৪
রঘুনাথ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে, “তা হয়েছেন বটে, তবে
একটা বাঙ্কার দখল করার জন্য একটা খাড়া দুর্গম বরফে ঢাকা পাহাড়ের গা বেয়ে পাকদণ্ডী দিয়ে সে উঠছে। হাতে রাইফেল, কাঁধে ভারী রাকস্যাক, মাথায় মিলিটারি হেলমেট। তার দলের মিলিটারিরা কেউ বেঁচে নেই। সে একা। উঠছে, উঠছে। চূড়ার বাঙ্কারটা আর খুব দূরে নয়। দখল নিয়ে তার উপর জাতীয় পতাকা উড়িয়ে দেবে সে। তারপর অ্যাটেনশন হয়ে স্যালুট করে বলবে ‘জয় হিন্দ। কিন্তু হঠাৎ উপর থেকে ট্যাট ট্যাট করে ফের গুলির শব্দ আসতে লাগল। কিন্তু উপেনের ভয়ডর নেই। বাঙ্কারটা দখল করতেই হবে। সেও রাইফেল তুলে উলটে গুলি চালাল ট্যাট ট্যাট। ফের হামাগুড়ি দিয়ে এগোনো। প্রায় চূড়ায় বাঙ্কারটার কাছে পৌঁছে গিয়েছে সে। শেষ সৈনিক। দেখা গেল বাঙ্কারেও আর-একজন মাত্র শত্রুসৈন্য বেঁচে আছে। দু’জনেই গুলি চালাল। উপেনের বুক থেকে অজস্র ফুটো দিয়ে ফুলঝুরির মতো রক্ত বেরচ্ছে।
উলটো দিকের শেষ সৈন্যটাও বুকে গুলি লেগে লুটিয়ে পড়েছে। যুদ্ধ শেষ। উপেন ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। এই দৃশ্যটা মনশ্চক্ষে দেখতে দেখতে কতবার তার চোখ ফেটে জল এসেছে। দেশের জন্য প্রাণ দেওয়ার বড় ইচ্ছে ছিল উপেনের। কিন্তু মা সুবাসিনীদেবী কান্নাকাটি করায় তার আর মিলিটারিতে নাম লেখানোই হল না।
এর পর উপেন ঠিক করল এভারেস্টে উঠবে। সেই বাবদে সে রাকস্যাক আর বরফের গাঁইতিও কিনে ফেলল। রতনপুরে যে বেশ উঁচু একটা টিলার মতো আছে, সেখানে গিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে পাহাড়ে ওঠা প্র্যাকটিস শুরুও করেছিল সে। খবর শুনে তার বিধবা পিসি মন্দাকিনীদেবী এমন চেঁচামেচি শুরু করলেন যে আর কহতব্য নয়, “ওরে, ওকী সব্বোনেশে কথা! ওটা যে শিবের পাহাড়। ওর মাথায় ওঠা মানে তো শিবঠাকুরের মাথায় পা দিয়ে দাঁড়ানো। নির্বংশ হবি যে! মাথায় বাজ পড়বে, ” পিসিকে বোঝায় কার সাধ্যি!
অবশেষে সে ঠিক করল ইংলিশ চ্যানেলটা সাঁতরে পার হবে। সেইজন্য প্রস্তুতি হিসেবে খালে, বিলে, পুকুরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতার প্র্যাকটিস করতে লাগল। সেই সময় একদিন জ্যাঠামশাই হরশঙ্কর কানটা আচ্ছা করে মুচড়ে দিয়ে বললেন, “ইংলিশ চ্যানেল? তার আগে ইংলিশ গ্রামারটা পার হয়ে দেখা দিকি মুখ্যু!”
এইসব নানাবিধ বাধায় উপেন জীবনে আর তেমন এগোতেই পারল না। কিন্তু যে জীবনে অ্যাডভেঞ্চার নেই, উদ্দীপনা নেই, সুদূরের ডাক নেই সে কেমন জীবন? নিজেকে চেপে রাখে বটে উপেন, কিন্তু বুকের ভিতরে একটা দ্রিমি দ্রিমি দামামা অনবরত বেজেই চলেছে। তার রক্ত ফুটছে টগবগ করে। একটা হেস্তনেস্ত, একটা এসপারওসপার করার জন্য তার হাত-পা নিশপিশ করে।
ঠিক এই সময়ে সে জটাবাবার সন্ধান পেল। বউডুবির ঝিলের ধারে বটতলায় তার ঠেক। জটাবাবা হুঙ্কার দিয়ে বললেন, “মায়ের ইচ্ছেয় কী না হয় রে! মায়ের সাধনা কর, তোর সব হবে।”
মন্ত্র নিয়ে উপেন সোৎসাহে সাধনায় নেমে পড়ল। কিন্তু সাধনা করারই কি জো আছে? বাড়িতে বেকার ছেলে থাকলে ফাইফরমাশের অন্ত থাকে না, “ওরে দোকান থেকে চিনি নিয়ে আয়, ” “যা তো বাজার করে আন, ” “পেতলের হাঁড়িটা ছ্যাঁদা হয়েছে, ঝালাই করে আন তো বাবা।” নিরিবিলিতে সাধনা করার জন্য অবশেষে সে খুঁজে খুঁজে রাজবাড়ির ভাঙা কালী মন্দিরটাই পছন্দ করল। দিব্যি জায়গা। চারদিকে জনমনিষ নেই। একধারে রাজবাড়ির বিরাট ধ্বংসস্তূপ আর জঙ্গল। মন্দিরটা সাফসুতরো করে, আসন পেতে ধুনি জ্বালি সে বসে গেল। সন্ধে থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বিনা বাধায় জপতপ চলতে লাগল তার। সাধনায় যে কাজ হচ্ছে তাও বুঝতে পারছিল সে। একদিন হয়তো শরীরে একটা কাঁপুনি উঠল, কোনওদিন বা শরীর ভারী হালকা হয়ে যেন ভেঙে পড়ার উপক্রম হল। কোনওদিন বা মাথাটা হঠাৎ আগুনের হলকা ছাড়তে লাগল। কাজ যে হচ্ছে তাতে সন্দেহ নেই।
মাসখানেকের মাথায় গভীর রাতে সে হঠাৎ করে বুঝতে পারল একটা বড় রকমের কিছু ঘটতে যাচ্ছে। শরীরের ভিতর যেন একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে খাচ্ছে। একটা কেমন যেন শিরশিরানি বয়ে যাচ্ছে হাতে, পায়ে। হঠাৎ মনে হয়, নির্জন মন্দিরে কেউ যেন এল। না, এল বলাটা ঠিক নয়, যেন আবির্ভূত হল। বন্ধ চোখেও সে যেন একটা নড়াচড়া দেখতে পাচ্ছিল। যেন শূন্য থেকে দেহ ধারণ করে কেউ একজন সামনে এসে দাঁড়াল। ফিসফিস করে সে জিজ্ঞেস করল, “মা মহামায়া, মা শ্মশানেশ্বরী, মা ভবতারিণী কি এলি? মা… মা…”
বজ্রনির্ঘোষে কে যেন বলে উঠল, “মা নয় রে, বাবা!”
পট করে চোখ খুলে উপেন হাঁ। ধুনির আলোয় দেখতে পেল সামনে স্বয়ং শিব। সেই জটা, সেই ত্রিশূল, পরনে বাঘছাল, গলায়
রুদ্রাক্ষ আর সাপ, সর্বাঙ্গে বিভূতি, বিশাল চেহারা, ভুঁড়ি। উপেনের চোখ জলে টলটল করতে লাগল। স্থলিত কণ্ঠে সে বলল, “জয় বাবা শিবশন্তো! জয় বাবা বিশ্বনাথ।”
শিব হাত তুলে বললেন, “শুভমস্ত! শুভমস্ত!’
উপেন গদগদ হয়ে বলে, “বাবা, আপনি আবার কষ্ট করে আসতে গেলেন কেন? আসবার কথা তো মা কালীর। বহুক্ষণ ডাকাডাকি করছি।”
শিব গম্ভীর গলায় বললেন, “কেন রে ব্যাটা, কালীর চেয়ে শিব কমতি কিসে?”
“আজ্ঞে না, কমতি হবেন কেন? বলছিলাম কী, এক গেলাস জল চাইলে যদি কেউ গেলাসভর্তি বেলপানা এনে দেয়, সেটা কি ভাল?” “তা বেলপানাই বা খারাপ কী? তা আছে নাকি বেলপানা?” কথার কথা বলছিলাম আর কী!”
“আজ্ঞে না,” শিব বিরক্ত হয়ে বললেন, “খাবারদাবার কিছু নেই?” “আজ্ঞে, এ আমার সাধনপীঠ। এখানে খাবারদাবার আসবে কোত্থেকে?”
নাক সিঁটকে শিব বললেন, “আহা, সাধনপীঠের কী ছিরি!”
বলতে-বলতে মাথা থেকে হঠাৎ জটাটা একটানে খুলে ফেলে ঘ্যাঁস
গ্যাঁস করে টাক চুলকাতে-চুলকাতে শিব বললেন, “এই পরচুলাগুলো ব্যাটারা কী দিয়ে বানায় বল তো? মাথায় দিলেই এমন চুলকায় যে, পার্ট ভুলে যাওয়ার অবস্থা হয়।”
চোখ গোল-গোল করে দৃশ্যটা দেখছিল উপেন। হতাশ হয়ে বলল, “আপনি শিব নন?”
“একেবারেই নই, তাও বলা যায় না। আমার নামই হল মহাদেব সাঁতরা।”
“ব্যাপারটা কী হল আমি যে বুঝতে পারছি না।”
“আর বলিস না। এই পাশের গাঁ ফুলপুকুরে আজ দক্ষযক্ষ পালা ছিল। তাতে আমি হলুম গে শিব। যে মেয়েটা মেনকা সেজেছিল, সেই মিস মিনতি দক্ষযজ্ঞ পালায় ভুল করে বেহুলা লখিন্দর পালার ডায়ালগ বলে ফেলেছিল। মিনতিরও দোষ নেই। সাতদিন ধরে টানা সাত-সাতটা পালা করতে হচ্ছে রাত জেগে। দিনে পার্ট মুখস্ত করতে হয় বলে ভাল করে ঘুম হয় না। কবে কোন পালায় পার্ট করতে হচ্ছে তা খেয়াল রাখা কি চাট্টিখানি কথা! কিন্তু গাঁয়ের লোক পৌরাণিক পালা দেখে-দেখে ভারী পোক্ত হয়ে গিয়েছে। তাদের সামনে ভুল পার্ট বললে রেহাই নেই। ট্যাঁকের পয়সা খসিয়ে পালা দেখতে এসেছে, ইয়ার্কি তো নয়। ভুল পার্ট শুনে প্রথমটায় হাসাহাসি হচ্ছিল, তারপর চেঁচামেচি। আর তারপরেই দমাদম ইট আর ঢিল পড়তে লাগল। কিছু লোক লাঠিসোটা নিয়ে তেড়ে এল। দক্ষযজ্ঞ আর কাকে বলে! চোখের পলকে সব লন্ডভন্ড কাণ্ড। কোনও রকমে আসর থেকে পালিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে আসছি। অন্ধকারে এখানে একটু আলো জ্বলতে দেখে ঢুকে পড়েছি রে ভাই।”
উপেন তেতো গলায় বলে, “বেশ করেছেন। আজ আমার সাধনভজনটা বেশ জমে গিয়েছিল মশাই। দিলেন তো তার পিণ্ডি চটকে।”
মহাদেব সাঁতরা ভালমানুষের মতো মুখ করে বলল, “ওরে তোর কাঁচা বয়স। এই বয়সে অত সাধনভজন করলে যে দড়কচা মেরে যাবি ভাই। ওসব রয়ে সয়ে করতে হয়। তা হ্যাঁরে, কিছু খাবারদাবার জুটবে? অতিথি বলে কথা!’
উপেন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “তা জুটবে। তা আজ রাতে কি এ গাঁয়েই দেহ রাখবেন নাকি?”
“তা রাখলে হয়।”
“তা হলে চলুন, আমার বাড়ি কাছেই।
“ওরে বাপু, এই পোশাকে গেরস্থবাড়িতে গিয়ে পড়লে হুলুস্থুলু হবে। তার চেয়ে এই বেশ নিরিবিলি জায়গা আছে। এখানেই বরং কয়েকটা দিন থেকে যাই।”
“কেন, আপনার ঘরবাড়ি নেই?
“নারে, আমি বাপে তাড়ানো, মায়ে খেদানো ছেলে। যাত্রাদলের সঙ্গেই ঘুরে-ঘুরে বেড়াই।”
“যাত্রাদলের লোকেরা আপনাকে খুঁজবে না?”
“তা খুঁজবে। তবে আগামী দিনপনেরো আমাদের কোনও বায়না নেই। ক’দিন একটু জিরিয়ে নিই। গায়ে-গতরের ব্যথাটা একটু মজুক। তা তোদের এই গাঁয়ের নামটা কী বল তো?”
“এ হল বিদ্যেধরপুর।”
মহাদেব চমকে উঠে বলে, “কোন বিদ্যেধরপুর বল তো? পলতাবেড়ে বিদ্যেধরপুর নয় তো?”
“আজ্ঞে, সেই বিদ্যেধরপুরই বটে।”
মহাদেবের চোখ রসগোল্লার মতো বড়-বড় হয়ে গেল, “বলিস কী? বিদ্যেধরপুরের কথা তো আমার বিস্মরণই হয়ে গিয়েছিল। পাকেচক্রে সেই গাঁয়েই এসে পড়েছি, এ যে ভাবা যায় না।”
“কেন মশাই, আপনার সঙ্গে কি বিদ্যেধরপুরের কোনও সম্পর্ক আছে?”
‘‘আছে মানে! এ যে আমার পিসি রাসমণির গাঁ। বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর তো আমি তেরো বছর বয়সে এই পিসির কাছেই এসে উঠেছিলাম। দুঃখ কী জানিস, মা-বাবা নয়, এই দুনিয়ায় এই পিসিমাই যা একটু ভালবাসত আমায়।”
“আপনার পিসি কোন পাড়ায় থাকতেন বলুন তো
“মালোপাড়ায়।”
“পিসেমশাই কে?”
“ব্রজমাধব রায়।”
“কিন্তু ওঁরা তো…’
“জানি, কেউ বেঁচে নেই। পিসির ছেলেপুলেও ছিল না। পিসি আমাকে বলেছিল, বিষয়সম্পত্তি সব আমার নামেই লেখাপড়া করে দিয়ে যাবে। তখন কাঁচা বয়স, বিষয়সম্পত্তি নিয়ে মাথা ঘামানোর ইচ্ছেই হয়নি। এখন যাত্রা করার নেশায় পাগল হয়ে এদল ওদলের সঙ্গে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। এখন মনে হয়, একটু জমিজমা পেলে থিতু হতাম।”
‘‘ব্রজমাধব রায়ের বিষয়সম্পত্তি কিন্তু কম নয়। অনেক ধানী জমি, ফলন্ত বাগান, দোতলা বাড়ি।”
মহাদেব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “তাতে আর আমার কী বল, আমাকে কি আর দিয়ে গিয়েছে?”
“তা বলতে পারছি না। তবে কানাঘুষো শুনেছি, গোবিন্দ ঘোষের কাছে ব্রজমাধব রায়ের উইল রাখা আছে। ওয়ারিশানকে খুঁজে পেলে বিষয় আশয় তার হাতেই তুলে দেওয়া হবে। এমন তো হতেই পারে যে, ব্রজমাধব রায় তাঁর সবকিছুই আপনাকে দিয়ে গিয়েছেন।”
ফের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মহাদেব বলে, “ওরে, আর লোভ দেখাসনি। আমার কপালটা তত ভাল নয় রে। যাত্রাদলে ঘুরে ঘুরেই আমার জীবনটা কেটে যাবে।”
‘‘তবু খোঁজ নিতে দোষ কী? আজ রাতের মতো আপনি এখানেই থাকুন। আমি আপনার খাবারদাবারের জোগাড় করি। দেখি, যদি বাবা বা জ্যাঠার পুরনো ধুতিটুতি আনতে পারি কিনা।”
“তুই যে একটা হিরের টুকরো ছেলে রে!”
গোবিন্দ ঘোষের নেশা হল সকালের দিকে ন’বছরের নাতনি বাবলির সঙ্গে কয়েক দান কাটাকুটি খেলা। বাবলির দারুণ বুদ্ধি। রোজই দাদুকে অনায়াসে হারিয়ে দেয়।
আজও গোবিন্দ ঘোষ যথারীতি পরপর তিন দান হারলেন। আফসোস করে বললেন, “আসল কথা কী জানিস বাবলি, আমি বুড়ো হয়েছি তো, বুড়ো বয়সে মাথা ভাল কাজ করে না।”
বাবলি ঝামড়ে উঠে বলল, “মোটেই তুমি বুড়ো হওনি। তুমি বুড়ো হলে আমি টের পেতাম না বুঝি? আসলে তুমি মন দিয়ে খেলছ না। আমি যখন বাঁ দিকের কোণে গোল্লা দিলাম, তুমি তখন মাঝখানের
ঘরে ঢ্যাঁড়া দিলে কেন? কোনা আটকে না খেললে তো হারতেই হবে।” “ওরে ওটাই তো বুড়ো বয়সের দোষ।”
“মোটেই না। তোমার দাঁতও পড়েনি, চুলও পাকেনি, চোখে ছানিও আসেনি। বুড়ো হলেই হল? বুড়ো হওয়ার তো একটা নিয়ম আছে নাকি? ফের বুড়ো-বুড়ো বললে আমি তোমার সঙ্গে খেলবই না।”
“আচ্ছা বাপু, রাগ করিসনি। আয়, আর একটা দান খেলি।” “বুড়ো হওনি তো?”
“আরে না, কোথায় বুড়ো? কে বুড়ো? আমি তো একজন টগবগে মানুষ। কে আমাকে বুড়ো বলে ধরে নিয়ে আয় তো, কান মলে দিই।”
বাবলি হি হি করে হাসে। ঠিক এই সময় বাইরে থেকে কে ডাকল, “গোবিন্দজ্যাঠা, ও গোবিন্দজ্যাঠা।”
“কে রে?”
“আজ্ঞে, আমি উপেন। উপেন সর্দার।”
গোবিন্দ ঘোষ বাইরে বেরিয়ে এলেন। বললেন, “আয় রে উপেন, দাওয়ায় বোস। সঙ্গে উটি কে?”
” “বলছি জ্যাঠা, কথা আছে।’
তিনজন মাদুরে মুখোমুখি বসবার পর উপেন বলল, “ইনি হলেন রাসমণি রায়ের ভাইপো মহাদেব সাঁতরা। আপনার কাছে ব্রজমাধব রায়ের যে উইল আছে, তাতে কি এঁর নাম আছে জ্যাঠা?”
গোবিন্দ ঘোষ মহাদেবের দিকে চেয়ে বললেন, “তা এতকাল কোথায় ছিলে বাপু? তোমার বাড়িতে লোক পাঠিয়ে খবর নিয়ে জেনেছি তুমি নাকি নিরুদ্দেশ। বাড়ির কেউ কোনও খবর রাখে না, রাখতে চায়ও না। তা এতকাল পরে হঠাৎ উদয় হলে কী করে?”
মহাদেব তাড়াতাড়ি হাতজোড় করে বলে, “আজ্ঞে সম্পত্তির লোভে আসিনি। ঘটনাচক্রে এসে পড়েছি।”
“উইলে তোমার নাম আছে বটে, কিন্তু মুখের কথায় তো হবে না। তুমিই যে সেই লোক তার পাকা প্রমাণ চাই। ভোটের কার্ডটার্ড কিছু আছে বাপু?”
“আজ্ঞে না।”
“সেসব জোগাড় করে আনো, তারপরেও ফ্যাকড়া আছে।” “কিসের ফ্যাকড়া?”
“তোমার পিঠের নীচের দিকে মেরুদণ্ডের বাঁ পাশে একটা আব থাকার কথা।”
“আজ্ঞে আছে।”
“যাক, তা হলে তো হয়েই গেল। বোঝা গেল, তুমিই মহাদেব।” “যে আজ্ঞে।”
“তা লাঠি, সড়কি চালাতে পার?” “আজ্ঞে না।”
“তরোয়াল খেলতে জান?” “আজ্ঞে না।”
“বলি বন্দুক, পিস্তলে হাত আছে?” “আজ্ঞে তাও না।”
“হাতে গুন্ডা-মস্তান আছে?”
“না তো!”
গোবিন্দ ঘোষ ভারী বিরক্ত হয়ে বললেন, “তা হলে এতকাল করলে কী? এসব হাতের কাজ শিখে না রাখলে কি চলে? পিসির
সম্পত্তি কি ছেলের হাতের মোয়া? নাকি হাত ঘোরালেই নাড়ু?”
মহাদেব ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, “পিসির সম্পত্তির সঙ্গে এসবের সম্পর্ক কী?”
“হাতে পাঁজি মঙ্গলবার। যাও না, পিসির বাড়িটা এক পাক ঘুরে দেখেই এসো না। তা হলেই বুঝতে পারবে সম্পর্ক কী? এতকাল তোমার পিসির সম্পত্তি আগলে-আগলে রেখেছিলুম বটে, কিন্তু আমিও এই ঠিক তোমার মতোই আহাম্মক। তাই সময় থাকতে ওসব হাতের কাজ শিখে রাখিনি। রাখলে আজ কত কাজ হত বলো তো?”
কিছু বুঝতে না পেরে মহাদেব হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর বলল, “আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না মশাই।”
“আহা, এ বোঝা আর শক্ত কী? সোজা কথা হল, আমাদের বিদ্যেধরপুরে এখন বীরের বড় অনটন চলছে হে। দু’-একজন বীর থাকলে বড় ভাল হত। তা বলে সুভাষ বোসের মতো বীর নয় হে। ফাটা বিষ্টু, হাতকাটা সুখেন, শ্মশান সমরের মতো বীর।”
মহাদেব ভারী হতাশ গলায় বলে, “আমার মাথায় যে কথাগুলো কিছুতেই বসছে না মশাই। যদি একটু বাংলা করে বলেন?”
“বাংলা শুনতে চাও? বেশ, তা হলে বাংলা করেই বলছি। সোজা কথা হল তোমার পিসির সম্পত্তি বেওয়ারিশ বলে দেগে দিয়ে কর্নেলসাহেবের লোকজন তা দখল করে পাহারা বসিয়ে দিয়েছে। তারা বলছে, এই সম্পত্তির মালিকের কোনও হদিশ নেই বলে সরকার বাহাদুর নাকি সব ভেস্ট করে নিয়েছে।”
“কর্নেলসাহেব? তিনি কে?”
“তা কে জানে! তিনি ‘রক্তকরবী’র রাজা কিংবা ‘রামায়ণ’-এর মেঘনাদের মতোই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন।”
“তা হলে হরেদরে ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে বলুন তো? পিসির সম্পত্তির মালিক কি আমি নই?”
“কে বলল নও? বড় একখানা দোতলা বাড়ি, ফলন্ত বাগান, বিশ বিঘে সরেস ধানী জমির একচ্ছত্র এবং ন্যায্য মালিক যে তুমিই হে! ব্যাঙ্কে কয়েক লাখ টাকা আর গয়নাও আছে। ভেবে তোমার আনন্দ হচ্ছে না?”
“কোথায় আর হচ্ছে মশাই! যা শুনলুম তারপর কি আনন্দ হয়?”
“এইটেই তো তোমাদের দোষ। খবরটা যখন আনন্দের তখন আগে একটু আনন্দ করে নেওয়াই তো ভাল। তারপর সম্পত্তি বেহাত হওয়ার দুঃখু তো আছেই। দুঃখের সঙ্গে আনন্দের কাটাকাটি হয়ে গেল, তুমি যেখানে ছিলে সেখানেই রয়ে গেলে। দুঃখই বা কিসের, আনন্দই বা কিসের?” **
“কিছু কি করার নেই মশাই?”
“তা থাকবে না কেন? আজ থেকেই ডন, বৈঠক, মুগুর ভাঁজা শুরু করে দাও। লাঠিখেলা, তরোয়াল চালানো শেখো। বন্দুক, পিস্তলের তালিম নাও। ষন্ডা-গুন্ডা জোগাড় করে দল পাকাও। নইলে জলের মতো টাকা খরচ করে মামলা মোকদ্দমাতেও নামতে পার।”
“যদি পুলিশের কাছে যাই।”
“আহা, তা যাবে না কেন? যেতে বাধা কি? বিপিনদারোগা ভুঁড়ি ভাসিয়ে তোমাদের জন্যই বসে আছে। তার কথাবার্তাও ভারী মিষ্টি। শুনলে কান জুড়িয়ে যায়। তার কাছে কিছুক্ষণ বসলেই তোমার মনে হবে বিদ্যাধরপুরে কোনও অন্যায়, অধর্ম নেই, কোনও অশান্তি নেই। সব নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলছে। বিপিনদারোগা এও বলে যে, কর্নেলসাহেব বিদ্যেধরপুরকে দুবাই বা সিঙ্গাপুর বানিয়ে তবে ক্ষান্ত হবেন। যাবে তাঁর কাছে? যাও না, গিয়ে বুঝে এসো।”
“একেই কি হরিষে বিষাদ বলে মশাই?”
“ঠিক ধরেছ। একেই বলে হরিষে বিষাদ। আরও আছে। ধরো, ‘বাড়া ভাতে ছাই’, ‘মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়া’, ‘তীরে এসে তরী ডোবা’, ‘এক বালতি দুধে এক ফোঁটা চোনা’, ‘খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তার এঁড়ে গোরু কিনে’। তবু ভাল যে, তোমার গোখরো সাপ চুরি যায়নি। গেলে বুঝতে৷”
মহাদেব চমকে উঠে বলে “গোখরো সাপ?”
“গোখরো সাপ বললে কম বলা হয়। সে ছিল মহিমের মেয়ে। তা সেই গোখরো সাপকেই তুলে নিয়ে গেছে কর্নেলসাহেবের লোক। শোকে, দুঃখে মহিমের চেহারা এখন অর্ধেক। খবর এসেছে আম বাগানটা কর্নেলকে বিক্রি করলে গোখরো সাপ তরলাকে ফেরত পাবে। তা এখন শুনছি মহিম রাজি হয়ে গেছে।”
“তা হলে কি আর কোনও আশাই নেই?”
“তা থাকবে না কেন? আশা-ভরসাই তো আমাদের সম্বল হে।
যাদের অর্থবল, জনবল, বাহুবল নেই, তাদের আশা করা ছাড়া উপায় কী? ধরো, হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হয়ে কর্নেলসাহেব মরো-মরো হলেন, কিংবা তোমার পিসে আর পিসেমশাইয়ের ভূত কর্নেলের গুন্ডাদের তাড়া করে বাড়ি থেকে বের করে দিল, কিংবা বিপিনদারোগার হঠাৎ ধর্মভাব আর ন্যায়পরায়ণতা জেগে উঠল। এমন কি হয় না?”
দুপুরে খেয়েদেয়ে এসে রাজবাড়ির কালীমন্দিরের উঁচু বাঁধানো চাতালটায় একটা চট পেতে শুয়ে চোখ বুজে আকাশ-পাতাল ভাবছিল মহাদেব। রাতারাতি লাখপতি আর ফের রাতারাতি ফকির হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটায় তার মাথা ঝিমঝিম করছে। লাখপতি হওয়ারও দরকার ছিল না তার। ফকির হওয়াটাও ঠিক হল না। ঘটনাটা না ঘটলে জীবনটা তো আনন্দেই কাটছিল তার। পিছুটান নেই, সংসার নেই, বন্ধন নেই। আজ রাজা সেজে, কাল ভিলেনের ভূমিকায় তো পরশু শিব বা ব্রহ্মা হয়ে দিব্যি কেটে যাচ্ছিল। এই ঘটনার পর মনটা বড় বিচ্ছিরি রকমের খিঁচড়ে আছে।
কোনও সাড়াশব্দ হয়নি, তবু চোখ বুজে থেকেও কাছেপিঠে একটা নড়াচড়া টের পেল মহাদেব। একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দও হল কি? পট করে চোখ চেয়ে সে দেখতে পেল উঁচু চাতালের কানার উপর দুটো হাত একটা কেউটে সাপকে চাতালে ছেড়ে দিচ্ছে।
যাত্রা করে-করে আর কিছু না হোক মহাদেবের বড়ি বেশ ফিট। চট করে পাদুটো টেনে নিয়ে সে সাপটা ছোবল তোলার আগেই একটা বলটান খেয়ে উঁচু চাতালটা থেকে লাফ দিয়ে নীচে নেমে পড়ল। সামনেই কোলকুঁজো হয়ে লোকটা বসে আছে, তার সামনে একটা ঢাকনা খোলা সাপের ঝাঁপি।
অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে মহাদেব চোখের পলকে লোকটাকে দু’হাতে জাপটে ধরে দুটো রাম ঝাঁকুনি দিল। লোকটা নিতান্তই রোগাভোগা। এরকম পেল্লায় ঝাঁকুনিতে ককিয়ে উঠে বলল, “ছাড়ুন, বাবু ছাড়ুন। আমার হাড়গোড় ভেঙে যাবে যে! আমি সদ্য ন্যাবায় ভুগে উঠেছি।”
“তুমি আমাকে খুন করতে চেয়েছিলে?”
“বলছি, বাবু বলছি। একটু দম নিতে দিন।”
লোকটা হ্যা হ্যা করে হাঁপাচ্ছে দেখে ছেড়ে দিল মহাদেব। বলল, “খবর্দার পালাবার চেষ্টা করো না। তা হলে কিন্তু…”
লোকটা দম নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে হাত তুলে বলল, “পালাতে পারবও না বাবু। শরীরের সেই তাকতই নেই। ন্যাবা বড় পাজি রোগ, ” লোকটা উঁচু হয়ে বসে খানিক জিরেন নিয়ে বলল, “আমি শ্রীনাথ সাপুড়ে। আমার তেমন দোষ নেই বাবু। সাপটা আপনাকে কামড়ালে আমার পাপ হত ঠিকই, কিন্তু যা করেছি পেটের দায়ে।”
“খুলে বলো।”
“আজ্ঞে বলছি। মহিমবাবুর সাপটাকে চুরি করার জন্য নববাবুর সঙ্গে পাঁচ হাজার টাকার কড়ার হয়েছিল। নববাবু মোটে হাজার টাকা ঠেকিয়ে বললেন, ‘ওতেই হবে।’ তা তাঁর সঙ্গে তো ঝগড়া-কাজিয়া করা যায় না। গুন্ডা নিয়ে ঘোরেন।
“নববাবুটা কে?”
“আজ্ঞে, শুনেছি তিনি কর্নেলসাহেবের ম্যানেজার“তারপর বলো।”
“আজ সকালে নববাবু এসে হঠাৎ ঝপ করে দশ হাজার টাকা ফেলে দিয়ে বললেন, ‘বাকি চার হাজারের সঙ্গে আরও দশ হাজার টাকা আগাম দিচ্ছি। রাজবাড়ির কালীমন্দিরে একটা লোক এসে জুটেছে। তার ব্যবস্থা করতে হবে।”
“নববাবু আমাকে মারতে চায় কেন জান?”
“আজ্ঞে না বাবু, সেসব আমার জানা নেই। ন্যাবায় শয্যাশায়ী ছিলুম বলে রোজগারপাতি ছিল না। উপোস করার দশা। আমার ছেলেপুলেগুলোও ফলপাকুড় খেয়ে কাটাচ্ছে। তাই টাকাটা ফেরাতে পারিনি। রাজি হয়ে যাই। আপনি কে, কী বৃত্তান্ত কিছুই জানি না বাবু। আমাকে মাপ করে দিন।”
লোকটার চোখ থেকে অঝোরে জল পড়ছে দেখে মায়া হল মহাদেবের। বলল, “তোমার নববাবু যদি জিজ্ঞেস করে আমি সাপের কামড়ে মরেছি কিনা, তখন কী বলবে?”
“আমার বলা-কওয়ার ধার তিনি ধারেন না। তাঁর চর সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। আপনি একটু সাবধানে থাকবেন বাবু।”
সাপটা চাতাল পেরিয়ে মন্দিরে ঢোকার দরজার কাছটাতে গিয়ে চৌকাঠে উঠছিল। শ্রীনাথ চাতালে উঠে গিয়ে সাপটাকে অত্যন্ত দক্ষ হাতে ধরে নিয়ে এসে ঝাঁপিতে পুরে ঢাকনা দিয়ে বলল, “বাবু যদি অনুমতি দেন তো আজ আমি আসি।”
লোকটা চলে যাওয়ার পর স্তম্ভিত মহাদেব চাতালে ওঠার সিঁড়িটায় বসে রইল। মাথাটা একেবারে ভোঁ ভোঁ হয়ে গিয়েছে। নিজের অবস্থাটা ঠিক বুঝতেও পারছে না সে। আতঙ্কে হাত-পা একটু অসাড় লাগছে। হঠাৎ কাছেপিঠে কে যেন বলে উঠল, “এসব কী হচ্ছে কি?”
মহাদেব চমকে চারদিকে তাকিয়ে দেখল। তারপর বুঝতে পারল, গলার স্বরটা তার নিজেরই। ফের তার নিজের মুখ থেকেই কথা বেরিয়ে আসতে লাগল। যেন সে নয়, তার ভিতর থেকে অন্য কেউ কথা কইছে, “না-না আর এক মুহূর্তও এখানে নয়…ওরে বাবা, যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে…নিকুচি করেছে পিসির সম্পত্তির, আমার যাত্রাদলই ভাল…এ বড় বিপদের জায়গা, মানে-মানে বিদেয় হতে পারলে বাঁচি…”
মহাদেব তাড়াতাড়ি গিয়ে তার জিনিসপত্র গোছাতে লাগল। জিনিসপত্র বলতে পরচুলা, রুদ্রাক্ষের মালা, রবারের সাপ, কাপড়ের তৈরি বাঘছালটাল। সেসব পোঁটলা করে বেঁধে ফেলল সে। হাতে নিল ত্রিশূলখানা, এমন সময় ফের কাছেপিঠেই কে যেন বলে উঠল, “মশাই কি চললেন নাকি?”
কথাটা তার নিজের মুখ থেকেই বেরিয়েছে মনে করে মহাদেব কোনও জবাব দিল না। এখন যত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়া যায়, ততই মঙ্গল। দরজার দিকে ফিরতেই দরজা জুড়ে একটা বেঁটেখাট, মজবুত চেহারার লোককে লাঠিহাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এমন আঁতকে উঠল সে যে, শিথিল হাত থেকে পোঁটলা আর ত্রিশূল দুটোই পড়ে গেল মেঝেয়।
প্রথমটায় ‘‘আঁ আঁ” করে উঠেছিল সে। তারপর হাতজোড় করে বলল, “আজ্ঞে, আমি চলে যাচ্ছি। নাক-কান মলছি মশাই। আর কখনও এ গাঁয়ে আসব না। বলেন তো লিখে দিতে পারি যে, পিসির সম্পত্তি আমি মোটেই চাই না, উইলটুইল আমি ছিঁড়ে ফেলে দিতে রাজি।”
লোকটা গম্ভীর গলায় বলে, “তা বললে হবে কেন? পিসির সম্পত্তি ছাড়ব বললেই কি ছাড়া যায়? ছাড়তে আপনাকে দিচ্ছে কে?”
“না-না, আপনি ওভাবে বলবেন না। ওতে আমি ভারী অপরাধী হয়ে যাই। আমি স্বীকার করছি যে, রাসমণি রায় মোটেই আমার পিসি আমার কখনও কোনও পিসিই ছিল না।”
নন। আসল কথা হল,
“কিন্তু আপনার নাম যে মহাদেব সাঁতরা।” “তাই বলেছি বুঝি? ও আমার আসল নামই নয়।” “আপনার আসল নাম তা হলে কী?” “আজ্ঞে, বিশ্বনাথ প্রামাণিক।” “ওটা তো আপনার যাত্রার দলের অধিকারীর নাম।” ‘‘অ্যাঁ!ও, তা বটে। আসলে আমাদের দু’জনের একই নাম।” “আর আপনার পিঠে যে আব আছে!”
‘‘আব! আব! তাই তো!তা আব তো অনেকের পিঠেই থাকে। কত আবওয়ালা লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে!”
“তা হলে দাবিদাওয়া ছেড়ে দিচ্ছেন?”
“দাবিদাওয়া! কিসের দাবিদাওয়া? কার দাবিদাওয়া? দাবিদাওয়ার কথা উঠছে কিসে?”
“ভাল করে ভেবে বলছেন তো?”
“যে আজ্ঞে।”
“তা হলে চলুন আমি আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে গ্রামের বাইরে
ছেড়ে দিয়ে আসি।”
ভারী বিনয়ের সঙ্গে মহাদেব বলে, “না না, আপনি কেন কষ্ট করবেন?”
“রাস্তাঘাট যদি চিনতে না পারেন?”
“এ গাঁয়ের রাস্তাঘাট সব আমার চেনা।” “কী করে চিনলেন?”
“চিনব না? এখানে পিসির বাড়িতে ছিলুম যে!” “রাসমণি রায়ের বাড়িতে?”
মহাদেব শশব্যস্তে বলে, “ওই দেখুন, ফের ভুলভাল বকছি! না-না, সে অন্য গাঁয়ে। আর গাঁগুলো তো সব এক রকম।”
“আপনার পিসির বাড়ি কোন গাঁয়ে?” “মাধবপুর।”
“কিন্তু এই যে একটু আগে বললেন, আপনার কোনও পিসিই নেই?”
“সাক্ষাৎ পিসি নেই বটে, তবে লতায় পাতায় আছে।”
“কিন্তু আমার উপর হুকুম আছে আপনাকে গাঁয়ের সীমানা পার করে দিয়ে আসার।”
মহাদেব আমতা-আমতা করে বলে, “চলুন।” “যে আজ্ঞে।”
“আপনি আগে-আগে হাঁটুন, আমি পিছনে আছি
মহাদেব সভয়ে বলে, “সেটা কি ভাল দেখাবে! আপনি মান্যগণ্য লোক।”
“পিছন থেকে মাথায় লাঠি বসিয়ে দেব বলে ভয় পাচ্ছেন তো! সে তো ইচ্ছে করলে সামনে থেকেও বসানো যায়।”
“আজ্ঞে তা তো বটেই।”
“ভাল কথা। কাল ফুলপুকুরে আমিও যাত্রা দেখতে গিয়েছিলাম। ‘দক্ষযজ্ঞ’। তা আপনি তো বেশ ভাল পার্ট করেন মশাই!”
ভারী অবাক হয়ে মহাদেব বলে, “আমি?” “আপনি নন?”
“তা হবে বোধ হয়।”
একটা বাগানঘেরা বাড়ির ফটকের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়েই ঘটনাটা ঘটল, পিছন থেকে কী একটা যেন তার মাথায় লাগল। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মহাদেব।