জাতীয় শিক্ষা
কথায় বলে, ‘টকের ভয়ে পালিয়ে গিয়ে তেঁতুলতলে বাসা।’ আজকাল ‘জাতীয় শিক্ষা’, ‘জাতীয় শিক্ষা’ বলিয়া যে বিপুল সাড়া পড়িয়া গিয়াছে দেশে, ইহার প্রতিও উক্ত ব্যাঙ্গোক্তি দিব্যি খাটে! সরকারি বিদ্যালয়ে বিদ্যা লয় হয় বলিয়াই যদি আমরা তাহাকে তালাক দিই , তাহা হইলে আমরা আমাদের শিক্ষার পরিপুষ্টির জন্য বা মনের মতো শিক্ষা দিবার জন্য যে বিদ্যাপীঠ খাড়া করিয়াছি বা করিব, তাহা কিছুতেই ওই সরকারি বিদ্যালয়েরই নামান্তর বা রূপান্তর হইবে না। তাহা হইলে টকের ভয়ে আমরা বৃথাই বাঁধা বাসা ফেলিয়া পলাইয়া আসিলাম, কেননা আবার আমাদের আর একরকম ‘টকবৃক্ষ’-এরই ছায়াতলে আশ্রয় লইতে হইল।
‘শুনিয়াছি, ‘বন্দেমাতরম’-এর যুগে যখন স্বদেশি জিনিসের সওদা লইয়া দেশময় একটি হইহই ব্যাপার, রইরই কাণ্ড পড়িয়া গিয়াছিল, তখন অনেক দোকানদার বা ব্যবসায়ীগণ বিলাতি জিনিসের ট্রেডমার্ক বা চিহ্ন দিব্যি চাঁচিয়া-ছুলিয়া উঠাইয়া দিয়া তাহাতে একটি স্বদেশি মার্কা মারিয়া লোকের নিকট বিক্রয় করিতেন। এখন যে-পদ্ধতিতে জাতীয় শিক্ষা আমাদের ভবিষ্যৎ আশা-ভরসাস্থল নব-উদ্ভাবিত জাতীয় বিদ্যালয়ে দেওয়া হইতেছে, তাহাও ঠিক ওই রকম বিলিতি শিক্ষারই ট্রেডমার্ক উঠাইয়া ‘স্বদেশি’ মার্কা লাগাইয়া দেওয়ার মতো। শিক্ষায় যা একটু মৌলিকতা দেখা যাইতেছে, তাহা কিন্তু বিশেষ দ্রষ্টব্য নয়। ওরকম এক-আধটু নূতনত্ব যে কেহ একটি নূতন জিনিসে লাগাইতে পারে। যদি আমাদের এই জাতীয় বিদ্যালয় ওই সরকারি বিদ্যাপীঠেরই দ্বিতীয় সংস্কাররূপে আত্মপ্রকাশ করে, তাহা হইলে আমরা কিছুতেই উহাকে আমাদের জাতীয় বিদ্যালয় বলিয়া স্বীকার করিতে পারি না, বা গৌরবও অনুভব করিতে পারি না। যাহা আমাদের সম্পূর্ণ নিজস্ব নয়, যাহা অন্যের ভুল দাগে দাগা-বুলানো মাত্র, তাহাকে কী বলিয়া কোন্ লজ্জায় ‘হামারা’ বলিয়া বুক ঠুকিয়া তাহাদেরই সামনে দাঁড়াইব – যাহাদিগকে মুখ ভ্যাংচাইয়া বাহির হইয়া আসিয়াছি আবার তাহাদেরই হুবহু ‘হনুকরণ’ করিতেছি। জাতীয় বিদ্যালয়ের শিক্ষা-পদ্ধতি ও শিক্ষাদাতা কর্তাদের সম্বন্ধে আমরা আজ পর্যন্ত যাহা জানিতে পারিয়াছি, তাহা খারাপ বলিতে আমাদেরই বক্ষে বাজিতেছে; কিন্তু সত্যকে অস্বীকার করিয়া ভণ্ডামি দিয়া কখনও মঙ্গল উৎসবের কল্যাণ-প্রদীপ জ্বলিবে না। শুধু চরকা দিয়া সুতা কাটানো ছাড়া এ ন্যাশনাল বিদ্যালয়ে তেমন কিছু নূতন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় নাই, যারা সম্পূর্ণরূপে আমাদের দেশের ছেলেদের মনের বা এদেশের আবহাওয়ার উপযোগী। এসবই ইংরেজি কায়দা-কানুনকে যেন মাথায় পগ্গ ও পায়ে নাগরা জুতা পরাইয়া এদেশি করা; অথবা সাহেবকে ধুতি ও মেমকে শাড়ি পরাইয়া বাবু ও বিবি সাজানো গেছে। এর পূর্বে স্বদেশি যুগে যখন আর একবার এইরকম জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হইয়াছিল, তখনও এই ব্যাপার ঘটিয়া সব কিছু পণ্ড হইয়া গিয়াছিল।
এসব দোষ তো আছেই, তাহা ছাড়া এমন ব্যাপার এখানে অনুষ্ঠিত হইতেছে তাহা কিছুতেই মার্জনা করা যায় না। যাঁহারা জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রফেসর বা অধ্যাপক নিযুক্ত হইতেছেন, তাঁহার সকলেই কী নিজ নিজ পদের উপযুক্ত? কত উপযুক্ত লোককে ঠকাইয়া শুধু দুটো বক্তৃতা ঝাড়ার দরুন ইহারা অনেকেই নিজের রুটির জোগাড় করিয়া লইয়াছেন ও লইতেছেন। আজ আমরা তাঁহাদের নাম প্রকাশ করিলাম না। যদি এখনও এই রকম ব্যাপার চলিতে থাকে, তবে বাধ্য হইয়া আরও অপ্রিয় সত্যকথা আমাদিগকে বলিতে হইবে। পবিত্রতার নামে, মঙ্গলের নামে এমন জুয়াচুরিকে প্রশ্রয় দিলে আমাদের ভবিষ্যৎ একদম ফরসা! দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন বা দেশের লোক কতকগুলি ভূতের বাথান ও আখড়া পাকাইবার জন্য বুকের রক্তসম টাকার আড়ি হুড়মুড় করিয়া ঢালিয়া দেন নাই। তাঁহারা টাকা ঢালিয়া দিয়াছেন ইংরাজি মেম-ভারতীয় জুতোপরা পায়ে নয়, বাগ্দেবী ভারতী-বীণাপাণির কমল পায়ে। এর চেয়ে উপযুক্ত লোক পাওয়া যাইতেছে না বলিয়া ‘খোঁড়া ওজর’ দেখাইলে চলিবে না, তাঁহারা ইহার জন্য চেষ্টা করিয়াছেন কি?