১২.
দীর্ঘশ্বাস ফেলল কিশোর।
চোখ নামাল রবিন। মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল।
তারমানে…তারমানে আবার ফেল করলাম। বিড়বিড় করল মুসা।
জবাব দিলেন না মিস্টার ক্রেগ। লম্বা লম্বা পায়ে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ালেন তিনি। তাকিয়ে রইলেন মেঘে ঢাকা ধূসর আকাশের দিকে।
দোষটা বোধহয় আমারই ছিল, ওদের দিকে পেছন দিয়ে রেখেছেন তিনি। ভাল করার জন্যে অনবরত চাপ দিয়ে যাচ্ছিলাম তোমাদের ওপর। মরিয়া হয়ে তাই এ কাজটা করে বসলে।
আচমকা ঝটকা দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন ওদের দিকে। কিন্তু কল্পনাই করতে পারিনি এ ভাবে আমাকে ঠকাবে তোমরা। নকল করে লিখবে।
নকল। বুঝতে পারল না কিশোর।
হাঁ হয়ে গেছে রবিন।
মুসা তাকিয়ে আছে চোখ বড় বড় করে।
তিনজনেই ভাল করেছ তোমরা, মিস্টার ক্রেগ বললেন। খুব ভাল। প্রতিটি অংকের সমাধান করেছ। একটা অংকও ভুল হয়নি। কি প্রমাণ হয় এতে? দেখে দেখে লিখেছ। তিনটে খাতা তুলে নিয়ে ওদের দিকে ছুঁড়ে দিলেন তিনি। কেন করলে এ কাজ? আমাকে খুশি করার জন্যে নকল ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না?
কিন্তু…আমরা তো নকল করিনি। কিশোর বলল।
খুব মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করেছি আমরা, রবিন বলল। আর কিছুই করিনি।
তাই তো, মুসা বলল। কোন রকম চালাকি করিনি আমরা।
আসলে তো মগজ উন্নত করার ওষুধ খেয়ে বুদ্ধি বেড়ে গেছে আমাদের, ভাবল কিশোর। কিন্তু টিচারকে বলল না সেকথা।
খাতার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে নম্বর দেখে বিস্ময়ে অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে আসতে থাকল রবিনের মুখ থেকে। বিশ্বাস করতে পারছে না। তবে কি সত্যি কাজ করেছে মগজ উন্নত করার ওষুধ? বুদ্ধিমান হয়ে গেছে ওরা?
তোমাদেরকে আমি পছন্দ করি, মিস্টার ক্রেগের কথা শুনে মুখ তুলে তাকাল রবিন। তাই এবার আর প্রিন্সপ্যালের কাছে পাঠালাম না। তবে এরপর আর এ ধরনের অন্যায় করলে কিন্তু আর মাপ করব না।
কিন্তু…স্যার…আমরা…কথা বের করতে পারছে না মুসা।
সত্যি বলছি, নকলটকল কিছু আমরা করিনি, কিশোর বলল।
অধৈর্য ভঙ্গিতে চোখ ওল্টালেন মিস্টার ক্রেগ। আঙুল তুলে নাড়লেন। বললাম তো, এবারকার মত মাপ করে দিলাম। এ কাজ কেন করেছ, তা-ও বুঝতে পারছি। দাও, দেখি, টেস্ট পেপারগুলো ছিঁড়ে ফেলি। কাল আবার নতুন খাতা দেব। নতুন প্রশ্নপত্র।
কিন্তু, স্যার, আমরা… বলতে গেল কিশোর।
বললাম তো, নতুন করে পরীক্ষা দিতে হবে তোমাদের, কোন কথা শুনতে চাইলেন না মিস্টার ক্রেগ মনোযোগ দিয়ে পড়বে আজ রাতে। যাতে পাস করতে পারো। আজকের কথা তাহলে আর মনে রাখব না আমি।
.
টিচারের ধমক আর রাগারাগি নিয়ে মাথাই ঘামাল না ওরা। আনন্দে নাচতে নাচতে রাড়ি ফিরল।
বুদ্ধিমান হয়ে গেছি আমরা, কিশোর বলল। মগজের স্থবিরতা কেটে গেছে। বোকামি শেষ।
সব আঙ্কেল জ্যাকের কৃতিত, রবিন বলল। তিনিই আমাদেরকে বুদ্ধিমান বানিয়ে দিয়েছেন। ভেবে দেখো, কিশোর, দুনিয়ায় কি একটা সাংঘাতিক অবস্থার সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন তিনি। সমস্ত বোকাদেরকে তো বুদ্ধিমান বানাবেনই, মগজ উন্নত করার ওষুধ বেচে বেচে নিজেও কি পরিমাণ বড়লোক হয়ে যাবেন, কল্পনা করতে পারো?
সব বোকাদের নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই, জবাবটা দিল মুসা। আমি শুধু আমাদের কথা ভাবছি। তুমি কল্পনা করতে পারো, স্কুলে সব বিষয়েই এ প্লাস পেয়ে গেলে কি একটা সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটে যাবে?
এখনই অত আশা করে ফেলাটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না, গম্ভীর সুরে কিশোর বলল। সব বিষয়ে এ প্লাস পাওয়ার বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা উচিত। নইলে পরে দুঃখ পেতে হবে। নিশ্চয় আমাদের ভাগ্য ভাল, সব। প্রশ্ন কমন পড়েছিল, তাই ওই পরীক্ষাটায় আমরা ভাল করে ফেলেছি। সবগুলোতেই যে এমন করব, তা না-ও হতে পারে। দেখা যাক, আগামী কাল কি
ওটাতেও এ পেয়ে যাব, জোর দিয়ে বলল রবিন, এ ব্যাপারে আর কোন সন্দেহ নেই আমার। এমনকি সেটা পাওয়ার জন্যে পড়তেও হবে না আমাদের। মহা উল্লাসে ব্যাকপ্যাকটাকে ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে লুফে নিল সে।
বাকি পথটা যেন উড়ে পেরোল তিনজনে।
রবিনদের বাড়িতে ঢুকল ওরা। লিভিং রূমে ঢুকে রিনিতাকে দেখতে পেল। কতগুলো প্লাস্টিকের টুকরো জোড়া দিয়ে ম্যাপ বানানোর চেষ্টা করছে সে।
এখনও এই নিয়েই পড়ে আছো, রবিন বলল। এক খেলা খেলতে বিরক্ত লাগে না তোমার?
না লাগে না, রিনিতা জবাব দিল।
মুসা হেসে জিজ্ঞেস করল, দেব জোড়া লাগিয়ে?
দিলে তো ভালই হতো। কিন্তু তোমরা হাঁদারা কি পারবে? মাথায় গোবর ছাড়া কিছু নেই।
দাও তো দেখি, হাত বাড়াল কিশোর।
থাক থাক, যেটুকু করেছি, সেটাও নষ্ট করার দরকার নেই, কিশোরের হাতটা সরিয়ে দিল রিনিতা।
আরে দিয়েই দেখোনা, রবিন বসে পড়ল রিনিতার পাশে। কিশোর আর মুসাও বসল।
প্রথমেই ইনস্ট্রাকশন শীট–যেটা দেখে দেখে সাজাতে হয়, সেটা ছিঁড়ে কুটি কুটি করল রবিন।
চিৎকার করে উঠল রিনিতা, হায় হায়, এ কি করলে! সাজাব কি করে এখন? কাঁদতে শুরু করল সে।
হেসে উঠল রবিন। ওই শীটের আর প্রয়োজন পড়বে না।
দ্রুতহাতে জোড়া দিতে শুরু করল সে। তাকে সাহায্য করল কিশোর আর মুসা।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্লাস্টিকের মস্ত একটা ওয়ার্ল্ড ম্যাপ তৈরি হয়ে গেল।
চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল রিনিতা। বিশ্বাস করতে পারছে না। তারপর বিস্ময়টা যেন বিস্ফোরিত হলো তার। চিৎকার করে উঠল, কি ভাবে করলে।
পানির মত সহজ, হাসতে হাসতে বলল রবিন।
তুমি কি ভেবেছিলে চিরকালই আমরা হাঁদা থেকে যাব, হেসে বলল রবিন।
কিশোর কিছু বলল না। নীরবে উপভোগ করতে লাগল ব্যাপারটা।
.
জানালা দিয়ে চুরি করে পুরো ব্যাপারটাই লক্ষ করল গাজুল আর মাজুল।
মাজুল অবাক, তারমানে সত্যি সত্যি ওষুধে কাজ হয়ে গেল।
হাসিমুখে মাথা ঝাঁকাল গাজুল।কেন, নিজের চোখেই দেখলে। যাক, বাঁচা গে, বারা। নতুন করে আর কারও খোঁজ করা লাগল না। আমাদের গোলাম আমরা। পেয়ে গেছি।