জং বাহাদুর সিংহর নাতি – ১

“হ্যাঁ রে, তুই যে জং বাহাদুরের নাতি সেটা কি টের পাস? তুই রোগাভোগা, দুবলা পাতলা, মিনমিনে, ভিতু সবই ঠিক। তবে ভাল করে খেয়াল করিস তো, তোর জিনের ভিতরে জং বাহাদুর সিংহ ঘাপটি মেরে আছে কিনা। আমার তো মনে হয় নিশুতি রাতে কান পাতলে তুই তোর ভিতরে জং বাহাদুরের গর্জন শুনতে পাবি।”

বীরু মাথা নেড়ে বলে, “না গোবিন্দখুড়ো, আমি কোনও তর্জনগর্জন শুনতে পাই না তো?”

“পাবি রে, পাবি। ওই গর্জন, ওই হুঙ্কার, ওই নাদ যে তোর জিনের মধ্যেই ঘাপটি মেরে আছে। টাইমবোমার কথা শুনিসনি? এ হল সেই জিনিস। সময় হলেই তোর ভিতরে জং বাহাদুর জেগে উঠবে। বীরের অভাবে দেশটা কেমন ছারেখারে যাচ্ছে, দেখছিস না? উঠতে হয় বলেই এখনও চাঁদ-সূর্য্যি ওঠে, বইতে হয় বলেই বাতাস এখনও বয়, কাটতে হয় বলেই দিন এখনও কাটে বটে, কিন্তু চারদিকটা যেন বাসি বিস্কুটের মতো নেতিয়ে পড়েছে। এখন ফের জং বাহাদুরের মতো একজন বীর ঝাঁকি মেরে উঠে না দাঁড়ালে যে চারপাশটা একেবারে লাতন হয়ে পড়বে।”

“আপনি যাকে বীর বলে এত ভক্তিশ্রদ্ধা করছেন, তিনি কিন্তু আসলে ডাকাত ছিলেন।”

“কোন বীরটা ডাকাত না ছিল রে আহাম্মক? ভীষ্ম, দ্রোণ, পঞ্চপাণ্ডব, আলেকজান্ডার, তৈমুর লং, নেপোলিয়ান কে ডাকাত নয় বল তো? পরের রাজ্য দখল, পরের ধনসম্পদ কেড়েকুড়ে নেওয়া সেটাও তো বকলমে ডাকাতিই! নাকি রে! আর তুই শুধু তোর দাদুর ডাকাতিটাই দেখলি? বুকের পাটাটা দেখলি না? পরাক্রমটা দেখলি না? দাপটটা দেখলি না? জং বাহাদুর সিংহ যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেত গোটা তল্লাট সিঁটিয়ে থাকত ভয়ে। হোক ডাকাত, তা বলে তো গর্তে লুকিয়ে থাকত না। দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন করত। ছিল গরিবের মা-বাপ। অমন ডাকসাইটে দারোগা বজ্রধর কানুনগো পর্যন্ত স্বীকার করত, “হ্যাঁ, জং বাহাদুর পুরুষসিংহই বটে। জং বাহাদুর চোখ বুজবার পর তো গোটা এই বিদ্যাধরপুরটা একেবারে আলুনি হয়ে গেল। বিদ্যেধরপুরে এই আমরা পুরনো যারা আছি তারা যে তোর দিকেই চেয়ে আছি বাপ। সবাই মনে করে রোগাভোগা, নড়বড়ে, অপদার্থ যাই হোক তবু বীর বাহাদুর সিংহতো শত হলেও জং বাহাদুরেরই নাতি! একদিন দুম করে কি তার ভিতরে একটা বিস্ফোরণ ঘটবে না? ভিতরের বাঘটা কি চিরকাল ঘুমিয়েই থাকবে?”

“সে আপনি যাই বলুন গোবিন্দখুড়ো, খুনখারাপি, চুরিডাকাতি কিন্তু ভাল কাজের মধ্যে পড়ে না। দেশের আইনে সেই ব্যবস্থা নেই।”

“কুলাঙ্গার! কুলাঙ্গার! মাঝে-মাঝে ভাবি তোর মুখ দেখলেও পাপ হয়। কিন্তু জং বাহাদুরের নাতি হয়েই তুই গন্ডগোলটা পাকিয়েছিস। তোকে না পারি গিলতে, না পারি ফেলতে।”

বিরক্ত ও হতাশ হয়ে গোবিন্দখুড়ো বিদেয় হলেন বটে, কিন্তু যাওয়ার সময় কী যেন বিড়বিড় করে বকতে-বকতে যাচ্ছিলেন। বোধ হয় বীর বাহাদুরকে শাপশাপান্তই করছিলেন। বীর বাহাদুরও বারান্দার সিঁড়িতে বসে দুঃখের সঙ্গে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল। আজ শরতের এই সুন্দর সকালবেলাটাই তার কাছে মাটি। সামনের উঠোনে অনেকটা জায়গা জুড়ে সকালের রোদে তেঁতুল, সজনে, নিম গাছের কেমন ঝিরিঝিরি ছায়া পড়েছে। কোকিলও আছে। পায়রারা উঠোন জুড়ে ঘুরে-ঘুরে দানা খাচ্ছে। একটা চমৎকার কাঠবেড়ালি তেঁতুল গাছ থেকে নেমে আম গাছটায় উঠে পড়ল। এসব দেখেও দেখছে না বীরু। মনটা খারাপ। গোবিন্দখুড়োই তো শুধু নয়, গোটা বিদ্যেধরপুরের লোকেই যে কেন চায়, সে একজন বেশ বীরপুরুষ হয়ে উঠুক!

মাঝেমধ্যে নানা জায়গা থেকে ছেলেছোকরারা এসে হাজির হয়। কেউ লাঠিখেলা বা তরোয়াল চালানো শিখতে চায়। কেউ এসে কুস্তির প্যাঁচপয়জার শিখতে ধরে পড়ে। আবার কেউ বা এসে সাত ফুট উঁচু দেওয়াল ডিঙোনোর ফায়দা শেখার জন্য ঝুলোঝুলি করে। রণপায়ে চড়ে কী করে দৌড়ে মাঠ, জঙ্গল পেরিয়ে যাওয়া যায় তা শিখতেও অনেকে এসে হত্যে দেয়। সে যে ওসব মোটেই জানে না একথা কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না। ঠারেঠোরে অনেকেই বলে যায়, “আপনি গুরু, সবই জানেন। তবে গুপ্তবিদ্যে শেখাতে চাইছেন না!”

দিনকয়েক আগে এরকমই একজন এসে হাজির। বেঁটেখাট চেহারা, হাবভাব হাড়হাভাতের মতোই। বলল, “ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরিবাকরি কোনও দিকেই সুবিধে হচ্ছে না মশাই। তাই ইয়ার বন্ধুরা পরামর্শ দিল, ডাকাতি করলে দোহাত্তা রোজগার। তবে তার জন্য তালিম নেওয়া চাই। নোয়াপাড়ার ফটিক বলল, ‘ডাকাতির তালিম নিতে চাও, তার আর ভাবনা কী? স্বয়ং জং বাহাদুরের নাতি বীর বাহাদুরই তো হাতের কাছে রয়েছে। ছুপা রুস্তম রে ভাই, কিছুতেই ধরা দিতে চায় না। তবে দোর ধরে যদি পড়ে থাকতে পার, তা হলে হিল্লে হয়ে যাবে।’ তাই আজ প্রাতঃকালে অমৃতযোগে ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে রওনা হয়ে এসে পড়েছি। বেশি কিছু নয়, আপনাকে তেমন গা ঘামাতেও হবে না। এই একটু বন্দুক-পিস্তল চালানো, তরোয়াল খেলা, খানিকটা লাঠিবাজি, একটু ক্যারাটে কুংফু, মুগুরভাজা, প্রাণায়াম।”

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বীরু বলেছিল, “আর কী বাকি রইল হে!”

“আজ্ঞে, বাকি তো মেলা। বিদ্যের কি শেষ আছে? আমি ছোটখাট মনিষ্যি, আধারও ছোট। আপনি দিতে চাইলেও আমি অত নিতে পারব কি?”

“তা পারবে না কেন? আমি বিদ্যে যে চুঁ চুঁ। দেওয়ার মতো বিদ্যেই আমার নেই। বন্দুক, পিস্তল চোখেই ভাল করে দেখিনি। লাঠি, সড়কি, তরোয়াল ছুঁয়েও দেখেনি কখনও। কুংফু-ক্যারাটের নাম শুনেছি বটে, তবে বস্তুটা কী তা জানি না। এক জোড়া মুগুর আছে বটে বাড়িতে, কিন্তু সে দুটো কখনও তোলার চেষ্টাও করিনি। তুমি খুব ভুল লোকের কাছে এসেছ।”

লোকটা হাঁ করে তার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “বলেন কী মশাই! আপনি কি তবে শ্রদ্ধাস্পদ জং বাহাদুর সিংহর নাতি বীর বাহাদুর নন? তবে কি বাড়ি ভুল করলুম! কিন্তু লোকে যে নাম বলতেই এই বাড়িই দেখিয়ে দিল!”

“বাড়ি ভুল হবে কেন? এটা জং বাহাদুরেরই বাড়ি আর আমি তাঁরই নাতি বীর বাহাদুর সিংহই বটে। তবে আমার সম্পর্কে যা শুনে এসেছ সব ভুল। আমি দুবলা-পাতলা মানুষ। দৌড়ঝাঁপ করলেই হাঁফ ধরে। জীবনে ডন-বৈঠক করিনি।”

লোকটা ভারী হতাশ হয়ে বারান্দায় পা ঝুলিয়ে অনেকক্ষণ বসে হইল। তারপরে ছলোছলো চোখে বলল, “এহ, আমি যে অনেক আশা করে এসেছিলুম মশাই। পিতৃদত্ত নামটাও রঘুনাথ। ভেবেছিলুম আপনার কাছে তালিম নিয়ে রঘুডাকাত হয়ে দুনিয়া কাঁপিয়ে দেব। তা হলে কি কোনও আশা নেই মশাই? অনেক দূর থেকে খিদে, তেষ্টা চেপে এই এতটা পথ হেঁটে এসে শেষে কি কপালে এই ছিল?”

লোকটার হাহাকার শুনে বীরুর একটু দুঃখও হল বটে। কিন্তু সে নাচার।

লোকটা হাপুস নয়নে কিছুক্ষণ বসে থেকে কাঁধের গামছা পেতে বারান্দাতেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে সে বীর বাহাদুরকে বলল, “কর্তা, আপনাকে কবে থেকে মনে-মনে গুরু বলে মেনেছি। যা থাকে কপালে আপনার শাগরেদিই করব বলে ঠিক করলাম। একটু আগে স্বপ্ন দেখছিলাম, একজন লম্বা-চওড়া লোক এসে বলছে, ‘তুই ঠিক জায়গাতেই এসেছিস।’ তাই আমি সাব্যস্ত করে নিয়েছি, মারুন, কার্টুন আমি আপনাকে ছেড়ে যাচ্ছি না।”

বীর বাহাদুর ফাঁপরে পড়ে বলে, “বাপু হে, তোমার মতলবখানা কী তা বুঝতে পারছি না। যদি জং বাহাদুরের ডাকাতি করা সোনাদানার সন্ধানে এসে থাকো, তা হলে সে গুড়ে বালি। আমার ঠাকুরদার ধনরত্নের খোঁজে এ বাড়িতে অন্তত সাতবার ডাকাতি হয়েছে। ডাকাতদের হাতেই আমার বাবা অল্পবয়সে মারা যান। আর আমাকে অন্তত বারপাঁচেক ডাকাতদের হাতে মার খেয়ে হাসপাতালে যেতে হয়েছে। দু’ বার তো মরো-মরো হয়েও বেঁচে ফিরেছি। আর চোরদের আগমনের তো হিসেব নেই। নিত্যি চোর হাজিরা দিত। তেমন সুবিধে না হওয়ায় আজকাল চোর-ডাকাতের আনাগোনা বন্ধ হয়েছে বটে, কিন্তু পুলিশের আনাগোনা বন্ধ হয়নি। জং বাহাদুরের নাতি বলে আমার নাম নাকি তাদের সন্দেহের তালিকায় আছে। কাজেই তারা প্রায়ই তত্ত্বতালাশ করতে আসে। আমি বড় সুখে নেই হে বাপু। জং বাহাদুরের নাতি হওয়ার এত হ্যাপা জানলে কে জন্মাত!”

রঘুনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “লোক আমি তেমন ভাল নই বটে, তবে আপনার সঙ্গে বেইমানি করব না ওস্তাদ। শত হলেও গুরু বলে মেনেছি কিনা।”

“ওহে বাপু, গুরু হতে গেলে কিন্তু এলেম লাগে। আমার কোনও যোগ্যতাই নেই। পৈতৃক কিছু জমিজিরেত ভাগে চাষ করিয়ে আমার গ্রাসাচ্ছাদন চলে। আমি বড়ই সামান্য মানুষ বাপু। আমাকে গুরু ধরলে ভুল করবে।”

“স্বপ্নটা তো উড়িয়ে দিতে পারি না মশাই।”

“ও তো দিবাস্বপ্ন, ওর কোনও দাম নেই।”

রঘুনাথ করুণ মুখ করে বলে, “আমাকে ঘাড় থেকে নামানোর জন্য ওসব তো আপনি বলবেনই কর্তা। কিন্তু আমার বিশ্বাস, স্বপ্নে আপনার ঠাকুরদা জং বাহাদুরই এসে আমাকে দেখা দিয়ে গেছেন। ওহ! সে যে কী একখানা চেহারা কর্তা, দেখলেই ভক্তিছেদ্দা হয়। আর যে কী হাড়কাঁপানো বাঘা চাউনি!রক্ত যেন হিম হয়ে গেল। না কর্তা, আমি এ বাড়ি ছেড়ে নড়ছি না। আপনি যদি একান্তই রাজি না হন, তা হলে ওই সামনের আম গাছ থেকে গলায় দড়ি দিয়ে আজই ঝুলে পড়ব।”

বীরু ভারী সমস্যায় পড়ে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল। তারপর বলল, “না হে বাপু, অতটা করার দরকার নেই। তা নিতান্তই যদি উড়ে এসে জুড়ে বসতে চাও তা হলে আগেভাগেই বলে রাখি, তোমাকে বসিয়ে-বসিয়ে খাওয়াতে পারব না কিন্তু। কাজকর্ম করতে হবে।”

“সে আর বলতে! কাজকর্মে আমি খুব পাকা। তা ছাড়া আমি থাকলে আপনার একটা বলভরসাও হয়। ঠিক কিনা বলুন?”

রঘুনাথ সেই থেকে রয়ে গিয়েছে।

তা দেখা গেল রঘুনাথ কাজের লোকই বটে। বড়সড় বাড়িখানায় বেশ অনেক ঘর এতকাল ধুলোবালি আর ঝুল জমে অন্ধকার হয়ে ছিল। ইঁদুর, আরশোলা, চামচিকে আর মাকড়সার আস্তানা। রঘুনাথ কয়েকদিনের মধ্যেই বাড়িটা বেশ পরিষ্কার করে ফেলল। বিরাট বাগানটা আগাছায় বড্ড জঙ্গল হয়ে পড়েছিল। আগাছা কেটে বাগান সাফ করল। বীর বাহাদুর এতকাল সেদ্ধভাত খেয়ে কোনও রকমে উদরপূর্তি করত। রঘুনাথ এসে দিব্যি রান্নাবান্না শুরু করে দিল এবং দেখা গেল তার রান্নার হাতটি চমৎকার।

রঘুনাথকে রাখতে প্রথমটায় গাঁইগুঁই করেছিল বটে, কিন্তু অবশেষে কয়েকদিন পর বীরু মুখ ফসকে বলেই ফেলল, “তুমি তো একজন গুণী মানুষ হে!”

রঘুনাথ বিগলিত হয়ে বলে, “কী যে বলেন কর্তা, আপনার কাছে আমি তো নস্যি।”

বীরু সন্দিহান হয়ে বলে, “কেন হে বাপু, আমার কাছে তুমি নস্যি হতে যাবে কেন? এ ক’দিনে তুমি যে এলেম দেখালে তাতে নিজেকে আমার ভারী অপদার্থ মনে হচ্ছে!’ “”

“আপনার সঙ্গে হাতির খুব মিল আছে কর্তা।”

বীরু হাঁ হয়ে থেকে, কিছুক্ষণ পরে সামলে নিয়ে বলে, “আমার সঙ্গে হাতির মিল! বলো কী হে!”

“ঠিকই বলছি। হাতির দোষ কি জানেন? ঘাড় ঘোরাতে পারে না বলে হাতি বুঝতে পারে না যে, সে কত বড় প্রাণী। আপনার বেলাও ওই কথা। আপনি যে মস্ত মানুষ তা আপনি বুঝতে পারছেন না।”

“বটে! তা বাপু এই ক’দিনে তুমি আমার কোনও গুণ দেখতে পেলে নাকি? আমি তো বিস্তর চেষ্টা করেও পাইনি।”

“মেলা গুণ, কর্তা! মেলা গুণ! খানিক ঢাকাচাপা পড়ে আছে, এই যা।”

“বাপু হে রঘুনাথ, আমাকে তোষামোদ করার দরকার নেই। তোমার উপর আমি সন্তুষ্টই আছি। বরং তোমাকে বেতনটেতন তেমন দিতে পারি না বলে আমার একটু লজ্জাও করছে।”

তাড়াতাড়ি জিভ কেটে কানে হাত দিয়ে রঘুনাথ বলে, “ও কথা মুখেও আনবেন না। শুনলে পাপ হয়। বেতনটা আবার কিসের? আমারই গুরুদক্ষিণা দেওয়ার কথা কিনা!”

“গুরুদক্ষিণা দেবে! ভাল জ্বালা তো। কারও কাছে কিছু শিখলে তবে না গুরুদক্ষিণার কথা ওঠে। আমার কাছে তুমি শিখেছটা কী?”

মাথা চুলকে, লাজুক হেসে রঘুনাথ বলে, “সে অত ফেঁদে বলা যাবে না মশাই, তবে শিক্ষা কিন্তু হচ্ছে। ঘনারামও বলেছে, ‘চেপে বসে থাক, আস্তে আস্তে মেলা শিখে যাবি। তারপর আর তোকে পায় কে?””

“ঘনারাম! সে আবার কে বলো তো?”

ফের ভারী লজ্জিত হয়ে রঘুনাথ বলে, “সে আছে একজন।”

“কিন্তু ঘনারাম বলে তো কাউকে আমি চিনতে পারছি না। তার কি এবাড়িতে যাতায়াত আছে?”

“তা আর নেই কর্তা, খুব আছে। হাওয়া-বাতাসের মতোই আসেখাঁটিযায়।”

বীরু আর কথা বাড়াল না। রঘুনাথের যে মাথায় একটু দোষ আছে সেটা সে বুঝতে পেরে গেল। তবে অল্পস্বল্প পাগল হলে তেমন দোষ নেই। বেশি পাগল না হলেই হল।

কিছুদিন পরে হঠাৎ কোণের দিকের একটা বন্ধ ঘর খুলে পরিষ্কার করতে গিয়ে রঘুনাথ খুব চেঁচামেচি জুড়ে দেওয়ায় বীর বাহাদুর তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখল, রঘুনাথ এক কাঁড়ি পুরনো জংধরা লোহালক্কড় বের করে উত্তেজনায় কাঁপছে।

বীরু ভ্রু কুঁচকে বিরক্ত হয়ে বলে, “ওহে রঘুনাথ, পুরনো লোহালক্কড়ের মধ্যে কি গুপ্তধন পেয়েছ নাকি হে! চেঁচামেচি কিসের?”

রঘুনাথ বড়-বড় চোখে চেয়ে বলে, “এই ভুলটাই তো আমিও করতে যাচ্ছিলাম কর্তা। ভেবেছিলুম বাজারের ‘শ্যামলাল হার্ডওয়্যার’-এ জিনিসগুলো সের দরে বেচে দেব। তখনই ঘনারাম এসে বলল, ‘ওরে আহাম্মক, সবকিছুই ঘষেমেজে দেখতে হয়। নইলে বুঝবি কী করে যে বস্তুটা আসলে কিনা? কথায় আছে, যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই। মিলিলেও মিলিতে পারে অমূল্য রতন।”

“না হে রঘুনাথ, তোমাকে দেখছি ঘনারামের ভূতে পেয়েছে।”

“যে আজ্ঞে, আপনার চারদিকে চোখ ফাঁকি দেওয়ার উপায় নেই। ঘনারামও বলছিল বটে, ‘বীরুবাবুকে দেখলে আলাভোলা মনে হয় বটে, কিন্তু হুঁশিয়ার লোক।”

বীরু বিরক্ত হয়ে বলে, “কী মুশকিল! ঘনারামটা কে সেটাই তো বুঝতে পারছি না? সে হঠাৎ আমার সুখ্যাতিই বা করে কোন সুবাদে? তাকে আগে আমার সামনে হাজির করো তো বাপু!”

রঘুনাথ একটু চিন্তিত মুখ করে বলে, “আজ্ঞে, হাজির করতে চাইলেই কি আর সে এসে হাজির হবে কর্তা? কাজটা শক্ত হবে।”

“তা হলে বাবু, সোজা বলে দিচ্ছি তাকে এ বাড়িতে যাতায়াত করতে বারণ করে দিয়ো।”

রঘুনাথ অবাক হয়ে বলে, “বারণ করব? তাই বা কী করে হয়? ঘনারাম তো এ বাড়িতেই থাকে মশাই!”

শুনে বীরু তাজ্জব। উত্তেজিত হয়ে বলে, “এ বাড়িতে থাকে, বলো কী? এটা কি মামার বাড়ির আবদার নাকি? না বলেকয়ে একজন উটকো লোক ঢুকে পড়লেই হল? দেশে কি আইন নেই? আদালত নেই? পুলিশ নেই? বাড়ির মালিককে না জানিয়ে তার পারমিশন না নিয়ে ঢুকে পড়লেই হল?”

রঘুনাথ মাথা চুলকোতে-চুলকোতে বলে, “তা কথাটা অবিশ্যি ঠিক। তবে সে পুরনো লোক কিনা। তা প্রায় ধরুন ষাট-সত্তর বছর ধরেই এখানে থানা গেড়ে আছে। একটু মায়াও পড়ে গেছে তো।”

এবার বিস্ময়ে অনেকক্ষণ কথাই বলতে পারল না বীরু। তারপর গলা নামিয়ে সন্দিহান চোখে রঘুনাথের দিকে চেয়ে বলে, “ষাট-সত্তর বছর ধরে আছে? বাপু রঘুনাথ, তোমার সত্যি কথা বলার অভ্যেস এত কম কেন? তুমি অবিশ্যি একটু পাগলও আছ। ঘনারামের গল্প ফেঁদে তুমি আমার পিলে চমকে দিয়েছিলে কিন্তু। যাকগে, গুলগল্প আর বেশি মেরো না বাপু। আমি সোজা সরল মানুষ, টপ করে সব বিশ্বাস করে ফেলি।”

“যে আজ্ঞে, তাই হবে। আপনার যদি ঘনারামের কথা শোনার গরজ না থাকে, তা হলে আমারই বা গায়ে পড়ে তা শোনানোর দরকারটা কী?”

একদিন সকালে বীরু তার রোজকার বরাদ্দের এক গ্লাস দুধ খাচ্ছিল। রঘুনাথ বলল, “কর্তা, দুধ খাওয়ার সময় আপনার মুখে কোনও ভাব ফোটে না কেন বলুন তো?”

বীরু অবাক হয়ে বলে, “দুধ খাওয়ার সময় কি মুখে কোনও ভাব ফোটার কথা নাকি?”

“আজ্ঞে, তাই তো জানি। দুধ হল অমৃত। তা খাওয়ার সময় মানুষের মুখে একটা স্বর্গীয় ভাব ফুটে উঠলে তবেই বুঝতে হবে, দুধটা

“বটে!”

“যে আজ্ঞে, কিন্তু ভাবটা যখন ফুটছে না তখন বুঝতে হবে রামরিখ গয়লার দুধে গন্ডগোল আছে।”

“তা বাপু সত্যি কথা বলতে কী, দুধের আমি তেমন স্বাদগন্ধ পাই না। খেতে হয় বলে খাই।”

“আজ্ঞে, আমিও তো সে কথাই বলছি। রামরিখ দুধ বলে যা দিচ্ছে তা স্রেফ পিটুলিগোলা। আমি ঘন করে জ্বাল দিয়ে দেখেছি। রামরিখের দুধে সরই পড়ে না। আর তাই দুধ খাওয়ার সময় আপনার মুখে সেই ভাবখানাও ফুটছে না। কথায় আছে দুধে হচ্ছে বল। আপনার বলও তাই বৃদ্ধি হচ্ছে না।”

“বলছ! তা হলে কী করা যায় বলো তো?”

“তাই বলছি, আপনি অনুমতি করলে আমি এই কাছের রামনগরের গোহাটা থেকে একটা দুধেল গাই কিনে নিয়ে আসি।”

“ও বাবা, গোরুর দেখাশোনা করবে কে? সে তো অনেক ঝামেলা!’

“আমি আছি কী করতে কর্তা? ও নিয়ে আপনি ভাববেন না। টাকাটা ফেলে দিন, আমি গোরু নিয়ে আসি।”

বীরু দোনোমনো করে বলে, “দেখ বাপু রঘুনাথ, তুমি যে কাজের লোক তা আমি জানি। তোমাকে আমার বিশ্বাসও হয়। কিন্তু দু’ দিনের জীবন দেখতে-দেখতে কেটে যাবে। ভজঘট পাকিয়ে লাভ কী?”

শেষ পর্যন্ত অবশ্য বীরু গোরু কেনায় মত দিল এবং দু’দিন পর রঘুনাথ দিব্যি একটা নধর কালো গোরু সঙ্গে একটা বকনা বাছুরসহ কিনে নিয়ে এসে বলল, “আট হাজার টাকা পড়ে গেল কর্তা। আরও কমেই হত, কিন্তু আরও কয়েকজন গোরুটাকে তাক করেছিল বলে এর নীচে নামানো গেল না।”

দামটা মোটেই বেশি বলে মনে হল না বীরুর। এবং মনে-মনে তাকে স্বীকার করতে হল, পাগল হোক বা গুলবাজ হোক, রঘুনাথের এলেম আছে।

পরদিন সকালে দুধের গেলাসে চুমুক দিয়েই বীরু বুঝতে পারল, এতকাল দুধ বলে যা খেয়ে এসেছে তার সঙ্গে গোরুর কোনও সম্পর্ক নেই। জিভ থেকে পেট পর্যন্ত দুধ যেন প্রভাতফেরি গাইতে গাইতে নেমে গেল। দুধ জিনিসটা যে কত ভাল, সেটাই নিমীলিত চোখে বসে ভাবছিল সে।

তার সামনে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাকে নিরীক্ষণ করছিল রঘুনাথ। এক গাল হেসে বলল, “হ্যাঁ, এইবার আপনার মুখে সেই স্বর্গীয় ভাবখানা ফুটেছে কর্তা!”

লজ্জা পেয়ে বীর বাহাদুর বলে, “হ্যাঁ, জিনিসটা মন্দ নয়। দুধ বোধ হয় এরকমই হওয়া উচিত।”

“হ্যাপাও পোহাতে হয়েছে কর্তা। আপনি ভালমানুষ বলে রামরিখ এতকাল খড়িগোলা জল খাইয়ে বিস্তর মুনাফা লুটেছে। এখন তাকে ছাড়িয়ে দেওয়ায় খেপে গিয়ে জোট বেঁধে চড়াও হয়েছিল। রামরিখের হুকুম, গোরু বেচে দিয়ে তার কাছ থেকেই দুধ নিতে হবে।”

বীরু আঁতকে উঠে বলে, “ও বাবা, রামরিখ যে ভীষণ গুন্ডা লোক, কখন চড়াও হয়েছিল?”

“আজ্ঞে আজ প্রাতঃকালেই। ভাল করে তখনও ইষ্টনাম স্মরণ করিনি। রামরিখ আর তার পাঁচ-সাতজন স্যাঙাত লাঠিসোটা নিয়ে হাজির।”

“সর্বনাশ! এ তো বিপদের কথা হল রে। তুমি বরং গোরুটা বেচেই দাও।”

“চিন্তা নেই কর্তা, আমি তো আছি। তার মারমুখো ভাব দেখে শেষে আমিও লাঠিগাছি নিয়ে তাদের রুখলাম।”

বীরু শিহরিত হয়ে বলে, “বলো কী হে! রামরিখ যে বিশাল পালোয়ান আর দারুণ লাঠিবাজ।”

“তা হবে, কে অত খবর রাখে? তবে তারা পাঁচ-সাত মিনিটের বেশি লড়াই দিতে পারেনি। ওই আম গাছের তলায় রামরিখকে শুইয়ে দিলাম, আর তার স্যাঙাতদের পিটিয়ে জনাতিনেককে ফেললাম ওই নিম গাছের তলায়। জনাদুই চাতালে শয্যা নিল, একজন ল্যাংচাতেল্যাংচাতে পালিয়েছে।”

স্তম্ভিত বীরু কিছুক্ষণ হাঁ করে রঘুনাথের দিকে বড়-বড় চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, “তুমি একা তাদের এতজনকে লাঠিপেটা করেছ? কথাটা কি আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?”

ঘাড় চুলকোতে-চুলকোতে রঘুনাথ বলে, “বিশ্বাস করা বা না-করা আপনার বিবেচনা। প্রয়োজনে আমি মিছে কথা কই বটে। তবে আপনাকে গুরু বলে মেনেছি তো। আপনার কাছে প্রাণ গেলেও মিছে কথা কইতে পারব না কর্তা।”

“বাপু হে, তুমি লাঠিখেলা শিখতে আমার কাছেই এসেছিলে। কিন্তু আমার ও বিদ্যে জানা নেই বলে শেখাতেও পারিনি। তা তুমি এমন লাঠিবাজ হয়ে উঠলে কী করে?”

“আজ্ঞে, আপনি হলেন ওস্তাদেরও ওস্তাদ। আপনার কথা আলাদা। তবে আমাকে একটু-আধটু তালিম দেয় বংশীবদন।”

“বংশীবদন!বংশীবদনটা আবার কে হে?”

একটু লাজুক হেসে হাত কচলে রঘুনাথ বলে, “আজ্ঞে বংশীবদনের কথা কী করে ভেঙে বলি! তবে সে আপনার খুব কাছের লোক। আশপাশেই ঘুরঘুর করে বেড়ায়।”

বীরু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “তা সে তোমার ঘনারামের মাসতুতো ভাই নয় তো?”

“আজ্ঞে ঠিক তা নয়, তবে দু’জনের একটা সম্পর্ক আছে বটে। ভারী গলাগলি ভাব।”

বীরু হতাশ হয়ে বলে, “বুঝেছি হে রঘুনাথ, তোমার গুল আর গল্পের স্বভাবটা আমি সারাতে পারিনি। তা সে যাকগে, আসল কথাটা হল দুধটা আজ বড্ড ভাল খেলুম।”

“যে আজ্ঞে। এ হল মুলতানি গাই। দুধের খুব স্বাদ। আরও অনেকেই কিনতে চাইছিল গোরুটাকে। আমি কিনে নেওয়ায় কয়েকজন জানতে চাইছিল গোরুটা কার জন্য কিনছি।”

“বটে! তা তারা জানতে চায় কেন?”

“আজ্ঞে, গাঁয়ের লোকের ওই একটা স্বভাব। দরকার থাক না না-থাক তারা এটা-ওটা জানতে চায়। তা আপনার নাম বলাতে দু’-একজন কেমন যেন ঠোঁট বেঁকাল। একজন তো বলেই ফেলল, ‘বীরু কি লটারি মেরেছে নাকি যে, গোরু কিনছে? তার এত পয়সা হল কবে?’ তা আমি তখন বুক চিতিয়ে সবাইকে শুনিয়ে বলে দিলাম, ‘কেন মশাই, কর্তাবাবুর কি টাকার অভাব? তিনি হ্যাতা ন্যাতা লোক তো নন, স্বয়ং জং বাহাদুরের নাতি। তাঁর কি টাকাপয়সা বা সোনাদানার অভাব আছে? তিনি টাকার পাহাড়ের উপর বসে আছেন মশাই।””

কথাটা শুনে বীরু চোখ কপালে তুলে বলে, “সর্বনাশ! তুমি করেছ কী, হাটে বাজারে দাঁড়িয়ে ও কথা বলে দিলে? এ তো খাল কেটে কুমির আনা। এ খবর রটতে দেরি হবে ভেবেছ? এক লহমায় গাঁয়েগাঁয়ে রটে যাবে যে, আমার হঠাৎ আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়েছে। চোর-ডাকাতরা ধরে নেবে আমি জং বাহাদুরের লুকনো টাকা আর সোনাদানার সন্ধান পেয়ে গেছি। এ বাড়িতে যে চোর-ডাকাতের মোচ্ছব লেগে যাবে হে রঘুনাথ।”

রঘুনাথ লজ্জিত মুখে ঘাড় চুলকোতে-চুলকোতে বলল, “আজ্ঞে, কাজটা বড্ড ভুল করে ফেলেছি বলেই এখন মনে হচ্ছে কর্তা। তবে পাঁচজনের সামনে আপনার অপমান হচ্ছে দেখে নিজেকে সামলাতে পারিনি। শত হলেও আপনি তো ওস্তাদ।”

“এখন যে আমার হৃদকম্প হতে লেগেছে রঘুনাথ! বুকটা দুরদুর করছে। ডাকাতদের হাতে বিস্তর ঠ্যাঙানি খেতে হয়েছে। এই বত্রিশ বছর বয়সে আবার ঠ্যাঙানি খেলে কি বাঁচব? এখনকার ডাকাতরা তো আবার বন্দুক-পিস্তল আর বোমা নিয়ে আসে। না হে, তুমি আমাকে বড্ড বিপদে ফেলে দিলে।”

“অত ভাবছেন কেন কর্তা? নীলরতন পাঠকমশাই তো হাতের কাছেই আছেন। অতি বিবেচক ধুরন্ধর মানুষ। সবাই তাঁকে বিপত্তারণ বলে মানে। তাঁর কাছ থেকে মোক্ষম বুদ্ধি পরামর্শ নিয়ে রাখব’খন।” “নীলরতন পাঠক? জন্মেও যে নাম শুনিনি।”

রঘুনাথ একগাল হেসে বলে, “নাম শোনেননি বলেই কি তিনি নেই? একটু আবডালে থাকেন বটে, কিন্তু মাথাখানা হল গিয়ে নানা ফন্দিফিকির আর কূটবুদ্ধির বাসা। বিপদের সময় লোককে বুদ্ধি পরামর্শ দেওয়াই তাঁর কাজ।”

“তা তিনি থাকেন কোথায়? কাছেপিঠে হলে তুমি বরং এক্ষুনি গিয়ে তাঁকে ব্যাপারটা জানিয়ে এসো।”

“অস্থির হবেন না কর্তা, ধৈর্য ধরুন। খবর তিনি এক রকম পেয়েই গেছেন।”

“খবর পেয়ে গেছেন? হওয়ার মুখে নাকি?” “যে আজ্ঞে।”

জং বাহাদুর সিংহ বাড়িখানা করেছিল বটে জম্পেশ। উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা আট বিঘে জমি। দু’ বিঘে জুড়ে মস্ত পুকুর। দলবল নিয়ে এই বাড়িতে বাস করত। ঘোড়াশালে মেলা ঘোড়া ছিল, একটা মোটরগাড়ি ছিল, অস্ত্রাগার ছিল বলেও শোনা যায়। আর ছিল মেলা সোনাদানা, পয়সা। সেসব এখন আর কিছুই নেই। শুধু বিশাল বাড়িটা পড়ে আছে। শখ করে নানা রকম দামি আর শৌখিন গাছের বাগান করেছিল জং বাহাদুর সিংহ। পরিচর্যার অভাবে গোটা বাগানটাই এখন আগাছার জঙ্গল। সাপ, শেয়ালের বাসা। বাড়িটার দিকে চাইলে মাঝে-মাঝে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বীরুর। এত বড় বাড়ি তার তো কোনও কাজেই লাগে না। একখানা ঘর হলেই তার চলে যায়। অনেকেই পরামর্শ দেয় বাড়িটা বিক্রি করে দিতে। কিন্তু সে রাজি হয়নি। বাড়িটার বড় মায়া।

কিন্তু কয়েকদিন যাবৎ একজন লোক তাকে জ্বালাতন করে যাচ্ছে। লোকটার নাম নবকুমার বিশ্বাস। তার বিরাট ব্যবসা। দু’বছর আগে লোকটা ভারী অমায়িক মুখ করে এক সকালে এসে বলল, “আপনার তো এত বড় বাড়ির কোনও প্রয়োজনই দেখছি না বীরুবাবু। রক্ষণাবেক্ষণও হচ্ছে না। যদি পুকুর সমেত পিছনের চার বিঘে জমি আমাকে ন্যায্য দামে দেন, তা হলে আমি ওখানে গাঁয়ের বাচ্চাদের জন্য একটা শিশু উদ্যান করব।”

বীর বাহাদুর অবাক হয়ে বলে, “শিশু উদ্যান করবেন? তার কি কোনও দরকার আছে মশাই? এটা তো বরাবর শিশু উদ্যানই হয়ে আছে। গাঁয়ের বাচ্চারা এসে গাছে উঠে আম, জাম, কাঁঠাল, কুল, জামরুল পেড়ে নিয়ে যাচ্ছে, পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে দাপাদাপি করছে, আমি তো বারণ করি না।”

“আহা, তা বলে জংলা জায়গা ফেলে রাখা কি ভাল? আমি তো শুনেছি আগাছা হওয়াতে আপনার বাগান এখন সাপখোপের রাজত্ব।” “গাঁ-গঞ্জে সাপখোপ থাকেই। তাতে কী?”

“আপনি বুঝতে চাইছেন না বীরুবাবু, এঁদো পুকুরের বদলে আমি বানাব সুইমিং পুল। আগাছা কেটে হবে দারুণ একখানা বাগান, একখানা ভাল গেস্ট হাউজ়, জিম, খেলাধুলোর ব্যবস্থা। এ জায়গা আর চেনাই যাবে না।”

“চেনা জায়গাটা অচেনা হয়ে গেলে কি ভাল হবে মশাই?”

“ভাল হবে না, বলেন কী? দুনিয়ার সব জায়গাই যে বদলে যাচ্ছে। আর ওটাই তো নিয়ম। আমি তো ঠিক করেছি গোটা বিদ্যেধরপুরকেই বদলে দেব। জেলেপাড়ার পুরনো রাজবাড়িটা আমরা অলরেডি কিনে নিয়েছি। কপালেশ্বরী কালীমন্দির ভেঙে নতুন করে গড়া হবে। আরও অনেক প্ল্যান আছে আমাদের।”

বিবরণ শুনে মোটেই খুশি হল না বীরু। খুশি হওয়ার খুব একটা কারণও নেই। বিরস মুখে বলে, “ঠিক আছে, ভেবে দেখব’খন। গাঁয়ের মাতব্বররা কী বলে দেখি।”

“ওঁদের নিয়ে কোনও চিন্তা নেই। ওঁদের আমরা পকেটে পুরে নিয়েছি। আপনি বরং একটু পজ়িটিভভাবে ভাবুন। আমি সাতদিন পরে ফের আসব।”

গোবিন্দখুড়ো সব শুনে শুধু বললেন, “হুম।” তারপর অনেকক্ষণ গুম মেরে রইলেন। তারপর একখানা বড় সাইজ়ের দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “সেইজন্যই তো গাঁয়ে একজন পুরুষসিংহর বড় দরকার ছিল রে। এমন একজন সড়ালে মানুষ, যার এক হাঁকাড়ে যত ক’টা মানুষ এসে এক জায়গায় জড়ো হত, এককাট্টা হয়ে রুখে দাঁড়াত। সেইজন্যই তোর মুখের দিকে আশায় আশায় আমরা সবাই চেয়েছিলুম। কিন্তু তোর ভিতর থেকে তো সিংহ গর্জনটা কিছুতেই বেরচ্ছে না।”

“নবকুমারকে বড় সোজা লোক ভাবিসনি বাপু। তার পিছনে বড় কারও মাথা আছে। তাদের যেমন টাকার জোর, তেমনি লোকবল। বুঝলি কিছু? জমিদারি প্রথা এখন লোপ পেয়েছে বটে, কিন্তু সেই প্রথাই আবার নাম ভাঁড়িয়ে ফিরে আসছে। রিয়েল এস্টেট না কী যেন একটা বলে। রাজবাড়ি গিয়েছে, শিবমন্দির গিয়েছে, কালীবাড়ির দখল নিয়েছে, গোটা তল্লাটই গিলে খেয়ে নেবে একদিন। তোর সাতআট বিঘের বসত বাড়িই কি রক্ষে করতে পারবি? যদি ভাল চাস তো এখনও জেগে ওঠ। তোর ভিতরে যে জং বাহাদুর ঘুমিয়ে আছে, তাকে খুঁচিয়ে জাগিয়ে দে। একটা বাঘা হুঙ্কার দিয়ে ঝাঁকি মেরে দাঁড়া তো দেখি?”

মুখ গোমড়া করে খুব অভিমানের সঙ্গে বীর বাহাদুর বলে, “সবসময়ে আমাকেই আপনারা বাঘ-সিংহ হতে বলেন কেন গোবিন্দখুড়ো? গাঁয়ে তো আর পাঁচজন ছেলে-ছোকরা, জোয়ান-মদ্দ আছে না কী?”

“তা থাকবে না কেন? মেলাই আছে। কিন্তু হাজারটা ভেড়ার তো দরকার নেই আমাদের। আমরা চাই একটা বাঘ।”

“এটা আপনাদের বড় অন্যায় খুড়ো, সবসময় আমাকেই আপনারা বিপদের মুখে ঠেলে দিতে চান। আমি তো বলেই দিয়েছি, দাদুর কোনও গুণই আমার মধ্যে নেই। আমি ভিতু, দুর্বল, আর এরকমই আমি বেশ ভাল আছি। ডাকাতদের হাতে কতবার মার খেয়েছি তা জানেন? মুখ বুজে সয়ে গেছি।”

গোবিন্দখুড়ো গদগদ হয়ে বললেন, “ওরে তাই তো বলছি। ওরকম মার খেয়েও যে তুই এখনও বহাল আছিস তার কারণ তোর শরীরে জং বাহাদুরের রক্ত বইছে।”

“কী যে বলেন খুড়ো, মার খাওয়াটা আবার কোন বীরত্বের কাজ?” “যতবার তোর বাড়িতে ডাকাত পড়েছে ততবার আমরা ঘরে বসে ইস্টনাম জপ করতে করতে ভেবেছি, এইবার বীরুটা গেল! যে মার তুই খেয়েছিস তাতে আর কোনও মদ্দ বেঁচে থাকত না। তোর দম ছিল বলে মরিসনি। যে ওই আসুরিক মার সহ্য করতে পারে, তার হিম্মত নেই তো কার হিম্মত আছে? তুই যে একটা বাহাদুর লোক সেটা একমাত্র তুই-ই বুঝতে চাইছিস না। যদি এই রকম মিনমিনে হয়েই থাকতে চাস, তবে বলে দিচ্ছি তোর কপালে কিন্তু বিপদ নাচছে।”

তা বিপদ যে নাচছিল সেটা বুঝতে বেশি দেরি হল না বীরুর। ঠিক সাতদিনের মাথায় নবকুমার এসে হাজির। এবার একা নয়, সঙ্গে দু’জন সন্দেহজনক হাবভাবের লম্বা, চওড়া লোক। তাদের কপালে ভ্রুকুটি, মুখে হাসি নেই।

“আজ্ঞে, হঠাৎ তর্জন-গর্জন করার দরকারটা কী হল তা একটু বুঝিয়ে বলবেন?”

নবকুমার বিনীতভাবেই বলল, “কী ঠিক করলেন বীরুবাবু?”

বীরু মাথা নেড়ে বলল, “বাপপিতেমোর জায়গা মশাই, বিক্রি করব না।”

“আহা স্পষ্ট করেই বলুন না, আমাদের দেওয়া দরটা কি কম মনে হচ্ছে? তা হলে আরও কিছু বাড়িয়ে দিতে পারি।”

বীরু এবার বেশ দৃঢ় কণ্ঠেই বলল, “না দামের কথাই আমি ভাবিনি। ভিটে বেচব না বলেই স্থির করেছি।”

“তা বললে হবে কেন বীরুবাবু? আপনি একা একজন মানুষ। এতখানি জমি দখল করে বসে থাকবেন, এটা কি ভাল? জমিটা তো গাঁয়ের লোকেরই উপকারে লাগবে। আপনি আর-একটু পজ়িটিভলি ভাবুন। আমরা দর বাড়াতে রাজি আছি যদি দরটা আমাদের সাধ্যের মধ্যে হয়।”

“দরের কথা উঠছে কেন? বিক্রিই যখন করব না, তখন দরাদরির প্রশ্নও নেই।”

“দেখুন, আমরা খবর রাখি যে আপনার দাদু জং বাহাদুর সিংহ নিতান্ত গায়ের জোরে ওই জমিটা দখল করেছিলেন। হয়তো আপনাদের পাকা দালানও নেই। বললে হয়তো খারাপ শোনাবে যে, খতিয়ে দেখলে জমিটা কিন্তু আপনি এক রকম জবরদখল করে বসে আছেন।”

বীরু কঠিন গলায় বলে, “আমার পাকা দলিল নেই কে বলল?”

“ঠিক আছে, মেনে নিচ্ছি যে আপনার দলিল আছে। তবু গাঁয়ের ভালর জন্য জমিটা যদি আপনি ন্যায্য দামে দেন, তা হলে এই গাঁয়ের মানুষের কত উপকার হবে তা ভেবে দেখেছেন? জমিটা তো পতিত জমি হিসেবে পড়েই রয়েছে। এভাবে উৎপাদনশীল জমি ফেলে রাখা তো অন্যায়।”

“জঙ্গল হাপিশ করে বাড়ি, ঘর বানানো কি ভাল কাজ মশাই? আর জমি পতিত হয়ে পড়ে আছে কে বলল? কত ফলন্ত গাছ আছে। জানেন? আর এটা তো এমনিতেই শিশু উদ্যান। সারা বছর তাদের এখানে আনাগোনা। সাফ কথা শুনে রাখুন, জমি আমি বেচব না। আপনি এখন আসুন।”

নবকুমারের স্যাঙাত দুটো লম্বা, চওড়া গুন্ডা লোক ক্রুর চোখে বীর বাহাদুরকে মেপে নিচ্ছিল। ভাবসাব যেন ইশারা পেলেই ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বে। তবে বীরুর মার খেয়ে অভ্যেস আছে বলে তেমন ভয় হল না। সেও বেশ লম্বা-চওড়া মানুষ বটে, তবে তার ভিতরে তেজ নেই। পানু সর্দার একবার বলেছিল, “তুই হলি তুবড়ির খোল, ভিতরে মশলাটাই ভরা হয়নি।”

নবকুমার গম্ভীর হয়ে বলে, “আপনি যে এতটা জমি দখল করে আছেন সেটা কিন্তু গাঁয়ের লোকেরাও ভাল চোখে দেখছে না। মোড়ল আর মুরুব্বিরা তো আমাকে বলেছে, বীর বাহাদুরের এটা ভারী অন্যায় হচ্ছে। তারা তো হাসিমুখে তাদের বাড়তি জমি আমাদের দিয়ে দিচ্ছে। আর আমরা তো ভাল কাজই করতে চাইছি। বিদ্যাধরপুর যদি একটা টুরিস্ট স্পট হয়ে ওঠে তা হলে কি আপনারও ভাল লাগবে না?”

“না, মশাই। আমি চাই না বিদ্যেধরপুরে গুচ্ছের লোক এসে জুটুক।”

“আপনি কি এই গ্রামের উন্নতি চান না?”

“আপনি যে ধরনের উন্নতির কথা বলছেন, সেরকম উন্নতি চাই না।”

“আপনি না চাইলেও উন্নতি আটকে থাকবে না। আপনাকে ফের অনুরোধ করছি, জমিটার বিষয়ে আর-একটু ভাবুন। আপনার বাড়তি, পতিত জমিই তো চাইছি। বসতবাড়িটা তো নয়। আপনি রাজি না হলে কর্নেলসাহেব কিন্তু খুব দুঃখ পাবেন।”

“কর্নেলসাহেবটা আবার কে মশাই?”

“আমার মনিব। গোটা পরিকল্পনাটা তো তাঁরই

।” “আমি কর্নেলটর্নেল কাউকে চিনি না।”

“চিনবেন, এখানকার লোক তো নন, তবে এবার থেকে তিনি এখানকারই বাসিন্দা হবেন বলে ঠিক করেছেন। বিদ্যেধরপুরের ভাগ্য খুবই ভাল। এ পর্যন্ত বোধ হয় হাজারখানেক গ্রাম দেখে কোনওটাই তাঁর পছন্দ নি। কিন্তু বিদ্যেধরপুর? এখনই তিনি জায়গাটা ভালবেসে ফেলেছেন। আর একবার যখন তাঁর নেকনজর পড়েছে, তখন এ গাঁয়ের উন্নতি ঠেকায় কে? তবে সেই উন্নতির পথে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ালে সেটা তিনি পছন্দ নাও করতে পারেন। কর্নেলসাহেব বড্ড মেজাজি লোক, বুঝতেই পারছেন। তাই বলছি, একটু ভাবুন। আমি না হয় দিনতিনেক পরে আসব।”

“না, নববাবু। আর আপনার আসবার দরকার নেই। আমি বিদ্যেধরপুরের উন্নতি চাই না। আমি চাই, এ গাঁ যেমন আছে তেমনি থাকুক।

নব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “আর-একটু বিষয়টা নিয়ে ভেবে দেখতে পারতেন।”

নব চলে যাওয়ার পর বীরু দুপুরবেলায় বাইরের বারান্দায় বসে মনখারাপ করে আকাশপাতাল ভাবছিল। রঘুনাথ এক ঝোলা কাঠকুটো নিয়ে এসে উঠোনের একপাশে জড়ো করে রেখে বলল, “ওস্তাদ, ভরসা দেন তো একটা কথা বলি।”

“কী কথা?”

“বাড়ির পিছন দিকের দেওয়ালটা কিন্তু বড্ড নোনা ধরে গিয়েছে।”

“তা কী আর করা যাবে!”

“একটু সারিয়েটারিয়ে নিলে হয় না ওস্তাদ?”

“না হে রঘুনাথ, এ বাড়ির উপর শকুনের নজর পড়েছে। আমি ভাবগতিক ভাল বুঝছি না। দেওয়ালের পিছনে আর পয়সা খরচ করে লাভ নেই।”

“তা আপনি কি নবকুমারের প্রস্তাব শুনে ঘেবড়ে গেলেন নাকি? নাকি কর্নেলসাহেবের কথা শুনে?”

‘‘তুমি কি আড়ালে আড়ি পেতে সব শুনেছ?”

“আজ্ঞে না, গাঁয়ে এখন ওদের নিয়েই কথা হচ্ছে কিনা। ছেলেছোকরাদের এক হাজার, দু’ হাজার করে দিয়ে হাতে রাখছে। যাতে তারা কোনও হাঙ্গামা না করে। বিপিনদারোগাকেও পকেটে পুরে ফেলেছে। মাতব্বররাও কাত হয়ে পড়েছে প্রায়। আপনার পাশে দাঁড়ানোর প্রায় কেউই নেই।”

“বলো কী হে রঘুনাথ! তা হলে কি আমি একা?

” “যে আজ্ঞে, তবে ঠিক একাও বলা যায় না।”

“একা বলা যায় না কেন? আমার পাশে কে আছে? ওই তো গোবিন্দখুড়োর মতো দু’-চারজন বুড়োহাবড়া। তাদের মতিগতিই বা কী? তা হলে কি জমিটা বেচে দেওয়াই ভাল?”

“বললেই তো আপনি আবার আমার উপর রাগ করবেন। তবু বলি, আপনি একাই একশো। আপনার দলবলের দরকার কী?”

বীরু হতাশ হয়ে মাথা নেড়ে বলে, “নাহ, তোমার মতো পাগলের পাল্লায় পড়ে আমার মাথাটাও আজকাল গুলিয়ে যাচ্ছে। গোবিন্দখুড়োর মুখে শুনলুম ওদের অনেক লোকবল, অর্থবল। নবকুমার সঙ্গে করে যে লোকদুটোকে এনেছিল, তাদের ভাবসাবও গুন্ডার মতোই।”

“আজ্ঞে, তারা গুন্ডাই।”

“তবে? আমি একা কি ওদের সঙ্গে পারব? এখন মনে হচ্ছে নবকুমারের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেই ভাল করতুম।”

“আজ্ঞে না। ছোট মুখে বড় কথা বলে ধরবেন না যেন। আমার তো মনে হচ্ছে রাজি না হয়ে ভালই করেছেন।”

“ভালটা যে কী করলাম সেটাই বুঝতে পারছি না।”

সারা দিনটা আজ বীরুর নানা দুশ্চিন্তায় কাটল। ভাল করে খেল না, রাতে ঘুমটাও তেমন হচ্ছিল না। এপাশ ওপাশ করতে-করতে হঠাৎ মাঝরাত্তিরে গুডুম শব্দে আঁতকে উঠল সে। বন্দুকের আওয়াজ না? এবং খুব কাছ থেকেই। মনে হল, পিছনের বাগানের দিক থেকেই আওয়াজটা এল। দুরুদুরু বুকে বিছানায় উঠে বসল বীরু। বন্দুক চালাচ্ছে কে? আবার কি ডাকাত পড়ল? নাকি নবকুমার তার দল নিয়ে হামলা করল?

ডান হাতে টর্চ আর একটা লাঠি নিয়ে বেরিয়ে এল বীরু। সাবধানে গাছপালার ফাঁক দিয়ে বাড়ির পিছনে এগিয়ে গেল। টর্চ জ্বেলে যা দেখা গেল তা আহ্লাদের ব্যাপার নয়। বাগানের দেওয়াল প্রায় ছয়-সাত ফুট অংশ ভেঙে পড়ে গিয়েছে। দেওয়ালটা পুরনো হয়েছে বটে, কিন্তু ভেঙে পড়ার মতো অবস্থায় ছিল না। কিন্তু দেওয়াল ভাঙার সঙ্গে বন্দুকের শব্দের সম্পর্কটা কী? কেনই বা দেওয়াল ভাঙল, আর কে-ই বা বন্দুক চালাল কিছুই বুঝতে না পেরে সে ভ্যাবলার মতো দৃশ্যটা দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দেখল। হঠাৎ মানুষজনের সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। টর্চ আর হ্যারিকেন নিয়ে কয়েকজন প্রতিবেশী এসে হাজির।

“এই যে বীরুভায়া, তোমার বাড়িতে কি আবার ডাকাত পড়ল নাকি?”

“আজ্ঞে, ঠিক বুঝতে পারছি না। দেওয়ালটা ভাঙা দেখছি, আর একটা বন্দুকের শব্দও পেয়েছি বটে। কিন্তু কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না।”

“তোমার তো বিরাট বাড়ি, বাগানের ঝোপঝাড়ে কেউ লুকিয়ে নেই তো আবার?”

“লুকনোর তো দরকারও দেখি না। আমার বাড়িতে তো তেমন আগলবাগলও নেই। যে খুশি আসে যায়। দেওয়ালটা কেন ভাঙা হল তা বুঝতে পারছি না।”

লোকজন ঘটনার সন্ধানে এসেছিল। হতাশ হয়ে ফিরে গেল। চিন্তিত বীরুর আর ভাল ঘুম হল না। পরদিন সে রঘুনাথকে জিজ্ঞেস করল, “কাল রাতে কোনও শব্দ পাওনি?”

“কিসের শব্দ ওস্তাদ?”

“বন্দুকের?”

“বন্দুক! না তো। তবে আমি ঘুমোলে একদম কাদা। কামান দাগলেও ঘুম ভাঙে না।”

“পিছনের দেওয়ালটাও খানিকটা কেউ ভেঙেছে

।” “যে আজ্ঞে, ভাঙারই কথা কিনা।”

“তার মানে কী রঘুনাথ?”

“মানে খুব সোজা ওস্তাদ। রাতারাতি দেওয়াল ভেঙে খানিকটা জমির দখল নিতে পারলে আপনাকে প্যাঁচে ফেলে দেওয়া যাবে। আপনি যে লড়াই দেবেন না তা ওরা জানে। গাঁয়ের লোক বা পুলিশ যদি আপনার পক্ষে না থাকে, তা হলে জমি এরকমভাবেই বেদখল হতে থাকবে।”

“কিন্তু বেদখল তো হয়নি?”

“আজ হয়নি, কাল যে হবে না তা কে বলতে পারে? এটা তো গৌরচন্দ্রিকা হয়ে রইল।”

“কিন্তু বন্দুকটা কে দাগল রঘুনাথ?”

“আজ্ঞে, সেটাও ভাবনার কথা। বন্দুক সর্বনেশে জিনিস। তবে ভারী কাজের জিনিসও বটে।”