জেরিনার কণ্ঠহার – অবশিষ্ট – এক রাত্রের বিভীষিকা

অবশিষ্ট – এক রাত্রের বিভীষিকা

এক

জায়গাটির নাম নাই—বা শুনলে! আমার সঙ্গীটির আসল নামও বলব না, কারণ তাঁর আপত্তি আছে। কারণ বোধ হয়, এই নৈশ নাটকে আমাদের কেউই বীরের ভূমিকায় অভিনয় করেনি। তবে এইটুকু শুনে রাখো, আমার সঙ্গীটি হচ্ছেন কলকাতার একজন বিখ্যাত ডাক্তার। আমি তাঁকে সুবোধ বলে ডাকব।

এত লুকোচুরি কেন জানো? গল্পটি অমূলক নয়।

অনেকদিন আগেকার কথা। সুবোধ তখন সবে ডাক্তারি পাশ করেছে, কিন্তু কোমর বেঁধে রোগী—বধকার্যে নিযুক্ত হয়নি।

ছেলেবেলা থেকেই ভাঙা—চোরা সেকেলে মন্দির প্রভৃতি দেখবার শখ ছিল আমার অত্যন্ত। ভারতবাসীর অধিকাংশ নিজস্বতা খুঁজতে গেলে এই সব ধ্বংসাবশেষের মধ্যে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।

সেদিনও আমরা দুজনে একটি পুরানো মন্দির দেখতে গিয়েছিলুম। তার গর্ভ থেকে দেবতার চিহ্ন পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়েছে বটে, কিন্তু তার গা থেকে কারুকার্যের সৌন্দর্য এখনও কেউ মুছে দিতে পারেনি। সেই সব কারিকুরি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল আমার নয়ন—মন।

কিন্তু সুবোধ হল নিরাশ। বিরক্তস্বরে বললে, ‘বনজঙ্গল মাঠের ভেতর দিয়ে পথে—বিপথে সাত মাইল পেরিয়ে এই দেখাতে আমাকে এখানে নিয়ে এলে? এ যে পর্বতের মূষিক—প্রসব!’

আমি বললুম, ‘মেডিকেল কলেজে মড়ার সঙ্গে বাস করে করে তোমার মনও মরে আড়ষ্ট হয়ে গেছে সুবোধ! নইলে এমন শিল্পচাতুরী দেখবার পরেও মুখ—ভার করতে পারতে না!’

সুবোধ বললে, ‘আরে রেখে দাও তোমার শিল্পচাতুরী! রোদ পড়ে আসছে, সামনে আছে সাত মাইল দুর্গম পথ। এ—সময়ে শিল্পচাতুরী নিয়ে তর্ক না করে বাসার দিকে পা চালাবার চেষ্টা করো। পথে আসতে আসতে শুনেছ তো, এখানকার বনে—জঙ্গলে বাঘ—ভাল্লুকের অভাব নেই? তারা শিল্পরসিকের মর্যাদা রাখে না।’

আকাশের দিকে চেয়ে দেখলুম। সূর্যের ছুটি নেবার সময় হয়ে এসেছে। আর ঘণ্টাখানেক পরেই অন্ধকারের কালো রাজত্ব শুরু হবে। শুনেছি এ—অঞ্চলে মাঝে মাঝে ডাকাতের ভয়ও হয়।

সুবোধ আগেই অগ্রসর হল। আমিও তাকে অনুসরণ করলুম।

দুই

কিন্তু বরাত ভালো ছিল না।

একটা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে খোলা মাঠের উপরে পড়েই দেখলুম, আকাশের একপ্রান্ত আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে কালির মতন কালো মেঘে মেঘে।

সেইদিকে আঙুল তুলে সুবোধ বললে, ‘দেখেছ?’

—’হুঁ, দেখেছি। মিশকালো মেঘ, ঝড় ওঠবার সম্ভাবনা।’

সুবোধ বললে, ‘মাঠের ওপর দিয়ে আমাদের প্রায় দু—মাইল হাঁটতে হবে। আসবার সময় দেখেছি, মাঠের ও—পাশে তিন—চারখানা কুঁড়েঘর আছে। কিন্তু সেখানে যাবার অনেক আগেই ঝড় আমাদের নাগাল ধরে ফেলবে। এখন উপায়?’

—’উপায় খুব তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে দেওয়া!’ বলেই আমি প্রায় ছুটতে শুরু করলুম।

কিন্তু মাইল—খানেক এগুতে—না—এগুতেই মেঘের দল এগিয়ে এল একেবারে আমাদের মাথার উপরে এবং সঙ্গে সঙ্গে সে কী ঝড়ের তোড়! সুবোধের মাথায় ছিল টুপি, ঝড়ের ছোঁয়া পেয়েই সে পক্ষীধর্ম অবলম্বন করে ফুড়ুক করে আকাশে উড়ে গেল। চারিধারে হু—হু গাঁ—গাঁ গর্জন, পিছন থেকে ঝোড়ো হাওয়ার ধাক্কা এবং রাশি রাশি কাঁকর ছুটে এসে আমাদের গায়ে বিঁধতে লাগল, ছররা গুলির মতো। সন্ধ্যার অন্ধকারের সঙ্গে মেঘের কালিমা মিলে আমাদের দৃষ্টি করে দিলে প্রায় অন্ধের মতো। ভাগ্যে ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল, নইলে নিশ্চয়ই আমরা পথ হারিয়ে ফেলতুম।

কোনওরকমে মাঠ পার হলুম বটে, কিন্তু গায়ে পড়ল বড়ো বড়ো কয় ফাঁটা জল।

সুবোধ বললে, ‘ওহে, এইবার বৃষ্টির পালা আরম্ভ হবে। সামনে একটা ঘরের মতন কী দেখা যাচ্ছে, ওইদিকে চলো—ওইদিকে চলো!’

হ্যাঁ, পাশাপাশি দু—তিনখানা কুঁড়েঘরই বটে। একটা দাওয়ার উপরে উঠে দাঁড়াতে—না—দাঁড়াতেই ঝমঝম করে নামল মুষলধারে বৃষ্টি।

খানিকক্ষণ ধরে হাঁপ ছাড়বার পর সুবোধ তেঁতো হাসি হেসে বললে, ‘বন্ধুবর, শিল্পচাতুরী এখন কেমন লাগছে?’

—’মন্দ কী?

ঝর—ঝর বরষা,

নাহি কোনও ভরসা।

এও একটা নূতনত্ব ভেবে অনায়াসেই উপভোগ করা যেতে পারে।’

—’ভবিষ্যতে তোমার ভাবুকতার ফাঁদে আর কখনও পড়ব না। এখান থেকে আমাদের বাসা এখনও চার মাইলের কম হবে না। এই বৃষ্টি আর অন্ধকারে সেখানে যাওয়াও অসম্ভব, এখানে থাকাও অসম্ভব।’

—’থাকা অসম্ভব কেন?’

—’সারা রাত উপোস করব? হিন্দু বিধবার মতো উপোস করবার শক্তি আমার নেই। আমার এত খিদে পেয়েছে যে, আমি যদি বাঘ হতুম, তোমাকে ধরেই গপ করে খেয়ে ফেলতুম, বন্ধু বলে মানতুম না।’

ফিরে দেখলুম, আমাদের পিছনে একটা দরজার ফাঁক দিয়ে আলোর লাইন দেখা যাচ্ছে। আমি সেই দরজায় ধাক্কা মারলুম। দরজাটা খুলে গেল। হ্যারিকেন লণ্ঠন হাতে করে একজন স্ত্রীলোক আমাদের দেখেই বিস্মিতভাবে দু—পা পিছিয়ে গেল।

কিন্তু তার চেয়েও বেশি বিস্মিত হলুম আমরা।

বাবা, এত বৃহৎ স্ত্রীলোক আমি কখনও দেখিনি! যেমন লম্বায়, তেমনি চওড়ায়! দেখলেই তাকে পালোয়ানের মতন জোয়ান বলে মনে হয়। এবং কী কালো আর কী কুৎসিত! বলতে কী, সে স্ত্রীলোক হলেও তাকে দেখে আমার বুকের কাছটা ছোঁৎ—ছোঁৎ করতে লাগল।

স্ত্রীলোকটা ভাঙা—ভাঙা বাংলায় বললে, ‘তোমরা কে গো বাবুজি?’

—’আমরা এদিকে বেড়াতে এসেছিলুম গো। ফেরবার পথে এই ঝড়—বৃষ্টি! আমাদের বাসা এখান থেকে অনেক দূরে। আজ রাতটা এখানে থাকবার ঠাঁই হবে?’

সে বললে, ‘বাবুজি, আমরা ভারী গরিব। এই নোংরা ঘরে তোমরা থাকতে পারবে কি?’

—’খুব পারব গো, খুব পারব। অবিশ্যি কাল সকালে তোমাকে ভালো করে বকশিশ না দিয়ে যাব না।’

স্ত্রীলোকটা খানিকক্ষণ কী ভাবলে। তারপর বললে, ‘আচ্ছা, এসো!’ আমরা ঘরের ভিতরে গিয়ে দাঁড়ালুম।

সে লণ্ঠনটা তুলে নিয়ে বললে, ‘আমার সঙ্গে চলো।’

চললুম। সে—ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে স্ত্রীলোকটা বললে, ‘বাবুজি, এই ঘরে তোমাদের থাকতে হবে।’

চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলুম। মাঝারি আকারের ঘর। মেঝেময় ছাগলের বিষ্ঠা, মেটে দেওয়াল, উপরে খড়ের ছাউনি। একদিকে দেওয়াল ঘেঁষে একটা সস্তা দামের আলমারি দাঁড় করানো রয়েছে, কিন্তু তার পাল্লায় কাচ নেই এবং ভিতরেও তাক নেই। আর একদিকে একখানা দড়ির খাটিয়া। সারাঘরে এমন বাঁটকা দুর্গন্ধ যে নাকে কাপড় চাপা দেবার ইচ্ছা হল।

স্ত্রীলোকটা বললে, ‘বাবুজি, রাতে তোমরা খাবে কী?’

সুবোধ বললে, ‘আমিও তোমাকে ঠিক ওই কথাই জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলুম! রাতে খাব কী? তোমাদের বাড়িতে খাবারটাবার কিছু নেই?’

—’দুটি চাল আছে, আর কিছু নেই। বাবুজি, আমরা বড়ো গরিব।’

সুবোধ ম্রিয়মাণ ক্ষীণস্বরে বললে, ‘বেশ, আজ ওই চালেই আমাদের চলবে।’

স্ত্রীলোকটা বললে, ‘বাবুজি, তোমরা মোরগ খাও?’

—’মোরগ? অর্থাৎ ফাউল? নিশ্চয়ই খাই।’

—’আমার মোরগ আছে, বাবুজি!’

সুবোধ অত্যন্ত উৎসাহিত হয়ে বললে, ‘অ্যাঃ, তোমার মোরগ আছে? তবে কে বলে তুমি গরিব? মোরগ তো রাজভোগ! আচ্ছা, এখন এই একটা টাকা নাও, কাল সকালে তোমাকে আরও তিন টাকা বকশিশ দিয়ে যাব।’ বলেই সে ফস করে পকেট থেকে মনিব্যাগটা বার করলে।

স্ত্রীলোকটার দুই চোখ হঠাৎ জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠল। তার সেই লোলুপ দৃষ্টির অনুসরণ করে দেখলুম, সুবোধ তার ব্যাগ খুলেছে এবং ব্যাগের ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়েছে কয়েকখানা নোট।

ঠিক সেই সময়ে দরজার কাছ থেকে কর্কশ হেঁড়ে গলায় কে বললে, ‘মণিয়া, এরা কারা?’

চমকে ফিরে দেখি, দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে আর একখানা বীভৎস মুখ! কালো পাথরের থালার মতন গোল মুখে দুটো ভোঁটার মতো চোখ, থ্যাবড়া নাক, ঝাঁটার মতো খোঁচা খোঁচা গাঁফ এবং হিংস্র জন্তুর মতো বড়ো বড়ো দাঁত! যেন মা—দুর্গার অসুর!

মণিয়া—অর্থাৎ সেই স্ত্রীলোকটা তাড়াতাড়ি বললে, ‘বাবুজিরা আজ এখানে থাকবে। চল, তোকে সব বলছি।’

তিন

সেই দুই অদ্ভুত ও ভয়াবহ মূর্তি অদৃশ্য হবার পর আমি বিরক্ত স্বরে বললুম, ‘সুবোধ, এই স্ত্রীলোকটার সামনে কে তোমাকে ব্যাগ খুলতে বললে?’

—’কেন ভাই, কিছু অন্যায় হয়েছে নাকি?’

—’অন্যায় হয়েছে কি না আজ রাতেই হয়তো বুঝতে পারব! একে তো এই অজানা জঙ্গুলে জায়গা, ঝড়—বাদলের রাত, আর আমাদের এই অসহায় অবস্থা, তার উপরে কৃতজ্ঞতার খাতির রেখেও বলতে হচ্ছে, আমাদের আশ্রয় দিয়েছে যারা তাদের চেহারা হচ্ছে দানব—দানবীর মতো! রক্ষক শেষটা ভক্ষক হয়ে না দাঁড়ায়!’

সুবোধ ভীতভাবে ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের পানে তাকিয়ে রইল।

খানিক পরেই দেখি পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এল সেই দুশমনের মতন পুরুষটা। দরজার কাছেই ছিল হ্যারিকেন লণ্ঠনটা। তার ম্লান আলোতেও স্পষ্ট দেখলুম, লোকটার হাতে চকচক করছে একখানা প্রায় একহাত লম্বা ছুরি—না, ছুরি না বলে তাকে ছোটো তরবারি বললেই ঠিক হয়! লোকটা একবার আমার দিকে তাকিয়ে বিশ্রী হাসি হাসলে, তারপর দাওয়া থেকে উঠানে নেমে অন্ধকারের ভিতরে মিলিয়ে গেল।

সুবোধও দেখেছিল। চোখ কপালে তুলে সে বললে, ‘সর্বনাশ! এই রাতে অতবড়ো ছুরি নিয়ে ও কী করবে? ও আমাদের পানে তাকিয়ে অমন করে হাসলে কেন?’

পাশের ঘর থেকে স্ত্রী—পুরুষের গলার আওয়াজ এল।

আমি বললুম, ‘আমরা এখানে এসে প্রথমে দেখেছিলুম মণিয়াকে। তারপর দেখলুম আর একটা লোককে। এখন দেখছি এ বাড়িতে আরও পুরুষও আছে! তাদের চেহারাও বোধহয় কার্তিকের মতন নয়!’

সুবোধ ধপাস করে খাটিয়ার উপরে শুয়ে পড়ে বললে, ‘এক মণিয়া—রাক্ষসী আক্রমণ করলেই আমরা দুজনেই হয়তো কাবু হয়ে পড়ব, তার উপরে আবার পুরুষ—সঙ্গীর দল! নাঃ, আমাদের আর কোনওই আশা নেই!’

ঘণ্টা দুয়েক পরে মোটা লাল চালের ভাতের সঙ্গে এল গরম ফাউলের ঝোল। কিন্তু ফাউল খাবার জন্যে সুবোধ আর কোনও আগ্রহই দেখালে না। তার মুখের ভাব দেখলে মনে পড়ে বলির পাঁঠার কথা। আমার নিজের মুখের ভাব কী রকম হয়েছিল, জানি না।

চার

রাতে শোবার আগে ঘরের দরজা ভিতর থেকে খুব সাবধানে বন্ধ করে দিলুম। হ্যারিকেনের লণ্ঠনটা সেই কাচ ও তাক—হীন আলমারির মাথায় এমনভাবে রেখে দিলুম, যাতে ঘরের সবটা দেখতে পাওয়া যায়।

সুবোধ বললে, ‘এরা কী জাত, বোঝা গেল না! এরা মুরগি পোষে, মুরগি রাঁধে, কিন্তু এদের মুসলমান বলে মনে হচ্ছে না।’

খাটিয়ার উপরে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে বললুম, ‘আমার বিশ্বাস, এরা সাঁওতাল কি ওই রকম কোনও বুনো জাত!’

সুবোধ ত্রস্তস্বরে বললে, ‘কী হে, ঘুমোবে নাকি? আমি কিন্তু সারারাতই জেগে বসে থাকব। এখানে ঘুম মানে মৃত্যু বা আত্মহত্যা।’

—’তুমি যদি পাহারা দিতে রাজি হও, তা হলে আমি আর জেগে মরি কেন?’ বলেই চোখ মুদে ফেললুম।

বাইরে তখনও ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে। থেকে থেকে গাছে গাছে ঝোড়ো হাওয়ার কান্নাও শোনা যাচ্ছে। সেইসঙ্গে শুনলুম একটা ছাগলও চিৎকার করছে প্রাণপণে।

কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, কতক্ষণ যে ঘুমিয়েছি জানি না, কিন্তু হঠাৎ সুবোধের প্রচণ্ড ঠেলাঠেলির চোটে ভেঙে গেল আমার ঘুম।

ধড়মড় করে উঠে বসলুম, ‘কী, কী, ব্যাপার কী?’

সুবোধ প্রায় কান্নার স্বরে বললে, ‘বাইরে থেকে দরজায় ধাক্কা মারছে! তারা আসছে—তারা আসছে!’

—’কী বলছ? কারা আসছে?’

—’যারা আমাদের গলা কাটতে চায়! আর রক্ষে নেই।’

সভয়ে দরজার দিকে তাকালুম।

সুবোধ থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বললে, ‘ও—দরজায় নয়, অন্য কোনও দরজায়! ওই শোনো।’

সত্য, ঘটাঘট করে একটা দরজার শব্দ হল। শব্দটা জাগছে এই ঘরের ভিতরেই, অথচ এখানে একটা ছাড়া দরজা নেই!

সুবোধ কান পেতে শুনে বললে, ‘শব্দটা আসছে যেন ওই ভাঙা আলমারির পেছন থেকেই।’

তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে আলমারিটা একটু টেনে সরিয়ে তার ফাঁকে উঁকি মেরে দেখলুম, সত্য—সত্যই আলমারির পিছনে রয়েছে আর একটা দরজা!

সুবোধ বললে, ‘ভাই, আমরা পাকা ডাকাতের পাল্লায় পড়েছি। ওই দরজাটা লুকোবার জন্যেই ওখানে ওরা আলমারি রেখেছে!’

হাত বাড়িয়ে দেখলুম, সে—দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করবার কোনও উপায় নেই।

বুঝলুম, একটু জোরে ধাক্কা মারলেই এই ভাঙা আলমারিটা এখনই উলটে হুড়মুড় করে পড়ে যাবে মেঝের উপরে। কিন্তু শত্রুরা জোরে ধাক্কা মারছে না কেন? আমাদের ঘুম ভেঙে যাবার ভয়ে? খুব সম্ভব তাই।

আলমারিটাকে আবার যথাস্থানে সরিয়ে রেখে তার গায়ে খাটিয়াখানা ঠেলে দিলুম। তারপর খাটিয়ায় বসে পড়ে ঘড়ি বার করে দেখলুম, রাত সাড়ে তিনটে।

পাঁচ

কিন্তু আমাদের প্রাণ এবং সুবোধের নোটগুলো এ—যাত্রা বেঁচে গেল, কারণ রাত্রে সন্দেহজনক আর কিছু ঘটল না।

সকালে ঘরের দরজা খুলেই দেখি, মণিয়া দাওয়ায় দাঁড়িয়ে আছে।

সে হেসে জিজ্ঞাসা করলে, ‘বাবুজি, রাতে ঘুম হয়েছিল তো?’

আমি ক্রুদ্ধস্বরে বললুম, ‘সারারাত তোমরা যদি দরজা ঠেলাঠেলি করো, তাহলে ঘুম হয় কেমন করে?’

মণিয়া আবার হেসে বললে, ‘ও, বুনি বুঝি ওদিকের ভাঙা দরজাটা ঠেলেছিল? হ্যাঁ বাবুজি, বুনির ওই স্বভাব। ও দরজার খিল নেই, বুনি তা জানে। তার জ্বালাতেই তো দরজার সামনে আলমারিটা দাঁড় করিয়ে রেখেছি।’

—’বুনি কে শুনি?’

—’আমাদের বকরি, বাবুজি!’

ছাগলি! একটা ছাগলির ভয়ে কাল রাতে আমরা—

হঠাৎ সুবোধ একদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলে।

উঠানের মাঝখানে রয়েছে একরাশ মুরগির পালক প্রভৃতি এবং তার পাশেই দেখা যাচ্ছে মস্ত একখানা একহাত লম্বা ছুরি।

তাহলে কাল রাতে সেই লোকটা এই ছুরিখানা নিয়ে বেরিয়েছিল মুরগি কাটবার জন্যেই?

বিদেশ—বিভুঁই, ঝড়—বাদল, নিশুতি রাত, অচেনা মানুষের বিকট চেহারা, বৃহৎ ছুরি, লুকানো দরজা, ছাগলি বুনির গৃহপ্রবেশ—চেষ্টা প্রভৃতি একসঙ্গে মিলে আমাদের মনের ভিতরে যে ঘোরতর বিভীষিকার জগৎ সৃষ্টি করেছিল, সকালের সূর্যালোকে তা উড়ে গেল কুয়াশার মতো।

নিজেদের মনে—মনে লজ্জাও যে হচ্ছিল না এমন কথা বলতে পারি না।

এবং অনুতাপও হচ্ছিল যথেষ্ট। হতে পারে মণিয়া আর তার সঙ্গীদের চেহারা অপ্সর—অপ্সরীদের মতন নয়। কিন্তু এই দুর্যোগের রাতে গহন বনে আমাদের মতন অনাহুত অতিথিদের আশ্রয় ও আহার্য দিয়ে তারা যে যত্নাদরটা করেছে, তার মর্যাদা না দিয়ে আমরা যে তাদের উপরেই অকৃতজ্ঞের মতন হীন সন্দেহ করেছি, এই অপ্রিয় সত্যটাই আমাদের মনকে আঘাত দিতে লাগল বারংবার।

বলা বাহুল্য, সুবোধের অঙ্গীকৃত তিন টাকা বকশিশ পরিণত হল পঞ্চ মুদ্রায়। এই অভাবিত সৌভাগ্যে মণিয়ার কালো মুখের উপর দিয়ে বয়ে গেল মিষ্ট হাসির তরঙ্গ।

প্রকাশিত—১৯৪০

___