চৈতি বাঈয়ের মামলা – ৪

চার

আপনি রোজ রোজ আসেন কেন?

তোমাকে দেখতে আসি।

আপনি তো অনেক মেয়ে দেখেছেন।

দেখছি, কিন্তু তারা তুমি নয়।

আমি কী?

তুমি সুন্দর। রূপ অনেকের থাকে, সুন্দর ক’জন?

ফ্যাকাশে মুখে রক্তের রঙ লাগল! মুখ ফিরিয়ে নিলে চৈতি। আর মনে মনে নিজেই নিজেকে বাহবা দিলে সুমন। প্রেমের অ আ ক খ না জেনেই বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারছে সে।

ধীরে ধীরে জাফরির পাশে সরে গেল চৈতি। জাফরি বেয়ে একটা লতা উঠেছে। তার দু’—একটা পাতা ছিঁড়তে ছিঁড়তে হঠাৎ বললে, আপনি আর আসবেন না।

সুমন চৈতির মনের অবস্থা বোঝবার চেষ্টা করলে। তার তরুণী মন কি সাড়া দিচ্ছে না সুমনের এই এগিয়ে যাওয়ায়? পরিবেশটা তো অনুকূল। সন্ধ্যাকাল, চাঁদ উঠেছে, চারধার নির্জন। তবে?

সুমন বললে, তুমি কি বিরক্ত হয়েছ শান্তিলতা?

না। এখানে আপনার আর না আসাই ভালো।

না এসে আমি পারি না। দূরে থাকলেও আমার সমস্ত মন পড়ে থাকে এখানে।

পিছন ফিরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল চৈতি।

গলার আওয়াজে অভিমান আনতে চেষ্টা করলে সুমন। বললে, কিন্তু তুমি যখন চাও না, আমার চলে যাওয়াই ভালো।

দরজার দিকে এগোল সে। কিন্তু দরজা অবধি পৌঁছোবার আগেই চৈতি ডাকলে, সুমন!

সে—ডাকে আবেগ, মিনতি আর লজ্জা মেশানো।

আর একবার মনে মনে নিজের পিঠ চাপড়ালে সুমন। নিখুঁত অভিনয় হয়েছে তার! কঠিন বরফ বোধ হয় এবার গলতে শুরু করল। জয় হোক ডক্টর কেশকারের!

ফিরে এল সুমন। জিজ্ঞেস করলে, আবার কেন ডাকলে?

থেমে থেমে কাঁপা গলায় চৈতি বলতে লাগল, আমার অতীত নেই—কোনো পরিচয় নেই—আমার মতো মেয়ের সঙ্গে কেন তুমি নিজেকে জড়াতে চাইছ সুমন?

তুমি ভাগ্য মানো শান্তি? তোমার সঙ্গে আমার জীবনটা জড়িয়ে যাবে, এটা বোধ হয় ভাগ্যের লেখা। নইলে, কোথায় ছিলে তুমি, কোথায় ছিলাম আমি! কেন দেখা হল বলো?

নতমুখে চৈতি দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। রংবেরঙের নকশা—কাটা মেঝের দিকে চোখ রেখে বলতে লাগল, কি জানি কেন, দিনরাত আমার ভয় করে—আমি ঠিক বুঝতে পারি না। তবু মনে হয়, আমাকে যেন একটা বিপদ ঘিরে আছে! না, না, সুমন, আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাও, তুমি ফিরে যাও!

আনত চোখের দীর্ঘ পল্লব ভিজিয়ে টসটস করে ফোঁটায় ফোঁটায় জল পড়তে লাগল।

সুমন যেন স্টেজের পাকা অভিনেতা। ডক্টর কেশকারের নির্দেশ মতো শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করলে। চৈতির দিকে একটু ঝুঁকে গলায় আবেগ এনে বললে, আর ফেরবার উপায় নেই। আমি তোমাকে ভালোবেসেছি শান্তিলতা।

আমার অতীত যদি ভালো না হয়?

তবুও ভালোবাসব।

চৈতির সারাদেহ একবার কেঁপে উঠল। জলে—ভেজা চোখ দুটি সুমনের মুখের দিকে তুলে প্রশ্ন করলে, সত্যি বলছ?

সেই একজোড়া ভাসা ভাসা ভিজে চোখে কি যে ছিল, সুমনের তা বুঝতে দেরি হল না। হঠাৎ একটা অপরাধবোধ তাকে বোবা করে দিল। একটি মেয়েকে প্রবঞ্চনা করার গ্লানিতে তার পুরুষচিত্ত যেন ছি—ছি করে উঠল তাকে। কিন্তু এতটা এগিয়ে আর তো ফেরা চলে না! আরও এগিয়ে যেতে হবে লক্ষ্যস্থলে না পৌঁছানো পর্যন্ত। জানতেই হবে চৈতি বাঈয়ের অপরাধ—রহস্য, জয়প্রকাশকে কেন খুন করেছে, কি অবস্থায় খুন করেছে। সে ডিফেন্স কাউন্সেল। সত্য, ন্যায় আর আইনের প্রতিনিধি সে, কোনো দুর্বলতাকেই প্রশয় দেবে না।

নিজেকে শক্ত করে নিলে সুমন। একটু নকল হাসি মুখে ফুটিয়ে বললে, তোমার কি বিশ্বাস হয় না?

বিশ্বাস করতে ভয় হয়। মনে হয়, কোনো সুখই বুঝি আমার জন্যে নয়!

ভিজে চোখ আবার ভিজে এল। সুমন বুঝতে পারলে, বিস্মৃত অতীত চৈতির অবচেতন মনের গভীরে সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার স্মৃতি অস্পষ্ট হলেও অবলুপ্ত হয়নি আজো। বন্ধ দরজায় ঘা দেওয়ার এই সুযোগ!

চৈতির হাত ধরে সুমন মোড়ায় বসালে। বললে, এত ভয় কেন তোমার শান্তি। তোমার জীবনে কি কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছিল কখনো? উত্তেজনার ঝোঁকে কোনো অপরাধ? মনে করে দেখো তো।

দুর্ঘটনা! অপরাধ! কই, মনে তো পড়ে না।

তবে ছেড়ে দাও ও—ভাবনা! অন্য কথা পাড়লে সুমন। তুমি আজ গ্রামোফোন রেকর্ড বাজাচ্ছ না?

বাজাব?—এতক্ষণে সহজ হয়ে উঠল চৈতি বাঈ। বললে, কোন গান বাজাব বলো?

রেকর্ডের গান নয়, আজ তোমার মুখে গান শুনতে ইচ্ছে করছে।

খুশিতে উছলে উঠল চৈতি।

কতদিন গান গাইনি আমি! কত গান জানতাম, কত ভুলে গেছি! কোন গান শুনবে সুমন?

চৈতির মুখের পানে লক্ষ্য রেখে সুমন বললে, অতুলপ্রসাদের সেই বাংলা গানটা—বঁধুয়া নিদ নাহি আঁখিপাতে—

ও গান আমি তো জানি নে সুমন।—সরলভাবে চৈতি বললে।

সে কি! জানো না? ও গানটা যে লোকের মুখে মুখে ফেরে। আচ্ছা, তোমায় শুনিয়ে দিচ্ছি।

ত্রিপদী টেবিলের ওপর সুমন একটা প্যাকেট এনে রেখেছিল। খুলে রেকর্ডখানা বার করলে, গোল—দরওয়াজার বাড়ি থেকে আনা সেই রেকর্ড! তারপর চাপিয়ে দিলে বারান্দার একধারে রাখা গ্রামোফোন মেশিনে। জ্যাকসন সাহেবকে বলে মেশিন আর কিছু রেকর্ড সুমনই পাঠিয়েছিল এখানে।

শুরু হল গান। আর চৈতির দিকে সজাগ লক্ষ্য রেখে বসে রইল সুমন।

 ‘বঁধুয়া, নিদ নাহি আঁখিপাতে।

 আমিও একাকী তুমিও একাকী

 আজি এ বাদল রাতে।’

শরতের পরিষ্কার আকাশে বাদলের চিহ্নমাত্র নেই। তবু প্রাচীন প্রমোদ—ভবনের এই গোলবারান্দায় কোনো নিঃসঙ্গ আত্মার আক্ষেপ বেহাগ—রাগে যেন গুমরে উঠতে লাগল। শুনতে শুনতে চৈতি কেমন—ধারা হয়ে গেল। বললে, কোথায় পেলে এই গান সুমন? এ—গান যেন শোনা—

সুমন সাগ্রহে বললে, এ গান তোমার শোনা! কোথায় শুনেছিলে চৈতি বাঈ?

সুমন আর শান্তিলতা নামে ডাকলে না, ইচ্ছে করেই বললে চৈতি বাঈ।

এক মনে শুনতে শুনতে চৈতি বললে, এ গানের মধ্যে আমি ঝড়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি—বৃষ্টির শব্দ! কে যেন এল সেই ঝড়ের মধ্যে!

উৎসুক হয়ে উঠল সুমন। একুশে জুলাই রাতে ঝড়—জলের দুর্যোগ ছিল! তবে কি খুলছে—একটু একটু করে খুলে যাচ্ছে পূর্বস্মৃতির বন্ধ দরজা?

সুমন বললে, আর কিছু মনে পড়ছে না? কে এসেছিল সে—রাতে? সেই ঝড়—জলের রাতে? ভেবে দেখো চৈতি বাঈ—দেশ করে ভেবে দেখো।

চঞ্চল হয়ে উঠল চৈতি। মুখে যন্ত্রণার রেখা দেখা দিল। কাতর স্বরে বললে, ভাবতে আমি আর পারছি না সুমন! আমার মাথার মধ্যে কেমন করছে! বন্ধ করে দাও গান—বন্ধ করো!

বন্ধ করে দিল সুমন। না, স্মৃতির বিকল যন্ত্রের ওপর চাপ দেওয়া ঠিক হবে না। কে জানে, হয়তো হিতে বিপরীত হবে! বন্ধ দরজা আপনা আপনি খুলে যাওয়া চাই। একটা অভিজ্ঞানে খুলব খুলব হয়েছে, আরও অভিজ্ঞান রয়েছে। কোনটায় কাজ হবে কে জানে।

খানিকটা শান্ত হয়েছে চৈতি। দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসে আছে মোড়ায়। ক্লান্ত, করুণ, উদাস। মায়া হয় দেখলে।

প্যাকেট থেকে ফোটো—অ্যালবামখানা বার করলে সুমন। চৈতির পাশে বসে আস্তে আস্তে ডাকলে, শান্তি!

চৈতি চোখ মেলে তাকাল।

এখন একটু ভাল বোধ করছ কি?

ফ্যাকাশে মুখে ক্ষীণ হাসি দেখা দিল।

এসো, কয়েকখানা ছবি দেখাই তোমাকে।

অ্যালবামটা খুলে ধরলে সুমন। প্রথম পাতায় চৈতিরই একখানা ফোটো। পরনে জরি বসানো ঘের—দেওয়া ঘাঘরা, বুকে চোলি, মাথায় ওড়নি, সিঁথিতে টিকলি। ঠোঁটে মুনি—মন—জয়করা হাসি।

সুমন জিজ্ঞেস করলে, এ কে?

তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে চৈতি অ্যালবাম থেকে ফোটোখানা খুলে নিল ফস করে। ঘরে গিয়ে আরশির সামনে দাঁড়াল, অবাক হয়ে বারবার দেখল। নিজেকে আর ফোটোখানাকে; তারপর ফিরে এসে বললে, আমি। কিন্তু এ কেমনতর আমি! কবেকার আমি! একি পোশাক আমার!

মনে পড়ছে না?

চৈতি মাথা নাড়লে। মনে পড়ছে না।

খান দুই পাতা উলটে গেল সুমন। বেরোল আরেকটি নারীর ছবি। বয়স হয়েছে, চল্লিশের কাছাকাছি, তবু অসামান্য রূপসী। শাড়িপরা চেহারা।

আচ্ছা, ইনি কে? জিজ্ঞেস করলে সুমন।

ফোটোখানার পানে চেয়ে রইল চৈতি। আর চৈতির পানে সুমন।

ধীরে ধীরে চৈতির মুখে ভাবান্তর হতে লাগল। একটু একটু করে উজ্জ্বল হয়ে উঠল সে—মুখ। অপরিচয়ের অন্ধকারে বুঝি আলো। দেখা দিয়েছে এতদিন পরে। মনের সাদা কাগজে পড়েছে স্মৃতির আঁচড়!

উৎসুক সুমন আবার জিজ্ঞেস করলে, কে ইনি? চিনতে পারছ?

অস্ফুট স্বরে চৈতি বললে, বেনারসী মা!

অধীর আগ্রহে সুমন বললে, বেনারসী মা! কি নাম ছিল মনে পড়ে?

নাম? সোহিনী বাঈ।

বাড়ি?

বলছি—লক্ষ্নৌ গোল—দরওয়াজা। আমিও ছিলাম সেখানে।

আরও তিনখানা পাতা দ্রুত উলটে গেল সুমন। বেরোল এক পুরুষের ছবি। যৌবন অতিক্রান্ত, মাথায় কালো ভেলভেটের বাঁকা টুপি, গায়ে কামিজের ওপর ওয়েস্টকোট, চোখের কোলে অমিতাচারের কালো ইতিহাস।

এ কার ছবি? জিজ্ঞেস করলে সুমন।

রংলাল চাচার।

কি করত মনে আছে?

বেনারসী মায়ের মুজরোতে সারেঙ্গি বাজাত। খুব ভালবাসত আমাকে। চামেলি আতর কিনে দিত। মনে পড়ছে—সব মনে পড়ে যাচ্ছে আমার!

সাফল্যের আনন্দে মেতে উঠল সুমন। মনে পড়ছে চৈতি বাঈয়ের! অভিজ্ঞান কাজ করছে। খুলে যাচ্ছে পূর্বস্মৃতির বন্ধ দরজা! খুনের রহস্য আর অস্পষ্ট থাকবে না—কুয়াশা ভেদ করে এইবার বেরিয়ে আসবে সত্যের সূর্যরশ্নি!

আরও দ্রুত হাতে পাঁচখানা পাতা ওলটাল সুমন। বেরোল এক যুবকের ছবি। সুপুরুষ চেহারা, কালো শেরওয়ানি গায়ে, ঠোঁটের ওপর সরু গোঁফের রেখা মুখখানাকে তীক্ষ্ন করেছে, উজ্জ্বল দুই চোখে যেন ব্যঙ্গমিশ্রিত হাসি।

চৈতির মুখের পানে চোখ রেখে সুমন প্রশ্ন করলে, এ কে?

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বদলে গেল চৈতির মুখের চেহারা। ফ্যাকাশে মুখ পলকের জন্য টকটকে লাল হয়ে উঠেই আরও ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ভাসা ভাসা চোখ দুটো আতঙ্কে আরও বড় হয়ে উঠল। ঘন ঘন নিশ্বাসে ফুলে ফুলে উঠতে লাগল নাকের পাটা দুটো। বাহ্যজ্ঞানরহিতের মতো শুধু তাকিয়েই রইল ফোটোখানির দিকে।

সুমন আবার প্রশ্ন করলে, বলো এ কে?

উদভ্রান্তের মতো চৈতি বলে উঠল, কেউ না—ও কেউ না!

উঠে চলে যাচ্ছিল চৈতি, খপ করে হাতখানা নিজের মুঠোর মধ্যে ধরে ফেলল সুমন। বললে, এ জয়প্রকাশ। বলো এ জয়প্রকাশ কিনা!

আমি ওকে চিনি না।

চেনো, নিশ্চয় চেনো।

না!

চৈতি, বলো।

না, না, না! আমি বলব না—বলতে পারব না!

সরু গলায় সভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল চৈতি। আর, সে চিৎকার, প্রাচীন বেগমমহলের খিলানে খিলানে ধাক্কা খেয়ে একটা অলৌকিক প্রেতস্বরের মতো বাজতে লাগল। ছুটে এল ঝুলনিয়া। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে, তাড়া—খাওয়া ভীত পশুর মতো চৈতি ছুটে চলে গেল ঘরের মধ্যে। দড়াম করে বন্ধ করে দিলে দরজা।

হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সুমন। মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিল অ্যালবামখানা। তারপর ইশারায় ঝুলনিয়াকে ডেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল।

.

বারমহলের বারান্দায় এসে সুমন বললে, চৈতির কাছে কতদিন কাজ করছ তুমি?

মনে মনে হিসেব করে ঝুলনিয়া বললে, করিব আট সাল হবে।

তবে তো তুমি সোহিনী বাঈয়ের ঘরের সব খবরই রাখতে। তাই না?

আমি নোকরানি, মনিবের সব খবর কেমন করে রাখব জী? কিছু কিছু রাখতাম।

আচ্ছা, তোমার মনিব কেমন মানুষ ছিলেন?

অমন মানুষ হয় না ভকিলসাব!—ঝুলনিয়ার চোখ ভিজে উঠল।

জীবনে অনেক টাকা রোজগার করেছিলেন, না?

জী। বেনারসের সেরা বাঈজী ছিলেন আমার মনিব। বড় বড় আমিরলোগ আসত—টাকার তোড়া ঢেলে দিত তাঁর পায়ে! কিন্তু যত রোজগার করেছিলেন, রাখতে পারেননি ততটা।

কেন?

রংলালের জন্যে।

রংলাল কেমন লোক ছিল?

মুখ—চোখ ঘুরিয়ে ঝুলনিয়া বললে, বজ্জাত! সরাব আর জুয়া ছাড়া কিছু জানত না। টাকা জোগাতেন আমার মনিব। জুয়া খেলে মাতলামি করে কত সময় পুলিশে ধরা পড়ত। মোটা টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনতেন বড় বাঈ। রংলালের জন্যে শান্তি ছিল না তাঁর।

তাই নাকি? কিন্তু রংলাল তো একটা সারেঙ্গিওয়ালা, তাকে এত আশকারা দিতেন কেন সোহিনী বাঈ?

সারেঙ্গি বাজনায় ওর নাকি জোড়া ছিল না। ও না বাজালে বড় বাঈয়ের আসর জমতই না। প্রয়াগে জরুর নেশা করেই ডুবে মরেছে!

সুমন জিজ্ঞেস করলে, সোহিনী বাঈ তাঁর সমস্ত দৌলত কাকে দিয়ে গেছেন? চৈতিকে নিশ্চয়?

জী। ছোটি বাঈ ছাড়া আর কে—ই বা ছিল তাঁর!

সুমন এবার অ্যালবাম খুললে। বললে, এ কে বলতে পারো?

ঝুলনিয়া বললে, এ তো জয়প্রকাশ।

কেমন লোক ছিল?

বড় ঘরের ছেলে বলেই মনে হত। তার চালচলন কথাবার্তা সবই ভাল ছিল, কেবল ভাল লাগত না রংলালের সাথে তার মেলামেশা। মাঝে মাঝে দেখতাম, মির্জা আতরওয়ালার দোকানে দুজনে কথা হচ্ছে।

নেশাটেশা করত নাকি জয়প্রকাশ?

কখনো দেখিনি।

অ্যালবাম বন্ধ করে সুমন বললে, আচ্ছা, তুমি যাও।

ঝুলনিয়া গেল না। উৎকণ্ঠায় কাতর হয়ে বললে, মারা যাবার সময় বড় বাঈ বলেছিল, ঝুলনিয়া, ছোটি বাঈকে তুই দেখিস! ছোটি বাঈয়ের কি সাজা হয়ে যাবে ভকিলসাব?

সে—জিজ্ঞাসার কোনো জবাব দিলে না সুমন। অন্য প্রশ্ন করলে, চৈতির স্বভাব—চরিত্র কেমন ঝুলনিয়া? লুকিয়ো না, সত্যি বলো।

রামজী কসম ভকিলসাব, ছোটি বাঈয়ের মধ্যে এতটুকু মন্দ নেই। ফুলের মতো নরম ওর মন, মানুষকে প্যার করাই ওর স্বভাব। মেজাজ ওর রাগী ছিল বটে—রাগ হলেই কাচের ডিশ, আরশি, আতরের শিশি সব ভেঙে চুরমার করত—কিন্তু সে শুধু ওর মনটা বাচ্চচার মতো নরম বলে।—ছোটি বাঈকে বাঁচাতে পারবে তো ভকিলসাব?

এক মুহূর্ত নিরুত্তর রইল সুমন। তারপর বললে, আমিও নিজেকে ঠিক এই কথাই জিজ্ঞেস করছি ঝুলনিয়া।

আর দাঁড়ালে না সুমন।

.

বারাবাঁকিতে সুমন আবার পরের দিনই গেল। তখন বিকেল বেলা।

অন্দরে যাবার মুখে ঝুলনিয়া জানালে, ছোটি বাঈ বলেছে চৌধুরিসাব যেন ফিরে যান। আর দেখা হবে না।

ছোটি বাঈয়ের তবিয়ত কেমন?

ভালো নয়! কাল রাত থেকে বিশেষ কিছু খায়নি।

কোথায় সে?

ঘরে শুয়ে আছে।

সুমন ভেতরে গেল। গোলবারান্দা ফাঁকা। ঘরেও চৈতি নেই। বিছানার ওপর একটা জিনিস চোখে পড়ল। সুমন সেটা তুলে নিলে। একখানা অসমাপ্ত চিঠি। বাঁকা বাঁকা বাংলা হরফে লেখা:

সুমন,

জানি তুই আবার আসবে। তাই এই চিঠি লিখছি। এই চিঠি নিয়ে তুমি ফিরে যেও, আর এসো না। আমার সব শেষ হয়ে গেছে।

ভালোবাসার সাধ বোধ হয় মেয়েদের রক্তে। তোমায় দেখে আমারও তাই নতুন করে বাঁচতে সাধ হয়েছিল। কিন্তু কেন তুমি আমার ভয়ঙ্কর অতীতকে মনে করিয়ে দিলে সুমন? আমি তো ছিলাম সব ভুলে গিয়ে। আমার স্বপ্নে—গড়া তাসের ঘর ভেঙে দিয়ে কী সুখ পেলে তুমি!

কিন্তু দোষ আমি তোমার দিই না। দোষ দিই আমার……

আর লেখা হয়নি।

চিঠিখানা হাতে নিয়ে সুমন স্তব্ধ হয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে বেরিয়ে গিয়ে ছাদের সিঁড়ি ধরলে।

ছাদেই আছে চৈতি। বিকেলের আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা মিনারের নিচে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পিছন থেকে সুমন ডাকলে, শান্তিলতা!

চমকে ফিরে দাঁড়াল চৈতি। আরও রোগা দেখাচ্ছে তাকে। ফ্যাকাশে মুখ বিকেলের আলোয় আরও ফ্যাকাশে মনে হচ্ছে। চোখ দুটো ফোলা ফোলা। বোধ হয় কেঁদেছে বহুক্ষণ। অনেক ঝড় পার হয়ে ক্লান্তপক্ষ একটি পাখি যেন ছাদে আশ্রয় নিয়েছে। বড় সুন্দর, বড় করুণ। একটা অদ্ভুত অনুভূতিতে ভরে গেল সুমনের মন। সেটা মায়া, না মমতা, না আর কিছু, বুঝতে পারল না।

শান্ত গলায় চৈতি বললে, আমি শান্তিলতা নই, চৈতি বাঈ। পুলিশের কয়েদি।

সুমন বুঝলে লুকোচুরি এখন মিছে। বললে, জানলে কেমন করে?

পুলিশে ধরা দেব বলে সকালে বেরোতে যাচ্ছিলাম। পাহারাদারেরা আটকে দিল। বুঝলাম, মিথ্যে বলেছিলে তুমি, পুলিশ আজও ছাড়েনি আমায়।

সবই যখন জানতে পেরেছ, তখন আমার আসল পরিচয়টাও জেনে রাখো।

জানি। তুমি আসামি পক্ষের ব্যারিস্টার।

কে বললে?

ঝুলনিয়া। বলতে প্রথমে চায়নি।

সুমনের গলায় আগ্রহ প্রকাশ পেল, তাহলে তোমার সব কথা এবার আমায় বলো।

অত্যন্ত উদাসীনের মতো চৈতি বললে, তুমি তো জানো, আমি জয়প্রকাশকে খুন করেছি।

তবু ঘটনার পুরো বিবরণ, কারণ, উদ্দেশ্য সবই আমার জানা দরকার! নইলে তোমাকে বাঁচাবার চেষ্টা করব কেমন করে?

সে চেষ্টা আর কোরো না।

একি বলছ! একটা জীবনের দাম লাখো কোহিনুরের চেয়েও (৮০—৮১ ছাড়) শিখিয়ে মানুষ করতেও তাঁর আগ্রহ ছিল খুব। তাঁরই চেষ্টায় আমি স্কুলের পড়া শেষ করে হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে এক বছর পড়েছিলাম।

ছোটবেলায় দেখতাম, আমাদের বাড়িতে কত লোকজন আসত, বেনারসী মা পরীর মতো সেজেগুজে তাদের মাঝখানে গান গাইতেন। দূর থেকে শুনতাম তাঁর গান, কাছে যাবার হুকুম ছিল না। একদিন আপনমনে তাঁরই একটা গান গাইছিলাম, তখন আমার বয়স বারো। বেনারসী মা শুনে আমায় ধমকে দিলেন। কেন যে তিনি আমার গানের ওপর রাগ করেছিলেন, সেদিন বুঝিনি। কিন্তু ধমক খেয়েও গানের প্রতি ভালোবাসা আমার কমল না। লুকিয়ে লুকিয়ে আমি গাইতাম। উৎসাহ পেতাম কেবল রংলাল চাচার কাছে। শেষ অবধি বেনারসী মা নিজেই আমাকে শেখাতে শুরু করলেন। বলতেন, আমার মেয়ে হবি বলেই তুই এমন গলা নিয়ে জন্মেছিস। কিন্তু তোর জীবনটা যেন আমার মতো না হয় বেটি! সে—কথার মানেটা তখন বুঝতাম না, মনে হত বেনারসী মায়ের মতো সুখী কে? কত রূপ, কতবড় গাইয়ে, কতা টাকা! কিন্তু তবুও এক—একদিন রাতে ঝগড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে যেত, আর খানিক বাদেই বেনারসী মা পাশের ঘর থেকে এসে আমায় বুকে জড়িয়ে নীরবে কাঁদতেন।

আমার যখন উনিশ বছর বয়স, তখন বেনারসী মায়ের শরীরটা ভাঙল। মাঝে মাঝে বুকে কি যেন একটা ব্যথা ধরত, গাইতে বসলে হাঁপিয়ে পড়তেন। বেনারস ছেড়ে লক্ষ্নৌয়ে বাড়ি কিনে চলে এলেন। আগের মতো আর মুজরো করতে পারতেন না। একদিন বলেছিলাম, আমি গাইব মা? সেদিন তাঁর যে মূর্তি দেখেছিলাম, জীবনে আর কখনো দেখিনি। লক্ষ্নৌয়ে আসার পর বছর দেড়েক মাত্র বেঁচেছিলেন বেনারসী মা। মারা যাবার দিন কতক আগে একদিন আমাকে কাছে ডাকলেন। আমার মুখের পানে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ, দুই চোখ দিয়ে স্নেহ—মমতা যেন ঝড়ে পড়ছিল। তারপর বললেন, আমার মেয়াদ আর বেশিদিন নয়। একটা কথা বলে যাই বেটি। গান—বাজনার লাইনিটা ভালো নয়, মানুষ এতে সুখী হয় না।

জিজ্ঞেস করলাম, এ—কথা কেন বলছ বেনারসী মা?

বেনারসী মা বললেন, আমি নিজে সুখী হতে পারিনি বলে। তোর মতো আমিও ছোটবেলা থেকে গান ভালবাসতাম। কিন্তু সেই হল আমার কাল! যৌবনে পা দিয়ে এমন একজনকে ভালবাসলাম, যার মুখের গান আর হাতের বাজনা সাপুড়ের বাঁশির মতো আমায় বশ করে ফেলল—সে রংলাল চৌহান। গোটা দেশে এমন গুণী কমই আছে। এই রংলালের মোহে আমি ঘর ছাড়লাম। কাশীতে গিয়ে আমাদের বিয়ে হল। আমার স্বামীর না ছিল চাল, না ছিল চুলো। তবু গণেশমহল্লার একখানা ঘুপসি ঘরে স্বামী আর গান নিয়ে আনন্দেই দিন কাটতে লাগল। ক্রমে বুঝতে পারলাম, আমার গুণী স্বামীর গুণ অনেক। হেন নেশা নেই যা ও করে না, জুয়াতেও সিদ্ধহস্ত। দিন যখন আর চলে না, রংলাল তখন আমার ওপর জোর করতে লাগল মুজরো করার জন্যে। শেষ অবধি তাই হল। আমার শেষ গয়নাখানা ওর নেশা আর জুয়ায় শেষ করে একদিন ডালকামণ্ডির বাঈজিপাড়ায় গিয়ে উঠলাম। স্বামী বলে পরিচয় দিতে বাধল, তাই রংলাল হয়ে রইল বাঈজীর সারেঙ্গিওয়ালা। মেয়েমানুষের জীবনে এর চেয়ে মর্মান্তিক ব্যথা আর কি আছে বলতে পারিস? কিন্তু রেহাই পেলাম না তবু। একদিন কাশী ছেড়ে আমাদের লক্ষ্নৌয়ে পালিয়ে আসতে হল। কেন জানিস? পালিয়ে না এলে রংলাল সেখানে খুন হয়ে যেত। বাইরের যারা, তারা জানে সোহিনী বাঈয়ের কত নাম, কত টাকা, কত সুখ! কিন্তু কোন দুঃখের আগুনে সারাটা জীবন আমি পুড়ে মরেছি, সে তুই ছাড়া কাউকে জানতে দিইনি।

বেনারসী মায়ের চোখ দিয়ে জল পড়ছিল। মুছিয়ে দিয়ে বললাম, অমন স্বামীকে তুমি তাড়িয়ে দাওনি কেন?

ভালবাসলে কি তাড়িয়ে দেওয়া যার রে? তুই পারিস তোর ওই রেশমীকে তাড়িয়ে দিতে?—আমার কোলের পোষা কুকুরটাকে দেখিয়ে বেনারসী মা বললেন। রেশমীকে আমি বুকে চেপে ধরলাম। ভারি সুন্দর ছিল সে, ধবধবে সাদা, কেবল ঝুলে—পড়া কান দুটো বাদামি। বেনারসী মা আবার বললেন, আমার সদাই ভাবনা হয়, ভয় হয় তোর জন্যে বেটি। গানকে ভালবেসে তোর জীবনটা যেন আমার মতো বরবাদ হয়ে না যায়। একটা কথা বলে যাই শোন। গানকে ভালবাসিস, কিন্তু কোনো গাইয়ে—বাজিয়ের সঙ্গে ভালবাসা করিস নে। যা রেখে যাচ্ছি তোর জন্যে তা যথেষ্ট। একটি ভাল ঘরের ভদ্র ছেলেকে বিয়ে করে সুখী হোস। আমার কথা মনে থাকবে? বল বেটি!

বললাম, মনে থাকবে। বেনারসী মায়ের শুকনো মুখে একটু তৃপ্তির হাসি ফুটল। বললেন, মরবার আগে বড় শান্তি দিলি মা! আরেকটা কথা বলি। আমি মরলে তোর রংলাল চাচাকে তাড়িয়ে দিস নে যেন, যতদিন বাঁচবে দুটি খেতে দিস। কিন্তু আমার কসম, টাকা চাইলে কক্ষনো ওর হাতে দিবি নে।

এর মাসখানেক বাদেই বেনারসী মা মারা গেলেন। রইল রংলাল চাচা, ঝুলনিয়া আর রামু। তবু আমার জগৎটা হঠাৎ যেন ফাঁকা হয়ে গেল। আশ্চর্যের বিষয়, বদলে গেল রংলাল চাচাও। বেনারসী মাকে হারিয়ে সে যেন ফকির হলে গেল। নেশা করা ছেড়ে দিল, ছেড়ে দিল জুয়া খেলা। একা ঘরে বসে সারেঙ্গি নিয়ে তার দিন কাটতে লাগল। মাঝে মাঝে আমার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে তীর্থে ঘুরে আসত। সে তীর্থে গেলে বাড়িটা আরও ফাঁকা লাগত আমার। এক একদিন বেরিয়ে পড়তাম বাড়ি থেকে। এই সময় দেখা হয়ে গেল জয়প্রকাশ কাপুরের সঙ্গে আমিনাবাদ পার্কে। মাঝারি লম্বা, সবল সুপুরুষ চেহারা, তামাটে ফর্সা। ধূসর রঙের চোখের তারা দুটো সব সময় কৌতুকে ঝিকমিক করছে। কথা কইতে কইতে জোরে হেসে উঠল। সাজপোশাক ফ্যাশান—দুরন্ত। সব মিলিয়ে মেয়েদের আকর্ষণ করার পক্ষে যথেষ্ট। কথায় কথায় বেরিয়ে পড়ল সেও হিন্দু ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিল। বড় লোকের ছেলে, পড়া ছেড়ে এখন ব্যবসা করছে। কানপুরে সিল্কের ব্যবসা। প্রথম প্রথম আমাদের দেখা হত বাইরে বাইরে। আমিনাবাদ পার্ক, চিড়িয়াখানা, শাহনজফ। কখনো বা তার হোটেলে। আমার বাড়িতে নিয়ে যেতাম না, তাকে বাঈজীমহল্লায় নিয়ে যেতে লজ্জা হত।

সুমন বললে, সোহিনী বাঈয়ের মৃত্যুর পর লক্ষ্নৌ ছেড়ে ফৈজাবাদে যাওনি কেন?

চৈতি বললে, গোল—দরওয়াজার বাড়িতে বেনারসী মায়ের স্মৃতি জড়িয়ে ছিল। তাছাড়া ভেবেছিলাম, বিয়ে হলে আমাকে চলেই তো যেতে হবে। জয়প্রকাশকে পেয়ে আমার নীরস দিনগুলোর মাঝে রং ধরল। ভালোবাসা নয়, ভালো লাগল তাকে। মনে মনে বিশ্বাস হল, ওর ওপর সারা জীবন নির্ভর করা যায়। একদিন বলে ফেললাম আমার পরিচয়, আমার ঠিকানা। জয়প্রকাশ জোরে হেসে উঠল। বললে, তোমার আমার মাঝখানে বাঈজীপাড়াটা কি বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে ভয় করছ? আমাদের পরিচয়টা কি এতই ঠুনকো?

নিশ্চিন্ত হলাম। জয়প্রকাশ গোল—দরওয়াজার বাড়িতেই আসা যাওয়া করতে লাগল। একবার সে হাজার পাঁচেক টাকা আমার কাছে থেকে ধার নিল। ব্যবসার জন্যে হঠাৎ দরকার। কিন্তু সময় মতো দিতে পারল না। বললে, ব্যবসায় কিছু লোকসান হয়েছে, পরে দিয়ে দেব। সন্দেহ করিনি। কিছুদিন বাদে আবার তার টাকার দরকার হল। দিতে চাইলাম, নিল না। বললে, কিছু মনে কোরো না চৈতি। দান দিতে পারব না,তুমি যদি আমার স্ত্রী হও, তবেই তোমার টাকার ওপর আমার অধিকার থাকবে। জয়প্রকাশের কথাটা ভালো লাগল। বললাম, তোমার বাপ—মা’র মত নাও। সে বললে, তাঁদের অমত হবে না। কিন্তু তুমি কি পারবে আমায় ভালোবেসে সব দিয়ে দিতে? বললাম, যাকে ভালোবাসতে পারব, তাকে সব দিতে পারব না? জয়প্রকাশের চোখে কৌতুকের হাসি ঝিকিমিক করে উঠল। বললে, টাকার মায়া বড় মায়া! ভালোবাসার জন্যে সবাই কি তা ছাড়তে পারে? কেমন একটা জেদ চেপে গেল। জয়প্রকাশ কি আমাকে সন্দেহ করছে? বললাম, আমি পারি। বিশ্বাস না হয় তো কালই আমার অ্যাটর্নিকে ডেকে পাঠাই। কিন্তু তোমাদের বাড়িতে আমাকে নিয়ে যাবে কবে? জয়প্রকাশ বললে, আমি কালই কানপুর যাচ্ছি বিয়ের ব্যবস্থা করতে। দিন সাতেক বাদে ফিরব। একুশে জুলাই সন্ধ্যা নাগাদ এসে তোমাকে নিয়ে যাব! ইতিমধ্যে দানপত্র তৈরি করে রেখো।

সাতটা দিন আমার স্বপ্ন দেখে কেটে গেল। আমার ভবিষ্যৎ জীবনের ছবি এঁকে। আমার একমাত্র দায় ছিল রংলাল চাচা, সেও আমায় ছুটি দিলে। এলাহাবাদে গিয়েছিল সে। জয়প্রকাশ চলে যাবার একদিন বাদেই পুলিশ এসে আমায় খবর দিলে, প্রয়াগের সঙ্গমে গঙ্গার পাড় ভেঙে চাচাজি ভেসে গেছে। শুধু তার কালো ভেলভেটের টুপি, কোট আর নোটবই পাড়ের ওপর পড়ে থাকতে দেখা যায়। যাক, কোনো বাঁধনই আর রইল না।

একুশে জুলাই সকালে মনটা জয়প্রকাশের আশায় গুগগুনিয়ে উঠতে লাগল। কতক্ষণে সে আসবে! কতক্ষণে তার হাতে নিজেকে তুলে দেব! আমার কুমারীমনের সমস্ত মধু নিয়ে তার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। বিকেল থেকে মেঘ করে এল। ঝোড়ো হাওয়া দিতে লাগল। সন্ধে নাগাদ শুরু হয়ে গেল মুষলধারে বৃষ্টি আর ঝড়ের দাপাদাপি। আমার সব আশায় যেন ছাই পড়ল। তবু রামুকে বললাম, নিচে সদর খুলে রাখতে। যদি বৃষ্টি ধরে যায়, যদি সে আসে। যত্ন করে সেজেছিলাম, খুলতে গিয়েও খুললাম না। কিন্তু সাতটা বাজল, আটটা বাজল, ন’টা বেজে গেল, কেউ এল না। না জয়প্রকাশ, না আর একজন।

সুমন বললে, আর একজন কে?

কালু। এক অন্ধ ভিখিরি। রোজ সন্ধে হলে আসত ভিক্ষে করতে। কিছু টাকা আর গরম কাপড় চেয়েছিল সে। আমি কানপুরে চলে যাব বলে তাকে সেদিন আসতে বলেছিলাম। কিন্তু সেও এল না। ঝুলনিয়া গিয়েছিল তার ননদের বাড়ি, ভয়ানক একা লাগছিল। মাইফিল—ঘরে এসে গ্রামোফোন মেশিনে অতুল প্রসাদের গানের রেকর্ডখানা চাপিয়ে দিলাম। ‘আমিও একাকী, তুমিও একাকী, আজি এ বাদল রাতে।’ শুনতে শুনতে মনে হল, আমার জীবনে এত বড় সত্যি আর নেই। বৃষ্টি তখনও পড়ছে, মাইফিল—ঘরের পর্দাগুলো দুলছে ঝোড়ো হাওয়ায়। এমন সময় জয়প্রকাশ এল। রাত তখন দশটা। সমস্ত শূন্যতা আমার এক নিমেষে ভরে গেল। বললাম, এই দুর্যোগ মাথায় নিয়ে তুমি এলে!

হেসে জয়প্রকাশ বললে, তোমার কাছে আসতে কোনো বাধাই আমি মানি না। শোনো, কালই আমরা কানপুর যাচ্ছি। বাবা—মা তোমার কথা শুনে খুব খুশি হয়েছে। তুমি খুশি হয়েছ তো?

একটা মিষ্টি লজ্জার আবেশে আমি চুপ করে রইলাম। জয়প্রকাশ বললে, আমার কাজ আমি করেছি, তোমার কাজ তুমি করেছ কি?

বললাম, করেছি। আমার অ্যাটর্নি এসেছিলেন, আমার এক লাখ তিরিশ হাজার টাকা আর এই বাড়িখানা তোমার নামেই লিখে দিয়েছি। বসবার ঘরের টেবিলের ড্রয়ার থেকে দানপত্রখানা বার করে এনে বললাম, শুধু সইটা করিনি—তোমার সামনে করব বলে!

জয়প্রকাশ চুপ হয়ে গেল। বললাম, তোমার কলমটা দাও।

একটা কথা বললে না জয়প্রকাশ, নীরবে কলমটা আমার হাতে দিলে। একটা কৌচের ওপর কাগজখানায় আমি সই করতে বসলাম। সইটা পুরো হয়নি, হঠাৎ আমার হাত থেকে কলমটা কেড়ে নিল সে। চেয়ে দেখি, তার হাসিমাখা মুখখানা কেমন কালো হয়ে গেছে।

অবাক হয়ে বললাম, একি!

জয়প্রকাশ দলিলখানাও তুলে নিয়ে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলল। তারপর বললে, না, এ আমি পারব না। শোনো চৈতি, আমি তোমাকে এতদিন মিথ্যে বলেছি। আমার ব্যবসা নেই, বাড়ি নেই, কানপুরে এক ভাই ছাড়া বাপ—মাও নেই। আমি মাতাল লম্পট, জোচ্চচুরিই আমার পেশা। কিন্তু হাজার হোক ভদ্রবংশের রক্ত গায়ে আছে তো, তাই বোধ হয় তোমার মতো নিতান্ত সরল একটা বোকা মেয়েকে ঠকাতে আমার বাধল। সেজন্যে অবশ্য তোমার ধন্যবাদ চাই না। তার বদলে শ’খানেক টাকা দাও, আমি চলি।

বললাম, দাঁড়াও!

টেবিলের ড্রয়ার থেকে টাকার বদলে যা নিয়ে এলাম, সেটা দেখে জয়প্রকাশের মুখ শুকিয়ে গেল। তবু জোর করে হেসে বললে, রিভলভার কেন? নাটক শুরু করলে নাকি?

মাথায় আমার আগুন জ্বলছিল। রিভলভারের মুখটা তার দিকে ফিরিয়ে বললাম, নাটকটা তুমিই শুরু করেছ। কিন্তু শেষটা বোধ হয় ভেবে দেখোনি। আমি সরল, আমি বোকা, তাই বলে একটা কুমারী মেয়ের বিশ্বাস নিয়ে ছিনিমিনি খেলার সাজা কি জানো?

ভয় পেয়ে জয়প্রকাশ বললে, দোষ আমার একার নয় চৈতি। একজন আমায় মতলব দিয়েছিল; বলেছিল, তোমার সম্পত্তি বাগাতে পারলে আধাআধি বখরা।

কে সে?

নাম বলতে মানা।

মিথ্যে কথা!

বিশ্বাস করো চৈতি!

তাহলে বলো, সে কে? বলো বলছি—নইলে কুকুরের মতো গুলি করে মারব!

ছুটে পালাতে গিয়ে জয়প্রকাশ নর্তকীর মূর্তিটার কাছে থেমে গেল। ঢোক গিলে বললে, মেরো না, বলছি। তাঁর নাম—

কথা শেষ হল না। আমার রিভলভার থেকে আচমকা খানিকটা আগুন ছিটকে বেরোল। যন্ত্রণায় কাতরে উঠে জয়প্রকাশ দু—হাতে বুক চেপে ধরল, তারপর হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়ে গেল জাজিমের ওপর। আমি যেন পাথর হয়ে গেলাম। অসাড় হাত থেকে খসে পড়ল অস্ত্রটা। কেমন করে জানি না দপ করে নিভে গেল সব বাতি। দড়াম করে খুলে গেল একটা দরজা, ঝোড়ো হাওয়া ঘরে ঢুকে যেন হায় করে উঠল। সেই অন্ধকারে হঠাৎ আমায় পেয়ে বসল একটা ভয়। বরফের মতো ঠাণ্ডা একটা ভয়। আমি খুন করেছি! আর, ভয় পাবার সঙ্গে সঙ্গেই আমার অসাড় ভাবটা কেটে গেল। আমার ঘর—বাড়ি ফেলে, জয়প্রকাশের মৃতদেহ ফেলে, আমার অতীত জীবন ফেলে, সেই দুর্যোগের অন্ধকারে আমি পালিয়ে গেলাম। তখন শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছিল, আমি খুন করেছি! আমি খুনি!

দু’হাতে মুখ ঢেকে চৈতি পাখরের বেঞ্চের ওপর ভেঙে পড়ল। আর কপালে কয়েকটা চিন্তার রেখা নিয়ে স্থাণুর মতো বসে রইল সুমন। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হল। চৈতির পিঠে হাত রেখে সুমন বললে, একটা কথা বলে যাই, পুলিশের কাছে তুমি বোলো না যে, তুমি খুন করেছ। এটা আমার অনুরোধ।

উঠে বসল চৈতি। বললে, এর পরেও কি তুমি আমায় বাঁচাতে চেষ্টা করবে?

করব।

কিন্তু তোমার সব চেষ্টার পরেও যদি না বাঁচি?

এক মুহূর্ত চুপ করে রইল সুমন। সেই বিষণ্ণ সন্ধ্যায় তার যৌবন মথিত করে হঠাৎ জেগে উঠল একটা আশ্চর্য অদম্য পিপাসা। গোলমাল হয়ে গেল মনের হিসেব। চৈতির চোখের জলে ধোয়া ফ্যাকাশে মুখখানা দু’হাতে বুকে চেপে তার কানে কানে বললে, তাহলেও তুমি আমার জীবনে বেঁচে থাকবে।

তারপর চৈতিকে ছেড়ে দিয়ে ছাদ থেকে নেমে গেল সুমন। নামতে নামতে মনে পড়ল ডক্টর কেশকারের কথা, পথটা হচ্ছে রেজার্স এজ—ক্ষুরের ফলার মতো সূক্ষ্ম! একটু অসতর্ক হলেই হয় চৈতির পতন, নয় তোমার পতন!

.

সেদিন অনেক ঘুরে অনেক রাত করে বাড়ি ফিরল সুমন। জ্যাকসন সাহেবের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল, গেল না।

লাইব্রেরি—ঘরে পা দিতেই টেলিফোন বেজে উঠল। জ্যাকসন সাহেব বললেন, হ্যালো সুমন, এলে না কেন? ব্যস্ত আছ নিশ্চয়? ডক্টর কেশকার বলছেন, আসামি চৈতি বাঈ এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। এর বাহুদুরিটা অবশ্য তোমরাই পাওনা। আমি কোর্টে কেস চালান দিচ্ছি।