জাতিবৈর

জাতিবৈর

ভারতবর্ষীয় যে কোন ইংরেজি সম্বাদপত্র (ইংরেজি সম্বাদপত্র অর্থে ইংরেজের দ্বারা সম্পাদিত সম্বাদপত্র) আমরা হস্তে গ্রহণ করি না কেন, সন্ধান করিলে অবশ্যই দেখিব যে, তাহার কোন স্থানে না কোন স্থানে দেশীয় লোকদিগের উপর কিছু গালি—কিছু অন্যায় নিন্দা আছে। আবার যে কোন বাঙ্গালা সম্বাদপত্র পড়ি না কেন, সন্ধান করিলে তাহার কোন অংশে না কোন অংশে—ইংরেজের উপর ক্রোধ প্রকাশ— ইংরেজের নিন্দা—অবশ্য দেখিতে পাইব। দেশী পত্র মাত্রেই ইংরেজের অন্যায় নিন্দা থাকে, ইংরেজি পত্র মাত্রেই দেশী লোকের অন্যায় নিন্দা থাকে। বহুকাল হইতে এরূপ হইতেছে—নূতন কথা নহে।

সম্বাদপত্রে যেরূপ দেখা যায়, সামাজিক কথোপকথনেও সেইরূপ। ইহা জাতিবৈরের ফল। এতদুভয় জাতির মধ্যে যে বিদ্বেষ ভাব, তাহাকেই জাতিবৈর বলিতেছি। প্রায় অধিকাংশ সদাশয় ইংরেজ ও দেশীয় লোক এই জাতিবৈর জন্য দুঃখিত। তাঁহারা এই জাতিবৈরকে মহা অশুভকারী মনে করিয়া ইহার শান্তির জন্য যত্ন করেন। যে সকল সম্বাদপত্রে এই জাতিবৈরের পরিচয় পাওয়া যায়, তাহাতেই আবার ইহার নিবারণার্থ নানাবিধ কূটার্থ, অলঙ্কারবিশিষ্ট, প্রবন্ধ দেখিতে পাওয়া গিয়াছে। ইহার নিবাকরণার্থ অনেক দ্বিজাতীয়, সমাজ, সভা, সোসাইটি, এসোসিয়েশন স্থাপিত হইয়া, শ্বেতকৃষ্ণ উভয় বর্ণে রঞ্জিত হইয়া সতরঞ্চের ছকের দশা প্রাপ্ত হইয়াছে। ইহার শমতা জন্য কত ইউনিয়ন ক্লব সংস্থাপিত হইয়া সূপকার এবং মদ্যবিক্রেতাকুলের আনন্দ বৃদ্ধি করিয়াছে। কিন্তু কিছুতেই এ রোগের উপশম হইল না, এ বিষ নামিল না। দুঃখের বিষয় যে, কেহ কখন বিবেচনা করিয়া দেখিল না যে, এই জাতিবৈর শমিত করিয়া, আমরা উপকৃত হইব কি না? আর উপকৃত হই বা না হই, বাস্তবিক ইহার শমতা সাধ্য কি না?

ইংরেজরা যে এ দেশের লোকের অপেক্ষা সাধারণতঃ শ্রেষ্ঠ, তাহা আত্মগৌরবান্ধ ব্যক্তি ব্যতীত কেহই অস্বীকার করিবেন না। ইংরেজরা আমাদের অপেক্ষা বলে, সভ্যতায়, জ্ঞানে, এবং গৌরবে শ্রেষ্ঠ। কোন এক জন ইংরেজের অপেক্ষা, কোন এক বাঙ্গালীকে শ্রেষ্ঠ দেখা যাইতে পারে, কিন্তু সাধারণ বাঙ্গালীর অপেক্ষা, সাধারণ ইংরেজ যে শ্রেষ্ঠ তদ্বিষয়ে সংশয় নাই। যেখানে এরূপ তারতম্য, সেখানে যদি শ্রেষ্ঠ পক্ষ নিস্পৃহ, হিতাকাঙ্ক্ষী এবং শমিতবল হইয়া থাকিতে পারেন, নিকৃষ্ট পক্ষ তাঁহাদিগের নিকট বিনীত আজ্ঞাকারী এবং ভক্তিমান হইয়া থাকিতে পারেন, তবেই উভয়ে প্রীতির সম্ভাবনা। যে নিকৃষ্ট হইয়া, বিনীত, বশ্য এবং ভক্তিমান না হইবে, শ্রেষ্ঠ তাহার উপর কাজে কাজেই বিরক্ত হইবেন। আর যে শ্রেষ্ঠ হইয়া বল প্রকাশ এবং অনিষ্টকারী হইবে, নিকৃষ্ট সুতরাং তাহার উপর রাগ করিবেন। অতএব ইংরেজেরা যদি আমাদিগের প্রতি নিস্পৃহ, হিতাকাঙ্ক্ষী এবং শমিতবল হইয়া আচরণ করিতে পারেন, আর আমরা যদি তাঁহাদিগের নিকট নম্র, আজ্ঞাকারী, এবং ভক্তিমান হইতে পারি, তবে জাতিবৈর দূর হইতে পারে। কিন্তু ইংরেজেরা জেতা, আমরা বিজিত। মনুষ্যের স্বভাবই এমত নহে যে, বিজিত হইয়া জেতার প্রতি ভক্তিমান হয় অথবা তাহাদিগকে হিতাভিলাষী, নিস্পৃহ মনে করে; এবং জেতাও কখন বল প্রকাশে কুণ্ঠিত হইতে পারেন না। আজ্ঞাকারী আমরা বটে, কিন্তু বিনীত নহি এবং হইতেও পারিব না। কেন না আমরা প্রাচীন জাতি; অদ্যাপি মহাভারত রামায়ণ পড়ি, মনু যাজ্ঞবল্ক্যের ব্যবস্থা অনুসারে চলি, স্নান করিয়া জগতে অতুল্য ভাষায় ঈশ্বর আরাধনা করি। যত দিন এ সকল বিস্মৃত হইতে না পারি তত দিন বিনীত হইতে পারিব না, মুখে বিনয় করিব, অন্তরে নহে। অতএব এই জাতিবৈর, আমাদিগের প্রকৃত অবস্থার ফল—যত দিন দেশী বিদেশীতে বিজিত-জেতৃ-সম্বন্ধ থাকিবে, যত দিন আমরা নিকৃষ্ট হইয়াও পূর্বগৌরব মনে রাখিব, তত দিন জাতিবৈরের শমতার সম্ভাবনা নাই।

এবং আমরা কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি যে, যত দিন ইংরেজের সমতুল্য না হই, তত দিন যেন আমাদিগের মধ্যে এই জাতিবৈরিতার প্রভাব এমনই প্রবল থাকে। যত দিন জাতিবৈর আছে, তত দিন প্রতিযোগিতা আছে। বৈরভাবের কারণই আমরা ইংরেজদিগের কতক কতক সমতুল্য হইতে যত্ন করিতেছি। ইংরেজদের নিকট অপমানগ্রস্ত, উপহসিত হইলে, যত দূর আমরা তাহাদিগের সমকক্ষ হইবার জন্য যত্ন করিব, তাহাদিগের কাছে বাপু বাছা ইত্যাদি আদর পাইলে ততদূর করিব না—কেন না সে গায়ের জ্বালা থাকিবে না। বিপক্ষের সঙ্গেই প্রতিযোগিতা ঘটে—স্বপক্ষের সঙ্গে নহে। উন্নত শত্রুর উন্নতির উদ্দীপক—উন্নত বন্ধু আলস্যের আশ্রয়। আমাদিগের সৌভাগ্যক্রমেই ইংরেজের সঙ্গে আমাদিগের জাতিবৈর ঘটিয়াছে।

যদি শুভানুধ্যায়ীদিগের যত্ন সফল হইয়া, সম্প্রতি জাতিবৈরিতার উপশম ঘটে, তাহা হইলে আমরা যে মানসিক সম্বন্ধের কথা উপরে বলিয়াছি, তাহা অবশ্য ঘটিবে; জাতিবৈর উচ্ছিন্ন হইলেই নিকৃষ্ট জাতি উৎকৃষ্টের নিকট বিনীত, আজ্ঞাকারী এবং ভক্তিমান হইবে,—কেন না সে অবস্থা না ঘটিলে জাতিবৈর যাইবে না। এইরূপ মানসিক অবস্থা, উন্নতির পথরোধক। যে বিনীত, সে আত্মক্ষমতায় বিশ্বাসশূন্য,—যে পরের আজ্ঞানুকারী, সে আত্মানুবর্তিতাশূন্য,—এবং যে প্রভুর প্রতি ভক্তিমান্ সে প্রভুর প্রতি সকল ভার অর্পণ করিয়া আত্মকার্যে বিমুখ হয়। যখন বাঙ্গালী ইংরেজের তুল্য না হইয়াও ইংরেজের প্রতি জাতিবৈরশূন্য হইবে, তখন বাঙ্গালী আত্মোন্নতির সম্ভাবনায় বিশ্বাস করিবে না, তাহার চেষ্টাও করিবে না, আত্মচিত্তবৃত্তিকে স্ফূর্তি দিবে না, আত্মরক্ষায় যত্ন করিবে না। তখন ভাবী উন্নতির মূল এককালীন উৎপাটিত হইবে। সে দূরবস্থা কখন না ঘটুক! জাতিবৈর এখনও বহুকাল বঙ্গদেশে বিরাজ করুক।

অতএব জাতিবৈর স্বভাবসঙ্গত, এবং ইহার দূরীকরণ স্পৃহণীয় নহে। কিন্তু জাতিবৈর স্পৃহণীয় বলিয়া, পরস্পরের প্রতি দ্বেষভাব স্পৃহণীয় নহে। দ্বেষ, মনের প্রতি কুৎসিত অবস্থা; যাহার মনে স্থান পায় তাহার চরিত্র কলুষিত করে। বাঙ্গালী ইংরেজের প্রতি বিরক্ত থাকুন, কিন্তু ইংরেজের অনিষ্ট কামনা না করেন; ইংরেজ বাঙ্গালীর প্রতি বিরক্ত থাকুন, কিন্তু বাঙ্গালীর অনিষ্ট কামনা না করেন। জাতিবৈরের ফলে প্রতিযোগিতা ভিন্ন বিদ্বেষ ও অনিষ্ট কামনা না ঘটে। অনেক স্থানে তাহা ঘটিতেছে।

—‘সাধারণী’, ১১ কার্তিক ১২৮০।