জেরিনার কণ্ঠহার – ১০

দশম পরিচ্ছেদ – শেষ রাতে

বিমল অত্যন্ত আশ্চর্য স্বরে বললে, ‘অবলা আবার পালিয়েছে! বলেন কি সুন্দরবাবু?’

সুন্দরবাবু প্রায় কাঁদো—কাঁদো গলায় বললেন, ‘আর কিছু বলবার মুখ আমার নেই ভায়া। তোমরা অনায়াসেই আমার এক গালে চুন আর এক গালে কালি মাখিয়ে দিতে পারো। আমি একটুও আপত্তি করব না।’

জয়ন্ত বললে, ‘অবলার হাত বাঁধা, আপনার সঙ্গে ছিল সার্জেন্ট আর পাহারাওয়ালা, তবু সে পালাল কেমন করে?’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম, কেমন করে? সে এক অদ্ভুত কাণ্ড ভাই, অদ্ভুত কাণ্ড! পুলিশের ওপর ডাকাতি—অশ্রুতপূর্ব ব্যাপার!’

—’কী বলছেন আপনি!’

—’তাহলে শোনো। অবলাকে নিয়ে আমরা তো মোটরে উঠে থানার দিকে চললুম—গাড়িতে আমার সঙ্গে ছিল একজন সাব—ইনস্পেকটার, একজন সার্জেন্ট, আর দুজন পাহারাওয়ালা। খানিক দূর এগিয়েই দেখলুম, পথ জুড়ে আড়াআড়ি ভাবে একখানা মোটর দাঁড়িয়ে রয়েছে, আর একটা লোক তার মেশিনের ঢাকনা খুলে কী যেন পরীক্ষা করছে। পথ জোড়া দেখে আমার ড্রাইভারও বাধ্য হয়ে গাড়ি থামিয়ে ফেললে, আর তার পরমুহূর্তেই তোমাদের বলব কী ভাই, চোখে—কানে কিছু দেখবার শুনবার আগেই, কোত্থেকে কারা এসে বিপুল বিক্রমে আমাদের এমন আক্রমণ করলে যে, আমরা কেউ একখানা হাত তোলবারও অবকাশ পেলুম না! চারিদিকে দেখলুম সর্ষেফুলে ভরা ঘোর অন্ধকার, সর্বাঙ্গে খেলুম কিল—চড় আর ডান্ডার গুঁতো, তার পরের সেকেন্ডেই অনুভব করলুম আমি চিতপাত হয়ে শুয়ে আছি রাস্তার ধুলোয়!…একখানা গাড়ি ছুটে চলে যাওয়ার শব্দ শুনে ধড়মড় করে উঠে বসে দেখি, অচেনা মোটরখানা অদৃশ্য, আমাদের মোটরখানা দাঁড়িয়ে আছে, আর আমার সঙ্গীরা রাস্তায় গড়াগড়ি দিতে দিতে আর্তনাদ করছে!’

—’হুঁ, অবলার দলের সবাই দেখছি খুব কাজের লোক, কেউ কম যায় না। এরই মধ্যে তারা রাজবাড়ি থেকে পালিয়ে আবার তাদের দলপতিকে উদ্ধার করবার জন্য চমৎকার এক ‘প্ল্যান’ ঠিক করে ফেলেছে! বাহাদুর!’

—’হুম, ওদের তো বাহাদুরি দিচ্ছ জয়ন্ত, কিন্তু আমার অবস্থাটা কী হবে বলো দেখি? কালকেই তো খবরের কাগজের রিপোর্টাররা আমাকে নিয়ে যা তা ঠাট্টা শুরু করে দেবে!’

—’আপনিও মোটরে উঠে তাদের পিছনে ছুটলেন না কেন?’

—’সে—চেষ্টাও কি করিনি ভাই? কিন্তু মোটর চালাতে গিয়ে দেখা গেল, তার চাকার ‘টায়ার’গুলো হতভাগারা ছ্যাঁদা করে দিয়ে গেছে!’

—’এই ভয়েই তো আপনার সঙ্গে আমরাও যেতে চেয়েছিলুম সুন্দরবাবু!’

—’বেঁচে গিয়েছ ভায়া, বেঁচে গিয়েছ—আমার সঙ্গে থাকলে তোমাদেরও চোরের মার খেয়ে মরতে হত!’

মানিক বললে, ‘আজ্ঞে না মশাই! আমরা গাড়িতে থাকলে আপনার মতো ঘুমিয়ে পড়তুম না!’

সুন্দরবাবু মহা চটে বললেন, ‘হুম, এ হচ্ছে অত্যন্ত আপত্তিকর কথা। মানিক, তুমি কি আমার চাকরিটি খাবার চেষ্টায় আছ? ঘুমিয়ে পড়েছিলুম মানে?’

—’মানে হচ্ছে এই যে, অত রাত্রে রাস্তা জুড়ে একখানা সন্দেহজনক গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও আপনি সাবধান হতে পারেননি। তা যে পারবেন না, এ তো জানা কথাই। কারণ যখন কারুর নাক ডাকে তখন কেউ কি সাবধান হতে পারে?’

সুন্দরবাবু অভিযোগ করে বললেন, ‘জয়ন্ত, জয়ন্ত! মানিকের আজকের ঠাট্টা আমি কিন্তু সহ্য করতে পারব না! এ বড়ো ‘সিরিয়াস’ ঠাট্টা!’

মানিক বললে, ‘দাঁড়ান না, আমার ঠাট্টাই আপনার গায়ে লাগছে, কিন্তু কাল কাগজওয়ালারা যখন ‘ঘুমন্ত পুলিশের কাণ্ড’ শিরোনাম দিয়ে বড়ো বড়ো প্রবন্ধ রচনা করে ফেলবে, তখন বুঝতে পারবেন কত ধানে কত চাল!’

সুন্দরবাবু করুণভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে ক্ষীণস্বরে বললেন, ‘তা যা বলেছ ভাই! তুমি তো ঘরের লোক—ঠাট্টাও করো, ভালোও বাসো। কিন্তু ওই কাগজওয়ালার দল ওদের আমি ঘৃণা করি!’

বিমল সান্ত্বনা দিয়ে বললে, ‘সুন্দরবাবু, আপনার এত বেশি মুষড়ে পড়ার কারণ নেই। যার জন্যে এত গণ্ডগোল সেই আসল জেরিনার কণ্ঠহার আমরা আবার উদ্ধার করতে পেরেছি।’

সুন্দরবাবু ভয়ানক বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘হুম, বলো কী!’

বিমল সব কথা সংক্ষেপে প্রকাশ করে বললে, ‘কণ্ঠহারটা কি আপনি এখনই নিয়ে যেতে চান?’

সুন্দরবাবু শিউরে উঠে বললেন, ‘বাপ রে, খেপেছ? এই রাত্রে ওই সর্বনেশে কণ্ঠহার নিয়ে পথে বেরুলে কি রক্ষে আছে? যে আশ্চর্য ক্রিমিনালের পাল্লায় পড়েছি, সে সব করতে পারে।’

বিমল যেন কী ভাবতে ভাবতে বললে, ‘হ্যাঁ, অবলা যে অসাধারণ ব্যক্তি, সে—বিষয়ে কোনওই সন্দেহ নেই। হয়তো এই মুহূর্তেই সে আমার বাড়ির আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে!’

সুন্দরবাবু একবার চমকে উঠেই চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ‘নাঃ এতটা সাহস তার হবে না। কারণ সে বিলক্ষণই জানে, এবারে ধরা পড়লে আমি তার একখানা হাড়ও আস্ত রাখব না। যে কিল—চড়—ডান্ডা খেয়েছি, তার শোধ নিতে হবে তো! হুম, পুলিশকে ধরে ঠ্যাঙানো, এত বড়ো আস্পর্ধা!’

বিমল বললে, ‘যাক, যা হবার হয়ে গেছে, এইবার রাত থাকতে থাকতে আপনারা যে যার বাসায় ফিরে একটু ঘুমোবার চেষ্টা করুন গে, যান।’ বলে সে বাগানের ঘাস—জমির উপরে হাত—পা ছড়িয়ে বসে পড়ল।

জয়ন্ত বললে, ‘ওকি, আপনি ওখানে জমি নিলেন কেন? বাড়ির ভেতরে যাবেন না?’

—’না, আমি আর কুমার, এইখানেই খোলা হাওয়ায় খানিক বিশ্রাম করতে চাই। কী বলো কুমার, রাজি আছ?’

—’আলবত।’ বলেই কুমার বিমলের পাশে গিয়ে স্থান গ্রহণ করলে।

জয়ন্ত হেসে কী বলতে গিয়ে আর বললে না, ফিরে হনহন করে বাগানের ফটকের দিকে এগিয়ে চলল এবং তার পিছু নিলেন মানিকের সঙ্গে সুন্দরবাবুও।

পথে বিমলের বাড়ি ছাড়িয়ে মিনিট খানেক অগ্রসর হবার পরেই পাওয়া গেল একটি সরকারি পার্ক।

জয়ন্ত বললে, ‘সুন্দরবাবু, আপনার সঙ্গে তো পাহারাওয়ালা রয়েছে, থানায় একলা যেতে হবে না। অতএব আমি আর মানিক এইখান থেকেই বিদায় নিচ্ছি।’

—’এখান থেকে বিদায় নেবে কেন? তোমাদের বাসা তো থানা ছাড়িয়ে!’

—’বিমলবাবুদের মতো আমরাও পার্কের এই খোলা হাওয়ায় খানিক বিশ্রাম করব।’

সুন্দরবাবু হতভম্বের মতন ভঙ্গি করে বললেন, ‘আমি প্রায় দেখি, তোমাদের আর বিমলবাবুদের মাথায় কেমন একরকম ছিট আছে। বাড়িতে অপেক্ষা করছে বিছানার আরাম, তবু হাটে বাটে যেখানে—সেখানে বিশ্রাম! না, তোমরা যতটা ভাবো আমি ততটা হাঁদা নই! হুম, নিশ্চয়ই এর কোনও মানে আছে!’

—’মানেটা যে কী, বাসায় ফিরে সেইটে আবিষ্কার করে ফেলুন গে’—হাসিমুখে এই কথা বলতে বলতে মানিকের হাত ধরে জয়ন্ত পার্কের ভিতর প্রবেশ করল।

একটা গাছের গুঁড়ির পিছনে আশ্রয় নিয়ে জয়ন্ত বলল, ‘মানিক পথ থেকে আমাদের কেউ দেখতে পাবে না, কিন্তু এখান থেকে আমরা পথের সবাইকেই দেখতে পাব।’

মানিক কৌতূহলী হয়ে বললে, ‘এই শেষ—রাতে পথে তুমি কাকে দেখবার আশা করো?’

—’অবলাকে।’

—’কী বলছ হে?’

—’হ্যাঁ। বিমলবাবুও জানেন, অবলা আজ রাত্রেই আবার ঘটনাস্থলে আসতে বাধ্য। সেইজন্যেই তিনি আজ বাগান ছেড়ে নড়তে রাজি নন।’

—’ও, বুঝেছি! তোমরা বলতে চাও, সেই হাস্নুহানার ঝোপের ভেতর থেকে কণ্ঠহারছড়া উদ্ধার করবার জন্যে আবার হবে অবলার আবির্ভাব?’

—’হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। এখানে তার পুনরাবির্ভাব যদি হয়, আজ রাত্রেই হবে। কারণ অবলার যুক্তি হবে এই : কণ্ঠহার ওই ঝোপেই আছে, বিমল বা অন্য কেউ এখনও তার সন্ধান পায়নি। কিন্তু আজকের রাতটা পুইয়ে গেলে কাল সকালের আলোয় কণ্ঠহারটা নিশ্চয়ই অন্য কারুর চোখে পড়ে যাবে। অতএব হারছড়াটাকে যদি উদ্ধার করতে হয়, আজ রাত্রেই করতে হবে। ও হারের ওপরে অবলার যে বিষম লোভ, এমন সুযোগ সে ছাড়বে বলে মনে হয় না। তার বিশ্বাস, আমরা সবাই এখন যে যার বিছানায় শুয়ে স্বপ্ন দেখছি, বাগান একেবারে নিষ্কণ্টক!’

গ্যাসের আলোয় দেখা যাচ্ছে, বিজন রাজপথ—অত্যন্ত স্তব্ধ। পনেরো মিনিটের মধ্যে একজনও পথিকের সাড়া পাওয়া গেল না।

মানিক বললে, ‘আর একটু পরেই গ্যাসের আলো নিববে, ধীরে ধীরে শহর জেগে উঠবে।’

জয়ন্ত চিন্তিত মুখে বললে, ‘তবে কি অবলা প্রাণের ভয়ে কণ্ঠহারের আশা ত্যাগ করলে! উঁহু, সে তো কাপুরুষ নয়!’

মানিক আগ্রহ—ভরে বললে, ‘দ্যাখো, দ্যাখো। ওই একটা লোক আসছে! লোকটা চোরের মতো ভয়ে ভয়ে চারিদিকে তাকাতে তাকাতে অগ্রসর হচ্ছে।’

—’কিন্তু মানিক, লোকটাকে চেনবার উপায় নেই। ওর মাথা থেকে নাক পর্যন্ত চাদরে ঢাকা! তবে লোকটা খুব জোয়ান আর ঢ্যাঙা বটে!’

—’ও যে বিমলবাবুদের বাড়ির দিকেই এগিয়ে গেল!’

—’এইবারে আমাদেরও পার্কের আশ্রয় ত্যাগ করতে হবে। চলো, কিন্তু সাবধান!’

পার্ক থেকে বেরিয়ে দুজনে উঁকি মেরে দেখলে, লোকটা পথের উপর থেকে অদৃশ্য হয়েছে!

জয়ন্ত নস্যদানি বার করে এক টিপ নস্য নিয়ে খুশি—গলায় বললে, ‘এত তাড়াতাড়ি যখন অদৃশ্য হয়েছে, লোকটা তখন নিশ্চয়ই বিমলবাবুদের বাগানের ভেতরেই ঢুকেছে!’

—’আমরাও এগুব নাকি?’

—’নিশ্চয়।’

কিন্তু কয়েক পা এগুতে না এগুতেই শেষ—রাত্রের স্তব্ধতা ভেঙে গেল উপর—উপরি তিনবার রিভলভারের গর্জনে। জয়ন্ত ও মানিক বেগে ছুটতে আরম্ভ করলে।

বিমলদের বাড়ির কাছে পৌঁছেই তারা দেখলে, বাগানের পাঁচিল টপকে ঠিক সামনেই লাফিয়ে পড়ল একটা লোক।

জয়ন্তও তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাঘের মতো, লোকটা কোনও বাধা দেবার আগেই প্রচণ্ড দুই ঘুষি খেয়ে মাটির উপরে ঘুরে পড়ে গেল।

মানিক হেঁট হয়ে দেখে বললে, ‘একেবারে অজ্ঞান হয়ে গেছে।’

পরমুহূর্তে পাঁচিলের উপর থেকেই পথে অবতীর্ণ হল বিমল ও কুমার।

জয়ন্ত বললে, ‘ওই দেখুন বিমলবাবু, আপনার আসামিকে।’

বিমল সচকিত কণ্ঠে বললে, ‘আপনারা! তাহলে আপনারাও জানতেন, অবলা আজ আবার আসবে?’

—’নইলে ঘর থাকতে বাবুই ভিজবে কেন? এই রাতে পথ আশ্রয় করব কেন? কিন্তু বিমলবাবু, যাকে ধরেছি সে অবলা নয়, ভোঁদা।’

—’ভোঁদা?’ বিমলের মুখে হতাশার ভাব ফুটে উঠল।

—’হ্যাঁ বিমলবাবু। অবলা এত সহজে ধরা পড়বার ছেলে নয়। চালাকের মতন ভোঁদাকে সে প্রতিনিধি করে পাঠিয়েছে।’

—’যাক, উপায় কী? ভোঁদাও বড়ো কম পাত্র নয়, অবলার ডান হাত।’

—’এখন একে নিয়ে কী করা যাবে?’

—’সে কথা সকালে ভাবব। আজ তো ওকে আমার বাড়িতে বন্দি করে রেখে দি। কি বলেন?’

—’বেশ।’

একাদশ পরিচ্ছেদ – অনাহুত অতিথি

কাল শেষ—রাত পর্যন্ত ঘুমের সঙ্গে ছিল বিচ্ছেদ, আজ সকালে তাই বেলা নটার আগে বিমলের ঘুম ভাঙল না।

সে বিছানা ছেড়ে উঠেই শুনলে, কুমারের নাসিকা—বাঁশরি এখনও তান—ছাড়া বন্ধ করেনি।

চেঁচিয়ে ডাকলে, ‘বলি কুমার! ওহে কুমার! এখন নিদ্রাভঙ্গের আয়োজন করো। প্রভাতের পরমায়ু ফুরোতে আর দেরি নেই!’

কুমার এপাশ থেকে ওপাশে ফিরল। তারপর দুই চোখ মুদেই বললে, ‘নিদ্রাভঙ্গের আয়োজন তো করব, কিন্তু উপকরণ কই?’

—’অর্থাৎ এক পেয়ালা গরম চা?’

—’নিশ্চয়। আগে চা আসুক, তবে আমি চোখ খুলব।’

বিমল ডাকলে, ‘রামহরি! ওগো রামহরি! বলি তুমিও ঘুমচ্ছো নাকি? স্টোভের ওপরে গরম জল ভরা কেটলির সঙ্গীত শুনতে পাচ্ছি না কেন?’

রামহরি বিশেষ চিন্তিত মুখে ঘরের ভিতরে ঢুকে বললে, ‘থামো খোকাবাবু, অত আর চ্যাঁচাতে হবে না। ওদিকে কী কাণ্ডটা হয়েছে শুনলে তোমাদের চক্ষুস্থির হয়ে যাবে।’

কুমার চোখ মেলে বললে, ‘চক্ষুস্থির হোক আর না হোক, তোমার কথা শুনে এই আমি চক্ষু উন্মীলিত করলুম। কী কাণ্ড হয়েছে রামহরি?’

—’তোমাদের সেই ভোঁদা বেটা লম্বা দিয়েছে।’

বিমল কিছুমাত্র ব্যস্ত না হয়ে বললে, ‘তাই নাকি?’

কুমার খালি বললে, ‘ও।’

—’তোমাদের কি মনে নেই, একতলার যে—ঘরে ভোঁদাকে বন্ধ করে রেখেছিলে, তার একটা জানলার একটা গরাদ ভাঙা? ভোঁদা সেইখান দিয়েই পালিয়েছে।’

বিমল বললে, ‘তাই নাকি?’

কুমার বললে, ‘ও!’

রামহরি বিস্মিত স্বরে বললে, ‘তোমরা দুজনে কাল কি সিদ্ধিটিদ্ধি কিছু খেয়েছ?’

—’কেন?’

—’নইলে অত কষ্ট করে যাকে ধরলে, সে পালিয়েছে শুনেও তোমাদের টনক নড়ছে না কেন?’

বিমল খিলখিল করে হেসে উঠল।

কুমার বললে, ‘আমাদের টনক সহজে নড়ে না। যাও রামহরি চা নিয়ে এসো!’

রামহরি হতভম্বের মতন তাদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

বিমল ও কুমার সমস্বরে গর্জন করে উঠল, ‘চা! চা! চা!’

রামহরি নড়ল না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ কী ভাবলে। তারপর হঠাৎ সমুজ্জ্বল মুখে বললে, ‘ওঃ—হো, বুঝেছি।’

—’ঘোড়ার ডিম বুঝেছ!’

—’ঘোড়ার ডিম নয় গো খোকাবাবু, ঠিক বুঝেছি! এতকাল একসঙ্গে ঘর করলুম, তোমাদের মতন মানিক—জোড়কে চিনতে আর পারব না?’

—’বটে?’

—’হ্যাঁ গো, হ্যাঁ! ভোঁদাকে তোমরা ইচ্ছে করেই পালাতে দিয়েছ!’

—’কী করে বুঝলে?’

—’ও ঘরে জানলার গরাদ ভাঙা, সেটা তো তোমরা জানতেই! আর জেনে—শুনেই তোমরা যখন ভোঁদাকে ওই ঘরেই বন্ধ করেছিলে, তখন তোমাদের নিশ্চয় মনের বাসনা ছিল, সে যেন এখান থেকে সরে পড়ে!’

বিমল বললে, ‘তাই নাকি?’

কুমার বললে, ‘ও!’

রামহরি বললে, ‘আর ন্যাকামি করতে হবে না, যাও! সত্যি করে বলো দেখি, আমি ঠিক বুঝেছি কি না?’

বিমল বললে, ‘আমি স্বীকার করছি রামহরি, তুমি ঠিকই আন্দাজ করেছ। এখন দয়া করে চটপট চা এনে দাও দেখি!’

রামহরি গাঁ ধরে মাথা নেড়ে বললে, ‘উঁহু, তা হবে না। আগে বলো, কেন ভোঁদাকে ধরেও ছেড়ে দিলে?’

—’আহা, তুমি জ্বালালে দেখছি! এতটা যখন বুঝেছ তখন এটুকু আর বুঝতে পারছ না যে, ভোঁদাকে ছেড়ে দিয়েছি পালের গোদাকে ধরব বলে!’

—’কেমন করে?’

—’জয়ন্তবাবু আর মানিকবাবু তার পিছনে আছেন। আমরা অবলার এখনকার ঠিকানা জানি না। ভোঁদা পালিয়ে নিজেদের আড্ডা ছেড়ে আর কোথাও যাবে না। সেই আড্ডার সর্দার হচ্ছে অবলা।’

—’খোকাবাবু, বুদ্ধি খেলিয়েছ ভালো! কিন্তু ভোঁদা তো জয়ন্তবাবুদের চেনে, তাঁরা পিছু নিলে সে সন্দেহ করবে না?’

—’রামহরি, তুমি আমাকে খোকাবাবু বলে ডাকো বটে, কিন্তু সত্যিই তো আমি আর খোকা নই! ও—কথা কি আমরাও ভাবিনি! জয়ন্তবাবুরা ভোঁদার পিছনে যাবেন না, যাবে তাঁদের চর।’

—’চর?’

—’হ্যাঁ। তুমি তো জানো না, কাজের সুবিধে হবে বলে জয়ন্তবাবু আজকাল একদল চর পুষছেন। তারা হচ্ছে পথের ছেলে—অনেকেই আগে ছিল ভিখারি। বয়সে তারা ছোকরা বটে, কিন্তু জয়ন্তবাবুর হাতে পড়ে সবাই খুব চালাক হয়ে উঠেছে। তাদের দিয়ে জয়ন্তবাবু এখন অনেক কাজ পান—তারা প্রত্যেকেই নাকি এক—একটি ছোট্টখাট্ট গোয়েন্দা! ভোঁদার পিছু নেবে তাদেরই কেউ। আমরা এখন জয়ন্তবাবুর জন্যেই অপেক্ষা করছি।’

ঠিক সেই সময়ে সিঁড়ির উপরে দ্রুত পায়ের শব্দ শোনা গেল।

কুমার বললে, ‘নিশ্চয় জয়ন্তবাবু আর মানিকবাবু আসছেন। রামহরি, আর দাঁড়িয়ে থেকো না, চায়ের ব্যবস্থা করো—গে যাও।’

—’চা? তা দু—এক কাপ চা পেলে মন্দ হয় না।’ বলতে বলতে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলে একমুখ হাসি নিয়ে স্বয়ং অবলা এবং তার পিছনে পিছনে ভোঁদা। তাদের দুজনেরই হাতে রিভলভার।

বিমল, কুমার ও রামহরির মুখের ভাব দেখলে মনে হয়, তাদের চোখের সামনে যেন প্রেতমূর্তির আবির্ভাব হয়েছে।

খিলখিল করে মেয়ে—হাসি হেসে অবলা বললে, ‘হে গর্দভরাজ বিমল, আমাদের দেখে তুমি কি বড়োই আশ্চর্য হয়েছ? কেন বলো দেখি? তোমরা তো আমাকেই খুঁজছিলে। সেইজন্যেই তো তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলুম।’

হতভম্ব বিমলের মুখ দিয়ে একটাও কথা বেরুল না, অবলার দুর্জয় সাহস দেখে বিস্ময়ে প্রায় হতজ্ঞান হয়ে গেল।

অবলা রিভলভারটা বাগিয়ে ধরে একখানা চেয়ারের উপরে বসে পড়ে বললে, ‘ভোঁদা, তুই ওপাশে গিয়ে দাঁড়া। এরা কেউ একটা আঙুল নাড়লেই গুলি করবি।…বিমল, এখনও তোমার বিশ্বাস বোধহয় যে, সূক্ষ্মবুদ্ধি আর বিচারশক্তিতে তুমি হচ্ছ একটি অদ্বিতীয় জীব? আর আমি হচ্ছি একটি আস্ত হাঁদারাম? যে—ঘরের জানলা ভাঙা সে—ঘরে ভোঁদাকে বন্ধ করার মানেই যে তাকে ছেড়ে দেওয়া, এ—কথাটাও আমি বুঝতে পারব না? তোমরা ভেবেছিলে ভোঁদার পিছু নিলেই আমার ঠিকানা জানতে পারবে? বেশ, এই তো আমি নিজেই এসেছি, আমাকে নিয়ে কী করতে চাও, বলো।’

কুমার ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললে, ‘তুমি চোর, তুমি ডাকাত, তুমি খুনে। তোমাকে আমরা গ্রেপ্তার করতে চাই।’

—’ওরে বাপ রে, কী উচ্চাকাঙ্ক্ষা! এই তো আমি হাজির, গ্রেপ্তার করবার হুকুম হোক।’

বিমল স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। কুমার অত্যন্ত অসহায়ের মতো অবলার ও ভোঁদার রিভলভারের দিকে তাকিয়ে দেখলে। রামহরি আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপন মনে বিড়বিড় করে কী বকতে লাগল।

অবলা বললে, ‘আমাকে গ্রেতার করবি? আস্পর্ধার কথা শোনো একবার! তোদের মতো চুনোপুঁটির হাতে ধরা পড়বার জন্যে আমার জন্ম হয়নি, বুঝেছিস? পদে পদে আমার কাছে নাকাল হচ্ছিস, তবু তোদের চৈতন্য হল না?’

ভোঁদা বললে, ‘কর্তা, মিছে কথা বলে কাজ নেই, যা করতে এসেছেন চটপট সেরে ফেলুন।’

অবলা বললে, ‘কেন রে ভোঁদা, তাড়াতাড়ির দরকার কী? জয়ন্ত আর মানিক তাদের চ্যালা—চামুণ্ডা দিয়ে আমাদের খালি—বাসার ওপরে যত খুশি পাহারা দিক না, আমরা তো সেখানে নেই—সেখানে আর ফিরেও যাব না, তবে তোর ভয় কিসের বল দেখি?’

ভোঁদা বললে, ‘ওরা যদি পুলিশে খবর দেয়?’

—’যদি নয় রে ভোঁদা, নিশ্চয় এতক্ষণে পুলিশ খবর পেয়েছে। কিন্তু খবর পেয়েই তো মোটকা গোয়েন্দা সুন্দরলাল আমাকে ধরবার জন্যে ছুটে আসতে পারবে না। ইংরেজদের যতই দোষ থাক, তাদের আইন ভারী চমৎকার রে। সুন্দরকে আগে তার কর্তাদের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে, তারপর আমাদের এই নতুন বাসা ‘সার্চ’ করবার জন্য আলাদা হুকুম নিতে হবে। কাজে—কাজেই আমি এখন খানিকক্ষণের জন্য নিশ্চিন্ত হয়ে বিমলের সঙ্গে গল্প করতে পারি—কি বলো বিমলভায়া, তাই নয় কি? তুমি বোধ করি ভাবছ যে, জয়ন্তের ঈগল—চক্ষুর পাহারাকে ফাঁকি দিয়ে কেমন করে আমি এখানে এলুম? গুপ্তদ্বার ভায়া, গুপ্তদ্বার! জয়ন্ত জানে না, আমার নতুন বাসার পিছন দিয়ে পালাবার জন্যে একটা লুকানো পথ আছে!’

বিমল এতক্ষণ পরে বললে, ‘অবলা, তোমার সাহস দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি।’

চেয়ারে বসে পা নাচাতে নাচাতে অবলা বললে, ‘হুঁ, তোমার বিস্মিত হওয়াই উচিত! সাহস তো আমার আছেই, তার উপরে আছে মৌলিকতা! আমি কাজ করি নতুন পদ্ধতিতে—অন্য লোক যেখানে দেখে অসম্ভব সব বাধা, আমি সেখানে অনায়াসেই সহজ পথ আবিষ্কার করতে পারি। দ্যাখো না, নইলে সোজা লম্বা না দিয়ে আজ কি আমি তোমার সঙ্গে আলাপ করতে আসতে পারতুম? কী বিমল, মাঝে মাঝে আড়চোখে ওই টেবিলটার দিকে তাকিয়ে কী দেখছ বলো দেখি? ওর কোনও টানায় রিভলভার—টিভলভার কিছু আছে বুঝি? ভাবছ, একটু ফাঁক পেলেই ওইদিকে হাত বাড়াবে? কিন্তু ও—বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকো, ফাঁক তুমি পাবে না—নড়েছ কি গুলি করেছি!…হুঁ, ভালো কথা! ওই টেবিলের টানায় সেই কণ্ঠহারটা তুমি লুকিয়ে রাখোনি তো?’

বিমল বললে, ‘কণ্ঠহার আমি সুন্দরবাবুর হাতে দিয়েছি।’

—’কখন? কাল রাত্রে? আমার হাত থেকে ঠ্যাঙানি খাবার পরও সুন্দর এখানে এসে কণ্ঠহার নিয়ে গেছে?’

—’হুঁ।’

—’আমি একথা বিশ্বাস করি না। সে—অবস্থায় কণ্ঠহার নিয়ে যাবার সাহস নিশ্চয় তার হয়নি। আর অত রাত্রে হার—ছড়া হাতছাড়া করবে, তুমিও এমন বোকা নও।…ভোঁদা, এদের ওপরে আমি নজর রাখছি, তুই টেবিলের টানাগুলো খুলে দেখ তো!’

ভোঁদা হুকুমমতো কাজ করলে। কোনও টানাই চাবি—বন্ধ ছিল না। সেগুলো হাতড়ে একটা রিভলভার বের করে নিয়ে সে বললে, ‘এখানে কণ্ঠহার নেই, কিন্তু এটা ছিল।’

—’রিভলভার? আমি আগেই জানতুম, বিমলের হাত ওটা নেবার জন্যে নিশপিশ করছে! কিন্তু বাপু, তুমি কার পাল্লায় পড়েছ, জানো তো? এখন যা চাই, বার করো দেখি। কোথায় সেই কণ্ঠহার?’

—’সুন্দরবাবুর কাছে।’

—’আবার ধাপ্পা? সাবধান বিমল, আগুন নিয়ে খেলা কোরো না। ওই কণ্ঠহারের জন্যে আমি প্রাণ পর্যন্ত পণ করেছি, এখানে আমি এত বিপদ মাথায় নিয়ে ছেলেখেলা করতে আসিনি! যদি দরকার হয়, এখনই তোমাদের তিনজনকে খুন করেও আমি কণ্ঠহার নিয়ে যাব।’

বিমল অবহেলা—ভরে বললে, ‘খুন করতে তোমার যে হাত কাঁপে না, তা আমি জানি। এখনও আমার গলায় দড়ির দাগ মিলোয়নি।’

সকৌতুকে অবলা হাসতে লাগল এবং সে হাসির সঙ্গে নীরবে যোগ দিলে যেন তার একটিমাত্র চক্ষুও। তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললে, ‘সেবারে দৈবগতিকে গলার দড়িকে ফাঁকি দিয়েছ বলে মনে কোরো না যেন, এবারেও আমার হাতের রিভলভারকে ফাঁকি দিতে পারবে! আমি এখানে এসেছি কণ্ঠহার নিয়ে যাবার জন্যে।’

বিমল বললে, ‘কিন্তু আমার কথা তো শুনলে। কণ্ঠহার আমার কাছে নেই।’

অবলা উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ‘ভোঁদা, তোর রিভলভারটাও আমাকে দে। এই আমি দু—হাতে দুটো রিভলভার নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম, তুই আগে বিমল আর কুমারের জামাকাপড়গুলো ভালো করে খুঁজে দেখ।’

হঠাৎ বাইরের রাস্তা থেকে কে খুব জোরে তিনবার শিস দিলে।

অবলা ও ভোঁদা দুজনেই চমকে উঠল।

ভোঁদা সভয়ে বললে, ‘মোনা শিস দিলে! পুলিশ আসছে!’

—’অ্যাঁঃ, আমার হিসেব গুলিয়ে গেল? পুলিশ কী করে এত শীঘ্র খবর পেলে?’—বলতে বলতে অবলা একলাফে ঘরের বাইরে গিয়ে পড়ল—সঙ্গে সঙ্গে ভোঁদাও। পরমুহূর্তে তারা অদৃশ্য এবং সিঁড়ির উপরে দ্রুত পদশব্দ!

বিমলও একলাফে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ‘শীঘ্র এসো কুমার। অবলাকে যদি ধরতে হয় তবে আজকেই ধরতে হবে!’

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – বন্যা

সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে নামতেই বিমল ও কুমার শুনতে পেলে, একখানা মোটরগাড়ি ছোটার আওয়াজ।

কুমার বললে, ‘অবলা আবার ভাগল!’

বিমল ছুটে সদর দরজা থেকে বেরিয়েই ডানদিকে তাকিয়ে দেখলে, একখানা লাল রঙের মোটর যেন ঝড়ো হাওয়ার আগে উড়ে চলেছে!

বাঁ—দিকেও গাড়ির শব্দ শুনে তারা ফিরে তাকাল। আর একখানা মোটর ঠিক সেইখানেই এসে থামল এবং গাড়ির হুইল ছেড়ে নীচে লাফিয়ে পড়ল জয়ন্ত।

তাকে কোনও কথা বলবার সময় না দিয়ে বিমল বললে, ‘ওই লাল গাড়িতে অবলা পালাচ্ছে!’

আর কিছু বলতে হল না। জয়ন্ত আবার একলাফে ড্রাইভারের আসনে গিয়ে বসল—সঙ্গে সঙ্গে বিমল ও কুমারও গাড়ির ভিতরে উঠে পড়ল। মানিকও সেখানে ছিল। গাড়ি ছুটল তিরবেগে।

বিমল বললে, ‘জয়ন্তবাবু, আপনি কেমন করে অবলার খবর পেলেন?’

গাড়ি চালাতে চালাতে সামনের দিকে তীক্ষ্নদৃষ্টি রেখে জয়ন্ত বললে, ‘ভাগ্যিস আমার এক ছোকরাকে এইখানে পাহারায় রেখে গিয়েছিলুম! সেই—ই আমাকে ছুটে গিয়ে খবর দিয়েছে!’

মানিক বললে, ‘উঃ, কী জোরে অবলাদের গাড়ি ছুটছে! অ্যাক্সিডেন্ট হল বলে!’

কিন্তু তাদের, না অবলাদের গাড়ি—কাদের গাড়ি ছুটছে বেশি বেগে? দুখানা গাড়িই যেন পাগলা হয়ে জনাকীর্ণ রাজপথে বিষল বিশৃঙ্খলা ও উত্তেজনার সৃষ্টি করলে। প্রথম গাড়িখানা এড়াতে না এড়াতেই দ্বিতীয় গাড়িখানা পথিকদের উপরে এসে পড়ে হুড়মুড় করে! কেউ পথের উপরে আছাড় খেয়ে আর্তনাদ করে ওঠে, কেউ ভয়ে চিৎকার করে, কেউ রেগে গালাগালি দেয়, বিস্মিত কুকুররা ঘেউ—ঘেউ রবে প্রতিবাদ করতে থাকে, অন্যান্য গাড়িগুলো কোনওরকমে পাশ কাটিয়ে নিজেদের সামলে নেয়। এক জায়গায় একটা পাহারাওয়ালা লাল গাড়িখানাকে বাধা দেবার চেষ্টা করবামাত্র মোটরের ভিতর থেকে হল রিভলভারের গুলিবৃষ্টি! পাহারাওয়ালা ‘বাপ রে বাপ’ বলে চেঁচিয়ে উঠে লম্বা দৌড় মেরে পৈতৃক প্রাণ রক্ষা করলে।

দুখানা গাড়ির মধ্যে ব্যবধান ছিল যথেষ্ট। জয়ন্ত অনেক চেষ্টা করেও সে ব্যবধান কমাতে পারলে না। সে তিক্তস্বরে বললে, ‘ও গাড়িখানাকে যদি আরও একটু কাছে পাই, তাহলে গুলি করে ওর ‘টায়ার’ ছ্যাঁদা করে দিতে পারি।’

লাল গাড়ি একটা তেমাথায় গিয়ে হঠাৎ মোড় ফিরে অদৃশ্য হল।

কয়েক মুহূর্ত পরে জয়ন্তও মোড় ফিরে বিস্মিত কণ্ঠে বললে, ‘দেখুন বিমলবাবু! মোড় ফিরেই আমরা অবলাদের কত কাছে এসে পড়লুম!’

সকলে দেখলে সত্যি—সত্যিই দুখানা গাড়ির মধ্যে ব্যবধান অনেকটা কমে গিয়েছে।

বিমল উত্তেজিত ভাবে বললে, ‘তার মানে হচ্ছে, মোড় ফিরে আমাদের চোখের আড়ালে এসেই অবলাদের গাড়ি নিশ্চয় একবার থেমে দাঁড়িয়েছিল!’

কুমার বললে, ‘আর সঙ্গে সঙ্গে অবলাও গাড়ি ছেড়ে নেমে পড়েছে। খাসা ফন্দি! আমরা ছুটব লাল গাড়ির পিছনে, আর অবলা দেবে সোজা লম্বা!’

বিমল বললে, ‘আর বাসায় ফিরে গর্দভরাজ বিমলের কথা ভেবে হেসে লুটিয়ে পড়বে।’

জয়ন্ত বললে, ‘অবলা যে পালিয়েছে তাতে আর সন্দেহ নেই। কিন্তু সে গেল কোন দিকে? ডাইনে তো একটা সরু গলি দেখছি!’ বলেই সে নিজের গাড়ি থামিয়ে ফেললে।

বিমল গলির মোড়ের একটা দোকানের দিকে তাকিয়ে হাঁকলে, ‘ওহে দোকানি, এখুনি একখানা লাল গাড়ি এখানে দাঁড়িয়েছিল?’

—’হ্যাঁ বাবু! সর্বনেশে গাড়ি! যেন তুফান মেল! আপনারাও তো কম যান না দেখছি! আজ কি শহরের রাস্তায় মোটরের রেস চলেছে?’

বিমল অধীর স্বরে বললে, ‘লাল গাড়ি থেকে কেউ এখানে নেমেছে?’

—’হ্যাঁ! মস্ত লম্বা একটা জোয়ান লোক গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে ওই গলির ভেতরে ছুটে চলে গেল!’

ততক্ষণে জয়ন্তের গাড়ি থেকেও সবাই নীচে নেমে পড়েছে।

কুমার বললে, ‘দোকানি, এ গলিটা দিয়ে বেরুনো যায়?’

—’না বাবু!’

জয়ন্ত গলির দিকে ছুটল।

বিমল বললে, ‘সাবধান জয়ন্তবাবু! রিভলভারটা বার করে গলির ভেতরে ঢুকুন! অবলা সশস্ত্র!’

মানিক বললে, ‘আমিও রিভলভার এনেছি। আপনারা?’

—’আমরা নিরস্ত্র।’

—’তাহলে আপনারা এইখানেই অপেক্ষা করুন।’

—’বলেন কী! শত্রুর রিভলভারের ভয়ে পশ্চাৎপদ হবার মতন বুদ্ধিমান আমরা নই! চলুন—আর দেরি নয়!’

সকলে অতি সতর্কভাবে আশেপাশে আনাচে—কানাচে তাকাতে তাকাতে এগুতে লাগল। সেই সাপের মতন পাকখাওয়া গলিটা প্রায় দেড়—শো ফুট লম্বা। দু—তিনজন লোককে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, একজন ঢ্যাঙা লোক ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গলির ভিতর দিকে চলে গিয়েছে।

কিন্তু সারা গলি খুঁজেও অবলার কোনও পাত্তাই মিলল না।

মানিক সন্দেহ প্রকাশ করলে, ‘এ গলির ভেতরেও হয়তো অবলার কোনও আড্ডা আছে।’

কুমার বললে, ‘অসম্ভব নয়। কিংবা সে কোনও অচেনা বাড়ির ভেতরে ঢুকে লুকিয়ে আছে!’

কুমারের কথা শেষ হতে—না—হতেই একখানা বাড়ির মধ্যে উঠল মেয়ে—পুরুষ নানা কণ্ঠে বিষম গণ্ডগোল :—’ওমা কী হবে গো!’ ‘পুলিশ, পুলিশ!’—’ডাকাত, গুন্ডা!’

জয়ন্ত বললে, ‘গোলমালটা আসছে ওই বাড়ির ভেতর থেকে! নিশ্চয় ওখানে অবলার আবির্ভাব হয়েছে!’

সকলে দৌড়ে একখানা তেতলা বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করল।

উঠানের পাশে একতলার দালানে তিন—চারজন মেয়ে ও দুজন পুরুষ দাঁড়িয়ে ভীত, উত্তেজিত স্বরে ক্রমাগত চিৎকার করছে!

বিমল বললে, ‘ব্যাপার কী, ব্যাপার কী?’

একজন উত্তর দিলে, ‘গুন্ডা মশাই, ডাকাত। দু—হাতে তার দুটো পিস্তল!’

—’কোথায় সে?’

—’তেতলার’ সিঁড়ি দিয়ে ছাদের ওপরে উঠেছে।’

তেতলার সিঁড়ির সার দেখা যাচ্ছিল। সর্বাগ্রে বিমল, তার পিছনে আর সবাই সিঁড়ি বয়ে উপরে উঠতে লাগল।

একেবারে তেতলার ছাদে। কিন্তু সেখানে কেউ নেই।

জয়ন্ত গলির দিকে ছাদের শেষে ছুটে গিয়ে মুখ বাড়ালে। এবং সেই মুহূর্তেই দেখলে, ছাদ থেকে বৃষ্টির জল বেরুবার যে লোহার পাইপটা নীচে পর্যন্ত চলে গিয়েছে, তার শেষপ্রান্ত ত্যাগ করে অবলা আবার নেমে পড়ল গলির মধ্যেই!

গলি ভরে গিয়েছে তখন কৌতূহলী জনতায়। জন—কয় লোক অবলার দিকে এগিয়ে আসতেই সে ফস করে বার করলে রিভলভার! একে তার প্রকাণ্ড মূর্তি দারুণ ক্রোধে ফুলে আরও বড়ো হয়ে উঠেছে, তার উপরে আবার মারাত্মক রিভলভার আবির্ভাবে জনতার সাহস একেবারে উপে গেল—যে যেদিকে পারল ছুটে পালাতে লাগল। দুই—তিন সেকেন্ডেই পথ সাফ! অবলা আবার বড়ো রাস্তার দিকে দৌড় দিলে।

ততক্ষণে বিমল, জয়ন্ত, কুমার ও মানিক আবার গলিতে নেমে এসেছে।

গলির মুখেই ছিল জয়ন্তের মোটরখানা। অবলা লাফ মেরে তার ভিতরে গিয়ে বসল।

জয়ন্ত চিৎকার করলে, ‘পাকড়ো, পাকড়ো!’

আর পাকড়ো! গাড়ি অদৃশ্য!

তারাও বড়ো রাস্তায় গিয়ে পড়ল।

জয়ন্ত প্রাণপণে চ্যাঁচাতে লাগল, ‘ট্যাক্সি! ট্যাক্সি!’

ট্যাক্সি নেই! কিন্তু একখানা বড়ো ফোর্ড গাড়ির দেখা পাওয়া গেল।

বিমল রাস্তার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে দু—দিকে দুই হাত ছড়িয়ে চেঁচিয়ে বললে, ‘ড্রাইভার, গাড়ি থামাও!’

গাড়ি দাঁড়াল! ভিতর থেকে মুখ বাড়িয়ে একজন হোমরা—চোমরা বাবু বিরক্ত স্বরে বললেন, ‘কে আপনারা? আমার গাড়ি থামালেন কেন?’

তিনি কোনও জবাব পেলেন না। বিমল, কুমার ও মানিক বিনাবাক্যব্যয়ে গাড়ির দরজা ঠেলে ভিতরে গিয়ে বসে আসল মালিককে একেবারে কোণ—ঠাসা করে ফেললে।

জয়ন্ত ড্রাইভারের পাশে গিয়ে আসন গ্রহণ করে বললে, ‘চালাও গাড়ি! খুব জোরসে!’

ড্রাইভার অসহায় ভাবে ফিরে তার মনিবের মুখের পানে তাকালে!

জয়ন্ত পকেট থেকে রিভলভার বার করে বললে, ‘আমার হাতে কী, দেখছ?’

ড্রাইভার দেখেই চমকে উঠল। আর মনিবের হুকুমের দরকার হল না। সে প্রাণপণে গাড়ি চালিয়ে দিলে।

তখন সামনের দিকে অবলার স্বহস্তে চালিত জয়ন্তের গাড়িখানাকে আর দেখাও যাচ্ছিল না।

কুমার বললে, ‘বিমল, আর অবলার আশা ছেড়ে দাও। সে খালি দুর্দান্ত সুকৌশলী সুচতুর নয়, ভাগ্যদেবীও তার প্রতি সদয়।’

মানিক বললে, ‘এই তো আমরা স্ট্র্যান্ড রোডে এসে পড়লুম। এর পরেই গঙ্গার ধার। অবলা কোন দিকে গিয়েছে জানতে হলে আমাদের নামতে হবে।’

জয়ন্ত বললে, ‘কিন্তু মোড়ের মাথায় অত ভিড় কেন? একখানা লরির পাশে পড়ে রয়েছে একখানা ভাঙা মোটর! অ্যাক্সিডেন্ট নাকি? আরে, আরে, এ যে আমারই গাড়ি দেখছি! কিন্তু—’

এক এক লাফে সবাই আবার রাস্তায় নেমে পড়ল।

হ্যাঁ, এখানা জয়ন্তেরই গাড়ি বটে! তার এক অংশ লরির সঙ্গে ধাক্কা লেগে ভেঙে একেবারে চুরমার হয়ে গিয়েছে।

একজন প্রতক্ষদর্শী বললে, ‘লরির ড্রাইভারের কোনও দোষ নেই মশায়! মোটরখানা যে চালাচ্ছিল নিশ্চয় সে পাগল! কিন্তু খুব তার পরমায়ুর জোর, আশ্চর্য—রকম বেঁচে গিয়েছে! তার মাথা ফেটে গিয়েছে বটে—’

বাধা দিয়ে বিমল বললে, ‘কিন্তু সে গেল কোথায়?’

—’গঙ্গার দিকে তিরের মতো ছুটে পালাল।’

সেখান থেকেই গঙ্গা দেখা যাচ্ছিল। তারা আর কিছু শোনবার জন্যে দাঁড়াল না—প্রচণ্ড বেগে দৌড় দিলে গঙ্গার দিকে।

এই তো গঙ্গার ধার! কিন্তু কোথায় অবলা? ঘাটে স্নানার্থীদের ভিড়, কিন্তু তাদের মধ্যে অবলা নেই।

তারা সকলকে প্রশ্ন করতে লাগল। একজন বললে, ‘হ্যাঁ মশাই, একটা রক্তমাখা লোককে দেখেছি বটে! সে তাড়াতাড়ি ঘাটের সিঁড়ি বয়ে জলে গিয়ে পড়ল…ওই দেখুন, ওই যে সাঁতার কাটছে!’

সকলে আগ্রহ—ভরে দেখলে, তীর থেকে খানিক দূরে একটা লোক সাঁতার কেটে বেগে এগিয়ে চলেছে!

বিমল চিৎকার করে বললে, ‘শিগগির একখানা নৌকা ভাড়া করো।’

দুর্ভাগ্যক্রমে ভাড়া যাবার মতো কোনও নৌকাই পাওয়া গেল না।

জয়ন্ত মালকাঁচা মেরে বললে, ‘তাহলে আমাদেরই সাঁতার কাটতে হবে!’

একজন লোক শুনতে পেয়ে বললে, ‘এখন সাঁতার কাটবেন কী মশাই? দেখছেন না, জল থেকে সবাই তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে আসছে?’

—’কেন?’

—’এখনই বান ডাকবে। আজ খুব জোর বান আসবার কথা। আসবে কী—ওই বান এসেছে।’

চারিদিকে চিৎকার উঠল—’বান, বান!’ ‘সাবধান!’ সবাই ওপরে উঠে এসো—সবাই ওপরে উঠে এসো!’

তারপরেই শোনা গেল চতুর্দিক পরিপূর্ণ করে সমুদ্রগর্জনের মতন সুগম্ভীর এক জল—কোলাহল! দেখা গেল, সাগর—তরঙ্গের মতোই উত্তাল এক সুদীর্ঘ তরঙ্গ—রেখা প্রায় সারা গঙ্গা জুড়ে পাকের পর পাক খেতে খেতে ছুটে আসছে—এবং তারই মধ্যে অসংখ্য ক্রুদ্ধ অজগরের মতো ঢেউ—এর দল শূন্যে ছোবল আর ছোবল মারছে! ফেনায়িত গঙ্গা যেন টগবগ করে ফুটতে লাগল।

বানের কবলে পড়ে অবলা সকলের চোখের আড়ালে চলে গেল।

বিমল, কুমার, জয়ন্ত ও মানিক একদৃষ্টিতে বন্যা—তরঙ্গের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

বান যখন বহু দূরে চলে গেল, বিমল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, ‘কুমার, এত করেও অবলাকে ধরতে পারলুম না—শেষটা বান হল আমাদের প্রতিবাদী! আমার বিশ্বাস, অবলা মরবে না!’

জয়ন্ত বললে, ‘হ্যাঁ বিমলবাবু, আমারও সেই বিশ্বাস! এই হল আমার প্রথম পরাজয়!’

বিমল ক্ষুব্ধ স্বরে বললে, ‘এত অল্প সময়ের মধ্যে বারংবার এত বিপদেও কখনও পড়িনি, আর শেষ পর্যন্ত এমন ভাবে আমাকে বোকা বানিয়ে ফাঁকি দিয়ে পালাতেও কেউ পারেনি! অদ্ভুত লোক ওই অবলা!’

কুমার বললে, ‘অবলা অদ্ভুত লোক হতে পারে, কিন্তু জিতেছি আমরাই। বিমল, ভুলে যেয়ো না, জেরিনার কণ্ঠহার আমরা উদ্ধার করতে পেরেছি!’

বিমল বললে, ‘হুঁ, ওইটুকুই যা সান্ত্বনা!’