জং বাহাদুর সিংহর নাতি – ৫

সামনের উঠোনে দাঁড়িয়ে হাঁ করে দৃশ্যটা দেখছিল বীরু। ফটক পেরিয়ে দুলকি চালে রঘুনাথ আসছে। তার ডান কাঁধে পাট করা চাদরের মতো ঝুলে আছে একটা লোক।

হাঁ বন্ধ করতে বেশ একটু সময় লাগল বীরুর। তারপর বলল, “এসব কী হচ্ছে রঘুনাথ? কাকে কাঁধে করে নিয়ে এলে?”

“আজ্ঞে, পথে কুড়িয়ে পেয়েছি। নিয়ে এলাম।” “কুড়িয়ে পেয়েছ?”

“যে আজ্ঞে। মাথায় একটু চোট হয়ে মূর্ছা গেছে।’

লোকটাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে চাতালে রাখা একখানা চেয়ারে হেলিয়ে বসিয়ে দিয়ে রঘুনাথ বলে, “চোট বেশি নয়।”

লোকটার মুখ দেখে বীরু চমকে উঠে বলল, “আরে! এ তো আমাদের মহাদেব!”

“চেনেন নাকি কর্তা?”

“চিনি মানে! এ তো আমাদের রাসুখুড়ির ভাইপো। আমরা একসঙ্গে পড়েছি। খুব বন্ধু ছিল আমার! মহাদেব যাত্রা করে বেড়ায় বলে রাসুখুড়ির খুব দুঃখ ছিল। কী হয়েছে ওর?”

“মরেই যাচ্ছিলেন। অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছেন কর্তা। শ্রীনাথ সাপুড়ে ওঁর গায়ে কেউটে সাপ ছেড়ে দিয়েছিল।” “সে কী! কেন?”

“নববাবুর যোগসাজশ। শ্রীনাথ গরিব মানুষ। তার প্রাণের দায়ও

আছে, পেটের দায়ও আছে।”

“কিন্তু মহাদেবকে মেরে নবকুমারের কী লাভ?”

“রাসমণি যে তার বিষয়সম্পত্তি সব মহাদেবকেই দিয়ে গেছে। সেই সব সম্পত্তি জবরদখল করে নিয়েছে কর্নেলসাহেব আর নববাবুর গুন্ডারা। পাকেচক্রে মহাদেব এসে পড়ায় তারা বিপদের গন্ধ পেয়েই এ কাজ করেছে।”

বীরু দুর্বল গলায় মিনমিন করে বলে, “এটা তো খুব অন্যায়।”

“যে আজ্ঞে, আপনার বন্ধুটি এখন বেশ বিপদের মধ্যে আছেন।

একে নিকেশ না করলে নববাবু নিষ্কণ্টক হতে পারবে না। নবকুমারের গুন্ডারা বেশিক্ষণ চুপচাপ থাকবে বলে মনে হয় না। এসে পড়ল বলে।”

বীরু তেতো গলায় বলে, “এ তো বড় ঝঞ্ঝাট হল হে?” “যে আজ্ঞে।”

“এখন আমাদের কী করা উচিত রঘুনাথ?”

“আপনি যা বলেন। আপনি হুকুম করলে মহাদেববাবুকে ফের রাস্তাতেই ফেলে রেখে আসতে পারি।”

“সেটা করা কি উচিত হবে রঘুনাথ? শত হলেও মহাদেব আমার ছেলেবেলার বন্ধু।”

“যে আজ্ঞে।”

বীরু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “এ তো বড় বিপদেই পড়া গেল। বাপু হে রঘুনাথ, তুমি মাঝে মাঝেই আমাকে বড় মুশকিলে ফেলে দাও।”

“যে আজ্ঞে, কর্তা যদি এই লাঠিখানা একটু ধরেন তা হলে আমি লোকটার চোখেমুখে খানিক জলের ঝাপটা দিই।”

ঘোর অন্যমনস্কতায় হাত বাড়িয়ে লাঠিটা নিল বীরু। তারপরই হঠাৎ চমকে উঠল। লাঠিটা কি একটা ঝটকা মারল নাকি তাকে?

চোখমুখে জলের ঝাপটা খেয়ে চোখ চেয়ে খানিকক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল মহাদেব। ক্ষীণ গলায় বলল, “আমি কোথায়? আমার কী হয়েছে!”

বীর বাহাদুর কাছে গিয়ে ঝুঁকে বলল, “আমাকে চিনতে পারছিস মহাদেব? আমি বীরু।”

মহাদেব হাঁ করে কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে চেয়ে থেকে সোজা হয়ে বসে বলল, “তাই তো! তুই তো বীরু! তোর কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম!”

তারপর চারদিকে টালুমালু চোখে চেয়ে দেখে ফের মহাদেব বলল, “এটা তো তোর বাড়ি, তাই না! আমি এখানে কী করে এলাম?”

“সে অনেক কথা। তোর কী হয়েছিল বলবি?”

মহাদেব ক্লান্তিতে চোখ বুজে রইল খানিক। তারপর হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠে বলল, “আমার বড় বিপদ যাচ্ছে রে ভাই। পাশের গাঁ ফুলপুকুরে কাল যাত্রা ছিল। পাবলিক খেপে গিয়ে তাড়া করায় পালিয়ে এসেছিলাম। এখানে এসেই জানলাম, পিসি নাকি বিষয়সম্পত্তি সব আমাকে দিয়ে গেছে। আর তারপরেই রাজবাড়ির কালীমন্দিরে আমার গায়ে কেউটে সাপ ছেড়ে দেওয়া হল। বরাতজোরে বেঁচে গেলেও আর একটা গুন্ডা এসে আমাকে পাকড়াও করে গাঁয়ের বাইরে বের করার নাম করে নিয়ে যেতে গিয়ে পিছন থেকে লাঠির ঘা মেরে…”

রঘুনাথ তাড়াতাড়ি মহাদেবের সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে বলল, “আজ্ঞে গুন্ডাটা আমিই। আপনি পালানোর জন্য ভারী ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন বলেই হালকা করে এক ঘা মারতে হয়েছিল। মাপ করবেন মশাই। আপনি পালিয়ে গেলে নববাবুদের যে ভারী সুবিধে হয়ে যাবে।”

মহাদেব কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলে, “কিন্তু আমি আর এখানে থাকতে চাই না রে ভাই বীরু। শ্রীনাথ বলে গেছে। নববাবু নাকি আমাকে ছাড়বে না। তুই ভাই আমাকে গাঁয়ের বাইরে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে দে।”

হঠাৎ বীরুর মুখ থেকে একটা আখাম্বা গর্জন বেরিয়ে এল, “না!” সেই গর্জনে চারপাশটা যেন চমকে উঠে স্তব্ধ হয়ে গেল। বীরু

নিজেও হতভম্ব। তার ভিতরে যে এরকম একটা গর্জন ছিল তা সে নিজে কখনও টের পায়নি।

নিজেকে সামলে সে গলা নামিয়ে বলল, “পালাবি কেন? আমি তো জানি রাসুখুড়ি তোকে মায়ের মতোই ভালবাসত। ভালবেসেই তার সব দিয়ে গেছে তোকে। কয়েকটা পাজি লোকের ভয়ে সব ছেড়েছুড়ে পালিয়ে যাবি?”

মহাদেব ফোঁপাতে-ফোঁপাতেই বলল, “কী করব ভাই, আমার তো সহায় সম্বল কিছু নেই। আমি কি ওদের সঙ্গে পারব?”

বীরু খুব আনমনে তার বাগানটার দিকে চেয়ে থেকে গম্ভীর গলায় বলল, “আমরা তো আছি।”

রঘুনাথ বলে, “তা হলে কী ঠিক করলেন কর্তা, বন্ধুকে কি এবাড়িতেই রেখে দেবেন?”

বীরু প্রবল অন্যমনস্কতার মধ্যে শুধু বলে, “হুঁ।”

বিকেলবেলাতেই হন্তদন্ত হয়ে বিপিনদারোগা এসে হাজির। রাগে ফুঁসছেন। “কী ব্যাপার বীরুবাবু, এসব কী হচ্ছে? আপনি জেনেশুনে একজন ভয়ঙ্কর অপরাধী, একজন ফিউজিটিভ ফেরারি আসামীকে আপনার বাড়িতে শেল্টার দিয়েছেন? এটা কত বড় অপরাধ জানেন? এ তো রীতিমতো সিডিশন, রাষ্ট্রদ্রোহ। এই অপরাধে আমি আপনাকেও অ্যারেস্ট করে নিয়ে যেতে পারি, তা জানেন? কোথায় সেই লোক? কোথায় মহাদেব সাঁতরা? এক্ষুনি তাকে আমাদের হাতে তুলে দিন।”

বীরু সামনের চাতালে চেয়ারের উপর চোখ বুজে যেমন ধ্যানস্থ হয়ে বসে ছিল, তেমনি বসে রইল। জবাব দিল না।

বিপিনদারোগা আবার হুঙ্কার দিলেন, “মহাদেবের নামে তিনটে এফ আই আর হয়েছে, তার খবর রাখেন? গতকাল রাতে সে ফুলপুকুরে দু’জনকে ঘায়েল করে এসেছে। সে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঘোরে। এই গাঁযেও ব্রজমাধব রায় আর রাসমণি রায়ের বাড়ি জোর করে দখল করার ছকও সে কষেছিল। অথচ ওইসব সম্পত্তি ভেস্ট হয়ে যাওয়ার পর সব আইনকানুন মেনেই কর্নেলসাহেব লিজ় নিয়েছেন। এটা তো আর মগের মুলুক নয় যে, উটকো একটা লোক এসে অন্যের উপর হামলা চালাবে। তার উপর সে শ্রীনাথ সাপুড়েকেও আজ দুপুরে অকারণে মারধর করেছে।”

বীরু তবু নির্বিকার। যেমন চোখ বুজে ছিল তেমনি রইল।

বিপিনদারোগা এবার হুঙ্কার দিলেন, “ও মশাই, কথাগুলো কি কানে যাচ্ছে না নাকি? এর পর কিন্তু আমাকে বাধ্য হয়ে আপনাকে হাতকড়া পরিয়ে লোকের সামনে দিয়ে হিড়হিড় করে থানায় টেনে নিয়ে যেতে হবে।”

বীরুর কোনও হেলদোল দেখা গেল না।

বিপিনদারোগা তার সেপাইদের হুকুম দিলেন, “তোমরা ভিতরে ঢুকে আগে মহাদেব সাঁতরাকে ধরে নিয়ে এসো। দু’জনকে একসঙ্গেই নিয়ে যেতে হব।”

এবার বীরুর মুখ থেকে একটা চাপা ধমক বেরিয়ে এল, “দাঁড়ান।”

বলে চেয়ার ছেড়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল বীরু। বিপিনদারোগার মনে হল, একটা বিশাল সাপ যেন শরীরের পাক খুলে ফণা তুলছে। আর তুলছে তো তুলছেই। বীরবাহাদুর সিংহ লম্বা, চওড়া লোক বটে, কিন্তু বিপিনবাবুর মনে হল, লোকটা আজ যেন আরও বিঘতখানেক লম্বা হয়ে গিয়েছে। আর চোখ! বাপরে, সেই গোরুর মতো নিরীহ চোখজোড়া তো আর চেনা যাচ্ছে না। পড়ন্তবেলার আলোয় এর চোখদু’খানা এমন ধকধক করে উঠল যে, বিপিনদারোগা নিজের অজান্তেই দু’পা পিছু হটে গিয়ে বললেন, “আহা, আপনাকে অ্যারেস্ট করার কথাটা কথার কথা। ওটা অত সিরিয়াসলি নেবেন না।”

বীরু একটাও কথা বলল না, শুধু তার চোখদুটো অঙ্গারের মতো জ্বলতে লাগল।

বিপিনদারোগা আর তার সেপাইরা আরও কয়েক কদম পিছিয়ে গেল।

বিপিনবাবু ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বললেন, “বুঝতেই তো পারছেন, সরকারি কাজ করতেই আসা। আমাদের আবার দোষ ধরবেন না কিন্তু। ঠিক আছে, আপনি না চাইলে আমরা না হয় আপনার বাড়িতে না ঢুকলুম।”

বেলা মরে গিয়ে একটা ছাড়া ছাড়া ভাব ঘনিয়ে এল চারদিকে। আর সেই আবছায়ায় বীরুর চোখদুটো আরও জ্বলজ্বলে হয়ে উঠল।

সেপাইরা ফটক পর্যন্ত পিছিয়ে গিয়েছে। বিপিনদারোগাও প্রায় কাছাকাছি। দূর থেকেই বললেন, “আচ্ছা, আজ তা হলে আসি। আপনার বন্ধুটিকে একটু সাবধান হতে বলবেন। আমাদের তো শুধু কর্তব্যটুকু করতে আসা বই তো নয়। কিছু মনে করবেন না যেন।”

বর্ষাকাল শেষ হয়ে এসেছে। গরম নেই। বরং একটু শীত-শীত ভাব। তবু বিপিনবাবু গলগল করে ঘামছেন। রুমালে টাক, কপাল, মুখ মুছতে মুছতে থানায় নিজের চেয়ারে বসে সেপাইদের দিকে চেয়ে বললেন, “ব্যাপারটা কী হল বলতো? কিছু বুঝতে পারলি?”

সেপাইদেরও কেমন যেন হতভম্ব ভাব। তারা প্রায় সমস্বরে বলে উঠল, “আজ্ঞে না বড়বাবু।”

“তা হলে আমরা চলে এলুম কেন?”

সেপাইরা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। কেউ জবাব দিতে সাহস পেল না। সেপাই রামতারণ বয়স্ক লোক। সে বলল, “আপনি তো ভয় পেয়ে গেলেন স্যার।”

একটা করুণার ভাব এসে গিয়েছিল।”

বিপিনবাবু ভ্রু কুঁচকে বিরক্ত হয়ে বলেন, “ভয়!আমি!বলিস কী?” রামতারণ আমতা-আমতা করে বলে, “আজ্ঞে না স্যার, ঠিক ভয়ও নয়। তবে অনেকটা ওরকমই কিছু।”

সনাতন বলে উঠল, “আমারও তাই মনে হল বড়বাবু। আপনার চোখ বেশ ছলছল করছিল।”

বিপিনবাবু একটা বড় এবং ঝোড়ো শ্বাস ফেলে বললেন, “নিজেকে নিয়ে আমার ওইটেই মুশকিল। এমনিতে আমি দাপুটে, ডাকসাইটে লোক বটে, কিন্তু মাঝে-মাঝে হঠাৎ করে মানুষের দুঃখ-কষ্টে মনটা বড় নরম হয়ে পড়ে।”

রামতারণ জানতে চাইল, “তা হলে কি বীরুবাবু আর মহাদেব সাঁতরাকে অ্যারেস্ট করা হবে না স্যার?”

বিপিনবাবু একটু ভাবিত হয়ে বললেন, “তা হবে না কেন? আমার মনের ভিজে ভাবটা কমে গেলেই দু’জনকে বেঁধে নিয়ে আসব। অন্যায় আর অরাজকতা তো চলতে দেওয়া যায় না।”

সেপাইরা সবাই কথাটা স্বীকার করে নিল, “তা তো ঠিকই।” শুধু রামতারণ সতর্ক গলায় জিজ্ঞেস করে, “ভেজা ভাবটা কবে নাগাদ শুকোতে পারে স্যার।”

“শুকোবে রে শুকোবে। এখন যে যার কাজে যা তো। আমাকে একটু একা থাকতে দে।”

সেপাইরা বিদেয় হলে বিপিনবাবু সিংহর মতো পদচারণা করতেকরতে আপনমনেই স্বগতোক্তি করতে লাগলেন, “না, এবার ব্যায়ামট্যায়াম শুরু করতে হবে দেখছি। সকালে উঠে মাইলটাক দৌড়, ডাম্বেল, বারবেল, প্রাণায়াম আর যোগ, ক্যারাটে, কপালভাতি, সূর্যপ্রণাম…”

“বড়বাবু কি পার্ট মুখস্থ করছেন? যাত্রায় নামছেন নাকি?” বিপিনবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “কে রে?”

দরজার আড়াল থেকে একটা রোগা মুখ বেরিয়ে এল, “আজ্ঞে?”

“আসলে কী জানিস, আমার হঠাৎ কেমন একটা দয়া, একটা দয়া,

“বড়বাবু, আমি গুটে।”

“কী চাস?”

“একটা খবর আছে বড়বাবু।”

“খবর, কিসের খবর?”

“সেইটে বলতেই আসা। আজ সকালে বাজারে গিয়েছিলুম নাতনির জন্য একটু কুচো চিংড়ি খুঁজতে। বড্ড ভালবাসে কিনা। যত আবদার সব আমার কাছে। তা সকালের দিকে বাজারে ঘোঁতনার দোকানের এক ভাঁড় দুধ চা না খেলে আমার চলে না। চা-টা করেও বড় ভাল।”

বিপিনদারোগা ধমকে উঠে বলেন, “এগুলো কি খবর নাকি? কুচো চিংড়ি, ঘোঁতনার চা?”

“আজ্ঞে না বড়বাবু। এই বলছি আর কী? তা চা-টা খেয়ে নিয়ে বেরতে গিয়ে দেখি, উলটো দিকের বটতলায় একজন মানুষ দাঁড়িয়ে। খুব কেতার মানুষ মশাই। গায়ে ঘি রঙা একখানা মারকাটারি পাঞ্জাবি, তাতে সোনার বোতাম। পরনে চুস্ত পায়জামা, পায়ে লপেটা চটি, হাতে আংটি। বেশ লম্বা-চওড়া চেহারা মশাই। দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলেন। গাঁয়ে নতুন দেখে একটু এগিয়ে গিয়ে হাতজোড় করে বললুম, তা ইদিকে কোথায় এসেছেন মশাই? বাবুভাইদের অনেককেই দেখেছি আমাদের সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করেন না। তা ইনি দেখলাম সেরকম নন। ভারী মিষ্টি হেসে বললেন, ‘আমি তো এখানকারই লোক। মাঝখানে কিছুদিন ছিলাম না বটে, তবে এখন এসে পড়েছি।’ বুঝলেন বড়বাবু, আমারও কেমন যেন মুখটা চেনা-চেনা লাগছিল। পষ্ট করে কিছু মনে মনে পড়ল না অবশ্য। তা বাবুটি রাগ করলেন না দেখে আমি ফস করে বলে বসলুম, ‘বাবুর সিগারেটের গন্ধটা বড্ড ভাল ছেড়েছে তো, তখন বাবুটি ফের হেসে বললেন, ‘কেন, তুমি একটা খাবে?’ বলে পকেট থেকে বিলিতি সিগারেটের একটা প্যাকেট বের করে তা থেকে একটা আমাকে দিলেন। এমনকী আদর করে নিজেই লাইটার ধরিয়েও দিলেন। বড় ভাল সিগারেট মশাই।”

বিপিনদারোগা একটা শ্বাস ফেলে বলেন, “কুচো চিংড়ি গেল, দুধ-চা গেল, এখন কি সিগারেটে আটকে রইলি?”

“আজ্ঞে আগাপাশতলা না বললে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে না কিনা, তাই বলছি। তা বাবুটির কাছ ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে দু’-চারটে কথা কইব বলে ভেবেছিলুম মশাই। তা তখনই দুম করে একটা বেশ বড় ঝাঁ চকচকে গাড়ি এসে সামনে দাঁড়াল। আর বাবু আমার দিকে চেয়ে ‘চলি হে’ বলেই তাতে উঠে পড়লেন। গাড়িটা ফের হুশ করে চলে গেল।”

“এটাই খবর তো?”

“আজ্ঞে না মশাই, এর পরেই খবর।”

“তা হলে বলে ফ্যাল।”

“এই বলছি। তা বাবুটি চলে যাওয়ার পর গাছতলায় দাঁড়িয়ে আরাম করে সিগারেটটা ফুঁকছিলাম, এমন সময় চার-পাঁচটা ষন্ডামার্কা লোক এসে আমাকে ঘিরে ফেলল। একটা তেড়িয়া চেহারার লোক আমার ঘাড় ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘তোর সাহস তো কম নয়। সাহেব তোর ইয়ার না বন্ধু যে, সিগারেট চেয়ে খেলি? এত বড় আস্পদ্ধা হয় কোত্থেকে রে?’ ঝাঁকুনির চোটে হাত থেকে দামি সিগারেটটা পড়ে বরবাদ। কী অন্যায় বলুন দিকি মশাই, তখনও অর্ধেকটারও বেশি বাকি ছিল।”

“সত্যিই তো! ভারী অন্যায়! এখন দয়া করে বাকি ঘটনা উগরে দিয়ে কেটে পড় তো!”

“যে আজ্ঞে। তা ষন্ডাগুলো ভারী বেয়াদব মশাই। ঘাড় ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। আমি যতই বলি, ‘ওরে ছেড়ে দে রে, আমি বুড়ো মানুষ। ঘাড়টা ভেঙে যাবে।’ তা কে শোনে কার কথা, হেঁচড়েছিচড়ে ধাক্কা দিতে-দিতে সেই মালোপাড়া পর্যন্ত নিয়ে গেল মশাই। সোজা কোথায় নিয়ে তুলল জানেন! ব্রজমাধব রায়ের বাড়িতে। তারপর বৈঠকখানায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে তবে পৈতৃক ঘাড়খানা তাদের হাত থেকে রেহাই পেল। কিন্তু মশাই, সেখানে যা দেখলুম তাতে আমার চোখ চড়কগাছ। ব্রজকর্তার পুরনো বাড়ি আর চেনার জো নেই। দেয়ালে নতুন রং, নানা কেতার সব ফার্নিচার, দারুণ জম্পেশ একখানা ঝাড়লণ্ঠন, আরও কত কী। আর সেখানেই দেখি সেই বাবু মানুষটি ঘর আলো করে গা এলিয়ে সোফার উপর বসে আছেন। পাশেই গ্যালগ্যালে মুখে নবকুমারবাবু দাঁড়িয়ে। সঙ্গে আরও মেলা লোকজন।”

বিপিনবাবু উঠে বলেন, “বলিস কী! কর্নেলসাহেব নন তো?”

“তবে আর বলছি কী বড়বাবু! যেই তেড়িয়া চেহারার লোকটা আমাকে ঘাড় ধরে তাঁর সামনে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই যে কর্নেলসাহেব, বেয়াদপটাকে ধরে এনেছি, ’’’

উত্তেজিত বিপিনবাবু বলেন, “তারপর?”

“আজ্ঞে, আমি তখন ঘাড়ে হাত বোলাচ্ছি। কর্নেলসাহেব ভারী মিষ্টি হেসে বললেন, ‘তোমার নাম ঘটেশ্বর সাধু না?’ আমি তো তাজ্জব। কী বলব মশাই পিতৃদত্ত নামটা আমি নিজে পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিলুম। আমি হাঁ করে থেকে বললাম, ‘আজ্ঞে, এ নাম আপনি জানলেন কী করে?’ উনি সে কথার জবাব না দিয়ে বললেন, ‘শোনো গুটে, তুমি যে চোর তাও আমি জানি। তবে চোরছ্যাঁচড়দের আমি অপছন্দ করি না। তাদের দিয়ে অনেক কাজ হয়। তারা এলাকার সব খবর আর অন্ধিসন্ধি জানে। তুমি যদি আমার হয়ে কাজ করো, তা হলে এই বুড়ো বয়সে তোমাকে আর রোজগারের ভাবনা ভাবতে হবে না, ”

বিপিনবাবু চোখ কপালে তুলে বললেন, “বলিস কি? তুই তো দেখছি, কর্নেলসাহেবের নজরে পড়ে গিয়েছিস। তোর তো কপাল খুলে গেল রে গুটে!”

“যে আজ্ঞে। তা আমি বললুম, ‘সে তো ভাল কথা কর্নেলসাহেব, তা কী কাজটাজ করতে হবে বলুন।’ তখন সাহেব ফের তার একটা দামি সিগারেট ধরালেন। এবার অবশ্য আমাকে দিলেন না। সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘এই জায়গা নিয়ে আমার একটা স্বপ্ন আছে, বুঝলে! বিদ্যেধরপুরের ভোল আমি পালটে দেব, কিছু বেয়াদব লোকের জন্য হচ্ছে না। আমি তাদের গতিবিধি আর মতলবের খবর চাই।””

বিপিনবাবু গদগদ হয়ে বললেন, “বাহ বাহ, এ তো একেবারে তোর মনের মতো কাজ! তা বন্দোবস্ত কীরকম হল রে?”

“আজ্ঞে, দুশো টাকা আগাম দিয়েছেন। সঙ্গে এও বলে দিয়েছেন যে, ভুলভাল খবর দিলে বা বেইমানি করলে কেটে ফেলবেন।”

“ওরকম একজন মনিব পেয়ে তো বর্তে গেছিস রে! এরকম শাঁসালো লোককে হাতছাড়া করিস না বাপু। লেগে থাকিস, ” তারপর গুটের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, “শাবাশ। এখন যা নাতনির জন্য মিষ্টিটিস্টি বা খেলনা কিনে নিয়ে বাড়ি যা। তোর হিল্লে হয়ে গেল।”

গুটে একটু গম্ভীর হয়ে বলে, “কথাটা এখনও শেষ হয়নি কিন্তু বড়বাবু। বাকিটা কি শুনবেন?”

ভ্রু কুঁচকে বিপিনবাবু বললেন, “আবার বাকিও আছে নাকি?” “আছে।”

“তা হলে বলে ফ্যাল।”

“আপনি নোয়াপাড়ার নিবারণের ফুলুরি খেয়েছেন কখনও?”

বিপিনবাবু হাঁ। খানিক বাতাস গিলে বলেন, “ফুলুরি! হঠাৎ ফুলুরির কথা কেন?”

“অমন ফুরফুরে, হালকা আর খাস্তা ফুলুরি আর কোথাও হয় না কিনা।”

“আমাদের এখন ফুলুরির বৃত্তান্তের কী দরকার?”

“আজ্ঞে, আজ কর্নেলসাহেবের কাছ থেকে টাকা পেয়ে নিবারণের দোকানে গিয়ে যখন শালপাতার ঠোঙায় কয়েকখানা গরম ফুলুরি নিয়ে বসেছি তখনই পট করে মনে পড়ে গেল কিনা?”

“কী মনে পড়ল?”

“এই কর্নেলসাহেব লোকটাকে কোথায় দেখেছি। এত চেনা-চেনা লাগছে কেন! কথাটা হল, ওই নিবারণের ফুলুরির দোকানেই একবার অনেকদিন আগে, ঘ্যাঁচা আমার গেঁজে থেকে তিনশো টাকা কেড়েকুড়ে নিয়েছিল। তাই ফুলুরির দোকানে গিয়ে বসতেই মনে পড়ে গেল।”

“ঘ্যাঁচাটা কে রে?”

ঘ্যাঁচাই হচ্ছে কর্নেলসাহেব। তার আসল নাম “আজ্ঞে, অঘোরনাথ।”

“দূর-দূর আহাম্মক কোথাকার! কাকে দেখতে কাকে দেখেছিস। তোর তো বোধ হয় সত্তর বছর বয়স হল। চোখে ছানিটানি পড়েছে বোধ হয়। আর ভীমরতি তো এই বয়সেই হয় বলে শুনেছি।”

“আজ্ঞে না বড়বাবু, আমি চোখেও কম দেখি না। স্মরণশক্তিও বেশ টনটনে আছে। ঘ্যাঁচা তখন জং বাহাদুর সিংহর দলের লোক ছিল। দলে বেশ খাতিরও হয়েছিল ঘ্যাঁচার। ভাল প্যাঁচপয়জার জানত। বন্দুকপিস্তলে অব্যর্থ টিপ, ডাকাবুকো। জং বাহাদুর সিংহ ভালওবাসত খুব। আমিও তখন তাঁর শাগরেদি করি কিনা, তাই জানি।”

“তোর মাথাটাই গেছে দেখছি! কোথায় কর্নেলসাহেব আর কোথাকার কে ঘ্যাঁচা! আর লোক হাসাস না বাপু। বাড়ি যা। এসব পাঁচকান করিস না যেন।”

“আপনার যখন বিশ্বাস হচ্ছে না, তখন না হয় না বললাম। তবে কিনা শুনলেও কিছু খারাপ হত না।”

“শুনছি। কিন্তু আগে থেকেই বলে রাখছি। বিশ্বাস করার জন্য চাপাচাপি করিসনি। বিশ্বাস করার অসুবিধে আছে।”

“ঘ্যাঁচা সবসময়েই বলত, ওর নাকি খুব টাকার দরকার। মেলা টাকা। দেশের গাঁয়ে গিয়ে ও নাকি চারতলা বাড়ি করবে। সিনেমা হল বানাবে। ব্যায়ামাগার তৈরি করবে। ওর গাঁয়ে কে একজন চারু গায়েন নামে পয়সাওয়ালা লোক আছে তার সঙ্গে পাল্লা দেবে বলে রোখ চেপেছিল খুব। সব আমার মনে আছে বড়বাবু। কিছু ভুলিনি। ঘ্যাঁচা লোভে পড়ে জংবাহাদুর সিংহর তবিল থেকে একদিন টাকা সরাতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় ঘনারামের হাতে। ঘনারাম আর বংশীবদন মিলে খুব ধোলাই দিয়েছিল ঘ্যাঁচাকে। এর কয়েকদিন পরেই ঘ্যাঁচা এমন একটা কাণ্ড করল যা করতে বুকের পাটা লাগে মশাই। সে জংবাহাদুরের ফুটফুটে দেড় বছরের নাতি বীর বাহাদুরকে চুরি করে নিয়ে পালিয়ে গেল। তারপর দশ লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়ে চিঠি দিল জংবাহাদুরকে। আদরের নাতি চুরি হয়ে যাওয়ায় জং বাহাদুর খ্যাপা বাঘ হয়ে গিয়েছিল মশাই। কিন্তু কাজটা বড্ড কাঁচা করে ফেলেছিল ঘ্যাঁচা। জং বাহাদুর সিংহর জাল বহু দূর ছড়ানো। তার চোখকে ফাঁকি দেওয়া কি সোজা কথা!তিনদিন বাদে নাতি উদ্ধার হয়ে গেল, ঘ্যাঁচাকে নিয়ে আসা হল পিছমোড়া করে বেঁধে। কর্তাবাবু তাকে প্রথমটায় জুতোপেটা করলেন। তারপর বাজারের চৌপট্টিতে থামের সঙ্গে তাকে বেঁধে রাখা হল। লোকজন যেতে আসতে তাকে চড়টা চাপড়টা মেরে যেত।”

“এ তো ঘোর অরাজকতা রে! আমি তখন থাকলে…”

“ভাগ্যিস আপনি ছিলেন না!”

“তারপর কী হল বল। আমি কিন্তু একটা কথাও বিশ্বাস করছি না।”

“তাতেও হবে। শুধু শুনে গেলেই হয়। দু’দিন ধরে ওই হেনস্থার পর কর্তাবাবু তাকে দয়া করে ছেড়ে দেন। তার দু’-চারজন পেয়ারের বন্ধুবান্ধব ছিল। তার মধ্যে আমিও ছিলুম। আমাদের কাছে সে প্রতিজ্ঞা করে গিয়েছিল, ‘যদি বাপের ব্যাটা হই তা হলে একদিন আমি ফিরে এসে জং বাহাদুরকে নির্বংশ করে ছাড়ব। আর এই বিদ্যেধরপুরে তখন রাজত্ব করব আমি।”

বিপিনবাবু বললেন, “ঠিক আছে, ঠিক আছে। এ তো ঘ্যাঁচার বৃত্তান্ত। এ তো আর কর্নেলসাহেবের গল্প নয় রে।”

“তবু বলি বড়বাবু, একটু সাবধান হওয়া ভাল। বীর বাহাদুরের কিন্তু বিপদ হতে পারে।”

“সে তো যে-কোনও মানুষেরই যে-কোনও সময়ে বিপদ হতে পারে। তা বলে তো আগাম কিছু করার উপায় নেই রে। ওসব চিন্তা করে খামোকা অস্থির হোস না তো! কর্নেলসাহেব যদি ঘ্যাঁচা হয় তবে পুন্নিমেও অমাবস্যা। বুঝলি! আর মনে রাখিস এখন উনি তোর অন্নদাতা। বেইমানি করলে কী ভাল হবে?”

“সেটাই তো চিন্তার কথা বড়বাবু। বুড়ো বয়সে এ কী বিপদ বলুন তো!”

“বিপদ! কীসের বিপদ? কার বিপদ? আরে, আমি আছি কী করতে? তার উপর তুই এখন কর্নেলসাহেবের দলের লোক। তোকে তো এখন গাঁয়ের একজন কেষ্টবিষ্টুই বলা যায়। যা, বাড়ি গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমোগে যা। আমাকে আবার এখুনি বেরতে হবে। কর্নেলসাহেবের সঙ্গে এই প্রথম দেখা করতে যাচ্ছি, একটু ফল-মিষ্টি না নিয়ে গেলে কি ভাল দেখায়?”

“যে আজ্ঞে, ” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে পড়ল গুটে। তারপর চাপা গলায় বলল, “আর-একটা কথা বড়বাবু।”

বিরক্ত হয়ে বিপিনবাবু বললেন, “আবার কথা! তোর কি কথা আজ আর শেষ হবে না?”

বেশি সময় লাগবে না বড়বাবু। প্রায় পঁচিশ বছর আগে বীরবাহাদুরের বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল। তাতে বীরুর মা-বাবা খুন হয়ে যায়। মামাবাড়িতে ছিল বলে বীরু বেঁচে গিয়েছিল। লোকে জানে ডাকাতের হাতে তার মা-বাবা খুন হয়ে গেছে। আমি সাক্ষী আছি বড়বাবু, খুনটা কিন্তু করেছিল ঘ্যাঁচা।”

“উফ, বাপু রে, আজ তোকে দেখছি ঘ্যাঁচায় পেয়েছে! ঘ্যাঁচা করেছে তো আমরা কী করতে পারি বল।”

“কথাটা জানানোর ছিল বলে জানিয়ে গেলাম। কাল সকালে যদি আমার লাশ পাওয়া যায়, অবাক হবেন না। আমি সত্যিই আজ বড্ড বেশি কথা কয়ে ফেলেছি।”

অন্ধকার হয়ে এসেছে। রাত গভীর হতে চলল। বীরু চুপ করে তার বাইরের চাতালে ঝুম হয়ে বসে আছে। নড়াচড়া নেই। সে অবিরল তার চারপাশে একটা চাপা ফিসফাস শুনতে পাচ্ছে। কথা আর কথা। যেন বাতাসে অদৃশ্য কণ্ঠস্বর। পরস্পর কথা কয়ে চলেছে অবিরল। কথা আর কথা। কথার সঙ্গে কথার কাটাকুটি হয়ে যাচ্ছে। কথার গা বেয়ে উঠে আসছে কথা। কথায়-কথায় ঘুড়ির প্যাঁচ খেলে যাচ্ছে। শোনা যায়, কিন্তু কিছু বোঝা যায় না। মানুষ আবহমানকাল ধরে যত কথা বলে এসেছে সেগুলোই যেন আবহে রয়ে গিয়েছে আজও। কে বলছে, কাকে বলছে, কী বলছে বোঝা যায় না।

বীরু চুপ করে, চোখ বুজে কথাগুলো ধরার চেষ্টা করছে।

“বীরুকর্তা?” “কে?” “আমি গুটে, ঘটেশ্বর সাধু।” “বলুন।” “একটা কথা বলে যেতে এলুম। আর হয়তো সময় পাব না।” “কী কথা?” “আপনি খুন হয়ে যেতে পারেন। সাবধান?” “জানি! আর কিছু বলবেন?” “আপনার মা-বাবাকে…” “তাও জানি।” “তা হলে কর্তা আসি গিয়ে? আপনি বরং ঘরে দোর দিয়ে দিন।” “ভয় নেই।” লোকটা চলে গেলে ফের ঝুম হয়ে বাতাসের ফিসফাস শুনতে লাগল বীরু।

বাড়ি ফেরার পথে বউডুবির জলার ধারটায় নির্জনে চার-পাঁচজন এসে নিঃশব্দে ঘিরে ধরল গুটেকে।

“বড্ড বেশি কথা বলে ফেলেছিস রে নিমকাহারাম।”

গুটের গলা কাঁপল না, তেমন ভয়ও হল না, বলল, “কথাগুলো কাউকে বলার ছিল যে! নইলে বড্ড আঁকুপাঁকু হচ্ছিল ভিতরে। অনেককাল চেপে রেখেছিলুম তো! আজ খালাস করে দিয়েছি। বড় আরাম লাগছে হে?”

“তাই নাকি?”

অন্ধকারেও একটা হেঁসো ঝিকিয়ে উঠতে দেখতে পেল গুটে।

কিছু বয়ে গেল চারধারে। লোকগুলো কোথায় যে ছিটকে পড়ল কে জানে।

গুটে ফের গুটিগুটি বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল। তার বড় খিদে পেয়েছে। কে জানে নাতনিটা এত রাত পর্যন্ত তার জন্যই জেগে বসে আছে কিনা। বড্ড মায়া।

অন্ধকারে যেমন বসেছিল বীরু, তেমনই বসে আছে। কেউ একজন পাশে এসে দাঁড়াল, “কাজ হয়ে গেছে ওস্তাদ। ঘণ্টেশ্বর সাধু বেঁচে আছে।”

“রঘুনাথ?”

“যে আজ্ঞে।”

“ও লাঠিটা কার? যখন দুপুরে লাঠিটা আমার হাতে দিয়েছিলে তখন শরীরে একটা ঝটকা লেগেছিল।”

“কী যে বলেন ওস্তাদ!লাঠিতে কি কারেন্ট থাকে?”

“লাঠিটা কার?”

“আপনার ঠাকুরদা জং বাহাদুর সিংহর।”

“এবার বেরলে হয় কর্তা। শত্রুর শেষ রাখতে নেই।”

চারদিকে একটা তুমুল ফিসফাস উঠল। হাওয়া বয়ে যায় মর্মরধ্বনি করে। আবহে অদৃশ্য মানুষের ছাপ। প্রচ্ছন্ন অবয়ব সব। আবছায়া। আছে কী নেই। যারা আর নেই, তাঁদেরই যেন ছাঁচ তুলে রাখা আছে চারদিকে। তারাই? নাকি, মনের ভুল। কিন্তু বাতাসে একটা প্ররোচনা আছে। কারা যেন বলতে চাইছে, “চলো-চলো।”

ফটকের পাশে টুলের উপর বসে ঘুমে ঢুলছিল শিবু। অভ্যাসবশে হাতে ধরা বন্দুক। ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্ন দেখেছিল, এক বুক তেষ্টা নিয়ে সে একটা মস্ত শাল জঙ্গল পেরোচ্ছে। হঠাৎ গভীর জঙ্গলের ভিতর একটা টলমলে পুকুর দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি জলের ধারে নেমে আঁজলা করে জল খেতে যাবে, দেখতে পেল, পুকুরের উলটো দিকে একটা কেঁদো বাঘও জল খেতে নেমেছে। শিবু আঁতকে উঠল। তড়িঘড়ি পালাতে যাচ্ছিল, কে যেন পিছন থেকে বলল, ““পালাচ্ছিস কেন? জলে ভাল করে তোর ছায়া দেখ তো? তুইও তো বাঘ।”

চটকা ভেঙে সোজা হয়ে শিবু দেখে, ফটকটার ওপাশে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। শাল গাছের মতো সটান চেহারার লম্বা একটা লোক। তার চোখে চোখ রেখে গমগমে গলায় বলল, “ফটকটা খুলে দাও।”

শিবুর মনে হল, এ আদেশ লঙ্ঘনীয় নয়। সে তাড়াতাড়ি পকেট থেকে চাবির গোছা বের করে তালা খুলে ফটকটা ফাঁক করে দিল।

কিন্তু তারপরেও দিব্যি বেঁচে রইল গুটে। কারণ একটা ঝড়ের মতো

যে লোকটা বারান্দায় বসে ছিল তার নাম মহেন্দ্র। তার বন্দুকটা হাতের নাগালেই দেওয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা। সে ঘুমোয়নি। খবর এসেছে গাঁয়ের বাড়িতে তার ছোট ছেলেটার টাইফয়েড হয়েছে। বড় দুশ্চিন্তা হচ্ছিল তার। টাইফয়েড খুব পাজি রোগ নয় তো! সামনেই হঠাৎ আখাম্বা লম্বা লোকটাকে দেখে সে বন্দুকের জন্য হাত বাড়িয়েও হাত সরিয়ে নিল। তার মন তাকে বলল, একে অভিবাদন জানানো উচিত। কেন মনে হল, সে বুঝতে পারল না। তবে সে উঠে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করল।

বৈঠকখানায় বন্ধ দরজার ওপাশে মেঝেয় মাদুর পেতে অঘোরে ঘুমোচ্ছিল কানাই। কে যেন তাকে খোঁচা দিয়ে জানিয়ে বলল, “ওরে ওঠ, দরজা খুলে দে!তিনি এসে গেছেন যে!” কানাই ধড়ফড় করে উঠে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বলল, “যে আজ্ঞে।”

দোতলার শোয়ার ঘরে খাটে শুয়ে একটা স্বপ্ন দেখছিল কর্নেলসাহেব। একটা ঘরে অনেকগুলো চেয়ার উলটো পালটা করে রাখা। বেরনোর উপায় নেই। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। ঘরে একটা গোখরো সাপ লিকলিক করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কে ছেড়ে দিয়ে গেল সাপটা? কর্নেল প্রাণভয়ে দৌড়য়। তার শরীরের ধাক্কায় একের পর-এক পড়ে যাচ্ছে চেয়ার। সাপটা চেয়ারের ফাঁকফোকর দিয়ে আঁকাবাঁকা তেড়ে আসছে। চেয়ারে হোঁচট খেয়ে বারবার হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে সে। ফের তড়িঘড়ি উঠে ছুটছে। সে চিৎকার করে বলছে, “আর কতক্ষণ চলবে এ খেলা?”

কে যেন মন্ত্র গলায় বলল, “এ খেলা অন্তহীন। দৌড়ও, দৌড়ও, দৌড়তে থাকো থেমো না।”

দূরের পুঞ্জীভূত মেঘ থেকে কেমন গুরু গুরু শব্দ হয় তেমনই এক ধ্বনিতে কে যেন ডাকল, “অঘোরনাথ!”

কর্নেলসাহেব ঘুমের মধ্যেই চমকে উঠে বালিশের পাশে রাখা পিস্তলটার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “কে?” কেউ জবাব দিল না।

কর্নেলসাহেব হাঁ করে সামনে দাঁড়ানো লোকটার দিকে চেয়ে হঠাৎ ককিয়ে উঠল, “আঁ আঁ আঁ আঁ, ” তারপর বলল “কর্তাবাবু! কর্তাবাবু জং বাহাদুর সিংহ!”

শালপ্রাংশু মহাভুজ লোকটা শুধু স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে।

কাঁপতে-কাঁপতে খাট থেকে নেমে হাঁটু গেড়ে বসল কর্নেলসাহেব। হাতজোড় করে বলল, “কর্তাবাবু, আর-একবার আর মাত্র একবার আমাকে বাঁচতে দিন।”

“কী শর্তে অঘোরনাথ?”

“চিরদিনের মতো বিদেয় হয়ে যাব। আর কখনও আপনার রাজত্বে আসব না।”

“এখনই! এই দণ্ডে?”

“তাই হবে কর্তাবাবু, তাই হবে।”

-সমাপ্ত-