প্রথম পরিচ্ছেদ – অবলাবিবি নয়, অবলাবাবু
আজকের বিকালবেলাটা বিমলের কাছে কেমন ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছিল। কারণ তার অষ্টপ্রহরের সঙ্গী কুমার বেড়াতে গিয়েছিল মামার বাড়িতে, শান্তিপুরে।
ইজিচেয়ারে শুয়ে শুয়ে সে একখানা মাসিক পত্রিকার পাতা ওলটাচ্ছিল আনমনে।
এমন সময়ে নীচে থেকে মেয়ে—গলায় ডাক এল, ‘বিমলবাবু বাড়িতে আছেন?’
বিমল বিস্মিত হল। কারণ আজ পর্যন্ত কোনও মহিলা আগন্তুকই রাস্তা থেকে এভাবে গলাবাজি করে তার নাম ধরে ডাকেননি।
চেঁচিয়ে বললে, ‘রামহরি, কে ডাকছেন দ্যাখো! ওঁকে বৈঠকখানায় নিয়ে গিয়ে বসাও। আমি এখনই যাচ্ছি।’
রামহরি নিজের মনেই বকবক করতে করতে এগিয়ে গেল—’কালে কালে আরও কতই দেখতে হবে, জানিনে বাপু! রাস্তায় বেরিয়ে মেয়েরাও বাবুদের মতো নাম ধরে চেঁচিয়ে ডাকে! হল কি!’
গেঞ্জির উপরে পাঞ্জাবিটা চড়িয়ে বিমলও নীচে নেমে গেল।
বৈঠকখানায় ঢুকে সবিস্ময়ে দেখলে, একখানা কৌচ জুড়ে বসে আছে অতিকায় এক পুরুষমূর্তি—মানুষের এত মস্ত চেহারা প্রায় অসম্ভব বললেও চলে! উঠে দাঁড়ালে তার মাথা নিশ্চয়ই সাত ফুটের উপরে যাবে, এবং তার বুকের ঘের সহজ অবস্থাতেই বোধহয় পঁয়তাল্লিশ—ছেচল্লিশ ইঞ্চির কম হবে না। তার রং শ্যাম, মুখের আধখানা প্রকাণ্ড চাপদাড়িতে সমাচ্ছন্ন এবং সর্বাঙ্গ দিয়ে যেন একটা উদ্দাম পশুশক্তির উচ্ছ্বাস বয়ে যাচ্ছে। বয়েস তার চল্লিশের ভিতরেই।
বিমল ঘরের এদিক—ওদিক তাকিয়ে বললে, ‘যে মহিলাটি আমায় ডেকেছিলেন, তিনি কোথায় গেলেন?’
মেয়ে—গলায় খিলখিল করে হেসে উঠে আগন্তুক বললে, ‘না বিমলবাবু, ডাকছিলুম আমিই। আমায় কি আপনি মেয়েমানুষ বলে মনে করেন?’
বিমল চমৎকৃত হয়ে হেসে বললে, ‘সর্বনাশ, আপনার মতো প্রচণ্ড পুরুষকে মহিলা বলে শেষটা কি বিপদে পড়ব?’
আগন্তুক বললে, ‘আপনার দোষ নেই, আমার গলা শুনে সকলেই ধোঁধায় পড়ে যান, তারপর আমার চেহারা দেখে চমকে ওঠেন! ভগবানের ভুল মশাই, ভগবানের ভুল! তারপরে বাবাও ভুল করে আমার নাম রেখেছেন অবলাকান্ত!’
বিমল একখানা সোফার উপরে বসে পড়ে বললে, ‘তাই বুঝি আপনি কুস্তি—টুস্তি লড়ে ভগবানের আর পিতার ভ্রম—সংশোধনের চেষ্টা করেন?’
অবলাকান্ত আবার নারীকণ্ঠে হাসতে শুরু করে দিলে।
ওই চেহারার ভিতর থেকে মেয়ে—হাসি শুনে বিমল কেমন অস্বস্তি বোধ করতে লাগল,—এ যেন জয়ঢাক ফুঁড়ে বেরুচ্ছে সেতারের প্রিং—প্রাং!
সে বললে, ‘আমার কাছে কি মশাইয়ের কোনও দরকার আছে!’ এবং বলেই লক্ষ করলে, অবলাকান্ত কানা। তার একটা চোখ পাথরের।
অবলাকান্ত বললে, ‘হ্যাঁ বিমলবাবু, আপনাকে আমার অত্যন্ত দরকার! আমি এখানে এসেছি একটা গোপনীয় পরামর্শ করতে!’
—’আমার মতো অচেনা লোকের সঙ্গে আপনি গোপনীয় পরামর্শ করতে এসেছেন? আশ্চর্য কথা বটে!’
—’বিলক্ষণ! কে বললে আপনি আমার অচেনা! আপনাদের দুঃসাহসিকতার কাহিনি বাংলাদেশের কে না জানে? খালি কি বাংলাদেশ? মঙ্গল গ্রহ পর্যন্ত আপনাদের চিনে ফেলেছে! তাই তো এসেছি আপনার কাছে!’
বিমল কৌতূহলী স্বরে বললে, ‘কিন্তু ব্যাপারটা কী খুলে বলুন তো?’
—’হ্যাঁ, তাই বলব বলেই তো এসেছি। কিন্তু তার আগে অঙ্গীকার করুন, আমার গুপ্তকথা আর কারুর কাছে প্রকাশ করবেন না?’
—’বেশ অঙ্গীকার করছি।’
অবলাকান্ত অল্পক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বললে, ‘আপনারা একবার অসমে যকের ধন আনতে গিয়েছিলেন তো?’
—’হুঁ।’
—’আমি কিন্তু এই কলকাতাতেই এক অদ্ভুত রহস্যের সন্ধান পেয়েছি।’
বিমল তৎক্ষণাৎ সোজা হয়ে বসে বললে, ‘কী রকম?’
—’শুনুন বলি—আমি টালিগঞ্জের পাঁচ নম্বর মণিলাল বসু স্ট্রিটে একখানা বাড়ি ভাড়া নিয়ে আছি। বাড়িখানা খুব বড়ো আর পুরোনো। শুনেছি কোন সেকালে এখানে নাকি এক রাজা বাস করতেন—এখন তাঁর বংশের কেউ নেই। এই বাড়ির সিঁড়ির তলায় চোর—কুঠুরির মতন একখানা ঘর আছে, সে ঘর আমরা ব্যবহার করি না। এই ঘরেরই এক দেয়ালে হঠাৎ আমি একটা গুপ্তদ্বার আবিষ্কার করেছি।’
বিমল বললে, ‘সেকালকার অনেক ধনীর বাড়িতেই এমন গুপ্তদ্বার পাওয়া যায়। এ আর এমন আশ্চর্য কী? আপনি কি সেই গুপ্তদ্বার খুলেছেন?’
—’হ্যাঁ।’
—’খুলে কী দেখলেন?’
—’খালি অন্ধকার।’
—’তাহলে আমার কাছে এসেছেন কেন? অমন অনেক গুপ্তদ্বারই আমি দেখেছি। তাদের পিছনে অন্ধকার থাকতে পারে, কিন্তু কোনও রহস্য থাকে না।’
—’আগে আমার কথা শুনুন। গুপ্তদ্বার খুলে প্রথমে দেখলুম অন্ধকার। তারপর আলো জ্বেলে দেখলুম, একটা সরু পথ। সেই পথ ধরে খানিকটা এগিয়েই কি হল জানেন?’
—’কী হল?’
বিমল দেখলে, অবলাকান্তের পাথরের চোখে কোনও ভাবান্তর হল না বটে, কিন্তু তার অন্য চোখটি দারুণ আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে উঠল। ভীত অভিভূত কণ্ঠে সে বললে, ‘পথটা কতখানি লম্বা জানি না, কারণ, আমার লণ্ঠনের আলো সামনের অন্ধকার ঠেলে বেশিদূর যেতে পারেনি। আমিও হাত পাঁচ—ছয়ের বেশি যেতে না যেতেই শুনতে পেলুম, নিরেট অন্ধকারের ভিতর থেকে বিকট, অমানুষিক স্বরে কে গর্জন করে উঠল। তারপরেই শুনলুম যেন কাদের দ্রুত পদশব্দ—যেন কারা দৌড়ে আমার দিকে তেড়ে আসছে! ভয়ে পাগলের মতো হয়ে আবার বাইরে পালিয়ে এলুম। সে দরজা আবার বন্ধ করে দিয়েছি।’
বিষম কৌতূহলে বিমলের দুই চক্ষু জ্বলে উঠল—এতক্ষণ পরে জাগল তার সত্যিকারের আগ্রহ!
অবলাকান্ত বললে, ‘আমার বিশ্বাস সেই গুপ্তদ্বারের পিছনে যকেরা পাহারা দেয়, আর তার ভিতরে আছে গুপ্তধন! কিন্তু গুপ্তধনের লোভে তো আর প্রাণ দিতে পারি না মশাই!’
বিমল বললে, ‘ওখানে গুপ্তধন আছে কি না জানি না, কিন্তু যক—টক যে নেই এটা একেবারে নিশ্চিত। ওসব আমি মানি না।’
অবলাকান্ত বললে, ‘আমার চেহারাটাই কেবল প্রকাণ্ড, আপনার মতন দুর্জয় সাহস আমার নেই! আর এ—রকম ব্যাপারে আপনার মাথা খুব খেলে জেনেই তো পরামর্শ করতে এসেছি! এখন আমার কী করা কর্তব্য?’
—’সেই গুপ্তদ্বারটা আগে আমাকে একবার দেখাতে পারেন?’
—’কেন পারব না? মনে রাখবেন, গুপ্তধন উদ্ধার করতে পারলে আপনিও তার অংশ থেকে বঞ্চিত হবেন না!’
বিমল শুষ্কস্বরে বললে, ‘গুপ্তধনের কথা এখন থাক। সুড়ঙ্গের রহস্যটা কী আমি কেবল তাই জানতে চাই! আপনি কি এখনই আমাকে নিয়ে যেতে পারবেন?’
—’অনায়াসে। ট্যাক্সিতে চড়ে সেখানে যেতে আধঘণ্টার বেশি লাগবে না।’
—’তাহলে উঠে পড়ুন। আজ আমি দরজাটা খালি চোখে দেখে আসব। কর্তব্য স্থির করব পরে।’
টালিগঞ্জের যে—জায়গায় গিয়ে ট্যাক্সি থামল সেখানটাকে কলকাতা শহরের এক প্রান্ত না বলে প্রায় নির্জন জঙ্গলের প্রান্ত বলা উচিত। লোকজনের আনাগোনা খুব কম—দূর থেকে মাঝে মাঝে কেবল দু—একজন মানুষের উচ্চ কণ্ঠস্বর বা কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। আসন্ন সন্ধ্যার বিষণ্ণ ছায়ায় চারিদিক ঝাপসা হয়ে আসছে ধীরে ধীরে।
বড়ো রাস্তা ছেড়ে অবলাকান্তের সঙ্গে বিমল আরও সরু এমন একটি পথে প্রবেশ করল, যেখান দিয়ে গাড়ি চলবার উপায় নেই।
বেশ খানিকটা এগিয়ে পাওয়া গেল একখানা জরাজীর্ণ, কিন্তু প্রকাণ্ড অট্টালিকা। এই নাকি অবলাকান্তের রাজবাড়ি। কত যুগ আগে সে যে রাজার উপযোগী ছিল, তাকে দেখে আজ তা অনুমান করা সহজ নয়। তার চারিদিকের জঙ্গলাকীর্ণ জমি আচ্ছন্ন করেই কেবল মান্ধাতার আমলের বুড়ো বুড়ো গাছ বিরাজ করছে না, নিজের গায়ে অর্থাৎ দেওয়ালের ওপরেও সে আশ্রয় দিয়েছে রীতিমতো হোমরা—চোমরা অশ্বত্থ—বটকে। অনেক জায়গাতেই জানলা—দরজা পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়েছে, তাদের বদলে রয়েছে কতকগুলো হাঁ—হাঁ করা গর্ত।
বিমল বিস্মিত স্বরে বললে, ‘অবলাকান্তবাবু, এ বাড়িতে থাকেন কী করে?’
অবলাকান্ত বললে, ‘বাড়ির বর্তমান মালিকের এমন পয়সা নেই যে এর আগাগোড়া মেরামত করেন। কিন্তু তিনি একটা মহল ভালো করেই সংস্কার করে দিয়েছেন, কাজেই আমার অসুবিধা হয় না। এই যে, এইদিকে আসুন।’
হ্যাঁ, বাড়ির এ অংশটা বাসের উপযোগী বটে। উপরের কোনও কোনও ঘরে আলো জ্বলছে, নীচের সদর—দরজার সামনে বসে এক দারোয়ান।
অবলাকান্ত দারোয়ানের কাছ থেকে একটা লণ্ঠন চেয়ে নিয়ে বললে, ‘আসুন আমার সঙ্গে। আপনাকে আগেই সেই চোর—কুঠরিটা দেখিয়ে আনি।’
দু—দিকের কয়েকটা ঘর পার হয়েই তারা একটা উঠানে গিয়ে পড়ল। উঠানের এককোণে সেকেলে সিঁড়ির সার এবং তার তলায় একটা মাঝারি আকারের দরজা, কিন্তু অত্যন্ত মজবুত—গায়ে তার লোহার খিল মারা।
অবলাকন্তে দরজার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে আড়ষ্ট স্বরে বললে, ‘ওই দরজাটা খুললেই ওর ভেতরে পাবেন সেই ভয়াবহ গুপ্তদ্বার! সত্যি বলছি বিমলবাবু, আমার কিন্তু এখানে আর দাঁড়াতে সাহস হচ্ছে না!’
বিমল বাইরের দরজা খুলে ফেলে বললে, ‘আপনার ভয় দেখে আমার হাসি পাচ্ছে! কই গুপ্তদ্বার কোথায়? আলোটা ভালো করে তুলে ধরুন দেখি!’ সে একেবারে চোর—কুঠরির ভিতরে গিয়ে দাঁড়াল—এবং সঙ্গে সঙ্গে দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল চোর—কুঠরির দরজা! ঘোর অন্ধকার!
ভিতর থেকে বিস্মিত কণ্ঠে বিমল বললে, ‘একি অবলাকান্তবাবু, দরজা বন্ধ করলেন কেন?’
বাহির থেকে শব্দ শুনে বোঝা গেল, চোর—কুঠরির দরজায় শিকল তুলে দেওয়ার ও তালা—চাবি—লাগানোর শব্দ!
দরজায় ধাক্কা মারতে মারতে বিমল ক্রুদ্ধস্বরে বললে, ‘দরজা খুলে দিন অবলাকান্তবাবু! আমি এ—রকম ঠাট্টা পছন্দ করি না!’
বাহির থেকে নারীকণ্ঠে খিলখিল করে হেসে উঠে অবলাকান্ত বললে, ‘ঠাট্টা নয় হে বিমল, ঠাট্টা নয়! আজ তুমি আমার বন্দি!’
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – রামহরি যা শোনে, ভোলে না
মামার বাড়ি থেকে ফিরে এসে কুমার প্রথমেই ছুটল বিমলের বাড়িতে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে এল বাঘা। তখন সকাল।
এ রাস্তায় বিমলদের দু—খানা বাড়ি ছিল। একখানা খুব বড়ো এবং একখানা খুব ছোটো। বড়ো বাড়িখানায় বাস করতেন বিমলের বহু আত্মীয়—স্বজন—যাঁদের সঙ্গে আমাদের গল্পের কোনও যোগ নেই।
ছোটো বাড়িখানায় বাস করত বিমল নিজে। সে বহু লোকের গোলমাল সহ্য করতে পারত না, তাই ফাই—ফরমাশ খাটবার পক্ষে রামহরিই ছিল যথেষ্ট। বড়ো বাড়িতে যেত কেবল দু—বেলা দুটি আহার করবার জন্যে। বাকি সময়টা তার কেটে যেত ছোটো বাড়ির ছোট্ট বৈঠকখানায় বা লাইব্রেরিতে বসে কখনও পড়াশুনা করে এবং কখনও কুমারের সঙ্গে বিচিত্র ও অসম্ভব সব স্বপ্ন দেখে। শান্তিপূর্ণ নির্জনতায় বাড়িখানিকে মনে হত যেন আশ্রমের মতো।
এ—বাড়ির আর একটি বিশেষত্ব হচ্ছে, পিছনকার বাগান। বিমল ও কুমারের যত্নে এই মাঝারি বাগানখানি সৌন্দর্যে ও ঐশ্বর্যে এমন অপূর্ব হয়ে উঠেছিল যে, অধিকাংশ বিখ্যাত ও বৃহৎ উদ্যানকেও লজ্জা দিতে পারত অনায়াসেই। তারা যখনই পৃথিবীর যে—কোনও দেশে গিয়েছে, তখনই সেখান থেকে নিয়ে এসেছে নানা—জাতের গাছ—গাছড়া। ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার নানা দেশের গাছ ও চারার সঙ্গে মিলে—মিশে বাস করে এখানে বাংলার নিজস্ব বনভূমির রং, গন্ধ, শ্যামলতা।
আঁকাবাঁকা করে কাঁটা একটি খাল নদীর অভাব মেটাবার চেষ্টা করে। টলমলে জলে দোলে পদ্মফুল, আশেপাশে বাহারি ঝোপঝাপ, ছোট্ট নকল পাহাড়, কোথাও সুদৃশ্য সেতু চলে গিয়েছে এ—পার থেকে ও—পারে। এক জায়গায় পাহাড়ের উপর আছে কৃত্রিম ঝরনা। ফুলন্ত লতাপাতায় সমাচ্ছন্ন এতটুকু একখানি কুঁড়েঘরেরও অভাব নেই। বড়ো বড়ো গাছের ঘন পাতার আড়ালে লুকোনো সব খোঁচায় বসে নানান পাখি মিষ্টি সুরের আলাপে চারিদিক করে তুলেছে সঙ্গীতময়। বাগানে এসে দাঁড়ালেই বিস্ময় জাগে, এত অল্প জায়গার ভিতরে এত বৈচিত্র্যের সমাবেশ সম্ভবপর হল কেমন করে?
কুমার বাড়ির সদর—দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল। বৈঠকখানায় কেউ নেই, লাইব্রেরিও শূন্য। উপরে উঠেও কারুর দেখা পেলে না। একটু আশ্চর্য হয়ে ডাকলে, ‘বিমল, বিমল!…রামহরি!’
কারুর সাড়া নেই।
বাঘা ব্যস্তভাবে এ—ঘরে ও—ঘরে ঢুকে ঘেউ—ঘেউ ভাষায় বোধ করি বিমল ও রামহরিকেই ডাকতে লাগল।
কুমার ভাবলে, বিমল তাহলে বাগানের দিকে গেছে। সিঁড়ি দিয়ে আবার নীচে নামবার উপক্রম করছে, এমন সময় সবিস্ময়ে দেখলে, রেলিং ধরে কাতরভাবে উপরে উঠছে রামহরি—তার মাথার চুল, মুখ ও দেহ রক্তমাখা!
মুহূর্তকাল হতভম্বের মতো থেকে কুমার বললে, ‘রামহরি, এ—কী ব্যাপার?’
রামহরি ধপাস করে সিঁড়ির ধাপের উপরে বসে পড়ে বললে, ‘গুন্ডার হাতে পড়েছিলুম বাবু!’
—’গুন্ডার হাতে!’
রামহরি হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, ‘কাল বৈকালে একটা দুশমন চেহারার লোক এসে খোকাবাবুকে ডেকে নিয়ে যায়! অনেক রাত পর্যন্ত খোকাবাবু ফিরল না বলে আমি যখন ভারী ব্যস্ত হয়ে উঠেছি, তখন হঠাৎ সদর—দরজায় কড়া—নাড়া শুনে গিয়ে দেখি, একটা অচেনা লোক দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই সে জিজ্ঞাসা করলে, ‘তোমার নাম কি রামহরি?’ আমি বললুম, ‘হ্যাঁ।’ সে বললে, ‘বিমলবাবু তোমাকে ডাকছেন। শিগগির চলো।’ সামনেই একখানা মোটরগাড়ি দাঁড়িয়েছিল, আমি আর দ্বিরুক্তি না—করে গাড়িতে গিয়ে উঠলুম। তারপর আমরা যখন গড়ের মাঠের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, তখন পাশ থেকে সেই লোকটা হঠাৎ লাঠি তুলে এমন জোরে আমার মাথার ওপর মারলে যে, আমি একেবারে অজ্ঞান হয়ে গেলুম। জ্ঞান হবার পর দেখলুম, সকাল হয়ে গেছে, আমি একটা গাছতলায় শুয়ে আছি, আর গুন্ডারা গাড়ি নিয়ে পালিয়েছে!’
কুমার চমৎকৃত স্বরে বললে, ‘রামহরি, তুমি যা বললে তার কোনও মানে হয় না। তোমাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে এমন ভাবে আক্রমণ করবার উদ্দেশ্য কী?’
—’আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, বাবু! তারা কি পাগল, না আমার শত্রু?’
—’তারা যদি তোমার শত্রু হবে, তবে বিমল কোথায় গেল? সে এখনও ফেরেনি কেন?’
রামহরি হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠে বললে, অ্যাঁঃ, খোকাবাবু এখনও ফেরেনি? বলো কি গো! তবে কি তারা চোর—ডাকাত? ফন্দি খাটিয়ে খোকাবাবু আর আমাকে পথ থেকে সরিয়ে তারা কি এ—বাড়ির সর্বস্ব লুটে নিয়ে গেছে?’
কুমার মাথা নেড়ে বললে, ‘না, রামহরি, না! এ—বাড়িতে লুট করার মতো কোনও সম্পত্তি থাকে না! এ—বাড়ির সবচেয়ে মূল্যবান নিধি হচ্ছে, বিমল নিজেই।—তাকেই আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! নিশ্চয়ই এর মধ্যে অন্য কোনও গূঢ় রহস্য আছে।’
হঠাৎ নীচে সদর—দরজার কাছ থেকে উচ্চ কণ্ঠস্বর শোনা গেল—’আরে, আরে! এ বাড়ি যে আমি চিনি! কী আশ্চর্য, এ যে বিমলবাবুর বাড়ি! হুম!’
কুমার তখনই বুঝতে পারলে, এ হচ্ছে পুলিশ ইনস্পেকটার সুন্দরবাবুর গলা! গত বৎসরে তাঁর সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়েছে। সে তাড়াতাড়ি নীচে নামতেই দেখলে সুন্দরবাবু দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করলেন।
—’একি, সুন্দরবাবু যে, নমস্কার! আপনি ঠিক সময়েই এসেছেন!’
—’ঠিক সময় এসেছি মানে?’
—’কাল এখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে সুন্দরবাবু!’
—’হুম, সেইজন্যেই তো আমি তদারক করতে এসেছি!’
—’তাহলে বিমলের খোঁজ আপনারা পেয়েছেন?’
—’হুম! আমি বিমলবাবুর খোঁজ করবার জন্যে এখানে আসিনি! আমি এসেছি আপনাদের বাগানে চোরের পায়ের ছাপ খুঁজতে!’
—’আমাদের বাগানে? চোরের পায়ের ছাপ? কী বলছেন!’
—’কিচ্ছু ভুল বলিনি। জানেন, কাল রাতে জেরিনার কণ্ঠহার চুরি গিয়েছে? আগে তার দাম ছিল পঞ্চাশ লক্ষ টাকা, কিন্তু এখন তাকে অমূল্য বলাও চলে!’
—’জেরিনার কণ্ঠহার? সে আবার কী?’
—’শুনুন তবে—রুশিয়ার সম্রাট আর সম্রাজ্ঞীকে জার আর জেরিনা বলে ডাকা হত, জানেন তো? রুশিয়ার সম্রাজ্ঞীর গলায় ছিল একছড়া মহামূল্য হিরার হার। কিন্তু রুশিয়ার বিপ্লবের সময় জার আর জেরিনাকে যখন হত্যা করা হয়, তখন এই আশ্চর্য কণ্ঠহার কেমন করে রুশদেশের বাইরে গিয়ে পড়ে। বিজয়পুরের মহারাজা গেল বছরে ফ্রান্সে বেড়াতে গিয়ে প্রকাশ্য নিলামে আধকোটি টাকা দিয়ে সেই হার কিনে আনেন।’
—’কিন্তু কোনও নির্বোধ ধনী যদি আধকোটি টাকা খরচ করে কতকগুলো দুর্লভ, অকেজো কাচ কিনে বসেন, তার জন্যে আমাদের মাথা—ব্যথার দরকার কি?’
—’আ—হা—হা শুনুন না! দরকার আছে বইকী! জেরিনার সেই কণ্ঠহার কাল রাতে চুরি গিয়েছে!’
—’আপদ গিয়েছে! এখন তা নিয়ে দুঃখ করবার সময় আমার নেই!’
—’আপনি বয়সে নবীন কিনা, তাই আসল কথা শোনবার আগেই অধীর হয়ে উঠছেন! কুমারবাবু আপনি কি জানেন না, বিজাপুরের মহারাজা কলকাতায় এসে আপনাদেরই বাগানের পিছনকার মস্ত বাড়িখানা ভাড়া নিয়ে বাস করছেন?’
—’তা আবার জানি না? রাজকীয় ধুমধামের চোটে এ—পাড়ার প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে যে!’
—’বিজয়পুরের মহারাজা কাল মহারানিকে নিয়ে মোটরে করে কলকাতার বাইরে কোথায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে রাত্রিবেলায় ফেরবার সময়ে পথে হঠাৎ মোটরের কল বিগড়ে যায়। ফলে মোটরকে আবার কার্যক্ষম করে নিয়ে বাড়িতে আসতে তাঁদের অনেক রাত হয়। ইতিমধ্যে কখন যে মহারাজের শোবার ঘর থেকে জেরিনার কণ্ঠহার চুরি গিয়েছে, সে—কথা কেউ জানে না। আজ সকালে সেই চুরির কথা প্রকাশ পেয়েছে, আর সঙ্গে সঙ্গে মামলার কিনারা করবার জন্যে ডাক পড়েছে ছাই ফেলতে ভাঙা—কুলো এই সুন্দর চৌধুরির! আমি এসে দেখলুম—’
—’আপনি এসে কী দেখলেন, তা জানবার আগ্রহ আমার একটুও নেই! আমি এখন—’
কুমারকে থামিয়ে দিয়ে সুন্দরবাবু খাপ্পা হয়ে বললেন, ‘আপনি কথায় কথায় বড্ড বেশি বাধা দিচ্ছেন কুমারবাবু! আগে আমি কী বলি শুনুন, নইলে পথ ছেড়ে দিন, আমি এই বাড়ির ভিতরটা আর বাগানের চারিদিকটা একবার ভালো করে দেখে আসি!’
কুমার বিস্মিত স্বরে বললে, ‘কেন?’
—’কারণ আমার মতন ঝানু ইনস্পেকটারের চোখে ধুলো দেওয়া সহজ নয়! আমি আবিষ্কার করেছি যে, চোরেরা এই বাড়ির পিছনকার বাগানের পাঁচিল টপকে মহারাজার বাড়িতে ঢুকে জেরিনার কণ্ঠহার চুরি করে আবার এই দিক দিয়েই ফিরে এসেছে! রাজবাড়ি থেকে আজ যখন আপনাদের বাগানটাকে দেখলুম, তখন বুঝতে পারিনি যে, এটা বিমলবাবুর বাড়ি—কারণ এ—বাড়িতে এসে আমি অনেক চা, টোস্ট, ওমলেট উড়িয়েছি বটে, কিন্তু কোনওদিন ওই বাগানটার দিকে যাইনি। কিন্তু বাড়ির সামনের দিকে এসেই বিমলবাবুর বাড়ি চিনতে পেরেছি। এখন আমি এই বাড়ির সর্বত্র খানাতল্লাশ করতে চাই,—হুম! কী করব বলুন, ‘ডিউটি ইজ ডিউটি’!’
প্রথমটা কুমারের মন রাগে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল! আরক্ত মুখে সে কড়া কথা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ একটা সত্য আবিষ্কার করে ফেলে নিজেকে সামলে নিলে এবং তারপরেই উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল, ‘বুঝেছি—বুঝেছি, এতক্ষণ পরে বুঝেছি! এই জন্যেই বিমল হয়েছে অদৃশ্য আর রামহরি হয়েছে আহত!’
সুন্দরবাবু থতমত খেয়ে বললেন, ‘কুমারবাবু, আপনার এসব কথার অর্থ কী? কে অদৃশ্য, আর কে আহত হয়েছে?’
কুমার বললে, ‘সুন্দরবাবু এতক্ষণ আমরা দুজনেই অন্ধকারে বাস করছিলুম, তাই কারুর কথা কেউ বুঝতে পারছিলুম না! এইবার আমি এসেছি অন্ধকার থেকে আলোকে!’
—’হুম, তার মানে?’
—’আগে রামহরির গল্প শুনুন,—রামহরি, রামহরি!’
রামহরি ওপর থেকে নীচে নেমে এল। তাকে দেখেই সুন্দরবাবু চমকে বলে উঠলেন, কী রামহরি, তোমার এমন মূর্তি কেন?’
রামহরি আবার তার গল্প বললে। সুন্দরবাবু সব শুনে মহাবিস্ময়ে বললেন, ‘অ্যাঁঃ বলো কী? বিমলবাবু অদৃশ্য!’
কুমার বললে, ‘কিন্তু বিমলের অদৃশ্য হওয়ার কারণ অনুমান করতে পারছেন?’
—’হুম, এখনও আমি কারণ—টারণ অনুমান করবার চেষ্টা করিনি। কিন্তু আপনি কি অনুমান করেছেন?’
—’ভেবে দেখুন সুন্দরবাবু! একদল চোর যদি এই বাড়ির ভিতর দিয়ে বিজয়পুরের মহারাজার বাড়িতে ঢুকে চুরি করতে চায়, তাহলে তারা কি চুরির আগে বিমল আর রামহরিকে যে কোনও কৌশলে পথ থেকে সরাবার চেষ্টা করবে না?’
সুন্দরবাবু বেজায় উৎসাহে লাফ মেরে বললেন, ‘ঠিক ধরেছেন কুমারবাবু!…রামহরি, রামহরি! কাল বিকেলে যে—লোকটা বিমলবাবুকে ভুলিয়ে নিয়ে যায়, তার চেহারা কী রকম বলতে পারো?’
—’তা কেন পারব না? তার মতন ঢ্যাঙা আর লম্বা—চওড়া চেহারা আমি আর কখনও দেখিনি, বাবু! মুখে মস্ত গাঁফ—দাড়ি, কিন্তু তার গলার আওয়াজ ঠিক মেয়েমানুষের মতো! তার চেহারা দেখলে ভয় হয়, কিন্তু গলা শুনলে হাসি পায়।’
—’হুম। রাত্রে যে তোমার কাছে এসেছিল, তাকে আবার দেখলে তুমি চিনতে পারবে?’
—’তা আবার পারব না, তাকে আর একবার দেখবার জন্যে আমার মন যে ব্যাকুল হয়ে আছে!’
—’আমরাও কম ব্যাকুল নই হে! আচ্ছা রামহরি, বিমলবাবু কোথায় যাচ্ছেন বেরুবার সময়ে সেকথা তোমাকে বলে যাননি?’
—’না…তবে হ্যাঁ, একটা কথা এখন আমার মনে পড়ছে! আমি একবার ঘরের দরজার কাছ দিয়ে যেতে যেতে শুনেছি বটে, খোকাবাবুর সঙ্গে কথা কইতে কইতে সেই গুণ্ডার মতন লোকটা বলছে—’আমি টালিগঞ্জের পাঁচ নম্বর মণিলাল বসু স্ট্রিটে বাড়ি ভাড়া নিয়ে আছি।’
সুন্দরবাবু উত্তেজিত স্বরে বললেন, ‘পাঁচ নম্বর মণিলাল বসু স্ট্রিট! পাঁচ নম্বর মণিলাল বসু স্ট্রিট! ঠিক শুনেছ রামহরি?’
—’হ্যাঁ গো বাবু, হ্যাঁ। আমি একবার যা শুনি তা আর কখনও ভুলি না।’
—’হুম, তোমার এ অভ্যাসটি ভালো বলতে হবে। কুমারবাবু, এখন আমাদের কী কর্তব্য বলুন দেখি?’
—’পাঁচ নম্বর মণিলাল বসু স্ট্রিটের দিকে সবেগে অগ্রসর হওয়া।’
—’ঠিক বলেছেন। এই আমি মহাবেগে অগ্রসর হলুম, হুম।’
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – অবলার ছবি
কুমার বললে, ‘সুন্দরবাবু, এই যে মণিলাল বসু স্ট্রিট।’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘বাব্বাঃ। কোন রসিক এই গলিটার নাম রেখেছে স্ট্রিট! এটা শহরের রাস্তা, না জঙ্গলের পথ? এই সেপাইরা, হুঁশিয়ার! গলির ভেতর থেকে কারুকে বেরুতে দিয়ো না, খবরদার!’
পানায়—সবুজ পচা জলে ভরা পুকুরের পাশ দিয়ে, দু—ধার থেকে ঝুঁকে—পড়া বাঁশঝাড়ের তলা দিয়ে, নড়বড়ে কুঁড়েঘর আর ভাঙা ভাঙা ছোটো ছোটো বাড়ি আর ঝোপঝাপ জঙ্গল, আদ্যিকালের অশ্বত্থ—বট—আম—কাঁঠাল গাছের ভিতর দিয়ে আঁকাবাঁকা পথের সঙ্গে মোড়ের পর মোড় ফিরতে ফিরতে সদলবলে কুমার খানিকটা এগিয়েই দেখতে পেলে সেই মান্ধাতার আমলের প্রকাণ্ড অট্টালিকাখানা। সকালবেলার সমুজ্জ্বল সূর্যকিরণে তার দীনতা ও জীর্ণতা যেন আরও ভালো করে ফুটে উঠেছে।
কুমার বললে, ‘ওইখানেই পাঁচ নম্বর বাড়ি বলে বোধ হচ্ছে।’
এগুতে এগুতে সুন্দরবাবু বললেন, ‘ও বাড়ির আবার নম্বর আছে নাকি? ও তো মস্ত বড়ো ভাঙা ঢিপি!’ কুমার বললে, ‘না, না, এদিকে এসে দেখুন। এদিকটাতে দেওয়ালের গায়ে অশথ—বটরা রাজত্ব বিস্তার করতে পারেনি, চুন—বালির প্রলেপ ঠেলে বাড়ির কঙ্কালও বেরিয়ে পড়েনি। ওই দেখুন, সদর—দরজায় একজন দারোয়ানও অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।’
কিন্তু দারোয়ানের সেই বিস্মিত ভাব স্থায়ী হল না। হঠাৎ সে উঠে দাঁড়াল এবং তাড়াতাড়ি ভিতরে ঢুকেই দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলে।
সুন্দরবাবু বললেন, ‘বটে, বটে, হুম। পুলিশ দেখেই লোকটা যখন ভড়কে গেল, তখন বাড়ির ভেতরে নিশ্চয়ই কোনও রহস্য আছে।’
কুমার দৌড়ে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মুখ তুলে দেখে বললে, ‘এই তো পাঁচ নম্বরের বাড়ি!’
সুন্দরবাবু বেজায় জোরে দরজার কড়া নাড়তে নাড়তে ডাকলেন, ‘দরোয়ান। দরোয়ান। এই বেটা পাজির পা—ঝাড়া।’
কেউ সাড়া দিলে না।
কুমার বললে, ‘এত বড়ো বাড়ি ঘিরে ফেলবার মতো লোক আমাদের সঙ্গে নেই। ওদিকে দরওয়ানটা বাড়ির ভেতরে গিয়ে এতক্ষণে খবর দিয়েছে, সময় পেলেই বদমাইশরা কোন দিক দিয়ে পালাবে, কে জানে? সুন্দরবাবু, আসবার সময়ে আপনি তো সার্চ—ওয়ারেন্ট বার করে এনেছেন, দরজাটা ভেঙে ফেলুন না।’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম, তা ছাড়া আর উপায় নেই দেখছি।…জমাদার, তোমরা সবাই মিলে দরজাটা লাথি মেরে ভেঙে ফ্যালো তো।’
পাহারাওয়ালাদের দমাদ্দম লাথির আঘাত সেই পুরাতন দরজা বেশিক্ষণ সইতে পারলে না, তার ভিতরকার খিল গেল ভেঙে।
ভিতরে প্রবেশ করল সর্বাগ্রে কুমার, তারপর সুন্দরবাবু, তারপর জমাদার ও জনকয় পাহারাওয়ালা। সকলে উঠানের উপরে গিয়ে দাঁড়াল।
সুন্দরবাবু তাড়াতাড়ি চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ‘ওই তো দেখছি ওপরে ওঠবার সিঁড়ি। কিন্তু রোসো, আগে নীচের ঘরগুলোই খুঁজে দেখি। আরে আরে, ও কী ও?’
দুম, দুম, দুম করে একটা শব্দ শোনা যেতে লাগল।
কুমার এক—ছুটে সিঁড়ির তলাকার সেই লোহার খিল মারা দরজাটার সুমুখে গিয়ে উত্তেজিত স্বরে বললে, ‘সুন্দরবাবু, ভেতর থেকে কে ওই দরজায় ধাক্কা মারছে!’
দ্বারের ওপাশ থেকে জাগল বিমলের সুপরিচিত কণ্ঠস্বর—’কুমার, কুমার! আমি অন্ধকূপে বন্দি, আমাকে উদ্ধার করো বন্ধু!’
আনন্দে পাগলের মতো হয়ে কুমার সেই বদ্ধ—দ্বারের উপর মারতে লাগল প্রচণ্ড লাথির পর লাথি!
সুন্দরবাবু বললেন, ‘ঠান্ডা হোন কুমারবাবু, ঠান্ডা হোন! হাতি লাথি মারলেও এ দরজা ভাঙবে কি না সন্দেহ। কিন্তু দরজা ভাঙবার দরকার কী? দেখছেন না, ওপরে খালি শেকল লাগানো রয়েছে, তালা পর্যন্ত নেই?’—বলেই তিনি শিকল খুলে দিলেন।
দরজা খুলে বিমল বাইরে আসতেই তাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে কুমার বলে উঠল, ‘বিমল! এত সহজে তোমাকে যে ফিরে পাব স্বপ্নেও তা ভাবতে পারিনি!’
বিমল শ্রান্ত স্বরে বললে, ‘এতক্ষণ অন্ধকূপে বন্ধ থেকে হঠাৎ বাইরের আলোতে এসে কিছুই আমি দেখতে পাচ্ছি না! একটু সবুর করো ভাই, নিজেকে আগে সামলে নি!’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘আচ্ছা, আপনারা এইখানেই থাকুন, ততক্ষণে আমি বাড়ির ভেতরটা খানাতল্লাশ করে আসি। জমাদার, সেপাইদের নিয়ে আমার সঙ্গে এসো।’
পুলিশের দলবল সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল। বিমল মিনিট—দুই চুপ করে থেকে বললে, ‘এইবারে তোমার কথা বলো, কুমার! কেমন করে তোমরা জানতে পারলে আমি এখানে বন্দি হয়ে আছি?’
কুমার সংক্ষেপে সমস্ত বর্ণনা করে বললে, ‘এখন বলো, তোমার মতন অসাধারণ লোককে এরা বন্দি করেছিল কোন কৌশলে?’
বিমল তিক্তস্বরে বললে, ‘ভাই, আমি অসাধারণ লোক নই, কারণ বন্দি হয়েছি তুচ্ছ একটা সাধারণ প্যাঁচে। এ ভাবে তুমি বন্দি হলে তোমাকে আমিও বোকা ছাড়া আর কিছু বলতে পারতুম না। রামহরি যে ঢ্যাঙা লম্বা—চওড়া দুশমন চেহারার লোকটার কথা বলছে, সে কেবল মহাশক্তিশালী নয়, মহাচতুরও বটে; সে জানে আমার দুর্বলতা কোথায় আর সেই হিসাবেই আমাকে ধরবার ফাঁদ পেতেছিল। কিন্তু এতক্ষণ আকাশ—পাতাল ভেবেও আমি ঠাওরাতে পারিনি, আমাকে এভাবে বন্দি করে তার কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে! এখন তোমার মুখে সমস্ত শুনে আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারছি। তার নাম অবলাকান্ত, যদিও তার চেহারাটা হচ্ছে নামের মূর্তিমান প্রতিবাদ। আবার অবলার গলার আওয়াজেও পাবে তার চেহারার প্রতিবাদ। সে—’ বলতে বলতে বিমলের দুই চোখ উঠল চমকে। সে স্পষ্ট দেখলে, উঠানের পশ্চিম দিকের রৌদ্রোজ্জ্বল দেওয়ালের উপরে পড়েছে একটা আবক্ষ নরমূর্তির কালো ছায়া।
অত্যন্ত আচম্বিতে বিমল উপর—পানে মুখ তুলে তাকালে এবং সঙ্গে সঙ্গে দেখলে,প্রকাণ্ড একখানা মুখ ছাদের কার্নিসের ধার থেকে সাঁৎ করে সরে গেল।
বিমল উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘কুমার, কুমার। ওই সেই অবলাকান্ত। ছাদের ধার থেকে উঁকি মেরে আমাদের দেখছিল, কিন্তু বুঝতে পারেনি যে সূর্যদেব তাকে ধরিয়ে দেবেন। চলো, চলো, ওপরে চলো।’
দ্রুতপদে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে তারা দুজনে দেখলে তেতলার সিঁড়ির মুখে পাহারাওয়ালাদের নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সুন্দরবাবু।
হতাশভাবে তিনি বললেন, ‘কোথাও টুঁ—শব্দটি নেই, সব ব্যাটাই বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে।’
বিমল বললে, ‘আপনি তেতলায় এখনও ওঠেননি?’
—’হুম, নিশ্চয় উঠেছি। তেতলায় তো মোটে দুখানা ঘর। কোনও ঘরেই কেউ নেই, সব ভোঁ—ভোঁ।’
—’না, সুন্দরবাবু, আমি এইমাত্র স্বচক্ষে দেখেছি, সেই পালের গোদা অবলাকান্ত তেতলার ছাদের ওপর থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে।’
—’অবলাকান্ত আবার কে?’
—’যে আমাকে বন্দি করেছিল। আসুন আবার তেতলায়।’—বলেই বিমল তেতলার সিঁড়ি দিয়ে বেগে উপরে উঠতে লাগল।
তেতলার উত্তর দিকে দুখানা বড়ো ঘর, অন্য তিনদিকে খোলা ছাদ। কিন্তু ছাদে কেউ নেই।
বিমল বললে, ‘সুন্দরবাবু, লোকজন নিয়ে আপনি ওই ঘর—দুখানার দিকে যান। এসো কুমার, আগে আমরা ছাদটা দেখে আসি।’
কুমার বললে, ‘ছাদ চোখের সামনেই পড়ে আছে, কোথাও একটা চড়াই পাখি পর্যন্ত নেই।’
—’কিন্তু ছাদের তলায় কী আছে সেটা দেখা দরকার—যদি ছাদ থেকে অদৃশ্য হবার কোনও উপায় থাকে।’
ছাদের তলায় পূর্বদিকে রয়েছে প্রায়—দুর্ভেদ্য সবুজ জঙ্গল। আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা, জামরুল, নোনা, ডুমুর, নারিকেল, সুপুরি ও খেজুর প্রভৃতি ফলগাছের বাহুল্য দেখে বোঝা যায় আগে সেখানটা ছিল বাগান। এখনও সেখানে বেঁচে রয়েছে অশোক, রঙ্গন, কৃষ্ণচূড়া, চাঁপা ও বকুল প্রভৃতি পুষ্পতরু। তাদের ভিতর থেকে সাড়া দিচ্ছে কোকিল, বউ—কথা—কও ও শ্যামা প্রভৃতি গীতকারী পাখির দল। ফলের ফসল আর নেই বললেও চলে, ফুলের বাসর ভেঙেছে, কিন্তু পাখিদের গানের আসর আজও বসে আগেকার মতোই।
দক্ষিণদিকে খানিকটা ঝোপঝাপ—ভরা খোলা জমির পর মস্ত বড়ো একটা দিঘি। তার পানায় আচ্ছন্ন বুকের দিকে হঠাৎ দৃষ্টিপাত করলে সন্দেহ হয়, সেটা যেন একটা তৃণশ্যামল মাঠ। তারপরেই দেখা যায় মাঝে মাঝে পানা ছিঁড়ে গেছে, রোদে জল চকচক করছে। মাঝে মাঝে দেখা যায়, দলবদ্ধ শালুকফুলেরও বাহার।
পশ্চিমদিকে মণিলাল বসু লেন।
বিমল সব ভালো করে দেখে—শুনে বললে, ‘না, ছাদের কোনওদিক দিয়ে পালাবার কোনও উপায় নেই। অবলাকান্তকে যদি পাওয়া যায়, উত্তরের ওই দুটো ঘরের ভেতরেই পাওয়া যাবে। চলো কুমার।’
তারা সুন্দরবাবুর কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি বললেন, ‘বিমলবাবু, আপনি ভুল দেখেছেন। এ দুটো ঘরেই কেউ নেই।’
—’তবু আমি একবার ঘর দুটো দেখব’ বলে বিমল প্রথম যে ঘরখানায় ঢুকল সেখানা একেবারেই খালি—এমনকী আসবাবের মধ্যে রয়েছে মাত্র দুখানা শীতলপাটি বিছানো চৌকি।
কিন্তু অন্য ঘরখানা খুব সাজানো! একদিকে একখানা দামি খাট, তার উপরে ধবধবে চাদরে ঢাকা নরম বিছানা। আর একদিকে সোফা—কোচ টেবিল। আর একদিকে একটি আলমারি ও ড্রেসিংটেবিল এবং আর—একদিকের দেওয়ালে রয়েছে খুব পুরু ফ্রেমে আঁটা একখানা ‘অয়েল—কালারে’ আঁকা প্রকাণ্ড ছবি, সেখানা প্রায় মেঝের উপরে এসে পড়েছে।
বিমল বললে, ‘সুন্দরবাবু, যে মহাপ্রভুকে আমরা খুঁজছি তার ছবির চেহারা দেখুন!’
সুন্দরবাবু ছবির দিকে খানিকক্ষণ বিস্মিত নেত্রে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘হুম, অবলা দেখছি মহা বলবান ব্যক্তি! কিন্তু ছবিতে কি এর চেহারা বেশি বড়ো করে আঁকা হয়েছে?’
—’না, এখানা হচ্ছে অবলার ‘লাইফ—সাইজে’র ছবি।’
—’ওরে বাবা, বলেন কি? অবলা কি মাথায় সাত ফুটের চেয়েও লম্বা?’
—’বোধহয় তাই।’
—’কিন্তু অবলাকে যখন পেলুম না, তখন তার ছবি নিয়ে আমাদের আর কী লাভ হবে? চলুন, যাই।’
—’আমি স্বচক্ষে তাকে ছাদের ওপর থেকে উঁকি মারতে দেখেছি। কিন্তু এখন সে ছাদেও নেই, এ—ঘরে ও—ঘরেও নেই। এটা যে অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। অবলা কি ডানা মেলে উড়ে গেল?’ বলতে বলতে বিমল ছবির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্নদৃষ্টিতে অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে কী পরীক্ষা করতে লাগল।
সুন্দরবাবু বললেন, ‘ও কী বিমলবাবু, আপনি কি অবলাকে না পেয়ে তার ছবিখানাকেই গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে চান?’
বিমল খানিকক্ষণ জবাব দিলে না। তারপর কুমারের দিকে ফিরে বললে, ‘দ্যাখো তো কুমার, ছবির ওপরে ডানদিকের ওইখানটায় তাকিয়ে!…কী দেখছ?’ কুমার ভালো করে দেখে বললে, ‘মাকড়সার একটা বড়ো ছেঁড়া জাল।’
—’জালটার খানিকটা রয়েছে দেওয়ালের ওপরে, আর খানিকটা রয়েছে ছবির ফ্রেমের ওপরে। জালটা নিশ্চয়ই সবে ছিঁড়েছে, কারণ মাকড়সাটা এখনও ব্যস্তভাবে তার জাল মেরামত করবার চেষ্টায় আছে। কিন্তু জালটা ছিঁড়ল কেন?’
সুন্দরবাবু বিরক্ত স্বরে বললেন, ‘কী বিপদ, হুম! আসামি কোথায় চম্পট দিলে, আর আপনারা মাকড়সার জাল নিয়েই মেতে রইলেন যে! আপনাদেরও স্বভাব দেখছি, আমাদের শখের গোয়েন্দা জয়ন্ত ভায়ার মতো!’
বিমল মুখ টিপে হেসে বললে, ‘সুন্দরবাবু, আমি গোয়েন্দা নই। কিন্তু আপনি পুলিশের পাকা লোক হয়েও কি বুঝতে পারছেন না, অমন অস্থানে ছবির ফ্রেম থেকে দেওয়াল পর্যন্ত ছিল যে মাকড়সার জাল, সে—জাল সদ্য সদ্য ছিঁড়ে যাওয়া অত্যন্ত সন্দেহজনক?’
—’কেন, সন্দেহজনক কেন? আপনার কথার অর্থ কী?’
—’আমার কথার অর্থ হচ্ছে এই যে, বড়ো ছবিখানাকে এইমাত্র কেউ দেওয়ালের গা থেকে সরিয়েছিল।’
—’সরিয়েছিল তো সরিয়েছিল, তাতে আমাদের এত মাথাব্যথা কেন?’
—’আমাদের মাথাব্যথার কারণ হয়তো কিছুই নেই, তবে আমিও ছবিখানাকে আর একবার দেওয়ালের গা থেকে সরিয়ে ফেলতে চাই।’—বলেই মলিল ছবিখানাকে দুই হাতে তুলে ধরে দেওয়ালের উপর থেকে সরিয়ে ফেললে।
ঘরসুদ্ধ সবাই চমৎকৃত হয়ে দেখলে, ছবির পিছনেই দেওয়ালের গায়ে রয়েছে একটা বন্ধ দরজা।
সুন্দরবাবু অভিভূত কণ্ঠে বললেন, ‘হুম। বাহাদুর বিমলবাবু।’
বিমল বললে, ‘এর মধ্যে আমার বাহাদুরি একটুও নেই। অবলাকান্ত ভারী চালাক বটে, কিন্তু একটু আগে তাকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন সূর্যদেব, আর একটু পরে এখন তার পথ নির্দেশ করলে তুচ্ছ এক মাকড়সা। সুন্দরবাবু, এই বন্ধ দরজার পিছনে কী আছে জানি না, কিন্তু অবলাকান্ত অদৃশ্য হয়েছে এই পথেই।’
সুন্দরবাবু প্রায় গর্জন করেই বললেন, ‘জমাদার। ডাকো সিপাইদের। ভাঙো এই দরজা।’
বিমল বললে, ‘কিন্তু সবাই সাবধান। অবলাকান্ত খুব শান্ত নিরীহ বালক নয়!’
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি
বিমল ও কুমার বার করলে রিভলভার। কনস্টেবলরা এগিয়ে গিয়ে জোরে লাথি মারতে লাগল দরজার উপর। দরজার পাল্লা—দুখানা দড়াম করে খুলে যেতে দেরি লাগল না।
হুড়মুড় করে সবাই খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল।
কিন্তু ঘরের মধ্যে কেউ নেই। ছোট্ট এক ফালি ঘর—চওড়ায় চার হাত আর লম্বায় ছয় হাতের বেশি হবে না। একেবারে আসবাব—শূন্য।
এদিক—ওদিক দৃষ্টিপাত করে সুন্দরবাবু বললেন, ‘কই মশাই, কোথায় আপনার অবলা? ফুস—মন্ত্রে উড়ে গেল নাকি?’
উত্তরদিকের দেওয়ালে রয়েছে গরাদহীন একটা ছোটো জানলা। বিমল সেই দিকে ছুটে গিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলে, জানলার বাইরে মস্ত একটা হুক থেকে ঝুলছে, মোটা একগাছা দড়ি। তারপর বুক পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়ে নীচের দিকে চেয়ে দেখলে, দড়ির অন্য প্রান্ত প্রায় মাটি পর্যন্ত নেমে গেছে এবং তখনও লটপট করে খুব দুলছে।
দড়িগাছা খানিকটা টেনে তুলে সকলকে দেখিয়ে বিমল বললে, ‘সুন্দরবাবু, অবলাকে আবার ভূতলে অবতীর্ণ করেছে এই দড়ি। এটা এখনও যখন দুলছে তখন বুঝতে হবে যে, মাটিতে পা দিয়ে অবলা এইমাত্র একে ত্যাগ করেছে।’
সুন্দরবাবু মুখভঙ্গি করে বললেন, ‘হুম, এ যে একেবারে ডিটেকটিভ উপন্যাসের কাণ্ড! আমরা হচ্ছি সত্যিকারের পুলিশ, এর মধ্যে পড়ে আমাদের মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে রে বাবা! এখন উপায়?’
কিন্তু বিমল তখন সুন্দরবাবুর কথা শুনছিল না। মুখ বাড়িয়ে তীক্ষ্নদৃষ্টিতে নীচের দিকটা পর্যবেক্ষণ করছিল।
এদিক থেকেই এই পাঁচ নম্বরের বাড়ির বিশাল ধ্বংসস্তূপের আরম্ভ। নীচে সামনেই রয়েছে একটা মহলের উঠান, এক সময়ে তার দুই ধারে ছিল সারি সারি ঘর ও টানা বারান্দা, এখন কিন্তু বেশির ভাগই হয়েছে ভূমিসাৎ। উঠানের উপরে রাশি রাশি ইটের ঢিপি, মাঝে মাঝে বুনো চারাগাছ এবং মাঝে মাঝে গর্ত। দু—দিন আগে বৃষ্টি হয়েছিল, এখনও তারই জল জমে রয়েছে গর্তগুলোর ভিতরে।
বিমল হঠাৎ জানলার ফাঁকে নিজের দেহটা গলিয়ে দিতে দিতে বললে, ‘কুমার, তুমিও আমার সঙ্গে এসো এই পথে।’
সুন্দরবাবু হাঁ—হাঁ করে বলে উঠলেন, ‘আরে মশাই, করেন কী, করেন কী! পড়লে বাঁচবেন না যে।’
—’পড়লে যে মানুষ বাঁচে না, আমিও সেকথা জানি সুন্দরবাবু। কিন্তু না—পড়বার জন্যে আমি কিছুমাত্র চেষ্টার ত্রুটি করব না। এখন আমার জন্যে মাথা না ঘামিয়ে আপনি সিঁড়ি দিয়েই নীচে নেমে যান। তারপর অন্য পথে বাড়ির ওই ভাঙা অংশটায় ঢুকে পড়তে পারেন কি না দেখুন।’ বলেই বিমল বাইরে গিয়ে দড়ি ধরে ঝুলে পড়ল।
সুন্দরবাবু দৌড়ে জানালায় গিয়ে বিস্মিত চোখে দেখলেন, বিমল অত্যন্ত অনায়াসে তড়বড় করে দড়ি ধরে নীচে নেমে যাচ্ছে। তিনি চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘বাপ রে বাপ। সিঁড়ির চওড়া ধাপ দিয়েও আমরা এর চেয়ে তাড়াতাড়ি নীচে নামতে পারতুম না! কুমারবাবু, আপনার বন্ধুর উচিত সার্কাসে যোগ দেওয়া।’
রজ্জুর শেষ—প্রান্তে পৌঁছে বিমল মাথা নামিয়ে দেখলে, তার পা মাটি রয়েছে হাত—তিনেক তফাতে। রজ্জু ত্যাগ করতেই সে পড়ল গিয়ে ইঞ্চি—দুয়েক জল—ভরা জমির উপরে।
সেইখানেই দাঁড়িয়ে সে ঊর্ধ্বমুখে অপেক্ষা করতে লাগল, কারণ কুমারও করেছে তখন রজ্জুকে অবলম্বন।
অল্পক্ষণ পরেই কুমার হল ভূমিষ্ঠ।
উপর থেকে জাগল সুন্দরবাবুরর চিৎকার—’ওইখানেই দাঁড়ান, আপনারা, আমি এক্ষুনি নেমে ছুটে যাচ্ছি।’
বিমল বললে, ‘সুন্দরবাবু ভুঁড়ি কতক্ষণে এখানে এসে পড়তে পারবে, কেউ তা জানে না। তবু তাঁর দলবলের জন্যে বাধ্য হয়ে আমাদের খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবেই—কারণ এটা হচ্ছে শত্রুপুরী, সঙ্গে যতবেশি লোক থাকে ততই ভালো। কিন্তু আপাতত পদযুগল চালনা করতে না পারলেও আমরা মস্তিষ্ক চালনা করতে পারব। অতএব এসো কুমার, আমরা এইখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ‘ব্লাড—হাউন্ডে’র কাজ আরম্ভ করে দি।’
কুমার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বললে, ‘সব দিকেই তো দেখছি ভেঙে—পড়া দেওয়াল, বড়ো বড়ো রাবিশের স্তূপ, ঝোপঝাপ আর এলোমেলো অলিগলি। খুব সহজেই এখানে লুকোনো বা এখান থেকে পালানো যায়। এখন কোনদিকে আমরা অগ্রসর হব, বিমল?’
বিমল বললে, ‘কুমার, তুমিও সাধারণ পুলিশ—অর্থাৎ সুন্দরবাবুর মতন হয়ো না। ভগবান তোমাকে অনুভূতি দিয়েছেন, অনুভব করো। দৃষ্টিশক্তি দিয়েছেন, ব্যবহার করো।’
কুমার বললে, ‘দৃষ্টিশক্তি ব্যবহার করেই তো দেখছি, চারিদিকে ভগ্নস্তূপ। আর অনুভূতি? হুঁ, অনুভব করছি বটে, আমার পায়ের তলায় রয়েছে জল আর কাদা।’
—’কিন্তু ভাই কুমার, তুমি অনুভব করছ অন্ধের মতো। আর ব্যবহার করছ কেবল স্থূলদৃষ্টি। বড়ো বড়ো স্পষ্ট জিনিস দেখে অপরাধী আর সাধারণ পুলিশ সহজে অনেক কিছুই অনুমান করতে পারে। পাছে বড়ো বড়ো সূত্র পিছনে ফেলে যায়, সেই ভয়ে অপরাধীও স্পষ্ট প্রমাণগুলোকে নষ্ট করতে ব্যস্ত হয়। আর সাধারণ পুলিশও খোঁজে কেবল অমনি সব বড়ো ও স্পষ্ট সূত্রকে। ফলে সূক্ষ্ম বা ছোটো প্রমাণগুলো ফাঁকি দেয় দুই পক্ষেরই চোখকে। তুচ্ছ মাকড়সার জাল, অবলা তাই তাকে আমলে আনেনি। সুন্দরবাবুর চোখেও তা যথাসময়ে পড়েনি, পড়লে হয়তো অবলা পালাতে পারত না। আর বর্তমান ক্ষেত্রে জলকাদার উপরে দাঁড়িয়ে থেকেও তুমি চোখ ব্যবহার করে দেখছ না যে, এর জের কোথায় গিয়ে পৌঁছোতে পারে!…কুমার, কুমার! কে যেন চাপা হাসি হাসলে বলে মনে হল না?’
—’চাপা হাসি? কই, আমি শুনিনি তো। বোধহয় তোমার ভ্রম?’
‘ভ্রম? হতেও পারে। কিন্তু আমি যেন কার চাপা হাসির আওয়াজ পেলুম।’
—’ও কিছু নয়! তুমি যা বলছিলে বলো। এই জল—কাদার জের কোনখানে গিয়ে পৌঁছোবে?’
—’ওইখানে কুমার, ওইখানে!’ বলেই বিমল হাত—ছয়েক তফাতে মাটির উপরে অঙ্গুলিনির্দেশ করলে।
কুমার দেখলে, উঠানের যেখানে জল নেই সেখান থেকে উত্তরদিকে চলে গিয়েছে অনেকগুলো ভিজে পায়ের ছাপ। নিশ্চয় এইমাত্র কেউ এই রজ্জু—অবলম্বন ত্যাগ করে সরে পড়েছে ওইদিকেই, সুতরাং তার অনুসরণ করাও কঠিন হবে না।
কুমার বললে, ‘ওঃ, তাই বলো? এতক্ষণে বুঝলুম।’
বিমল বললে, ‘কিন্তু ওইটুকু তোমার বোঝা উচিত ছিল আগেই। দড়ি ছেড়ে যখন আমি অবতীর্ণ হলুম ভূতলে, যখনই আমার পায়ের তলায় অনুভব করলুম জল—কাদাকে, সেই মুহূর্তেই আমার মন বললে,—’অবলা কোনদিকে গিয়েছে তা জানা আর কঠিন হবে না। কারণ তাকেও যখন নামতে হয়েছে এই জল—কাদায়, তখন ধরিত্রীর গায়ে পায়ের ছবি না এঁকে কোনওদিকেই সে আর পালাতে পারবে না।’ মনে—মনে মনের কথা শুনেই ফিরে দেখলুম, সত্যই তাই। ফিরে না দেখলেও চলত, কারণ পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই আছে, চোখে দেখবার আগেই যাদের বলা যায় অবশ্যম্ভাবী!’
কুমার হেসে ফেলে বললে, ‘আমি হার মানছি। তুমি তো জানোই ভাই বিমল, যতক্ষণ তোমার সঙ্গে থাকি ততক্ষণ আমি নিজের মস্তিষ্ককে ঘুম পাড়িয়ে আর নিজের বুদ্ধিকে মনের কৌটোয় বন্দি করে রাখি। আমার নিজের অস্তিত্ব কেবল প্রকাশ পায় তোমার অসাক্ষাতেই—যেমন পেয়েছিল আজ সকালে, তোমাকে দেখতে না পেয়ে।’
বিমল হেসে সস্নেহে কুমোরের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললে, ‘জানি বন্ধু, জানি,—তোমাকে জানতে আমার বাকি নেই। তখন তোমার নিজের অস্তিত্ব জেগেছিল বলেই এত শীঘ্র আমি মুক্তি পেয়েছি।…কিন্তু চোর পালাবার পর আমাদের বুদ্ধি নিয়ে কী করব? সুন্দরবাবু হচ্ছেন জড়ভরত দি সেকেন্ড, এখনও তাঁর আবির্ভাব হল না, আমাদের আর অপেক্ষা করা চলে না। চলো কুমার, অগ্রসর হই। তোমার রিভলভারটা বার করে হাতে নাও।’
কর্দমাক্ত পদচিহ্ন উঠান পার হয়ে উত্তরদিকের একটা ছাদ—ভাঙা দালানের উপরে গিয়ে উঠেছে। তারপর একটু ডানদিকে এগিয়েই বাঁ—দিকে ফিরে একটা ঘরের ভিতরে ঢুকেছে।
পদচিহ্নের অনুসরণ করে বিমল ও কুমার সে—ঘরের ভিতর দিয়ে ঢুকল আর এক ঘরে। তারপর পদচিহ্ন এমন ক্ষীণ হয়ে গেল যে আর দেখা যায় না।
বিমল চারিদিকে তাকিয়ে বলল ‘কুমার, পদচিহ্নের আয়ু তো ফুরিয়ে গেল। কিন্তু সে যতটুকু পথ নির্দেশ করেছে আমাদের পক্ষে তাই—ই যথেষ্ট। কারণ আমরা বেশ বুঝতে পারছি, প্রথমত, একটু আগে অবলা এইখানে এসে দাঁড়িয়েছিল, দ্বিতীয়ত, এ—ঘর থেকে ভিতর দিকে যাবার জন্যে রয়েছে একটিমাত্র দরজা। অবলা এখান থেকে যে—পথে এসেছে সেই পথেই আবার বেরিয়ে যায়নি নিশ্চয়। সুতরাং আমাদের যাত্রা করতে হবে ভিতর দিকেই।’
তারা এবার যে ঘরে ঢুকল তার ছাদ, দেওয়াল ও দরজা, জানলা সব অটুট বটে, কিন্তু ভিতরে বাসা বেঁধেছে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বিমল ও কুমার সেখান থেকে বেরুবার পথ খুঁজছে, এমন সময় হঠাৎ তাদের পিছনে হল দুম করে দরজা বন্ধ করার শব্দ।—সঙ্গে সঙ্গে ঘরের হিংস্র অন্ধকার যেন সেখানকার ম্লান আলোটুকুকে গপ করে একেবারে গিলে ফেললে।
বিমল তাড়াতাড়ি ফিরে একলাফে ঘরের বন্ধ—দরজার উপরে গিয়ে পড়ল।
দরজার ওপাশ থেকে জাগল আবার সেই পরিচিত নারী কণ্ঠস্বর—’হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ! বিমল, আবার তুমি আমার বন্দি!’
দারুণ ক্রোধে ও নিষ্ফল আক্রোশে নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বিমল প্রায় অবরুদ্ধ—স্বরে বললে, ‘কুমার, কুমার। ধিক আমার নির্বুদ্ধিতা! বিপদের রাজ্যে এসেও বিপদের দিকে নজর রাখিনি!’
বাহির থেকে অবলা আবার খুব খানিকটা হেসে নিলে। তারপর তীক্ষ্ন খনখনে স্বরে বললে, ‘ওহে বিমল। এই তোমার বুদ্ধি? এই বুদ্ধি ভাঙিয়ে তুমি দেশ—বিদেশে এত বিখ্যাত হয়ে পড়েছ? একটা নেংটি ইঁদুর পর্যন্ত এক ফাঁদে দুবার ধরা পড়ে না—তুমি যে দেখছি নেংটি ইঁদুরেরও চেয়ে অধম। একটু আগে তুমিই আবার মস্ত মুরুব্বির মতন অনুভূতি আর দৃষ্টিশক্তি নিয়ে কুমারকে যে মস্ত লেকচার দিচ্ছিলে, তাও আমি আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনেছি। শুনে আমি হাসি চাপতে পারিনি আর সে হাসির আওয়াজ পেয়েও তুমি সাবধান হওনি। ওহে নাবালক, সূক্ষ্ম দৃষ্টিশক্তি কেবল তোমারই একচেটে না? জানো মূর্খ, মাটির ওপরে যে আমার কাদা—মাখা পায়ের ছাপ পড়ছিল, আমারও তা অজানা ছিল না! ইচ্ছা করলেই আমি পায়ের ছাপগুলো মুছে তোমাকে ধোঁধায় ফেলে পালাতে পারতুম। কিন্তু তা আমি করিনি। কেন জানো? তোমার বুদ্ধি নেংটি ইঁদুরেরও চেয়ে মোটা বলে। আমি বেশ জানতুম, পায়ের দাগগুলো দেখেই তুমি আহ্লাদে আটখানা হয়ে ধেই—ধেই করে নেচে উঠবে! তাই আমি মাটির গায়ে পায়ের ছবি আঁকতে আঁকতে এমন জায়গায় এসে অদৃশ্য হয়েছি যেখানে আমার পক্ষে তোমাকে ফাঁদে ফেলা হবে খুবই সহজ! বুঝলে বোকাচন্দ্র? ঘুমোও এখন অন্ধকারে, নাকে সর্ষের তেল দিয়ে!’
অতিরিক্ত রাগে ফুলতে ফুলতে বিমল আর কোনও কথাই বলতে পারলে না। কিন্তু কুমার চেঁচিয়ে বললে, ‘ওরে হতভাগা চোর! আমাদের তুই বন্দি করবি? এতক্ষণে বাড়ির ভেতরে পুলিশ এসে পড়েছে, তা জানিস?’
অবলা আবার হেসে উঠে বললে, ‘পুলিশ, না ফুলিশ? ওই ভুঁদো হাঁদা—গঙ্গারাম সুন্দরবাবুকে আমি চিনি না নাকি? সে আমার কী করতে পারে? জানো কি বাপু, এই সাতমহলা সেকেলে বাড়িখানা ভাঙাচোরা বটে, কিন্তু মস্ত এক গোলকধোঁধার মতো? ঠিক এই জায়গাটিতে আসতে আসল পুলিশের এখন একটা দিন লাগতেও পারে! ভেবো না, আমাদের আনাগোনার সাক্ষী হয়ে পায়ের ছাপগুলো এখনও চারিদিকে ছড়িয়ে আছে! আমার লোকজনেরা সেগুলোকে এখন কেবল নিশ্চিহ্নই করে দিচ্ছে না, পুলিশকে ভুল পথে নিয়ে যাবার জন্যে উলটোদিকে নতুন নতুন পদচিহ্নও রেখে এসেছে! অতএব হে বিমল, হে নেংটি—ইঁদুরাধম! আপাতত আমি বিদায় গ্রহণ করছি! হ্যাঁ, আর একটা কথা শুনে রাখো। ষাঁড়ের মতন চেঁচিয়ে মিছে গলা ভেঙো না, কারণ তোমাদের চিৎকার বাইরে গিয়ে পৌঁছোবে না!’
বিমল তখন হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দেখে নিয়েছে যে, এ—ঘরের দরজাটা রীতিমতো পুরাতন। কাল সে যেখানে বন্দি হয়েছিল সেখানকার মতন এ—দরজাটাও মজবুত ও লোহার খিল মারা নয়। অবশ্য সাধারণ লোকের পক্ষে এ—দরজাও যথেষ্ট দুর্ভেদ্য, কিন্তু অবলা বোধহয় তার প্রায়—অমানুষিক শক্তির সঙ্গে পরিচিত নয়! আর সেই শক্তি এখন প্রচণ্ড ক্রোধে হয়ে উঠেছে ভয়ানক মারাত্মক! বিমল জীবনে আর কখনও এত অপমান বোধ করেনি!
অবলার কথা যখন শেষ হয়নি, বিমল পিছনে হটে গিয়ে নিজের দেহের মাংসপেশিগুলোকে দ্বিগুণ ফুলিয়ে তুললে! তারপর বেগে ছুটে গিয়ে নিজের সমস্ত শক্তি একত্র করে প্রাণপণে দরজার উপরে মারলে এক বিষম ধাক্কা! মড়—মড় শব্দে দরজার পাল্লা ভেঙে পড়ল।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – অপূর্ব লুকোচুরি খেলা
ভাঙা দরজার ভিতর থেকে বিমল বাইরে লাফিয়ে পড়ল ক্রুদ্ধ ব্যাঘ্রের মতো!
বেরিয়েই দেখতে পেলে একচক্ষু অবলার দাড়ি—গাঁফে সমাচ্ছন্ন মস্ত বড়ো মুখখানা—ক্ষণিকের জন্যে। এবং সেই এক পলকের মধ্যেই বিমল এও লক্ষ করলে, অবলার মুখে ফুটে উঠেছে বিপুল বিস্ময়ের চিহ্ন—নিশ্চয়ই দরজা ভেঙে তার এমন অতর্কিত আবির্ভাব সে একেবারেই আশা করেনি!
কিন্তু পরমুহূর্তেই অবলার প্রকাণ্ড মূর্তিখানা সে—ঘরের ভিতর থেকে সাঁত করে সরে গেল।
মহা ক্রোধে জ্ঞানশূন্যের মতন বিমল বেগে অগ্রসর হতে গিয়ে হঠাৎ সে—ঘরের দরজার চৌকাঠে ঠোক্কর খেয়ে দড়াম করে মাটির উপরে পড়ে গেল! তার দেহ আর পাঁচজনের মতন ছোটো ও হালকা ছিল না, আঘাতটা হল রীতিমতো গুরুতরই।
কুমার তাড়াতাড়ি ছুটে এসে তাকে তুলে ধরে বললে, ‘বিমল, বিমল! কোথায় লাগল?’
নিজেকে তখনই সামলে নিয়ে একলাফে দাঁড়িয়ে উঠে বিমল বললে, ‘না, না, আমার কিছু লাগেনি! চলো, চলো—অবলা বুঝি আবার পালাল!’
ছুটে দুজনেই আর একটা শূন্যঘর পেরিয়ে আবার সেই ছাদভাঙা দালানের উপরে এসে পড়ল। উঠানের উপরে কেউ নেই। কিন্তু ভাঙা দালান দিয়ে খানিক ছুটেই পাওয়া গেল একটা সরু লম্বা পথ—দু—ধারেই তার সারি সারি কয়েকখানা ঘর।
বিমল বললে, ‘কুমার, তুমি ও—ধারের ঘরগুলো খোঁজো, আমি খুঁজি এ—ধারের ঘরগুলো!’
প্রথম ঘরটায় উঁকি মেরে বিমল দেখলে, কেউ নেই। আসবাবহীন ঘুপসি ঘর— দেখলেই বোঝা যায়, বহুকাল তার মধ্যে কেউ বাস করেনি—এককোণে পড়ে রয়েছে কেবল একটা বড়ো কুপো।
দু—ধারে পাঁচখানা করে ঘর ছিল—সব ঘরই দুর্দশাগ্রস্ত, বাসের অযোগ্য। কোনও ঘরেই অবলাকে পাওয়া গেল না।
শেষঘর ও গলির পরেই তারা দুজনে যেখানে এসে দাঁড়াল সেখানেও আর একটা ছোট্ট উঠানের মতো আছে বটে, কিন্তু তার সমস্তটাই ধ্বংসস্তূপে পরিপূর্ণ। সেই পুঞ্জীভূত ইষ্টকের রাশি ও রাবিশের ফাঁকে ফাঁকে গজিয়ে উঠেছে নানান রকম আগাছার চারা। সেখান দিয়ে কারুর পক্ষে পালানো অসম্ভব এবং সেখানে সাপ টিকটিকি ছাড়া কোনও বড়ো জীবেরই লুকোবার উপায় নেই।
বিমল হতাশভাবে বললে, ‘ফিরে চলো কুমার, আজ আমাদের কপাল খারাপ!’
কুমার বললে, ‘উঃ, রাগে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে! হতভাগাকে যদি একবার ধরতে পারতুম!’
—’ধরতে তাকে নিশ্চয়ই পারতুম, হঠাৎ ঠোক্কর খেয়ে পড়ে গিয়েই তো সব মাটি করলুম। কিন্তু সে গেল কোনদিকে?…কুমার, কাছেই দুম করে কি একটা শব্দ হল না?’
—’হ্যাঁ, বিমল, আমিও শব্দটা শুনেছি! কী যেন একটা পড়ে গেল!’
—’শব্দটা এসেছে এই গলির দিক থেকেই’, বলেই বিমল দৌড়ে আবার সেইদিকে গেল।
কিন্তু গলির ভিতরে কেউ নেই। তারা দুজনে আবার তাড়াতাড়ি দু—দিকের ঘরে উঁকি মারতে মারতে এগিয়ে চলল।
গলির প্রান্তে এসে শেষঘরে উঁকি মেরে বিমল চকিত স্বরে বললে, ‘এ কী!’
—’কী বিমল?’
—’কুপোটা দেখে গিয়েছিলুম ঘরের কোণে দাঁড় করানো রয়েছে, কিন্তু এখন দেখছি সেটা মেঝের উপরে গড়াগড়ি খাচ্ছে!…কুমার, অবলা ঠিক কথাই বলেছে—আমি হচ্ছি একটি আস্ত গাধা। শতধিক আমাকে, হাতে পেয়েও তাকে ছেড়ে দিলুম!’
কুমার ঘরের ভিতরে ঢুকে বললে, ‘তাহলে সে কি ওই কুপোর ভিতরে ঢুকে বসেছিল?’
—’কুপোর ভিতরে কী তার আড়ালে গা—ঢাকা দিয়েছিল তা আমি জানি না, কিন্তু একটু আগে সে নিশ্চয়ই ছিল এই ঘরে! হঠাৎ নিজে নিজেই জ্যান্ত হয়ে ঘরময় গড়াগড়ি দিতে পারে, এমন আশ্চর্য কুপোর কাহিনি পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত শোনা যায়নি! কুপোটাকে কেউ ফেলে দিয়েছে, আর অবলা ছাড়া সে অন্য কেউ নয়।’
—’কিন্তু সে—’
কুমারের মুখের কথা মুখেই রইল, খানিক দূর থেকে হঠাৎ চারিদিক কাঁপিয়ে বিষম আর্তনাদ উঠল—’বাবা রে, মরে গেছি রে, সেপাই! সেপাই!’
—শিগগির এসো কুমার, শিগগির! এ যে সুন্দরবাবুর গলা!’
তারা দ্রুতপদে আবার আগেকার উঠানে এসে পড়ল।
কুমার বললে, ‘উঠোনে তো কেউ নেই! সুন্দরবাবু কোথা থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন?’
—’সেপাই, সেপাই! জলদি আও—হামকো মার ডালা!’
বিমল একদিকে ছুটতে ছুটতে বললে, ‘সুন্দরবাবু চ্যাঁচাচ্ছেন, বাগান থেকে। এই যে, ওদিকে যাবার পথ!’
ধ্বংসস্তূপের মাঝখান দিয়ে বুনো গাছের জঙ্গল মাড়িয়ে বিমল ও কুমার উঠান থেকে বেরিয়েই দেখলে, একটা বটগাছের তলায় মাটির উপরে ভুঁড়ি ফুলিয়ে চিত হয়ে পড়ে সুন্দরবাবু ধনুষ্টঙ্কারের রোগীর মতো ক্রমাগত হাত—পা ছুড়ছেন এবং বাগানের নানা দিক থেকে ছুটে আসছে সাত—আটজন পাহারাওয়ালা!
বিমল এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, ‘কী হয়েছে সুন্দরবাবু? অত চ্যাঁচালেন কেন? এত হাত—পা ছুড়ছেন কেন?’
কুমার তাঁকে দু—তিনবার চেষ্টার পর টেনে তুলে বসালে।
সুন্দরবাবু হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘চ্যাঁচাব না? হাত—পা ছুড়ব না? বলেন কী মশাই? হুম, আমি পেটে খেয়েছি ভয়ানক এক ঘুষি, গালে খেয়েছি বিষম এক চড়। আমার দম বেরিয়ে গেছে, আমি চক্ষে সর্ষেফুল দেখছি!’
—’কে আপনাকে ঘুষি—চড় মারলে? ভালো করে খুলে বলুন।’
—’দাঁড়ান মশাই, দাড়ান! ভালো করে খুলে বলবার আগে ভালো করে হাঁপ ছেড়ে নি।…হ্যাঁ, শুনুন এইবার! আপনারা তো দিব্যি দড়ি বেয়ে ‘শর্ট—কাট করে ফেললেন, কিন্তু আপনাদের খোঁজে আমাকে এখানে আসতে হয়েছে দস্তুরমতো সাত—ঘাটের জল খেয়ে! বাবা রে বাবা, এটা কি বাড়ি না গোলকধোঁধা? আমি—’
বিমল বিরক্ত স্বরে বাধা দিয়ে বললে, ‘অত ব্যাখ্যা শোনবার সময় নেই! কে আপনাকে মেরেছে তাই বলুন! সে কোথায় গেল?’
—’আরে মশাই, রাগ করেন কেন? কে আমাকে মেরেছে আমি কি ছাই তাকে চিনি? সে কোথায় গেল তা দেখবার সময় কি আমি পেয়েছি? আমি দেখেছি খালি সর্ষেফুল। আসামিকে খোঁজবার জন্যে সেপাইদের এদিক—ওদিক পাঠিয়ে আমি নিজে এলুম এইদিকে। হঠাৎ কোথা থেকে একটা দৈত্যের মতো লোক ছুটে এসে আমার পেটে মারলে গুম করে ঘুষি আর গালে মারলে ঠাস করে চড়—সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঘুরে আমি ধড়াম করে পড়ে গেলুম!’
—’দৈত্যের মতো লোক? তাহলে নিশ্চয় সে অবলাকান্ত!’
—’হুম, অবলাকান্ত? কক্ষনও তার নাম অবলাকান্ত নয়—তাহলে প্রবলাকান্ত বলব কাকে?…আরে, আরে—ওই দেখুন মশাই, ওই দেখুন! ও বাবা, বেটা এতক্ষণ ওই ঝোপের ভেতরে লুকিয়ে ছিল নাকি? এই সেপাই, সেপাই! পাকড়ো, আসামি ভাগতা হ্যায়।’
হ্যাঁ, অবলাই বটে! ঝোপের আড়ালে থেকে বেরিয়েই সে আবার বাগান ছেড়ে ছুটল ভাঙাবাড়ির ভিতর দিকে এবং তার অনুসরণ করতে বিমল ও কুমার একটুও দেরি করলে না—যদিও তারা ছিল অনেকটা পিছিয়ে!
আবার সেই পোড়ো উঠান! বিমল ভিতরে ঢুকেই দেখলে, খানিক আগে সে যে দড়ি ধরে উঠানে নেমেছে সেই দড়ি অবলম্বন করেই অবলা আবার অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে উপর দিকে উঠে যাচ্ছে! অত বড়ো দেহে ক্ষিপ্রতা সত্যসত্যই বিস্ময়জনক!
বিমল বেগে ছুটে গিয়ে নীচে থেকে দড়ি ধরে হ্যাঁচকা টান মারতে মারতে চিৎকার করে বললে, ‘একটা রিভলভার! একটা রিভলভার! কার কাছে একটা রিভলভার আছে? সুন্দরবাবু, সুন্দরবাবু!’
পাহারাওয়ালারা সবাই এসে পড়ল, কিন্তু তাদের কারুর কাছেই রিভলভার ছিল না! কুমার আর কিছু না পেয়ে ইট কুড়িয়ে নিয়ে ছুড়তে লাগল। সুন্দরবাবু যখন হাঁসফাঁস করতে করতে আবির্ভূত হয়ে রিভলভার বার করলেন, অবলা তখন তেতলার জানলার আড়ালে হয়েছে অন্তর্হিত!
বিমল তিক্তস্বরে বললে, ‘নাঃ, আর পারা যায় না, এই একঘেয়ে লুকোচুরি খেলা আজকেই শেষ করতে হবে! অবলা আবার তার গর্তে ঢুকল! সুন্দরবাবু, পাঁচ নম্বর মণিলাল বসু স্ট্রিটের সদর দরজায় পাহারাওয়ালা আছে তো?’
—’আছে বইকী, দুজন।’
—’আচ্ছা, আপনি বাকি পাহারাওয়ালাদের নিয়ে আবার পাঁচ নম্বরকে আক্রমণ করুনগে যান!’
—’হুম, আচ্ছা ধড়িবাজ আসামির পাল্লায় পড়েছি রে বাবা, প্রাণ যে ওষ্ঠাগত হয়ে উঠল!’
—’যান, যান—দেরি করবেন না!’
—’আপনারা?’
—’আমরা আক্রমণ করব এইদিক দিয়ে, নইলে অবলা আবার পালাতে পারে’—বলেই বিমল দড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলে!
সুন্দরবাবু পাহারাওয়ালাদের নিয়ে অদৃশ্য হলেন। কুমার নীচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
বিমল রজ্জুপথে যখন দোতলা পার হয়েছে তখন হঠাৎ জাগল সেই খনখনে গলায় মেয়েলি হাসি! সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল—’ওরে হাঁদারাম বিমল, আর তোর রক্ষে নেই—মর, মর, মর!—’
কুমার সভয়ে দেখলে, তেতলার জানলার ভিতর থেকে সড়াৎ করে একখানা হাত বেরিয়ে ধারালো ভোজালি দিয়ে বিমলের অবলম্বন রজ্জুর উপর আঘাত করলে একবার, দুইবার, তিনবার!
—এবং দড়িটা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার সঙ্গেই যেন দপ করে নিবে গেল কুমারের চোখের আলো!