পঞ্চম পরিচ্ছেদ
আমি মাণিকজীর নিকট যেরূপ শুনিলাম, তাহাতে পালনজীর উপরেই সর্বাগ্রে সন্দেহটা বদ্ধমূল হয়। কাল রাত্রে দেরাজের মধ্যে দুই হাজার টাকা রাখিয়াছেন এবং বাড়ী অরক্ষিত অবস্থায় পড়িয়া আছে, এ কথা মাণিকজী কেবল পালনজীকেই বলিয়াছিলেন। অথচ সেই রাত্রের মধ্যেই পালনজীর টাকা চাই-ই, রাত্রের মধ্যে যেরূপে হউক তাঁহাকে পাঁচ শত টাকা সংগ্রহ করিতেই হইবে, একথা পালনজী নিজে, মাণিকজীকে বলিয়াছেন। অভাবে স্বভাবও নষ্ট হয় এরূপ স্থলে অবশেষে অনন্যোপায় হইয়া পালনজীকে চৌর্য্যবৃত্তি অবলম্বন করিতে হইয়াছিল—সেই সময়ে মিরিয়ম বাঈ তাঁহার উদ্দেশ্য সাধনের অন্তরায় হওয়ায় হতভাগ্য পালনজীকে একটি ক্ষুদ্র অপরাধ গোপন অথবা সাধন করিবার জন্য বাধ্য হইয়া তদপেক্ষা এক বৃহত্তর অপরাধে অপরাধী হইতে হইয়াছে। ইহাই সহজে সকলের মনে আগে উদয় হয়; মাণিকজীরও যে না হইয়াছে, তাহা নহে; তথাপি তাঁহার উপর মাণিকজীর অগাধ বিশ্বাস; তিনি ত প্রথমে পালনজীর কথা আমার কাছে একেবারে চাপিয়া যাইবার চেষ্টা করিতেছিলেন, আমি পীড়া-পীড়ি করিয়া না ধরিলে, হয় ত তাহা তিনি করিতেনও।
আপাততঃ যাহাতে এই হত্যাকাণ্ডের ভিতরের কোন কথা কোন সংবাদপত্রে বাহির না হয়, সে দিকে বিশেষ মনোযোগ রাখা যুক্তিযুক্ত বোধ করিলাম। সম্পাদকগণ এই সকল কাহিনী শব্দালঙ্কারে সাজাইয়া তাঁহাদিকের গ্রাহক বর্গের ক্ষুন্নিবৃত্তি করিয়া থাকেন বটে, কিন্তু তাঁহাদের এই সামান্য স্বার্থের জন্য আমাদিগকে এক এক সময় বাইশ হাত জলে গিয়া পড়িতে হয়। পলাতক আসামীগণ তাহাদিগের তখন কোন পথ অবলম্বনীয়, তাহা ঠিক করিয়া লইবার বেশ একটি সুবিধা পায়, এবং তাহা হইতেই সাধ্যানুসারে সতর্ক হয়।
পাথরের পুতুলটাও আমার একটা বড় চিন্তার বিষয় হইল। অজ্ঞাতসারে হত্যাকারীর বুক-পকেট হইতেই যে পাথরের পুতুলটা পড়িয়া গিয়াছে, ইহা নিশ্চয়। এই ধরণের পুতুল আমাদের এখানে বড় একটা দেখিতে পাওয়া যায় না, সিলোনেই পাওয়া যায়। হয় হত্যাকারী কাল সিলোন হইতে কোন জাহাজে এখানে আসিয়া পৌঁছিয়াছে না হয় সিলোন হইতে প্রত্যাগত কোন বন্ধুর নিকট হইতে ইহা সে পাইয়া থাকিবে; যে কোন প্রকারেই হউক কাল এই পুতুলটা তাহার হস্তগত হইয়াছিল। নতুবা দুই দিন হইতে যে, সে আধসের ওজনের এত বড় একটা পাথরের পুতুল বুক-পকেটে বহিয়া ঘুরিয়া বেড়াইবে, ইহা কখনই সম্ভবপর নহে। যাহা হউক একবার বেন্দোরায় গিয়া ইহার সন্ধান লইতে হইবে। ইহাছাড়া হত্যাকারীকে সন্ধান করিয়া বাহির করিবার আরও একটা সূত্র রহিয়াছে—মাণিকজীর সেই অপহৃত নোটগুলি। ভাবিয়া দেখিলাম, আগে নোটগুলিরই সন্ধান লওয়া ঠিক। হত্যাকারীর লক্ষ্যে উদ্যত আমার এই দুইটি শরের দুইটিই যে ব্যর্থ যাইবে, এরূপ আমি মনে করি না।
বাড়ীতে আসিয়া আহারাদি করিয়া নোটগুলির সন্ধানে পুনরায় বেলা দুইটার পর বাহির হইয়া পড়িলাম। উদ্দেশ্য সফল হইল বেলা তিনটার পর সংবাদ পাইলাম, সেইদিনই বেলা দশটার সময় মাণিকজীর অপহৃত বিশখানি নোটের পাঁচখানি নোট একটি ব্যাঙ্কে জমা পড়িয়াছে। কি আশ্চর্য্য! হত্যাকারী লোকটা কি এমনই কাঁচা—একটা বালকের যে বুদ্ধিটুকু থাকা সম্ভব সেটুকুও কি তাহার মস্তিষ্কে নাই! তাহার পর যখন জানিতে পারিলাম, সেই পাঁচখানি নোট সেইখানকার একজন প্রতিষ্ঠা পত্র ব্যবহারাজীবী জমা দিয়াছেন, তখন নোটগুলি পাইয়া আমার যতখানি আনন্দিত হওয়া উচিত আমাকে তাহার দশগুণ বিস্মিত হইতে হইল। এমন একটা খুনের মামলায় তাঁহার ন্যায় একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির কি সংসক্তি থাকিতে পারে, কিছুই ভাবিয়া পাইলাম না। তাঁহার নাম দাদাভাই নবরজী।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
বোম্বে সহরে দাদাভাই নবরজীর মান-সম্ভ্রম খুব। সাক্ষাৎ সম্বন্ধে তাঁহার সহিত আমার পরিচয় না থাকিলেও তাঁহার নাম ও গুণগ্রাম আমার অবিদিত ছিল না। আমি বেলা পাঁচটার পর তাঁহার বাড়ীতে যাইয়া তাঁহার সহিত দেখা করিলাম। তিনি আমাকে অভ্যর্থনা করিয়া তাঁহার ড্রইংরুমে লইয়া গিয়া বসাইলেন। আমি হত্যা সম্বন্ধে কোন কথার উল্লেখ না করিয়া সেই পাঁচখানি নোটের কথাই আগে উত্থাপন করিলাম। আমার মুখে নোটের কথা শুনিয়া তিনি কোনরূপ চাঞ্চল্য প্রকাশ করিলেন না। বলিলেন, “আমি যে পাঁচখানি নোট ব্যাঙ্কে জমা দিয়াছি, তাহাতে কোন গোল থাকিতে পারে এমন আমার বোধ হয় না।”
আমি বলিলাম, “আপনি যাহা বোধ করিতেছেন, তাহা ঠিক নহে। নোটগুলির ভিতরে একটা বিশেষ গোলযোগ আছে, নতুবা এমন অসময়ে আমি আপনাকে বিরক্ত করিতে আসিতাম না।”
“আচ্ছা, দেখিতেছি”, বলিয়া তিনি টেবিলের উপরিস্থিত কলিংবেলে বারত্রয় আঘাত করিলেন। তৎক্ষণাৎ একজন ভৃত্য তাঁহার সম্মুখে দাখিল হইল। তিনি ভৃত্যকে বলিলেন, “ফামজীকে এখানে একবার আসিতে বল।”
ভৃত্য চলিয়া গেল।
দাদাভাই আমাকে বলিলেন, “তাই ত ফামজী আবার আমাকে বিপদে ফেলিল, দেখিতেছি। মনে করিয়াছিলাম, কথাটা চাপিয়া যাইব অনেক দিন হইতে লোকটা আমার কাছে রহিয়াছে, একটা মায়া পড়িয়া গিয়াছে। কিন্তু আর সহ্য করা যায় না। যাহা হউক, কথাটা আপনি আর কাহারও কাছে প্রকাশ করিবেন না।”
আমি বলিলাম, “কথাটা কি না শুনিলে, তাহা আমি এখন কিরূপে বলিব; তবে যদি আবশ্যক না হয়, তাহাই হইবে। আমি একজন ডিটেকটিভ—কেবল কৌতূহল চরিতার্থ করিবার জন্য আমি আপনার কাছে আসি নাই, কার্য্যোদ্ধারের জন্য যাহা কিছু আবশ্যক—তাহা আমাকে বাধ্য হইয়া করিতেই হইবে।”
তিনি কি বলিতে যাইতেছিলেন, এমন সময়ে দ্বার ঠেলিয়া একটি যুবক সেই প্রকোষ্ঠে ধীরে ধীরে প্রবেশ করিল। যুবকটি দেখিতে যেমন দীর্ঘ, তেমনই কৃশ এবং মুখমণ্ডলে সঙ্কোচ ও উদ্বেগের চিহ্ন স্পষ্ট প্রকটিত। তাহারই নাম ফামজী। একবার সঙ্কুচিত দৃষ্টিতে আমার দিকে চাহিয়া দাদাভাই নবরজীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
দাদাভাই বলিলেন, “দেখ ফামজী, ইনি একজন পুলিস-কৰ্ম্মচারী, তুমি আজ সকালে আমাকে যে পাঁচখানি নোট দিয়াছ, ইনি বলিতেছেন, সে নোটগুলির ভিতরে একটা গোলযোগ আছে।”
ফামজী একটু ইতস্ততঃ করিয়া জড়িতকণ্ঠে বলিল, “না-না মিথ্যা কথা। কোন গোল নাই।” বলিতে
বলিতে ফামজীর মুখমণ্ডল আরক্ত তৎক্ষণাৎ আবার মলিন হইয়া গেল।
আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এই নোটগুলি আপনি কোথায় পাইয়াছিলেন?”
ফামজী বলিল, “আমার ভগিনী আমাকে দিয়াছেন।”
“কখন দিয়াছেন?”
“আজ প্রত্যুষে।”
“কতগুলি নোট পাইয়াছেন?”
“আপনার ভগিনীর নিকট হইতে কোন্ প্রয়োজনে আপনি এই পাঁচশত টাকা লইয়াছেন?” ফামজী কোন উত্তর করিলেন না। দীননেন্ত্রে দাদাভাই নবরজীর মুখের দিকে চাহিলেন। দাদাভাই বলিলেন, “ফামজী, আমার মুখের দিকে চাহিয়া আর কোন ফলনাই। কোন্ প্রয়োজনে টাকা আনিয়াছ, বল। আর সত্যই যদি তুমি একটা পাপ লুকাইতে গিয়া আর একটা পাপ করিয়া থাক, তাহা হইলে এবার তুমি মরিলে, এবার আর আমার হাত নাই।”
ক্ষুব্ধভাবে ফামজী বলিয়া উঠিলেন, “না-না, আমি আর কোন অপরাধ করি নাই।” তাহার পর আমার দিকে ফিরিয়া কহিলেন, “দেখুন মহাশয়, আমি হইার একজন কর্ম্মচারী মুহুরীর কাজ করিয়া থাকি। দিনকতক জুয়াখেলা ধরিয়াছিলাম; তাহাতে আমি পাঁচশত টাকার দেনদার হইয়া পড়ি। কোনরূপে সে টাকা পরিশোধ করিতে না পারায়—আমার দুম্মতি হইয়াছিল, তাই এমন সদাশয় মনিবের পাঁচশত টাকা তহবীল তছরূপ করি। ইনি কাল তাহা জানিতে পারিয়া আমাকে সেই টাকা তখনই দাখিল করিতে বলেন, আর ঐ টাকা ফিরিয়া পাইলে ক্ষমা করিয়া কাজে বহাল রাখিতে সম্মত হন। আমি আর কোন উপায় না পাইয়া আমার ভগিনীকে নিজের বিপদের কথা জানাই। আমার ভগিনীর আর্থিক অবস্থা ভাল নহে; তাহা না হইলেও সে আমাকে বিপন্ন দেখিয়া পাঁচশত টাকা দিতে স্বীকার করে। কিন্তু নিজের হাতে টাকা না থাকায় পালনজী পেষ্টনজীর নিকটে টাকা চাহে, পালনজী তাহাকে অর্থ সাহায্য করিতে সম্মত হন, কাল রাত্রেই তিনি আমার ভগিনীকে পাঁচশত টাকা আনিয়া দেন। আমি সেই টাকা আমার ভগিনীর নিকট হইতে আজ সকালে আনিয়া আমার মনিবকে দিই। ইনি টাকাটা পাইয়াই ব্যাঙ্কে জমা দিয়াছেন। ইহাতে গোলযোগের কিছু ত দেখি না।”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “পালনজীর সহিত আপনাদের কি সম্পর্ক?”
ফামজী বলিলেন, “আমার ভগিনীকে তিনি বিবাহ করিবেন।”
“আপনার ভগিনীর নাম কি?
“হীরাবাঈ।”
“তিনি কোথায় থাকেন?”
“গোকুলদাসের হাসপাতালের দক্ষিণ দিককার একটা গলিতে থাকেন।”
অদ্যাপি যে রহস্য আবৃত ও মলিন ছিল, ফামজীর কথাগুলি যেন তাহা ধুইয়া মুছিয়া ঝকঝকে তকতকে করিয়া তুলিল। এতক্ষণে বেশ বুঝিতে পারিলাম, পালনজীই অর্থের জন্য মিরিয়ম বাঈকে নিশ্চয় খুন করিয়াছে—আর সন্দেহ করিবার কিছুই নাই। কি আশ্চর্য্য! লোকটা কি এমনই অপদার্থ—একটা স্ত্রীলোকের মন রাখিতে গিয়া অনায়াসে এমন একটা ভয়ানক কাজ করিয়া ফেলিল! মনে মনে স্থির করিলাম, হীরাবাঈ এর সহিত এখন দেখা করিবার আর আবশ্যকতা নাই; হতভাগ্য পালনজীকে একেবারে গ্রেপ্তার করাই ঠিক। আমি ঠিক পথই ধরিয়াছি। পালনজীর কানে এই সকল কথা যাহাতে আগে না ওঠে, সেজন্য আমি দাদাভাই ও তাঁহার মুহুরীকে কোন কথা কাহারও নিকট প্রকাশ করিতে নিষেধ করিয়া দিলাম। বিশেষতঃ ফামজীর মুখে যদি তাহার ভগিনী হীরাবাঈ এই সকল কথা শুনিতে পায়, সে আগে হইতেই তাহার প্রণয়ী পালনজীকে সতর্ক করিয়া দিবে।
আমি দাদাভাই ও ফামজীকে বলিলাম, “দেখুন অন্ততঃ অনুগ্রহপূর্বক চব্বিশ ঘন্টার জন্য আপনারা এই কথাটা কাহাকেও বলিবেন না― পরে আপনারা সকলই জানিতে পারিবেন। যেজন্য আপনাদিগকে এই সকল কথা জিজ্ঞাসা করিলাম, সে অনেক কথা—বলিতে অনেক সময় লাগিবে—আমি আর এখানে বিলম্ব করিতে পারিতেছি না তাহা না হইলে হয় ত আমার মুখেই আপনারা সব শুনিতে পাইতেন।”
ব্যগ্রভাবে ফামজী জিজ্ঞাসা করিল, “আমার ভগিনীর কি কোন বিপদের সম্ভাবনা আছে?”
আমি বলিলাম, “না না—কিছু না।”
ফামজী আমার কথা কানে না তুলিয়া হতাশ ভাবে বলিল, “আমার ভগিনীই — ”
আমি বাধা দিয়া বলিলাম, “আঃ! কেন আপনি ব্যাকুল হইতেছেন? আমার কথায় বিশ্বাস করুন, আপনার কি আপনার ভগিনীর কোন বিপদ ঘটিবে না সেজন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করিব—চিন্তিত হইবেন না। আমার কথা যেন স্মরণ থাকে, আপাততঃ ঘুণাক্ষরে এ সকল কথা যেন কাহারও কানে না উঠে।”
দাদাভাই ও ফামজী উভয়েই আমার কথায় সম্মত হইলেন।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
পরদিন ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হইতে পালনজীর নামে একখানা ওয়ারেন্ট বাহির করিয়া লইলাম। পালনজীর বিরুদ্ধে যে সকল প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে, তাহা তাঁহাকে ফাঁসী কাঠে তুলিয়া দিবার পক্ষে খুবই বলবৎ। বিশেষতঃ মাণিকজীর অপহৃত নোটগুলির মধ্য হইতে যখন পাঁচখানি নোট পালনজীর হাত দিয়া বাহির হইয়াছে—তখন ত এ কেসটা দিবালোকের ন্যায় একেবারে পরিষ্কার হইয়া গিয়াছে—তবে একটা কথা হইতেছে—সেই পাথরের পুতুল, সেটা যদি পালনজীর বলিয়া এখন প্রমান করিতে পারি, তাহা হইলে আর কোন গোলযোগ থাকে না।
ওয়ারেন্ট বাহির করিয়া আমি পালনজীর বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম, এবং আমার শুভাগমনের কারণ বিজ্ঞপ্তি করিলাম। পালনজী অতিমাত্র বিস্ময়ের সহিত তাহা শুনিলেন। কিছুতেই তিনি নিজের অপরাধ স্বীকার করিলেন না সেধার দিয়াই গেলেন না সকল কথাই উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন যেন একেবারেই কিছুই জানেন না। তিনি যে নিজের অপরাধ স্বীকার করিবেন না, ইহা আমি আগে হইতেই জানিতাম। কিন্তু তিনি যে এরূপভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করিবেন, এরূপ আশা করি নাই।
পালনজী বলিলেন—একান্ত উদ্বিগ্নভাবেই বলিলেন, “আপনার ভ্রম হইয়াছে, আপনি কিসে আমাকে দোষী স্থির করিতেছেন—বুঝিতে পারিতেছি না; আমি কেন মিরিয়ম বাঈকে খুন করিব? কোন কারণ নাই। এই খুনের সংবাদটা শুনিয়া বোধ করি—আমার ন্যায় আর কেহ এত অধিক বিস্মিত হয় নাই। এমন কি প্রথমে আমি ইহা বিশ্বাস করিতে পারি নাই।”
“আপনি খুনের রাত্রে মাণিকজীর বাড়ীতে গিয়াছিলেন?”
“গিয়াছিলাম। কেন আমি তাহা এখন আপনার নিকটে অস্বীকার করিতে যাইব? বিশেষতঃ যখন আমি নিজেকে নিরপরাধ বলিয়া জানি—তখন ত কোন কথা গোপন করিবার কোন আবশ্যকতা দেখি না।”
“দেখুন, আমি আপনাকে সতর্ক করিয়া দিতেছি, এখন আপনি মুখ দিয়া যে কথা বাহির করিবেন, পরে তাহাই আপনার বিরুদ্ধে প্রমাণ রূপে গণ্য হইবে। যাহা বলিবেন, বুঝিয়া বলিবেন।
“সেজন্য আমি ভাবি না—আমি আত্মপক্ষ সমর্থন করিতে পারিব। আমি খুনের রাত্রে বন্ধু মাণিকজীর নিকটে পাঁচশত টাকা চাহিয়াছিলাম; সেই টাকা—”
“—হীরাবাঈকে দিবার জন্য?”
চমকিত ভাবে পালনজী আমার মুখের দিকে চাহিলেন। ব্যাকুলকন্ঠে বলিলেন, “কিরূপে আপনি ইহা জানিতে পারিলেন?”
আমি বলিলাম, “হীরাবাঈ এর ভ্রাতার নিকটে আমি শুনিয়াছি। আপনি যে পাঁচখানি নোট পাঠাইয়া দিয়াছিলেন, দাদাভাই তাহা ব্যাঙ্কে জমা করিয়া দেন। এত শীঘ্র সেই নোটগুলি বাহির করা আপনার ঠিক হয় নাই—বড়ই কাঁচা বুদ্ধির কাজটা করিয়া ফেলিয়াছেন; অপরাধ গোপন করিবার জন্য আপনার বিধিমত সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। আর সতর্ক হইবেনই বা কি—আপনাকে বাধ্য হইয়াই টাকাগুলি এত শীঘ্র বাহির করিয়া দিতে হইয়াছে—নতুবা হীরাবাঈ-এর ভ্রাতা শ্রীমান্ ফামজীকে যে শীঘরে গমন করিতে হয়।”
অত্যন্ত ভয়ানক ভাবে উত্তেজিত হইয়া পালনজী বলিয়া উঠিলেন, “আপনি ভদ্রলোকের সম্মান রাখিয়া কথা কহিবেন। আমি এখনও বলিতেছি—আমি খুন করি নাই—আমি আপনারই ন্যায় নিরাপরধ। আমি হীরাবাঈ-এর অনুরোধে, তাহার ভ্রাতাকে কোন একটা বিপদ হইতে রক্ষা করিবার জন্য আমার বন্ধু মাণিকজীর নিকট হইতে পাঁচশত টাকা মাত্র কর্জ্জ করি।”
“কিন্তু আপনার সেই বন্ধুই বলিতেছেন, আপনাকে তিনি টাকা দেন নাই।”
অগ্নিসৃষ্ট বারুদের ন্যায় পালনজী যেন দপ্ করিয়া জ্বলিয়া উঠিলেন। দৃঢ়স্বরে বলিলেন, “তাহা হইলে তিনি ঘোরতর মিথ্যাবাদী—মিথ্যা কথা বলিয়াছেন। বেন্দোরা ষ্টেশনে তাঁহার সহিত আমার দেখা হয়। আমি তাঁহার নিকটে পাঁচশত টাকা চাহিবা মাত্র তিনি টাকা দিতে চাহিলেন, কিন্তু তাহার নিকটে বেশি টাকা না থাকায় দিতে পারিলেন না। আমাকে বলিলেন, তাঁহার টাকা মজুত আছে পরে যখনই আমি চাহিব, তখনই পাইব। এদিকে আমার সেইরাত্রে টাকার দরকার, আমি তখনই তাঁহার বাড়ীতে গিয়া তাঁহার স্ত্রীর নিকট হইতে টাকাগুলি পাইতে পারি, এই মর্ম্মে একখানি পত্র লিখিয়া দিবার জন্য তাঁহাকে অনুরোধ করিলাম।”
“কিন্তু আপনার এই অনুরোধ তিনি রাখিতে পারেন নাই?”
“না না, সে কি কথা, তিনি তখনই আমাকে পাঁচশত টাকার উল্লেখ করিয়া তাঁহার স্ত্রীর নামে একখানা পত্র লিখিয়া দিলেন। আমি সেই পত্ৰ লইয়া তখনই মাণিকজীর বাড়ীতে গেলাম। স্বামীর পত্র পাইয়া মিরিয়ম বাঈ আমাকে পাঁচশত টাকা দিলেন, তখন রাত প্রায় নয়টা। আমি সেই টাকা হীরাবাঈকে সেই রাত্রেই আনিয়া দিই।”
আমি সন্দিগ্ধভাবে বলিলাম, “আপনার ন্যায় এরূপ ভাবে আর কাহাকেও কখন আত্মরক্ষা সমর্থনের চেষ্টা করিতে দেখি নাই। আপনি যাহা বলিতেছেন, মাণিকজী সে কথা একেবারে অস্বীকার করিতেছেন, তিনি বলিতেছেন, আপনাকে সে রাত্রে তিনি টাকা কি কোন পত্র দেন নাই।”
আমি তাঁহার সহিত উপহাস করিতেছি মনে করিয়া পালনজী অত্যন্ত কঠিনভাবে আমার মুখের দিকে চাহিলেন। তাঁহার ভাব দেখিয়া এরূপ বোধ হইল, যেন তিনি আমার কথা বিশ্বাস করিতে পারিতেছেন না। ক্ষণপরে তিনি একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন, “আশ্চর্য্য! তিনি কি বলিতেছেন, আমাকে পত্ৰ লিখিয়া দেন নাই?”
“না। সে পত্র কি আপনি আমাকে দেখাইতে পারেন?”
“না, আমি তাহা মিরিয়ম বাঈকে দিয়াছিলাম।”
“কই, সে পত্র এখনও পাওয়া যাইতেছে না। আপনার কথা সত্য হইলে, সে পত্র এতক্ষণে আমারই হস্তগত হইত। বিশেষতঃ সে পত্রখানা মিরিয়ম বাঈ-এর নষ্ট করিবার কোন কারণ দেখিতেছি না।
“আপনি কি আমার কথা বিশ্বাস করিতেছেন না?”
“বিশ্বাস করিবার ত কোন কারণই খুঁজিয়া পাইতেছি না; মাণিকজী বলিতেছেন, আপনাকে সে রাত্রে তিনি টাকা দেন নাই, অথচ তাঁহার অপহৃত নোটগুলির পাঁচখানি নোট আপাততঃ আপনার নিকটে পাওয়া যাইতেছে; এরূপ স্থলে আপনার কথায় কিরূপে আমার বিশ্বাস হইতে পারে?”
“সত্যই কি এখন মাণিকজী বলিতেছেন, আমাকে তিনি টাকা দেন নাই?”
“না, তিনি আপনাকে টাকা দেন নাই।”
অত্যন্ত হতাশভাবে পালনজী বলিলেন, “তবে তিনি নিশ্চয়ই পাগল হইয়া গিয়াছেন; তিনি আমার পরম বন্ধু, আমারই বিরুদ্ধে তিনি এমন ভয়ানক মিথ্যাকথা কিরূপে বলিতেছেন!”
আমি আর অনর্থক বাগ্বিতণ্ডায় সময়ের অপব্যয় করা যুক্তিযুক্ত নয় ভাবিয়া তাঁহাকে বলিলাম, “আর তর্কে প্রয়োজন নাই, তর্ক করিতে আপনার কাছে আসি নাই। পুনর্ব্বার আপনাকে স্মরণ করাইয়া দিতেছি, আমার কাছে এখন আপনি যাহা কিছু বলিবেন, তাহা পরে আপনার বিরুদ্ধে প্রমাণ রূপে ব্যবহৃত হইতে পারে। বাহিরে গাড়ী দাঁড়াইয়া আছে, এখন আপনাকে আমার সঙ্গে থানায় যাইতে হইবে।’
“তাহাই হউক”, বলিয়া পালনজী সবেগে উঠিয়া দাঁড়াইলেন। এবং আমার সঙ্গে বাহিরে আসিয়া গাড়ীতে উঠিলেন।
গাড়ী থানা অভিমুখে ছুটিল।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
মিরিয়ম বাঈ-এর হত্যাপরাধে পালনজী ধৃত হইয়াছেন, এই সংবাদটি যেন দেখিতে দেখিতে কোথা হইতে একেবারে সহরের চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল। বেন্দোরা ও তন্নিকটবর্ত্তী স্থান সমূহের সকল লোকের মুখে আজ পালনজীর কথা, সঙ্গে সঙ্গে আমার কার্য্যকুশলতার বিবিধ প্রশংসা। যেন চারিদিক ব্যাপিয়া একটা মহা হৈ-চৈ পড়িয়া গেল; যেখানে দুইজন লোক একত্র হইয়াছে, সেইখানে কেবল ওই একই কথা। পরদিন প্রাতে সমস্ত দৈনিক সংবাদপত্রে এই সংবাদটি অলঙ্কৃত ও অতিরঞ্জিত হইয়া বাহির হইল; সম্পাদক-লেখনীর মুখেও আমার প্রশংসা ধরে না। এমন অনেক ডিটেকটিভ আছেন, যাঁহারা এই সকল প্রশংসায় খুব খুসী হইতে পারিতেন, কিন্তু আমি ইহাতে আদৌ সন্তুষ্ট হইতে পারিলাম না; কারণ পালনজীকে সেরূপ দৃঢ়ভাবে নিজের নির্দোষিতা সপ্রমাণ করিতে দেখিয়া আমাকে একটু চিন্তিত হইতে হইয়াছিল। এক-একবার সমস্ত সন্দেহ ঠেলিয়া মনে হইতেছিল, হয়ত লোকটা দোষী নহে। কিন্তু তাঁহার বিরুদ্ধে যে সকল প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে, তাহা খুবই অকাট্য। পালনজী নিজমুখেই স্বীকার করিতেছেন, খুনের রাত্রে তিনি মাণিকজীর বাড়ীতে গিয়াছিলেন, স্বীকার করিতেছেন, তাঁহারই হাত হইতে সেই অপহৃত পাঁচখানি নোট বাহির হইয়াছে; তবে একটা কথা হইতেছে, মাণিকজী তাঁহাকে একখানা পত্র দিয়াছিলেন সে পত্রখানি এখন পাওয়া যাইতেছে না; আমার বোধ হয়, পত্রের কথাটা একেবারে মিথ্যা, পালনজী বড় বুদ্ধির খেলা খেলিয়াছেন, সকল কথা স্বীকার করিয়া একটা কথাতে সকল দিক বজায় রাখিবার চেষ্টা করিতেছেন। তিনি যে দুইটি কথা স্বীকার করিতেছেন, তাহা তিনি স্বীকার না করিলেও প্রমাণের বড় অভাব ছিল না, কারণ একটু চেষ্টাতেই যেরূপ নোটগুলির কথা জানিতে পারা গেল, তেমনি আর একটু চেষ্টা করিলেই জানিতে পারা যাইত যে, সেই খুনের রাত্রে মাণিকজীর বাড়ীতে পালনজী প্রবেশ করিয়াছিলেন।
পালনজী হত্যাপরাধে ধৃত হইয়াছেন শুনিয়া, মাণিকজী মহা উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিয়াছিলেন। পালনজীর উপর তাঁহার অগাধ বিশ্বাস; প্রথমে তিনি পালনজীকে কিছুতেই দোষী বলিয়া বিশ্বাস করিতে চাহেন না; তাহার পর যখন তিনি আমার মুখে পুস্খানুপুঙ্খরূপে সমুদয় বিষয় শুনিলেন, তখন আর আমার কথায় বিশ্বাস না করিয়া থাকিতে পারিলেন না। বলিলেন, “পালনজীকে আমি বরাবরই সচ্চরিত্র বলিয়া জানিতাম, সে যে সামান্য টাকার জন্য এমন একটা ভয়ানক কাজ করিবে, ইহা স্বপ্নের অগোচর। হায়, আমি যদি তখনই তাহাকে নিজের সঙ্গে লইয়া বাড়ীতে গিয়া টাকা দিতাম, তাহা হইলে আমার হতভাগিনী স্ত্রীর জীবন রক্ষা পাইত, আর পালনজীকেও ফাঁসীকাঠে ঝুলিতে হইত না!”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “পালনজী এখন যেরূপ ভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করিতেছেন, তাহাতে আপনি কি বোধ করেন?”
মাণিকজী বলিলেন, “মিথ্যা কথা, উহার একটি বর্ণও সত্য নহে। আমি তাহাকে টাকার জন্য আমার বাড়ীতে যাইতেও বলি নাই কোন পত্রও দিই নাই। যখন আমার ধারণা রহিয়াছে, বাড়ীতে কেহই নাই, তখন কেনই বা আমি তাহাকে এরূপ পত্র দিতে যাইব?”
আমি বলিলাম, “সে রাত্রে আপনি সহরে সান্ধ্যসম্মেলনে না গিয়া নিজের বাড়ীতে ফিরিলে এমন একটা ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটিত না।”
মাণিকজী সম্মহিতসূচক ভাবে মাথা নাড়িয়া বলিলেন, “হাঁ, এখন তাহাই মনে হইতেছে। এমন হইবে জানিলে আমি কখনই সেদিন সহরে যাইতাম না। আমার পরম বন্ধু ডাক্তার তোরাবজী ম্যাকনজীর বাড়ীতে আমার সান্ধ্য-সম্মেলনের নিমন্ত্রণ ছিল; তাহার সহিত আমার বিশেষ সখ্যতা, যদি আমি না যাই, সেজন্য তিনি নিজে আসিয়া আমাকে বিশেষ অনুরোধ করিয়া যান, সুতরাং আমাকে বাধ্য হইয়া তাঁহার বাটিতে যাইতে হয়।”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি সেই পাথরের পুতুলটি কখনও পালনজীর নিকটে দেখিয়াছিলেন কি?”
মাণিকজী বলিলেন, “না, কখনও দেখি নাই। এ কথা আপনি জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন?”
আমি বলিলাম, “যদি এই পাথরের পুতুল পালনজী না হয়, তাহা হইলে তিনি নিশ্চয়ই নিরপরাধ। আপনি আমার কথা শুনিয়া বিস্মিত হইবেন না, ইহাতে বিস্ময়ের কিছুই নাই; আমি খুব সাহস করিয়া, বলিতে পারি, এই পাথরের পুতুলটি যাহার সেই ব্যক্তিই আপনার স্ত্রীর হত্যাকারী।”
নবম পরিচ্ছেদ
মাণিকজীর নিকট হইতে বাড়ী ফিরিয়া আসিয়া ভৃত্যের মুখে শুনিলাম, একটি স্ত্রীলোক আমার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছে এবং উপরিতলের একটা ঘরে অপেক্ষা করিতেছে। আমি তাহার সহিত দেখা করিবার জন্য তাড়াতাড়ি উপরে গেলাম। গিয়া দেখিলাম, তাহার বয়স বেশি নহে। নিরুপমা সুন্দরী, লোকাতীত রূপলাবণ্যে তাহার সর্ব্বাঙ্গ ঝলমল করিতেছে। ইতিপূর্ব্বে তাহাকে আর কখনও দেখি নাই। এই প্ৰথম দেখিলাম, তথাপি যেন মনে হইতে লাগিল, তাহাকে ইহার আগে আর কোথায় দেখিয়াছি। তাহার পর একটু ভাবিয়া দেখিতে নিজের ভ্রম বুঝিতে পারিলাম, বস্তুতই তাহাকে আগে আর কোথায় দেখি নাই, ইহার মুখমণ্ডলের সহিত দাদাভাই নবরজীর মুহুরী ফামজীর মুখের অনেকটা সাদৃশ্য আছে; ইহাতেই আমি একটা অনুমান করিয়া লইতে পারিলাম। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমারই নাম কি হীরাবাঈ?”
“হাঁ, আমিই হীরাবাঈ—পালনজীর সম্বন্ধে আমি আপনাকে দুই-একটা কথা বলিতে আসিয়াছি।” বলিয়া হীরাবাঈ দীননয়নে আমার মুখের দিকে চাহিল।
আমি তাহার সেই কাতর দৃষ্টিতেই তাহার মনের ভাব অনেকটা বুঝিতে পারিয়া বলিলাম, “পালনজীকে আর রক্ষা করিবার কোন উপায় নাই।”
হীরাবাঈ ব্যাকুলভাবে কহিল, “না, তাহা বলিলে হইবে না— পালনজীকে রক্ষা করিবার জন্য একটা-না-একটা কিছু আপনাকে করিতেই হইবে।”
আমি বলিলাম, “পালনজী এই খুনের অপরাধে যেরূপ জড়াইয়া পড়িয়াছেন, তাহাতে—”
হীরাবাঈ বাধা দিয়া বলিল, “আপনি কি তাঁহাকে দোষী মনে করিতেছেন?”
আমি বলিলাম, “তাঁহার বিরুদ্ধে যে সকল অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে, তাহাতে তাঁহাকে দোষী ভিন্ন আর কি মনে করিতে পারি?”
হীরাবাঈ ক্ষুব্ধভাবে বলিয়া উঠিল, “আমি প্রমাণের কোন কথা শুনিতে চাই না আমি তাঁহাকে যতদূর জানিয়াছি-চিনিয়াছি-বুঝিয়াছি—তাহাতে আমি সহস্র প্রমাণ পাইলেও, তিনি যে এমন একটা ভয়ানক হত্যাপরাধে অপরাধী, এ কথা কিছুতেই বিশ্বাস করিতে পারি না। অপরাধ লইবেন না—আপনি তাঁহাকে জানেন না—তাই, আপনি তাঁহাকে ভুল বুঝিয়াছেন। আপনি আমার কথায় বিশ্বাস করুন, তিনি আপনার-আমার মত একান্ত নিরপরাধ।
আমি বলিলাম, “আমি পালনজীকে না জানিতে পারি, কিন্তু তাঁহার বন্ধু মাণিকজী অনেক দিন হইতে তাঁহাকে জানেন, তিনিও এখন পালনণীকে দোষী মনে করিতেছেন।”
ঘৃণাভরে অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া হীরাবাঈ বলিল, “মাণিকজী! হাঁ—ঠিক বটে! তিনি ত পালনজীকেই এখন দোষী মনে করিবেন।”
আমি বলিলাম, “মাণিকজীর উপরে তুমি অন্যায় দোষারোপ করিতেছ। বিশ্বাস না করিবার কোন উপায় থাকিলে তিনি পালনজীকে কখনই দোষী মনে করিতে পারিতেন না। পালনজী হত্যাপরাধে ধৃত হওয়ায় বরং তিনি অধিকতর দুঃখিত।”
হীরাবাঈ ক্ষণকাল নীরবে কি ভাবিল। তাহার পর বলিল, “আপনি আমার কথায় বিশ্বাস করিলেন না; ভাল, যাহাতে আপনার চক্ষুকর্ণের বিবাদ মিটে, এবার আমি তাহাই করিব। আমার বাড়ীতে অনুগ্রহপূৰ্ব্বক আপনাকে একবার যাইতে হইবে পালনজী দোষী কি নির্দোষী তাহা আপনাকে দেখাইয়া দিব।”
আমি বলিলাম, “তুমি নিজের ভুল নিজে বুঝিতে পারিতেছ না। বৃথা চেষ্টা করিবে।”
হীরাবাঈ দৃঢ়স্বরে বলিল, “পরে তাহা দেখা যাইবে পালনজীকে রক্ষা করিবার জন্য জীবনপণে আমি একবার চেষ্টা করিয়া দেখিব—দেখি তাঁহার জন্য আমি এই ক্ষুদ্র নারী-বুদ্ধিতে কিছু করিয়া উঠিতে পারি কি না। আমি নিশ্চয় জানি, পালনজী নিৰ্দ্দো আর কিছু নয়, কেবল ঘটনাচক্রে এরূপ ভাবে জড়াইয়া পড়িয়াছেন—কখনই তিনি খুন করেন নাই! তাঁহাকে এই ভয়ানক বিপদের মুখ হইতে রক্ষা করিবার কোন উপায়ই কি আর নাই? আপনি কি এ দুঃসময়ে আমাকে কোন সাহায্য করিতে পারেন না?”
আমি বলিলাম, “সাধ্যমত সাহায্য করিতে প্ৰস্তুত আছি।”
হীরাবাঈ বলিল, “আপনাকে ধন্যবাদ! আপনি এই খুন সম্বন্ধে যাহা কিছু জানেন, বলুন। আমি পালনজীকে রক্ষা করিবার জন্য আমার শরীরের শেষ রক্ত বিন্দুটি পর্য্যন্ত ব্যয় করিব—ইহার বেশি আরও যদি কিছু করিতে হয়, তাহাও করিব– লজ্জা ভয় রাখিব না মান অপমান দেখিব না,—নিজের জীবনের দিকেও চাহিব না।”
তখন আমি এই খুনের মোকদ্দমা সম্বন্ধে এ পর্য্যন্ত যাহা কিছু করিয়াছি, সমুদয় হীরাবাঈকে বলিতে লাগিলাম, এবং সেই পাথরের পুতুলটি তাহাকে দিলাম। হীরাবাঈ অত্যন্ত মনোযোগের সহিত সব শুনিল, আমার বলা শেষ হইলেও সে দুই তিন মিনিট ধরিয়া অনন্যমনে কি ভাবিল। তাহার পর পুতুল লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “আপনি আগামী রবিবার আমার বাড়ীতে সন্ধ্যার পর যাইবেন, সেইখানে যাহাতে আপনার চক্ষুকর্ণের বিবাদ মিটাইতে পারি, তাহার ব্যবস্থা আমি ঠিক করিয়া রাখিব, আপনিও মানিকজীকে গ্রেপ্তার করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া যাইবেন বলিয়া আনয়ন অবগুন্ঠন টানিয়া দিল।
আমি বলিলাম, “তাহাই হইবে।”
পরক্ষণে হীরাবাঈ ঘরের বাহির হইয়া গেল।
হীরাবাঈ চোখের দৃষ্টির ভাবে আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম, পালনজীকে রক্ষা করিবার জন্য একটা কিছু গুরুতর মতলব তাহার মাথায় প্রবেশ করিয়াছে। নিজেকে বুদ্ধিমান বলিয়া আমার নিজের একটা খুব ধারণা ছিল, তাহার পর রবিবার দিন হীরাবাঈ-এর বাটীতে গিয়া যেরূপ দেখলাম, তাহাতে আমার সে ধারণা একেবারে তিরোহিত হইয়া গেল। বুঝিলাম, হীরাবাঈ-এর তুলনায় আমি একটা নির্বুদ্ধি। হীরাবাঈ সেদিন এরূপ ভাবে নিজের কার্য্যোদ্ধার করিল যে, তাহার কৌশলকে শতবার ধন্যবাদ দিতে হয়, এমন আমি আর কখনও দেখি নাই সেদিন যাহা দেখিলাম, তাহা আমার চিরকাল স্মরণ থাকিবে।