ছয় । মখমল-ঢাকা কাষ্ঠখণ্ড
রাজমুকুটের জন্যে নেপোলিয়ন অপেক্ষা করতে পারেন। তাঁর বয়স মোটে তেত্রিশ বৎসর! তিনি বেশ বুঝেছেন, মুকুট আছে তাঁর হাতের কাছেই।
কিন্তু তাঁর মনের কথা কী, জানে না তা কেউই।
একজন বললেন, ‘রাজপক্ষের লোকেরা কী বলছে জানেন? ‘নেপোলিয়নের উত্তরাধিকারী হবে কে?’ কাল যদি আপনি মারা যান, আমাদের কী দশা হবে? আপনি উত্তরাধিকারী নির্বাচন করুন।’
‘সেটা খুব বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।’
‘আপনার পদে কে বসবে জানতে পারলে ফ্রান্স হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে।’
‘আমার সন্তান নেই।’
‘তাহলে দত্তক পুত্র গ্রহণ করুন।’
‘আমার স্বাভাবিক উত্তরাকিারী হচ্ছে ফ্রান্সের জনসাধারণ।’
নেপোলিয়ন বাইরে আত্মপ্রকাশ করলেন না বটে, কিন্তু মনে মনে তখনই তিনি পুত্র বা উত্তরাধিকারীর জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন।
আরও এক বছর কয়েক মাস কেটে গেল। অখণ্ড শান্তির মধ্যে নেপোলিয়ন ফ্রান্সকে সকল দিক দিয়ে মহান করে তোলবার চেষ্টায় নিযুক্ত হলেন। ধনে-ধান্যে ব্যবসা-বাণিজ্যে খ্যাতি-প্রতিপত্তিতে ফ্রান্স এমন উন্নত হয়ে উঠল যে, ঘরে ঘরে তাঁর নামে জয়জয়কার পড়ে গেল। রাজ্যের এমন কোনও বিভাগ নেই যেদিকে পড়ল না তাঁর চোখ। নেপোলিয়ন বুঝিয়ে দিলেন, তিনি কেবল যোদ্ধা নন, রাজোচিত সমস্ত গুণ তাঁর মধ্যে বিদ্যমান আছে।
এই সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে আবার এক ষড়যন্ত্র হল। কিন্তু ষড়যন্ত্র প্রকাশ হয়ে গেল, ধরা পড়ল অনেক লোক। বন্দিদের মধ্যে ছিলেন ফ্রান্সের দুইজন বিখ্যাত জেনারেল—পিচেগ্রু ও মোরো। বিচারে তেরো জনের হল মৃত্যুদণ্ড। একদিন দেখা গেল, পিচেগ্রু কারাগারেই গলায় দড়ি দিয়ে মারা পড়েছেন। কিন্তু হোহেনলিন্ডেন-বিজয়ী মোরোকে অপরাধী জেনেও নেপোলিয়ন ক্ষমা করে নির্বাসন-দণ্ড দিলেন।
(যাঁরা বলেন নেপোলিয়ন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী জেনারেল মোরোকে বরাবরই পথ থেকে সরাতে চেয়েছেন, তাঁরা মিথ্যুক ও নিন্দুক। কারণ মোরোর এই গুরুতর অপরাধ প্রমাণিত হয়েছিল। তাঁর নিশ্চয়ই প্রাণদণ্ড হত। হল না খালি নেপোলিয়নের উদারতার জন্যে।
কিন্তু মোরো এ উদারতার সম্মান রাখেননি। কারণ পরে তিনি প্রকাশ্যভাবেই নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে করেছিলেন অস্ত্রধারণ।)
আর একজনও ধরা পড়লেন—তিনি হচ্ছেন ফ্রান্সের বিগত রাজবংশজাত ডিউক অফ ইংহিয়েন। তিনি জার্মান রাজ্যের বাসিন্দা, রাষ্ট্রীয় আইন অনুসারে নেপোলিয়নের নাগালের বাইরে। তবু তাঁকে ধরে আনা হল। কাজটা বেআইনি হলেও বিচারে ডিউকেরও অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেল। তাঁরও হল প্রাণদণ্ড।
হয়তো ডিউক বেঁচে যেতেন, কিন্তু নেপোলিয়নের পররাষ্ট্রসচিব কূটরাজনীতিবিদ টালিরান্ড ডিউকের বিরুদ্ধে নেপোলিয়নকে উত্তেজিত করলেন। এই টালিরান্ড ছিলেন মুখে নেপোলিয়নের বন্ধু, মনে-মনে বিষম শত্রু। ডিউকের বেআইনি গ্রেপ্তার ও রাজরক্তপাতের জন্যে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে ইউরোপে যে তুমুল আন্দোলন উঠবে, এটা তাঁর অজানা ছিল না।
ডিউকের প্রাণদণ্ড হয়ে গেলে টালিরান্ড নিজেই মতপ্রকাশ করেছিলেন, ‘এ হল অপরাধের চেয়ে খারাপ,—এ হল বিষম ভ্রম।’
ডিউকের মৃত্যর জন্যে ইউরোপ কি মতামত প্রকাশ করছে তা জানবার আগেই নেপোলিয়ন গিয়ে পড়লেন তাঁর জীবনের চরম উন্নতির স্রোতের মধ্যে!
ব্যবস্থাপক সভার কয়েকজন প্রবীণ সভ্য এলেন এই প্রস্তাব নিয়ে : ফ্রান্সে আবার রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করা হোক।
নেপোলিয়ন মুখে বলতেন, ‘সিংহাসন কি? একখানা কাঠ, মখমলে ঢাকা।’ কিন্তু কাজে এই একখানা কাঠের লোভ সামলাবার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। ওই একখণ্ড মাত্র কাষ্ঠ পৃথিবীকে চিরদিন অভিভূত করে এসেছে—বিপ্লবের ও জনসাধারণের মানসপুত্র নেপোলিয়নও অভিভূত হলেন।
কিন্তু কোন উপাধি গ্রহণ করা যায়? ফ্রান্সের সিংহাসনে তাঁর আগে যাঁরা বসেছেন তাঁরা সবাই ছিলেন ‘রাজা’। ও নামের কোনও মর্যাদাই আর নেই। নেপোলিয়ন উপাধি বেছে নিলেন ‘সম্রাট’! কর্সিকার বিদেশি গৃহস্থের ও উকিলের গরিব ছেলে হলেন ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের সম্রাট প্রথম নেপোলিয়ন (১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে)। উচ্চাকাঙ্ক্ষার কী সফলতা! মানুষের কল্পনাও স্তম্ভিত হয়ে যায়!
কিন্তু এর মধ্যে প্রহসনেরও অভাব ছিল না। প্রথম চার বৎসর মুদ্রার উপরে নেপোলিয়ন পরিচিত হতেন ‘প্রজাতন্ত্রের সম্রাট’ বলে। ‘রাজা’ উপাধি লুপ্ত ও প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে হাজার হাজার ফরাসি আত্মদান করেছে। বিপ্লবের বা বিদ্রোহের ধর্ম ফরাসিরা এখনও ভোলেনি। অতএব ‘শনৈঃ পর্বতলঙ্ঘনম্’! প্রথম ধাপ ‘প্রথম কনসাল’। দ্বিতীয় ধাপ ‘আজীবনের জন্যে কনসাল’। তৃতীয় ধাপ ‘সম্রাট’। চতুর্থ ধাপ ‘প্রজাতন্ত্রের সম্রাট’। পঞ্চম ধাপে প্রজাতন্ত্রের নামও লুপ্ত হল। নেপোলিয়ন ফরাসিদের চিনেছেন। তাদের মন তৈরি করবার কৌশল তিনি জানেন!
সম্রাট নেপোলিয়নের পতাকার তলায় এসে দাঁড়াতে লাগল দলে দলে লোক। মাত্র বারো বৎসর আগে যারা ফ্রান্সের রাজার মৃত্যদণ্ডের জন্যে ‘ভোট’ দিয়েছিল, তাদেরও একশো তিরিশজন সম্রাটের অধীনে চাকরি নিতে আপত্তি করলে না! মাত্র বারো বৎসর পরে! মানুষ কী জীব!
সম্রাটের রাজসভা দরকার। এখানকার আইনকানুন বা আদবকায়দা নেপোলিয়নের জানা ছিল না। তার জন্যে ডেকে আনা হল পুরোনো রাজসভার বিশেষজ্ঞগণকে! রাজসভায় উপাধিধারীদের দরকার! নেপোলিয়নের সঙ্গে সঙ্গে যাঁরা ‘বড়’ হয়েছেন, তাঁদের উপরে উপাধি বৃষ্টি হতে লাগল। বার্দিয়ার, মুরাট, লেনস, নে ও দাভউষ্ট প্রভৃতি জেনারেলরা আর সাধারণ লোক রইলেন না—যদিও প্রথম জীবনে অনেকেই আস্তাবল, হোটেল বা জাহাজ কেবিনের চাকর ছিলেন।
নেপোলিয়নের নখদর্পণে নরচরিত্র! তিনি বললেন, ‘ওদের আমি উপাধি দিচ্ছি কেন জানো? নিজেদের উপাধির মান রাখবার জন্যে ওরা আমার ‘সম্রাট’ উপাধিকে অমান্য করতে পারবে না!’
মা লেটিজিয়া, মা লেটিজিয়া! তিনি আজ সম্রাটজননী! মাতৃত্বের এর চেয়ে গর্ব ও সৌভাগ্য আর কী হতে পারে? নেপোলিয়ন সাদরে তাঁকে প্যারিসে আহ্বান করলেন। কিন্তু তিনি আসতে নারাজ! ছেলের মাথায় রাজমুকুট দেখে তিনি সুখী হননি, ভীত হয়েছেন। অনেক কষ্টে তাঁকে রাজধানীতে আনা হল।
সেকালকার ইউরোপিয়ান সম্রাটরা অভিষেকের জন্যে যেতেন রোমে, পোপের কাছে। কিন্তু নেপোলিয়নের অভিষেকের জন্যে রোম থেকে এলেন স্বয়ং পোপ। রাজধানী হাসছে—ফুলের মালায় আর আলোর মালায়। চারিদিকে গান-বাজনা, উৎসব-আনন্দের সাড়া।
পোপ নেপোলিয়নের মাথায় রাজমুকুট পরিয়ে দিতে উদ্যত হলেন।
নিয়ম হচ্ছে, পুরোহিত যখন মুকুট পরাবেন, রাজা ও রানিকে তখন নতজানু হয়ে থাকতে হবে।
জীবনে কখনও যিনি কারুর কাছে নতজানু হননি, এখন তিনি কী করেন দেখবার জন্যে সকলেই উদগ্রীব হয়ে রইল।
নেপোলিয়ন নতজানুও হলেন না, পোপকে মুকুট পরাতেও দিলেন না।
সকলে সবিস্ময়ে দেখলে, নেপোলিয়ন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পোপের হাত থেকে টেনে নিয়ে মুকুট পরলেন স্বহস্তেই! তারপর তিনিই মুকুট পরালেন নতজানু জোসেফাইনকে! কেন? হয়তো এই ভেবেই যে, এ মুকুট তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেননি, অর্জন করেছেন স্বহস্তেই (১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে)!
পোপ এ অপমান ভুললেন না।
রাজদণ্ড হস্তে নেপোলিয়ন সিংহাসনে গিয়ে বসলেন। তাঁর তখনকার মনের ভাব একটি কথায় প্রকাশ পায়। সিংহাসনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর বড় ভাই জোসেফ। নেপোলিয়ন জনান্তিকে বললেন, ‘দাদা, বাবা যদি এ দৃশ্য দেখতে পেতেন!’
নেপোলিয়নের বয়স চৌত্রিশ বৎসর কয়েক মাস।
রুশিয়া এতদিন নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়নি। তার প্রধান কারণ, পূর্ববর্তী জার পল ছিলেন নেপোলিয়নের প্রতিভার ভক্ত। পল এখন নিহত। সিংহাসনে বসেছেন তাঁর ছেলে। কিন্তু ডিউক অফ ইংহিয়েনের প্রাণদণ্ডের জন্যে নতুন জার আলেকজান্ডার হলেন ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ। সুইডেনের রাজাও গেলেন তাঁর দলে।
ইউরোপে আর কোনও মিত্রশক্তির সাহায্য-প্রাপ্তির আশা ছিল না বলে ইংল্যান্ড এতদিন ইচ্ছার বিরুদ্ধেও চুপচাপ ছিলেন। এইবারে রুশিয়াকে দলে পেয়ে ইংরেজরাও বেঁকে দাঁড়ালেন এবং রুশিয়ার সঙ্গে একটি চুক্তি করে ফেললেন।
অস্ট্রিয়া নিজের শোচনীয় পরাজয়ের অপমান ভুলতে পারেনি। ভিতরে ভিতরে সে প্রাণপণে সৈন্য সংগ্রহ করে যুদ্ধের আয়োজন করছিল। এখন সেও দলে যোগ দিলে। সুইডেনও।
নেপোলিয়নের অভিষেকের এক বৎসর পরেই ইউরোপের দিকে দিকে বেজে উঠল রণদেবতার ভেরি! চার বৎসর ধরে নেপোলিয়ন শান্তিরক্ষার জন্যে যতদূর সম্ভব চেষ্টা করেছেন, কিন্তু আর সে চেষ্টার ফল ফলল না।
মারেঙ্গোর পাঁচ বৎসের পরে নেপোলিয়নকে আবার তরবারি ধরতে হল। এটা হল তাঁর যোদ্ধাজীবনের দ্বিতীয় স্তর এবং এই স্তরেই যোদ্ধা নেপোলিয়নের গৌরবোজ্জ্বল স্বরূপ যথার্থভাবে প্রকাশ পায়।
অস্ট্রিয়া ভেবেছিল, নেপোলিয়নের রণকৌশল সে আয়ত্ত করে ফেলেছে, তাঁকে হারানো আর কঠিন হবে না। কিন্তু অস্ট্রিয়া বোঝেনি, প্রতিভা চলে নতুন নতুন পথ ধরে। তার সঙ্গে যুদ্ধে নিযুক্ত হওয়ার দুই মাস আগে, ঘটনাস্থল থেকে ছয়-সাতশো মাইল দূরে স্বদেশে বসে নেপোলিয়ন এবারকার যুদ্ধে যা-যা করতে হবে, সমস্তই ঠিক করে ফেলেছিলেন।
তাঁর বিরুদ্ধে ইউরোপের তিন শ্রেষ্ঠ শক্তি একসঙ্গে দাঁড়িয়েছে দেখে তিনি একটুও ভীত হলেন না। প্রথমে তিনি ইংল্যান্ড আক্রমণের জন্যে সমুদ্রতটে সৈন্য সাজাচ্ছিলেন; কিন্তু অস্ট্রিয়ানরা অগ্রসর হচ্ছে শুনে তাকেই আগে জব্দ করতে ছুটে চললেন।
এবারকার অস্ট্রিয়ান সেনাপতির নাম ম্যাক। নেপোলিয়ন তাঁর সেনাদলকে সাত ভাগে বিভক্ত করলেন। কয়েক দলকে পাঠিয়ে দিলেন দানিয়ুব নদী পার হয়ে অস্ট্রিয়ানদের পিছনে গিয়ে পড়বার জন্যে। আরও দুদিক থেকে সেনাপতি দুপনত ও নে-র অধীনস্থ দুই দল সৈন্য অস্ট্রিয়ানদের বাধা দিতে লাগল। কিছু বোঝবার আগেই ম্যাক সবিস্ময়ে দেখলেন, তাঁর পিছনে শত্রু, ডাইনে শত্রু, বাঁয়ে শত্রু! নিরুপায় হয়ে তিনি উলম নগরের দিকে এসে সৈন্য সমাবেশ করলেন।
নেপোলিয়নের দূত গিয়ে বললেন, ‘সেনাপতি, আত্মসমর্পণ করুন।’
ম্যাক সগর্বে বললেন, ‘আটদিনের জন্যে যুদ্ধ স্থগিত থাকুক। নইলে মৃত্যুই শ্রেয়।’
দূত বললেন, ‘যুদ্ধ বন্ধ হবে না।’
ম্যাক বললেন, ‘তবে আত্মসমর্পণই করছি।’ হাস্যকর ব্যাপার! তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী যে নেপোলিয়ন, দূত আসবার আগে পর্যন্ত ম্যাক সে-কথাও জানতেন না! উলমের যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ট্রিয়ানরা একটা বন্দুক ছোঁড়বারও সুযোগ পায়নি! এমন আশ্চর্য যুদ্ধজয়ের কাহিনি ইতিহাসে আর দ্বিতীয় নেই (১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে)।
নেপোলিয়ন বললেন, ‘সৈন্যগণ, পনেরো দিনের মধ্যে আমরা অস্ট্রিয়ানদের ব্যাভেরিয়া থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি; এক লক্ষ শত্রুর ভিতরে বন্দি হয়েছে ষাট হাজার নব্বই জন। আমাদের জয়চিহ্ন হচ্ছে দুই শত কামান আর আশিটা পতাকা। কিন্তু এখনও আমাদের সামনে রয়েছে আর একটা যুদ্ধ। ইংরেজরা পৃথিবীর শেষপ্রান্ত থেকে ডেকে এনেছে রুশিয়ানদের। এবারে আমাদের লড়তে হবে তাদের সঙ্গেই। এই যুদ্ধই বলে দেবে, ফরাসি সৈন্যেরা ইউরোপে অধিকার করবে প্রথম কি দ্বিতীয় স্থান!’
ওদিকে ঠিক পরের দিনেই নেলসন ট্রাফালগারের জলযুদ্ধে ফ্রান্স ও স্পেনের সম্মিলিত নৌবাহিনীকে হারিয়ে দিয়ে নিজে মারা পড়লেন।
নেপোলিয়ন এবার আর কোথাও থামলেন না। শত্রু তাড়াতে তাড়াতে প্রথমে তিনি অস্ট্রিয়ার সীমান্ত পার হলেন। তারপর একেবারে প্রবেশ করলেন তার রাজধানী ভিয়েনা নগরে।
কিন্তু অস্ট্রিয়ার সম্রাট একটুও দমলেন না, সসৈন্যে পিছিয়ে গিয়ে রুশিয়ার সম্রাটের সঙ্গে মিলিত হলেন। তাঁদের দলে রুশ ও অস্ট্রিয়ান সৈন্য ছিল আশি হাজার।
নেপোলিয়নের সৈন্যসংখ্যা মাত্র ষাট হাজার। কিন্তু পুরো ষাট হাজার সৈন্যও তিনি কাজে লাগাতে পারলেন না। অধিকৃত অস্ট্রিয়ার রাজধানীতে ও নানা স্থানে অনেক সৈন্য রক্ষীরূপে রেখে তাঁকে এগিয়ে আসতে হল। ইউরোপের সকলেরই দৃঢ় ধারণা হল, আর নেপোলিয়নের রক্ষা নেই, নেপোলিয়নও বুঝলেন, এবারের যুদ্ধে হারলে তাঁর মুকুট তো ধুলোয় লুটোবেই, উপরন্তু তাঁর সমস্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা পরিণত হবে নিষ্ফল স্বপ্নে। কারণ, গত মাসের একুশ তারিখে ট্রাফালগারের জলযুদ্ধে ইংরেজরা তাঁর সমস্ত নৌবাহিনী ধ্বংস করে দিয়েছে। যদিও সে পরাজয়ের জন্যে তিনি দায়ী নন, কিন্তু জলপথ তাঁর হাতছাড়া হয়েছে। এর উপরে স্থলে হারলে কেউ তাঁকে বাঁচাতে পারবে না। কাজেই তিনি যুদ্ধের ফন্দি স্থির করতে লাগলেন খুব সাবধানে।
অতঃপর আমরা যে-যুদ্ধের কথা বলব, নেপোলিয়নের জীবনে সেইটিই হচ্ছে সবচেয়ে গৌরবজনক যুদ্ধ! সুতরাং তার আলোচনা করব বিস্তৃতভাবেই।
ব্রান নামক স্থানে নেপোলিয়ন নিজের সৈন্য সমাবেশ করেছিলেন। রুশ ও অস্ট্রিয়ান সৈন্যরা সেইখানে তাঁকে আক্রমণ করতে এল।
কিন্তু নেপোলিয়েনর পরিকল্পনা তখন সম্পূর্ণ। তিনি সসৈন্যে পিছিয়ে আসতে লাগলেন, এবং ফরাসিদের দক্ষিণ পার্শ্বটাকে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে দিলেন এই মতলবে, শত্রুরা তাঁকে ঘিরে ফেলবার জন্যে উৎসাহিত হয়ে উঠুক! শত্রুদের সংখ্যাধিক্যের জন্যে যদিও তাঁর এই পদ্ধতিটা অত্যন্ত বিপদজ্জনক, তবু তিনি ভয় পেলেন না।
শত্রুরা নেপোলিয়নের কৌশল বুঝলে না, ভাবলে চমৎকার সুযোগ উপস্থিত! তারা মহোৎসাহে অগ্রসর হল। যেন ভয় পেয়েছে এমনি ভাব দেখিয়ে ফরাসিরা আরও পিছিয়ে পড়তে লাগল। এমনকী দু-একটা ছোটখাটো সংঘর্ষে তারা পলায়নেরও অভিনয় করলে! নেপোলিয়ন নিজেও রুশ-সম্রাট আলেকজান্ডারের কাছে চব্বিশ ঘণ্টার যুদ্ধ-নিবৃত্তির জন্যে আবেদন করলেন। তিনি জানতেন, সে আবেদন গ্রাহ্য হবে না এবং রুশ-সম্রাট ভাববেন যে, তিনি সমস্ত দলবল নিয়ে নিরাপদে পালাবার জন্যেই যুদ্ধ থামাবার অনুরোধ করছেন। ফলে শত্রুরা অধিকতর উৎসাহিত হয়ে আরও তাড়াতাড়ি তাঁকে আক্রমণ করতে আসবে!
নেপোলিয়নের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল। শত্রুরা বোকার মতন ফাঁদে পা দিলে। পয়লা ডিসেম্বর তারিখে ফরাসিদের পশ্চাৎপদ দক্ষিণ পার্শ্বের সৈন্যদের বেষ্টন করবার জন্যে অধিকাংশ শত্রুসৈন্য তাদের ব্যূহের বামদিকে গিয়ে সমবেত হল। নেপোলিয়নের ফন্দি ছিল এই, শত্রুব্যূহের মধ্যভাগ রীতিমতো দুর্বল হয়ে পড়ল।
যুদ্ধের ফল যে কী হবে, সে-সম্বন্ধে নেপোলিয়নের আর কোনওই সন্দেহ রইল না। তিনি সানন্দে দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘কালকের সূর্যাস্তের আগেই শত্রুরা আসবে আমাদের হাতের মুঠোর ভিতরে!’
এ-বিষয়ে তিনি এতটা নিশ্চিত হলেন যে, তখনই একখানা প্রচারপত্র ছাপিয়ে নিজের সৈন্যদের জানিয়ে দিলেন, ‘শত্রুরা আমাদের ডান পাশ পেরিয়ে পিছন থেকে আক্রমণ করতে এসে নিজেদের পার্শ্বদেশ অরক্ষিত করে ফেলছে!’
ফরাসিরা তখন অস্টারলিটজ ক্ষেত্রে এসে তাঁবু ফেলেছে। রাত হল। নেপোলিয়ন খুশি মনে বিশ্রাম করতে গেলেন। পরের দিন দোসরা তাঁর সিংহাসন আরোহণের প্রথম বাৎসরিক উৎসব।
রাত্রি প্রভাত। সেদিনকার সূর্যের অসাধারণ ঔজ্জ্বল্য দেখে ফরাসি সৈন্যরা বিপুল আনন্দে তার জয়গান করে উঠল। এ সূর্য তারপর তাদের কাছে ‘অস্টারলিটজের সূর্য’ বলে বিখ্যাত হয়েছিল। অস্টারলিটজ একটি ছোট গ্রামের নাম। ইউরোপের অন্য কোনও দেশ তার নাম পর্যন্ত জানত না। কিন্তু আজ থেকে সে কেবল পৃথিবীবিখ্যাত নয়, ইতিহাসেও অমর হয়ে রইল।
যুদ্ধ আরম্ভ হল ফরাসিদের দক্ষিণ পার্শ্বেই। এদিকে ছিলেন দুজন ফরাসি নায়ক—সোল্ট ও ডাভোট। এখানকার জমিটা ছিল জলাভূমি ও তার উপরে ভাসছে এমন পাতলা বরফের আচ্ছাদন যে, পায়ের চাপেই ভেঙে যায়! কাজেই ফরাসিদের পক্ষে শত্রুদের বাধা দেওয়ার সুবিধা হল যথেষ্ট। সোল্ট ও ডাভোটের উপরে হুকুম ছিল, একটা নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত যেমন করেই হোক, শত্রুদের নিযুক্ত করে রাখবার জন্যে।
নেপোলিয়নের অভিপ্রায় হচ্ছে এই : অধিকাংশ শত্রু যখন ফরাসিদের ডান পাশে গিয়ে রীতিমতো ব্যস্ত হয়ে থাকবে, তখন তিনি নিজের বাম পাশের ও মধ্যভাগের সমস্ত সৈন্য নিয়ে প্রচণ্ড বেগে শত্রুদের দক্ষিণ পার্শ্ব ও মধ্যভাগ আক্রমণ করবেন। শত্রুব্যূহের ওই দুই অংশের সৈন্যরা দলে হালকা, সুতরাং ফরাসিদের আক্রমণ সইতে পারবে না, ফলে তাদের বাম পাশের সৈন্যরা ব্যূহ থেকে বিচ্ছিন্ন ও অসহায় হয়ে পড়বে।
শত্রুদের বাম পার্শ্বের সঙ্গে ফরাসিদের দক্ষিণ পার্শ্বের বিষম সংঘর্ষ উপস্থিত হল। শত্রুরা এখানে দলে ভারী, কিন্তু জলাভূমির সাহায্য পেয়ে ফরাসিরা দলে হালকা হয়েও শত্রুদের প্রাণপণে বাধা দিতে লাগল। উচ্চভূমির উপর থেকে দলে দলে আরও বেশি শত্রু সৈন্য ক্রমাগত এইদিকেই নেমে আসতে লাগল ফরাসিদের একেবারে চেপে মেরে ফেলবার জন্যে! আসন্ন জয়লাভের উত্তেজনায় শত্রুসেনাপতিদের এ খেয়াল একবারও হল না যে, নিজেদের বাম পার্শ্বে তাঁরা যত বেশি সৈন্য সরবরাহ করছেন, তাঁদের দক্ষিণ পার্শ্ব ও মধ্যভাগ তত দুর্বল হয়ে পড়ছে!
বেশ খানিকক্ষণ কেটে গেল। ডান পাশের ফরাসিরা সংখ্যাতীত শত্রুদের আর বুঝি বাধা দিতে পারে না! নিজের সাদা ঘোড়ার পিঠে স্থির পাথরের মূর্তির মতন বসে নেপোলিয়ন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে উভয় পক্ষের গতিবিধি নিরীক্ষণ করছেন।
অনেকে এসে বারংবার বলতে লাগল, ‘সম্রাট, হুকুম দিন! আমাদের দক্ষিণ পার্শ্বের সৈন্যরা আর আত্মরক্ষা করতে পারছে না—আমরা গিয়ে ওদের সাহায্য করি।’
নেপোলিয়ন গম্ভীর স্বরে বলেন, ‘না! এখনও সময় হয়নি।’
তারপর বন্দুক ও কামানের গর্জন, আহতদের আর্তরব ও যোদ্ধাদের সিংহনাদ যখন চরমে উঠেছে, নেপোলিয়ন তখন বুঝলেন তাঁর মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত!
এতক্ষণ শত্রুদের বামপার্শ্ব আক্রমণের পর আক্রমণ করছিল এবং ডানপাশের অল্পসংখ্যক ফরাসিরা করছিল কেবল আত্মরক্ষা। কিন্তু অধিকাংশ ফরাসি সৈন্য এখন পর্যন্ত চিত্রলিখিতের মতন স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে প্রধান সেনাপতির বা সম্রাটের আদেশের অপেক্ষা করছিল। এইবারে নেপোলিয়ন আদেশ দিলেন—’অগ্রসর হও! আক্রমণ করো!’
নেপোলিয়নের বিভিন্ন বিভাগের সেনানায়করা—লেনস, বার্নাডোটে, লেগরান্ড ও সেন্ট-হিলেয়ার প্রভৃতি হুকুম পেয়েই আপন-আপন পল্টনের পুরোভাগে গিয়ে দাঁড়ালেন। ফরাসিদের আক্রমণ আরম্ভ হল।
রুশ সৈন্যরা তখন উচ্চভূমি বা পাহাড়ের উপর থেকে নেমে তির্যক বা তেরছা ভাবে ফরাসিদের দক্ষিণ পার্শ্বের দিকে ছুটে যাচ্ছিল। আচম্বিতে ফরাসিদের বামপার্শ্ব থেকে এই প্রবল আক্রমণের জন্যে তারা প্রস্তুত ছিল না। বিস্ময়ের ধাক্কা সামলাবার আগেই তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পশ্চাৎপদ হতে লাগল। ফরাসিরা তাদের ঠেলে নিয়ে গিয়ে পাহাড়ের আশেপাশে ছড়িয়ে দিলে এবং নিজেরা উচ্চভূমি দখল করলে। শত্রুদের এ অংশে ছিল Reserve বা সংরক্ষিত সৈন্য এবং এর মধ্যে ছিলেন স্বয়ং রুশ সম্রাট।
রুশ ফৌজের সর্বশ্রেষ্ঠ অংশ—অর্থাৎ রক্ষী সৈন্যরা তখন অস্টারলিটজের ক্ষেত্র দিয়ে ফরাসিদের ডান দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। তারাও ফরাসিদের মধ্যভাগ থেকে এই অভাবিত আক্রমণে প্রথমটা হতভম্ব হয়ে গেল। ইতিমধ্যে রুশ সম্রাট ও অন্যান্য সেনাপতিরা এসে পড়ে তাদের আবার উৎসাহিত করে তুললেন। রুশ রক্ষী সৈন্যরা প্রতি আক্রমণ করলে এবং দেখতে দেখতে ফরাসিরাই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল। অনেকে পালাতেও লাগল।
যুদ্ধক্ষেত্রের এ অংশটা ছিল নেপোলিয়নের চোখের আড়ালে। কিন্তু কোলাহল শুনেই তিনি আন্দাজ করলেন, গতিক সুবিধার নয়, তাড়াতাড়ি সেনাপতি র্যাপকে ডেকে বললেন, ‘যাও, যাও! ব্যাপার কী দেখে এসো!’
কয়েক দল রক্ষীসৈন্য নিয়ে র্যাপ ছুটে গেলেন। পথিমধ্যে তাঁকে দেখে ও তাঁর উৎসাহবাণী শুনে পলাতক ফরাসিরা আবার ফিরে দাঁড়াল। ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে র্যাপ দেখলেন, বিজয়ী রুশিয়রা তরবারি চালিয়ে ছত্রভঙ্গ ফরাসিদের খণ্ডবিখণ্ড করে ফেলছে! র্যাপের নতুন সৈন্যদের দেখে শত্রুরা কামান সাজাতে আরম্ভ করলে।
কিন্তু র্যাপ তাদের কামান ছোঁড়বার সময় দিলেন না। চিৎকার করে বললেন, ‘সৈন্যগণ, তোমাদের বন্ধুদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নাও!’ ফরাসি রক্ষীরা রুশ রক্ষীদের আক্রমণ করলে।
দুই পক্ষের রক্ষীদের মধ্যে যখন বিষম যুদ্ধ চলছে, সেই অবসরে ছত্রভঙ্গ ফরাসিরা আবার শ্রেণিবদ্ধ হয়ে ফিরে দাঁড়াল। আধঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধের গতি আবার ফিরে গেল। রুশিয়া ও অস্ট্রিয়ার দুই সম্রাটের চোখের সামনে তাদের সৈন্যদের মৃতদেহের স্তূপ ক্রমেই উচ্চ হয়ে উঠতে লাগল! রুশরা পালাতে আরম্ভ করলে।
রক্তাক্ত দেহে ভগ্ন তরবারি হস্তে র্যাপ ফিরে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে নেপোলিয়নকে বললেন, ‘সম্রাট, শত্রুরা পলায়ন করছে!’
শত্রুদের বামপার্শ্ব তখন প্রধান দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফরাসিদের ঘিরে ফেলতে এসে শত্রুরা সভয়ে দেখলে, এখন তাদেরই তিন দিকে ফরাসি সৈন্য। দলে দলে তারা মারা পড়তে লাগল। বেড়াজাল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে শত্রুরা বরফে-ঢাকা এক হ্রদের উপর দিয়ে পালাতে শুরু করলে। অত সৈন্যের পদভার সইতে না পেরে হুড়মুড় করে ভেঙে গেল তুষারের আচ্ছাদন। কনকনে ঠান্ডা হ্রদ যেন হাঁ করে গিলে ফেললে হাজার হাজার মানুষকে। সে ভীষণ দৃশ্য দেখে বিজয়ী ফরাসিরাও ভয়ে শিউরে উঠল।
এই হল চিরস্মরণীয় অস্টারলিটজ যুদ্ধ (২ ডিসেম্বর, ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে)।
তিরাশি হাজার রুশ ও অস্ট্রিয়ান সৈন্যদের মধ্যে প্রায় অর্ধাংশ হত, আহত বা বন্দি হল। রুশ সম্রাট নিজের দেশে পালিয়ে গেলেন। অস্ট্রিয়ার সম্রাট সেইদিন সন্ধ্যাতেই নেপোলিয়নের কাছে সন্ধি প্রার্থনা করতে এলেন। প্রুশিয়ার অধিপতি ফরাসিদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করতে উদ্যত হয়েছিলেন, কিন্তু ব্যাপার দেখে মুষড়ে পড়ে নেপোলিয়নের অদ্ভুত বিজয়লাভের জন্যে অভিনন্দন জ্ঞাপন করলেন। ট্রাফালগারের জলযুদ্ধে জিতে ইংল্যান্ড আশায় উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল, কিন্তু অস্টারলিটজের আশ্চর্য খবর সে আশাকে পরিণত করলে গভীর নিরাশায়! অস্টারলিটজে নেপোলিয়নের আশ্চর্য যুদ্ধ-কৌশল নেলসনের বিজয় গৌরবকে করে দিলে পরিম্লান। ইংল্যান্ডের প্রধান মন্ত্রী উইলিয়ন পিট ভগ্নহৃদয়ে প্রাণত্যাগ করলেন। নেপোলিয়নের শত্রুদের সমস্ত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে গেল।
অস্টারলিটজের যুদ্ধ হচ্ছে নেপোলিয়নের অপূর্ব রণপ্রতিভার অতুলনীয় নিদর্শন। যুদ্ধের শেষে তিনি সৈন্যদের সম্বোধন করে এই কথাগুলি বলেছিলেন :
‘সৈন্যগণ, সাবাস! তোমাদের সাহসের কাছ থেকে আমি যা যা প্রত্যাশা করেছিলুম, অস্টারলিটজের যুদ্ধে তোমরা সে-সমস্তই সফল করেছ; তোমাদের ঈগল-চিহ্নিত পতাকাকে তোমরা অমর যশগৌরবে মণ্ডিত করে তুলেছ। রুশিয়া ও অস্ট্রিয়ার সম্রাটদ্বয়ের দ্বারা পরিচালিত একলক্ষ সৈন্যকে তোমরা চার ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে বিতাড়িত বা বন্দি করেছ। যারা তোমাদের হাত ছাড়িয়ে পালাতে গিয়েছিল, তারা হ্রদের জলে ডুবে মরেছে। এই চিরন্তন মহিমায় সমুজ্জ্বল যুদ্ধের ফল হচ্ছে চল্লিশটি শত্রু-পতাকা, একশো-কুড়ি কামান, কুড়িজন সেনাপতি ও তিরিশ হাজারেরও বেশি বন্দি। সংখ্যায় প্রবল হয়েও শত্রুরা তোমাদের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারেনি, এর পরে তোমাদের আর কোনও প্রতিদ্বন্দ্বীকে ভয় করতে হবে না।…ভবিষ্যতে তোমাদের দলের কেউ যদি বলে যে—’আমি অস্টারলিটজের যুদ্ধে হাজির ছিলুম’, তা হলে উত্তরে সে এই কথাই শুনবে—’তাহলে তুমি হচ্ছ মহাবীরদেরই একজন।’