জং বাহাদুর সিংহর নাতি – ২

“হ্যাঁরে গুটে, শেষ পর্যন্ত কি তুইও বুড়ো হলি নাকি? গত চার মাসে এবার নিয়ে তিন-তিন বার ধরা পড়লি। কত বড় লজ্জার কথা বল তো? আর এই তোকে ধরতেই অতবড় ডাকসাইটে দারোগা দীনু বিশ্বাস তিন বছর ধরে ঘোল খেয়েছিল। প্রমোশন পর্যন্ত আটকে

গেল। শেষ পর্যন্ত আড়কাঠি মারফত তোকে খবর পাঠিয়েছিল, ‘ভাই গুটে, তুমি ধরা না দিলে যে আমার মান ইজ্জত থাকছে না। অনিদ্রায় ভুগছি, খিদে হচ্ছে না, লোকে দুয়ো দিচ্ছে। একবারটি ধরা দিয়ে আমার মুখরক্ষা করো। তোমার মেয়ের বিয়েতে আমি তিন ভরির সোনার হার দেব।’ মনে আছে সে কথা?”

“যে আজ্ঞে! দারোগাবাবুরা বরাবর আমাকে স্নেহ করতেন।”

“হ্যাঁরে, তোর চোখে ছানিটানি আসেনি তো? ব্লাডপ্রেশারটা কি মাসে-মাসে পরীক্ষা করাস? কানে কম শুনছিস না তো আজকাল? বাতে ধরেনি তো? খিদে, ঘুম সব ঠিকমতো হয় তো? শরীর নড়বড়ে হয়ে গেলে কি আর ও লাইনে সুবিধে করতে পারবি? যোগাসন, প্রাণায়াম সব করিস তো? বারবার আনাড়ির মতো ধরা পড়ে যাচ্ছিস বলে তোর জন্য বড্ড চিন্তা হচ্ছে।”

“আজ্ঞে বড়বাবু, শরীরের জোয়ার-ভাটা তো আছেই। বয়সও তো হচ্ছে। তবে কিনা সেইজন্য নয়। আমার মনটাই বড় উচাটন হয়ে আছে কিনা। আমার নিজের হাতে তৈরি চেলাচামুণ্ডারা কেমন করে-কন্মে খাচ্ছে। কিন্তু আমার নিজের ছেলেপুলেরাই তো কিছু শিখতে চাইল না বড়বাবু!অপোগণ্ড রয়ে গেল।”

“কেন, তারা কোন নবাবপুত্তুরটা যে তোর মতো ওস্তাদকে হাতে পেয়েও পায়ে ঠেলল?”

“দুঃখের কথা কী বলব বড়বাবু, আমার বউ-ই তাদের কাছে আমায় ঘেঁষতে দিল না। দুই ছেলেই লেখাপড়া শিখে একজন কলেজের মাস্টার, আর-একজন উকিল। ওই আলুনি কাজ করে কী মজা পায় তা ওরাই জানে। আরও দুঃখের কথা শুনবেন? আমার একটা বছরতিনেকের ফুটফুটে নাতনি রয়েছে। সে আমার বড্ড ন্যাওটা। মাঝে-মাঝে কোলে উঠে গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ও দাদু, তুমি কি চোর?’ সেই থেকেই কেমন যেন কাজে গুবলেট করে ফেলি। এই তো সেদিন চাঁদু কর্মকারের বাড়িতে শোয়ার ঘরে ঢুকে তার বউয়ের গলা থেকে বিছে হারটা সরিয়ে বেরিয়ে আসছি, হঠাৎ নজরে পড়ল বউটার পাশে শোওয়া ছোট খোকাটির গা থেকে লেপটা সরে গেছে। বড্ড শীত ছিল সেই রাতে। মতিভ্রমই হবে, মায়ার বশে গায়ে লেপটা টেনে দিতে গেলুম, আর অমনি বউটা এমন চেঁচাল যে…”

“বুঝেছি রে গুটে। সেইজন্যই তো গীতায় বলেছে, ‘ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্তোত্তিষ্ঠ পরন্তপঃ”। মন দুর্বল হলেই সর্বনাশ, কাজ ভণ্ডুল।”

“আজ্ঞে, তাই ভাবছি। এবার কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে বাকি জীবনটা জেলখানাতেই কাটিয়ে দেব। জেলখানা তো আমার এক রকম বাড়ির মতোই, কী বলেন। সারাদিন শুয়ে, বসে থেকে হরিনাম করলেও পরকালের খানিকটা কাজ হবে। কী বলেন বড়বাবু?”

“সর্বনাশ!”

“কেন বড়বাবু, খারাপ কিছু বললুম নাকি?”

“তুই তো ডাকাত, অমন কথা বলতে আছে? আমাদের সরকারবাহাদুর যে বড্ড গরিব রে গুটে। কত লোককে বসিয়ে বসিয়ে তিনবেলা ভরপেট খাওয়াবে বল তো? আর শুধু কী খাওয়া, তেলসাবান আছে, চুল ছাঁটার মজুরি আছে, অসুখ হলে ডাক্তার, বদ্যি, ওষুধের খরচ আছে। তোদের কি সরকারবাহাদুরের কথা ভেবে একটুও মায়াদয়া হয় না? আজকাল তো দেখছি কাজকর্ম জোটাতে না পারলে দিব্যি ছোটখাট চুরিচামারি কী গুন্ডামি করে গটগট করে এসে দাঁত বের করে জেলখানায় ঢুকে পড়ছে সব। তারপর দিব্যি ঠ্যাঙের উপর ঠ্যাং তুলে তিন বেলা খ্যাঁটন, বারো ঘণ্টা ঘুম আর কূটকচালি। ছিঃ ছিঃ! দেশপ্রেম নেই, আনুগত্য নেই, লজ্জাশরম, আত্মমর্যাদা নেই। তুই কোন দুঃখে ওই অপোগণ্ডগুলোর দলে নাম লেখাবি? আমি তো আজকাল পারতপক্ষে কাউকে অ্যারেস্টই করি না। সব্বাইকে বলি, যা করছ করো, শুধু দয়া করে ধরা পড়ে সরকারবাহাদুরের গলগ্রহ হয়ে থেকো না। আমরা তো আর অন্নসত্র খুলে বসিনি।”

“তা কথাটা তো ন্যায্য বলেই মনে হচ্ছে বড়বাবু। এদিকটা আমি ভেবে দেখিনি।”

“আহা, তুই ভাবতে যাবি কেন? ভাবাভাবি কি তোর কাজ? তার জন্য তো আমরাই আছি।”

“তা আমার দিকটাও তা হলে কি একটু ভাববেন নাকি বড়বাবু?” “দ্যাখ, এখন চুরিচামারি করতে গেলে বয়সের দোষে তোর ভুলচুক হবেই হবে। অগত্যা ধরা পড়ে তোর জেল হবে। তার চেয়ে

বরং তুই ইনফর্মার হয়ে যা। তাতে হাতখরচাটা হয়ে যাবে।”

“শেষে কি আড়কাঠিই হতে হবে বড়বাবু? তাতে কি আমাদের সমাজে আমার মানমর্যাদা থাকবে?”

“ওরে, ইনফর্মার মানে এক রকম গোয়েন্দাই। গোয়েন্দাদের কি মানমর্যাদা কিছু কম? তাদের নিয়ে কত বই লেখা হয়, সিনেমা হয়। নিজেকে আড়কাঠি না ভেবে গোয়েন্দা বলে ভাবিস।”

“নাহ, একথাটা বড় জব্বর কথা। নিজেকে গোয়েন্দা ভাবতে বেশ একটু গা গরম হচ্ছে বড়বাবু।”

“ওই জন্যই তো বলি, বেশি ভাবতে যাসনে। ভাবনার ভার আমার।”

“তা হলে বউনিটা করেই যাই আজ বড়বাবু।”

“কিসের বউনি?”

“একটা খবর আছে।”

“কী খবর রে?”

“আজ্ঞে, আজ শেষ রাতে বীর বাহাদুরের বাড়ি থেকে একটা বন্দুকের আওয়াজ হয়েছে।”

“সর্বনাশ! বীর বাহাদুরের বাড়ি থেকে? কিন্তু সে তো ভেডুয়া লোক। সে বন্দুক পেল কোথা থেকে?”

“কানাঘুষো শুনেছি, তার বাড়িতে একটা উটকো লোক ঢুকেছে। মস্ত লেঠেল।”

বিপিনদারোগা ভ্রু কুঁচকে বললেন, “লেঠেল! বীর বাহাদুরের আবার লেঠেলের দরকারটা কী? আর লাঠি দিয়ে যে গুলিও চালানো

যায় তা তো কখনও শুনিনি।”

“আজ্ঞে ভেঙে না বললে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে না কর্তা। আসল কথাটা হল, রঘুনাথ অতি গুন্ডা লোক। গয়লা রামরিখ দলবল নিয়ে চড়াও হয়েছিল তার উপর। রামরিখ শুধু পালোয়ানই নয়, একজন পাকা লাঠিয়ালও বটে। কিন্তু একা রঘুনাথ তাদের উত্তমকুস্তম লাঠিপেটা করেছে। শুনতে পাচ্ছি, বীরুবাবুর ভাঁড়ার ঘরে কিছু পুরনো লোহালক্কর পাওয়া যায়। সেগুলোর মধ্যে নাকি কিছু মরচে ধরা পুরনো বন্দুক, পিস্তলও ছিল। মনে হয় রঘুনাথ সেগুলো ঘষেমেজে কাজের যুগ্যি করে নিয়েছে।”

বিপিনবাবু চোখ কপালে তুলে বললেন, “বলিস কী? এ তো ভয়ঙ্কর খবর। তা হলে তো এক্ষুনি রঘুনাথকে ধরে আনতে হয়।”

“তাড়াহুড়ো করবেন না বড়বাবু। খামোকা আবার সরকারবাহাদুরের আর-একটা খরচ বাড়বে। বন্দুকের খবরটা পাকা নয়। পাকা খবর পেলে আমি সময়মতো দিয়ে যাব।”

“বন্দুকের শব্দটা কি তুই আর ভুল শুনেছিস?”

“ভুলও শুনে থাকতে পারি। বয়স হয়েছে তো, কান কি আর আগের মতো কাজ করে বড়বাবু? পটকার আওয়াজও হতে পারে। আর-একটা কথা, পুরনো জং ধরা বন্দুকে গুলি ভরে চালানো কিন্তু খুব বিপজ্জনক। বন্দুকের নল কেটে বন্দুকবাজেরই মারা পড়ার সম্ভাবনা।”

“তা হলে কি তুই বলতে চাস যে, রঘুনাথ একজন বিপজ্জনক লোক?”

“সেরকমই মনে হয়। তবে মুখ দেখলে মনে হবে ভারী গোবেচারা মানুষ। বীরুবাবুর কাছে লাঠি আর তরোয়াল খেলা শিখতে এসেছিল। সেই থেকে রয়ে গেছে।”

“সর্বনাশ! বীর বাহাদুর কি ওসব জানে নাকি

“আজ্ঞে না। তবে তার দাদু জং বাহাদুর ছিল ওস্তাদ লেঠেল। তরোয়াল চালানোতেও জুড়ি ছিল না, আবার বন্দুক, পিস্তলেও অব্যর্থ টিপ।”

বিপিনদারোগা মুখে একটা তাচ্ছিল্যসূচক ‘ফুঃ’ শব্দ করে বললেন, “কিছু-কিছু মানুষ আছে যারা মরার পর মানুষের মুখেমুখে মহান হতে থাকে। গ্যাস বেলুন দেখেছিস তো? এ হল সেই বৃত্তান্ত। যত গ্যাস ভরবি, তত ফুলবে আর ততই উপরে উঠবে। এই যেমন আলেকজান্ডার, চেঙ্গিস খান, তৈমুর লং তেমনি তোদের ওই জং বাহাদুর। ভাল করে খোঁজ নিলে দেখা যাবে লোকটার হয়তো আমাশা বা বাতব্যাধি ছিল। হয়তো ম্যালেরিয়ায় ভুগত কিংবা ভূত বা আরশোলায় ভয় পেত। সেসব কথা তো ইতিহাস বইতে লেখা থাকে না, বুঝলি। ইতিহাস পড়েছিস তো?”

“আজ্ঞে না বড়বাবু। বর্ণপরিচয়ের পর আর ওদিকটায় যাতায়াত নেই কিনা। তবে না পড়লেও আপনার কথা বেশ বুঝতে পারছি।”

“আরে এলাকার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হল গিয়ে দারোগা। তার কাজই হল দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন। তা জং বাহাদুরের আমলে এলাকার দারোগাটা ছিল কে? না, রাখাল গোঁসাই। পরম বৈষ্ণব মানুষ। মশাটা, মাছিটা পর্যন্ত মারত না। নিয়মিত একাদশী করত, সকাল-বিকেল কীর্তন গাইত খোল, করতালসহ। কপালে রসকলি, কেটে কি আর চোর, ডাকাতের সঙ্গে পাঙ্গা দেওয়া যায়? তাই তখন ছিল চোর, ডাকাতদের মোচ্ছব। এই আমার মতো একজন জাঁদরেল অফিসার থাকলে কি আর জং বাহাদুরের জারিজুরি খাটত? কী বলিস?”

“যে আজ্ঞে, কথাটা তো ন্যায্য বলেই মনে হচ্ছে।”

“ন্যায্য কথাকে তো ন্যায্য বলেই মনে হবে। এখন চারদিকে তাকিয়ে দেখ, এক শান্তির রাজ্য। কোথাও কোনও গন্ডগোল নেই। কে যেন চারদিকে শান্তির জল ছিটিয়ে দিয়ে গিয়েছে। গাছে-গাছে ফল ধরে আছে, ফুলে-ফুলে মৌমাছি আর প্রজাপতি ঘুরে বেড়াচ্ছে, গাঁয়ের বধূ কলসি কাঁখে টিউবওয়েল থেকে জল নিয়ে যাচ্ছে, বুড়োরা নির্ভয়ে প্রাতঃভ্রমণ, সান্ধ্যভ্রমণ করছে, ছেলেরা মাঠে-ঘাটে খেলে বেড়াচ্ছে, চাষিরা চাষ করছে, তাঁতিরা তাঁত বুনছে, কুমোররা হাঁড়িকুড়ি? বা প্রতিমা গড়ছে, কামাররা দা, কুড়ুল তৈরি করছে, কোথাও কোনও অরাজকতা দেখতে পাচ্ছিস?”

“আজ্ঞে না। বিদ্যেধরপুরের লোকেরা তো অরাজকতা কথাটাই ভুলে গেছে বড়বাবু।”

বিপিনবাবু আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বললেন, “তবেই বুঝে দেখ। খুনোখুনি নেই, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই নেই। শুধু পাখির ডাক, শুধু রাখালিয়া বাঁশির সুর, শুধু আলো-হাওয়া। গুটে কি ঘুমিয়ে পড়লি নাকি রে?”

“আজ্ঞে না বড়বাবু, চোখ বুজে শুনছিলাম। শুনতে এত খাসা লাগছিল যে, একটু তন্দ্রামতো এসে গিয়েছিল। তা বড়বাবু কি নির্যস এই বিদ্যেধরপুরের কথাই বলছিলেন আজ্ঞে?”

“তা নয়তো কী?”

“তাই জায়গাটা কেমন চেনা-চেনা লাগছিল বটে!”

“ওরে, বিদ্যেধরপুরকে ক’দিন পরে যে আর মোটেই চিনতে পারবি না। বারবার চোখ কচলে দেখতে হবে আর মনে হবে, না হে বাপু, এ তো আর আমাদের সেই পুরনো বিদ্যেধরপুর নয়। এটা কি দুবাই না সিঙ্গাপুর?”

“বটে বড়বাবু! তা হলে কি মন্তেশ্বর মহারাজের কথাটাই ফলে যাবে?”

“কে তোর মন্তেশ্বর মহারাজ?”

“আজ্ঞে বউডুবির খালের ধারে তাঁর ঠেক। লোকে বলে, তিনি স্বয়ং শিবের অবতার। যা বলেন তা অব্যর্থ ফলে যায়।”

“তা কী বলেন তিনি?”

“গত অমাবস্যায় সন্ধের মুখে বাদামের শরবত খেতে-খেতে হঠাৎ বললেন, ‘না রে এবার ডেরাডান্ডা তুলতে হবে। এই জায়গা শ্মশান হয়ে যেতে আর দেরি নেই।””

“তোর মাথা আর তোর গাঁজাখোর মন্তেশ্বর মহারাজের মুন্ডু, বাতাসে ভাল করে কান পেতে শোন। দু’চোখ ভাল করে মেলে দেখ। শুনতে পাবি চারদিকে একটা চাপা সাজো সাজো রব। দেখতে পাবি বড়-বড় মানুষ টাকার থলি হাতে আনাগোনা করছে। বিদ্যেধরপুরের জমির দর কত জানা আছে? বাজার ঘুরে দেখে আয়, জমির দাম দ্বিগুণ, তিনগুণ হয়ে গেছে। শেষে দশগুণ, বিশ গুণে গিয়ে দাঁড়ালেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।”

শুনে বড়-বড় চোখ করে নড়েচড়ে বসে গুটে বলে, “বটে বড়বাবু! তা হলে কি বিদ্যেধরপুরে তেলের খনির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে? ক’দিন আগে গয়েশ্বরের লোকেরা রথতলার মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করছিল দেখলাম।”

“নারে, না। ক’দিন সবুর কর, দেখতে পাবি বিদ্যেধরপুরের গা দিয়ে তেল গড়াচ্ছে। পার্ক হবে, রেস্টুরেন্ট হবে, ঝাঁ চকচকে দোকানপাট হবে, গেস্ট হাউজ়, মল, স্টেডিয়াম হল বলে।”

একটু মিইয়ে গিয়ে গুটে বলে, “তাতে কি আমাদের কিছু সুবিধে হবে বড়বাবু?”

“তা না হবে কেন? সকলেরই দু’পয়সা হবে। এই আমার যেমন হচ্ছে।”

সকাল থেকে তরলাকে দেখতে না পেয়ে মহিমবাবু ভারী উচাটন। রোজ প্রাতঃকালে ঘুম থেকে উঠেই পাপোশের পাশে সুন্দর গুটি পাকিয়ে শুয়ে থাকা তরলাকে দেখে ভারী একটা সুখ হয় তাঁর। আর তরলা মেয়েও বড় ভাল। কারও সাতে-পাঁচে নেই। ঠান্ডা সুস্থির মেজাজ। আপনমনে থাকে আর নিজের মনে ঘুরে বেড়ায়। ঘরের মধ্যে এদিক-ওদিক, খাটের তলা, আলনার আড়াল সব খুঁজে দেখতে গিয়ে হঠাৎ মহিমবাবুর চোখে পড়ল ঘরের দরজাটাও আবজানো, খিলটা দেওয়া নেই। খুবই অবাক হলেন তিনি। তবে কি বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন নাকি? খিল দিয়ে শুতে কি রাতে ভুলে গিয়েছিলেন?

তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে দাওয়া থেকে হাঁক মারলেন, “ওরে গিরিধারী, কোথায় গেলি রে! দেখ তো বাবা কী কাণ্ড।”

গিরিধারী তাঁর পুরনো কাজের লোক। তার বয়স হয়েছে। কানে কম শোনে, চোখেও কম দেখে। ডাকাডাকি শুনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, “হল কী কর্তা? বাড়িতে ডাকাত পড়েছে নাকি?”

“আমার তরলা কোথায় গেল বলতে পারিস? ঘুম থেকে উঠেই দেখছি, পাপোশের পাশটা ফাঁকা। আর ঘরের দরজাও খোলা।”

“আপনার কিন্তু কর্তা একটু ভীমরতি হয়েছে আজকাল। তা হওয়ারই কথা। এ বয়সে হয়। এই তো সেদিন হরিসভায় কীর্তন শুনতে গিয়ে অন্য কার যেন চটিজোড়া পায়ে দিয়ে ফিরে এলেন। গত বিষ্যুৎবার পটলবাবুর সঙ্গে বউডুবির খালে মাছ ধরতে যাবেন বলে বন্দুক নিয়ে বেরিয়েছিলেন।”

“তোরও কি বয়স বসে আছে নাকি? বুড়ো বয়সের দোষ কি জানিস? বেশি কথা কওয়া। যে কথাটা না কইলেও হয়, সেটাই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে, পাড়া জানান দিয়ে বলতে লেগেছিস। বলি আসল কথাটা কি কানে গেছে? তরলা গেল কোথায়?”

“ওই তো বললুম, আপনাকে ভীমরতিতে ধরেছে। ঘরের দরজাটায় খিল দিতে নিশ্চয়ই রাতে ভুলে গিয়েছিলেন। আমি ঘরের দরজা খোলা দেখে ঘরে গিয়েছিলুম উঁকি মারতে। তরলা কোথাও যায়নি, আপনার বিছানায় উঠে বালিশের পাশে দিব্যি বিড়ে পাকিয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। একটু আগেই দেখে এলুম।”

“বলিস কী? গত বিশ বছরে কখনও তো তরলা আমার বিছানায় ওঠেনি!”

“আহা, তরলারও তো বয়স হচ্ছে। তারও হয়তো একটু নরম বিছানায় শুতে ইচ্ছে যায়।”

তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে বিছানার দিকে তাকিয়ে মহিমবাবুর চোখ স্থির। ঠিক বটে, তাঁর বালিশের পাশে বিড়ে পাকিয়ে একটা গোখরো সাপ শুয়ে আছে। তবে সাপটা কখনওই তাঁর আদরের তরলা নয়। তিনি আর্তনাদ করে উঠলেন, “ওরে ও গিরিধারী, শিগগির আয়। এ যে মোটেই আমার তরলা নয়। এটা যে একটা বিচ্ছিরি, জংলি, নোংরা একটা সাপ।”

গিরিধারী দৌড়ে এসে বলে, “বলেন কী কর্তা! তরলা নয়?”

মহিমবাবু খপ করে হাত বাড়িয়ে সাপটার মুন্ডুটা ধরে বিছানা থেকে তুলে আনলেন। ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বললেন, “চোখের মাথা খেয়েছিল নাকি? ভাল করে চেয়ে দেখ তো, এটা আমার তরলা?”

গিরিধারীও অপ্রস্তুত হয়ে বলে, “তাই তো কর্তা। চোখে ছানি এসেছে বলে সব কিছু তেমন পরিষ্কার ঠাহর হয় না কিনা। এ তো তরলা বলে মনে হচ্ছে না। তরলার ফোঁসফোঁসানিটাও অন্য রকম। তা হলে কি এর তাড়া খেয়েই আমাদের তরলা পালিয়েছে?”

“বাজে কথা বলিস না তো। আমার তরলা কাউকে ভয় পায় নাকি? সে কি তাড়া খেয়ে লেজ গোটানোর মেয়ে? আর এই জংলি সাপটাই বা কোথা থেকে এসে হাজির হল? তুই এক্ষুনি থানায় যা তো। একটা মিসিং ডায়েরি করে আয়। লিখবি, প্রায় তিন ফুট লম্বা, ধূসর রঙের সুন্দর একটা গোখরো সাপ নিরুদ্দেশ। তাকে কেউ খুঁজে এনে দিতে পারলে হাজার টাকা পুরস্কার।”

“আহা, পুলিসের কি আর কাজকর্ম নেই কর্তা? তারা কি সব ফেলে সাপ খুঁজতে বেরবে?”

“কেন, গনা মিত্তিরের যে কুকুর হারিয়েছিল সেটাকে তো থানার সেপাইরাই খুঁজে এনেছিল?”

“আহা, সে তো পোষা কুকুর।”

“আর আমার তরলা বুঝি পোষা সাপ নয়?”

“পোষা কুকুর নাম ধরে ডাকলে কাছে আসে, তরলা কি আসে?” “কানে শোনে না বলে আসে না। শুনতে পেলে আমার তরলাও আসত।”

“ঠিক আছে কর্তা, তাই হবে। তবে থানায় যাওয়ার আগে একটু আশপাশটাও খুঁজে নেওয়া দরকার। তরলার পাড়া বেড়ানোর অভ্যেস আছে। মাঝে-মাঝে মধুবাবুর শাশুড়ি যখন সকালে উঠোনে মোড়া পেতে বসে ধান পাহারা দেন, তখন তাঁর কাছটিতে গিয়ে বসে থাকে। বিশুদের মাচানের তলায় গিয়ে মাঝে-মাঝে ইঁদুরের তল্লাশ নেয়। বিজয়বাবুদের তুলসী মঞ্চের নীচেও মাঝে-মাঝে থিম হয়ে বিড়ে পাকিয়ে পড়ে থাকে।”

“যা বাবা, যা। একটু খুঁজে আয়। তরলাকে না পাওয়া গেলে যে আমার অন্নজল ত্যাগ হয়ে যাবে।”

“অত উতলা হবেন না কর্তা। আর যে সাপটার মুন্ডু ধরে আছেন, সেটার তো নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। আর কিছুক্ষণ ওরকম টুটি টিপে ধরে থাকলে ওটা যে অক্কা পাবে। পিছনের বাগানের দিকটায় গিয়ে ওটাকে ছেড়ে দিয়ে আসুন।”

মহিমবাবু সংবিত ফিরে পেয়ে ডান হাতে ধরা সাপটার দিকে চেয়ে দেখলেন, সেটা সত্যিই নেতিয়ে পড়েছে, তেমন খলবল করছে না। তিনি মুঠোটা একটু আলগা করে সাপটাকে নিয়ে গিয়ে বাগানের বেড়ার নীচে ছেড়ে দিলেন। সাপটা প্রাণভয়ে পড়ি কী মরি করে পালিয়ে গেল।

তরলা হারিয়ে গিয়েছে শুনে পাড়ার অনেকেই ভিড় করে খবর নিতে এল। মধু ঘোষ তো হায় হায় করে উঠলেন, “আহা! অমন ভদ্র, সভ্য সাপ আমি জন্মেও দেখিনি। আর কী সুন্দর দেখতে! সাপ তো নয়, যেন আলপনা।”

বিজয়বাবু আফসোস করে বললেন, “তরলাকে কি আর কখনও গোখরো সাপ বলে ভেবেছি? পাড়ার মেয়ে বলেই তো মনে হত। ভক্তিশ্রদ্ধাও ছিল খুব। আমার বাড়িতে গেলে তো তুলসী মঞ্চের কাছটাতেই হত্যে দিয়ে পড়ে থাকত।”

বিশুর বুড়ি ঠাকুরমা বলল, “আমার তো ইচ্ছে করত তরলার নাকে একখানা সোনার নোলক পরিয়ে দিই। ভারী লক্ষ্মীমন্ত সাপ বাপু। ও ঠিক ফিরে আসবে। মহিমকে তো নিজের বাপের মতোই ভালবাসত।”

গাঁয়ের একমাত্র গোয়েন্দা করালী বারিক অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার বলল, “বুঝলে মহিমদা, আমার কিন্তু মনে হচ্ছে এই সর্পহরণের মধ্যে একটা ধূৰ্ত প্যাঁচ আছে।”

“ধূর্ত প্যাঁচ, সেটা কীরকম হে?

“তার আগে আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দাও দিকি?”

“দ্যাখ করালী, আমার মনটা বড় খারাপ। এ সময়ে উলটোপালটা প্রশ্ন করে আমার মাথাটা আর গরম করিসনি।”

“দ্যাখ মহিমদাদা, মাথা গরম করলে বুদ্ধি উবে যায়। আর তখনই লোকে আহাম্মকের মতো সব কাজ করে বসে। লোকের দা, কুড়ুল হারায়, সোনাদানা বা টাকাপয়সা চুরি যায়, সে এক রকম। কিন্তু তোমার হারিয়েছে একটা জলজ্যান্ত গোখরো সাপ। এটা তো আর এলেবেলে জিনিস বলে ধরা যায় না।”

“সাপ হলে কী হয়, সে আমার মেয়ের মতো।”

“আহা, তা তোমার কাছে মেয়ে হলেও আর পাঁচজনের কাছে তো নয়। জ্যান্ত গোখরো তোমার ঘরে পাহারা দেয় বলে তোমার বাড়িতে কস্মিনকালেও চোর ঢোকে না। এবার যখন ঢুকেছে আর সাপটাও গায়েব হয়েছে, তখন তো ভাবনার কথা। তাই না?”

“ওরে, ভাবনার কথা বলেই তো ভাবছি।”

“আরও তলিয়ে ভাবতে হবে মহিমদাদা। আগে বলো, তোমার ঘর থেকে আর কিছু চুরি গিয়েছে কি?”

“না তো, আলমারি তো বন্ধই রয়েছে। দেওয়ালে বন্দুকটাও ঝুলছে। মানিব্যাগ বালিশের নীচে। নাহ, কিন্তু চুরি যায়নি।”

“কিন্তু চোর তো বিনা কারণে দরজার খিল খসিয়ে ঘরে ঢোকেনি। চুরি করতেই ঢুকেছে। সর্বনেশে কথা হল, সে আর সব কিছু ছেড়ে তোমার আদরের তরলাকেই থলিতে পুরে নিয়ে গেছে। বিবেচক চোরই বলতে হবে। তরলার বদলে আর-একটা জংলি গোখরো রেখে দিয়ে গেছে। এবার মাথা ঠান্ডা রেখে ঘটনাগুলো মেলাও তো দেখি।”

“সেই চেষ্টাই তো করছি। মিলছে না তো!” “তা হলে আমি বলি?”

“বাচাল হলেও বেচাল নই। আর গোয়েন্দাদের একটু বেশি কথা বলতে হয়। প্রোফেশনাল হ্যাজ়ার্ড। ওটা ধরতে নেই।” “তা হলে বলে ফ্যাল বাপু।”

“তোমার ঘরে যে চোরটা ঢুকেছিল যে কোনও সাধারণ চোর নয়। বোঝাই যাচ্ছে সে সাপ ধরার একজন ওস্তাদ লোক। সে তোমার তরলাকে চুরি করতেই এসেছিল। উদ্দেশ্য হয়তো তোমাকে ব্ল্যাকমেল করা। তরলাকে তুমি মেয়ের মতোই ভালবাস, এটা সে ভালই জানে। তরলার মুক্তিপণ হিসেবে সে এখন দাবিদাওয়া তুলতে পারে। আর তার চেয়েও ভয়ঙ্কর হল যে, একটা জংলি গোখরো সাপ তোমার বিছানায় ছেড়ে দিয়ে গেছে। তুমি নিজে যদিও একজন সর্পবিশারদ, তবু সাপে কাটলে তোমারও মরার কথা। ঘুমের মধ্যে অজান্তে সাপটার গায়ে হাতটাত দিলে এতক্ষণে তোমার হরিবোল হয়ে যেত। এখন ভাল করে ভেবে দেখো দেখি, তোমাকে পথ থেকে সরালে কার সুবিধে হয়?”

“দুর আহাম্মক! আমার আবার শত্রু কে? আমি তো অজাতশত্রু।” “অত নিশ্চিন্ত থেকো না, তলিয়ে ভাবো। তোমার বারো বিঘের আম বাগান, শতখানেক নারকেল গাছ, পেল্লায় পাকা বাড়ি। একটু ভাল করে ভেবে দেখো তো, কেউ তোমাকে সরানোর জন্য বা তোমার কাছ থেকে কিছু আদায় করার জন্য কলকাঠি নাড়ছে কিনা।”

“দাঁড়া বাপু, দাঁড়া। ভাবতে সময় দিচ্ছিস কোথায়? নাগাড়ে তো নিজেই কথা কয়ে যাচ্ছিস।”

“কথা না কইলে যে লোকের আক্কেল খোলে না।”

“এই ঘটনার সঙ্গে আমার বিষয়সম্পত্তির সম্পর্ক কী সেটাই তো বুঝতে পারছি না। আমি মারা গেলে বিষয়সম্পত্তি পাবে আমার দুই ভাইপো, কৃষ্ণ আর বলরাম। তা তারা শহুরে মানুষ, গাঁয়ের বিষয়সম্পত্তি নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। সাফ বলে দিয়েছে, ওসব বেচে দিতে।”

“কৃষ্ণ আর বলরাম ভাল ছেলে। তারা তোমাকে মারার জন্য ঘরে সাপ ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে না। আর তরলাকেও চুরি করবে না। তাদের তো স্বার্থ নেই। অন্য লাইনে ভাবো।”

“হ্যাঁ, বটে। কিছুদিন যাবৎ একটা লোক আমার আম বাগানটা কিনবে বলে ঘুরঘুর করছে। কী জানি রিসর্ট না কী যেন বানাবে। আমি তাকে কয়েকবারই দুরদুর করে তাড়িয়ে দিয়েছি। একবার তো রেগে গিয়ে বন্দুক নিয়েই ধাওয়া করেছিলাম। লোকটার নাম যত দূর মনে আছে নবকুমার না কী যেন!”

করালী একটা শ্বাস ফেলে বলে, “আজ থেকে একটু হুঁশিয়ার থেকো। এটা ছিল সাঁড়াশি আক্রমণ। সাপ কাটলে কাজ ফরসা, আর সাপে না কাটলে তরলার জন্য মুক্তিপণ। এক নম্বরটা ফসকে গেছে বটে, কিন্তু দু’নম্বরটা এখনও তাদের হাতে আছে।”

“তুই কি বলতে চাস, এটা নবকুমারেরই কাজ?”

“আমার মুখ থেকে কিন্তু কথাটা বেরয়নি। প্রমাণ না পেলে কিছুই বলা যায় না।”

“তবে তুই আর কিসের গোয়েন্দা? আমি পুলিশের কাছে যাব।” “যাও না, কে আটকাচ্ছে?”

“হুঃ, তুই আবার গোয়েন্দা! তুই গোয়েন্দা হলে আমি তো রঘু ডাকাত। এই তো সেদিন কেত্তনের আসরে গিয়ে রাখাল ঘোষের নতুন জুতোজোড়ার একপাটি চুরি হয়ে গেল। তুই আকাশ-পাতাল ভেবে অনেক মাথা খাটিয়ে শেষে বললি, ‘যখন একপাটি চুরি গিয়েছে তখন এ নিশ্চয়ই কোনও খোঁড়া লোকের কাজ। বাঁ পায়ের জুতো যখন চুরি হয়েছে তখন ধরতে হবে চোরের ডান পা খোঁড়া, ’ বলেছিলি কিনা?”

“দেখো মহিমদাদা, গোয়েন্দাদের অনেক সম্ভাবনার কথা মাথায় রাখতে হয়। হুট করে কোনও সমাধানে পৌঁছনো তো কাজের কথা নয়।”

“দেখ করালী, তোর দোষ কী জানিস। তুই বড্ড বাচাল।”

“তার ফলটা কী হল বল! সবাই গিয়ে বেচারা সনাতন দাসের উপর হামলে পড়ল। কী হেনস্থাটাই হতে হল লোকটাকে। পরে দেখা গেল সনাতনের বাঁ পা-টাই খোঁড়া। শেষে জুতোর পাটিটা পাওয়া গেল চণ্ডীমণ্ডপের পাশে কচু বনে। বিষ্ণুপদর ছেলে ফুটু দেখেছে একটা নেড়ি কুকুর জুতোর পাটিটা নিয়ে কামড়াকামড়ি করছিল।”

“সাধে কী তোমাকে সবাই বিশ্বনিন্দুক বলে মহিমদাদা। কখনও কারও কোনও গুণ কি তোমার চোখে পড়েছে? তুমি যেন সবসময়ে একটা দোষ দেখার চশমা পরে আছ। কেন, আমি কি রামবিলাস দোসাদের পিতলের লোটাটা খুঁজে দিইনি? হারাধনবাবুর সাধের পকেটঘড়িটা কে উদ্ধার করে দিল বলো? রথের মেলায় গিয়ে পাঁচকড়িবাবুর সাত বছরের ছেলে মন্টু যে হারিয়ে গেল, তাকে নন্দপুর গাঁয়ের বীরু সামন্তর বাড়ি থেকে যে উদ্ধার করে এনেছিলুম, সেই গল্প তো এখনও লোকের মুখে মুখে ফেরে।”

“নিজের ঢাক আর নিজে কত পেটাবি বাপু? রামবিলাস তো জনে-জনে বলে বেড়িয়েছে যে, লোটাটা তাকে খুঁজে দিয়েছে জটাবাবা। লোটা হারিয়ে যখন সে শোকে অন্নজল ত্যাগ করতে বসেছে, তখনই নাকি জটাবাবা চৌম্বক প্রক্রিয়ায় লোটার সন্ধান বলে দেয়। তুই নাকি সেটা শুনতে পেয়ে গিয়ে গয়ারামের পুকুরের উত্তর ধরে জলের মধ্যে থেকে সেটা তুলে এনেছিলি। আর হারাধনখুড়ো তো তোর নামে মামলা করতে চেয়েছিল। হারাধনখুড়ো দুপুরে যখন চান করতে গিয়েছিলেন, সেই ফাঁকে তাঁর তিন বছরের নাতি গুবলু তাঁর পকেটঘড়িটা নিয়ে বাইরের বারান্দায় বসে খেলছিল। তুই নাকি তাকে একটা কাঠি লজেন্স ঘুষ দিয়ে ঘড়িটা হাতিয়ে নিয়েছিলি! তারপর যখন ঘড়ি নিয়ে হইচই ওঠে, তখন তুই ঘড়িটা বের করে দিয়ে বুক ফুলিয়ে নিজের কেরদানি জাহির করতে লাগলি। আর মন্টু যে রথের মেলা থেকে হারিয়ে গিয়েছিল সেটা মোটেই সত্যি নয়। বীরু সামন্ত তার সম্পর্কে মামা হয়। সেই সুবাদেই সে বীরুর বাড়িতে গিয়েছিল ল্যাংড়া আম খাবে বলে।”

“এইজন্যই লোকের ভাল করতে নেই, বুঝলে মহিমদাদা। গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না। আজ যদি শহরে, গঞ্জে গিয়ে চেম্বার খুলে বসতাম, তবে আমার সত্যিকারের কদর দেখতে। যাকগে, তোমার ভালর জন্যই বলছিলুম, কাল রাতে যা ঘটেছে তা অত্যন্ত রহস্যজনক।”

“সে না হয় ধরলুম। কিন্তু তুই তো বাপু বহুরূপী। সকাল আটটা থেকে দশটা অ্যালোপ্যাথি ডাক্তারি করিস, বেলা দশটা থেকে বারোটা হোমিওপ্যাথি, বিকেল চারটে থেকে ছ’টা তুই কুংফু আর ক্যারাটে শেখাস, বিকেল ছ’টা থেকে রাত আটটা তুই জ্যোতিষী, রাত আটটা থেকে দশটা তুই গোয়েন্দা।”

করালী অতি উচ্চাঙ্গের একখানা হাসি হেসে বলে, “আমার গুণ একটু বেশি সেটা আমি মানছি মহিমদাদা। আমার নিজেরও মনে হয়, ভগবান আমাকে দু’-একটা গুণ কম দিলেই বোধ হয় ভাল হত। বেশি গুণ থাকলে তার গুনগারও দিতে হয় কিনা।”

মধু ঘোষ বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন, “ওরে বাপু, তোর যদি একটাও গুণ না থাকত তা হলে আমরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচতুম। আমাকে এমন আমাশার ওষুধ দিলি যে, ওষুধ খেয়ে আমি কোমরের ব্যথায় একমাস শয্যা নিলুম।”

বিজয় সাধুখাঁও গরম হয়ে বলে, “দেখ করালী, ভণ্ড জ্যোতিষীরাও পাঁচটা ভবিষ্যৎবাণী করলে দুটো-একটা ফলে। তুই-ই একমাত্র জ্যোতিষী যার পাঁচটা ভবিষ্যৎবাণীই ফেল! তুই বলেছিলিস আমার মেজছেলে ফটিক এবার ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ হবে। সে ফেল মেরেছে। বলেছিলি, রাঙা গাইটা বোশেখের মধ্যে বিয়োবে। বিয়োয়নি। বলেছিলি আমার নিরানব্বই বছরের পিসি গিরিজাবালা দেব্যার আশ্বিন মাস পেরোবে না, তারপরই আমি তার বিষয়সম্পত্তি পাব। পিসি এখনও দিব্যি বেঁচে। আর সম্পত্তিও নাকি দেবোত্তর করে দিয়েছে। এগজ়িমা সারানোর জন্য কবচ দিয়েছিলি, সেই এগজ়িমা এখনও বাঁ পায়ে গ্যাঁট হয়ে বসে তোর কবচকে মুখ ভ্যাংচাচ্ছে। গঙ্গারামের সঙ্গে মোতিগঞ্জের জমির মামলায় নির্ঘাত জিতব বলে দু’হাজার টাকা দিয়ে যজ্ঞ করালি, সেই মামলায় আমি হেরে ভূত।”

বিশুর বুড়ি ঠাকুরমা বিন্দুবাসিনীদেবী বললেন, “না গো বাপুরা, তোমরা অমন করে করালীকে খুঁড়ো না। ও যে গুণের ছেলে তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। এই তো গেলবার মাঘ মাসে আমার হাঁপানির টান উঠেছিল বলে করালী হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিয়েছিল। তাতে আমার তো বাপু খুব কাজ হয়েছে। হাঁপানি সারল না বটে, কিন্তু হাঁটুর বাত উধাও। তারপর গত জষ্টি মাসে পিত্তশূলে আমি যখন শয্যা নিলুম, তখন তো ওই করালীর ওষুধ খেয়েই উপকার হল। পিত্তশূল সারেনি ঠিকই, কিন্তু চোখের ছানি কেটে গিয়ে দিব্যি সব পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। আমার নাতবউয়ের তো মাথার চুল উঠে টাক পড়তে বসেছিল। তখন ওই করালীর হোমিও ওষুধ খেয়ে কী কাণ্ডটাই হল! টাকে চুল গজায়নি বটে, তবে নাতবউয়ের গ্যাস, অম্বল একেবারে সেরে গিয়েছে। এখন নাতবউ ঠিক করেছে করালীর কাছে গিয়ে গ্যাস, অম্বলের ওষুধ নিয়ে এসে খাবে, আর তাতেই নাকি তার টাকে চুল গজাবে। তাই বলছিলুম, করালীর ওষুধে কিন্তু খুব কাজ হয়। একটু উলটোপালটা হয় বটে, তবে কাজ ঠিকই হয়।”

বিগলিত মুখে করালী বলে, “আহা থাক না ঠাকুরমা, নিজের প্রশংসা নিজের কানে শোনাও যে পাপ। তা সেই পাপ আমাকে নিত্যি সইতে হচ্ছে। চারদিকে লোক এত ধন্যি-ধন্যি করে যে, আজকাল রাস্তায় আমাকে মুখ লুকিয়ে হেঁটে যেতে হয়।”

মধু ঘোষ মিচকে হেসে বলে, “কিন্তু তোর কান তো খাড়া থাকে।” ঠিক এই সময়ে গিরিধারী একজন রোগা, বুড়ো মতো মানুষকে নড়া ধরে টেনে এনে মহিমবাবুর সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলে, “এই যে কর্তা, এ হল এ তল্লাটের চোরেদের সর্দার। এর নাম গুটে। ফটকের বাইরে ঘুরঘুর করছিল, ধরে এনেছি।”

গুটে কাঁধের গামছাখানা টেনে এনে মুখের ঘাম মুছে চারদিকে জুলজুল করে চেয়ে দেখল। তারপর বলল, “আজ্ঞে আমি গত পরশু থেকে চুরি করা ছেড়ে দিয়েছি। পরশু থেকেই থানার বড়বাবু আমাকে আড়কাঠির চাকরিতে বহাল করেছেন।”

মাধববাবু গুটের আপাদমস্তক ভাল করে দেখে নিয়ে বললেন, “তোমাকে দেখে তো পাকা চোর বলেই মনে হচ্ছে।”

গুটে দু’ধারে মাথা নাড়া দিয়ে বলে, “সে এককালে ছিলুম মশাই। এখন বয়স হচ্ছে তো। তা ছাড়া নাতনির কাছেও মান থাকছে না।”

মাধববাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “ওহ, বড্ড মানী লোক দেখছি! তা এখানে কী মতলবে ঘুরঘুর করছিলে বলো তো?”

“আজ্ঞে, মতলব কিছু খারাপ ছিল না মশাই। দু’-চারটে কথা বলতেই আসা।”

“কী কথা?”

“কথাটা হচ্ছে গিয়ে আপনার ওই বিষয়আশয় নিয়েই।”

“বলো কী হে, তুমি কি আমার সঙ্গে বিষয় সম্পত্তি নিয়ে কথা কইতে এসেছ নাকি?”

গুটে ঘাড় চুলকাতে-চুলকাতে বলে, “আজ্ঞে, ছোট মুখে বড় কথাই হয়ে গেল নাকি কর্তা?”

মহিমবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “কিছু মনে কোরো না বাপু। আজকাল কালের নিয়মেই মানুষের আস্পর্দা বেড়েছে। তবে কিনা আমার সময়টা বড় ভাল যাচ্ছে না হে। মনটাও বড্ড খারাপ। আমার বড় আদরের একটা পোষা সাপ ছিল। আজ সকাল থেকে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই আজ আর বিষয়সম্পত্তি নিয়ে কথা নয়।”

গুটে একগাল হেসে বলে, “আজ্ঞে কর্তা, কথায় বলে কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ।”

“তার মানেটা কী দাঁড়াল হে?”

“আজ্ঞে, আপনি যখন আপনার তরলার শোকে চোখের জল ফেলছেন, তখন গাঁয়ের চোরেরা বিশালাক্ষী কালীবাড়িতে পুজো দিতে গিয়েছে। সন্ধেবেলা হরির লুঠও দেবে।”

“বটে!তা তাদের এত ফুর্তির কারণ কী?”

“আজ্ঞে কারণ তো জলের মতো সোজা। লোকে কুকুর পোষে, কী দরোয়ান রাখে সে এক কথা। কিন্তু এ বাড়ি পাহারা দেয় জ্যান্ত গোখরো সাপ। চোরেরা তাই এ বাড়ির ত্রিসীমানা মাড়াত না। আজ থেকে তারা একেবারে নিষ্কণ্টক। তাই বলছিলুম, আপনার তরলার সঙ্গে কিন্তু বিষয়সম্পত্তির একটু যোগ আছে।”

মাধববাবু ভ্রু কুঁচকে বলেন, “তুমি কি বলতে চাও গাঁয়ের চোরেরাই তরলাকে চুরি করে নিয়ে গিয়ে তাদের পথ পরিষ্কার করেছে?”

মাথা নাড়া দিয়ে গুটে বলে, “আজ্ঞে না কর্তা। চোরেদের কারও তত বুকের পাটা নেই। তবে আপনার যে বুকের পাটা আছে তা তারা একবাক্যে স্বীকার করে। শুধু তারা কেন, আমাদের দারোগা বড়বাবুও তো বলছিলেন সেদিন, ‘হ্যাঁ বটে, এ তল্লাটে আসার পর থেকে দেখছি, বুকের পাটা যদি কারও থেকে থাকে তবে তা মহিমবাবুর। পাশবালিশের বদলে তিনি অজগর সাপের গায়ে পা তুলে ঘুমোন, কেউটে সাপের লেজের ডগা দিয়ে কান চুলকান, পাপোশের বদলে গোখরো সাপের মাথায় পা ঘষেন।”

মহিমবাবু হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠলেন, “বেঁধে, বেঁধে! অতটা বাড়াবড়ি না করলেও চলবে।”

“যে আজ্ঞে! আসল কথা হল, আপনার কথা উঠলে তিনি আর নিজেকে সামলাতে পারেন না কিনা।”

“বটে! তা হঠাৎ বিপিনদারোগার এত গদগদ ভাব কেন বলো তো? লক্ষণটা তো আমার তেমন ভাল ঠেকছে না হে!”

গোবিন্দ খাসনবিশ বলে উঠল, “তা তো বটেই। এই তো গেল হপ্তায় বিপিনদারোগা এসে অক্ষয় গোঁসাইয়ের বুদ্ধি আর দূরদর্শিতার কথা কেমন শত মুখে বলে গেল, আর রাত কাটার আগেই কত বড় ডাকাতিটা হয়ে গেল অক্ষয়ের বাড়িতে। সেদিন বিষ্ণুপদ খাজাঞ্চির হাতের লেখা দেখে বলে উঠল, ‘এ তো মুক্তাক্ষর!’ তার সাতদিনের মাথায় খাজাঞ্চির পো দলিল জালিয়াতির মামলায় ফেঁসে গিয়েছে। আর নবীন ময়রার রসগোল্লা খেয়ে তাকে যে দরাজ সার্টিফিকেট দিয়ে গেল বিপিনদারোগা, তার ফল কী হল বল! পরদিন সকালে নবীনের দোকানে রসগোল্লার গামলায় মরা ইঁদুর ভেসে থাকতে দেখে কী হইচই। সেই বদনামে এখন দোকানটাই উঠে যাওয়ার মুখে।”

গুটে জুলজুল করে চারদিকে চেয়ে নিয়ে বলে, “তিনি সর্বদাই বলেন, ‘ওরে, তোরা মানীকে মান দিতে ভুলিস না যেন। যদিও আমি এক হিসেবে এখানকার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, কিন্তু তা বলে মানুষের মান মর্যাদার কথা মনে রাখি।”

মহিমবাবু গম্ভীর গলায় বলেন, “দেখো বাপু গুটে, এই সাতসকালে যে তুমি আমার গুণকীর্তন করতে আসোনি তা আমি জানি। ভণিতা ছেড়ে এখন আসল কথাটা খোলসা করো তো বাপু।”

“আজ্ঞে, তার কিছু অসুবিধে আছে। আমার বাঁ হাঁটুতে বড় ব্যথা।” মহিমবাবু অবাক হয়ে বলেন, “তা তোমার যা বয়স তাতে হাঁটুর

ব্যথা হতেই পারে। কথা তো কেউ আর হাঁটু দিয়ে কয় না, কী বলো?”

“যে আজ্ঞে! কিন্তু আগে যেমন হরিণের মতো দৌড়তে পারতুম তেমনটা তো আর এখন পেরে উঠব না কর্তা।”

মহিম বিরক্ত হয়ে বলেন, “তা এই বুড়ো বয়সে তোমাকে দৌড়াদৌড়িই বা করতে হবে কেন বলো তো?”

“আপনি বায়ুচড়া মানুষ, কখন কী করে বসেন তার তো ঠিক নেই কিনা! এই সেদিন বন্দুক বাগিয়ে নববাবুকে যে ধাওয়াটা করলেন, তা তো গাঁসুদ্ধ লোক দেখেছে। তা নববাবুর আর কোনও গুণ না থাকুক পায়ে বেড়িটা আছে বটে। পৈতৃক প্রাণটা রক্ষে করতে একেবারে মুগবেড়ের হাটে গিয়ে উঠলেন। বটতলার চাতালে শুয়ে ঘণ্টাখানেক হ্যা হ্যা করে হাঁপিয়েছেন বটে, কিন্তু প্রাণটা তো রক্ষে হয়েছে। কিন্তু আমি তো অতটা পেরে উঠব না।”

মাধববাবু বললেন, “আহা, নবকুমারের কথা আলাদা। সে অতি ঘোড়েল লোক। আমার বিশ বিঘের আম বাগানটা কিনে স্টেডিয়াম না কী যেন বানাতে চায়। রোজ এসে টাকার গরম দেখাত, তাই মাথাটা

গরম হয়ে গিয়েছিল।”

“যে আজ্ঞে, আপনি ন্যায্য কাজই করেছিলেন। ওই আম বাগান তো আজকের নয়, আপনার প্রপিতামহের আমলের। কাশী থেকে কলমের গাছ আনিয়ে তিনিই বাগানখানা করেছিলেন। কী বলব কর্তা, আপনাদের ওই আম বাগানের সঙ্গে আমাদেরও বহুকালের সম্পর্ক। ঈশেন কোণে ঝোপঝাড়ের আড়ালেই হল গিয়ে আমাদের ঠেক। লাইনে নামবার আগে ওখানেই যদু ওস্তাদ আমাদের তালিম দিত কিনা। হস্তলাঘব, কুম্ভক, বায়ুবন্ধন, প্রাণায়াম, যন্ত্রধাবন, অঙ্গুলিমুদ্রা কত কী শিখতে হত! লোকে চোর বলে জানে। তুচ্ছতাচ্ছিল্যও করে, কিন্তু পিছনে যে মেহনত আছে, সাধনা আছে সেটা জানে ক’জন বলুন?”

“বটে! তা হলে আমার আম বাগানেই তোমাদের আখড়া ছিল?” “যে আজ্ঞে, আপনার কাছে আম বাগান বটে, কিন্তু আমাদের কাছে তীর্থ। এই ঠেক থেকে কত বড়-বড় গুণী কারিগর বেরিয়েছে। কালোরতন, নাটা, নবীন, ঢোল, কার্তিক, গুলেমস্তান। জায়গাখানাও বড় সরেস। এক ধারে উঁচু পাঁচিল, অন্য ধারে ঝোপঝাড়ের আড়াল। ওই বাগানের উপর আপনার যেমন মায়া, আমাদেরও তেমনই মায়া। তবে কিনা কর্তা চিরকাল কি কারও সমান যায়?”

“তার মানে?”

“এই বলছিলুম আজ্ঞে, ও বাগান কি রক্ষে করতে পারবেন? পুবধারের দেওয়াল ঘেঁষে যে গাছগুলো আছে তার মধ্যে তিনটে গাছ নেতিয়ে পড়েছে, গিয়ে দেখে আসুন। ভাববেন না যেন গাছ বুড়ো হয়ে মরতে বসেছে। ওই তিনটে গাছের গোড়ায় গন্ধক, সোড়া আরও সব নানা জিনিস পুঁতে ইচ্ছে করেই মারা হয়েছে। আর আপনার পেয়ারের গোখরো সাপটাকে তো আর এমনি-এমনি তুলে নিয়ে যায়নি। পিছনে একটা মতলব আছে বলেই না! তবে আপনার বিছানায় যে গোখরো সাপটাকে ছেড়ে দিয়ে গিয়েছে, সেটার বিষ দাঁত ওপড়ানো ছিল। শুধু আপনাকে একটু হুঁশিয়ার করে দেওয়ার জন্যই। তবে এর পরের বার যেটা ছেড়ে দিয়ে যাবে, সেটার কথা আগাম বলা মুশকিল।”

মহিমবাবু এত অবাক হয়ে গিয়েছেন যে, কিছুক্ষণ বাক্যস্ফূর্তি হল না। তারপর রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “তুমি যখন এত কথা জান, তখন তুমিও নিশ্চয়ই আমার শত্রুপক্ষের লোক?”

গোবিন্দ খাসনবিশ বললেন, “ওরে তোরা হাঁ করে দেখছিস কী? চোরটাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেল। তারপর বিচুটি নিয়ে আয়। এ তো ভয়ঙ্কর লোক।”

বিজয়বাবু উত্তেজিত হয়ে বলেন, “এ তো মগের মুলুক হয়ে উঠল দেখছি।”

করালী বলে, “আহা, আপনারা উত্তেজিত হবেন না। মানুষকে যত কথা কইতে দেবেন, ততই ইনফরমেশন বেরিয়ে আসবে।”

গুটে মাথা নেড়ে বলে, “আজ্ঞে না, পুরোপুরি শত্রুপক্ষের লোক নই মহিমকর্তা। এবার যা বুঝবার বুঝে নিন। শুধু মনে রাখবেন, আপনার আদরের তরলা কিন্তু এখন শত্রুপক্ষের হাতে।”