জেরিনার কণ্ঠহার – ৫

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – কচুরির দুর্ভাগ্য

চোখের সামনে গাঢ় অন্ধকার নিয়ে কুমার যখন দাঁড়িয়ে রয়েছে আচ্ছন্নের মতো, তখন হঠাৎ ওপর থেকে শোনা গেল আবার সেই চিরপরিচিত, নির্ভীক, আনন্দময় কণ্ঠের উচ্চ হাস্যধ্বনি!

বিমল হাসছে!

কুমার নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলে না, কারণ সেই মুহূর্তেই তার দুই কান প্রস্তুত হয়েছিল একটা গুরুভার দেহের বিষম পতনধ্বনি শোনবার জন্যে!

অন্ধকারের আবরণের ভিতর থেকে নিজের চোখ দুটোকে প্রাণপণে মুক্ত করে নিয়ে কুমার প্রথমে মাটির দিকে তাকিয়ে দেখলে।—সেখানে ভোজালি দিয়ে কাটা দড়িগাছা পড়ে আছে বটে, কিন্তু কোনও যন্ত্রণাকর দৃশ্যের বা মানুষের রক্তাক্ত দেহের অস্তিত্ব নেই, আকস্মিক পুলকে উচ্ছ্বসিত হয়ে পরমুহূর্তেই উপর—পানে চোখ তুলে সে দেখলে, একটা বৃষ্টির জল বেরুবার লোহার মোটা নল ধরে তার বন্ধু বিমল নীচের দিকে নেমে আসছে! তাহলে তার কান ভুল শোনেনি—দুরাত্মা শত্রু এবং সাক্ষাৎ মৃত্যুকে উপহাস করে এইমাত্র হেসে উঠেছিল তার বন্ধুই?

বিপুল আনন্দে চিৎকার করে কুমার ডেকে উঠল, ‘বিমল, ভাই বিমল!’

বিমল নামতে নামতে বললে, ‘ভয় নেই কুমার, আমার আয়ু এখনও ফুরোয়নি।’

কুমার আরও উপর দিকে তাকিয়ে দেখলে। তেতলার জানলা থেকে অবলা এবং তার ভোজালি অদৃশ্য হয়েছে, ঝুলছে খালি কাটা দড়ির খানিকটা। তেতলার ছাদ থেকে জল বেরুবার পাইপটা জানলার পাশ দিয়ে দেয়াল বেয়ে নেমে এসেছে প্রায় ভূমিতল পর্যন্ত। এটা কুমার বরাবরই দেখে এসেছে, যত বড়ো বিপদ যত অকস্মাৎই দেখা দিক, বিমল উপস্থিত বুদ্ধি হারায় না কখনও। অবলার অস্ত্রাঘাতে দড়ি ছেঁড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বা ঠিক তার পূর্ব—মুহূর্তেই বিমল খপ করে হাত বাড়িয়ে তার পাশের পাইপটা চেপে ধরে খুব সহজেই আত্মরক্ষা করেছে।

নল ত্যাগ করে ভূতলে অবতীর্ণ হয়ে বিমল হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে বললে, ‘ভাই কুমার, মৃত্যু আমাকে গ্রহণ করলে না। বোধহয় এত সহজে মরবার জন্যে ভগবান আমাকে সৃষ্টি করেননি।’

কুমার বললে, ‘কিন্তু পাইপটা ওখানে না থাকলে কী যে হত, তাই ভেবেই আমার গা এখনও শিউরে উঠছে। বিমল, তুমি আজ বেঁচে গেছ দৈবগতিকে।’

বিমল বললে, ‘বন্ধু’ পাইপটা না পেলেও আমি বোধহয় মরতুম না। দড়ি ছেঁড়বার আগেই দড়ি ছেড়ে দোতলার কার্নিশ ধরে ঝুলতে পারতুম। আর দৈবের কথা বলছ? দৈবের সুযোগ তারাই নিতে পারে, বুদ্ধি যাদের অন্ধ নয় আর সাহস যাদের সর্বদাই সজাগ। দ্যাখো, অবলা যে দুরাত্মা সে বিষয়ে কোনওই সন্দেহ নেই। কিন্তু কেবলমাত্র সাহসী আর বুদ্ধিমান বলেই বারবার বেঁচে যাচ্ছে সে দৈবের মহিমায়।…যাক, এখন আর এসব আলোচনার সময় নেই। তুমি এখন এক কাজ করো কুমার। দৌড়ে এই বাড়ির সদর দিয়ে ভিতরে ঢুকে দ্যাখোগে যাও, সুন্দরবাবুরা অবলাকে ধরতে পারলেন কি না। যে—জানলা দিয়ে অবলা তেতলার ঘরে ঢুকেছে ওই জানলা থেকেই তুমি আমাকে সব খবর দিয়ো।’

কুমার বললে, ‘খবর দেব মানে? তুমি কি এইখানেই থাকবে?’

—’নিশ্চয়। নইলে অবলা যদি আবার ওই জানলা দিয়ে বেরিয়ে চম্পট দেয়?’

—’কিন্তু তার পালাবার উপায় তো আর নেই। দড়ি তো সে নিজের হাতেই কেটে দিয়েছে।’

বিমল একটু বিরক্ত হয়ে বললে, ‘আঃ, কুমার! যা বলি, শোনো। ওটা হচ্ছে অবলার নিজের বাসা। আর একগাছা নতুন দড়ি সংগ্রহ করতে তার বেশিক্ষণ লাগবে না। যাও, আর দেরি কোরো না, আমি এখানে পাহারায় রইলুম।’

কুমারের মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল, তবু আর কিছু না—বলে সে অগ্রসর হল।

উঠান থেকে বেরিয়ে জঙ্গলময় বাগানের ভিতরে গিয়ে দেখলে, বড়ো বড়ো গাছের ছায়া হেলে পড়েছে পূর্বদিকে। আন্দাজে বুঝলে, বেলা হয়েছে প্রায় দুটোর কাছাকাছি। কোন সকালে সে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, পেটে এখনও অন্ন—জল পড়েনি। বিশেষ, তার এত তৃষ্ণা পেয়েছিল যে বাগানের সেই পানায় সবুজ পুকুরের দিকেই সে কয়েক পা এগিয়ে না গিয়ে পারলে না। কিন্তু তারপরেই তার মনে হল বিমলের কথা। কাল থেকে সে অন্ন—জলের স্পর্শ পায়নি, তবু এখনও সমস্ত কষ্ট সহ্য করে আছে অম্লান মুখে! নিজের দুর্বলতায় লজ্জিত হয়ে কুমার আবার ফিরে এসে পাঁচ নম্বরের বাড়ির খিড়কির দরজা খুঁজতে লাগল।

সুন্দরবাবু ঠিক বলেছেন। এটা কি বাড়ি না গোলকধোঁধা! রাবিশের পাহাড়, ঝোপঝাপ, জঙ্গল ও কাঁটাবনের ভিতর থেকে আসল পথটি বার করে নিতে তার বেশ কিছুক্ষণ লাগত, কিন্তু একজন পাহারাওয়ালা তাকে দেখতে পেয়ে বাড়ির মধ্যে ঢোকবার পথ বাতলে দিলে।

ভিতরে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে উঠেই সে দেখলে, দোতলার বারান্দায় সুন্দরবাবু একখানা চেয়ারের উপরে শুকনো মুখে চুপ করে বসে আছেন এবং তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে আছে কাঠের পুতুলের মতন জন—চারেক পাহারাওয়ালা।

কুমার শুধোলে, ‘কী খবর সুন্দরবাবু? এখানে বসে কেন?’

সুন্দরবাবু হাসবার জন্যে বিফল চেষ্টা করে বললেন, ‘আপনাদের পথ চেয়ে বসে আছি আর কি!’

—’তার মানে?’

—’আমি জানি সার্কাসের খেলোয়াড়দের মতো দড়ি বেয়ে তেতলায় উঠে আপনারা আবার নীচে নেমে আসবেন। তারপর আপনাদের নামতে দেরি হচ্ছে দেখে চারজন সেপাইকে ওপরে পাঠিয়ে আমি এইখানেই বসে অপেক্ষা করছি। কিন্তু আপনি একলা এদিক দিয়ে এলেন কেন?’

—’সে কথা পরে বলছি। কিন্তু তার আগে জানতে চাই, আপনি কি এখনও অবলার খোঁজ করেননি?’

সুন্দরবাবু শ্রান্ত স্বরে বললেন, ‘হুম, করেছি বইকী কুমারবাবু, করেছি বইকী! দোতলা একতলা সব তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছি—কোথাও অবলা হতভাগা নেই! সদর—দরজার সেপাইদের মুখে শুনলুম, এ—বাড়ি থেকে জনপ্রাণী বাইরে বেরোয়নি। কিন্তু বিমলবাবু কোথায়? তিনি তো এতক্ষণে তেতলায় উঠেছেন?’

কুমার খুব সংক্ষেপে বিমলের খবর জানালে।

সুন্দরবাবু সবিস্ময়ে বললেন, ‘হুম। ত্যাঁদোড় আসামির কথা তো আমি জীবনে কখনও শুনিনি। এই একখানা বাড়ির ভিতরেই বসে এতগুলো মানুষকে নিয়ে সে যা—ইচ্ছে—তাই করছে? কী দুর্দান্ত লোক রে বাবা! যান কুমারবাবু, শিগগির তেতলায় যান, ওপরে চারজন সেপাই আছে—আপনার কোনও ভয় নেই। আমি এইখানেই ঘোঁটি আগলে বসে রইলুম!’

—’আপনিও আমার সঙ্গে এলে ভালো হত না?’

সুন্দরবাবু করুণ স্বরে বললেন, ‘কিন্তু আমাকে কিছুক্ষণের জন্যে মাপ করুন ভায়া, একে খিদের জ্বালায় ছটফট করে মরছি, তার ওপরে তেষ্টার চোটে প্রাণ করছে টা—টা! এখন উঠে দাঁড়ালে আমি হয়তো মাথা ঘুরেই পড়ে যাব। এক ঠোঙা খাবার আনতে পাঠিয়েছি, কিঞ্চিৎ জলযোগ না করলে আমি তো আর নড়তে পারছি না!’

এমন কাঁচুমাচু মুখে সুন্দরবাবু কথাগুলো বললেন যে, কুমার কোনও প্রতিবাদ করতে পারলে না। কেবল বললে, ‘আমি যাচ্ছি, কিন্তু আপনার রিভলভারটা একবার আমাকে দেবেন কি?’

সুন্দরবাবু বিনাবাক্যব্যয়ে ‘বেল্ট’ থেকে রিভলভারটা খুলে নিয়ে কুমারের হাতে সমর্পণ করলেন।

কুমার তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে তেতলায় উঠে গিয়ে দেখে, ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে আছে চারজন পাহারাওয়ালা।

জিজ্ঞাসা করলে, ‘তোমরা কি ওই ঘরগুলো খুঁজে দেখেছ?’

তারা জানালে, খুঁজে দেখেছে বটে, কিন্তু কেউ কোথাও নেই।

কুমার বললে, ‘অসম্ভব। আসামি তেতলাতেই লুকিয়ে আছে।’

সে ছুটে গিয়ে আগেই চোর—কুঠরির ভিতরে ঢুকল। ঘরে কেউ নেই।

তারপর এগিয়ে গিয়ে গরাদহীন জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়েই সচমকে দেখলে, বাইরের হুকে ঝুলছে দুইগাছা দড়ি—তার একগাছা ছেঁড়া এবং আর একগাছা নেমে গিয়েছে প্রায় নীচেকার উঠান পর্যন্ত।

তাহলে বিমলের সন্দেহই সত্যে পরিণত হল? নতুন দড়ি ঝুলিয়ে অবলা আবার সরে পড়েছে?

কিন্তু সে পালাবে কেমন করে? উঠানের উপরে পাহারা দিচ্ছে যে বিমল নিজে!

কুমার বুক পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়ে উঠানের চারিদিকে দৃষ্টিপাত করলে। সেখানে বিমল বা অবলার কারুর কোনও চিহ্নই নেই!

কুমার আশ্চর্য হয়ে ভাবতে লাগল, বিমলের সাবধানি চোখকে ফাঁকি দিয়ে অবলা নিশ্চয়ই নামতে পারেনি; আর এ—বিষয়েও একতিল সন্দেহ নেই যে, প্রাণ থাকতে বিমল কখনওই তাকে পালাতে দেবে না! তবে?…তবে কি এরই মধ্যে বিমলের সঙ্গে তার হাতাহাতি হয়ে গেছে? আর জয়ী হয়েছে অবলাই? না, এটাও সম্ভব নয়। বিমলের মতো বলবান লোক বাংলাদেশে বেশি নেই, এত শীঘ্র সে কাবু হবার ছেলে নয়! কিন্তু অবলার সঙ্গে সেও অদৃশ্য কেন? তবে কি বিমল আবার শত্রুর পিছনে পিছনে ছুটেছে?

কুমার চিৎকার করে অনেকবার বিমলের নাম ধরে ডাকলে, কিন্তু কোনও সাড়া পেলে না!

ভীত, চিন্তিত মুখে সে দ্রুতপদে আবার দোতলায় নেমে এসে উত্তেজিত স্বরে বললে, ‘সুন্দরবাবু, সুন্দরবাবু। অবলা নতুন দড়ি বেয়ে ফের নীচে নেমে অদৃশ্য হয়েছে, বিমলেরও দেখা নেই।’

খাবারের ঠোঙা থেকে একখানা কচুরি নিয়ে সুন্দরবাবু তখন সবে প্রথম কামড় বসাবার জন্যে মুখব্যাদান করেছেন; কিন্তু খবর শুনেই তাঁর পিলে চমকে গেল রীতিমতো! মহা বিস্ময়ে বলে উঠলেন, ‘এ কী রকম জাঁহাবাজ আসামি রে বাবা! এ যে পারার ফাঁটার মতো হাতের মুঠোর ভেতর থেকেও ধরা দেয় না! হুম, আমাকে হাল ছাড়তে হল দেখছি।’

কুমার ক্রুদ্ধস্বরে বললে, ‘তাহলে হাল ছেড়ে খাবারের ঠোঙা নিয়ে আপনি এইখানেই বসে থাকুন, আমি একলাই চললুম আমার বন্ধুর সন্ধানে।’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘আ হা হা, চটেন কেন মশাই? সব সময় কি মুখের কথাই সত্যি কথা হয়? আমার কি কর্তব্যজ্ঞান নেই? এই রইল আমার খাবারের ঠোঙা—আর রইল আমার মুখের কচুরি, কোথায় যেতে হবে চলুন—হুম!’

সপ্তম পরিচ্ছেদ – জয়ন্ত ও মানিকের প্রবেশ

আবার সেই পোড়োবাড়ির জঙ্গলভরা উঠান!

সুন্দরবাবু বললেন, ‘ওই অলক্ষুণে পাঁচ নম্বরের বাড়ি আর এই হতচ্ছাড়া উঠান! আমাদের কি আজ এরই মধ্যে লাট্টুর মতো বাঁ বাঁ করে ঘুরে মরতে হবে?’

কুমার কোনও কথা না বলে একেবারে উঠানের সেইখানে গিয়ে হাজির হল, খানিক আগে সে যেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল বিমলকে।

সেখানে ভিজে মাটির উপরে রয়েছে অনেকগুলো পায়ের দাগ এবং আরও নানারকম চিহ্ন। কুমার সেগুলোর দিকে তাকিয়ে নতুন কোনও সূত্র আবিষ্কারের চেষ্টা করছে, এমন সময়ে উঠানের ভিতরে প্রবেশ করলে আর দুজন নতুন লোক।

কিন্তু নতুন লোক হলেও তারা আমাদের অচেনা নয়। কারণ তাদের একজন হচ্ছে বিখ্যাত শখের ডিটেকটিভ জয়ন্ত এবং আর একজন তার বন্ধু মানিক।

সুন্দরবাবু আনন্দে নেচে উঠে বললেন, ‘আরে আরে—হুম। কোথায় ছিলে হে তোমরা? কেমন করে আমাদের খোঁজ পেলে? ভারী আশ্চর্য তো!’

জয়ন্ত বললে, ‘কিছুই আশ্চর্য নয়। আমরা গিয়েছিলুম বিমলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে রামহরির মুখে সব শুনে সিধে এখানে চলে এসেছি। ব্যাপার কী বলুন দেখি? আসামি কি ধরা পড়েছে? বিমলবাবুকে দেখছি না?’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘আসামিরও খোঁজ নেই, বিমলবাবুও অদৃশ্য। ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছি না।’

জয়ন্ত বললে, ‘কুমারবাবু, সংক্ষেপে আমাকে ব্যাপারটা বলতে পারবেন?’

কুমার খুব অল্প কথায় প্রধান প্রধান ঘটনাগুলো বর্ণনা করলে।

সমস্ত শুনে জয়ন্ত উদ্বিগ্ন স্বরে বললে, ‘বলেন কী কুমারবাবু? কিন্তু আপনি চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী করছেন?’

—’মাটির ওপরের ওই দাগগুলো পরীক্ষা করছি।’

মানিক নীচের দিকে তাকিয়ে বললে, ‘তাই তো, এখানে যে অনেক রকম দাগ রয়েছে! জয়ন্ত, তোমাকে সবাই তো পদচিহ্ন—বিশারদ বলে জানে, এখানকার মাটি দেখে কিছু আবিষ্কার করতে পারো কি না দ্যাখো না!’

জয়ন্ত তখনই মাটির উপরে বসে পড়ল। তারপর মিনিট—পাঁচেক ধরে নীরবে সমস্ত পরীক্ষা করে বললে, ‘হুঁ, কিছু কিছু বোঝা যাচ্ছে বটে। কুমারবাবু, এই একজোড়া পদচিহ্ন দেখুন। খুব স্পষ্ট, নিখুঁত চিহ্ন, আর বেশ গভীর। কেউ এখানে খানিকক্ষণ ধরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল, আর সেই জন্যেই ছাপ এমন স্পষ্ট উঠেছে। আমার বিশ্বাস, এ পায়ের দাগ হচ্ছে আমাদের বন্ধু বিমলবাবুর।’

কুমার বললে, ‘হ্যাঁ, বিমল ওইখানেই ছিল বটে।’

—’তারপরেই দেখছি অনেকখানি ঠাঁই জুড়ে একটা লম্বা—চওড়া দাগ। আর ওই ভাঙাবাড়ির দিক থেকে দু—জোড়া পায়ের দাগ এই লম্বা—চওড়া দাগের কাছে এসে থেমেছে। ব্যাপারটা বুঝছেন? লম্বা—চওড়া দাগটা দেখে অনুমান করছি, একটা মানুষের দেহ এখানে আছাড় খেয়েছে! আর ওই দু—জোড়া দাগের আকার দেখে বেশ বোঝা যায়, ওগুলো হচ্ছে ছুটন্ত লোকের পায়ের ছাপ। হুঁ, দুজন লোক ভাঙাবাড়ির দিক থেকে ছুটে এসেছে একজন ভূপতিত লোকের কাছে! কেবল তাই নয়, দেখুন কুমারবাবু, দেখুন! ওই ঝুলন্ত দড়ির তলা থেকেও আর একজোড়া পায়ের দাগও এইখানে এসে থেমেছে। আন্দাজ বলতে পারি, এ হচ্ছে অবলার পদচিহ্ন। তাহলে হিসাবে কী পাই? একজন ভূতলশায়ী লোক আর তিনজন দণ্ডায়মান লোক! না, তারা কেবল দাঁড়িয়েই ছিল না, এখানে হাঁটু গেড়ে বসেও পড়েছিল। এই দেখুন, ভিজে মাটির উপরে তিনজোড়া হাঁটুর চিহ্ন! আমার সন্দেহ হচ্ছে, বিমলবাবু পড়ে গিয়েছিলেন, আর তিনজন লোক এসে তাঁকে মাটির ওপরে চেপে ধরেছিল!’

কুমার রুদ্ধশ্বাসে কাতরভাবে বললে, ‘জয়ন্তবাবু, আর কিছু বুঝতে পারছেন?’

জয়ন্ত ভূতলে দৃষ্টি সংলগ্ন রেখেই উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ‘পারছি বইকী! এই দেখুন, তিনজোড়া পায়ের দাগ চলেছে আবার ওই ভাঙাবাড়ির দিকে, আর তাদের সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে মাটির ওপর দিয়ে একটা ভারী দেহ টেনে নিয়ে যাওয়ার চিহ্ন।…সবই তো বেশ বোঝা যাচ্ছে। কুমারবাবু, আপনার বন্ধু বিপদে পড়েছেন! এই দাগ ধরে আমি অগ্রসর হই, আপনারা সবাই আসুন আমার পিছনে পিছনে!’

জয়ন্ত এগুলো। কিন্তু গেল—বারে বিমলের সঙ্গে কুমার ভাঙাবাড়ির ডানদিকে গিয়েছিল, এবারে জয়ন্ত সে দিকে গেল না। বাঁদিকে এগিয়ে ছাদ—ভাঙা দালানে উঠল। পাশাপাশি খানকয় ঘর—একটা ঘর ছাড়া সব ঘরই দরজা খোলা।

বন্ধ—দ্বারের উপরে করাঘাত করে জয়ন্ত বললে, ‘এ ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ কেন?’ বলেই সে জীর্ণ দরজার উপরে পদাঘাত করলে সজোরে এবং পরমুহূর্তে অর্গল ভেঙে খুলে গেল দ্বার সশব্দে।

জয়ন্ত, কুমার, মানিক ও সুন্দরবাবুর সঙ্গে পাহারাওয়ালারা বেগে ভিতরে প্রবেশ করলে। ঘর কিন্তু শূন্য।

সে—ঘরের ভিতর দিয়ে আর একটা ঘরে যাবার দরজা এবং সে—দরজাও বন্ধ।

এবারের দরজাটা তেমন জীর্ণ ছিল না বটে, কিন্তু মহা—বলবান জয়ন্তের ঘন ঘন পদাঘাত সহ্য করবার শক্তি তার বেশিক্ষণ হল না। আবার গেল তারও হুড়কো ভেঙে।

ঘরের ভিতর ঢুকে দেখা গেল এক ভয়াবহ দৃশ্য!

প্রায়—অন্ধকার ঘর, প্রথমটা ভালো করে নজরই চলে না। কেবল এইটুকুই আবছা আবছা বোঝা গেল, একটা উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে এক স্থিরমূর্তি।

জয়ন্ত তাড়াতাড়ি রিভলভার বার করে বললে, ‘কে তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে?’

সাড়া নেই।

—’জবাব দাও, নইলে মরবে!’

তবু সাড়া নেই।

পাহারাওয়ালারা দুটো জানালা খুলে দিল।

একটা পুরানো তেপায়ার উপরে দাঁড়িয়ে আছে বিমল। তার মুখ কাপড় দিয়ে বাঁধা।

কুমার দৌড়ে তার কাছে গেল।

জয়ন্ত ভীতকণ্ঠে বললে, ‘এ কী ভয়ানক! দ্যাখো মানিক, কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো!’

কড়িকাঠের একটা কড়ায় বাঁধা একগাছা রজ্জু এবং সেই রজ্জুর অপর প্রান্ত সংলগ্ন রয়েছে বিমলের কণ্ঠদেশে! বিমলের হাত দুখানা পিছমোড়া করে বাঁধা এবং তার দুই পায়েও দড়ির বাঁধন!

কুমার বিভ্রান্তের মতন বলে উঠল, ‘বিমল! বন্ধু! তোমার গলায়—’

জয়ন্ত দুই হাতে বিমলের দেহ ধরে নামিয়ে বললে, ‘কার পকেটে ছুরি আছে? শিগগির বিমলবাবুর গলার আর হাত—পায়ের দড়ি কেটে দাও।’

সুন্দরবাবুর কথামতো কাজ করলেন। মানিক দিলে মুখের বাঁধন খুলে।

জয়ন্ত দুই চক্ষু বিস্ফারিত করে বললে, ‘সর্বনাশ! বিমলবাবু, গলায় ফাঁস পরে আপনি যে শূন্যে দোলও খেয়েছেন দেখছি! দেখুন সুন্দরবাবু, গলার চারিদিকে রাঙা টকটকে দড়ির দাগ!’

সুন্দরবাবু শিউরে উঠে বললেন, ‘হুম!’

বিমল মুখ টিপে একটু হাসলে বটে, কিন্তু তার দুই চোখ তখন অশ্রুসজল।

কুমার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল, কারণ বিমলকে সে কাঁদতে দেখেনি কখনও!

বিমল বললে, ‘তুমি অবাক হয়ে গেছ কুমার? ভাবছ আমার চোখে কান্নার জল? না বন্ধু, না! এ কান্নার অশ্রু নয়, এ হচ্ছে রুদ্ধ ক্রোধ আর নিষ্ফল আক্রোশের অশ্রু। অবলা ঠিক কলের পুতুলের মতন আমাদের নাচিয়ে নাচিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। তাকে ধরব কি, তার হাতে বারবার ধরা পড়ছি আমি নিজেই! আর এবারে খালি ধরাই পড়িনি—চক্ষের সামনে দেখেছি নিশ্চিত মৃত্যুর ঘোর অন্ধকার!’

কুমার বললে, ‘কিন্তু কী করে তুমি বন্দি হলে? অবলা তো ছিল তেতলায়!’

বিমল বললে, ‘হ্যাঁ। অবলা ছিল তেতলায়। আমি দাঁড়িয়েছিলুম উঠোনের ওপরে। আমার দৃষ্টি তেতলার জানলা ছেড়ে আর কোনও দিকে তাকায়নি, কারণ এখানে অবলা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও শত্রু থাকতে পারে, এমন সম্ভাবনা আমার মনে জাগেনি!…দাঁড়িয়ে আছি, আচমকা পিছন থেকে ‘ল্যাসো’র মতন দড়ির একটা ফাঁসকল এসে পড়ল আমার গলার ওপর। কিছু বলবার আগেই অদৃশ্য হাতের বিষম এক হ্যাঁচকা টানে পরমুহূর্তেই দড়াম করে মাটির ওপরে পড়ে গেলুম। আঘাত পেয়ে দু—এক মিনিট অজ্ঞানের মতো হয়ে রইলুম।…সাড় হতে দেখি, আমি এই ঘরের ভিতরে রয়েছি—আমার মুখ, হাত, পা, সব বাঁধা আর আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে অবলার সঙ্গে আরও দুজন লোক। আমি—’

হঠাৎ বাধা দিয়ে সুন্দরবাবু বলে উঠলেন, ‘বিমলবাবু! এতক্ষণ লক্ষ করে দেখিনি, কিন্তু আপনার গলায় ওটা কী ঝুলছে?’

—’জেরিনার কণ্ঠহার।’

—’জেরিনার কণ্ঠহার?’

—’হ্যাঁ, অবলার উপহার!’

—’বলেন কি মশাই, বলেন কি? যে মহামূল্যবান হিরের হারের জন্যে এত কাণ্ড, অবলা সেইটেই আপনাকে উপহার দিয়েছে?’

—’আমাকে নয়, আপনাদের। কারণ অবলা জানে, কড়িকাঠের দড়িতে এখন আমার মৃতদেহ আড়ষ্ট হয়ে ঝুলছে!’

কুমার অধীর কণ্ঠে বললে, ‘বিমল, ও কথা রেখে এখন আসল কথা বলো।’

—’তাই বলি! অবলা খিলখিল করে খুব খানিকটা হেসে নিয়ে বললে, ‘এই যে, বাছাধনের যে জ্ঞান হয়েছে দেখছি! বামন হয়ে চাঁদ ধরবার লোভ করেছিলে, এখন লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু হবে বইকী! বড্ড বেশি লেগেছে বুঝি? কি করব খোকাবাবু, আমার যে মোটেই সময় নেই, নইলে আদর করে দু—দণ্ড তোমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতুম! যাক, আর বেশিক্ষণ তোমাকে কষ্ট দেব না, এবারে একেবারে সব জ্বালা তোমার জুড়িয়ে দিচ্ছি!…ওরে ভোঁদা, কড়িকাঠের কড়ায় দড়িটা বাঁধা হল?…হয়েছে? আচ্ছা।’ এই বলে সে নিজের পকেট থেকে একছড়া হিরের হার বার করলে। তারপর হারছড়া আমার গলায় পরিয়ে দিয়ে বললে, ‘এই নাও ছোকরা জেরিনার কণ্ঠহার পরো। শুনে অবাক হচ্ছ? অবাক হয়ো না। কারণ এটি হচ্ছে নকল জেরিনার কণ্ঠহার। বিজয়পুরের মহারাজা ভারী চালাক, আমাদের জন্যে লোহার সিন্দুকে এই নকল হারছড়া রেখে, আসল জিনিস সরিয়ে রেখেছেন অন্য কোথাও! আর এই কাচের নকল হার বোকার মতো চুরি করে এনে আমরা বিপদ—সাগরে নাকানি—চোবানি খেয়ে মরছি! ও হার তোমার গলায় রইল, এখন পুলিশ এসে ওটাকে উদ্ধার করবে অখন! আমাকে এখন যেতে হবে, কিন্তু তার আগে তোমার একটা ব্যবস্থা করে যেতে চাই!…ওরে ভোঁদা, ওরে উপে! চেয়ারখানা এদিকে টেনে নিয়ে আয় তো! হ্যাঁ, এইবার ছোকরাকে ওর ওপরে তুলে দাঁড় করিয়ে দে।’ তারা হুকুম তামিল করলে। তারপর আমার গলায় পরিয়ে দিলে দড়ির ফাঁস। অবলা বললে, ‘বিমলভায়া, চোখে ধোঁয়া দেখবার আগে মনে মনে ভগবানকে ডেকে নাও। যদিও তুমি আমাকে যথেষ্ট জ্বালিয়েছ, তবু তোমার মতো ক্ষুদ্র জীবকে বধ করবার ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্তু জানো তো, মাঝে মাঝে পিঁপড়ের মতন তুচ্ছ প্রাণীকেও না মারলে চলে না? আমি আবার বিজয়পুরের মহারাজার অনাহুত অতিথি হতে চাই, এবারে আসল জেরিনার কণ্ঠহার না নিয়ে ফিরব না! কিন্তু তুমি বেঁচে থাকলে আবার আমাকে বাধা দেবার চেষ্টা করবে! তাই—’ ঠিক এই সময়ে বাহির থেকে আর—একজন লোক ছুটে এসে বললে, ‘বাবু, পুলিশের লোক আবার উঠোনের ওপর এসেছে!’ অবলা ব্যস্ত হয়ে বললে, ‘ভোঁদা, যা—যা, শিগগির ছুটে গিয়ে মোটরখানা বার করে ‘স্টার্ট’ দে, আর এ—বাড়িতে নয়!’ তারপর আমার দিকে ফিরে বললে, ‘বিমল, আরও মিনিট তিন—চার তোমার সঙ্গে গল্প করব ভেবেছিলুম, কিন্তু তা আর হল না। শুনেছি তুমি নাকি ‘অ্যাডভেঞ্চার’ ভালোবাসো—এইবার তোমার চরম অ্যাডভেঞ্চারের পালা! যাও, এখন ‘দুর্গা’ বলে পরলোকের পথে যাত্রা করো।’ সে একটানে চেয়ারখানা আমার পায়ের তলা থেকে সরিয়ে নিয়ে বেগে দৌড়ে চলে গেল! ঝপাং করে আমার দেহ ঝুলে পড়ল—গলায় লাগল বিষম হ্যাঁচকা টান। সেই মুহূর্তেই হয়তো আমার দফারফা হয়ে যেত, কিন্তু আমি আগে থাকতেই এর জন্য প্রস্তুত ছিলুম, গলার সমস্ত মাংসপেশি ফুলিয়ে শক্ত আর আড়ষ্ট করে প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিলুম—যদিও ভয়ানক যন্ত্রণায় প্রাণ হল বেরিয়ে যাবার মতো! তুমি জানো কুমার, আমার মতো যারা নিয়মিতভাবে খুব বেশি ব্যায়াম অভ্যাস করে, তারা শরীরের যে কোনও স্থানের মাংসপেশি ইচ্ছা করলেই লোহার মতন কঠিন করে তুলতে পারে, তখন মুগুরের আঘাতও অটলভাবে সহ্য করা অসম্ভব হয় না! কাজেই গলায় দড়ির চাপ কোনওরকমে সামলে নিলুম—যদিও এ উপায়ে বেশিক্ষণ আত্মরক্ষা করতে পারতুম না। বেশিক্ষণ এভাবে থাকবারও দরকার হল না, কারণ আগেই দেখে নিয়েছিলুম ওই তেপায়াটা! পুলিশের ভয়ে অত্যন্ত তাড়াতাড়ি পালাতে হল বলে অবলা ওর দিকে ফিরে চাইবার সময় পায়নি, নইলে নিশ্চয়ই ওটাকে সরিয়ে ফেলত। বার—দুয়েক ঝাঁকি মেরে দোল খেয়ে আমি কোনওরকমে ওর ওপরে গিয়ে দাঁড়ালুম। তারপর খানিকক্ষণ যে কী ভাবে কেটেছে, তা জানেন খালি আমার ভগবান! পুরনো, নড়বড়ে তেপায়া, আমার ভারী দেহের ভারে টলমল ও মচমচ শব্দ করতে লাগল। প্রতি মুহূর্তেই ভয় হয়—এই বুঝি পটল তুলি! এক এক সেকেন্ডকে মনে হয় এক এক ঘণ্টা! সে যেন মরণাধিক যন্ত্রণা! তারপর—তারপর আর কী, ঘটনাস্থলে তোমাদের আবির্ভাব, যমালয়ের দ্বার থেকে আমার প্রত্যাবর্তন!’

সুন্দরবাবু সহানুভূতি—মাখা স্বরে বললেন, ‘হুম, বিমলবাবু, হুম! না—জানি আপনার কতই লেগেছে! কিন্তু বিজয়পুরের মহারাজাটা তো ভারী বদ লোক দেখছি! চোরে যে নকল হিরের হার চুরি করেছে এ—কথাটা আমাদেরও কাছে প্রকাশ করেনি!’

কুমার বললে, ‘ও—সব কথা পরে হবে, এখন আমাদের কী করা উচিত? বিমলের কথায় বোঝা গেল, অবলা তার দলবল নিয়ে মোটরে চড়ে এখান থেকে সরে পড়েছে!’

বিমল বললে, ‘এর পর তার দেখা পাব আমরা বিজয়পুরের মহারাজার ওখানেই। জেরিনার কণ্ঠহার ছেড়ে সে অন্য কোথাও নড়বে না। সেইখানেই আর একবার তার সঙ্গে শক্তি—পরীক্ষা করব!..হ্যাঁ, ভালো কথা! জয়ন্তবাবু, মানিকবাবু! আপনারাও এখানে যে?’

জয়ন্ত বললে, ‘এখন বাড়ির দিকে চলুন! চুম্বক কেন যে লোহাকে টেনেছে, পথে যেতে যেতে সে কথা বলব অখন!’

অষ্টম পরিচ্ছেদ – নৈশ অভিনয়

বিজয়পুরের মহারাজাবাহাদুর যে বাড়িখানা ভাড়া নিয়েছেন, ঠিক তার সামনেই একখানা ছোটো তেতলা বাড়ি।

বড়ির উপর—তলার রাস্তার ধারে এক ঘরে জানলার কাছে বসেছিল একজন বিপুলবপু পুরুষ। তার দেহখানা এত বড়ো যে দেখলেই মনে হয়, ওই চেয়ারখানা ভার সইতে না পেরে এখনই মড়মড় করে ভেঙে পড়বে।

এইমাত্র ক্ষৌরকার্য সমাপ্ত করে সে ‘স্ট্রপে’র উপরে ক্ষুর ঘষতে ঘষতে ডাকলে, ‘উপে!’

দরজা ঠেলে একজন লোক ঘরের ভিতরে ঢুকেই চমকে উঠল।

ক্ষুরখানা খাপের ভিতরে ঢুকিয়ে মেয়ে—গলায় খিলখিল করে হেসে উঠে প্রথম লোকটি বললে, ‘কী রে, আমাকে দেখেই চমকে উঠলি বড়ো যে?’

উপে বললে, ‘আজ্ঞে, দাড়ি—গাঁফ কামিয়েছেন বলে আপনাকে এখন সহজে আর চেনা যাচ্ছে না!’

—’হুঁ, তাই তো আমি চাই! আমাকে দেখে চিনতে পারলে পুলিশ অবলা বলে ছেড়ে দেবে না। কিন্তু মুশকিলে পড়েছি আমার এই প্রকাণ্ড দেহখানা নিয়ে। গাঁফ—দাড়ি কামিয়ে ফেলা যায়, কিন্তু বড়ো চেহারা তো ছেঁটেছুটে ছোটো করা যায় না! আমার বেয়াড়া দেহটা দেখলেই যে লোকে ফিরে—ফিরে তাকায়, আর আমার হতচ্ছাড়া মেয়েলি গলার আওয়াজ! এ গলা যে একবার শোনে সে আর ভোলে না। উপে রে, একটু চালাক লোক হলেই আমার ছদ্মবেশ ধরে ফেলতে পারবে!’

উপে বললে, ‘কর্তা, আপনি রাজবাড়ির এত কাছে এসে ভালো করেননি। পুলিশ এখন ভারী সাবধান, চারিদিকে আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে!’

অবলা বললে, ‘হ্যাঁ, খুঁজে বেড়াচ্ছে বটে, তবে রাজবাড়ির এত কাছে নয়। ওই ভুঁদো সুন্দর—দারোগাকে আমি খুব চিনি, তার নজর থাকবে এখন টালিগঞ্জের দিকেই। আমরা যে ভরসা করে রাজবাড়ির এত কাছে আসব, এ সন্দেহ কেউ ভুলেও করতে পারবে না। এখানেই আমরা বেশি নিরাপদ। কিন্তু সে কথা এখন থাক। শ্যামা এসে রাজবাড়ির কোনও খবর দিয়ে গেছে?’

——’হ্যাঁ কর্তা! শ্যামা এইমাত্র এসে বলে গেল, আসল কণ্ঠহার আছে রাজার শোবার ঘরে, ড্রেসিং টেবিলের ডানদিকের টানায়।’

—’হুঁ, বিজয়পুরের রাজা দেখছি মহা বুদ্ধিমান ব্যক্তি! তিনি নকল হার রাখেন সিন্দুকে লুকিয়ে, আর আসল জিনিস রাখেন প্রায় প্রকাশ্য জায়গায়! তিনি বেশ জানেন যে, সাধারণ লোকের চোখ আগেই খোঁজে লোহার সিন্দুক। চমৎকার ফন্দি।’

—’শ্যামা আরও বললে, রাজার শোবার ঘরের ঠিক সামনে দিনরাত একজন বন্দুকধারী সেপাই মোতায়েন থাকে।’

অবলা বললে, ‘ও সেপাই—টেপাইকে আমি থোড়াই কেয়ার করি। তাদের চোখে ধুলো দিতে বেশি দেরি লাগবে না।’

—কিন্তু কর্তা, শ্যামা যে আজই রাজবাড়ির কাজ ছেড়ে দিতে চায়। তাকে নাকি সকলে সন্দেহ করছে।’

—’তা এখন কাজ ছাড়লে আমার কোনও ক্ষতি নেই। যে—কারণে তাকে রাজবাড়িতে কাজ নিতে বলেছিলুম আমার সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে। তবে আজকের দিনটা সবুর করতে বলিস।’

ঠিক এই সময়ে দড়াম শব্দে ঘরের দরজা খুলে একটা লোক ভিতরে ঢুকেই উৎফুল্ল স্বরে বলে উঠল, ‘কেল্লা ফতে বাবু, কেল্লা ফতে।’

অবলা বললে, ‘কী রে ভোঁদা, ব্যাপার কী?’

—’বিমল বেটা পটল তুলেছে!’

—’ঠিক বলছিস তো?’

—’বাবু, বেঠিক কথা বলবার ছেলে আমি নই। একেবারে হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে আমি খবর নিয়ে এসেছি। বিমলকে অজ্ঞান অবস্থায় কাল দুপুরে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কিন্তু কিছুতেই তার জ্ঞান হয়নি। আজ ভোরবেলায় সে মারা পড়েছে।’

অবলা তার মস্ত বড়ো মুখে এক—গাল হেসে বললে, ‘তাহলে আমার মুখ থেকে বিমল যেটুকু শুনেছিল, নিশ্চয়ই তার কিছুই প্রকাশ করতে পারেনি। বহুৎ আচ্ছা, এতক্ষণে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম। ভোঁদা তোড়জোড় সব ঠিক কর। বিমল যখন পরলোকে হাওয়া খেতে গেছে, তখন আজ রাত্রে আবার আমরা তারই বাগান দিয়ে রাজবাড়ি আক্রমণ করব।’

—’কিন্তু বাবু, ও—বাড়িতে সেই রামহরি বুড়ো তো এখনও আছে?’

—’সে বেটা আজ বিমলের শোকে আচ্ছন্ন হয়ে থাকবে, পাঁচিল টপকে কখন আমরা বাগানের ভেতরে গিয়ে ঢুকব, এটা জানতেও পারবে না।…এখন কী করতে হবে শোন ভোঁদা।’

—’বলুন কর্তা।’

—’জন—ছয়েক লোক নিয়ে আমরা রাজবাড়িতে ঢুকব। রাজবাড়ির পশ্চিমদিকের রাস্তায় রাত্রে লোকজন বড়ো চলে না, সেইখানে আমাদের একখানা মোটরগাড়ি থাকবে। শ্যামার মুখে খবর পেয়েছি, পূর্বদিকে রাজার শোবার ঘরে আসল কণ্ঠহার আছে। ও—বাড়ির অন্ধি—সন্ধি সব আমার জানা। রাজবাড়িতে ঢুকে তোকে নিয়ে এক জায়গায় লুকিয়ে থাকব। বাকি লোকদের নিয়ে উপে বারান্দা দিয়ে যাবে পশ্চিমদিকে। আগে গাছকয় দড়ি বারান্দা থেকে ঝুলিয়ে দেবে। তারপর এমন আওয়াজ করে কোনও দরজা—টরজা ভাঙবার চেষ্টা করবে, যাতে—করে বাড়ির লোকের ঘুম ভেঙে যায়। তারপর চোর এসেছে বলে সবাই যখন ব্যস্ত হয়ে পশ্চিমদিকে ছুটে যাবে, আমার লোকেরা দড়ি বেয়ে নীচে নেমে মোটরে চড়ে লম্বা দেবে—বুঝেছিস?’

ভোঁদা আহ্লাদে নাচতে নাচতে বললে, ‘বুঝেছি কর্তা, বুঝেছি! বাড়ির সবাই যখন চোর ধরতে ছুটবে, তখন আমরা দুজনে ঢুকব রাজার শোবার ঘরে।’

উপে তারিফ করে বললে, ‘উঃ, আমার কর্তার কী বুদ্ধির জোর! বলিহারি!’

অবলা বললে, ‘ও বিমলছোকরা কিছু করতে না পারুক, আমাদের বড়োই জ্বালিয়ে মারছিল। পথের কাঁটা এখন সাফ। প্রথমটা আমি তাকে মারতে চাইনি। কিন্তু যে নিজে মরতে চায়, ভগবানও তাকে বাঁচাতে পারে না, আমি কী করব?’

সে—রাত্রির সঙ্গে চাঁদের সম্পর্ক ছিল না—অবশ্য কলকাতা শহরও আজকাল আর চাঁদের মুখাপেক্ষী নয়। গ্যাস ও ইলেকট্রিকের সঙ্গে মিতালি করে কলকাতা আজ চাঁদের গর্ব চূর্ণ করেছে। তবু এখানে চাঁদের আলো জাগে বটে, কিন্তু সে যেন বাহুল্য মাত্র।

রাত তখন দুটো বাজে—বাজে। পথে পথে লোকজন আর চলছে না। পাহারাওয়ালারা রোয়াকে ঘুমিয়ে পড়ে কণ্ঠকে নীরব, কিন্তু নাসিকাকে জাগিয়ে সরব করে তুলেছে। তাদের নাসাগর্জনে ভয় পেয়ে ঝিঁঝিপোকারা একেবারে চুপ মেরে গেছে।

হঠাৎ বিজাপুরের মহারাজার অট্টালিকার পাশের এক রাস্তার কয়েকটা গ্যাসের আলো যেন অকারণেই নিবে গেল। তারপরই জাগল একখানা মোটরগাড়ির আওয়াজ। গাড়িখানা অন্ধকার রাস্তার ভিতরে ঢুকে খানিক এগিয়েই থেমে পড়ল।

কিছুক্ষণ সমস্ত চুপচাপ।…মিনিট পনেরো কাটল।

তারপরেই আচম্বিতে চারিদিকের স্তব্ধতাকে যেন টুকরো টুকরো করে দিয়ে চিৎকার উঠল—’চোর, চোর! ডাকাত! এই সেপাই! এই দরোয়ান!’ মুহূর্তের মধ্যে বহু কণ্ঠের কোলাহলে ও বহু লোকের পদশব্দে বেধে গেল এক মহা হুলুস্থুল।

বলা বাহুল্য, এই গোলমালের জন্ম বিজয়পুরের মহারাজের বাড়িতেই। পাড়াসুদ্ধ সকলের ঘুম ভেঙে গেল, এবং ছুটে গেল রোয়াকের পাহারাওয়ালার কত সাধের সুখস্বপ্ন! দেখতে দেখতে রাজপথের উপরে বৃহৎ এক জনতার সৃষ্টি হল!

কোথায় চোর, কারা চিৎকার করছে, সেসব কিছু বোঝবার আগেই সকলে শুনতে পেলে দ্রুতগামী এক মোটরের শব্দ।…

রাজবাড়ির দোতলার একটা ঘুপসি জায়গা থেকে বেরিয়ে পড়ে অবলা চুপিচুপি বললে, ‘ভোঁদা, এইবার আমাদের পালা।’

দুজনে দ্রুতপদে, কিন্তু নিঃশব্দে পূর্বদিকে এগিয়ে গেল।

অবলা বললে, ‘এই ঘর। যা ভেবেছি তাই। সেপাই গেছে চোর ধরতে। ঘরের দরজা খোলা, ভেতরে আলো জ্বলছে। ভোঁদা, একবার উঁকি মেরে ভেতরটা দেখ তো।’

ভোঁদা উঁকি মেরে দেখে নিয়ে বললে, ‘ঘরের ভেতরে কেউ নেই।’

—’হুঁ, তাহলে রাজাবাহাদুরও চোর—ধরা দেখতে গেছেন। বহুৎ আচ্ছা। চল।’

দুজনে সিধে ঘরের ভিতরে গিয়ে দাঁড়াল। মাঝারি ঘর। একদিকে একখানা বড়ো খাট। আর একদিকে দুটো আলমারি এবং আর একদিকে একটা আয়নাওয়ালা ড্রেসিং— টেবিল।

অবলা তাড়াতাড়ি টেবিলের কাছে গিয়ে ডানদিকের একটা টানা জোর করে টেনে খুলে ফেললে। ভিতর থেকে একটা ছোটো বাক্স বার করে তার ডালা খুলেই আনন্দে অস্ফুট চিৎকার করে উঠল।

ইতিমধ্যে একটা আলমারির আড়াল থেকে বেরিয়ে এল অভাবিত দুই মূর্তি।

তাদের একজনের হাতে রিভলভার। সে বললে, ‘কী দেখছ অবলাকান্ত? জেরিনার কণ্ঠহার?’

অবলা চমকে দুই পা পিছিয়ে গেল। তার মুখের ভাব বর্ণনাতীত।

—’কী অবলা, অমন করে তাকিয়ে আছ কেন হে? আমাদের চেনো না বুঝি? তাহলে শুনে রাখো, আমার নাম জয়ন্ত আর এর নাম মানিক। আমরা হচ্ছি শখের গোয়েন্দা—অর্থাৎ ঘরের খেয়ে তোমাদের মতন বনের মোষ তাড়াই। আমরা জানতুম, আজ হোক কাল হোক, তোমরা এখানে আসবেই। তাই তোমাদের অভ্যর্থনা করবার জন্যেই আমরা এখানে অপেক্ষা করছিলুম।…ওকি, ওকি, তুমি বন্ধুর পিছনে সরে গিয়ে দাঁড়াচ্ছ কেন? আমার রিভলভার দেখে ভয় হচ্ছে বুঝি?’—বলতে বলতে জয়ন্ত পায়ে পায়ে এগুতে লাগল।

অবলা হঠাৎ পিছন থেকে ভোঁদাকে মারলে প্রচণ্ড এক ধাক্কা। ভোঁদা ঠিকরে একেবারে হুড়মুড় করে জয়ন্তের দেহের উপরে এসে পড়ল। জয়ন্ত এর জন্যে প্রস্তুত ছিল না, টাল সামলাতে না পেরে সেও ভোঁদাকে নিয়ে পড়ে গেল মাটির উপরে।

মানিক তাড়াতাড়ি হেঁট হয়ে জয়ন্তকে তুলতে গেল। জয়ন্ত নিজেকে ভোঁদার আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করতে করতে বললে, ‘আমাকে নয়—আমাকে নয় মানিক, তুমি ধরো অবলাকান্তকে।’

কিন্তু অবলা তখন ঘরের বাইরে। সে চোখের নিমেষে দোতলার বারান্দার রেলিং ধরে বাইরের দিকে ঝুলে পড়ল। তারপর রেলিং ছেড়ে অবতীর্ণ হল পাশের বাগানের পাঁচিলের উপরে। এবং সেখান থেকে একলাফে বাগানের ভিতরে। সে হচ্ছে বিমলের বাগান।

বাগানের চারিদিকে ফুটফুটে চাঁদের আলো। অবলা লাফ মেরে বসে পড়েই উঠে দাঁড়িয়ে সভয়ে দেখলে, একটা ঝাঁকড়া গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে আবার দুই মূর্তি।

মূর্তি দুটো এগিয়ে এল। তারে দুজনেরই হাতে কী চকচক করছে? রিভলভার!

একটা মূর্তি হেসে উঠে বললে, ‘আমাদের চিনতে পারছ অবলা? আমরা হচ্ছি বিমল আর কুমার। হ্যাঁ। তোমার মায়া কাটাতে পারলুম না, তাই যমালয় থেকেই ফিরে এলুম।’

—’হুম। বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এবার বধিব ঘুঘু তোমার পরান। হুম। হুম।’ বলতে বলতে আর একদিক থেকে আবির্ভুত হলেন সুন্দরবাবু!

তারপরেই নানা দিক থেকে দেখা দিতে লাগল পাহারাওয়ালার পর পাহারাওয়ালা।

নবম পরিচ্ছেদ – সুন্দরবাবুর পুনরাগমন

মিথ্যা আর পলায়নের চেষ্টা! এটা বুঝে অবলা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, পাথরের মূর্তির মতো।

কুমার বললে, ‘সুন্দরবাবু, অবলার মতো ধড়িবাজকে কিছু বিশ্বাস নেই। শিগগির ওর হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিন।’

—’ঠিক বলেছেন। এই অবলা, হুম। বার করো হাত, পরো লোহার বালা। আমি তোমাকে গ্রেপ্তার করলুম।’

ইতিমধ্যে হাঁপাতে হাঁপাতে ঘটনাস্থলে জয়ন্ত ও মানিকের আবির্ভাব হল। অবলাকে বন্দি অবস্থায় দেখে জয়ন্ত আশ্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললে, ‘যাক, পালের গোদাটা তাহলে পালাতে পারেনি। উঃ, সত্যি বিমলবাবু, এ হচ্ছে ভয়ানক ধড়িবাজ, আর একটু হলে আমারও চোখে ধুলো দিয়েছিল।’

মানিক বললে, ‘কিন্তু জয়ন্ত, অবলার সঙ্গের লোকটা কোন ফাঁকে লম্বা দিয়েছে।’

জয়ন্ত বলল, ‘উপায় কী, আমরা যে অবলাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে ছিলুম।’

হঠাৎ মেয়ে—গলায় খনখন করে হেসে উঠে অবলা বললে, ‘আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হবার দিন এখনও তোমাদের ফুরোয়নি।’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম, তার মানে?’

—’মানে? মানে—টানে আমি জানি না। বললুম একটা কথার কথা।’

—’চুপ করে থাকো রাসকেল। তোমার ছোটো মুখে অত কথার কথা আমি শুনতে চাই না।’

—’ওহে সুন্দর—দারোগা, কী বলব, আমার হাত বাঁধা, নইলে আমাকে রাসকেল বলার ফল এখনই পেতে! তোমার মতো ক্ষুদ্র জীবের হাতে ধরা পড়লে এতক্ষণে আমি হয়তো লজ্জাতেই মারা পড়তুম! কিন্তু আমি ধরা পড়েছি বিমলের হাতে, এতে আমার অগৌরব নেই। তার ওপরে দেখছি আমার অজান্তে বিমল আর কুমারের সঙ্গে যোগ দিয়েছে ডিটেকটিভ জয়ন্তও। এতগুলো মাথাকে কেমন করে সামলাই বলো! কিন্তু আমি ধরা পড়েছি একটিমাত্র ভুলেই। আগে যদি জানতুম বিমল এখনও বেঁচে আছে, তাহলে তোমরা কেউই আজ আমাকে ফাঁদে ফেলতে পারতে না।’

বিমল হাসতে হাসতে বলল, ‘হ্যাঁ অবলা, তোমার কথা মিথ্যে নয়। কিন্তু আমাকে কিছুক্ষণের জন্যে মরতে হয়েছিল যে তোমাকে ফাঁদে ফেলবার জন্যেই! তুমি আমাকে যথেষ্ট জ্বালিয়েছ। সত্যি কথা বলতে কি, এত অল্প সময়ের মধ্যে আর কেউই আমাকে এত বেশি জ্বালাতন করতে পারেনি। তোমার বুদ্ধির তারিফ করি। কিন্তু এও জেনে রাখো অবলা, শেষপর্যন্ত অসাধুতার জয় কখনও হয় না।’

অবলা বললে, ‘বৎস বিমল, তোমার হিতোপদেশ বন্ধ করো, ওসব বুলি আমারও অজানা নেই। এখন আমাকে নিয়ে যা করবার হয়, করো।’

জয়ন্ত বললে, ‘আমাদের প্রথম কর্তব্য হচ্ছে, তোমার কাছ থেকে জেরিনার কণ্ঠহার আদায় করা।’

সুন্দরবাবু চমকে উঠে বললেন, ‘অ্যাঁঃ! অবলা—নচ্ছার কণ্ঠহারটা এরই—মধ্যে চুরি করতে পেরেছে নাকি।’

জয়ন্ত বললে, ‘হ্যাঁ, কণ্ঠহার চুরি করবার পরেই আমরা দেখা দিয়েছি।’

অবলা হাসিমুখে বললে, ‘না, কণ্ঠহার আমার কাছে নেই।’

—’নেই?’

—’না। তোমাদের দেখে আমি যখন ভোঁদার পিছনে সরে দাঁড়াই, কণ্ঠহারটা তখনই লুকিয়ে তার পকেটে ফেলে দিয়েছি।’

—’তুমি বলতে চাও, ভোঁদা কণ্ঠহার নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে?’

—’হ্যাঁ। তোমরা আমাকে ধরলেও কণ্ঠহার পাবে না। আমার আসল উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে।’

সুন্দরবাবু ও জয়ন্ত এগিয়ে গিয়ে অবলার জামাকাপড় তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখলেন। কিন্তু কণ্ঠহার পাওয়া গেল না।

অবলা বললে, ‘দেখছ তো, হেরেও আমি জিতে গেলুম?’

সুন্দরবাবু রাগে গসগস করতে করতে বললেন, ‘হতভাগার বাদুড়ে মুখখানা থাবড়া মেরে ভেঙে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে!’

অবলা বললে, ‘ওহে খুদে দারোগা, আর এখানে দাঁড়িয়ে বীরত্ব দেখিয়ে কোনওই লাভ নেই। কণ্ঠহারের আশা ছেড়ে এখন আমায় থানায় নিয়ে চলো দেখি। আমার ঘুম পেয়েছে।’

সুন্দরবাবু ধাক্কা মেরে অবলাকে পাহারাওয়ালাদের দিকে ঠেলে দিতে গেলেন, কিন্তু তাকে এক ইঞ্চিও নড়াতে পারলেন না।

অবলা খিলখিল করে হেসে বললে, ‘ওহে পুঁচকে বীরপুরুষ! তোমার নিজের শক্তি দেখছ তো? এখন যদি আমার হাত খোলা থাকত, তোমার কী অবস্থা হত বলো দেখি?’

সুন্দরবাবু রাগে অজ্ঞানের মতো হয়ে চেঁচিয়ে বললেন, ‘হুম, হুম! এই সেপাই ছুঁচোটাকে ধাক্কা মারতে মারতে ওখান থেকে নিয়ে চলো দেখি! হুম!’

জয়ন্ত বললে, ‘সুন্দরবাবু, লোকটা সুবিধের নয়, আমরাও আপনার সঙ্গে থানা পর্যন্ত যাব নাকি?’

সুন্দরবাবু তাচ্ছিল্যভরে বললেন, ‘সঙ্গে সেপাই রয়েছে, অবলারও হাত বাঁধা, তোমাদের সাহায্যের দরকার নেই। মোটরে উঠে থানায় পৌঁছোতে ছ—সাত মিনিটের বেশি লাগবে না।’

সুন্দরবাবু অবলাকে নিয়ে চলে গেলেন।

জয়ন্ত ফিরে দেখলে, সামনের দিকে তাকিয়ে বিমল চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সেও সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলে। তারপর হাসিমুখে বললে, ‘বিমলবাবু, আপনি কী ভাবছেন হয়তো আমি তা বলতে পারি।’

—’বলুন দেখি।’

—’আপনি ভাবছেন, অবলা এইমাত্র কণ্ঠহারের যে কাহিনি বললে, হয়তো সেটা সত্য নয়।’

—’ঠিক। তারপর?’

—’আপনি আরও ভাবছেন, অবলা এতক্ষণ যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখানে অনেক ফুলগাছ আর হাস্নুহানার বড়ো ঝোপ রয়েছে। ওখানটা একবার ভালো করে খুঁজে দেখা দরকার।’

—’বাহাদুর জয়ন্তবাবু, আপনি আমার মনের কথা ঠিক ধরতে পেরেছেন। অতএব কুমার, বাড়ির ভেতর থেকে তুমি একটা পেট্রলের লণ্ঠন জ্বেলে নিয়ে এসো।’

কুমার তাড়াতাড়ি ছুটল এবং পেট্রলের লণ্ঠন নিয়ে ফিরে এল।

বিমলের সন্দেহ মিথ্যে নয়। অল্পক্ষণ খোঁজবার পরেই হাস্নুহানার ঝোপের ভিতরেই পাওয়া গেল জেরিনার কণ্ঠহার!

কুমার সানন্দে বললে, ‘অবলা গ্রেপ্তার—কণ্ঠহার উদ্ধার! ব্যাস আমরাও নিশ্চিন্ত!’

ঠিক সেই সময়ে মহাবেগে সুন্দরবাবুর দ্বিতীয় আবির্ভাব বিষম! চিৎকার করতে করতে তিনি বলছেন, ‘সর্বনাশ হয়েছে! অবলা আবার পালিয়েছে।’