জনৈকা যুক্তিহীনা নারী
রিগা বিশাল একটি ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়েছিল। ঘরের একটি বড় অংশে স্বচ্ছ সিলঝিনিয়ামের ঝকঝকে আয়না। সেই আয়নায় রিগার প্রতিবিম্ব ফুটে উঠেছে। রিগা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে আছে, সে অত্যন্ত সুপুরুষ। তার কুচকুচে কালো চুল, দীর্ঘ পেশিবহুল দেহ। মসৃণ ত্বক এবং ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। তার শরীরের উপর আলগাভাবে একটি অর্ধস্বচ্ছ নিও পলিমারের কাপড় জড়ানো রয়েছে। নিজের দিকে তাকিয়ে থেকে সে তার মুখে একটা সন্তুষ্টির মতো শব্দ করে জানালার দিকে ঘুরে এল। ঠিক এ রকম সময় দরজা খুলে তার দীর্ঘদিনের সঙ্গিনী শুনু ঘরে প্রবেশ করে। রিগাকে দেখে শুনু হঠাৎ থমকে দাঁড়াল, তার চোখেমুখে একই সাথে বিস্ময় এবং শঙ্কার এক ধরনের ছায়া পড়ে। রিগা মুখে হাসি টেনে এনে বলল, কেমন দেখছ শুনু?
শুনু কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বলতে পারে না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, তুমি– তুমি পুনরুজ্জীবন ঘরে গিয়েছ?
হ্যাঁ শুনু।
কেন? তোমার তো সময় হয় নি।
একটু আগেই গেলাম। কেমন কাজ করেছে মনে হয়?
শুনু একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ভালো। খুব ভালো
দেখতে যেমন ভালো দেখাচ্ছে আমার ভিতরে লাগছেও সেরকম চমৎকার। তুমি বিশ্বাস করবে না আমি ভিতরে কী রকম একটা শক্তি অনুভব করছি।
সত্যি?
হ্যাঁ–আমি জানতাম না, পুনরুজ্জীবন ঘরের এত উন্নতি হয়েছে। শরীরের সব জীর্ণ কোষ বদলে দিয়েছে। শুধু তাই না, মনে হয় মস্তিষ্কে নিউরন–সেলেও কিছু কাজ করেছে, খুব ভালো চিন্তা করতে পারছি।
সত্যি?
হ্যাঁ, ছয় মাত্রার একটা অনুপৌণিক সমীকরণ ছিল, কখনো আমি সমাধান করতে পারি নি। পুনরুজ্জীবন ঘর থেকে বের হবার পর মস্তিষ্কটা এমন সতেজ লাগতে লাগল যে ভাবলাম সমীকরণটা একটু ভেবে দেখি। তুমি বিশ্বাস করবে না শুনু, সাথে সাথে সমাধানটা বের হয়ে গেল।
শুনু রিগার উচ্ছাসে অংশ নিতে পারল না। কপাল থকে চুলগুলো সরিয়ে নিচু গলায় বলল, ও।
শুধু তাই না, খাওয়ার রুচি বেড়ে গিয়েছে দশ গুণ। আগে যেটা খেতে পানসে লাগত হঠাৎ করে তার স্বাদ বেড়ে গেছে। স্নায়ুর মাঝেও কিছু একটা হয়েছে। রিগা শব্দ করে হাসতে হাসতে বলল, আনন্দের অন্য জিনিসগুলো তো এখনো চেষ্টা করে দেখিই নি!
শুনু রিগার হাসিমুখের দিকে এক ধরনের বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে। তার হাসি থেমে যাবার পর নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, রিগা, তুমি এখন কেন পুনরুজ্জীবন ঘরে গেলে? এখন তো সময় হয় নি।
রিগা খানিকক্ষণ শুনুর দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থেকে তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি তো জান শুনু কেন আমি পুনরুজ্জীবন ঘরে গেছি। আমরা সবাই তো যাই। যেতে হয়। তুমিও যাবে।
শুনুর কোমল চেহারায় হঠাৎ এক ধরনের তীব্র ব্যথার ছায়া এসে পড়ে। রিগা তার মুখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে নরম গলায় বলল, আমি দুঃখিত শুনু। তুমি তো জান একদিন আমাদের একজনের কাছে থেকে সরে যেতে হবে। আমরা তো আর সবসময় একসাথে থাকতে পারি না–
শুনু কোনো কথা বলল না, হঠাৎ করে তার চোখে পানি এসে যায়, সে প্রাণপণে তার চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা করে।
রিগা একটু এগিয়ে এসে শুনুর মাথায় হাত রেখে বলল, ছিঃ শুনু, কাঁদে না। এর মাঝে কাদার কিছু নেই। এটা হচ্ছে জীবন। মনে নেই তোমার আর স্রুরার যখন ছাড়াছাড়ি হল তখন তুমি কেমন ভেঙে পড়েছিলে? মনে আছে?
শুনু মাথা নাড়ল। রিগা নরম গলায় বলল, তারপর আমার সাথে তোমার পরিচয় হল। আমরা ঘর বাধলাম–কী চমৎকার একটা জীবন হয়েছিল আমাদের। ঠিক সেরকম আবার আমাদের চমৎকার জীবন হবে। তোমার সাথে দেখা হবে অসম্ভব হৃদয়বান কোনো পুরুষের–সব দুঃখ মুছে নেবে তোমার। আমার কথা ভুলে যাবে তখন।
শুনু হাতের উল্টো পৃষ্ঠা দিয়ে চোখ মুছে মৃদু গলায় বলল, রিগা, আর কয়দিন আমরা একসাথে থাকতে পারি না? আর মাত্র কয়দিন?
রিগা নিচু গলায় হেসে ফেলল, বলল, ছিঃ শুনু, ছেলেমানুষি কোরো না! আর কয়দিনে কী এসে যায়? কিছু আসে যায় না। তুমি সেই প্রাচীনকালের মানুষের মতো কথা বলছ! আমি কতবার তোমাকে বলেছি প্রাচীনকালের মানুষের জীবন নিয়ে এত ভেবো না। সেই জীবন শেষ হয়ে গেছে।
শুনু চোখ মুছে নিশ্বাস ফেলে বলল, জানি। কিন্তু কিন্তু আমার কী ভয়ঙ্কর লোভ হয়–
রিগা বিস্ফারিত চোখে শুনুর দিকে তাকাল, অবাক হয়ে বলল, কিসের লোভ হয়?
আমার–আমার একটি সন্তান হবে। ছোট একটা শিশু–আঁকুপাকু করবে–আর আমি বুকে চেপে ধরব।
রিগা হতচকিত দৃষ্টিতে শুনুর দিকে তাকিয়ে রইল। খানিকক্ষণ সে কোনো কথা বলতে পারল না, তারপর একরকম জোর করে বলল, সন্তান?
হ্যাঁ
কিন্তু–কিন্তু তুমি তো জান সন্তানের প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে। এক সময় সন্তানের প্রয়োজন হত কারণ মানুষ বুড়ো হয়ে মারা যেত। তাদের স্থান নেবার জন্যে নূতন মানুষের প্রয়োজন হত! এখন আমরা মৃত্যুকে জয় করেছি, প্রকৃতির নিয়মে বার্ধক্য আমাদের স্পর্শ করে না। আমরা মারা যাই না। আমাদের আর সন্তানের প্রয়োজন নেই।
শুনু নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানি।
এক সময় মানুষের আয়ু ছিল ষাট–সত্তর বছর! এখন আমি আর তুমি একসাথে ঘর করেছি সাড়ে ছয় শ বছর! তার আগে আমি যে মেয়েটির সাথে ছিলাম সেখানে ঘর করেছি চার শ বছর। তার আগে
আমি জানি। শুনু নিশ্বাস ফেলে বলল, আমরা সেই কতকাল থেকে বেঁচে আছি আর আমরা বেঁচে থাকব আরো কত মহাকাল! কিন্তু তবু আমার মনে হয় আমি যদি ছোট একটা শিশু পেতাম—
.
রিগা বিস্ফারিত চোখে এই সম্পূর্ণ যুক্তিতর্কবর্জিত প্রায় উন্মাদিনী মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে। এই ধরনের অর্থহীন হাস্যকর কথা কেউ বলতে পারে সে নিজের কানে না শুনলে বিশ্বাস করত না।
মানুষ সত্যিই বড় বিচিত্র।