরনের দুর্বোধ্য এবং নিষ্ঠুর রসিকতা বলে মনে হতে থাকে। ডক্টর আজহার নীলার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে বলল, আছে তোমার কাছে তিন লাখ টাকা?
নীলা কিছু বলল না। ডক্টর আজহার সোজা হয়ে বসে হঠাৎ গলার স্বরে এক ধরনের গুরুত্বের ভাব এনে বলল, তোমার মন খারাপ করার কোনো কারণ নেই, কারণ একটু আগে তোমার বাবার সাথে তোমাকে দেখে আমার মাথায় একটা চমৎকার আইডিয়া এসেছে। সে জন্য তোমাদের এখানে ডেকে এনেছি।
নীলার চোখ হঠাৎ চকচক করে ওঠে, কী আইডিয়া?
আমাদের এই কুকুর ছানাগুলোকে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। তারা কতটুকু বদ্ধিমান হয়েছে, মানুষের সাথে থাকতে তারা কত পছন্দ করে, সেই ব্যাপারগুলো নিয়ে গবেষণা। করতে হবে। সেটা করার সবচেয়ে ভালো উপায় কী জান?
কী?
তাদের কোনো একটি ফ্যামিলির সাথে থাকতে দেওয়া। কাজেই যদি দেখা যায় তুমি সেরকম একটা ফ্যামিলির মেয়ে তা হলে তোমাকে আমরা একটা কুকুর ছানা দিয়ে দেব।
সত্যি? নীলা আনন্দে চিৎকার করে উঠে বলল, সত্যি?
সত্যি। শুধু একটি ব্যাপার।
কী ব্যাপার?
কুকুর ছানাটিকে পোষার ব্যাপারে আমাদের কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। আর
আর?
আর মাঝে মাঝে কুকুর ছানাটিকে আমাদের পরীক্ষা করতে দিতে হবে। রাজি?
নীলা রাজি বলে চিৎকার করতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে থেমে তার আব্বুর দিকে অনুমতির জন্য তাকাল। আবিদ হাসান হেসে মাথা নেড়ে অনুমতি দিলেন। সাথে নীলা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল, রাজি!
চমৎকার। ডক্টর আজহারের গলার স্বর আবার গম্ভীর হয়ে আসে, সে একটু সামনে ঝুঁকে বলল, তা হলে তোমার আব্বুর সাথে কিছু কাগজপত্র তৈরি করে নেওয়া যাক। কাল ভোরে তোমার বাসায় চমৎকার একটা আইরিশ টেরিয়ার কুকুর ছানা চলে আসবে!
নীলা চকচকে চোখে বলল, আমি কি আমার কুকুর ছানাটিকে দেখতে পারি?
ডক্টর আজহার এক মুহূর্ত কী যেন ভাবল, তারপর বলল, এস আমার সাথে।
ডক্টর আজহারের পিছু পিছু আবিদ হাসান এবং নীলা একটি বড় হলঘরে হাজির হল। ঘরের দেয়ালে অনেকগুলো বড় বড় টেলিভিশন স্ক্রিন। একেকটা স্ক্রিনে একেকটি ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্য। কোনোটিতে বড় একটি ল্যাবরেটরিতে মানুষেরা কাজ করছে, কোথাও বড় গুদামঘর। থেকে জিনিসপত্র সরানো হচ্ছে, কোথাও খাচায় রাখা বড় বড় কুকুর, কোথাও বিচিত্র ধরনের যন্ত্রপাতি। ডক্টর আজহার সুইচপ্যানেল স্পর্শ করতেই একটা স্ক্রিনের দৃশ্য পাল্টে যায় এবং সেখানে ধবধবে সাদা কুকুর ছানার ছবি ফুটে ওঠে। কুকুর ছানাটি স্থির দৃষ্টিতে কোথায় জানি তাকিয়ে আছে।
ডক্টর আজহার নীলাকে বলল, এই যে, তোমার কুকুর ছানা।
নীলা বুকের মাঝে আটকে রাখা নিশ্বাসটি বের করে দিয়ে বলল, ইস্! কী সুন্দর!
আবিদ হাসানকেও স্বীকার করতে হল কুকুর ছানাটি সত্যিই ভারি সুন্দর! শিশু–তা সে মানুষেরই হোক আর পশুপাখিরই হোক, সব সময়ই সুন্দর।
০৩.
নীলার কুকুর ছানা নিয়ে মুনিরা হাসানের প্রকাশ্যে এবং আবিদ হাসানের গোপনে যেটুকু দুশ্চিন্তা ছিল পেট ওয়ার্ল্ডের কাজকর্ম দেখে তার পুরোটাই দূর হয়ে গেল। পেট ওয়ার্ল্ড যে নীলার জন্য শুধু একটি ধবধবে সাদা কুকুর ছানা দিয়ে গেল তা নয়, কুকুর ছানাটিকে দেখেশুনে রাখার জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবকিছুর ব্যবস্থা করে দিয়ে গেল। তারা বাসার সামনে মোল্ডেড প্লাস্টিকের সুন্দর ঘর, প্রথম তিন মাসের খাবার এবং ওষুধপত্র, কুকুর ছানা পরিচর্যা করার উপরে বই, কাগজপত্র এমনকি একটা ভিডিও এবং কুকুর ছানার বুদ্ধিমত্তা বিকাশের জন্য কী কী করতে হবে সেসব ব্যাপারেও নীলার সাথে আলাপ করে গেল। কুকুর ছানার দৈনন্দিন তথ্য পাঠানোর জন্য একটি ই–মেইল একাউন্ট এমনকি জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগ করার জন্য সার্বক্ষণিক একটি টেলিফোন নম্বরও দিয়ে গেল।
কয়েকদিনের মাঝেই কুকুর ছানাটির উপস্থিতিতে বাসার সবাই মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে যায়। কুকুর ছানাটি শান্ত এবং আমুদে। নীলার মনোরঞ্জনের জন্য খুব ব্যস্ত এবং অত্যন্ত সুবোধ। কোন জিনিসটি করতে পারবে এবং কোন জিনিসটি করতে পারবে না সেটি একবার বলে দেওয়া হলেই কুকুর ছানাটি সেটি মনে রাখে এবং মেনে চলে। সারা রাত জেগে থেকে কেউকেউ চিৎকার করে সারা বাড়ি মাথায় তুলে সবার জীবন অতিষ্ঠ করে দেবে বলে যে ভয়টা ছিল দেখা গেল সেটা পুরোপুরি অমূলক। রাত্রে ঘুমানোর সময় কুকুর ছানাটিকে তার। ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেওয়ামাত্রই সে দুই পায়ের মাঝে মাথা ঢুকিয়ে ব্যাপারটি মেনে নেয়।
কুকুর ছানাটির কী নাম দেওয়া যায় সেটি নিয়ে অনেক জল্পনাকল্পনা হল এবং শেষ পর্যন্ত নীলার যে নামটি পছন্দ সেটি হচ্ছে টুইটি। আবিদ হাসানের ধারণা ছিল এই নামটিতে অভ্যস্ত হতে কুকুর ছানা সপ্তাহখানেক সময় নেবে কিন্তু দেখা গেল এক বেলার মাঝে কুকুর ছানাটি তার নতুন নামে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে সত্যি সত্যি কুকুরের মাঝে বুদ্ধিমান প্রজাতি তৈরি করা সম্ভব সেটি আবিদ হাসান এই প্রথমবার একটু একটু বিশ্বাস করতে শুরু করলেন।
কিছুদিনের মাঝেই বাসার সবাই কুকুর ছানা টুইটিকে বেশ পছন্দ করে ফেলল। নীলা। স্কুল থেকে আসার পরই টুইটিকে নিয়ে ছোটাছুটি করে। সত্যি কথা বলতে কী, আবিদ হাসানও বিকেলবেলা টুইটি নামের এই আইরিশ টেরিয়ার কুকুর ছানাটিকে নিয়ে খানিকক্ষণ খেলার জন্য বেশ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে থাকেন। মুনিরা হাসান যদিও নিজে থেকে এখনো টুইটির সাথে কোনো রকম মাখামাখি করেন নি, কিন্তু বারান্দায় বসে থেকে তার স্বামী এবং কন্যাকে এই কুকুর ছানাটিকে নিয়ে বড় ধরনের হইচই করতে দেখা বেশ পছন্দই করেন। নির্বোধ পশুপাখি সম্পর্কে তার যেরকম একটি ধারণা ছিল টুইটিকে কাছাকাছি দেখে তার বেশ একটা বড় পরিবর্তন হয়েছে।
আবিদ হাসান যেটুকু জানেন সে অনুযায়ী পেট ওয়ার্ল্ড এখনো পুরোপুরি ব্যবসা শুরু করে নি। ডক্টর আজহারের সাথে কথা বলে যেটুকু বুঝেছিলেন তাতে মনে হয় মোটামুটি নিয়মিতভাবে বুদ্ধিমান প্রজাতির কুকুর ছানা তৈরি করতে শুরু করার এখনো বছর দুয়েক সময় বাকি। যে। কোনো ব্যবসার গোড়ার দিকে একটা সময় থাকে যখন সেটি দাঁড়া করানোর জন্য তার পিছনে। প্রচুর টাকা ঢালতে হয়। পেট ওয়ার্ল্ড সে ব্যাপারে নিশ্চয়ই ভালোভাবে প্রস্তুত। তারা শুধু যে। তাদের প্রতিষ্ঠানটিকে চালিয়ে যাচ্ছে তাই নয়, টঙ্গীর আশপাশে বেশ কিছু দাঁতব্য সেবা প্রতিষ্ঠানও খুলেছে। সেখানে গরিব মানুষজন বিনা খরচে চিকিৎসা পেতে পারে, বিশেষ করে সন্তানসম্ভবা মায়েদের চিকিৎসার খুব ভালো এবং আধুনিক ব্যবস্থা রয়েছে। আমেরিকান বড় করপোরেশনগুলো স্থানীয় এলাকায় সবসময়েই এ ধরনের নানারকম আয়োজন করে থাকে, তার সবগুলোই যে মানুষের জন্য ভালবাসার কারণে হয়ে থাকে তা নয়। ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া থেকে শুরু করে স্থানীয় মানুষজনের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলা জাতীয় ব্যাপারগুলোই আসলে মূল উদ্দেশ্য। নিজেরা যখন বিশাল অর্থের পাহাড় গড়ে তুলবে তখন তার একটি অংশ যদি গরিব দুঃখী মানুষের জন্য খরচ করা হয় খারাপ কী?
দেখতে দেখতে তিন মাস পার হয়ে গেল। টুইটিকে নিয়ে প্রাথমিক উচ্ছ্বাসটুকু কেটে যাবার পরও নীলার উৎসাহে এতটুকু ভাটা পড়ে নি। সফটওয়্যার নিয়ে নতুন একটা প্রজেক্ট শুরু করার পর আবিদ হাসান হঠাৎ করে বাড়াবাড়ি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, মাঝখানে তাকে কয়েক সপ্তাহের জন্য জার্মানিও যেতে হল। জার্মানি থেকে ফিরে আসার সময় এবারে তার স্ত্রী এবং কন্যার জন্য ছোটখাটো উপহারের সাথে সাথে টুইটির জন্যও একটা উপহার কিনে আনলেন–একটা ফ্লী–কলার, কুকুরের গলায় বেঁধে রাখলে তার শরীরে উকুন হয় না!
জার্মানি থেকে ফিরে এসে অনেকদিন পরে রাত্রে একসাথে খেতে বসে আবিদ হাসান তার মেয়ের খোঁজ–খবর নিচ্ছিলেন। স্কুলের খবর, বন্ধুবান্ধবের খবর দিয়ে নীলা টুইটির খবর দিতে শুরু করল। বলল, আব্বু, টুইটি যা দুষ্টু হয়েছে তুমি সেটা বিশ্বাস করবে না।
নীলার গলায় অবশ্য টুইটির বিরুদ্ধে যেটুকু অভিযোগ তার চাইতে অনেক বেশি মমতার ছাপ ছিল। আবিদ হাসান মুখ টিপে হেসে বললেন, কী দুষ্টুমি করেছে, শুনি?
তাকে গল্প না বললে খেতে চায় না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, কিসের গল্প শুনতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে বল দেখি?
কিসের?
একটা ছোট বাচ্চা আর তার মায়ের গল্প।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
নীলা আদুরে গলায় বলল, আচ্ছা আব্বু বল, প্রত্যেকদিন কি গল্প বলা যায়?
আবিদ হাসান মাথা নাড়লেন, ঠিকই বলেছি। এভাবে চলতে থাকলে তো তোর কুকুর ছানাকে পড়ার জন্য নার্সারি স্কুলে পাঠাতে হবে!
নীলা হেসে ফেলল, বলল, না আব্বু কুকুরকে নার্সারি স্কুলে পাঠাতে হবে না। আমি অনেক চেষ্টা করে দেখেছি টুইটির পড়াশোনায় কোনো উৎসাহ নেই। ডাবলিউ আর এম উল্টাপাল্টা করে ফেলে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। আর কিছুতেই নয়ের বেশি গুনতে পারে না। দশ লিখলেই টুইটির মাথা আউলা–ঝাউলা হয়ে যায়! একবার বলে এক আরেকবার বলে শূন্য।
আবিদ হাসান হঠাৎ একটু অবাক হয়ে নীলার দিকে তাকালেন, এতক্ষণ টুইটির সম্পর্কে যেসব কথা বলে গেছে তার কোনোটাই তিনি খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে নেন নি, নীলার শেষ কথাটি শুনে তিনি রীতিমতো চমকে উঠলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কী বললি তুই?
নীলা গাল ফুলিয়ে বলল, তার মানে তুমি আমার কোনো কথা শোন নি?
কে বলেছে শুনি নি। সব শুনেছি।
তা হলে আবার জিজ্ঞেস করছ কেন?
তুই সত্যি বলেছিস নাকি ঠাট্টা করছিস জানার জন্য।
ঠাট্টা করব কেন? নীলা মুখ গম্ভীর করে বলল, তোমার মনে নেই টুইটির দাম সাড়ে সাত হাজার ডলার? সে সবকিছু বোঝে।
পাগলী মেয়ে, দাম বেশি হলেই সবকিছু বুঝবে কে বলেছে? সবকিছুর একটা সীমা থাকে। খুব বুদ্ধিমান কুকুরেরও বুদ্ধির একটা সীমা থাকবে।
নীলা বুক ফুলিয়ে বলল, আমার টুইটির বুদ্ধির কোনো সীমা নেই।
তুই যা বলেছিস সেটা সত্যি হলে আসলেই তোর টুইটির বুদ্ধির কোনো সীমা নেই।
তুমি কী বলছ আব্বু? আমি কি তোমাকে মিথ্যে বলেছি?
ইচ্ছে করে হয়তো বলিস নি কিন্তু যেটা বলছিস সেটা সত্যি হতে পারে না। মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী খুব বেশি দূর গুনতে পারে না।
নীলা মুখ গম্ভীর করে বলল, টুইটি পারে। আমি তোমাকে দেখাব।
ঠিক আছে। আবিদ হাসান খেতে খেতে বললেন, যেটা হয়েছে সেটা এ রকম, তোর টুইটি কিছু শব্দ শুনে কিছু কাজ করে, শব্দগুলো যে সংখ্যা সেটা সে জানে না। অনেকটা ময়না পাখির কথা বলার মতো। ময়না পাখি যে কথা বলে সেটা তারা বুঝে বলে না–তারা শুধু এক ধরনের শব্দ করে। বুঝেছিস!
নীলা বলল, আমি বুঝেছি আব্বু, তুমি কিছু বোঝ নি।
মুনিরা হাসান এবারে মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, অনেক হয়েছে। এখন দুজনেই কথা বন্ধ করে খাও।
পরদিন অফিস থেকে এসে আবিদ হাসান টুইটির বুদ্ধিমত্তা পরিমাপ করতে বসলেন। নীলাকে ডেকে বললেন, নিয়ে আয় দেখি টুইটিকে।
নীলা গলা উঁচিয়ে ডাক দিল, টু–ই–টি।
সাথে সাথেই বাসার পিছন থেকে টুইটি ছুটে এসে নীলাকে ঘিরে লাফাতে শুরু করল। আবিদ হাসান একটু অবাক হয়ে দেখলেন টুইটি এর মাঝে বেশ বড় হয়েছে, তার মাঝে কুকুর ছানা কুকুর ছানা ভাব আর নেই। নীলা আঙুল উঁচিয়ে বলল, আম্মু তোকে এখন পরীক্ষা করে দেখবে। বুঝেছিস?
আবিদ হাসান সকৌতুকে দেখলেন মানুষ যেভাবে সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ে, টুইটি। ঠিক সেভাবে মাথা নাড়ল–যেন সে সত্যি সত্যি নীলার কথা বুঝতে পেরেছে। নীলা বলল, আমি যখন বলব এক তখন তুই একবার পা উপরে তুলবি, এইভাবে– বলে নীলা তার। নিজের পা উপরে তুলল, বুঝেছিস?
টুইটি তার পা একবার উপরে তুলল, তারপর হ্যা–সূচকভাবে মাথা নাড়ল। নীলা এবার জোরে জোর বলল, এক।
টুইটি তখন তার পাটি একবার উপরে তুলে আবার নামিয়ে আনে। নীলা বলল দুই তখন টুইটি তার পাটি একবার উপরে তুলে নিচে নামিয়ে আনে তারপর আবার দ্বিতীয়বার উপরে তুলে নিচে নামিয়ে আনে। নীলা এবারে বলল, তিন টুইটি সত্যি সত্যি তিনবার তার পা উপরে তুলে নিচে নামিয়ে আনে। নীলা এইভাবে গুনে যেতে থাকে এবং প্রত্যেকবারই টুইটি সঠিক সংখ্যকভাবে তার পা উপরে তুলে এবং নিচে নামিয়ে আনে। আট পর্যন্ত গিয়ে অবশ্য গুলিয়ে ফেলল এবং প্রথমবার ভুল করে ফেলল। নীলা হাল ছেড়ে না দিয়ে আবার প্রথম থেকে শুরু করতে যাচ্ছিল, আবিদ হাসান তাকে থামালেন, বললেন, আর করতে হবে না। আমি দেখেছি।
কী দেখেছ?
দেখেছি যে তুই কিছু একটা বললে সে কিছু একটা করতে পারে। এটা হচ্ছে এক ধরনের ট্রেনিং টুইটি এটা না বুঝে করছে।
নীলা বলল, কী বলছ তুমি আব্বু? টুইটি না বুঝে কিছু করে না। তুমি দেখতে চাও?
দেখা।
নীলা এবারে টুইটির দিকে তাকিয়ে বলল, টুইটি তুই কাঠি চিনিস? কাঠি?
আবিদ হাসান অবাক হয়ে দেখলেন টুইটি না–সূচকভাবে মাথা নাড়ল। নীলা তখন খুঁজে একটা কাঠি বের করে হাতে নিয়ে বলল, এই যে এইটা হচ্ছে কাঠি। বুঝেছিস?
টুইটি হ্যাঁ–সূচকভাবে মাথা নাড়ল। নীলা বলল, যা, এইবারে খুঁজে খুঁজে পাঁচটা কাঠি নিয়ে আয়।
টুইটি সাথে সাথে লেজ নেড়ে বাগানের দিকে ছুটে গেল এবং খুঁজে বের করে একটা কাঠি নিয়ে ছুটে এসে নীলার পায়ের কাছে রেখে দিয়ে আবার বাগানের দিকে ছুটে গেল। এইভাবে সত্যি সত্যি সে পাঁচটা কাঠি খুঁজে খুঁজে নীলার পায়ের কাছে এনে হাজির করল। নীলা এবারে যুদ্ধ জয়ের ভঙ্গি করে বলল, দেখেছ, আপু?
আবিদ হাসান এবারে সত্যি অবাক হলেন। কুকুর কত পর্যন্ত গুনতে পারে তিনি জানেন, কিন্তু সংখ্যাটি বেশি হবার কথা নয়। নীলাকে নিয়ে তিনি ঘুঁটিয়ে ঘুঁটিয়ে টুইটিকে পরীক্ষা করে সত্যি সত্যি হতবাক হয়ে গেলেন। এটি শুধু যে গুনতে পারে তাই নয়, এটি মানুষের যে কোনো কথা বুঝতে পারে, যে কোনো জিনিস শিখিয়ে দিলে এটি শিখে নিতে পারে। শুধু যে নানা ধরনের জিনিস চিনিয়ে দেওয়া যায় তাই নয়; এটি পুরোপুরি মানবিক কিছু ব্যাপারও বুঝতে পারে, ভালো, খারাপ বা আনন্দ এবং দুঃখ এই ধরনের ব্যাপার নিয়েও তার বেশ স্পষ্ট ধারণা আছে। নীলা যখন টুইটিকে একটা ছোট বাচ্চার নানা ধরনের কর্মকাণ্ড নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে একটা গল্প বলল, আবিদ হাসান অবাক হয়ে দেখলেন টুইটি গল্পটা সত্যি সত্যি একজন মানবশিশুর মতো উপভোগ করল। এটি একটি অবিশ্বাস্য ব্যাপার এবং আবিদ হাসান নিজের চোখে না দেখলে এটি তিনি বিশ্বাস করতেন না।
সেদিন গভীর রাতে আবিদ হাসান ইন্টারনেটে কুকুরের বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য নিজের কম্পিউটারে ডাউনলোড করে নিয়ে এলেন। মনোবিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণায় চোখ বুলিয়ে পশুপাখির বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে নানা ধরনের তথ্য নিয়ে পড়াশোনা করলেন। রাতে ঠিক ঘুমানোর আগে তিনি ডক্টর আসিফ আহমেদ আজহারের পেটেন্টটি একবার দেখার চেষ্টা করে একটি বিচিত্র জিনিস আবিষ্কার করলেন। তাঁর একাধিক পেটেন্ট রয়েছে সত্যি কিন্তু সেগুলো কুকুরের বুদ্ধিমত্তার জিন্সকে আলাদা করার উপরে নয়। তার পেটেন্টগুলো হচ্ছে একটি প্রাণীর দেহে ভিন্ন প্রজাতির একটি প্রাণীর কোষকে অনুপ্রবেশ করিয়ে সেখানে সেটিকে বাঁচিয়ে রাখার উপরে।
সে রাতে আবিদ হাসান অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমাতে পারলেন না। ঠিক কী তাকে পীড়া দিচ্ছিল তিনি বুঝতে পারলেন না কিন্তু টুইটির পুরো ব্যাপারটি নিয়ে তার ভিতরে এক ধরনের অশান্তি কাজ করতে লাগল। তার কেন জানি মনে হতে লাগল এখানে কোনো এক ধরনের অশুভ ষড়যন্ত্র চলছে।
০৪.
সকালে নাশতা খেতে খেতে আবিদ হাসান অন্যমনস্ক হয়ে যেতে লাগলেন। মুনিরা হাসান তার স্বামীকে ভালোই বুঝতে পারেন, খানিকক্ষণ চোখের কোনা দিয়ে তাকে লক্ষ করে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কী হয়েছে? কী নিয়ে এত চিন্তা করছ?
টুইটিকে নিয়ে।
কী চিন্তা করছ?
আবিদ হাসান একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি তো দেখেছ টুইটির কী সাংঘাতিক বুদ্ধি!
হ্যাঁ। দেখেছি।
কিন্তু একটা কুকুরের এই ধরনের বুদ্ধি থাকা সম্ভব না। নিচু শ্রেণীর ম্যামেলের বুদ্ধির বেশিরভাগ হচ্ছে সহজাত বুদ্ধি বা ইন্সটিংক্ট। কিন্তু টুইটির বুদ্ধি অন্যরকম–সে শিখতে পারে এবং সেটা কাজে লাগাতে পারে। এই রকম বুদ্ধি শুধু মানুষেরই থাকতে পারে।
মুনিরা হাসান হাসলেন, বললেন, আমি তোমাকে গ্যারান্টি দিচ্ছি টুইটি মানুষ না।
সেটাই তো সমস্যা। হিসাব মিলাতে পারছি না। পেট ওয়ার্ল্ডের পুরো ব্যাপারটা নিয়েই আমার ভিতরে এক ধরনের অস্বস্তি হচ্ছে। কেমন জানি অশান্তি হচ্ছে, মনে হচ্ছে কিছু একটা বড় রকমের অন্যায় হচ্ছে।
মুনিরা হাসান হেসে বললেন, এই দেশে মানুষজনের জীবনেরই ঠিক নেই, কুকুরকে নিয়ে অন্যায় হলে আর কত বড় অন্যায় হবে? অন্ততপক্ষে এইটুকু তো বলতে পারবে টুইটি মহাসুখে আছে!
তা ঠিক আবিদ হাসান আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন।
কাজে বের হয়ে যাবার সময় আবিদ হাসান টুইটির ঘরের পাশে একবার দাঁড়ালেন, তাকে দেখে টুইটি তার কাছে ছুটে এল, তাকে ঘিরে ছোট ছোট লাফ দিয়ে টুইটি আনন্দ প্রকাশ করার চেষ্টা করতে লাগল। আবিদ হাসান নরম.গলায় বললেন, কী রে টুইটি, তুই ভালো আছিস?
টুইটি মাথা নাড়ল, আবিদ হাসানের স্পষ্ট মনে হল টুইটি তার প্রশ্নটি বুঝতে পেরেছে। তিনি নিজের ভিতরে টুইটির জন্য এক ধরনের স্নেহ অনুভব করলেন। কুকুর ছানাটিকে তিনি নিজের কাছে টেনে আনলেন, তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নরম গলায় কিছু কথা বললেন। ধবধবে সাদা লোমের ভিতর আঙুল প্রবেশ করিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে হঠাৎ মনে হল তিনি কিছু একটা স্পর্শ করেছেন। আবিদ হাসান কৌতূহলী হয়ে টুইটির মাথার লোম সরিয়ে তাকিয়ে দেখলেন, সেখানে একটি অস্ত্রোপচারের চিহ্ন। ছোটখাটো অস্ত্রোপচার নয়, বিশাল একটি অস্ত্রোপচার, মনে হয় পুরো খুলিটিই কেটে আলাদা করা হয়েছিল।
আবিদ হাসান হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠলেন, তার হঠাৎ একটি নতুন জিনিস মনে হয়েছে। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে নয়–অন্য কোনোভাবে টুইটির বুদ্ধিমত্তা বাড়ানো হয়েছে!
.
আবিদ হাসান অফিসে গিয়ে কাজে খুব একটা মন দিতে পারলেন না। সারাক্ষণ তার ভিতরে কিছু একটা খুঁতখুঁত করতে থাকল। দুপুরবেলা তিনি পেট ওয়ার্ল্ডে ফোন করলেন, মিষ্টি গলার একটি মেয়ে তার টেলিফোনের উত্তর দিল। আবিদ হাসান জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি জেরিন?
হ্যাঁ। আপনি কে বলছেন?
আমার নাম আবিদ হাসান।
জেরিন তাকে চিনতে পারল, খুশি হয়ে বলল, আমাদের টেস্ট কেস কেমন আছে আপনার বাসায়?
ভালো আছে।
চমৎকার। আমাদের স্টাফ নিয়মিত যাচ্ছে নিশ্চয়ই।
হ্যাঁ যাচ্ছে। খুব যত্ন করছে, কোনো সমস্যাই নেই।
খুব ভালো লাগল শুনে, তা এখন আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?
আবিদ হাসান একটু ইতস্তত করে বললেন, আপনাদের যে কুকুর ছানাটি আমাদের বাসায় আছে সেটি নিয়ে আমার একটা প্রশ্ন ছিল।
বেশ। আপনাকে আমি সার্ভিস সেন্টারে কানেকশান দিয়ে দিচ্ছি–
না, না। সার্ভিস সেন্টার নয়, আমি আসলে ম্যানেজমেন্টের সাথে কথা বলতে চাই। উঁচু ম্যানেজমেন্ট। খুব জরুরি একটা ব্যাপারে।
জেরিন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ম্যানেজমেন্টের সবাই তো এখন ব্যস্ত, একটা বোর্ড মিটিঙে আছেন।
আমার ব্যাপারটি আসলে বোর্ড মিটিঙের মতোই জরুরি। আবিদ হাসান ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ডক্টর আজহারকে বলেন যে আপনাদের কুকুরের মাথায় অস্ত্রোপচারের একটা ব্যাপার নিয়ে আমি কথা বলতে চাই।
জেরিন বলল, বেশ। আপনি এক মিনিট অপেক্ষা করুন।
আবিদ হাসান টেলিফোনে বিদেশী গান শুনতে শুনতে অপেক্ষা করতে লাগলেন। দীর্ঘ সময় পর টেলিফোনে খুট করে শব্দ হল এবং সাথে সাথে ডক্টর আজহারের গলা শুনতে পেলেন, গুড মর্নিং মিস্টার হাসান।
গুড মর্নিং।
আজহার বলল, আপনি কি একটা জরুরি ব্যাপার নিয়ে আমার সাথে কথা বলতে চান?
হ্যাঁ। আবিদ হাসান একটা নিশ্বাস নিয়ে বললেন, আমি ঠিক কীভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না। আপনার সাথে আমি যখন কথা বলেছি তখন আপনি বলেছিলেন জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে আপনারা কুকুরের বুদ্ধিমত্তা বাড়িয়েছেন।
বলেছিলাম। সেটি নিয়ে কোনো সমস্যা হয়েছে?
ঠিক সমস্যা নয়, কনফিউশান হয়েছে। আপনাদের কুকুর ছানাটির ইন্টেলিজেন্স আমি পরীক্ষা করে দেখেছি। সোজা কথায় এটি অস্বাভাবিক বুদ্ধিমান। আমি পশুপাখির বুদ্ধিমত্তা নিয়ে পড়াশোনা করে দেখেছি, আপনাদের কুকুর ছানার বুদ্ধিমত্তা ম্যামেলের মাঝে থাকা সম্ভব নয়।
টেলিফোনের অন্যপাশে ডক্টর আজহার উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠল, ম্যামেল বলতে যা বোঝায় আমাদের টেস্ট–কেস তা নয়। আপনাকে তো আমরা বলেছি জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে আমরা অত্যন্ত বুদ্ধিমান প্রাণী তৈরি করেছি।
তা হলে কুকুরটার মাথায় অপারেশনের চিহ্ন কেন?
অপারেশন?
হ্যাঁ।
ডক্টর আজহার কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আপনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার লক্ষ করেছেন মি. হাসান। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে যে বুদ্ধিমান প্রজাতি আমরা দাঁড় করিয়েছি তার মস্তিষ্কের সাইজ অনেক বড়। সাধারণ কুকুরের স্কালে সেটা গ্রো করতে পারে না। তাই সার্জারি করে স্কালের সাইজটি বড় করতে হয়।
এটি কি পশু নির্যাতনের মাঝে পড়ে না?
ডক্টর আজহার আবার হো হো করে হেসে বলল, এই দেশে মানুষ নির্যাতনের জন্যই আইন ঠিক করা হয় নি, পশু নির্যাতনের আইন করবে কে?
আবিদ হাসান একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, এই জন্যই কি আপনারা পেট ওয়ার্ল্ড তৈরি করার জন্য আমাদের দেশকে বেছে নিয়েছেন?
না। এই জন্য করি নি। গবেষণার জন্য পশুপাখি ব্যবহার করা নতুন কিছু নয়। আমাদের মডার্ন মেডিসিন পুরোটাই তৈরি হয়েছে পশুপাখির ওপর পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে। মানুষের জন্য লক্ষ লক্ষ প্রাণীকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি নিশ্চয়ই জানেন। আপনি যদি ভেজিটারিয়ান না হয়ে থাকেন তা হলে আপনি নিশ্চয়ই গরু ছাগল হাঁস মুরগিও খান।
আবিদ হাসান একটা নিশ্বাস ফেললেন, কোনো কথা বললেন না। ডক্টর আজহার বলল, আপনার সব কনফিউশান কি দূর হয়েছে হাসান সাহেব?
হ্যাঁ। হয়েছে। শুধু একটা ব্যাপার। ছোট একটা ব্যাপার।
কী ব্যাপার?
আপনি বলেছিলেন জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে বুদ্ধিমান কুকুর তৈরি করা সম্পর্কে আপনার একটা পেটেন্ট আছে।
ডক্টর আজহার এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, হ্যাঁ। কোনো সমস্যা?
হ্যাঁ। ছোট একটা সমস্যা। আমি ইন্টারনেটে আপনার পেটেন্টগুলো পরীক্ষা করে দেখছিলাম। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিঙে আপনার কোনো পেটেন্ট নেই।
ডক্টর আজহার দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, আপনি–আপনি আমার পেটেন্টের খোঁজ নিয়েছেন?
হ্যাঁ। ইন্টারনেটের কারণে ঘরে বসে নেওয়া যায়। ব্যান্ড উইডথ বেশি নয় বলে সময় একটু বেশি লাগে। আপনার পেটেন্ট সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ে। এক প্রজাতির প্রাণীর ভিতরে অন্য প্রজাতির প্রাণীর টিস্যু বসিয়ে দেওয়ার উপরে।
ডক্টর আজহার চুপ করে রইল। আবিদ হাসান বললেন, আপনি আমার কাছে একটা মিথ্যা কথা বলেছেন। কেন বলেছেন জানি না। যে একটা মিথ্যা কথা বলতে পারে সে অসংখ্য মিথ্যা কথা বলতে পারে। কাজেই আমি আপনার কোন কথাটা বিশ্বাস করব বুঝতে পারছি না।
ডক্টর আজহার শীতল গলায় বলল, আপনি আমার কোন কথাটা বিশ্বাস করতে পারছেন না?
আমার ধারণা, আপনারা আসলে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে বুদ্ধিমান কুকুর তৈরি করেন নি। আপনারা খুব সাধারণ একটা কুকুরের মাথায়
কুকুরের মাথায়?
সাধারণ একটা কুকুরের মাথায় মানুষের মস্তিষ্ক লাগিয়ে দিয়েছেন। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিঙে আপনার কোনো দক্ষতা নেই–কিন্তু এ ব্যাপারে আপনার দক্ষতা আছে।
ডক্টর আজহার কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে হঠাৎ উচ্চৈঃস্বরে হাসতে শুরু করল, আবিদ হাসান টেলিফোনটা রেখে দিয়ে চুপ করে বসে রইলেন।
দুপুরবেলা একটা খুব জরুরি মিটিং ছিল কিন্তু আবিদ হাসান দুপুরের আগেই বের হয়ে এলেন। মিটিঙে তাকে না দেখে তার প্রজেক্টের সবাই চেঁচামেচি শুরু করবে কিন্তু তার কিছু করার নেই। পেট ওয়ার্ল্ড সম্পর্কে তার ভিতরে যে সন্দেহটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সে ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হওয়া দরকার। টুইটিকে নিয়ে তার মাথার এক্স–রে করিয়ে নিতে হবে। তাকে মাঝে মাঝেই নানারকম ওষুধ খাওয়ানো হয় সেগুলো ঠিক কী ধরনের ওষুধ সেটাও বিশ্লেষণ করতে হবে। টুইটির মস্তিষ্কের খানিকটা টিস্যু কোনোভাবে বের করা যায় কি না সেটা নিয়েও তার পরিচিত একজন নিউরো সার্জনের সাথে কথা বলতে হবে। পেট ওয়ার্ল্ডকে যদি আইনের আওতায় আনতে হয় তা হলে পুলিশকেও জানাতে হবে। এ দেশের পুলিশ তার কোনো কথা বিশ্বাস করবে কি না সে ব্যাপারে অবশ্য যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
আবিদ হাসান পার্কিং লট থেকে তার গাড়িটা বের করে রাস্তায় ওঠার সময় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মাইক্রোবাস তার পিছু পিছু যেতে শুরু করল, সেটা তিনি দেখতে পেলেন। দেখতে পেলেও সেটি যে তার পিছু নিয়েছে সেটাও বোঝার তার কোনো উপায় ছিল না।
সেগুন বাগানে আবিদ হাসানের বাসার রাস্তাটুকু তুলনামূলকভাবে নির্জন, সেখানে ঢোকার পর হঠাৎ করে আবিদ হাসানের মনে পিছনের মাইক্রোবাসটি নিয়ে একটু সন্দেহ হল, রিয়ার ভিউ মিররে অনেকক্ষণ থেকে সেটাকে তিনি তার পিছনে দেখতে পাচ্ছিলেন। ঢাকার রাস্তায় একই গাড়ি প্রায় আধঘণ্টা সময় ঠিক পিছনে পিছনে আসার সম্ভাবনা খুব কম। পিছনের মাইক্রোবাসটি কাঁদের এবং ঠিক কেন তার পিছু পিছু আসছে সে সম্পর্কে আবিদ হাসানের কোনো ধারণাই ছিল না। এটি সত্যি সত্যি তার পিছু আসছে নাকি ঘটনাক্রমে তার পিছনে রয়েছে সেটা পরীক্ষা করার জন্য আবিদ হাসান একটা সুযোগের অপেক্ষায় রইলেন, খানিকদূর গিয়ে যখন দেখতে পেলেন সামনে কোনো গাড়ি নেই তখন একেবারে হঠাৎ করে তিনি গাড়িটি রাস্তার মাঝখানে ঘুরিয়ে নিয়ে উল্টোদিকে যেতে শুরু করলেন। খানিকদূর গিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখলেন মাইক্রোবাসটিও রাস্তার মাঝে ইউ–টার্ন নেওয়ার চেষ্টা করছে– সেটি যে তার পিছু পিছু আসছে সে ব্যাপারে এবারে তার কোনো সন্দেহ রইল না। আবিদ হাসান ঠিক কী করবেন বুঝতে পারলেন না। দ্রুত গাড়ি চালিয়ে সরে যাওয়ার সম্ভাবনা কম, সামনে বড় রাস্তায় অনেক ভিড়, রিয়ার ভিউ মিররে তাকিয়ে অবস্থাটা আঁচ করার চেষ্টা করছিলেন তার আগেই হঠাৎ করে মাইক্রোবাসটা গুলির মতো ছুটে এসে তাকে ওভারটেক করে রাস্তার মাঝে আড়াআড়িভাবে দাঁড়িয়ে গেল। আবিদ হাসান ব্রেক কষে গাড়ি থামালেন, তিনি অবাক হয়ে দেখলেন মাইক্রোবাস থেকে কালো পোশাক পরা দুজন মানুষ নেমে এসেছে, দুজনের হাতেই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র।
আবিদ হাসানের সমস্ত শরীর আতঙ্কে অবশ হয়ে গেল, তার মাঝে কোনো একটি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে সচল রাখার চেষ্টা করে। কোনো কিছু না বুঝে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার সহজাত এবং আদিম প্রবৃত্তির তাড়নায় তিনি গাড়ি ব্যাক গিয়ারে নিয়ে এক্সেলেটরে সমস্ত শক্তি দিয়ে চাপ দিলেন। টায়ার পোড়া গন্ধ ছুটিয়ে গাড়িটা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে পিছনে ছুটে গেল, কোথাও ধাক্কা লেগে প্রচণ্ড শব্দ করে কিছু একটা ভেঙেচুরে গুঁড়ো করে ফেলল, জিনিসটি কী আবিদ হাসান বুঝতে পারলেন না এবং বোঝার চেষ্টাও করলেন না।
ঠিক এ রকম সময়ে মানুষ দুজন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে তার দিকে লক্ষ্য করে গুলি করতে শুরু করে, আবিদ হাসান মাথা নিচু করে আবার এক্সেলেটরে চাপ দিতেই গাড়িটি জীবন্ত প্রাণীর মতো পিছনে ছিটকে গেল। ঝনঝন শব্দ করে গাড়ির কাঁচ ভেঙে পড়ল এবং তার মাথার উপর দিয়ে শিস দেওয়ার মতো শব্দ করে বুলেট ছুটে গেল। আবিদ হাসান সম্পূর্ণ আন্দাজের ওপর ভর করে গাড়িটা ঘুরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। বৃষ্টির মতো গুলি ছুটে এল, গাড়ির বনেটে প্রবল ধাতব শব্দ শোনা যেতে থাকে এবং সেই অবস্থায় গাড়িটা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ঘুরে যায়, পাগলের মতো স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে কোনোমতে গাড়িটার নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে চেষ্টা করলেন আবিদ হাসান। পুরোপুরি আন্দাজের ওপর নির্ভর করে গাড়িটা রাস্তায় তোলার চেষ্টা করলেন, আবার কোথাও ধাক্কা লেগে গাড়িটা লাফিয়ে কয়েক ফুট উপরে উঠে গেল। প্রচণ্ড শব্দে সেটা নিচে আছড়ে পড়ল এবং আবিদ হাসান তখন একটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনলেন। গাড়িটাকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করতে করতে মাথা তুলে পিছনে তাকিয়ে দেখতে পেলেন কালো পোশাক পরা মানুষ দুজন নিজেদের মাইক্রোবাসের দিকে ছুটে যাচ্ছে, গুলির শব্দ শুনে লোকজন ছোটাছুটি করে পালিয়ে যাচ্ছে। আবিদ হাসান বুক থেকে আটকে থাকা একটা নিশ্বাস বের করে গাড়িতে সোজা হয়ে বসে রাস্তায় নেমে এলেন। গাড়িটা চালাতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন সেটি নড়তে চাইছে না, শব্দ শুনে বোঝা যাচ্ছে পিছনে কোনো একটি চাকার বাতাস বের হয়ে গেছে। সেই অবস্থায় গাড়িটাকে আবিদ। হাসান আরো কিলোমিটার খানেক চালিয়ে নিয়ে রাস্তার পাশে থামালেন। ঘটনাস্থলে লোকজনের মাঝে ছোটাছুটি হইচই হচ্ছিল, এখানে কেউ কিছু জানে না। তার ক্ষতবিক্ষত ভেঙেচুরে যাওয়া গাড়িটাও কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করল না। ইঞ্জিন বন্ধ করে আবিদ হাসান নিজের দিকে তাকালেন, কপালের কাছে কোথাও কেটে গিয়ে রক্ত বের হচ্ছে, ডান হাতের কনুইয়ে প্রচণ্ড ব্যথা, তিনি হাতটা সাবধানে এক–দুইবার নেড়ে দেখলেন, কোথাও ভাঙে নি। পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের রক্তটা মুছে সাবধানে গাড়ি থেকে বের হলেন–তার অনেক সুখের গাড়ি একেবারে ভেঙেচুরে শেষ হয়ে গেছে। অসংখ্য গুলিতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে, এটি একটি বিস্ময়ের ব্যাপার যে তার শরীরে গুলি লাগে নি। দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন বলে গাড়িতে উঠলেই সিটবেল্ট বাধার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল তাই কোনো গুরুতর জখম হয় নি। আবিদ হাসান গাড়ির দরজা বন্ধ করার সময় লক্ষ করলেন তার হাত। অল্প অল্প কাঁপছে। কিন্তু সাথে সাথে তিনি আরেকটা জিনিস আবিষ্কার করলেন হঠাৎ করে তার মস্তিষ্ক আশ্চর্য রকম শীতল হয়ে গেছে তার ভিতরে কোনো উত্তেজনা নেই। কী করতে হবে সে সম্পর্কে তার খুব স্পষ্ট ধারণা আছে। এ
প্রথমেই তিনি দেখলেন তার পকেটে মানিব্যাগ এবং সেই মানিব্যাগে কোনো টাকা আছে কি না। তারপর একটু হেঁটে প্রথমেই যে স্কুটার পেলেন সেটাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন সেটি মতিঝিল যাবে কি না। স্কুটারটি রাজি হওয়া মাত্র তিনি সেটাতে উঠে বসে গেলেন। স্কুটারটি ছুটে চলতেই আবিদ হাসান পিছনে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন কেউ তাকে অনুসরণ করছে কি না, যখন নিঃসন্দেহ হলেন কেউ তার পিছু পিছু আসছে না তখন তিনি স্কুটারটি থামিয়ে নেমে পড়লেন। ভাড়া চুকিয়ে তিনি ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা ফোন–ফ্যাক্সের দোকান খুঁজে বের করলেন। ভিতরে মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ একটা ফোন সামনে নিয়ে উদাস হয়ে বসে ছিল, তাকে দেখে সোজা হয়ে বসল। আবিদ হাসান তার স্ত্রীর টেলিফোন নম্বরটি দিলেন, ডায়াল করে মানুষটি টেলিফোনটি আবিদ হাসানের দিকে এগিয়ে দেয়। অন্যপাশে তার স্ত্রীর গলার আওয়াজ পেয়ে আবিদ হাসান একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, মুনিরা–
হ্যাঁ, আবিদ। কী ব্যাপার?
কী ব্যাপার তুমি এখন জানতে চেয়ো না। আমি তোমাকে যা বলব তাই তোমাকে করতে হবে। বুঝেছ?
আবিদ হাসানের গলার স্বরে এমন একটা কিছু ছিল যে মুনিরা শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। ভয়–পাওয়া গলায় বললেন, কী হয়েছে?
অনেক কিছু। তোমাকে পরে বলব। তোমাকে এই মুহূর্তে নীলাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু তুমি নিজে যেতে পারবে না। বুঝেছ?
বুঝেছি। কিন্তু নিজে যেতে পারব না কেন?
আবিদ হাসান শান্ত গলায় বললেন, তোমাকে পরে বলব। নীলাকে স্কুল থেকে এনে তোমরা দুজন হোটেল সোনারগাঁওয়ে চলে যাবে। সেখানে একটা রুম ভাড়া করবে। রুম ভাড়া করবে জাহানারা বেগমের নামে–
জাহানারা বেগম? জাহানারা বেগম কে?
আমার মা। তুমি জান।
হ্যা সেটা তো জানি, কিন্তু তার নামে কেন?
তা হলে আমার নামটা মনে থাকবে, তোমার সাথে আমি যোগাযোগ করতে পারব। সেজন্যে
মুনিরা হাসান কাঁপা গলায় বললেন, কী হচ্ছে আবিদ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি। আমাকে তুমি ভয় দেখাচ্ছ কেন?
আমি তোমাকে সব বলব। শুধু জেনে রাখ আমি তোমাকে মিছিমিছি ভয় দেখাচ্ছি না। শুনে রাখ, তুমি কিছুতেই নীলাকে নিয়ে বাসায় যাবে না। কিছুতেই যাবে না। মনে থাকবে?
থাকবে।
হোটেল থেকে তোমরা বাইরে কাউকে ফোন করবে না। বুঝেছ?
বুঝেছি।
তোমার কাছে টাকা না থাকলে টাকা ম্যানেজ করে নাও। আর এই মুহূর্তে নীলাকে আনার ব্যবস্থা কর।
মুনিরা হাসান টেলিফোনে হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। ভাঙা গলায় বললেন, তুমি কোথা থেকে কথা বলছ?
আবিদ হাসান একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, সেটা তোমার শুনে কাজ নেই। যখন। সময় হবে জানাব। আমি রাখছি। জেনে রাখ আমি ভালো আছি।
মুনিরা আরো কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলেন কিন্তু আবিদ হাসান তার আগেই টেলিফোনটা রেখে দিলেন, তার হাতে সময় খুব বেশি নেই। টেলিফোনের বিল দিয়ে আবিদ হাসান বের হয়ে এলেন। তাকে যে পেট ওয়ার্ল্ডের লোকেরা মেরে ফেলতে চেয়েছে সে ব্যাপারে তার কোনো সন্দেহ নেই। যার অর্থ টুইটির ব্যাপারে তার ধারণাটি সত্যি। টুইটি সাধারণ কোনো কুকুর নয়, এর মস্তিস্কটি মানুষের মস্তিষ্ক দিয়ে পাল্টে দেওয়া হয়েছে। মানুষের মস্তিষ্কের আকার অনেক বড়, কুকুরের মাথায় সেটি আটানো সম্ভব নয়, কাজেই সম্ভবত পুরোটুকু নেওয়া হয় না। কিংবা কে জানে হয়তো মস্তিষ্কের টিস্যু লাগিয়ে দেওয়া হয়, যেন কুকুরটির মাঝে খানিকটা কুকুর এবং খানিকটা মানুষের বুদ্ধিমত্তা চলে আসে। আবিদ হাসানের হঠাৎ করে পেট ওয়ার্ল্ডের সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা মনে পড়ল। কে জানে হয়তো সেখানে সেবা দেওয়ার নাম করে হতদরিদ্র মহিলাদের সন্তানদের নিয়ে নেওয়া হয়। পুরো ব্যাপারটাই একটি ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের কথা প্রকাশ করার পুরো দায়িত্বটিই এখন আবিদ হাসানের–সেটি প্রকাশ করতে হলে সবচেয়ে প্রথম দরকার টুইটিকে। সবচেয়ে বড় প্রমাণই হচ্ছে টুইটি। কাজেই এখন তার টুইটিকে উদ্ধার করতে হবে। হাতে সময় নেই, টুইটিকে নিয়ে আসার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার বাসায় ফিরে যেতে হবে।
আবিদ হাসান রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে একটা খালি স্কুটারকে থামালেন। স্কুটারে করে তিনি তার বাসার সামনে দিয়ে গিয়ে আবার ঘুরে এলেন। আশপাশে সন্দেহজনক কেউ দাঁড়িয়ে নেই। বাসার পিছনে একটি গেট রয়েছে যেটি কখনোই ব্যবহার হয় না, আবিদ হাসান তার কাছাকাছি এসে স্কুটার থেকে নেমে পড়লেন। স্কুটারটিকে দাঁড়া করিয়ে রেখে তিনি নেমে এলেন, পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খুলে ভিতরে ঢুকে তিনি চাপা গলায় ডাকলেন, টুইটি।
প্রায় সাথে সাথেই টুইটি গাছের আড়াল থেকে তার কাছে ছুটে এসে তাকে ঘিরে আনন্দে লাফাতে শুরু করল। আবিদ হাসান দুই হাতে কুকুরটাকে তুলে নিয়ে নিচু গলায় বললেন, টুইটি সোনা, চল এখান থেকে পালাই, এখন আমাদের খুব বিপদ।
টুইটি কী বুঝল কে জানে কয়েকবার মাথা নেড়ে একটা চাপা শব্দ করল। স্কুটারে উঠে আবিদ হাসান বললেন, রমনা থানায় চল।
স্কুটার চলতে শুরু করতেই আবিদ হাসান চারদিকে তাকাতে লাগলেন, কেউ তার পিছু পিছু আসছে কি না সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া দরকার। চারপাশে অসংখ্য গাড়ি রিকশা। স্কুটার ছুটে চলছে, তার মাঝে সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ল না। আবিদ হাসান একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন, কোনোভাবে থানার মাঝে ঢুকে পড়তে পারলেই নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।
থানার সামনে টুইটিকে নিয়ে নেমে আবিদ হাসান স্কুটারের ভাড়া মিটিয়ে দিলেন। তার হাতে কুকুরটি দেখে কয়েকজন পথচারী কৌতূহল নিয়ে তাকাল, একজন বলল, কী সুন্দর কুকুর!
হ্যাঁ। আবিদ হাসান মাথা নাড়লেন, খুব সুন্দর।
বিদেশী কুকুর নাকি?
হ্যাঁ। এটার নাম আইরিশ টেরিয়ার।
একটু হাত দিয়ে দেখি? কামড় দেবে না তো?
না কামড় দেবে না। খুব শান্ত কুকুর।
মানুষটি টুইটির মাথায় হাত বুলানোর জন্য এগিয়ে এল। ঠিক তখন আবিদ হাসান তার পিঠে একটা শক্ত ধাতব স্পর্শ অনুভব করলেন। শুনতে পেলেন কেউ তার কানের কাছে মুখ রেখে ফিসফিস করে ইংরেজিতে বলছে, আমি একজন পেশাদার খুনি। তুমি একটু নড়লেই খুন হয়ে যাবে।
আবিদ হাসান হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। মানুষটি আরো কাছে এসে বলল, তোমার আর কোনো কিছু করার সুযোগ নেই, আমার কথা বিশ্বাস না করলে চেষ্টা করে দেখতে পার।
আবিদ হাসান চেষ্টা করলেন না। যে মানুষটি টুইটির মাথায় হাত বুলিয়েছে সে কিছু একটা বলছে কিন্তু তিনি এখন কিছু বুঝতে পারছেন না। তার কানের কাছে মুখ রেখে মানুষটি ফিসফিস করে বলল, আমি মনে মনে দশ পর্যন্ত গুনব, তার মাঝে তুমি সামনের। গাড়িটাতে ওঠ। তুমি ইচ্ছা করলে নাও উঠতে পার–সত্যি কথা বলতে কী, আমি চাই তুমি না ওঠ। তা হলে তোমাকে আমি খুন করতে পারি। আমার জন্য সেটা খুব কম ঝামেলার।
আবিদ হাসান নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। শুনতে পেলেন টুইটি একটা চাপা। শব্দ করল। যে মানুষটি কুকুরের মাথায় হাত বুলিয়েছে সে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে। আরো দু–একজন মানুষ সুন্দর কুকুরটি দেখার জন্য ভিড় জমিয়েছে। তার মাঝে পিছনের মানুষটি হাতের অস্ত্রটি দিয়ে আবিদ হাসানকে একটা ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস করে বলল, আমি যেখানে রিভলবারটি ধরেছি সেখানে তোমার হৃৎপিণ্ড। কাজেই কী করবে ঠিক করে নাও।
আবিদ হাসানের হাত কাঁপতে থাকে, মনে হতে থাকে তিনি হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবেন। কিন্তু তিনি পড়ে গেলেন না। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখার ইচ্ছেটাকে অনেক কষ্টে আটকে রেখে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার দেশ কোথায়?
পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি দীর্ঘশ্বাসের মতো একটা শব্দ করে বলল, সামাজিক কথাবার্তা বলার জন্য তুমি সময়টা ভালো বেছে নাও নি। আমি গুনতে শুরু করছি। এক।
আবিদ হাসানের মস্তিষ্ক হঠাৎ করে শীতল হয়ে আসে, পুরো পরিস্থিতিটুকু হঠাৎ করে তার কাছে স্পষ্ট হয়ে এল। পিছনের মানুষটির ইংরেজি উচ্চারণ যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলের। মানুষটি পেশাদার খুনি এবং সম্ভবত তাকে এখনই মেরে ফেলবে। আবিদ হাসান বুঝতে পারলেন এই মানুষটির কথা শোনা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই। তিনি একটা নিশ্বাস ফেললেন এবং পাঁচ পর্যন্ত গোনার আগেই টুইটিকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে গাড়িতে উঠে বসলেন। পিছনের মানুষটি হেঁটে হেঁটে তার পাশে এসে বসল, আবিদ হাসান কৌতূহল নিয়ে মানুষটার দিকে তাকালেন। মানুষটি সুদর্শন, বাঙালির মতো হলেও বাঙালি নয়, মানুষটি সম্ভবত মেক্সিকান।
ড্রাইভার গাড়িটা ছেড়ে দিল। পাশে বসে থাকা মেক্সিকান মানুষটি একটি বড় রিভলবার তার কোলের উপর রেখে হাত বাড়িয়ে টুইটির মাথায় হাত বুলিয়ে ইংরেজিতে বলল, এই কুকুরের জন্য আমাকে মানুষ মারতে হবে–এই কথাটা কে বিশ্বাস করবে বল?
আবিদ হাসান মনে মনে বললেন, কেউ না।
০৫.
ডক্টর আজহার নরম গলায় বলল, আমি খুবই দুঃখিত মিস্টার আবিদ হাসান আপনাকে এভাবে কষ্ট দেওয়ার জন্য।
আবিদ হাসান স্থির চোখে ডক্টর আজহারের দিকে তাকালেন, লোকটির গলার স্বরে এক ধরনের আন্তরিকতা রয়েছে, অন্য যে কোনো সময় হলে তিনি হয়তো লোকটার কথা বিশ্বাস করতেন, কিন্তু এখন বিশ্বাস করার কোনো উপায় নেই। দুপুরবেলা দুজন মানুষ তাকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে খুন করার চেষ্টা করেছে, রমনা থানার সামনে থেকে একজন মেক্সিকান পেশাদার খুনি তাকে ধরে এনেছে। এই মুহূর্তে একটা লোহার প্ল্যাটফর্মের দুইপাশে তার দুই হাত রেখে হাতকড়া পরিয়ে দিয়েছে। আবিদ হাসান মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন, দুই হাত আটকে থাকায় নড়াচড়া করতে পারছেন না। ভয় বা আতঙ্ক নয়, আবিদ হাসান নিজের ভিতরে এক ধরনের তীব্র অপমানবোধ অনুভব করছেন।
ডক্টর আজহার টেবিলের পাশে একটা গদিআঁটা চেয়ারে বসে পা দুলিয়ে বলল, আমার হিসাবে একটা ভুল হয়ে গেছে। আপনাকে আমি আন্ডার এস্টিমেট করেছি। আপনার বুদ্ধিমত্তা সাধারণ মানুষ থেকে অনেক বেশি। এখন আপনাকে বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই, পেট ওয়ার্ল্ড সম্পর্কে আপনার প্রত্যেকটা ধারণা সত্যি।
ডক্টর আজহার মাথা ঘুরিয়ে টুইটির দিকে তাকাল, ঘরের এক কোনায় সেটি শান্ত হয়ে বসে আছে। তার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, আপনি ঠিকই অনুমান করছেন, এই যে কুকুরটা দেখছেন এটি আসলে একটি মানুষ। কুকুরের শরীরে আটকে পড়ে থাকা মানুষ।
আবিদ হাসান ভেবেছিলেন কোনো কথা বলবেন না কিন্তু শেষ পর্যন্ত কৌতূহলের কাছে হার মানলেন, মাথা তুলে জিজ্ঞেস করলেন, একটা কুকুরের মস্তিষ্কের সাইজ টেনিস বলের মতো। মানুষের মস্তিষ্ক তো অনেক বড়।
হ্যাঁ। ডক্টর আজহার মাথা নাড়ল। বলল, সে জন্য আমরা মস্তিষ্ক ট্রান্সপ্লান্ট করি ফিটাস থেকে, ভ্রূণ থেকে।
আবিদ হাসান শিউরে উঠলেন। কোনোমতে একটা নিশ্বাস বুক থেকে বের করে দিয়ে বললেন, আপনাদের সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো ভাঁওতাবাজি।
বলতে পারেন। আমরা অবশ্য ছোটখাটো মেডিক্যাল হেল্প দিই। যখন একটা বাচ্চার ভ্রূণ দরকার হয় কোনো একটা প্রেগন্যান্ট মহিলা থেকে নিয়ে নিই। তারা অবশ্য জানে না, তাদেরকে বলা হয় কোনো কারণে মিসক্যারেজ হয়েছে। আমাদের ডাক্তারেরা মাদের উল্টো বকাবকি করে অনিয়ম করার জন্য। ডক্টর আজহার কথা শেষ করে হা হা করে হাসতে শুরু করল।
আবিদ হাসান স্থির চোখে ডক্টর আজহারের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার ভিতরে এ নিয়ে কখনো কোনো অপরাধবোধ জন্মায় না?
অপরাধবোধ? ডক্টর আজহার আবার শব্দ করে হেসে উঠল, নাগাসাকি আর। হিরোশিমাতে যারা নিউক্লিয়ার বোমা ফেলেছিল তাদের কি অপরাধবোধ হয়েছিল? আলেকজান্ডার দি গ্রেটের কি অপরাধবোধ হয়েছিল? হয় নি। হওয়ার কথা নয়। একটা বড় কিছু করার জন্য অনেক ছোট ত্যাগ করতে হয়। এই দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য আমাদের দেশের কিছু মানুষের এই ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। একদিন যখন আমাদের এই প্রজেক্ট দেশের অর্থনীতির ভিত তৈরি করে দেবে।
আবিদ হাসান বাধা দিয়ে বললেন, যথেষ্ট হয়েছে। আমি আর শুনতে চাই না।
ডক্টর আজহার প্রথমবার একটু রেগে উঠল, বলল, কেন শুনতে চান না?
কারণ উন্মাদের প্রলাপ অন্য উন্মাদেরা শুনুক। আমার শোনার প্রয়োজন নেই।
ডক্টর আজহার খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে আবিদ হাসানের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর মাথা এগিয়ে এনে কঠিন গলায় বলল, আমাদের এই প্রজেক্টে কত ডলার ইনভেস্ট করা হয়েছে আপনি জানেন?
না। আমার জানার প্রয়োজন নেই। ইচ্ছে নেই।
তবু আপনাকে শুনতে হবে। সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার। আপনি জানেন বিলিয়ন ডলার মানে কত? এক হাজার মিলিয়ন হচ্ছে এক বিলিয়ন। আর মিলিয়ন কত জানেন? এক হাজার–_
আমার জানার প্রয়োজন নেই।
আছে। কেন আছে জানেন?
কেন?
কারণ সারা পৃথিবীর মাঝে শুধু আপনাকে আমি এই তথ্য দিতে পারি। একটি প্রাণীর দেহে অন্য প্রাণীর টিস্যুকে বাঁচিয়ে রাখার টেকনিক আমরা দাঁড়া করিয়েছি। এন্টি রিজেকশান ড্রাগের পেটেন্ট আমাদের। এখানে ব্রেন–ট্রান্সপ্লান্টের অপারেশন করে রোবট সার্জন। সেই রোবট সার্জন দাঁড়া করতে আমাদের কত খরচ হয়েছে জানেন? সেই সফটওয়্যার দাঁড়া করতে আমাদের কত দিন লেগেছে জানেন?
আবিদ হাসান মাথা নেড়ে বললেন, আমি জানতে চাই না।
ডক্টর আজহার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, জানতে হবে। কারণ শুধু আপনিই এটা জানতে পারবেন। শুধু আপনাকেই আমি বলতে পারব।
আবিদ হাসান প্রথমবার এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করলেন, কেন শুধুমাত্র তাকে বলতে পারবে সেটি অনুমান করা খুব কঠিন নয়। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে মেরে ফেলা হবে বলে?
না। আমি অপচয় বিশ্বাস করি না। শুধু শুধু আপনাকে মেরে কী হবে?
তা হলে?
আপনাকে আমরা ব্যবহার করব।
ব্যবহার?
হ্যাঁ। আমাদের কাছে বিশাল একটা কুকুর এসেছে। গ্রেট ডেন। চমৎকার কুকুর, তার মস্তিষ্ক ট্রান্সপ্লান্ট করব আপনার মস্তিষ্ক দিয়ে। আপনার বিশাল মস্তিষ্কের পুরোটা নিতে পারব না– যেটুকু পারি সেটুকু নেব। ডক্টর আজহার মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আইডিয়াটি কেমন?
আবিদ হাসান অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ডক্টর আজহারের দিকে তাকিয়ে রইল, ডক্টর আজহার মাথা নেড়ে বলল, আপনার এত চমৎকার একটি মস্তিষ্ক সেটা অপচয় করা কি ঠিক হবে? কী বলেন?
আবিদ হাসান দাতে দাঁত ঘষে বললেন, তুমি জাহান্নামে যাও–দানব কোথাকার।
ডক্টর আজহার জিভ দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বলল, রাগ হচ্ছেন কেন মিস্টার আবিদ হাসান? আমি পরীক্ষা করে দেখতে চাই, আপনার স্মৃতির কতটুকু অবশিষ্ট থাকে।
আবিদ হাসান চিৎকার করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন টুইটি একটা চাপা শব্দ করল, সামনের দুই পায়ের মাঝে মাথা চেপে রেখে থরথর করতে লাগল। দেখে মনে হল সারা শরীরে এক ধরনের খিচুনি শুরু হয়েছে। ডক্টর আজহার টুইটির কাছে এগিয়ে গেল, চোখের পাতা টেনে কিছু একটা দেখে মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল, খানিকটা হতাশ ভঙ্গিতে বলল, এখনো হল না। কুকুরটা তার মস্তিষ্ককে রিজেক্ট করতে শুরু করেছে। আমাদের এন্টি–রিজেকশান ড্রাগকে আরো নিখুঁত করতে হবে।
ডক্টর আজহার পা দিয়ে টুইটিকে উল্টে দিয়ে লম্বা পা ফেলে টেবিলটার কাছে এগিয়ে এল। পকেট থেকে কাগজপত্র এবং চাবি টেবিলের ওপর রেখে অনেকটা আপন মনে বলল, আপনি মন খারাপ করবেন না মিস্টার আবিদ হাসান। ঘুমের একটা ইনজেকশন দিয়ে দেব, আপনি কিছু বুঝতেও পারবেন না। আপনার ঘুমন্ত দেহ ট্রেতে তুলে দেব, ব্যস আমাদের আর কোনো দায়িত্ব নেই।
আবিদ হাসান কোনো কথা বললেন না, হিংস্র চোখে ডক্টর আজহারের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ডক্টর আজহার ঘর থেকে বের হতে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, একটা জিনিস লক্ষ্য করেছেন? আপনার সাথে কিন্তু আমার বেশ মিল রয়েছে। আমার প্রায় সমবয়সী, দেখতেও অনেকটা একরকম। আমাদের বুদ্ধিমত্তাও মনে হয় কাছাকাছি। কিন্তু আপনার ক্ষমতা আমার ধারে কাছে নয়। আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না টাকা দিয়ে কত কী করা যায়।
ডক্টর আজহার তার গলায় ঝোলানো কার্ড দিয়ে দরজা খুলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
আবিদ হাসান বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন–তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না কিছুক্ষণের মাঝেই তার মস্তিষ্ককে একটা বিশাল গ্রেট ডেনের মাথায় বসিয়ে দেওয়া হবে। এটি কি সত্যিই ঘটছে নাকি এটা একটা দুঃস্বপ্ন? ভয়ঙ্কর একটা দুঃস্বপ্ন?
আবিদ হাসান তার হাতের দিকে তাকালেন, দুই হাতে হাতকড়া দিয়ে প্লাটফর্মের সাথে আটকে রাখা, কংক্রিটের দেয়াল, উপরে এয়ার কুলারের ভেন্ট, স্টিলের দরজা উপরে ইলেকট্রনিক নিরাপত্তাসূচক নম্বর, একটু দূরে টুইটির কুঁকড়ে থাকা শরীর সবকিছু একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মতো, কিন্তু সেটি দুঃস্বপ্ন নয়। আবিদ হাসান প্রাণপণ চেষ্টা করলেন নিজেকে শান্ত রাখার কিন্তু এবারে অনেক কষ্ট করেও নিজেকে শান্ত করতে পারলেন না। শুধু তার মনে হতে লাগল ভয়ঙ্কর একটা চিৎকার করে ধাতব প্লাটফর্মটিতে মাথা কুটতে শুরু করবেন।
কুকুরের একটি চাপা শব্দ শুনে আবিদ হাসান মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন। টুইটি আবার উঠে বসেছে, দুই পায়ের মাঝখানে মাথা রেখে ভীত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আবিদ হাসান হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠলেন, টুইটি কি তাকে সাহায্য করতে পারবে না?
আবিদ হাসান সোজা হয়ে বসে টুইটিকে ডাকলেন, টুইটি।
টুইটি মাথা তুলে আবিদ হাসানের দিকে তাকাল। আবিদ হাসান চাপা গলায় বললেন, তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ?
টুইটি কষ্ট করে তার মাথা নাড়ল, সে বুঝতে পারছে। আবিদ হাসান উত্তেজিত গলায় বললেন, তা হলে তুমি আমাকে সাহায্য কর। ঠিক আছে?
টুইটি ক্লান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নেড়ে আবিদ হাসানের দিকে তাকাল।
ভেরি গুড টুইটি। চমৎকার। তুমি টেবিলের উপর ওঠ। সেখান থেকে মুখে করে চাবিটা নিয়ে আসবে আমার কাছে। বুঝেছ?
টুইটি না–সূচকভাবে মাথা নাড়ল, সে ঠিক বুঝতে পারছে না। আবিদ হাসান একটু অধৈর্য হয়ে বললেন, না বুঝলেও ক্ষতি নেই, আমি তোমাকে সাহায্য করব। যাও তুমি টেবিলের উপর ওঠ।
টুইটি নিজেকে টেনে টেনে নিতে থাকে, প্রথমে চেয়ার তারপর সেখান থেকে কষ্ট করে টেবিলের উপর উঠল। আবিদ হাসান উত্তেজনা চেপে রেখে বললেন, এখন ডান দিকে যাও।
টুইটি অনিশ্চিতের মতো দাঁড়িয়ে রইল তারপর ডানদিকে এগিয়ে গেল। আবিদ হাসান বললেন, ঐ যে চকচকে জিনিসটা সেটা চাবি। মুখে তুলে নাও।
টুইটি একটা কলম মুখে তুলে নিল। আবিদ হাসান মাথা নেড়ে বললেন, না। না। এটা চাবি না, এটা কলম। চাবিটা আরো সামনে।
টুইটি কলমটা রেখে প্রথমে একটা পেন্সিল, তারপর একটা নোট বই এবং সবশেষে চাবিটা তুলে নিল। আবিদ হাসান চাপা আনন্দের স্বরে বললেন, ভেরি গুড টুইটি! ভেরি ভেরি গুড! এভাবে চাবিটা নিয়ে এস আমার কাছে।
টুইটি চাবিটা মুখে নিয়ে টেবিল থেকে নেমে আবিদ হাসানের কাছে এগিয়ে এল। আবিদ হাসান চাবিটা হাতে নিয়ে হাতকড়াটা খোলার চেষ্টা করলেন। কোথায় চাবি দিয়ে খুলতে হয় বুঝতে একটু সময় লাগল, একবার বুঝে নেবার পর খুট করে হাতকড়াটা খুলে যায়। উত্তেজনায় আবিদ হাসানের বুক ঠক ঠক করতে থাকে, সত্যি সত্যি তিনি এখান থেকে বেঁচে যেতে পারবেন কি না তিনি এখনো জানেন না, কিন্তু একবার যে শেষ চেষ্টা করে দেখবেন সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আবিদ হাসান টুইটিকে বুকে চেপে ধরে একবার আদর করলেন, তারপর যেখানে শুয়ে ছিল সেখানে শুইয়ে রেখে বললেন, তুমি এখান থেকে নড়বে না। ঠিক আছে?
টুইটি মাথা নেড়ে আবার দুই পায়ের মাঝখানে মাথাটা রেখে চোখ বন্ধ করল। কুকুরটি মনে হয় আর বেশিক্ষণ বেঁচে থাকবে না।
আবিদ হাসান এবারে ঘরটা ঘুরে দেখলেন, একটা লোহার রড বা শক্ত কিছু খুঁজছিলেন, টেবিলের নিচে সেরকম একটা কিছু পেয়ে গেলেন। এটা দিয়ে জোরে মাথায় আঘাত করতে পারলে একজন মানুষকে ধরাশায়ী করা খুব কঠিন হবে না। আবিদ হাসান রডটা নিয়ে তার আগের জায়গায় ফিরে এলেন। হাতকড়াটা হাতের ওপর আলতো করে রেখে প্লাটফর্মের কাছে বসে রইলেন। ডক্টর আজহার ফিরে এলে একবারও সন্দেহ করতে পারবে না যে তিনি আসলে এখন নিজেকে মুক্ত করে রেখেছেন।
ডক্টর আজহার ফিরে এল বেশ অনেকক্ষণ পর। তার গলায় ঝুলানো কার্ডটি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে বেশ সহৃদয় ভঙ্গিতে বলল, মিস্টার আবিদ হাসান, একটু দেরি হয়ে গেল। কেন জানেন?
আবিদ হাসান কোনো কথা বললেন না, ডক্টর আজহার সেটা নিয়ে কিছু মনে করল না, হাসি মুখে বলল, এই পেট ওয়ার্ল্ডে সব মিলিয়ে আমরা চার–পাঁচজন মানুষ প্রকৃত ব্যাপারটি জানি। অন্যেরা সবাই জানে এটি হান্ড্রেড পার্সেন্ট খাঁটি বিজনেস! কাজেই যখনি বেআইনি কিছু করতে হয় পুরো দায়িত্বটি এসে পড়ে আমাদের ওপর! আমি ছাড়া অন্য সবাই আসলে সিকিউরিটির মানুষ নতুবা যন্ত্র! কাজেই সবকিছুই আমাকে করতে হয়। বুঝেছেন?
ডক্টর আজহার টেবিলে একটা কাঁচের এম্পুল রেখে সেখানে একটা সিরিঞ্জ দিয়ে ওষুধ টেনে নিতে নিতে বলল, আপনাকে একটা ঘুমের ওষুধ দিয়ে অজ্ঞান করে নিতে হবে, তারপর ঐ কনভেয়ার বেল্টে আপনাকে উপুড় করে শুইয়ে দিতে হবে। ব্যস, তারপর আমার দায়িত্ব শেষ। কাল সকালে আপনি যখন ঘুম থেকে উঠবেন আপনি আবিষ্কার করবেন যে আপনি একটা বিশাল কুকুরের দেহে আটকা পড়ে আছেন। ডক্টর আজহার আনন্দে হা হা করে হেসে উঠল।
ডক্টর আজহার সিরিঞ্জটা নিয়ে খুব সহজ ভঙ্গিতে আবিদ হাসানের দিকে এগিয়ে এল। মানুষটি কোনো কিছু সন্দেহ করে নি। আবিদ হাসানের বুকের ভিতর ধকধক্ করে শব্দ করতে থাকে–তিনি একটি মাত্র সুযোগ পাবেন,সেই সুযোগটি কি তিনি ব্যবহার করতে পারবেন? জীবনে কখনো কোনো মানুষকে আঘাত করেন নি, কীভাবে কোথায় কখন আঘাত করতে হয় সে সম্পর্কেও কোনো ধারণা নই। কোথায় জানি দেখেছিলেন মাথার পিছনে আঘাত করলে মানুষ অচেতন হয়ে পড়ে। তিনি কি পারবেন সেখানে আঘাত করতে? আবিদ হাসান নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকেন।
ডক্টর আজহার আরেকটু কাছে এগিয়ে এল, সিরিঞ্জটা উপরে তুলে সুচের দিকে তাকিয়েছে, এক মুহূর্তের জন্য তার ওপর থেকে চোখ সরিয়েছে, সাথে সাথে আবিদ হাসান হাত মুক্ত করে লোহার রডটা তুলে নিলেন। ডক্টর আজহার হতচকিত হয়ে আবিদ হাসানের দিকে তাকাল এবং কিছু বোঝার আগেই আবিদ হাসান তার সমস্ত শক্তি দিয়ে ডক্টর আজহারের মাথায় আঘাত করলেন। আত্মরক্ষার জন্য ডক্টর আজহার মাথাটা সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু কোনো লাভ হল না, প্রচণ্ড আঘাতে আর্তচিৎকার করে সে নিচে পড়ে গেল।
আবিদ হাসান দুই হাতে রডটি ধরে আরো কাছে এগিয়ে গেলেন, ডক্টর আজহার ওঠার চেষ্টা করলে আবার আঘাত করবেন, কিন্তু মানুষটার ওঠার ক্ষমতা আছে বলে মনে হল না। হাত থেকে সিরিঞ্জটা ছিটকে পড়েছে, আবিদ হাসান সেটি তুলে নিয়ে আসেন। মানুষকে তিনি কখনো ইনজেকশান দেন নি কিন্তু সেটি নিয়ে এখন ভাবনা–চিন্তা করার সময় নেই। সিরিঞ্জের সুচটা আজহারের হাতে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে ওষুধটা তার শরীরে ঢুকিয়ে দিলেন, দেখতে দেখতে ডক্টর আজহার নেতিয়ে পড়ল।
আবিদ হাসান বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দিলেন, পরিকল্পনার প্রথম অংশটুকু চমৎকারভাবে কাজ করেছে। এখন দ্বিতীয় অংশটুকু–এখান থেকে বের হয়ে যাওয়া। আবিদ হাসান ডক্টর আজহারের গলায় ঝোলানো ব্যাজটা খুলে নিলেন–এটা ব্যবহার করে এই ঘর থেকে বের হওয়া যাবে।
ব্যাজে এক ধরনের ম্যাগনেটিক কোডিং রয়েছে সেটার সাহায্যে নিশ্চয়ই সব দরজা খুলে এই বিল্ডিং থেকে বের হওয়া যাবে কিন্তু তবু তিনি কোনো ঝুঁকি নিলেন না। ডক্টর আজহারের জ্যাকেটটা খুলে নিজে পরে নিলেন। দুজনের শরীরের কাঠামো মোটামুটি একরকম, হঠাৎ দেখলে বুঝতে পারবে না। সময় নষ্ট করে লাভ নেই, যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে বের হওয়া যায়।
টুইটির কাছে গিয়ে আবিষ্কার করলেন সেটি নিথর হয়ে পড়ে আছে, বেঁচে আছে কি নেই বোঝার উপায় নেই। একটা নিশ্বাস ফেলে মাথায় হাত বুলিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, টুইটিকে বাচানোর ক্ষমতা তার নেই। সবচেয়ে বড় কথা টুইটির জন্যে বেঁচে না থাকাই সম্ভবত বেশি মানবিক। আবিদ হাসান টেবিলের পাশে একটা এটাচি কেস আবিষ্কার করলেন। সম্ভবত ডক্টর আজহারের। ভিতরে নানা ধরনের কাগজপত্র, আবিদ হাসান এটাচি কেসটি হাতে তুলে নিলেন–এখানকার কিছু প্রমাণ বাইরে নিয়ে যাওয়া দরকার।
দরজায় ব্যাজটি প্রবেশ করাতেই সেটি শব্দ করে খুলে গেল। বাইরে বড় করিডোর, উপরে পর্যবেক্ষণ ক্যামেরা পরীক্ষা করছে, আবিদ হাসান সহজ ভঙ্গি করে হেঁটে যেতে শুরু করলেন। করিডোরের শেষ মাথায় আরেকটি দরজা। সেখানে ব্যাজটি প্রবেশ করাতেই একটা কর্কশ শব্দ শোনা গেল এবং সাথে সাথে তিনি একজন মানুষের গলায় স্বর শুনতে পেলেন, মানুষটি ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, ডক্টর ট্রিপল-এ তুমি চলে যাচ্ছ কেন?
আবিদ হাসানের হৃৎপিণ্ড প্রায় থমকে দাঁড়াল, অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করলেন। ডক্টর আজহারের ব্যাজ ব্যবহার করে বের হয়ে যাচ্ছেন বলে তাকে ডক্টর আজহার ভাবছে। সম্ভবত এই মুহূর্তে তাকে দেখতেও পাচ্ছে। আবিদ হাসান যথাসম্ভব মাথা নিচু করে বললেন, শরীর ভালো লাগছে না।
যে লোকটাকে ধরে এনেছি তার কী অবস্থা?
ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি।
গুড। ট্রান্সপ্লান্টের জন্য রেডি?
আবিদ হাসান কী বলবেন বুঝতে পারলেন না, অস্পষ্ট এক ধরনের শব্দ করলেন, হুস।
কনভেয়ার বেল্টে তুলেছ?
না।
ঠিক আছে দুশ্চিন্তা কোরো না, আমরা তুলে নেব।
থ্যাংকস।
আবিদ হাসান চলে যাচ্ছিলেন তখন আবার সিকিউরিটির মানুষটির গলায় স্বর শুনতে পারলেন, ডক্টর ট্রিপল-এ—
হুঁ।
তোমার গলার স্বর একেবারে অন্যরকম শোনাচ্ছে। আবিদ হাসান ভিতরে ভিতরে চমকে উঠলেও কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রাখলেন, বললেন, তাই নাকি?
হ্যাঁ। কী ব্যাপার?
জানি না। হয়তো ফ্লু। দুপুর থেকেই গলাটা খুশখুশ করছে।
ও। যাও গিয়ে বিশ্রাম নাও।
আবিদ হাসান বুকের ভিতর থেকে একটা নিশ্বাস বের করে সাবধানে হেঁটে যেতে ক্ষ করলেন। সামনে আরো একটা দরজা, ব্যাজ ব্যবহার করে সেটা খুলে বের হয়ে এলেন। দরজার ওপরে ইংরেজিতে বড় বড় করে লেখা, কঠোর নিরাপত্তা অঞ্চল। শুধুমাত্র অনুমোদিত মানুষের জন্য।
সামনে একটা লিফট, লিফটের বোতাম স্পর্শ করতেই নিঃশব্দে দরজা খুলে গেল। আবিদ। হাসান ভিতরে ঢুকলেন। পেট ওয়ার্ল্ডের গোপন এলাকা থেকে তিনি বাইরে চলে এসেছেন। এখানকার মানুষজন সাধারণ মানুষ, এই ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের কিছু জানে না। আবিদ হাসান ডক্টর আজহারের ব্যাজটি পকেটে ঢুকিয়ে নিলেন, সম্ভবত এই ব্যাজটির আর প্রয়োজন নেই।
নিচে দরজার কাছে বড় টেবিলে জেরিনকে বসে থাকতে দেখা গেল। আবিদ হাসানকে দেখে অবাক হয়ে বলল, আপনি?
হ্যাঁ।
কখন এলেন?
এসেছি দুপুরবেলা। ডক্টর আজহার নিয়ে এসেছেন।
ও। সবকিছু ঠিক আছে তো?
আবিদ হাসান জেরিন নামের মেয়েটির চোখের দিকে তাকালেন, সেখানে কোনো ধরনের জটিলতা নেই, সপ্রশ্ন চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আবিদ হাসান তাকে বিশ্বাস করবেন বলে ঠিক করলেন। বললেন, না, সবকিছু ঠিক নেই।
মেয়েটি চমকে উঠে বলল, কী হয়েছে?
আপনি যদি আমার সাথে আসেন আপনাকে বলতে পারি।
জেরিন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু এখন আমার ডিউটি
আবিদ হাসান বাধা দিয়ে বললেন, আপনাকে আমি বলতে পারি আমি আপনাকে যে কথাটি বলব সেটি হবে আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় ডিউটি।
জেরিন আবিদ হাসানের দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত কী যেন ভাবল, তারপর বলল, ঠিক আছে চলুন।
দুই মিনিট পর জেরিনের গাড়িতে বসে আবিদ হাসান বের হয়ে এলেন, গাড়িটি রমনা থানার দিকে যেতে থাকে।
০৬.
ডক্টর আজহারের এটাচি কেসে যে কাগজপত্র ছিল সেটি থেকে শেষ পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র দপ্তরকে পেট ওয়ার্ল্ডের ষড়যন্ত্রের কথা বোঝানো সম্ভব হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিতে আরো কয়েক মাস সময় লেগেছে। পুরো ব্যাপারটিতে অস্বাভাবিক গোপনীয়তা রাখা হয়েছে, খবরের কাগজে কিছু ছাপা হয় নি। তার সঠিক কারণটি আবিদ হাসানের জানা নেই, তাকে সরকারের একেবারে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অনুরোধ করা হয়েছিল, তিনি সেই অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন।
ঠিক কী কারণে টুইটি হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেল এবং কেন তাকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না সেই ব্যাপারটি নীলা অবশ্য কিছুতেই বুঝতে পারল না। বড় মানুষেরা মাঝে মাঝে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং অর্থহীন কাজ করে বসে থাকে; এটাও সেরকম কিছু একটা কাজ এভাবেই সে ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করল। মাঝে মাঝেই তার টুইটির জন্য খুব মন খারাপ হয়ে যেত।
আবিদ হাসান ব্যাপারটি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। বছর দুয়েক পর হঠাৎ করে আবার সেটি মনে পড়ল পত্রিকায় সার্কাসের বিজ্ঞাপন দেখে। সার্কাসের পশুপাখির নানা ধরনের খেলাধুলার মাঝে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ বুদ্ধিমান কুকুরের কলাকৌশল। একটি গ্রেট ডেন কুকুর নাকি মানুষের মতো সংখ্যা যোগ–বিয়োগ করতে পারে।
আবিদ হাসান তার মেয়েকে নিয়ে সার্কাস দেখতে গিয়েছিলেন। সত্যি সত্যি বিশাল একটি গ্রেট ডেন কুকুর সংখ্যা যোগ–বিয়োগ করে দেখাল, ইংরেজি নির্দেশ পড়ে সেই নির্দেশ মোতাবেক কিছু কাজকর্ম করল। সার্কাস শেষ হলে আবিদ হাসান কুকুরটিকে দেখতে গিয়েছিলেন। বড় একটি লোহার খাঁচায় আটকে রাখা ছিল, আবিদ হাসানকে দেখে হঠাৎ করে ভয়ঙ্কর খেপে গিয়ে সেটা খাঁচার মাঝে লাফ–ঝাঁপ দিতে শুরু করে। কুকুরের ট্রেইনার অবাক হয়ে বলল, কী আশ্চর্য! এটি খুব শান্ত কুকুর, আপনাকে দেখে এভাবে খেপে গেল কেন?
আমি জানি না।
আপনি কি কিছু বলেছেন? এই ব্যাটা আবার মানুষের কথা বুঝতে পারে।
হ্যাঁ। বলেছি।
কী বলেছেন?
বলেছি, কী খবর ডক্টর ট্রিপল-এ?
কথাটি একটি রসিকতা মনে করে ট্রেইনারটি হা হা করে হাসতে শুরু করল।