দশম পরিচ্ছেদ
রবিারের ঘটনা এইরূপ :–
আমি সন্ধ্যার পর হীরাবাঈ এর বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। একটি গলির মধ্যে–বড় রাস্তা হইতে তিন চারিখানা বাড়ীর পরেই হীরাবাঈ-এর বাড়ী। বাড়ীখানি ছোট—নীচে দুইটি ও উপরিতলে দুইটি মাত্র ঘর।
হীরাবাঈ ব্যগ্রভাবে আমার অপেক্ষা করিতেছিল। আমাকে দেখিয়াই সে তাড়াতাড়ি আসিয়া উপরের একটি ঘরে লইয়া গেল। ঘরের এক পার্শ্বে একখানা চেয়ার ছিল, আমি সেই চেয়ারখানা টানিয়া উপবেশন করিলাম।
হীরাবাঈ বলিল, “আপনার সেই হত্যাকারী এখনই আসিয়া উপস্থিত হইবে, আপনি প্রস্তুত হইয়া আসিয়াছেন ত?”
আমি তাহার প্রশ্নের উত্তরে পকেট হইতে এক জোড়া উজ্জ্বল হাতকড়ি বাহির করিয়া দেখাইলাম।
দেখিয়া হীরাবাঈ সন্তুষ্ট হইল। ক্ষণপরে বলিল, “পালনজী দায়রা সোপর্দ হইয়াছে।”
আমি বলিলাম, “হাঁ—তাহা ত হইবারই কথা। কিন্তু তিনি ত আত্ম-সমর্থনের কোন চেষ্টাই করিতেছেন না।”
হীরাবাঈ দৃঢ়স্বরে বলিল, “তাঁহাকে আর কিছুই করিতে হইবে না –আমি তাঁহার পক্ষ সমর্থন করিব। তাঁহার জন্য আমার আর কোন আশঙ্কা নাই, তিনি আমার বিপন্ন দাদাকে রক্ষা করিয়াছেন, আমিও তাঁহাকে এই বিপদ হইতে নিশ্চয় রক্ষা করিব।” বলিতে বলিতে কি এক আশ্চর্য্য দীপ্তিতে তাহার বিশালায়ত চক্ষুদ্বয় উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল।
আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “কিছু সন্ধান-সুলভ পাইয়াছ?”
হীরাবাঈ বলিল, “কিছু কি? —অনেক–অনেক। চুপ করুন –ঠিক হইয়াছে। একখানা গাড়ী আসিয়া বুঝি গলির মোড়ে এইমাত্র লাগিল। আপনার হত্যাকারী আসিয়াছেন এখন আপনি এক কাজ করুন এই পাশের ঘরে লুকাইয়া থাকুন, যখন আমি বাহিরে আসিবার জন্য আপনাকে ইঙ্গিত করিব বাহিরে আসিবেন।”
কি জানি কি খেয়াল হীরাবাঈ-এর মাথায় চাপিয়াছে—বুঝিতে পারিলাম না। কতকটা বিস্মিত, কতকটা বা চিন্তিতভাবে তাহার কথামত পাশের ঘরে ঢুকিলাম। পরক্ষণে বাহিরের সিঁড়ীতে কাহার উচ্চ পদশব্দ শুনিলাম। পদ-শব্দকারী শব্দ করিতে করিতে আমি যে ঘরে পূর্ব্বে বসিয়াছিলাম, সেই ঘরে প্রবেশ করিলেন। লোকটি কে?
তাহার পর যেরূপ শব্দ শুনিলাম, তাহাতে বুঝিতে পারিলাম, আমি পূর্ব্বে যে চেয়ারখানায় বসিয়াছিলাম তিনি সেইখানা অধিকার করিলেন। বসিয়া বলিলেন, “কি ব্যাপার হীরা, এ অধীনকে হঠাৎ স্মরণ হইল কেন?”
কন্ঠস্বর যেন পরিচিত কিন্তু বড় জড়ানো বোধহয়, দস্তুর মত মদের মুখে। হীরাবাঈ-এর কাণ্ডকারখানা দেখিয়া মনটা স্থির ছিল না—স্বরটা চেনা-চেনা ঠেকিলেও ঠিক ঠাওর করিতে পারিলাম না। হীরাবাঈ প্রত্যুত্তরে তাঁহাকে বলিল, “বড় দায়ে পড়িয়াই আপনার শরণ লইতে হইয়াছে। পালনজীর উদ্ধারের একটা উপায় আপনাকে করিতে হইবে। এ সময়ে আপনি সাহায্য না করিলে আর উপায় নাই।” আগন্তুক বিস্মিতভাবে বলিলেন, “আমি কিরূপে তোমাকে সাহায্য করিব, বুঝিতে পারিতেছি না। করা উচিত—কিন্তু কোন উপায় নাই—আমার ক্ষমতার বহির্ভূত।”
হীরাবাঈ কহিল, “আমার ত তাহা মনে হয় নায়—”
মধ্যপথে বাধা দিয়া আগন্তুক বলিলেন, “না, প্রিয়তমে না, ইহাতে আমার কোন হাত নাই।”
হীরাবাঈ বলিল, “আমি মুখেই আপনার প্রিয়তমা—যদি আপনি আমাকে আন্তরিক ভালবাসিতেন তাহা হইলে এমন একটা বিপদে উপকার করিতে কখনই কুণ্ঠিত হইতেন না।”
একটু উত্তেজিত কন্ঠে আগন্তুক বলিয়া উঠিলেন, “কি আশ্চর্য্য! তুমি কি আমাকে এমনই নির্ব্বোধ মনে করিয়াছ যে, আমি পালনজীকে উদ্ধার করিয়া তোমাদের বিবাহের পথটা পরিষ্কার করিয়া দিব শেষে তুমি পালনজীকে লইয়া সুখে ঘর-কন্না করিবে, আর আমি দূর হইতে তোমাদের মিলন-সুখ দেখিয়া কৃতার্থ হইব? কি ভ্রম! তা হয় না—প্রাণাধিকা হীরা, তা হয় না এমন নির্ব্বোধ এ জগতে কেহ নাই। আমি তোমাকে প্রাণের অধিক ভালবাসি কত ভালবাসি, তা কি জান না হীরা — আমি তোমাকে বিবাহ —”
বাধা দিয়া হীরাবাঈ কহিল, “এত শীঘ্র বিবাহ-প্রস্তাব করিলে লোকে বলিবে কি?”
জড়িত কণ্ঠে তিনি বলিলেন, “লোকের কথায় আমি কান দিই না হীরা— তোমাকে আমি বড় ভালবাসি–তোমাকে আমি–তোমাকে আমি মাথায় করিয়া রাখিব।”
এ শোক-তাপপূর্ণ জগতে এমন প্রেমিক লোকটাকে দেখিবার জন্য মনটা হঠাৎ বড় কৌতূহলী হইয়া উঠিল—আর থাকিতে পারিলাম না। আমি যে ঘরে লুক্কায়িত ছিলাম, সেই ঘরের কবাট একটু ফাঁক করিয়া দেখিলাম—যাহা দেখিলাম, তাহা আমাকে বিস্ময়বিহ্বল করিয়া তুলিল—লোকটা কি ভয়ানক! কন্ঠস্বর শুনিয়া পূৰ্ব্বেই একটা মোটামুটি অনুমান করিতে পারিয়াছিলাম, তাই রক্ষা, নতুবা সে বিস্ময় এখন দমন করা আমার সাধ্যাতীত হইত—হয়ত একটা অব্যক্ত চীৎকার নতুবা একটা কিছু করিয়া ফেলিতাম।
আগন্তুক মাণিকজী স্বয়ং।
একাদশ পরিচ্ছেদ
হীরাবাঈ সপরিহাসে কহিল, “আপনি না মানুষ? আপনার স্ত্রীর সেই অগাধ ভালবাসা এত শীঘ্ৰ কিরূপে বিস্মৃত হইলেন?”
মাণিকজী বলিলেন, “তাহার কথা ছাড়িয়া দাও হীরা– তাহার কথা ছাড়িয়া দাও — যে মরিয়াছে তাহার সকলই ফুরাইয়াছে। তবে আর এখন তাহার কথা কেন?”
হীরাবাঈ কহিল, “শুনিয়াছি, আপনি তাহাকে বড় ভালবাসিতেন।”
বাধা দিয়া মাণিকজী বলিয় উঠিলেন, “কস্মিনকালেও না—আমি একমাত্র তোমাকেই ভালবাসি; যে মুহূর্তে তোমায় দেখিয়াছি, সেই মুহূর্ত হইতে তোমাকে ভালবাসি। আমার স্ত্রী খুন হইয়াছে, সেই খুনের অপরাধে পালনজী কারাগারে আর কোন বাধাবিঘ্ন নাই, এখন আমি অনায়াসেই তোমাকে বিবাহ করিতে পারি।”
হীরাবাঈ বলিল, “তা পারেন, কিন্তু আপনি যেমন অনায়াসে আমাকে বিবাহ করিতে পারেন, আমি যে ঠিক তেমনই অনায়াসে পারিব, আপনি কিরূপে তাহা জানিলেন? ভাল কথা, যদি আমি আপনাকে বিবাহ করি, যদি আমি —”
মাণিকজী হো হো করিয়া অকারণ একটা বিকট হাসি হাসিয়া বলিলেন, “মন্দ নয়! বিবাহের প্রস্তাবের মুখেই একেবারে ‘যদি’ গণকে আনিয়া উপস্থিত করিলে। যদি তুমি আমায় বিবাহ কর কি? নিশ্চয় তুমি করিবে।” বলিয়া সবেগে উঠিয়া দাঁড়াইয়া হীরাবাঈ-এর হাত ধরিলেন।
হীরাবাঈ কোনরূপ চাঞ্চল্য প্রকাশ না করিয়া ধীরভাবে বলিল, “আমি আপনাকে বিবাহ করিলে, আপনি পালনজীর মুক্তির উপায় করিয়া দিবেন, বলুন?”
মাণিকজী বলিলেন, “না, তাহা আমি কিছুতেই পারিব না। তাহার বিরুদ্ধে যে সকল প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে—বড়ই সাংঘাতিক।”
হীরাবাঈ বলিল, “কিন্তু আপনি ত তাঁহাকে নিরপরাধ বলিয়া জানেন?”
মাণিকজী বলিলেন, “না-না এমন অন্যায় আমি জানিব কেন– আমার একান্ত বিশ্বাস, দস্যু পালনজীই আমার স্ত্রীকে খুন করিয়াছে।”
হীরাবাঈ এর চক্ষু জ্বলিয়া উঠিল। সে বলিল, “কি পাপিষ্ঠ! তোমার কি একান্ত বিশ্বাস, পালনজী তোমার স্ত্রীকে খুন করিয়াছেন?” বলিয়া সবেগে মাণিকজীর হাত হইতে নিজেকে মুক্ত করিয়া সরিয়া দাঁড়াইল। তাহার পর বস্ত্রাভ্যন্তর হইতে সেই পাথরের পুতুলটা বাহির করিয়া, মাণিকজীর নাসিকার নিকটে ধরিয়া বলিল, “পিশাচ! তুমি কি বলিতে চাও, যখন পালনজী তোমার স্ত্রীর বুকে ছুরিকাঘাত করেন, তখন তিনিই এই পাথরের পুতুলটা সেখানে ফেলিয়া আসিয়াছিলেন?”
মাণিকজী সেই পাথরের পুতুলটা দেখিয়া সভয়ে টলিতে টলিতে দুই পদ পশ্চাতে হটিয়া গিয়া বলিলেন, “না-না—তা আমি জানি না এ পাথরের পুতুল আমি পূৰ্ব্বে কখনও দেখি নাই।”
হীরাবাঈ তীব্রকন্ঠে বলিয়া উঠিল, “নরাধম! এখনও অস্বীকার করিতেছ, এখনও স্মরণ করিয়া দেখ–মনে পড়ে, যেদিন তোমার স্ত্রী খুন হয়, সেইদিন তুমি এই সহরে ডাক্তার তোরাবজী ম্যাকনজীর বাড়ীতে সান্ধ্য-সম্মেলনে যোগ দিতে আসিয়াছিলেন? মনে পড়ে, সেইখানে সেই রাত্রে ডাক্তার তোরাবজীর সিলোন হইতে প্রত্যাগত এক বন্ধুও উপস্থিত ছিলেন? মনে পড়ে তাঁহার নিকট হইতে কে এই পাথরের পুতুলটা তকন চাহিয়া লইয়াছিল?”
মাণিকজী বলিলেন, “আমিই লইয়াছিলাম, তাহাতে হইয়াছে কি?”
হীরাবাঈ উচ্চকন্ঠে বলিয়া উডিল, “মুর্খ! যাহা হইয়াছে বলিতেছি। এই পুতুলটা তখন তুমি তাঁহার নিকট হইতে লইয়া পকেটে রাখিয়া দাও, তাহার পর তোমার মাথায় একটা বিকট খেয়াল চাপায়, তুমি সেখান হইতে সকলের অজ্ঞাতসারে সরিয়া পড়িয়া পুনরায় বেন্দোরাতে যাইয়া উপস্থিত হও। নিজের বাড়ীতে গিয়া তোমার স্ত্রীর সহিত দেখা কর। তাহার পর তুমি পশুর মত—পশুতেও এমন নৃশংস কাজ করে না তুমি তোমার সেই সরলা স্ত্রীকে খুন কর; দেরাজ হইতে বাকী টাকা বাহির করিয়া লও; গৃহ-সামগ্রী তছরূপ কর, কাজ শেষ করিয়া পুনরায় ডাক্তার তোরাবজীর বাড়ীতে আসিয়া সান্ধ্য-সম্মেলনে যোগ দাও। কিন্তু যখন তুমি তোমার সেই হতভাগিনী স্ত্রীকে খুন কর, তখন যে এই পাথরের পুতুলটা, তোমার পাপের যথোচিত দণ্ডবিধান করিবার জন্য তোমার বুকপকেট হইতে পড়িয়া গিয়াছিল, তাহা জানিতে পার নাই। আর রক্ষা নাই, এখন পিশাচ, নিজের পাপের সমুচিত প্রায়শ্চিত্ত করিবার জন্য প্রস্তুত হও। বলিতে বলিতে হীরাবাঈ রোষদীপ্ত নেত্রে সেই পাথরের পুতুলটা সম্মুখে তুলিয়া ধরিয়া ধীরে ধীরে মাণিকজীর দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল। মাণিকজীও সেই ভয়ঙ্করী মূর্তি দেখিয়া সভয়ে ক্রমশঃ পশ্চাতে হটিয়া আসিতে লাগিলেন।
আমি যেখানে দাঁড়াইয়াছিলাম, ক্ৰমে মাণিকজী সেইখানে আসিয়া পড়িলেন। এখন সুযোগ ত্যাগ করা উচিত নয় মনে করিয়া আমি গুপ্তস্থান হইতে বাহির হইয়া পশ্চাদ্দিক হইতে তাঁহাকে চাপিয়া ধরিলাম। পলাইবার চেষ্টায় তিনি বল প্রকাশ করিতে লাগিলেন। তাঁহার সে চেষ্টা বৃথা হইল—খানিকটা ধস্তাধস্তির পর এক জোড়া সুচিক্কণ অয়ঙ্কঙ্কণে তাঁহার উভয় হস্তের মণিবন্ধ সুশোভিত হইল।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
গৃহতলে লুটাইতে লুটাইতে মাণিকজী উচ্চকণ্ঠে চীৎকার করিয়া উঠিল, “মিথ্যা কথা আমি ইহার কিছুই জানি না ভয়ানক মিথ্যা কথা।”
আমিও তাহার অপেক্ষা দুই তিন পর্দা উচ্চসুরে হাঁকিয়া বলিয়া উঠিলাম, “আগাগোড়া সত্য, সত্য হইলেও তোমার পক্ষে ভয়ানক। পাপিষ্ঠ! এখন আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি, তুমি নিজেই স্ত্রীহন্তা। চুপ কর, চীৎকার করিলেই মরিবে।” বলিয়া পকেট হইতে পিস্তল বাহির করিলাম।
যখন আমি মাণিকজীকে আক্রমণ করি, সেই সময়ে তাহার বুকপকেট হইতে তাহার পকেটবুকখানা পড়িয়া গিয়াছিল, এবং তন্মধ্য হইতে কতকগুলো কাগজ-পত্র গৃহতলে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। সেই সকল ছড়ান কাগজপত্র হইতে হীরাবাঈ একখানা শুষ্করক্তের দাগ লাগা কাগজ তাড়াতাড়ি তুলিয়া লইয়া দেখিতে দেখিতে বলিল, “এই সেই চিঠি, পালনজী মিথ্যাবাদী নহেন। মাণিকজী স্ত্রীর নামে এই চিঠি লিখিয়া পালনজীকে টাকা আনিতে পাঠাইয়াছিলেন। এই ত ইহাতে সেই পাঁচ শত টাকার উল্লেখ রহিয়াছে, দেখিতেছি।”
মাণিকজী বুঝিতে পারিল, চারিদিক হইতে সে অত্যন্ত কঠিন ভাবে জড়াইয়া পড়িতেছে, অস্বীকার করিয়া আর কোন লাভ নাই। তখন সে ভগ্নকণ্ঠে বলিতে লাগিল, “হায়। এত চেষ্টা সব ব্যর্থ হইয়া গেল। হাঁ হীরা, আমিই মিরিয়মকে খুন করিয়াছি। করিয়াছি — তেমাারই জন্য; তোমারই জন্য আমি স্ত্রীহন্তা। তোমায় ভালবাসিয়া আমার সব গেল, আমিও মরিতে বসিয়াছি। আমার স্ত্রী আমার চক্ষুঃশূল ছিল কেবল তাহার পৈতৃক সম্পত্তির লোভে আমি তাহাকে বিবাহ করিয়াছিলাম, অর্থলোভে জোর করিয়া মুখে ভালবাসা দেখাইতাম, পালনজী তোমার প্রেমাকাঙ্ক্ষী। মনে করিয়াছিলাম, এক শরে দুই পাখী মারিব, তাহা ত হইল না। মানুষ গড়ে বিধাতা ভাঙে; মনের আশা মনেই রহিয়া গেল। পালনজী যখন টাকা চায়, তখনই আমার মাথায় এই এক-ঢিল দুই-পাখী মারিবার মতলবটা উপস্থিত হয়। আমি পালনজীকে ওই পত্রখানা লিখিয়া দিয়া ডাক্তার তোরাবজীর বাড়ীতে চলিয়া যাই। সেইখানে দুইচারিজনের সহিত দেখা সাক্ষাৎ করিয়া পুনরায় নিজের বাড়ীতে চলিয়া আসি। আসিয়া আমার স্ত্রীর মুখে শুনিলাম, পালনজী তাহার নিকট হইতে টাকা লইয়া গিয়াছে। আর যায় কোথা, এমন সুযোগ কি ত্যাগ করা যায়, আমি দেরাজেরভিতর ঘরের জিনিষ পত্র সমুদয় তছরূপ করিলাম, দেরাজের ভিতরকার জিনিষগুলোও তছরূপ করিয়া রাখিলাম দেখিলে যাহাতে সহজে লোকের মনে ধারণা হয়, খুন একটা চুরি-ডাকাতি হইয়া গিয়াছে, ঘরটা এরূপ ভাবে বিপর্যস্ত করিয়া ফেলিলাম। ঘন্টাখানেকের মধ্যে সব কাজ শেষ করিয়া পুনরায় ডাক্তার তেরাবজীর বাড়ীতে গিয়া সান্ধ্যসম্মেলনীতে যোগ দিলাম। তেরাবাজীও আমার প্রতি কোন সন্দেহ করিতে পারিলেন না; তিনি মনে করিলেন, সেইখানে তাঁহারই বাড়ীতে কোথাও আমি ছিলাম। আমি নিজের নিদোষতা সপ্রমাণ করিবার জন্য বেশ আটঘাট বাঁধিয়া রাখিয়াছিলাম; কিন্তু এই পত্রখানা পকেটে না তুলিয়া তখনই যদি পুড়াইয়া ফেলিতাম আর এই পাথরের পুতুলটা যদি আমার অজ্ঞাতসারে বুকপকেট হইতে না পড়িয়া যাইত তাহা হইলে আমাকে আর পায় কে? অনায়াসে পালনজীকে ফাঁসীর দড়ীতে ঝুলাইয়া, তোমার অতুল সৌন্দর্য্য উপভোগ করিতে পারিতাম। হায়! ঐ পাথরের নির্জীব পুতুলটা আমার সকল সাধে বাদ সাধিল।”
আমি হীরাবাঈ এর মুখের দিকে প্রশংসমান নেত্রে চাহিয়া বলিলাম, “তুমি যে উদ্দেশ্যে ফাঁদ পাতিয়াছিলে, তাহা সফল হইয়াছে; এখন বল দেখি, কিরূপে তুমি জানিতে পারিলে, মাণিকজী নিজে তাঁহার স্ত্রীর হত্যাকারী?”
হীরাবাঈ বলিল, “আপনি যখন সেদিন আপনার বাড়ীতে আমার কাছে এই পাথরের পুতুলটার কথা উত্থাপন করেন, তখনই আমার মনে কেমন একটা খটকা লাগে; সেইজন্যই আমি তখন আপনার নিকট হইতে এই পুতুলটা চাহিয়া লই। আপনার মুখ হইতে যেরূপ শুনিলাম, তাহাতে আমি অনেকটা অনুমান করিয়া লইতে পারিলাম যে, মাণিকজী এই খুন-রহস্যের মধ্যে কিছু-না-কিছু ভাবে জড়িত আছেই। আপনি বলিয়াছেন, সেই খুনের রাত্রে মাণিকজী এখানে ডাক্তার তোরাবজীর বাড়ীতে আসিয়াছিলেন। আমি তাঁহাকে জানি, তাঁহারই চিকিৎসায় আমি একবার দুরারোগ্য কঠিন রোগ হইতে রক্ষা পাই। তিনি আমাকে নিজের সহোদরের ন্যায় স্নেহ করেন। আমি সেইদিনই বৈকালে তাঁহার সহিত দেখা করিলাম। পাথরের পুতুলটা দেখাইলাম। তিনি দেখিয়াই চিনিতে পারিলেন; বলিলেন, সন্ধ্যা-সম্মেলনীর রাত্রে তাঁহারই একজন বন্ধু মাণিকজীকে এই পাথরের পুতুলটা দিয়াছিলেন; আমি ডাক্তার মহাশয়ের সেই বন্ধুর ঠিকানা জানিয়া লইয়া গিয়া তাঁহার সহিত দেখা করিলাম। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করায় তিনিও বলিলেন, মাণিকজী তাঁহার নিকটেই এই পুতুলটা চাহিয়া লইয়াছিল। আমার সন্দেহ ঘুচিল—মানিকজীকে খুনী বলিয়া বুঝিতে পারিলাম; মাণিকজীকে এখানে আসিবার জন্য পত্র লিখিলাম। তাহার পর যাহা ঘটিয়াছে সমুদয় আপনি জানেন, আর কি জানিবার আছে, মাণিকজী যে দোষী, তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ তাহারই স্বহস্তলিখিত এই পত্র, আর অপরাধী নিজের অপরাধ নিজমুখেই এখন স্বীকার করিতেছে। আপনি যাহা বলিয়াছেন তাহা ঠিক, এই পাথরের পুতুলটা আপনার নিকট হইতে না পাইলে আমি কখনই মাণিকজীকে এত সহজে হত্যাকারী বলিয়া সপ্রমাণ করিয়া পালনজীকে মৃত্যুমুখ হইতে কিছুতেই রক্ষা করিতে পারিতাম না।
আমি বলিলাম, “তাহা ঠিক, কিন্তু দৈবের সহায়তা ভিন্ন এত শীঘ্র কার্য্যোদ্ধার হইত না। যদি দৈবক্রমে খুন করিবার সময় এই পাথরের পুতুলটা মাণিকজীর অজ্ঞাতসারে পকেট হইতে না পড়িয়া যাইত, তাহা হইলে হয় ত আজ ‘উদোর বোঝা বুদোর ঘাড়ে’লইয়া পালনজীকে ফাঁসীকাঠে ঝুলিতে হইত। আমার মতে শতকরা নব্বই এরূপ মোকদ্দমা দৈবের সহায়তায় নিরাকরণ হইয়া থাকে।”
মাণিকজী বলিল, “আমাকে আর কেন ধরাশয্যায় রাখিয়া কষ্ট দিতেছেন, আমার গন্তব্য স্থানে আমাকে লইয়া চলুন।”
অনন্তর আমি মাণিকজীকে লইয়া হাজতে পুরিলাম। পালনজী মুক্তি পাইলেন। বিচারে মাণিকজীর প্রতি প্রাণদণ্ডাজ্ঞা হইল।
হতভাগ্য ফাঁসীর রজ্জুতে স্বকৃত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিল।
হীরাবাঈ এখন সচ্চরিত্র পালনজীর পরিণীতা পত্নী। আর এই পাথরের পুতুল—আমি সেই মোকদ্দমার স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ রাখিয়া দিয়াছি।