চৈতি বাঈয়ের মামলা – ৩

তিন

বারাবাঁকির এই বাড়িটায় মোগল স্থাপত্যশিল্পের চিহ্ন আগাগোড়াই বর্তমান। এককালে নাকি এটা কোনো এক নবাবজাদার অন্যতম প্রমোদভবন ছিল।

দো—মহল বাড়ি। বারমহলের মাথাটা গম্বুজাকৃতি, অন্দরমহলের মাথায় ছাদ। রংবেরঙের পাথর—বসানো থাম, সূক্ষ্ম জালিকাটা জাফরি, উঁচু খিলান মুসলমানী রুচির পরিচয় দেয়। বাড়ির চারপাশ ঘিরে অনেকখানি বাগান, ফুল—ফলের গাছ, ফোয়ারা, পরীদের মূর্তি। যত্নের অভাবে বাগান হয়েছে এখন জঙ্গল, ফোয়ারার উচ্ছ্বাস স্তব্ধ, হাত—পা—ভাঙা পাথরের পরীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এখন বোধ হয় নবাব—হারেমের সেই জ্যান্ত পরীদের খোঁজে।

লাল কাঁকরের রাস্তা দিয়ে হিলম্যান ঢুকে এল। লোহার ফটকের পাশে সাদা পোশাক পুলিশকে জ্যাকসন সাহেবের সই—করা কার্ড দেখাতে হয়েছে।

বারান্দায় কফির পেয়ালা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন ডক্টর কেশকার। সুমনকে দেখে বললেন, সুপ্রভাত!

সুপ্রভাত ডক্টর!

বারান্দায় উঠে এল সুমন। বেতের চেয়ারে বসল। এই দ্বিতীয় দিন তার এখানে আসা।

কেশকার বললেন, গত কয়েকদিন ধরে এখানে তোমায় আশা করছি।

সুমন বললে, অন্য কেস নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। কেমন বুঝছেন রোগীকে?

বারাবাঁকিতে আসার পর থেকে ওর সেই উগ্র আতঙ্কটা কেটে গেছে। আঘাত—পাওয়া নার্ভগুলোও অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। কিন্তু পূর্বস্মৃতি এখনো অস্পষ্ট। একটা ঠাণ্ডা নীরবতা ওকে ঘিরে আছে সর্বদা।

কারণটা অনুমান করেছেন কি?

সাধারণত দেখা যায় যেসব যুবক—যুবতী একটু বেশি রোমান্টিক প্রকৃতির, প্রেমের ব্যাপারে ঘা খেলে তাদের এই অবস্থা হয়। একটা বিষণ্ণ হতাশা তাদের পেয়ে বসে। হয়তো চৈতি বাঈয়ের জীবনেও কোনো রোমান্টিক ফ্রাস্ট্রেশন, যাকে বলে প্রণয়ঘটিত ব্যর্থতা, লুকিয়ে আছে। আর, তারই ফলে ওর মনটা ক্রমশ ঠাণ্ডা কঠিন বরফের স্তূপে পরিণত হয়ে গেছে।

সুমন চিন্তিত মুখে বললে, কিন্তু ডিফেন্স কাউন্সেল হিসেবে চৈতি বাঈয়ের সব কথা ওর মুখ থেকেই আমাকে জানতে হবে। কেননা, সর্বদাই ওর পাশে ছিল, সেই সোহিনী বাঈ আজ বেঁচে নেই।

বার দুয়েক মাথা নেড়ে কেশকার বললেন, জানতে হলে কোনো অভিজ্ঞান চাই, যা দেখলে ওর পূর্বস্মৃতি ফিরে আসতে পারে। কিন্তু তাতেও হবে না—ইউ মাস্ট ব্রেক দি আইস! কঠিন বরফ ভাঙতে হবে।

কেমন করে?

খোঁজ—খবর নিয়ে আগে জানতে হবে চৈতির জীবনে সত্যিই কোনো প্রেমের ঘটনা ঘটেছিল কিনা। তা যদি থাকে, তবে সেই পথ ধরে এগিয়ে যাওয়াই ভালো।

আরেকটু স্পষ্ট করে বলুন ডক্টর।

স্পষ্ট করেই বলছি। তোমাকে চৈতির প্রেমিক সাজতে হবে। ভালোবাসার অভিনয় করে আস্তে আস্তে ওর কাছে এগোতে হবে। তোমার প্রেমের উত্তাপে হয়তো একদিন গলতে শুরু হবে কঠিন বরফ—খুলে যাবে ওর মনের বন্ধ দরজা। কিন্তু—

ফরাসি ধাঁচের ছোট্ট দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে কেশকার বলেলেন, কিন্তু এ কাজে ঝুঁকি অনেক। পথটা হচ্ছে রেজার্স এজ—ক্ষুরের ফলার মতো অতি সূক্ষ্ম। একটু এদিক—ওদিক হলেই হয় তোমার পতন হবে, নয় চৈতির পতন। এখন ভেবে দেখো কি করবে। আমি চলি। গুড ডে চৌধুরি!

সুমন নীরবে দাঁড়িয়ে উঠে ডক্টরকে বিদায় দিলে।

একটু বাদে কফির পেয়ালা নিতে এল ঝুলনিয়া। জ্যাকসন সাহেব চৈতির পুরোনো আয়াকেই কাজে বহাল করেছেন। মোটাসোটা মধ্যযৌবনা বিহারী মেয়ে। হাতে পায়ে চিবুকে উলকি, নাকে মাকড়ি।

সুমনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে আগের দিন।

ঝুলনিয়া বললে, ভকিলসাব এসেছেন! কফি আনব?

সুমন বললে, না। তোমার মনিবের সঙ্গে দেখা করব।

খবর দিচ্ছি।

চলে যাচ্ছিল ঝুলনিয়া। সুমন ডাকলে, শোনো, ভেতরে গিয়ে কি বলবে?

বলব ভকিলসাব এসেছেন।

না, বলবে চৌধুরিসাব এসেছেন। আমি ভকিল, বাঈ যেন তা জানতে না পারে।

জী আচ্ছা।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ফিরে এল ঝুলনিয়া। বললে, আসুন।

বারমহল পার হয়ে একটা শ্বেতপাথরের চত্বর। তারপর অন্দরমহলের দরজা। একদিন হয়তো খোজা প্রহরী দাঁড়িয়ে খাকত, এখন দরোয়ানের পোশাকে পুলিশ টুলে বসে থাকে। ঝুলনিয়া সুমনকে নিয়ে এল অন্দরমহলের শেষপ্রান্তে, যেখানে জাফরি ঢাকা একটা গোল বারান্দা ঝুঁকে আছে একটা মজা পদ্মদিঘির ওপর।

জাফরির পাশে পিছন ফিরে দাঁড়িয়েছিল চৈতি। টুকরো টুকরো রোদের সোনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে তার গায়ে মুখে। মজে যাওয়া দিঘিটায় এখনো দু—একটা লাল পদ্ম ফোটে; চৈতি বোধ হয় তাই দেখছিল। পিঠে লতিয়ে পড়ে আছে রুক্ষ চুলের বেণী।

ঝুলনিয়া ডাকলে, ছোটি বাঈ!

ফিরে তাকাল চৈতি।

ফিরে তাকাল চৈতি। সকালের আলোয় সুমন আজ ভাল করে দেখতে পেল তাকে। এখানে প্রথম দিন এসেও সে দেখা করেনি। শান্ত উদাসিনী মূর্তি। প্রভাতকালেই যেন গোধূলির ছায়া নেমেছে। ভৈরবী গাইতে বসে কে যেন ধরেছে পুরিয়া—ধানেশ্রী। ধূসর রঙের শাড়িটা করুণ বিষাদের মতো জড়িয়ে আছে দেহটাকে। ভাসা ভাসা দুই কালো চোখে এখানো কিশোরকালের সরলতা। ভালো করেই দেখলে সুমন। না, গোল—দরওয়াজার বাঈজির মুখে ম্লানিমা ছাড়া কালিমার এতটুকু চিহ্ন কোথাও নেই। আশ্চর্য, এ মেয়ে খুন করতে পারে! হয়তো পারে। ক্রিমিনাল বার—এর ব্যারিস্টার সুমন চৌধুরি তার স্বল্প অভিজ্ঞতায় জেনেছে দুনিয়ায় অসম্ভব কিছুই নয়।

সুমনকে পৌঁছে দিয়ে ঝুলনিয়া চলে গেল।

ভয় ঘনিয়ে এল চৈতির চোখে। আস্তে আস্তে উর্দুতে জিজ্ঞেস করলে, আপনি পুলিশের লোক?

অল্প হেসে উর্দুতেই জবাব দিলে সুমন, না, না, আমি পুলিশের লোক নই। আমি সুমন চৌধুরি। তোমার সঙ্গে আলাপ করতে এলাম। চিনতে পারছ না আমাকে? মনে করে দেখো তো কোথায় দেখা হয়েছিল।

চৈতি ভাবতে চেষ্টা করলে। কিন্তু চোখের দৃষ্টি বদলাল না।

সুমন বলতে লাগল, চন্দনচৌকিতে সেই ছোট্ট পাহাড়ি বস্তি— তার পাশে উঁচু পাহাড়—তুমি ছুটে গেলে খাদের মুখে—ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিলে, আমি তোমায় ধরে ফেললাম! মনে পড়ছে না? বলো তো সে—পাহাড়টার নাম কি?

ভাসা ভাসা দুই কালো চোখের অন্ধকারে ধীরে ধীরে স্মৃতির আলো ফুটে উঠল। মৃদু স্বরে চৈতি বললে, গোধূলিয়া পাহাড়।

ঠিক!—খুশি হয়ে উঠল সুমন। পূর্বস্মৃতি একেবারে অস্পষ্ট হয়নি তাহলে! একটা মোড়া দেখিয়ে বললে, বোসো। নিজেও বসলে। তারপর প্রশ্ন করলে, আচ্ছা গোধূলিয়া পাহাড় থেকে খাদে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিলে কেন?

আমার কেবল ভয় হত পুলিশে ধরবে—ফাঁসি দেবে!

কেমন এমন ভয় হত?

শিশুর মতো সরল মুখে জবাব দিলে চৈতি, তা তো মনে নেই।

তোমার বাড়ি কোথায়?

এই তো।

আগে কোথায় ছিলে?

আগে? এইখানে।

এইখানে? না, লক্ষ্নৌ শহরে থাকতে? মনে করে দেখো তো, গোল—দরওয়াজা—সোহিনী বাঈ—রংলাল—তুমি গান গাইতে নাচতে—

চুপ করে চেয়ে রইল চৈতি। স্মৃতির সাদা কাগজে একটি আঁচড়ও পড়ল না।

বন্ধ দরজায় আর একবার ঘা দিতে চেষ্টা করলে সুমন। বলল, জয়প্রকাশকে মনে আছে? জয়প্রকাশ কাপুর—যাকে তুমি ভালোবাসতে—মনে পড়ছে?

চৈতি শুধু মাথা নাড়লে বার দুই। উদাসীন মুখে—চোখে কোনো ভাবান্তর হল না। সতর্ক চোখে তাকাল সুমন। ডক্টর কেশকারের কথাই ঠিক, মেয়েটা ভান করছে?

অন্য কথায় চলে গেল সুমন।

কেমন লাগছে এ জায়গাটা? বেশ নির্জন, না?

বড় একা লাগে।

তোমার আপনজনেরা কোথায়?

ক্লান্ত উদাস গলায় চৈতি বললে, আপনজন? কেউ নেই।

আস্তে আস্তে মোড়া থেকে উঠে আবার জাফরির পাশে গিয়ে দাঁড়াল। চেয়ে রইল মজা দিঘির নিঃসঙ্গ লাল পদ্মটার দিকে।

সুমনও উঠল। নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়াল চৈতির পিছনে। তারপর পরিষ্কার বাংলায় হঠাৎ মৃদু গলায় ডেকে উঠল, শান্তিলতা, শোনো।

অবাক হয়ে ফিরে তাকাল চৈতি। বললে, আপনি বাঙালি?

হাসিমুখে ঘাড় নাড়লে সুমন।

শান্তিলতা কার নাম?—চৈতি প্রশ্ন করলে।

তোমার নাম।

আমার!

হ্যাঁ, তোমারি নাম। এ নাম শোননি কখনো? মনে করে দেখো তো—অনেকদিন আগে—তুমি যখন ছোট্ট ছিলে—সেই ফৈজাবাদ—বাপ মা ছোট বোন—মনে পড়ছে না? তোমার সমস্ত অতীত খুঁজে দেখো, কে তোমায় আদর করে ডাকত শান্তি! শান্তিলতা!

ভাসা ভাসা দুই কালো চোখের অন্ধকারে একটু আলো ফুটতে না ফুটতে আবার মিলিয়ে গেল। বিচলিত হয়ে উঠল চৈতি। আকাশের মতো অনন্ত শূন্যতায় তার অতীতকে যেন হাতড়ে ফিরছে। কাঁপা কাঁপা ঠোঁট নেড়ে আপন মনে বলতে লাগল, শান্তি! শান্তিলতা! মনে পড়ছে—কে যেন ডাকত আমায়—কিন্তু—না, না, আর মনে পড়ছে না—কিছুতেই মনে পড়ছে না—হারিয়ে গেছে—আমার অতীত হারিয়ে গেছে!

বলতে বলতে আবার মোড়ায় এসে বসে পড়ল চৈতি। দুই হাঁটুর ওপর মুখ গুঁজে হু হু করে কেঁদে উঠল। অতিপ্রিয় খেলনা হারিয়ে গেলে শিশু যেমন করে কেঁদে ফেলে।

কয়েক মুহূর্ত তাকে কাঁদতে দিল সুমন। হোক খুনি, হোক অপরাধী, মানুষ কত অসহায়! কেমন একটা মমতায় ভিজে উঠল তার মন। আলগোছে তার মাথায় হাত রেখে ডাকলে, শান্তিলতা, ওঠো।

কান্না—ভেজা মুখ তুলে তাকাল চৈতি।

স্নিগ্ধ স্বরে সুমন বললে, মন খারাপ কোরো না, তোমার হারানো অতীতকে আজ না হয় একদিন তুমি খুঁজে পাবেই। খুঁজতে আমি তোমার সাহায্য করব। আবার আসব।

চলে যাচ্ছিল সুমন; পিছন থেকে ডাক এল, শুনুন!

সুমন ফিরে দাঁড়াল।

কাছে গিয়ে চৈতি বললে, এখানে তো কেউ আসে না, আপনি কেন এলেন?

ডক্টর কেশকারের নির্দেশিত পথে প্রথম পা বাড়ালে সুমন। হাসিমুখে বললে, সেই গোধূলিয়া পাহাড়ে দেখা অবধি তোমাকে আমার ভাল লেগেছে। আমি তোমার বন্ধু হতে চাই।

দক্ষিণ হাতখানা বাড়িয়ে দিলে সুমন। হাস্যোজ্জল মুখে চেয়ে রইল চৈতির মুখের দিকে। কান্না—ভেজা ফ্যাকাশে মুখে একটু আলো লাগল। নুয়ে পড়ল ভাসা ভাসা চোখের দৃষ্টি। সুমন অনুভব করলে, তার ডান হাতের মুঠোয় ভিজে ভিজে নরম একখানা করতল আশ্রয় নিয়েছে। কাঁপছে ভীরু পাখির মতো। মৃদু চাপ দিয়ে সুমন ছেড়ে দিলে হাতখানি।

তারপর চলে গেল গোল বারান্দা পার হয়ে। চৈতি তখন নিজের হাতখানির দিকে তাকিয়ে আছে।

.

রাজু বললেন, বহুৎ আচ্ছা! নাটকের দোসরা অ্যাক্ট তাহলে শুরু হয়েছে বল!

সুমন বললে, দুর! ডক্টর কেশকার বলেছেন চৈতির সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করতে, যাতে আমাকে বিশ্বাস করে ও সব কথা খুলে বলে। তাই বারাবাঁকিতে রোজ যাই।

একটা সিগারেট ধরিয়ে রাজু বললে, ডক্টর কেশকার নাটকের প্লটকে জমিয়ে তুলছে দেখছি! কেয়াবাৎ! চাঁদনি রাতে ফুলগাছ—তলায় গানটান গাইছিস নাকি তোরা?

হেসে ফেলল সুমন। বললে, তামাশা রাখ।

প্রেম করা তামাশা নয় ইয়ার, আমাসা! এ ব্যাধিতে একবার ধরলে সহজে সারে না। তখনই বলেছিলাম, পয়লা অ্যাক্টে হিরোইন মরতে যাচ্ছিল, দোসরা অ্যাক্টে হিরো মরতে যাবে। হলও তাই। নাট্যকার রাজু রিয়েল নাট্যকার!

চটে গিয়ে সুমন বললে, দুত্তোর নাট্যকার! আমি মরছি কেস নিয়ে মাথা ঘামিয়ে, আর তুই বানাচ্ছিস নাটক! আসল কথাটা শোন না—

ধোঁয়া ছেড়ে রাজু বললে, শুনব আর কি বল! মন নিয়ে খেলা আর আগুন নিয়ে খেলা একই। সাবধান ইয়ার, মনের মানিব্যাগটা তোর সামলে রাখিস, মনের পকেট মারতে মেয়েজাতটা ওস্তাদ!

তোর মনের পকেট মারা গেছে বুঝি?

ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে রাজু বললে, মনের পকেট জামার পকেট দুই—ই!

সুমন আবার হেসে উঠল। তারপর হাসি থামিয়ে বললে, ঠাট্টা রাখ। ডক্টর কেশকার কি বলেছেন জানিস? কোনো অভিজ্ঞান দেখালে চৈতি বাঈয়ের পূর্বস্মৃতি হয়তো সহজে ফিরে আসতে পারে। কিন্তু কী সেই অভিজ্ঞান? পাবই বা কোথায়?

রাজু একটু ভেবে বললে, ঠিক হয়েছে চল, বাজারে গিয়ে রুই মাছগুলোর পেট চিরে দেখা যাক। দু—একটা আংটি হয়তো বেরিয়ে পড়তে পারে।

সুমন ভাবনায় অন্যমনস্ক হয়ে রইল। এক সময় বললে, সন্ধের পর একবার আসিস।

কেন?

কিছু ভাল লাগছে না। গান—বাজনা শুনতে ইচ্ছে করছে।

এ আর বেশি কথা কি! লক্ষ্নৌ শহরে গান—বাজনার অভাব? ওস্তাদ রহিমবক্সের ওখানে চ।

না। গান যদি শুনতে হয় তো সুন্দর মুখ থেকেই শুনব। কি বলিস? গোল—দরওয়াজায় গেলে কেমন হয়?

ফুর্তিতে রাজু শিস দিয়ে উঠল।

.

প্রবেশপথের মুখে একটা সার্কেল আছে বলেই বোধ করি নাম হয়েছে গোল—দরওয়াজা। কিন্তু নাট্যকার রাজু বলে, এখানে যারা বাস করে, তারা এক একটি জ্যান্ত গণ্ডগোল, তাই পাড়াটার নাম গোলদরওয়াজা।

দিল্লির চৌড়ি বাজার বলো, আর বেনারসের ডালকামুণ্ডি বলো বা লক্ষ্নৌর গোল—দরওয়াজাই বলো—সব বাঈজীপট্টিরই চেহারা মোটামুটি এক। কিছু পান—জর্দা—আতরের দোকান, কিছু গুণ্ডা—বদমাসদের জটলা, কিছু শখবাজ কাপ্তেনদের আনাগোনা।

রাত এগারোটা। জমে উঠেছে রাতের বাজার। শুরু হয়েছে রূপের সওদা। বাঈজীপট্টির রাস্তায় একটি চেনা মূর্তি দেখা গেল। ঢ্যাঙা রোগাটে দেহ, চুড়িদার পায়জামা, কল্কাদার পাঞ্জাবি, ঝাঁকড়া মাথায় আদ্দির বাঁকা টুপি। নাট্যকার রাজু! পাশে তার যে বলিষ্ঠ সুদর্শন ছোকরাটি চলেছে, তার মুখে নকল গোঁফ আর চোখে কালো চশমা না থাকলে একনজরেই সুমন চৌধুরি বলে চেনা যেত।

সোহিনী বাঈয়ের বাড়ির কাছাকাছি এসে দেখা গেল দরজায় পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। কালো চশমার ভেতর দিয়ে সুমন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল সোহিনীর বাড়িটা। একপাশে একটা গলি, অপরপাশে গায়ে—লাগা আরেকটা বাড়ি।

সুমন বললে, পাশের বাড়িটায় কে থাকে জানিস?

খবর চাই?

চাই।

রাস্তার উল্টো দিকে একটা আতরের দোকান। রাজু সেইদিকে এগোল।

মির্জা আতরওয়ালা পুরোনো খরিদ্দার দেখে খুশিতে তরমুজের বিচির মতো একসারি কালো দাঁত বের করে ফেললে।

ম্যয়নে ক্যহা আদাবরজ হ্যায় রাজুসাহাব! কি ভাগ্যি আমার। বহুৎদিন বাদে জনাবের দেখা মিলল। গোল—দরওয়াজা ধন্য হয়ে গেল আজ! আসুন, আসতে আজ্ঞা হয়!

সুমনকে টেনে রাজু মির্জার ছোট একফালি দোকানের একধারে চেপে বসল।

দুনিয়ার হালচাল কেমন মির্জা?

মির্জা বললে, চলে যাচ্ছে কোনোরকমে। তা হুুজুর, ঠেটর তুলে দিলেন, আর খুলবেন না?

খুলব বৈকি!—রাজু বললে, পরলোকে বাপের কাছে টেলিগ্রাম করেছি, কিছু ক্যাশ পাঠিয়ে দিলেই আবার থিয়েটার খুলব।

মির্জা কি বুঝল সেই জানে। খাতির করে বললে, হুজুরকে লিয়ে পান মাঙউ?

মাঙাও।

পাশের পানের দোকানে মির্জা ফরমাইশ করলে। তারপর বললে, গান—বাজনা শুনবেন নাকি হুজুর?

মির্জা আতরওয়ালার আরেকটি পেশা আছে। বাঈজীর দালালি।

সুমনকে দেখিয়ে রাজু বললে, আমার এই দোস্ত পাটনা থেকে গান শুনতেই তো এসেছে। কিন্তু যার গান শুনতে চায়, সে তো এখন খুনের দায়ে ফাটকে!

মির্জা বললে, চৈতি বাঈয়ের কথা বলছেন? সে থাকলেও তার গান শুনতে পেতেন কিনা সন্দেহ।

কেন?

চৈতি বাঈ বড় একটা মুজরো করত না। ভারি খেয়ালি মেয়ে ছিল কিনা। কত আমির লোককে নিয়ে গেছি, চৈতি ফিরিয়ে দিয়েছে। কেবল কাপুর সাহাব গেলে—

কাপুর সাহাবাটি কে?

জয়প্রকাশ কাপুর। রহিশ আদমি। চৈতি খুব প্যার করত তাকে।

বড় তাজ্জব তো! যে যাকে প্যার করে, তাকে সে খুন করতে পারে?

মির্জা বললে, কি জানেন হুজুর, চৈতির মেজাজটা ভারি রগচটা। আমি ওকে আতর বেচতাম, জিনিসের একটু ফারাক হলেই আতরের শিশি ও ভেঙে চুরমার করে দিত।

সুমন চুপচাপ শুনছিল; হঠাৎ প্রশ্ন করলে, আচ্ছা মির্জাসাহেব, খুনটা কি রাগের মাথায় চৈতি বাঈ করেছে? না, আর কোনো কারণ ছিল?

মির্জা চট করে একবার এদিক—ওদিক তাকিয়ে দেখল। ফিসফিস করে বলল, গরিব আতরওয়ালা আমি, আমি কেমন করে জানব হুজুর? বাঈ—পাড়ায় অমন এক—আধটা খুন—খারাবি হয়েই থাকে।

সুমন প্রসঙ্গ পাল্টাল। বললে যেতে দাও ও—কথা। চৈতি বাঈ ছাড়া ভালো গাওয়াইয়া এ—পাড়ায় আর কে আছে?

আছে বইকি হুজুর। মোতি বাঈ আছে, আনোয়ারা বাঈ আছে—বহুৎ আচ্ছা গায়!

চৈতি বাঈয়ের মতো?

ঝুট বলব না হুজুর। চৈতি বাঈ বুলবুল ছিল, বুলবুল!

রাজুকে কনুয়ের একটা মৃদু ঠেলা দিলে সুমন। যেন হঠাৎ মনে পড়ে গেল এইভাবে। রাজু বললে, আচ্ছা, শুনেছি, সোহিনীর বাড়ির ঠিক পাশে যে বাঈ থাকে, সে বেশ ভালোই গায়! কি যেন নামটা—

নুরী বেগম। কিন্তু ও তো তেমন ভালো গাইতে পারে না হুজুর! তবে বয়সটা কম বটে, দেখতেও খুবসুরত।

সুভানাল্লা! বয়স কম, আবার দেখতেও খুবসুরত। নুরী বেগম জিন্দাবাদ!—সোল্লাসে বলে উঠল রাজু।

একখানা দশ টাকার নোট মির্জার হাতে গুঁজে দিয়ে সুমন বললে, চলো মিঞা।

মির্জার পুরু ঠোঁটের ফাঁকে তরমুজের কালো বিচির সারি আরেকবার বেরিয়ে পড়ল। সেলাম ঠুকে বলল, গোলাম তৈয়ার। চলুন।

সুমন আর রাজু দোকান থেকে বেরোতে গিয়ে থমকে গেল। অদ্ভুত এক চেহারা নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল দোকানের সামনে। লোকটার বয়স বোঝা মুশকিল, পরনে শতচ্ছিন্ন কালো আলখাল্লা, একমাথা রুক্ষ চুল, মুখে পাতলা দাড়ি। আর চোখের কটারঙের তারা দুটো স্থির, বাঁ হাতে একটা বাঁকা লাঠি, ডান হাতে একটা টিনের পাত্র

মির্জা একটা পয়সা টিনের পাত্রে ফেলে দিতেই লাঠি ঠকঠকিয়ে লোকটা চলে গেল।

সুমন প্রশ্ন করলে, কে?

মির্জা বললে, ও কালু। চোখ নেই, তাই ভিখ মেগে খায়।

রাত বারোটায় ভিক্ষে।

দিনের বেলা শহরে ভিখ মাগে, আর রাতে বাঈ—পাড়ায়।— আসুন হুজুর।

চলতে চলতে মির্জার অলক্ষে সুমন নিজের মাথার পাটকরা চুল এলোমেলো করে দিলে।

.

 ‘লট উলঝি সুলঝা যা রে বালম,

 হাঁথমে মেহেদি ল্যগী।”

নুরী বেগম গান ধরেছে। আর, গাইতে গাইতে মাজাঘষা গোল মুখে আর সুর্মাটানা ঈষৎ ট্যারা চোখে ভাও বাতাচ্ছে মারাত্মক। রাজুর পাশে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে, হুইস্কির গেলাস হাতে নিয়ে, শুনতে শুনতে আর দেখতে দেখতে সুমনের হাসি পাচ্ছিল। হোয়াইট লেবেলের বোতল সামনে রেখে রাজুর কিন্তু মাথা নাড়ার বিমার নেই।

নুরী বেগম গাইছে :

.

 ‘মাথেকি বিঁদিয়া বিখর গ্যয়ী হ্যায়,

 আপনা হাঁথ ল্যগা যা রে বালম,

 হাঁথমে মেহেদি ল্যগী।’

কপালের টিপ আমার মুছে গেছে, ও বালম, তুই নিজের হাতে টিপ পরিয়ে দিয়ে যা। কি করব, হাতে আমার মেহেদির রং লেগেছে।

হাতের হুইস্কির গেলাসটা সুমন সবার অগোচরে পাশের পিকদানে উপুড় করে ঢেলে দিলে। তারপর রাজুর কানে কানে কি যেন বলে মাইফিলের আসর ছেড়ে উঠে টলতে টলতে বারান্দায় বেরিয়ে গেল।

গান থামিয়ে দিলে নুরী বেগম। বললে, আপনার দোস্ত উঠে গেলেন যে! গান পছন্দ হচ্ছে না?

জিত কেটে রাজু বলে উঠল তোবা! তোবা! তোমার গান পছন্দ হবে না, এও কি একটা কথা হল বাঈজী! কি হয়েছে জানো? আমার দোস্ত বেশি নেশা করে ফেলেছে কিনা, তাই বারান্দায় গেছে একটু হাওয়া খেতে। এই এলো বলে! নাও, তুমি আরেকখানা ধরো। কী মিঠি আওয়াজ তোমার বাঈজী! শুনলে মরে যেতে ইচ্ছে করে!

ফিক করে হেসে ফেললে নুরী বেগম। তারপর সুর্মাটানা ট্যারা চোখে দারুণ কটাক্ষ হেনে দ্বিতীয় গান ধরলে :

.

 ‘না মারো রে সইয়াঁ চিতুওনকে বাণ—’

 রাজু বললে, সুভানাল্লা!

.

বারান্দায় বেরিয়ে এল সুমন।

টিমটিম করে একটা বাতি জ্বলছে। এদিক—ওদিক কেউ কোথাও নেই। বারান্দার কোণে ছাদে ওঠার সিঁড়ি। নিঃশব্দে উঠে গেল সুমন।

ছাদে উঠে দেখল, একটাই ছাদ, মাঝে নিচু পাঁচিল দিয়ে দু—ভাগ করা। আধখানা নুরী বেগমের, আধখানা সোহিনী বাঈয়ের। অনায়াসে পাঁচিল টপকে সুমন ও—ছাদে চলে গেল। তারপর টর্চের আলোয় সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল দোতলায়।

জনহীন বাড়িটা কবরের মতো ঠাণ্ডা নিঝুম। অথচ আশপাশের বাড়িগুলো জীবনের স্পন্দনে ভরপুর! সুমন ভাবলে, বাঈজিদের দুনিয়া এই! আজ আলো, কাল অন্ধকার!

টানা বারান্দার পাশে ঘরগুলো তালাবন্ধ। সিঁড়ির মুখেই মাইফিল—ঘর। সুমন এসে দাঁড়াল সেই ঘরের সামনে। বড় হলঘর, বড় বড় দরজা—জানালা সবই বন্ধ। পকেট থেকে মাস্টার কী বের করে তালা খুলে ফেললে। তারপর ঘরে ঢুকে টর্চের আলোয় সুইচ খুঁজে টিপে দিলে। জ্বলে উঠল বেলোয়ারি ঝাড়ের বাতিগুলো। খোলা দরজার কপাট দুটো ভেজিয়ে দিলে সুমন। ঘরের আলো বাইরে না যায়। তারপর চারপাশে তাকাল।

বাইরে থেকে বাড়িটাকে দেখতে যেমন পুরোনো হতশ্রী, ভেতরটা তেমন নয়। প্রাচুর্যের সঙ্গে রুচিরও পরিচয় পাওয়া যায়।

প্রথমেই চোখে পড়ে হলের একধারে মানুষ—প্রমাণ সাইজের একটি মার্বেল পাথরের নর্তকী—মূর্তি। অপরূপ গঠনসৌকর্য দেখে মনে হয় ফরাসি বা ইতালীয় শিল্পীর হাতে তৈরি। সারা ঘরটা ফিকে সবুজ রং করা। বড় বড় আর্শি, দামি নেটের পর্দা, কয়েকখানা গদিওয়ালা কৌচ আর শ্বেতপাথরের টেবিল দিয়ে সাজানো। কৌচগুলোর ওপর ধুলোর আস্তরণ, একটা টেবিলের ওপর কাচের চৌবাচ্চচায় লাল মাছ। মরে গেছে। মেঝের অধিকাংশ জুড়ে পুরু ফরাস, তার ওপর ধুলোয় ধূসর কাশ্মীরি জাজিম। একপাশে রঙিন ছিটের ঢাকার মধ্যে একটা সারেঙ্গি, একটা তম্বুরা আর গোটাকয়েক বাঁয়া—তবলা, ছাউনিগুলো অব্যবহারে ফেটে গেছে।

ফরাসের একটা জায়গায় সুমনের চোখ পড়ল। জাজিমের ওপর অনেকখানি কালো ছাপ। জয়প্রকাশ কাপুরের শুকনো রক্তের দাও!

চোখ সরিয়ে নিল সুমন। মাইফিল—ঘরের এক প্রান্তে একটা ছোট ঘর। মাঝখানে দরজা নেই, তার বদলে চওড়া একটা খিলান, দু—পাশে জাফরি—কাটা দেয়াল। বোধ হয় বাঈজিদের বিশ্রামের জন্য। অথবা বিশেষ অতিথিদের আরামের জন্য। ও—ঘরটাও দেখা যাক।

খিলান পার হয়েই থেমে গেল সুমন। দাঁড়িয়ে রইল নিশ্বাস রোধ করে। মাইফিল—ঘরের ঝাড়বাতির উজ্জল আলো খানিকটা এ—ঘরেও এসে পড়েছে। সেই আলোয় সুমন দেখলে সামনের দেয়ালের ব্যাকেট থেকে ঘন নীল ভেলভেটের পর্দা ঝুলছে, তারই নিচে একজোড়া পা! ট্রাউজার আর জরিদার কাবুলি চপ্পল পরা পুরুষের পা!

সুমন আসার আগেই আর কেউ এখানে এসেছে তাহলে! আর, আর সুমনের সাড়া পেয়ে লুকিয়েছে পর্দার পেছনে। কিন্তু কে ও? পুলিশ নয় নিশ্চয়। তারা এলে লুকিয়ে আসবে কেন? তবে কি গোয়েন্দা? কে নিযুক্ত করল? না, কোনো চোর—ছ্যাঁচোড়? যেই হোক, মিত্র সে নয়।

কি করবে এখন সুমন? থাকবে, না যাবে? ধরবে, না ধরা পড়বে? কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সে ইতিকর্তব্য স্থির করে নিলে। ট্রাউজারের পকেট থেকে অটোমেটিক অস্ত্রটা চলে এল ডান হাতের মুঠোয়। তারপর বাঁ হাতে ভেলভেটের পর্দাটা ধরে সহসা টান মারলে একপাশে। পেতলের রিং লাগানো পর্দা শব্দ করে সরে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে হাসি ফুটে উঠল সুমনের মুখে।

কেউ না। প্রকাণ্ড আর্শির গায়ে তার নিজেরই প্রতিবিম্ব। পর্দার নিচে নিজেরই জরিদার কাবুলি চপ্পলের প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছিল। এতক্ষণ নিজেই তাহলে কৌতুক করছিল নিজের সঙ্গে!

চারপাশে তাকিয়ে মনে হল, ছোট ঘরটা কারো নিজস্ব বসবার ঘর। ডিভানের মতো একটা বসবার জায়গা, বেতের একটা আরাম কেদারা, একটা দেরাজওয়ালা লেখবার টেবিল ছাড়া আর আসবাবের বাহুল্য নেই। টেবিলের ওপর কলমদান, একটা রাইটিং প্যাড, একটা নৌকাকৃতি রিডিং ল্যাম্প, খানকতক উর্দু কবিতাগ্রন্থ, তার মধ্যে আবার অতুলপ্রসাদের বাংলা গানের বই! উর্দু কাব্যের বইগুলোর মলাট খুলতেই দেখা গেল হিন্দিতে লেখা :

 প্যারী চৈতিকে

 জয়প্রকাশ

শুধু অতুলপ্রসাদের গানের বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় বাংলা মেয়েলি হরফে লেখা ‘শান্তিলতা’।

টেবিলের ড্রয়ারটা টানলে সুমন। ভেতরে খানদুয়েক ব্যাঙ্কের চেকবই। চেকের কাউন্টার পার্টগুলো সুমন দেখতে লাগল। বেশির ভাগ চেকই রংলালের নামে ইসু করা। কখনো দুশো, কখনো পাঁচশো, একখানা দু’হাজার টাকার। চেকবই ছাড়া ছোটখাটো ফোটো অ্যালবাম একখানা রয়েছে। দ্রুতহাতে ছবিগুলো উল্টে গেল সুমন। তারপর কি ভেবে নিজের কোটের মধ্যে অ্যালবামখানা লুকিয়ে ফেলল।

ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে নজরে পড়ল একটা স্ট্যান্ডের ওপর ডালা খোলা একটা গ্রামোফোন মেশিন। একখানা রেকর্ড চাপানো, তার ওপর সাউন্ডবক্স নামানো, গান শেষ হবার পরেও তোলা হয়নি। রেকর্ডখানা তুলে নিয়ে দেখলে সুমন। হিন্দি ঠুংরি বা গজল নয়, অতুলপ্রসাদের বহুশ্রুত বাংলা গান—

 বঁধুয়া, দিন নাহি আঁখি পাতে।

 আমিও একাকী, তুমিও একাকী

 আজি এ বাদল রাতে।।

হয়তো একুশে জুলাই—এর সেই বাদলা রাতে চৈতি এই রেকর্ডখানা শুনছিল। জয়প্রকাশ আসার আগে। তারপর রিভলভারের আওয়াজে চাপা পড়ে গিয়েছিল গান।

রেকর্ডখানাও কোটের ভেতরে লুকিয়ে রাখলে সুমন। তারপর আবার এসে দাঁড়াল মাইফিল—ঘরে। আর কিছু দেখবার নেই এখানে। কিন্তু সত্যিই কি দেখবার নেই কিছু?

সুমনের সন্ধানী দৃষ্টি আর একবার সারা ঘরটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করতে লাগল। এক জায়গায় এসে তার সঞ্চরমান দৃষ্টি থেমে গেল। লাল মোজেইক—করা মেঝের ওপর একটা সাদা বস্তু পড়ে আছে। কুড়িয়ে নিলে সুমন। মার্বেল পাথরের তৈরি নিখুঁত দুটি আঙুল—অনামিকা আর কনিষ্ঠা!

সুমন একবার নর্তকীমূর্তির দিকে তাকালে, তারপর আঙুল দুটি নর্তকীর লীলায়িত বাঁ হাতের ভাঙা জায়গায় বসিয়ে দিতেই বেমালুম খাপ খেয়ে গেল।

কিন্তু ভাঙল কেন? কবে ভাঙল? একুশে জুলাই রাতে কি? তা নইলে আঙুল দুটো আজো মেঝেয় পড়ে থাকবে কেন? আগে ভাঙলে নিশ্চয় সযত্নে তুলে রাখা হত, অথবা যথাস্থানে জুড়ে দেওয়া হত।

একুশে জুলাই রাতে চৈতি বাঈয়ের হাতে গুলি খেয়ে জয়প্রকাশ মরেছে, কিন্তু ফরাসি নর্তকীর হাতের আঙুল ভাঙল কেন?

কারণটা যাই হোক, এখন ফেরা যাক। হাতঘড়িটা দেখলে সুমন। ফিরতে আরও দেরি হলে নুরি বেগম কি ভাববে কে জানে। বাতি নিভিয়ে অন্ধকার বারান্দায় বেরিয়ে এল সে। দরজা আবার তালাবন্ধ করে দিলে।

.

নুরী বেগম তখনো গাইছে :

 ‘না মারো, না মারো রাজা

 চিতুওনকা বাণ—’

আর, সুর্মাটানা ট্যারা চোখের বাণ খেয়ে খেয়ে নাট্যকার রাজুর হৃদয়টা একেবারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। হোয়াইট লেবেলের বোতলটাও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে!

বহুৎ আচ্ছ! বহুৎ আচ্ছা!

তারিফ করতে করতে সুমন ঘরে ঢুকল।

নুরী বেগম বললে, কোথায় গিয়েছিলেন?

বারান্দায় হাওয়া খাচ্ছিলাম, আর তোমার গান শুনছিলাম বেগম।

কই, আমার চাকর তো আপনাকে দেখতে পেল না!

সুমন একটু থতিয়ে গিয়ে বললে, অন্ধকারে দাঁড়িয়েছিলাম কিনা, তাই। আচ্ছা বেগম, পাশের বাড়িটায় ভূতটুত আছে নাকি?

শুনে আঁতকে উঠল নুরী বেগম। বললে, এ কী বলছেন!

বারান্দায় দাঁড়িয়ে হঠাৎ যেন রিভলভারের আওয়াজ আর চিৎকার শুনতে পেলাম পাশের বাড়ি থেকে।

জোর করে অবিশ্বাসের হাসি হাসলে বেগম। বললে, না, না, ও তোমার নেশার খেয়াল!

আরে বা!—সুমন বললে, তামাম লক্ষ্নৌ শহর তো জানে চৈতি বাঈ জয়প্রকাশকে গুলি করেই খুন করেছে। তুমি কোনো আওয়াজ শোনোনি?

কিসের?

হল্লা আর গুলির আওয়াজ!

হল্লা শুনতে পাইনি, তবে দুটো গুলির আওয়াজ শুনেছিলাম বটে।

দুটো?

সুমনের নকল ঢুলুঢুলু চোখ দুটো হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠল।

দুটোই তো মনে হল। কি জানি, ঝড়—জলের রাতে ভালো করে শুনতে পাইনি।—ছেড়ে দাও ও—কথা, জিন’কে আমার বড্ড ভয়।

রাজু বললে, ভয় কি বাঈজি? তোমার ওই সুর্মা—লাগানো চোখের তীর খেলে জিন তো জিন, জিনের চোদ্দপুরুষও আর বাঁচবে না।

হাতঘড়িটা আবার দেখলে সুমন। ওয়ালেট থেকে খানকয়েক দশ টাকার নোট বের করে সামনের ট্রের ওপর রেখে বললে, চলি বেগম।

আর গান শুনবে না?

আজ থাক! রাত হয়েছে।

.

রাত সত্যিই হয়েছে।

গোল—দরওয়াজার মুখে সার্কেলের কাছে দাঁড়িয়েছিল সুমনের হিলম্যান। চকের দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকটা অন্ধকার নির্জন।

নুরী বেগমের বাড়ি থেকে হেঁটে এল সুমন ও রাজু।

রাজু বললে, তুই কি ব্যারিস্টারি ছেড়ে গোয়েন্দগিরি ধরলি ইয়ার?

চাবি দিযে গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে সুমন জবাব দিলে, দরকার হলে ব্যারিস্টারকেও গোয়েন্দাগিরি করতে হয়।

কিন্তু চৈতি বাঈয়ের বাড়ি যদি গেলি তো লুকিয়ে গেলি কেন? পুলিশের পারমিশান নিয়ে সোজা রাস্তায় গেলেই পারতিস।

সব সময় সোজা রাস্তা দিয়ে গেলেই ঠিক জায়গায় পৌঁছানো যায় না রাজু।—কে?

একটা ধরা গলার আওয়াজ অন্ধকারের ভেতর থেকে এগিয়ে এল, আল্লার নামে কিছু দান করো!

সেই অন্ধ ভিখিরিটা! গায়ে সেই কালো আলখাল্লা কটারঙের চোখে স্থির তারা! রাত আড়াইটের সময়ও ভিক্ষে করছে! ভিক্ষে করছে, না পিছু নিয়েছে?

গাড়িতে উঠতে গিয়ে থেমে গেল সুমন। পকেট থেকে কিছু খুচরো পয়সা বের করে প্রসারিত হাতের টিনের পাত্রে ফেলে দিলে।

লাঠি ঠকঠকিয়ে চলে গেল লোকটা। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল সুমন। ভারি অদ্ভুত ভিখিরি তো!

তারপর গাড়িতে স্টার্ট দিলে।