জং বাহাদুর সিংহর নাতি – ৩

আজ সকালেই শিরীষ গাছটা থেকে মস্ত একটা মৌচাক নামিয়েছে রঘুনাথ। সেই টাটকা মধু মেশানো দুধের গেলাসে চুমুক দিয়ে হঠাৎ যেন ম্যান্দামারা সকালটা একেবারে ঝলমল করে উঠল বীরুর চোখের সমুখে। খাঁটি দুধ আর টাটকা মধু মিলেমিশে তার ভিতরে যেন ওস্তাদ গাইয়ের তানকারির সঙ্গে বাঘা তবলিয়ার সঙ্গত। যেন মেঘ ভেঙে শরৎশশীর উদয়।

রঘুনাথ ভারী বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করে, “কিছু কি টের পাচ্ছেন কর্তা?”

সম্মোহিত চোখে চেয়ে বীরু বলে, “পাচ্ছি হে রঘুনাথ, খুব টের পাচ্ছি।”

“পাওয়ারই কথা, আপনার ঠাকুরদাও দুধ আর খাঁটি মধু খেতেন কিনা।”

“খেতেন নাকি?” “যে আজ্ঞে।”

“তা সেকথা তুমি জানলে কী করে?”

“আজ্ঞে, আমি আর জানব কী করে? ওই ঈশানদাদা-ই বলে গেলেন সেদিন। তিনি আবার আপনার ঠাকুরদার রসুইকর ছিলেন কিনা।”

ভ্রু কুঁচকে বীরু বলে, “আমার ঠাকুরদার রসুইকর! বলো কী হে, সে আবার কে?”

“তাকে অবশ্যি আপনার চেনার কথাই নয়। তখন বড্ড ছোট ছিলেন তো আপনি।”

বীরু গম্ভীর হওয়ার একটা চেষ্টা করল। কিন্তু দুধ আর মধু মিলে তাকে এমন মেখে ফেলেছে যে, গম্ভীর হওয়া খুবই কঠিন। তাই আগে সে দুধটা শেষ করে অনেক কষ্টে মুখে, চোখে একটা ভ্রুকুটি ফুটিয়ে তুলে বলল, “আচ্ছা রঘুনাথ, এই ঘনারাম, বংশীবদন, নীলরতন পাঠক আর ওই ঈশানদাদা এরা তোমারই দলের লোক নয় তো?”

রঘুনাথ আকাশ থেকে পড়ে বলে, “আমার দল? বলেন কী কর্তা?” বীরু চিন্তিতভাবে বলে “এরকম সন্দেহ হওয়াটা কি অমূলক রঘুনাথ? আমার তো মনে হচ্ছে তোমার দলবল এ বাড়িতেই গা ঢাকা দিয়ে আছে।”

রঘুনাথ সবেগে মাথা নাড়া দিয়ে বলে, “আজ্ঞে না ওস্তাদ। তারা এ বাড়িতে গা ঢাকা দিয়ে আছে বটে, তবে তারা আমার দলবল নয়। তারা সব আপনারই দলবল। “

বিস্ময়ে হাঁ হয়ে বীরু বলে, “আমার দলবল?”

হঠাৎ পিছন থেকে বজ্রগম্ভীর স্বরে কে যেন বলে উঠল, “হ্যাঁ বীরুবাবু, তারা আপনারই দলবল। খবর্দার, একটুও নড়বেন না। হাতের অস্ত্র ফেলে দিন এবং দু’হাত উপরে তুলে দাঁড়ান। আমার হাতে লোডেড পিস্তল।”

বীরুর হাত থেকে দুধের খালি গেলাসটা ঠকাত করে মাটিতে পড়ে গেল। সে কাঁপতে-কাঁপতে দু’হাত তুলে দাঁড়িয়ে কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলে, “এসব কী হচ্ছে দারোগাবাবু?”

“আপনার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আছে বীরুবাবু। আপনি নিজের বাড়িতে একদল হুলিগান, অ্যানার্কিস্ট আর টেররিস্টকে পুষে রেখেছেন। কিছুদিন আগে তারা রামরিখ গয়লাকে প্রচণ্ড মারধর করেছে। সেই হামলায় রামরিকের কয়েকজন বন্ধুও উন্ডেড হয়েছে। ঠিক দু’দিন আগে আপনার বাড়ির পিছনের বাগানে একদল নিরীহ লোকের উপর আপনার দলবল বন্দুক নিয়ে চড়াও হয়। তাতে একজন গুরুতর উন্ডেড।”

বীরু কাঁপা গলায় বলে, “বিশ্বাস করুন বিপিনবাবু, আমার বাড়িতে কোনও দলবল নেই। কেউ বন্দুকও ছোড়েনি বরং কারা যেন আমার বাড়ির পাঁচিল ভেঙে দিয়ে গিয়েছে।”

“পাঁচিল ভাঙা যদি কোনও অপরাধ হয়েই থাকে, তা হলে সেটা দেখার জন্য আমিই তো আছি। আপনি তো আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারেন না। বাই দা বাই, আপনার কি বন্দুকের লাইসেন্স আছে?” “আজ্ঞে না, আমার বন্দুকও নেই।”

“পুলিশ শোনা কথায় বিশ্বাস করে না। আমরা সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে এসেছি। আপনার বাড়িতে তল্লাশি হবে। যাদের উপর হামলা হয়েছে তারা বলেছে, আপনার গ্যাংয়ের অনেকের হাতেই বন্দুক আর পিস্তল ছিল। ছিঃ, আপনাকে আমি একজন নিরীহ আর সজ্জন লোক বলে জানতুম। যদিও আপনার দাদু একজন কুখ্যাত ডাকাত ছিলেন, তবু আমার ধারণা ছিল, আপনি আপনার দাদুর মতো নন।”

“নইও। গাঁয়ের সবাই জানে আমি একজন ভিতু লোক।” “তাদের ধারণা এবার পালটাবে। আর আপনার এই কাজের

লোকটিকেও আমার সন্দেহ হচ্ছে। একে আমরা থানায় নিয়ে যাচ্ছি।” হাত কচলে এক গাল হেসে রঘুনাথ বলল, “এই রে! দারোগাবাবু কি আমাকে ভুলে গেলেন নাকি? এই তো সেদিন আপনার কাজের লোক আসেনি বলে আপনার বাড়িতে গিয়ে মশলা বেটে দিয়ে এলুম, কাপড় কাচলুম, কুয়ো থেকে না হোক বিশ-পঁচিশ বালতি জল তুলে চৌবাচ্চা ভরলুম, মহিমগঞ্জ থেকে গিন্নিমার বাতের তেল এলে দিলুম। পরশুদিনও তো একঝুড়ি কালো জাম আর একঝুড়ি পাকা আম দিয়ে এসেছি। গত কাল দিয়ে এসেছি ছানা আর ক্ষীর।”

বিপিনবাবু বললেন, “আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। তোমার ব্যাপারটা না হয় পরে ভেবে দেখা যাবে।”

“যে আজ্ঞে, যত পরে হয় ততই ভাল।”

তল্লাশিতে অবশ্য কিছুই পাওয়া গেল না। সেপাইরা এসে বলল, “না বড়বাবু, কিছুই পাওয়া গেল না। কিছু পুরনো লোহালক্কড় আছে, কিন্তু বন্দুক, পিস্তল নেই।”

“তরোয়াল, ছোরা, বল্লম?

“আজ্ঞে না, তবে এই পাকা বাঁশের লাঠিটা আছে বটে।”

বিরক্ত হয়ে বিপিনবাবু বললেন, “আরে দূর, দূর। লাঠি দিয়ে তো আর গুলি চালানো যায় না। এত লোক যখন এখানে থাকে, তখন এ বাড়িতে নিশ্চয়ই অনেকের রান্নাও হয়। তাদের শোয়ার জন্য বিছানা, বালিশ বা শতরঞ্চিও দরকার। তেমন কিছু দেখলে?”

“আজ্ঞে না বড়বাবু। পিছনের দিকের একটা ঘরে একটা মাত্র বিছানা আছে, আর সামনের দিকের ঘরে বীরুবাবুর খাট। বেশি লোকের রান্না হওয়ার মতো হাঁড়িকুড়িও নেই।”

“মাটির নীচে কোনও গুপ্ত কুঠুরিটুঠুরি নেই?”

“আছে। ভাঁড়ার ঘরের নীচে একটা ছোট্ট কুঠুরি। তাতে শুধু কয়েকটা মাটির জালা ছাড়া কিছু নেই।”

“তা হলে এবার বাগানটা সার্চ করো। গাছপালা, ঝোপঝাড় কিছুই বাদ দিয়ো না।”

“ঠিক আছে স্যার, ” বলে সেপাইটা চলে গেল।

বিপিনবাবু বীরবাহাদুরের ফাঁকা চেয়ারটায় বসে, পা ছড়িয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে বীরুর দিকে চেয়ে থেকে বললেন, “এত আর্মস আর দশ-বারোজন গুন্ডাকে কোথায় চোখের পলকে হাপিস করে দিলেন বলুন তো। লোকে আপনাকে ন্যালাখ্যাপা মনে করে বটে, কিন্তু আমি তো দেখছি আপনি একজন ঝানু ক্রিমিনাল।”

চোখ কপালে তুলে বীরু বলে, “আমি, আমি ক্রিমিনাল?”

“তবে! এমন আঁটঘাট বেঁধে কাজ করেন যে, আমি থ হয়ে গিয়েছি মশাই। এ বাড়িতে হানা দেওয়ার আগে আমি দোকানপাটে খোঁজ নিয়ে দেখেছি, এ বাড়িতে রোজ কতজনের আন্দাজ চাল, ডাল, তেল, নুন বা আনাজপাতি আসে। তা হলে আপনার দলের দশ-বারোজন গুন্ডা কি হাওয়া খেয়ে থাকত? এটুকু একটা গাঁয়ে দশ-বারোজন বাইরের লোকের পক্ষে দিনের পর দিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকাও সম্ভব নয়। অথচ অকাট্য প্রমাণ আছে, তারা এখানেই আছে। আর আছে যখন, তখন তাদের খোরাক আসছে কোত্থেকে? তারা তো আর হাওয়া, বাতাস খেয়ে থাকে না।”

রঘুনাথ ফস করে বলে উঠল, “আজ্ঞে, ঠিকই ধরেছেন দারোগাবাবু। তারা মোটেই কিছু খেতে চায় না।”

বিপিন দারোগা অবাক হয়ে বললেন, “কারা খেতে চায় না?” বীরু বিনয়ের সঙ্গে বলে, “ওর কথা ধরবেন না বিপিনবাবু, ওর একটু মাথার দোষ আছে।”

“হুঁ, আমারও তাই মনে হয়েছে বটে

“গরিবের দোষঘাটের অভাব কী? তা ধরুন, মাথার দোষও তার মধ্যে একটা।”

বিপিনবাবু বলেন, “হুঁ বুঝলাম। কিন্তু বীরুবাবু, এ কাজটা তো আপনি ঠিক করছেন না।”

“কোন কাজটা?’

“এই লোকমুখে শুনলাম, কে একজন পয়সাওয়ালা লোক এসে বেশ ভাল দামে আপনার বাড়ি আর বাগান কিনে নিতে চাইছে, কিন্তু আপনি রাজি হচ্ছেন না। এটা তো ঠিক হচ্ছে না মশাই। এই অজ পাড়াগাঁয়ে এই রকম একটা প্রস্তাব তো হাতে চাঁদ পাওয়ার শামিল। হাতের লক্ষ্মী কি পায়ে ঠেলতে আছে? দেখাশোনা, রক্ষণাবেক্ষণ হয় না বলে বাড়ি ঝুরঝুরে হয়ে যাচ্ছে। বাগান আগাছার জঙ্গল হয়ে উঠেছে। সাপখোপ, পোকামাকড়, মশামাছি, ভূতপ্রেতের আড্ডা বসে গিয়েছে।”

ফস করে রঘুনাথ ফের বলে বসল, “তা আর বলতে!”

“ওই যে শুনুন, রঘুনাথও সায় দিচ্ছে। বেচে দিন মশাই, বেচে দিন। যেসব ক্রিমিনাল আপনি পুষছেন, তাদেরই বিশ্বাস কী? একদিন তারাই হয়তো আপনার উপর চড়াও হয়ে সব দখল করে নেবে। তখন একূল ওকূল দুই-ই গেল আপনার।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বীরু বলে, “হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছে বটে।”

“এই তো বিবেচকের মতো কথা। পুরনো বাড়ি, পুরনো জিনিসপত্র আঁকড়ে থাকাটা কোনও কাজের কথা নয়। দেখুন না, মহিমবাবু তাঁর কবেকার আম বাগান কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইছিলেন না। এমনকী যারা কিনতে এসেছিল, তাদের অকারণে বন্দুক নিয়ে তাড়া করেছিলেন। দেমাকি লোক, বন্দুক আছে, গোখরো সাপ পোষেন। তা সেই মহিমবাবুও শুনেছি নিমরাজি হয়েছেন। গাঁয়ের আর সবাই তো ভাল দাম পেয়ে তাদের বাড়তি জমি ছেড়ে দিচ্ছে। শুধু আপনারা দু’একজন যা গাঁইগুঁই করছেন।”

“তা বটে।”

“ভাল কথাই বলছি, জমিজমা ভাল দামে বেচে দিয়ে একটা ছোটখাট বাড়ি কিনে নিয়ে আরামে থাকুন। আর্মস অ্যাক্ট এবং হুলিগ্যানিজম অ্যান্ড রায়টিংয়ের জন্য আমি আপনার নামে কোনও চার্জ দেব না। নইলে অগত্যা নাচার হয়ে আপনাকে অনিচ্ছে সত্ত্বেও আমাকে অ্যারেস্ট করতে হবে।”

আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বীরু বলে, “বুঝেছি।”

সেপাইরা ফিরে এসে বলল, “না বড়বাবু, সারা বাগান সার্চ করে দেখেছি। কোনও আর্মস পাইনি। কেউ গা-ঢাকা দিয়েও নেই।”

“ঠিক আছে, ঠিক আছে। সব ভাল যার শেষ ভাল, ” বলে উঠে পড়লেন বিপিনবাবু। মুখে একটু হাসি-হাসি ভাব। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, “আমি তদন্ত করে দেখছি। আপনার বাগানের দেওয়ালটা ভেঙেছে গাঁয়ের দুষ্টু ছেলেরাই। আম, জামের লোভেই কাণ্ডটা করেছে বলে মনে হয়। তাই আমি ও ব্যাপারে কোনও অ্যাকশন নিচ্ছি না, বুঝলেন?”

“যে আজ্ঞে, বুঝতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না।”

“বুঝবেন বইকী! আপনি বুদ্ধিমান লোক।”

বিপিনবাবু বিদেয় হওয়ার পর রঘুনাথ খুব সন্তর্পণে জিজ্ঞেস করল, “বাড়িটা কি বেচেই দেবেন নাকি কর্তা?”

বীরুর আজ সকাল থেকেই মেলা দীর্ঘশ্বাস পড়ছে। কাহিল গলায় বলে, “কী আর করব বল দিকি? আমি দুর্বল মানুষ, জনবল নেই, অর্থবল নেই, ডাকাবুকো নই। স্বয়ং দারোগাবাবুও ওদের পক্ষে। আমি তো ওদের ঠেকাতে পারব না।”

“তা তো ঠিকই, তবে কিনা বাড়িটা বেহাত হলে আপনার কুটুমরা ভারী দুঃখ পাবে। এতকালের আশ্রয় ছেড়ে তারা এখন কোথায় গিয়ে মাথা গুঁজবে সেটাই চিন্তার কথা।”

এবারের দীর্ঘশ্বাসটাও চাপতে পারল না বীরু। বলল, “বাপু রঘুনাথ, আমার কুটুমের খাতে তুমি কাকে কাকে ধরেছ তার একটা লিস্টি দিতে পার আমাকে? যার তিন কূলে কেউ নেই তার আবার কুটুম হয় কী করে সেটাই তো আমার মাথায় আসছে না। এরা তোমার সেই ঘনারাম, বংশীবদনরা নয় তো!”

ঘাড় চুলকে ভারী লাজুক মুখে রঘুনাথ বলে, “আজ্ঞে তেনারাই। আপনি তাঁদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন বটে, কিন্তু আপনার উপর তাঁদের যে বড্ড মায়া।”

“তা তাঁরা আমার কুটুম হতে যাবেন কোন দুঃখে? তাঁরা বরং তোমার কুটুম, তোমার সঙ্গেই ভাবসাব। আমার তো সন্দেহ হচ্ছে ওই যারা দেওয়াল ভাঙতে এসেছিল, তাদের উপর তুমিই তোমার কুটুমদের নিয়ে হামলা করেছিলে। নইলে নবকুমারের দল পালানোর লোক নয়। কথাটা ঠিক কিনা বুকে হাত দিয়ে বলো তো রঘুনাথ!”

রঘুনাথ ভারী অপরাধী মুখ করে বলে, “আজ্ঞে আপনাকে গুরু বলে মেনেছি, মিছে কথা তো কইতে পারি না। কথাটা আপনি বেঠিকও বলেননি। নবকুমারের গুন্ডার দলের উপর হামলা তেনারাই করেছিলেন বটে, তবে আসল কথা কিন্তু তেনারা আমার কুটুম নন মোটেই। আপনি বিশ্বাস করুন বা না করুন, তেনারা আপনারই কুটুম বটে।”

বিরক্ত হয়ে বীরু বলে, “তোমার মতো পাগলের সঙ্গে কথা কয়ে লাভ নেই। মোদ্দা কথাটা হল, কুটুমরা তোমারই হোক কী আমারই হোক, এরকম কুটুম থেকে তফাত থাকা ভাল। একটা অকারণ গন্ডগোল পাকিয়ে তাঁরা কোন উপকারটা করলেন বলো তো? আর একটু হলে তো হাজতবাস করতে হত আমাকে।”

“তাঁরা মোটেই আপনার উপকার করতে চাইছিলেন না কর্তা।” “তবে তাঁরা চাইছেন কী?”

“তাঁরা চাইছেন আপনার উপকার আপনি নিজেই করুন।” “তার মানেটা কী দাঁড়াচ্ছে?”

।” বীরু বিরক্ত হয়ে বলে, “যতসব পাগলের প্রলাপ।”

“একবার লাফ মেরে উঠে বুক চিতিয়ে দাঁড়ালেই হয়

“আজ্ঞে তা বটে। তবে কিনা মাঝে-মাঝে মানুষের একটু খ্যাপামিরও দরকার হয় কিনা।”

বীরু হতাশ হয়ে বলে, “খেপে গিয়ে লাভ কী হে রঘুনাথ? সবকিছুই তো আমার বিরুদ্ধে। এমনকী এই তুমিও নিজের মুখে বলে ফেললে যে, ঘরের কাজকর্ম করে দাও, ফাইফরমাশ খাটো। তা হলে আমি আর কার উপর ভরসা রাখি বলো!”

“আজ্ঞে সে কথাও ঠিক। দারোগাবাবুর সঙ্গে দহরম মহরম এক রকম নেমকহারামিই দাঁড়ায় বটে। কারণ, দারোগাবাবু তো আর আপনার পক্ষের লোক নন। আমি এ বাড়িতে গিয়ে নামে কূটকচালি করছি কিনা, অন্ধিসন্ধির খবর দিচ্ছি কিনা, এরকম সন্দেহ তো আপনার হতেই পারে।”

“হচ্ছেও।”

“যে আজ্ঞে। তবে আমার তেমন দোষ নেই কর্তা। একদিন বীলরতন পাঠকমশাই এসে বললেন, ‘ওরে রঘু, আমি তো ভাবগতিক বিশেষ ভাল বুঝছি না। লক্ষণ যা দেখছি তাতে তোকে না হাজতবাস করতে হয়। আর তুই যদি হাজতে যাস, তা হলে বীরু যে বড্ড কাহিল হয়ে পড়বে।’ তা বাবা, তুই দারোগাবাবুর সঙ্গে একটু ভাবসাব বজায় রাখিস। দারোগা, পুলিশ হাতে থাকা ভাল। আলপটকা বিপদে পড়লে কাজে দেয়।”

“এ কথাটাও কি আমাকে বিশ্বাস করতে বলো?”

“আজ্ঞে, শুনতে একটু মিথ্যের মতো লাগে বটে, কিন্তু কথাটা নির্জলা সত্যি। মুখপাতটুকু করে রেখেছিলুম বলে রক্ষে। নইলে আজ কোমরে দড়ি পরিয়ে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যেত।”

“দেখো রঘুনাথ, তোমাকে বুঝবার জন্য বোধ হয় একটা মানে বই দরকার। তুমি আমার শত্রু না বন্ধু তা-ই আমি আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারলাম না। এই যে সকালে তুমি আমাকে মধু মিশিয়ে দুধ খাওয়ালে, তখন মনে হল, রঘুনাথের মতো বন্ধু হয় না। আবার পরে পরেই যা-যা হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে তুমি আমাকে মোটেই শান্তিতে থাকতে দিতে চাও না। দুধটা খাওয়ার পর বেশ চনমনে লাগছিল। এখন উদ্বেগ, অশান্তিতে শরীরটা দুর্বল লাগছে।”

“ভাল কথা মনে করেছেন ওস্তাদ, স্নায়ুদৌর্বল্যে চ্যবনপ্রাশ। এই যে কর্তা, এই বয়াম থেকে এক খাবলা মেরে দেন তো।”

রঘুনাথের হাতের বয়ামটার দিকে সভয়ে চেয়ে থেকে বীরু বলে, “চ্যবনপ্রাশ! হঠাৎ চ্যবনপ্রাশ খেতে যাব কেন?”

“আজ্ঞে, আপনার ঠাকুরদাও খেতেন কিনা।”

রঘুনাথ অম্লানবদনে বলে, “কয়েকটা ডন-বৈঠক দিয়ে নেন কর্তা। দেখবেন শরীরটা বেশ চনমনে হয়ে উঠবে।”

“পাগল হয়েছ? জীবনে কখনও হুড়যুদ্ধু করিনি। ওসব আমার পোষাবে না বাপু। বয়সের কথাটাও তো মনে রাখতে হবে!”

“যে আজ্ঞে! তা ঠাকুরের ইচ্ছেয় বয়সও তো বড় কম হল না আপনার। সামনের অগ্রহায়ণে আপনি বত্রিশে পা দেবেন।”

বীরু গম্ভীর হয়ে বলে, “তা বত্রিশটা কি তোমার কাছে কাঁচা বয়স বলে মনে হচ্ছে নাকি?”

“আজ্ঞে না, বত্রিশ বছর তো বেশ যথা বয়স বলেই মনে হচ্ছে।”

“কিন্তু রঘুনাথ, আমার বয়সের এত নিখুঁত হিসেব তুমি জানলে কী করে?”

“আমি আর কী করে জানব বলুন, তবে নীলরতন পাঠকমশাইয়ের কাছে পাকা হিসেব আছে।”

“নীলরতন পাঠক! তা তিনিই বা হিসেবটা পেলেন কোথায়?” “বলেন কী কর্তা, তিনি যে আপনার ঠিকুজি কোষ্ঠী করেছিলেন।”

বীরু অবাক হয়ে বলে, “আমার ঠিকুজি কোষ্ঠী তো করেছিলেন বুলবুলি ঠাকুর।”

একগাল হেসে রঘুনাথ বলে, “তিনিই। কাঁধে পোষা বুলবুলি পাখি নিয়ে ঘুরতেন বলে তাঁর ওই নাম দিয়েছিল লোকে।”

যাতায়াতও আছে।”

“তার মানে কী রঘুনাথ?”

রঘুনাথ ভারী কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “মানে কি আমিই জানি কর্তা?” “যিনি বিশ বছর আগে গত হয়েছেন, তিনি এখনও যাতায়াত করছেন কী করে?”

“এই তো মুশকিলে ফেললেন। তা তিনি যাতায়াত করলে আমাদের কী করার আছে বলুন?”

“একটা কাজ করার আছে বাপু। আর সেটা হল, মিছে কথা না বলা। তবে এ কথা স্বীকার না করেও উপায় নেই যে, আমার জন্ম অগ্রহায়ণেই হয়েছিল বটে। আমি বত্রিশে পা দেব, এটাও সত্যি। আর ঠিকুজি কোষ্ঠী যে বুলবুলি ঠাকুরই করেছিলেন একথাও ঠিক। কথা হল, তুমি এতসব খুঁটিনাটি জানলে কী করে? সত্যি কথা বলতে কী, এত সব তো আমার মনে ছিল না।”

“মুশকিল কী জানেন কর্তা, আপনার কাছে থেকে-থেকে অভ্যেস এমন খারাপ হয়ে গিয়েছে যে, মিছে কথাগুলো কিছুতেই মুখে আসতে চায় না। আর সত্যি কথা বললে আপনার কেমন বিশ্বাস হয় না।”

“কথাটা ঠিক। তাঁর কাঁধে একটা পোষা বুলবুলি বসে থাকত বটে!কিন্তু তাঁকে তুমি পেলে কোথায় বাপু? তিনি না হোক বিশ বছর আগেই গত হয়েছেন।”