০৯.
ব্ল্যাকবোর্ডে লিখতে লিখতে থেমে গেলেন মিস্টার ক্রেগ। চক হাতে ঘুরে দাঁড়ালেন। কি হলো, কিশোর? এত হাসি কিসের?
ক্লাসের সবগুলো চোখ এখন কিশোরের দিকে।
হাসি থামানোর চেষ্টা করছে কিশোর। কিন্তু এমন একটা ছবি ওর হাতে ধরিয়ে দিয়েছে টেরির দোস্ত কডি, না হেসে থাকতে পারছে না সে। তাকালেই হাসি। মিস্টার ক্রেগের কিম্ভুত একটা ছবি এঁকেছে কডি। নাক দিয়ে দুটো কালো ক্রিমি বেরিয়ে আসছে।
ছবির নিচে টেরি ক্যাপশন লিখে দিয়েছে: পেট পচা। তাই ক্রিমিও পেটে থাকতে চায় না।
এই লেখাটাই বেশি হাসাচ্ছে কিশোরকে। ছবিটা দেখে তার মনে হচ্ছে: শিল্পী বটে কড়ি! ছবি আঁকায় ওর যে এত ভাল হাত, কই জানা ছিল না তো!
অংক করাচ্ছেন মিস্টার ক্রেগ। সারা ক্লাসের মনোযোগ সেদিকেই ছিল। পিনপতন নীরবতা। কেবল ব্ল্যাকবোর্ডে মিস্টার ক্রেগের চক ঘষার কিচকিচ শব্দ। এর মাঝে কিশোরের হো হো করে হেসে ওঠাটা যে কতটা বেমানান লেগেছে, ভাবতেই এখন সিঁটিয়ে গেল সে।
গাধা! গাধা আর কাকে বলে!
এগিয়ে এলেন মিস্টার ক্রেগ। কিশোরের কাছে এসে দাঁড়ালেন। তার হাতের ছবিটার দিকে তাকালেন।
আচমকা হাত বাড়িয়ে কেড়ে নিলেন ছবিটা দেখার জন্যে চোখের সামনে নিয়ে গেলেন।
ঢোক গিলল কিশোর। মুখ তুলে তাকাল টিচারের দিকে। হাসি নেই তার মুখে। ভীষণ গম্ভীর।
আরও নীরব হয়ে গেছে ঘরটা। নিঃশ্বাসের শব্দও শোনা যাচ্ছে।
তুমি এঁকেছ? জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার ক্রেগ। ফিসফিসানির মত শোনা গেল তাঁর কণ্ঠ।
না, কোনমতে জবাব দিল কিশোর। কান ঝাঁ-আঁ করছে। ঘাড় গরম হয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছে লাল হয়ে যাচ্ছে মুখ।
হু। কে কছে তাহলে? মোলায়েম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার ক্রেগ।
আঁ!… কডির কথা বলবে কিনা ঠিক করতে পারছে না কিশোর। জানি না!
আমার ছবি নাকি? মিস্টার ক্রেগের প্রশ্ন।
তা-তাও তো বুঝতে পারছি না, স্যার, বলেই হা-হা করে হেসে উঠল কিশোর। আটকাতে পারল না হাসিটা।
গাধা! মস্ত গাধা! মনে মনে গাল দিল নিজেকে।
নীরবতা নেই আর ঘরে। সবাই হাসছে এখন। মিস্টার ক্রেগ বাদে।
হাসি থামার অপেক্ষা করতে লাগলেন তিনি। তারপর ছবিটা কিশোরের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, আঁকাটা ঠিক হয়নি। আমার চুল আরও লম্বা। নাকটা আরও খাটো।
হাঁপ ছেড়ে বাচল কিশোর। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আল্লাহু আঁচিয়েছেন আমাকে, ভাবল। মিস্টার ক্রেগ ধমক দেননি। স্কুল ছুটির পর থাকতে বলেননি। শাস্তি দেননি। বড় বাঁচা বেঁচে গেলাম।
কিন্তু নিঃশ্বাসটা একটু আগেভাগেই ফেলেছে কিশোর। তখনও অনেক কিছু বাকি।
ক্লাসটাকে যখন আজ এতটাই সরগরম করে তুলতে পারলে, কিশোর পাশা, মিস্টার ক্রেগ বললেন, যাও না, ব্ল্যাকবোর্ডে গিয়ে সবাইকে দেখিয়ে দাও সমীকরণটা কি ভাবে করতে হবে।
সমীকরণ? আমি?
বুকের মধ্যে হাতুড়ির বাড়ি পড়া শুরু হলো কিশোরের। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে দেখে পায়ে শক্তি পাচ্ছে না। কোনমতে টলতে টলতে এগিয়ে গেল ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে।
সমীকরণটা পড়তে গিয়ে মাথা চুলকানো শুরু করল।
আরও একবার ভাবল মগজ উন্নত করার ওষুধটার কথা। এখনও কি ওষুধের কার্যকারিতা শুরু হওয়ার সময় হয়নি?
ইস্, যদি জেনে যেত কি করে সমাধান করতে হবে সমীকরণটার? কি মজাই না হতো। খসখস করে লিখে যেত মিস্টার ক্রেগ আর সহপাঠীদের বিস্মিত চোখের সামনে। ওকে আর বোকা বলার সাহস পেত না কেউ। বোকা তো সে ছিলও না। কিন্তু কেন যে…
ওষুধে কি কাজ শুরু করেছে?
যদি খালি…যদি খালি…
চকে লিখে রাখা অংকগুলোর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কেমন যেন অন্য রকম লাগতে শুরু করল তার।
মনে হলো যেন একটা তীব্র বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে গেল সমস্ত দেহে।
খাড়া হয়ে উঠল হাতের লোম। ভয়ে না মগজের কোন প্রতিক্রিয়ার কারণে, বুঝতে পারল না।
পারবে সে, বুঝে গেল। সমাধান করে ফেলতে পারবে সমীকরণটার।
কি হলো, কিশোর? চুপ করে আছো কেন? পেছন থেকে বললেন মিস্টার ক্রেগ।
অক্ষর আর নম্বরগুলোর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল সে, কোনটার সমাধান করব, স্যার? কিভাবে?
হেসে উঠল সারা ক্লাস। ব্যঙ্গের হাসি।
ঠিক আছে, প্রথমে এক্স থেকেই শুরু করি, গলা কাঁপছে কিশোরের।
একটুকরো চক তুলে নিয়ে লিখতে আরম্ভ করল সে।
লিখতে গিয়ে বেশি চাপ দিয়ে চকই ভেঙে ফেলল। অর্ধেকটা চক উড়ে গিয়ে পড়ল মেঝেতে। তাকাল না সে।
বুকের মধ্যে কাঁপছে। হচ্ছে তো অংকটা?
অদ্ভুত এক ভয়ের অনুভূতি। এ রকম অনুভূতি জীবনে হয়নি তার।
অবশেষে লেখা শেষ হলো। ফিরে তাকাল মিস্টার ক্রেগের দিকে। অনিশ্চিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, হয়েছে, স্যার?
বোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল মিস্টার ক্রেগের মুখ।
কঠিন হয়ে গেল দৃষ্টি।
অস্থির ভঙ্গিতে চুলে আঙুল চালালেন টিচার। চঞ্চল চোখের মণি দ্রুত ঘুরছে ব্ল্যাকবোর্ডের লেখাগুলোর ওপর।
আশ্চর্য! বিড়বিড় করলেন তিনি। অবিশ্বাস্য!
হাসিটা চওড়া হলো কিশোরের।
ঢোক গিললেন মিস্টার ক্রেগ। চোখের পাতা সরু করে আনলেন। এগুলো কি করলে? এতক্ষণ ধরে লিখলে, কিছুই তো হয়নি।
তারমানে, স্যার? হাসি মুছে গেল কিশোরের মুখ থেকে, হয়নি?
উঁহু। হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন টিচার। যে ভাবে লেখা শুরু করলে, আমি তো ভাবলাম পেরেই ফেলবে…কিন্তু কথাটা শেষ হলো না তার।
তারমানে, স্যার…ভুল? ঢোক গিলল কিশোর। ভাঙা ভাঙা স্বর বেরোল কোলাব্যাঙের মত।
পুরোপুরি ভুল, হতাশ ভঙ্গিতে জানালেন মিস্টার ক্রেগ। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।
ফুটো বেলুনের মত চুপসে গেল কিশোর। তবে কেউ আর এখন হাসছে না তার দিকে তাকিয়ে। সবারই যেন দুঃখ হচ্ছে তার জন্যে।
কিশোরকে কেউ সাহায্য করতে পারবে? মিস্টার ক্রেগ বললেন। রবিন, মুসা-তোমরা তো কিশোরের বন্ধু। পারবে তার অংকটা করে দিতে?
না, স্যার, জবাব দিল রবিন। আমি আমার বইপত্রই আনতে ভুলে গেছি। তা ছাড়া এই চ্যাপ্টারটা আমি পড়িওনি।
মাথা চুলকে মুসা বলল, আমি, স্যার, আমার লাঞ্চবক্স আনতেই ভুলে গেছি।