ঠুকে মারি আর মুখে মারি

মুখে-মারি পালোয়ানের বেজায় নাম, —তার মত পালোয়ান নাকি আর নাই। ঠুকে-মারি সত্যিকারের মস্ত পালোয়ান, মুখে-মারির নাম শুনে সে হিংসায় আর বাঁচে না। শেষে একদিন ঠুকে-মারি আর থাকতে না পেরে, কম্বলে নব্বুই মন আটা বেঁধে নিয়ে, সেই কম্বল কাঁধে ফেলে মুখে-মারির বাড়ি রওয়ানা হ’লো।
পথে এক জায়গায় বড্ড পিপাসা আর ক্ষিদে পাওয়ায় ঠুকে-মারি কম্বলটা কাঁধ থেকে নামিয়ে একটা ডোবার ধারে বিশ্রাম করতে বসল। তারপর চোঁ-চোঁ করে এক বিষম লম্বা চুমুক দিয়ে ডোবার অর্ধেক জল খেয়ে বাকি অর্ধেকটায় সেই আটা মেখে নিয়ে সেটাও সে খেয়ে ফেলল। শেষে মাটিতে শুয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুম দিল।
সেই ডোবাতে একটা হাতী রোজ জল খেতে আসত। সেদিনও সে জল খেতে এল; ডোবা খালি দেখে তার ভারি রাগ হ’লো। পাশেই একটা মানুষ শুয়ে আছে দেখে সে তার মাথায় দিল গোদা পায়ের এক লাথি! ঠুকে-মারি বলল, “ওরে, মাথা টিপেই দিবি যদি, একটু ভাল করে দে’ না বাপু!” হাতীর তখন আরো বেশী রাগ হ’লো। সে শুঁড়ে করে ঠুকে-মারিকে তুলে আছাড় মারতে চেয়েছিল, কিন্তু তার আগেই ঠুকে-মারি তড়াক্‌ করে লাফিয়ে উঠে হাতী মশাইকে থলের মধ্যে পুরে রওয়ানা হ’লো।
খানিক দূর গিয়ে সে মুখে-মারির বাড়িতে এসে হাজির হ’লো আর বাইরে থেকে চেঁচাতে লাগল, কই হে মুখে-মারি! ভারি নাকি পালোয়ান তুমি! সাহস থাকে তো লড় না এসে!” শুনে মুখে-মারি তাড়াতাড়ি বাড়ির পিছনে এক জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল। মুখে-মারির বৌ বলল, “কর্তা আজ বাড়ি নেই। কোথায় যেন পাহাড় ঠেলতে গিয়েছেন।” ঠুকে-মারি বলল, “এটা তাকে দিয়ে ব’লো যে এর মালিক তার সঙ্গে লড়তে চায়।” এই বলে সে হাতীটাকে ছুঁড়ে তাদের উঠানে ফেলে দিল।
ব্যাপার দেখে বাড়ির লোকের চক্ষুস্থির! কিন্তু মুখে-মারির সেয়ানা খোকা হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়ে উঠল, “ও মা গো! দুষ্টু লোকটা আমার দিকে একটা ইঁদুর ফেলেছে! কি করি বল তো?” তার মা বলল, “কিছু ভয় নেই। তোমার বাবা এসে ওকে উচিত শিক্ষা দেবেন। এখন ইঁদুরটাকে ঝাঁট দিয়ে ফেলে দাও।”
এই কথা বলা মাত্র ঝাঁটার ঝট্‌পট্‌ শব্দ হ’লো আর খোকাটা বলল, “ঐ যা! ইঁদুরটা নর্দমায় পড়ে গেল।” ঠুকে-মারি ভাবল, “যার খোকা এরকম , সে নিশ্চয়ই আমার উপযুক্ত জুড়ি হবে।” বাড়ির সামনে একটা তাল গাছ ছিল, সেইটা উপ্‌ড়ে নিয়ে ঠুকে-মারি হেঁকে বলল, “ওরে খোকা, তোর বাবাকে বলিস্‌ যে আমার একটা ছড়ির দরকার ছিল, তাই এটা নিয়ে চল্‌লাম।” খোকা তৎক্ষণাৎ বলে উঠল, “ওমা দেখেছ? ঐ দুষ্টু লোকটা বাবার খড়্‌কে কাঠি নিয়ে পালিয়ে গেল।” খড়্‌কে কাঠি শুনে ঠুকে-মারির চোখ দুটো আলুর মত বড় হয়ে উঠল। সে ভাবল, “দরকার নেই বাপু, ওসব লোকের সঙ্গে ঝগড়া করে।” সে তখনই হন্‌ হন্‌ করে সে গ্রাম ছেড়ে নিজের গ্রামে পালিয়ে গেল।
মুখে-মারি বাড়িতে এসে ছেলেকে জিজ্ঞাসা করল, “কিরে! লোকটা গেল কই?” খোকা বলল, “সে ঐ তাল গাছটা নিয়ে পালিয়ে গেল।” এই কথা শুনে মুখে-মারি ভয়ানক রেগে বলল, “হতভাগা! তুই আমার ছেলে হয়ে আমার নাম ডোবালি? দরকার হলে দুটো কথা বলতে পারিস্‌নে? যা! আজই তোকে গঙ্গায় ফেলে দিয়ে আসব।” এই বলে সে অপদার্থ ছেলেকে গঙ্গায় ফেলে দিতে চলল।
কিন্তু গঙ্গা তো গ্রামের কাছে নয়— সে অনেক দূর। মুখে-মারি হাঁটছে হাঁটছে আর ভাবছে, ছেলেটা যখন কান্নাকাটি করবে, তখন তাকে বলবে, “আচ্ছা, এবার তোকে ছেড়ে দিলাম।” কিন্তু ছেলেটা কাঁদেও না, কিছু বলেও না, সে বেশ আরামে কাঁধে চড়ে ‘গঙ্গায়’ চলেছে। তখন মুখে-মারি তাকে ভয় দেখিয়ে বলল, “আর দেরী নেই, এই গঙ্গা এসে পড়ল বলে।” ছেলেটা চট্‌ করে বলে উঠল, “হ্যাঁ বাবা। বড্ড জলের ছিটা লাগছে।” শুনে মুখে-মারির চক্ষুস্থির! সে তখনই ছেলেকে কাঁধ থেকে নামিয়ে বলল, ” শিগ্‌গির বল, সত্যি করে, লোকটাকে তুই কিছু বলেছিস কিনা?” ছেলে বলল, “ওকে তো আমি কিছু বলিনি। আমি মাকে চেঁচিয়ে বললাম, দুষ্টু লোকটা বাবার খড়্‌কে কাঠি নিয়ে পালিয়ে গেল।” মুখে-মারি এক গাল হেসে তার পিঠ থাব্‌ড়ে বলল, “সাবাস্‌ ছেলে! বাপ্‌কা বেটা!”