গল্পগ্রন্থ
উপন্যাস
অগ্রন্থিত
নাটক
ছড়া

জয়দ্রথ বধে ঘনাদা

জয়দ্রথ বধে ঘনাদা

(১)

মহাভারতে নেই।

না, আছে।

কোথাও নেই।

আলবত আছে। ওই মহাভারতেই।

বাজে কথা। পড়েছ মহাভারত?

পড়েছি বলেই বলছি। ওই মহাভারতেই আছে, ভালো করে পড়ে দেখো।

ওপরের কোটেশন চিহ্ন দেওয়া বাক্যালাপগুলো পড়েই ওগুলোর অকুস্থল বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেন নামে কোনও গলির একটি না নতুন না-পুরাতন মুক্তছাদের একটি মাত্র ত্রিতল নাতি-প্রশস্ত গৃহযুক্ত অট্টালিকা বলে যাঁরা ধরে নিয়েছেন, তাঁরা ভুল কিছু করেন নি।

কথাগুলি ওই বাহাত্তর নম্বরের দোতলার বৈঠকি ঘরেই শোনা গেছে। এবং সেগুলি তেতলার টঙের ঘরের সেই তিনি-কে শোনাবার জন্যই উচ্চারিত।

কিন্তু এ মেসবাড়ির সে মামুলি দস্তুরের সঙ্গে মিল ওইটুকুই—ওই ন্যাড়া ছাদের সিঁড়িতে টঙের ঘরের তাঁর চটির শব্দ পাওয়া থেকে সে শব্দ বারান্দায় এসে পৌঁছনো পর্যন্ত গলা ছেড়ে তাঁকে শোনাবার মতো আওয়াজে ওইসব আলাপ উত্তেজিত হয়ে চালিয়ে যাওয়া।

মিলটা তারপর ওইখানেই শেষ। তাঁর চটির আওয়াজ বারান্দা থেকে আমাদের বৈঠকি ঘরের দিকে এগগাবার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের চাল একেবারে আলাদা। অনেকদিন অনেক গোপন পরামর্শসভার তর্কাতর্কির পর ঘনাদার ওপর এই চাল। চালাই সাব্যস্ত হয়েছে।

এ চালের স্বপক্ষে সবচেয়ে জোরালো ওকালতি করেছে গৌর। বলেছে, ঘড়ি কি টিকটিক বন্ধ করে টিকতে পারে? জিন্দা আর জাগা থাকলে গোলা পায়রা কি বকবকম থামাতে পারে? নিলেমের হাটের ফড়ের সবচেয়ে বড় সাজা কী? কথার তুবড়ি ছোটাতে না পারুক, দু-চারটে জুতসই ফোড়ন কাটতে না পারা। ঘনাদাকে সেই সাজাই আমরা দেব।

তারপর দেখব, গৌরকে মদত দিয়েছে শিশির, এ সাজায় চিড়বিড়িয়ে মৃগীর রুগি না হয়ে উঠে উনি ক-দিন চাঙ্গা থাকতে পারেন?

ঘনাদাকে এই মোক্ষম সাজা দিতেই আমরা ক-দিন এই নতুন চাল চালছি! চাল খুব ঘোরালো প্যাচালো কিছু নয়। শুধু ঘনাদার মুখে এক রকম কুলুপ দেওয়ার ব্যবস্থা।

চালটা সোজাসুজি তাই এই। সকাল বিকেল তেতলার ন্যাড়া ছাদ থেকে নামবার সিঁড়িতে ঘনাদার চটি ফটফটানি শুনলেই আমরা তাঁকে শোনাবার মতো ছাড়া গলায় ওই মহাভারত বা আর কিছু নিয়ে জোর তর্ক শুরু করব। কিন্তু তিনি বারান্দায় নেমে বৈঠকি ঘরে এসে ঢোকার আগেই সব একেবারে চুপ।

তিনি প্রথমবারে ওই অবস্থায় ঘরে এসে মুখে কিছু বলেননি, শুধু একটু সন্দিগ্ধ বিস্ময়ে আমাদের সকলের মুখের ওপর চোখ বুলিয়েছিলেন।

কিন্তু আমরা সবাই তখন একেবারে ধোওয়া তুলসি পাতা। খল প্যাঁচ কিছু আমাদের মুখে ফুটবে কোথা থেকে?

দ্বিতীয়বার ঘনাদা আর মুখ না খুলে পারেননি।

সেদিন আমরা একটু অপ্রস্তুতই ছিলাম। ঘনাদা তাঁর বাঁধাধরা সময়ের একটু আগে নেমে আসায় ভেবেচিন্তে তৈরি করে রাখা কিছু তর্ক তুলে তাঁকে ছটফটানি ধরাবার ব্যবস্থা করতে পারিনি। তার জায়গায় হঠাৎ ন্যাড়া সিঁড়িতে তাঁর চটির আওয়াজ পেয়ে যা তৎক্ষণাৎ মাথায় এসেছে তাই শুনিয়েছি গলা চড়িয়ে।

না, কালবোশেখি আর হবে না। শিশিরই প্রথম যা হোক করে একটা প্রসঙ্গ তুলেছে।

হবে না মানে? শিবু যেন মানহানির মামলা রুজু করেছে। কালবোশেখি বন্ধ হলে-

এ দেশ রাজস্থান হবে। শিবুর খুঁজে না পাওয়া জবাবটা পূরণ করে দিয়েছিল গৌর।

হবে কেন? রাজস্থানই তো হচ্ছে। শিশির জোর গলায় ওই শেষ কথাটি বলেই চুপ হয়ে গিয়েছিল, কারণ বারান্দার দরজা দিয়ে ঘনাদা তখন আড্ডাঘরে পা দিয়েছেন।

আমাদের সকলের মুখ হঠাৎ কুলুপ-আঁটা হয়ে গেলেও ঘনাদা কিন্তু আগের দিনের মতো নিজেও চুপ হয়ে থাকতে পারেননি। দরজা থেকে এসে তাঁর মৌরসি আরামকেদারাটি দখল করতে করতেই নিজের আগ্রহটা লুকোতে একটু হালকা সুর লাগিয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন—কী তর্ক হচ্ছিল হে?

আমরা সবাই তখন বোবা। প্রশ্নটা যেন বুঝতেই পারিনি, এমনভাবে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করেছি।

ঘনাদা অধৈর্যটা পুরোপুরি আর চাপতে না পেরে একটু ঝাঁঝালো গলাতেই বলেছেন—কী নিয়ে অত চেঁচামেচি করছিলে, বলেই ফেলো না।

এতক্ষণে যেন অতি অনিচ্ছায় মুখ খুলে গৌর বলেছে, আজ্ঞে, ও কিছু না!

কিছু না! ঘনাদা বেশ কষ্ট করেই গলাটা যথাসাধ্য ঠাণ্ডা রেখে বলেছেন, কিন্তু রাজস্থান নিয়ে কী যেন চেঁচাচ্ছিলে মনে হল?

রাজস্থান! প্রথমে বেশ একটু অবাক হবার ভান করে, তার পর উদাসীন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললাম, হ্যাঁ, কিছু বলছিলাম বোধহয়, ঠিক মনে পড়ছে না।

মনে পড়ছে না। ঘনাদার গলার আওয়াজেই এবার আর সন্দেহ করবার কিছু থাকে না যে সলতের আগুন খোলের ভেতরের মশলায় গিয়ে লেগেছে।

তা লাগুক! তবু এখনও নয়। ও সোঁ-সোঁ আওয়াজ পেয়েই এখুনি ছাড়লে কাজের কাজ কিছু হবে না। আঙুলের টিপুনিতে শুধু একটু ঘুরপাক খেয়েই মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে ফেঁসে যাবে।

তাই ভেতর থেকে একেবারে ঠিকরে বার হবার মতো প্রচণ্ড সেই ঠেলাটা আসার জন্য আর একটু অপেক্ষা করতে হবে।

একবার সে ছুটি-কি-ফাটি বেগ এসে গেলে আর ভাবনা নেই। দু-আঙুলে টিপে একটু পাক দিয়ে ছেড়ে দিলেই উড়ন তুবড়ি ক-পাক ঘুরে মাটি ছুঁতে গিয়েই আবার যেন ছোঁ মারা হয়ে তেশূন্যে উঠে যাবে।

যার জন্য অপেক্ষা করছিলাম সেই প্রচণ্ড বেগের ঠেলাই এরপর একদিন টের পেলাম।

শুধু সোঁ-সোঁ ডাক নয়, যে হাতের যে যে আঙুলে ধরে রাখা, সব একেবারে যেন ছিঁড়ে নিয়ে ছুটে যাবার ছটফটানি।

মওকা বুঝে আমরাও ঠিকমতো পাক লাগালাম এবার।

মওকাটা এল মহাভারতের কথা নিয়েই।

আমাদের অবশ্য সেদিন আগে থাকতে রিহার্সেল দিয়ে তৈরি থাকার সুবিধে ছিল। ন্যাড়া ছাদের সিঁড়ির মাথায় ঘনাদার চটি ফটফটিয়ে উঠতেই উদারামুদারা বাদ দিয়ে একেবারে তারায় তান ছেড়েছিলাম সবাই মিলে।

সব বাজে কথা!—প্রথম গলাবাজিটা গৌরের—মহাভারতে ও-সব কিছু নেই।

আলবত আছে! শিবুর গর্জন, পড়েছিস মহাভারত?

হ্যাঁ, পড়েছি।-গৌরের আস্ফালন—সব পড়েছি—ব্যাসদেব থেকে কাশীরাম দাস, সব।

শুধু যেমন-তেমন করে পড়লেই হয় না।—আমার শিবুকে সমর্থন—পড়তে জানা চাই। তাহলে দেখবি মহাভারতে যা চাস সব আছে? যা চাইব সব আছে? গৌরের ভেংচি কেটে টিটকিরি।

হ্যাঁ, মহাভারতে আছে। ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ঘনাদার আজ আর প্রশ্ন-ট্রশ্ন কিছু নয়—একেবারে সরাসরি বাড়ি কাঁপানো-গলায় ঘোষণা।

ভেতরে চলে এসে মৌরসি আরামকেদারায় বসার সঙ্গে সঙ্গেই সে ঘোষণায় আর একটু সংযোজন—পড়তে জানলেই পাওয়া যায়।

পড়তে জানলেই পাওয়া যায়? হ্যাঁ, আজ আর মুখে আমাদের কুলুপ-টুলুপ নয়। একেবারে প্রথম থেকেই যুদ্ধংদেহি-তাল-ঠোকা শিশিরের গলা দিয়ে মহাভারতে একটা অতি সোজা প্রশ্নের জবাব কোথায় পাব বলতে পারেন?

প্রশ্নটা কী? ঘনাদা শিশিরের আওলড়েঙ্গে গোছের তাল ঠোকার সঙ্গে তার বাড়িয়ে ধরা সিগারেটের টিনটার ভেতরও আঙুল চালিয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন।

প্রশ্নটা হল—শিশির যেন ভেবে নিতে গিয়ে মুশকিলে পড়ে হঠাৎ দুম করে বলেছে, এই—এই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধটার কথাই ধরুন না। ওটা কবে হয়েছে কিছু বলতে পারেন? আছে সেকথা মহাভারতে কোথাও? কই, বলুন-না?

কিন্তু বলবেন কী করে? ঘনাদা তখন শিশিরের টিন থেকে হাতানো সিগারেটগুলোর একটা ধরাতেই ব্যস্ত।

ঘনাদা কি সত্যি ফাঁপরে পড়েছে নাকি? অতক্ষণ ধরে সিগারেট ধরানো নিজের সেই বেসামাল অবস্থা ঢাকবার একটা ফিকির। কিন্তু এ ফিকির আর কতক্ষণ চালাবেন?

চালাতে পারলেন না। সিগারেট ধরানো শেষ করে শিশিরের নতুন লাইটারটা নিজের মুঠোতেই রেখে দিয়ে ঘনাদা প্রশ্নটা যেন ঠিক শোনেননি এমন ভাব দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁ, কী যেন জানতে চাইছিলে?

ঘনাদাকে বেকায়দায় পেয়ে আমরা সবাই যেন ঘোড়ার মুখে লাগাম দিয়ে তৈরি। শিশিরের বদলে শিবই সবিস্তারে আমাদের প্রশ্নটা ঘনাদাকে শোনালে। তার সঙ্গে আমিই এবার শেষ তালটা ঠুকে দিয়ে বললাম, যা শুনলেন তার জবাবটা কোথাও আছে মহাভারতে?

আছে! ঘনাদার বেশ জলদগম্ভীর স্বর। এটা ফাঁকা আওয়াজ না, সত্যিকার একটা পাকা চালের পাঁয়তারা পরখ করবার জন্য যা বলব ভাবছিলাম তা আর বলবার দরকার হল না।

ঘনাদা নিজে থেকেই বললেন, অভিমন্যু বধটা পড়েছ?ভাল করে পড়ে দেখো।

অভিমন্যু বধ পড়ব? কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের তারিখ জানতে?

আমাদের সকলের সব কটা চোখই তখন বুঝি কপালে। কিন্তু ধাঁধাটা যাঁর সরল করবার দায়, তিনি তো হঠাৎ আরামকেদারা ছেড়ে উঠে এ ঘর ছেড়েই চলে যাচ্ছেন। শিশিরের লাইটারটা অবশ্য ফেরাতে ভুলে গিয়ে।

যেতে যেতে একটু দয়া তিনি শুধু করলেন। বারান্দার দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবার আগে কটা কথা আমাদের দিকে যেন ছুঁড়ে দিয়ে গেলেন।

কথাগুলো হল—ভালো করে পড়ো। তা পড়লে যা কিছু আসল খেই সব ওখানেই পাবে।

 

(২)

আমরা ঘনাদাকে বেকায়দায় ফেলে জব্দ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তিনিই আমাদের থ বানিয়ে গেলেন।

তিনি ঘর থেকে হাওয়া—কিন্তু আমাদের বুদ্ধিসুদ্ধিও সেই সঙ্গে যেন জট পাকানো।

অভিমন্যু বধ পালা পড়ো, খেই পাবে—তিনি বলে দিয়ে গেলেন। এটা কি ভাঁওতা? কিন্তু রাম-ভাঁতা হলেও আমাদের তা হেসে উড়িয়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে থাকলে চলবে না। ভাঁওতাটা ধরিয়ে দেবার জন্যই অভিমন্যু বধের পর্বটা কাশীরাম দাসে অন্তত পড়তে হবে।

অন্য উপায় যখন নেই তখন আনাও কাশীরাম দাস। পড়ো অভিমন্যু বধের গোটা পালাটা।

চারজনে পালা করে তাই পড়লাম। সেই—

যুদ্ধিষ্ঠির বলে বাপু শুনহ বচন।
ব্যূহ ভেদিবারে তুমি জান প্রকরণ॥
অভিমন্যু বলে তবে শুন নরমণি।
প্রবেশ জানি যে আমি নির্গম না জানি॥

থেকে দ্রোণের সেই অতি দুঃখের স্বীকারোক্তি–

ন্যায়যুদ্ধে অভিমন্যু জিনিতে যে পারে।
কহিলাম হেন জন নাহিক সংসারে।
কৃষ্ণের সে ভাগিনেয়, অর্জুনের সুত।
দেখিলে সাক্ষাতে যার সমর অদ্ভুত॥
তাহারে নারিব ন্যায়যুদ্ধে কদাচন।
কহিনু জানিও মম স্বরূপ বচন॥

তারপর দুর্যোধনের কথায় সেই সপ্তরথীর একসঙ্গে অভিমন্যুকে আক্রমণ–

বেড়িল বালকে গিয়ে সপ্ত মহারথী।
হানাহানি মারামারি যুদ্ধ চলে অতি॥

আর এসব বিবরণের শেষে সেই—

সম্মুখ সমরে বীর ছাড়িল জীবন।
গমন করিল চন্দ্রলোকে সেইক্ষণ॥

শেষ পর্যন্ত কিছুই পড়তে বাদ রাখলাম না। কিন্তু আমরা যা চেয়েছি কোথায় সেই জবাব?

সেদিন বিকেলেই তাঁর বিকেলের সরোবরসভায় যাবার মুখে ন্যাড়া সিঁড়ির নীচেই তাঁকে ধরলাম।

কই? শুধু অভিমন্যু বধের বৃত্তান্ত নয়, গোটা দ্রোণপর্বই তো পড়ে ফেললাম। কোথাও কিছু পেলাম না।

ঘনাদা কি আমাদের এমন দল বেঁধে চড়াও হওয়াতে ভড়কালেন? বিন্দুমাত্র না।

বরং আমাদের আনাড়িপনায় যেন হতাশ হয়ে করুণা করে বললেন, তার মানে সব পড়েও আসল খেইটা ধরতে পারোনি।

আসল খেইটা কোথায়? আমাদের গলায় অবিশ্বাসের সুরটা বেশ স্পষ্ট।

কোথায়? ঘনাদা যেন ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে বললেন, জয়দ্রথ কে, তা জানো?

জানব না কেন! খুব জানি।—–আমাদের আস্ফালন।

তাহলে ওই জয়দ্রথের ব্যাপারটাই ভাল করে আর একবার পড়ো, বলে ঘনাদা হনহন করে আমাদের ছেড়ে বারান্দা হয়ে নীচে নেমে গেলেন।

আমরা রাগব, না হাসব বুঝতে না পেরে তখন সবাই হতভম্ব।

জয়দ্রথের ব্যাপারটা ভাল করে জানলেই আমাদের প্রশ্নের জবাব পাব? কী পেয়েছেন আমাদের ঘনাদা? আর কত এমন গুল ঝাড়বেন? নিজের গুল নিজেই শেষে সামলাবেন কী করে?

তবু জয়দ্রথের ব্যাপারটা পুরোপুরি আর একবার না পড়ে আমাদের উপায় নেই। তাই পড়লাম। অভিমন্যু বধে যুধিষ্ঠিরের সেই বিলাপ থেকে—

যুধিষ্ঠির বলিলেন শুন বিবরণ।
চক্রব্যূহ করি দ্রোণ করে মহারণ॥
ব্যূহ ভেদি যুদ্ধ করে নাহি হেন জন।
অভিমন্যু প্রতি তবে কহি সে কারণ॥
এতেক শুনিয়া পুত্র লাগিল কহিতে।
নির্গম না জানি ব্যুহে, জানি প্রবেশিতে॥
তথাপিহ পাঠাই না করি বিচার।
প্রবেশিল ব্যুহে শিশু করি মহামার॥
তার পিছু যাই সবে হেন করি মনে।
ব্যূহদ্বার রুদ্ধ করে সিন্ধুর নন্দনে॥
জয়দ্রথে জিনিবারে নারে কোন জন।
সে কারণে মরিলেক অর্জুন নন্দন॥

থেকে—

জয়দ্রথ হেতু মরে অভিমন্যু বীর।
শুনি ধনঞ্জয় ক্রোধে হইল অস্থির॥
মহাক্রোধে বলিলেন ইন্দ্রের নন্দন।
আমি যাহা বলি তাহা শুন সর্বজন।
জয়দ্রথ হেতু মরে অভিমনু বার।
এক বাণে নিপাতিব তাহার শরীর॥

এসব কিছু নিয়ে সেই শ্রীকৃষ্ণের মায়া কৌশলে জয়দ্রথ বধ পর্যন্ত আগাগোড়া সবই পড়লাম। কিন্তু তার মধ্যে আমরা যা চাই সে জবাব কোথায়?

সেই কথাই বলতে পরের দিন সকাল হতেই সবাই মিলে টঙের ঘরে গিয়ে হাজির। অবশ্য উপযুক্ত ভেট না নিয়ে নয়।

ঘনাদা তখন সযত্নে তাঁর গড়গড়ার কলকেতে টিকে সাজাচ্ছিলেন। বনোয়ারির বয়ে-আনা ট্রের দুটি বড় বড় প্লেটে হিঙের কচুরি আর অমৃতিগুলির সুগন্ধ আর চেহারা তো বটেইবায়না দেওয়া ডবল সাইজগুলো দেখেও খুশিটা একেবারে গোপন করতে পারলেন না। টিকে সাজানো কলকেটা গড়গড়ার মাথায় বসিয়ে তামাকটা ধরতে দিয়ে বেদিগোছের তাঁর লম্বা চওড়া নিচু চারপায়াটির যথাস্থানে এসে বসে বললেন, এত সকালে এই হাতিমার্কা মাল কোথায় পেলে হে?

তাঁর এই খুশির ওপরই বড় ঘা দেবার জন্য তৈরি থেকে বললাম, আজ্ঞে, ওগুলো আমাদের গলির মোড়ের রাদুর দোকানেরই, তবে কাল প্রায় মাঝরাতে বায়না দেওয়া।

ঘনাদা তখন কচুরির প্লেট কোলের কাছে টেনে নিয়ে তার সদ্ব্যবহার শুরু করেছেন। সেই অবস্থাতেই যতটুকু বিস্ময় প্রকাশ করা সম্ভব তাই করে বললেন, তা মাঝরাতে কেন?

আজ্ঞে, তখনই আমাদের পড়াটা শেষ হল কিনাবড় গোলাটা ছাড়বার আগে আমরা একটু ছররা ছিটোলাম।

পড়া শেষ হল? কী পড়া? ঘনাদাকে সত্যিই দু-চোয়ালের বাঁধানো দাঁতের কাজ একটু থামাতে হল। তারপর পূর্ব কথাটা স্মরণ করে কতকটা অবহেলা ভরে বললেন, ও, তোমাদের যা পড়তে বলেছিলাম, সেই জয়দ্রথের কথা সব পড়লে?

হ্যাঁ—আমরা কামানটা দাগলাম—পড়ে দেখে বুঝলাম আপনি নিজে জয়দ্রথের বৃত্তান্ত কিছুই পড়েননি, কারণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ কবে হয়েছিল তার কোনও হদিসই সেখানে নেই।

ঘনাদা তাঁর চোয়াল নাড়া থামিয়ে হঠাৎ কি একটু টান হয়ে বসলেন! বসা আশ্চর্য কিছু নয়, কারণ এরকম সোজাসুজি ঘা তাঁর ওপর আমরা কখনও দিইনি।

এরকম ঘা খেয়ে ঘনাদা যদি একটু চমক খেয়ে থাকেন, তা মাত্র দু-সেকেন্ডের জন্য। সে মুহূর্তটুকু পার হতেই আবার যথাপূর্ব চোয়াল নাড়তে নাড়তে চোখে একটু উপহাসের ঝিলিক ফুটিয়ে বললেন, নেই নাকি? আচ্ছা নীচে গিয়ে বোস। আমি সেখানেই গিয়ে সব শুনছি।

প্রতিবাদ না করে নীচেই নেমে গেলাম বটে, কিন্তু মেজাজ তখন সকলেরই আমাদের খোশ। ঘনাদা এই সময় নেওয়া মানে যে তাঁর এখন সসেমিরে অবস্থা তাতে আর সন্দেহ নেই। তা সময় তিনি যত পারেন, নিন। শেষ মাত-এর চাল এখন আমাদেরই মুঠোয়। হাবুড়ুবু খেতে খেতে তিনি ধরবার মতো কুটোটিও পাবেন কিনা সন্দেহ।

শেষ পর্যন্ত ঘনাদা এলেন, বাইরে বেরুবার মতো সাজপোশাকে একেবারে তৈরি হয়ে। শেষে মৌরসি, কেদারাটি দখল করে যথারীতি শিশিরের বাড়িয়ে ধরা টিনটি থেকে সিগারেট নিতে গিয়ে টিনটি হাতে রাখতেও ভুললেন না। তারপর সিগারেট ধরিয়ে যেন ধীরে সুস্থে বললেন, আচ্ছা, তোমরা কী পড়েছ শুনি একটু!

সবই পড়েছি। আমরাও ভারিক্কি চালে বললাম, জয়দ্রথের সেই আদি বৃত্তান্ত, পাণ্ডবদের বনবাসের সময়ে তাদের আস্তানা লুট করতে গিয়ে পাণ্ডবদের হাতে মার খাওয়া, বিশেষ ভীমের থাপ্পড়ে পুরো দু-পাটি দাঁত উপড়ে যাবার পর তার সেই বারো বছরের দারুণ তপস্যা আর শেষে বাধ্য হয়ে শিবঠাকুরের সেই বর দিতে চাওয়া—

শিব বলে বর চাহ সিন্ধুর তনয়।
এত শুনি জয়দ্রথ হরে প্রণময়।।
অনেক করিয়া স্তুতি বলয়ে বচন।
অবধান কর প্রভু মম নিবেদন।।
এই বর দেহ শূলপাণি।
পাণ্ডবগণেরে যেন রণে আমি জিনি।।
তাতে শিব যা বললেন, সেই—

শুন তবে সত্য কথা সিন্ধুর তনয়।
জিনিবে পাণ্ডবগণে বিনা ধনঞ্জয়॥

এইসব শেষ করে অভিমন্যু বধ আর তারপর জয়দ্রথই অভিমন্যুর সহায়হীন ভাবে যুদ্ধে হত হওয়ার প্রধান কারণ জেনে—

জয়দ্রথ হেতু মরে অভিমন্যু বীর।
শুনি ধনঞ্জয় ক্রোধে হইল অস্থির॥

আর তারপরে অর্জুনের সেই প্রতিজ্ঞা—

মহাক্রোধে বলিলেন ইন্দ্রের নন্দন।
আমি যাহা বলি তাহা শুন সর্বজন।।
জয়দ্রথ হেতু মরে অভিমন্যু বীর।
এক বাণে নিপাতিব তাহার শরীর।।

তারপর—

দাঁড়াও দাঁড়াও! ঘনাদাই হঠাৎ গম্ভীর গলায় বাধা দিয়ে আমাদের থামালেন— এর পর আসল বিবরণটা ওখানে নেই।

ওখানে নেই মানে! আমরা তাজ্জব—কোথায় আছে তাহলে? ব্যাসের মূল মহাভারতে?

না, ঘনাদা যেন দুঃখের সঙ্গে বললেন, সেখানেও ব্যাসদেব অর্জুনের খাতিরে একটু অদল বদল করে বলেছেন।

অদলবদল! আমরা একটু সন্দিগ্ধভাবে বললাম, কী রকম অদলবদল?

না, সেরকম কিছু নয়। ঘনাদা আশ্বস্ত করলেন, এই একটু বাড়িয়ে কমিয়ে উলটো-পালটা বসানো।

আমরা এ নিয়ে কিছু তর্ক তোলবার আগে ঘনাদা নিজে থেকেই আবার বললেন, এই যেমন অর্জন জয়দ্রথ বধের প্রতিজ্ঞা করে—এক বাণে নিপাতিব তাহার শরীর বলার পর যা থাকবার কথা তা নেই। অর্জুনের মুখে তারপর যা বসানো হয়েছে,

সে-সবও তার কথা নয়।

তার মানে? এবার আমরা সত্যিই হতভম্ব।

মানে, ওখানে যা থাকবার কথা তা হল, বলে ঘনাদা প্রায় সুর করেই আমাদের শোনালেন,

এত তীব্র পুত্রশোকে মূছাহত প্রায়।
অর্জুনের মুখে না আর বাক্য বাহিরায়॥
তখন চিৎকারী উঠি দেবকীনন্দন।
বলেন শুনহ সবে প্রতিজ্ঞা বচন॥
কালি যদি জয়দ্রথ বিনাশ না হয়।
সূর্যাস্তেই প্রাণ পার্থ ত্যজিবে নিশ্চয়॥
দিনান্তেও জয়দ্রথ না মরিলে কালই।
আত্মঘাতী হবে পার্থ নিজ চিতা জ্বালি।।

অর্জুনের হয়ে শ্রীকৃষ্ণই এসব কথা বলেছিলেন? ঘনাদা তাঁর শোলোক পড়া থামাবার পর আমরা বেশ সন্দিগ্ধভাবে জিজ্ঞাসা করলাম, মানে, এগুলো অর্জুনের তো মনের কথা না-ও হতে পারে? আর তা যদি না হয় তাহলে অর্জুনও একথা শুনেবেন না কি?

অর্জুন হয়তো বেশ একটু চমকেও গিয়েছিলেন, ঘনাদা তাঁর অনুমানটা বিস্তারিত করলেন, কিন্তু পুত্রশোকে তিনি তখন অধীর। শ্রীকৃষ্ণের কথা যত ভুলই হোক, তার প্রতিবাদের কোনও দরকারই আর তাঁর নেই।

সবই বুঝলাম, শিশির যেন পুলিশি জেরার ধরনে জানতে চাইলে, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ হঠাৎ কাল সূর্যাস্ত পর্যন্ত জয়দ্রথ বধের সময় বেঁধে দিয়ে অর্জুনকে অমন রীতিমত বেকায়দায় ফেলতে গেলেন কেন?

কেন তা তিনিই জানেন।—ঘনাদা ভক্তি গদগদ হলেন—তবে বিশ্বসংসার যিনি চালাচ্ছেন, চতুর চূড়ামণি সেই কৃষ্ণ বাসুদেবের নেহাত বাজে খামখেয়াল ওটা নিশ্চয় নয়। একটা কিছু মতলব তাঁর নিশ্চয় ছিল। দেখা যাক সে মতলব শেষ পর্যন্ত জানা যায় কি না।

ভক্তি গদগদ হয়ে আগের প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলেও ঘনাদাকে পুরোপুরি হড়কে পালাতে দিলাম না। জিজ্ঞাসা করলাম, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের কথাগুলো মহাভারতে অর্জুনের জবানিতে চালান হল কী করে?

সেটা স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণেরই ইচ্ছায়, ঘনাদা মহাভারতের বর্ণন-প্রমাদের রহস্য ভেদ করে বললেন, নিজের মহিমা তাঁর আর বাড়াবার দরকার নেই। তাই কীর্তির গৌরবটা অর্জুনকেই দিতে চাইলেন। মহামতি ব্যাসদেবও মানসবার্তায় তা টের পেয়ে। সেই ইচ্ছাপূরণে ত্রুটি করেননি।

আচ্ছা, অনেক কথাই জানালাম!—গৌর হঠাৎ ঘনাদাকে বেকায়দায় ফেলতে মূল মামলায় ফিরে গেল—কিন্তু এসব কথার মধ্যে আসল প্রশ্নের জবাব আছে কি? সে জবাব কোথায়?

ঘনাদা কি বেসামাল? হঠাৎ কোনও ছুতোয় তিনি কি ঘর ছেড়ে যাবার তাল করবেন এবার?

না। ভাঙলেও যিনি মচকান না, অমন সেই ঘনাদা অত সহজে দান ছাড়বার মানুষ নন।

বেশ ধীরে-সুস্থে হাতের সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে তিনি বললেন, আছে! আছে! জবাব ঠিক যেখানে থাকবার সেখানেই আছে। এরপর আর কী পড়লে শুনি না।

এরপর? শিবু মুখে যেন সত্যিকার অরুচি ফুটিয়ে বললে, এরপর তো সেই মামুলি থোড় বড়ি-খাড়া আর শ্রীকৃষ্ণের সেই সস্তা সস্তা ম্যাজিক দেখাবার ভড়কি!

ভড়কিটা কী রকম একটু শুনতে পাই না? ঘনাদার মুখে একটু বাঁকা-হাসি লাগানো বলে সন্দেহ হল।

বেশ, শুনুন তাহলে, শিবু তাল ঠোকার মতো করে ওখানেই আনিয়ে রাখা ঢাউস কাশীরাম দাস-খানি কাছে টেনে পাতা ওলটাতে ওলটাতে বললে, পরের দিন অর্জুন আর শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের রথে জয়দ্রথকে খুঁজে কী রকম হয়রান—দ্রোণাচার্যের বৃহ-রচনার কায়দায় জয়দ্রথই বা কেমন নিশ্চিহ্নভাবে লুকোল—সে সব বিবরণ পড়বার নিশ্চয় দরকার নেই, আমি শুধু ভড়কির বর্ণনাটুকুই পড়ছি।

শিবু সেই বিরাট কাশীরাম দাস খুলে এবার পড়তে শুরু করল–

জয়দ্রথে কোনো মতে পাওয়া নাহি যায়,
হতাশ হইয়া পার্থ সখাপানে চায়।
বলে, আর বৃথা কেন করি অন্বেষণ,
অগ্নিকুণ্ড জ্বালো দিব প্রাণবিসর্জন।
পার্থের হতাশা দেখি দেব নারায়ণ,
সখারে সাহস দিয়া কহেন তখন।
কি ভয় আছে রে ইথে উপায় সৃজিব,
জয়দ্রথে আজিকেই নিধন করিব।
এত বলি সুউপায় চিন্তি নারায়ণ,
সুদর্শনে করিলেন সূর্য আচ্ছাদন।
আচম্বিতে দেখে সবে হইল রজনী,
কুরুসেনা মধ্যে হল জয় জয় ধ্বনি।

ব্যাস? আর কী চাই?

শিবু তার কাশীরাম পড়া থামাতেই ওপরের মন্তব্যটি শুনে আমরা চমকে বক্তার দিকে চাইলাম।

না, আমাদের শুনতে কোনও ভুল হয়নি। বক্তা স্বয়ং ঘনাদা ছাড়া আর কেউ নন।

কিন্তু তিনি কী বললেন? কী? হঠাৎ বাতুল প্রলাপ বকতে শুরু করলেন নাকি? প্রলাপ না হলে কথা ক-টার মানে কী? ঘনাদাকেই সে কথা জিজ্ঞাসা করলাম।

মানে! ঘনাদা করুণার হাসি হেসে বললেন, মানে, যা চাও সবই তো পেলে!

সবই পেলাম! আমরা হাসব, না রাগে চেঁচাব বুঝতে পারছি না, তখন সেই অবস্থাতেই জিজ্ঞাসা করলাম, সব পেয়ে গেছি মানে আমাদের প্রশ্নের জবাবও পেয়ে গেছি বলতে চান? কোথায়?

কোথায় আবার?—ঘনাদা আমাদের মূঢ়তায় যেন বিস্মিত—এইমাত্র যা পড়লে ওই শোলোকগুলিতেই। তবে অবশ্য ঠিক মতো পড়তে জানা চাই।

ঠিক মতো আপনার পড়াটা কী শুনি?—এবার আমাদের আর গরম হবার ভান করতে হল না—ওই সুদর্শনে করিলেন সূর্য আচ্ছাদন পড়ে কী গভীর রহস্যের আপনি সন্ধান পেলেন বুঝতে চাই।

আরে!ঘনাদা মৃদু ভর্ৎসনার সুরে বললেন, রহস্য গভীর হবে কেন? একেবারে ওপরেই ভেসে রয়েছে। সুদর্শনে করিলেন সূর্য আচ্ছাদন মানে কি সত্যি সত্যি সুদর্শন চক্রে সূর্য ঢেকে দেওয়া? ওর আসল মানে, সে দিন ওই কুরুক্ষেত্র অঞ্চলে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের ইঙ্গিত দেওয়া। শ্রীকৃষ্ণ আর যেমন-তেমন কেউ নন, আর সব কিছুর সঙ্গে জ্যোতিষশাস্ত্রটাও তাঁর পুরোপুরি জানা। তিনি আগেই কষে জানতে পেরেছিলেন, কোনদিন ওখানে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ হবে। দিনটা ঠিক অর্জুনের জয়দ্রথ বধের প্রতিজ্ঞার পরের দিন হওয়ায় তিনি অমন করে অর্জুনের হয়ে কথা বলার ছলে অমন অসম্ভব প্রতিজ্ঞার কথা শুনিয়েছিলেন সবাইকে। যতদূর বোঝা যায়, সেদিন বেশ মেঘলা ছিল, সেই মেঘের আড়ালে বেশ খানিকটা বেলা থাকতেই হঠাৎ গ্রহণ শুরু হয়ে একেবারে পূর্ণগ্রাসে পৌঁছয়। দিন শেষ হয়ে সন্ধ্যা নামছে ভেবে জয়দ্রথকে নিয়ে কুরুযযাদ্ধারা অর্জুনের অগ্নিকাণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ-বিসর্জন মজা করে দেখতে আসে। আর তখনই পূর্ণগ্রাসের পর সূর্যের রাহুমুক্তি আবার শুরু হয়, আর দিনের আলো থাকতেই জয়দ্রথকে সামনে পেয়ে অর্জুনের প্রতিজ্ঞা পালনের কোনও অসুবিধা আর থাকে না।

এ বিস্তারিত ব্যাখ্যা শেষ করে ঘনাদা শিশিরের পুরো সিগারেটের টিনটি হাতিয়ে আরামকেদারা ছেড়ে ওঠবার উপক্রম করতে আমরা তাঁকে প্রায় জোর করে ধরে রেখে দাবি করেছি—কিন্তু আমাদের প্রশ্নের জবাব মহাভারতে কই?

এখনও সে কথা জিজ্ঞাসা করছ? আমাদের সম্বন্ধে তাঁর হতাশাটা ভাল করেই গলার স্বরে বুঝতে দিয়ে বললেন, আরে, সূর্যগ্রহণ কারওর খামখেয়ালে হয় না। তা হয় একেবারে নির্ভুল অঙ্কের হিসেবে। এই কদিন আগে আমাদের এখানে সূর্যের পূর্ণগ্রাস হয়ে গেছে। সত্যিকার জ্যোতির্বিদ কাউকে ধরে, এই গ্রহণ থেকে পিছনে হিসাব চালিয়ে সেই গ্রহণের তারিখ, জয়দ্রথ-বধ মানে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পল-বিপল পর্যন্ত নির্ভুল বলে দেবে।

আমাদের চোখগুলো কপালে উঠিয়ে রেখেই ঘনাদা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এবার আর তাঁকে বাধা দিতে পারলাম না।