জলজ
য়ুল। ঘুম থেকে ওঠ।
য়ুলের মনে হয় অনেকদূর থেকে কেউ যেন তাকে ডাকছে। গলার স্বরটি চেনা কিন্তু সেটি কার য়ুল মনে করতে পারল না। য়ুল গভীর ঘুম থেকে জেগে ওঠার চেষ্টা করতে করতে আবার অচেতনতার অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিল, তখন সে শুনতে পেল আবার তাকে কেউ একজন ডাকল, য়ুল। ওঠ।
য়ুল প্রাণপণ চেষ্টা করে জেগে উঠতে, মনে করতে চেষ্টা করে সে কে, সে কোথায়, কে তাকে ডাকছে, কেন তাকে ডাকছে। কিন্তু তার কিছুই মনে পড়ে না। সে অনুভব করে এক গভীর জড়তায় তার দেহ আর চেতনা যেন কোথাও অবরুদ্ধ হয়ে আছে, তার ভিতর থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না।
ওঠ য়ুল। আমরা পৃথিবীর কাছাকাছি চলে এসেছি।
পৃথিবী! হঠাৎ করে য়ুলের সব কথা মনে পড়ে যায়, পৃথিবী হচ্ছে সূর্য নামক সাদামাঠা একটা নক্ষত্রের মহাকর্ষে আটকে থাকা নীলাভ একটি ছোট গ্রহ। যে গ্রহে তার পূর্বপুরুষ মানুষের জন্ম হয়েছিল। যে মানুষ রোবটদের নিয়ে ক্রসিয়াস গ্রহপুঞ্জে বসতি করেছে দুই শতাব্দী আগে। সেই ক্রসিয়াস গ্রহপুঞ্জ থেকে সে ফিরে যাচ্ছে পৃথিবীতে। সূর্য নামক সাদামাঠা একটি নক্ষত্রের কক্ষপথে আটকে থাকা তৃতীয় গ্রহটিতে।
য়ুল খুব ধীরে ধীরে তার চোখ খুলে তাকাল, তার মুখের ওপর ঝুঁকে আছে একটি ধাতব মুখ। সেই ধাতব মুখে তার জন্য উৎকণ্ঠা, তার জন্য মমতা।
য়ুলকে চোখ খুলতে দেখে ধাতব মুখটি আরো নিচু হয়ে এল, শীতল ধাতব হাতে তার মুখমণ্ডল স্পর্শ করে বলল, তুমি প্রায় এক যুগ থেকে ঘুমিয়ে আছ য়ুল। তোমার এখন ওঠার সময় হয়েছে।
য়ুল ধাতব মুখ, তার শীতল স্পর্শ এবং কোমল কণ্ঠটি চিনতে পারে। এটি ক্রন, একজন রোবট ক্রসিয়াস গ্রহপুঞ্জ থেকে তার সাথে এসেছে। প্রায় একযুগ দীর্ঘ মহাকাশ অভিযানে তাকে একা একা আসতে দেয় নি ক্রসিয়াস গ্রহপুঞ্জের বিজ্ঞান একাডেমি। তার সাথে দিয়েছে একজন রোবট, যার নাম ক্রন এবং একজন আধা জৈবিক আধা যান্ত্রিক বায়োবট যার নাম কীশ। বার্ধক্য তাদের স্পর্শ করে না বলে গত এক যুগ তারা এই মহাকাশযানের শূন্য করিডোরে অপেক্ষা করেছে, ক্রসিয়াস গ্রহপুঞ্জের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছে, শীতল ঘরের কালো ক্রোমিয়াম ক্যাপসুলে য়ুলের দেহকে চোখে চোখে রেখেছে। য়ুল ক্রনের ধাতব অথচ কোমল মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ভালো আছ ক্ৰন?
হ্যাঁ। আমি ভালো আছি।
কীশ কোথায়? কীশ ভালো আছে?
কীশ মূল নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে। সেও ভালো আছে।
য়ুল আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ক্ৰন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, এখন তুমি কথা বলবে না য়ুল। তুমি চুপ করে শুয়ে থাকবে। তুমি প্রায় এক যুগ শীতল ঘরে ঘুমিয়ে ছিলে। তোমার দেহকে খুব ধীরে ধীরে জাগিয়ে তুলতে হবে।
আমি তো জেগেই আছি!
তোমার মস্তিষ্ক জেগে আছে, কিন্তু তোমার দেহ এখনো জেগে ওঠে নি। আমাকে একটু সময় দাও আমি তোমার দেহকে ধীরে ধীরে জাগিয়ে তুলব।
বেশ।
য়ুল ক্রোমিয়ামের কালো ক্যাপসুলে নিশ্চল হয়ে রইল। সে খুব ধীরে ধীরে অনুভব করে তার দেহে আবার প্রাণ ফিরে আসছে। শরীরের ভিতরে এক ধরনের উষ্ণতা বইতে শুরু করেছে, হাত, পা, বুক, পিঠে এক ধরনের জীবন্ত অনুভূতির জন্ম হয় এবং একসময় খুব ধীরে ধীরে সে নিজের ভিতরে হৃৎস্পন্দনের শব্দ শুনতে পায়। সে বুকভরে একটি নিশ্বাস নিয়ে খুব ধীরে ধীরে নিজের দুই হাত চোখের সামনে মেলে ধরল, আঙুলগুলো একবার মুষ্টিবদ্ধ করে। আরেকবার খুলে নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ক্রনকে বলল, আমি পুরোপুরি জেগে উঠেছি ক্রন।
ক্রন ক্যাপসুলের ওপরে লাগানো কিছু মনিটরে চোখ বুলিয়ে বলল, হ্যাঁ। তুমি জেগে উঠেছ। তুমি এবারে উঠে দাঁড়াতে পার।
য়ুল খুব ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। ক্ৰন তাকে হাত ধরে শীতল মেঝেতে নামিয়ে এনে উজ্জ্বল কমলা রঙের একটি নিও পলিমারের পোশাক দিয়ে তার দেহকে ঢেকে দেয়। য়ুল মহাকাশযানের দেয়াল স্পর্শ করে নিজের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করতে করতে বলল, আমি কাঁপন অনুভব করছি। মহাকাশযানের ইঞ্জিন চালু করা হয়েছে?
হ্যাঁ। পৃথিবীতে নামার জন্য গতিপথ পরিবর্তন করতে হচ্ছে।
ও।
আমরা চেয়েছিলাম তুমি পৃথিবীকে দেখ। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভিতর দিয়ে যখন যাবে সেই উত্তাপ অনুভব কর। এই গ্রহটিতে তোমার এবং আমার সবার পূর্বপুরুষের জন্ম। হয়েছিল।
হ্যাঁ। য়ুল কোনোভাবে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, হ্যাঁ আমি পৃথিবীকে সত্যি সত্যি দেখতে চাই।
এস আমার সাথে। আমার হাত ধর।
য়ুল সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, তার প্রয়োজন নেই ক্রন। আমার মনে হয় আমি নিজের ভারসাম্য ফিরে পেয়েছি।
য়ুল একটু টলতে টলতে হেঁটে মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দিকে এগিয়ে যায়। কন্ট্রোল প্যানেলের ওপর কীশ ঝুঁকে কিছু একটা দেখছিল, পায়ের শব্দ শুনে ঘুরে তাকিয়ে য়ুলকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল, য়ুল! ঘুম ভাঙল তা হলে?
হ্যাঁ, ভেঙেছে!
আমরা পৃথিবীর কাছাকাছি এসে গেছি। কিছুক্ষণের মাঝেই পৃথিবীর কক্ষপথে আটকে যাব।
চমৎকার! কত বড় কক্ষপথ?
চেষ্টা করছি কাছাকাছি যাবার। এক শ ইউনিট, বায়ুমণ্ডলটা পার হয়েই।
পৃথিবী কি দেখা যাচ্ছে?
হ্যাঁ এই দেখ– বলে কীশ কোথায় একটা সুইচ স্পর্শ করতেই হঠাৎ করে সামনে বিশাল একটা স্ক্রিনে পৃথিবীর ছবি ভেসে আসে। নীল গ্রহটির ওপর সাদা মেঘ, গ্রহটি ঘিরে খুব সূক্ষ্ম একটি নীলাভ আবরণ, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের চিহ্ন।
য়ুল কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে থাকে, বুকের ভিতর আটকে থাকা একটা নিশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, কী সুন্দর দেখেছ!
কীশ য়ুলের দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না।
য়ুল বিশাল স্ক্রিন থেকে চোখ ফিরিয়ে একবার কীশ আরেকবার ক্রনের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হল? তোমরা কোনো কথা বলছ না কেন? তোমাদের কাছে সুন্দর মনে হচ্ছে না?
হচ্ছে। কীশ এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, তবে
তবে কী?
আমি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল বিশ্লেষণ করে দেখেছি—
কী দেখেছ?
দেখেছি এই বায়ুমণ্ডল বিষাক্ত।
য়ুল চমকে উঠে বলল, কী বললে?
কীশ কাতর মুখে বলল, আমি দুঃখিত য়ুল তুমি এত আশা করে সেই সুদূর ক্রসিয়াস গ্রহপুঞ্জ থেকে পৃথিবীতে এসেছ তোমার পূর্বপুরুষের জন্মগ্রহ দেখতে। কিন্তু পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল দেখে আমার মনে হচ্ছে–
কীশ হঠাৎ থেমে যায়। তারপর ইতস্তত করে বলল, মনে হচ্ছে—
কী মনে হচ্ছে?
মনে হচ্ছে এই গ্রহ প্রাণহীন।
প্রাণহীন?
হ্যাঁ। প্রাণহীন। বাতাসের ওজোন স্তর পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন, আলট্রা ভায়োলেট রে সরাসরি পৃথিবীকে আঘাত করেছে। বাতাসে মাত্রাতিরিক্ত ডায়োক্সিন, প্রয়োজনের অনেক বেশি কার্বন–ডাই–অক্সাইড, নানা ধরনের এসিড। সবচেয়ে যেটি ভয়ঙ্কর সেটি হচ্ছে অক্সিজেনের পরিমাণ এত কম যে পৃথিবীতে কোনো প্রাণ থাকার কথা নয়।
য়ুল অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে থাকে, কী বলছ তুমি?
আমি দুঃখিত য়ুল। কিন্তু আমি সত্যি কথা বলছি।
য়ুল দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, তুমি বলছ পৃথিবী থেকে মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে?
আমার তাই ধারণা। খুব নিম্ন শ্রেণীর প্রাণ, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা সরীসৃপ হয়তো আছে কিন্তু কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী নেই।
কেমন করে তুমি নিশ্চিত হলে কীশ?
মানুষ বুদ্ধিমান প্রাণী, তাদের একটি সভ্যতা ছিল। তারা বিজ্ঞানে খুব উন্নত ছিল। তারা যদি পৃথিবীতে বেঁচে থাকত তা হলে আমরা এখন তার চিহ্ন পেতাম। রেডিও তরঙ্গ দেখতে পেতাম, আলো দেখতে পেতাম, লেজার রশ্মি দেখতে পেতাম, পারমাণবিক বীম দেখতে পেতাম। আমরা পৃথিবী থেকে তার কোনো চিহ্ন পাচ্ছি না য়ুল। পৃথিবী যেন একটি মৃত গ্রহ।
য়ুল খুব সাবধানে কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে রাখা একটি চেয়ারে বসে পড়ে, সে এখনো পুরো ব্যাপারটি বিশ্বাস করতে পারছে না। যে পৃথিবী এবং পৃথিবীর মানুষকে দেখার জন্য সে ছায়াপথের অন্য অংশ থেকে দীর্ঘ বারো বছর অভিযান করে এসেছে সেই পৃথিবী এখন প্রাণহীন? মানুষ পুরোপুরি অবলুপ্ত? য়ুল এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে বড় স্ক্রিনটির দিকে নীল পৃথিবী, তার সাদা মেঘ, হালকা বাদামি স্থলভূমির দিকে তাকিয়ে থাকে। এই বিশাল পৃথিবীতে কোনো মানুষ বেঁচে নেই কেমন করে সে বিশ্বাস কবে?
কীশ একটু এগিয়ে য়ুলকে স্পর্শ করে বলল, আমি খুব দুঃখিত য়ুল। আমি খুবই দুঃখিত।
০২.
মহাকাশযানটি পৃথিবীকে ঘিরে কয়েকবার ঘুরে আসে, মহাকাশযানের সংবেদনশীল যন্ত্রপাতি পৃথিবীপৃষ্ঠকে তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করে, কয়েক শতাব্দী আগের একটি বিধ্বস্ত সভ্যতা ছাড়া সেখানে প্রাণের কোনো চিহ্ন নেই। ক্ৰন মহাকাশযানটির কক্ষপথ পরিবর্তন করে আরো নিচে নামিয়ে আনে, ক্ষীণ বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষণে মহাকাশযানের চারপাশে এক ধরনের অতিপ্রাকৃত আলো জ্বলে ওঠে। ভিতরে তাপমাত্রা কয়েক শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে যায়। কীশ মহাকাশযানের তথ্যকেন্দ্রে পৃথিবীর সকল তথ্য বিশ্লেষণ করে য়ুলের কাছে জানতে চাইল সে পৃথিবীতে অবতরণ করতে চায় কি না। য়ুল কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে কীশের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, হ্যাঁ চাই।
তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ পৃথিবীতে নেমে শুধু তোমার আশাভঙ্গই হবে।
বুঝতে পারছি, তবু আমি নামতে চাই।
কীশ তবু একটু চেষ্টা করল, আমরা কিন্তু পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশের সকল তথ্য সংগ্রহ করে ফেলেছি। পৃথিবীতে নেমে নতুন কোনো তথ্য পাব না।
তবু আমি নামতে চাই। আমি নিজের চোখে দেখতে চাই।
বেশ। তা হলে আমরা মাঝারি একটা আন্তঃগ্রহ নভোযান নিয়ে নেমে যাই। ক্রন এই মহাকাশযানে থাকুক, আমাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করুক। কীশ য়ুলের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তোমার সাথে যাই।
য়ুল নিচু গলায় বলল, আমার সাথে কারো যাবার প্রয়োজন নেই। আমি একাই যেতে পারব।
কীশ মাথা নাড়ল। বলল, আমি তোমাকে একা যেতে দিতে পারি না। এটি মহাকাশযানের নিরাপত্তা নীতিবহির্ভূত।
পৃথিবীতে কোনো জীবিত প্রাণী নেই। সেখানে কোনো বিপদ নেই কীশ।
হয়তো তোমার কথা সত্যি, কিন্তু আমরা কোনো ঝুঁকি নিতে পারি না।
বেশ। তবে তাই হোক।
কিছুক্ষণের মাঝে মহাকাশযানের আন্তঃগ্রহ নভোযানটিকে পৃথিবীতে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত করা শুরু হয়। সেটিকে জ্বালানি দিয়ে পূর্ণ করা হয়। যোগাযোগ এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা হয়। পৃথিবীতে কিছুদিন থাকার মতো খাবার, পানীয় এবং বিশুদ্ধ বাতাস নেওয়া হয়। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, বিপজ্জনক পরিবেশে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় পোশাক, ভ্রমণ করার জন্য ক্ষুদ্র ভাসমান যান এবং কোনো কাজে লাগবে না সে বিষয়ে প্রায় নিশ্চিত হয়েও কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রও সাথে নিয়ে নেওয়া হয়।
ক্রন আন্তঃগ্রহ নভোযানে এসে কীশ এবং য়ুলকে তাদের নিজস্ব আসনে বসিয়ে নিরাপত্তা–বাঁধন দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে দেয়। তারপর মূল দরজা বন্ধ করে তাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়। কিছুক্ষণের মাঝেই য়ুল নভোযানের ইঞ্জিনের গর্জন শুনতে পেল। নভোযানটি ধীরে ধীরে মূল মহাকাশযান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে। য়ুল গোল স্বচ্ছ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে, নভোযানটি বাতাসের ঘর্ষণে কেঁপে কেঁপে উঠছে, তার পৃষ্ঠদেশ বাতাসের তীব্র ঘর্ষণে উজ্জ্বল রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। তাপ নিরোধক আস্তরণ থাকার পরও য়ুল মহাকাশযানের উষ্ণতা অনুভব করে। আকাশ কুচকুচে কালো থেকে প্রথমে বেগুনি, তারপর গাঢ় নীল এবং সবশেষে হালকা নীল হয়ে এসেছে। য়ুল নিচে তাকাল, গাঢ় নীল সমুদ্র, সাদা মেঘ এবং বহুদূরে ধূসর স্থলভূমি। য়ুলের এখনো বিশ্বাস হতে চায় না এই গ্রহটিতে তার পূর্বপুরুষের জন্ম হয়েছিল এবং সেই পূর্বপুরুষ গ্রহটিকে জীবনের অনুপযোগী করে ধ্বংস করে ফেলেছে।
নভোযানটি থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে আরো নিচে নেমে আসে, গতিবেগ কমে এসেছে, মহাকাশযানের জানালা দিয়ে সাদা মেঘগুলোকে অতিপ্রাকৃতিক দৃশ্যের মতো মনে হয়, পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও এই দৃশ্য দেখা সম্ভব বলে মনে হয় না।
কীশ কন্ট্রোল প্যানেল থেকে মাথা তুলে ঝুলের দিকে তাকিয়ে বলল, য়ুল।
বল।
আমরা গতিবেগ আরো কমিয়ে নামার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। শব্দের বাধা অতিক্রম করার সময় একটি ঝাঁকুনি হতে পারে।
ঠিক আছে। কোথায় নামবে?
এখনো ঠিক করি নি। কোনো প্রাচীন শহরের কাছাকাছি যেখানে সভ্যতার চিহ্ন পাওয়া যাবে।
য়ুল একটি নিশ্বাস ফেলল, কোনো কথা বলল না।
নভোযানটি সমুদ্রের তীরে একটি বড় প্রাচীন শহরের কাছে যখন খুব ধীরে ধীরে অবতরণ করল, তখন পৃথিবীর সেই জায়গায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। য়ুল তার আসন থেকে মুক্ত হয়ে জানালার কাছে দাঁড়াল, গোধূলির নরম আলোকে পৃথিবীকে কী রহস্যময়ই না। লাগছে! সে যে ক্রসিয়াস গ্রহপুঞ্জ থেকে এসেছে সেখানে কখনো এ রকম আঁধার নেমে আসে না, সেখানে সারাক্ষণ তীব্র কৃত্রিম আলোয় আলোকিত থাকে। আলোহীন এক বিচিত্র অন্ধকার দেখে অনভ্যস্ত য়ুল নিজের ভিতরে এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করে।
কীশ যন্ত্রপাতি খুলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে পরীক্ষা করতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মাঝেই সে নিশ্চিত হয়ে যায় শ্বাস–প্রশ্বাসের কৃত্রিম একটা ব্যবস্থা না করে এখানে মূল বের হতে পারবে না। কীশ আর্কাইভ ঘর থেকে অক্সিজেন সাপ্লাই, গ্যাস পরিশোধন যন্ত্র বের করে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে নিশ্বাস নেবার জন্য একটি কৃত্রিম ব্যবস্থা দাঁড় করাতে শুরু করে। য়ুল কীশের দক্ষ হাতের কাজ দেখতে দেখতে বলল, কীশ।
বল য়ুল।
তুমি বলছ এখানে কোনো জীবিত মানুষ নেই। কিন্তু এমন তো হতে পারে পৃথিবীর কোনো একটি কোনায় এক–দুইজন মানুষ বেঁচে আছে। নিরিবিলি, কারো সাথে কোনো সম্পর্ক নেই?
কীশের যান্ত্রিক মুখে সমবেদনার চিহ্ন ফুটে ওঠে। সে নরম গলায় বলল, তার সম্ভাবনা বলতে গেলে নেই। পৃথিবীর বাতাসে বেঁচে থাকার মতো যথেষ্ট অক্সিজেন নেই।
হয়তো তারা কৃত্রিম নিশ্বাস নেবার ব্যবস্থা করে বেঁচে আছে, হয়তো—
তুমি কী বলতে চাইছ য়ুল। বলে ফেল।
য়ুল একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, মনে কর আমার সাথে যদি কারো দেখা হয়, আমি তার সাথে কীভাবে কথা বলব? গত কয়েক শতাব্দীতে ভাষার কত পরিবর্তন হয়েছে–
কীশ কয়েক মুহূর্ত য়ুলের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি নিশ্চিত তোমার সাথে কারো দেখা হবে না। কিন্তু তুমি যদি সত্যিই চাও, তা হলে তোমার মানসিক শান্তির জন্য আমি তোমার জন্য একটি ভাষা অনুবাদক দাঁড় করিয়ে দেব। পৃথিবীর যে কোনো কালের মানুষের ভাষা বোঝা নিয়ে তোমার কোনো সমস্যা হবে না।
ধন্যবাদ কীশ। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আমি জানি আমি এটি ব্যবহার করার সুযোগ পাব না, তবুও কাল ভোরে বের হওয়ার সময় আমি এটা সাথে রাখতে চাই।
কীশ স্থির দৃষ্টিতে য়ুলের দিকে তাকিয়ে রইল, কোনো কথা বলল না।
০৩.
ভাসমান যানটিতে কীশের পাশে য়ুল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, এমনিতে দেখে বোঝা যায় না, খুব ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যাবে তার নাকের মাঝে সূক্ষ্ম এক ধরনের তন্তু প্রবেশ করেছে, তন্তু দুটি পৃথিবীর বিষাক্ত গ্যাসকে পরিশোধন করে নিশ্বাসের জন্য বিশুদ্ধ বাতাস সরবরাহ করছে। তার কানে ক্ষুদ্র মডিউলটিতে ভাষা অনুবাদকটি বসিয়ে দেওয়া আছে, পৃথিবীর যে কোনো মানুষের ভাষা সেটি তাকে অনুবাদ করে দেবে। গলার ভোকাল কর্ডের ওপর শব্দ উপস্থাপক যন্ত্রটি য়ুলের কথাকেও মানুষের যে কোনো ভাষায় অনুবাদ করে দেবে। কীশ নিশ্চিত যে য়ুল এই যন্ত্রটি ব্যবহার করার সুযোগ পাবে না কিন্তু য়ুল সেটি এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করে নি।
ভাসমান যানটি পৃথিবীপৃষ্ঠের খুব কাছে গিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটে যাচ্ছে, সামনে নানা ধরনের মনিটর, সেগুলো জীবন্ত প্রাণীকে খোঁজার চেষ্টা করছে। কিছু কীটপতঙ্গ এবং অত্যন্ত নিম্নশ্রেণীর সরীসৃপ ছাড়া পৃথিবীতে কোনো প্রাণের চিহ্ন নেই। নিচে শুষ্ক মাটি, শৈবাল এবং ফার্ন জাতীয় কিছু উদ্ভিদ বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কীশ তা সংরক্ষণের জন্য বেশ উৎসাহ নিয়ে কীটপতঙ্গ থেকে শুরু করে শৈবাল এবং ফার্নের নমুনা সংগ্রহ করছে, য়ুল এক। ধরনের ঔদাসীন্য নিয়ে কীশের কাজকর্ম লক্ষ করে। পৃথিবী সম্পর্কে তার ভিতরে যে স্বপ্ন ছিল তা পুরোপুরি যন্ত্রণায় পাল্টে গিয়ে তাকে এক ধরনের অস্থিরতায় ডুবিয়ে ফেলছে।
ভাসমান যানটি বিস্তীর্ণ প্রাণহীন শুষ্ক মরু অঞ্চলের ওপর দিয়ে একটি বিধ্বস্ত শহরে প্রবেশ করল। কয়েক শ বছর থেকে এই শহরটি পরিত্যক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুকনো ধুলোবালুতে অনেক অংশ ঢেকে আছে, বড় বড় কিছু দালান ধসে পড়েছে, কোথাও দালানের কাঠামোটি মৃত মানুষের কংকালের মতো দাঁড়িয়ে আছে। শহরের রাস্তাঘাটে ফাটল, যেটুকু অক্ষত সেখানে ধ্বংসপ এবং জঙ্গল। স্থানে স্থানে কালো পোড়া অগ্নিদগ্ধ দালানকোঠা। সব মিলিয়ে ভয়ঙ্কর মন–খারাপ–করা দৃশ্য। কীশ যানটি একটি মোটামুটি অক্ষত দালানের কাছে স্থির করিয়ে য়ুলকে নিয়ে নেমে আসে। দালানের ভেঙ্গে পড়া, ধসে যাওয়া দেয়ালের ফাটল দিয়ে দুজন ভিতরে ঢুকল। কীশের মাথায় লাগানো উজ্জ্বল আলোতে চারদিক আলোকিত হয়ে যায়। ধূলিধূসর ঘরের ভিতরে ওরা চারদিকে তাকিয়ে দেখে ভেঙে যাওয়া আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি, যোগাযোগের যন্ত্রপাতি, প্রাচীন কম্পিউটার। কীশ তার যান্ত্রিক চোখ এবং গাণিতিক উৎসাহ নিয়ে একটি একটি জিনিস পরীক্ষা করতে থাকে, পুরোনো তথ্য ঘাঁটাঘাঁটি করে পৃথিবীতে ঠিক কী ঘটেছিল এবং ঠিক কীভাবে সব মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল কীশ সেটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে থাকে। এসব বিষয়ে কীশের ধৈর্য প্রায় সীমাহীন, য়ুল তার কাজকর্ম দেখে অবশ্য কিছুক্ষণেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। সে কীশের কাছে গিয়ে বলল, কীশ আমি এই অন্ধকার ঘুপচি ঘরে বসে থাকতে চাই না।
তা হলে কী করতে চাও?
বাইরে থেকে ঘুরে আসি। এই ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহরটা খুব মন খারাপ করা। আমি সমুদ্র তীরে গিয়ে বসি। সমুদ্রের পানি এখনো গাঢ় নীল। বসে বসে দেখতে মনে হয় ভালো লাগবে।
তুমি একটু অপেক্ষা করতে পারবে? আমি একটা ক্রিস্টাল ডিস্ক পেয়েছি, মনে হচ্ছে এর মাঝে কিছু তথ্য আছে।
থাকুক। এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
কীশ উঠে দাঁড়াল। বলল, তা হলে চল। আমি এখানে পরে আসব।
কীশ য়ুলকে নিয়ে আবার ভাসমান যানে উঠে বসল। সুইচ স্পর্শ করতেই ভাসমান যানের নিচে দিয়ে আয়োনিত গ্যাস বের হতে শুরু করে এবং ভাসমান যানটি সাবলীল গতিতে উপরে উঠে এসে ঘুরে দক্ষিণ দিকে সমুদ্রের তীরে যেতে শুরু করে। বিস্তীর্ণ বিবর্ণ পাথর পার হয়ে ধূলিধূসর একটা অঞ্চলে চলে আসে, সেই অঞ্চলটি পার হওয়ার পরই হঠাৎ করে আদিগন্তবিস্তৃত একটি বালুবেলা দেখা যায়। কীশ ভাসমান যানটির গতিবেগ বাড়িয়ে দেয়, পিছনে ধুলো উড়িয়ে তারা ছুটে যেতে থাকে, বাতাসে য়ুলের চুল উড়তে থাকে। কিছুক্ষণের মাঝে বিশুদ্ধ বাতাসের প্রবাহ ছাপিয়ে য়ুল তার নাকে সমুদ্রের নোনা পানির গন্ধ পেল। বহুদূরে নীল সমুদ্র দেখা যায়, য়ুল কেন জানি নিজের ভিতরে এক ধরনের চঞ্চলতা অনুভব করতে থাকে।
গ্যালাক্সির অন্য প্রান্ত থেকে য়ুল তার বুকের ভিতরে করে পৃথিবীর জন্য ভালবাসা নিয়ে এসেছিল। শুষ্ক বিবর্ণ বিধ্বস্ত পৃথিবীর ধ্বংসস্তূপে সে এই ভালবাসা দিতে পারছিল না। নীল সমুদ্র দেখে হঠাৎ তার ভিতরে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ধরনের আবেগের জন্ম হয়, সে আবিষ্কার করে নিজের অজান্তেই তার চোখ ভিজে আসছে।
সমুদ্রের ভেজা বালুতে ভাসমান যানটিকে থামিয়ে য়ুল এবং কীশ নেমে এল। য়ুল সমুদ্রের দিকে এগিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, আহা! কী সুন্দর।
কীশ নরম গলায় বলল, আমি শুনে খুব খুশি হয়েছি য়ুল যে এই সমুদ্রটি দেখে তোমার এত ভালো লাগছে!
য়ুল অবাক হয়ে বলল, তোমার ভালো লাগছে না?
লাগছে। কিন্তু আমি তো মানুষ নই–আমার সৌন্দর্যের অনুভূতি ভিন্ন। তোমাদের মতো এত ব্যাপক নয়–অনেক নিচু স্তরের অনুভূতি।
য়ুল মাথা নেড়ে হেঁটে হেঁটে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। সমুদ্রের ঢেউ একটি একটি করে এগিয়ে আসছে, কাছাকাছি আসার পর সাদা ফেনা তুলে আছড়ে পড়ছে। ভেজা বালুতে কিছু শামুক এবং জলজ লতাপাতা। য়ুল হেঁটে হেঁটে পানির কাছাকাছি দাঁড়াল, ঢেউ তার কাছাকাছি এসে পায়ের কাছে ভেঙে পড়ল–য়ুল নিজের ভিতরে এক ধরনের শিহরন অনুভব করে।
য়ুল আরো এক পা এগিয়ে যেতেই কীশ পিছন থেকে সতর্ক করে বলল, বেশি কাছে যেও না য়ুল, ঢেউয়ের আঘাতে তোমাকে পানিতে টেনে নেবে।
য়ুল মাথা নাড়ল, বলল, নেবে না। মানুষের শরীরের অর্ধেক থেকে বেশি পানি। পানির সাথে মানুষের এক ধরনের ভালবাসা আছে। আমি শুনেছি। প্রাচীনকালে পানিকে নাকি বলত জীবন!
কীশ একটু এগিয়ে এসে বলল, তবু সাবধান থাকা ভালো। ক্রসিয়াস গ্রহপুঞ্জে এরকম সমুদ্র নেই, এত পানি একসাথে আমরা কখনো দেখি নি। পানির সাথে কীভাবে বেঁচে থাকতে হয় তুমি–আমি জানি না।
য়ুল অন্যমনস্কভাবে বলল, কিছু জিনিস মনে হয় মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। পানির সাথে ভালবাসা হচ্ছে একটা। তুমি তো জান পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের বিকাশ হয়েছিল পানিতে।
জানি।
আগে ব্যাপারটা খুব অবাক লাগত। এখন এই বিশাল আদিগন্ত বিস্তৃত নীল সমুদ্র দেখে মনে হচ্ছে সেটাই তো স্বাভাবিক। সেটাই তো সত্যি।
কীশ কোনো কথা বলল না। য়ুল ভেজা পানিতে পা ভিজিয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের কাছাকাছি হাঁটতে থাকে। এক একটি ঢেউ সাদা ফেনা তুলে তার পায়ের কাছে আছড়ে পড়তেই সে তার নিজের ভিতরে এক বিচিত্র আবেগ অনুভব করে। সমুদ্রের নোনা বাতাসে তার চুল, নিও পলিমারের পোশাক উড়তে থাকে। য়ুল নিজের ভিতরে এক ধরনের বিষণ্ণতা অনুভব করে, এক সময় এই সমুদ্রতট মানুষের কলকাকলীতে মুখরিত হয়ে থাকত, সেই কথাটা সে কিছুতেই ভুলতে পারে না।
কীশ কিছুক্ষণ একা একা দাঁড়িয়ে থাকে, আদিগন্ত বিস্তৃত বিশাল নীল সমুদ্র দেখে য়ুলের ভিতরে হঠাৎ যে ধরনের আবেগের জন্ম হয়েছে কীশ তার সাথে পরিচিত নয়, তার পক্ষে সেটা অনুভব করাও সম্ভব নয়। য়ুল সমুদ্রতীর থেকে এখন খুব সহজে ফিরে যাবে বলে মনে হয় না। কীশ কিছুক্ষণ য়ুলকে লক্ষ্য করে ভাসমান যানটিতে ফিরে গেল মিছিমিছি সময় নষ্ট না করে, একটু আগে বিধ্বস্ত দালান থেকে সে যে ক্রিস্টাল ডিস্কটি উদ্ধার করেছে তার ভিতর থেকে কোনো তথ্য বের করা যায় কি না সেটাই চেষ্টা করে দেখবে।
কিছুক্ষণের মাঝেই কীশ ক্রিস্টাল ডিস্কে একটা বিচিত্র জিনিস আবিষ্কার করে, এখানে মানুষের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঠিক আগে পৃথিবীতে কী হয়েছিল সে সম্পর্কে কিছু অস্পষ্ট তথ্য আছে। পৃথিবীর বাতাসের বিষক্রিয়া, পারমাণবিক বিস্ফোরণ, বিষাক্ত গ্যাসের কবল থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য কী করা হয়েছিল তার আভাস দেওয়া আছে। সে সম্পর্কে তথ্য কোথায় পাওয়া যেতে পারে সেটি নিয়েও কিছু গোপন তথ্য রয়েছে।
কীশ খুব কৌতূহলী হয়ে ওঠে, ক্রিস্টাল ডিস্কটা হাতে নিয়ে সে দ্রুত পায়ে হেঁটে য়ুলের কাছে হাজির হল। য়ুল কীশকে দেখে একটু অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে কীশ! তোমাকে মানুষের মতো উত্তেজিত দেখাচ্ছে!
তুমি ঠিকই বলেছ। আমার ভিতরে উত্তেজনা থাকলে আমি মানুষের মতোই উত্তেজিত হতাম।
কেন? কী হয়েছে?
ক্রিস্টাল ডিস্কটা বিশ্লেষণ করে কিছু চমকপ্রদ তথ্য পেয়েছি।
কী তথ্য?
এই পৃথিবীতে মানুষের শেষ মুহূর্তের তথ্য। যখন মানুষ বুঝতে পেরেছে এই পৃথিবীতে মানুষ বেঁচে থাকতে পারবে না, তখন তারা কী করেছে তার তথ্য।
য়ুল একটু চমকে উঠে কীশের দিকে তাকাল, কী করেছে?
আমি এখনো জানি না। এই ক্রিস্টাল ডিস্কে সেই তথ্য নেই, কিন্তু কোথায় আছে তার আভাস দেওয়া আছে।
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি। তোমার যদি আপত্তি না থাকে আমি সেটা খুঁজে বের করতে চাই।
আমার কোনো আপত্তি নেই।
তা হলে চল যাই।
য়ুল একটু ইতস্তত করে বলল, আমার সেই ধ্বংসস্তূপে যেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি যাও আমি এখানে এই সমুদ্রতীরে তোমার জন্য অপেক্ষা করব।
কীশকে কয়েক মুহূর্ত বেশ বিভ্রান্ত দেখায়। সে একটু ইতস্তত করে বলল, সেটা হয় য়ুল। নিরাপত্তা বিধানে স্পষ্ট করে লেখা আছে মানুষকে বিপজ্জনক পরিবেশে কখনো একা রাখতে হয় না।
য়ুল হেসে ফেলল, বলল, এটা মোটেও বিপজ্জনক পরিবেশ নয় কীশ! এটা পৃথিবী।
কিন্তু এটা বাসযোগ্য পৃথিবী নয় য়ুল। এই পৃথিবীতে বিশুদ্ধ বাতাসের প্রবাহ ছাড়া তুমি এক মিনিটও বেঁচে থাকতে পারবে না।
কিন্তু আমার ফুসফুসে তো বিশুদ্ধ বাতাসই যাচ্ছে। একুশ ভাগ অক্সিজেন উনআশি ভাগ বিশুদ্ধ নাইট্রোজেন।
কিন্তু
কোনো কিন্তু নেই। তুমি যাও। ঐ মনখারাপ ঘরে তোমার যেটা খোজাখুঁজি করার ইচ্ছে সেটা খুঁজে বেড়াও। আমি এখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করব।
কীশ কোনো কথা না বলে য়ুলের দিকে তাকিয়ে রইল। য়ুল বলল, তা ছাড়া তোমার সাথে তো যোগাযোগ মডিউল রয়েছে, তুমি যেখানেই থাক আমাকে দেখতে পাবে। আমার সঙ্গে কথা বলতে পারবে। যদি সত্যিই কোনো বিপদ হয় তা হলে তুমি চলে এসো আমাকে উদ্ধার করার জন্য।
ঠিক আছে। আমি তা হলে যাচ্ছি। তুমি এখানে থাক–সমুদ্রের বেশি কাছে যাবে না।
যাব না।
তোমাকে কিছু খাবার পানীয় দিয়ে যাচ্ছি! এবং একটা অস্ত্র।
অস্ত্র?
হ্যাঁ, আমি জানি সেটা তোমার ব্যবহার করার কোনো প্রয়োজন হবে না, কিন্তু তবু দিয়ে যাচ্ছি। সাথে রেখো।
বেশ। য়ুল হেসে ফেলল, বলল, যদি সত্যি কোনো জীবন্ত প্রাণী আমাকে আক্রমণ করে সেটা কি একটা আনন্দের ঘটনা হবে না? তার অর্থ হবে পৃথিবীতে এখনো প্রাণ রয়েছে।
কীশ মাথা নাড়ল, বলল, সেটি তুমি সত্যিই বলেছ য়ুল। সেটি এক অর্থে আসলেই আনন্দের ঘটনা হবে। তবে তুমি যদি তখন নিজেকে রক্ষা করতে পার সেটি হবে দ্বিগুণ আনন্দের ঘটনা।
কিছুক্ষণের মাঝেই য়ুল দেখল প্রচণ্ড গর্জন কর ভাসমান যানটি বালু উড়িয়ে উত্তর দিকে যেতে শুরু করেছে।
০৪.
য়ুল একাকী সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে থাকে, সামনে যত দূর চোখ যায় সমুদ্রের আশ্চর্য নীল জলরাশি। সে অন্যমনস্কভাবে বাম দিকে তাকাল। বহু দূরে আবছা ছায়ার মতো কিছু উঁচু নিচু পাহাড়, তার পাদদেশে সমুদ্রের বিশাল তরঙ্গ ঝাঁপটা দিয়ে পড়ছে। দৃশ্যটি নিশ্চয়ই অভূতপূর্ব–য়ুল নিজের অজান্তেই সেদিকে হাঁটতে শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে তার হঠাৎ একটি বিচিত্র জিনিস মনে হল। এক সময় এই পৃথিবীতে লক্ষকোটি মানুষ বেঁচে ছিল, এখন। এখানে সে একা। সমস্ত পৃথিবীতে সে একমাত্র জীবিত মানুষ–ব্যাপারটি সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না।
য়ুল হাঁটতে হাঁটতে একসময় উঁচু–নিচু পাহাড়ি এলাকার কাছাকাছি হাজির হল, ঢাল বেয়ে সে ধীরে ধীরে উপরে উঠে এসেছে, সমুদ্রের পানি নিচে পাথরে আছড়ে পড়ছে। য়ুল একটা বড় পাথরে বসে দীর্ঘসময় নিচে তাকিয়ে থাকে, তারপর আবার হাঁটতে রু করে। সামনে বড় পাথরের দেয়াল খাড়া উঠে গেছে, তার পাশ দিয়ে সরু চিলতে একটা ফুটো, একটু অসাবধান হলেই অনেক নিচে গিয়ে পড়বে। একা সম্ভবত এদিক দিয়ে যাওয়া উচিত নয়, হঠাৎ করে একটা দুর্ঘটনা হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। কিন্তু মূল কী ভেবে সেই সরু ফুটো দিয়ে পাথর আঁকড়ে হাঁটতে থাকে, কিছুক্ষণের মাঝেই সে একটা ভোলা অংশে চলে আসে। হঠাৎ করে খানিকটা জায়গা সমুদ্রের অনেক ভিতরে ঢুকে গেছে। য়ুল উঁচু–নিচু পাথর অতিক্রম করে সাবধানে সামনে এগিয়ে যায়, পাথরের একেবারে কিনারায় এসে সে দাঁড়াল, নিচে সমুদ্রের নীল পানি, পানির গভীরতা নিশ্চয়ই অনেক বেশি, কারণ এখানে কোনো বড় ঢেউ নেই। শান্ত বাতাসের সঙ্গে ছোট ঘোট নিরীহ ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে। তীরে যেরকম সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছিল, এখানে সে রকম কিছু নেই। চারপাশে এক ধরনের সুমসাম নীরবতা, পরিবেশটি অনেকটুকু অতিপ্রাকৃত। য়ুল একটা বড় পাথরে হেলান দিয়ে দাঁড়াল এবং হঠাৎ তার মনে হল সে এখানে একা নয়। মূল কেমন যেন চমকে ওঠে, অনুভূতিটি এত জীবন্ত সে একবার মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাল। চারপাশে কেউ কোথাও নেই, তবুও তার ভিতরে অন্য কারো উপস্থিতির অনুভূতিটি জেগে রইল।
য়ুল সাবধানে আরো একটু সামনে এগিয়ে যায়, নিচে শান্ত গভীর নীল পানি, উপরে মেঘহীন নীল আকাশ। সমুদ্রের বাতাস বইছে, বাতাসে এক ধরনের নোনা গন্ধ। য়ুল হঠাৎ আবার চমকে ওঠে, হঠাৎ করে আবার তার মনে হয় কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে। চারদিকে তাকাল, কোথাও কেউ নেই, তা হলে কেন তার মনে হচ্ছে কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে?
য়ুল হঠাৎ নিজের ভিতরে এক ধরনের ভীতি অনুভব করে, কোনো কিছু না জানার ভীতি, না বোঝার ভীতি। সে একটু পিছনে সরে এসে বড় একটা পাথরে হেলান দিয়ে বসতে চাইল, এক পা পিছিয়ে আসতেই হঠাৎ করে ছোট একটা নুড়ি পাথরে তার পা হড়কে যায়। য়ুল তাল সামলে কোনোমতে দাঁড়িয়ে গেল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয়বার তার পা হড়কে যায় এবং কিছু বোঝার আগেই সে পাথরের গা ঘেঁষে গভীর সমুদ্রের পানিতে গিয়ে পড়ল। ঘটনার আকস্মিকতায় সে এত অবাক হয়েছিল যে তার মাঝে আতঙ্ক বা ভীতি পর্যন্ত জন্মাবার সময় হয় নি।
পানিতে ডুবে যেতে যেতে য়ুল হঠাৎ করে বুঝতে পারল মানুষের দেহ আসলে পানিতে ভেসে থাকতে পারে না। ভেসে থাকতে হলে সাঁতার নামক একটি অত্যন্ত প্রাচীন শারীরিক প্রক্রিয়া অনেক কৌশলে আয়ত্ত করতে হয়। ক্রসিয়াস গহপুঞ্জে পানির পরিমাণ এত কম যে সাঁতার শেখা দূরে থাকুক, সেখানে কোনো মানব সন্তানই কখনো পানিতে নিজের পুরো দেহকে ডোবাতে পারে নি।
পানিতে ডুবে গেলেও য়ুল খুব বেশি আতঙ্কিত হল না কারণ তার মনে আছে নিশ্বাস নেবার জন্য দুটি সূক্ষ্ম তন্তু তার নাকে বিশুদ্ধ বাতাস প্রবাহিত করছে। য়ুলের বুকের কাছাকাছি যোগাযোগ মডিউলটি এতক্ষণে নিশ্চয়ই কীশের কাছে তথ্য পৌঁছে দিয়েছে এবং কীশ তাকে উদ্ধার করার জন্য একটা ব্যবস্থা করবেই।
সমুদ্রের শীতল পানিতে য়ুলের শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে, চোখের সামনে পানি এবং সেই পানির নিচের জগতটি একটি অবাস্তব জগতের মতো মনে হয়। য়ুল হাত নেড়ে কোনোভাবে ভেসে ওঠার চেষ্টা করতে করতে একবার নিশ্বাস নিতে চেষ্টা করে এবং হঠাৎ করে আবিষ্কার করে সে নিশ্বাস নিতে পারছে না। যে তন্তুটি তার নাকে বিশুদ্ধ বাতাস প্রবাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করছিল পানির নিচে সেটি কাজ করছে না। কেন কাজ করছে না সেটি বোঝার চেষ্টা করে লাভ নেই, সমুদ্রে পড়ে গিয়ে প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে কিছু একটা ঘটে গেছে, তন্তুটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে কিংবা বাতাসের চাপের সমতা নষ্ট হয়ে গেছে–কিন্তু সেটি এখন আর বিশ্লেষণ করার সময় নেই, সে নিশ্বাস নিতে পারছে না সেটিই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা!
য়ুল হঠাৎ করে এক ধরনের ভয়াবহ আতঙ্ক অনুভব করে, সে আরো একবার নিশ্বাস নেবার চেষ্টা করল এবং সঙ্গে সঙ্গে তার নাকে–মুখে লোনা পানি প্রবেশ করে। সে পাগলের মতো ছটফট করে উপরে উঠতে চেষ্টা করে কিন্তু কোনো লাভ হয় না, সমুদ্রের পানির আরো গতীরে নেমে যেতে থাকে। য়ুল নিশ্বাস নেবার জন্য আবার চেষ্টা করল কিন্তু নিশ্বাস নিতে পারল না। তার সমস্ত বুক একটু বাতাসের জন্য হাহাকার করতে থাকে, সে মুখ হা করে নিশ্বাস নেবার চেষ্টা করতে থাকে। ছটফট করতে করতে সে বুঝতে পারে সে চেতনা হারিয়ে ফেলছে, তার চোখের সামনে একটি কালো পরদা নেমে আসছে–সবকিছু শেষ হয়ে জীবনের ওপর যবনিকা নেমে আসছে! তা হলে এটাই কি মৃত্যু? এটাই কি শেষ?
য়ুলের দেহ শিথিল হয়ে আসে, সে পানির গভীরে নেমে যেতে থাকে, হিমশীতল পানিতে নিজের অজান্তেই তার দেহ কেঁপে কেঁপে উঠছে। তার অচেতন মস্তিষ্কে ছায়ার মতো দৃশ্য ভেসে যেতে থাকে। তার শৈশব–কৈশোর এবং যৌবনের দৃশ্য ছাড়া–ছাড়াভাবে মনে হয়, প্রিয়জনের চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বুকের মাঝে আটকে থাকা বদ্ধ নিশ্বাসে মনে হয় তার বুক ফেটে যাবে–এখন মৃত্যুই বুঝি শান্তি নিয়ে আসবে–সেই মৃত্যু কি এগিয়ে আসছে? কোমল চেহারার একটি অপার্থিব মানবী তার দিকে এগিয়ে আসছে, তার মুখের ওপর মুখ নামিয়ে মেয়েটি তার ঠোঁট স্পর্শ করল। এটাই কি মৃত্যু? য়ুল চোখ বন্ধ করল, সকল যন্ত্রণা হঠাৎ করে যেন দূর হয়ে গেল। বুকভরে সে যেন নিশ্বাস নিতে পারল। য়ুলের মনে হল তাকে ঘিরে অসংখ্য মানবী নৃত্য করছে। সে চোখ খুলে তাকানোর চেষ্টা করল, কিন্তু তাকাতে পারল না। হঠাৎ করে তার চোখের সামনে গাঢ় অন্ধকার নেমে এল।
এটিই কি মৃত্যু? য়ুল উত্তর খুঁজে পেল না
০৫.
নভোযানের নিরাপদ বিছানা থেকে উঠে বসে য়ুল অপরাধীর মতো কীশের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার জীবন রক্ষা করার জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
কীশ কোনো কথা বলল না, এক ধরনের ভাবলেশহীন মুখে য়ুলের দিকে তাকিয়ে রইল। য়ুল আবার বলল, আমি খুব দুঃখিত তোমাকে এত বড় ঝামেলার মাঝে ফেলে দেওয়ার জন্য।
কীশ এবারেও কোনো কথা বলল না, যদি সে একটি বায়োবট না হত তা হলে য়ুল নিশ্চয়ই ভাবত কীশ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে আছে। য়ুল তার বিছানা থেকে নামার জন্য পা নিচে নামিয়ে বলল, কীশ, সত্যিই আমি খুব দুঃখিত–তুমি হয়তো বিশ্বাস করছ না, কিন্তু আমি সত্যিই বলছি।
আমি তোমার কথা অবিশ্বাস করছি না য়ুল– আমি তোমার প্রত্যেকটি কথা বিশ্বাস করেছি। তবে—
তবে কী?
আমার ধারণা ছিল আমি মানুষকে বুঝতে পারি, কিন্তু আজকে আমি আবিষ্কার করেছি যে আমি মানুষকে বুঝতে পারি না। মানুষের মাঝে নিজেকে নিজের ধ্বংস করে ফেলার একটা প্রবণতা রয়েছে। সম্পূর্ণ অকারণে মানুষ নিজেকে ধ্বংস করে ফেলে।
য়ুল একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, সেটি সত্যি নয়। আমি মোটেই নিজেকে ধ্বংস করতে যাচ্ছিলাম না। আমি
তুমি যেখানে উপস্থিত হয়েছিলে এবং যেভাবে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছ তার সঙ্গে আত্মহত্যার খুব বেশি পার্থক্য নেই।
সেটি সত্যি নয়। যেটা ঘটেছে সেটা একটা দুর্ঘটনা।
যে দুর্ঘটনা আহ্বান করে আনা হয় সেটি দুর্ঘটনা নয়, সেটি এক ধরনের নির্বুদ্ধিতা। আর যে নির্বুদ্ধিতার জন্য জীবন বিপন্ন হতে পারে সেটি আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছু নয়।
য়ুল দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করে বলল, কিন্তু তুমি অস্বীকার করতে পারবে না যে এটি একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতা। আমি শুনেছিলাম মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে মানুষের চোখের সামনে তার পুরো স্মৃতি ভেসে যায়; কথাটি সত্যি আমি আমার শৈশবের অনেক দৃশ্য দেখেছি। যখন কিছুতেই নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না, জীবনের সব আশা ছেড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলাম, তখন দেখলাম একটি নারীমূর্তি আমার কাছে এগিয়ে আসছে, এসে আমার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে আমাকে চুমু খাচ্ছে! আমি ভেবেছিলাম সেটা নিশ্চয়ই মৃত্যুদূত!
কীশ কোনো কথা না বলে য়ুলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। য়ুল একটু অবাক হয়ে বলল, তুমি এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন?
এমনি।
কী হয়েছে? আমি কি কিছু ভুল বলেছি?
যে নারীমূর্তি তোমাকে চুমু খেয়েছে তার চেহারা তোমার মনে আছে?
না, পুরো ব্যাপারটি ছিল এক ধরনের কাল্পনিক দৃশ্য, এক ধরনের হেলুসিনেশান। অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় যেরকম দৃষ্টিভ্রম হয় সেরকম। শুধু একটি জিনিস মনে আছে–আমার ঠোঁটে ঠোঁট রাখার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল নিশ্বাস নিতে না পারার কষ্টটা কেটে গেল। সম্ভবত আমার মস্তিষ্ক তখন আমার শারীরিক যন্ত্রণার অনুভূতি কেটে দিয়েছিল। আমি শুনেছি মানুষ যখন অনেক কষ্ট পায় তখন কষ্টের অনুভূতি চলে যায়।
কীশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে য়ুলের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বলল, তুমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান একজন মানুষ য়ুল। অত্যন্ত সৌভাগ্যবান একজন মানুষ। তুমি একেবারে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছ।
সেজন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ কীশ। তুমি যদি ঠিক সময়ে গিয়ে আমাকে রক্ষা না করতে
আমি তোমাকে রক্ষা করি নি য়ুল।
য়ুল বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠে বলল, তুমি কী বলছ কীশ?
আমি তোমাকে রক্ষা করি নি।
তা হলে?
যোগাযোগ মডিউলে সঙ্কেত পেয়ে ছুটে গিয়ে দেখি তোমার অচেতন দেহ সমুদ্রের বালুবেলায় শুয়ে আছে।
য়ুল হতচকিতের মতো কীশের দিকে তাকিয়ে রইল। কীশ অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, আমার পক্ষে তোমাকে রক্ষা করা সম্ভব ছিল না, কিছুতেই আমি সময়মতো তোমার কাছে যেতে পারতাম না।
তা হলে? য়ুল হতবাক হলে বলল, তা হলে আমাকে কে রক্ষা করেছে?
জ্ঞান হারানোর আগে তুমি যে নারীমূর্তিটি দেখেছিলে সেটি কোনো কাল্পনিক দৃশ্য ছিল না। সে মৃত্যুদূত ছিল না।
তা হলে?
সে তোমার ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে তোমার বুকের ভিতর অক্সিজেন দিয়ে তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল।
ব্যাপারটি বুঝতে ঝুলের কয়েক মুহূর্ত সময় লেগে যায়। যখন সে বুঝতে পারে তখন সে প্রায় লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়, কীশের কাঁধ ধরে বলল, তুমি কেমন করে জান?
তোমার শরীরে যোগাযোগ মডিউলে আমি দেখেছি। কীশ এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, ইচ্ছে করলে তুমিও দেখতে পার। পুরো ঘটনাটুকু রেকর্ড করা আছে।
কোথায়? য়ুল প্রায় চিৎকার করে বলল, কোথায়?
এস আমার সঙ্গে।
কীশ নভোযানের যোগাযোগ কেন্দ্রে সুইচ স্পর্শ করতেই য়ুলের বুকে লাগানো যোগাযোগ মডিউলে রেকর্ড করা ছবিগুলো ভেসে আসে। প্রথম দিকের ঘটনাগুলো দ্রুত পার করে য়ুল সমুদ্রের পানিতে পড়ে যাওয়া থেকে দৃশ্যগুলো দেখতে শুরু করে। পানিতে তলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে এক ধরনের আধো আলো আধো ছায়ার মতো পরিবেশ হয়ে যায়। য়ুলকে সরাসরি দেখা যাচ্ছিল না কিন্তু বাচার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় সে হাত–পা ছুড়ছে সেটি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এক সময় সে হাঁপ ছেড়ে দিয়ে তলিয়ে যাচ্ছে–চারদিকে এক ধরনের অন্ধকার নেমে আসছে এবং হঠাৎ দূর থেকে কিছু মানবী মূর্তিকে দেখা গেল, নিরাভরণ দেহে তারা জলচর প্রাণীর আশ্চর্য সাবলীলতায় তার কাছে ছুটে আসে। তাকে ঘিরে কয়েকবার ঘুরে আসে, একজন সাবধানে তাকে ধরে উপরে তোলার চেষ্টা করে, বুকের মাঝে কান লাগিয়ে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করে। নিজেদের মাঝে কিছু একটা নিয়ে বলাবলি করে তারপর একজন এগিয়ে এলে তার ঠোঁটে ঠোঁট স্পর্শ করে তার বুকের ভিতরে বাতাস ঠুকে দিতে শুরু করে। দেখতে দেখতে য়ুলের দেহে সজীবতা ফিরে আসে। নারীমূর্তিগুলো য়ুলকে ধরে পানির উপরে তুলে এনে সযত্নে বালুবেলায় শুইয়ে রেখে আসে।
য়ুল হতবাক হয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল, এরা কারা কীশ?
কীশ নরম গলায় বলল, মানুষ। পৃথিবীর মানুষ।
তারা কোথায় থাকে?
পানিতে?
পানিতেই?
হ্যাঁ। পৃথিবীর বাতাস বিষাক্ত হয়ে যাওয়ায় মানুষ পানিতে ফিরে গেছে। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে সমুদ্রের পানি থেকে দ্রবীভূত অক্সিজেন নেওয়ার মতো ক্ষমতা করে দেওয়া হয়েছে। এরা এখন পানিতে বেঁচে থাকতে পারে।
তুমি কেমন করে জান?
আমি নিশ্চিতভাবে জানি না। আমি অনুমান করছি। ক্রিস্টাল ডিস্ক থেকে যেসব তথ্য পেয়েছি সেখানে এ ধরনের ব্যাপারে অভাস দেওয়া হয়েছিল। মানুষকে রক্ষা করার জন্য বড় ধরনের দৈহিক পরিবর্তন করে দেওয়া। আমি তখন বুঝতে পারি নি, এখন বুঝতে পারছি।
য়ুল হেঁটে হেঁটে নভোযানের জানালার কাছে দাঁড়ায়, বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে। আকাশে একটা অসম্পূর্ণ চাঁদ, চাঁদের হালকা জ্যোৎস্নায় বাইরে এক ধরনের অতিপ্রাকৃতিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে য়ুল হঠাৎ করে নিজের ভিতরে এক ধরনের শিহরন অনুভব করে। এই পৃথিবীতে সে একা নয়, এখানে মানুষ আছে।
য়ুল কীশের দিকে তাকাল, কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি ওদের সাথে দেখা করতে যাব কীশ।
আমি জানতাম তুমি যেতে চাইবে।
তুমি ব্যবস্থা করে দিতে পারবে না?
কীশ নরম গলায় বলল, আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি।
০৬.
সমুদ্রের নীল পানি থেকে কয়েক ফুট উঁচুতে ভাসমান যানটি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। য়ুলের শরীরের সাথে লাগিয়ে রাখা অক্সিজেন সিলিন্ডারের চাপটুকু পরীক্ষা করে কীশ বলল, তোমার এই সিলিন্ডারে যে পরিমাণ অক্সিজেন আছে সেটা টেনেটুনে ছয় ঘণ্টা ব্যবহার করা যাবে। কাজেই তুমি এই সময়ের ভিতরে ফিরে আসবে।
য়ুল মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে।
সোজাসুজি উপরে ভেসে উঠো, আমি তোমাকে খুঁজে বের করব।
বেশ।
তোমার শরীরের ওপর যে পলিমারটুকু দেওয়া হয়েছে সেটা তাপ নিরোধক, তোমার ঠাণ্ডা লাগার কথা নয়। আস্তরণটুকু বেশ শক্ত–ছোটখাটো আঘাতে ছিঁড়ে যাবে না।
বেশ।
চোখের ওপর যে কন্টাক্ট লেন্স দেওয়া হয়েছে সেটি দিয়ে এখন তুমি পানির ভিতরে পরিষ্কার দেখতে পাবে। কোমরের ব্যাগে আলোর জন্য ফ্লেয়ার আছে। প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবে। ওদের সঙ্গে কথা বলার জন্য অনুবাদক যন্ত্র থাকল, তুমি তো জান কীভাবে ব্যবহার করতে হয়।
জানি।
চমৎকার! পানিতে সাঁতার দেওয়ার জন্য, ওঠা–নামা করার জন্য ছোট জেট প্যাকটা থাকল। যোগাযোগ মডিউলটা তো আছেই, আমি তোমার সঙ্গে সারাক্ষণ যোগাযোগ রাখব। কোনো সমস্যা হলে বা বিপদ হলে আমাকে জানাবে।
জানাব।
আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার তোমার কোমরে একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ঝুলিয়ে দিয়েছি। ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় এটি কাজ করতে পারে। আঘাত দিয়ে অচেতন করে দেওয়া। থেকে শুরু করে একটা বিশাল পাহাড়কে চূর্ণ করে দিতে পারবে। আমি আশা করছি তোমার এটি ব্যবহার করতে হবে না, কিন্তু যদি ব্যবহার করতে হয় খুব সাবধান।
তুমি নিশ্চিন্ত থাক কীশ।
বেশ। এবারে তা হলে তুমি যেতে পার।
ধন্যবাদ কীশ। তোমাকে ধন্যবাদ।
ভাসমান যানটি পানির আরো কাছে নেমে আসে, য়ুল এক পাশে দাঁড়িয়ে খুব সাবধানে সমুদ্রের পানিতে নেমে পড়ে। এক মুহূর্তের জন্য শীতল পানিতে তার সারা দেহ কাঁটা দিয়ে ওঠে, কিছুক্ষণেই তার দেহের তাপমাত্রার সাথে সামঞ্জস্য রেখে পলিমারটুকু উষ্ণ হয়ে উঠবে। য়ুল চারপাশে তাকাল, আধো আলো আধো ছায়ার একটি অতিপ্রাকৃত পরিবেশ, তার মাঝে এক ধরনের অশরীরী সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে।
য়ুল নিশ্বাস নিয়ে তার শ্বাসযন্ত্রটি পরীক্ষা করে দেখে, তারপর যোগাযোগ মডিউলটি স্পর্শ করে বলল, কীশ! সবকিছু ঠিক আছে।
চমৎকার!
তোমার সঙ্গে দেখা হবে কীশ, আমি যাচ্ছি।
মানুষের সঙ্গে তোমার পরিচয় আনন্দময় হোক।
য়ুল যোগাযোগ মডিউলটি বন্ধ করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ছোট জেট প্যাকটি থেকে পানির ধারা বের হয়ে এসে তাকে সামনে নিয়ে যাচ্ছে। য়ুল সংবেদনশীল যন্ত্রে পানির নিচে জলজ শব্দ শুনতে শুনতে সতর্ক চোখে চারপাশে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে যেতে থাকে। এই বিশাল সমুদ্রে সে কাউকে খুঁজে পাবে না, তাকে অন্যেরা খুঁজে নেবে সেটাই সে আশা করে আছে।
সমুদ্রের নিচে থেকে প্রবালের পাহাড় উঁচু হয়ে উঠে এসেছে, সেখানে নানা ধরনের জলজ গাছ, তার ভিতরে রঙিন মাছ ছোটাছুটি করছে। উপরের পৃথিবী যেরকম প্রাণহীন, সমুদ্রের নিচে মোটেও সেরকম নয়। দেখে মনে হয় উপরের প্রাণহীন জগতের সব প্রাণী বুঝি এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে।
য়ুল প্রবাল পাহাড়ের পাদদেশে এসে থামে। তাকে দেখে কিছু রঙিন মাছ ছুটে পালিয়ে গেল, পায়ের কাছাকাছি একটা গর্ত থেকে ছোট একটা অক্টোপাস দ্রুত আড়ালে সরে গেল। য়ুল উপরের দিকে তাকাল, সূর্যের আলোতে সমুদ্রপৃষ্ঠ বিচিত্র এক ধরনের আলোতে ঝিকমিক করছে। য়ুল তার জেট প্যাক চালু করে আবার সামনে এগিয়ে যেতে শুরু করে হঠাৎ করে থেমে গেল, তার মনে হল সে যেন একটি নারীকণ্ঠ শুনতে পেয়েছে। য়ুল পানিতে আবার স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে, চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল, কোথাও কেউ নেই। য়ুল এই জলমানবীদের ভাষা এখনো জানে না, তাই মানুষের শাশ্বত কণ্ঠস্বরের ওপর নির্ভর করে সে বন্ধুত্বসূচক একটি শব্দ করল।
কাছাকাছি একটা পাথরের আড়াল থেকে বড় চোখের একটি মেয়ের মাথা উঁকি দেয়। য়ুল তার দিকে একটু এগিয়ে যেতেই মেয়েটি দ্রুত সরে গেল। য়ুল আবার তার আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত পর আবার সেই কৌতূহলী মুখটি প্রবালের পাথরের আড়াল থেকে উঁকি দেয়, অবাক বিস্ময়ে য়ুলের দিকে তাকিয়ে থাকে। য়ুল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হাত তুলে মেয়েটিকে ডাকল, মেয়েটি ভয় পেয়ে আবার আড়ালে সরে যায় এবং কিছুক্ষণ পর আবার ধীরে ধীরে কৌতূহলী চোখে বের হয়ে আসে। য়ুল মেয়েটির দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করল এবং মেয়েটি আবার একটু এগিয়ে আসে। মেয়েটির সুগঠিত নিরাভরণ দেহ কিছু জলজ পাতা শরীরে জড়িয়ে রেখেছে। মেয়েটি অনিশ্চিতের। মতো একটু এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে যায়। তারপর ভয় পাওয়া গলায় কিছু একটা বলল। সুরেলা কণ্ঠস্বরে সঙ্গীতের স্তবকের মতো কিছু কথা।
য়ুল অনুবাদক যন্ত্র চালু করে রেখেছে, যান্ত্রিক কণ্ঠে সেটি অনুবাদ করে দেয়, মেয়েটি জিজ্ঞেস করছে, তুমি কে? তোমার নাম কী?।
য়ুল বলল, তুমি আমাকে চিনবে না, আমি অনেক দূর থেকে এসেছি। আমার নাম য়ুল।
য়ুল! মেয়েটি খিলখিল করে হেসে বলল, কী বিচিত্র নাম!
তোমার নাম কী?
আমার নাম তিনা।
য়ুল মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আনন্দিত হলাম তিনা।
তুমি নিশ্চয়ই অনেক দূর থেকে এসেছ, কারণ তোমার কথা খুব বিচিত্র। কিন্তু তুমি কেমন করে অনেক দূর থেকে এসেছ? তুমি তো পানিতে নিশ্বাস নিতে পার না।
কে বলছে পারি না। এই যে দেখ আমি পারি।
মেয়েটি খিলখিল করে হেসে বলল, তুমি পার না, আমরা জানি।
কেমন করে জান?
আমরা দেখেছি। তুমি পানিতে নেমে নিশ্বাস নিতে পারছিলে না। তখন আমরা তোমার মুখে বাতাস ফুঁকে দিয়েছি। ছোট বাচ্চাদের যেরকম দিতে হয়!
মেয়েটি হঠাৎ খিলখিল করে হাসতে শুরু করে, যেন অত্যন্ত মজার কোনো ব্যাপার ঘটেছে। হাসি ব্যাপারটি সংক্রামক–য়ুলও হাসতে শুরু করে এবং প্রবাল পাহাড়ের আড়াল থেকে নানা বয়সী আরো কয়েকজন কিশোর–কিশোরী এবং তরুণী বের হয়ে আসে। তারা পানিতে ভাসতে ভাসতে য়ুলকে ঘিরে দাঁড়ায়।
একটি সাহসী কিশোর য়ুলের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি আগে পানির ভিতরে নিশ্বাস নিতে পার নি এখন কেমন করে পারছ?
য়ুল ঘুরে তার পিঠের সঙ্গে লাগানো অক্সিজেন সিলিন্ডারটি দেখাল, বলল, এই যে দেখছ–এখানে বাতাস ভরা আছে। এই বাতাস নল দিয়ে আমার নাকে যাচ্ছে, তাই আমি নিশ্বাস নিতে পারছি।
উপস্থিত সবার মাঝে একটা বিস্ময়ের ধ্বনি শোনা যায়। কিশোর ছেলেটি অবাক হয়ে বলল, এটা তুমি কেমন করে করেছ? বাতাস তো ধরে রাখা যায় না, বাতাস তো ভেসে ভেসে উঠে যায়।
দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করল, এত মসৃণ ঐ জিনিসটা তুমি কোথায় পেয়েছ? আমরা তো কখনো এত মসৃণ জিনিস দেখি নি?
য়ুল কী বলবে বুঝতে পারল না। তার সামনে যারা দাঁড়িয়ে আছে তারা মানুষের সভ্যতার কিছু জানে না। যন্ত্রপাতি দূরে থাকুক শরীরের পোশাক পর্যন্ত নেই, যেটুকু আছে সামুদ্রিক গাছের পাতা–লতা দিয়ে তৈরি। তাদের কাছে উচ্চচাপের অক্সিজেন সিলিন্ডার বা নিও পলিমারের পোশাক বা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের কোনো অর্থ নেই। তাদের কাছে জ্ঞান বা প্রযুক্তিরও কোনো অর্থ নেই। সৃষ্টির শুরুতে মানুষ যেভাবে নিজের শরীরের শক্তি আর মস্তিষ্কের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রকৃতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল, এখন আবার ঠিক সেই একই ব্যাপার। মানুষ আবার একেবারে সেই গোড়া থেকে শুরু করেছে। তাদের কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তর সে কী করে দেবে?
মেয়েটি আরো একটু কাছে এগিয়ে এসে অক্সিজেনের সিলিন্ডারটি স্পর্শ করে বলল, কোথায় পেয়েছ তুমি এটা?
য়ুল একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, পৃথিবীটা বিশাল বড়, তার মাঝে কত বিচিত্র জিনিস আছে তুমি চিন্তাও করতে পারবে না।
সবাই মাথা নাড়ল। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি বলল, ঠিকই বলেছ তুমি, পৃথিবীটা অনেক বড়। কত কী আছে এখানে। কত রকম মাছ! কত রকম প্রাণী! কত রকম গাছ পাথর!
হ্যাঁ! সেগুলো যখন তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করবে, তখন দেখবে তার মাঝে কত কী শেখার আছে, জানার আছে। তুমি যত বেশি জানবে, দেখবে বেঁচে থাকা তত বেশি আনন্দের।
তিনা নামের মেয়েটি হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠল, হাসতে হাসতে বলল, তোমার কথাগুলো কী অদ্ভুত। কী বিচিত্র! তুমি কোথায় এ রকম করে কথা বলতে শিখেছ?
য়ুল উত্তরে কী বলবে বুঝতে পারল না।
.
প্রবাল পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে য়ুল এবং জল–মানব এবং জল–মানবীদের সঙ্গে একটি সখ্যতা গড়ে ওঠে। য়ুলকে তারা সমুদ্রের আরো গহিনে নিয়ে যায়। সমুদ্রগভীরের সুপ্ত আগ্নেয়গিরির উষ্ণ পাহাড়কে ঘিরে জল–মানবদের বসতি গড়ে উঠেছে। সেখানে মায়ের সাথে সাথে শিশুরা ভেসে বেড়াচ্ছে, জন্মের পরমুহূর্ত থেকে তারা স্বাধীন। খাবার জন্য সামুদ্রিক শ্যাওলা, জলজ উদ্ভিদ আর নানা ধরনের মাছ! ঘুমানোর জন্য পাথরের ওপর শ্যাওলার বিছানা। বসতির নেতৃত্ব দেবার জন্য একজন মানবী। সমুদ্রের বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য একদল সুদেহী প্রহরী, কিছু নারী কিছু পুরুষ। সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্রয়োজনে ভিন্ন এক ধরনের সমাজ গড়ে উঠেছে।
য়ুল মুগ্ধ হয়ে তাদের মাঝে ঘুরে বেড়ায়, পানিতে ভেসে যেতে যেতে একসময় সে ভুলে যায় যে সে এসেছে গ্যালাক্সির অন্য প্রান্ত থেকে, সে তুলে যায় সে পৃথিবীর বাতাসে বেঁচে থাকা একজন মানুষ। যাদের সাথে সে ভেসে বেড়াচ্ছে তারা জলজ–মানব, পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন আলাদা করে নেবার বিচিত্র দৈহিক ক্ষমতার অধিকারী।
য়ুল হঠাৎ করে বুঝতে পারে তারা আসলে কেই মানুষ, এই পৃথিবীর একই সন্তান।
০৭.
নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের সামনে বসে কীশ মূল মহাকাশযানের সাথে যোগাযোগ করছে। য়ুলের সারা দিনের সংগ্রহ করা সব তথ্য এর মাঝে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, ক্রন সেগুলো মহাকাশযানের মূল তথ্য কেন্দ্রে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে। য়ুল তার ছোট বিছানায় পা তুলে বসে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। মাথা ঘুরিয়ে কীশের দিকে তাকিয়ে বলল, কীশ।
বল।
আজকে আমার যেরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে তার কোনো তুলনা নেই।
সত্যি?
হ্যাঁ। যেরকম আমার আনন্দ হয়েছে সারা জীবনে আমার সেরকম আনন্দ হয় নি। কেন বলতে পারবে?
না। মানুষ খুব দুর্বোধ্য আমি তাদের বুঝতে পারি না।
য়ুল হেসে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। আমি মানুষ হয়েই মানুষকে বুঝতে পারি না, তুমি বায়োবট হয়ে কেমন করে বুঝবে? আমার আনন্দ হয়েছে কারণ এই জল–মানব আর জল–মানবীরা একেবারে শিশুর মতো সহজ–সরল। একটা ছোট শিশুকে দেখলে যে কারণে আনন্দ হয়, ওদের দেখলে সে কারণে আনন্দ হয়।
ও আচ্ছা।
য়ুল ভুরু কুঁচকে কীশের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী বললে?
আমি বলেছি, ও আচ্ছা।
য়ুল একটু উষ্ণ হয়ে বলল, তুমি কেন ওটা বললে? তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করছ?
কীশ তরল গলায় বলল, তুমি যদি আমাকে সত্যি কথা বলতে বল তা হলে আমি বলব যে আমি তোমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করছি না।
য়ুল গম্ভীর গলায় বলল, তা হলে কী কারণে আমার আনন্দ হয়েছে বলে তুমি মনে কর?
আমার ধারণা তিনা নামের মেয়েটির কারণে।
য়ুল থতমত খেয়ে গেল এবং জোর করে মুখে একটু কাঠিন্য এনে বলল, তুমি কী বললে?
আমি বলছি তিনা নামক মেয়েটির কারণে। মেয়েটি তোমার মুখে অক্সিজেন প্রবাহ করিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছিল বলে সম্ভবত তার প্রতি তোমার একটু কৃতজ্ঞতা জন্মেছে। এবারে তাকে দেখে সে জন্য তোমার নিশ্চয়ই আনন্দ হয়েছে। তা ছাড়া আরো একটি ব্যাপার
কী ব্যাপার?
মানুষের সৌন্দর্যের অনুভূতি আমি ঠিক বুঝতে পারি না। তবে আমার ধারণা মেয়েটি অপূর্ব রূপসী।
য়ুল কীশকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, বাজে কথা বোলো না কীশ। মানুষের অনুভূতি সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই
কীশ মাথা নাড়ল, বলল, হতে পারে। আমি এসব ব্যাপারে একেবারেই অজ্ঞ। তবে আমি ভাসমান যানে বসে তোমার রক্তচাপ, হৃৎস্পন্দন এবং শরীরে নানা ধরনের হরমোনের পরিমাপ করছিলাম। আমি লক্ষ্য করেছি যতবার তুমি তিনা নামক জল–মানবীর কাছে গিয়েছ বা তার সাথে কথা বলেছ, তোমার রক্তচাপ এবং হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে।
য়ুল খানিকক্ষণ কীশের দিকে তাকিয়ে বলল, ও, তারপর সে হেঁটে জানালার কাছে। গিয়ে দাঁড়ায় নিজের কাছে গোপন করে লাভ নেই। তিনা নামের জল–মানবী মেয়েটির কথা সত্যিই ঘুরে–ফিরে তার মনে পড়ছে। কী আশ্চর্য!
০৮.
ভাসমান যানের পাশে য়ুল পা ঝুলিয়ে বসে নিশ্বাস নেবার তন্তুটি নিজের নাকে লাগিয়ে নেয়। যোগাযোগ মডিউলটি পরীক্ষা করে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে য়ুল কীশের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কিছুক্ষণের মাঝেই ফিরে আসব।
বেশ। কিন্তু
কিন্তু কী?
আমি এখনো বিশ্বাস করি তোমার দ্বিতীয়বার সমুদ্রের নিচে যাওয়াটি সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। আমরা অল্প সময়ের মাঝে পৃথিবী ছেড়ে যাব, এই সময়টুকুতে আবার এ রকম ঝুঁকি নেওয়া ঠিক নয়।
ঝুঁকি? কিসের ঝুঁকি?
কত রকম ঝুঁকি। পৃথিবীর ওপরে প্রাণ প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে কিন্তু সমুদ্রের নিচে অসংখ্য প্রাণী রয়েছে। কিছু কিছু ভয়ঙ্কর। তুমি তাদের দেখে অভ্যস্ত নও।
সমুদ্রের নিচে যদি জল–মানব এবং জল–মানবী পুরো জীবন থাকতে পারে, আমি তা হলে এক ঘণ্টা থাকতে পারব।
সেটি সত্যি। কিন্তু
এর মাঝে কোনো কিন্তু নেই। আমি একজন মানব সন্তান। এই জল–মানব এবং জল–মানবীরাও মানব সন্তান। চিরদিনের মতো চলে যাবার আগে এক মানব সন্তানের অন্য মানব সন্তান থেকে বিদায় নেবার কথা।
সেটি সম্ভবত তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু।
না, কোনো কিন্তু নেই। আমি তিনাকে বলেছিলাম তার কাছ থেকে বিদায় নেব। সে নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে।
কীশ কোনো কথা বলল না, সে জানে এখানে কথা বলার বিশেষ কিছু নেই।
য়ুল পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর কীশ কিছুক্ষণ ভাসমান যানটিতে দাঁড়িয়ে থাকে। ভাসমান যানের মনিটরে সে য়ুলকে দেখতে পায়, জেট প্যাক ব্যবহার করে পানির গভীরে চলে যাচ্ছে। কীশ মনিটরটি স্পর্শ করে সেটি বন্ধ করে দিল। কয়েক ঘণ্টার মাঝে নভোযানটিকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। তার আগেই তাকে অনেকগুলো কাজ শেষ করতে হবে। আশপাশে একটা নিরাপদ দ্বীপ খুঁজে বের করে সেখানে কিছু জরুরি আয়োজন শেষ করতে হবে। য়ুল ফিরে আসার আগে হয়তো শেষ করতে পারবে না–কিন্তু করার কিছু নেই।
০৯.
য়ুল ভেজা শরীরে ভাসমান যানটিতে বসে আছে। তার শরীর থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ে ভাসমান যানের কিছু যন্ত্রপাতি ভিজে যাচ্ছে কিন্তু সেদিকে য়ুলের নজর নেই। সে দীর্ঘসময় আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে একসময় মাথা নামিয়ে কীশের দিকে তাকাল। বলল, কীশ।
বল।
আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। কিন্তু ঠিক কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না।
কীশ মাথা ঘুরিয়ে য়ুলের দিকে তাকাল, তার সবুজাভ চোখে এক ধরনের আলোর ছটা জ্বলে উঠে আবার নিভে যায়।
য়ুল নিজের আঙুলের দিকে তাকাল এবং অনাবশ্যকভাবে নখের মাথা পরিষ্কার করতে করতে আবার কীশের দিকে তাকিয়ে একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল, আমি যেটা বলতে চাইছি সেটা কীভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না। তোমার কাছে সেটাকে অত্যন্ত বিচিত্র মনে হতে পারে
কীশ কোনো কথা না বলে ঝুলের দিকে তাকাল এবং হঠাৎ য়ুল কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল।
কীশ এবারে সোজা হয়ে দাঁড়াল এবং নিজের আধা জৈবিক আধা যান্ত্রিক হাত দিয়ে য়ুলের কাধ স্পর্শ করে বলল, য়ুল তুমি কী বলতে চাইছ আমি জানি।
য়ুল হতচকিত হয়ে কীশের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি জান?
হ্যাঁ। তুমি আমার সঙ্গে ক্রসিয়াস গহপুঞ্জে ফিরে যেতে চাও না। তুমি এখানে থাকতে চাও। তাই না?
য়ুল কিছুক্ষণ বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে কীশের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। তুমি ঠিকই আন্দাজ করেছ, আমি এখানে থাকতে চাই।
কীশ নরম গলায় বলল, আমি মানুষ নই, তাই মানুষকে বুঝতে পারি না, কিন্তু তাদের সাথে এত দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি যে তারা কখন কী করবে অনেক সময় সেটা আন্দাজ করতে পারি।
য়ুল কিছু বলল না। কীশ ভাসমান যানের নিয়ন্ত্রণের কাছে দাঁড়িয়ে সেটা চালু করতে করতে বলল, আমি কাছাকাছি একটা ছোট দ্বীপ খুঁজে বের করেছি। সেখানে আমি তোমার জন্য একটা ছোট বাসস্থান তৈরি করেছি। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু সেখানে আছে। জল–মানব আর জল–মানবীর শরীর থেকে কিছু জিনেটিক নমুনা সংগ্রহ করা আছে, সেটা ব্যবহার করে তোমার ফুসফুসের মাঝে পরিবর্তন আনা যাবে। কিন্তু সেটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। যতদিন তুমি পানির নিচে থাকার মতো পুরোপুরি প্রস্তুত না হচ্ছ এই দ্বীপটিতে তোমাকে দীর্ঘ সময় কাটাতে হবে।
য়ুল কীশের দিকে তাকিয়ে বলল, কীশ–আমি তোমাকে কী বলে ধন্যবাদ জানাব বুঝতে পারছি না। কীশ শান্ত গলায় বলল, তুমি আর যেটাই কর আমাকে, ধন্যবাদ জানিও না। আমি যেটি করছি সেটি হচ্ছে তোমার জীবনের মূল্যকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা। সেটি অমানবিক এবং অন্যায়। কিন্তু আমি সেটা করেছি তোমার জন্য–কারণ আমি জানি এটাই তোমার ইচ্ছে–
য়ুল বাধা দিয়ে বলল, কীশ, আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ।
কীশ য়ুলের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কিংবা মানুষের প্রতি আমার এক ধরনের হিংসা হয়।
কেন?
কারণ যে তীব্র অনুভূতির জন্য তুমি তোমার নিজের জীবন বিপন্ন করে ফেলতে পার আমরা সেই অনুভূতি বুঝতে পারি না। কীশ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, যাই হোক–য়ুল, পৃথিবীতে এখনো নানা ধরনের ব্যাক্টেরিয়া রয়েছে, সুপ্ত ভাইরাস রয়েছে, কাজেই তোমাকে সাবধান থাকতে হবে। তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে গেছি। নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করে গেছি।
কীশ ভাসমান যানটিকে দ্বীপের মাঝামাঝি নামাতে নামাতে বলল, নিরাপত্তার জন্য আমি তোমার কাছে কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র রেখে যাচ্ছি। তবে
তবে কী?
তুমি সেটা ব্যবহার করতে চাও কি না সেটি তোমার ইচ্ছে। কারণ জল–মানব এবং জল–মানবীরা যদি কখনো তোমাকে সত্যিকারের একটি অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখে তারা তোমাকে ভুল বুঝতে পারে। তারা তোমাকে মনে করতে পারে কোনো অলৌকিক পুরুষ। স্বর্গের কোনো দেবতা। প্রচণ্ড ক্ষমতাধর কোনো জাদুকর।
তুমি ঠিকই বলেছ কীশ।
তবে তুমি তাদের জ্ঞান দিতে পার। নতুন জিনিস শেখাতে পার। যে জিনিস শিখতে তাদের কয়েক হাজার বছর লেগে যেত সেটা তুমি কয়েকদিনে শেখাতে পার। আমি তোমার জন্য গ্যালাক্টিক সাইক্লোপিডিয়া রেখে যাচ্ছি, কয়েকটা ক্রিস্টালে রাখা আছে। পৃথিবীর বা জ্ঞানবিজ্ঞানের সব তথ্য তুমি সেখানে পাবে।
ভাসমান যানটি নিচে নামাতে নামাতে কীশ বলল, মনে রেখো আজ থেকে কয়েক শতাব্দী আগে পৃথিবীর কিছু মানুষ অনেকগুলো শিশুকে জল–মানব আর জল–মানবীতে রূপান্তর করে সমুদ্রে নামিয়ে দিয়েছিল। তারা বাইরের কোনো সাহায্য ছাড়া বড় হয়েছে। তুমি তাদের মাঝে প্রথম একটি বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছ। একটু ভুল করলে কিন্তু সব ওলটপালট হয়ে যাবে।
য়ুল কীশের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি ভুল করব না কীশ। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি আমি কোনো ভুল করব না।
১০.
নভোযানটি প্রচণ্ড গর্জন করে আকাশের সাদা মেঘের মাঝে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া পর্যন্ত য়ুল অপেক্ষা করল। তারপর সে দীর্ঘ পদক্ষেপে বালুবেলায় হেঁটে হেঁটে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যায়। সমুদ্রের ঢেউ সাদা ফেনা তুলে তার দিকে এগিয়ে পায়ের কাছে আছড়ে পড়ল। য়ুল তার মাঝে মাথা সোজা করে ঢেউ ভেঙে হেঁটে যেতে থাকে।
সমুদ্রের বালুবেলায় তার পায়ের চিহ্ন ঢেউ এসে মুছে দিতে থাকে।
ঠিক তার ফেলে আসা জীবনের মতোই।