চৈতি বাঈয়ের মামলা – ৫

পাঁচ

মি লর্ড, জয়প্রকাশ—হত্যা সম্পর্কে পুলিশ—তদন্তে যা যা জানা গেছে, সবই আপনার কাছে পেশ করেছি। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা অনুসারে আমি আসামি চৈতি বাঈকে ফার্স্ট ডিগ্রি হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করলাম। সাক্ষীদের জবানী থেকে মামলার, সত্যাসত্য প্রমাণিত হবে। মাননীয় জুরীগণ, ঘটনার পুরো বিবরণ আপনারাও শুনলেন। সাক্ষীদের সাক্ষ্যও মন দিয়ে শুনুন। তারপর, সভ্য নাগরিক হিসেবে, বিবেক—বুদ্ধি খাটিয়ে আপনারা সাব্যস্ত করুন, এই হত্যাকাণ্ডের আসামি চৈতি বাঈ প্রকৃতই দোষী কিনা। মামলার সূচনায় আপনাদের কাছে এই আমার অনুরোধ।

লক্ষ্নৌ চিফ কোর্টের পাবলিক প্রসিকিউটর বেণীপ্রসাদ শর্মা অভিবাদনের ভঙ্গিতে মাথা ঝুঁকিয়ে, তাঁর বিশাল দেহভার চেয়ারে ন্যস্ত করলেন। ককিয়ে উঠল চেয়ারখানা। দেহের ওজন সোয়া তিনশো পাউন্ড, বর্তুলাকার নাকের নিচে সেকেন্ড ব্র্যাকেটের মতো একজোড়া সুপুষ্ট গোঁফ, গলার আওয়াজে বাঘ ডাকে। কোর্টরুমে লোকারণ্য। কিন্তু এই আদালত—ঘরেই একধারে লোহার খাঁচার মধ্যে বসে থেকেও চৈতি বাঈ যেন জনতার থেকে বহুদূরে সরে রয়েছে। শান্ত, স্তব্ধ, নির্লিপ্ত।

এসেছে অনেকেই। জ্যাকসন সাহেব, ডক্টর কেশকার, মির্জা আতরওয়ালা, নাট্যকার রাজু, ঝুলনিয়া। গিরিজায়াও এসেছেন, জলে ঝাপসা চোখ আর দুরু দুরু বুক নিয়ে। কিন্তু আশ্চর্য, সবচেয়ে আগে যার আসবার কথা, সেই সুমন চৌধুরিকেই দেখা যাচ্ছে না!

জজ সাহেব প্রশ্ন করলেন, আসামি পক্ষের ভকিল কে? কেউ আছেন কি?

ভিড়ের মধ্যে থেকে সাড়া এল, মি লর্ড, আমি আসামিপক্ষ সমর্থন করতে চাই।

বহুজোড়া চোখ পড়ল বক্তার ওপর। অবাক হলে গেল জ্যাকসন সাহেব থেকে ঝুলনিয়া। চমকে উঠলেন গিরিজায়া। এ তো সুমন চৌধুরি নয়! বিরলকেশ খর্বকায় এ উকিল কে?

নাট্যকার রাজু উঠে এল গ্যালারির আসন থেকে। উকিলটিকে জিজ্ঞেস করলে, আপনার নাম?

বি. বি. গুলজার।

আপনাকে ব্রিফ দিল কে?

কেউ দেয়নি। আমি আসামির হিতৈষী, তাই স্বেচ্ছায় নিয়েছি।

রাজু বললে, সম্রাট মহানুভব! তারপর জজের উদ্দেশে বললে, হুজুর, মিস্টার গুলজার আসামির উকিল নন, তার ডিফেন্স কাউন্সেল অন্য।

কে তিনি?—জজ প্রশ্ন করলেন।

ব্যারিস্টার সুমন চৌধুরি।

তিনি কোর্টে হাজির আছেন কি?

রাজু শুধু এদিক—ওদিক চাইতে লাগল।

মিস্টার গুলজার বললে, মি লর্ড, ব্যারিস্টার সুমন চৌধুরি যখন কোর্টে হাজির নেই, তখন বোঝা যাচ্ছে তিনি এই কেস নিতে ইচ্ছুক নন। সুতরাং আমাকে এই কেস ডিফেন্ড করতে দেওয়া হোক।

দর্শকের আসন থেকে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলেন গিরিজায়া। একেবারে এজলাসের সামনে। বললেন, হুজুর, আমি আসামির মা। আমার মেয়ের মামলা সুমন চৌধুরির হাতেই তুলে দিয়েছি, আর কারো হাতে দিতে চাই নে হুজুর।

মিস্টার গুলজার অত্যন্ত অন্তরঙ্গের মতো গিরিজায়াকে বললে, ঘাড়বাচ্ছেন কেন? আমায় কেস দিলে আপনার পয়সাকড়ি লাগবে না—আমি সোহিনী বাঈয়ের উকিল ছিলাম। নির্ঘাৎ খালাস করে দেব আপনার মেয়েকে।

গিরিজায়া দুমনা হয়ে ভাবতে লাগলেন।

আদালত—ঘরে গুনগুন ধ্বনি উঠল। জজ একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, কোথায় ব্যারিস্টার চৌধুরি? তিনি কি আসবেন?

ঠিক সেই মুহূর্তে দরজার কাছ থেকে শোনা গেল, মি লর্ড!

সমস্ত আদালত তাকাল সেদিকে। দেখা গেল, ভিড় ঠেলে সুমনের কালো গাউন—পরা চেহারা এগিয়ে আসছে। কপালের একটা জায়গা প্লাস্টার করা। এগিয়ে এসে সুমন বললে, আমার অনিচ্ছাকৃত দেরির জন্যে আদালতের কাছে আমি ক্ষমা চাইছি। কোর্টে আসবার পথে একখানা ভাড়াটে মোটরের সঙ্গে আমার গাড়ির ধাক্কা লাগে, তারই ফলে এই দেরি।

গিরিজায়া কেঁদে ফেললেন। চৈতির উদাস দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্যে চঞ্চল হয়ে উঠল। আর রাজু ফিরে দেখে, মিস্টার গুলজার যেন যাদুমন্ত্রে হাওয়া হয়ে গেছে! লোকটার সবই গুল নাকি? ব্যাপারটা সুমনকে জানাতে হবে।

জজ সাক্ষী তবল করলেন।

পয়লা সাক্ষী ইন্সপেক্টর তিওয়ারি। সে শপথ নেওয়ার পর পি.পি. উঠলেন জেরা করতে।

ইন্সপেক্টর তিওয়ারি, একুশে জুলাই রাত্রে আপনি কি ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন?

গিয়েছিলাম।

গিয়ে কি দেখলেন?

দেখলাম, জয়প্রকাশ কাপুরের রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে। আর তার পাশে একটা রিভলভার।

আপনার কি ধারণা হয়েছিল, ওই রিভলবার দিয়েই খুন করা হয়েছিল?

হ্যাঁ।

কেন এ ধারণা হয়েছিল?

রিভলভারের নলটা তখনো সামান্য গরম ছিল।

হৃষ্ট হয়ে উঠলেন পুষ্ট পি. পি.। জজের দিকে ফিরে বললেন, মি লর্ড, ইন্সপেক্টরের শেষ কথাটার বিশেষ গুরুত্ব আছে বলে মনে করি। রিভলভারের নল গরম হলে সন্দেহ থাকে না যে সদ্য সদ্য গুলি ছোড়া হয়েছে। ঘটনাস্থলে যে রিভলভার পাওয়া গেছে, তারও নল গরম ছিল। এবং তার বাঁটে ও ট্রিগারে যার আঙুলের সুস্পষ্ট ছাপ পাওয়া গেছে, সে আর কেউ নয়—আসামি চৈতি বাঈ। আমার আর কোনো প্রশ্ন নেই ইন্সপেক্টর।

জজ বললেন, মিস্টার চৌধুরি, আপনি এবার সাক্ষীকে জেরা করতে পারেন।

উঠল সুমন। একটা পেন্সিল দিয়ে নিজের চিবুকে মৃদু মৃদু আঘাত করতে করতে অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করে বসল, ইন্সপেক্টর তিওয়ারী, আপনি চা খান?

খাই।

এক কাপ গরম চা ঠাণ্ডা হতে কতক্ষণ সময় লাগে বলে মনে হয়?

মিনিট দশেক বড়জোর।

আচ্ছা, একুশে জুলাই রাতে ক’টার সময় থানায় টেলিফোন পেয়েছিলেন?

দশটা বেজে কুড়ি মিনিট।

গোল—দরওয়াজায় আসামির বাড়িতে আপনি হাজির হয়েছিলেন কতক্ষণে?

পৌনে এগারোটায়।

অর্থাৎ, টেলিফোন পাওয়ার পঁচিশ মিনিট বাদে! তাই না?

তাই।

তাহলে—এক কাপ গরম চা ঠাণ্ডা হতে যদি বড়জোর দশ মিনিট সময় লাগে, গুলি করার পঁচিশ মিনিট বাদেও রিভলভারের নল গরম থাকতে পারে কি? বিশেষ করে ঝড়—বৃষ্টির রাতে?

ঘাবড়ে গেল ইন্সপেক্টর তিওয়ারি। জবাব দিতে পারল না। গম্ভীর গলায় জোর দিয়ে সুমন বললে, ইন্সপেক্টর তিওয়ারি, ঠিক করে বলুন, রিভলভারের নল গরম না ঠাণ্ডা ছিল? বলুন!

মনে নেই।

আদালত—ঘরে গুঞ্জন উঠল সুমনের জেরায় কায়দায়। আর অসন্তাোষে ফুলে উঠল সেকেন্ড ব্র্যাকেটের মতো শর্মাজীর গোঁফ জোড়া!

ধন্যবাদ ইন্সপেক্টর, আপনি যেতে পারেন।

এজলাসের দিকে ফিরে সুমন শান্ত গলায় বললে, আমি শুধু একটা কথাই বলতে চাই মি লর্ড। ইন্সপেক্টর যখন সঠিক বলতে পারলেন না রিভলভারের নল গরম ছিল কিনা, তখন আসামির রিভলভার থেকেই ফায়ার করা হয়েছিল, এটা প্রমাণ হয় কি?

দর্শকের আসনে বসে নাট্যকার রাজু বলে উঠল, শাবাশ! ফার্স্টঅ্যাক্ট ফার্স্ট সিনেই জমিয়ে দিলে সুমন! কি বলেন?

উৎসাহে পাশের লোকটিকে ঠেলা দিল রাজু। একমুখ দাড়ি—গোঁফওয়ালা, গলায় কম্ফর্টার—জড়ানো পাশের বুড়ো লোকটি নাকের ডগায় চশমা লাগিয়ে এতক্ষণ চেয়েছিল সুমনের দিকে। মাথা নেড়ে বললে, কি বলছ হে! এ তো থিয়েটার নয়, এ যে আদালত।

ওই একই কথা। আদালতের চেয়ে বড় থিয়েটার আছে নাকি?

তা যা বলেছ!—ফোকলা দাঁতে হাসলে বুড়ো। বললে, ছোকরার জেরার কায়দাটা ভালো। তবে শেষ অবধি জিততে পারবে কি?

রাজু বললে, যদি পারে, তবে খুনের মামলায় ওর জোড়া থাকবে না। আগে ওকে কেস দিয়ে খুনিরা নিশ্চিন্তে খুন করতে যাবে।

ঢং করে ঘড়ি বাজাল। পরদিনের জন্যে শুনানী মুলতুবী রেখে জজসাহেব উঠে গেলেন:

তোমার নাম?

রামভরোসা। লোকে রামু বলে। আমার নানী আমার নাম রেখেছিল হুজুর। বলতো,রামজীই তোর ভরোসা!

থামো!—ধমক দিয়ে শর্মাজী বললেন, আসামিকে তুমি চেনো?

তা আর চিনব না! আমি বাঈয়ের পুরোনো নোকর।

কতদিন কাজ করেছ?

একটা হাই তুলে সাক্ষী রামু বললে, তা হুজুর ধরুন, আমার নানীকে গঙ্গায় দিয়েছি তিন সাল হল। তারও দু’ সাল আগে আমার তিসরি শাদি হয়েছিল। তারও এক মাস আগে—

রামুর গলার আওয়াজ ক্রমশ মিইয়ে গিয়ে অন্য একটা আওয়াজ শোনা যেতে লাগলো, ঘোঁ—ঘরর—ঘোঁ—ঘরর—

শর্মাজীর গলায় বাঘ ডেকে উঠল, এই, ঘুমোচ্ছ কেন?

ধড়ফড় করে জেগে উঠল রামু। বললে, ঘুমুইনি, মনে মনে সাল হিসেব করছিলাম।

ঘটনার রাতে তুমি কোথায় ছিলে?

মনিবের বাড়িতে। ঝড়—জলের রাত ছিল, তাই সকাল সকাল খেয়েদেয়ে শুয়েছিলাম। আমার হুজুর বার—টান নেই। আমার নানী বলত—

আবার নানী! তারপর বলো।

তারপর হুজুর একটু চোখ লেগে গিয়েছিল। (আরেকটা হাই তুলল রামু) হঠাৎ ঘুমের ঘোরে—

রামুর নাক দিয়ে আবার সেই বিচিত্র আওয়াজ শুরু হল, ঘোঁ—ঘরর—ঘোঁ—ঘরর—

রাগে শর্মাজীর গোঁফের সেকেন্ড ব্র্যাকেট ফুলে উঠল। গর্জন করে উঠলেন, এই, কি হচ্ছে?

চোখ কচলে রামু বললে, ভাবছি হুজুর।

বলো, তারপর কি হল।

হঠাৎ দুম করে একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। তাড়াতাড়ি ওপরে গিয়ে দেখি হুজুর, মাইফিল—ঘরে জয়প্রকাশ কাপুর রক্ত মেখে পড়ে আছে। আর ছোটি বাঈ পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে।

তুমি ঠিক দেখেছিলে আসামি পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে?

রামুর নজর ভুল হয় না হুজুর। নিজের চোখে দেখেছি।

মোহনবাগানকে গোল দিলে ইস্টবেঙ্গলের মুখের চেহারা যেরকম হয়, শর্মাজীর মুখখানা তেমনি হল। সোয়া তিনশো পাউন্ড ওজনের দেহ দুলিয়ে জজের সামনে গিয়ে বললেন, সাক্ষীকে আমি আর প্রশ্ন করতে চাই না মি লর্ড। সে স্বচক্ষে আসামিকে রিভলভার হাতে মৃত জয়প্রকাশের পাশে দেখেছে, আসামিকে খুনি প্রমাণ করার পক্ষে এইটুকুই যথেষ্ট।

জজসাহেব সুমনকে বললেন জেরা করতে। সাক্ষীর কাঠগড়ার সামনে এগিয়ে গেল সুমন। বললে আচ্ছা রামু, তুমি তো বড় বাঈয়ের সঙ্গে বেনারসেও অনেকদিন ছিলে?

জী হুজুর।

বেনারসের ভাঙের সরবত খুব বঢ়িয়াঁ। তুমি খেতে না?

অবজেকশন!—হাঁসফাঁস করে পি.পি. বলে উঠলেন, এ প্রশ্ন অবান্তর।

সুমন শান্ত স্বরে বললে, সেটা আদালতের না আমার বিজ্ঞ বন্ধুর বিচার্য, আমি জানতে চাই মি লর্ড।

জজসাহেব বললেন, অবজেকশন ওভাররুলড। আপনি সাক্ষীকে জেরা করুন মিস্টার চৌধুরি।

সুমন আবার প্রশ্ন করলে, তুমি খেতে না রামু?

ঝুট বলব না হুজুর, খেতাম বইকি। আমার নানী বলত, বারো সাল ভাঙ খেলে মহাদেবের কিরপা মিলে যায়।

ঠিক, ঠিক! তা তুমি এখনো খাও তো?

কি করব হুজুর, অভ্যেস হয়ে গেছে! নইলে ভালো খিদে হয় না, ঘুম হয় না।

হাত আড়াল দিয়ে একটা হাই তুললে রামু।

বেশ, বেশ! ও তো সরাবের নেশা নয়, ওতে দোষ কি? সেদিন রাতেও খেয়েছিলে?

অল্পস্বল্প খেয়েছিলাম। ঠাণ্ডার রাত ছিল, তাই—

কথা বন্ধ হয়ে গেল রামুর। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই শুরু করে দিলে নাকের কনসার্ট, ঘোঁ,—ঘরর—ঘোঁ—ঘরর—

সুমনের জলতেষ্টা পেয়ে গেল বোধ হয়। টেবিলের কাছে সরে এসে জলভরা কাচের গেলাসটা তুলে নিয়ে আচমকা ছেড়ে দিলে। ঝনঝন শব্দে টুকরো হয়ে গেল গেলাসটা। চকিতে ফিরে তাকাল সে রামুর দিকে, রামু তখনো স্বপ্নলোকে বিচরণ করছে।

মৃদ হাসি ফুটে উঠল সুমনের মুখে। জজের দিকে ফিরে বললে, মি লর্ড, আদালতকে আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই। এত কাছে থেকে গেলাস ভাঙার শব্দে যার ঘুমের ব্যাঘাত হয় না, একুশে জুলাই সেই ঝড়—বৃষ্টির রাতে রিভলভারের আওয়াজে তার ভাঙের নেশায় ঘুম ভেঙে যাওয়া কি সম্ভব? আমার বিজ্ঞ বন্ধু শর্মাজী কি বলেন?

সুমন নিজের চেয়ারে এসে বসল। চাপা উল্লাসের ধ্বনিতে গম—গম করে উঠল আদালত—ঘর। আর রাগে শর্মাজীর সেকেন্ড ব্র্যাকেট ফুলে উঠল। তাঁর মুখের চেহারা এখন মোহনবাগানের গোল খেলে ইস্টবেঙ্গলের মুখভাব যেমন হয়, তেমনি।

দর্শকের আসনে বসে রাজু বলে উঠল, কেয়াবাৎ ব্যারিস্টার। কি বলুন?

পাশের কম্ফর্টার জড়ানো বুড়ো মাথা নেড়ে স্বীকার করলে, হ্যাঁ, ছোকরার মাথা আছে। তবে শেষ রক্ষে করতে পারলে হয়।

আলবৎ পারবে। আপনার কি মনে হয়?

কিছুই বলা যায় না ভাইয়া। নিজের বুকে আঙুল ঠেকিয়ে বললে, এই বুড়ো লালজী দুনিয়ার অনেক দেখেছে, অনেক শুনেছে। তীরে এসেও তরী ডোবে!

ফোকলা দাঁতে হাসতে লাগল বুড়ো।

তৃতীয় সাক্ষী লব হল, লায়লী বানু হাজির!

সাক্ষীর কাঠগড়ায় ধীরে ধীরে এসে দাঁড়াল একটি যুবতী মেয়ে! পরনে সাদা সালোয়ার কামিজ, মাথায় কালো দোপাট্টা। মুখে করুণ বিষাদ, চোখ দুটি ফোলা ফোলা। তবু ঠোঁটে শুকনো রঙের দাগ, চোখের কোলে সুর্মার সূক্ষ্ন টান লক্ষ করলে সুমন।

সোয়া তিনশো পাউন্ড চর্বির তাল নিয়ে শর্মাজী জেরা করতে উঠলেন। বাঘের মতো আওয়াজ যথাসাধ্য মোলায়েম করে প্রশ্ন করলেন, তুমি কি করো?

আমি প্রাইভেট নার্স।

নিহত জয়প্রকাশ কাপুরকে তুমি চিনতে?

চিনতাম।

কতদিনের আলাপ?

তিন বছরেরও বেশি।

সে তোমার কে ছিল?

মুখ নিচু করে লায়লী যেন চোখের জল সামলে নিলে। তারপর বললে, আমার ভাবী স্বামী। আমরা পরস্পরকে ভালোবাসতাম।

কোমাদের কি বিয়ের কথা হয়েছিল?

হয়েছিল। এই এনগেজমেন্ট রিং জয়প্রকাশেরই দেওয়া।

লায়লী তার ডান হাত প্রসারিত করলে। অনামিকায় সবুজ পাথর বসানো একটি আংটি। ধরা গলায় বললে, এই জয়প্রকাশের শেষ স্মৃতি!

জয়প্রকাশের সঙ্গে তোমার শেষ দেখা হয় কবে?

একুশে জুলাই সকালে। আমাকে বলে গিয়েছিল, গোল—দরওয়াজায় চৈতি বাঈয়ের বাড়িতে একটু কাজ সেরে রাত আটটায় এসে আমার সঙ্গে খাবে। আর আসেনি!

জয়প্রকাশের খুন সম্পর্কে তুমি কি কিছু জানো?

শুধু জানি না, নিজের চোখেই দেখেছি।

কি দেখেছ?

বলছি—সেদিন রাতে খুব ঝড়—বৃষ্টি হচ্ছিল। আটটা বাজল ন’টা বাজল, জয়প্রকাশ খেতে এল না। আমার মনটা কেমন অস্থির হয়ে উঠল। একটা গাড়ি ডাকিয়ে দশটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম জয়প্রকাশকে খুঁজতে। খুঁজে খুঁজে গোল—দরওয়াজায় চৈতি বাঈয়ের বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম।

রাত তখন কত?

দশটা হবে।

সেখানে গিয়ে কি দেখলে?

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ঝগড়ার শব্দ শুনতে পেলাম। দোতলার বারান্দায় গিয়ে দেখি, একটা হলঘরে জয়প্রকাশের সামনে চৈতি বাঈ দাঁড়িয়ে আছে, হাতে পিস্তল। চৈতি শাসাচ্ছিল, আমাকেই বিয়ে করতে তুমি বাধ্য! জয়প্রকাশ বলছিল, তা হয় না, লায়লীকে আমি কথা দিয়েছি।—ঘরে ঢুকব কি ঢুকব না ভাবছি, এমন সময় ওই ডাইনি—(দুই চোখে তীব্র আক্রোশ নিয়ে লায়লী আসামির দিকে আঙুল দেখালে) ওই পিশাচী দুম করে গুলি করলে, আর জয়প্রকাশ বুকে চেপে—

কান্নার আবেগে লায়লীর গলা বুজে এল। কাঠগড়ার রেলিঙের ওপর ভেঙে পড়ল সে।

শর্মাজী বললেন, পুয়োর চাইল্ড! আমার আর একটি প্রশ্ন আছে তোমার কাছে। তারপর তুমি কি করলে?

অশ্রুভেজা মুখ তুলে লায়লী বললে, পুলিশে খবর দেব বলে ছুটে নেমে এসে গাড়িতে বসলাম—কিন্তু মাথা ঘুরছিল, পারলাম না।

এজলাসের দিকে ফিরে পি.পি. তাঁর গলায় সাক্ষীর চেয়েও বেশি আবেগ ঢেলে বললেন, মি লর্ড! জেন্টলমেন আফ দি জুরি! আমি বেশি কথা বলতে চাই না, সাক্ষীর কাঠগড়ায় যে অভাগিনী মেয়েটি আপনাদের সামনে এখন দাঁড়িয়ে আছে, তার মুখের দিকে তাকাতে অনুরোধ করছি শুধু। ওর চোখের জলই বলে দিচ্ছে, আসামির অপরাধ কতখানি সত্য!

শর্মাজীর বিপুল মেদভারে চেয়ারখানা আর্তনাদ করে উঠল।

জজসাহেব এবার ডিফেন্স কাউন্সেলকে জেরা করতে ডাকলেন।

সমস্ত আদালত উৎসুক হয়ে উঠল। কিন্তু আশ্চর্য, সুমন দাঁড়িয়ে উঠে বললে, আমার কোনো প্রশ্ন নেই।

চোখ মুছতে মুছতে লায়লী কাঠগড়া থেকে নেমে গেল।

শুনানী মুলতুবী রইল সেদিনের মতো।

গ্যালারির কস্ফর্টার জড়ানো লালাজী বললেন, ব্যাপার কি ভায়া। ব্যারিস্টারের জেরার ভাঁড়ার খালি হয়ে গেল নাকি?

রাজু জবাব দিলে না। তাড়াতাড়ি সুমনের কাছে গিয়ে বললে, লায়লী বানুকে আমি চিনি ইয়ার। আমার থিয়েটারে কিছুদিন কাজ করেছিল। ও আবার নার্স হল কবে?

সুমন বললে, ঠিকানা জানিস?

পুরোনো মাইনের খাতায় আছে।

ঠিকানাটা আজই চাই।

.

প্রিন্স এসেছে দেখা করতে। রাজু বললে।

প্রিন্স! লায়লি অবাক হল।

আজবগড়ের রাজকুমার। আমরা প্রিন্স বলেই ডাকি। থিয়েটারের ভারি শখ, মনের মতো একটি হিরোইন পেলেই থিয়েটার খুলে ফেলবে।

সত্যি! লায়লীর মুখে—চোখে আগ্রহ।

রাজু বললে, তাই তো ওকে নিয়ে এলাম। কাপ্তেন লোক তোমারও একটা হিল্লে হয়ে যেতে পারে লায়লী।

কোথায় তিনি?

নিচে মোটরে।

সেকি! যাও যাও নিয়ে এসো।

আরশির সামনে দাঁড়িয়ে লায়লী চট করে পাউটার—পাফটা বুলিয়ে নিলে। মাথার চুল আর একটু ফাঁপিয়ে দিলে। রঙীন ঠোঁট দু’খানা ভিজিয়ে নিলে জিভ দিয়ে।

নিচের থেকে প্রিন্সকে নিয়ে এল রাজু। দীর্ঘকায় সুদর্শন চেহারা, লম্বা কালো শেরোয়ানি আর কাশ্মীরি টুপিতে মানিয়েছে চমৎকার। মুখে সরু পাকানো গোঁফ, চোখে কালো চশমা।

রাজুকে বলতে হল না, লীলায়িত ভঙ্গিতে নিজেই অভ্যর্থনা করলে লায়লী, আসুন, আসুন! আমার গরিবখানায় আপনার মতো মেহমানের পায়ের ধুলো পড়বে, সে আমার সৌভাগ্য! বলুন, কি দিয়ে খাতির করব?

একটা কৌচে বসতে বসতে প্রিন্স একটু হেসে বললে, দুটো মিষ্টি কথা দিয়ে।

তাহলে যাই, মধু খুঁজে আনিগে।

ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে প্রিন্স বললে, ফুল আবার মধু খুঁজতে যাবে কোথায়? সে তো তার বুকেই আছে।

বাঁকা চোখে বিদ্যুৎ নিয়ে লায়লী জবাব দিলে, আপনি জানলেন কি করে? ও খবর তো ভ্রমর ছাড়া কেউ জানে না।

সিগারেটে একটা টান দিয়ে রাজু বলে উঠল, সুভানাল্লা! কবির লড়াই জমেছে ভাল। কিন্তু এখন থিয়েটারের কথা হলে আরো ভাল হত না?

প্রিন্স বললে, মিস লায়লী যদি হিরোইন হয়, আমি থিয়েটারের জন্যে টাকা দিতে রাজি। কিন্তু—

কিন্তু কি? রাজু বললে—।

মিস লায়লী তো শুনেছি, নার্স, সে কাজ ছেড়ে থিয়েটারে—

লায়লী তাড়াতাড়ি বলে উঠল, কে বললে আমি নার্স? দরকার পড়লে যেখানে যেমন সেখানে তেমন পরিচয় দিতে হয়।

গুলাবি আতরমাখা রেশমি রুমালে মুখ মুছে প্রিন্স বললে, বেশ, তাহলে দু’—একদিনের ভেতরেই আগাম টাকা দিয়ে এগ্রিমেন্ট করে নাও রাজু। এই কথাই রইল, আমি এখন উঠি—

প্রিন্স উঠতে যাচ্ছিল, রাজু লায়লীকে চোখ টিপে ইশারা করলে। খপ করে প্রিন্সের হাতখানা ধরে ফেলে সে মোহিনী হাসি হেসে বললে, বসুন না, এত তাড়া কেন?

লায়লীর হাতের দিকে তাকিয়ে প্রিন্স বললে, বাঃ, চমৎকার তোমার আংটি। কে দিয়েছে? কোনো ভ্রমর বুঝি?

লায়লি বললে, কে আবার দেবে! নিজেই শখ করে কিনেছি।

আমারও সবুজ পাথরের আংটির খুব শখ।

তাই নাকি! নিজের আঙুল থেকে খুলে লায়লী প্রিন্সের কনিষ্ঠায় পরিয়ে দিলে। বললে, লায়লীকে ভুলবেন না।

প্রিন্স বললে, কিছু নিলে, কিছু দিতে হয়। আমার আংটিটা তুমি নেবে?

প্রিন্সের হাতেও টকটকে লাল পাথর বসানো একটা সুন্দর আংটি। চুনি নাকি? লোভে চকচক করে উঠল লায়লীর চোখ। আংটিটা তার আঙুলে পরিয়ে দিয়ে প্রিন্স বললে, তোমার বুকে যদি জায়গা না পাই, তোমার হাতেই থাকি—

রাজু একগাল হেসে বললে, হাতে রাখাই তো লায়লীদের কাজ।

প্রিন্স উঠে পড়ল।

দরজা অবধি এগিয়ে দিলে লায়লী বললে, আবার দেখা হবে তো?

প্রিন্স একটু হেসে বললে, দেখা আবার হবে বইকি!

গলাটা উদাস করে লায়লী বললে, আশায় আশায় থেকে ফুল যেন শুকিয়ে না যায়!

চলে যেতে যেতে রাজু বললে, জল ছিটিয়ে রেখো।

ছয়

ভাগ্নেটা বায়না ধরেছে, কুকুরছানা চাই। পুতুল নয়, জ্যান্ত। নেড়ি নয়, ঝাঁকড়া লোমওয়ালা খাস বিলেতি। কিন্তু চাই বললেই তো চলে না, কলকাতার মতো লক্ষ্নৌ শহরে তো টেরিটি বাজার নেই যে গেলাম আর কিনে আনলাম। ছ’ বছরের বাচ্চচা সেকথা মানতে চায় না। সাতদিন ধরে সমানে ধরেছে, কুকুরছানা তার চাই—ই চাই। আজ না পেলে সে চান করবে না, খাবে না, দুপুরবেলা ঘুমুবে না। রামবিচ্ছু ছেলেটা! রাজু আবার ওই ভাগ্নেটাকেই প্যার করে বেশি। তাই কাজকর্ম ফেলে সক্কাল বেলাতেই রাজু বেরিয়েছে কুকুরছানা ঢুঁড়তে।

ঘুরেছে অনেক জায়গায়। আরিয়ানগর থেকে মকবুলগঞ্জ, হজরতগঞ্জ থেকে গণেশগঞ্জ, এ—পাড়া থেকে ও—পাড়া। আত্মীয়—স্বজন, বন্ধু—বান্ধব, জানা—চেনা কাউকে বাদ দেয়নি জিজ্ঞেস করতে—কুকুরছানা আছে? চিড়িয়াখানা অবধি গিয়েছিল, যদি মিলে যায়।

ঘুরতে ঘুরতে চকের ভেতর দিয়ে শর্টকাট করছিল রাজু। জ্যান্ত যখন পাওয়া গেল না, তখন পেট—টেপা একটা খেলনা কুকুরই কেনা যাক। লাফালাফি না করুক, ডাকবে তো!

তামাকওয়ালা নাথথু ডাকলে, রাম রাম রাজুবাবু! এদিকে কি মনে করে? তামাক লিবেন নাকি? মিঠেকড়া বঢ়িয়াঁ চিজ!

রাজু বললে, কুকুরছানা আছে?

ঘাবড়ে গেল নাথথু। বললে, কুকুরছানা!

হ্যাঁ, হ্যাঁ, মাথা খারাপ হয়ে গেল আমার কুকুর কুকুর করে! ভালো জাতের চাই, কিছু টাকাও দিতে পারি। আছে নাকি সন্ধানে?

ঘাড় নেড়ে নাথথু বললে, না বাবু, কুকুরে তো তামাক খায় না, কেমন করে সন্ধান দেব বলুন?

কুকুর নেবেন নাকি হুজুর?

অচেনা গলার আওয়াজে রাজু তাকিয়ে দেখে, লোকটা চেনা। এ সেই ঘুমকাতুরে রামভরোসা, ওরফে রামু। চৈতি বাঈয়ের চাকর ছিল। তামাকের দোকানের পাশে গাঁজা আফিম সিদ্ধির দোকান। সেখান থেকে এগিয়ে আসছে রাজুর দিকে। রামু বললে,কুকুর চাই? আমি দিতে পারি, আমার কাছে আছে।

আছে! রাজু যেন হাত বাড়িয়ে স্বর্গ পেল। বললে, কুকুর তো নয়, আমার বাপের ঠাকুর! কোথায় আছে?

আমার ডেরায়! এই নজদিকে।

নেড়ি নয় তো?

কি বলছেন হুজুর? একদম সাহেবের বাচ্চচা! ধবধবে সাদা, লটপটে কান দুটো বাদামি। দাম কিন্তু বেশি পড়বে।

কত?

বিশ রুপেয়া।

রাজু বুঝলে, রামুর দাঁও মারবার ফিকির। কিন্তু উপায় নেই, রামবিচ্ছু ভাগ্নে ব্যাটা আচ্ছা প্যাঁচে ফেলেছে। রাজু বললে, তাই সই। ইস, বেলা হয়ে গেল! জলদি চলো তোমার ডেরায়, আমার আবার কোর্ট আছে।

সুমন বললে, মি লর্ড, গত দিনের সাক্ষী মিস লায়লী বানুর সাক্ষ্য আমি আর একবার নিতে চাই! আদালতের কাছে আমি অনুমতি চাইছি।

পি. পি. গোঁফ ফুলিয়ে বলে উঠলেন, তার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। সাক্ষ্য যা দেবার মিস লায়লী সেদিন দিয়েই গেছে, নতুন করে তার ব্যথার স্থানে ঘা দেওয়াটা নিছক নৃশংসতা!

মৃদু হেসে সুমন বললে, আমার বিজ্ঞ বন্ধু শর্মাজীর হৃদয় খুবই আবেগপ্রবণ বুঝতে পারছি। কিন্তু আইনের বিচার চলে হৃদয়াবেগের পথে নয়, সত্যের পথ ধরে।

জজ বললেন, আদালত অনুমতি দিচ্ছে।

শমন পেয়ে লায়লী কোর্টে হাজির ছিল। দ্বিতীয়বার সাক্ষীর কাঠগড়ায় উঠল। মুখে তেমনি করুণ বিষাদ, চোখ ছলছল।

হাতের পেন্সিলটা চিবুকে মৃদু মৃদু আঘাত করতে করতে সুমন এগিয়ে গেল কাছে। বললে, মিস লায়লী, আপনাকে বেশি কষ্ট আমি দেব না। একটাই প্রশ্ন শুধু করব। নিহত জয়প্রকাশকে আপনি সত্যিই চিনতেন?

নিশ্চয়।

কিন্তু আমার মনে হয়, আপনি তাকে চিনতেন না—জীবনে কখনো দেখেন নি।

একটু চাপা রাগ লায়লীর চোখে ঝিলিক দিয়ে গেল। বললে, আপনি কি বলতে চান আদালতে দাঁড়িয়ে আমি মিথ্যে বলেছি?

আমার বিশ্বাস তাই। জয়প্রকাশের সঙ্গে আপনার কখনো আলাপও হয়নি, বিয়ের কথাও হয়নি।

উত্তপ্ত গলায় লায়লী বলে উঠল, একথা মিথ্যে! বিয়ের কথা নিশ্চয় হয়েছিল।

প্রমাণ কি?

জয়প্রকাশের দেওয়া এই এনন্টগজমেন্ট রিং এখনো আমার হাতে রয়েছে। আর আপনি বলছেন—

কেঁদে ফেললে লায়লী।

ব্যাঘ্র—গর্জনে পি.পি. বলে উঠলেন, অবজেকশন! সাক্ষীর ওপর এই জুলুম শুধু নিয়মবিরুদ্ধ নয়, ভদ্রতাবিরুদ্ধ!

শান্ত গলায় সুমন বললে, আমার বিজ্ঞ বন্ধু সহজেই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন দেখছি! এটা ভালো লক্ষণ নয়। আমি তাঁকে তাঁর ব্লাডপ্রেসার মাপতে পরামর্শ দিচ্ছি।

আদালত—ঘরে একটা হাসির ঢেউ বয়ে গেল।

জজসাহেব হাতুড়ি ঠুকলেন : অর্ডার! অর্ডার! জেরা চালিয়ে যান মিস্টার চৌধুরি।

এই সময় ব্যস্তসমস্ত হয়ে কোর্ট রুমে ঢুকে পড়ল নাট্যকার রাজু। বগলদাবায় সদ্যকেনা কুকুরছানা। ভাগ্নেকে দিয়ে আসার সময় হয়নি। ভাগ্যে কেউ লক্ষ করেনি, তাই। ঠেলেঠুলে লালজীর পাশে বসে পড়তেই কুকুরটা ছটফটিয়ে রাজুর কোল থেকে লালাজীর কোলে গিয়ে লেজ নাড়তে শুরু করে দিলে।

চশমার ফাঁকে তাকিয়ে লালাজী বললে, এ আপদ কোত্থেকে জোটালে ভাইয়া?

কুকুরটাকে ফের নিজের কোলে বসিয়ে রাজু বললে, কিনলাম।

কুকুর নিয়ে আদালতে ঢোকা বেআইনি কাজ। বাইরে রেখে এসো।

শখের কুকুর, বাইরে কোথায় রাখব?

সুমন বলছে, মিস লায়লী, আপনাকে ব্যথা দেওয়ার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত। কিন্তু কি করব, কর্তব্য বড় কঠোর। আপনার এনগেজমেন্ট রিংটা একবার দেখতে পারি কি?

লাল পাথর বসানো আংটিটা খুলে দিলে লায়লী। সেটা দেখতে দেখতে সুমন বললে, ভারি ডিসেন্ট! এই আংটিটাই জয়প্রকাশ আপনাকে উপহার দিয়েছিল?

স্পষ্ট গলায় উত্তর এল, হ্যাঁ।

এটা তাহলে কে দিয়েছিল? পকেট থেকে আরেকটা আংটি বার করে দেখালে সুমন। সবুজ পাথর বসানো সেই আংটিটা।

শুকিয়ে গেল লায়রি মুখ। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল।

সুমন বললে, কে দিয়েছিল এটা?

ঢোঁক গিলে লায়লী বললে, মনে নেই।

ঠোঁটের কোণে একটু ধারালো হাসি নিয়ে সুমন বললে, আমার কিন্তু মনে আছে। গতদিন এই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আপনি বলেছিলেন, এই সবুজ আংটিটাই জয়প্রকাশ দিয়েছিল। আজ বলছেন, এই লাল আংটি। কোনটা সত্যি?

লায়লীর ঠোঁট কাঁপছে।

সুমনের মুখ গম্ভীর আর গলা প্রখর হয়ে উঠল, কোনোটাই জয়প্রকাশের দেওয়া নয়। এই লাল আংটি আজবগড়ের প্রিন্সের দেওয়া উপহার। কেমন, তাই নয়? বলো—জবাব দাও মিস লায়লী! কবুল করো তুমি নার্স নাও, থিয়েটারের সাধারণ অভিনেত্রী—তোমার সাক্ষ্য নকল, বিয়ের আংটি নকল, তোমার কান্নাও নকল!

আর পারলে না লায়লী। কাঁপা গলায় কোনোমতে বললে, আ—আমি কবুক করছি—আমায় যেতে দিন।

চোখে রুমাল চেপে ফুঁপিয়ে উঠল লায়লী, তার এবারের কান্নাটা নকল নয়।

শর্মাজীর দিকে একবার কটাক্ষ করে সুমন জজকে বললে, মি লর্ড, সাক্ষীর স্বীকারোক্তির পর আমার মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

শর্মাজী যেন পর পর তিনখানা গোল খেয়েছেন।

আদালত—ঘরের নিরেট স্তব্ধতা চৌচির হয়ে গেল এক নিমেষে। দর্শকদের হর্ষধ্বনিতে ভরে উঠল ঘর। রাজু প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল, কেয়াবাৎ ব্যারিস্টার! তুহারি কাম!

আর, বলতে গিয়ে খেয়াল হল কুকুরটা তার কোলে নেই, আবার লালাজীর কোলে বসে তার হাত চাটছে। বিরক্ত হয়ে লালজী বললে, ভালো জ্বালায় পড়লাম! শান্তিতে মামলা শোনবার জ্যো নেই!

হাত বাড়িয়ে কুকুরটাকে টেনে নিয়ে রাজু হেসে বললে, আর শুনবেন কি? মামলা তো জিতে নিলে সুমন চৌধুরি।

এরই মধ্যে! এখনো হয়তো আরও সাক্ষী আছে, ভকিলদের সওয়াল—জবাব আছে, জুরিদের রায় আছে। কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় দেখো।

জজসাহেব বললেন, সরকারপক্ষের আর কোনো সাক্ষী আছে?

পি. পি. বললেন, না।

আসামীপক্ষের?

নেই। সুমন জবাব দিলে।

এজলাস ছেড়ে জজ উঠে গেলেন। জ্যাকসন সাহেব সুমনের পিঠ চাপড়ে বললেন, ভারি ইন্টারেস্টিং তোমার জেরা। কিন্তু ইয়ংম্যান, খুনের রহস্য যদি ভেদ করতে পারো, তবেই বুঝব তোমার বাহাদুরি!

কোর্টরুমের বাইরে এসে সুমন বললে, একি! বগলে কুকুর কেন তোর?

রাজু বললে, আর বলিস কেন ইয়ার! ভাগ্নেটার জন্যে কিনতে হল।

ভালো জাতের মনে হচ্ছে। কোত্থেকে কিনলি?

রামুর কাছ থেকে।

রামু!

ভাংখোর রামু। চৈতি বাঈয়ের চাকর ছিল যে।

বটে!—অবাক হল সুমন। কুকুরটার ধবধবে গা, বাদামি কান।

রাজু বললে, কুকুরটা যা জ্বালিয়েছে! খালি ছটফট করে, আর বুড়ো লালাজির হাত চাটে।

তাই নাকি!

কিন্তু আরো অবাক হতে তার বাকি ছিল।

আদালতের বাইরে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়েছিল সুমনের হিলম্যান। আদালত সবে ভেঙেছে, রাস্তায় ভিড়। সেই ভিড় ঠেলে সুমন গাড়ির কাছে এগিয়ে যেতেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল।—আল্লার নামে কিছু দান করো বলতে বলতে সেই ছেঁড়া আলখাল্লা গায়ে অন্ধ ভিখিরি কালু এসে তার গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ধাক্কা লেগে খানিকটা পিছিয়ে গেল সুমন। আর, তখুনি একটা অ্যাসিড—বালব এসে গাড়ির বনেটে লেগে চুরমার হয়ে গেল।

হই হই করে উঠল রাস্তার লোক।

পাথরের মতো অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সুমন। অন্ধ কালু তখন তার লাঠিটা রাস্তার ওপর হাতড়ে খুঁজছে। সুমন লাঠিটা তুলে দিল তার হাত। তারপর রাজুকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিল।

অ্যাসিড—বালবটা যে তাকেই লক্ষ্য করে ছোড়া, সুমনের তা বুঝতে দেরি হয়নি। শত্রুপক্ষের প্রথম আক্রমণ! কিন্তু কারণটা কি? এই মামলা? তা যদি হয়, তবে যে তার দুশমন, সে আসামি চৈতি বাঈয়েরও দুশমন! চৈতিরও শত্রু আছে তাহলে! দূরে নয়, ধারে—কাছেই আছে। তা হলে অন্ধ কালু কে?

আশ্চর্য, বিপদের মুখে দাঁড়িয়েও সুমন খুশি হয়ে উঠল। রহস্যের আবছায়ায় একটা আলো যেন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে!

.

জেন্টলমেন অফ দি জুরি!

ব্যাঘ্র—গর্জনে পি. পি. শর্মাজী সওয়াল—জবাব করছেন।

আজ ক’দিন ধরে আপনারা যথেষ্ট ধৈর্য সহকারে এই মামলার শুনানী শুনেছেন। সেজন্যে আপনাদের ধন্যবাদ। আসামি দোষী কি নির্দোষ, তা সাব্যস্ত করার ভার আপনাদেরই ওপর, আপনাদের বিবেক যা বলবে, তারই ওপর নির্ভর করছে বিচার। তাই আপনারা আপনাদের কর্তব্যে রত হওয়ার আগে আমি আসামির বিরুদ্ধে প্রমাণগুলি সংক্ষেপে বিবৃত করতে চাই।

সোয়া তিনশো পাউন্ড চর্বির স্তূপ দুলিয়ে শর্মাজী টেবিলের ধার থেকে হাঁসফাঁস করতে করতে এগিয়ে গেলেন একেবারে জুরিদের কাছ পর্যন্ত। বলতে লাগলেন, প্রথমেই আপনাদের মনে রাখতে অনুরোধ করছি যে, আসামি কোনো সম্ভ্রান্ত ভদ্রবংশের মেয়ে নয়। সে একজন বাঈজি, নাচে—গানে ছলায়—কলায় পুরুষের মন ভোলানোই যার পেশা। বাঈজিদের জীবনে প্রণয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সাধারণ ঘটনা, এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকেই আসে প্রতিহিংসা। আসামি চৈতি বাঈয়ের জীবনে তাই ঘটেছে। জয়প্রকাশ কাপুরের প্রণয়ে ব্যর্থ হয়ে সে তাকে গুলি করে মেরে প্রতিহিংসার জ্বালা মেটায়। নারী যখন নারিত্বের সওদা করে, তখন এমনিই হয়!

ব্যাঘ্র—গর্জন করে গলাটা বোধ হয় শুকিয়ে গিয়েছিল। টেবিলের কাছে ফিরে এসে শর্মাজী এক গেলাস ঠাণ্ডা লিমনেড খেলেন। গলাটা ভিজিয়ে আবার শুরু করলেন, সাক্ষীদের কথার গুরুত্ব কতখানি তা আপনারাই বিচার করবেন। কিন্তু তাঁদের কথা বাদ দিলে আসামির বিরুদ্ধে যে প্রমাণ আছে, তা অকাট্য। সে প্রমাণ এই! (টেবিলের ওপর থেকে একটা রিভলভারের টোটা তুলে নিলেন শর্মাজী) এই রক্তমাখা টোটা নিহত জয়প্রকাশের বুকের ডান দিক থেকে বেরিয়েছে। এই টোটা ৩.২ সাইজের এবং আসামির রিভলভারের নলের ফাঁদও হচ্ছে এই মাপের। খুনের পর আসামির রিভলভারের নল গরম ছিল না বলে আমার তরুণ বন্ধু মিস্টার চৌধুরি যতই চমক দেবার চেষ্টা করুন না কেন, সরকারি আর্মস—এক্সপার্ট পরীক্ষা করে দেখেছেন রিভলভারের নলের মুখে বারুদ লেগে আছে এবং অস্ত্রের গায়ে আঙুলের যে ছাপ পাওয়া গেছে, ওই আসামি চৈতি বাঈয়ের আঙুলের ছাপের সঙ্গে তার হুবহু মিল! একুশে জুলাইয়ের সেই দুর্যোগের রাতে ঘরে জয়প্রকাশ ও চৈতি বাঈ ছাড়া তৃতীয় ব্যক্তি উপস্থিত ছিল না। সুতরাং, এর পরেও কি সন্দেহ থাকতে পারে যে, আসামিই জয়প্রকাশকে খুন করেছে? আপনাদের সহজ বুদ্ধিবৃত্তিকে জিজ্ঞাসা করুন।

থামলেন পি.পি. এক ঢোক জল মুখে নিয়ে হলুদ রঙের দুটো ট্যাবলেট গিলে ফেললেন। স্নায়ুগুলোকে আরও সতেজ করে নিলেন বোধ হয়। তারপর ব্যাঘ্রবিক্রমে আবার শুরু করলেন, জেন্টলমেন অফ দি জুরি! সভ্য জগতের জঘন্যতম অপরাধ হল নরহত্যা। কোনো দেশেই তার ক্ষমা নেই। আসামি সেই চরম অপরাধে অভিযুক্ত। ন্যায়ের তুলাদণ্ড হাতে আপনারা বসেছেন বিচার করতে—আসামি নারী বলে কোনো দুর্বলতা যেন না আসে। মাননীয় জুরিগণ! চেয়ে দেখুন আসামির দিকে—ওই সুন্দর মূর্তির আড়ালে লুকিয়ে আছে শয়তানের আত্মা! ওই সাদা হাতে মাখা আছে নিহত জয়প্রকাশের রক্তের অদৃশ্য দাগ! আপনাদের আমি আবার অনুরোধ করছি, খুনিকে অব্যাহতি দিয়ে সমাজের ও সভ্যতার অকল্যাণ করেবেন না! ন্যায়বিচার করুন—আসামী খুনি কিনা, আপনাদের বিবেককে জিজ্ঞাসা করুন! এই আমার বক্তব্য।

চেয়ারে বসে পড়ে পি. পি. একটা অতিকায় হাপরের মতো হাঁফাতে লাগলেন। আদালত—ঘরে পিন পড়লেও শোনা যায়, এমন নিঃশব্দতা। গিরিজায়া চোখে আঁচল চেপে আছেন।

কিন্তু যাকে নিয়ে এত কথা, এত বিচার—বিতর্ক, সে লোহার খাঁচার মধ্যে বসেও যেন শত যোজন দূরে। স্তব্ধ উদাস নির্লিপ্ত মূর্তি দেখলে মনে হয় একটা কথাও তার কানে যায়নি।

এবার ডিফেন্স কাউন্সেলের সওয়াল—জবাবের পালা। জজের আদেশে সুমন উঠল ধীরে ধীরে। তার কপালে চিন্তার কয়েকটা রেখা ছাড়া মুখে উত্তেজনার কোনো চিহ্ন নেই। একবার সে তাকাল চৈতির দিকে, তারপর হাতের পেন্সিল দিয়ে চিবুকে মৃদু আঘাত করতে করতে শান্ত নিরুত্তাপ গলায় বলতে শুরু করলে, মি লর্ড! জেন্টলমেন অফ দি জুরি! আমার পূর্ববর্তী বক্তা শর্মাজী তাঁর অসাধারণ বাগ্মিতায় আমাদের চমৎকৃত করেছেন। তাঁর তুলনায় আমার ভাষায় দৈন্য নিয়ে বক্তব্য পেশ করতে কুণ্ঠিত বোধ করছি। তবে ভরসা এই যে, বিচার বিতর্কে ভাষায় চেয়ে যুক্তির প্রয়োজনই বেশি। আবেগের স্রোতে গা ভাসিয়ে শর্মাজী কিন্তু যুক্তির দিকটাই এড়িয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, সভ্য জগতের জঘন্যতম অপরাধ হল নরহত্যা। কোনো দেশেই এর ক্ষমা নেই।—কিন্তু খুন করলেই সি সেটা অপরাধ হয়? আমরা তো ইতিহাসে দেখেছি এক একটা মহাযুদ্ধ লাগে, আর লক্ষ লক্ষ মানুষ লক্ষ লক্ষ মানুষকে খুন করে গৌরবের জয়পতাকা ওড়ায়। একটা মানুষ যদি দশটা মানুষের প্রাণ নিতে পারে, দেশ ও জাতি তাকে বাহবা দেয়, ভিক্টোরিয়া ক্রস বীরচক্র মেডেল দিয়ে তাকে সম্মান করে। কই, সে—খুনের তো বিচার হয় না! ক্রিমিন্যাল বলে তারা নিন্দিতও হয় না। কেন হয় না? হয় না এই কারণে যে সেই মাস—মার্ডার বা পাইকারি খুনের পেছনে একটা বৃহৎ ও মহৎ উদ্দেশ্য থাকে। সেটা হল দেশের সুখ, শান্তি স্বাধীনতা রক্ষা। তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে? খুনটা অপরাধ নয়, যদি মোটিভ ভালো হয়। সুতরাং, কোনো ব্যাক্তি যদি তার ব্যক্তিগত সুখ শান্তি স্বাধীনতা বাঁচবার জন্যে খুন করে, তবে সমাজ তাকে অপরাধী বলতে পারে কি? জেন্টলমেন অফ দি জুরি! আসামির কথা ভাববার আগে আমার এ প্রশ্নের জবাবটা আপনারা ভাবুন।

জুরিরা নীরবে পরস্পরের দিকে তাকালেন।

এজলাসের সামনে সুমন একবার এধার থেকে ওধার পায়চারি করে এল। তারপর আবার শুরু করলে, এখন আমাদের মামলায় আসা যাক। আমার প্রবীণ সহযোগী শর্মাজী বলেছেন, ‘প্রণয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাঈজীদের জীবনে সাধারণ ঘটনা। আর, সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকেই আসে প্রতিহিংসা।’ শর্মাজির যৌবনের ইতিহাস আমার জানা নেই, হয়তো ওঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই একথা বলেছেন। কিন্তু গোড়াতেই একটা ভুল তিনি করে বসেছেন। আসামি চৈতি বাঈ মৃতা সোহিনী বাঈয়ের পালিতা কন্যা। নিজে সে বাঈজী নয়, পেশা সে কোনোদিনই নেয়নি। আসামির জন্ম আমার আপনাদের মতো, এমনকি শর্মাজীর মতোই ভদ্রবংশে। ফৈজাবাদের স্বর্গীয় নীলকণ্ঠ মৈত্র ওর বাপ এবং ওই বিধবা গিরিজায়া দেবী ওর মা। কাকের বাসায় কোকিল ডিম পেড়ে যায়, তাই বলে কোকিল কি কাক হয়? সোহিনী বাঈও আসামিকে বাঈজী কবে তুলতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন আসামি লেখাপড়া শিখে ভদ্র জীবনযাপন করুক। তাই তাকে বেনারসের স্কুলে এবং হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়েছিলেন,গান শিখিয়েছিলেন, কিন্তু গান বাজনার নৈশ আসরে কোনোদিন ঘেঁযতে দেননি। এর ঠিক উল্টো চরিত্র ছিল জয়প্রকাশ কাপুর। ভদ্রবংশের ছেলে হয়েও সে ভদ্র হতে পারেনি, হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষা পেয়েও সে ছিল মাতাল লম্পট জুয়াড়ি। ভালোবাসার ভান করে বিয়ে করবে বলে ভুলিয়ে সে আসামির প্রায় দেড় লাখ টাকার সম্পত্তি নিজের নামে লিখিয়ে নেওয়ার মতলব করেছিল। আসামির সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে সে লিখিয়ে নিয়েও ছিল—এই সেই দলিল! (টেবিল থেকে জোড়া দেওয়া দলিলখানা তুলে জুরিদের হাতে দিল সুমন) কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেই প্রতারণা ধরা পড়ে যায় আসামির কাছে। আর তারই ফলে যা স্বভাবিক, তাই বটে। উত্তেজিত হয়ে ওঠে আসামি। ভালোবাসা নিয়ে খেলা করলে, সরল বিশ্বাসে আঘাত লাগলে কে না উত্তেজিত হয়? জয়প্রকাশের সেই জঘন্য প্রতারণা থেকে শুধু নিজের সম্পত্তি নয়, নারীত্বের সম্মানটুকুও বাঁচাতে গিয়ে আসামি যদি হাতে রিভলভার তুলে নেয়, তবে সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? জেন্টলমেন অফ দি জুরি! সমাজের কল্যাণের কথা যদি বলেন, তবে জয়প্রকাশের মতো একটা মাতাল লম্পট—একজন কুমারীর সর্বনাশ যে করতে যাচ্ছিল—তাকে গুলি করে মারাই কি উচিত নয়? আপনাদের নীতিবোধ কি বলে?

থামলো সুমন। জুরিরা আর একবার পরস্পরের দিকে চাইলেন। সুমনের প্রশান্ত গম্ভীর গলার রেশ মিলিয়ে এল ধীরে ধীরে।

তারপর আবার শুরু করল সে, এবার খুনের ঘটনায় আসা যাক। ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যাক আসামি সত্যিই খুন করেছে কিনা। নিহতের পাশে যে রিভলভার পাওয়া যায়, তার গায়ে আসামির আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে এবং নিহতের দেহ থেকে যে টোটা বেরিয়েছে, তার মাপ আর আসামির রিভলভারের মুখের মাপ একই। আমার বিজ্ঞ সহযোগী এই কোয়েন্সিডেন্স—মাত্র এইটুকু মিল থেকেই সাব্যস্ত করে ফেলেছেন যে, আসামিই খুনি। এ যেন শিশুদের যোগের অঙ্ক কষা! দুই আর দুইয়ে কত? চার। কিন্তু তিন আর একেও কি চার হতে পারে না? জেন্টলমেন অফ দি জুরি! আমি মেনে নিচ্ছি, ঘটনাস্থলে পাওয়া রিভলভারটা আসামিরই—মেনে নিচ্ছি সে ফায়ারও করেছিল। কিন্তু ফায়ার করাটাই শেষ কথা নয়, তার পরেও প্রশ্ন থেকে যায়, গুলিটা জয়প্রকাশের গায়ে লেগেছিল কিনা। আমি বলছি, লাগে নি, লাগা সম্ভব নয়। খোঁজ করে দেখা গেছে, আসামি রিভলভার কেনার পর থেকে একটিমাত্র টোটা ছাড়া দ্বিতীয় টোটা খরচ হয়নি। এত এব, ছোড়া অভ্যেস আসামির আদপেই ছিল না, এ যুক্তি মেনে নেওয়া যায়। তাছাড়া যে উত্তেজিত অবস্থায় সে ফায়ার করেছিল, সেই অবস্থায় কোনো কাঁচা হাতে ছোড়া গুলি লক্ষ্যে লাগা কি সম্ভব?

জুরিরা নড়েচড়ে বসলেন।

সুমন বলতে লাগল, এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জয়প্রকাশকে তাহলে গুলি করল কে? আমি বলব, তৃতীয় ব্যক্তি—যার হাতের টিপ অব্যর্থ, যে একুশে জুলাই রাতে চৈতি বাঈ ও জয়প্রকাশের অজান্তে ঘরের কোথাও লুকিয়েছিল।

জজ বললেন, জয়প্রকাশ ক্ষতি করতে চেয়েছিল আসামির, সুতরাং তার ওপর আসামিরই আক্রোশ থাকা স্বাভাবিক। তৃতীয় ব্যক্তি তাকে খুন করবে কি কারণে?

সুমন বললে, নিজের অপরাধ ঢাকতে। সেই তৃতীয় ব্যক্তি আর কেউ নয়, যে জয়প্রকাশকে চৈতি বাঈয়ের সম্পত্তি ঠকিয়ে নেওয়ার মতলব দিয়েছিল, সেই। পাছে জয়প্রকাশ তার নাম প্রকাশ করে দেয়, সেই আশঙ্কায় তার মুখ সে চিরদিনের মতো বন্ধ দিয়েছে!

মৈনাক পর্বতের মতো উঠে দাঁড়ালেন শর্মাজী। পুরু ঠোঁটে ব্যঙ্গের হাসি এনে বললেন, আমার তরুণ বন্ধু তৃতীয় ব্যক্তির বিষয় যা শোনালেন, রোমাঞ্চকর কাহিনী হিসেবে তা সত্যিই উপাদেয়। কিন্তু আমরা এখানে কাহিনী শুনতে আসিনি, এসেছি সত্যকে প্রমাণ করতে। সে—রাতে আসামির ঘরে তৃতীয় ব্যক্তি হাজির ছিল, তার কোনো প্রমাণ আমার সহযোগী দিতে পারেন কি?

পারি।—পকেট থেকে একটা জিনিস বার করলে সুমন। শ্বেতপাথরের তৈরি দুটি সুগঠন আঙুল—অনামিকা আর কনিষ্ঠা। সেই ভাঙা আঙুল দুটি জজের টেবিলে রেখে সুমন বললে, প্রমাণ এই। সোহিনী বাঈয়ের মাইফিল ঘরে নর্তকীর যে শ্বতপাথরের মূর্তি আছে, এই আঙুল দুটি তারই হাতের ভাঙা অংশ। আঙুল দুটি একুশে জুলাই রাতেই ভেঙেছিল, তা নইলে মৃতদেহের কাছেই পড়ে থাকতে দেখা যেত না। আগে ভাঙলে তুলে রাখা হত বা জুড়ে দেওয়া হত। আমি বলতে চাই, রিভলভারের একই গুলি কি দুটো বস্তুতে লাগতে পারে? একই গুলিতে জয়প্রকাশ খুন হওয়া, এবং নর্তকী—মূর্তির আঙুল ভাঙা কি সম্ভব? তা যখন সম্ভব নয়, তখন নিঃসন্দেহে বলা যায় যে সে—রাতে আর একটা রিভলভার থেকে দ্বিতীয় গুলি ফায়ার করা হয়েছিল। এবং ফায়ার করেছিল সেই তৃতীয় ব্যক্তিই।

তাহলে সেই দ্বিতীয় গুলি তদন্তের সময় পুলিশ পায়নি কেন?

বাঘের মতোই হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন পি.পি।

তার জবাব পুলিশ দেবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দ্বিতীয় গুলি মাইফিল ঘরের কোথাও আছে নিশ্চয়। আদালতের কাছে আমি আর একবার তদন্তের অনুমতি চাইছি।

চিন্তার রেখা পড়ল জজ সাহেবের কপালে। একটু ভেবে বললেন, অনুমতি দেওয়া হল।

আদালত—ঘর গুঞ্জনধ্বনিতে ভরে উঠল। আবার কোন দিকে মামলার মোড় ঘুরবে কে জানে! হত্যা—রহস্যের কোন দরজা খুলে যাবে দেখা যাক।

রাজু বললে, হিরো বটে সুমন চৌধুরি! নাটকটা একাই জমিয়েছে, কি বলুন লালজী? দ্বিতীয় গুলিটা খুঁজে পেলেই বাজিমাত!

কম্ফর্টারখানা ভালো করে জড়িয়ে লালজী বললে, বাজিমাৎ কি অত সহজে হয় ভাইয়া। এ বুড়ো অনেক দেখেছে, অনেক শুনেছে। ধরে নিলাম, দ্বিতীয় গুলিটা পাওয়া গেল। পেলেই বা কি হবে? দ্বিতীয় গুলিটা যে ছুড়েছিল, তাকে যদি ধরতে পারে, তবেই বুঝব হ্যাঁ—তোমার ব্যারিস্টার বাহাদুর!

পারতেও তো পারে।

উঁহু, পারবে না। পুলিশই পারলে না ধরতে, তোমার ব্যারিস্টার পারবে? ও কি রবার্ট ব্লেক?

চটে গেল রাজু। বললে, সুমন চৌধুরি রবার্ট ব্লেকের জ্যাঠামশাই!

তাই নাকি? বেশ, বাজি ধরো—দশ রুপোয়।

ফোকলা দাঁতে হাসতে লাগল লালজী।

রাজু বললে, বেশ, ধরলাম। দশ টাকা।

.

ঘুম আসছে না। অনেক রাত হল, অনেক পেয়ালা কফি ফুরোল, অনেক তামাক পুড়ল পাইপো, ঘুম এল না কিছুতেই। না এল ঘুম, না বসল মন মোটা মোটা আইনের কেভাবে।

লাইব্রেরি ঘরে বসে সুমন শুধু ভাবছে আর ভাবছে। কেন দেখা হল চৈতির সঙ্গে গোধূলিয়া পাহাড়? কেন জড়িয়ে পড়ল তার মামলায়? আর কেনই বা ভালোবাসল তাকে? ভালোবাসা যে এমন অতর্কিতে আসে, সুমন কি তা জানত? নাট্যকার রাজুর কথাই, বোধ হয় ঠিক, জীবনটা একটা নাটক!

চৈতিকে যদি বাঁচাতে না পারে? সুমন কি তাকে ভুলতে পারবে? ভালোবাসলে কি ভুলতে পারা যায়? ডক্টর কেশকার তো সতর্ক করে দিয়েছিলেন, তবু কেন সতর্ক হতে পারল না সে? সুমন কি অনুতপ্ত? না, মোটেই না। চৈতি তার জীবনে ভালোবাসার প্রথম স্বাদ এনেছে। চৈতির কাছে সে ঋণী।

বন্ধ জানলার শার্সিতে একটা পোকা বারবার মাথা ঠুকছে। নিয়তির কাছে যেন অসহায় আত্মসমর্পণ! সেই আওয়াজে চোখ ফেরাতেই সুমনের দৃষ্টি আটকে গেল। জানলার শার্সিতে কালো একটা ছায়া পড়েছে। কে যেন বাইরে চুপিসারে ওত পেতেছে!

এক মুহূর্ত ভাবলে সুমন। তারপর টেবিলের ড্রয়ার থেকে কি একটা জিনিস পকেটে ফেলে বেরিয়ে গেল বাইরে। আশ্চর্য, আলখাল্লা গায়ে সেই অন্ধ ভিখিরি কালু দাঁড়িয়ে! শক্ত মুঠিতে তার হাত চেপে সুমন বললে, এখানে কি মতলবে? ফের দুশমনি করতে?

চাপা গলায় কালু বললে, আল্লা জানে, আমি আপনার দুশমন নই। তাহলে সেদিন আদালতের সামনে আপনাকে বাঁচাতাম না, অ্যাসিডে আপনার মুখ পুড়ে যেত।

কে অ্যাসিড ছুড়েছিল?

তার লোক।

কার লোক?—বলো—বলো শিগগির!

চৈতি বাঈকে যে খুনের মামলায় ফাঁসিয়েছে।

কে সে?

কালুর মুখে আতঙ্ক দেখা দিল। কাঁপা গলায় বললে, বলব বলেই তো এত রাতে লুকিয়ে এসেছি। কিন্তু এখানে নয় ভকিলসাব, কে শুনে ফেলবে! ঘরে চলুন, সব বলব।

.

সওয়াল—জবাবের দ্বিতীয় দিন।

রিভলভারের একটা ফাঁকা টোটা হাতে নিয়ে সুমন বলছে, এই সেই দ্বিতীয় রিভলভারের গুলি। সোহিনী বাঈয়ের মাইফিল ঘরের দেয়াল আলমারির মধ্যে গেঁথে ছিল। অথচ প্রথম বারের তদন্তে পুলিশের চোখ এড়িয়ে যায়। এ গুলি কি আসামির রিভলভারের? না, তার ছ—ঘরা রিভলভারের পাঁচটা টোটা এখনো ভরা। জেন্টলমেন অফ দি জুরি! এবার বলুন ঘটনার রাতে ঘটনাস্থলে তৃতীয় ব্যক্তি উপস্থিত ছিল কিনা।

একটা চাপা শোরগোলে আদালত—ঘরের স্তব্ধতা খানখান হয়ে গেল।

হাতুড়ি ঠুকলেন জজসাহেব : অর্ডার! অর্ডার!

সোয়া তিনশো পাউন্ডের সজীব মৈনাক পর্বত উঠে দাঁড়ালেন। ব্যাঘ্রবিক্রমে বললেন, কিন্তু দুটো গুলিই ৩.২ সাইজের। কোন গুলিটা কার রিভলভারের তা প্রমাণ করবে কে?

প্রমাণ করবে একজন সাক্ষী—ঘটনাটা যে নিজের চোখে দেখেছে। আদালত অনুমতি দিলে তাকে আনতে পারি।

আদালত অনুমতি দিচ্ছে। জজসাহেব বললেন।

কোর্টরুমের বাইরে থেকে সমুনের পিছু পিছু লাঠি ঠকঠকিয়ে কালু এসে দাঁড়াল। গায়ে সেই আলখাল্লা, কটা চোখের তারা দুটো স্থির। জজসাহেবর ভুরু কুঁচকে উঠল। বললেন, এ তো অন্ধ, এর সাক্ষ্যের মূল্য কি?

অট্টহাস্য করে উঠলেন পি.পি.। হেসে বললেন, আমার তরুণ বন্ধু মিস্টার চৌধুরি প্রকৃতিস্থ কিনা সন্দেহ হচ্ছে! একজন অন্ধ ভিখিরিকে এনে তিনি বলছেন, সে ঘটনা স্বচক্ষে দেখেছে! এরপর হয়তো একজন কালাকে এনে বলবেন, সে সব শুনেছে!

কোনো জবাব দিলে না সুমন। নীরবে টেবিল থেকে কাচের পেপারওয়েট তুলে নিয়ে কালুকে লক্ষ্য করে ছুড়ে দিলে। আর, দক্ষ ক্রিকেট খেলোয়াড়ের মতো কালু সেটা সহজেই লুফে নিলে।

স্তম্ভিত হয়ে গেল সমস্ত আদালত।

জজসাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তুমি অন্ধ সেজে থাকো কেন?

হাতজোড় করে কালু বললে, হুজুর, অন্ধ সেজে থাকলে লোকে দুটো পয়সা বেশি ভিক্ষে দেয়।

আসামিকে তুমি চেনো?

লোহার খাঁচার দিকে তাকিয়ে কালুর চোখে জল এসে গেল। বললে, চিনি বৈকি হুজুর। আর জন্মে আমার মা ছিল! রোজ আমায় খেতে দিত, পয়সা দিত।

খুনের ঘটনা তুমি দেখেছিলে?

জী সরকার।

কি দেখেছিলে বলো।

আগের দিন বাঈ আমায় বলেছিল, ‘আমার শাদি হবে, এখান থেকে চলে যাব। কাল বিকেলে তুমি এসো কালু, কিছু টাকা আর গরম কাপড় নিয়ে যেও।’ কিন্তু কে জানত হুজুর বিকেল থেকে বিষ্টি নামবে আর তুফান শুরু হবে! রাস্তায় বেরোলে হাওয়া ঠেলে ফেলে দেয়। সবুর করতে করতে রাত হয়ে গেল, তবু গেলাম বাঈয়ের বাড়ি। যদি বাঈ কালই চলে যায়। ভিখিরির আবার ঝড়—বিষ্টি কি?

রাত তখন কটা?

তখন সীতারাম শেঠদের পেটা ঘড়িতে দশটা বাজছে।

তারপর?

সদর খোলা ছিল, ভেতরে ঢুকে ভয়ে ভয়ে বাঈকে ডাকলাম। কেউ সাড়া দিল না। ভাবলাম, তবে কি বাঈ চলে গেছে? দেখতে হবে। আমি তো সত্যিই অন্ধ নই, অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে ওপরে উঠলাম। বারান্দায় এসে দেখি, মাইফিল ঘরে বাতি জ্বলছে, এক নওজোয়ান ছোকরা আর চৈতি বাঈ দাঁড়িয়ে ঝগড়া করছে। বাঈয়ের হাতে একটা পিস্তল।

সেই নওজোয়ান ছোকরাকে দেখলে তুমি চিনতে পারবে? পি. পি. প্রশ্ন করলেন।

পারব হুজুর।

তিনটি যুবকের ফোটো কালুর সামনে ধরে পি. পি. বললেন, দেখো তো এর মধ্যে কোনটা তার ছবি?

কালু জয়প্রকাশের ছবিখানাই তুলে নিলে।

জজ বললেন, বলো, তারপর কি দেখলে—

সেই নওজোয়ান হুজুর বলছিল, ‘দোষ আমার একার নয়।’ আমাকে একজন মতলব দিয়েছিল, বলেছিল তোমার টাকাকড়ি ফাঁকি দিয়ে নিতে পারলে আধাআধি বখরা।’ ভয়ানক রেখে গিয়েছিল বাঈ, হাত কাঁপছিল, বললে, ‘তার নাম বলো, নইলে গুলি করে মারব!’ ভয়ে নওজোয়ান এদিক—ওদিক ছুটোছুটি করছিল। হুজুর, সেই সময় দেখতে পেলাম, সেই পাথরের নাচওয়ালীর পেছনে আর একটা লোক লুকিয়ে আছে—তারও হাতে পিস্তল!

সমস্ত কোর্টরুম একটা অস্ফুট শব্দ করে উঠল।

কালু বলতে লাগল, বাঈ বলছিল, ‘তার নাম বলো।’ নওজোয়ান ভয় পেয়ে বললে, ‘বলছি’ কিন্তু বলবার আগেই হুজুর, সেই লোকটা আড়াল থেকে দুম করে গুলি করলে নওজোয়ানকে—আর চমকে গিয়ে বাঈয়ের হাতের পিস্তল থেকেও গুলি ছুটে গেল! মুখ থুবড়ে পড়ে গেল নওজোয়ান, গলগল করে তাজা খুন বেরোতে লাগল বুক থেকে—মনে পড়লে এখানো আমার গায়ে কাঁটা দেয় হুজুর!

তুমি তখন কি করলে?

বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছিলাম। সেই লোকটা তখন চুপি চুপি হাত বাড়িয়ে বাতি নিভিয়ে দিলে, তারপর বেড়ালের মতো পা টিপে টিপে বেরিয়ে এল মাইফিল—ঘর থেকে। বারান্দা দিয়ে পালাতে গিয়ে অন্ধকারে আমার গায়ে তার ধাক্কা লেগে গেল—ভীষণ চমকে উঠল সে—কিন্তু আমি অন্ধ বলে কিছু বললে না, সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। নইলে হুজুর আমাকেও খতম করে দিত।

স্বপ্নাচ্ছন্ন চোখে কালুর দিকে তাকাল চৈতি। যেন এক অবিশ্বাস্য গল্প শুনছে। কই, সে তো কিছুই জানতে পারেনি!

আবার উঠে দাঁড়ালেন মৈনাক পর্বত। গর্জন করে উঠলেন, সাক্ষীর কথা যদি সত্য হয়, তবুও সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। তৃতীয় ব্যক্তির গুলিটাই তো নর্তকীর আঙুলে লাগতে পারে—

পারে না। শান্ত অথচ জোরালো গলায় সুমন বললে, আততায়ী লুকিয়েছিল স্ট্যাচুর ঠিক পেছনে, আর নর্তকী তার হাত একটা সাধারণ মানুষের মাথায় চেয়েও উঁচুতে তুলে আছে। সেক্ষেত্রে তৃতীয় ব্যক্তির গুলি নর্তকীর আঙুলে লাগতে পারে কি? বরং তফাত থেকে চৈতির কাঁপা হাতের গুলিই লাগা সম্ভব।

জজসাহেব কালুকে জিজ্ঞেস করলেন, এসব কথা এতদিন জানাওনি কেন?

হাতজোড় করে কালু বললে, জানের ভয়ে হুজুর। কিন্তু বিনা দোষে বাঈয়ের ফাঁসি হয়ে যাবে ভেবে আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। আল্লা কসম হুজুর, বাঈ খুনি নয়, খুনি দোসরা আদমি।

দরদর করে জল গড়িয়ে এল কালুর চোখ দিয়ে।

জুরিরা বিচলিত হয়ে হলেন।

কম্ফর্টার জড়ানো লালজী ফিসফিস করে বললে, ভিখিরিটাকে দিয়ে গল্পটা মন্দ ফাঁদেনি ব্যারিস্টার। কিন্তু শেষ অবধি আজগুবি হয়ে যাবে না তো?

কক্ষনো না।—রাজু বললে।

বেশ, বেশ, না হলেই ভালো। তবে বাজি রেখেছ, মনে রেখো।

জজসাহেব বললেন, সেই দোসরা আমদিকে চেনো তুমি?

কালু বললে, চিনি হুজুর।

কে সে? তার নাম কি?

মুখে আতঙ্ক নিয়ে বোবা হয়ে রইল কালু।

বলো—কোনো ভয় নেই—বলো সে কে?

কালু বললে, রংলাল সারেঙ্গিওয়ালা।

আরেকবার অট্টহাস্যে কোর্টরুম কাঁপিয়ে দিলেন পি.পি। বলে উঠলেন, মি লর্ড, আমরা কি এখানে বাতুলের প্রলাপ শুনতে এসেছি? একথা কে না জানে যে, জয়প্রকাশ খুন হওয়ার এক হপ্তা আগে রংলাল প্রয়োগ জলে ডুবে মারা যায়! সুতরাং সাক্ষীর জবানবন্দী আজগুবি ছাড়া আর কি?

ফোকলা দাঁতে হেসে লালজী বললে, কি হল ভাইয়া? বাজিটা হারলে তো?

হতবুদ্ধি রাজু জবাব দিতে পারল না।

উঠে দাঁড়াল সুমন। স্পষ্ট সুগম্ভীর গলায় বললে, মি লর্ড, জেন্টলমেন অফ দি জুরি! সত্যের রং সাদা, বিজ্ঞ পি.পি. কালো চশমা চোখে দিয়ে তাকে দেখতে পাচ্ছেন না। সারেঙ্গিওয়ালা রংলাল চৌহান মরেনি, বেঁচে আছে। এই কোর্টরুমেই সে উপস্থিত আছে।

নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল সকলের। সারা আদালত—ঘর যেন কবরের মতো ঠাণ্ডা অসাড়।

সুমন বললে, তিন মিনিট সময় দিলাম। রংলাল, তুমি ধরা দাও!

হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে রইল সুমন। কোর্টরুমের দেয়ালে বড় ঘড়িটা টিকটিক শব্দে এক—একটা মুহূর্তের মৃত্যু ঘোষণা করে যাচ্ছে। রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে রইল আদালত।

কঠিন গলায় সুমন বলে উঠল, টাইম ইজ আপ! এখনো বলছি, নিজে ধরা দাও রংলাল! নইলে আমি গিয়ে তোমায় অ্যারেস্ট করব! উঁহু, পালাবার চেষ্টা কোরো না—কোর্টরুমের সকল দরজায় পুলিশ মোতায়েন রেখেছি। আর পকেট থেকে রিভলভার বার করেও লাভ নেই—আমারটা আমার হাতেই আছে। এসো, এগিয়ে এসো—সারেন্ডার!

সকলে স্তম্ভিত হয়ে দেখল, গ্যালারির আসন থেকে এক—পা এক—পা করে নেমে আসছে গলায় কম্ফর্টার জড়ানো চশমা নাকে বুড়ো লালজী! একটানে তার চুল—দাড়ি খুলে দিলে সুমন। আর, লোহার খাঁচার ভেতরে চৈতি বাঈ বিস্ময়ে বেদনায় চিৎকার করে উঠল, রংলাল চাচা!

রংলালের পকেট থেকে তার রিভলভারটা বার করে নিয়ে সুমন বললে, এই সেই রিভলভার, যার গুলি জয়প্রকাশকে খুন করেছে। পি.পি. পরীক্ষা করে দেখতে পারেন, এর টোটাও ৩.২ সাইজের। মি লর্ড, জেন্টলমেন অফ দি জুরি! আর আপনাদের সন্দেহ আছে কি?

জজ বললেন, রংলাল চৌহানকে আমি জয়প্রকাশ খুনের চার্জে অভিযুক্ত করলাম। আসামি, তোমার কিছু বলবার আছে?

মুখ নিচু করে দাঁড়িয়েছিল রংলাল। ধীরে ধীরে মাথা তুলে বললে, শেষ বাজিতে হেরে গেলাম—আর কি বলব হুজুর? কিছু না!

তুমি মরে গেছ বলে মিথ্যে রটিয়েছিলে কেন?

জুয়া খেলে বহুত দেনা হয়েছিল। জেল থেকে বাঁচবার জন্যে।

একুশে জুলাই রাতে চৈতি বাঈয়ের ঘরে লুকিয়েছিলে কি জন্যে?

চৈতির সম্পত্তি লিখিয়ে নিয়ে পাছে জয়প্রকাশ আধা বখরা ফাঁকি দেয়, সেই জন্যে।

রংলালকে সার্জেন্ট নিয়ে গেল। জুরিরা গেলেন পরামর্শ—কক্ষে।

.

ফোরম্যান অফ দি জুরি! এই মামলার রায় সম্পর্কে আপনারা একমত হয়েছেন?

হয়েছি।

আপনাদের সিদ্ধান্ত কি? আসামি চৈতি বাঈ দোষী না নির্দোষ?

নির্দোষ।

উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল জনতা। জ্যাকসন সাহেব সুমনের হাতে হাত মিলিয়ে হাসিমুখে বললেন, শাবাশ ইয়ংম্যান! রংলালকে তুমি চিনলে কি করে?

সুমন বললে, দৈব আমার সহায়, তাই রাজু চৈতির কুকুরটাকেই কিনল। আর আমি চেনার আগেই রেশমি রংলালকে চিনল। তাছাড়া রাজুর সঙ্গে বাজি রাখায় আমার সন্দেহ জোরালো হয়। পাকা জুয়াড়ি তার স্বভাব বদলাতে পারে না।

গিরিজায়া তখন মেয়েকে বুকে জড়িয়ে হাউ হাউ করে কাঁদছেন।

.

বারাবাঁকির সেই বেগম—মহলের গোল—বারান্দায় চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে চৈতি। ঝুলনিয়া আজ তাকে সাজিয়ে দিয়েছে। এই মহলটা দিন কয়েকের জন্যে জন্য ভাড়া নিয়েছে চৈতি। গোল—দরওয়াজার বাড়িতে আর ফিরে যাবে না।

জাফরির ফাঁক দিয়ে মজা—দিঘির পানে তাকিয়ে আছে সে। একক লাল পদ্মটার আরেকটা কুঁড়ি দেখা দিয়েছে।

সুমন এসে ডাকলে, চৈতি!

ফিরে তাকাল চৈতি! মৃদু হেসে বললে, আমি আর চৈতি নই, আমি শান্তি—শান্তিলতা। আমায় কবে নিয়ে যাবে তোমার বাড়িতে? নিয়ে যাবে তো?

হেসে বললে সুমন, নিয়ে না গিয়ে উপায় কই? জটিয়াবাবা যা জট পাকালেন।

হই হই করে ঢুকে পড়ল নাট্যকার রাজু। বগলদাবায় রেশমি। চৈতির হাতে দিয়ে বললে, ম্যাডাম, তোমাদের বিয়ের উপহার। তারপর সুমনকে বললে, দেখলি তো ইয়ার, লাস্ট অ্যাক্টে হিরো আর হিরোইন মরতে বসেছিল, নাট্যকার রাজুই তোদের বাঁচিয়ে দিল।

কি রকম?

ভাগ্যিস খুঁজে খুঁজে এই কুকুরছানাটাই কিনেছিলাম, তাই তো মামলায় বাজি মেরে দিলি! যাক, নাটকের উজ্জ্বল দৃশ্যে তৃতীয় ব্যক্তির থাকা উচিত নয়।

চলে যেতে গিয়ে ফিরে এল রাজু, ইস, বড্ড ভুল হয়ে গেছে! দশটা টাকা হবে?

সমাপ্ত