জটাধরের বিপদ

জটাধরের বিপদ

নূতন দিল্লীর গোল মার্কেটের পিছনের গলিতে কালীবাবুর বিখ্যাত দোকান ক্যালকাটা টি ক্যাবিন। এই আড্ডাটির নাম নিশ্চয়ই আপনারা শুনেছেন।

সতরোই পৌষ, সন্ধ্যা ছটা। পেনশনভোগী বৃদ্ধ রামতারণ মুখুজ্যে, স্কুলমাস্টার কপিল গুপ্ত, ব্যাংকের কেরানী বীরেশ্বর সিংগি, কাগজের রিপোর্টার অতুল হালদার এবং আরও অনেকে আছেন। আজ নিউইয়ার্স ডে, সেজন্য ম্যানেজার কালীবাবু একটু বিশেষ আয়োজন করেছেন। মাংসের চপ তৈরি হচ্ছে। রামতারণবাবু নিষ্ঠাবান সাত্ত্বিক লোক, কালীবাড়ির বলি ভিন্ন অন্য মাংস খান না। তাঁর জন্য আলাদা উনুনে মাছের চপ ভাজবার ব্যবস্থা হয়েছে।

সিগারেট তামাক আর চপ ভাজার ধোঁয়ায় ঘরটি ঝাপসা হয়ে আছে, বিচিত্র গন্ধে আমোদিত হয়েছে। উপস্থিত ভদ্রলোকদের জনকয়েক পাশা খেলছেন, কেউ খবরের কাগজ পড়ছেন, কেউ বা রাজনীতিক তর্ক করছেন।

অতুল হালদার বললেন, ওহে কালীবাবু আর দেরি কত? চায়ের জন্যে যে প্রাণটা চ্যাঁ চ্যাঁ করছে। কিন্তু খালি পেটে তো চা খাওয়া চলবে না, চটপট খানকতক ভেজে ফেল।

কালীবাবু বললেন, এই যে সার, আর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চপ রেডি হয়ে যাবে।

এমন সময় জটাধর বকশী প্রবেশ করলেন।* চেহারা আর সাজ ঠিক আগের মতনই আছে, ছ ফুট লম্বা মজবুত গড়ন, কাইজারী গোঁফ, গায়ে কালচে—খাকী মিলিটারী ওভারকোট, মাথায় পাগড়ির মতন বাঁধা কম্ফর্টার, অধিকন্তু কপালে গুটিকতক চন্দনের ফুটকি আর গলায় একছড়া গাঁদা ফুলের মালা। ঘরে ঢুকেই বাজখাঁই গলায় বললেন, নমস্কার মশাইরা, খবর সব ভাল তো!

বীরেশ্বর সিংগি একটু আঁতকে উঠলেন, রামতারণবাবু রেগে ফুলতে লাগলেন। কপিল গুপ্ত সহাস্যে বললেন, আসতে আজ্ঞা হক জটাধরবাবু, আপনি বেঁচে উঠেছেন দেখছি। আজকেও ভূত দেখাবেন নাকি?

পটকার মতন ফেটে পড়ে রামতারণবাবু বললেন, তোমাকে পুলিসে দেব, বেহায়া ঠক জোচ্চোর! ভূত দেখাবার আর জায়গা পাও নি!

জটাধর বকশী প্রসন্নবদনে বললেন, মুখুজ্যে মশায়ের রাগ হবারই কথা, আমার রসিকতাটা একটু বেয়াড়া রকমের হয়েছিল তা মানছি। মরা মানুষ সেজে আপনাদের ভয় দেখিয়েছিলুম সেটা ঠিক হয় নি। তার জন্য আমি ভেরি সরি। মশাইরা যদি একটু ধৈর্য ধরে আমার কথা শোনেন তো বুঝবেন আমার কোন কুমতলব ছিল না।

রামতারণ মুখুজ্যে ক্রুদ্ধ বিড়ালের ন্যায় মৃদুমন্দ গর্জন করতে লাগলেন। কপিল গুপ্ত বললেন, কি বলতে চান বলুন জটাধরবাবু।

অতুল হালদারের পাশে বসে পড়ে জটাধর বললেন, মশাইরা নভেল পড়ে থাকেন নিশ্চয়? প্রেমের গল্প, বড় ঘরের কেচ্ছা, ডিটেকটিভ কাহিনী, রূপসী বোম্বেটে, এই সব? তার জন্যে কিছু পয়সাও খরচ করে থাকেন। কিন্তু বলুন তো, গল্পের বইএ কিছু সত্যি কথা পান কি? আজ্ঞে না, আপনারা জেনে শুনে পয়সা খরচ করে ডাহা মিথ্যে কথা পড়েন, তা শরৎ চাটুজ্যেই লিখুন আর পাঁচকড়ি দেই লিখুন। কেন পড়েন? মনে একটু ফুর্তি একটু সুড়সুড়ি একটু টিপুনি একটু ধাক্কা লাগাবার জন্যে। গল্প হচ্ছে মনের ম্যাসাজ, চিত্তের ডলাইমলাই, পড়লে মেজাজ চাঙ্গা হয়। আমি কি—এমন অন্যায় কাজটা করেছি মশাই? রামতারণবাবু প্রবীণ লোক, ওঁকে ভক্তি করি, ওঁর সামনে তো ছ্যাবলা প্রেমের কাহিনী বলতে পারি না, তাই নিজেই নায়ক সেজে একটি নির্দোষ পবিত্র ভূতের গল্প আপনাদের শুনিয়েছিলুম।

রামতারণ বললেন, তোমার চা চুরুট পানের জন্যে আমার যে সাড়ে চোদ্দ আনা গচ্চা গিয়েছিল তার কি?

—তুচ্ছ, অতি তুচ্ছ। ছ—সাত টাকার কমে আজকাল একটা ভাল গল্পের বই মেলে না সার। আমি সেদিন অতি সস্তায় আপনাদের মনোরঞ্জন করেছিলুম।

কপিল গুপ্ত বললেন, যাই হোক, কাজটা মোটেই ভাল করেন নি, আচমকা সবাইকে একটা শক দেওয়া অতি অন্যায়। আর একটু হলেই তো বীরেশ্বরবাবুর হার্ট ফেল হত।

জটাধর হাত জোড় করে বললেন, আচ্ছা সে অপরাধের জন্যে মাপ চাচ্ছি, আজ তার দণ্ডও দেব। ও ম্যানেজার কালীবাবু মশাই, বিস্তর চপ ভাজছেন দেখছি, এক—একটার দাম কত? ছ আনা? বেশ বেশ। তা সস্তাই বলতে হবে, বড় বড় করেই গড়েছেন। ভাল মাস্টার্ড আছে তো? ছাতু গোলা নকল মাস্টার্ড চলবে না, তা বলে দিচ্ছি। এই ঘরে তেরো জন খাইয়ে রয়েছেন দেখছি, আমাকে আর কালীবাবুকে নিয়ে পনরো জন। প্রত্যেকে যদি গড়ে চারখানা করে চপ খান তা হলে পনরো ইণ্টু চার ইণ্টু ছ আনা, তাতে হয় সাড়ে বাইশ টাকা। তার সঙ্গে চা কেক পান তামাক ইত্যাদিও ধরুন বারো টাকা। একুনে হল পঁয়ত্রিশ টাকা। থামুন, আমার পুঁজি কত আছে দেখি।

জটাধর পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করলেন এবং নোট গনতি করে বললেন, কুলিয়ে যাবে, আমার কাছে গোটা পঞ্চাশ টাকা আছে। কালীবাবু আপনি কিছু বেশী করে মাল তৈরি করুন। এখন মশাইরা দয়া করে আমার সবিনয় নিবেদনটি শুনুন। আজ আপনারা সবাই আমার গেস্ট, আমার খরচে সবাই খাবেন। না না, কোনও আপত্তি শুনব না, আমার অনুরোধটি রাখতেই হবে, নইলে মনে শান্তি পাব না।

কপিল গুপ্ত বললেন, ব্যাপার কি জটাধরবাবু, এত দিলদরিয়া হলেন কেন?

জটাধরের মোটা গোঁফের নীচে একটি সলজ্জ হাসি ফুটে উঠল। ঘাড় চুলকে মাথা নীচু করে বললেন, আপনারা হলেন ঘরের লোক, আপনাদের বলতে বাধা কি! কি জানেন, আজ বড় আনন্দের দিন, আজ আমার শুভ বিবাহ—

রামতারণ বললেন, পৌষ মাসে শুভ বিবাহ কি রকম? তুমি ব্রাহ্ম না খ্রীষ্টান? আজ বিবাহ তো তুমি এখানে কেন?

—আজ্ঞে আমি খাঁটি হিঁদু। বিবাহের অনুষ্ঠানটি আজ বেলা এগারোটায় রেজিস্ট্রেশন অফিসে সেরে ফেলেছি। সিভিল ম্যারেজ তো পাঁজি দেখে হবার জো নেই, রেজিস্ট্রারের মর্জি মাফিক লগ্ন স্থির হয়। বিয়েটা চুকে গেলেই ভাবলুম, এখন তো দিল্লিতে আমার চেনা—শোনা বেশী কেউ নেই, মাসতুতো ভাইএর বাসায় উঠেছি, সে আবার পেটরোগা মানুষ, ভাল জিনিস খাবার শক্তিই নেই। কিন্তু বিয়ের দিনে পাঁচ জনে মিলে, ফুর্তি, একটু খাওয়াদাওয়া না করলে চলবে কেন? আপনাদের কথা মনে এল, ধরতে গেলে আমার আত্মীয় বন্ধু বরপক্ষ কন্যাপক্ষ সবই আপনারা, তাই এখানে চলে এলুম। আমাদের কালীবাবু দেখছি অন্তর্যামী, ফীস্ট তৈরি করেই রেখেছেন। যা আছে দয়া করে তাই আজ আপনারা খান। কিন্তু এখানে আপনাদের খাইয়ে তো আমার সুখ হবে না, আমার আস্তানায় একদিন আপনাদের পায়ের ধুলো দিতেই হবে, বউভাত খেতে হবে। বেশী কিছু নয়, চারটি পোলাও, একটু মাংস, একটু পায়েস, আর ঘণ্টিওয়ালার দোকানের জাহানগিরী বালুশাই। মুখুজ্যে মশাই নিষ্ঠাবান লোক তা জানি, কালীবাড়ির পাঁঠাই আনব। আমার স্ত্রীর রান্না খুব চমৎকার, আপনারা খেয়ে নিশ্চয় তারিফ করবেন। আর একটি নিবেদন আছে সার। এখানকার মিউনিসিপাল অফিসে একটা কাজের চেষ্টা করছি, সার্ভেয়ার—আমিনের পোস্ট। মুখুজ্যে মশাই যদি দয়া করে একটু সুপারিশ করেন তো কাজটি পেয়ে যাই। ওঁকে সবাই খাতির করে কিনা।

রামতারণবাবু বললেন, তা না হয় একটা সুপারিশ পত্র লিখে দেওয়া যাবে। কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞাসা করি—তোমার বয়েস তো পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি মনে হচ্ছে, এখন দ্বিতীয় পক্ষ বিবাহ করলে নাকি?

আজ্ঞে না সার, এই সবে প্রথম পক্ষ। এত দিন নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি, বিবাহে রুচিও ছিল না, ভেবেছিলুম নির্ঝঞ্ঝাট জীবনটা কাটিয়ে দেব। কিন্তু তা হল না, শেষটায় বন্ধনে জড়িয়ে পড়লুম। শুনবেন সব কথা সার?

রামতারণ বললেন, বেশ তো শোনাই যাক তোমার কথা। অবশ্য যদি গোপনীয় কিছু না হয়।

জটাধর জিব কেটে বললেন, রাম বল, আমার জীবনে গোপনীয় কিছু নেই। এই জটাধর বকশী আমুদে বটে, কিন্তু খাঁটী মানুষ, চরিত্রে কোনও কলঙ্ক পাবেন না। ও ম্যানেজার কালীবাবু, আপনি খাবার পরিবেশন করুন, খেতে খেতেই কথা হবে। শুনুন মশাইরা।—

যুদ্ধের সময় সত্যিই আমি নর্থ বর্মায় মিলিটারিতে চাকরি করতুম। বেয়াল্লিশ সালের গোড়ায় যখন জাপানীরা রেঙ্গুনে বোমা ফেলতে লাগল তখন ইংরেজের ওপর আর ভরসা রইল না, প্রাণের ভয়ে আমরা সবাই পালালুম। টামু—ইম্ফল রোড দিয়ে দলে দলে নানা জাতের মেয়ে পুরুষ ছেলে বুড়ো চলল, রোগে আর অপঘাতে কত যে মারা গেল তার সংখ্যা নেই। কাগজে সে সব কথা আপনারা পড়েছেন। অনেক কষ্টে আমি যখন বর্মা বর্ডার পার হয়ে ইম্ফলে এলুম তখন একটি মেয়ে আমার শরণাপন্ন হল। বড় করুণ কাহিনী তার, অল্প বয়সে অনেক দুঃখ পেয়েছে। স্বামীর নাম বলহরি জোয়ারদার, রেঙ্গুনে তার মোটর মেরামতের কারখানা ছিল, ভালই রোজগার করত। জাপানীরা তাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেল, তাদের মোটর মেকানিকের বড় অভাব ছিল কিনা। যাবার সময় বলহরি তার বউকে বলল, অচলা, চললুম, এ জীবনে হয়তো আর দেখা হবে না। তুমি যেমন করে পার পালাও, দেশে ফিরে যাবার চেষ্টা কর। অচলা কাঁদতে কাঁদতে একটি বাঙালী দলের সঙ্গে রওনা হল। দলের সবাই একে একে মারা গেল, কলেরায়, টাইফয়েডে, বাঘের পেটে। অবশেষে অচলা আধমরা অবস্থায় মণিপুরে পৌঁছুল। আমার স্বভাবটা কি রকম জানেন, লোকের দুঃখ দেখতে পারি না, বিশেষ করে মেয়েছেলের। অচলাকে বললুম, আমার সঙ্গেই চল, আমি যদি বেঁচে থাকি তুমিও বাঁচবে।

রামতারণবাবু প্রশ্ন করলেন, অচলার মা বাপ কোথা ছিল?

—হায় রে, তার আবার মা বাপ! তারা বহুকাল থেকে পেগু শহরে বাস করত, সেখানেই বলহরির সঙ্গে অচলার বিয়ে হয়। জাপানীরা এসে পড়লে অচলার মা বাপ ভাই বোন কে কোথায় পালাল, বাঁচল কি মরল কেউ জানে না। তারপর শুনুন। অচলাকে নিয়ে তো কোনও গতিকে বিপদের গণ্ডি পেরিয়ে এলুম। তারপর মশাই বারো বচ্ছর নানা জায়গায় কাজ করেছি, ডিব্রুগড়ে, চাটগাঁয়ে, নোয়াখালিতে, রংপুরে, আরও অনেক স্থানে। কোনও চাকরিই স্থায়ী নয়, থিতু হয়ে কোথাও বাস করতে পারি নি। অবশেষে ঘুরতে ঘুরতে এই দিল্লিতে এসে পড়েছি। স্থির করেছি আর নড়ব না। এখানেই একটা কাজ জুটিয়ে নেব। কাজের যোগাড়ও প্রায় হয়েছে, এখন মুখুজ্যে মশাই একটু দয়া করলেই পেয়ে যাব।

রামতারণ বললেন, কন্ট্রাক্টর সেকেন্দর সিংকে আমি বলব, তার ইনফ্লুএন্স আছে, সে তোমার জন্য চেষ্টা করবে। আচ্ছা, তুমি তো বহুকাল ভ্যাগাবন্ড হয়ে ঘুরেছ, অচলা অ্যাদ্দিন কোথায় ছিল?

—কোথায় আর থাকবে সার, আমার কাছেই ছিল। মেয়েটা বড় ভাল। রং তেমন ফরসা নয়, কিন্তু মুখের খুব শ্রী আছে। প্রথম প্রথম বড় কান্নাকাটি করত, তারপর ক্রমশ সামলে উঠল। কিন্তু মাস দুই আগে দেখলুম আবার ঘ্যানঘ্যানানি শুরু করেছে। জিজ্ঞাসা করলুম, কি হয়েছে অচলা? জবাব দিল, আমার মরণ হয় না কেন।…আরে ব্যাপারটা কি খোলসা করেই বল না। অচলা বলল, তোমার জন্যে কি আমাকে বিষ খেয়ে জলে ডুবে গলায় দড়ি দিয়ে মরতে হবে?…ভাল জ্বালা, আরে আমার অপরাধটা কি? অচলা বলল, লোকে যে আমার বদনাম রটাচ্ছে তা শুনতে পাও না?…কি মুশকিল, তা আমাকে করতে বল কি? অচলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, অ জটাইবাবু, তোমার কি বুদ্ধি—শুদ্ধি কিচ্ছু নেই?

কপিল গুপ্ত বললেন, তা অচলা কিছু অন্যায় বলে নি।

জটাধর বললেন, না মশাই, অচলা কিছু অন্যায় বলে নি, আমারও বুদ্ধি—শুদ্ধি বিলক্ষণ আছে। বিবাহের বন্ধনে জড়িয়ে পড়বার ইচ্ছে আমার মোটেই ছিল না, কিন্তু প্রজাপতি যদি নারীর রূপ ধরে পিছনে লাগেন তবে তাঁর নির্বন্ধ এড়ানো পুরুষের সাধ্য নয়। কে এক কবি লিখেছেন না?—শারদ লতিকা কে ললিত ললনাকায়। বাজে কথা মশাই, ললনা হচ্ছেন ছিনে জোঁক। ভেবে দেখলুম অচলাকে বিয়ে করে ফেলাই ভাল। তার স্বামী বলহরির কোনও পাত্তাই নেই, নিশ্চয় মরেছে। কিন্তু হিন্দু পদ্ধতিতে বিয়ে করায় বিস্তর ঝঞ্ঝাট, তাই সিভিল ম্যারেজই স্থির করলুম। রেজিস্ট্রার লালা হনসরাজ চোপরা অতি ভাল লোক। বললেন, বারো বছর যখন কেটে গেছে তখন ভাববার কিছু নেই, স্বচ্ছন্দে বিয়ে কর। তাই আজ বিয়ে করে ফেললুম।

রামতারণবাবু বললেন, কিন্তু একটা কর্তব্য যে বাকী রয়ে গেল, পূর্বের স্বামীর শ্রাদ্ধ করা উচিত ছিল।

—তা আর বলতে হবে না সার, আমার কাজে খুঁত পাবেন না। বারো বছর পূর্ণ হবা মাত্র অচলা তার লোহা আর শাঁখা ভেঙ্গে ফেলল, সিঁদুর মুছল, থান পরল। তাকে দিয়ে দস্তুর মতন শ্রাদ্ধ করালুম, পাঁচটি ব্রাহ্মণও খাওয়ালুম। সবে তিন দিন আগে তার অশৌচান্ত হয়েছে। তার পর সিভিল ম্যারেজ চুকে যেতেই অচলা আবার সধবার লক্ষণ ধারণ করেছে। হাঁ, ভাল কথা মনে পড়ল। ও কালীবাবু এই সাতটা চপ আমি পকেটে পুরলুম, নিজে গবগবিয়ে খাব আর সহধর্মিণীকে কিচ্ছু দেব না তা তো হতে পারে না। তেমন স্বার্থপর আমি নই। বেচারী পনরো দিন নিরামিষ খেয়ে আছে। এই সাতটা চপের দামও আমি দেব।

অতুল হালদার বললেন, খুব ইণ্টারেস্টিং ইতিহাস। আমি নোট করে নিয়েছি, আমাদের হিন্দুস্থান মিরর কাগজে ছাপব। আপনার কোনও আপত্তি নেই তো জটাধরবাবু?

—কিছুমাত্র না, স্বচ্ছন্দে ছাপুন। যদি চান তো আরও ডিটেল দিতে পারি, অচলা আর আমার ফোটোও দিতে পারি।

এই সময় একটি লোক টি ক্যাবিনের দরজার কাছে এসে ভাঙা গলায় বলল, জটাধর বকশী এখানে আছে?

আগন্তুক লোকটি রোগা, বেঁটে, পরনে ময়লা খাকী প্যাণ্ট নীল জার্সি, তার উপর মোটা পট্টুর বুক খোলা কোট, হাতে একটা বড় রেঞ্চ। তার প্রশ্নের উত্তরে জটাধর বললেন, আমিই জটাধর বকশী। আপনি কে মশাই?

—তোমার যম। এই কথা বলেই লোকটি ঘরে এসে খপ করে জটাধরের হাত ধরল।

রামতারণ বললেন, কে হে তুমি এখানে এসে হামলা করছ? জান, এ হল ট্রেসপাস, ক্রিমিন্যাল কেস। নাম কি তোমার?

—আমার নাম বলহরি জোয়ারদার। আপনাদের কিছু বলছি না মশাই, আমার দরকার এই শালা জটাধরের সঙ্গে?

রামতারণ বললেন, অ্যাঁ, অবাক কাণ্ড! তুমিই অচলার ভূতপূর্ব স্বামী নাকি?

—শুধু ভূতপূর্ব নই মশাই, দস্তুর মতন জলজ্যান্ত বর্তমান স্বামী, ভবিষ্যতেও স্বামী। এই পাজী জটে শালাকে যদি জেলে না পাঠাই তো আমার নাম বলহরি জোয়ারদার নয়।

রামতারণ বললেন, আচ্ছা ফ্যাসাদ! কি হে জটাধর, এখন করবে কি?

জটাধর করুণ স্বরে বললেন, আমার সর্বনাশ হবে সার, আপনিই একটা ফয়সালা করুন। এই বলে জটাধর রামতারণের পা ধরলেন।

রামতারণ বললেন, স্থির হও জটাধর, এ সব ব্যাপারে মাথা ঠাণ্ডা রাখা দরকার। মীমাংসা তো অচলার হাতে। সে যদি বলে, এই লোকটিই তার স্বামী, তবে আর কথা নেই, তোমাকে তাই মেনে নিতে হবে। ও জোয়ারদার মশাই, আপনি অচলার সঙ্গে দেখা করেছেন?

—তা আর আপনাকে বলতে হবে না, তার কাছ থেকেই তো আসছি। আমাকে দেখে মাগী বেদম কান্না শুরু করেছে। আমি ধমক দিতে বলল, জটাইবাবুকে ডেকে আন, তাঁর অমতে কিছু করতে পারব না। ওঃ, জটাই যেন তাঁর গুরুঠাকুর।

রামতারণ বললেন, ব্যাপারটা বিশ্রী রকম জটিল হল দেখছি। অচলা যদি জটাধরের কাছেই থাকতে চায় আর বলহরি তাতে রাজী না হয় তবে তো মহাফ্যাসাদ, আদালতের ব্যাপার। কিন্তু বেআইনী কাজ তো কিছুই হয় নি। নষ্টে মৃতে প্রব্রাজতে—একটা শাস্ত্রবচন আছে না? বারো বছর কেটে গেলে রীতিমত শ্রাদ্ধশান্তির পরে অচলার পুনর্বিবাহ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভূতপূর্ব স্বামীর ফিরে আসাই অন্যায়।

কপিল গুপ্ত বললেন, এখন আর্ডেনের মতন মানে মানে সরে পড়াই উচিত ছিল।

বলহরি বলল, আহা কি কথাই বললেন মশাই, প্রাণ জুড়িয়ে গেল। নিজের স্ত্রীর কাছে আসব না তো এই জটেকে দেখে জিব কেটে পালাব নাকি?

জটাধর বললেন, আমি এই বলহরি জোয়ারদার মশাইকে খেসারত হিসেবে কিছু টাকা দিতে রাজী আছি। এখন পঞ্চাশ দিতে পারি, বাসায় গিয়ে আরও পঞ্চাশ—

বলহরি গর্জন করে বলল, চোপ রও শুয়ার, এক শ টাকায় আমার বউ কিনতে চাও? একটা পাঁঠীও ও দামে মেলে না।

কপিল গুপ্ত বললেন, ওহে জোয়ারদার, একটু বুঝে—সুঝে তম্বি ক’রো । তুমি তো তালপাতার সেপাই, জটাধরের চেহারাটি দেখছ তো? এক চড়েই তোমাকে সাবাড় করতে পারে।

—এঁঃ, চড় মারলেই হল! দেখছেন না, ব্যাটা ভয়ে কেঁচো হয়ে আছে। পাঁচটি বচ্ছর মাঞ্চুরিয়ার জাপানীদের কাছে ছিলাম মশাই, জুজুৎসুর প্যাঁচ ভাল করেই শিখেছি। তারপর চীনেদের সঙ্গে সাত বছর কাটিয়েছি। ছাড়তে কি চায়? তিনটে কমরেডকে গলা টিপে মেরে পালিয়ে এসেছি। জটাধরকে দুটি আঙ্গুলের টোকায় কাত করতে পারি। চল হতভাগা।

কাঁচপোকা যেমন প্রকাণ্ড আরশোলাকে ধরে নিয়ে যায় তেমনি বলহরি জোয়ারদার জটাধরের হাত দরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চলে গেল।

রামতারণ মুখুজ্যে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, এমন বিপদেও মানুষ পড়ে! আহা বেচারা আজ দুপুরে বিয়ে করেছে আর সন্ধ্যাবেলায় এই বিশ্রী কাণ্ড। অচলা মেয়েটার জন্যে সত্যিই দুঃখ হচ্ছে।

ম্যানেজার কালীবাবু নিবিষ্ট হয়ে হিসাব করছিলেন। এখন উচ্চস্বরে বললেন, চুলোয় যাক অচলা, আজকের খরচা দেবে কে? জটাধর তো আপনাদের বোকা বানিয়ে সরে পড়ল।

কপিল গুপ্ত বললেন, সরে পড়েছে তাতে হয়েছে কি? আমরা তো নিজের নিজের খরচে খেতে প্রস্তুতই ছিলুম। কালীবাবু, তুমি আমাদের নামে নামে বিল তৈরি কর।

কালীবাবু বললেন, কিন্তু ওই জটাধর যে নিজেই বারোটা চপ, চারখানা কেক, আর চারটে বড় পেয়ালা চা খেয়েছে, তা ছাড়া বউকে দেবে বলে সাতটা চপ পকেটে পুরেছে। মোট দাম হল ন টাকা ছ আনা। এ খরচ কে দেবে?

কপিল গুপ্ত বললেন, মোটে ন টাকা ছ আনা? দেড়খানা উপন্যাসের দাম। খরচটা আমাদের মধ্যেই চারিয়ে দাও, কি বলেন মুখুজ্যেমশাই? জটাধরের বিবেচনা আছে, বেশী ঠকায় নি।

বীরেশ্বর সিংগি বললেন, আমি তখনই বুঝেছিলাম যে ওই বলহরিই হচ্ছে জটাধরের মাসতুতো ভাই, সাতটা চপ তার পেটেই যাবে।

১৩৬১ (১৯৫৪)

* জটাধরের পূর্বকথা ‘কৃষ্ণকলি ইত্যাদি গল্প’ পুস্তকে আছে।