১৮.
হাঁ করে তাকিয়ে আছে তিন গোয়েন্দা। বুঝতে পারছে না এই দুজন আবার কারা। অন্য কোন ব্রেন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের লোক না তো? এরা আবার মগজের কোন অংশটা চায়?
পায়ে পায়ে এগিয়ে আসতে শুরু করল লোকগুলো। ভঙ্গিটা কেমন যান্ত্রিক। ধীরে ধীরে পা ফেলছে। একতালে। একসঙ্গে।
কিশোরের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ করে দিল ওকে। বলে দিতে লাগল, লোকগুলো বিপজ্জনক।
সামনে এসে দাঁড়াল গাজুল আর মাজুল।
কে আপনারা? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
তোমাদের নতুন প্রভুর চর, দুজনের মধ্যে লম্বা লোকটা, গাজুল বলল।
আমাদের মনিবের সেবা করার জন্যে নিয়ে যাব তোমাদেরকে, মাজুল বলল। গোলাম বানাব তোমাদের।
গোলাম! লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। কারা ওরা? এ প্রশ্নের জবাব তার অতি বুদ্ধিমান মগজও দিতে পারছে না। রসিকতা করছেন, তাই না?
আমরা রসিকতা করি না, শীতল কণ্ঠে জবাব দিল গাজুল।
অন্য কোন গ্রহ থেকে এসেছেন নাকি আপনারা? মুসা জিজ্ঞেস করল ভয়ে ভয়ে। কণ্ঠস্বর অমন কেন? কেমন যান্ত্রিক। সিনেমায় দেখা রোবটগুলোর মত।
না, আমরা ভিনগ্রহবাসী নই, এই পৃথিবীরই মানুষ। তোমাদের কথাবার্তাই তো বরং আমাদের কাছে বিশ্রী লাগছে। কেমন আদিম আদিম। তোমাদের শোধরাতে সময় লাগবে। তবে শোধরাতে পারব। একবার আমাদের ঘাঁটিতে নিয়ে নিই। তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।
লোকগুলো রসিকতা করছে না, বুঝতে পারল কিশোর। পালানোর তাগিদ অনুভব করল।
আচমকা নড়ে উঠল সে। রবিনের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে চিৎকার করে বলল, মুসা, পালাও।
তিনজন তিন দিকে দৌড় মারল ওরা। প্রাণপণে ছুটতে লাগল।
কিছুদূর এসে পেছনে পায়ের শব্দ না শুনে ফিরে তাকাল মুসা।
কিশোর, ওরা আসছে না।
ফিরে তাকাল কিশোর আর রবিন।
আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে লোকগুলো। চেহারাতেও তেমন কোন ভাবান্তর নেই। রাগ, হতাশা, ক্ষোভ, কোন কিছু নেই। নির্বিকার। ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে ওরা যেন জানে কোনমতেই পালাতে পারবে না তিন গোয়েন্দা। ধরা পড়বেই।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত স্থির তাকিয়ে থেকে ঘুরে দাঁড়াল আবার কিশোর। হাঁটতে শুরু করল।
কোথায় যাবে? রবিনের প্রশ্ন।
বাড়িতে।
কিন্তু লোকগুলো? রসিকতা করছিল?
না। আমাদেরকে ধরার নতুন কোন ফন্দি আঁটছে ওরা। বুঝতে পারছি না কি করবে।
.
স্যালভিজ ইয়ার্ডের পেছনের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল ওরা।
সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল মেরিচাচীকে।
গাড়ির চাবি হাতে গ্যারেজের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন রাশেদ পাশা।
নেমে এলেন মেরিচাচী। কিশোরের সামনে দাঁড়ালেন। এত দেরি করলি কেন?
আবার দুটো লোক আমাদের ধরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল, জবাব দিল কিশোর।
কারা ওরা?
কি জানি। অদ্ভুত নাম, গাজুল আর মাজুল। বলল ওদের মনিবের জন্যে আমাদের নিয়ে যেতে চায় ওরা। গোলাম বানাবে।
চট করে রাশেদ পাশার দিকে তাকালেন মেরিচাচী। কি কাণ্ডই না শুরু হলো। যন্ত্রণা! এর একটা বিহিত করা দরকার। পুলিশে ডায়ারি করাব নাকি? কি বলো?
দেখা যাক, চিন্তিত ভঙ্গিতে গাল চুলকালেন রাশেদ পাশা। আগে স্কুলের সমস্যাটার একটা ফয়সালা করে আসি। কিশোর, তোরা ভেতরে যা। আমরা না আসা পর্যন্ত ঘর থেকে বেরোবি না। কাউকে ঢুকতে দিবি না। কারও সঙ্গে কথা বলবি না। যে-ই আসে আসুক।
পেছনের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকল তিনজনে।
চকলেটের গন্ধ আসছে।
খিদেটা চাগিয়ে উঠল মুসার। নিশ্চয় কেক বানাচ্ছিলেন আন্টি। দেখো তো, কোথায় আছে?
এই যে, এখানে, কাউন্টারের ওপাশ থেকে জবাব এল। মাথা তুলল ডন। একটা ট্রে বের করে কাউন্টারের ওপরে রাখল। তাতে ইয়া বড় এক কেক। এক টুকরো কেটে নিয়ে আয়েশ করে চিবাচ্ছে সে।
এত দৌড়াদৌড়ি ও এত পরিশ্রম গেছে যে, কিশোর আর রবিনেরও খিদে লেগেছে। কেকটা দেখে আর সহ্য হলো না। দৌড়ে গেল তিনজনেই। ঝাঁপিয়ে পড়ল কেকের ওপর।
দেখতে দেখতে সাবাড় করে ফেলল অত বড় কেকটা।
রেফ্রিজারেটর থেকে কোকের বোতল বের করল কিশোর। তিনটে গ্রাসে ঢালল। রবিন আর মুসার হাতে একটা করে গ্লাস তুলে দিয়ে নিজে নিল তৃতীয়টা। ডনকে বলল, তুমি খেতে চাইলে ঢেলে নাও।
রবিন বলল কিশোরকে, চলো, লিভিং রূমে গিয়ে বসি। সিনেমা-টিনেমা দেখে সময় কাটাই।
কিন্তু লিভিং রূমে ঢুকেই থমকে দাঁড়াতে হলো ওদের। হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে গাজুল আর মাজুল।
মাজুলের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করল গাজুল।
মুহূর্তে ডনের পাশে চলে এল মাজুল। তার কলার চেপে ধরল। লাফ দিয়ে ডান হাতে বেরিয়ে এসেছে একটা পিস্তলের মত জিনিস। সেটা তুলে তাক করল একটা পাথরের ফ্লাওয়ার ভাসের দিকে। টিপে দিল ট্রিগার।
আগুনে পানি পড়লে ছ্যাৎ করে যেমন শব্দ হয়, তেমনি একটা শব্দ করে মুহূর্তে নেই হয়ে গেল জিনিসটা। একেবারে গায়েব।
হাঁ হয়ে গেল তিন গোয়েন্দা।
তাহলে বুঝলে তো, হাসিমুখে বলল গাজুল, তোমাদেরও কি অবস্থা করতে পারি আমরা। কিন্তু করব না। কারণ গোলাম বানানোর জন্যে বহু কষ্টে তোমাদের খুঁজে বের করেছি আমরা। গোলাম হওয়ার উপযুক্ত বানিয়েছি। বোকা থেকে বুদ্ধিমান বানিয়েছি। এখন তোমরা আমাদের কাছে মূল্যবান। তবে তাই কলে ওই বাচ্চা ছেলেটাকেও কিছু করব না, তা ভেবো না। আমাদের কাছে ওর এক কানাকড়ি দাম নেই।
পিস্তলটা ডনের মাথায় ঠেকিয়ে চাপ দিল মাজুল।
ব্যথা লাগল। চিৎকার করে উঠল ডন। লাথি মারল মাজুলের হাঁটুতে।
পাটা সরিয়ে নিল মাজুল। ব্যথা পেল কিনা বোঝা গেল না। কারণ টু শব্দও করল না সে। তবে পিস্তলের নলের মুখটা আরও ঠেসে ধরল ডনের মাথায়।
ব্যথায় ককাতে লাগল ডন।
পা বাড়াল মুসা।
উঁহু, আঙুল নেড়ে সাবধান করল গাজুল, কোন কিছু করার চেষ্টা করলে ও মারা যাবে, ডনকে দেখাল সে। ও মরে যাবার পরও তোমাদেরকে ছাড়া হবে না। হয় আমাদের কথা মানবে, নয়তো মরবে।
কি করতে বলেন আমাদের জিজ্ঞেস করল কিশোর।
কোন রকম ঝামেলা না করে আমাদের সঙ্গে চলো, গাজুল বলল।
কোথায়?
যেখানে আমি নিয়ে যাব।
আরেকবার ডনের দিকে তাকাল কিশোর। মাজুলের হাতের পিস্তলটার দিকে তাকাল। শুধু আমি গেলে হয় না?
না, তোমাদের তিনজনকেই যেতে হবে।
রবিন বলল, ঝামেলা বাধিয়ে লাভ নেই, কিশোর। তুমি গেলে আমিও যাব। ডন বাঁচুক।
আমিও যাব, দ্বিধা না করে বলল মুসা।
হাসি ফুটল গাজুলের মুখে। মানুষদের এ ধরনের আন্তরিকতাগুলো আমাকে অবাক করে। কেমন বোকার মত অন্যের জন্যে প্রাণ দিতে রাজি হয়ে যায়। যাকগে, আমার কি। মাজুলের দিকে তাকাল সে। মাজুল, আমি ওকে না বলা পর্যন্ত এখানে থাকো। ওকে আটকে রাখো। আমি ওদের নিয়ে যাচ্ছি। ও-কে বললে তুমিও চলে আসবে।
এটাকে কি করব? ডনের কথা জিজ্ঞেস করল মাজুল।
তোমার যা খুশি, গাজুল বলল।
তাহলে আমরা যাব না, সঙ্গে সঙ্গে বেঁকে বসল কিশোর। ওকে বাঁচানোর জন্যে আমরা যেতে রাজি হয়েছি। আমাদেরকে কথা দিতে হবে ডনের কোন ক্ষতি হবে না।
এক মুহূর্ত ভাবল গাজুল। ঘাড় কাত করল। ঠিক আছে, কথা দিচ্ছি। ছেলেটার কোন ক্ষতি হবে না। এখন চলো।
আপনার কথার বিশ্বাস কি?
আমরা কথা দিলে কথা রাখি, এটাই আমাদের নিয়ম। সেজন্যে ভেবেচিন্তে কথা দিই। নাও, চলো তো এখন, দেরি হয়ে যাচ্ছে।