জগলুল সিংগুলারিটি
রিলেটিভিটির ক্লাসে প্রফেসর জগলুল হঠাৎ লক্ষ করলেন তৃতীয় বেঞ্চের মাঝামাঝি জায়গায় বসে আলাউদ্দিন গালে হাত দিয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। দেখে প্রফেসর জগলুলের একটু মেজাজ খারাপ হল। তিনি ডাকসাইটে প্রফেসর, তার ক্লাসে ছাত্ররা অমনোযোগী হবে–সে যত ভালো ছাত্রই হোক তিনি সেটা সহ্য করতে পারেন না।
ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা থামিয়ে তিনি একটু এগিয়ে গিয়ে থমথমে গলায় ডাকলেন, আলাউদ্দিন–
আলাউদ্দিন সাথে সাথে ছাদ থেকে চোখ নামিয়ে আনে, জি স্যার?
তুমি ছাদের দিকে তাকিয়ে আছ কেন?
একটা জিনিস ভাবছিলাম।
ক্লাসে তুমি অন্য জিনিস ভাবতে আস নি, ক্লাসে এসেছ আমি কী পড়াচ্ছি সেটা শুনতে।
আমি সেটাও শুনছি স্যার। শুনতে শুনতে ভাবছি।
তুমি আমার পড়া শুনছ?
জি স্যার শুনছি।
প্রফেসর জগলুল এবারে সত্যি সত্যি রেগে গেলেন; কেউ মিথ্যে কথা বললে তিনি ভীষণ রেগে যান। চোখ লাল করে ছোট একটা গর্জন করে বললেন, তুমি আমার কথা শুনছ?
আলাউদ্দিন এবারে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, জি স্যার, শুনছি।
বল দেখি ট্রান্সফর্মেশান মেট্রিক্সটা কী রকম?
বই খাতা না দেখে শুধু স্মৃতির ওপর নির্ভর করে ট্রান্সফর্মেশান মেট্রিক্সটা বলা সম্ভব নয় কিন্তু আলাউদ্দিন মোটেও বিচলিত না হয়ে বলতে শুরু করল এবং কিছুক্ষণ শুনেই প্রফেসর জগলুল বুঝতে পারলেন আলাউদ্দিন ঠিকই বলছে। এতে তার রাগ আরো বেড়ে গেল, তিনি আরো জোরে গর্জন করে বললেন, আগে থেকে পড়ে এসে ক্লাসে বিদ্যা ফলানো ক্লাস এটেন্ড করা নয়। ক্লাসে এলে মনোযোগ দিতে হবে।
আলাউদ্দিন একটু বিব্রত হয়ে নিচু গলায় বলল, আমি মনোযোগ দিচ্ছি স্যার।
না তুমি মনোযোগ দিচ্ছ না। তুমি ছাদের দিকে তাকিয়ে আছ। আমি ক্লাসে কী বলছি তুমি শুনছ না, কী লেখছি তুমি দেখছ না।
দেখছি স্যার। এই দেখেন স্যার আমার খাতায় সব লেখা আছে। তাছাড়া
তাছাড়া কী?
আমি মনোযোগও দিচ্ছি স্যার। যেমন স্যার আপনি ব্ল্যাকবোর্ডে দুই নাম্বার লাইনে ইকুয়েশানটা ভুল লিখেছেন। ইনডেক্সগুলো উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে। ছয় নাম্বার লাইনে এসে আবার ভুল করেছেন, সেই ভুলটা আগের ভুলটাকে শুদ্ধ করে দিয়েছে। সাত নাম্বার লাইন থেকে ইকুয়েশানটা আবার শুদ্ধ হয়েছে। যদি সেটা না হত ইমাজিনারি উত্তর আসত।
প্রফেসর জগলুল বোর্ডের দিকে তাকালেন, ভুলটা চোখে পড়তে তার অনেকক্ষণ সময় লাগল, এবং যখন সেটা তার চোখে পড়ল তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন, তার মুখে হঠাৎ রক্ত উঠে এল এবং লজ্জায় তার কান ঝা ঝা করতে লাগল। তিনি ডাস্টার দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডের লেখা মুছে শুদ্ধ করতে করতে বিড়বিড় করে বললেন, আমার নোটবইয়ে ঠিকই লেখা রয়েছে, বোর্ডে তুলতে ভুল হয়েছে।
আলাউদ্দিন হাসি–হাসি মুখ করে না–সূচকভাবে মাথা নাড়ল, প্রফেসর জগলুল সেটা দেখতে পেলেন না, কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, বস।
স্যার আমি কী ভাবছিলাম সেটা কি আপনাকে একটু বলতে পারি?
প্রফেসর জগলুল থমথমে গলায় বললেন, আমি ক্লাসে অন্য জিনিস নিয়ে কথা বলা পছন্দ করি না।
এটা অন্য জিনিস না স্যার। রিলেটিভিটির একটা ব্যাপার। স্পেস টাইম কন্টিনিউয়ামের একটা সহজ ইকুয়েশান—
প্রফেসর জগলুল তাকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি সেটা নিয়ে অন্য সময় কথা বোলো
আলাউদ্দিনের মুখে একটা আশাভঙ্গের ছাপ পড়ে, সে সেটা গোপন করার চেষ্টা করতে করতে নিজের জায়গায় বসে পড়ল। প্রফেসর জগলুল আবার বোর্ডে লিখতে শুরু করলেন, খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে আর পড়াতে পারছেন না, আলাউদ্দিন তার মেজাজটাকে একটু খিঁচড়ে দিয়েছে। প্রতিভাবান ছাত্ররা সাধারণত শিক্ষকদের প্রিয় হয়, কিন্তু সেই প্রতিভাটা যদি শিক্ষকদের দৈনন্দিন জীবনের জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়ায় তখন ছাত্রটির মাঝে ভালো লাগার কিছু খুঁজে পাওয়া কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আলাউদ্দিন নামক এই সাদাসিধে গোবেচারা ধরনের ছাত্রটির বিরুদ্ধে তিনি এক ধরনের বিজাতীয় বিদ্বেষ অনুভব করতে লাগলেন।
.
দুপুরবেলা সাধারণত ক্লাস–সেমিনার থাকে না, তখন প্রফেসর জগলুল জার্নাল নিয়ে বসেন। নতুন কী কাজ হয়েছে খোঁজখবর নেন, নিজের রিসার্চের কাজকর্ম করেন। তিনি তাত্ত্বিক মানুষ, বেশিরভাগ কাজই কাগজ আর কলম নিয়ে বসে থাকা। আজকেও কাগজ কলম নিয়ে বসেছেন ঠিক এ রকম সময় দরজায় আলাউদ্দিন এসে দাঁড়াল। ছোটখাটো চেহারা, মাথার চুল এলোমেলো, চোখে সস্তা ফ্রেমের চশমা, শার্টটা একটু লম্বা, পায়ে স্যান্ডেল–দেখেই বোঝা যায় নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। চোখে হয়তো বুদ্ধির ছাপ আছে, থাকলেও সেটা মোটা চশমার আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে। আলাউদ্দিন দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, আসতে পারি স্যার?
প্রফেসর জগলুলের ভুরু কুঞ্চিত হল, তিনি একবার ভাবলেন বলবেন না। কিন্তু বলতে পারলেন না। একজন শিক্ষককে সবসময় তার ছাত্রদের কাছে আসতে দিতে হয়। তিনি সরাসরি তাকে আসতেও বললেন না, জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার?
একটা জিনিস নিয়ে একটু আলাপ করতে চাইছিলাম।
কী জিনিস?
স্পেস টাইম কন্টিনিউয়ামের একটা ইকুয়েশান। আমি লিখে এনেছি, একটু যদি দেখে দেন।
প্রফেসর জগলুল বিরক্ত গলায় বললেন, নিয়ে এস।
আলাউদ্দিন একটু বিব্রত ভঙ্গিতে এগিয়ে এল। তার হাতে একটা বাঁধানো খাতা, সেই খাতাটা টেবিলের উপর রেখে বলল, এই যে ইকুয়েশানটা আছে স্যার, তার দুইটা সলিউশান। একটা আপনি ক্লাসে পড়িয়েছেন, আরেকটা অবাস্তব বলে বাদ দিয়েছেন।
হুঁ। কী হয়েছে তাতে?
যেই সলিউশানটা আপনি বাদ দিয়েছেন আমি সেটা দেখছিলাম স্যার। আমার মনে হয় সেটা অবাস্তব সলিউশান না
অবাস্তব না?
না স্যার। সময় সম্পর্কে আমাদের যেই ধারণা সেই ধারণার সাথে মিলছে না বলে আমরা বলছি এটা অবাস্তব। কিন্তু আমরা যদি সময় সম্পর্কে অন্য একটা ধারণা নিই। তাহলে–
অন্য ধারণা?
জি স্যার। এই দেখেন আমি ক্যালকুলেশান করেছি।
আলাউদ্দিন খাতাটি খুলে ধরল এবং ভিতরে তার টানা হাতে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জটিল অঙ্ক দেখে প্রফেসর জগলুল ভিতরে ভিতরে হতবাক হয়ে গেলেও বাইরে সেটা প্রকাশ করলেন না। চোখেমুখে বিরক্তি মেশানো প্রচ্ছন্ন একটা বিদ্রূপের ভাব ধরে রাখলেন। নিরুৎসুক গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কী ক্যালকুলেশান?
ক্যালকুলেশানটা দেখলেই বুঝবেন স্যার, তবে আমি এমনি বলে দিই। আমাদের ধারণা সময় আগে অতীত থাকে, তারপর বর্তমানে আসে, সেখান থেকে ভবিষ্যতে যায়।
সে ধারণাটা সত্যি না?
সত্যি না আবার সত্যি–আলাউদ্দিন দাঁত বের করে একটু হাসল। প্রফেসর জগলুল এবারে একটু রেগে গেলেন, বললেন, কী বলতে চাইছ পরিষ্কার করে বল।
বলছি যে স্পেস যেরকম পুরোটা একসাথে রয়েছে, সময় সেরকম পুরোটা একসাথে রয়েছে। অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ পুরোটা।
পুরোটা? প্রফেসর ভুরু কুঁচকে বললেন, পুরোটা?
আলাউদ্দিন একটু থতমত খেয়ে বলল, জি স্যার পুরোটা। এই যে দেখেন স্যার এইখানে ক্যালকুলেশান করেছি।
প্রফেসর জগলুল জটিল সমীকরণটির দিকে তাকিয়েই হঠাৎ করে বুঝে গেলেন আলাউদ্দিন কী বলতে চাইছে এবং তিনি ভীষণভাবে চমকে উঠলেন। এই সাদাসিধে ছেলেটি একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার করে ফেলেছে কিন্তু সে নিজে সেটা নিশ্চয়ই জানে না। প্রফেসর জগলুল তার চেহারায় কিছু বুঝতে দিলেন না। বিরক্তি মেশানো প্রচ্ছন্ন বিদ্রুপের ভাবটা ধরে রেখে একটু রাগ–রাগ চোখে আলাউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আলাউদ্দিন একটু বিব্রত হয়ে খানিকটা লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, আমার ক্যালকুলেশান বলছে এখন যেটা অতীত সেটা যখন বর্তমানে চলে আসবে, তখন আমরা বর্তমান থেকে ভবিষ্যতে চলে যাব। কাজেই এখন যেটা অতীত সেটাকে কখনই আমরা দেখব না! ঠিক সেরকম এখন যেটা ভবিষ্যৎ সেটাও আমরা কখনো দেখব না–কারণ আমরা যখন ভবিষ্যতে যাব তখন যেটা ভবিষ্যতে আছে সেটা আরো ভবিষ্যতে চলে যাবে। কাজেই যদিও পুরো সময়টাই বর্তমান, আমরা আমাদের নিজেদের সময় ছাড়া কোনোটা দেখতে পাব না। যদিও অন্য সময়ের জন্যে হয়তো অন্য জগৎ রয়েছে, অন্য স্পেস রয়েছে
অন্য স্পেস রয়েছে?
হয়তো রয়েছে।
অন্য সময়ও আছে?
জি স্যার।
কিন্তু কখনো দেখতে পাব না?
না স্যার। আলাউদ্দিন মাথা চুলকে বলল, মনে হয় পারব না।
প্রফেসর জগলুল ভিতরে ভিতরে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে এক ধরনের প্রবল উত্তেজনা অনুভব করতে থাকেন কিন্তু বাইরে নিস্পৃহ ভাবটা ফুটিয়ে রাখলেন। সম্পূর্ণ নিরাসক্ত গলায় বললেন, যে জিনিস প্রমাণ করা যায় না তবু বিশ্বাস করতে হয় সেটাকে বিজ্ঞান বলে না, সেটাকে বলে ধর্মশাস্ত্র। ধর্মে বলা হয় খোদাকে কেউ দেখতে পাবে না তবু তাকে বিশ্বাস। করতে হয়, তুমিও বলছ একই সাথে অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যৎ রয়েছে কিন্তু কেউ দেখতে পাবে না তবুও বিশ্বাস করতে হবে
আলাউদ্দিন মাথা চুলকে বলল, কিন্তু আমি তো সেটা এমনি এমনি বলছি না, একটা ইকুয়েশানের সলিউশান থেকে বলছি। খোদার অস্তিত্ব নিয়ে তো কোনো ইকুয়েশান নেই–
উত্তরে প্রফেসর জগলুল বলার মতো কিছু পেলেন না বলে বিরক্তি এবং অসহিষ্ণুতার ভঙ্গি করে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ফিজিক্স হচ্ছে এক ধরনের বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের প্রথম কথাই হচ্ছে তার সব থিওরি পরীক্ষা করে দেখা যাবে। যে বিজ্ঞানের থিওরি পরীক্ষা করা যায় না সেটা নিয়ে মাথা ঘামানো হচ্ছে সময় নষ্ট।
প্রফেসর জগলুলের রূঢ় উত্তরে জালাউদ্দিনের খুব আশাভঙ্গ হল এবং সে সেটা গোপন করার কোনো চেষ্টা করল না। একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, স্যার, তবু আমার খাতাটা একটু দেখবেন? ক্যালকুলেশানে কোথাও কোনো ভুল আছে কি না।
প্রফেসর জগলুল টেবিল থেকে একটা জার্নাল টেনে নিতে নিতে শীতল গলায় বললেন, ঠিক আছে রেখে যাও। যদি সময় হয় দেখব।
আলাউদ্দিন খাতাটা তার টেবিলের উপর রেখে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। যতক্ষণ সে ঘর থেকে পুরোপুরি বের হয়ে না গেল প্রফেসর জগলুল জার্নালের দিকে তাকিয়ে রইলেন, কিন্তু সে বের হওয়ার সাথে সাথে তিনি আলাউদ্দিনের খাতার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। উত্তেজনায় তিনি নিশ্বাস নিতে পারছেন না, তার চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকে। তিনি লোভাতুর দৃষ্টিতে খাতার পৃষ্ঠা উল্টান, এখানে যে পরিমাণ কাজ করা হয়েছে সেটা দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফিজিক্যাল রিভিউয়ে তিন থেকে চারটা পেপার হয়। এটা প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের মাঝে হইচই পড়ে যাবার কথা। অনেকদিন থেকে তিনি সেরকম কোনো কাজ করছেন না। এই একটা কাজ দিয়েই তিনি সারা পৃথিবীতে একটা আলোড়ন তৈরি করে ফেলতে পারবেন।
প্রফেসর জগলুল আলাউদ্দিনের খাতার পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে বুকের ভিতরে ঈর্ষার এক ধরনের তীব্র খোঁচা অনুভব করতে থাকেন। এই জটিল অঙ্কগুলো আঠার–উনিশ বছরের একটি ছেলের কাজ, ব্যাপারটা তার বিশ্বাস হতে চায় না। তিনি ঘুঁটিয়ে ঘুঁটিয়ে দেখেন এবং কিছুক্ষণের মাঝেই তিনি নিঃসন্দেহ হয়ে যান আলাউদ্দিন যেটা বলেছে সেটা সত্যি, স্পেস যেরকম একই সাথে পুরোটুকু ছড়িয়ে আছে, সময়ও সেরকম একই সাথে পুরোটা ছড়িয়ে আছে। সময়ের প্রত্যেকটা বিন্দু থেকে সবকিছু ভবিষ্যতে এগিয়ে যাচ্ছে তাই কেউ কারো খোঁজ পাচ্ছে না। কোনোভাবে কেউ যদি হঠাৎ এক বিন্দু থেকে অন্য বিন্দুতে উপস্থিত হয়, সে দেখবে পুরোপুরি ভিন্ন এক জগৎ! প্রফেসর জগলুল লম্বা একটা নিশ্বাস নিলেন, এর একটা সুন্দর নাম দিতে হবে, সেই নাম নিয়ে তিনি পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়ে যাবেন।
প্রফেসর জগলুল আলাউদ্দিনের খাতাটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, কেউ দেখার আগে পুরো খাতাটা গোপনে ফটোকপি করে নিতে হবে। মাস তিনেক পর অস্ট্রেলিয়াতে একটা কনফারেন্স আছে, মনে হয় সেটাতেই প্রথম পেপারটা দেয়া যায়। আলাউদ্দিন যেন কিছুতেই জানতে না পারে, সেটা অবশ্যি সমস্যা হবার কথা নয়, এখানে জার্নাল পেপার এসব বলতে গেলে প্রায় আসেই না।
.
তিন দিন পরে আলাউদ্দিন তার খাতা ফেরত নিতে এল। প্রফেসর জগলুল ভান করলেন কী খাতা কী বৃত্তান্ত তিনি সব ভুলে গেছেন। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে হঠাৎ মনে পড়েছে এ রকম ভান করে বললেন, ও, তোমার সেই অবাস্তব সলিউশানের ক্যালকুলেশান?
জি স্যার। দেখেছিলেন?
ঘুঁটিয়ে দেখার সময় পাই নি, শুধু চোখ বুলিয়ে দেখেছি এক দিন। ট্রিটমেন্ট তো পুরোনো। আজকাল এই ক্যালকুলেশান কেউ টেনসর দিয়ে করে না, ডায়াডিক দিয়ে করে।
কিন্তু স্যার সলিউশানটা?
প্রফেসর জগলুল ঘাড় বাঁকালেন, বললেন যে জিনিস কোনোদিন পরীক্ষা করা যাবে না সেটা থাকলেই কী আর না থাকলেই কী। একটা ইকুয়েশানের তো কতই সলিউশান থাকে, একটা ফেজ লাগিয়ে দিলেই তো নতুন সলিউশান। নতুন সলিউশান মানে তো আর নতুন ফিজিক্স না। যাই হোক, আমি বলি কী–
কী স্যার? আলাউদ্দিন আগ্রহ নিয়ে তাকাল।
সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। এইসব বড় বড় জিনিস বাদ দিয়ে পড়াশোনা কর। ভালো একটা রেজাল্ট করতে পারলে অনেক কাজ হবে।
আলাউদ্দিন খুব মনমরা হয়ে তার খাতাটা নিয়ে বের হয়ে গেল।
প্রফেসর জগলুল পরের এক সপ্তাহ রাত জেগে কাজ করে একটা পেপার দাঁড়া করালেন। তার নিজের সত্যিকার কোনো কাজ করতে হল না, পুরোটা করে রেখেছে। আলাউদ্দিন। তার কাজ হল ব্যাপারটা প্রকাশ করার জন্যে লেখাটা দাঁড় করানো কিছু টেবিল, দুটো ফিগার এবং পেপারের শেষে একগাদা রেফারেন্স। ব্যাপারটা নিয়ে পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের মাঝে কী রকম হইচই পড়ে যাবে এবং তিনি কেমন করে এক ইউনিভার্সিটি থেকে অন্য ইউনিভার্সিটিতে সেমিনার দিয়ে দিয়ে বেড়াবেন সেটা চিন্তা করে তার চোখমুখ আনন্দে ঝলমল করতে থাকে।
.
সপ্তাহ দুয়েক পরে এক ভোরবেলায় আলাউদ্দিন প্রফেসর জগলুলের ঘরে হাজির হল, তার হাতে সেই খাতা এবং চোখেমুখে এক ধরনের উত্তেজনা। তার চুল উষ্কখুষ্ক এবং চোখের নিচে কালি। দেখে মনে হয় সারারাত ঘুমায় নি। দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, আসতে পারি স্যার?
প্রফেসর জগলুল ভিতরে ভিতরে কৌতূহলী হয়ে উঠলেও মুখে নিরাসক্ত ভাবটা ধরে রেখে গলার স্বরে প্রচ্ছন্ন একটু বিরক্তি এবং অসহিষ্ণুতা ফুটিয়ে বললেন, কী ব্যাপার?
আলাউদ্দিন এগিয়ে এসে বলল, স্যার মনে আছে আপনি বলেছিলেন–যে থিওরি এক্সপেরিমেন্ট করে পরীক্ষা করা যায় না তার কোনো মূল্য নেই?
প্রফেসর জগলুল হাই তোলার মতো ভঙ্গি করে বললেন, বলেছিলাম নাকি? মনে নেই আমার।
জি স্যার। আপনি বলেছিলেন। বলেছিলেন যে থিওরি এক্সপেরিমেন্ট করে প্রমাণ করা যায় না সেটা হচ্ছে ধর্মশাস্ত্র।
প্রফেসর জগলুল ভুরু কুঁচকে বললেন, কী হয়েছে তাতে?
আমি স্যার একটা এক্সপেরিমেন্ট বের করেছি। একটা উপায় আছে এক্সপেরিমেন্ট করার।
প্রফেসর জগলুলের হৃৎস্পন্দন প্রায় থেমে গেল। বলে কী ছেলেটা? সাদাসিধে চেহারার এই ছেলেটা বাজে কথার মানুষ না সেটা তিনি এতদিনে বেশ ভালো করে বুঝে গেছেন। সত্যি যদি সে এই তত্ত্বটার এক্সপেরিমেন্ট দাঁড় করিয়ে থাকে তাহলে একটা নোবেল প্রাইজ কেউ আটকাতে পারবে না। তিনি জ্বলজ্বলে চোখে নিশ্বাস বন্ধ করে আলাউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন, এই ছেলেটার কারণে একটা নোবেল প্রাইজ তার ধরাছোঁয়ার ভিতরে চলে এসেছে–সেটা যেন কিছুতেই হাতছাড়া না হয়। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা করতে হবে খুব সাবধানে। আলাউদ্দিন যেন কিছুতেই বুঝতে না পারে। প্রথমে ব্যাপারটা তার কাছ থেকে বের করে আনতে হবে তারপর অন্য কিছু। একবার প্রাইজটা পেয়ে যাবার পর এই ছেলে যতই চেঁচামেচি করুক কেউ বিশ্বাস করবে না। উনিশ-বিশ বছরের একটা ছাত্রের কথা কে বিশ্বাস করবে? যদি সেরকম ঝামেলা দেখা যায় তাহলে অন্য কিছু ব্যবস্থা করা যাবে। আজকাল টাকা দিয়ে কত কী করে ফেলা যায় আর একজন মানুষকে সরিয়ে দেয়া এমন কী কঠিন ব্যাপার? কিন্তু সেটা নিয়ে মাথা গরম করে কী হবে? তার জন্যে অনেক সময় পাওয়া। যাবে।
আলাউদ্দিন আবার বলল, স্যার, দেখবেন আমার ক্যালকুলেশানটা?
দেখার জন্যে প্রফেসর জগলুলের সমস্ত শরীর বুক চোখ হা হা করতে থাকে কিন্তু তিনি জোর করে মুখে নিরাসক্ত ভাবটা ধরে রাখলেন, ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আমার একটা ক্লাস রয়েছে এখন তো পারব না। যদি চাও তো খাতাটা রেখে যেতে পার, সময় পেলে দেখব।
তাহলে স্যার আপনাকে একটু বলি?
প্রফেসর জগলুল ইচ্ছে করে একবার ঘড়ির দিকে তাকালেন, তার সময় খুব মূল্যবান ব্যাপারটি আলাউদ্দিনকে খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, কী বলবে তাড়াতাড়ি বল।
স্যার মনে আছে আপনাকে বলছিলাম স্পেস যেরকম ছড়ানো, টাইম বা সময় ঠিক একইভাবে ছড়ানো? এই মুহূর্তে যেরকম অতীত আছে সেরকম বর্তমানও আছে?
আলাউদ্দিন কী বলছে প্রফেসর জগলুলের বুঝতে কোনো অসুবিধে হল না কিন্তু তিনি –বোঝার ভান করে বললেন, বলে যাও–
স্পেসে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হলে সবসময় খানিকটা সময় অতিক্রম করতে হয়। ঠিক সেরকম এক সময় থেকে অন্য সময় যেতে হলে খানিকটা স্পেস অতিক্রম করতে হবে।
কতটুকু স্পেস?
আলাউদ্দিনের চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকে। সে নিশ্বাস নিয়ে বলল, বিশাল স্পেস। বিলিয়ন বিলিয়ন মাইল। কিন্তু
কিন্তু কী?
আমি ক্যালকুলেশান করে দেখেছি এই স্পেস টাইমের কন্টিনিউয়ামে দুইটা সিংগুলারিটি রয়েছে।
জি স্যার, একটা সিংগুলারিটিতে কখনো যাওয়া যাবে কি না সন্দেহ আছে কিন্তু আরেকটায় মনে হয় সহজে যাওয়া যাবে। গতিবেগ বাড়াতে বাড়াতে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে হঠাৎ করে এক্সেলেরেশানটা একটা নির্দিষ্ট টাইমে পাল্টে দিতে হবে, তারপর আবার
উত্তেজনায় প্রফেসর জগলুলের হৃৎপিণ্ড প্রায় থেমে গেল কিন্তু তিনি আলাউদ্দিনকে কিছু বুঝতে দিলেন না। উঠে দাঁড়িয়ে একটা ছোট হাই তুলে বললেন, বেশ বেশ ভালো এক্সারসাইজ করেছ। এখন একটু পড়াশোনা কর, সামনের সপ্তাহে একটা মিডটার্ম দিয়েছি মনে আছে তো?
আলাউদ্দিনের মুখে স্পষ্ট একটা আশাভঙ্গের ছাপ পড়ল। সে ম্লান মুখে বলল, আমি অনেকবার ক্যালকুলেশানটা দেখেছি, কোনো ভুল নেই স্যার, শুধু এক্সেলেরেশান কন্ট্রোল করে একটা জিনিসকে অল্প একটু ভবিষ্যতে পাঠানো যাবে। একবিন্দু ভবিষ্যৎ কিন্তু সেখান থেকে আর ফিরে আসবে না আর দেখা হবে না–
প্রফেসর জগলুল টেবিল থেকে একটা বই নিয়ে হেঁটে বের হয়ে যাবার ভান করে বললেন, তোমরা মনে হয় পাঠ্যবই না পড়ে আজেবাজে সায়েন্স ফিকশান পড়। সায়েন্স আর সায়েন্স ফিকশান এক জিনিস না।
খাতাটা রেখে যাব স্যার? একটু দেখবেন স্যার?
ঠিক আছে রেখে যাও। সময় পেলে দেখব। আমার তো তোমাদের মতো সময় নেই। কত কাজকর্মে ব্যস্ত থাকতে হয় জন।
প্রফেসর জগলুল ঘর থেকে বের হয়ে আলাউদ্দিনকে চলে যাবার সময় দিয়ে প্রায় সাথে সাথেই ফিরে এসে আলাউদ্দিনের খাতাটার উপরে ঝুঁকে পড়লেন। তার হৃৎপিণ্ড ধকধক শব্দ করতে থাকে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, উত্তেজনায় তিনি নিশ্বাস নিতে পারছেন না। একটা নোবেল প্রাইজ তার হাতের মুঠোয় চলে এসেছে, কেউ আর সেটা আটকাতে পারবে না। কেউ না! আলাউদ্দিন যে সিংগুলারিটির কথা বলেছে সেটার নাম হবে জগলুল সিংগুলারিটি! বিজ্ঞানের ইতিহাসে পাকাঁপাকিভাবে তার নাম সোনার অক্ষরে লেখা হয়ে যাবে।
.
বেশ রাতে প্রফেসর জগলুল বাসায় ফিরে যাচ্ছেন, বহুদিনের পুরোনো লক্কড়–ঝক্কড় একটা ভক্সওয়াগন গাড়ি, কোনোমতে এখনো চলছে। আর কয়দিন, তারপর এই তুচ্ছ গাড়ির কথা আর চিন্তা করতে হবে না। কে জানে টাইম নিউজউইক পত্রিকায় এই লক্কড়–ঝক্কড় গাড়ি নিয়েই তার ছবি ছাপা হবে, বিশাল প্রতিবেদন ছাপা হবে! প্রফেসর জগলুল অন্ধকারে দাঁত বের করে হাসলেন।
ইউনিভার্সিটি থেকে বের হয়ে প্রফেসর জগলুল ডান দিকে ঘুরে গেলেন। রাস্তাটা খারাপ, তাকে খুব সাবধানে গাড়ি চালাতে হয়। গাড়ি চালাতে চালাতে তিনি আলাউদ্দিনের এক্সপেরিমেন্টের কথা ভাবতে লাগলেন, সে যে এক্সপেরিমেন্টের কথা বলেছে সেটা খুবই সহজ। একটা বস্তুকে নির্দিষ্ট ত্বরণে এগিয়ে নিয়ে ত্বরণকে পরিবর্তন করতে হয়, নির্দিষ্ট সময় পর আবার। যদি ত্বরণের পরিবর্তনের সাথে সময়ের একটা সামঞ্জস্য রাখা যায় তাহলেই স্পেস টাইমের সেই সিংগুলারিটিতে পা দেয়া যায়, যেটাকে আর কয়দিন পরেই বলা হবে জগলুল সিংগুলারিটি! সেই জগলুল সিংগুলারিটি দিয়ে বস্তু বের হয়ে চলে যায় ভিন্ন জগতে এক চিলতে সময় সামনে। মাত্র এক চিলতে সময় কিন্তু সেই সময়ের সাথে এই সময়ের কোনো যোগাযোগ নেই।
পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করে প্রফেসর জগলুল মনে মনে হাসলেন। যখন তিনি পৃথিবীর নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে জগলুল সিংগুলারিটির ওপর সেমিনার দেবেন তখন তিনি ব্যাপারটি নিয়ে। রসিকতা করবেন। বলবেন, মনে কর কেউ গাড়ি করে যাচ্ছে। ফাঁকা রাস্তা তাই এক্সেলেটরে চাপ দিয়েছে, হঠাৎ দেখল সামনে একটা স্পিড বাম্প। ব্রেক কষার আগেই গাড়ি লাফিয়ে উঠল উপরে, তারপর নেমে আসল নিচে, ধাক্কা খেয়ে গাড়ি চলে গেল বামে, কোনোমতে ব্রেক কষতেই গাড়ি ঝাঁকুনি দিয়ে থামতে গেল–হঠাৎ করে দেখবে গাড়ি পা দিয়েছে জগলুল সিংগুলারিটিতে। স্পেস টাইমের ফুটো দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে অন্য জগতে–
হঠাৎ করে প্রফেসর জগলুল চমকে উঠলেন। রাস্তার পাশে দিয়ে মাথা নিচু করে হেঁটে যাচ্ছে আলাউদ্দিন, এক হাতে ধরে রাখা অনেকগুলো বইপত্র, মাথা নিচু করে হাঁটছে– পৃথিবীর কোনো কিছুতে তার কোনো খেয়াল আছে বলে মনে হয় না। প্রফেসর জগলুলের বুকের ভিতর হঠাৎ রক্ত ছলাৎ করে উঠল, গাড়িটা বাম পাশে ঘেঁষে আলাউদ্দিনকে একটা ধাক্কা দিলে কেমন হয়, ছিটকে পড়বে নিচে, তখন বুকের ওপর দিয়ে চালিয়ে নেবেন গাড়িটা–তার নোবেল প্রাইজের একমাত্র প্রতিবন্ধক শেষ হয়ে যাবে চোখের পলকে।
প্রফেসর জগলুল পিছনে তাকালেন, এই রাস্তাটা নির্জন এমনিতে লোকজন গাড়ি রিকশা থাকে না, আজকে আরো কেউ নেই। আলাউদ্দিনকে শেষ করার এই সুযোগ! পৃথিবীর কেউ জানতে পারবে না। প্রফেসর জগলুলের নিশ্বাস দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে আসে, স্টিয়ারিং হুইল শক্ত করে ধরে রেখে তিনি এক্সেলেটরে চাপ দিলেন। তার লক্কড়–ঝক্কড় ভক্সওয়াগনটি হঠাৎ গর্জন করে ছুটে গেল সামনে, আঘাত করল আলাউদ্দিনকে, দেখতে পেলেন ছিটকে যাচ্ছে সে, ব্রেক কষলেন একবার তারপর স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়িটাকে ঘুরিয়ে নিতে। পিষে
ফেলতে হবে আলাউদ্দিনকে, শেষ করে দিতে হবে একমাত্র সমস্যাটিকে!
কিছু একটাতে তিনি আঘাত করলেন এবং হঠাৎ করে মনে হল তিনি পড়ে যাচ্ছেন। চমকে উঠে তিনি স্টিয়ারিং হইলটাকে শক্ত করে ধরে রাখলেন। অবাক হয়ে দেখলেন তার সামনে রাস্তা, রাস্তার পাশে দোকানপাট, লাইটপোস্টের হলুদ আলো, রাস্তায় ছিটকে পড়ে থাকা আলাউদ্দিনের শরীর সবকিছু অদৃশ্য হয়ে গেছে। চারদিকে কুয়াশার মতো এক ধরনের অতিপ্রাকৃত আলো, সেই আলোতে যতদূর দেখা যায় কোথাও কিছু নেই, চারদিকে শুধু শূন্যতা। এক ভয়াবহ শূন্যতা।
প্রফেসর জগলুল কাঁপা হাতে গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করতেই এক ভয়ঙ্কর নৈঃশব্দ্য নেমে এল। কোথাও কোনো শব্দ নেই, শুধু তার হৃৎপিণ্ড ধকধক শব্দ করছে। এই ঘোট হৃৎপিণ্ড এত জোরে শব্দ করে কে জানত।
প্রফেসর জগলুল গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে স্থাণুর মতো বসে রইলেন। আলাউদ্দিনকে মারতে গিয়ে তিনি জগলুল সিংগুলারিটিতে পা দিয়ে ফেলেছেন।
পৃথিবীর মানুষ আর কোনোদিন জগলুল সিংগুলারিটির কথা জানতে পারবে না!