০৭.
রান্নাঘরে ফিরে এলেন আঙ্কেল জ্যাক।
বোতলটা তুলে নিয়ে লিভিং রূমের দিকে এগোলেন তিনি। কানে আসছে চেরি আন্টি আর ছেলেদের কথাবার্তা, হাসাহাসির শব্দ।
দরজার কাছে এসে এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন তিনি। তারপর মুচকি হেসে ঢুকে পড়লেন ঘরের মধ্যে। বোতলটা তুলে দেখালেন ছেলেদের। এই যে, তোমাদের ওষুধ।
বোতলটা প্রথমে কিশোরের হাতে দিলেন তিনি।
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল কিশোর। চোখের পাতা সরু হয়ে এল। সন্দেহ ফুটল তাতো বুদ্ধি বাড়ানোর ওষুধ?
মুখভঙ্গি নির্বিকার করে রেখে মাথা ঝাঁকালেন আঙ্কেল জ্যাক। হ্যাঁ, আমার নিজের ফরমুলা। বহু বছর ধরে এর ওপর গবেষণা করেছি আমি।
চেরি আন্টির পাশে কাউচে বসে পড়লেন তিনি। জিনিসটা কি ভাবে কাজ করে ব্যাখ্যা করে বোঝানো খুব কঠিন। বুদ্ধিমান মানুষদেরই সহজে মাথায় ঢুকতে চাইবে না, আর তোমরা তো বোকাই হয়ে গেছ। তবু বলি, এটা হলো নিউরন আর প্রোটনের ব্যাপার-স্যাপার। তার যুক্ত হয়েছে মগজে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ প্রবাহের নিয়ম-কানুন…
অত কঠিন কঠিন কথা শুনতে গিয়ে মাথা ঘুরে যাবার জোগাড় হলো মুসার। বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কা-কা-কাজ হবে তো?
ভয়ে ভয়ে বলল রবিন, মগজ বদলে দেবে? কিশোরের হাতের বোতলটার দিকে তাকাল সে।
না, তা বদলাবে না, আশ্বস্ত করলেন আঙ্কেল জ্যাক। আড়চোখে পরস্পরের দিকে তাকালেন তিনি আর চেরি আন্টি। আবার ছেলেদের দিকে ফিরলেন আঙ্কেল জ্যাক। সোজা করে বলতে গেলে তোমাদের মগজের বুদ্ধি, চলাচলের রাস্তার মধ্যে যে প্রতিবন্ধকতাগুলো সৃষ্টি হয়েছে, যার জন্যে বোকা হয়ে গেছ তোমরা, সেটা দূর করতে সাহায্য করবে এই ওষুধ। তোমাদের মগজের মহাসড়কটা খুলে দেয়ার ব্যবস্থা করেছি আমি। মগজে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ প্রবাহকে আরও খোলাখুলি ভাবে প্রবাহিত করতেও সাহায্য করবে এই ওষুধ।
এত বড় জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতার পরেও সন্দেহ যেতে চাইল না কিশোরের। বোতলটার দিকে তাকাল আবার। তো কি করব আমরা এখন? কতটা করে ওষুধ খেতে হবে?
পুরোটাই, আঙ্কেল জ্যাক বললেন। তিন দাগ ওষুধ আছে এখানে। সমান সমান তিন ভাগ করে খেয়ে ফেলবে আজ রাতে।
তারপর? রবিনের প্রশ্ন।
তারপর, স্রেফ ভুলে যাবে এটার কথা। মনে করারও আর প্রয়োজন নেই। জোর করে চালাক হওয়ার চেষ্টা কোরো না। সব কিছু ভুলে গিয়ে পড়ালেখায় মন দেবে। কোন কাজকেই অবহেলা করবে না। যত বেশি পরিশ্রম করবে, যত বেশি মনোযোগী হবে, তত দ্রুত বুদ্ধি খুলতে থাকবে তোমাদের।
তার গোল লাল টকটকে মুখে কোমল হাসি ছড়িয়ে পড়ল। তারপর দেখো কি ঘটে। আমার বিশ্বাস, তোমাদের মনের কষ্ট দূর হবে।
সত্যিই বুদ্ধিমান হব তো? সন্দেহ যাচ্ছে না কিশোরের।
হবে হবে…
বাইরে গাড়ির হর্নের শব্দ হলো। দুবার খাটো, একবার লম্বা।
ওই যে, বোধহয় হ্যারি এল। আমার সহযোগী বিজ্ঞানী। উঠে দাঁড়ালেন আঙ্কেল জ্যাক। জরুত্রী মীটিং আছে তার সঙ্গে।
ঠিক আছে, আমরা তাহলে যাই, বোতলটা হাতে নিয়ে কিশোরও উঠে দাঁড়াল। রবিন, যাবে না?
হ্যাঁ হ্যাঁ, যাব তো বটেই।
কি হয় জানিও, আঙ্কেল জ্যাক বললেন। আরেকটা কথা, এটা আমার অতি গোপন একটা আবিষ্কার। কাউকে বোলো না।
বলবে না কথা দিয়ে, আঙ্কেল আর আন্টি দুজনকেই ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল ওরা।
বোতলটা কোটের পকেটে ভরে রাখল কিশোর।
মুসা জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবে?
চলো, আগে আমাদের বাড়িতেই যাই। দেরি না করে ওষুধটা খেয়ে ফেলি। তারপর তোমাদের যেখানে ইচ্ছে যেও।
কিশোরদের বাড়িতে ঢুকে সোজা মুসা আর রবিনকে নিজের ঘরে নিয়ে এল কিশোর। ওদেরকে ওখানে বসিয়ে রেখে নিচতলায় গিয়ে উঁকি মেরে দেখে এল মেরিচাচী কোথায়।
তিনি ওখানে নেই। তারমানে তার অফিসে। কাজে ব্যস্ত। ইয়ার্ডের কর্মচারী বোরিস আর রোভার গেছে রাশেদ পাশার সঙ্গে পুরানো মাল কিনতে।
দ্রুত তিনটে গ্লাস তুলে নিয়ে আবার ওপরতলায় উঠে এল সে। টেবিলে রাখল ওগুলো। সমান তিন ভাগে ভাগ করল ওষুধটাকে।
সত্যি সত্যি কাজ হবে তো? হালকা লালচে রঙের তরল পদার্থটার দিকে তাকিয়ে থেকে ফিসফিস করে বলল মুসা। আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।
নিজের গ্লাসটা তুলে নিল রবিন। আঙ্কেল জ্যাকের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারো। অসম্ভব বুদ্ধিমান। আমাদের সঙ্গে মিথ্যে বলবেন না।
হাসি ফুটল কিশোরের মুখে। কাণ্ডটা কি হবে ভাবো তো? বুদ্ধিমান হয়ে যাব আমরা। আর আমাদেরকে বোকা বলার সাহস পাবে না কেউ। কি সাংঘাতিক ব্যাপারই,না হবে।
হ্যাঁ, সাংঘাতিক, রবিন একমত হলো তার সঙ্গে।
একসঙ্গে গ্লাস তুলল ওরা। গ্লাসে গ্লাসে টোকা লাগিয়ে টোস্ট করল বড়দের মত করে।
উজ্জ্বল আলোয় ঝিক করে উঠল রঙিন তরল।
খেতে কেমন লাগবে আল্লাহই জানে, দ্বিধা করছে কিশোর।
যেমনই লাগে খেয়ে ফেলা যাক, রবিন বলল। যত দেরি করব, ততই ভয় বাড়বে।
একসঙ্গে ঠোঁট লাগিয়ে গ্লাসে চুমুক দিল তিনজনে। ইঞ্চিখানেক ওষুধ থাকতেই গ্লাসটা নামিয়ে রাখল মুসা। বিচ্ছিরি স্বাদ! আর এত ঘন!
খেয়ে ফেলো, মুসা, খেয়ে ফেলো, কিশোর বলল। কাজে লেগেও যেতে পারে।
বোকা থাকা চলবে না আমাদের, যোগ করল রবিন।
আবার গ্লাস ঠোঁটে ঠেকাল ওরা। কোনমতে মুখে ঢেলে গিলে ফেলল। গ্লাসগুলো নামিয়ে রাখল।
ঠোঁটে লেগে থাকা ওষুধ চেটে মুসা বলল, জঘন্য। এত ভয়াবহ স্বাদের জিনিস জীবনে মুখে দিইনি।
হু। মিকশ্চারও অত খারাপ না, কিশোর বলল দুনিয়ার সবচেয়ে বাজে স্বাদের ওষুধ। কয়েকবার ঢোক গিলে স্বাদটা জিভ থেকে নামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল সে। ওয়াক ওয়াক করল। মনে হচ্ছে বেরিয়ে চলে আসবে। মুসার দিকে তাকাল। চিউয়িং গাম আছে নাকি?
পকেটে হাত দিল মুসা।
কি, চালাক চালাক লাগছে? জিজ্ঞেস করল রবিন।
উম।…মনে তো হচ্ছে, জবাব দিল কিশোর।
রাইনসরাস বানান করো তো।
উ?
রাইনসরাস। করো। বানান করো।
দ্বিধা করতে লাগল কিশোর। ভাবছে। তারপর বলল, আর-আই-এন-ও…
থামো থামো, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে লাগল রবিন। কাজ করছে না ওষুধ।
এত দ্রুত নিশ্চয় কাজ করে না এই ওষুধ, মুসা বলল। সময় দিতে হবে। ওই যে আঙ্কেল বললেন, চিন্তার রাস্তার প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে হবে..নিশ্চয় অতিরিক্ত ময়লা পড়ে গেছে। সাফ হতে সময় লাগবে।
জোরে নিঃশ্বাস ফেলল রবিন। তা লাগুক। বুধবারের মধ্যে হয়ে গেলেই বাঁচি।
কেন? বুধবার কেন?
ভুলে গেছ, বুধবারে অংক পরীক্ষা?
হাই তুলতে শুরু করল কিশোর। হঠাৎ করেই ঘুম পাচ্ছে আমার।
আমারও, রবিন বলল।
আমি তো চোখই টেনে খুলে রাখতে পারছি না, টেবিলের ওপরই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তে চাইল মুসা। বাড়ি যাওয়া এখন আমার পক্ষে দুঃসাধ্য!
থাক, যাওয়ার দরকার নেই, কিশোর বলল। রাতে আমাদের এখানেই থেকে যাও। বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দাও রাতে ফিরবে না।
ঘুমজড়িত স্বরে মুসা জবাব দিল, আমার ফোন করার ক্ষমতাও নেই।