ছয় বীর
সে প্রায় ছয়শত বৎসর আগেকার কথা-সে সময়ে ইংরজি ও ফরাসিতে প্রায়ই যুদ্ধ চলিত। দুই পক্ষেই বড়ো-বড়ো বীর ছিলেন – তাঁহাদের আশ্চর্য বীরত্বের কাহিনী ইউরোপের দেশ-বিদেশে লোকে অবাক হইয়া শুনিত।
ইংলণ্ডের রাজা তৃতীয় এড্ওয়ার্ড তখন খুব বড়ো সৈন্যদল লইয়া ফ্রন্সে যুদ্ধ করিতেছিলেন। ফ্রান্সের উত্তর দিকে সমুদ্রের উপকুলে ইংলণ্ডের খুব কাছাকাছি একটি শহর আছে, তাহার নাম ‘ক্যালে’ (Calais)। এই শহরটির উপর বহুকাল ধরিয়া ইংরাজদের চোখ ছিল-কারণ, এইটি দখল করিতে পারিলে, ফ্রান্সে যাওয়া-আসার খুবই সুবিধা হয়। এডওয়ার্ড জলস্থল দুইদিক হইতে এই শহরটিকে ঘেরাও করিয়া ফেলিলেন। ক্যালে শহরে সৈন্য-সামন্ত বেশি ছিল না, কিন্তু সেখানকার দুর্গ বড়ো ভয়ানক। তার চারিদিক উঁচু দেয়াল ঘেরা-সেই দেয়ালের বাহিরে প্রকাণ্ড খাল—এক-একটা ফটকের সামনে এক-একটি পোল-সেই পোল দুর্গের ভিতর হইতে গুটাইয়া ফেলা যায়। সে সময়ে কামান ছিল বটে-তাহার গোলাতে মানুষ মরে কিন্তু দুর্গ ভাঙে না। সুতরাং জোর করিয়া দুর্গ দখল করা বড়ো সহজ ছিল না। কিন্তু এওয়ার্ড তাহার জন্য ব্যস্ত হইলেন না—তিনি শহরের পথঘাট আটকাইয়া, প্রকাণ্ড তাম্বু গাড়িয়া দিনের পর দিন নিশ্চিন্তে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। মতলবটি এই যে, যখন দুর্গের ভিতরের খাবার সব ফুরাইয়া আসিবে আর ভিতরের লোকজন ক্রমে কাহিল হইয়া পড়িবে, তখন তাহারা আপনা হইতেই হার মানিবে। মিছামিছি লড়াই হাঙ্গামা করিবার দরকার হইবে না।
‘ক্যালে’র লোকেরা যখন দেখিল, ইংরাজেরা চারিদিক হইতে পথঘাট ঘিরিয়া ফেলিতেছে, তখন তাহারা শিশু, বৃদ্ধ, অক্ষম এবং দুর্বল লোকদিগকে এবং স্ত্রীলোকদিগকে শহরের বাহিরে পাঠাইয়া দিল।
তার পর কিছুদিন ধরিয়া ইংরাজ ও ফরাসিতে রেষারেষি চলিতে লাগিল। ফরাসিদের মতলব, বাহির হইতে দুর্গের ভিতরে খাবার পৌঁছাইবে -ইংরাজের চেষ্টা যে সেই খাবার কিছুতেই ভিতরে যাইতে দিবে না। ডাঙার পথে খাবার পৌঁছানো একরূপ অসম্ভব ছিল – কারণ, সেদিকে ইংরাজদের খুব কড়াক্কড় পাহারা। সমুদ্রের দিকেও ইংরাজদের যুদ্ধ-জাহাজ সর্বদা ঘোরাঘুরি করিত কিন্তু অন্ধকার রাত্রে তাহাদের এড়াইয়া, ফরাসি নাবিকের মাঝে মাঝে রুটি, মাংস, শাকসজি প্রভৃতি শহরের মধ্যে পৌঁছাইয়া দিত। মোরঁৎ ও মেস্ত্রিয়েল নামে দুইজন নাবিক এই কাজে আশ্চর্য সাহস ও বাহাদুরি দেখাইয়াছিল। একবার নয়, দুইবার নয়, তাহারা বহুদিন ধরিয়া এইরকমে সেই শহরে খাবার জোগাইয়াছিল। ইংরাজেরা তাহাদের ধরিবার জন্য কতবার কত চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু প্রতিবারেই তাহারা ইংরাজ জাহাজগুলিকে ফাঁকি দিয়া পলাইত।
এইরকমে ছয়মাস কাটিয়া গেল, তবু দুর্গের লোকেরা দুর্গ ছাড়িয়া দিবার নাম পর্যন্ত করে না। তখন রাজা এওয়ার্ড কিছু ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। তিনি আরো লোকজন আনাইয়া সমুদ্রের তীরে দুর্গ বানাইলেন, সেখানে খুব জবরদস্তু পাহারা বসাইলেন, সমুদ্রের ধারে পাহাড়ের বড়ো-বড়ো পাথর ছুড়িবার যন্ত্র বসাইলেন। নৌকার সাধ্য কি সেদিক দিয়া শহরে প্রবেশ করে। খাবার আসিবার পথ যখন বন্ধ হইতে চলিল, দুর্গের লোকদেরও তখন হইতে ক্ষুধার কষ্ট আরম্ভ হইল, তাহারা দুর্বল হইয়া পড়ায় তাহাদের মধ্যে নানারকম রোগ দেখা দিতে লাগিল। তবু তাহারা মাঝে মাঝে দল বাঁধিয়া, ইংরাজদের শিবির হইতে খাবার কাড়িয়া আনিতে চেষ্টা করিত, কিন্তু তাহাতে যেটুকু খাওয়া জুটিত তাহা অতি সামান্য। দুর্গের সৈন্যরা মাসের পর মাস ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করিয়াও, আশ্চর্য তেজের সঙ্গে দুর্গ রক্ষা করিতে লাগিল-তাহাদের এক ভরসা এই যে, ফরাসি রাজা ফিলিপ নিশ্চয়ই সৈন্য-সামন্ত লইয়া তাহাদের সাহায্য করিতে আসিবেন।
একদিন সত্য সত্যই দেখা গেল, শহর হইতে কিছু দূরে ফরাসি সৈন্যদল আসিয়া হাজির হইয়াছে। তাহাদের রঙ্গিন নিশান আর সাদা তাম্বুগুলি দুর্গেৰ লোকেরা যখন দেখিতে পাইল, তখন তাহাদের আনন্দ দেখে কে। তাহারা ভাবিল আমাদের এত দিনের ক্লেশ সার্থক হইল। যাহা হউক, ফিলিপ আসিয়াই ইংরাজেরা কোথায় কেমনভাবে আছে, তাহার খবর লইয়া দেখিলেন যে, এখান হইতে ইংরাজদের হটানোবড়ো সহজহইবে না। ‘কালে’ ঢুকিবার পথ মাত্র দুইটি, একটি একেবারে সমুদ্রের ধারে-সেদিকে ইংরাজের বড়ো-বড়ো যুদ্ধ-জাহাজ চব্বিশ ঘটা পাহারা দেয়। আর-একটি পথে পোলের উপর দিয়া নদী পার হইতে হয় .. সেই পোলের উপর ইংরাজের রীতিমতো দখল জন্মাইয়া বসিয়াছে। পোলের মুখে দুর্গ বসাইয়া বড়ো-বড়ো যোদ্ধারা তাহার মধ্যে তীরন্দাজ লইয়া প্রস্তুত রহিয়াছে-তাহারা প্রাণ থাকিতে কেহ পথ ছাড়িবে না। ইহা ছাড়া আর সব জলাভূমি, সেখান দিয়া সৈন্য-সামন্ত পার করা এক দুরূহ ব্যাপার।
ফিলিপ তখন ইংরাজ শিবিরে দূত পাঠাইয়া প্রতাব করিলেন, “আইস। তোমরা একবার খোলা ময়দানে আসিয়া আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর।” এওয়ার্ড উত্তর দিলেন, “আমি আজ বৎসরখানেক এইখানে অপেক্ষা করিয়া আছি, ইহাতে আমার খরচপত্র যথেষ্ট ইয়াছে এতদিনে দুর্গের লোকেরা কাবু হইয়া আসিয়াছে, এখন তোমার খাতিরে আমি এমন সুযোগ ছাডিতে প্রস্তুত নই। তোমার রাস্তা তুমি খুঁজিয়া লও।”
তিন দিন ধরিয়া দুই দলে আপসের কথাবার্তা চলিল,কিন্তু তাহাতে কোনোরূপ মীমাংসা হইল না। তখন ফিলিপ অগত্যা তাহার সৈন্যদল লইয়া আবার বিনা যুদ্ধেই ফিরিয়া গেলেন। তাঁহাকে ফিরিতে দেখিয়া দুর্গবাসীদের মন একেবারে ভাঙিয়া পড়িল। এতদিন তাহারা যে ভরসায় সকল কষ্ট ভুলিয়া ছিল, এখন সে ভরসাও আর রহিল না। তখন তাহারা একেবারে নিরাশ হইয়া সন্ধির প্রস্তাব করিল। এওয়ার্ড বলিলেন, “সন্ধি করিতে আমি প্রস্তুত আছি, কিন্তু তোমরা আমায় বড়ো ভোগাইয়াছ, আমার অনেক জাহাজ ডুবিয়াছে, টাকা ও সময় নষ্ট হইয়াছে, এবং অন্য নানারকমের ক্ষতি হইয়াছে। আমি ইহার ষোলো-আনা শোধ না লইয়া ছাড়িব না। আমার সন্ধির শর্ত এই–ক্যালের দুর্গ শহর টাকাকড়ি লোকজন সমস্ত আমার হাতে হাড়িয়া দিতে হইবে—আমার যেমন ইচ্ছা ফাঁসি, কয়েদ, জরিমানা ইত্যাদি দণ্ডবিধান করিব এবং ইহাও জানিও যে, আমি যে শাস্তি দিব তাহা বড়ো সামান্য হইবে না।”
ইংরাজ দূত যখন ক্যালের লোকেদের এই কথা জানাইল, তাহারা এমন শর্তে সন্ধি করিতে রাজী হইল না। তাহারা বলিল, “রাজা এওয়ার্ড স্বয়ং একজন বীরপুরুষ, তাঁহাকে বুঝাইয়া বলুন, তিনি এমন অন্যায় দাবি কখনো করিবেন না।” ইংরাজ দলের ধনী ও সম্ভ্রান্ত লোকেরা তখন তাহাদের পক্ষ লইয়া রাজাকে অনেক বুঝাইলেন। ক্যালের লোকেরা কিরূপ সাহসের সহিত কত কষ্ট সহ্য করিয়া, বীরের মতো দুর্গ রক্ষা করিয়াছে, সে-সকল কথা তাহারা বার বার বলিলেন। এমন শত্রুকে যে সম্মান করা উচিত এ কথা এক বাক্যে সকলে স্বীকার করিলেন। কিন্তু এওয়ার্ডের প্রতিজ্ঞা অটল। অনেক বলা-কওয়ার পর তিনি একটু নরম হইয়া এই হুকুম দিলেন—“ক্যালের লোকেরা যদি ক্ষমা চায় তবে তাহাদের ছয়জন প্রতিনিধি পাঠাইয়া দিক—তাহারা দুর্গের চাবি লইয়া, খালি পায়ে খালি মাথায় গলায় দড়ি দিয়া আমার কাছে অসুক এবং সকলের হইয়া শাস্তি গ্রহণ করুক। তাহা হইলে অরি সকলকে মাপ করিতে পারি, কিন্তু এই ছয়জনের আর রক্ষা নাই।”
ইংরাজ দূত আবার দুর্গে গিয়া এই হুকুম জানাইল। দুর্গের লোকেরা রাজার আদেশ জানিবার জন্য ব্যগ্র হইয়া অপেক্ষা করিতেছিল—এই হুকুম শুনিয়া তাহারা স্তব্ধ হইয়া গেল। তখন ক্যালের সম্ভ্রান্ত ধনী বৃদ্ধ সেণ্ট পিয়ের বলিয়া উঠিলেন, “বন্ধুগণ, আমার জীবন দিয়া যদি তোমাদের বাঁচাইতে পারি, তবে ইহার চাইতে সুখের মৃত্যু আমি চাহি না। আমি ছয়জনের মধ্যে প্রথম প্রতিনিধিরূপে দাড়াইলাম।” এই কথায় চারিদিকে ক্রন্দনের রোল উঠিল—অনেকে সেণ্ট পিয়েরের পায়ে পড়িয়া কাঁদিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে আরো পাঁচজন লোক অগ্রসর হইয়া, তাঁহার পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইল এবং বলিল, “আমরাও মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত গ্রহণ করিতে প্রস্তুত আছি।” এই দৃশ্য দেখিয়া ইংরাজ দূতের চক্ষে জল আসিল-তিনি বলিলেন, “রাজা এওয়ার্ড যাহাতে ইহাদের প্রতি সদয় হন, আমি সেজন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিব।”
ছয়জন প্রতিনিধিকে রাজার সভায় উপস্থিত করা হইল। তাহারা শান্তভাবে রাজার সম্মুখে হাঁট গাড়িয়া বসিলেন। তার পর সেণ্ট পিয়ের ধীরে ধীরে বলিতে লাগিলেন, “আমাদের ‘ক্যালে’বাসী বন্ধুগণ এতদিন অসহ্য দুঃখ কষ্ট সহ্য করিয়া দুর্গ রক্ষা করিয়াছেন। তাহাদের অযোগ্য প্রতিনিধি আমরা, আজ তাঁহাদের জীবনরক্ষার জন্য দুর্গের চাবি আপনার কাছে দিতেছি। এখন আমরা সম্পূর্ণভাবে আপনার ইচ্ছা ও আদেশের অধীন রহিলাম।”
সভাসুদ্ধ লোকে স্তম্ভিত হইয়া তাঁহাদের দিকে চাহিয়া রহিল। ছয়জনের সকলেই বয়সে বৃদ্ধ। বহুদিন অনাহারে তাঁহাদের শরীর শুকাইয়া গিয়াছে, তাহাদের গম্ভীর প্রশান্ত মুখে কষ্টের রেখা পড়িয়াছে, এক-একজন এত দুর্বল যে, চলিতে পা কাঁপে, অথচ তাঁহাদের মন এখনো তেজে পরিপূর্ণ। তাহাদের দেখিয়া ইংরাজ যোদ্ধাগণের মনে শ্রদ্ধার উদয় হইল। সকলেই বলিতে লাগিল, “ইহাদের উপর শাস্তি দিয়া প্রতিশোধ লওয়া কখনই উচিত নয়।” যিনি দূত হইয়া গিয়াছিলেন তিনি বলিলেন, “ইহাদের শাস্তি দিলে রাজা এড়ওয়ার্ডের কলঙ্ক হইবে—ইংরাজ জাতির কলঙ্ক হইবে।” কিন্তু এওয়ার্ডের মন গলিল না—তিনি জল্লাদ ডাকিতে হুকুম দিলেন। তখন ইংলণ্ডের রানী ফিলিপা বন্দীদের মধ্যে কাঁদিয়া পড়িলেন এবং দুই হাত তুলিয়া ভগবান যীশুর দোহাই দিয়া এড়ওয়ার্ডকে বলিলেন, “ইহাদের তুমি ছাড়িয়া দাও।” তখন এওয়ার্ড অর ‘না’ বলিতে পারিলেন না।
ছয় বীরকে মুক্তি দিয়া রানী তাহাদিগকে তাঁহার নিজের বাড়িতে লইয়া, পরিতোষপূর্বক ভোজন করাইলেন এবং নানা উপহার দিয়া বিদায় দিলেন। ইহাদের বীরত্বের কথা ফরাসিরা আজও ভোলেন নাই—ইংরাজও তাহা স্মরণ করিয়া রাখিয়াছেন।
সন্দেশ-অগ্রহায়ণ, ১৩২৬