১৫.
সমস্যা! মিসেস মিলফোর্ড বললেন। কুটি করলেন ছেলেদের দিকে তাকিয়ে।
গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে কোন রকম অঘটন ঘটিয়েছে নাকি ওরা? জানতে চাইলেন মেরিচাচী।
আবার নিজের দুই হাতের দিকে তাকালেন মিসেস অ্যান্ডারসুন। হাত দুটো টেবিলের ওপর ফেলে রেখে মুখ তুললেন। না, কোন ধরনের অঘটন ওরা ঘটায়নি। কোন অপরাধ কিংবা অন্যায়ও করেনি। সমস্যাটা অন্য রকম।
কিশোর, মুসা, রবিনের মুখের ওপর থেকে ঘুরে এল মিসেস অ্যান্ডারসনের দৃষ্টি। আবারও বলছি, কি ভাবে কথাটা শুরু করব আমি বুঝতে পারছি না। কিন্তু না। বললেও চলছে না।
সোয়েটারের আস্তিনে বেরিয়ে থাকা একটা সুতো টেনে ঘেঁড়ার চেষ্টা করলেন মিস্টার ক্রেগ।
কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করলেন মিস্টার বেলসন। নড়েচড়ে বসলেন চেয়ারে।
স্কুলের সবাইকে ঘাবড়ে দিচ্ছে কিশোর, মুসা ও রবিন, অবশেষে কথাটা যেন ছুঁড়ে দিলেন মিসেস অ্যান্ডারসন। শুধু তাই না, টিচারদেরকেও ওরা ভয় পাইয়ে দিয়েছে।
কিন্তু, আমরা… বলতে গেল কিশোর।
হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন মিসেস অ্যান্ডারসন। তিন গোয়েন্দার অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে বললেন, মহাবুদ্ধিমান হয়ে গেছে আপনাদের ছেলেগুলো। আগে কেন বুঝতে পারিনি সেটাও এক রহস্য। তবে গত হপ্তা দুয়েক ধরে যা ঘটছে, তাতে আর কোন সন্দেহ নেই আমাদের।
মহাবুদ্ধিমান? চোয়াল ডললেন রাশেদ পাশা। চোখ তুলে তাকালেন তিন গোয়েন্দার দিকে। মহা না হোক, তবে ওরা যে আর দশটা সাধারণ ছেলের চেয়ে বুদ্ধিমান সেটা আমরা অনেক আগে থেকেই জানি।
সেটা তো আমরাও জানতাম, মিসেস অ্যান্ডারসন বললেন। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে অদ্ভুত কাণ্ড করে বেড়াচ্ছে ওরা। কিছুদিন এতটাই বোকা হয়ে রইল, যে ক্লাস পরীক্ষার সমস্ত টেস্টে ফেল করতে থাকল। আচার-আচরণে বোকামির চূড়ান্ত। কিন্তু গত দিন পনেরো ধরে হয়েছে উল্টোটা বুদ্ধিমত্তার চূড়ান্ত।
কিন্তু বুদ্ধিমত্তার মধ্যে খারাপটা কি দেখলেন, তা তো বুঝতে পারছি না, না বলে আর পারলেন না মুসার আম্মা মিসেস আমান।
তা ঠিক, মাথা ঝাঁকালেন মিসেস অ্যান্ডারসন। খারাপ কিছু নেই। প্রতিটি পরীক্ষায় একশোতে একশো নাম্বার পায় ওরা। ক্লাসের যত বই আছে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আগাগোড়া মুখস্থ। বইয়ের পর বই, বইয়ের পর বই পড়ে শেষ করে ফেলে ওরা, একটা অক্ষরও ভোলে না সেগুলোর। যে কোন বিষয়ের ওপর রচনা লিখতে দিলেও, যত কঠিন সাবজেক্টই হোক, বিশ-তিরিশ পৃষ্ঠার রচনা লিখে ফেলে অনায়াসে।
এটা তো দারুণ খবর! হাসলেন মেরিচাচী। সাংঘাতিক। তারমানে গোয়েন্দাগিরির ভূত গেছে মাথা থেকে। আজকাল পড়াশোনার প্রতি বেশি মনোযোগী হয়েছে।
ঠিকই বলেছেন, এটা দারুণ খবরই, মোলায়েম স্বরে মিসেস অ্যান্ডারসন বললেন। সাংঘাতিক। কিন্তু মোটেও ভাল অর্থে নয়। বুদ্ধি এত বেশি বেড়ে গেছে, ক্লাসে সারাক্ষণ টিচারদের ভুল শুধরে দিতে থাকে। পাঠ্যবইতে ভুল খুঁজে পায়। ওদের কাণ্ড-কারখানায় ওদেরকে রীতিমত ভয় পায় এখন সহপাঠীরা। তারা জানে, কোন প্রতিযোগিতাতেই আপনাদের ছেলেদের সঙ্গে পারবে না ওরা। ওদের ধারণা, অস্বাভাবিক…মানে, অলৌকিক কোন ব্যাপার ঘটছে কিশোর, মুসা আর রবিনকে ঘিরে।
না না, খারাপ কিছু ঘটাচ্ছে না ওরা, মেরিচাচীকে কথা বলার জন্যে মুখ খুলতে দেখে তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন মিস্টার ক্রেগ। ঝুঁকে এসেছেন সামনের দিকে। খুবই ভাল ছেলে ওরা। আসলে, যা করছে তার ওপর ওদের কোন হাত নেই। অনেক বেশি জানে ওরা। অনেক, অনেক বেশি। এই বয়েসের ছেলেদের তুলনায় সীমাহীন জ্ঞান ওদের, অস্বাভাবিক জ্ঞান। যেটা সত্যিই বিপজ্জনক, বুঝতেই পারছেন। স্কুলের পরিবেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে ওরা।
আমি লক্ষ করেছি, মিস্টার বেলসন বললেন, ছেলেমেয়েরা এখন আর ওদের সঙ্গে খেলতে চায় না, কথা বলতে চায় না, দূরে দূরে থাকে, সব সময় এড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে। স্কুলের পরিবেশের জন্যে মোটেও সেটা ভাল কিছু নয়, বুঝতেই পারছেন।
ঘরের সবগুলো চোখ এখন ওদের দিকে, দেখতে পাচ্ছে কিশোর। দুরুদুরু করছে বুকের মধ্যে। তার মনে হচ্ছে ঘটনাটা বাস্তবে ঘটছে না। যেন স্বপ্নের মধ্যে রয়েছে ওরা। অতিরিক্ত বুদ্ধিমান হয়ে যাওয়াটা যে এতখানি বিপজ্জনক কল্পনাই করতে পারেনি কোনদিন।
তারমানে আর সবার কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেছে ওরা। আলাদা করে ফেলা হচ্ছে ওদেরকে। ভবিষ্যতে আরও কি ঘটতে পারে কল্পনা করে মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল শীতল শিহরণ।
তারমানে কোন ধরনের ফ্রিকে পরিণত হয়েছি আমি? মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করল সে।
আমার কোন বন্ধু থাকবে না। সবাই আমাকে ঘৃণা করবে।
টিচাররাও আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে, কারণ আমি ওদের ভুল ধরে দিই।
তাহলে কি ঘটবে আমার?
দুই সহকারীর দিকে তাকাল সে। মুসা আর রবিন-ওরাও আর তার সহকারী থাকতে চাইবে না। কারণ ওদের মগজও তার মত একই রকম বুদ্ধিমান হয়ে গেছে।
মাথা নিচু করে আছে মুসা।
নিজের নখ খুঁটছে রবিন।
দুজনেই ভয় পেয়েছে। প্রচণ্ড ভয়।
চুপ করে আছো কেন? মিসেস অ্যান্ডারসন বললেন। কিছু বলো তোমরা।
আচমকা বলে উঠল রবিন, কি বলব? এর কোন ব্যাখ্যা আমরা দিতে পারব না।
একটা জিনিস হতে পারে… বলতে গেল মুসা।
খপ করে তার হাত চেপে ধরল কিশোর, না না, মুসা, বোলো না। আঙ্কেল জ্যাককে আমরা কথা দিয়েছি কারও কাছে ফাস করব না।
কিন্তু না বললে দেখছ না কি রকম বিপদে পড়ে যাচ্ছি? রবিন বলল। না বলে পারা যাবে না।
কি না বলে পারা যাবে না? ধমকের সুরে বললেন রবিনের মা। আমার ভাই কি করেছে? বলো, জলদি! না বললে আমিই ওকে জিজ্ঞেস করছি। ফোনের দিকে হাত বাড়ালেন তিনি।
মগজ উন্নত করার ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে আমাদেরকে, বলে ফেলল রবিন।
রবিন, থামো! চিৎকার করে উঠল কিশোর।
কিন্তু যা বলার বলে ফেলেছে রবিন। আর গোপন রাখা যাবে না। সুতরাং বাকিটাও বলে ফেলল রবিন, আমাদেরকে এক বোতল মগজ উন্নত করার ওষুধ দিয়েছিল আঙ্কেল জ্যাকবুদ্ধি বাড়ানোর জন্যে। হঠাৎ করে কেন জানি বোকা হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। তার কাছে গিয়ে সব বুলোম। বুদ্ধি বাড়ানোর ওষুধ নিয়ে গবেষণা করছে আঙ্কেল জ্যাক, আমাদের কাকুতি-মিনতি শুনে একটা বোতল দিয়ে দিয়েছিল, তিনজনে ভাগ করে খাওয়ার জন্যে। এবং তাতে কাজ হয়ে গেছে। ওষুধ আমাদের বুদ্ধি বাড়িয়ে দিয়েছে।
কিন্তু এত বোকাই বা হয়ে গিয়েছিলে কেন, হঠাৎ করে? মেরিচাচী প্রশ্ন করলেন। টিচারদের দিকে তাকালেন। বোকা যে হয়ে গিয়েছিল, সেটা আমিও লক্ষ করেছি।
মিস্টার আমান বললেন, আমিও।
তাহলেই তো বোঝা যাচ্ছে, মিস্টার ক্রেগ বললেন, একটা পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল ওদের।
একটা নয়, দুটো, দুই আঙুল তুললেন মিস্টার মিলফোর্ড। একবার অতিরিক্ত বোকা হয়ে যাওয়া, একবার অতিরিক্ত বুদ্ধিমান। কিশোরের দিকে তাকালেন তিনি। চালাকটা কি করে হলে, তা তো বুঝলাম। কিন্তু বোকা হলে কি করে?
মাথা নাড়ল কিশোর, জানি না!
চুপ হয়ে গেল সবাই।
ঘরে পিনপতন নীরবতা।
দীর্ঘক্ষণ পর জোরে নিঃশ্বাস ফেলে নীরবতা ভাঙলেন মিসেস অ্যান্ডারসন। কোন ধরনের জাদু-করা-ফরমুলা এ রকম বুদ্ধিমান বানিয়েছে তোমাদেরকে আমি জানি না, তিন গোয়েন্দাকে বললেন তিনি। তবে একটা কথা জানি। এ স্কুল তোমাদেরকে ছাড়তে হবে। আর তোমাদেরকে এখানে রাখা সম্ভব হবে না আমাদের পক্ষে।