টাইম ট্রাভেল – পরিচ্ছেদ ১৪

১৪.

সাতদিন পর।

স্কুলে তার লকারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। ব্যাকপ্যাকে জিনিসপত্র ভরছে। স্কুল ছুটি হয়েছে। বাড়ি যাবে।

উল্টোদিকের লকারের সামনে দাঁড়ানো রয়। হাসিমুখে তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, হাই রয়, দিনকাল কেমন যাচ্ছে?

মাথা ঝাঁকিয়ে দায়সারা জবাব দিল রয়, ভাল।

আমাদের বাড়ি যাবে? কম্পিউটার গেম খেলব।

 মুখ বাঁকাল রয়। নাহ।

কেন? এসো না, কি হয়েছে, অনুরোধ করল কিশোর।

কাঁধ ঝাঁকাল রয়। উঁহু। তোমার সঙ্গে পারব না। একটা গেমও জিততে পারব। মগজ অতিরিক্ত খুলে গেছে তোমার, বুদ্ধি বেড়ে গেছে।

কিন্তু…

দড়াম করে লকারের দরজা বন্ধ করে দিয়ে তাড়াহুড়া করে ওখান থেকে সরে গেল রয়।

তাকে ধরতে যাবে কিনা ভাবছে কিশোর, কথা কানে এল। ঘুরে তাকিয়ে দেখে টেরি আর তার দুই দোস্ত টাকি ও কডি। ওপথ দিয়েই যাচ্ছে।

ওদের পথরোধ করল কিশোর। অনুরোধের সুরে বলল, টেরি, কেমন আছো? চলো না আমাদের বাড়িতে। খেলবে।

আঁতকে উঠল টেরি। ওরিব্বাপরে! তোমার সঙ্গে? না বাবা, দৈত্যের সঙ্গে খেলতে আমরা রাজি না। এই টাকি, চল চল!

প্রায় দৌড়ে চলে গেল টেরি আর তার দোস্তরা।

মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রইল কিশোর। এতটাই বুদ্ধিমান হয়ে গেছে ওরা, অস্বাভাবিক মানুষে পরিণত হয়েছে, সবাই এখন ওদের ভয় পায়।

মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। এ সময় সেখানে এসে হাজির মুসা আর রবিন। ওদেরও মন খারাপ। মুসার মুখ দেখে মনে হলো কেঁদে ফেলবে।

কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

কেউ আমাদের সঙ্গে খেলতে রাজি হয় না, করুণ সুরে মুসা বলল।

যাকে বলি, সেই পালায়, রবিন বলল। সবাই আমাদেরকে বলে ফ্রীক।

কেউ কেউ বলে জিন-ভূতের আসর হয়েছে, কেউ বলে কবরস্থানে গিয়ে প্রেতাত্মা ঢুকিয়েছি মগজে…শুনতে শুনতে আর ভাল লাগে না, মুসা বলল।

অতিরিক্ত বুদ্ধিমান হয়ে যাওয়াটাও যে এতটা বিপজ্জনক, সেটা তো জানতাম না, রবিন বলল।

বিপজ্জনক তো বটেই, প্রচণ্ড দুঃখেরও, মুসা বলল। এরচেয়ে তো বোকা থাকাটাই ভাল ছিল।

না, তা ছিল না,  মাথা নাড়ল কিশোর। অস্বাভাবিক থাকাটাই বিপজ্জনক, সেটা বোকাই হোক আর বুদ্ধিমানই হোক। তিনজনেরই বুদ্ধি এখন এক রকম হয়ে গেছে আমাদের। কারও চেয়ে কেউ কম নই, তাই নিজেরাও আর আগের মত খেলতে পারছি না। কি যে করব বুঝতে পারছি না।

বুদ্ধি দিল রবিন, চলো, আবার আঙ্কেল জ্যাকের কাছে যাই। তাকে গিয়ে বলি, আমাদের স্বাভাবিক বুদ্ধিটা ফিরিয়ে দেয়ার কোন ব্যবস্থা করতে পারেন কিনা।

পারলে তো ভালই হতো… চিন্তিত ভঙ্গিতে ব্যাকপ্যাক পিঠে ফেলল কিশোর।

হলরূম ধরে এক সারিতে এগিয়ে চলল ওরা।

আগে আগে চলছে রবিন।

সামনে দুটো ছায়া পড়েছে হলরুমের মেঝেতে।

ধাক্কা লাগবে ভেবে আচমকা দাঁড়িয়ে গেল রবিন।

তার পিঠের ওপর এসে পড়ল মুসা। কি হলো?

 নীরবে হাত তুলে দেখাল রবিন।

 একপাশ থেকে বেরিয়ে এল ছায়া দুটো।

 বাবা! মা! তোমরা? অবাক হলো রবিন।

ওদের দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন মিস্টার ও মিসেস মিলফোর্ড। গম্ভীর থমথমে চেহারা।

পেটের মধ্যে খামচি দিয়ে ধরার মত অনুভূতি হলো রবিনের। কিছু ঘটেনি তো? জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে, মা?

জবাবটা তোমরাই ভাল দিতে পারবে, এক এক করে রবিন, মুসা, ও কিশোরের ওপর দৃষ্টি ঘুরে. এল মিস্টার মিলফোর্ডের। রবিনের ওপর এসে স্থির হলো আবার। মিস্টার ক্রেগ আমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন। মুসার মা-বাবা আর কিশোরের চাচা-চাচীকেও ডেকেছেন।

কি করেছ তোমরা? মিসেস মিলফোর্ড জিজ্ঞেস করলেন।

কই, কিছু তো করিনি, জবাব দিল কিশোর।

কিছু করিনি আমরা। রবিন বলল।

এসো আমাদের সঙ্গে। প্রিন্সপ্যাল মিসেস অ্যান্ডারসনের ঘরে যেতে বলা হয়েছে আমাদের।

মিসেস অ্যান্ডারসন? ভুরু কুঁচকাল মুসা। তার ওখানে যাব কেন? কোন অপরাধ তো করিনি আমরা। হচ্ছেটা কি?

ইচ্ছে না থাকলেও যেতে হলো। দশ সেকেন্ড পর পিন্সপ্যালের অফিসের সামনের ঘরে ঢুকল ওরা। সামনের ঘরটা খালি। চারটে প্রায় বাজে। কর্মচারীদের সবার ছুটি হয়ে গেছে। বাড়ি চলে গেছে সেক্রেটারিরা।

পেছনের ঘর, অর্থাৎ মিসেস অ্যান্ডারসনের অফিসের দরজার দিকে এগোল সবাই। ঢোকার আগেই দরজায় বেরিয়ে এলেন তিনি। স্বাগত জানালেন ওদের। ডেকে ঘরে নিয়ে গেলেন। সেখানে ঘরের মাঝখানে একটা লম্বা টেবিলের সামনে বসা দেখা গেল কিশোরের চাচা-চাচী আর মুসার বাবা-মাকে। টেবিলের একধারে বসা মিস্টার ক্রেগ।:আরও একজন লোক আছেন সেখানে, মিস্টার বেলসন। স্কুল। পরিচালকদের সভাপতি। সবাই গম্ভীর।

মিসেস অ্যান্ডারসন এমনিতে হাসিখুশি, আন্তরিক, সবার সঙ্গেই উষ্ণ ব্যবহার করেন। কিন্তু এখন তিনিও গম্ভীর। রবিনের বাবা-মাকেও বসতে অনুরোধ করলেন তিনি।

শীতল দৃষ্টিতে তিন গোয়েন্দার দিকে তাকালেন মিস্টার বেলসন। ফ্যাকাসে চামড়া, চকচকে টাক, কঠোর চেহারা। ধূসর সুট আর সরু নীল টাই পরেছেন। যতবার দেখেছে তাকে গোয়েন্দারা, এই একই পোশাকে। এগুলো ছাড়া যেন আর কোন কাপড় নেই তার।

বাইরের ঘর আর অফিসের মাঝের দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে এলেন মিসেস অ্যান্ডারসন। ঘুরে গিয়ে বসলেন নিজের চেয়ারে। নিজের দুই হাতের দিকে তাকালেন। মুখ তুললেন। আসার জন্যে ধন্যবাদ দিলেন সবাইকে। ভঙ্গি দেখেই বুঝতে পারছে কিশোর, অস্বস্তিতে ভুগছেন মিসেস অ্যান্ডারসন। কি ভাবে কথাটা শুরু করব ঠিক বুঝতে পারছি না, অবশেষে শুরু করলেন তিনি। অদ্ভুত এক সমস্যায় পড়ে গেছি আমরা।