ছদ্মবেশী – ১

ছদ্মবেশী 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

সালসতী দ্বীপের বেন্দোরাতে আরব-সমুদ্র পার্শ্বস্থ পাহাড়ের উপর একখানি সুন্দর বাড়ীতে মাণিকজী পৈয়ানজী নামে এক পার্শী যুবক সপরিবারে বাস করিতেন। তাঁহার সেই সুন্দর গৃহখানিতে তাঁহার গৃহলক্ষ্মী মিরিয়ন বাঈও বড় সুন্দরী ছিলেন। যে বাড়ীখানির কথা বলিতেছি, তাহার পশ্চিম প্রান্তে তরঙ্গোচ্ছ্বাসিত ফেনিল আরব-সাগর দিগন্তবিস্তৃত এবং উত্তর ও পূর্বে তাল ও নারিকেল বৃক্ষশ্রেণীর অপূর্ব শোভা। এই সকল প্রাকৃতিক দৃশ্য ও সৌন্দর্য্যের মধ্যে বাড়ীখানিকে আরও সুরম্য দেখাইত। এই বাড়ীখানি তিন বৎসর পূর্ব্বে মিরিয়মেরই পিতৃগৃহ ছিল। 

প্রতিদিন অপরাহ্নে এই নব দম্পতি তাঁহাদিগের বাটীর পশ্চিমদিককার বারান্দায় বসিয়া প্রচুর কৌতুকহাস্যের সহিত পরমপ্রসন্নমনে দিগন্তপ্রসারিত আরবসমুদ্রবক্ষে বিচিত্র তরঙ্গলীলা দেখিতেন। কখনও উভয়ে দৃষ্টির সীমান্ত রেখায় যেখানে সুনীল সমুদ্রের সহিত নীল আকাশ অগাধ সৌন্দৰ্য্য ঢালিয়া মৃদুমধুর চুম্বনে পরস্পর প্রেমালিঙ্গন পাশে বদ্ধ, সেইদিকে অনিমেষলোচনে চাহিয়া থাকিতেন। তাহার পর রবি আকাশ-বক্ষঃ বাহিয়া খেলা শেষে শ্রান্ত শিশুটির মত পরপারের দিগন্ত-বেলায় সেই বিহ্বল মিলনের মধ্যে ঢলিয়া পড়িলে কনকলাবণ্যে যখন নিখিল বিশ্ব ভরিয়া উঠিত, এবং সমুদ্রের চঞ্চল বক্ষে আর তটে সেই কোমল পেলব স্বর্ণছায়া স্বর্ণাস্তরণের ন্যায় প্রসারিত হইয়া পড়িলে তটাহত তরঙ্গ বারংবার তাহার উপরে যখন আছড়াইয়া গড়াইয়া অগাধ বারিরাশিতে লীন হইয়া যাইত, তখনকার সেই মনোহর মহান দৃশ্য এই নব দম্পতির ঐকান্তিক মনোযোগ আকর্ষণ করিত। তাঁহার পর যখন পশ্চিমাকাশের বর্ণবিচিত্র সেই কোমলোজ্জ্বল হেমদীপ্তির উপরে মলিনবসনা সন্ধ্যা ধীরে ধীরে তাহারধূসর যবনিকা টানিয়া দিত, তখনও আবার এই দম্পতি স্বপ্নাবিষ্টের ন্যায় সেই দিকেই চাহিয়া থাকিতেন। বারান্দার সম্মুখস্থ পথিমধ্য হইতে পথিকেরা পথ চলিতে চলিতে সাগ্রহনেত্রে এই দম্পতির যুগলমিলন দেখিয়া নেত্রের সার্থকতা সম্পাদন করিত, এবং মনে করিত, এইরূপ মিলনই সকলের একান্ত প্রার্থনীয়। এমন কি তদুভয়ের এই প্রণয়ের গভীরতা সম্বন্ধে প্রতিবেশীরা অনেক ক্ষুদ্র গল্প ও ছড়া রচনা না করিয়া ক্ষান্ত থাকিতে পারে নাই। প্রণয়প্রসঙ্গে কোথায় কিছু অভাব পরিলক্ষিত হইলে প্রতিবেশীরা স্ত্রী পুরুষে সর্ব্বাগ্রে মাণিকজী ও মিরিয়মের তুলনা দিত। 

এমন সুখের সংসারে একদিন বিধাতার চক্রে আগুন লাগিয়া গেল। এবং আগুনটা কোন্ দিক হইতে লাগিল সেইটি দেখিবার ভার আমার উপরেই পড়িয়াছিল। 

একদিন প্রাতে অত্যন্ত বিস্ময়ের সহিত শুনিলাম, সুন্দরী মিরিয়ম বাঈ খুন হইয়াছে। সংবাদ পাইবামাত্র আমি অবিলম্বে বেন্দোরাতে মাণিকজীর গৃহে উপস্থিত হইলাম। তখন বেলা দশটা। 

শয়ন কক্ষে মিরিয়ম বাঈ নিহত হইয়াছে। দেখিলাম, তাহার রক্তাক্ত মৃতদেহ তখনও রক্তপ্লাবিত গৃহতলে পড়িয়া রহিয়াছে। ছুরিকাঘাতে বক্ষঃস্থল দ্বিধা বিদীর্ণ হইয়া গিয়াছে, আর সেই ক্ষতমুখে চাপ্‌ চাপ্ রক্ত জমাট বাঁধিয়াছে। এবং উন্মুক্ত বিপুল কেশদাম রক্তে একেবারে ডুবিয়া গিয়াছে। অনিন্দ্যসুন্দরী মিরিয়মের সেই পরিপূর্ণ বিমল সৌন্দর্য রক্ত-বিভীষিকায় এরূপ আচ্ছন্ন করিয়াছে যে, দ্বিতীয়বার সেদিকে চাহিতে ইচ্ছা করে না। আমার পৌঁছিবার অনতিবিলম্বে লাস সেখান হইতে চালান দেওয়া হইল। 

কক্ষটিতে দৃষ্টিক্ষেপমাত্র বেশ বুঝিতে পারা যায়, হত্যাকারী সহজে মিরিয়ম বাঈকে খুন করিতে পারে নাই। ইহার জন্য তাহাকে সাধ্যানুসারে বলপ্রয়োগ করিতে হইয়াছিল। এবং শিকার ও শিকারী উভয়ের মধ্যে একটা ক্ষুদ্র যুদ্ধও সংঘটিত হইয়াছিল। নতুবা গৃহ-সামগ্রী এরূপভাবে তছরূপ হইবার কারণ কি? বিছানার আস্তরণখানার অর্দ্ধাংশ গৃহতলে লুটাইতেছে। একখানা সোফা ও দুইখানা চেয়ার একেবারে উল্টাইয়া পড়িয়াছে, এবং দুই-তিনখানা ছবি গৃহ-প্রাচীর ছাড়িয়া গৃহতলে ভগ্নাবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে। এই সকলের মধ্যে একটা জিনিষ কোন কারণে আমার বড় মনোযোগ আকর্ষণ করিল—সেটি একটি পাথরের ছোট পুতুল, ঠিক মৃতদেহের পার্শ্বেই পড়িয়াছিল। আমি সেটা যত্নপূর্ব্বক নিজের পকেটস্থ করিলাম। 

যেরূপ দেখিলাম, তাহাতে স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে যে, মিরিয়ম বাঈ খুনীর ছুরি হইতে আত্মরক্ষার্থে অনেক চেষ্টা করিয়াও নিষ্কৃতি লাভ করিতে পারে নাই। একান্ত অসহায় অবস্থায় তাহাকে অকালে জীবন-লীলা সম্বরণ করিতে হইয়াছে। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

প্রথমে আমি এই খুনটার কারণ কিছুই খুঁজিয়া পাইলাম না। মিরিয়ম বাঈ নিজের সারল্যে সৌন্দর্য্যে ও মিষ্ট বাক্যে সেখানকার পরিচিত মাত্রেই স্নেহ আকর্ষণ করিয়াছিল। সকলেই তাহাকে ভালবাসিত, এমন কি একজনও তাহার শত্রু ছিল না। এরূপ স্থলে এমন একটা হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হইবে, ইহা সকলের পক্ষে স্বপ্নের অগোচরীভূত। ক্রমে সাভিনিবেশ অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম, কক্ষের দক্ষিণ পার্শ্বে যে একটি দেরাজ ছিল, সেই দেরাজের দুই-তিনটি ড্রয়ারের চাবি ভাঙা এবং তাহার ভিতরকার জিনিষগুলি সব বিশৃঙ্খলভাবে বিক্ষিপ্ত রহিয়াছে। আমি তখনই মানিকজীকে সে সংবাদ দিলাম। তিনি দেখিয়া-শুনিয়া বলিলেন, তাঁহার দুই হাজার টাকা তন্মধ্য হইতে অন্তর্হিত হইয়াছে। তাঁহার মুখে দুই হাজার টাকা অন্তর্দ্ধানের কথা শুনিয়া বুঝিতে পারিলাম, এই চুরিই খুনের একমাত্র কারণ। চোর চুরির মতলবে গৃহে প্রবেশ করিলে মিরিয়ম বাঈ তাহার উদ্দেশ্যের অন্তরায় হইয়াছিলেন; অগত্যা চোর তাঁহাকে খুন করিয়া স্বকার্য্য সাধনপূর্ব্বক স্বস্থানে প্রস্থান করিয়াছেন। 

আরও ভাবিয়া দেখিলাম, চোরটা ঘর সন্ধানী—ইহাদের পরিচিতই হইবে, ইহাদের ঘর-সংসারের সকল সংবাদই সে রাখে। সে পূর্ব হইতেই সন্ধান রাখিয়াছিল যে, মাণিকজীকে কোন কারণে সহরে যাইতে হইবে—রাত্রে বাড়ী ফিরিবেন না, এবং দাস দাসী দুইজনও সেদিন কাহাদের বিবাহোৎসবে যোগ দিতে বাহিরে যাইবে, ফিরিতে অনেক রাত্রি হইবে। এই সকল সন্ধান-সুলুক লইয়া চোর যথাসময়ে গৃহে প্রবেশ করিয়া, ঘটনাক্রমে হত্যাকারীতে পরিণত হইয়া পলায়ন করিয়াছে। শেষ রাত্রে প্রথমে সেই ভৃত্য ও পরিচারিকা দুইজনে বাড়ী ফিরিয়া আসে। তাহারই প্রথমে এই খুনের কথা জানিতে পারিয়া গোলমাল করে। অতি প্রত্যূষে মাণিকজী সহর হইতে ফিরিয়া আসিয়া দেখেন, তাঁহার গৃহপ্রাঙ্গণে লোকারণ্য পুলিশ আসিয়া বাড়ী অধিকার করিয়াছে ভৃত্য ও পরিচারিকা চীৎকার করিয়া কাঁদিতেছে। এবং তাঁহার প্রিয়তমা স্ত্রী মিরিয়ম বাঈ আর এ জগতে নাই। 

আমি প্রথমে ভৃত্য ও পরিচারিকাকে এই খুন সম্বন্ধে একে একে অনেক প্রশ্ন করিলাম। বিশেষ কোন ফল লাভ করিতে পারিলাম না। তাহাদের মুখে এমন কিছুই শুনিলাম না, যাহাতে সেই খুনী আসামীকে গ্রেপ্তার করিবার কোন সুগম পন্থা আবিষ্কার করিতে পারি। 

ভৃত্য বলিল, কাল সন্ধ্যার পূর্ব্বে সে বাড়ী ত্যাগ করে, শেষ রাত্রে বাড়ী ফিরিয়া আসে। তাহার সঙ্গে পরিচারিকাও আসিয়াছিল। প্রথমে সে তেমন সময়ে বাড়ীর পশ্চাদ্দার খোলা দেখিয়া বিস্মিত হয়, তখনই সে পরিচারিকাকে সঙ্গে লইয়া গৃহকর্ত্রীকে ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করিতে উপরিতলে যায়। সেখানে গিয়া দেখে, কর্ত্রীর শয়ন কক্ষের দ্বার উন্মুক্ত—সেই উন্মুক্ত দ্বারের পার্শ্বে তাহার মনিব-পত্নীর রক্তাক্ত দেহ পতিত। তখনই সে স্থানীয় পুলিসে খবর দেয়। তাহার মনিব ও মনিব-পত্নীর মধ্যে যথেষ্ট প্রণয় ছিল; তাহাদের প্রতি কাহারও কোন শত্রুতা ছিল না। 

পরিচারিকা যাহা বলিল, তাহা ভৃত্যেরই জবানবন্দীর পুনরাবৃত্তি মাত্র। নূতন কথা কিছুই পাইলাম না। আর হতভাগ্য মাণিকজী বেমানজী! তাহাকে তখন যেরূপ শোকাকুল দেকিলাম, তাহাতে তাঁহাকে তখন কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতেই আমার সাহস হইল না। সেরূপ অবস্থায় তিনি যে আমার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর করিতে পারিবেন, এরূপ আশাও আমার মনে স্থান পাইল না। তথাপি কয়েকটি কথা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা না করিলে নয়; আমি তাঁহাকে আমার অভিপ্রায় জ্ঞাপন করিয়া ভৃত্যের দ্বারা সংবাদ-পাঠাইলাম। আমি তখন তাঁহার শয়ন-কক্ষেই (যেখানে মিরিয়মের মৃতদেহ ছিল) বসিয়াছিলাম। তিনি আসিলে আমি তাঁহার শোকে যথেষ্ট সহানুভূতি প্রকাশ করিয়া সান্ত্বনা বাক্য প্রয়োগ করিতে লাগিলাম। উহারই মধ্যে তাঁহাকে একটু প্রকৃতিস্থ হইতে দেখিয়া যতদূর সম্ভব বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি এই দারুণ দুর্ঘটনা সম্বন্ধে কোন কথা আমাকে বলিতে পারেন কি? যেরূপ ব্যাপার দেখিতেছেন, তাহাতে আপনি কি বুঝিতেছেন?” 

মাণিকজী বলিলেন, “এ ঘরে নয়, এখানে আমি কিছুতেই তিষ্ঠিতে পারিতেছি না – অন্য ঘরে চলুন – অন্য ঘরে চলুন ।” বলিতে বলিতে ঘর হইতে বাহির হইয়া পড়িলেন। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

আমরা উভয়ে অন্য একটা ঘরে গিয়া বসিলাম। মাণিকজী বলিলেন, “কিছুই ত বুঝিতে পারিতেছি না। সকলই যেন স্বপ্নের মত বোধ হইতেছে—অগ্নিদেব করুণ ― যেন তাহাই হয়—তাহাই হয়।” এই বলিয়া তিনি নিতান্ত ব্যাকুল ভাবে দুই হস্তে দুই চক্ষু আবৃত করিলেন। 

আমি বলিলাম, “আপনি যদি এখন এমন অধীর হইয়া পড়েন, তাহা হইলে সকল দিক নষ্ট হইয়া যায় —এখন আপনার কর্ত্তব্য কি, তাহা অবশ্যই আপনি জানেন।” 

 মাণিকজী বলিলেন, “জানি—হত্যাকারীর যথোপযুক্ত দণ্ড বিধান করা—কিন্তু আজ যাহাকে হারাইলাম, তাহাকে কি আর এ জীবনে খুঁজিয়া পাইব! কাল রাত্রে আমাকে সহরে যাইতে হয়। সেখানে আমার এক বন্ধুর বাড়ীতে অভিনয় দর্শনের নিমন্ত্রণ ছিল। সন্ধ্যার পর আমি বাড়ী হইতে বাহির হই। আমি যে, রাত্রে বাড়ীতে ফিরিতে পারিব না, যাইবার সময়ে সে কথা আমার স্ত্রীকে বলিয়া যাই। হায়! সেই দেখাই তাহার সহিত শেষ দেখা বলিতে বলিতে মাণিকজীর কন্ঠরোধ হইল। একান্ত হতাশভাবে দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া বালকের ন্যায় কাঁদিতে লাগিলেন। ক্ষণপরে জড়িতকণ্ঠে বলিলেন, “যেরূপ ব্যাপার দেখিতেছেন, তাহাতে আপনি কি অনুমান করেন?” 

আমি বলিলাম, “যেরূপ দেখিতেছি, তাহাতে আমার, বিশ্বাস চুরিই—” 

সহসা বাধা দিয়া উত্তেজিত ভাবে মাণিকজী বলিলেন “চুরি? চুরিই যে প্রধান উদ্দেশ্য, তাহার আর সন্দেহ কি? কাল দেরাজের ভিতরে আমার দুই হাজার টাকা মজুত ছিল।” 

“সমুদয়ই কি নোট?” 

“হাঁ, বিশখানি একশত টাকার নোট।” 

“সে নোটগুলি যে চুরিই গিয়াছে, তাহা আপনি বেশ বুঝিতে পারিতেছেন?” 

“যখন দেরাজটা এরূপ ভগ্নাবস্থায় পড়িয়া থাকিতে দেখিতেছি—অথচ সেই দুই হাজার টাকার কোন সন্ধান হইতেছে না, তখন চুরি ভিন্ন আর কি মনে হইতে পারে?” 

“আপনি যে দুই হাজার টাকার নোট এই দেরাজের ভিতরে রাখিয়াছিলেন, তাহা আর কেহ জানিত?”

“কেহ না, কেবল আমার স্ত্রী জানিতেন, আর • আর –” বলিতে বলিতে সহসা মধ্যপথে থামিয়া গেলেন। একটু পরেই চক্ষু ও ললাট কুঞ্চিত করিয়া একান্ত চিন্তিতভাবে বলিয়া উঠিলেন, “না, তাহা একেবারেই অসম্ভব!” 

“কি অসম্ভব? আপনি কোন কথা আমার নিকটে গোপন করিবেন না; ঐ সকল ব্যাপারে অনেক সম্ভব অসম্ভবে, অনেক অসম্ভব সম্ভবে পরিণত হয়। আপনি সকল কথা আমাকে খুলিয়া বলুন। আপনার যাহা কৰ্ত্তব্য, তাহা কি আমাকে বারংবার স্মরণ করিয়া দিতে হইবে?” 

“পরে বলিতেছি, আগে আমি জানিতে চাই, আপনি কিরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন।” 

আমি বিরক্তভাবে বলিলাম, “আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা মিক্সপেনি ডিটেকটিভ ষ্টেরিতে বেশ মানায়। এমন কোন ডিটেকটিভ দেখি না, যিনি এমন একটা খুনের কেসে এত অল্প সময়ের মধ্যে একটা কোন অভ্রান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারেন। তবে যেরূপ দেখিতেছি, তাহাতে বেশ বুঝিতে পারা যায়, যে খুন করিয়াছে, সে নিশ্চয়ই এই দুইটি সংবাদ পূৰ্ব্ব হইতেই অবগত ছিল যে, কাল রাত্রে আপনার স্ত্রী একাকিনী থাকিবেন, আর আপনার এই দেরাজের মধ্যে সেই দুই হাজার টাকা মজুত আছে। আপনি আর কাহারও কাছে, এ সম্বন্ধে কোন কথা বলেন নাই কি?” 

আমার এই প্রশ্নে এবার মাণিকজীকে আরও চিন্তিত দেখিলাম। অবশেষে গৃহের চারিদিকে একবার শূন্য দৃষ্টি সঞ্চালন করিয়া বলিলেন, “একজন নির্দোষী ভদ্রলোককে এই বিপদের মধ্যে টানিয়া আনা আমি যুক্তিযুক্ত বোধ করি না। একজনের নিকটে আমি কোন কারণে একথা বলিয়াছিলাম, তিনি আমার একজন পরম বন্ধু, তাঁহার নামক পালনজী পেষ্টনজী। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি পালনজীকে এ কথা বলিয়াছিলেন কেন?” 

মাণিকজী বলিলেন, “বলিবার কারণ আছে। কাল সন্ধ্যার পর সহরে যাইবার জন্য আমি বেন্দোরা ষ্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষা করিতেছিলাম। সেই সময়ে সেইখানে পালনজীর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। আমাকে দেখিয়াই তিনি বলিলেন, আমার সঙ্গে দেখা করিবার জন্যই তিনি আমার বাড়ীতে যাইতেছিলেন; ঘটনাক্রমে ষ্টেশনেই দেখা হইয়া গিয়াছে। আমি তাঁহাকে সে সময়ে বড়ই উদ্বিগ্ন দেখিলাম। তিনি ব্যগ্রভাবে আমার কাছে পাঁচশত টাকা কর্জ চাহিলেন। উপস্থিত রাত্রিটা আমি তাঁহাকে অপেক্ষা করিতে বলিয়া বলিলাম, বাড়ীতে আমার দেরাজেই দুই হাজার টাকা মজুত আছে, প্রাতেই তাঁহাকে অনায়াসে পাঁচশত টাকা দিতে পারিব। কিন্তু তিনি তাহা শুনিলেন না, টাকার জন্য বড়ই পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলেন। ষ্টেশন হইতে আমার বাড়ী এক ক্রোশের কম নহে, টাকার জন্য তখন বাড়ী ফিরিয়া যাইতে হইলে এদিকে আমার বিলম্ব হইয়া যায়। তাহাও আমি তাঁহাকে বুঝাইয়া বলিলাম। তাহাতে তিনি আমার চিঠি লইয়া নিজেই আমার বাড়ীতে যাইতে চাহিলেন। তাহাতেও তাঁহাকে নিরাশ হইতে হইল; আমি তাঁহাকে বলিলাম, তিনি তখন আমার বাড়ীতে গেলেও টাকা পাইবেন না; কারণ বাড়ীতে কেহই নাই।” 

তিনি বলিলেন, “কেন আপনার স্ত্রী’ত বাড়ীতে আছেন।” 

মাণিকজী বলিলেন, “আমি রাত্রে বাড়ী ফিরিতে পারিব না, শুনিয়া আমার স্ত্রী কাল রাত্রে তাঁহার কোন এক সখীর বাড়ী যাইবেন, বলিয়াছিলেন। তাহাতেই আমি মনে করিয়াছিলাম, আমার চিঠি লইয়া গেলেও তাঁহার টাকা পাইবার সম্ভাবনা নাই। হায়! রাত্রে যদি আমার স্ত্রী সেখানে যাইতেন, তাহা হইলে আজ আর আমার এমন সর্ব্বনাশ ঘটিত না! কেবল এই দুই হাজার টাকা আজ চুরি গেলে আমি বিশেষ ক্ষতিবোধ করিতাম না।” 

আমি বলিলাম, “উতলা হইবেন না, এখন শোক প্রকাশের সময় নহে। আপনার কথা শুনিয়া পালনজী কি বলিলেন?” 

মাণিকজী বলিলেন, “আমার কথায় তিনি দুঃখ প্রকাশ করিয়া আমার বন্ধুত্বের উপরে বারংবার দোষারোপ করিতে লাগিলেন। যাইবার সময় বলিয়া গেলেন, আজ রাত্রের মধ্যে যেরূপে হউক, তাঁহাকে পাঁশশত টাকা সংগ্রহ করিতেই হইবে। তাহা বলিলেও তিনি যে টাকার জন্য তাঁহাকে আমি ভাল রকমই জানি―এমন একটা ভয়ানক কাজ করিবেন, এ বিশ্বাস আমার আদৌ নাই। ইহা কখনই সম্ভবপর নয়।” 

আমি বলিলাম, “সম্ভবপর নয় কিসে? আপনি তাঁহাকে বলিয়াছিলেন, বাড়ীতে টাকা আছে, বাড়ী অরক্ষিত, অথচ তাঁহার অর্থাভাব বড়ই প্রবল। এরূপ স্থলে টাকা সংগ্রহের এমন একটা সুযোগ ত্যাগ না করাই তাহার পক্ষে খুবই সম্ভবপর। একটু ভাবিয়া দেখিলে বেশ বুঝিতে পারা যায়, তিনি পশ্চাদ্বার দিয়া আপনার বাড়ীতে ঢুকিয়াছিলেন, তাহার পর উন্মুক্ত গবাক্ষপথে আপনার শয়নগৃহের ভিতরে যাইলে শব্দ শুনিয়া আপনার স্ত্রী জাগিয়া উঠিয়াছিলেন। তখন অন্যন্যোপায় হইয়া পালনজী আপনার স্ত্রীকে খুন করিয়া দুই হাজার টাকা লইয়া সরিয়া পড়িয়াছেন। কথাটা বড়ই ভয়ানক বইকি!” 

মাণিকজী বলিলেন, “আপনি কি পালনজীকেই দোষী স্থির করিতেছেন?” 

আমি বলিলাম, “না—না, এত শীঘ্র কাহাকেও দোষী স্থির করিয়া, ফাঁসী-কাঠের দিকে টানিয়া লইয়া যাওয়া অভ্যাস আমার আদৌ নাই। এ সকল সামান্য প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া দোষী স্থির করা অর্ব্বাচীনের কাজ। দেখুন মহাশয়, আরও একটি কথা হইতেছে, যদি তিনি আপনার স্ত্রীকে খুন করিয়া নোটগুলি লইয়া গিয়া থাকেন, আজই হউক, আর দশদিন পরেই হউক, ঐ নোট তাঁহাকে ভাঙাইবার জন্য বাহির করিতে হইবে। সেই নোটের নম্বরগুলি এখন দরকার হইতেছে।” 

তাড়াতাড়ি পকেট হইতে নোটবুকখানি বাহির করিয়া তিনি বলিলেন, “বেশি টাকার নোটের নম্বর আমি টুকিয়া রাখি।” বলিয়া সেই নোটবুকখানির যে পৃষ্ঠায় নোটের নম্বরগুলি লেখা ছিল, সেই পৃষ্ঠাটি খুলিয়া আমার সম্মুখে ধরিলেন। 

আমার নিজের নোটবুক বাহির করিয়া সেই নম্বরগুলি তুলিয়া লইতে লাগিলাম। 

মাণিকজী বলিলেন, “আপনি পালনজীকেই কি সন্দেহ করিতেছেন?” 

আমি নম্বর লেখা শেষ করিয়া বলিলাম, “সে কথা আমি এখন ঠিক করিয়া বলিতে পারি না। পালনজীর 

গত রাত্রের গতিবিধি সম্বন্ধে সকল তথ্য আমাকে আগে সংগ্রহ করিতে হইবে। 

মাণিকজী বলিলেন, “সে সম্বন্ধে আমি বিশেষ কিছু জানি না। কাল রাতে আটটার পর তাঁহার সহিত আমার সেই-যা ষ্টেশনে একবার দেখা হইয়াছিল; তখনই তিনি চলিয়া যান। কোথায় যাইবেন, কি করিবেন, সে সম্বন্ধে তিনি কোন কথা আমাকে বলেন নাই।” 

আমি বলিলাম, আপনি পালনজীর ঠিকানাটা আমাকে বলুন। তাঁহার আকৃতি কিরূপ? বয়স কত? মাণিকজী বলিলেন, “বয়স ত্রিশ বৎসর হইবে। মুখাকৃতি বড় সুন্দর, মাথায় কোঁকড়ান চুল। চোখে সর্ব্বদা চশমা রাখেন। আকারটা কিছু দীর্ঘ। এই বেন্দোরার উত্তরপ্রান্তে তিনি বাস করেন।” 

আমার নিজের নোটবুকে সব লিখিয়া লইলাম। এবং অন্যান্য দুই-একটি কথার পর বিদায় লইয়া উঠিয়া পড়িলাম 

ঘরের বাহিরে আসিয়া সেই পাথরের পুতুলটার কথা মনে পড়িয়া গেল। আমি পুনরায় কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিয়া মাণিকজীকে বলিলাম, “আর একটা কথা আছে — কথায় কথায় সে কথাটা একেবারেই ভুলিয়া গিয়াছিলাম। দেখুন দেখি, এই পুতুলটা কি আপনাদেরই?” বলিয়া সেই পাথরের পুতুলটা পকেট হইতে বাহির করিয়া তাঁহাকে দেখাইলাম। 

“না কই, আমি পূৰ্ব্বে ইহা কখনও দেখি নাই”, বলিয়া মাণিকজী পুতুলটি আমার হাত হইতে লইয়া তখনই সেটা মাটীতে ফেলিয়া দিলেন। বলিলেন, “একি! ইহাতে যে রক্ত লাগিয়া রহিয়াছে।” 

আমি পুতুলটা কুড়াইয়া লইয়া বলিলাম, “হাঁ, আপনার স্ত্রীরই রক্ত। এই পুতুল যদি আপনাদের না হয় তবে নিশ্চয়ই সেই হত্যাকারীর। আমি আপনার স্ত্রীর মৃতদেহের পার্শ্বেই ইহা পড়িয়া থাকিতে দেখি। যখন পাপিষ্ঠ ঝুঁকিয়া পড়িয়া আপনার স্ত্রীকে ছুরিকাঘাত করে, খুবই সম্ভব তখনই তাহার বুক-পকেট হইতে অজ্ঞাতসারে ইহা পড়িয়া গিয়াছে। পুতুলটাতে খানিকটা রক্তও লাগিয়াছে। হত্যাকারীর তখন মাথার ঠিক ছিল না 

না থাকিবারই কথা, নতুবা সে কখনই খুনের এমন একটা বিশিষ্ট সূত্র পশ্চাতে ফেলিয়া যাইত না। যাহা হউক, আমার মনে হয়, এই নির্জীব পাথরের পুতুলটাই যথাসময়ে সেই পাপিষ্ঠ হত্যাকারীকে একদিন ফাঁসীর সুকঠিন রজ্জুতে লম্বমান করিয়া দিবে।” 

মাণিকজী বলিলেন, “তাহাই প্রার্থনীয়। কিন্তু আমার বিশেষ অনুরোধ যতক্ষণ না আপনি পালনজীকে ঠিক দোষী বলিয়া জানিতে পারিতেছেন, ততক্ষণ যেন তাঁহাকে এই হত্যাপরাধে কোন বিপদে ফেলা না হয়। অনর্থক এমন একটা বদনামের ভাগী হইয়া কোন ভদ্রব্যক্তির জীবন কলঙ্কিত হয়, এমন ইচ্ছা আমার নয়।” 

“না-না—সে ইচ্ছা আমারও নাই। দুই-একটা সামান্য অবস্থাগত প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া সহসা কাহাকে বিপদে ফেলা ঠিক হয় না—” বলিয়া আমি উঠিয়া পড়িলাম এবং মাণিকজীর নিকট তখনকার মত বিদায় গ্রহণ করিলাম।