ছাগল ও তার পিএইচডি ডিগ্রি

ছাগল ও তার পিএইচডি ডিগ্রি

ইংরেজি ‘ডক্টর’ শব্দটি মূলত ল্যাটিন ভাষার। এর অর্থ হলো ‘শিক্ষক বা ‘প্রশিক্ষক’। মধ্যযুগের দিকে ইউরোপে যারা ল্যাটিন ভাষা পড়াতেন, তাদের একটি লাইসেন্স লাগতো, যার নাম ছিলো ‘Licentia Docendi’। এই লাইসেন্টিয়া ডোসেন্ডির ইংরেজি অনুবাদ হলো ‘License to Teach’ বা শেখানোর লাইসেন্স। লাইসেন্সটিকে ডাকা হতো ‘Doctoratus’, যার ইংরেজি রূপ হলো ‘Doctorate’, এবং এ লাইসেন্স যার থাকতো, তাকেই বলা হতো ডক্টর, আর ডক্টর মানে হলো শিক্ষক।

তখনকার দিনে ডক্টর ছিলেন চার্চের মোল্লারা, যারা বাইবেল পড়াতেন ও ব্যাখ্যা করতেন। চার্চের অনুমতি ছাড়া কেউ ‘ডক্টরেট ডিগ্রি’ বা ‘শেখানোর লাইসেন্স’ পেতো না। কিন্তু ১২১৩ সালে খ্রিস্টানদের পোপ ঘোষণা করলেন যে, আজ থেকে চার্চের পাশাপাশি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় ও শেখানোর লাইসেন্স বা ডক্টরেট ডিগ্রি দিতে পারবে। তবে এ ঘোষণার আগেও প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় চার্চের অনুমতি নিয়ে কিছু ছাত্রকে ডক্টরেট ডিগ্রি দিতো। কিথ এলান তাঁর ‘Changing Doctoral Degrees : An International Perspective’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে— পৃথিবীর প্রথম ডক্টরেট ডিগ্রিটি দেয়া হয়েছিলো ১১৫০ সালের দিকে, প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে।

সে-যুগে খ্রিস্টানদের এই ‘ডক্টরেট ডিগ্রি’-র মতো আরেকটি ডক্টরেট ডিগ্রি মুসলমানদেরও ছিলো। নাম- ইযাজাহ। ডক্টরেট দেয়া হতো ক্যাথোলিক চার্চ থেকে, আর ইযাজাহ দেয়া হতো মুসলিম মাদ্রাসা থেকে। কিন্তু দুটিরই অর্থ ছিলো এক: শেখানোর লাইসেন্স। যার ডক্টরেট ও ইযাজাহ আছে, তিনি শিক্ষকতা করতে পারবেন।

ডক্টরেট ও ইযাজাহ, এ দুটির কোনটি আগে শুরু হয়েছিলো এ নিয়ে বিতর্ক আছে। অধ্যাপক জর্জ মাকদাইসির মতে, ডক্টরেট ডিগ্রির প্রচলন ঘটেছে মুসলিমদের ইযাজাহ ডিগ্রির অনুকরণে।

এ কথা তাঁর ‘Scholasticism and Humanism in Classical Islam and the Christian West’ প্রবন্ধে উল্লেখ আছে। তবে টবি হাফ, নর্ম্যান ড্যানিয়েল, তাঁরা মাকদাইসির মতের সাথে একমত পোষণ করেন নি।

সতেরো শতকের দিকে জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই ডক্টরেট ডিগ্রি বা শিক্ষকতার লাইসেন্সের নতুন নাম দিলো ‘Doctorate of Philosophy’ বা PhD (Philosophiae Doctor), এবং বাংলাদেশে কেউ কেউ এই ‘চযরষড়ংড়ঢ়যু’ শব্দের অর্থ করে থাকে দর্শন। কিন্তু এই ফিলোসোফি সেই ফিলোসোফি নয়। ডক্টরেট অব ফিলোসোফিতে যে-ফিলোসোফি শব্দটি আছে, তা মূলত গ্রিক ভাষায় শব্দটির আদি অর্থকে নির্দেশ করে। অর্থটি এরকম: খড়াব ড়ভ ডরংফড়স বা জ্ঞানের প্রতি মোহ। অর্থাৎ ক্ষমতা, অর্থবিত্ত, বা পদ-পদবি নয়, যে-ব্যক্তির জ্ঞান ও বুদ্ধিচর্চার প্রতি মোহ জন্মেছে, সে-ব্যক্তিই পিএইচডি। অথচ আমি দেখছি, ইদানীং ছাগলেরাও দলবেঁধে পিএইচডি নিচ্ছে।

ফিলোসোফি শব্দটি ব্যবহারের পেছনে অন্য কারণও আছে। তখন ইউরোপে ইতিহাস, গণিত, দর্শন, সামাজিক বিজ্ঞান, ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সকল বিষয়কে একত্রে ফিলোসোফি বলা হতো। এখন যেটিকে ‘কলা অনুষদ’ বা ‘ফ্যাকাল্টি অব লিবারেল আর্টস’ ডাকা হয়, সেটি ওই সময় ‘ফ্যাকাল্টি অব ফিলোসোফি’ নামে পরিচিত ছিলো। এ জন্য কেউ দর্শনে ডক্টরেট না করলেও, তার ডক্টরেট ডিগ্রিকে ‘ডক্টরেট অব ফিলোসোফি’ বলা হতো। সংক্ষেপে লিখা হতো: Dr. Phil.

তবে কিছু কিছু জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়, পরবর্তীতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ডক্টরেটগুলিকে দর্শনের ডক্টরেট থেকে আলাদা করার জন্য ‘Doctor Rerum Naturalium’ বা ‘Doctor of Natural Sciences’ রাশিটি ব্যবহার করতে শুরু করে। এটিকে সংক্ষেপে লেখা হয়: Dr. rer. nat., এবং একইভাবে, কেউ সামাজিক বিজ্ঞান বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডক্টরেট করলে লেখা হয় Dr. rer. pol., আইন বিষয়ে করলে লেখা হয় Dr. jur. ইত্যাদি। সুতরাং জার্মানিতে যা Dr. Phil. বা Dr. rer. nat. বা Dr. jur., ইংরেজি বিশ্বে তা PhD বা DPhil; বিষয় যা-ই হোক না কেন।

উনিশ শতকের দিকে আমেরিকায় আরেক ধরনের ডক্টরেট ডিগ্রির প্রচলন ঘটে। এগুলোকে বলা হয় প্রোফেশোনাল বা ভোকেশোনাল বা পেশাগত ডক্টরেট ডিগ্রি। এদের একটি হলো ‘Doctor of Medicine’, যার ল্যাটিন নাম ‘Medicinae Doctor বা M.D., এবং আরেকটি হলো ‘Juris Doctor’ বা J.D.।

এমডি হলো চিকিৎসা বিষয়ে পেশাদার ডিগ্রি, যা আমেরিকানরা ধার করেছে মূলত স্কটল্যান্ড থেকে, এবং জেডি হলো আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি। এ ডিগ্রিগুলো আমাদের এমবিবিএস ও এলএলবির মতো, কিন্তু দুটোই ডক্টরেট ডিগ্রি।

এই অনেক ঘরানার ডক্টরেট ডিগ্রির একটি হলো গবেষণামুখী ডক্টরেট বা রিসার্চ-ডক্টরেট, এবং পিএইচডি বলতে গড়-মানুষরা এখন এটিকেই বুঝে থাকে। তাদের ধারণা, এটিই একমাত্র পিএইচডি ডিগ্রি, এবং এ ডিগ্রি যার আছে তিনি অমরত্ব লাভ করেছেন। সাংবাদিক ও প্রোপাগান্ডিস্ট ডক্টরেটরা সমাজে এই অপধারণার বিকাশ ও বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন। প্রবন্ধটির শিরোনামে আমি যে-ছাগলদের কথা বলেছি, সে-ছাগলেরা পিএইচডির ধারণা তাদের কাছ থেকেই রপ্ত করেছে, এবং ডিগ্রিটি অর্জনে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ছে সর্বশক্তি নিয়ে।

কে পিএইচডি পাবে ও কে পিএইচডি দেবে, এ নিয়ে পৃথিবীতে খুব বেশি আলোচনা হয়নি। মক্তবের শিক্ষককে ডক্টর ডাকা যাবে কি না, এ প্রশ্নের সুরাহা হওয়া দরকার। আমি কি এ বইটি লেখার জন্য নিজেকে নিজে ডক্টরেট ডিগ্রি দিতে পারি? রবীন্দ্রনাথের কি উচিত হবে ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়ার জন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকিয়ে থাকা? বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর কেউ ডক্টরেট ডিগ্রি দিতে পারবে না, এমন একচ্ছত্র নিয়ম কি বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর জন্য সুবিধাজনক? এ প্রসঙ্গে ভিটগেনস্টাইনকে মনে পড়ছে। ভিটগেনস্টাইনের সুপারভিশনে ক্যাম্বব্রিজে একটি ছাত্র পিএইচডি করছিলো। তার থিসিসের বিষয়বস্ত ছিলো- লিগ অব নেশনস বা প্রাক্তন জাতিসংঘের ব্যর্থতা

ছাত্রটি একদিন ভিটগেনস্টাইনকে জানালো- এ বিষয়ে আমার মৌলিকভাবে তেমন কিছু বলার নেই। যা লিখবো, তা ইতোমধ্যে অনেকেই লিখে গেছেন। পিএইচডির খাতিরে হয়তো একটি মোটা থিসিস লেখা হবে, কিন্তু এটি কোনো জ্ঞান উৎপাদন করবে না। শুধু লেখার জন্যই লেখা হবে।

ভিটগেনস্টাইন বললেন, থিসিস লেখার দরকার নেই, তোমার যে এ উপলব্ধিটুকু হয়েছে, শুধু এটার জন্যই একটি পিএইচডি পাওয়া দরকার। তোমাকে আমি পিএইচডি ডিগ্রি দেবো।

পৃথিবীর অধিকাংশ পিএইচডিই এখন কেবল ডিগ্রি নেওয়ার উদ্দেশ্যে করা। জ্ঞানের কোনো শাখায় এসব ডিগ্রি তেমন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে না। এগুলোর প্রায় সবই অন্যের কাজের পুনরুৎপাদন ও অনাবশ্যক এক্সটেনশন। এরকম পিএইচডি বছরে এক লাখ উৎপাদিত হলেও সভ্যতার কোনো উপকার হয় না।

এখানে আমি আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। ভিটগেনস্টাইন বিএ পড়ার সময় যে-থিসিসটি লিখেছিলেন, তা বই আকারে বেরিয়েছিলো। বইটিকে ক্যাম্বব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় পরবর্তীতে তাঁর পিএইচডি থিসিস হিশেবে বিবেচনা করেছিলো, এবং বার্ট্রান্ড রাসেলের সুপারিশে তাঁকে ডক্টরেট ডিগ্রি দেয়া হয়েছিলো। অর্থাৎ বিষয়বস্তু গুরুত্বপূর্ণ হলে, একটি ছোট বই-ও পিএইচডি অর্জনের উপলক্ষ হতে পারে।

তবে বাংলাদেশে পিএইচডি-প্রত্যাশীরা যে সাজিয়ে-গুছিয়ে থিসিস লিখেন ও প্রিন্ট করেন, তা দেখলে পল ডিরাক নিজের থিসিসটিকে খালে ফেলে দিতেন। বহু পিএইচডি গবেষক এখন থিসিসের বাঁধাই ও মলাট দিয়ে এর বিষয়বস্ত ঢেকে রাখতে চান। কারণ তারা জানেন, এটির ভেতরে কিছু নেই। এটি কিছু শূন্যের সমাহার। এর পাতায় পাতায় ফুটনোট। এর পাদটীকা, অর্থাৎ পায়ে টীকা আছে, কিন্তু কপালে কোনো টীকা নেই। এটি কোনো জ্ঞান উৎপাদন করেনি। পড়লে এ থেকে কোনো আলোর বিচ্ছুরণ ঘটবে না। এটি সবজি ক্ষেতে গজানো বিরক্তিকর ঘাস; যা মাঝে মাঝে ছাগল এসে খেয়ে যায়।

তাই এটিকে ঢেকে রাখতে হবে সুন্দর মলাট দিয়ে, বাঁধাই করতে হবে উৎকৃষ্ট কারিগর দ্বারা। মানের যখন অবনমন ঘটে, সৌন্দর্য তখন মুখ্য হয়ে ওঠে। মানহীনতা ঢাকতে পিএইচডি শ্রমিকরা আশ্রয় নিচ্ছেন ভালো মানের কাগজ, ভালো মানের প্রিন্ট, ও ভালো মানের মলাটের। এ পরিশ্রমটুকুর জন্যই তাদেরকে পিএইচডি দেওয়া হচ্ছে।

এগুলো যে মুদ্রিত আবর্জনা, কেরোসিনের সলতে, তা ওই পিএইচডি- প্রত্যাশী ও তার সুপারভাইজর জানেন। তারপরও এটিকে তারা প্রকাশ করেন। এটিই তাদের জীবিকা। সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা ময়লা সাফ করে জীবিকা নির্বাহ করেন, আর এই পিএইচডি-শিল্পীরা ময়লা উৎপাদন করে রুটির সংস্থান করেন। সম্প্রতি আফ্রিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, বয়স ও ক্ষমতায় তার চেয়েও বড়ো এক বুড়ো ছাত্রকে পিএইচডি দান করে রুটি হাতিয়ে নিয়েছেন। ছাত্রটিও খুশি। কারণ, তার কোনো কিছুর অভাব ছিলো না; শুধু নামের আগে একটি ড-এ ডট লাগাতে পারছিলো না। তার এ অভাব ঘুচে গেছে।

চুরির অপবাদ একসময় দখলে ছিলো গ্রামের সিঁধেল চোরদের; কিন্তু চোরদের অতীত গৌরব এখন ডক্টরেটদের দখলে। সম্প্রতি একটি বিশ্ববিদ্যালয় এমন দুই চোরকে গৌরবজনক শাস্তি প্রদান করেছে। তারা চুরি করেছিলো এক বিখ্যাত মনীষীর লেখা। অভিনয় করতে করতে তাদের এমন উন্নতি হয়েছে যে, তারা এখন ফুকো, রাসেল, রুশো, বার্কলে, বার্গসন, হেগেল, কান্ট, হিউম, হবস, ও সার্ত্রের চরিত্রে অভিনয় করছে। এ প্রতিভা নিঃসন্দেহে ঈর্ষণীয়।

কিন্তু শাস্তি যাদের প্রাপ্য ছিলো, তারা না পেয়ে পেলো আহাম্মকেরা। আহাম্মক দিয়ে যে গবেষণা হয় না, তা বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বুঝতে নারাজ, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও পরিচালিত হচ্ছে অভিজ্ঞ আহাম্মক দ্বারা। একপাল আহাম্মক দেখাশোনা করছে আরেক পাল আহাম্মকের, এ এক ট্র্যাজেডি।

বুলবুল কবির নামের একজনকে মনে পড়ছে, তিনি ভোলাগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ বিভাগের শিক্ষক। ২০১৫ সালে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি পান, কারণ খুব শ্রমসাধ্য একটি পিএইচডি থিসিস তিনি লিখেছিলেন (কোনো কাজের ৯৮ শতাংশ নকল করা সত্যিই শ্রমসাধ্য ব্যাপার)।

মুশকিল হলো, থিসিসটি একদিন সুইডেনের গোটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোনাস নিলসনের নজরে আসে। নিলসন দেখতে পান, বুলবুল কবির নামক খাঁটি বাঙালি শিল্পীটি তার একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রায় হুবহু মেরে দিয়েছেন, এবং ভাগিয়ে নিয়েছেন পিএইচডি! ক্ষুব্ধ নিলসন ভোলাগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জনাব সোবহানাল্লাহকে চিঠি লিখে এর বিচার চান। বিচারক হিশেবে উপাচার্য সোবহানাল্লাহ্র সুখ্যাতি কে না জানে?

বুলবুল কবিরকে চাঁদের আলো নামের একটি পত্রিকা জিগ্যেস করেছিলো, কেন আপনি এমনটি করলেন? বুলবুল কবির জবাব দিয়েছিলেন, কোনো গণ্ডগোল হয়ে থাকলে তার দায়ভার আমার সুপারভাইজর ও ভোলাগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের; এ ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই। পরে একদিন চাঁদের আলো ভোলাগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে যায়, এবং বুলবুল কবিরের থিসিসটিকে খুঁজে বের করে। তারা দেখতে পায়, কে বা কারা যেন বুলবুলের শিল্পকর্মটিতে বেশ ঘষামাজা ও সংযোজন-বিয়োজন করেছে! গ্রন্থাগারিক মো. জয়নব আলির বক্তব্য ছিলো এরকম: “অতি সম্প্রতি ফাইজুল মোহাম্মদ বুলবুল কবীরের পিএইচডি অভিসন্দর্ভে কিছু ঘষামাজা নজরে এসেছে। চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ ওঠায় কেউ অবৈধ প্রক্রিয়ায় এ কাজটি করেছেন। ঘটনার তদন্ত প্রয়োজন।”

বুলবুল কবিরের সুপারভাইজর ছিলেন অধ্যাপক বদিউস সামাদ আবু। আবু সাহেব কি তার দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করেছিলেন? তিনি কি সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী প্রক্টর বুলবুল কবিরকে জানিয়েছিলেন, কাকে বলে গবেষণা? সম্ভবত না। গবেষণা তাদের মুখ্য বিষয় ছিলো বলে মনে হয় না। তাদের লক্ষ্য ছিলো- কীভাবে কয়েক হাজার শব্দ এক করে কিছু বাক্য লেখা যায়, আর তা ছাপিয়ে ভাগিয়ে নেয়া যায় পিএইচডি। বুলবুল কবির এ কাজে দারুণ সফলতা দেখিয়েছেন, এবং বিশ্ববিদ্যালয়টি গবেষণাকর্মে কতোটা ব্যর্থ, তাও বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। বুলবুল কবিরকে আমি অভিনন্দন জানাই।

পিএইচডির সাথে মানুষ হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। বরং কেউ কেউ অপ্রয়োজনীয়ভাবে পিএইচডি নিতে গিয়ে পরিণত হতে পারেন ছাগলে। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, ছাগল শব্দটি এ অঞ্চলে বিবর্তিত হয়ে গেছে। এটি আর ছাগলদের দখলে নেই। ছাগলের মাংস, এমনটি আর বাজারে শোনা যায় না। শোনা যায়- খাসির মাংস, বকরির মাংস। রেস্তোরাঁয় গিয়ে এখন আর কেউ বলে না, আমি ছাগলের মাংস দিয়ে ভাত খাবো। মানুষের একটি অংশ, ছাগল শব্দটিকে নিজেদের করে নিয়েছে। শব্দটি শুনলে বা দেখলে, তারাই এখন প্রতিক্রিয়া দেখায়। ভাবে, মনে হয় আমাকে বললো! যাই, জবাব দিয়ে আসি!

অপ্রয়োজনীয় পিএইচডি হলো সেগুলো, যেগুলো অর্জনের পেছনে কোনো একাডেমিক কারণ নেই। আছে সামাজিক কারণ। বাংলাদেশে অনেকেই পিএইচডিকে বিবেচনা করছেন সামাজিক মর্যাদা লাভের হাতিয়ার রূপে। কেউ হয়তো এমন একটি চাকরি করছেন, যেখানে পিএইচডির কোনো প্রয়োজনই নেই। কিন্তু তিনি উতলা হয়েছেন পিএইচডি নেওয়ার জন্যে। তার শখ হয়েছে, নামের আগে ‘ডক্টর’ লাগানোর। বাঙালির এমন মনোভাব তার চারিত্রিক হীনম্মন্যতার দিকেই ইঙ্গিত করে। সামাজিক মর্যাদার সাথে যে ‘ডক্টর’ শব্দটির কোনো সম্পর্ক নেই, এটি বুঝতে তারা নারাজ। উপরে ‘ডক্টর’ শব্দটির অর্থ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমি দেখিয়েছি যে, ডক্টরেট ডিগ্রি কোনো সামাজিক মুকুট নয়। এটি একটি প্রয়োজনীয় একাডেমিক ডিগ্রি।

কিন্তু ছাগলদের কাছে এটি এখন সামাজিক মুকুট! তাদের দাবি, ডিগ্রিটি না থাকলে নামটি একটু লম্বা করে বলা যায় না। এটি তাদের শিং! কিছু পরিস্থিতিতে এ শিং দিয়ে নিজেদেরকে তারা রক্ষা করে থাকে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এটিকে শিং হিশেবে গ্রহণ করেছে। কোনো বিষয়ে ‘শুধু আবুল’ এবং ‘ডক্টর আবুল’, এ দুইজন একই কথা বললে, ডক্টর আবুলের কথাকেই ছাগলসমাজ বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বাঙালির কোনো অনুষ্ঠানে, মোহাম্মদ জব্বার ও ডক্টর মোহাম্মদ জব্বারের গুরুত্ব এক নয়। ডক্টর মোহাম্মদ জব্বারের দিকে মানুষ হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।

কিছু বেকুব, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের টেক্কা দেওয়ার জন্য পিএইচডি নিচ্ছে। তারা বুঝাতে চাচ্ছে, আমরা তাদের চেয়ে কম কিসে? আমাদেরও ডক্টরেট আছে!

ইদানীং ওয়াজ মাহফিলের বক্তারাও এ যুদ্ধে শামিল হয়েছেন। তারাও দলবেঁধে পিএইচডি নেয়া শুরু করেছেন। স্যারবৃন্দ টের পেয়েছেন, ‘ডক্টর’ নামের মুকুটটি মাথায় না থাকলে ফতোয়ার ওজন কমে যাচ্ছে, মানুষ যথেষ্ট সমীহ করছে না। কেউ কেউ হাসাহাসি করছে। সমাজ ধরে নিয়েছে, মাওলানা আশরাফের চেয়ে ডক্টর মাওলানা আশরাফের কথা অধিক সত্য। ডক্টর মাওলানা আশরাফ বানোয়াট হাদিস বললেও তা রাসূলের বাণী। তিনি মিথ্যা গল্প প্রচার করলেও সেটি ইতিহাস।

যার পিএইচডি আছে, তিনি একজন বিশেষজ্ঞ, এমন ধারণা ভিত্তিহীন। ফাইনম্যান বলেছিলেন, পিএইচডির পরও কেউ গর্দভ থাকতে পারে। কেউ যদি তার ভেতরের গাধাটি বাঁচিয়ে রাখতে চায়, তাহলে পিএইচডির তাতে বাধা দেওয়ার সামর্থ্য কম। সভ্যতা যাদের জ্ঞানের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তাদের অধিকাংশেরই পিএইচডি নেই।

পিএইচডির কাজ কাউকে বিশেষজ্ঞ করে তোলা নয়। কেউ কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হবেন কি না, এটি এখানে ঐচ্ছিক। পিএইচডি এখন গবেষণা করার একটি প্রশিক্ষণ কোর্স মাত্র। এটি শিক্ষার্থীদের শেখায়, কীভাবে কোনো বিষয়ে গবেষণা করে সৃষ্টি করতে হয় গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান। ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ প্রশিক্ষণ স্নাতক কোর্সেও দেওয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান সৃষ্টির কিছু সম্ভাবনা তৈরি হয়। গবেষণা ভালো হলে, থিসিসগুলোতে মাঝে মাঝে নতুন জ্ঞান উৎপন্নও হয়। জ্ঞান সৃষ্টির সাথে বিশেষজ্ঞ হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। কোনো বিষয়ে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি না করেও কেউ বিশেষজ্ঞ হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে পড়াশোনা ও অভিজ্ঞতাই মুখ্য, পিএইচডি নয়। তবে যিনি যে-বিষয়ে গবেষণা করেন, সে-বিষয়ে তার বিশেষজ্ঞ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, এটি মাথায় রাখতে হবে।

বাঙালি ধরে নিয়েছে, যার পিএচডি আছে তিনি মহাজ্ঞানী। আর যার পিএইচডি নেই, তিনি কিছুই জানেন না। ছাগলেরা এ সুযোগটিই নিয়েছে। তারা ভুয়া পিএইচডির ঘাড়ে সওয়ার হয়ে অভিনয় করছে প্রকৃত পিএইচডিধারীর চরিত্রে। সমাজের মানুষ এ মনোভাব না পাল্টালে, পিএইচডির সামাজিক ‘মুকুট’ বেঁচে থাকবে, এবং ছাগলদের মাথায় এ মুকুট বিরাজ করবে চিরকাল। পিএইচডি নেবেন শুধু তারা, যাদের পিএইচডি দরকার। যারা গবেষণা করবেন, গবেষণা খাতে ক্যারিয়ার গড়বেন, অন্যদের গবেষণা শেখাবেন, বা যাদের আত্মবিশ্বাস আছে যে পিএইচডি থিসিসে উৎপাদন করতে পারবেন নতুন কোনো জ্ঞান, কেবল তারাই যেন পিএইচডি নেন। অন্যরা এ মুকুট-প্রতিযোগিতা থেকে অব্যাহতি নেবেন।