টানেল
অবজারভেশন টাওয়ারটি খাড়া উপরে উঠে গেছে। স্বচ্ছ কোয়ার্টজে ঢাকা বৃত্তাকার ছোট ঘরটা থেকে তাকালে নিচে মেঘ এবং দূরে পাহাড়ের সারি চোখে পড়ে। এ রকম সময়ে মাইলারের একটা স্ক্রিন মহাকাশে খুলে দেয়া হয়, সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে সেখান থেকে এই এলাকায় একটা কৃত্রিম জ্যোৎস্নার আলো ছড়িয়ে পড়ে। সেই আলোতে চারদিকে এক ধরনের অতিপ্রাকৃতিক দৃশ্য ফুটে উঠছে। বীপা মুগ্ধ চোখে সেদিকে তাকিয়ে থেকে নরম গলায় বলল, কী সুন্দর তাই না?
রিশ তার কথার উত্তর না দিয়ে অন্যমনস্ক চোখে দূরে যেখানে তাকিয়েছিল সেখানেই তাকিয়ে রইল। বীপা আহত গলায় বলল, তুমি আমার কথা শুনছ না।
রিশ বলল, শুনছি।
তাহলে কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন?
এই তো দিচ্ছি।
এটা কি উত্তর দেয়া হল? আমি যদি বলি ইস কী সুন্দর, তাহলে তুমিও বলবে ইস কী সুন্দর!
রিশ বীপার ছেলেমানুষি মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে হেসে বলল, ঠিক আছে, এখন থেকে বলব।
সত্যি?
সত্যি।
বীপার মুখটি আনন্দে ঝলমল করে উঠল। সে রিশের হাত শক্ত করে ধরে রেখে বলল, আজ এখানে এসে আমার কী যে ভালো লাগছে।
এই হাসিখুশি মেয়েটার জন্যে রিশ তার বুকের ভিতরে এক ধরনের গভীর ভালবাসা অনুভব করে। সে তার মাথায় হাত দিয়ে সোনালি চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিয়ে বলল, আমারও খুব ভালো লাগছে।
বীপা হাসিমুখে বলল, এই তো তুমি কথা বলা শিখে গেছ!
আমি বলেছিলাম না, সবকিছু খুব তাড়াতাড়ি শিখে নিই। এখন বিশ্বাস হল?
বীপা মাথা নাড়ে, হল।
রিশ আর বীপা হাত ধরাধরি করে বৃত্তাকার অবজারভেশন টাওয়ারটি একবার ঘুরে আসে। তাদের মতো আরো অনেকেই এসেছে। সপ্তাহে একদিন মাইলারের এই স্ক্রিনটা খুলে কৃত্রিম জ্যোৎস্না ছড়িয়ে দেয়া হয়, সেদিন এই বিচিত্র জ্যোৎস্নার মায়াময় দৃশ্য দেখার জন্যে অনেক দূর দূর থেকে এই টাওয়ারের সবাই এসো জড়ো হয়। কোয়ার্টজের জানালায় হেলান দিয়ে সবাই বাইরে তাকিয়ে আছে, তাদের মাঝে ধীরে ধীরে পা ফেলে হেঁটে যেতে যেতে বীপা বলল, আজকে আমরা সারারাত এখানে থাকব।
বিশ হাসিমুখে বলল, ঠিক আছে থাকব।
সারারাত আমরা কথা বলব।
কী নিয়ে কথা বলবে?
কত কী বলার আছে আমার। কোথায় বিয়ে হবে আমাদের। কোথায় যাব বেড়াতে। কতজন বাচ্চা হবে আমাদের। তার মাঝে কতজন হবে ছেলে, কতজন মেয়ে! তুমি কি কখনো আমাকে কথা বলার সময় দাও?
এই তো দিচ্ছি।
ছাই দিচ্ছ। তোমাকে কতবার বলে শেষ পর্যন্ত আজ একটু সময় দিলে
বিশ একটা নিশ্বাস ফেলে অপরাধীর মতো বলল, আসলে খুব বড় একটা এক্সপেরিমেন্ট দাঁড়া করছি আমরা। স্পেস টাইমের ওপর বিজ্ঞানী রিসানের একটা সূত্র আছে। সেটা প্রথমবার আমরা পরীক্ষা করে দেখছি। সেটা যে কত গুরুত্বপূর্ণ এক্সপেরিমেন্ট সেটা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।
আমি কল্পনা করতে চাইও না।
আমি যেটা করতে চাইছি সেটা যদি করতে পারি দেখবে সারা পৃথিবীতে হইচই পড়ে যাবে।
চাই না আমি কোনো হইচই।
কী চাও তুমি?
আমি চাই তুমি সারাক্ষণ আমার পাশে থাকবে।
রিশ শব্দ করে হেসে উঠল এবং ঠিক তখন বুঝতে পারল তার পকেটের কমিউনিকেশন মডিউলটি একটা জরুরি সঙ্কেত দিতে শুরু করেছে। কেউ একজন তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। বিশ চোখের কোনা দিয়ে বীপাকে এক নজর দেখে পকেট থেকে ছোট কমিউনিকেশন মডিউলটি বের করল। সাথে সাথে বীপার চোখেমুখে এক ধরনের আশাভঙ্গের ছাপ পড়ল। সে আহত গলায় বলল, তুমি এখন এটিতে কথা বলবে?
রিশ অপরাধী গলায় বলল, আমাকে একটু কথা বলতে হবে বীপা। নিশ্চয় খুব জরুরি, খুব জরুরি না হলে সাত মাত্রায় যোগাযোগ করত না।
বীপা কিছু বলল না কিন্তু তার মুখে আশাহত হওয়ার ছাপটি খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অনুভূতির তারতম্যগুলো বীপার মুখে খুব সহজেই ধরা পড়ে যায়।
রিশ যোগাযোগ মডিউলটির সুইচ স্পষ্ট করতেই একজন মধ্যবয়স্ক মানুষের চেহারা স্পষ্ট হয়ে আসে। মানুষটি উত্তেজিত গলায় বলল, রিশ, যে চতুষ্কোণ ক্ষেত্রে শক্তি সঙ্কোচন করা হয়েছিল সেখানে সময়ক্ষেত্র ভেদ করা হয়েছে।
রিশ লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল, কী বলছ তুমি?
হা। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে একটা চতুষ্কোণ জায়গা, আলো প্রতিফলিত হয়ে আসছে, একটা আয়নার মতো!
সত্যি?
সত্যি। কতক্ষণ রাখতে পারব জানি না। প্রচণ্ড শক্তি ক্ষয় হচ্ছে। তুমি তাড়াতাড়ি চলে আস।
আসছি, আমি এক্ষুনি আসছি।
রিশ যোগাযোগ মডিউলটি বন্ধ করে হতচকিতের মতো বীপার দিকে তাকাল, তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। তার চোখ চকচক করতে থাকে, কাঁপা গলায় বলল, শুনেছ বীপা, শুনেছ?
বীপার নীল চোখে তখনো একটা বিষণ্ণ আশাভঙ্গের ছাপ। সে মৃদু গলায় বলল, শুনেছি।
আমাকে যেতে হবে বীপা, আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে।
বীপা চোখ নামিয়ে বলল, যাও।
এটা অনেক বড় ব্যাপার বীপা, অনেক বড় ব্যাপার। রিসানের সূত্রকে প্রমাণ করা হয়েছে। প্রথমবার স্পেস টাইম কন্টিনিউয়ামে একটা টানেল তৈরি করা হয়েছে। সেই টানেল দিয়ে ভিন্ন সময়ে কিংবা ভিন্ন অবস্থানে চলে যাওয়া যাবে। চিন্তা করতে পার?
বীপ কোনো কথা বলল না
চল বীপা তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিই।
বীপা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি যাও রিশ। আমি এখানে আরো কিছুক্ষণ থাকি। আমি নিজে নিজে বাসায় চলে যাব।
রিশ নিচু হয়ে তার হাতে হাত স্পর্শ করে এক রকম ছুটে বের হয়ে গেল। বীপা মাথা ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে এখনো দূরে মেঘ আর পাহাড়ের সারি দেখা যাচ্ছে। কৃত্রিম জ্যোৎস্নার আলোতে এখনো সবকিছু কী অপূর্ব মায়াময় দেখাচ্ছে। বীপা অন্যমনস্কভাবে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। তার বুকের মাঝে একটা অভিমান এসে ভর করছে, কার ওপর এই অভিমান সে জানে না। ধীরে ধীরে তার চোখে পানি এসে যায়, দূরের বিস্তীর্ণ মেঘ আর নীল পাহাড়ের সারি অস্পষ্ট হয়ে আসে। বীপা সাবধানে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে তার চোখের পানি মুছে ফেলল। রিশ একজন অসাধারণ বিজ্ঞানী আর সে খুব সাধারণ একজন মেয়ে। কে জানে, সাধারণ মেয়েদের বুঝি অসাধারণ বিজ্ঞানীদের ভালবাসতে হয় না। তাহলে বুঝি তাদের এ রকম একাকী নিঃসঙ্গ হয়ে বেঁচে থাকতে হয়।
.
রিশ দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই তার দিকে কয়েকজন ছুটে এল। মধ্যবয়স্ক টেকনিশিয়ানটি উত্তেজিত গলায় বলল, শক্তিক্ষেত্রে প্রচুর চাপ পড়ছে রিশ, কতক্ষণ ধরে রাখতে পারব জানি না।
রিশ হাঁটতে হাঁটতে উত্তেজিত গলায় বলল, সেটা নিয়ে চিন্তা কোরো না। একবার যখন হয়েছে আবার হবে। টানেলটা কত বড়?
এক মিটার থেকে একটু ছোট।
এক জায়গায় আছে নাকি নড়ছে?
মোটামুটি এক জায়গাতেই আছে, শক্তির তারতম্য হলে একটু কাঁপতে থাকে। তুমি দেখলেই বুঝতে পারবে।
রিশ টেকনিশিয়ানের পিছু পিছু ল্যাবরেটরির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে হতবাক হয়ে গেল। বিশাল ল্যাবরেটরি ঘরে ইতস্তত যন্ত্রপাতি ছড়ানো। দুপাশে বড় বড় যন্ত্রপাতির প্যানেল, শক্তিশালী পাওয়ার সাপ্লাই, বড় কম্পিউটার। দেয়ালের পাশে রাখা বড় বড় লেজারগুলো থেকে লেজাররশ্মি ছুটে যাচ্ছে। ঘরে যন্ত্রপাতির মৃদু গুঞ্জন, এক ধরনের ঝাঁজালো গন্ধ। ঘরের ঠিক মাঝখানে স্পেস টাইম কন্টিনিউয়ামের টানেলটি দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হয় কেউ বুঝি একটা চতুষ্কোণ আয়না ঝুলিয়ে রেখেছে। রিশ প্রায় ছুটে গিয়ে জিনিসটার কাছে দাঁড়াল, তার এখনো বিশ্বায় হয় না এই মহাবিশ্বে একটা টানেল তৈরি করা হয়েছে, আর সে সেই টানেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে! টানেলের অন্য পাশে কী আছে কে জানে। হয়তো ভবিষ্যতের কোনো মূহর্ত হয়তো অন্য কোনো দেশ, মহাদেশ, অন্য কোন গ্রহ। অন্য কোনো গ্যালাক্সি। রিশের এখনো বিশ্বাস হতে চায় না। রিশ খুব কাছে থেকে দেখল, জিনিসটা খুব সূক্ষ্ম আয়নার মতো। দেখে মনে হয় হাতের ছোঁয়া লাগলেই বুঝি ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে যাবে। কিন্তু এটি ঝনঝন করে ভেঙে পড়বে না, প্রচণ্ড শক্তি ব্যয় করে এটি দাঁড়া করানো আছে, যতক্ষণ ল্যাবরেটরি থেকে শক্তি দেয়া যাবে ততক্ষণ সেটা দাঁড়িয়ে থাকবে।
রিশ কয়েক মুহূর্ত টানেলটার দিকে তাকিয়ে বলল, দৃশ্যমান আলো যেতে পারছে না, তাই এটাকে দেখাচ্ছে চকচকে আয়নার মতো।
টেকনিশিয়ানরা জিজ্ঞেস করল, এটার অন্য দিকটা কোথায়, রিশ?
কেউ জানে না। আমরা শক্তি খুব বেশি দিতে পারছি না তাই সেটা খুব বেশি দূরে হওয়ার কথা নয়। হয়তো খুব কাছাকাছি।
আমরা কি অন্য মাথাটা দেখতে পাব?
যদি একই সময়ে হয়ে থাকে নিশ্চয়ই দেখব। কিন্তু সময়ের মাত্রায় যদি এটা অন্য কোথাও এসে থাকে তাহলে তো এখন দেখা যাবে না, যখন সেই সময় এসে হাজির হবে তখন দেখবে।
রিশের কাছাকাছি আরো কিছু মানুষ এসে ভিড় জমায়। অন্য বিজ্ঞানীরা, অন্য টেকনিশিয়ানরা, সবাই উত্তেজিত গলায় কথা বলতে থাকে। কমবয়সী একটা মেয়ে জিজ্ঞেস করল, টানেলটার অন্য মাথা কোথায় সেটা জানার কোনো উপায় নেই?
আছে। উপায় আছে। অনেক দীর্ঘ একটা হিসেব–নিকেশ করার ব্যাপার আছে। পুরোটা কীভাবে করতে হবে সেটা এখনো কেউ ভালো করে জানে না। যখন সেটা জানা যাবে তখন আগে থেকে বলে দেয়া যাবে এই টানেল দিয়ে কোথায় যাওয়া যাবে।
মেয়েটার হাতে একটা স্কু–ড্রাইভার ছিল সেটা দেখিয়ে বলল, আমি যদি এই স্কু ড্রাইভারটা এখানে ছুঁড়ে দিই তাহলে কী হবে?
রিশ হেসে বলল, এটা টানেল দিয়ে গিয়ে অন্য মাথা দিয়ে বের হয়ে যাবে।
মেয়েটা চোখ বড় বড় করে বলল, সত্যি ছুঁড়ে দিয়ে দেখব?
রিশ মাথা নেড়ে বলল, দেখ।
মেয়েটা স্কু–ড্রাইভারটা ঝকঝকে আয়নার মতো চতুষ্কোণ টানেলের মুখে ছুঁড়ে দিল। সবার মনে হল ঝনঝন করে বুঝি সেটা ভেঙে পড়বে। কিন্তু সেটা ভেঙে পড়ল না, স্কু ড্রাইভারটা একটা অদৃশ্য দেয়ালে বাধা পেয়ে যেন ফিরে এল। পানির মাঝে ঢিল ছুড়লে যেরকম একটা তরঙ্গের জন্ম হয় চতুষ্কোণ আয়নার মতো জিনিসটার মাঝে ঠিক সেরকম একটা তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল।
রিশ মেঝে থেকে ভ্রু–ড্রাইভারটা তুলে মেয়েটার হাতে দিয়ে বলল, আরো জোরে ছুঁড়তে হবে, টানেলটার মুখে পৃষ্ঠটানের মতো একটা ব্যাপার আছে। জোরে না ছুড়লে সেটা ভেদ করে ভিতরে ঢোকার উপায় নেই।
মেয়েটা এবারে স্ক্রু –ড্রাইভারটা হাতে নিয়ে গায়ের জোরে ছুঁড়ে দিল। সত্যি সত্যি সেটা আয়নার মতো পরদাটির মাঝে ঢুকে গেল এবং হঠাৎ করে শাৎ করে শুষে নেবার মতো একটা শব্দ হল এবং পুরো স্কু–ড্রাইভারটাকে যেন অদৃশ্য কিছু একটা টেনে ভিতরে নিয়ে গেল। ব্যাপারটা দেখে ল্যাবরেটরি ঘরে যারা দাঁড়িয়েছিল সবাই একই সাথে বিস্ময়ের মতো একটা শব্দ করল। রিশ উত্তেজিত গলায় বলল, দেখেছ, এর মাঝে শক্তির পার্থক্যের একটা ব্যাপার আছে। সহজে জিনিসটা ভিতরে যেতে চায় না। কিন্তু একবার ঢুকে গেলে কিছু একটা টেনে নিয়ে যায়–ঠিক যেরকম রিসানের সূত্রে বলা হয়েছিল।
কমবয়সী একজন তরুণ এক পা এগিয়ে এসে বলল, এর মাঝে কি কোনো বিপদ আছে?
কী রকম বিপদ?
যেমন মনে কর এই টানেল দিয়ে সবকিছু টেনে বের করে নিয়ে গেল, অন্য কোথাও। নিয়ন্ত্রণের বাইরে অন্য কিছু ঘটে গেল, পুরো জগৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড অদৃশ্য হয়ে গেল।
রিশ হেসে ফেলল, বলল, না। এই টানেলটা তৈরি করা হয়েছে ল্যাবরেটরির শক্তি দিয়ে। এই টানেল দিয়ে ছোটখাটো জিনিস এক শ–দু শ কিলোগ্রাম এদিক–সেদিক করা। যাবে, তার বেশি কিছু নয়।
তার মানে এই পুরো জগতকে শুষে নেবার কোনো ভয় নেই?
না। শক্তির নিত্যতার সূত্র যদি সত্যি হয় তার কোনো ভয় নেই।
কমবয়সী মেয়েটা এগিয়ে এসে বলল, আমার স্কু–ড্রাইভার কি টানেলের অন্য মাথা দিয়ে এতক্ষণে বের হয়ে গেছে?
রিশ হেসে বলল, আমার তাই ধারণা।
কেউ কি সেটা দেখতে পেয়েছে?
কেমন করে বলি। হয়তো দেখেছে। হয়তো দেখে নি।
মেয়েটা আরেকটা কী কথা বলতে যাচ্ছিল, মধ্যবয়স্ক টেকনিশিয়ান বাধা দিয়ে বলল, আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। পাওয়ার সাপ্লাই যেটুকু শক্তি দেবার কথা তার থেকে অনেক বেশি টেনে নেয়া হয়েছে। পুরোটা ওভারলোডেড হয়ে আছে। আর কিছু যদি দেখার না থাকে তাহলে বন্ধ করে দেয়া উচিত।
রিশ বলল, এক সেকেন্ড, আমি একটা জিনিস পরীক্ষা করে নি।
টেকনিশিয়ান জিজ্ঞেস করল, কী পরীক্ষা করবে?
টানেলটার উপরে যে শক্তির স্তরটা আছে সেটা কতটুকু একটু পরীক্ষা করে দেখি।
রিশ আশপাশে তাকিয়ে একটা বড় রেঞ্চ হাতে নিয়ে এগিয়ে এল, পরদাটার উপরে সেটা দিয়ে স্পর্শ করতেই তরল পদার্থে যেরকম একটা ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে সেভাবে ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল। রিশ রেঞ্চটা দিয়ে আবার আলতোভাবে আঘাত করল, তখন আরেকটু বড় তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল। রিশ এবারে রেঞ্চটা হাতে নিয়ে বেশ জোরে মসৃণ আয়নার মতো দেখতে অংশটুকুর উপরে আঘাত করতেই সেটা ফুটো করে রেঞ্চটা ভিতরে ঢুকে যায় এবং শাৎ করে একটা শব্দ হয়ে পুরো রেঞ্চটাকে অদৃশ্য কিছু একটা যেন টেনে ভিতরে নিয়ে নেয়। এবং কিছু বোঝার আগেই বিশের হাতটাও কব্জি পর্যন্ত ভিতরে ঢুকে গেল। রিশ তার হাতে এক ধরনের তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা অনুভব করে এবং একটা আর্ত চিৎকার করে সে তার হাতটা টেনে। বের করতে গিয়ে আবিষ্কার করে তার হাতটাকে সে টেনে বের করতে পারছে না। তার হাতটা কোথায় জানি আটকে গেছে। শুধু আটকে যায় নি, অদৃশ্য একটা জিনিস তার হাতটাকে টেনে নেয়ার চেষ্টা করছে।
আশপাশে যারা দাঁড়িয়েছিল তারা সবাই ভাবলছি রিশ টেনে তার হাতটাকে বের করে আনবে এবং যখন দেখল সে বের করে আনছে না তখন হঠাৎ করে সবাই বুঝতে পারল সে তার হাতটাকে বের করতে পারছে না। সবার মুখে একটা আতঙ্কের ছায়া পড়ল এবং সবার আগে টেকনিশিয়ান ছুটে গিয়ে তার হাতটা ধরে টেনে বের করার চেষ্টা করল। রিশ যন্ত্রণায় চিৎকার করে বলল, পারবে না, বের করতে পারবে না।
টেকনিশিয়ান ফ্যাকাশে মুখে বলল, কেন পারব না?
টানেলের অন্য পাশে নিশ্চয়ই ভবিষ্যৎ। আমার হাতটা নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে চলে গেছে, ভবিষ্যৎ থেকে কিছু অতীতে আসতে পারে না।
তাহলে?
হাতটা কেটে ফেলতে হবে।
ঘরের সবাই শিউরে উঠল। টেকনিশিয়ান আতঙ্কিত গলায় বলল, কেটে ফেলতে হবে?
হ্যাঁ। আর কোনো উপায় নেই। কেউ একজন ছুটে যাও একটা ইলেকট্রিক চাকু নিয়ে এস–ছুটে যাও।
সত্যি কেউ ছুটে যাবে কি না বুঝতে পারছিল না। একজন ছুটে ঘরের জরুরি বিপদ সঙ্কেতের লাল সুইচটা চেপে ধরল এবং সাথে সাথে একটা লাল আলো জ্বলতে জ্বলতে তীক্ষ্ণ বিপদ সঙ্কেত বাজতে শুরু করে। টেকনিশিয়ান কী করবে বুঝতে না পেরে আবার রিশকে জাপটে ধরে টেনে আনতে চেষ্টা করে, ফিনফিনে আয়নার মতো পাতলা পরদাটি হঠাৎ যেন পাথরের দেয়ালের মতো শক্ত হয়ে গেছে। বিশের মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে এবং সে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠে–ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও আমাকে।
টেকনিশিয়ান রিশকে ছেড়ে দিতেই সে হুমড়ি খেয়ে আরো খানিকটা ভিতরে ঢুকে গেল। সবাই আতঙ্কে নিশ্বাস বন্ধ করে দেখতে পেল কোন একটা অদৃশ্য শক্তি যেন তাকে ভিতরে টেনে নেবার চেষ্টা করছে, রিশ প্রাণপণে নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না, একটু একটু করে সে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে।
কেউ একজন রক্ত শীতল করা শব্দে আর্তনাদ করে উঠল–তার মাঝে রিশ তার আরেকটা হাত ব্যবহার করে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে যায় আর হঠাৎ করে সেই হাতটাও ভিতরে ঢুকে গেল। হঠৎ করে অদৃশ্য একটা শক্তি দ্বিগুণ জোরে তাকে ভিতরে টেনে নিতে থাকে এবং সবাই দেখল সে আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে, কী করবে কেউ বুঝতে পারে না, চারদিক থেকে মানুষ ছুটে আসছে এবং তার মাঝে সবাই দেখতে পায় রিশ স্বচ্ছ আয়নার মতো একটা জিনিসে ঢুকে যাচ্ছে, প্রথমে আস্তে আস্তে তারপর আরো জোরে এবং হঠাৎ কিছু বোঝার আগে প্রচণ্ড শক্তিতে কেউ যেন তাকে টেনে একটা গহ্বরে ঢুকিয়ে নিয়ে গেল। একটু আগে যেখানে রিশ দাঁড়িয়েছিল সেখানে কেউ নেই। চকচকে আয়নার মতো জিনিসটার মাঝে শুধু একটা তরঙ্গ খেলা করতে থাকে। কোথায় জানি একটা বিস্ফোরণের মতো শব্দ হল এবং হঠাৎ করে বড় বড় দুটি পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায় এবং সাথে সাথে দপ করে চতুষ্কোণ আয়নার মতো জিনিসটা অদৃশ্য হয়ে গেল।
ল্যাবরেটরি ঘরে সবাই পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে, তাদের কারো বিশ্বাস হচ্ছে না রিশ স্পেস টাইমের বিশাল এক জগতের কোথাও চিরদিনের জন্যে হারিয়ে গেছে।
.
বিশ শক্ত একটা মেঝেতে আছাড় খেয়ে পড়ার সাথে সাথে সব শব্দ যেন মন্ত্রের মতো থেমে গেল। শক্তিশালী পাওয়ার সাপ্লাইয়ের গুঞ্জন ছিল, ইমার্জেন্সি সঙ্কেতের তীক্ষ্ণ শব্দ ছিল, ভয় পাওয়া মানুষের আর্তনাদ ছিল, হঠাৎ করে কোথাও কিছু নেই। চারদিকে সুনসান নীরবতা। একটু আগে শরীরে যে প্রচণ্ড যন্ত্রণা ছিল সেই যন্ত্রণাও হঠাৎ করে চলে গেছে, বুকের মাঝে হৃৎপিণ্ডটি শুধু এখনো প্রচণ্ড শব্দ করে ধকধক করে যাচ্ছে।
রিশ উঠে বসতেই তার পায়ে কী একটা লাগল, তুলে দেখে একটা ছোট স্ক্রু–ড্রাইভার, একটু আগে সেটাকে টানেলের মাঝে দিয়ে ছুঁড়ে দেয়া হয়েছিল। রিশ মাথা তুলে তাকাল। স্পেস টাইম কন্টিনিউয়ামের টানেল দিয়ে সে এখানে এসে পড়েছে, কিন্তু টানেলটির মুখটা সে দেখতে পাচ্ছে না, এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুজে গিয়েছে।
রিশ উঠে দাঁড়িয়ে মাথা তুলে তাকাল। জায়গাটা আবছা অন্ধকার। একটু আগে ল্যাবরেটরির তীব্র চোখ–ধাঁধানো আলো থেকে হঠাৎ করে এই আবছা অন্ধকারে এসে প্রথমে সে ভালো করে কিছু দেখতে পায় না। একটু পর আস্তে আস্তে তার চোখ সয়ে এল, মস্ত বড় একটা হলঘরের মতো জায়গা, দেয়ালের কাছাকাছি নানারকম যন্ত্রপাতি সাজানো, মাথার। উপরে একটা হলুদ আলো মিটমিট করে জ্বলছে। বিশ ভালো করে তাকাল, জায়গাটা কেমন জানি পরিচিত মনে হচ্ছে তবু ভালো করে চিনতে পারছে না। রিশ ভালো করে তাকাল এবং আবছা হলুদ ভূতুড়ে আলোতে সে জায়গাটি চিনতে পারল, এটি তার ল্যাবরেটরি ঘর। দীর্ঘদিনের অব্যবহারে এ রকম ভূতুড়ে একটা রূপ নিয়েছে। রিশ এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে, সে হঠাৎ করে ভবিষ্যতে চলে এসেছে। কতদিন ভবিষ্যতে এসেছে সে?
রিশ উঠে দাঁড়াল, ল্যাবরেটরির পিছনে একটা ছোট দরজা ছিল, এখনো সেই দরজাটা আছে কি না কে জানে। কিছু বাক্স সরিয়ে রিশ দরজাটা আবিষ্কার করে, হাতলে চাপ দিতেই সেটা খুট করে খুলে গেল। দরজাটা খুলে বাইরে আসতেই শীতল বাতাসের একটা ঝাপটা অনুভব করে। এখন শীতকাল। এক মুহূর্ত আগে সে গ্রীষ্মের এক রাতে ছিল, এখন সেটাকে কত পিছনে ফেলে এসেছে কে জানে।
রিশ হেঁটে হেঁটে বের হয়ে আসে। ল্যাবরেটরিটা একটা ভূতুড়ে বাড়ির মতো দেখাচ্ছে, দীর্ঘদিন থেকে সেটা নিশ্চয়ই অব্যবহৃত হয়ে আছে। কতদিন হবে? এক বছর? দুই বছর? দশ বছর? নাকি এক শ বছর? হঠাৎ করে এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে রিশ। কতদিন পার হয়েছে এর মাঝে? বীপার কথা মনে পড়ে হঠাৎ করে, কোথায় আছে এখন বীপা? কেমন আছে বীপা?
.
বীপা হতচকিত হয়ে তাকিয়ে রইল রিশের দিকে, তারপর কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বলল, তুমি?
হা বীপা। আমি।
এতদিন পরে?
এতদিন পরে নয় বীপা। এই একটু আগে আমি তোমাকে অবজারভেশন টাওয়ারে ছেড়ে এসেছি। এক ঘণ্টাও হয় নি।
বীপা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, না রিশ। এক ঘণ্টা নয়–প্রায় এক যুগ হয়ে গেছে।
এক যুগ? রিশ আর্তনাদ করে বলল, এক যুগ?
এক যুগ থেকেও বেশি। আমাকে দেখে তুমি বুঝতে পারছ না?
না। রিশ মাথা নাড়ল, তোমার চেহারার সেই ছেলেমানুষি ভাবটি আর নেই, কিন্তু তোমাকে দেখে বুঝতে পারছি না। তোমাকে দেখে ঠিক সেরকমই লাগছে।
কিন্তু আমি আর সেরকম নেই। রিশ আমি আর আগের বীপা নেই।
রিশের বুকের মাঝে হঠাৎ করে কেঁপে ওঠে, কেন বীপা, কী হয়েছে?
এক যুগ অনেক সময়। আমি তোমার জন্যে অনেকদিন অপেক্ষা করেছি। অনেকদিন। তুমি আস নি।
রিশ কাতর গলায় বলল, এই তো এসেছি।
অনেক দেরি করে এসেছ।
রিশ প্রায় আর্তনাদ করে বলল, তুমি… তুমি আর কাউকে বিয়ে করেছ বীপা?
বীপার মুখে হঠাৎ একটা বেদনার ছায়া পড়ল। সে মাথা নিচু করে বলল, আমি দুঃখিত রিশ, আমি খুব দুঃখিত। আমি খুব সাধারণ মেয়ে। আমি নিঃসঙ্গতা সইতে পারি না। আমি ভেবেছিলাম তুমি আর আসবে না। আমি ভেবেছি তুমি চিরদিনের জন্যে হারিয়ে গেছ। বার বছর অনেক সময়। এই সময়ে সব পাল্টে যায়। আমি খুব সাধারণ মেয়ে, খুব সাধারণ একটা ছেলের সাথে আমি ঘর বেঁধেছি। আমাদের একটা ছেলে আছে। মনে হয় সেও খুব সাধারণ একটা ছেলে হয়ে বড় হবে। জান রিশ, সেটা কিন্তু আশীর্বাদের মতো।
রিশ খানিকক্ষণ দেয়াল ধরে শূন্যদৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বলল, আমি যাই বীপা।
যাবে?
হ্যাঁ।
বীপা জিজ্ঞেস করতে চাইল, তুমি কোথায় যাবে রিশ? কিন্তু সে জিজ্ঞেস করল না।
বার বছর পর কাউকে আর এই কথা জিজ্ঞেস করা যায় না। তাদের একজনের ওপর আরেকজনের আর কোনো অধিকার নেই।